০৪. দেখিতে দেখিতে বৰ্ষা নামিয়া পড়িল

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

দেখিতে দেখিতে বৰ্ষা নামিয়া পড়িল। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষেই। কি যে হইয়াছে দিন-কালের সে কথা কৃষিজীবী সাধারণ মানুষগুলি বুঝিতে পারিতেছে না। চিরকালের প্রবাদখনার বচন চৈতে মথর মথর, বৈশাখে ঝড়পাথর, জ্যৈষ্ঠ মাটি ফাটে—তবে জেনো বর্ষা বটে। অর্থাৎ চৈত্রে আধা শীত আধা গরম, বৈশাখে কালবৈশাখী, জ্যৈষ্ঠে প্রখর গ্রীষ্ম—এই হইলে জানিবে সুবর্ষা অবশ্যম্ভাবী। আর এ ফাল্গুনের শেষ হইতেই গরম উঠিতেছে; চৈত্রে বৈশাখে মারাত্মক রৌদ্র, কালবৈশাখী নাই! কদাচিৎ এক-আধ পসলা বর্ষা ঝড়; শিলাবৃষ্টি তো নাই। তারপর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে হঠাৎ বর্ষার মেঘ গুরু গুরু ডাকিয়া চলিয়া আসিতেছে। চাষীদের বীজ পাড়া হইতেছে না। বর্ষা তাহাদিগকে বেকুব করিয়া দিয়া বিদ্যুতের মৃদু মৃদু চমকে যেন সকৌতুকে হাসিয়া তামাশা করিতেছে। মহাতাপ বর্ষার মেঘকে নিত্য গালি পাড়ে। সে বিপুল বিক্ৰমে মাঠে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে। শুকনা ধুলার বাতে বীজ পাড়া হইয়াছে সামান্য। বাকি বীজ আছাড়া করিয়া ফেলিতে হইবে। দশ দিনের মধ্যে সে কাজ শেষ করিয়া মহাতাপ জমিতে জল বাঁধিয়া লাঙল চালাইতে লাগিয়াছে। সেতাবও এখন মাঠে। সে কখনও খানিকটা কোদাল চালায়। কখনও এক-আধবার লাঙলের মুঠা ধরে। আলের উপর বসিয়া তামাক সাজে, নিজে খায়। মহাতাপকে ডাকিয়া হাতে হুঁকা দিয়া তাহার লাঙলটা গিয়া ধরে।

মহাতাপ বলে—ক্ষ্যাপামি কোরো না। মোষের লেজের বাড়িতে তুমি পড়ে যাবে। মহাতাপ দুইটি বিপুলকায় মহিষ লইয়া লাঙল চালায়।

নোটন কৃষাণ মুখ টিপিয়া হাসে। মিথ্যা বলে নাই ছোট মনিব। বড় মনিব তাহার তালপাতার সেপাই।

সেদিন আষাঢ়ের পনেরোই। গত দুই-তিন দিন মুষলধারে বৃষ্টি নামিয়াছিল। মাঠ-ঘাট প্রায় ভাসিয়া গিয়াছে। সকালবেলাটাও ঘনঘটা হইয়া রহিয়াছে। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়িতেছে। চাঁপাডাঙার বউ দাওয়ার উপর আঁচল বিছাইয়া শুইয়া অলস দৃষ্টিতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। মানিক একটা বাটিতে মুড়ি খাইতেছে।

মানদা ভিজিতে ভিজিতে এক পাজা বাসন লইয়া বাড়িতে ঢুকিল। দুম করিয়া দাওয়ার উপরে রাখিয়া দিয়া আবার প্রায় ছুটিয়া বাহির হইয়া যাইবার উদ্যোগ করিল।

চাঁপাডাঙার বউ বলিল, মানু–

—আসছি।

–যাচ্ছিস কোথা নাচতে নাচতে?

–মাছ।

—মাছ!

–মাছ উঠেছে পুকুর থেকে! ঘোট ঘোট পোনা।

–পোনা বেরিয়ে যাচ্ছে? গোবিন্দকে পুকুরের মুখে বার দিতে বল্‌।

–তুমি বল। আমি মাছ ধরে নিয়ে আসি। শো-শো করে নালার জলে ছুটছে সারবন্দি। সে বাহির হইয়া গেল।

মানিক দাঁড়াইয়া উঠিল—আমি যাব। সে তাহার সাধের বাঁশিটা লইয়া একবার বাজাইয়া দিল–পু!

বড় বউ তাহাকে কোলে লইয়া মাথায় মাথাল দিয়া উঠানে নামিল। নহিলে যে দুরন্ত ছেলে জলে ভিজিয়া নাচিয়া-কুঁদিয়া একাকার করিবে। মহাতাপের ছেলে তো! খামারবাড়িতে আসিয়া ডাকিল, গোবিন্দ! গোবিন্দ।

মানিক বাঁশি বাজাইল—পু-পু। খামারে গোবিন্দ নাই। নিশ্চয় বর্ষার আরামে গোয়ালের দাওয়ায় খড়ের গাদা বিছাইয়া শুইয়া ঘুম দিতেছে। ঘোড়াটা ইদানীং বড় কাজে ফাঁকি দিতেছে। কোনোদিন সন্ধ্যার সময় থাকে না। সন্ধ্যার আগেই গরু গোয়ালে ঢুকাইয়া পালায়। তাও দুটাএকটা বাছুর বাহিরে ফেলিয়া যায়।

সে গোয়াল-বাড়িতে আসিয়া ঢুকিল।

গোবিন্দ ঘুমায় নাই। সে গরুর চালায় দাঁড়াইয়া কোমরে হাত দিয়া নাচ প্র্যাকটিস করিতেছিল। সে ইহারই মধ্যে ঘোতনের যাত্রার দলে ভর্তি হইয়াছে। আপন মনেই সে–এক দুই তিন, এক দুই তিন চার গনিয়া গনিয়া নাচিতেছিল।

চাঁপাডাঙার বউ ডাকিল, গোবিন্দ!

তালভঙ্গের অপরাধে অপরাধীর মত গোবিন্দ দাঁড়াইয়া গেল।

চাঁপাডাঙার বউ বলিল, ও কি হচ্ছে? অ্যাঁ?

গোবিন্দ জিভ কাটিয়া মাথা হেঁট করিল। মানিক বাঁশিটা বাজাইয়া দিল–পু।

—বলি ক্ষেপলি নাকি? নাচছিস আপন মনে?

–উ কিছু লয়। কি বলছ? মাথা চুলকাইতে লাগিল।

–কিছু নয়! এক দুই তিন, এক দুই তিন-বলে নাচছিলি আর বলছিস–কিছু নয়?

এবার গোবিন্দ বলিল, লাচ শিখছিলাম গো! যাত্তার দলে সখী সাজব কিনা? লাও এখন কি বলছ বল!

—যাত্তার দলে সখী সাজবি? তা হলে সে খুব যাত্তার দল।

–উঁহুঁ! ঘোঁতন ঘোষ মশায়ের দল। দেখবে এবার কেমন গায়েন করে।

–ঘোঁতন ঘোষের দলে ঢুকেছিস?

বড় বউ স্থির দৃষ্টিতে ছেলেটার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ধারণা করিতে চেষ্টা করিল, ব্যাপারটা কি? তাহার যেন একটা সন্দেহ হইল।

রাখালটা অস্বস্তিতে পড়িয়াছিল। সে বলিল, বল, ক্যানে গো!

চাঁপাডাঙার বউ বলিল, শাওন মাস থেকে তোর জবাব হল গোবিন্দে। তাকে আর কাজ। করতে হবে না। মাসের শেষে মাইনে–বলিয়াই মনে হইল—গোবিন্দ মাইনে পাইবে না। পূজা পর্যন্ত তাহার মাহিনা সে অগ্রিম লইয়া রাখিয়াছে। আবার একবার তাহার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল,এইজন্যেই তুই সন্ধ্যার আগে পালাস? আবার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—ঘোঁতন। তোকে আমাদের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করে, না গোবিন্দে? কি জিজ্ঞাসা করে?

গোবিন্দ কিছু বলিবার পূর্বেই ছোট বউ এক আঁচল মাছ লইয়া প্রবেশ করিল।অ দিদি। পাড়ার ছেলে জুটে সব ধরে নিলে মাছগুলা। খলবল করে বেড়াচ্ছে—এক শো, দু শো

–করুক। তুই তো নেচেকুঁদে এলি জলে কাদায়।

–এই দেখ কত মাছ ধরেছি!

আঁচল খুলিয়া সে ঝরঝর করিয়া মাছগুলো ফেলিয়া দিল। মানিক বাঁশিটা বাজাইয়াছিল। নেহাত ছোট মাছ নয়, গত বছরের পোনা কোনোেটা এক পোয়া কোনোেটা তিন ছটাক! কাতলাগুলো পাঁচ পোয়া হইয়াছে।

চাঁপাডাঙার বউ ঘোতনের কথা বাদ দিয়া গোবিন্দকে বলিল, গোবিন্দ, শিগগির যা। যতক্ষণ আছিস কাজ করতে হবে তো। যা!

পুকুরটা ভাগের পুকুর। তবে সেতাবদের অংশই বেশি। সেতাব কিনিয়া কিনিয়া অংশটাকে প্রায় দশ আনার কাছাকাছি করিয়া ফেলিয়াছে। পুকুরটা তাহার বাড়ির কাছে, হেফাজত করিতে সে-ই করে। সেতাবের পর মোটা অংশ বিপিন মোড়লের; প্রায় সোয়া তিন আনা অর্থাৎ পাঁচ ভাগের এক ভাগ। অবশিষ্ট এগার পয়সার মধ্যে ভাগী আছে অনেক কয়জন। রামকেষ্ট এবং শিবকেষ্টর তিন পয়সা রকমের ভাগ আছে। সেটা অবশ্য সেতাবের কাছে ঋণদায়ে আবদ্ধ। শিবকেষ্টর ভাগের খুড়ী টিকুরীর বউ মাছ বাহির হইতেছে এবং ছেলের পাল মাছ ধরিতেছে সংবাদ পাইয়া গাছকোমর বাঁধিয়া ছুটিয়া আসিয়া পথের উপর দাঁড়াইয়া ছেলের দলের উপর গালিগালাজ বর্ষণ করিতে শুরু করিল।

—বলি অ ড্যাকরার, অ আল্পেয়েরা, অরে অ আবাগেরা, আবাগীর পুতেরা, বলি পরের লুটেপুটে খেয়ে কদিন বাঁচবি রে। ওলাওঠো হয়ে মরবি রে, ধড়ফড়িয়ে মরবি। পুকুরে শিবকেষ্টর দেড় পয়সা অংশ, আমার দেড় পয়সা ভাগ দিয়ে যা বলছি। বলি পালাচ্ছিস যে! আমি বুঝি দেখতে পাচ্ছি না? আমার চোখ নাই? ঢেলা ছুঁড়ে মারব, ঢেলা ছুঁড়ে মারব বলছি। পরের পুকুরের মাছ বেরিয়েছে—বড় মজা, ভাজা খাবি, ঝোল খাবি, অম্বল খাবি, খাবি খেয়ে মরবি, ওলাউঠা হয়ে মরবি, অম্বলশূল হবে–

কয়েকটা ছেলে পথের ধারের গাছের আড়াল হইতে উঁকি মারিতেছিল। তাহাদের দেখিয়া টিকুরীর বউ বলিল, যাবি কোথা? পথ আগলে দাঁড়িয়েছি আমি। দে বলছি আমার ভাগের মাছ, দে।

একটা ছেলে তাহাকে জিভ কাটিয়া ভ্যাঙচাইয়া বলিল, দে! দে বললেই দেব? মাঠে মাছ। ধরেছি; তোমাদের পুকুরের মাছ তা কে বললে? গায়ে নেকা আছে?

–ওরে খালভরা! নেকা নাই, কিন্তু মাছগুলো কি আকাশ থেকে পড়ল?

–তা কি জানি? ওই তো বড় মোড়লের মোটা ভাগ, তাদের ছোট বউ তো কিচ্ছু বললে না?

আর একটা ছেলে বলিল, সি এক আঁচল ধরে নিয়ে গেল—সের দরুনে।

টিকুরীর বউ এবার জ্বলিয়া উঠিল। অ্যাঁ? ওরা নিয়ে গেল? যাই, আমি যাই একবার। আগে তোরা মাছ দিয়ে যা! দে—দে—মাছ দে। দে।

হঠাৎ একটা বড় গাছের আড়াল হইতে রাখাল পাল বাহির হইয়া আসিয়া আঁচল হইতে মাছ কয়েকটা বাহির করিয়া ফেলিয়া দিয়া বলিল, ওই লে। লে তোর মাছ।

টিকুরীর বউ তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিতে চেষ্টা করিল কিন্তু গাছকোমর বাঁধা কাপড় খুলিল না। সে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল। অ মাগো! এ কে গো? পালেদের ফাঁকলা?

—ফাকলা। আমার নাম ফাঁকলা? ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল রাখাল।

—তা ভাসুরের নাম করব নাকি?…তুই যে সম্পর্কে ভাসুর হস মিন্সে। বুড়ো মিন্সে ছেলের পালের সঙ্গে মাছ ধরতে এয়েছে। নোলাতে ছেঁকা দাও গিয়ে!

রাখাল মুহূর্তে ধ্বনির প্রতিধ্বনির মত জবাব দিল গরম গরম মাছভাজা খেয়ে তুমি নোলাতে ছেকা নিয়ে মা, তুমি হেঁকা নিয়ে। নোলাতে আরও গাল ফুটবে, তপ্ত খোলায় খইয়ের মত ফুটবে।

হনহন করিয়া চলিয়া যাইতে যাইতে রাখাল আবার ফিরিয়া দাঁড়াইল। বলিল, মরে তুমি মেছো পেত্নী হবে, মাছ মাছ করে বিলে বিলে চবাং চবাং করে ঘুরে বেড়াবে, সারা অঙ্গে সেঁক ধরবে। তা আমি বলে দিলাম। বলিয়া সে চলিয়া গেল।

ছেলেগুলা এই অবসরে সুটসুট করিয়া পালাইতেছে। টিকুরীর বউ এবার ঘুরিয়া দাঁড়াইল, মাথায় সে এতক্ষণে ঘোমটা দিতে পারিয়াছিল এবং রাখাল পালের গমনপথের দিকে চাহিয়া বলিল, মরে যাও, তুমি মরে যাও, অপঘাতে যাও, মাছ বলে সাপ ধর, সাপের কামড়ে জ্বলে পুড়ে মর। পেরেত হও। আপন জ্বালাতে তুমি দাপাদাপি করে বেড়াও।

মাছ কয়টা কুড়াইতে সে কিন্তু ভুলিল না। মাছ কয়টা কুড়াইতেছিল। এমন সময় মাঠের খাবার লইয়া বড় বউ বাড়ি হইতে বাহিরে আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। সে বলিল, কি হল গা টিকুরীর খুড়ী?

মাছ কুড়াইতে কুড়াইতেই মুখ তুলিয়া চাঁপাডাঙার বউকে দেখিয়া টিকুরীর খুড়ী বলিল, এই যে! মোড়ল-গিন্নি! ভামিনী আমার!

মাছ কুড়াইয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল। বলিল, তোমাদের ছোট বউ নাকি সাজার পুকুরের পাঁচ সের মাছ ধরে ঘরে ঢুকিয়েছে?

চাঁপাডাঙার বউ অবাক হইয়াও হাসিয়া কৌতুকরে বলিল, পাঁচ সের? দাঁড়িপাল্লা দিয়ে। ওজন করলে কে খুড়ী?

—দাঁড়িপাল্লা দিয়ে ওজন করলে কে খুড়ী! ওজন করবে কে? বলি ওজন করবে কে? আমি কি মেছুনী নাকি?

চাঁপাডাঙার বউ এবার বিব্রত হইল, সে জানে ইহার জের অনেক দূর যাইবে। সে তাই বলিল, সে আবার কখন বললাম তোমাকে?

–বললে না? তো কি বললে? ও-কথার মানে কি হয়?

—তা জানি না। ছোট বউ কতকগুলো মাছ ধরে এনেছে। মাঠে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে মাছ। ঘরে আছে, তোমার ভাগ তুমি নিয়ে যাও।

–যাবই তো। ভাগের ভাগ হকের ধন। এ আমার ভাইকে ফাঁকি দিয়ে পুঁটলি-বাধা ধন নয়। নেবই তো ভাগ।

—কি বলছ খুড়ী যা-তা?

–ঠিক বলছি। দেওর-সোহাগী, দেওরকে সোহাগের মানে আমরা বুঝি না, না? কিন্তু ওতে নিজেই ফাঁকি পড়ে, বলি, ঠকিয়ে জমানো ধন ভোগ করবে কে? বলি হল একটা কোলে? ওই জন্যেই ছেলে নেনা, যেমন সেতাব—তেমনি তুমি।

এবার চাঁপাডাঙার বউ গম্ভীরভাবে বলিল, থাম টিকুরীর খুড়ী।

টিকুরীর খুড়ী থামিয়া গেল। চমকাইয়া উঠিয়াই থামিল। চাঁপাডাঙার বউয়ের কণ্ঠস্বরে যেন কি ছিল; সে যেমন অলঙ্ঘনীয়—তেমনি ভর্ৎসনাপূর্ণ।

সেই কণ্ঠস্বরেই চাঁপাডাঙার বউ বলিয়া গেল, তুমি যা বললে তা যদি সত্যি হয়, তবে ভগবান আমার মাথায় যেন বজ্ৰাঘাত করেন। আর যদি মিথ্যা হয় তারও বিচার তিনি করবেন। কোনো শাপান্ত আমি করব না।

ফিরিল সে, ফিরিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিল, মানু! মানু!

মানু বাড়ির ভিতর হইতেই সাড়া দিল, কি বলছ?

—এই টিকুরীর খুড়ীকে ওদের মাছের ভাগ দিয়ে দে। যাও খুড়ী, তোমার ভাগ তুমি নাও গে। মানুও সে মূর্তি সেথায় দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। কোনো একটা কথাও মুখে ফুটিল না। মাছ সে। বড় ভালবাসে। সেই মাছ ফেরত দিবার আদেশের বিরুদ্ধেও কোনো কথা তাহার ফুটিল না।

কথা কটা বলিয়া চাঁপাডাঙার বউ আবার ফিরিল এবং আপন পথে গরবিনীর মতই চলিয়া গেল।

 

গ্রাম্যপথে তখন চাষীর ঘরের মেয়েরা স্বামী-পুত্রের বাপ-ভাইদের খাবার লইয়া মাঠে চলিয়াছে। কাকালে ঝুড়ির মধ্যে কাসার খোরায় মুড়ি গুড় ইত্যাদি। বৃষ্টিতে যাহাতে সেগুলি ভিজিয়া না যায়, তাহার জন্য তাহার উপর আর একটি ঝুড়ির আবরণ। এক হাতে জলের ঘটি। তাহারা আগে চলিতেছে। চাঁপাডাঙার বউয়ের আজ দেরি হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তবুও সে চলিবার। গতি ত্বরিত করিতে পারিতেছে না। তাহার বুকের ভিতরটা যেন কেমন করিতেছে, গা যেন ভারি। হইয়া উঠিয়াছে। টিকুরীর খুড়ী তাহার বুকে যেন শেল ঘঁড়িয়া মারিয়াছে। সে আঘাতে তাহার সর্বাঙ্গ কাঁপিতেছে। সব বল যেন ফুরাইয়া গিয়াছে। সে গ্রামপ্রান্তরের একটা গাছতলায় আসিয়া দাঁড়াইল। আর চলিতে পারিবে না।

পিছন হইতে একটি মেয়ে আসিয়া তাহাকে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। চাঁপাডাঙার বউ মাঠের দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। বেদনার্ত অন্তরের সঙ্গে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বোধ করি একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। মন এমন ক্ষেত্রে শূন্য বিস্তৃতির দিকে চাহিয়া সান্ত্বনা পায়। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল কাদম্বিনী। এই বিস্তীর্ণ জলভরা মাঠও মাসখানেকের মধ্যে সবুজ ফসলে ভরিয়া উঠিবে না!

মেয়েটি তাহাকে দেখিয়া বলিল—বড় মোল্যান।

চাঁপাডাঙার বউ মুখ ফিরাইল-ইহার মধ্যে কখন তাহার চোখ হইতে জলের ধারা গড়াইয়া আসিয়াছে।

মেয়েটি সবিস্ময়ে বলিল, কাঁদছ তুমি বড় মোল্যান?

চাঁপাডাঙার বউয়ের খেয়াল হয় নাই যে, তাহার চোখ হইতে জল গড়াইতেছে। কথাটা শুনিয়া সে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া চোখ মুছিতে চেষ্টা করিল। দুই হাত আবদ্ধ, কাজেই মুখখানি নিজের কাঁধের কাপড়ে খুঁজিয়া চোখের জল মুছিয়া চাহিল।

মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, কি হল গো মোল্যান?

বিষণ্ণ হাসিয়া চাঁপাডাঙার বউ বলিল, বড় মাথা ধরেছে মা। শরীরটা কেমন করছে আমার।

সে আবার মুখ ফিরাইল।

সামনেই বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র। বর্ষণের মধ্যে কর্ষণ চলিয়াছে। মাঠে মাঠে হালগুরু আর মানুষ। চাষীর পেশিবহুল দেহ সামনে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, গরুগুলি কাধ টান করিয়া লাঙল টানিয়া চলিতেছে। কতক লোক আলের উপর কোদাল কোপাইয়া চলিয়াছে। বীজক্ষেতের মধ্যে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বীজচারা তুলিতেছে।

মধ্যে মধ্যে বীজের বোঝা মাথায় করিয়া চাষী চলিয়াছে রোয়ার ক্ষেত্রের দিকে। পরিপাটি। কাদা-চাষ-করা-জমিতে মেয়ে-পুরুষ মিলিয়া ধানচারা রোপণ করিতেছে। চারিদিক ব্যাঙের কোলাহলে মুখর। কাদা-চাষকরা জমির চারপাশে কাক নামিয়াছে—পোকামাকড়ের আশায়। দুই। একটা কাদাখোঁচা এখানে ওখানে ঘুরিতেছে। কালো মেঘের গায়ে সাদা বকের সারি উড়িয়া চলিয়াছে মাঝে মাঝে। মেঘমেদুর দিনটির সঙ্গে ক্লান্ত বিষণ্ণ চাঁপাডাঙার বউ যেন একাত্মতা অনুভব করিতেছিল।

যে মেয়েটি চাঁপাডাঙার বউয়ের সঙ্গে কথা বলিতেছিল সে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া সহানুভূতির সঙ্গে বলিল, দেহ ভাল নেই তো এই জলে ভিজে এলে ক্যানে মা? ছুটকীকে পাঠালেই হত।

চাঁপাডাঙার বউ বলিল, অমরকুড়ির পানে যাস যদি নয়ানের মা, তবে আমাদের ওদিকে ডেকে দিস বলিস এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর যেতে পারছি না।

–দোব—দোব। ছেবার তো নয় মা, নইলে আমি নিয়ে যেতাম।

—তার চেয়ে বড় মোড়লকে বলিস। মহাতাপ চাষ ছেড়ে আসতে রাগ করবে। বড়কে বলিস, সে এসে নিয়ে যাবে।

অমরকুড়ি অর্থাৎ অমরকুণ্ডু। ধান সেখানে মরে না। সেখানেই তখন সেতাবদের চাষ চলিতেছিল।

চাষের সময় সেতাবও চাষে খাটে। কঠিন কাজগুলো তেমন সে পারে না, তবে অন্য সকল। কাজই করে। কোদাল কোপায়, বীজচারা পোঁতে, কাদা-চাষ-করা জমিতে কোনো ঠাঁই উঁচু হইয়া থাকিলে, সেও পায় করিয়া ঠেলিয়া সমান করিয়া দেয়।

সেতাবের চাষ বড়। দুইখানা হাল। হাল দুইখানার কাজ শেষ হইয়াছে; লাঙল খোলা অবস্থায় হাল কাঁধে লইয়া গরু চারিটা ঘুরিয়া ঘাস খাইতেছে। কয়েক জন সাঁওতাল মেয়ে ধান। পুঁতিতেছে। মহাতাপ কোদাল কোপাইতেছে। সেতাব হুঁকা হাতে জমির এধার হইতে ওধার পর্যন্ত ঘুরিয়া উঁচু জায়গাগুলি পায়ে বসাইয়া দিতেছে।

নয়ানের মা জমির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

চাঁপাডাঙার বউয়ের দেহ খারাপ, আসিতে পারিবে না শুনিয়া সেতাব উদ্বিগ্ন চিত্তেই আলপথে হাঁটিতেছিল। গাছতলায় উপস্থিত হইয়া সে দেখিল, চাঁপাডাঙার বউ চুপ করিয়া যেন মাটির পুতুলের মত বসিয়া আছে।

সেতাব বলিল, নয়ানের মা বললে—দেহ খারাপ তোমার?

চাঁপাডাঙার বউ বলিল, হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে চোখের জলের বাঁধ ভাঙিয়া গেল।

–ওই–ওই, একে বলে, তা হলে জলে ভিজে এলে ক্যানে? ম্যালেরিয়ার সময়—দেখি, কপাল দেখি! সে কপালে হাত দিতে গেল।

চাঁপাডাঙার বউ কপাল সরাইয়া লইয়া বলিল, না।

—এই দেখ, না ক্যানে? দেখি।

–না, কিছু হয় নি আমার।

–একে বলে, এ তো ভ্যালী বিপদ রে বাবা।

–লোকের কথা আমি আর সইতে পারছি না।

—এই দেখ। কে আবার কি কথা বললে তোমাকে? কে? কার ঘাড়ে তিনটে মাথা? বল, আমি দেখছি তাকে। মহাতাপকে বললে—

–না, সে শুনবে বলে তোমাকে ডেকে পাঠিয়ে এখানে এনেছি আমি। লোকে বলছে। মহাতাপকে ঠকিয়ে তুমি পুঁজি করছ। কেন তুমি মহাতাপকে সব কথা বল না?

—তোমাকেই বলি নাকি আমি?

–তাতে ক্ষেতি হয় না। কিন্তু–

—সে আমি বুঝব; সে আমার মায়ের পেটের ভাই। তাকে বলি—আর সে পাড়াসুদ্ধ গেরামসুদ্ধ বলে বেড়াক। কিন্তু কে কি বললে—আমার দিব্যি দিয়ে বলছি বলতে হবে তোমাকে।

–দিব্যি দিলে?

–দিলাম।

–বললে টিকুরীর খুড়ী।

 

টিকুরীর খুড়ী তখন সেতাবদের বাড়ির দাওয়াতে বসিয়া মানদার সঙ্গে মাছ ভাগ লইয়া বেশ একটা ঝগড়া পাকাইয়া তুলিয়াছিল। উঠানে মাছ ভাগ করা পড়িয়া আছে। এদিকে অনেকগুলি—সেটা সেতাবদের ভাগ, আর এক জায়গায় বিপিনের অর্থাৎ মোটা মোড়লের ভাগ, সেটা সেতাবের ভাগ হইতে কিছু কম হইলেও নেহাত কম নয়, আর কয়েকটি ভাগে কোনোটিতে দুইটি কোনোটিতে তিনটি এমনি। গোবিন্দ মাছ ভাগ করিতেছে।

মানিকের হাতে একটি মাছ। সে মাছটি লইয়া টিপিতেছে।

টিকুরীর খুড়ীর ভাগ ওই তিনটি মাছওয়ালা ভাগের একটা ভাগ। মাছ তিনটি তুলিতে তুলিতে বলিল, ভাগী ভঁড়িয়ে খেতে নাই বাছা, তাতে মঙ্গল হয় না। বুঝেছ? খেয়ো না তা। তোমার একটা ছেলে। ভাসুরের কাছে জায়ের কাছে ও বিদ্যা শিখোনা। ফল দেখেছ তো? তোমাদের স্বামীস্ত্রীকে ঠকিয়ে গোপনে পুঁজি অনেক করেছে ওরা। কিন্তু হয়েছে? বলি একটা সন্তান হয়েছে চাঁপাডাঙার বউয়ের? মাছসুদ্ধ হাত দুটা সে মানদার মুখের কাছে নাড়িয়া দিল।

মানদা কি বুলিবে খুঁজিয়া না পাইয়া বলিল, মিছে কথা বলছ কেনে?

–মিছে কথা! মিছে কথা! গায়ের লোককে শুধাও গা। দেওর-সোহাগী আমার। মরণ তোর দেবীপুরের বউ! কিছু বুঝিস নে তুই। শোনগে, ঘোঁতন ন্যাকাপড়া-জানা ছেলেভদ্দর নোক—সে কি বলে শোনগে। বলে, দেওর-ভাজ আমরা আর দেখি নাই কখনও। নতুন দেখছি। মর তুই মর ছুঁড়ী! তুই মর্।

সে চলিয়া যাইতেছিল।

গোবিন্দ এবার বলিল, অই, অই, তুমি রাখাল পালের কাছে যে মাছ কটা নিলে, সে কটা ভাগ কর এইবার। ওগো ও মোল্যান–অই! মানিকের মা, বল না গো। অ ছোট মোল্যান! এই ওর কোঁচড়ে ভরা রয়েছে গো।

মানদা থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল—কণ্ঠস্বর তাহার রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। তবু সে বিচিত্র স্থির দৃষ্টিতে টিকুরীর খুড়ীর গমনপথের দিকে চাহিয়া রহিল।

টিকুরীর খুড়ী কিন্তু মাছগুলি লইয়া শিবকেষ্টর বাড়ি গেল না। এই জলের মধ্যেই সে গিয়া উঠিল ঘোঁতনের বাড়িতে। ঘোঁতন তাহার মামলা করিয়া দিবে বলিয়াছে। সেই জমি ভাগের মামলা।

সেদিন সাবরেজেষ্ট্রি আপিস বন্ধ। তাহার উপর বর্ষার দিন। ঘোঁতন দাওয়ার উপর বসিয়া বাঁয়া-তবলা লইয়া পিটিতেছিল। গান তাহার বড় আসে না। তবলাতেই তাহার সঙ্গীতপ্রিয়তার আবেগ নিঃশেষিত হয়। ধা তিন-ধা-ধতিন ধা। তে রে কেটে-মুখে বোল বলে আর তবলা বাজায়। তবে বক্তৃতায় সে মজবুত! শকুনি, কলি, তক্ষক প্রভৃতি কয়টা পার্টে তাহার খুব নাম।

খুড়ী ঘোতনের দাওয়ায় মাছগুলি ঢালিয়া দিয়া বলিল, লে বাবা ঘোঁতন, ভেজে খাস। খুড়ী চাপিয়া বসিল।

ঘোঁতন খুশি হইয়া বাজনা বন্ধ করিয়া বলিল, এ যে লহনা পোনা খুড়ী।

—হেঁ বাবা। পেলাম, তা বলি ঘোঁতনকে দিয়ে আসি। তা আমার মামলার কি করলি বাবা?

–করেছি খুড়ী। ঠুকে দিয়েছি দরখাস্ত লিখে দিয়েছি সেতাব মোড়ল বিপিন মোড়ল গং প্রভৃতি পঞ্চায়েতবর্গ ঘুষ খাইয়া বিধবাদের সম্পত্তি ঠকাইয়া শিবকেরামকেষ্ট গংকে দিয়াছে। একেবারে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। ইংরিজিতে দরখাস্ত লিখে দিয়েছি।

বলিতে বলিতেই হেঁট হইয়া একটা মাছ তুলিয়া লইয়াই বলিল, মাছ উঠেছে বুঝি পুকুর থেকে বেড়ে টাটকা মাছ। ভাজি যা হবে! পুঁটি, পুঁটি, অ পুঁটি!

খুড়ী বলিল, সাজার পুকুরের মাছ, বুয়েচ বাবা, মাঠে একেবারে ময়লাপ। মহাতাপের বউ সের দরুনে ধরে ঘরে ঢুকিয়েছে। তা যদি বলতে গেলাম বাবা তো চাঁপাডাঙার বউয়ের ঠেকার কি? আমিও টিকুরীর বেটী, আমি খুব শুনিয়ে দিয়েছি। মুখে মুখে বলে দিয়েছি—বলি দেওরসোহাগী আমার, ঘরের ভাগী ভঁড়িয়ে খেয়ে তোমার তো একটা হল না। আবার শেষে পাড়ার শরিকদের ফাঁকি? ওদের ছোট বউকে বলে এসেছি। গলায় দড়ি তোর। দেওর-ভাজ আর পৃথিবীতে নাই? তা কাকে বলছ? ছুঁড়ী ভাবলী।

ঘোঁতন বলিল, তুমিও ভাবলী খুড়ী, তুমিও ভাবলী।

–আমি ভাবলী?

ঠিক এই সময়েই পুঁটি–ঘোঁতনের অবিবাহিত যুবতী বোন—ঘরের দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া আসিল।কি, বলছ কি?

–এই মাছ কটা নিয়ে যা। বেশ করে ভাজি করবি। কিংবা ঝাল।

টিকুরীর খুড়ী বলিল, অ মা গো! পুঁটি? তোমার বুন। এ যে হাতি হয়ে উঠেছে?

খুড়ীর কথা গ্ৰাহ্য না করিয়া পুঁটি বলিল, আমি পারব না। হাঁড়ি চড়ে না, তার মাছভাজা? এ ঘরে তোমার মা ধুকছে জ্বরে, ওঘরে বউ খুঁকছে। তুমি বসে বসে তবলা পিটছ। আমি এত পারব না। তোমরা সবাই আমার হাতির গতরই দেখেছ।

–পুঁটি!–কড়াসুরে ঘোঁতন শাসন করিয়া উঠিল।

পুঁটি যাইতে যাইতে ফিরিয়া মাছ কয়টা কুড়াইয়া লইয়া বলিল, ভাজতে পারব না, পুড়িয়ে দিচ্ছি, খেয়য়া। ঘরে তেল নাই। আর ডাক্তার-কবরেজ যা হয় ডাক-মায়ের জ্বর খুব।

—ম্যালেরিয়া জ্বর, ওর আবার ডাক্তার-কবরেজ কি হবে? হু-হু করে উঠেছে, আবার খানিক পরে ছেড়ে যাবে। ইউনিয়ন বোর্ড থেকে মেপাক্রিন এনে দোব, খেলেই সেরে যাবে।

—ভাল, উদিকে ভাগীদার নেপাল কাহারের বউ এসে বসে আছে।

–ধান-টান দিতে আমি পারব না। সে বলে দেগা। ধান নাই তো দেব কোথা থেকে?

–ধান পরের কথা, এখন বেচন নাই। জমি চাষ হবে না। বেচন দেখে দাও গো।

–বেচন? বেচনই বা পাব কোথা আমি?

–তবে থাকবে তোমার জমি পড়ে।—বলিয়া পুঁটি ঘরে চলিয়া গেল।

—থাকুক গে! আমার কচুটা।—বলিয়া ঘোঁতন বুড়ো আঙুল দেখাইয়া দিল। তারপর খুড়ীকে বললে, খাই যেন একা আমি, বুঝলে খুড়ী? হুঁ। বলিয়া তবলায় অকারণে চাটি মারিয়া দিল।

–আমি চললাম বাবা। একটা তাগিদ দিস, বুঝলি?

বলিয়া খুড়ী উঠিয়া পড়িল।

 

আরও দিন পনের পর সেদিন বিকেলবেলা বেচারি পুঁটি আসিয়া উপস্থিত হইল বিপিন মোড়লের বাড়ি।

মোটা মোড়ল পায়ে সরিষার তেল মাখিতেছিল। তামাক সাজিতেছিল একজন কৃষাণ। পুঁটি আসিয়া দাঁড়াইল এক পাশে। বলিল, আমি একবার আপনার কাছে এলাম জ্যাঠা।

–কে? কে বল দেখি তুমি বাছা? চেনা-চেনা করছি, চিনতে ঠিক লারছি–

–আমি নবগেরেমের গোপাল ঘোষের কন্যে—

–গোপালের কন্যে? তুমি ঘোঁতনের ভগ্নী?

–হ্যাঁ।

–দেখ দেখি কাণ্ড। বড় হয়ে গিয়েছ। চিনতে পারছি।

–মা পাঠালে আপনার কাছে।

–বল, কি জন্যে পাঠালে?

–বললে পাঁচজন থাকতে বীচনের অভাবে আমাদের জমি চাষ হবে না?

–তোমাদের বীচন নাই? কি হল? তা তুমি এলে কেন? ঘোঁতন কই? ছি-ছি-ছি!

—তাকে তো জানেন। সে উ সব দেখবে না। আর তার সময়ও নাই। রেজেস্টারি আপিস ইউনিয়ন বোর্ড আপিসে সারাদিন কাজ তো। পুঁটি ক্ষীণ যুক্তিতে ভাইকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করি।

–হুঁ, তা কতটা জমির বীচন চাই?

–দশ বিঘে জমি; তার বিঘে ছয়েক পুঁতেছে, চার বিঘে পড়ে আছে—বীচন নাই।

—তাই তো বাছা। আমার খানিক বীচন আছে, বাঁচবে, কিন্তু বেনো জমির জন্যে রাখতে হবে। তা—

—আমাদের কি হবে?

–ঘোঁতন হলে বলতাম, উপোস করে মরবে। তা সে কথা তো তোমাকে বলতে পারছি না। দেখি সেতাবের বীচন বাঁচবে, সেতাবের হিসেব মহাতাপের গতর–। তা সেতাব আবার ঘাড় পাতলে হয়? তুমি বাছা ওদের বড় বউকে গিয়ে ধর গা। নাঃ চল, আমিই যাই।

মোটা মোড়ল পথে নামিল। আপন মনেই বলিতে লাগিল, বুয়েছ মা, এই সেতাবের কত্তা বাবার নাম ছিল দয়াল মোড়ল, লোকে বলত দলু মোড়ল; আমার বাবার নাম ছিল পরেশ। দুজনা ছিল চাকলার মাথা। নবগ্যেরামে তখন লতুন ফেশান ঢুকেছে। দেখেশুনে দুজনে পরামর্শ করত আর বলত—দলো মলেই হল, আর পরশা মলেই ফরসা। তাও আমরা কিছু কিছু বজায় রাখলাম, এরপর সব খখা। উচ্ছন্ন দিলে। ইংরেজি ইস্কুলে ঢুকেবাবু হয়ে ফেল মেরে ঘর ঢুকছে; জমি বেচে-বেচে খাচ্ছে বসে।

সারা পথটাই বকিতে বকিতে সেতাবদের দরজায় হাজির হইল। দরজা হইতে ডাকিল–সেতাব? সেতাব রয়েছ? অ সেতাব?

বাড়ির বাহির-দরজায় বাহির হইয়া আসিল মহাতাপ, তাহার হাতে কা। ফরাত ফরাত শব্দে কাটা টানিতে টানিতে বাহির হইয়া আসিয়া মাতব্বর খুড়ো মোটা মোড়লকে দেখিয়াই অপ্ৰস্তুত হইয়া গেল। চট করিয়া কাসুদ্ধ হাতটা পিছনের দিকে করিল।

বিপিন বলিল, সেতাব কই?

মহাতাপের পেট-ভর্তি তামাকের ধোঁয়া, সে দম বন্ধ করিয়া বলিল, তামাক খান। বলিয়া কাটা বিপিনের হাতে দিয়া পিছন ফিরিয়া হুস করিয়া ধোঁয়া ছাড়িয়া দিল। এবং এতক্ষণে স্বচ্ছন্দ হইয়া বলিল, বসুন, উঠে বসুন।

দাওয়ার উপর উঠিয়া মোড়াটা আগাইয়া দিল। পুঁটি অদূরে পথের ধারে দাঁড়াইয়া ছিল।

বিপিন মোড়ল দাওয়ায় উঠিয়া মোড়ায় বসিয়া ডাকিল, এইখানে এস বাছা। অ পুঁটি!

মহাতাপ সবিস্ময়ে বলিল-পুঁটি! এই লাও, ঘোঁতনা তাড়িয়ে দিয়েছে নাকি?

পুঁটি ধীরে ধীরে আগাইয়া আসিল।

মহাতাপ বিপিনকে বলিল, তোমরা হুকুম দাও জেঠা, ঘোঁতনকে আমি কিলিয়ে সোজা করে দিই। বড়া বজ্জাত। নচ্চারটা বড় বজ্জাত। এ মেয়েটা ভাল। যা গালাগাল দেয় আর মারে ওকে–। আমি চোতপরবের সঙের সময় দেখে এসেছি।

বিপিন বলিল, তুই থাম্ মহাতাপ! ও তার জন্যে আসে নি।

মহাতাপ আগাইয়া গিয়া বলিল, তার জন্যে আসে নি! কই বলুক পুঁটি, বলুক কালীমায়ের। দিব্যি করে ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দেয় কি না? বলুক।

পুঁটি দায়ে পড়িয়াছে। সে না পারে স্বীকার করিতে না পারে প্রতিবাদ করিতে। স্বীকার করায় লজ্জা আছে, প্রতিবাদে কুণ্ঠা আছে, আশঙ্কা আছে; মহাতাপ তো নিজেই কালীর দিব্যি গালিয়া। চাক্ষুষ দেখার কথা চিৎকার করিয়া বলিবে এবং হয়ত শেষ পর্যন্ত বীচন দিব না বলিয়া বসিবে।

বিপিন মোড়ল প্রবীণ লোক। সে পুঁটিকে নতমুখ দেখিয়া বলিল, না রে বাপু, না। আজ ও অন্য কাজে এসেছে। ওদের জমির বীচন নাই। বীচন খোঁজ করতে এসেছে।

–হরিবোল! হরিবোল! মহাতাপ হাসিতে লাগিল।

–হাসছিস ক্যানে?

—বীচন হয় নাই তো! সে আমি জানতাম–প্রচুর কৌতুকে সে হাসিতে লাগিল।–তুষ ফেললে বীজ হয় খুড়ো? আমি জানতাম। ঘোঁতনের ভাগীদার নেপাল যেদিন বীচন ফেলে, সেইদিনই আমি বলেছিলাম। আমি বললাম, ই কি রে? এ যে সব তুষ! এতে বীজ হবে ক্যানে? নেপাল বললে আমি কি করব? ঘোঁতন ঘোষ বললে—যা হয় ওতেই হবে। আমি বললাম–দে তবে গোঁজ গোঁজায় নমো করে। মহাতাপ খুব হাসিতে লাগিল।

বিপিন বলিল, কিছু বীচন দিতে হবে। তোর তো নিশ্চয় আছে।

—হ্যাঁ। অহঙ্কার করিয়া মহাতাপ বলিল, জরুর আছে, আলবৎ আছে। কিন্তু ঘোঁতনকে নেহি দেঙ্গা

–দোব না বললে কি হয়? দিতে হবে। ডাক্, সেতাবকে ডাক্।

—সেতাব!-রাগিয়া উঠিল মহাতাপসেতাব কি করবে? সেতাব? মাঠে যতদিন বীচন। থাকবে ততদিন সেতাবের এক গাছ নেহি হ্যায় বাবা। সব মহাতাপের। বিলকুল। হা ধান কাটেগা, ঘরে আনেগা, ঝাড়াই করেগা, গোলায় তুলেগা, তারপর উ যা করেগা তা করেগা। মাঠকে মালিক হ্যাম হ্যায়—হাম। একবার ঘোঁতনার মায়ের কথায় ধান ছেড়ে দিয়েছি, সবাই বকেছে আমাকে। মহাদেবের পাট নিয়ে দশ টাকা চাঁদা দিয়েছি। উঁহুঁ, আর নেহি দেগা।

এবার পুঁটি বলিল, আমার মা-ই আমাকে পাঠিয়েছে মহাতাপদাদা। জমি পোঁতা না হলে আমরা খাব কি বল?

—খাব কি? শুধু তোরা খাবি? ঘোঁতন খাবে না? আগে ভাত বেড়ে তোত কে দিবি।

হঠাৎ বিপিন মোড়ল পুঁটিকে বলিল, চল, বাড়ির ভিতর চল। ডাক, চাঁপাডাঙার বউমাকে ডাক। বউমা তো তোমাদের আপনার গো। বউমার মা তোমার মা তো সই!

মহাতাপ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উঁহু, বড় বউয়ের শরীর খারাপ। সে শুয়ে আছে। উঁহুঁ।

 

সত্যই বড় বউ ঘরের মধ্যে শুইয়া ছিল। শরীর খারাপ বলিয়া শুইয়া আছে। আসলে টিকুরীর খুড়ীর সেই মর্মান্তিক কথা কয়টা বিষাক্ত তীরের মত তার মর্মস্থল বিধিয়া অবধি তাহাকে বিষণ্ণ ক্লান্ত করিয়া ফেলিয়াছে। কথা কয়টার বিষে তাহার অন্তর এমনই জর্জর হইয়া গিয়াছে। যে, সংসারের জীবনে যেন রুচি পর্যন্ত বিস্বাদ ঠেকিতেছে। অপর সকলের কাছে কথাটা গোপন করিবার অভিপ্ৰায়েই সে শরীর খারাপের অজুহাতে আপন ঘরে শুইয়া আছে। সে চুপ করিয়া। শুইয়া ছিল। মাথার দিকে জানালার ধারে বসিয়া সেতাব তামাক খাইতেছিল আর মৃদুস্বরে বকিতেছিল।

—একে বলে, এ তো ভারি বিপদ করলে তুমি! এ তো বড় ফ্যাসাদ! টিকুরীর খুড়ী কি বললে, আর তুমি গিয়ে শয্যা পাতলে! ওঠ–ওঠ।

–না। আমাকে জ্বালিয়ো না। আপনার কাজ দেখগে যাও।

–ওই! তুমি না খেয়ে পড়ে থাকবে, আর আমি কাজ দেখব? ওঠ ওঠ। কুকুরের কামড় হাঁটুর নিচে। টিকুরীর খুড়ী বললে, ভাগী ভাঁড়িয়ে পুঁজি করি বলে তোমার ছেলে হয় নাই। টিকুরীর খুড়ী একেবারে সাক্ষাৎ বেদব্যাস। তা হয় নাই তো হয় নাই। ছেলে নাই তো নাই–

—কি বললে? বড় বউ উঠিয়া বসিল। সেতাব ভয় পাইয়া থামিয়া গেল। চাঁপাডাঙার বউয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কি বললাম?

–ছেলে নাই তো নাই! তোমরা পুরুষমানুষ, তোমাদের কথা আলাদা! কিন্তু—

বড় বউ বিচিত্ৰ হাসি হাসিল।

সেতাব সে হাসি দেখিয়া জ্বলিয়া গেল। বড় বউয়ের হাসিতে যে আগুন ছিল, সেই আগুন তাহার অন্তরের সঞ্চিত সন্তানকামনার গোপন ক্ষোভের শুষ্ক দাহ্য বস্তুতে ধরিয়া গেল। কথাটা দুই জনেই পরস্পরের কাছে গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। সেতাব চাঁপাডাঙার বউয়ের মুখের দিকে। কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে চাহিল-বড় বউয়ের মত বিচিত্র দৃষ্টিতে। তারপর কাটা রাখিয়া দিয়া বলিল, আলাদা? পুরুষের কথা আলাদা? না? হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সে বলিল, একসময় মনে হয়–। সে থামিয়া গেল এবং চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল।

বড় বউ উঠিয়া দাঁড়াইল। সেতাবের গায়ের কাপড়ের খুঁট চাপিয়া ধরিয়া বলিল, কি মনে হয়? বলে যাও।

সেতাব বলিল, মনে হয় ঘর-দোর ধান-ধনে আগুন দিয়ে চলে যাই।

বড় বউয়ের হাতখানা খসিয়া পড়িল।

–আমার মনে হয় না ছেলের কথা? আমার সাধ নাই? মনে হয় না এসব আমি ক্যানে করছি? কার জন্যে করছি? কে ভোগ করবে? আমার জলগণ্ডুষের সাধ নাই? পেরেত হয়ে জলের জন্য হা-হা করে বেড়াতে হবে না আমাকে? তবু কি করব?

সেতাব চলিয়া গেল।

চাঁপাডাঙার বউ একটা অস্ফুট কাতর শব্দ করিয়া স্তব্ধ হইয়া গেল। মনে হইল আকাশ ভাঙিয়া পড়িতেছে, মাটি ফাটিতেছে। ফাটুক। তাই ফাটুক। সে তাহারই মধ্যে ঢুকিয়া যাক।

ঠিক এই মুহূর্তে নিচে হইতে বিপিনের ডাক শোনা গেল—বড় বউমা! চমকিয়া উঠিল চাঁপাডাঙার বউ। সে ঠিক বুঝিতে পারিল না। তবু মাথার ঘোমটা তুলিয়া দিল।–কে?

পাশের ঘরের জানালাটা খুলিয়া মানদা মুখ বাড়াইয়া বলিল, পঞ্চায়েতের শিব মোড়ল–মোটা মোড়ল এসেছে দিদি!

চাঁপাডাঙার বউ কোনো রকমে উঠিয়া সিঁড়ির দিকে পা বাড়াইল।

বিপিন নিচেই দাওয়ার উপর চাপিয়া বসিয়া ছিল। তামাক খাইতেছিল। পুঁটি একটি খুঁটি ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল একপাশে। সেতাব হনহন করিয়া নামিয়া আসিল এবং পুঁটিকে দেখিয়া খানিকটা অবাক হইয়া গেল। সে পুঁটিকে ঠিক চেনে নাই। এমন কালো অথচ শ্রীমতী এত বড় একটি মেয়ে সিঁথিতে সিঁদুর নাই, বিধবা বা কুমারী ঠিক ঠাওর করা যায় না; এ কে? কিন্তু চমৎকার মেয়ে। তাহাকে দেখিয়া বিস্ময় স্বাভাবিকভাবেই জাগিয়া উঠিবার কথা। মহাতাপ উঠানে। বসিয়া একটি কাঠ দিয়া দাগ কাটিতেছিল এবং বলিতেছিল, সে হোগা নেহি, কভি নেহি।

সেতাব বলিল, কি গো খুড়ো?

বিপিন বলিল, এই যে তুমি বাড়িতে আছ; তুমি নাই ভেবে অগত্যে বড় বউমাকে ডাকছিলাম।

সেতাব হুঁকোটা লইয়া টানিল না। সে পুঁটিকেই দেখিতেছিল। হাতের কাচের চুড়ি, লোহা দেখিয়া এতক্ষণে বুঝিল মেয়েটি কুমারী। কিন্তু এত বড় কুমারী মেয়ে? কার বাড়ির? বলিল, এ মেয়েটি?

মহাতাপ উত্তর দিল—ঘোঁতনার বোন।

–ঘোতনের ভগ্নী? বিপিন বলিল, হ্যাঁ, গোপালের কন্যে। বেচারি এসেছে, ওদের বীচন নাই। জমি পড়ে আছে। চার-পাঁচ বিঘের মতন বীচন নাই। ঘোঁতন বলে দিয়েছে, সে কিছু জানে না। কি করে বল? ওকেই আসতে হয়েছে। এত বড় কুমারী মেয়ে, এক গা থেকে আর এক গাঁ—হুঁ। তা পাগল বলছে—নেহি দেগা। তোমরা সব ওকে বকেছ ঘোঁতনকে ধান ছেড়ে দেওয়ার জন্য, তাই ও আর বীচন দেবে না। তাই।

সেতাব বলিল, গোপাল ঘোষ আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে খুড়ো, সে তুমি জান। কিন্তু আমি মনে রাখি নি। ঘোঁতনকে গতবার ধান দিয়েছিলাম। সে বৃত্তান্তও সব জান। আবার বীচনও দোব। পাবে বীচন। পুঁটি এসেছে যখন বুঝছি—ওর মা পাঠিয়েছে। গোপাল ঘোষ যা করুক ঘোঁতন যা করুক—ঘোঁতনের মা—বড় বউয়ের সমা! আমার পূজ্য লোক। দিতে হবে বৈকি, দোব বীচন। বড় বউ বলবে কি? বীচন দোব। পাবে, বীচন পাবে।

মহাতাপ অবাক হইয়া গেল। সেতাবের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, বীচন দেবে?

–হ্যাঁ, জমি তো পুঁততে হবে?

মহাতাপ তাহাকে বলিল, তুমি আর নেহি বাঁচেগা। মর যায়েগা জরুর মর যায়েগা।

সেতাব বলিল, কি বকছে দেখ! সিদ্ধি খেয়েছি?

—কি কছি? আ-হা-হা? তুম এক বাতমে বীজ খয়রাত কর দিয়া? তুম চামদড়ি, তুম কিপটে; তুম দাতাকৰ্ণ বন গিয়া, তুম নেহি বাঁচেগা। কিন্তু আমি বীচন দেব না। কভি না। শুয়ার ঘোঁতনা যদি পিঠে একটা কিল খায় আমার তবে দোব। নেহি তো কভি না।

সে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।

পুঁটি হাসিয়া ফেলিল।

বড় বউ এবার বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, বীচন পাবে কাকা। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব।

তারপর পুঁটিকে বলিল, ওরে, তুই কত বড় হয়েছিস পুঁটি? এত দিনে বীচনের জন্যে দিদি বলে মনে পড়ল? ইমা কেমন আছে?

তাহাকে লইয়া সে বাড়ির ভিতর ঢুকিল।

–মায়ের খুব জ্বর দিদি। মা তোমার কথা প্রায়ই বলে।

–কি বলে রে?

–কত কথা বলে। বেশি বলে—কাদু আমার ভাগ্যবতী, গুণবতী, রূপবতী–মায়ের কাছে সবই ভাই তুমি।

কাদম্বিনী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, বলিল, সহমা আমাকে বড় ভালবাসে।

—সেদিন রূপের কথায় বলছিল—সে দেখতে হয় কাদুকে। যেমন মুখচোখ, তেমনি গড়নপেটন—আহা-হ্যাঁ, এখনও যেন কনে বউটি!

—মরণ আমার রূপের! মরণ আমার কনে বউয়ের ছিরিরকে যেন কাদুর অন্তরে আর্তনাদ। করিয়া উঠিল।

পুঁটি তাহা বুঝিল না, সে উৎসাহভরে বলিল, শোন—এই শেষ নাকি? আমার এক পিসি বললেতা বাঁজা মেয়ের দেহের বাঁধন ভাল থাকে। মা বললে—কি হল দিদি? দিদি?

কাদম্বিনী পাশের দেওয়ালটা ধরিয়া দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। মুখখানা তাহার কেমন হইয়া গিয়াছে। সে বলিল, মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।

সে এক হাতে গলার কবচটা চাপিয়া ধরিয়াছিল, আপনার অজ্ঞাতসারেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *