০৪. ব্যাপারটা পরে জানা যায়

ব্যাপারটা পরে জানা যায়-আগের দিন অর্থাৎ শুক্রবারের সন্ধ্যার ঘটনা।

পরের দিন শনিবার, মানদা সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ চা নিয়ে এসে দরজা ঠেলে দেখে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ।

প্রথমে ডাকাডাকি করে মানদা, পরে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে, কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে মালঞ্চর কোন সাড়া পাওয়া যায় না। মানদা ভয় পেয়ে রতনকে ডেকে আনে। দুজনে তখন আরো জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দেয় আর চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করে, তবু কোন সাড়া নেই

মানদা ভয় পেয়ে গিয়েছে তখন রীতিমত। কাঁপা কাঁপা গলায় রতনকে বলল, ব্যাপার কি বল তো রতন?।

ঠিক ঐ সময় সিঁড়িতে স্যান্ডেলের শব্দ পাওয়া গেল।

মানদা বলল, এ সময় কে এলো আবার?

মালঞ্চর স্বামী সুশান্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলো। মাথার চুল রুক্ষ, একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনের প্যান্ট আর শার্টটা আরো ময়লা হয়ে গিয়েছে।

মানদা সুশান্তকে দেখে বলে, বাবু, মা ঘরের দরজা খুলছে না।

—খুলবেও না আর কোন দিন—

—সে কি বাবু! কি বলছেন আপনি।

—আমি জানি, শেষ হয়ে গেছে—আমি চললাম-থানায় খবর দাও—তারাই এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকবে—বলে যেমন একটু আগে এসেছিল সুশান্ত, তেমনি ভাবেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

সুশান্ত কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

ঘণ্টা দুই পরে থানার অফিসার নীচের ঘরে ঢুকে দেখতে পেয়েছিলেন তজোপোষের ওপর সুশান্ত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

সুশান্ত কথাগুলো বলে যাবার পর রতন কিছুক্ষণ ঘরের সামনে বারান্দাতে দাঁড়িয়েই থাকে, তারপর মানদার দিকে কেমন যেন বিহুল বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মানদাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তারও মুখে কোন কথা নেই।

কিছুক্ষণ পর রতনের যেন বিহুলতাটা কাটে। সে বলে, তুই কোথাও যাস নে মানদা, আমি থানাতে চললাম

—থানায়, কেন রে?

–কি বোকা রে তুই। সত্যিই যদি মা মারা পড়ে থাকেন তাহলে ঘরের দরজা ভেঙে কি আমরা খুনের দায়ে পড়ব?

—খুন! অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে মানদা।

–কে জানে! হতেও তো পারে! কাল এগোরাটা পর্যন্ত যে মানুষটা বেঁচে ছিল হঠাৎ সে যদি রাত্রে ঘরের মধ্যে মরে পড়ে থাকে। উঁহু বাবা, আমার ভাল ঠেকছে না। নিশ্চয়ই কোন গোলমাল আছে—আমি চললাম থানায় খবর দিতে—বলতে বলতে রতন সিঁড়ির দিকে এগুলো।

—এই রতন, আমাকেও তাহলে তোর সঙ্গে নিয়ে চ-মানদা চেঁচিয়ে ওঠে।

–আমাকে সঙ্গে নে! মানদাকে খিচিয়ে উঠল রতন, তুই কচি খুকীটি নাকি!

—মাইরি বলছি কতন, আমি এর কিছু জানি না।

–জানিস না তো থানার লোক এসে যখন জিজ্ঞাসা করবে তখন তাই বলবি।

—আমি কাল রাত এগারোটার সময় যখন নীচে চলে যাই মা তখন চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। জলজ্যান্ত মানুষটা

–তাহলে তাই বলবি, আমি আসছি—বলে রতন সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল।

 

স্থানীয় থানার দারোগা সুশীল চক্রবর্তীর বয়স খুব বেশী নয়, বছর চল্লিশেক হবে। রতনের মুখে সংবাদটা পেয়েই জনা-দুই সেপাই সঙ্গে নিয়ে তিনি হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে চলে এলেন।

মানদা তখনও বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে। একটা অজ্ঞাত ভয় যেন মানদাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

সুশীল চক্রবর্তী মানদাকে দেখিয়ে রতনকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কে?

—আজ্ঞে বাবু, ও এই বাড়িব ঝি, মানা।

—হুঁ। কোন্ দরজা?

–ঐ যে দেখুন না–

—সুশীল চক্রবর্তী দরজাটা একবার ঠেললেন—দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। জোরে জোরে দরজার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা দিলেন—ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

—বিক্রম সিং!

—জি হুজুর!

–দরজা ভেঙে ফেল।

কিন্তু ঘরের দরজা ভাঙা অত সহজ হল না। মজবুজ কাঠের দরজা, দরজার গায়ে ইয়েল লক সিস্টেম। অনেক কষ্টে প্রায় আধ-ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পর বিক্রম সিং আর হরদয়াল উপাধ্যায় দরজাটা ভেঙে ফেলল।

ঘরের মধ্যে ঢুকেই সুশীল চক্রবর্তী থমকে দাঁড়ালেন।

ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে তখনো, সব জানলা বন্ধ। মালঞ্চ চেয়ারের ওপর বসে—মাথাটা ঈষৎ বুকের ওপর ঝুঁকে আছে, আর হাত-পাঁচেক দূর থেকেই সুশীল চক্রবর্তী স্পষ্ট দেখতে পেলেন, একটা পাকানো রুমাল মহিলাটির গলায় চেপে বসে আছে।

কিছুক্ষণ নিঃশব্দে উপবিষ্ট ঐ দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন সুশীলবাবু।

চোখ দুটো বিস্ফারিত, মুখটা ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে, এবং মুখের ভিতর থেকে জিহ্বাটা সামান্য বের হয়ে আছে। গায়ে হাত দিলেন—শরীর ঠাণ্ডা এবং শক্ত কাঠ। সুশীল চক্রবর্তীর বুঝতে কষ্ট হল না, মহিলাটি অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছেন।

মাথার কেশ বিপর্যস্ত কিছুটা। হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো। গলায় একটা সোনার হার, হাতে পাঁচগাছি করে বর্ফি প্যাটার্নের সোনার চুড়ি ঝকঝক করছে, কানে নীল পাথরের দুটো টাব। পরনে একটা জামদানী ঢাকাই শাড়ি, বুক পর্যন্ত ব্লাউজের বোতামগুলো ছেড়া, খালি পা—

হঠাৎ নজর পড়ল সুশীলবাবুর—ঘরময় কতকগুলো বড় বড় মুক্তো ছড়ানো, নীচু হয়ে মেঝে থেকে একটা মুক্তো তুলে নিয়ে হাতের পাতায় মুক্তোটা পরীক্ষা করলেন, একটা বড় মটরের দানার মত মুক্তোটা—ভিতর থেকে একটা নীলাভ দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। দামী সিংহলী মুক্তো মনে হয়।

স্পষ্ট বোঝা যায়, কেউ গলায় রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে ভদ্রমহিলাকে হত্যা করেছে। মানদা আর রতন ঢোকেনি, তারা বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সুশীল চক্রবর্তী ডাকলেন, ওহে রতন না কি তোমার নাম, ভিতরে এসো।

রতন প্রায় কাঁপতে কাঁপতে এসে ঘরে ঢুকল আর ঢুকেই গৃহকত্রীকে ঐ ভাবে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে অস্ফুট একটা ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল।

—এ কে?

—আজ্ঞে উনিই আমাদের মা, এই বাড়ির কর্ত্রী।

—তা তোমাদের বাবু—মানে কর্তাবাবু কই, তাকে ডাক তো একবার।

—বাবু তো এখানে থাকেন না আজ্ঞে।

–থাকেন না মানে?

—আজ্ঞে রেতের বেলায় থাকেন না। সন্ধ্যার পর আসেন আর রাত এগারোটা সোয়া এগারোটা নাগাদ চলে যান।

–দেখ বাপু, তোমার কথার তো আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবু এখানে থাকেন না—মানে তোমাদের গিন্নীমা একা একা এ বাড়িতে থাকেন?

—আজ্ঞে একা না, মানদা আর আমি থাকি, আর নীচের ঘরে একজন বাবু থাকেন।

—বাবু! কে বাবু?

—তা তো জানি না আজ্ঞে, উনি তিনদিন ছিলেন না, আজ সকালেই আবার ফিরে এসেছেন। তিনিই তো বললেন আজ্ঞে, আমাদের মা বেঁচে নেই, তিনি মরে গেছেন।

সুশীল চক্রবর্তীর কেমন যেন সব গোলমাল ঠেকে। এবং বুঝতে পারেন ব্যাপারটার মধ্যে সত্যিই গোলমাল আছে।

–যাকে ওরা এ বাড়ির মালিক বা বাবু বলছে—তিনি প্রত্যহ সন্ধ্যায় আসেন, আবার রাত্রি এগারোটা সোয়া এগারোটায় চলে যান, অথচ নীচে আর এক বাবু থাকে—মানে কি?

সুশীলবাবু প্রশ্ন করলেন, এ বাড়ির আসল মালিক কে?

আজ্ঞে বললাম তো, তিনি এখানে থাকেন না!

–তার নামটা জানো? কি নাম তার?

–আজ্ঞে শুনেছি সুরজিৎ ঘোষাল।

—আর নীচে যে বাবু থাকেন, তার নাম?

–তা তো জানি না।

—সে বাবুটি কে?

—তা জানি না।

—তবে তুমি জানলে কি করে যে এ বাড়ির আসল মালিক সুরজিৎ ঘোষাল।

—আজ্ঞে মানদার মুখে শুনেছি।

–ডাক তোমার মানদাকে। সুশীলবাবু বললেন।

–এই মানদা, ঘরে আয়, দারোগাবাবু কি শুধাচ্ছেন। রতন মানদাকে ডেকে আনল।

মানদা এসে ঘরে ঢুকল। একটু মোটার দিকে চেহারাটা, বয়সে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। মনে হয় মাথার চুল পরিপাটী করে আঁচড়ানোই ছিল, এখন একটু বিপর্যস্ত। পরনে একটা ভেলভেটপাড় মিলের মিহি শাড়ি, গলায় একগাছা সরু হার, হাতে সোনার রুলি। চোখমুখের চেহারাটা বেশ সুশ্রী।

-তোমার নাম মানদা?

—আজ্ঞে বাবু।

—ইনি তোমাদের গিন্নীমা?

–আজ্ঞে–কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মানদা। ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা নজরে পড়েছিল তার।

—তোমাদের কর্তাবাবুর সঙ্গে এর কি সম্পর্ক ছিল?

—আজ্ঞে ইনি সুরজিৎবাবুর বিয়ে করা ইস্ত্রী নন।

—বিয়ে করা স্ত্রী নন।

–আজ্ঞে না।

এবার সুশীলবাবু বুঝতে পারেন মহিলাটি সুরজিৎ ঘোষালের রক্ষিতা ছিল। বলেন, তার মানে উনি সুরজিৎবাবুর রক্ষিতা ছিলেন?

—হ্যাঁ।

—এঁর কোন আত্মীয়স্বজন আছে?

–আছে।

–কে?

—ওঁর স্বামী। স্বামী! কোথায় থাকেন তিনি? তাঁর নাম জানো?

–জানি, সুশান্তবাবু—এই বাড়িরই নীচের তলায় থাকেন।

–এখানেই থাকেন?

–হ্যাঁ।

—কোথায় তিনি?

—বোধ হয় নীচে।

–কাল রাত্রে বাড়ি ছিলেন সুশান্তবাবু?

–আজ্ঞে তিনদিন ছিলেন না, আজ সকালেই এসেছেন—

ব্যাপারটা সুশীল চক্রবর্তীর কাছে তখনো পরিষ্কার হয় না। সুশীল চক্রবর্তী আবার প্রশ্ন করলেন, সুরজিৎবাবু কি বোজ আসতেন এখানে?

—তা আসতেন বৈকি।

—আর ওঁর স্বামী?

—এই তো একটু আগে বনু, সে মানুষটার সঙ্গে এর কোন সম্পর্কই ছিল না।

–উনি ওপরে আসতেন না? .

-না। তবে মাঝে-মধ্যে টাকার দরকার হলে, মানে মদ খাবার পয়সা চাইতে আসতেন।

—কত দিন এ বাড়িতে আছ তুমি?

—তা বছর চারের বেশীই হবে। —আর উনি?

—উনি কতদিন এ বাড়িতে আছেন জানি না বাবু, তবে শুনেছি এই বাড়িটা সুরজিৎবাবুই ওঁকে কিনে দিয়েছিলেন।

—গ্যারেজে একটা গাড়ি দেখলাম—

–সুরজিৎবাবু গিন্নীমাকে ওটা কিনে দিয়েছিলেন।

–ড্রাইভার নেই?

–আজ্ঞে না, মা নিজেই গাড়ি চালাতেন।

–রতন কতদিন আছে?

–ও আমার মাস দুই পরে আসে। তার আগে এক বুড়ো ছিল—ভৈরব, সে কাজ ছেড়ে দেবার পর রতন আসে।

–সুরজিৎবাবু কোথায় থাকেন জানো?

–আজ্ঞে কোথায় থাকেন জানি না, তবে ফোন নাম্বারটা জানি।

সুশীল চক্রবর্তী মানদার কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে ঘরের কোণে দেওয়ালের ব্র্যাকেটের ওপরে রক্ষিত ফোনটার কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে নম্বর ডায়াল করলেন। একজন ভদ্রমহিলা ফোন ধরলেন।

—এটা কি সুরজিৎবাবুর বাড়ি?

–হ্যাঁ।

—তিনি বাড়িতে আছেন?

—আছেন, ঘুমোচ্ছন—আধ ঘণ্টা বাদে ফোন করবেন।

—তাকে একটিবার ডেকে দিন, আমার জরুরী দরকার।

–কে আপনি? কোথা থেকে বলছেন?

—আপনি কে কথা বলছেন?

—আমি তাঁর স্ত্রী।

—শুনুন, বিশেষ জরুরী দরকার, আমি পুলিস অফিসার—একবার তাকে ডেকে দিন।

একটু পরেই অন্য প্রান্ত থেকে ভারি গলা শোনা গেল। সুরজিৎ ঘোষাল বলছি!

—আমি বালিগঞ্জ থানার ও.সি. সুশীল চক্রবর্তী, আপনাদের হিন্দুস্থান রোডের বাড়ি থেকে বলছি, এখুনি একবার এখানে চলে আসুন।

–কি ব্যাপার?

—এ বাড়িতে একজন খুন হয়েছেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে আসুন। বলে সুশীল চক্রবর্তী ফোন রেখে দিলেন।

—ওঁর স্বামী নীচের ঘরে থাকেন বলছিলে না? সুশীলবাবু আবার মানদাকে প্রশ্ন করলেন।

–হ্যাঁ।

—চল তো নীচে।

একজন সেপাইকে ঘরের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখে সুশীল চক্রবর্তী মানদাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। বাড়িটি দোতলা, ওপরে তিনখানা ঘর, নীচেও তিনখানা ঘর, আর আছে দেড়তলায় একটা ঘর, তার নীচে গ্যারেজ।

সুশীলবাবু যখন ঘরে ঢুকলেন সুশান্ত তখন ঘুমে অচেতন।

সুশীল চক্রবর্তী একবার ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। একটা বেতের চেয়ার, একটা খাট। এক কোণে দড়ির আলনায় খানকয়েক ময়লা প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি ঝুলছে আর এক কোণে ছেড়া ময়লা কাবুলী চপ্পল, কাঁচের গ্লাস চাপা দেওয়া একটা জলের কুঁজো। লোকটা শার্ট আর প্যান্ট পরেই ঘুমোচ্ছে।

—শুনছেন, ও মশাই—

কয়েকবার ডাকেও ঘুম ভাঙল না, শেষ পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে সুশান্তর ঘুম ভাঙাতে হল। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সুশান্ত উঠে বসল, কে?

–আমি থানা থেকে আসছি, কি নাম আপনার?

–আমার নাম দিয়ে কি হবে আপনার?

—যা জিজ্ঞাসা করছি জবাব দিন-ধমকে উঠলেন সুশীল চক্রবর্তী, কি নাম বলুন?

–সুশান্ত মল্লিক।

—এ বাড়ি আপনার?

–আজ্ঞে না?

—তবে এ বাড়ি কার?

–কে জানে কার।

–জানেন না, অথচ এ বাড়িতে থাকেন, ভারি আশ্চর্য তো! সুরজিৎ ঘোষালকে চেনেন?

—চিনব না কেন?

–কে লোকটা?

—ওপরে গিয়ে মালঞ্চ দেবীকে শুধান না, তিনিই আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেবেন।

–মালঞ্চ দেবী কে?

হাসল সুশান্ত, বলল, সুরজিৎ ঘোষালের মেয়েমানুষ।

–আপনি কে হল মালঞ্চ দেবীর?

—কেউ না।

—মিথ্যে কথা বলছেন, মানদা বলছিল উনি আপনার স্ত্রী।

—বাজে কথা, আপনি নিজেই গিয়ে শুধান না ওকে।

–কাকে শুধাব–she is dead.

–তাহলে সত্যি সত্যিই she is dead! জানেন মশাই, ভেবেছিলাম আমিই ঐ মহৎ কর্মটি করব। অর্থাৎ একদিন হত্যা করব ওকে। কিন্তু তা আর হল না, দেখছি, মাঝখান থেকে হালটটাকে আর একজন এসে হত্যা করে গেল। However I am really glad it is don!

—আপনিও এই বাড়িতেই থাকেন?

–হ্যাঁ, মালঞ্চ দেবীর দয়ায়।

–এ বিষয়ে আপনি কিছু জানেন, মানে কে বা কারা তাকে হত্যা করতে পারে?

–না মশাই, আমি আদার ব্যাপারী, আমার জাহাজের সংবাদে কি প্রয়োজন। দেখুন স্যার, তিন রাত আমি ঘুমোইনি। ঘুমে শরীর আমার ভেঙে আসছে, Please, আমাকে একটু ঘুমোতে দিন। বলতে বলতে সুশান্তু আবার খাটের ওপর গা ঢেলে শুয়ে পড়ল।

ঠিক ঐ সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল। সুশীল চক্রবর্তী বাইরে এসে দেখলেন, সৌম্য, সুন্দর, হৃষ্টপুষ্ট এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বিরাট একটা ইমপোর্টেড কার থেকে নামছেন। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, পায়ে চঞ্চল।

সুশীল চক্রবর্তী এগিয়ে বললেন, আপনি বোধ হয় সুরজিৎ ঘোষাল?

-হ্যাঁ। ফোনে বলেছিলেন কে যেন খুন হয়েছে। রাতিমত উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ল সুরজিৎ ঘোষালের কণ্ঠে।

—হ্যাঁ, ওপরে চলুন মিঃ ঘোষাল। আসুন।

সুশীল চক্রবর্তীর পিছনে পিছনে ওপরে উঠে মালঞ্চর শয়নকক্ষে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন সুরজিৎ ঘোষাল, এ কি! মালা নেই!

–না মিঃ ঘোষাল, she is dead.

—সত্যি সত্যিই মৃত?

–হ্যাঁ  ঐ দেখুন, গলায় রুমাল পেঁচিয়ে ওঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।

–হত্যা করা হয়েছে!

–হ্যাঁ।

—কে–কে হত্যা করল?

—সেটা এখনো জানা যায়নি?

-মালঞ্চকে হত্যা করা হয়েছে! সুরজিৎ ঘোেষাল যেন কেমন বিমূঢ় অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকেন মালঞ্চর মৃতদেহটার দিকে।

—মিঃ ঘোষাল।

সুশীল চক্রবর্তীর ডাকে কেমন যেন বোবাদৃষ্টিতে সুরজিৎ তাকালেন তার মুখের দিকে।

—এ বাড়িটা কার? সুশীল চক্রবর্তীর প্রশ্ন।

–এই বাড়িটা—এটা—

—কার এ বাড়িটা? এ বাড়ির মালিক কে?

–ঐ মালঞ্চ।

—কিন্তু আপনিই এ বাড়িটা কিনে দিয়েছিলেন ঐ মালঞ্চ মল্লিককে, তাই নয় কি?

–কে বলল আপনাকে?

—আমি জেনেছি।

সুরজিৎ ঘোষাল বোবা।

—আর উনি আপনার keeping-য়ে ছিলেন, এটা কি সত্যি?

–হ্যাঁ-সুরজিৎ ঘোষাল কুণ্ঠার সঙ্গে মাথা নীচু করে বললেন।

—কত বছর উনি আপনার কাছে ছিলেন? সুশীল চক্রবর্তীর আবার প্রশ্ন।

—তা বোধ হয় বছর সাতেক হবে।

–Quite a long period, তা কখনও মনোমালিন্য বা ঝগড়া-টগড়া হয়নি। আপনাদের দুজনের মধ্যে?

—ঝগড়া? না। তবে ইদানীং কিছুদিন ধরে আমি ওর ওপরে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম। She was playing double role with me!

অন্য কোন পুরুষ?

—হ্যাঁ!

–কি নাম তার?

–দীপ্তেন ভৌমিক?

—তিনি বুঝি এখানে যাতায়াত করতেন?

—হুঁ এবং আমার অগোচরে।

—কথাটা কি করে জানতে পারলেন—if you dont mind মিঃ ঘোষাল!

–Somehow firt I smelt it. আমার কেমন সন্দেহ হয়–বুঝতেই পারছেন। I became alert—এবং ক্রমশ সবই জানতে পারি একটু একটু করে।

—আচ্ছা ঐ যে দীপ্তেন ভৌমিক, তিনি কি করেন, কোথায় থাকেন জানেন নিশ্চয়ই?

—হ্যাঁ, শুনেছিলাম তিনি বালিগঞ্জেই লেক রোডে থাকেন। বিলেত থেকে ম্যানেজমেন্ট কি সব পাস করে এসে বছর তিনেক হল একটা ফার্মে কাজ করছেন। মোটা মাইনে পান।

—তা দীপ্তেনবাবুর সঙ্গে মালঞ্চদেবীর আলাপ হল কী করে?

–বলতে পারেন আমারই নির্বুদ্ধিতায়।

–কি রকম?

—গত বছর আমরা পুরী বেড়াতে যাই, সেখানেই আলাপ।

–তার বাড়ির ঠিকানাটা জানেন?

—জানি।

সুরজিৎ ঘোষালের কাছ থেকে ঠিকানাটা শুনে সুশীল চক্রবর্তী লিখে নিলেন তার নোটবইয়ে।

–আচ্ছা মিঃ ঘোষাল, তিনি কি ভাড়াটে বাড়িতে থাকেন?

–না, ওটা একটা মাটি-স্টোরিড বিলডিংয়ের চারতলার ফ্ল্যাট, মনে হয় ফ্ল্যাটটা তিনি কিনেছেন।

বিক্রম সিং ঐ সময় একটা কাগজে করে কতকগুলো মুক্তো এনে সুশীল চক্রবর্তীর হাতে দিয়ে বলল, স্যার, ঘরের মধ্যে এই পঞ্চাশটা মুক্তো পাওয়া গিয়েছে। আর এই ছেড়া সিল্কের সুতোটা।

সুশীল চক্রবর্তী কাগজটা সবসমেত মুড়িয়ে পকেটে রেখে বললেন, আপনি কাল এখানে এসেছিলেন, মিঃ ঘোষাল?

—এসেছিলাম।

—কখন?

–রাত্রি সোয়া আটটা নাগাদ।

–তারপর কখন চলে যান?

–আধঘণ্টা পরেই।

—অত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন যে?

–কাজ ছিল একটা।

—আচ্ছা মালঞ্চদেবীর স্বামী তো এই বাড়িতেই থাকেন। আপনি কোন আপত্তি করেননি?

—না।

—আপনার সঙ্গে তার পরিচয় আছে?

–থাকবে না কেন–

—লোকটিকে কি রকম মনে হয়?

–Most non-interfering, শান্তশিষ্ট টাইপের মানুষ।

–Naturally!

—আমি কি এখন যেতে পারি মিঃ চক্রবর্তী?

—হ্যাঁ  পারেন, তবে আপনাকে আমার হয়তো পরে দরকার হতে পারে।

—সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর ফোন করলেই আপনি আমাকে বাড়িতে পাবেন। সুরজিৎ ঘোষালকে বিদায় দিয়ে রতনকে আবার ডাকলেন সুশীল চক্রবর্তী। প্রশ্ন করলেন—তোমার নাম রতন–কি?

–আজ্ঞে রতন সাঁপুই।

–তোমার দেশ কোথায়?

—মেদিনীপুর জেলায় আজ্ঞে—-পাঁশকুড়ায়।

–আচ্ছা রতন, ঐ সুরজিৎবাবু ছাড়া অন্য একজন বাবুও এখানে আসতেন, তাই?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, দীপ্তেনবাবু।

–কাল রাত্রে দীপ্তেনবাবু এসেছিলেন?

—হ্যাঁ, সন্ধ্যার মুখেই এসেছিলেন।

—কখন চলে গেলেন?

—আজ্ঞে কখন গিয়েছিলেন বলতে পারব না—তাকে আমি যেতে দেখিনি।

—হুঁ। আচ্ছা দীপ্তেনবাবু থাকতে থাকতেই কি সুরজিৎবাবু এসেছিলেন?

-হ্যাঁ।

—তাহলে তো দুজনে খাও হতে পারে—

—বলতে পারব না আজ্ঞে দেখা হয়েছিল কিনা—

—হুঁ। কাল কত রাত পর্যন্ত তুমি জেগে ছিলে?

—আজ্ঞে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, তাই সদরে তালা দিয়ে দশটা নাগাদ শুয়ে পড়েছিলাম। তারপরই ঘুমিয়ে পড়েছি।

–আজ সকালে কখন ঘুম ভাঙল?

–ভোর ছটা সাড়ে ছটায় মা চা খেতেন এবং মার হাতমুখ ধোয়া হয়ে গেলেই রান্নাঘরের বেলটা বেজে উঠত, তখন মানদা চা নিয়ে ওপরে যেত।

–এ বাড়িতে রান্নাবান্না কে করে, তুমি না মানদা?

—আজ্ঞে আমিই।

–তারপর বল–

–সাতটা বেজে যেতেও যখন বেল বাজল না তখন মানদা চা নিয়ে ওপরে যায়, তারপর তো যা ঘটেছে আপনি সব শুনেছেন।

—হুঁ। তোমার মাইনে কত–কত পেতে এখানে?

–আজ্ঞে একশো টাকা, তাছাড়া দু-তিন মাস পর পর জামাকাপড় পেতাম, মাঝেমধ্যে বকশিসও—

দীপ্তেনবাবু যে এখানে যাতায়াত করতেন সে কথাটা তুমিই বোধ হয় সুরজিৎবাবুকে জানিয়েছিলে?

ছিঃ বাবু, চুকলি কাটা আমার অভ্যাস নয়—এ ঐ মানদার কাজ। ঐ মানদাই বলেছে, বুঝলেন বাবু, নচেৎ সুরজিৎবাবু জানলেন কি করে, আর তাইতেই তো এই বিভ্রাট হল।

—তোমার ধারণা তাহলে দীপ্তেনবাবুর ব্যাপার নিয়েই —ঠিক জানি না বাবু, তবে আমার তো তাই মনে হয়।

—হুঁ। ঠিক আছে, যাও। মানদাকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও। আর শোন, এখন এ বাড়িতে পাহারা থাকবে, তুমি কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না।

-আজ্ঞে আমি তো ভেবেছিলাম আজই দেশে চলে যাব।

-না, এখন তোমার যাওয়া হবে না। পালাবার চেষ্টা করলে কিন্তু বিপদে পড়বে-বুঝেছ? যাও, মানদাকে পাঠিয়ে দাও–

মানদা এলো।

আর একবার মানদার আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলেন সুশীল চক্রবর্তী, তারপর জেরা শুরু করলেন।

—মানদা, কাল তোমার সুরজিৎবাবু কখন এখানে আসেন?

—তা ঠিক বলতে পারব না বাবু, ঘড়ি দেখিনি। তবে দীপ্তেনবাবু আসার ঘণ্টাখানেক পরেই বাবুর গাড়ি এসে থামে।

–দীপ্তেনবাবু তখন কোথায় ছিলেন?

-এই ঘরে।–তাহলে তোমার বাবুর সঙ্গে দীপ্তেনবাবুর কাল রাত্রে দেখা হয়েছিল বল?

–তা বলতে পারব না বাবু।

–কেন, দীপ্তেনবাবু তো তখন এই ঘরেই ছিলেন বলছ!

—ছিলেন, তবে দেখা হয়েছিল কিনা জানি না। কারণ পরে বাবু চেঁচামিচি করে যখন বের হয়ে গেলেন তখন ঘরে ঢুকে আমি দীপ্তেনবাবুকে দেখতে পাইনি।

–এ বাড়ি থেকে বেরুবার আর কোন দ্বিতীয় রাস্তা আছে?

—না তো।

—বলছিলে বাবু চেঁচামেচি করছিলেন—কেন চেঁচামেচি করছিলেন তা জানো?

–বোধ হয় ঐ দীপ্তেনবাবুর ব্যাপার নিয়েই–

-দীপ্তেনবাবু যে তোমার বাবুর অনুপস্থিতিতে এই বাড়িতে আসতেন তোমার বাবু জানলেন কি করে—তুমি বলেছিলে?

—আজ্ঞে না। মা আমাকে মানা করে দিয়েছিলেন, আমি বলতে যাব কেন?

–মিথ্যে কথা। সত্যি বল, তুমিই–মা কালীর দিব্বি বাবু, আমি চুকলি কাটিনি।

–তুমি মাইনে কত পেতে?

–দেড়শো টাকা।

–বল কি! তা মাইনেটা কে দিত?

–মা-ই দিতেন।

–হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পারো। আর একটা কথা শুনে রাখ, এ বাড়ি থেকে এখন তুমি বা রতন কেউ কোথাও বেরুবে না।

-বেশ, আপনি যা বলবেন তাই হবে।

–ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো।

মানদা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।