০৪. বিমলের অতর্কিত প্রশ্নটা

বিমলের অতর্কিত প্রশ্নটায় যেন সহসা ভূত দেখার মতই চমকে উঠলেন বৃন্দাবন সরকার। এবং কয়েকটা মুহূর্ত তাঁর কণ্ঠ দিয়ে একটি শব্দও বের হল না।

তারপর যেন আত্মগতভাবেই বললেন বৃন্দাবন, এ–এ আপনি কি বলছেন দারোগাবাবু?

বলছিলাম ওঁকে কেউ হত্যাও তত করে থাকতে পারে!

হত্যা? হাউ অ্যাবসার্ড? হাউ ইমপসিবিল! না, না-হত্যা তাঁকে কে করবে আর করতেই যা যাবে কেন?

আরে মশাই, কে করতে পারে সে তো পরের কথা। আপাততঃ সেদিকটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে বৈকি। কিন্তু যাক সে কথা। তার আগে কতকগুলো কথা আমার জানা প্রয়োজন।

কিন্তু–

শুনুন মিঃ সরকার, জানেন তো আমাদের পুলিসের মন বড় সন্দিগ্ধ, তাই অসম্ভবকে আমরা সম্ভব বলেই ধরে নিই। যাক যা জিজ্ঞাসা করছিলাম, গতকাল যখন আপনি এখানে ছিলেন আপনার কাকামশাইয়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার কথাবার্তা হয়েছে?

হ্যাঁ, তা হয়েছে বৈকি।

কি বিষয়ে আপনাদের কথাবার্তা হয়েছিল বলতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে—

আপত্তি থাকবে কেন? কথাবাতা গতকাল যা হয়েছে তা আমাদের ব্যবসা সম্পর্কেই। কারণ ঐ ব্যবসা সম্পর্কে কথাবার্তা বলতেই হপ্তায় অন্ততঃ দুবার করে এখানে আমাকে আসতে হচ্ছিল ইদানীং।

গতকাল আপনার কাকার কোন কথায় বা ব্যবহারে কোন চাঞ্চল্য ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন কি কোন সময়?

না কাকার প্রকৃতিই ছিল যেন সোবার, শান্ত। কখনও মনে পড়ে না, কোন কারণে কাকাকে জ্ঞানতঃ চঞ্চল বা উত্তেজিত হতে দেখেছি। অতি বড় আনন্দের ব্যাপারেও যেমন তাঁর উল্লাস ছিল না, তেমনি নিদারুণ ক্ষতি বা নিরানন্দের ব্যাপারেও তাঁকে কখনও তেমন ম্রিয়মাণ মুহ্যমান হতে দেখিনি বড় একটা।

হুঁ। আচ্ছা তার কোন শত্রু ছিল বলে জানেন?

শত্রু! না

এ বাড়িতে যেসব চাকরবাকর ও অন্যান্য যারা সব আছে তারাও কি, আপনি মনে করেন, বিয়ও অল সাসপিসন?

নিশ্চয়ই। সবাই তো অনেকদিনের পুরনো লোক, একমাত্র শকুন্তলা ছাড়া।

শকুন্তলা! হুঁ ইজ সি?

কাকার পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্ট সে। কাকার লেখাপড়ার কাজ করে দেওয়া, তাঁকে বই পড়ে শোনানো ইত্যাদির ব্যাপারে মাস-আষ্টেক হল কাকা তাকে অ্যাপয়েন্ট করেছিলেন।

হুঁ। তাঁর সঙ্গেও কথাবার্তা বলতে চাই।

ডেকে আনব?

না, একটু পরে। একটা কথা মিঃ সরকার, কাল রাত্রে সর্বশেষ কখন আপনার কাকামশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়?

কাকা সাধারণতঃ একটু রাত করেই শুতেন, কারণ—

থামলেন কেন, বলুন?

অনেকদিন থেকে হার্টের প্যালপিটেশনে ভুগছিলেন, তারপর ইদানীং মাসকয়েক থেকে শুনছিলাম তিনি এক নতুন উপসর্গ ইনসমনিয়াতেও ভুগছিলেন নাকি।

নিদ্রাহীনতার আর হৃৎপিণ্ডের দৌর্বল্য?

হ্যাঁ।

সেজন্য কোন ঔষধপত্র খেতেন কি?

মধ্যে মধ্যে শুনেছি কোরামিন আর ইদানীং ডাক্তারের পরামর্শে ঘুমের জন্য লুমিনল ট্যাবলেট খেতেন। শকুন্তলা দেবীই একদিন আমাকে বলছিল কথাটা।

কোন ডাক্তার তাঁকে দেখতেন?

কলকাতার ডাঃ আর. এন. চৌধুরীই বরাবর তাঁকে দেখতেন। হপ্তায় একবার তিনি এখানে আসতেন।

হুঁ। আচ্ছা তারপর যা বলছিলেন বলুন গতরাত্রের কথা।

চিরদিনই আমার একটু সকাল সকাল সোওয়া অভ্যাস। রাত দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ি আমি। কিন্তু কাকার সঙ্গে তাঁর ঘরেই বসে গতরাত্রে জরুরী ব্যবসা-সংক্রান্ত কতকগুলো আলোচনা করতে করতে কাল শুতে আমার প্রায় পৌনে এগারোটা হয়ে গিয়েছিল।

সারদাবাবুর ঘরে আপনি কাল কত রাত পর্যন্ত ছিলেন মনে আছে?

রাত এগারোটা বাজলে আমি উঠি।

হুঁ। তাহলে রাত এগারোটায় শেষ আপনি গতকাল তাঁকে জীবিত দেখেছিলেন?

হ্যাঁ। আজ সকালে কখন জানলেন যে উনি মৃত?

দশরথই এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে সংবাদটা দেয়।

ও, দশরথই তাহলে সর্বপ্রথম এ বাড়িতে আজ দেখেছে—জানতে পেরেছে যে আপনার কাকামশাই মৃত!

না।

তবে?

সর্বপ্রথম জানতে পারে ব্যাপারটা শকুন্তলাই।

শকুন্তলা? আই সি। তা তিনি কখন জানতে পারেন?

খুব ভোরে। শকুন্তলা কাকার ঘরে গিয়েই—

কিন্তু অত ভোরে সে ঘরে কেন তিনি গিয়েছিলেন?

কাকার বাগানে নানা জাতের সব রেয়ার গোলাপ আছে, সেই গোলাপের গাছেরই কি সব সার সম্পর্কে শকুন্তলা নাকি গতকাল দুপুরে কি একটা সারের সম্পর্কে বই থেকে পড়ে কাকাকে বলেছিল, তাই কাকা বলেছিলেন শকুন্তলাকে আজ খুব ভোরে তাঁর সঙ্গে বাগানে যাবার জন্যে যখন তিনি যাবেন। তাই বোধ হয় শকুন্তলা কাকার ঘরে গিয়েছিল তাঁকে ডাকতেই।

আই সি। আচ্ছা এই শকুন্তলা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা মিঃ সরকার?

নো নো-সি ইজ অ্যাবসলুটলি বিয়ও অল সাসপিসন। সি ইজ এ পারফেক্ট লেডি।

ঠিক আছে। আপনি এবারে অনুগ্রহ করে শকুন্তলা দেবীকে এ ঘরে যদি একটু পাঠিয়ে দেন মিঃ সরকার! তাঁকেও আমার কিছু প্রশ্ন করবার আছে।

নিশ্চয়ই, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি-বলে বৃন্দাবন সরকার সোফা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তখুনি।

বৃন্দাবন সরকার ঘর ছেড়ে চলে যেতেই মৃদুকণ্ঠে এতক্ষণে সুশান্ত কথা বলে, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস বিমল?

কি? বিমল সুশান্তর মুখের দিকে তাকালো।

কাকার অ্যাটেনডেন্ট অথচ ভদ্রলোকের ভাইপোটি এমন অবলীলাক্রমে শকুন্তলা, শকুন্তলা বলে নামটা উচ্চারণ করছিলেন–

মৃদু হেসে বিমল বললে, অল্পবয়সে স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে, তা একটু-আধটু–

হুঁ, তাই তো মনে হচ্ছে শকুন্তলার দুষ্মন্ত—

সহসা ঐসময় ঘরের বাইরে পদশব্দ শুনে বিমল বললে, চুপ-শকুন্তলা আসছে বোধ হয়!

শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।

ছিপছিপে রোগা, একটু বেঁটে এবং মুখখানি মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলেও অদ্ভুত একটা আলগা শ্ৰী আছে যেন শকুন্তলার চেহারায় ও মুখখানিতে।

দেখার সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

মাথার পর্যাপ্ত চুল দুটি বিনুনীর আকারে বক্ষের দুপাশে লম্বমান।

সাধারণ একটি কালোপেড়ে তাঁতের শাড়ি যৌবনপুষ্ট দেহে চমৎকার মানিয়েছে।

হাতে একগাছি করে কঙ্কণ এবং দুকানে দুটি নীলার টাব। আর দেহে কোথাও কোন অলঙ্কার বা আভরণ নেই। পায়ে চপ্পল। কিন্তু ঐ সামান্য অনাড়ম্বর বেশেই যেন শকুন্তলার রূপ একেবারে ফুটে বের হচ্ছিল।

এ যেন সত্যিই সেই কবিমানসী বনবিহারিণী হরিণী শকুন্তলা।

নমস্কার, আপনিই শকুন্তলা দেবী? বিমল বললে।

প্রতি-নমস্কার জানিয়ে নিঃশব্দে মৃদুভাবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল শকুন্তলা।

বসুন।

শকুন্তলা উপবেশন করল।