০৪. বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে

শুক্রবার।

আকমল হোসেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এখনো জুমার নামাজ শুরু হয়নি। মুসল্লিরা ঢুকছেন। মাথায় টুপি দেওয়া লোকজনে ভরে আছে প্রাঙ্গণ। যারা আশপাশে আছে, তাদের মাথায়ও টুপি। আকমল হোসেন নিজেও মাথায় টুপি দিয়েছেন। মিনিট দশেক আগে এসেছেন। তিনি জানেন, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। তাহলে আশপাশের লোকজন মনে করবে তিনি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। তাই তিনি ঠিক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে এদিক-ওদিক যাচ্ছেন। কোনো দোকানে ঢুকছেন কিংবা ফুটপাতের দোকানদারদের সঙ্গে কোনো কিছু দরদাম করছেন। টুকটাক কিছু কিনছেনও। মাঝেমধ্যে চারদিকে তাকান। দেখতে পান, তাঁর গাড়ির কাছে আলতাফ দাঁড়িয়ে ডাব খাচ্ছে। তিনি টুপিটা খুলে পকেটে ঢোকান। ভাবেন, টুপি মাথায় দিয়ে ঘোরাঘুরি করা ঠিক নয়। লোকে অন্য রকম ভাবতে পারে।

গত রাতে মেরিনার কাছে চিরকুট এসেছে মারুফের। ও লিখেছে : দুটি অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে আবার শহরে ঢুকব। বাসায় যাব কি না ঠিক নেই। বেশি যাতায়াত করলে বাড়ি চিহ্নিত হয়ে যাবে। তাই এমন কৌশল। বাবা যেন শুক্রবার জুমার নামাজের আগে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থাকেন। ওখানে বাবার সঙ্গে দেখা হবে এবং একই সঙ্গে গুলিস্তান এলাকা রেকি করা হবে। তুই কেমন আছিস, মেরিনা? এখন আমাদের জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান, মনে রাখিস।

কিন্তু আধা ঘণ্টা হয়ে গেলেও মারুফের দেখা মিলছে না। কোথায় গেল ছেলেটি? আটকালই বা কোথায়? নাকি এখানে আসার সময় বদলেছে? আকমল হোসেন চিন্তায় পড়েন। দুদিন পর ওরা পরপর দুটি অপারেশন করবে। গুলিস্তানের গ্যানিজ ও ভোগ—অবাঙালিদের দোকান। গেরিলারা এ দোকানে অপারেশন চালাবে। এতক্ষণ অপেক্ষা করে আকমল হোসেনের অস্থির লাগছে। তিনি নিজেই গ্যানিজ দোকানটির চারপাশ রেকি করবেন ঠিক করেন। তার নজরে কিছু পড়লে তিনি তা মারুফকে জানাতে পারেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে আকমল হোসেন রাস্তা পার হয়ে দোকানের সামনে আসেন। তারপর ভেতরে ঢোকেন। বড় দোকান। ঘরভর্তি মালপত্র। বেশির ভাগ দ্রব্যই পোশাকসামগ্রী। তিনি অনেকবার এ দোকানে এসেছেন। প্রয়োজনীয় কাপড় কিনেছেন। আজ দোকানের ভেতরে ঢুকে চারদিক খেয়াল করেন। নিরাপত্তাকর্মীদের অবস্থান লক্ষ করেন। একসময় ফিরে আসেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে। মারুফের পাত্তা নেই। কী হলো ছেলেটির? নিশ্চয় পরিকল্পনায় কোনো রদবদল হয়েছে। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। ভাবছেন, ফিরে যাবেন। আবার ভাবলেন, আর কিছুক্ষণ থাকবেন। ছেলেটা কোথাও হয়তো আটকে গিয়েছে। কাজ শেষ হলে ছুটতে ছুটতে আসতেও পারে। সেই চিন্তায় ফলের দোকানে দাঁড়ালেন। আয়শা খাতুন। পেয়ারা ভালোবাসেন। মেরিনা আমড়া-কামরাঙা খোঁজে। তিনি নিজে জাম্বুরা খেতে ভালোবাসেন। তিনজনের তিন ধরনের ফল পছন্দ। এ জন্য বাড়িতে সব রকম ফলই থাকে। এত কিছুর পরও কমলা-আপেল কিনলেন। ভাবলেন, যোদ্ধা ছেলেদের যদি কেউ আসে তাদের জন্য এসব ফল দরকার হতে পারে। আলতাফকে ডেকে সেগুলো গাড়িতে পাঠালেন।

যাওয়ার আগে আলতাফ জিজ্ঞেস করে, যাবেন না, স্যার? আর কতক্ষণ থাকবেন?

আর কিছুক্ষণ পর যাব। ছেলেটা যদি আমাকে এসে না পায়, তাহলে মন খারাপ করবে।

এখনই হয়তো নামাজ শেষ হবে।

সমস্যা কী? মুসল্লিরা যে যার পথে চলে যাবেন।

ভিড় হবে, স্যার। আর সময় তো ভালো না। আমরা তো শত্রুপক্ষ।

ঠিক আছে, তুমি যাও। আমি আসছি।

তিনি ফলের টাকা দিতে দিতে চারদিকে তাকান। কোথাও মারুফ নেই। তার মন খারাপ হয়। শুধু মানসিক নয়, শারীরিকভাবেও বিষণ্ণ বোধ করেন। পরক্ষণে সচেতন হয়ে ওঠেন। এবং নিজেকে ধমকান, এভাবে ভাবা ঠিক নয়। এটা যুদ্ধের সময়।

তখন মসজিদ থেকে স্রোতের মতো মানুষ বের হয়। তিনি একমুহূর্ত দাঁড়ান। দেখতে পান, সবার আগে বেরিয়ে আসছেন খাজা খয়েরউদ্দিন। এপ্রিল মাসে গঠিত হয়েছে শান্তি কমিটি। এই কমিটি শহরের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখবে। শহরের পরিস্থিতি আগের অবস্থায় নিয়ে আসবে। তাদের অনেক কাজ। আকমল হোসেন মৃদু হাসলেন। আর দুদিন পর শহরবাসী বুঝবে, স্বাভাবিক অবস্থা কী! তা ফিরিয়ে আনার সুযোগ ওদের জীবনে আর আসবে না। খাজা খয়েরউদ্দিন শান্তি কমিটির আহ্বায়ক। আকমল হোসেন দেখলেন, খয়েরউদ্দিন উত্তেজিত স্বরে কথা বলছেন। তাঁর অনুসারীদের কিছু বোঝাচ্ছেন। আকমল হোসেন স্মৃতি হাতড়ে দেখলেন, যেদিন শান্তি কমিটি গঠিত হয়, সেদিন টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি খুঁটিয়ে কাগজ পড়ে এসব বিষয় একটি পুরোনো ডায়েরিতে লিখে রাখেন, যেন ভুলে না যান সে জন্য। আজও দেখতে পেলেন মিছিলের তোড়জোড় চলছে।

একটু পর খয়েরউদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিল শুরু হয়। শুনতে পান বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে চকবাজার মসজিদ পর্যন্ত মিছিল যাবে। তিনি পেছনে সরে আসেন। একজন হুড়মুড়িয়ে নামতে নামতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলে, থু, বাঙালি গাদ্দার।

তিনি শুনে অন্যদিকে তাকান। কোনো ভাবান্তর প্রকাশ করেন না। তিনি আরও দুপা পিছিয়ে আসেন। পরে আরও অনেকখানি। ততক্ষণে মিছিল গুলিস্তানের রাস্তায় উঠেছে। নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে চারদিক। ওদের হাতে ব্যানার-পোস্টার। নানা স্লোগানে ওরা একটি বিদ্বেষপূর্ণ বার্তায় চারদিক তোলপাড় করছে।

আকমল হোসেন মনে করলেন, শান্তি কমিটির প্রথম সভায় যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল—এই সভা মনে করে যে, হিন্দুস্থান পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দেশপ্রেমিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ করছে। শেষ সিদ্ধান্তটি ছিল—এ সভা আমাদের প্রিয় দেশের সম্মান ও ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশপ্রেমিক জনগণকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আকুল আহ্বান জানাচ্ছে।

দেশপ্রেমিক জনগণের মিছিল যাচ্ছে। চারদিকে পাকিস্তান রক্ষায় জীবনদানকারী হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেশপ্রেমিকেরা। ভালোই তো, দেখা যাবে ওরা কতটা খাঁটি। আকমল হোসেন চোখের ওপর ডান হাত রেখে রোদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকেন। মিছিলের শেষ মানুষটিকে তখন আর দেখা যাচ্ছে না। তিনি ফেরার কথা ভাবলেন। পেছনে ফিরলে দেখতে পান, একজন ফেরিওয়ালা তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ফিরতেই লোকটি বলে, স্যার, ওরা আপনাকে গাদ্দার বলেছে। আপনি কিছু বললেন না কেন, স্যার?

ও তো ঠিকই বলেছে। ওর চিন্তায় আমি তো তা-ই। তিনি নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দেন। মৃদু হাসেন।

গাদ্দার মানে কী, স্যার?

বিশ্বাসঘাতক।

লোকটি চমকে উঠে বলে, বিশ্বাসঘাতক! কী বলে ওরা? বিশ্বাসঘাতক! আপনি কি বিশ্বাসঘাতক, স্যার?

হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতক তো বটেই।

কেন, স্যার? কেন?

কারণ আমি বাঙালি, সে জন্য। আমরা ওদের মুখোশ খুলে দিতে চাই। বলে।

নেমে যায় লোকটির কণ্ঠস্বর। বলে, ও, এই। আমিও তো বাঙালি। আমার বাড়ি বলেশ্বর নদীর ধারে। গ্রামের নাম মাছুয়া। মহকুমা পিরোজপুর। জেলা বরিশাল।

বাহ, তুমি তো একদম খাঁটি বাঙালি। ব্র্যাভো।

কিন্তু আমি বিশ্বাসঘাতক না। আমি বিশ্বাসঘাতক হব কেন? এটা আমার জন্মভূমি।

ওরা তো আমাদের বিশ্বাসঘাতক বলবেই।

কেন, স্যার? আমরা কী করেছি?

আমরা স্বাধীনতা চাই। স্বাধীন দেশ চাই। ওরা যা বলে বলুক। আমার তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা যুদ্ধ করছি।

সে জন্য বিশ্বাসঘাতক শুনে আপনার খারাপ লাগেনি।

হ্যাঁ, তাই। তুমি যে ব্যাপারটা বুঝেছ সে জন্য আমার ভালো লাগছে।

আমি তো ভেবেছিলাম আপনি লোকটিকে ঘুষি মারলেন না কেন? কুত্তার বাচ্চা বলে কী!

আস্তে কথা বলো।

তোমার নাম কী, ভাই?

মোতালেব।

কোথায় থাকো?

নারিন্দায়।

এখানে রোজ বসো?

বসি।

ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।

লোকটি আকমল হোসেনের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ি পর্যন্ত আসে। আকমল হোসেন গাড়িতে উঠে বসলে মোতালেব ফিসফিস করে বলে, স্যার, আগামী সপ্তাহ থেকে আপনি আর আমাকে এখানে পাবেন না। আমি দেশে চলে যাব। ওখান থেকে যুদ্ধ করতে যাব। ওরা আপনাকে গাদ্দার বলেছে—আমার গায়ে আগুন ধরে গেছে। কারণ, আপনি গাদ্দার হলে আমিও গাদ্দার। আপনি আমাকে দোয়া করবেন।

আকমল হোসেন ওর মাথায় হাত রাখেন। বলেন, বিজয়ীর বেশে ফিরবে দেশে—এই দোয়া করি।

দেশ স্বাধীন হলে আপনি আমাকে এখানে খুঁজতে আসবেন তো, স্যার?

আসব। অবশ্যই আসব। তোমার জন্য আমি ফুল নিয়ে আসব। বিজয়ীকে ফুলের মালা দেব।

মোতালেব হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারপর নিজেই গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। আকমল হোসেন গাড়িতে স্টার্ট দেন। বুকের ভেতর শান্তি কমিটি কাঁটার মতো বিধে থাকে। প্রথম বৈঠকের পর যেদিন ওরা শহরের পথে মিছিল করেছিল, সেদিনও তিনি দূরে দাঁড়িয়ে ওদের মিছিল দেখেছেন। সেদিনও মিছিল বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে চকবাজার মসজিদ হয়ে নিউ মার্কেটের মোড়ে গিয়ে শেষ হয়েছিল। মিছিলে বিহারিদের সঙ্গে বাঙালি দালালেরাও ছিল। মিছিলে ব্যান্ড পার্টি ব্যবহার করা হয়েছিল। যেন উৎসব, এমন ভাব। পাকিস্তানের পতাকাসহ ব্যানার-ফেস্টুন বহন করেছিল মিছিলকারীরা। ইয়াহিয়া, আইয়ুব, জিন্নাহ, ফাতেমা জিন্নাহ, এমনকি আল্লামা ইকবালের ছবিসহ প্ল্যাকার্ড ছিল ওদের হাতে। সেদিন বৃষ্টি ছিল। তার পরও মিছিলকারীরা কোথাও থামেনি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শেষ করেছিল নির্ধারিত স্থানে গিয়ে। সেখানে বক্তৃতা করেছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন। মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন গোলাম আযম। গাড়ি নিয়ে এসব দেখার জন্য সেদিন তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছিলেন।

কয়েক দিন পর পত্রিকায় পড়েছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিনের প্রচারিত প্রেস রিলিজ। সেখানে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিরা সারা প্রদেশে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হওয়ায় এখন পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে। শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হত্যা করছে। যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেনাবাহিনী দেশকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করছে। তাদের সাফল্যের জন্য কমিটি আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করছে।

আকমল হোসেন এ স্মৃতি মনে করে হা-হা করে হাসেন। রাস্তায় গাড়ি তখন লাল বাতির সামনে থেমে গেছে।

আকমল হোসেনের হাসি শুনে আলতাফ পেছন থেকে ডাকে, স্যার।

ওদের প্রেস রিলিজের কথা মনে করে হাসছি। ওরা নিজেরা যে নিজেদের ফাঁদে পা ঢুকিয়েছে, তা ওরা বুঝতে পারে না। ওরা মনে করছে, ওরা সাফল্যের মধ্যে আছে।

আমিও এটা মনে করি, স্যার। ওদের আনন্দের ড়ুগড়ুগি শুনলে আমার হাসি পায়।

ভেবে দেখো, ওরা কী বলছে? বলছে রাষ্ট্রবিরোধীরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রানি করছে। মানে গেরিলারা অপারেশন চালাচ্ছে—এর অর্থ তো তা-ই দাঁড়ায়।

ঠিক, স্যার।

রেড লাইট সিগন্যাল শেষ হয়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে তিনি বলেন, ওরা বলছে, সেনাবাহিনী দেশকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকে স্বীকার করার বাকি থাকল কী? বিদেশের মানুষেরা এত বোকা না যে এর মর্ম বোঝে না।

আবার তিনি হো-হো করে হাসেন। আলতাফের মনে হয় স্যারের মনে আজ খুব ফুর্তি। সামনে আরেকটি গেরিলা অপারেশন হবে—এ আনন্দে তিনি আছেন। গাড়ির দরজা খোলার আগে তিনি বলেন, আলতাফ, আমাদের বাড়িতে রাখা অস্ত্রগুলো আজ চেক করতে হবে। তুমি অন্য কোথাও যেয়ো না।

না স্যার, কোথাও যাব না। এখন তো আপনাকে না বলে কোথাও যাই না। আমার সময়টাও এখন যুদ্ধ, স্যার। রাত-দিন মনে করি দেশের জন্য কিছু করতে হবে। আমার যা সাধ্য ততটুকু, সাধ্যের বাইরে যদি কিছু করতে হয়, তা-ও করব।

থ্যাংকু, আলতাফ। তোমার কাজ করার ইচ্ছা আমাদের শক্তি। আমরা কখনো পেছাব না।

আলতাফ গাড়ি থেকে নেমে দরজা খোলে। গাড়ি ঢুকে যায় ভেতরে। গ্যারেজে ঢোকে। এ গ্যারেজের মেঝে খুঁড়ে গেরিলাদের গোলাবারুদ রাখা হয়েছে একটি টিনের বাক্সে। রান্নাঘরের ফলস ছাদে আছে। স্টোররুমে আছে। ছাদের ওপরে পানির ট্যাংকে আছে। এসব কিছুর নজরদারি করেন আকমল হোসেন। কখন, কীভাবে, কোথায়, কাকে, কী দিতে হবে তার সবকিছু তিনি নিজে দেখাশোনা করেন। কোথায় কী আছে তা তার নখদর্পণে। আয়শা খাতুন স্বামীর এই ক্ষিপ্র কাজে কখনো খুব বিস্মিত হন। সঙ্গে থাকে বাড়ির অন্যরা। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলেন, আয়শা খাতুন আর মেরিনা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

আয়শা খাতুন উদ্গ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, মারুফের সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার?

হয়নি। ছেলেটি তো এল না! বেশ অনেকক্ষণই তো অপেক্ষা করলাম।

হয়তো কোথাও আটকা পড়েছে। হবে হয়তো।

নয়তো ওদের রেকি করার কৌশলে কোনো চেঞ্জ হয়েছে।

সবাই মিলে ঘরে ঢোকেন।

আব্বা, আপনি কিছু খাবেন? শরবত দেব?

এখন কিছু লাগবে না। গোসল করে নিই, একবারে ভাত খাব। তুই ঠিক আছিস তো, মা?

কেন, আব্বা? আমি তো সুস্থ আছি। আপনি কেন ভাবলেন আমার কিছু হয়েছে?

ভুলে যেতে পারি না যে এটা যুদ্ধের সময়। যেকোনো সময় যা কিছু হতে পারে, কে জানে, মা। তুমি টেবিলে খাবার রেডি করো, আমি আসছি।

আকমল হোসেনের সঙ্গে সঙ্গে আয়শা খাতুনও শোবার ঘরে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, বায়তুল মোকাররমে কী দেখলে? শহরের পরিস্থিতি কী?

পাকিস্তানের পতাকা হাতে শান্তি কমিটির মিছিল দেখেছি এবং পাশাপাশি একজন মানুষ পেয়েছি, যে আমাকে বলেছে, সে যুদ্ধে যাবে। বলেশ্বর নদীর ধারের লোক। বুঝতে পারছি, ওর যুদ্ধক্ষেত্র ৯ নম্বর সেক্টর হবে।

আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, তোমার আজকের দেখা দারুণ। পাকিস্তানের পতাকা হাতে স্বাধীনতাবিরোধীদের মিছিল এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা।

হ্যাঁ, আয়শা। ঠিক বলেছ। দুটিই যুদ্ধের সময়ের চিত্র। দুটিই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, একদিন দেশ স্বাধীন হবে এবং একদিন স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার হবে। অপরাধের দণ্ড ওদের পেতেই হবে।

ঠিক, ঠিক বলেছ। এমন কথা শুনলে আমার মনে হয়, আমার আয়ু বেড়ে যাচ্ছে।

আয়শা খাতুন আবেগে আকমল হোসেনের দুহাত জড়িয়ে ধরলে তিনি বলেন, শুধু হাত কেন? এসো। তিনি আয়শা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার ওপর নিজের থুতনি রেখে বলেন, আমরা যুদ্ধের সময়ের সাক্ষী। এ সময়ের দলিলগুলো আমাদের গুছিয়ে রাখতে হবে।

আয়শা খাতুন অনুভব করেন, যুদ্ধের সময়ও এ মানুষটির বুক প্রবল ওমে ভরা। এ মানুষটি জেবুন্নেসার জন্য কেঁদেছেন। বলেছেন, ওকে শহীদের মর্যাদায় স্মরণ করবে। ওর মৃত্যুর তারিখ ডায়েরির পৃষ্ঠায় লিখে রেখেছেন। বলেছেন, আয়শা, আমরা যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন ওর মৃত্যুদিনে একটি মোমবাতি জ্বালাব। আর পথের পাঁচটি বাচ্চাকে ডেকে এনে খাওয়াব। ওদের জেবুন্নেসার কথা বলব। পারবে না, আয়শা?

আয়শা নিজেও কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলেছেন, পারব না কেন, আমাদের পারতেই হবে। আমরা না পারলে মুছে যেতে থাকবে জেবুন্নেসাদের ইতিহাস।

সেদিনও প্রবল আবেগে আকমল হোসেন আয়শা খাতুনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আজও দুজনের ওমভরা শরীর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রাখে। পুরো ঘরে এখন ওমভরা সময়। যুদ্ধের সময়। যে যুদ্ধ স্বাধীনতার জন্য। দুজনে অনেকক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাবেন, তাঁদের বিবাহিত জীবনের সাতাশ বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু এমন ওমে ভরা সময় আসেনি। এই অন্য রকম সময় দুজনকে নিবিড় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়।

খাবার টেবিলে মেরিনা বলে, আব্বা, ফয়সল ফোন করেছিল।

কী বলেছে? কোনো পরিকল্পনা?

বলেছে, ওরা গেরিলা নামে একটি পত্রিকা বের করবে। আপনাকে লিখতে হবে। বলেছে, ওরা ইংরেজিতে বের করবে। বেশির ভাগই যুদ্ধের খবরাখবর থাকবে। ঢাকায় বসবাসকারী বাঙালিরা যেন সব ধরনের খবর পায়, সে চেষ্টা করবে। আর যুদ্ধের খবর বেশি থাকবে। লিখবেন তো, আব্বা?

বলিস কী, মা! লিখতে তো হবেই। না লিখলে নিজের সঙ্গে নিজেরই বেইমানি করা হবে।

বুঝেছি। এই সময় আপনার কাছে সব কাজই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি এমন বাবা পেয়ে গর্বিত।

আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, আর মা?

মা-ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাগো, আপনার গানের ধ্বনি তো একটা রণক্ষেত্র।

এমন আলোচনায় খাবার টেবিল অন্য রকম হয়ে যায়। মন্টুর মা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কী কথা হচ্ছে, সেটা বুঝতে চায়। বোঝেও। একইসঙ্গে নিজেকে বলে, মেরিনা মন্টুর মায়ের জন্য গর্ব হয় না? মন্টুর মা-ও তো গর্বের মানুষ হতে চায়।

মায়ের সঙ্গে কথা বলে আকস্মিকভাবে মন্টুর মায়ের দিকে তাকায় মেরিনা। চোখ বড় করে বলে, আপনি আমার কাছে আসেন। চেয়ারের কাছে। আমি আপনার হাত ধরব। মন্টুর মা এগিয়ে এলে মেরিনা বলে, আপনার জন্যও আমার গর্ব হয়, খালা। আপনি যুদ্ধকে নিজের করে নিয়েছেন।

মন্টুর মা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে, যাই।

মেরিনা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আব্বা, ফয়সল আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য আসতে চেয়েছে।

ফোন করে দে। পারলে আজ বিকেলে আসুক।

আচ্ছা, বাবা। মেরিনা খুশি হয়ে ঘন ঘন মাথা নাড়ে। বলে, বাবা, আমি ঠিক করেছি ওদের সঙ্গে কাজ করব। ওরা আমাকে বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করার দায়িত্ব দিয়েছে। পত্রিকার কপি ঢাকার সব বিদেশি অফিসে পাঠানো হবে।

গুড। এটা খুব দরকার। বিশ্বের সবাইকে অনবরত জানাতে হবে—আমরা আছি। আমরা বসে নেই।

তুমি ডালের স্যুপটা খাও। আজ তুমি তোমার প্রিয় স্যুপ খেতে ভুলে গেছ।

আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, আজ আমি বের হব। অনেক দিন বের হইনি।

কোথায় যাবে? কারও সঙ্গে কথা হয়েছে?

ঢাকা শহরের দুর্গবাড়ি তো শুধু আমরা নই, আরও আছে না। শায়লা আপা ফোন করেছিলেন। এলিফ্যান্ট রোডে যেতে হবে। বলেছেন, জরুরি কথা আছে।

বুঝেছি। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব?

না, আমি রিকশায় যাব। একটু পরেই ফিরে আসব। তুমি তো বাড়িতেই আছ?

হ্যাঁ, আমি আর বের হব না। চলো, উঠি।

তখনই টেলিফোন বাজে। ছুটে যায় মেরিনা।

হ্যালো, ও ভাইয়া। তুমি তো এলে না। বাবা তোমার জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন।

আমরা বায়তুল মোকাররমের সামনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আব্বা-আম্মা কই?

দুজনেই ততক্ষণে টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ফোন ধরেন আকমল হোসেন।

হ্যালো, বাবা।

আব্বা, আমরা সকালে বায়তুল মোকাররম যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করেছি। জুমার নামাজের পর শান্তি কমিটির মিছিল হবে সে জন্য। আমরা রিস্ক নিতে চাইনি। অন্য সময় রেকি করা হয়েছে।

ঠিক করেছ। তবে তোমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে আমার ওদের কর্মসূচি দেখার সুযোগ হয়েছে। তুমি মন খারাপ কোরো না। সকালে যা দেখেছি, তার সবকিছু ডায়েরিতে লিখছি। একজন ফেরিওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়েছে, যে যুদ্ধে যাবে বলেছে।

আব্বা, গ্যানিজ ও ভোগ অপারেশনের সব প্রস্তুতি আমাদের শেষ হয়েছে।

দোয়া করি। তোমাদের জন্য দোয়া করি।

আম্মাকে আমার সালাম দেবেন।

ফোন রেখে দেয় মারুফ। মেরিনা নিজের ঘরে যায়। আয়শা খাতুন রান্নাঘর তদারকিতে ঢোকেন। আকমল হোসেন ভাবেন, তিনি নিজেও দু-এক দিনের মধ্যে ধানমন্ডি যাবেন। ওখানকার দুর্গবাড়িটিও গেরিলা অপারেশনের নানা দিক দেখাশোনা করে। ওই বাড়ির সাতটি ঘরের পাঁচটিতেই ঢালাও বিছানা পাতা আছে গেরিলাদের জন্য। ওই বাড়ির দুই ছেলে যুদ্ধে গেছে। তাদের বড় ছেলে পঁচিশের রাতের পরে তার কলেজের শিক্ষককে পরিবারসহ নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, মা, আমার শিক্ষক হিন্দু। তাদের চার মেয়ে। তাদের এ বাড়িতে থাকতে দাও। নিজের ইচ্ছায় কোথাও না যেতে পারলে তাদের তুমি যেতে বলবে না। আমি জানি, বাবা-মাসহ চার মেয়েকে রাখার সামর্থ্য তোমার আছে, মা। সেই থেকে প্রদীপ সাহার পরিবার ওই বাড়িতে আছে। ছেলেটি সেই যে গেল আর আসেনি। ওর বাবা-মা খবর পেয়েছে যে, ছেলেটি ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া বাড়িগুলো পরস্পর যুক্ত। একে অপরের খোঁজখবর রাখে। একটু পরে আয়শা খাতুন বেরিয়ে যান।

আকমল হোসেন নিজ ঘরে এসে টেবিলে বসেন। আজকের অভিজ্ঞতার বিবরণ ডায়েরিতে লেখেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার দুর্গবাড়িগুলোর ঠিকানা তিনি ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। পুরো তালিকা নিয়ে তিনি একটি বড় কাগজে ম্যাপ বানিয়েছেন। রাস্তাসহ বাড়ির স্থান চিহ্নিত করে লাল কালি দিয়ে গোল গোল দাগ করেছেন। সে জন্য একটি বাড়ির অবস্থান তিনি অনায়াসে বুঝে নিতে পারেন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গার ম্যাপ আঁকা তিনি খুব পছন্দ করেন। এ ম্যাপ গেরিলাদের কাজেও লাগে। ওদের অপারেশনের আগে তিনিও রেকি করেন। আয়শা খাতুন যে বাড়িতে গেছেন, সেটি একটি সরকারি বাসভবন। আমিরুজ্জামান সরকারি চাকুরে। তার ভাই গেরিলা। শরীরে মুক্তিযোদ্ধার টগবগে রক্ত। দারুণ সাহসী।

আকমল হোসেন মৃদু হেসে টেবিল থেকে উঠলেন। এভাবে ভাবলে তিনি পুরো ছক নিয়ে রাত পার করে দিতে পারবেন। সবটাই তার নখদর্পণে। তিনি চেনেন সবাইকে। ফার্মগেটের দিকে একটি ঘাটি করার জন্য ছেলেদের পরিকল্পনা আছে। সেটা নিয়েও তিনি ভাবছেন। ওখানে একটি বাড়ি ভাড়া করতে হবে। যত দিন যাচ্ছে, তত গেরিলা তৎপরতা বাড়ছে। দলে দলে ছেলেরা ঢুকছে ঢাকায়। সাঁড়াশির মতো আক্রমণ করবে ওরা—চারদিক থেকে আক্রমণ। ওদের মুখের দিকে তাকালে আকমল হোসেন নিজের বয়সের কথা ভুলে যান। মনে হয়, তিনি ওদের বয়সী। এমন একটি ভাবনা এ যুদ্ধের সময় তার জন্য এক গভীর আনন্দের ব্যাপার। তিনি কিছুক্ষণ রেস্ট করবেন বলে বিছানায় শুয়ে পড়েন। মুহূর্তে চোখ বুজে আসে।

পাঁচটার পরে মেরিনার ডাকে ঘুম ভাঙে তাঁর। সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলেন। কোনো এক সাগরপাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কখনো সঙ্গে আয়শা, কখনো মারুফ, কখনো মেরিনা। কিন্তু সবাই একসঙ্গে নয়। মেরিনার উচ্ছ্বাস সবচেয়ে বেশি। বারবারই বলছিল, আব্বা, ওই দেখেন, পাখিটা কী সুন্দর! ইশ, ওই ফুলটা ছিঁড়ে আনি! সাগর আর মেঘের এমন বন্ধুত্ব আমি কোনো দিন দেখিনি। মারুফ বারবার সাগরে নেমে পা ভিজিয়ে আসছিল। বলছিল, পৃথিবীর কোন স্বর্গ এই জায়গা! আয়শা খাতুন খানিকটা চুপচাপ ছিল। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। তিনি আয়শার হাত ধরে বলেছিলেন, কী হয়েছে তোমার? আয়শা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলেছিল, জানি না। মেরিনার ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি বিষণ্ণ বোধ করেন।

আব্বা ওঠেন। ফয়সল আর নাসিম এসেছে। আপনার গভীর ঘুম দেখে আমি অনেকক্ষণ ডাকিনি। আমার মনে হচ্ছিল, আপনি সুন্দর স্বপ্ন দেখছেন।

তিনি চোখ খোলেন। মেয়েকে দেখেন। বাবার হাত ধরে নাড়িয়ে দিয়ে মৃদু হাসে মেয়ে।

তুই ওদের সঙ্গে কথা বল। আমি আসছি।

মেরিনা রান্নাঘরে ঢুকে কেটলিতে চায়ের পানি চুলোয় বসিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। ওরা দুজন নিচুস্বরে কথা বলছিল। মেরিনাকে ঢুকতে দেখে বিব্রত হয়ে বলে, যুদ্ধের সময় আমরা আস্তে কথা বলার অভ্যাস করেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। ঘরের ভেতরও অভ্যাস রয়ে গেছে।

কী যে বলো না, ফয়সল! এ সময় এত কিছু ভাবারও সময় নেই আমাদের। কত ধরনের কাজ নিয়ে আমরা ঘুরছি। তোমরা তো কাজ নিয়েই এসেছ। আড্ডা দিতে তো নয়। আব্বা এখনি আসবেন।

আকমল হোসেন ঘরে ঢোকেন। হাসিমুখে বলেন, কেমন আছ তোমরা?

আমরা ভালো আছি, চাচা।

তোমাদের পরিকল্পনার কথা শুনে ভালো লেগেছে। গেরিলা নামটিও আমার পছন্দ হয়েছে। কীভাবে করবে পত্রিকা?

সাইক্লোস্টাইল করে ছাপব। ট্যাবলয়েড সাইজ। আমাদের বন্ধুরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমরা চাই, দেশে যারা আছেন, তারা যুদ্ধের খবরাখবর পাবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সচেতন থাকবেন। আপনাকে প্রতি সংখ্যায় লিখতে হবে, চাচা।

অবশ্যই লিখব। তোমরা উদ্যোগ নিয়েছ আর আমি তার সঙ্গে থাকব না, তা কি হয়! তবে আমার মনে হয়, যারাই লিখবেন, তাঁদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা ভালো। আমি ভেবেছি, শান্তি কমিটি, সেনাবাহিনী, সরকার ইত্যাদি বিষয়ে খুঁটিনাটি খবরাখবর দেব। তাদের অবস্থান, তাদের প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ দেব। ঢাকা শহর যেন তোমাদের পত্রিকায় নানা দিক নিয়ে উপস্থিত থাকে।

হ্যাঁ, খুব ভালো হবে, চাচা। আমরা শহরকে সবার সামনে ছবির মতো রাখতে চাই। প্রতিটি ঘটনার বিবরণ তারা পাবেন আমাদের পত্রিকা থেকে।

ছেলেদের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আকমল হোসেন ভাবেন, এই যুদ্ধের সময়েও বেঁচে থাক এমন সাহসী অসংখ্য তরুণ। ওদের পরিকল্পনায় হাজারো স্বপ্নের ফুলকলি ফুটে উঠছে।

মেরিনা ওদের চা-পায়েস খেতে দেয়। ওদের চলে যাওয়ার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে। যেন কথার শেষ নেই। কথার রেশ ধরে এগিয়ে আসছে কাজ, কাজের পর থাকবে ফলাফল। মারুফ যাওয়ার পরে মেয়েটি এ বাড়ির হাল ধরে রেখেছে। গেরিলাদের যোগাযোগ ওর সঙ্গেই। ও জানে বাড়ির কোন পয়েন্ট থেকে কাকে বের করে দিতে হবে, কোন পয়েন্ট থেকে ঢোকাতে হবে। নতুন আর পুরোনো শহরের মাথায় বাড়িটির অবস্থান হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহজ যোগাযোগ ছিল এ বাড়ির সঙ্গে। ওরা বলে, পুরান ঢাকা আর নতুন ঢাকার যোগাযোগের সেতুবন্ধ এই বাড়ি। আমাদের খুব সুবিধা হয়। আজও মেরিনা ফয়সল আর নাসিমকে বাড়ির দ্বিতীয় এন্ট্রি পয়েন্ট দিয়ে বের করে দিল। মোট চারটি এন্ট্রি পয়েন্ট আছে বাড়িটির। আলতাফ পুরো বাড়ির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে। আকমল হোসেন ভাবলেন, সময়ই সবচেয়ে বড় বন্ধু। সবাইকে এক সুতায় গেঁথে রেখেছে।

তিনি আবার শোবার ঘরে গিয়ে টেবিলে বসলেন। নিজের তৈরি ম্যাপের ওপর ঝুঁকে পড়ে গ্যানিজ ও ভোগ অপারেশনের রাস্তার হিসাব-নিকাশ করেন। অবাঙালিদের এই দোকান দুটো স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি যোগাযোগ ঘাটি। এখানে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায় গেরিলারা। এই গেরিলারা ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত। ক্র্যাক বললে বোঝা যায় তারা কারা। আর দুদিন পর ওরা শহরের রাস্তা তোলপাড় করে তুলবে। বলবে, দেখো, আমরা আছি।

সন্ধ্যার আগেই আয়শা খাতুন বাড়ি ফিরলেন। উফুল্ল হয়েই ফিরেছেন। আকমল হোসেনকে বললেন, যেখানে গিয়েছিলাম সেটা একটা দুর্গবাড়ি। ওই বাড়িতে একজন সিএসপি অফিসার থাকেন ঠিকই, কিন্তু গেরিলাদের জন্য ওটা একটা চমৎকার জায়গা। ওরা সুযোগমতো ওখানে যায়; খাওয়াদাওয়া করে। তারপর সুযোগমতো বেরিয়ে আসে। নিশাত আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরা এলে মনে হয় দেবদূত এসেছে। যুদ্ধের সময়ও যে এত আলো থাকে, তা ভাবতে পারতাম না যদি ওদের সঙ্গে আমার দেখা না হতো।

যাক, আমাদের শহরের মধ্যেই আমরা ভিন্ন শহর গড়েছি। এটাই আমাদের সার্থকতা, আয়শা। রাস্তায় তোমার কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

না, রিকশাওয়ালা একটানে নিয়ে এসেছে। পথে আর্মির গাড়ি দেখেছি। দেখে মেজাজ খারাপ করেছি।

এটা মন্দ বলোনি। মেজাজ খারাপ করাটাও দরকার। মেজাজ খারাপ না হলে বুঝতে হবে আমরা থিতিয়ে গেছি। যাকগে। ওরা তোমাকে নিশ্চয়ই গান গাইতে বলেছে?

আয়শা খাতুন লজ্জিত ভঙ্গিতে বলেন, হ্যাঁ, বলেছে। ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলে দুটো চা খাচ্ছিল। নিশাত ওদেরকে বুটের ডালের হালুয়া বানিয়ে দিয়েছিল। ওরা খাওয়া থামিয়ে বলল, খালাম্মা, বুকের ভেতর আপনার গানের ধ্বনি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই। শুধু দুটো লাইন গুনগুন করবেন—মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম—এই গানটি। আমি করলাম।

এটাই আমাদের যুদ্ধ, আয়শা। পরস্পরের গায়ে গায়ে থাকা। ওদের একধরনের কাজ; আমাদের অন্য ধরনের। কোনো কাজই খাটো করে দেখার নয়।

আমি কাপড় চেঞ্জ করে আসছি। তুমি ড্রয়িংরুমে বসো।

টেলিফোন বাজে। আকমল হোসেন ফোন ধরেন।

চাচা বলছেন?

বলো, বাবা।

আমি শাহাদাঁত। আমাদের হাতে কিছু অস্ত্র এসেছে। রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আজ রাতেই। আমরা আপনার বাড়ির কাছাকাছি আছি।

নিয়ে এসো আমার বাসায়। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমরা কোনো দুশ্চিন্তা করবে না।

ফোন রেখে তিনি আলতাফকে ডাকলেন।

অস্ত্র রাখার জায়গা এ বাসায় ও-ই তৈরি করে। রাজমিস্ত্রির কাজ শিখেছে। মিস্ত্রি হওয়ার জন্য নয়। অস্ত্র লুকিয়ে রাখার জন্য কাজ শেখে। রং করার কাজও শিখেছে ও। বাড়িতে নানা ধরনের যন্ত্রপাতিও রাখা আছে। আলতাফ কাছে এসে দাঁড়ালে বললেন, অস্ত্র আসছে। রাখতে হবে। কোথায়?

আয়শা খাতুন শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, পেছনের বারান্দায়। ওখানে ভাঙাচোরা যে দুটো টেবিলচেয়ার আছে, সেগুলো সরিয়ে খোঁড়ার ব্যবস্থা করো। তারপর হেঁড়া মাদুর বিছিয়ে ঢেকে রাখা যাবে।

ঠিক বলেছ। তার ওপর ভাঙাচোরা টেবিল-চেয়ার রেখে দেব। মনে হবে, ভাঙাচোরা জিনিস ওখানে ডাম্প করা হয়েছে।

আরও বুদ্ধি আছে। ওখানে আমরা শুকনো লাকড়ির বোঝ রেখে দেব। আর্মি যদি এ বাড়িতে আসেও, তবু এসব জায়গা চিহ্নিত করতে পারবে বলে মনে হয় না।

আমারও তেমন ভরসা আছে। আলতাফ, তুমি কাজে লাগো।

সেটাই ভালো। খালাম্মা ঠিকই বলেছেন, স্যার। দরকারের সময় বুদ্ধি ঠিকই মাথায় আসে।

আকমল হোসেন নিজে ভাঙা চেয়ার-টেবিল দুটো সরিয়ে দেন। আলতাফ শাবল-কুড়াল-দা নিয়ে আসে। খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। শব্দ যেন বেশি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখছেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন।

কখনো তাঁরা বারান্দার নিচে নেমে বাড়ির চারদিকে ঘুরে আসেন। কখনো গেটের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ান। বারান্দায় ওঠেন। ড্রয়িংরুমে আসেন। বসতে পারেন না কোথাও। প্রবল তাড়না তাঁদের স্থির থাকতে দেয় না। দুজনে দুদিকে প্রখর দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আলতাফের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আসে শাহাদাঁত। আকমল হোসেন নিজেই গেট খুলে দেন। আবার বন্ধ করেন। অল্প সময়ের জন্য মুখ বাড়িয়ে রাস্তা দেখে নেন। গাড়ি গ্যারেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শাহাদাতের সঙ্গে নজরুল আর রতন এসেছে। সবাই মিলে বস্তা দুটো দ্রুত ঘরে ওঠায়। আলতাফ তখন একটি চার কোনা গর্ত করার কাজ শেষ করেছে। বস্তা দুটো অনায়াসে সেখানে রাখা যাবে।

আয়শা খাতুন তাগাদা দিয়ে বলেন, বস্তা দুটো তাড়াতাড়ি রেখে দাও। আলতাফকে আবার গর্তের মুখ বন্ধ করার কাজ করতে হবে। বাড়িতে অস্ত্র এলেই তার ভেতরে প্রবল অস্থিরতা কাজ করে। আজও তার মুখের দিকে তাকিয়ে মেরিনা বলে, আম্মা, আপনি ধৈর্য ধরেন। অস্ত্র তো, অনেক সময় তাড়াহুড়োয় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

তার পরও সতর্কতার তো শেষ নেই, মারে।

আমরা অনেক সতর্ক। আপনি স্থির হয়ে বসেন। আব্বার সঙ্গে আমি থাকছি।

আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি বারান্দায় বসে গেট পাহারা দিই। তুই যা।

যোদ্ধারা অস্ত্রের বস্তা নিয়ে গর্তে ঢোকায়। সাবধানে পাশাপাশি খাড়া করে রাখে। আলতাফ গর্তের মুখ বন্ধ করার কাজ শুরু করে। মেরিনা চায়ের কথা বলতেই শাহাদাঁত আঙুল তুলে বলে, নো টি। আমরা তাড়াতাড়ি চলে যাই।

চলেন, আমি গেট খুলে দিচ্ছি। আব্বা তো এখানে থাকবেন। চোখের সামনে সবকিছু না দেখা পর্যন্ত আব্বার শান্তি নেই।

মেরিনা যোদ্ধাদের সঙ্গে যায়। আয়শা খাতুন বারান্দায় বসে গাড়ি বেরিয়ে যেতে দেখেন। মেরিনা বারান্দায় উঠে এলে দুজনে একসঙ্গে পেছনের বারান্দায় আসে।

সবকিছুই ঠিকঠাকমতো হয়। আকমল হোসেন নিজে তদারক করেন। বারান্দা পরিষ্কার করে পরিকল্পনামতো ভাঙা টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি রাখা হয়। আলতাফ গ্যারেজের কাছে জড়ো করে রাখা শুকনো খড়ি চেয়ার-টেবিলের পাশে জড়ো করে রাখে। আয়শা খাতুন বারান্দার দরজায় তালা লাগিয়ে দেন। আলতাফ নিজের ঘরে চলে যায়।

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন আকমল হোসেন, আয়শা খাতুন, মেরিনা। দুই বস্তা অস্ত্র লুকিয়ে রাখার পর পরিস্থিতি তাদের পক্ষে আছে, এটা কেউ ভাবতে পারছেন না। আশঙ্কার প্রহর গুনছে। একবার মনে হয়, আশঙ্কার সময় কেটে গেছে। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। যদি কেউ খবর পেয়ে থাকত, তাহলে এই সময়ের মধ্যেই বাড়িতে হানা দিত। তার পরও চুপচাপ বসে থাকেন তিনজন। টিভি ছেড়ে রাখেন। দেখার মতো প্রোগ্রাম নয়। তার পরও সময় কাটাতে হয় তাদের। কোথাও থেকে কোনো ফোন আসে না। যারা অস্ত্র রেখে গেছে, তাদেরও ফোন আসে না। তারা নিরাপদ শেল্টারে যেতে পেরেছে কি না, সে খবরও পাওয়া হয়নি। নিজেরাও কোনো দুর্গবাড়িতে ফোন করেন না। শুধু অপেক্ষা—যেন কোনো দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে না আসে। যেন কেউ অস্ত্র রাখতে দেখেনি এটুকু জেনে স্বস্তিতে থাকা। যেন অস্ত্রগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগে। যেন যোদ্ধাদের হাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি সরগরম করে দেয় শহরের রাস্তা।

মধ্যরাত গড়িয়ে যায়।

মেরিনা বলে, আব্বা, আমরা কি ধরে নিতে পারি যে আমাদের বিপদের সময় কেটে গেছে? ভয়ের আর কিছু নেই? গেরিলারা নিরাপদে আছে।

না, মা। এত সহজ করে কোনো কিছু ভেবো না। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে আমরা ঝুঁকিতে আছি। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ভুল যেন আমাদের বিপদে না ফেলে।

মেরিনা মাথা নাড়ে। বলে, বুঝেছি। খবর পাওয়ার অপেক্ষা আমাদের মাথা থেকে কখনো সরবে না। সব সময় নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আলতাফ মুখ বাড়ায়।

স্যার, আমি ঘুমোতে যাই?

যাও। শুয়ে পড়ে গে। আজ তুমি একটা বড় কাজ করেছ। অবশ্য প্রায়ই তোমাকে করতে হয়।

আমিও যাই, আব্বা?

যাও, মা।

মেরিনা নিজের ঘরে যায়। বিছানায় শুয়ে পড়ার পরও ঘুম আসে না। সতর্ক থাকার একধরনের আতঙ্ক আছে। সেই আতঙ্ক নিয়েও টেবিলে এসে বসে। বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন ড্রয়িংরুমে ছিল, তখন ওর ভীষণ ঘুম পেয়েছিল। দুচোখ জড়িয়ে যাচ্ছিল। হাই উঠছিল। এখন মনে হচ্ছে, দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। মাত্র কতটুকু সময় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে আসা, বাথরুমে যাওয়া, পানি খাওয়া—মাত্র এতটুকু। কিন্তু মনে হচ্ছে, মাঝখানে যোজন যোজন ব্যবধান। ও ঘরের বাতি বন্ধ করতে করতে ভাবে—না, এত রাতে টেবিলে নয়। এখন ঘুমোতেই হবে। খুব অল্প সময়ে বাড়িতে একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। এই একটি ঘটনার ফলাফল বিপুল বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। ও উঠে বারান্দায় আসে। দেখতে পায়, আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসে আছেন।

আমিও বসব, আম্মা?

ঘুম আসছে না বুঝি?

না। মৃদু হেসে আরও বলে, অস্ত্র রাখার বিষয়টি এত এক্সসাইটেড ছিল যে স্নায়ু এখনো টানটান হয়ে আছে। ঝিমিয়ে যাচ্ছে না।

তাহলে আয়। রাতের অন্ধকারে আয়শার কণ্ঠস্বর পৌঁছাতে সময় লাগে। যেন কণ্ঠস্বর শহর ঘুরে এ বাড়ির ভেতর ঢুকেছে। মেয়েটার জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছে, মা।

বাবা বলে, আমার পাশে বস।

মেরিনা বাবার ঘা ঘেঁষে আদুরে ভঙ্গিতে বসে। মনে মনে ভাবে, সেই বয়সটা ফিরে পেলে লাফিয়ে বাবার কোলের ভেতরে ঢুকত। ও কাছে বসলে বাবা ওর মাথাটা কাত করে নিজের ঘাড়ের ওপর রাখেন।

কতক্ষণ পার হয়ে যায় তা কারও মনে থাকে না।

একসময় মেরিনা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, ঘুমোতে পারিনি কেন, জানো?

কেন রে? নতুন কোনো কথা মনে হয়েছে তোর?

আমার জেবুন্নেসার কথা খুব মনে হয়েছে। খুব ইচ্ছা হয়েছিল ওর চিঠিটা পড়ার। কিন্তু পড়তে পারলাম না। আমি অনেক ভেবে দেখেছি যে ওই চিঠিটা ভাইয়াকে দেওয়া আমার জন্য খুব কঠিন। শেষ পর্যন্ত আমি হয়তো পারব না দিতে।

আয়শা খাতুন নিজেও বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন, তুমি দিতে না পারলে আমি দেব, মা। মারুফের সঙ্গে ওর ভালোবাসার সম্পর্ক দিয়ে আমরা ওকে জেনেছি। ওকে আমার এই পরিবারের একজন মনে হচ্ছে। ওকে আমরা দেখিনি। কিন্তু ও দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে। নির্যাতিত হয়ে জীবন দিয়েছে। তাতে কিছু এসে যায় না। ওর মৃত্যুই সত্য। ও আমাদের কাছে শহীদ। মারুফের জানা দরকার, যাকে ও ভালোবাসার কথা বলেছিল, তার সঙ্গে তার আর কেন দেখা হলো না। এই যুদ্ধের সময় তার কী হয়েছিল।

আয়শা খাতুন থেমে থেমে কথা বলছিলেন। একটি বাক্য শেষ করে আরেকটি বাক্য বলতে সময় নিচ্ছিলেন। তিনি যখন থামলেন, তখন মেরিনার কান্নার শব্দ শুনলেন। টের পেলেন আকমল হোসেনও চোখের জল মুছছেন।

তখন মধ্যরাত শেষ হয়েছে।

তারা পরস্পর হাত ধরেন। বাইরে রাস্তায় কোনো শব্দ নাই। মানুষ বা গাড়ির চলাচল নাই। বাড়ির পেছনের বুনো ঝোপে কয়েকটি জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। ঝিঁঝির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। থেমে থেমে।

আকমল হোসেন এসবের মাঝে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়ে বললেন, আজ রাতে আমরা না ঘুমাই?

আমারও তা-ই মনে হয়, আব্বা। আজ রাতে আমরা ঘুমাব না।

মেরিনার কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর মিশে যায় অন্ধকারে।

আয়শা খাতুন অন্ধকার চিরে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, আজ রাতে আমরা না ঘুমিয়ে অস্ত্র পাহারা দেব। আমাদের গেরিলাযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রের দরকার। এই মুহূর্তে আমাদের সামনে যুদ্ধই বড় কথা। যোদ্ধাদের কাছে গানও অস্ত্রের সমান হয়ে গেছে।

আয়শা খাতুন থামলে অন্য দুজন কথা বলেন না।

তাঁর কণ্ঠস্বর গুনগুন ধ্বনির মতো আচ্ছন্ন করে রাখে তাঁদের। জীবনের নিঃশ্বাস অন্ধকারের হাওয়ায় ভাসে।

 

গ্যানিজ ও ভোগ অপারেশনের জন্য তৈরি হয়েছে ক্র্যাক প্লাটুনের তিনজন সদস্য। আজই সেই দিন। আগের দিন রেকি করেছে ওরা। আকমল হোসেন জানেন, বিকেল চারটার দিকে আক্রমণ করা হবে। দুপুরের আগেই এ বাড়ি থেকে অস্ত্র নিয়ে গেছে জুয়েল আর গাজী। দুপুরের পর থেকে বাগানে পায়চারি করেন তিনি। তারপর চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে থাকেন। গেটের কাছ থেকে নড়ার হুকুম নেই আলতাফের-কেউ যদি আসে। কারও যদি কোনো দরকার হয়!

গতকাল গেরিলারা রেকি করার পর তিনি নিজেও রেকি করতে গিয়েছিলেন। গ্যানিজের ভেতরে ঢুকেছিলেন। তীক্ষ্ণ নজরদারিতে দেখেছিলেন গেরিলা অপারেশনের জন্য পরিবেশ বৈরী নয়। ফোনে তাঁর পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছিলেন গাজীকে।

বিকেল চারটার দিকে একজন অবাঙালির হাইজ্যাক করা ৯০ সিসি হোন্ডায় চড়ে তারা গুলিস্তানে আসে। রাস্তায় বাস চলাচল স্বাভাবিক। ভিড় তেমন নেই। ওদেরকে একটি টয়োটা গাড়িতে করে কভার দিয়ে এসেছে সামাদ, উলফত আর জুয়েল। ওরাও চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, এই সামান্য ভিড়ে একটানে গাড়ি চালিয়ে যেতে ওদের অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া আক্রমণের সময় গাড়ি-রিকশা নিজেদের উদ্যোগেও সরে যেতে থাকে। ওদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

ঘরে বসে আকমল হোসেন ঘড়ি দেখেন। ঘড়ির মিনিটের কাঁটার দিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন। সময় দেখে বুঝতে পারেন, ছেলেরা বেরিয়ে গেছে। দুপুরের আগে তিনি জুয়েলের হাতের ব্যাগে একটি স্টেনগান, পাঁচটি গ্রেনেড৩৬ ও ফসফরাস বোমা দিয়েছেন। ওরা কীভাবে যাচ্ছে, সে দৃশ্যটি আর দেখা হলো না। তিনি চেয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে ওদের পিছে পিছে যেতে। রাজি হয়নি জুয়েল। চেঁচিয়ে বলেছে, না, আপনি যাবেন না। আমাদেরকে কভার দেওয়া গাড়ি থাকবে। একমুহূর্ত থেমে আবার বলেছে, আপনার কিছু হোক—এটা আমরা চাই না, চাচা। আপনারা যারা আমাদের দুর্গ, তাদের কিছু হলে আমরা তো আশ্রয় হারাব। যুদ্ধটা কত দিন চলবে, তা তো আমরা জানি না, চাচা। আপনারা আমাদের পাশে থাকুন।

আকমল হোসেন ওর চেঁচামেচির উত্তর দেননি। মনে হয়েছিল, এই কথার উত্তর হয় না। জুয়েল পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে তিনি ওর মাথায় হাত রেখেছিলেন। তিনি জানেন, এই অপারেশনে জুয়েল সামাদের গাড়িতে আছে।

হাইজ্যাক করা হোন্ডা সিসিটা চালাচ্ছে মানু। তার পেছনে আছে মায়া আর গাজী। গাজীর কাছে আছে স্টেনগান। বেশ খানিকটা দূর থেকেই ওরা দেখল প্রতিদিনের মতো গ্যানিজের গেটে পাহারায় আছে চারজন পুলিশ। ওরা অবাঙালি। হোন্ডা সিসি চালিয়ে রেকি করে ওরা। সামাদের টয়োটা কার গেট থেকে সামনের দিকে রাখা হয় স্টার্ট অন রেখে। রেকি করার সময় তিনজনই কালো রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে নেয়। তারপর ফিরে আসে মেইন গেট থেকে কয়েক হাত পেছনে। হোন্ডা থামলে প্রথমে নামে গাজী। স্টেনগান হাতে দৌড়ে যায় সামনে। সেই অবস্থায় স্টেনগানে ম্যাগাজিন ভরে নেয়। পেছনে মায়া। ও চিৎকার করে বলে, হ্যান্ডস আপ।

পুলিশরা হতভম্ব। হ্যান্ডস আপ করে না, কিন্তু বন্দুক হাতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। চারদিকে হইচই। বাইরে চিৎকার করে পথচারীরা। ভেতরে আছে। দোকানে কর্মরত লোকেরা। সঙ্গে বেশ কয়েকজন ক্রেতা। তারা ছোটোছুটি করে দোকানের ভেতরের আসবাবপত্রের আড়ালে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করছে। তাদের পায়ের ধাক্কায় ছোট ছোট ঝুড়ি বা ওয়েস্টপেপার বাস্কেট কিংবা কাগজের বাক্স ইত্যাদি উল্টে গিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। কেউ কারও দিকে তাকায় না। প্রত্যেকে নিজেকে লুকানোয় ব্যস্ত।

দুজনের কেউই তখনো দোকানের ভেতরে ঢোকেনি। পুলিশ চারজন কী করবে বুঝে ওঠার আগেই গাজী ওদেরকে ব্রাশফায়ার করে। পড়ে যায় ওরা। রক্তাক্ত ফুটপাত থেকে রক্তের স্রোত নামে রাস্তায়। উধ্বশ্বাসে মানুষজন পালায়। আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বায়তুল মোকাররমের সামনের ফুটপাত থেকে দোকানিরা পাততাড়ি গোটায়। মুহূর্তে রাস্তা জনশূন্য হয়ে যায়।

মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মায়া দোকানের ভেতরে গ্রেনেড-৩৬ ছুড়ে মারে। সঙ্গে একটি আগুনে ফসফরাস বোমা। ভেতরে হইচই-চেঁচামেচিচিৎকার, ক্রন্দন ভেসে আসে ওদের কানে।

গাজী দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে, বুঝে দেখ, পঁচিশের রাতে তোদের সেপাইরা আমাদের কী করেছে। ভেবে দেখ, আমাদের ইপিআর সদস্যদের কীভাবে মেরেছিস!

আয়। দেখ, আমাদের কভার দেওয়া গাড়ি আড়াআড়িভাবে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।

দেখতে পাচ্ছিস কি জুয়েলের হাতে স্টেনগান। স্টেনের নল বের করে রাস্তার দিকে তাক করে রেখেছে ও।

দুজনে ফুটপাত ধরে দৌড়ে গিয়ে হোন্ডায় ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিয়ে রাখা হোন্ডা চালাতে শুরু করে মানু। সামনেই আছে কভার দেওয়া টয়োটা। স্টেনগানের নল আর দেখা যায় না। সেটা ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। পেছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে হাত নাড়ে জুয়েল। দুআঙুল তুলে ভি দেখায়। দূর থেকে ওরা কিছু বলতে পারে না।

বেশ গতিতেই হোন্ডা চালাতে চালাতে মানু ঘাড় নাড়িয়ে বলে, কনগ্রাচুলেশন ফর গ্রেট সাকসেস।

গাজী শিস বাজিয়ে বলে, হিপ-হিপ-হুররে।

মায়া ওর ঘাড়ে চাপ দিয়ে বলে, বাড়াবাড়ি হচ্ছে, থাম।

এটা আমাদের বিজয় উৎসব।

ওটা রূপগঞ্জে গিয়ে হবে। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে, যেখানে গেরিলারা অবস্থান নিয়েছে। আমরা একটা মুক্ত এলাকা গড়ে তুলেছি।

মানু গম্ভীর স্বরে বলে, তোরা কথা থামা। এটা বেশি কথা বলার সময় না। এটা উল্লাসেরও সময় নয়।

উল্লাস জীবনের ধর্ম। যুদ্ধের সময়ও উল্লাস চাই।

বাব্বা, দার্শনিক ভাবনা! তোরা আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেছিস। এখন চুপ করে থাক, নইলে হোন্ডা থেকে ফেলে দেব।

কেউ কোনো কথা বলে না। সামনে লালবাতির সিগন্যাল না মেনে ছুটে বেরিয়ে যায় হোন্ডা। গতি বাড়িয়ে দেয় মানু। টয়োটা কার অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দোকানপাট বন্ধের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। ওরা যাবে ভোগে। ওই দোকানেও আজকে অপারেশন। গুলিস্তানের খবর ছড়িয়ে পড়াতে সন্ত্রস্ত মানুষ ছুটছে। খবর পৌঁছাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। রাস্তায় ছোটার সময় সেটাই টের পায় ওরা।

গাজী বলে, হাতে সময় খুব কম। প্রস্তুতি নিতে হবে।

মায়া দ্রুত একটি ফসফরাস গ্রেনেড পিন-আউট করে গাজীর হাতে দেয়। ওরা জানে, এভাবে পিন-আউট গ্রেনেড নিয়ে ছোটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বেশি ঝাকুনি লাগলে পিন-আউট করা ফসফরাস বোমার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তার পরও ওরা নির্ভীক।

খুক করে হেসে মায়া বলে, দুঃসাহসী অভিযান ভয়হীন। ভয় করবি তো পেঁদিয়ে যাবি।

পেঁদিয়ে যাবি কী রে? আগে তো কখনো শুনিনি।

চুপসে যাবি।

মনে এত আনন্দ যে নতুন শব্দও আবিষ্কার করছিস?

চুপ শালা।

আবার বেগে ছুটে চলা। গতি মাপার সময় নেই। তীব্র গতিতে ছুটছে হোন্ডা সিসি। গাজী খুব সতর্কভাবে ফসফরাস বোমাটি ধরে রেখেছে।

দোকানের কাছাকাছি এলে ওরা দেখতে পায়, ভোগের কর্মচারীরা দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছে। প্রায় বন্ধ করেই ফেলেছে। দোকানের শাটার আর এক হাত মাত্র খোলা। ওরা বুঝে যায়, হোন্ডা থেকে নেমে কাজ করার সুযোগ নেই। তাহলে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

ঘাড় না ঘুরিয়ে মানু বলে, সময় নষ্ট করার সময় নেই। হোন্ডা থামাব না।

আমারও মনে হচ্ছে, থামানোর দরকার নেই।

মায়া চেঁচিয়ে বলে, গেট রেডি গাজী।

দোকানের সামনে এসে হোন্ডা স্লো হয় মাত্র। একমুহূর্ত দেরি না করে চলন্ত হোন্ডা থেকে সেই দরজার ওপর ফসফরাস বোমা ছুড়ে মারে গাজী।

হইচই-আর্তচিৎকার শুরু হয়।

শাঁই করে বেরিয়ে যায় হোন্ডা। দোকানের কাছে আসার আগেই কভার দেওয়া গাড়িটি পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের পিছু নিয়েছিল। হোন্ডা বেরিয়ে গেলে কভার দেওয়া গাড়িও সঙ্গে সঙ্গে ওদের অনুসরণ করে।

 

ঘড়ি দেখে উন্মুখ হয়ে থাকেন আকমল হোসেন। ভাবেন, এতক্ষণে ওদের অপারেশন শেষ হয়েছে। নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেছে তো ওরা? মেরিনা কাছে এসে দাঁড়ায়। আয়শা খাতুনও। আকমল হোসেন ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমরা সবাই একই চিন্তায় আছি, না?

নিশ্চয়ই ওরা এতক্ষণে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেছে।

আমিও তাই ভাবছি, আম্মা।

মেরিনার কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা ধ্বনিত হয়। দরজায় এসে দাঁড়ায় আলতাফ ও মন্টুর মা। আয়শা খাতুন বলেছেন, যতক্ষণ ওদের খবর না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ রান্নাঘরে চুলো জ্বলবে না। আলতাফ নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ওদের খবর না পাওয়া পর্যন্ত একটি বিড়িও টানবে না।

আম্মা, আমি টেলিভিশন ছাড়ি? মেরিনার অস্থির আচরণ ওর কণ্ঠস্বরেও ধরা পড়ে।

ছাড়তে পারো। তবে এত তাড়াতাড়ি ওরা ওদের ভাষায় দুষ্কৃতিকারীদের কোনো খবর দেবে না।

তার পরও ছেড়ে রাখি। যদি কোনো কিছু শুনতে পাই।

আকমল হোসেন বলেন, ভলিউমটা লো করে রাখিস, মা।

আলতাফ আর মন্টুর মা বারান্দায় আসে। সিঁড়ির ওপর বসে মন্টুর মা। আলতাফ গেট খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। গাড়ির চলাচল খেয়াল করে। ভাবে, যদি কোনো গাড়িতে করে ওরা এ বাড়িতে আসে তাহলে ওদের বলবে, আপনাদের পরের অপারেশনে আমাকে নেবেন। আমি ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হতে চাই। ওরা বলবে, আপনার তো ট্রেনিং নেই, আলতাফ ভাই। আমি বলব, আপনারা আমাকে ট্রেনিং দেন। আমি ত্রিপুরার মেলাঘরে ট্রেনিং নিতে পারব না। ঢাকায় কোন মাঠে যেতে হবে আমাকে বলেন। ওরা তখন নিশ্চয়ই কোনো জায়গায় যেতে বলবে ওকে। ও রাইফেল চালানো শিখবে। গ্রেনেডের পিন খোলা শিখবে।

আলতাফ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুহাতে মুখ ঢাকে। নিজেকেই বলে, সব সময় বড় ঘটনার সঙ্গী হতে হয়। যে বড় ঘটনার সঙ্গী হতে পারে না, সে অভাগা।

তারপর নিজেকেই বলে, তুমি তো বড় ঘটনার সঙ্গী হয়েছ, আলতাফ মিয়া। তুমি এই দুর্গের পাহারাদার। দরকারমতো অস্ত্র বের করে দাও। দরকারমতো লুকিয়ে রাখো।

হ্যাঁ, তা দেই।

নিজেকেই উত্তর দেয়। তারপর গেটে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি ওরা আসে! একমুহূর্ত দেরি না করে গেট খুলতে হবে। চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি-রিকশা। পায়ে হাঁটা মানুষ। কখনো দু-একটা মিলিটারির গাড়ি। সেনাদের মাথায় হেলমেট থাকে। আর রাইফেলের নল উঁচিয়ে রাখে। কত দূর থেকে ওরা এই দেশে মরতে এসেছে। আলতাফ দুহাত ওপরে তুলে বলে, তোমাদের গেরিলাযোদ্ধাদের হাতে মরতে হবে। মরতেই হবে। রেহাই পাবে না।

মন্টুর মা সিঁড়িতে বসে থাকতে পারে না। উঠে রান্নাঘরে আসে। ভাবে, ওরা কখন আসবে? ওরা এলে তো আগে পানি চাইবে। তার পরে চা। মন্টুর মা ট্রের ওপর গ্লাস সাজিয়ে রাখে। পানি ঢালে না। আসার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে ঠান্ডা পানি ঢালবে। আর একটি ট্রের ওপর চায়ের কাপ সাজায়। চায়ের পাতা, চিনির কৌটা ওপর থেকে নামিয়ে হাতের কাছে রাখে। চায়ের কেটলিতে পানি ভরে কেরোসিনের স্টোভের ওপর রাখে, যেন শুধু আগুন জ্বালালেই হয়। কাজ গুছিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে পিড়ির ওপর বসে থাকে।

মেরিনা রান্নাঘরে আসে।

ফ্রিজে কয় বোতল পানি আছে, তা দেখতে এলাম।

মন্টুর মা বসে থেকেই বলে, ওনারা যদি দশজনও আসে, তা-ও ঠান্ডা পানি দিতে পারব।

ভালোবাসা আপনাকে, খালা।

ফ্রিজে পনির আর পায়েস আছে।

ব্যস, অনেক। আমার মা তো মা না, এই বাড়ির সেনাপ্রধান। বন্দুক-গুলিগ্রেনেড-বোমা-ভাত-মাংস-পায়েস-পনির-কমলা-আপেল-বিছানা-বালিশ সব তার হাতের মুঠোয়। মা যে কী পারে না, তা আমি বুঝতে পারি না। আমাদের প্রিয় নবীর স্ত্রী আয়শা উটের পিঠে চড়ে যুদ্ধ করেছিলেন। আমার মায়ের নাম আয়শা। যুদ্ধ তাঁর কাছেও ভাবনা।

মন্টুর মা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, শুধু ভাবনা না, শক্তিও। মনের শক্তি।

ঠিক বলেছেন। মেরিনা হাত তুলে নিজেকে ঝাঁকায়।

মন্টুর মায়ের মনে হয়, মেরিনার চেহারায় আলোর ঝলকানি। মেরিনা এক গ্লাস পানি খেয়ে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। মন্টুর মা আবার বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে বসে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ এই বাড়িতে আসে না।

এতক্ষণ ধরে আকমল হোসেন অনবরত নিজেকে সামলেছেন। মাগরেবের আজান ভেসে আসছে। তিনি উঠে আলম হাফিজকে ফোন ঘোরালেন। দিলু রোডের তাঁর বাড়িটিও একটি দুর্গ। ফোন ধরল তার মেয়ে সোমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী। আকমল হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, মা, তোমার আব্বা কোথায়?

আব্বা নামাজ পড়ছেন, চাচা। নামাজ শেষ হলে আব্বাকে বলি আপনাকে ফোন করতে।

না, আমিই করব। তুমি ছোট্ট করে উত্তর দাও—

আকমল হোসেন কথা শেষ করার আগেই সোমা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, ওরা সবাই ভালো আছে, চাচা। একেকজন একেক বাড়িতে চলে গেছে। একসঙ্গে নেই। মোটরসাইকেল মগবাজারের রেললাইনের ধারের গলিতে ফেলে গেছে। আপনি কিছু ভাববেন না। চাচা, আপনি ভালো আছেন তো?

হ্যাঁ মা, ভালো আছি।

তিনি কথা বলার সময় তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আয়শা খাতুন আর মেরিনা। তিনি মুখ ফিরিয়ে আয়শা খাতুনকে বললেন, তোমার চুলোয় আগুন দিতে পারো। অপারেশন সাকসেসফুল। ছেলেরা বিভিন্ন বাড়িতে হাইডে চলে গেছে।

আমার ছেলেটা ফোন করেনি।

আহ্ আশা, এমন করে বলতে নেই। সব সময় মনে করবে, ওরা কোনো কাজে আছে।

তা ঠিক। কখনো পরিস্থিতি মানতে না পারা নেহাতই ছেলেমানুষি।

আয়শা সরে যান। মেরিনা মৃদু স্বরে বলে, মা দুঃখ পেয়েছেন।

তুই মায়ের কাছে যা। তার স্বস্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর।

এখন মা একা থাকতে চাইবেন। আমি আমার নিজের ঘরে যাচ্ছি।

তখন আলতাফ নিজের ঘরে ঢুকে বিড়ি জ্বালায়। মনের সুখে টানতে টানতে পা নাচায়। ভাবে, একটা অপারেশনে যোগ দিতেই হবে। নইলে জীবন বৃথা। বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনিরা যুদ্ধের গল্প শুনতে চাইলে তখন কী বলবে? শুধু অস্ত্র পাহারা দেওয়া নয়, আরও বেশি কিছু চাই।

সেই সন্ধ্যায় আলতাফ একজন চেইন স্মোকার হয়। আয়শা খাতুন রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেন, কেরোসিনের চুলা জ্বলছে। সে আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে মন্টুর মা। তিনি ফিরে আসেন ডাইনিং স্পেসে। ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করেন। ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে তিনি মনে করেন, এই মুহূর্তে পানির চেয়ে আগুনই তার বেশি প্রিয়। তিনি শুরু করেন গুনগুন ধ্বনি-আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…। গানের সুর শুনে আকমল হোসেন মাথা তোলেন। কিন্তু না, আয়শা খাতুন এ ঘরে নেই। মেরিনা পড়ার টেবিলে বসে দরজার দিকে তাকায়—মা কি এ ঘরে আসছেন?

আয়শা খাতুন মেয়ের ঘরে ঢোকেন না। তিনি পেছনের বড় বারান্দায় এসে বসেন। আকাশ দেখেন। আকাশের পটভূমিতে আগুনের শিখা বুকের মধ্যে জাগিয়ে রাখেন।

মায়ের গুনগুন ধ্বনি শুনে মেরিনার মনে হয়, এই ধ্বনির মধ্যে শুধু সুর আর বাণী নেই, অন্য কিছু যোগ হয়েছে। আকমল হোসেনও এমন ভাবনাই করেন। টেবিলের ওপর রাখা নিজের কাগজপত্র দেখতে দেখতে ভাবেন, পরের পরিকল্পনা সামাদ বলেছে ইন্টারকন্টিনেন্টালে অপারেশন। প্রথম অপারেশনের পর এখানে পাহারার খবরদারি কড়াকড়ি হয়েছে। তীক্ষ্ণ নজর রাখা হয়েছে। হোটেলে অনায়াসে প্রবেশ দুঃসাধ্য। সে জন্য হোটেলে ঢুকতে হবে। দেখাতে হবে যে, আমরা পারি।

তিনি মাথা সোজা করে চেয়ারে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বোজেন। একেকটি পরিকল্পনার কথা চিন্তা করলে তার ভেতরে প্রশান্তি ছড়ায়। তিনি মনে করেন, ক্ষণিকের জন্য হলেও ওই প্রশান্তি উপভোগ করা উচিত। আজও সেই শান্ত-স্নিগ্ধতায় শুনতে পান আয়শা খাতুনের পায়ের শব্দ। তিনি মৃদু স্বরে ডাকেন, আশা।

বলো।

তোমার গুনগুনে আজ ভিন্ন কিছু পেয়েছি। শুধু সুর আর বাণী না।

তুমি যে আগুন জ্বালাতে বললে?

তাহলে এ বাড়ির সবকিছুতে আজ আগুন?

আমি তো সেরকমই মনে করছি।

এই মনে করা আমাদের জীবনে সুন্দর হোক। মৃত্যু ও ধ্বংসের সৌন্দর্য।

আয়শা খাতুন কথা বলেন না। তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘরে এসেছেন টাকা নিতে। আলতাফকে দোকানে পাঠাবেন। সে কথা ভুলে যান। দাঁড়িয়েই থাকেন। চেইন স্মোকার আলতাফের ছোট অ্যাশ-ট্রেতে আরও দুটুকরো সিগারেটের পোড়া জমা হয়। মন্টুর মা স্টোভের ওপর থেকে ভাতের পাতিল নামালে আগুন ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। শুধু মন্টুর মা মাড় পালানোর জন্য ভাতের পাতিল উপুড় করে।

 

একদিন ক্র্যাক প্লাটুনের পাঁচজন বাড়িতে আসে। আগামীতে ওরা ইন্টারকন্টিনেন্টালের বাথরুমে বিস্ফোরক রাখবে বলে ঠিক করেছে। গতকাল আকমল হোসেন নিজেও হোটেলের চারপাশ রেকি করে এসেছেন। দেখেছেন পাহারার পরিমাণ কেমন এবং কতটা ডিঙাতে হবে। হোটেলের বিভিন্ন জায়গায় পাহারার জন্য অসংখ্য মিলিশিয়া রাখা হয়েছে। আগের চেয়ে তিন গুণ বেশি। হোটেলের তিন দিকের কোনায় বালির বস্তা দিয়ে প্রতিরোধের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। সেই বস্তার ওপর লাইট মেশিনগান নিয়ে সারাক্ষণ পাহারায় থাকছে সেনাবাহিনীর সদস্য।

পায়ে হেঁটে এসব দেখে তিনি কপালের ঘাম মুছলেন। বুঝলেন, এই অপারেশন সাকসেসফুল না হলে মৃত্যু। তার পরও সময় এখন জীবন-মৃত্যুর লড়াই। তিনি গাড়িতে ফিরলেন। আলতাফ বসে আছে গাড়িতে। এসব ক্ষেত্রে তিনি ওকে নিয়ে আসেন। তিনি গাড়িতে উঠলে আলতাফ সরাসরি বলে, কালকে আমি ভাইয়াদের সঙ্গে থাকব, স্যার।

এখন কথা না। আগে বাড়ি যাই।

তিনি গাড়িতে স্টার্ট দেন। তিনি আলতাফের মনোভাবের কথা জানেন। ও বারবারই বলে। কিন্তু গেরিলা অপারেশন তো পাড়ার খেলার মাঠে ফুটবল খেলা নয় যে, যে কেউ খেলায় অংশ নেবে। বলের গায়ে দু-চারটি লাথি মেরে বলবে, ফুটবল খেলেছি।

চা খাওয়ার ফাঁকে তিনি ছেলেদের নিজের রেকি করার কথা বলেন। ওরা মনোযোগ দিয়ে তার বিবরণ শোনে। কথা থামিয়ে তিনি সামাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, এবার তোমার কথা শুনব। কারণ, তুমি ভেতরে ঢুকে দেখে এসেছ।

আমি হোটেলে ঢোকার সুযোগ করে নিয়েছি জামাল ওয়ারিসের মাধ্যমে। তিনি একজন অবাঙালি। ঢাকাতেই থাকেন। আমি তাঁর কাছ থেকে থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের নতুন অফিসঘরে নিয়ন সাইনবোর্ড লাগানোর অর্ডার সংগ্রহ করতে যাই। সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোথায় কী করব, সেই বিষয়ে রেকি করি। আমার মনে হয়, যেভাবে বিস্ফোরক রাখার চিন্তা করেছি, তা ঠিকমতো রাখতে পারলে আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল হবে।

সবাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল। থামতেই মেরিনা বলে, ইনশাআল্লাহ, আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে গেলাম। এর পরের অপারেশনে আমি যাব। আম্মা আমাকে একটা ট্রাউজার আর শার্ট কিনে দেবেন। আব্বা, কী বলেন?

তোমার ট্রেনিং দরকার, মা।

আমি ভাইয়াদের কাছ থেকে যা শুনছি এবং দেখছি, তাতে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আমি পারব।

বাকের হাসতে হাসতে বলে, তুমি তো এমনিতেই গেরিলা। তুমি আমাদের সবকিছুর সঙ্গেই আছ।

আরও কিছু করতে চাই।

আয়শা খাতুন গম্ভীর স্বরে বলেন, ওকে করতে দেওয়াই উচিত। আমার বিশ্বাস, ওকে যে কাজ দেওয়া হবে, তা ও পারবে।

আকমল হোসেন অন্যদের থামিয়ে দিয়ে বলেন, ওকে দিয়ে কী করানো যায়, তা আমাকে ভাবতে দিয়ো। আমাদের কালকের অপারেশন শেষ হোক।

সবাই মাথা নেড়ে সায় দেয়।

রূপগঞ্জে মারুফ ভালো আছে তো, মতিন?

হ্যাঁ, ভালো আছে, খালাম্মা। ও প্রায়ই বাড়ির কথা মনে করে। ওর বাড়িটা একটা দুর্গবাড়ি—এ নিয়ে ওর মনে গর্ব আছে।

আয়শার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মৃদু হেসে বলেন, ভয় পাই শারীরিক অসুস্থতার। জ্বর, আমাশা, নিউমোনিয়া…

যুদ্ধের সময় এসব ভাবা ঠিক নয়, আয়শা। হলে হবে। আবার সুস্থও হবে।

ঘরে একমুহূর্ত নীরবতা। আকমল হোসেন যা বললেন, তার বিপরীতে কেউ আর কোনো কথা বলে না। সময় যে কত গভীর এবং মন্ময় হতে পারে, সকলে তা উপলব্ধি করে। সময়ের গভীরতায় নিমগ্ন মানুষের কথা অকস্মাৎ ফুরিয়ে যায়। কতক্ষণ কেটে যায় কেউ জানে না।

মতিন বলে, আমরা এখন যাই। কাল আসব।

এসো। সাবধানে যেয়ো। ভালো থেকো।

ঘরে কথা নেই। জেগে ওঠে পদশব্দ। দরজায় দাঁড়িয়ে মতিন বলে, পুরো রূপগঞ্জ গেরিলা ক্যাম্প হয়েছে। ওখানে গেলে আমাদের শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যায়।

তোমাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ তোমাদের সুস্থ রাখুন।

তোমাদের মঙ্গল হোক।

আয়শা খাতুন ওদের পিছু পিছু বারান্দা পর্যন্ত যান। মেরিনা গেট পর্যন্ত আসে। আলতাফ গেট সামান্য ফাঁক করে একজনকে যেতে দেয়। তারপর চারটি গেটের আরেকটি দিয়ে আরেকজনকে। সবশেষে দুজনকে পেছনের গেট দিয়ে। এখান থেকে ভিন্ন পথে বের হয়ে ওরা আবার মিলিত হবে এক জায়গায়।

আকমল হোসেন জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকান। সেই কবে এই শহরে তাঁর জন্ম, সেই কত বছর ধরে এই শহরে তার বেড়ে ওঠা—শহরের সঙ্গে জানাজানি কতভাবে! এই জানা থেকে ধুলোবালি এবং পোকামাকড়ও বাদ নেই। ঘাস-গাছ-লতাপাতাও বাদ নেই। এখন এই শহর তার সামনে নতুনভাবে জেগে উঠেছে। সামনে সুদিন। শহরের ভৌগোলিক অবস্থান বদলাবে, শহরটি যুদ্ধ করে স্বাধীন করা একটি দেশের রাজধানী হবে। উপমহাদেশের মানচিত্র বদলে দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেবে। তার বুকের ভেতর আনন্দের জোয়ারধ্বনি। আগামীকাল তিনি নিজে ছেলেদের হাতে বিস্ফোরক উঠিয়ে দেবেন।

পরদিন সামাদের ব্রিফকেসে ঢোকানো হয় ২৮ পাউন্ড পিকে এবং ৫৫ মিনিট মেয়াদি টাইম-পেনসিল। ওরা দ্রুত গাড়িতে উঠে রওনা হয়। কোনো কথা নেই। বিদায় নেই। আকমল হোসেন হাতঘড়িতে সময় দেখেন। দেয়ালঘড়ির দিকেও তাকান। তারপর গেরিলা পত্রিকায় শান্তি কমিটির ওপর লিখবেন বলে টেবিলে গিয়ে বসেন।

 

ততক্ষণে গাড়ি পৌঁছে গেছে ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে। আগেই ঠিক করা ছিল যে তারা মেইন গেট দিয়ে ঢুকবে না। দুজন ঢুকবে ভেতরে, দুজন গাড়িতে অপেক্ষা করবে স্টেনগান হাতে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুইস এয়ার অফিসঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে সামাদ আর বাকের। ওদের সহযোগিতা করে ওই অফিসে কর্মরত বন্ধু। ফিসফিসিয়ে বলে, সাবধানে যা। ফেরার পথ অন্যদিকে।

জানি। তুই সাবধানে থাকিস।

এক সেকেন্ড মাত্র। বন্ধুর হাত ধরে ছেড়ে দেয় ওরা। বুঝতে পারে, চারপাশে ওরা আছে বলে কাজ সহজ হয়ে গেছে। ওরা আছে বলে প্রসার জায়গা তৈরি হয়। দুজনে পেছন ফিরে তাকায় না। বুঝতে পারে, ওদের বন্ধু নিজের চেয়ারে গিয়ে বসেছে। আর কিছুক্ষণ পর অফিস ছুটির সময় হয়ে যাবে। বন্ধু বলেছে, ছুটির আধঘণ্টা আগে ও অফিস ছেড়ে চলে যাবে অন্যত্র কাজ আছে এই অজুহাতে।

দুজনে টয়লেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রথমে ঢোকে সামাদ। চারদিক দেখেশুনে বেরিয়ে আসে। তারপর ব্রিফকেস নিয়ে ঢোকে বাকের। ব্রিফকেস কমোডের পেছনে রাখে। তারপর টাইম-পেনসিল প্রেস করে। দ্রুত দরজা বন্ধ করে বের হয়ে আসে। দুজন দুপথে বের হয়ে গাড়িতে ওঠে। সামান্য সময় মাত্র। গাড়ি শাঁই করে ছেড়ে যায় হোটেলের এলাকা।

বিকেল পাঁচটা ৫৬ মিনিটে ঘটে বিস্ফোরণ। ৫৫ মিনিট মেয়াদি টাইমপেনসিল ছিল। ওদের বাড়িতে পৌঁছাতে অসুবিধা হয় না। ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে ধানমন্ডি ৫ নম্বর বাড়িটি বেশি দূরে নয়। ধানমন্ডি ২৭ এবং ২৮-ও ওদের টার্গেট ছিল। যে যার মতো পৌঁছে গেল বাড়িতে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আকমল হোসেন বুঝলেন, ওরা যদি বিপদে না পড়ে, তবে এতক্ষণে নিরাপদে বাড়িতে চলে গেছে। তার পরও সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। ওদের ফোনের অপেক্ষা।

সন্ধ্যার পর মিজারুল ফোন করে।

চাচা, অপারেশন সাকসেসফুল। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠেছে হোটেল। শপিং আর্কেড, লাউঞ্জ এবং আশপাশের ঘরের জানালার কাচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বাথরুমের দেয়ালও ভেঙে পড়েছে। আহত হয়েছে। কয়েকজন।

তোমাদের অভিনন্দন, বাছারা।

আমরা কাল সকালে রূপগঞ্জ চলে যাব। সবাই একসঙ্গে না। ভাগে ভাগে। বিভিন্ন সময়ে।

সাবধানে যেয়ো, বাছারা। তোমরা আমাদের সোনার ছেলে। দোয়া করি, ভালো থাকো।

আকমল হোসেন ফোন রেখে দেওয়ার পর দুহাত ওপরে তুলে নেচে ওঠে মেরিনা।

কী আনন্দ, কী আনন্দ! আব্বা, ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশি সাংবাদিক থাকলে তারা নিশ্চয় এই খবর ছড়িয়ে দেবে সারা দুনিয়ায়।

সেটাই তো করা উচিত। ঢাকা শহরের গেরিলাযুদ্ধ…

আকমল হোসেন আর বাক্যটি শেষ করেন না। আয়শা খাতুন বলেন, তুমি কি চা খাবে? বিকেলে তো খাওনি।

হ্যাঁ, তোমার চুলায় জ্বলে উঠুক আলো। আগুন জ্বালো।

আজ আগুন আমি জ্বালাব।

মেরিনা একছুটে রান্নাঘরে আসে। মন্টুর মা পিড়ি পেতে বসে আছে। মেরিনাকে দেখে চোখ বড় করে বলে, বুঝেছি। ওরা জিতেছে।

হ্যাঁ, দারুণ জয়। আজ আগুন আমি জ্বালাব।

না, আমি। আমি জ্বালাব।

মন্টুর মা ঘুরে স্টোভের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশলাইটা নিজের মুঠিতে নেয়। মেরিনার দিকে তাকিয়ে বলে, সব সময় তো আমি জ্বালাই। আজ খুশির দিনে আমি জ্বালাব না কেন? আমিও তো যুদ্ধ করতে চাই।

মেরিনা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মন্টুর মায়ের দিকে। মন্টুর মা স্টোভ জ্বালিয়ে পানি বসায়। মেরিনা ছুটে ড্রয়িংরুমে এসে বলে, আব্বা, খালা আমাকে আগুন জ্বালাতে দেয়নি। বলেছে, এই আগুন জ্বালানো তার যুদ্ধ। আরও বলেছে, এই যুদ্ধ তাকে করতে দিতেই হবে।

আকমল হোসেন হা-হা করে হাসেন। অনেক দিন পর তার এই প্রাণখোলা হাসি দেখে আয়শা খাতুন ভ্রু কুঁচকে বলেন, হাসছ যে? কিসের এত আনন্দ?

যুদ্ধ সবখানে পৌঁছে গেছে। আমাদের আর ভয় নাই। আমরা জয়ী হবই।

আকমল হোসেন আবার হাসিতে ভেঙে পড়েন। হাসতে হাসতে সোফার গায়ে মাথা ঠেকান।

মেরিনা বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে মৃদুস্বরে ডাকে, আব্বা।

বল, মা।

এটা কি আনন্দের সময়?

সবকিছুর সময়। কোনোটা বাদ দিয়ে কোনোটা নয়। তোর মা যেমন গুনগুন ধ্বনিতে আমাদের ভরিয়ে দেয়, তেমন এই হাসি দিয়ে আমি গেরিলাদের বিজয়ের আনন্দ করব। অবশ্যই এটা আনন্দের সময়।

এখন আমরা সবাই মিলে তোমার সঙ্গে হাসব।

অবশ্যই হাসবি। এই হাসি দিয়ে আমরা জেবুন্নেসার মৃত্যুর উৎসব করব। ও এই পরিবারের একজন হতে পারত। হয়নি। তাতে কিছু আসে-যায় না। আমার ছেলের ভালোবাসা ও পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ও একজন শহীদ। বীর নারী। শত্রুর গায়ে থুতু ছিটিয়ে জীবন দিয়েছে।

আকস্মিকভাবে ঘরে স্তব্ধতা নেমে আসে। কারও মুখে কথা নেই। আয়শা সোফায় মাথা হেলিয়ে চোখ বোজেন। মেরিনা অপলক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা কী আশ্চর্য সৌন্দর্যে ইতিহাসের পাতায় রং মাখালেন। ওর বুকের ভেতর তোলপাড় করে। নিজেকে বলে, জেবুন্নেসা, তুমি অমর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *