০৪. ঝাঁপান উৎসব

১৬.

ঝাঁপান উৎসবে তিনদিন আগে সুফল ওঝা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, এবছর মনে হচ্ছে মায়ের কাছে খালি ঝাঁপি নিয়ে যেতে হবে। ফি-বছর এসময় দু-চারটে জাতসাপ আমার ঝাঁপিতে থাকেই থাকে। এবছর মনে হচ্ছে মায়ের কাছে খালি হাতে যেতে হবে।

ভিকনাথ তার মন রাখার জন্য বলেছিল, অত চিন্তা করো না। মায়ের বাহন মা-ই জুটিয়ে নেবে। তবে যদি শরীল সাথ দেয় তাহলে চলো বিলের ধার দিয়ে ঘুরে আসি। ওদিকের ঝোপ ঝাড়ে তেনারা ঘোরাফেরা করে লোকমুখে খবর পেয়েছি। তা ছাড়া ফি-বছর ওখানেই তো তুমি মনসা পুজার ধরা সাপগুলো ছেড়ে আসো।

-তা ঠিক, তবে তাদের কি এখন পাব?

-পাই না পাই চলো না ঘুরে আসি। ভিকনাথ বোঝাল, জায়গাটা নির্জন। বিলের ঠাণ্ডা বাতাসে সাপগুলা আরাম করে থাকে ওখানে।

কথাটা মনে ধরেছিল সুফলের, ভিকনাথকে সে মুখের উপর মানা করতে পারেনি। মানুষটা বোকা হলেও সরলতা হারিয়ে ফেলেনি। এই সরলতাই ভিকনাথের সম্পদ। ওর সরল চাহনিতে ওর বড়ো বড়ো চোখদুটো কাঠটগর ফুলের মতো ফুটে থাকে সব সময়। এই সারল্য ওর খাটুনিভরা চেহারাতে ধরা পড়ে।

পণ্ডিতবিলের পাড় ধরে পায়ে চলার পথ। ভিকনাথ তার লম্বা রোগা শরীর দুলিয়ে বাঁক কাঁধে পথ হাঁটে। তাকে পেশাদার বেদের মতো দেখায়। বাঁকের দুদিকে দোল খায় শূন্য সাপঝাঁপি, যা যত্ন করে গোবর মাটি দিয়ে লেপা। ভিকনাথের পরনে ময়লা ধুতি, খালি গা। মাথায় ফেট্টি দিয়ে বাঁধা লাল গামছা। কিছু দূর এসে মোচ নাচিয়ে সে সুফল ওঝাকে শুধোল, ওস্তাদ, আমার মন বলচে আজ খালি হাতে ফিরতে হবে না। এদিকটায় কুনো ওঝা-গুণিনের পা পড়েনি।

খাড়া পথ ঠেঙিয়ে ঝোপের ভেতর ঢুকে এল ভিকনাথ। কাঁধের বাঁকটা নামিয়ে ঘাড় মুছে নিয়ে সে পিছন ঘুরে তাকাল। সুফল ওঝা গামছা পেতে পা থেবড়ে বসেছে মাটিতে। এক মুঠো মাটি খামচে তুলে নিয়ে সে গন্ধ শুঁকে দেখছে বারবার। বিড়বিড়ান মন্ত্রের ধ্বনি কানে আসছিল ভিকনাথের।

এই ফাঁকে শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়িয়েছে সুফল ওঝা। ছোট করে কাটা গোঁফ নাচিয়ে নিঃশব্দে সে ঝোপ-ঝাড়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। ভিকনাথের কথাটাই ঠিক। এখানে কারোর পায়ের ছাপ পড়েনি। যদি তেনারা থাকে এখানে নিশ্চয়ই শান্তিতে আছে। গত বছর মনসা পুজোর পরে এখানেই চারটে খরিস সাপ ছেড়ে গিয়েছিল সুফল ওঝা। গেল সালে ঝাঁপান পার্টি মা মনসার গুণগান কম করেনি। সুফল ওঝাও পিছিয়ে ছিল না এসব ব্যাপারে। সে হেলে-দুলে গাইছিল, ডালা খুললে কালো মালা নাচেরে, নাচেরে/ও মালা কেমড়ে দিলে কেউ কি তখুন বাঁচে রে? বাঁচে রে?/ওরে অষ্টোনাগ ষোলবোড়া বত্রিশ চিতের বাহার রে/মা মনসার ভোগে লাগে, কাঁচা দুধ, পোষা হাঁসের মানসো রে। গানের তালে তালে মাথা হেলায় দশ জন মানুষ। ওরা সব দোহারকি। ওরা না হলে ঝাঁপান গান জমবে না। গানের তালে তালে চলতে থাকে সাপের খেলা। সুফল ওঝা হাঁটু নাচায়, কখনও গামছা বাঁধা হাত এগিয়ে দেয় সাপের ছোবলের এলাকায়। একাজে ঝুঁকি অনেক, চোট খেলে বাঁচার আশা কম। তখন কী সাপে কামড়াইলো বাছারে আমার মা বলিয়া ডাকিতে দিল না আর…! বলে কান্নাকাটি করলেও সে আর ফিরবে না। একবার দংশালে বিষ চারিয়ে যাবে রক্তে, মুখে গাঁজরা উঠে নীল হয়ে যাবে শরীর। মৃত্যু এসে টেনে নিয়ে যাবে শ্মশানঘাটে।

খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সুফল ওঝা মাটি ঝুরো ঝুরো করে উড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ার দিকে। মাটি যে দিকে উড়ে যাবে, সেদিকেই তাদের দেখা পাওয়া যাবে। ঘাস মাটির গন্ধ শুঁকে পথ চিনে কটা মানুষ যেতে পারে। শুধুমাত্র ময়ূরভঞ্জের জানগুরু এ কাজটা করতে পারে। সব বিদ্যা দিলেও গুরুমারা বিদ্যা কেউ দিতে চায় না। সুফল ওঝা কাকুতি-মিনতি করেও জানগুরুর কাছ থেকে এটা আদায় করতে সক্ষম হল না। তবে জানগুরু তাকে অভয় দিয়ে বলেছিল, এক পাতে কি সব খাবি? পাত বদলা। তারপর ভাবব তুই হজমাতে পারবি কিনা। শোন বেটা, সবার পেটে কি ঘি সহ্য হয় রে?

সুফল ওঝা মুখ ঝুঁকিয়ে ফিরে এসেছিল দেশ-গাঁয়ে। মনে তার ইচ্ছে ছিল, সে আর একবার ময়ুরভঞ্জ যাবে। ওটা তার কাছে দেবস্থান। গুরুস্থান। ময়ূরভঞ্জের জনগুরু না থাকলে তাকে আজ হয়ত মাঠে-ঘাটে মুনিষের কাজ করে বেড়াতে হত। গাঁয়ে-গঞ্জে এত সম্মান কি তখন তার থাকত? আজ ঝাড়ফুঁক করে দুটো কাঁচা পয়সার মুখ দেখে সে। মাটির বাড়িখানা তার সবাই টেরিয়ে-টেরিয়ে দেখে। খড়ের মোটা ছাউনি ঘরের গরম ভাবটাকে পুরো শুষে নিয়েছে। মাটির ঘর হলেও তা দোতলা। কড়ি-বর্গা, জানলা-দরজা সব নিম আর কাঁঠালকাঠের। বাড়ির সামনের শিউলি গাছটায় সমবচ্ছর ফুল ধরে, বিশেষ করে সন্ধের পর থেকে কেউ যেন দামি আরশিশির ছিপি খুলে দেয়, হুড়মুড়িয়ে সুগন্ধ নাকে এসে আরামের সুড়সুড়ি দিয়ে পালায়। বেড়ার ধারে আকন্দগাছের সারি, ফলার মতো বড়ো বড়ো পাতাগুলোয় চুন বোলানো, মন ভরে যায়। সুফল ওঝার সব চাইতে ভালো লাগে ঘরের পেছনের কদবেল গাছটা। ওর তেল চকচকে ক্ষুদে-ক্ষুদে পাতাগুলো মেয়েদের কপালের কালচে-সবুজ টিপের মতো, সকালের রোদ বাড়লে পাতাগুলো যুবতী মেয়ের ভরাট নিটোল মুখের মতো চমকায়। তখন হাঁ হয়ে যায় সুফল ওঝার চোখ, সদ্য বেরনো বাঁশকোড়ার মতো হকচকিয়ে ওঠে চোখ। উঠোনের এক পাশে গোরু বাঁধা, পাতনাগুলো সুখের খনি, গোরুগুলো ঘাস-খড় কুচনো চিবাতে চিবাতে অনুগত ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে। সকালে ওই নীরিহ গোরুগুলো বালতি ভরা দুধ দেয়। আউসের মুড়ি দিয়ে জামবাটিতে দুধ সহযোগে খেতে ভীষণ ভালো লাগে সুফল ওঝার।

এত সুখ তার কপালে লেখা সে কি আগে জানত? এই মন্ত্রই তাকে সব জানিয়েছে, চিনিয়েছে। আর দশটা মানুষের থেকে আলাদা করে দিয়েছে তাকে। দশ গাঁয়ের মানুষ তাকে এখন এক ডাকে চেনে। এই সম্মান সে হারাতে চায় না কোনোমতে। হাইস্কুলের ছোকরা মাস্টার তাকে হেনস্থা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ওর মতন দশটা মানুষ গাঁয়ে থাকলে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে তাকে। সুফল ওঝা তাই কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। পথের কাঁটাকে পথেই খতম করে দিতে চেয়েছিল সে, কিন্তু ভাগ্যের জোরে মাস্টার বেঁচে যায়। সেদিন যদি হাতকাটা দুলু গিয়ে না পৌঁছাত তাহলে সাঁতার না জানা মাস্টার বর্ষার বিলে বিষ দেওয়া মাছের মতো ভেসে উঠত। কাক-পক্ষীতেও টের পেত না-এর পেছনে কার হাত আছে।

আজ ডাঙাবনের ঝোপের মধ্যে বসে সুফল ওঝা কপাল কুঁচকে রোদের দিকে তাকাল। রোদ বাড়লে তেজ কমে আসে সাপের। ওদের ঘরসংসার তখন গরমগুহা। আইঢাই করে সংবেদী শরীর। উইটিপি থেকে বেরিয়ে এসে ওরা জলের ধারে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাঙ শামুক মাছ যা পায় খায়। না খেলে পেট বাঁচবে কি করে? যাই দেবে অঙ্গে, তাই যাবে সঙ্গে।

বিল ধারের সাপগুলো ফণাধারী, ওদের চোটপাট মন্দ নয়, খর চোখ, তড়িৎ গতি, হিংস্র ভাবনা। ঠিক খেলিয়ে না ধরলে সমূহ বিপদ। সাপের চোখে চোখ রেখে সুফল ওঝার বেঁচে থাকা। চোখ সরে গেলে বিপদ। ঝাঁ-করে নেমে আসবে খাঁড়ার কোপের চেয়েও হিংস্র ছোবল। তখন মৃত্যু অবধারিত।

ঝোপঝাড় চিরে সুফল ওঝা এগিয়ে গেল উইটিপিগুলোর দিকে। বর্ষায় অমন নিরাপদ আশ্রয় আর কী হতে পারে? ওখানেই কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকতে পারে খরিস সাপের বংশ।

সুফল ওঝার নির্দেশে বাঁক নামিয়ে উইটিপি খুঁড়তে লেগে গিয়েছিল ভিকনাথ। ওর কালো শরীর চুঁইয়ে ঘাম আর মাটির মিশ্রণ নামছিল সরসরিয়ে, তবু ওর কোনো ক্লান্তি নেই। একমাত্র সুফল ওঝাই পারবে মন্ত্রের সাহায্যে ঝারিকে সংসারে ফিরিয়ে দিতে এটা তার বদ্ধমূল ধারণা। সুফল ওঝা সব পারে শুধু মরা মানুষ জ্যান্ত করতে পারে না। মাটি খোঁড়ার ঝোঁকে মাথায় বাঁধা লাল গামছা খসে পড়ে মাটিতে। গামছাটা তুলে নিয়ে ভিকনাথ রগড়ে রগড়ে মুখ মুছল, তারপর শূন্য দৃষ্টিতে উইটিপির দিকে তাকাল, ওস্তাদ, আর কত দূর খুঁড়তে হবে গো? হাতের ডানা দুটো যে ব্যথা করছে।

-কারোর ডানা ভাঙতে গেলে নিজের ডানা তো এট্টু ব্যথা করেই। সুফল ওঝা ছাঁটা গোফ নাচিয়ে হাসল, সাপধরার কাজ ভাত রাঁধার মতো সহজ কাজ নয়। এ কাজে কখন থামতে হবে তা আগাম কেউ জানে না।

উইটিপি খুঁড়ে পাকা খরিস বের করে আনতে গায়ের গেঞ্জি ভিজে সপসপে হয়ে গেল সুফল ওঝার। সাপটার ফোঁসফোঁসানীতে ভয়ে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে ভিকনাথ। চোখের সামনে বিষদাঁত ভাঙা নয়, এমন সাপ সে কি এর আগে দেখেছে? মনে করতে পারল না ভিকনাথ। ভয়ে ঘাম ফুটে বেরল তার শরীরে। লাল গামছায় মুখ মুছে সে সুফল ওঝার চোখের দিকে তাকাল, ওস্তাদ, এটাকে কুথায় রাখবো, ঝোলায় না ঝাঁপিতে।

সুফল ওঝার ঠোঁটে গর্বের চিলতে হাসি, বিষদাঁত না ভাঙা অব্দি ও ঝোলায় থাকবে। যতক্ষণ না বিষদাঁত ভাঙচি, ততক্ষণ ওর জেদ-গোঁ কোনোটাই কমবে নি। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল সুফল ওঝা, অতীত দিনে হারিয়ে গিয়ে সে আবার উড়ুলমাছের মতো ভেসে উঠল, আজ আমার কেন জানি না বাসুর কথা মনে পড়ছে।

কুন বাসুগো ওস্তাদ?

হরিনাথপুরের বাসুদেব। যে বাসুদেব বেলডাঙার রেল-ইস্টিশানে কাজ করত। ওই যে গাড়ি আসার সময় কিংবা টিকিট দেওয়ার সময় হলে ঘন্টা বাজাত–সেই বাসুদেব। বছর তিনেক আগের ঘটনা। সাপের বিষ বের করতে গিয়ে আঙুলটা সাপের মুখের ভেতর ঢুকে যায়। পাকা সাপটা কামড়ে দেয় ওকে। একেবারে বুড়ো আঙুলে। কত চেষ্টা করলাম। দশ গাঁয়ের গুণিন এলো। তবু মানুষটা বাঁচল নি। ভ্যানে চাপিয়ে বাসুরে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হল তখন ওর শরীরে জান নেই। প্রাণ পাখি উড়ে গেছে বহুক্ষণ। সুফলের অশ্রুপ্লাবিত মুখ। বাসুদেবের জন্য তার অন্তরটা কেঁদে উঠল অসময়ে। মানুষটার টাকা-পয়সা জমিজমার অভাব ছিল না। বেলডাঙায় তার নামে রেল কোয়ার্টার ছিল। তবু ফি-মাসে ঘর আসত দেখভালের জন্য।

বাসুদেব বৌ বাচ্চা নিয়ে কোয়ার্টারে থাকত। ওর বউয়ের পাকা ঘরে থাকার ভীষণ সখ। সেই চাকুরিয়া বাসুদেবের একটাই নেশা-মনসা পুজোয় সাপের খেলা দেখানো।

ফি-বছর আসত সে। সে-বছর এসে সে আর ফিরে গেল না। দৈবের লিখন কে খাবে?

ডাঙা ঝোপের সাপটার বিষ দাঁত ভাঙল না সুফল ওঝা। একা থাকলে এসব কাজ করা ঝক্কির। আনকোরা লোক দিয়ে এসব ঝুঁকির কাজ হয় না। বিপদ-আপদ ঘটে গেলে সে ঠেকা দিতে অক্ষম। লম্বা কাপড়ের থলিতে সাপটা ঢুকিয়ে নিজের কাছে রাখল সে। তখনো ফোঁস-ফোঁসানী থামেনি সাপটার। এ অবস্থায় ভিকনাথের হাতে সাপটা তুলে দেওয়া উচিত হবে না। হিতে বিপরীত হয়ে গেলে বিপদ।

মান গেল জান গেল তুর কাছে মা বিনতি/সাত সাগরের জল দিয়েছি মান রাখিস এই মিনতি। অশখলায় ডান পা নড়িয়ে হলদে খরিসের খেলা দেখাচ্ছিল সুফল ওঝা, ওর ধূর্ত চোখে যেন সাপের চোখটায় বসানো। একটু অন্যমনস্ক হলেই নিমেষে বিষ ঢেলে দেবে ফণা তোলা সাপ। ভিড় বাড়ছিল রোদ বাড়ার সাথে সাথে। আজ মনসা পুজোয় নতুন জামা আর ধুতি পরেছে সুফল ওঝা। ওর কপালে সিঁদুরের লম্বা তিলক আঁকা। সাপুড়ে নয়, কাঁপালিকদের মতো দেখাচ্ছিল ওকে।

মনসা পুজোয় জ্যাবজ্যাবে করে তেল মেখেছে সুফল ওঝা। নারকেল তেলমাখা তার ধাতে সয় না। জ্ঞানপড়ার পর থেকেই সরষের তেল মাথায় মাখছে সুফল ওঝা। সরষের তেল নাকি মাথা ঠাণ্ডা রাখে, ঘুম ভালো হয়। যদিও কাল সারা রাত ঘুমাতে পারে নি সে। কমলার ঘটনাটা তাকে বেশ দুঃখ দিয়েছে। মেয়েটা মুখের উপর অমনভাবে বলে দেবে স্বপ্নেও সে আশা করেনি। কমলা দীপ্তকঠে বলল, বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে রঘুকেই করব। রঘু ছাড়া আমি আর কাউকে আমার স্বামী হিসাবে ভাবতে পারি না।

কমলা অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে না হলে অমন কথা সে বলে কিভাবে? তার লঘু-গুরু জ্ঞান নেই। সে প্রায় উন্মাদ।

সুফল ওঝা হতবাক দৃষ্টি মেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলক। কমলা জ্ঞান দেবার ঢঙে বলেছিল, তুমি তোমার কাজ নিয়ে থাকতে পার বাবা। আমার জন্য ভেবো না, আমি পালাবার মেয়ে নই। যদি পালাবার ইচ্ছে থাকত তাহলে একবছর আগেই পালিয়ে যেতাম।

-কমলা তুই চুপ কর। চমকে উঠেছিল সুফল ওঝা, যত বড়ো মুখ নয়, তত বড়ো কথা তুই বলিস কি করে?

ঝাঁপান গানের সুর যতবার শোনা যায় ততবার যেন পুরনো হয় না। ভিড়টা জমে উঠেছে। সাপখেলাকে উদ্দেশ্য করে। ভিকনাথ রঘুনাথকে দেখতে পেয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, শোন রঘু, তুর সাথে কথা আচে। রঘুনাথ পাকুড়গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল, কী কথা?

চারপাশে সতর্ক চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভিকনাথ বলল, সামনে তুর বেপদ নাচচে। সাবধানে থাকবি। কমলার সঙ্গে দেখা-শোনা কম করবি।

-কেনে কি হয়েচে?

 –সে অনেক কথা, পরে বলব। ভিকনাথ চোরের মতো ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

.

প্রীতি ম্যাচে এবার মানিকডিহি খেলতে যাবে দেবগ্রামে। সূর্যাক্ষ সন্ধেবেলায় এসে হড়বড়িয়ে বলে গেল, রঘু, তোকে ব্যাকে খেলতে হবে, তৈরি থাকিস। রঘুনাথ চোখ কপালে তুলে বলল, আমার দ্বারা খেলাফেলা হবে নি বলে দিলাম। তুই অন্য কাউকে দেখ সূর্য। বাবা ঘরে নাই। আমার কাল থেকে মাঠে আখ কাটতে যাবার কথা।

চুনারাম এই বয়সেও মাঠে যায় জনখাটতে। সে না খাটলে সংসার অচল। দুর্গা মাঠে জনখাটতে যাবে বলে অস্থির। চুনাম তাকে যেতে দেয় না। গলায় জোর খাটিয়ে বলে, তুমি ঘরের বউ, ঘরে থাকবা। আরে আমরা কি মরে গেচি, এ্যাঁ?

রঘুনাথ ঠিক করেছে সেও মুনিষখাটতে মাঠে যাবে। ভিকনাথ তাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। ধার করে আখঝোড়ার হেঁসো কিনেছে সে। জনখেটে শোধ দেবে হেঁসোর পয়সা।

রঘুনাথের এই সিদ্ধান্তে চুনারাম খুশি হলেও খুশি হয়নি দুর্গামণি। এই বয়স থেকে ছেলেটা খাটতে যাবে–এটা মন থেকে কিছুতেই মানতে পারছে না সে। গুয়ারাম ঘরে থাকলে রঘুনাথ ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে খেত, এমনকী চুনারামকেও এই বয়সে জনখাটতে মাঠে পাঠাত না সে।

সূর্যাক্ষ হতাশ হয়ে বলল, তুই যে খাটতে যাবি শেষ পর্যন্ত পারবি তো? তোকে দেখে তো মনে হয় ফুলবাবু।

সূর্যাক্ষ রঘুনাথের হাত চেপে ধরে বলল, তোকে যে করেই হোক কালকের দিনটা উদ্ধার করে দিতেই হবে। তুই না গেলে আমাদের গ্রাম গো-হারা হেরে যাবে। তুই কি চাস আমরা হেরে যাই?

রঘুনাথ ইতস্তত করে বলল, ঠিক আছে আমি যাবো। কখুন যেতে হবে বল? তবে এটাই শেষ। গরিব মানুষের পেটের খেলাটাই আসল খেলা, আর সব খেলা ছেলেখেলা।

স্রিয়মান হেসে সূর্যাক্ষ বলল, তোর কথাই মেনে নিলাম। এবারটা চ। আর তোকে যাওয়ার জন্য বলব না। কাল বারোটার বাসে আমরা যাব। তুই বারোটার সময় বাঁধের উপর থাকিস। আমি তোকে সাইকেলে করে স্ট্যান্ড অবধি নিয়ে যাব। ফুটবল খেলার শখ ছোট থেকেই রঘুনাথের। গুয়ারাম মেলা থেকে তাকে একটা লাল রঙের রবারের বল কিনে দিয়েছিল। বলটা এত ছোট যে পা দিয়ে মারতে গেলে লাগত। এর চেয়ে বাতাবীলেবু পেটানো ঢের ভালো। পাকুড়তলায় মাঝেমধ্যে বাতাবীলেবু ম্যাচ হত। কাঁচা বাতাবীলেবু হাওয়ায় পড়ে গেলে গোরু-ছাগলেও খায় না। সেই বাতাবীলেবু নিয়ে বাঁধের উপর পেটা-পেটি খেলা। এই খেলা কি বল খেলার কোনো নিয়ম মানে? তবু রঘুনাথের মজা লাগত খেলতে।

মানিকডিহির মাঠে প্রথম সে ম্যাচ খেলতে নামে। সেদিনও সূর্যাক্ষ তাকে জোর করে নামায়। পরে রঘুনাথ ভেবেছে-কাজটা তার উচিত হয়নি। গায়ে শুধু জোর থাকলে খেলা হয় না। খেলার কায়দা-কানুন জানা দরকার। গোয়াড় গোবিন্দরা বরবাদ করে দেয় খেলার মাধুর্য। রঘুনাথ এবার মাঠে নামলে নিজেকে সামলে নিয়ে নামবে যাতে লোক না হাসে।

সারারাত উত্তেজনায় ঘুমাতে পারল না রঘুনাথ, চোখ বুজলেই খেলার শব্দ, ফুটবলের ধুপধাপ আওয়াজ, দর্শকদের চিৎকার চেঁচামেচি তার কানে উড়ে এল। তার উশখুসানি দেখে দুর্গামণি বিচলিত হয়ে বলল, রাত বাড়ছে, ইবার শুয়ে পড় বাপ। কাল আবার তুকে মুনিষ খাটতে যেতে হবে।

মুনিষ খাটতে যাওয়া নয় তো যুদ্ধ করতে যাওয়া। ছেলের জন্য ভিজে ভাত, পেঁয়াজ আর আলুচচ্চড়ি রেখে দিয়েছে দুর্গামণি। ভরপেট ছেলেকে না খাইয়ে পাঠালে ভিমরি লেগে পড়ে যেতে পারে। মেহনতের কাজে খাদ্য-খাবারই আসল কথা। এই শিক্ষাটা দুর্গামণি তার বাপ-মার কাছ থেকে পেয়েছে। এখন বদলে যাচ্ছে সময় তবু খিদের স্বভাব পাল্টায়নি। এই পেট হল মহাশত্রু। একে সামলে রাখতে পারলে দুনিয়ার সব কাজ মোটামুটি চলে যায়।

পাশ ফিরে শুয়ে রঘুনাথ অন্ধকারে মায়ের দিকে তাকাল, কাল আমি খাটতে যেতে পারবো নি মা। কাল আমার বল খেলা আচে দেবগ্রাম। সূর্য আমায় সেখানে নিয়ে যাবে।

-সূর্য হল গিয়ে বড়ো লোকের ব্যাটা। তার সাথে কি তুর পাল্লা দেওয়া উচিত হবে? দুর্গামণির কণ্ঠস্বরে ভয় আর বিস্ময় ঘোঁট পাকিয়ে গেল।

রঘুনাথ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। সূর্য আমার বন্ধু। ওর কথা রাখব নি তো কার কথা রাখব?

–কতা রাখতে গিয়ে তিনটে মানুষের পেটের কতা ভুলে যাবি তা হয় না। দুর্গামণি অন্ধকার চিরে তীক্ষ্ম চোখে তাকাল, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। বল খেলে কি হবে? বল কি তুকে ভাত দিবে?

দুর্গামণির কথাগুলো মন থেকে মেনে নিতে পারল না রঘুনাথ, অথচ মায়ের মুখের উপর তার প্রতিবাদ করা সাজে না। তাই সে গলার স্বর মোলায়েম করে বলল, একদিন কাজে না গেলে যদি হাঁড়ি ঠনঠনায় তাহলে অমন সনসারে হাঁড়ি আঁখায় চড়িয়ে লাভ কি?

-গরিবের কিসে লাভ কিসে ক্ষতি তা যদি বুঝতে পারতাম বাপ? বড়ো জটিল হিসাব। এত বছর ধরে হাঁড়ি ঠেলে মাথা সব গুলিয়ে যায়। দুর্গামণির বুক ছুঁয়ে আক্ষেপের নিঃশ্বাস গড়িয়ে পড়ল।

অভাব ধাওড়াপাড়ায় কার নেই? তবু চরম অভাবের মধ্যে মানুষগুলো শ্বাস নেয়, বুড়িগাঙের জলে ডুব দিয়ে ভাতের প্রতীক্ষায় পাড়ে উঠে আসে। ওদের কাছে যে দিনটা যায় সেদিনটা ভালো। যে দিনটা আসছে, সেইদিনটা চিন্তার।

অনেক রাতে ঘুমালেও ঠিক ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল রঘুনাথের। কুসুমআলোয় শরীরের স্ফূর্তি ভাবটা শিশির চুবানো ঘাসের চেয়েও চনমনে হয়ে ওঠে। এ সময় কমলার কথা রোজ মনে পড়ে তার। অনেকদিন কমলার সঙ্গে দেখা হয়নি তার। সুফল ওঝা জোর করে মেয়েটাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। কমলার একদম যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কাশীনাথ তাকে জোর করে দিয়ে এল মামার ঘরে। দূরত্ব অনেক সময় মনের দূরত্বও বাড়িয়ে দেয়। সম্পর্কের সূক্ষ্ম সুতো ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে দেয়। কমলাকে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে সুফল ওঝা বেশ সুখেই আছে। কলাবতীও চিন্তামুক্ত। কাশীনাথ বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ইদানীং নিচু ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের সে দায়িত্ব নিয়ে পড়াচ্ছে। মাস গেলে যা পাবে তাতে ওর হাত খরচ চলে যাবে। তা ছাড়া মাস্টার ডাকটা শুনতে তার মন্দ লাগে না। এই সম্মান টিউশনির অর্থমূল্যের চাইতেও বেশি মূল্যবান।

বেলা বারোটায় বাস ছেড়ে গেল মিষ্টির দোকানের সামনে থেকে। অন্যদিনের তুলনায় আজ বাসে ঠাসা ভিড়। গাঁয়ের ছেলেরা দেবগ্রামে খেলতে যাচ্ছে এটা কি কম গর্বের কথা।

পাশাপাশি সিট পেয়েছে সূর্য আর রঘুনাথ। বাইরের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে ওরা। কামারী পেরিয়ে যেতেই সূর্যাক্ষ বলল, আজ তোর মনে আনন্দ নেই। কেন কি হয়েছে রে?

-না কিছু হয়নি তো! রঘুনাথ এড়িয়ে যেতে চাইলে সূর্যাক্ষ তার চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, কী ভাবছিস তুই?

রঘুনাথ বলল, আসার সময় কাকার সাথে দেখা হল। কত রোগা হয়ে গিয়েছে। আসলে কাকি চলে যাওয়ার পর কাকার মনের অবস্থা ঠিক নেই। সারাদিন খালি মানসিক করে বেড়াচ্চে। ঠাকুরদেবতার থানে মাথা ঠুকচে।

-তোর কাকিকে নিশ্চয় তোর কাকা ভীষণ ভালোবাসত।

রঘুনাথ ঘাড় নাড়াতেই সূর্যাক্ষ বলল, আমার মন বলছে সে যদি বেঁচে থাকে নিশ্চয়ই একদিন ফিরে আসবে।

-আমারও মন তাই বলচে।

এ সময় ঢ্যাঁড়শ গাছে ফুল আসে। ফুলগুলো ঘিয়ে রঙের ভেলভেটের মতো, ভেতরে লাল রঙের ছিটে দেওয়া। বর্ষার জল পেয়ে বাঘহাতা ঘাসগুলো কিশোরী মেয়ের শরীরের বাড়কেও হারিয়ে দিচ্ছে।

দেবগ্রাম আসতেই বাসটা ব্রেক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে থামল। জনা কুড়ি লোক নেমে এল বাস থেকে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল গলা চড়িয়ে। ওদের আলোচনার মধ্যে উঠে আসছিল ফুটবল। মোটা মতোন হোমড়া-চোমড়া একজন গলা উঁচিয়ে বললেন, যদি তোমরা আজ জিততে পারো তাহলে আমি খুশি হয়ে তোমাদের একটা খাসী এনে দেব। যদি না জিততে পারো তাহলে ফেরার পথে শুধু চা-সিঙ্গাড়া।

দেবগ্রামের বলখেলার মাঠ স্টেশন থেকে বেশি দূরের পথ নয়। এখান থেকে রেল গাড়ির ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। হুইশেল ভেসে আসে বাতাস বিদীর্ণ করে। বলখেলার মাঠটা সবুজ ঘাসে গা মুড়িয়ে অলস শরীরে শুয়ে আছে। একটু পরে তার ঘুম ভাঙিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হবে। বাঁশি বেজে উঠবে রেফারির। বল ব্যাক-ভলি করে গোলে ঢুকিয়ে দেবে সেন্টার-ফরোয়ার্ড। তখন ব্যাকে যে খেলে তার কিছু করার থাকবে না।

গোলকিপার আর ব্যাকের দায়িত্ব যে প্রচুর এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে রঘুনাথ মানিকডিহির মাঠে। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার কথা বিস্মৃত হয়নি সে। অবশ্য এর কৃতিত্ব সূর্যাক্ষর। ও পাশে না থাকলে ম্যাচটা মনে হয় হাতছাড়া হয়ে যেত।

আজ ড্রেস পরে মাঠে নামতে গিয়ে একবার মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল রঘুনাথের। এসময় আখের আলসে ছাড়িয়ে মাঠ থেকে তার ফেরার কথা। ঘর ফিরতে রোদ ঝিমিয়ে যাবে। তারপর এক সময় কালচে হয়ে যাবে বুড়িগাঙের ঘোলাজল। বুড়িগাঙে ডুব দিয়ে এলে ভাত বেড়ে দেবে মা। সঙ্গে শাক ভাজা আর পাতলা ডাল। কোনো কোনো দিন শুধু শাক ভাজা, ডাল জোটে না, কোনোদিন আবার শুধু ডাল, শাক সেঁতলাবার মতো তেলও জোটে না।

বড়ো আশ্চর্য এই জীবন।

গোলের দিকে ধেয়ে আসা বলটাতে রঘুনাথ রাগের মাথায় লাথি ছুঁড়ে দিল। বল গিয়ে পড়ল ঠিক অন্য গোল পোস্টের পেনাল্টি এলাকার মাঝখানে। বাঘের মতো ওৎ পেতে ছিল সূর্যাক্ষ। বলটা বুক দিয়ে নামিয়ে পায়ে খেলাতে খেলাতে সজোরে কিক মারল গোলের দিকে। হেড দিয়ে বলটাকে মাঠের বাইরে বের করে দিতে চেয়েছিল ব্যাকি, কিন্তু তা হল না, বল কোণ ঘেঁষে রকেট গতিতে ঢুকে গেল গোলের ভেতর। জালে জড়িয়ে গেল বল। মানিকডিহি এগিয়ে গেল এক শূন্য গোলে।

যারা খেলা দেখছিল তাদের চক্ষু চড়কগাছ। এ-ও কি সম্ভব? একজন মানুষের পায়ে কত শক্তি থাকতে পারে? এ ছেলে খেলার মধ্যে থাকলে নাম করবে। একে আটকাবে সাধ্য কার?

খেলা শেষ হতেই সূর্যাক্ষ এসে রঘুনাথকে জড়িয়ে ধরল। সেই নাদুসনুদুস ভুড়িওয়ালা লোকটা এসে বললেন, সাবাস, এর আগে আমি তোমার খেলা দেখিনি। আজ তোমার খেলা দেখে মন ভরে গেল!

ক্লাবের মেম্বার তারক তাকে উসকে দিয়ে বলল, এ ছেলের পা নয় তো একেবারে ইস্পাত দিয়ে গড়া। মানুষের পা হলে এত জোরে শট মারা সম্ভব নয়।

এসব কথা রঘুনাথের কানে ঢুকছিল না কিছুই। সে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কী এমন করেছে সে যার জন্য তাকে এত বাহাদুরী নিতে হবে। আখের আলসে ছাড়াতে না গিয়ে সে বল খেলতে এসেছে। এর বেশি সে আর কিছু ভাবতে চায় না।

দেড় ঘণ্টা সময় মাঠের মধ্যে কী ভাবে কেটে গেল কিছুই টের পায় নি সে। মোটা লোকটা এগিয়ে এসে বললেন, আমাদের গাঁয়ে এমন ছেলে আছে আগে আমি জানতাম না। তোমার কি চাই বলো?

রঘুনাথ ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। তার হয়ে কথা বলল সূর্যাক্ষ, পচাদা, ও বড়ো লাজুক ছেলে, মুখ ফুটে কিছু চাইবে না। ম্যাচ খেলতে আসবে বলে ওর আজ মুনিষ খাটতে যাওয়া হয়নি। তুমি যদি ওর একদিনের ‘রোজ’ দিয়ে দাও তাহলে ভীষণ ভালো হয়।

-সে কথা আর বলতে। এই নাও, ধরো একশ টাকা। পচার থলথলে গাল খুশিতে নড়ে উঠল, টাকা দিয়ে এ খেলার কোনো বিচার হবে না। তবে তুমি যদি বলো আমি কেসনগর স্টেডিয়ামে কথা বলব। ওখানে আমার জানাশোনা আছে। আজ যা দেখালে তার সিকিভাগ যদি খেলতে পারো তাহলে স্টেডিয়ামের মাঠ তোমার দখলে চলে আসবে।

কিছু না বুঝে রঘুনাথ সূর্যাক্ষের দিকে সাহায্যের জন্য তাকাল। সূর্যাক্ষ বলল, রঘু গাঁ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। ঘরে ওর মা একা আছে। ওর বাবা মুনিষ খাটতে গিয়েছে রাঢ় দেশে। দাদুটা বুড়ো।

সামান্য হলেও আবেগে ঘা খেলেন নাদুসনুদুস চেহারার লোকটা। কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সূর্যাক্ষ বলল, রাগ করো না পচাদা, যা সত্যি আমি তাই বললাম। আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা সুযোগ পায় না। ওরা যদি সুযোগ পেত তাহলে দুনিয়াকে দেখিয়ে ছেড়ে দিত।

-তা ঠিক। তবে আমাদেরও দোষ আছে। পচার আবেগী কণ্ঠস্বর বাস্তবের মাটিতে ফিরে এল।

রঘুনাথের অনেকক্ষণ থেকে জল তেষ্টা পেয়েছে। সে দূরের টিউবওয়েলটার দিকে চাতক চোখে তাকাতেই সূর্যাক্ষ বলল, চল, আমিও তোর সাথে যাই। আমারও তেষ্টা পেয়েছে খুব।

জল খেয়ে ওরা যখন ফিরে আসছিল তখনই কু-ঝিক ঝিক রেলগাড়ির শব্দ শুনতে পেল। শব্দ যে গান হয়, সেই প্রথম রঘুনাথ বুঝল।

সূর্যাক্ষ বলল, তুই বুঝি এর আগে কোনোদিন ট্রেন দেখিসনি? রঘুনাথ ঘাড় নাড়তেই সূর্যাক্ষ আফসোস করে বলল, আজ আর সময় হবে না, না হলে আজই তোকে ট্রেন দেখিয়ে নিয়ে যেতাম। ছ’টার বাসটা যে করেই হোক ধরতে হবে। শুনেছি-আজ নাকি সাতটার বাস নেই। দেবগ্রাম আসলে ফেরার এই এক ঝামেলা।

অনেকক্ষণ পরে সূর্যাক্ষর কথা বলার ধরন দেখে রঘুনাথের ঠোঁট পিছলে বেরিয়ে এল হাসি, সশব্দে নয়, সে নীরবে হাসল শরীরে কাঁপন তুলে। ভালোলাগার রেশগুলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল তার সত্তায়। সেই রেশগুলো ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল কোষে কোষে।

ক্লাব সেক্রেটারী মদনদা মানিকডিহি জেতাতে ভীষণ খুশি। আবেগী স্বরে সে বলল, আমাদের এই দলটা সর্বকালের সেরা দল। আমার মন বলছে কেসনগর যদি আমাদের সঙ্গে খেলে তাহলে ওদেরও আমরা হারিয়ে দেব।

পচা বললেন, শুধু মুখে বললে হবে না, করে দেখাতে হবে।

তর্ক করতে করতে ওরা রাস্তার এক পাশ ধরে হাঁটছিল। এ সময় দেবগ্রামের পাকা রাস্তায় লোকজন ছড়ানো-ছিটানো ভাবে দেখা যায়। দত্ত মেডিকেলের কাছে আসতেই দুলুর সঙ্গে চোখাচোখি হল রঘুনাথের।

দুলুর বুকে যেন পাথর চাপা ছিল এতক্ষণ। সেই ভার পাথর সরিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দুলু। কপালের ঘাম তর্জনীতে কেঁচে নিয়ে সে বলল, তোর সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। যদি না দেখা হত তাহলে আজ নির্ঘাত আমাকে ধাওড়া পাড়ায় যেতে হোত।

দুলুব পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মানোয়ারার বর সাদাত। ওর মুখে কোনো কথা নেই, ও শুধু শুনছিল। দুলু খপ করে রঘুনাথের হাত ধরে বলল, এটু আড়ালে চল, তোর সাথে দুটা গোপন কথা আছে।

সাদাত দুলুর ব্যবহারে কেমন ব্যথিত চোখে তাকাল। এ কেমন ভদ্রতা? এমনকী যা মুখ চেনা মানুষের কাছে বলা যায় না। আসলে দুলু সেই কাশিমবাজার থেকে এড়িয়ে চলছে সাদাতকে। সাদাতই তার মানোয়ারাকে ছিনিয়ে নিয়েছে টাকার জোরে। তাছাড়া মানোয়ারার মনে তার উপর কোনো ভালোবাসা ছিল না। মানোয়ারা পালবুড়ার আটা চাকিতে আসত শুধু টাকার জন্য। দুলু টাকা না দিলে তাদের হাঁড়ি চড়ত না।

গোলপোস্টের পেছনে হাত ধরে হুড়হুড় করে টেনে নিয়ে গেল দুলু। ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে চাপা গলায় সে বলল, শোন তোর কাকিকে দেখলাম পলাশী স্টেশনের বেঞ্চির নীচে শুয়ে থাকতে। চেহারা পুরো ধসে গিয়েছে। প্রথমে দেখে চিনতে পারিনি। পরে চিনতে পেরে তার কাছে যেতেই সে আমাকে দেখে প্রাণ বাঁচানোর দৌড় লাগাল। আমি তাকে হয়ত ধরতে পারতাম কিন্তু গাড়ি ছেড়ে দেবে বলে আমি আর ঝুঁকি নিইনি।

রঘুনাথের যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না দুলুর কথাগুলো। ঢিলির সঙ্গে যদি তার দেখা হয়ে থাকে তাহলে সে কেন ছেড়ে এল হাবা-গোবা, পাগল-ছিটেল মেয়েমানুষটাকে। বড়ো অবিবেচকের কাজ করেছে দুলু।

কথাগুলো শোনার পরে মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল রঘুনাথের। সে যে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। বারবার তার কাকার কথা মনে পড়ছিল। লুলারাম দুলুর হাত ধরে কতবার বলেছে, তোরে আমি খুশ করে দিব যদি তুই তোর বৌদির খবর এনে দিস। আমি তো গাঁ ছেড়ে বেরুতে পারিনে, কত যে কাজের ঝামেলা!

ভাবতে গিয়ে রঘুর মাথার ভেতরটা ডানা ভাঙা পাখির মতো কাতরে উঠল, উঃ, কী শুনলাম গো! এসব শোনা তো আমার পাপ..।

-পাপ নয় রে, এসব হল গিয়ে কর্মফল। চল রঘু পলাশী থেকে ঘুরে আসি।

রঘুনাথ আবেগে ভাসল না, আমার কাছে নগদ কুনো পয়সা নেই। পলাশী যেতে গেলে হেঁটে যেতে হবে আমাকে।

দুলু অর্থপূর্ণ চোখে সাদাতের দিকে তাকাল, সাদাত ভাই, তোমার কাছে কিছু টাকা থাকলে উধার দাও। কাল সকালে ঘুরোন দিয়ে দিব।

সাদাত বলল, কালই যে ঘুরোন দিতে হবে এমন নয়। তুমি সুবিধা মতো দিও। আমি আমার বিবির মুখে তোমার অনেক সুখ্যাতি শুনেছি।

সাদাতের বাঁশ-চাটাইয়ের ব্যবসা সারা দুর্গাপুর-আসানসোল জুড়ে। যেখানে খনি, সেখানকার ধস ঠেকাতে দরকার হয় চাটাইয়ের। বিনা চাটাইয়ে ধস নামে মাটির। খনির বাঁধ দেওয়া জল হুসহুসিয়ে ঢুকে আসে অন্য খনিতে। তখন সমূহ বিপদ। এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে শুধু চাই চাটাই। মোকামপাড়ায় কারিগর আছে চাটাই তৈরি করার। সেই চাটাই বান্ডিল বেঁধে লোড করা হয় লরিতে। চাটাই ভর্তি লরি রওনা দেয় আসানসোল-দুর্গাপুরের দিকে। আগে ফোনে কথা বলে নেয় মহাজনরা। চাটাই পৌঁছে দিলে নগদ টাকা। তখন খালি লরি নিয়ে ফিরে আসতে হয় সাদাতকে। সাদাত খনি অঞ্চল থেকে কয়লা অথবা কয়লার গুঁড়ো নিয়ে আসে ট্রাকে ভরে। তাতে যা লাভ হয় লরির ভাড়া পুষিয়ে গিয়েও লাভের মুখ দেখা যায়। মোকামপাড়ায় বসে সাদাতের এই ব্যবসা অনেকেরই মাথার মধ্যে ঢোকে না তবে যতদিন যাচ্ছে ততই ফুলে-ফেঁপে উঠছে সে। মোকামপাড়ায় একমাত্র সাদাতেরই পাকা দালান। সারা মোকামপাড়া ঘুরে এলে একমাত্র ওরই আছে একশ দশ সি.সি-র মোটর সাইকেল।

মানোয়ারাকে সাদাত পয়সার টোপ দিয়ে পণ্ডিত বিলের মাছের মতো ডাঙায় তুলেছে খেলিয়ে। মানোয়ারা এখন তার পোষা বেড়াল, সারাদিন মিউমিউ করে আদরের কথা বলে। স্বামী গরবে ইদানীং তার পা পড়ছে না। এমনকী নিজের জন্মদাতা আব্বাজানকেও মানোয়ারা খুব বেশি পাত্তা দেয় না। চাঁদ মহম্মদ মেয়ের এই পরিবর্তন নিজের চোখে দেখছে, কষ্টে বুক ভেঙে গেলেও তার কিছু করার নেই। আসলে রক্তের দোষ যাবে কোথায়? নুরি বেগম ডানা কাটা পরীর মতো দেখতে ছিল, সে-ও তো কাঁচা বয়সে ভুল করে অন্যের হাত ধরে ঘর ছেড়ে পালাল। এখন নুরি বেগমের তেজ কমেছে, রূপ চটা ওঠা ফুটোফাটা মাটির মতো, এখন বহু কষ্টে দিন কাটছে তার। তার দুর্দশার ফিরিস্তি মাঝেমধ্যেই কানে আসে চাঁদ মহম্মদের। তখন বউটার জন্য এই বয়সে মনটা মাখা ময়দার চেয়েও নরম হয়ে যায়। মনে হয় বহরমপুর থেকে ফিরিয়ে আনবে নুরি বেগমকে। কোরানে ক্ষমার কথা বলেছে বারবার। চাঁদ মহম্মদ ধর্ম ছুঁয়ে শ্বাস নিচ্ছে এখনও। নুরি বেগমের বিচ্ছেদ এখনও তার মনে গোস্তকাটা ধার চাকু ঢুকিয়ে দেয়। তখন ছটফট করে পুরো বদন। সেই পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়ে। মসজিদের নামাজ সেরে ফিরছে চাঁদ মহম্মদ। মনোয়ারা আব্দার ধরেছে সিমাই খাবে। দুধ-সিমাইয়ের পায়েস মেয়েটার ভীষণ প্রিয়। রফিকের দোকান খুলিয়ে সিমাই আর গুড়া দুধের ঠোঙা নিয়ে ঘর ফিরছে চাঁদ মহম্মদ। তিন-সাড়ে তিন বছরের মেয়েটাকে দুধের বোঁটা ধরিয়ে দিয়ে এককেতে হয়ে শুয়ে আছে কাঁথাকানির ভেতর নুরি বেগম। যেন সে কোন নারী নয়, আসমানের স্ত্রী, যেন সে কোনো হরী-পরী নয়, খুশির বাতাসে নুয়ে যাওয়া ফুলের গাছ, মাতৃত্বের সুগন্ধে ম-ম করছে ঘর। চাঁদ মহম্মদ সেই সুখের বাতাসকে বুক ভরে নিয়ে সারাদিনের রসদ খুঁজে নিচ্ছে নিজের জন্য।

সেই চোখের মণি মানোয়ারা এখন স্বামীর সুখের ঘর পেয়ে ভুলতে বসেছে বাপকে। চাঁদ মহম্মদের দুঃখ হলেও বুক চেপে থাকে সে। নিজের ঘর ছাড়া সে এখন ভুল করেও সাদাতের ঘরের দিকে তাকায় না। মানোয়ারাও পথে-ঘাটে বাপকে দেখলে মুখ নিচু করে চলে যায়, যেন সে চাঁদ মহম্মদকে চেনে না, চাঁদ মহম্মদ তার আব্বা নয়, তার কোনো আম্মাজান নেই বাপজান নেই, সে যেন আকাশ থেকে ঠিকরে পড়া তারা।

চাঁদ মহম্মদ এসব লক্ষ্য করে হায় আল্লা রসুলতান্না বলে দীর্ঘশ্বাস উগলে দেয় বাতাসে।

তুর ভালো হোক বিটি, তুর ভালো হোক। চাঁদ মহম্মদের ঠোঁট এমনকী চোখের তারা কেঁপে ওঠে ঝনঝনানো কাঁসার থালার মতো। ঝাপসা চোখে সে সুখের পৃথিবীটাকে দেখে জটিল কুয়াশায় ঢাকা।

 সাদাত পলাশী গেল না, সে কালীগঞ্জের বাস ধরে গাঁয়ে ফিরে গেল। কথা হল সে ধাওড়াপাড়ায় গিয়ে লুলারামকে খবর দেবে। লুলারাম যেন গোরুরগাড়ি নিয়ে হাজির থাকে কালীগঞ্জে। কালীগঞ্জ থেকে শেরপুর ধাওড়া কম পথ নয়। অতটা হাঁটা পথ ঢিলিকে নিয়ে ফেরা মুখের কথা হবে না। তাছাড়া ঢিলির শরীরের অবস্থার কথা কারোরই সঠিকভাবে জানা নেই। এখন তার হাঁটাচলার ক্ষমতা আছে কিনা সেটাও দুলু স্পষ্টভাবে বলতে পারল না। একটা মানুষ প্রাণের ভয়ে দৌড়ে পালাল মানে সে যে পুরোপুরি সুস্থ এমন নয়।

পলাশী নামতেই অন্ধকার ছেয়ে এল চারদিকে। দুলু উশখুশিয়ে বলল, চল, এখন আমরা চা খেয়ে স্টেশনপানে চলে যাই। এখন কুনো ট্রেন নেই। ট্রেন আসবে সেই দশটার সময়।

ফাঁকা প্লাটফর্মে দু-একটা নেড়িকুকুর এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। টিমটিম করে জ্বলছিল স্টেশনের বাতিগুলো। দু’চারজন লোক ছাড়া পুরো প্লাটফর্ম এখন ফাঁকা ফুটবল খেলার মাঠ। গাছতলায় অন্ধকার শুয়ে আছে কল্পনার ডাইনিবুড়ির মতো। মাথার উপর খেলে বেড়াচ্ছে ফর্সা মেঘ। হাওয়ায় মিশে আছে মৃদু মৃদু শীতের কামড়।

দুলু, সূর্য আর রঘুনাথ হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিল স্টেশনের শেষপ্রান্তে। আর একটু হাঁটলেই শুরু হবে ধানমাঠ। আশে-পাশের ঘর গেরস্থালির আলোগুলো অন্ধকারের সঙ্গে যুঝছে।

কাউকে দেখতে না পেয়ে রঘুনাথ মন বেজার করে বলল, মনে হচ্ছে কাকি ভয়ে কুথাও চলে গিয়েছে। ও মনে হয় আর ঘর ফিরবেনি। যদি ঘরে ফেরার ইচ্ছে হত তাহলে কি অমনধারা পেলিয়ে-পেলিয়ে বেড়াত?

দুলু নিরাশ গলায় বলল, ওই শেডের নীচে তাকে দেখেছিলাম। আমাকে দেখে চিনতে পেরে দে দৌড়..। যেন আমি খুব রাগী দারোগা। ওকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।

সূর্য বিচক্ষণের মতো বলল, নারে এসব কথা সঠিক নাও হতে পারে। আমার মনে হয় কাকিমা ভীষণ অসুস্থ। কোথাও ঠিক মাথা গুঁজে পড়ে আছে। আড়ালে থাকলে লোকে কম জ্বালাতন করবে সেইজন্য।

-আমি এতদিন ধরে লালগোলা টেরেনে যাতায়াত করচি, কোনোদিন ওর সাথে দেখা হয়নি। আজ জানলা দিয়ে ছেপ ফেলতে গিয়ে দেখি চেনা মানুষ! দুলু শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল, জানিস রঘু, তখন তোর কাকার মুখটা মনে পড়ে গেল। মানুষটা দেখা হলেই আমাকে বলত-দেখিস তো দুলু, তোর বৌদির সাথে যদি দেখা হয় তারে সাথে করে ধরে আনিস। সব খরচাপাতি আমি তুরে দিয়ে দেব।

সূর্যর কথাই শেষ পর্যন্ত ঠিক হল।

চা-দোকানের পেছনে চট মুড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়েছিল ঢিলি। রঘুনাথই তাকে প্রথম দেখে। দুলুকে বলতেই সে হেসে উঠল, দুর তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। যা দেখছিলাম সেটা তো মালের বস্তা।

-না গো, দেখো কেমুন এট্টু-এট্টু নড়চে!

-তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। বস্তাকে ভাবছিস তোর কাকিমা! ঠিক আচে চল কাছে গিয়ে দেখি। সন্দেহ মেটাতে দুলুই লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল সামনে। বস্তা ভেবে ঠেলা মারতেই ঝাঁকিয়ে উঠেছিল ঢিলি, ছোঁবে না গো, ছোঁবে না! আমার গায়ে কুঠ ফুটেচে। যে ছোঁবে তারও কুষ্ঠ হবে।

ঢিলির কণ্ঠস্বর চিনে নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি রঘুনাথের। তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে কালীগঞ্জ পর্যন্ত ফিরিয়ে আনতেই যা ঝামেলা।

ধাওড়াপাড়ার লোকজন নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল লুলারাম। সে গোরুর গাড়ি জোগাড় করতে পারেনি তাড়াহুড়োতে, সেইজন্য চারপায়া এনেছে ঢিলিকে নিয়ে যাবে বলে। দড়ির খাটিয়ায় ঢিলি যাতে না পড়ে যায় সেইজন্য গোরু বাঁধার দড়ি এনেছে সঙ্গে। বেশি ছটফট করলে তাকে বেঁধে দেবে চৌ-পায়ায়। পাগলদের কোনো বিশ্বাস নেই। যেন কুলে এসে নৌকো না ডুবে যায় সেইজন্য এই বাড়তি সতর্কতা।

কালীগঞ্জে পৌঁছে চোখ রগড়ে নিয়ে ঢিলি সশব্দে ভেঙে পড়ল কান্নায়। লুলারাম এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরতেই ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল সেই হাত। ধিক্কার জানিয়ে বলল, খবরদার তুমি আমাকে ছোঁবে না। যদি ছুঁতে হয় আমাকে নয়, ভিকনাথের বউকে গিয়ে ছোঁও। তুমার ধ্যাসটোমো আমি সব ধরে ফেলেছি। তুমি আর আমার চোকে ধুলো ছিটোতে পারবে না।

ঢিলি হাত ছাড়িয়ে দিলেও তার শরীরের উত্তাপে ছ্যাঁকা খেল লুলারাম। ঢিলি জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে। ওকে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

লুলারাম ভয় পেয়ে রঘুনাথকে বলল, তুর কাকির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্চে। ওরে ধর। নইলে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে বিপদ হবে।

লুলারামের ভীতু চোখের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথ ঢিলির দিকে এগিয়ে গেল। ঢিলি গর্জন করে উঠল, খবরদার আমাকে ছুঁবিনে। যদি ছোঁস তো তুর হাত আমি মুচড়ে ভেঙে দেব।

কাকি চুপ করো। মাথা গরম করো না।

–চুপ করব? কেনে চুপ করব? আগুন উগলানো চোখে তাকাল ঢিলি, এই পাপীটাকে কে এখানে আসতে বলেচে? আমি তো বেশ ছিলাম। ও এসে আমাকে তাতিয়ে দিল।

-তুমার গায়ে ধুম জ্বর। তুমি চুপ করো কাকি। রঘুনাথের কথায় কি ছিল শান্ত হয়ে গেল ঢিলি, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমি বাঁচতে চাইনে রে, আমাকে মরতে দে। এতদিন ঘরের বাইরে ছিলাম–বেশ ছিলাম। শুধু মেয়েদুটার জন্যি আমার কষ্ট হত। ওরা ছাড়া এ দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই।

ঢিলিকে দেখামাত্রই হাসপাতালে ভর্তি করে নিলেন বড়ো ডাক্তার। আউটডোরের বারান্দায় অপেক্ষা করছিল পাড়ার সবাই। রোগী দেখে এসে ডাক্তারবাবু কথা বলবেন। লুলারামের ভেতরে মাকুর মতো সক্রিয় ছিল চাপা উত্তেজনা।

ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতের ইশারায় লুলারামকে কাছে ডেকে নিলেন তিনি, তারপর চাপা গলায় বললেন, রোগী আপনার কে হয়? তবে সুখবর আছে। রোগী মা হতে চলেছে।

মাথায় বাজ পড়লেও মানুষের মুখ এত পুড়ে যায় না, লুলারাম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সিমেন্ট বাঁধানো মেঝেতে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় কুলকুল করে ঘেমে গেল সে। ঢিলি আবার পোয়াতী হয়েছে কথাটা ভাবতে গিয়ে ঝ্যানঝেনিয়ে উঠল তার সারা শরীর। ঘেন্না এসে চার ঠোকরানো মাছের মতো ঠুকরে গেল তার মনের জমি। এ কু-কাজ কে করল, এ তো তার কাজ নয়। বছরের উপর হতে চলল ঢিলির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। পাশে শোওয়া তো দুরের কথা ঢিলি তাকে ছুঁতেও দেয় না কোনোদিন। হাত ধরলে ঢিলি গাল দিয়ে ভূত ভাগায়, যাও না ঝারির কাচে, আমার কাচে মরতে কেনে এয়েচো! আমি তো তুমার কাছে এখুন কাঠের পুতুল!

কে, কে দায়ী এই দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য? কার পাতা ফাঁদে জড়িয়ে গেল ঢিলি। তবে কি রেল স্টেশন, ফাঁকা বাঁধ নাকি…। আর কিছু ভাবার ক্ষমতা ছিল না লুলারামের। বাঁ হাতে সজোরে কপাল টিপে সে রঘুনাথকে ডাকল।

রঘুনাথ সামনে আসতেই লুলারাম বলল, তোরা গাঁয়ে ফিরে যা, আমি রাতভর এখানেই থাকব।

-থাকবে তো খাবে কুথায়?

রঘুনাথের প্রশ্নে বিরক্ত হলো লুলারাম, এক রাত না খেলে মানুষ মরে না। যা তোরা যা। আমাকে একা থাকতে দে।

মাথায় আকাশ নিয়ে লুলারাম দাঁড়িয়ে থাকল অন্ধকারে।

.

১৭.

সাতদিন পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গেল ঢিলির।

এই সাত দিন দুবেলা ভাত নিয়ে হাসপাতালে যেত রঘুনাথ। হাসপাতালের খাবার ঢিলির মুখ দিয়ে নামতে চাইত না। নূপুর ভাত-তরকারি রেঁধে বেঁধে দিত গামছায়। সেই খাবার পৌঁছে দিয়ে বাইরের সিমেন্টের বেঞ্চিটাতে চুপচাপ বসে থাকত রঘুনাথ। লুলারাম প্রথম দিন ছাড়া দ্বিতীয় দিন থেকে হাসপাতালে আর আসত না। মাচা কুমড়োর মতো মুখ ঝুলিয়ে সে কী যেন ভাবত সবসময়। চিন্তার রেখাগুলো গাঢ় হয়ে ফুটে উঠত সারামুখে। মাঝেমধ্যে মুখ দিয়ে হুস করে শব্দ তুলে পাগলের মতো বলত, আমার সব্বোনাশ হয়ে গেল! মা শীতলাবুড়ি–একী করলে গো তুমি।

প্রথম রাতে হাসপাতালে থাকার গোপন উদ্দেশ্যটা ধরে ফেলে অবনী। তার সেদিন নাইট-ডিউটি ছিল। ফিমেল ওয়ার্ডে রোগীর চাপ না থাকায় অতসী দিদিমণি চেয়ারে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি চতুর লুলারাম। সে আউট ডোরের বারান্দা থেকে পা টিপে টিপে চলে এসেছিল ফিমেল ওয়ার্ডে। আজ রাত হোক ঢিলির জীবনে শেষ রাত। ও যতদিন বাঁচবে ততদিন জ্বালিয়ে মারবে লুলারামকে। বউটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শেষ করে দেওয়া যেত কিন্তু তাতে ঝামেলা বাড়ত বই কমত না। গাঁয়ের মানুষের সন্দেহবাতিক মন। ওরা হাজার প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের ঔৎসুক্যের আর শেষ নেই। ঢিলি পরের ছানা পেটে নিয়ে ঘুরছে। পাগল হলেও ওর চেহারার বাঁধুনী ফুরিয়ে যায়নি। একনজর দেখলে চোখ ফেরানো যায় না, কেননা ওর দিঘির মতো চোখ দুটো সব সময় ছলছলানো আর টানাটানা। থলথলে বুকের সৌন্দর্য অনেকটাই দৃশ্যমান কারণে-অকারণে। পেট কুঁচকে গেলেও গভীর নাভি পথচলতি মানুষের মনে কামের ভাবটা বাড়িয়ে দেয়। বারুদবাতি যে কোনো সময় জ্বলে উঠে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। অন্যের পাপের বোঝা লুলারাম কেন বইতে যাবে বরং তার পাপের ভাগীদার হোক সবাই। ঘুমন্ত ঢিলির কণ্ঠনালী সজোরে টিপে ধরতেই ঘুম ভেঙে যায় ঢিলির। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে সজোরে লাথ ছুঁড়ে দেয় লুলারামের অণ্ডকোষে। কাঠব্যাঙের মতো তখনই ঠিকরে পড়ে লুলারাম। তার পতনের শব্দে ঘুম চোখে ছুটে আসে অবনী। অতসী দিদিমণি ভাবেন- রুগি বুঝি ঘুমের ঘোরে পড়ে গিয়েছে খাট থেকে। দৌড়ে এসে তিনি দেখেন অন্য কাণ্ড।

অবনী রক্তচোখে ধমকাচ্ছে লুলারামকে, তোমাকে মেয়েদের ঘরে কে আসতে বলেছে শুনি? জানো, ডাক্তারবাবুর কানে কথাটা গেলে কালই তোমার রুগিকে ডিসচার্জ করে দেবে। একবার নাম কেটে গেলে ফিরে আর ভর্তি হবে না মনে রেখো।

অতসী দিদিমণি রাগে ফুঁসছিলেন, এদের আর বুঝিয়ে পারা যাবে না, যত সব অশিক্ষিতের দল। ছিঃ ছিঃ কী কাণ্ড দেখো! এত রাতে মেয়েদের ওয়ার্ডে লুকিয়ে চলে এসেছে। যতসব চরিত্রহীন কারবার।

গলায় হাত বোলাতে-বোলাতে ভয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ঢিলি। তার মুখে কথা নেই, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই শুধু দু’চোখের কোণ ছাপিয়ে জলের ধারা নামছিল অনর্গল। সে জানে–উপর দিকে থুতু ছুঁড়লে নিজের গায়েই পড়বে। সেটা কারোর জন্য মঙ্গল হবে না। ঢিলি স্পষ্ট বুঝে গিয়েছে লুলারাম তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায়। তার ফিরে আসা লুলারাম সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি।

অতসী দিদিমণি এগিয়ে গিয়ে শুয়ে থাকা ঢিলির কপালে হাত রাখল, তুমি কাঁদ কেন, তোমার কি হয়েছে?

–দিদিমণি গো, আমি আর বাঁচতে চাইনে। ঢিলি ঠোঁট মুখ কুঁচকে কেঁদে উঠল।

-এ্যায়, কেঁদো না, কেঁদো না বলছি। অতসী দিদিমণির কপট ধমকে ঢিলি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাবার চেষ্টা করল প্রাণপণ, কিন্তু পারল না বরং ঝাঁকুনি দেওয়া কান্নায় কাহিল হয়ে সে নেতিয়ে শুয়ে রইল বিছানায়। অবনী লুলারামের হাত ধরে নিয়ে গেল বাইরে, দিলে তো আজ সবার ঘুম চটকে? পারো বটে ভায়া। তোমার সাহস দেখে আমার বুক এখনও কাঁপছে। লুলারাম ধকধকানো চোখে তাকাল, অবনীর কথাগুলো সঠিক বোধগম্য হল না তার। অবনী কি গলা টিপে ধরার দৃশ্যটা দেখেছে? যদি দেখে থাকে তাহলে অতসী দিদিমণির কাছে সে কেন ঘটনাটা ফাঁস করে দিল না। কেন সে বাঁচাল তাকে? লুলারাম গোঁফ চুলকে সংশয়ের চোখে অবনীর দিকে তাকাল।

অবনী অন্ধকার থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি কী ভাবছ, আমি জানি। ভাবছ–আমি খুব বোকা তাই না?

বুক শুকিয়ে গেল লুলারামের, না, না নয়।

-বউটাকে মারতে গিয়েচিলে কেন, ওর দোষ কি? অবনীর চোখে ক্রুর হাসি খেলে গেল।

লুলারাম কাঁপতে কাঁপতে বলল, যার গায়ে ছ্যাঁকা লাগে সে বোঝে। তুমাকে কি আমি বলে বোঝাতে পারব? তুমি যখুন দেখে ফেলেছো, তুমাকে আসল কথাটা বলি। আমার বউয়ের পেটে যে সন্তান এয়েচে-সেটি আমার লয়।

-তার মানে? আঁতকে উঠল অবনী।

অন্ধকারে মেঘ ডাকার শব্দ ভেসে এল।

.

গোরুর গাড়িতে চেপে ঘর ফিরছিল ঢিলি। চেনা পথ-ঘাট সব যেন বদলে গিয়েছে কেমন করে। নূপুর আর ঢিলি মুখোমুখি বসে আছে ছৌয়ের ভেতর। হাঁ করে নূপুর দেখছিল তার মাকে। ক’ মাসেই যেন পুরো শরীরটা বদলে গিয়েছে মায়ের। আগের চাইতে অনেক রোগা দেখাচ্ছে তাকে।

গত সাত দিনে নূপুরের কত ইচ্ছে ছিল হাসপাতালে আসার, লুলারাম তার ইচ্ছেটাকে থেঁতলে দিয়েছে। ধমক দিয়ে বলেছে–ঘরে থাক। ওখানে কেনে মরতে যাবি? সব খপর তো রঘুর মুখে পাচ্ছিস!

অন্যের মুখে ঝাল খেলে কি নিজের মুখে ঝাল লাগে? নাকি তা ভালো দেখায়? লুলারাম বলেছিল, তুদের সেই আগের মা আর নেই! এখুন যারে দেখবি সে হল তুর মায়ের কঙ্কাল।

কঙ্কাল হোক, যাই হোক মা তো মা-ই। একথা লুলারামকে বোঝাবে কে?

রঘুনাথ সব শুনে নূপুরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, কাকার কথা বাদ দে তো। ওর কথা যত গায়ে না মাখবি তত ভালো।

নূপুর বড়ো হয়েছে। বুঝতে শিখেছে আগুন-জলের মর্ম।

ঢিলি চেয়ে আছে তার দিকে, মুখে কোনো কথা নেই।

রঘুনাথ বলেছিল গোরুর গাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে সে ধাওড়াপাড়া অবধি আসবে কিন্তু শুভর জন্য তা আর হল না। অবনী রঘুনাথকে চিনতে পেরে ঘর পর্যন্ত নিয়ে গেল। ওখানেই শুভর সঙ্গে অনেক সময় ধরে কথা হল তার। শুভ বেশি কথা বলে না তবু ওর মনে কোনো গুমোটভাব নেই। শরৎকালের সাদা মেঘের মতো ফুরফুরে তুলো তুলো মন। এই মেঘের দিকে তাকালে মন ভালো হতে বাধ্য। সেদিন শুভর সঙ্গে টিকেদারবাবুর ছেলে সবুজও ছিল। ওরা দুজন মানিকজোড় এখনও গুলতি হাতে নিয়ম করে বাঁশঝাড়ে যায় ডাহুক মারতে। ডাহুকের দেখা না পেলেও ওদের কোনো দুঃখ নেই। ঘুরে বেড়ানোর নেশাটা ওদের পেয়ে বসেছে।

সেদিন রঘুনাথ ওদের সঙ্গী হল। শুভর হাত থেকে গুলতি নিয়ে সে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই শুইয়ে দিল একটা ডাহুকপাখি আর মাঠঘুঘু। পাখি দুটোকে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে দেখে বেজায় মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল শুভর। সবুজ তার হাত ধরে আনন্দ করে বলেছিল, আজ ফিস্ট হবে। রঘুকে আমরা আজ যেতে দেবো না। আজ রাতে ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।

অতসী দিদিমণি যত্ন নিয়ে রেঁধে দিয়েছিলেন ডাহুকপাখির মাংস। যদিও পরিমাণে অল্প মাংস কিন্তু স্বাদে ছিল অতুলনীয়। ঘুঘুর মাংসটা আলাদাভাবে আলাদা কায়দায় রাঁধলেন তিনি। নিজে মাংস খান না অথচ তাঁর মাংস রান্নার প্রশংসা না করে পারা যাবে না।

শুভ বলেছিল, পিসি তুমি এত সুন্দর মাংস রেঁধেছ যে জিভের জল আর আটকে রাখা যাচ্ছে না। কোনো কথা শুনব না, আজ তোমাকে আমাদের সঙ্গে খেতে হবে।

অতসী দিদিমণি মিষ্টি হেসে বললেন, মাংস আমি জ্ঞানপাড়ার পর থেকে কোনোদিনও খাইনি। তোরা বড় হ। চাকরি কর। তারপর মিষ্টি আনবি, আমি খাব।

-সে তো অনেক দিনের ব্যাপার। সবুজ বিস্মিত স্বরে বলল, পিসি, আমরা কি চাকরি পাব কোনোদিন? আমার তো মনে হয় না আমরা কোনোদিন চাকরি পাব।

পিসি কিছু বলার আগে রঘুনাথ ভরসার গলায় বলল, কেন চাকরি পাবি না, নিশ্চয়ই পাবি। আমাদের শেরপুর গাঁয়ের দু’জন ছেলে পাশ করে মাস্টুর হয়েছে। ওরা মাস গেলে কড়কড়ে নোট গুণে নেয়।

অতসী দিদিমণি মন দিয়ে শুনলেন কথাগুলো, মন দিয়ে পড়লে নিশ্চয়ই তোরা চাকরি পাবি। শুভ তো পড়াশোনায় বেশ ভালো তবে ওদের ঘরের পরিবেশটা ভালো নয়। আমি তো ওকে বলেছি–এখানে এসে পড়তে। আমার ঘর তো ফাঁকা থাকে।

সে রাতে আর ঘরে ফিরতে পারেনি রঘুনাথ। লুলারাম গিয়ে খবর দিয়েছিল দুর্গামণিকে। দুর্গামণি কপালে ভাঁজ ফেলে চুনারামের মুখের দিকে তাকাল, চুনারাম তাকে ভরসা দিয়ে বলল, ছেলে নিয়ে অত ভেবো না বউমা। তুমার এই ছেলের কেউ কোনোদিন ক্ষতি করতে পারবে না। ওর গলায় আমি শুয়োরের হাড়ের তাবিজ বানিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছি। হাঁড়ির ঝি চণ্ডীর দয়া আচে ওর উপর।

ভোর-ভোর ঘরে ফিরে এল রঘুনাথ।

সে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই দুর্গামণি উদ্বেগ নিয়ে বলল, জানিস বাপ, কাল এট্টা চরম বিপদ ঘটে যেত।

-কী হয়েচে মা? রঘুনাথের তর সইছিল না।

পাশে দাঁড়ানো চুনারাম দাঁতন করা থামিয়ে বলল, কী আর হবে। যত সব ছোটলুকের মরণ।

-তুমি থাম তো বাবা। দুর্গামণি ধমক দিয়ে চুনারামকে নীরব করে দিতে চাইল।

চুনারাম চুপ করে গেলেও তার ভেতরে কথার খই ফুটছিল। নিজেকে সংযত করে সে দুর্গামণির মুখের দিকে তাকাল। গলা নামিয়ে দুর্গামণি ভয়ার্তস্বরে বলল, কাল রাতে ছোটবউ পেলিয়ে গিয়েছিল আবার। আঁধারে পা হড়কে গিয়ে সে ছিটকে গিয়েছিল বুড়িগাঙে। ভাগ্যিস লুলারাম তখন কি কাজে বাঁধের ধারে ছিল। সে-ই লোক ডেকে ছোটবউকে বাঁচায়। বড়ো ভাগ্য ভালো যে ছোটবউয়ের কুনো ক্ষতি হয়নি।

বেলা বাড়তেই রঘুনাথ শুনতে পেল ঢিলি পা হড়কে বাঁধ থেকে পড়ে যায়নি। সে আত্মহত্যা করার জন্য ঝাঁপ দিয়েছিল বুড়িগাঙে। সেই সময় ঝারির সঙ্গে মিলিত হবার আশায় বাঁধে এসেছিল লুলারাম। একদিন ঝারির সান্নিধ্য না পেলে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আর ঝারিও বড়ো খিটখিটে হয়ে ওঠে, সে তখন কারোর কথা সহ্য করতে পারে না।

ঝারি আর লুলারামের মেলামেশাটা এখন বাচ্চা-বুড়ো সবাই জানে। নূপুর বুঝতে শিখেছে সব, আড়ালে সে চোখের জল ফেলে। ঝারিকে তার ভালো লাগে না। ঝারির জন্য তাদের সংসারটা ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে। অথচ পাড়ার মধ্যে মাথা উঁচু করে ঘোরে বউটা। ওর ভেতর লজ্জা-শরমের কোনো শেকড় নেই। দু-কান কাটার লাজ-লজ্জা বুঝি থাকতে নেই।

শীতটা ধাওড়াপাড়ায় বড়ো কষ্টের।

বেলা ছোট হলে মানুষের মন যে ছোট হবে এমন সহজ সমীকরণ কোথাও লেখা নেই। কদিন থেকে গুয়ারামের জন্য মনটা বড়ো ছটফট করছে চুনারামের। শুধু মনে হচ্ছে যদি প্রাণপাখিটা হঠাৎ করে উড়ে যায় তাহলে ছেলের হাতের জল সে আর পাবে না। সবার ভাগ্যে কি এমন সুখ লেখা থাকে? সুখ হল সেই সরলা খিরিষগাছের ফল যা দিয়ে চারা হয়, জ্বালন হয়–ছাই ওড়া দুপুরে যার মর্ম বোঝা আর খা-খা শ্মশানে গিয়ে বুক চাপড়ে কাদা একই কথা। সুখের কোনো আকার নেই, আকৃতি নেই, সুখ হল জলের মতো মদের মত, নেশা হবে পিপাসা মিটবে। বড়োজোর খিরিষের আঠার মতো জড়িয়ে থাকবে কিছুক্ষণ।

ছেলের জন্য মন খারাপ চুনারামের আজকের নয়, বহু পুরনো অভ্যাস। এই ছেলের জন্য সে বাবুদের ঘরের কাজ ছেড়ে চলে এসেছিল গায়ে। লাজবতীও থাকতে পারত না তাকে ছেড়ে। প্রায়ই মুখ ভার করে বলত, তুমার সাথে আমারেও লিয়ে চলো। ইখানে একা থাকতি কি ভালো লাগে গো? মন ধরে না, খাঁ-খাঁ করে চারপাশ। আমি হেঁপসে মরি!

লাজবতীর টানে নয়, শুধুমাত্র ছেলের টানে বাবুবাড়ির কাজ ছেড়ে চলে এসেছিল চুনারাম। এখন মাজা পড়া শরীর, পাকা চুল, চোখে ছানি তবু ছেলেটাকে দেখার জন্য মনটা অকবগিয়ে ওঠে! রাতকালে এই চিন্তা আরও গাঢ় হয়। বিদেশ বিভূঁইয়ে ছেলেটা কেমন আছে কে জানে। যত দিন যাচ্ছে তত যেন চিন্তাটা ছোবল মারছে মনের ভেতর।

ভূষণীবুড়ি সেদিন ঘুরতে ঘুরতে তাদের দোর অবধি এসেছিল, একথা-সেকথার পরে বলল, ফাঁকা ঘরে হেঁপসে উঠেচি গো! ছেলে নেই, বউমা নেই, একা একা কী ভাবে যে সময় কাটে বলা দায়। মনে হয় দম এটকে মরে যাব।

ভূষণীবুড়ির কথাগুলো শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল চুনারামের। এ সময় বুড়িগাঙের জল স্থিতু হয়ে দম নেয়। আকাশের নীল বুকের ভেতর শুষে নিয়ে সাদা কালো নীল মিশিয়ে বিচিত্র এক আলপনা আঁকে জলের উপর। কদমগাছের ফাঁক দিয়ে কী অদ্ভুত কায়দায় গড়িয়ে নামে রোদ। সেই চুয়ানো রোদ গায়ে লেগে ঘাস হয় গর্ভবতী। নাকছাবির মতো ফুল আসে ঘাসের বুকে। বাসি চারাগুলো শিশির পান করে কিশোরীর টাইট শরীরের মতো টনটনিয়ে ওঠে। এত সুখ তবু সুখের মধ্যে লুকিয়ে থাকা উঁইপোকার মতো অসুখ কুরে কুরে খায় চিন্তার হাজার ফসলি জমি। শীতকালটা চুনারামের কাছে বা বেশি ভয়ের সময়। ক’দিন ধরে যা শীত পড়েছে তাতে হাড় কাঁপে ঠকঠকিয়ে। আমড়াগাছের পাতাগুলো সব ঝরে গেল। কার শোকে ন্যাড়া হয়ে গেল নিমগাছ।

এই শীতের সময় চুনারাম বরফের মাছের মতো প্যাটপেটিয়ে চেয়ে থাকে, মৃত্যুভয় তার লোমকূপে এসে বাসা বাঁধে। গেল সালে ধাওড়াপাড়ার চারজন বুড়া সাফ হয় শীতের কামড়ে। বয়স হলে শীত বুঝি কাউকে ক্ষমা করে না। যমরাজকে আয়ুর দক্ষিণ-দুয়ারে নিয়ে এসে দাঁড় করায়।

এ সময় গুয়ারামও কাছে নেই তাহলে মনের জোর শতগুণ বেড়ে যেত চুনারামের। রঘুনাথের উপর ভরসা নেই চুনারামের, নাতিটা গায়েগতরে বাড়ল কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি বড়ো কম। কাঁচা বয়সের ভাবনা পাকা আতার মত, হালকা চাপ দিলেই পেটের ভেতরের মাল-মশলা সব কিছু দেখিয়ে দেয়।

এই শীতটা কাটবে কি? মোটা সুতোর চাদরটা গায়ে জড়িয়ে চুনারাম বাঁধের গোড়ায় এসে দাঁড়াল। প্রায় বছর দশেক আগে কেনা চাদরটা এখন জরাজীর্ণ, সুতোর ফুপি বেরিয়ে ঠান-বুড়িদের মতো দশা। রঙ জ্বলে গিয়ে এখন আর আগের চেহারা মনে পড়ে না। সকালের রোদ এসে ঢলিয়ে পড়ছে গায়ে। একটু আরামবোধ হচ্ছে চুনারামের। বেড়ার উল্টো পিঠে খেলা করছে বনিপাখির দল। ক্যাচর-ম্যাচর শব্দে উঠোন যেন হাটতলা। ধসে পড়া কাঁথ দেওয়ালের মাটি বর্ষায় ধুয়ে-গলে প্রায় সমতল। একটা তেল চকচকে ছাগলছানা তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে রোদে। ধসা দেওয়ালের উপর ছাগল নাচলে গৃহস্বামীর অমঙ্গল হয়। চুনারাম রাগের ঘোরে ছাগলছানাটা তাড়াতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল মুনিরামের চোখে।

দেখা মাত্র যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুনিরাম, কাশতে কাশতে উঠে এল সে বেড়ার ধারে, কুথায় যেচিস রে, টুকে আয় না, কতা বলি।

অনেক বুড়িয়ে গেছে মুনিরাম, অসুখ ওর বয়সটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও বিশ বছর। শরীরে জোর নেই, চোখ ঢুকেছে গর্তে। কথা বলার সময় শ্বাসকষ্টের রুগির মতো ফ্যাসফেসে শব্দ হয়। চোখের তারা ছিটকে আসার উপক্রম।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও দাঁড়াতে বাধ্য হল চুনারাম। পিঠাপিঠি দুই ভাই, অথচ দেখা হয় না কতকাল। পণ্ডিত বিলের পাড়ে মুনিরামকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিল মোকামপাড়ার লোকেরা। সিদ কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছিল সে। জামগাছে বেঁধে কী মার-ই না মারল ওকে। সেদিন ভাইয়ের জন্য কষ্ট হয়েছিল চুনারামের। মনে মনে ভেবেছিল এমন ভাইয়ের সঙ্গে যতদিন বাঁচবে যোগাযোগ রাখবে না। প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি। মুনিরামই রাতের বেলায় এসে তার পা ধরে কেঁদে কেটে বলল, দাদারে, তুর মুকে চুনকালি লেপে দিয়েছি। আমারে ক্ষেমা করে দে। যতদিন বাঁচব, আমি আর সিঁদকাঠি ছোঁব না। আর চুরিচামারি নয়, ইবার থিকে আমি বড়ো দানে হাত মারব। মোকামপাড়ার লোকগুলোকে দেখিয়ে দিব–ওরা আমার গায়ে হাত তুলে হেলেসাপকে খরিসসাপ বানিয়ে দিল। আগে ওদের ক্ষতি হত, ইবার থেকে ওদের সব্বোনাশ হবে।

মুনিরাম সিঁদেল চোর থেকে হয়ে গেল ডাকাত দলের সর্দার। তার কালো ঘোড়াটা বাঁধা থাকত বাঁশতলায়। বাঁধের উপর সে বিনা কারণে ঘোড়া ছোটাত। এক শ্বাসে চলে যেত মানিকডিহির গাঙপাড়। অন্য শাসে ফিরে আসত হলদিপোঁতা ধাওড়া।

মুনিরামের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারল না চুনারাম। হাজার হোক ভাই বলে কথা। বয়স বাড়লে সম্পর্কে কেমন ছাতা ধরে। অনেক সম্পর্ক আবার নতুন করে ট্যাক গজায়। মুনিরাম ক’ বছর আগেও কথা বলত না টাকার দেমাকে। নিজেকে ভাবত শেরশাহ। গায়ে কুঠ ফোটার পর মাটির ঢেলা থেকে তার মন হয়ে গিয়েছে লতলতে কাদা। এখন সাত চড়ে রা কাড়ে না সে। দিনের বেশির ভাগ সময় ঈশ্বরচিন্তা করে কাটিয়ে দেয়। হাত-পায়ের ঘাগুলোয় শুলোনী উঠলে সে কোঁকায়। ঢিলি তখন তার সেবা যত্ন করে। লুলারাম বিরক্ত হয়। মনে মনে ভাবে মানুষটা কেন মরছে না। এত লোকের বাপ মরছে, তার কেন বাপ মরছে না।

পণ্ডিতবিলের পাড়ে কুঁড়েঘর বেঁধে দিয়েছিল লুলারাম, বাপকে হাত ধরে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল সে। ফেরার সময় বলেছিল, কী করবো বলল, গাঁয়ের মানুষের রায়, আমাকে তো মাথা পেতে নিতে হবে। তুমার অসুকটা তো ভালো নয়। কার মুকে চাপা দেব বলো। যতদিন পেরেছি, লুকিয়ে তুমাকে ঘরে রেখেচি। আর পারলাম না। ইবার থেকে বিলধারেই থাকো। বিলের ঠাণ্ডা বাতাস তুমার শরীলটাকে ঠাণ্ডা করে দিবে। আমি সাতদিন অন্তর এসে তুমারে দেখে যাবো।

চোখের জল সেদিন আটকাতে পারেনি মুনিরাম। এই ছেলেকে হাতে ধরে চুরি বিদ্যার গুপ্তমন্ত্র শিখিয়েছে সে। সে তো শুধু জন্মদাতা বাপ নয়, একাধারে গুরু। দীর্ঘশ্বাস বুকে ঠেলে ওঠার আগেই বিলপাড় থেকে সটকে গিয়েছে লুলারাম।

অসুখ আর রুগী বয়ে বেড়ানো ঝক্কির কাজ। তাছাড়া মুনিরাম ঘরে থাকলে ঢিলিকে খারাপ নজরে দেখতে পারে না লুলারাম। মুনিরামের জন্য ঝারি রাতকালে ঘরে আসতে পারে না। ওর ঘুম খরগোসের চেয়েও পাতলা। খুট করে পায়ের শব্দ পেলে কে-কে বলে চেঁচিয়ে ওঠে। আর তার চেঁচানি শুনে পাড়ার কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়।

সেদিন লুলারামের ঘর থেকে গভীর রাতে বেরনোর সময় ধরা পড়ে গেল ঝারি। নূপুরই তার পথ আটকে দাঁড়াল। ধিক্কারে বাতাস কাঁপিয়ে বলল, তোমার সাহস তো কম নয়! বাঁধধার ছেড়ে এবার ঘরে ঢুকেছ, দাঁড়াও দাদুকে আর তোমার বরকে সব বলে দেব।

ঝারি তার হাত ধরে ক্ষমা চাইল কাকুতি-মিনতি করে।

 বাবার চাপে পড়ে নূপুর তাকে ক্ষমা করে দিলেও মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি আজও।

মুনিরামের মুখোমুখি দাঁড়ালে চুনারাম আজও কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে। মুনিরামের আঙুলে জড়ানো ন্যাকড়াগুলো পুঁজ রক্তে ভরে আছে। ওগুলোর দিকে তাকালে চুনারামের গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে, তার মনে হয় সে-ও বুঝি অচিরে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হবে। লুলারাম তার বাপকে বিলের ধার থেকে ফিরিয়ে এনে ভুল কাজ করেছে। কিন্তু এছাড়া লুলারামের সেদিন কিছু করার ছিল না। থানা থেকে বড়োবাবু লোক পাঠালেন। লুলারামকে জেলে যেতে হবে অন্তত বছর খানিকের জন্য। সে জেলে গেলে মেয়ে দুটোকে দেখবে কে? ঢিলির উপর তার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। কবে সে ঘর ছেড়ে চলে যাবে একথা আগাম কেউ বলতে অক্ষম। অতএব ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো সেই মুনিরাম। বছর চারেকের মাথায় মুনিরামকে ফিরিয়ে এনেছিল লুলারাম। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে বলেছিল, বাবা ঘরে চলো। আমার টেইম এয়েছে, আমাকে জেলে যেতে হবে। জেলে না গেলে বড়োবাবু আমাকে ছাড়বে না। মাঝ রাস্তায় জিপ থামিয়ে বলবে দৌড়ো। তারপর গুলি করে দেবে। বলবে পেলুতে যাচ্ছিলাম তাই গুলি ছুঁড়ে মেরে দিয়েছে। আইন সব ওদের হাতে। আমি জলে নেমে মগরমাছের সঙ্গে লড়াই করে কি পারব? আমি তো চুনোপুঁটি।

সেই যে ফিরে এল মুনিরাম, আর সে বিলমুখো হয়নি। একলা ঘরে মন বসত না তার, খেতে বসে চোখের জল ভাতের থালায় পড়ত। সাতদিন ছাড়া আসব বলে লুলারাম আসত মাসে একবার। হাত পুড়িয়ে সেদ্ধভাত খেতেই কালঘাম ছুটে যেত মুনিরামের। বউটা সাত তাড়াতাড়ি চলে গেল! সত্যবতী থাকলে তার কপালে এত দুর্ভোগ হত না। রাঁধাবাড়ার কাজটা সামলে দিত বউ। আর কিছু না হোক দুটো কথা বলে তো বাঁচা যেত শান্তিতে। একলা থাকার জ্বালা অনেক। বুকের পাঁজরে শিলপাথর কেউ চাপিয়ে দেয়। লুলারাম জেলে যাবার পর স্বাভাবিক হয়ে গেল ঢিলি। পাড়ার লোকে আড়ালে আবডালে বলল, বউটা ইবার শ্বাস ছেড়ে বাঁচল। ঘরের মানুষ যদি পরের ঘরে নজর দেয় তাহলে তার নজরে পাপ বাসা বাঁধে। সে মানুষের কুনোদিন কুনো উন্নতি হয় না। ঘরের লক্ষ্মী কানলে বাইরে লক্ষ্মী কি সুখ পায় না সুখে থাকে?

চৌপায়ার এক কোণায় বসে চুনারাম শুধালো, তা কেমুন আছিস?

–কেমুন আচি তা তো তুই নিজের চোকে দেখতে পাচ্ছিস। মুনিরাম ঘেয়ো হাতের দিকে তাকিয়ে কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।

-মনে হচ্চে আগের চেয়েও ভালো।

–ওই ভালো! অন্ধের কিবা রাত কিবা দিন। কুনো মতে বেঁচে আছি। ঢোক গিলে মুনিরাম বলল, সাত সকালে তুই কুথায় যাচ্ছিস? আমারে সাথে করে নিয়ে যাবি? এখুন একা বেরতে ভয় পাই। সব সময় মনে হয় আমার পেছনে বুঝি যম হাঁটচে।

-ও তোর মনের ভুল। চুনারাম জোর দিয়ে বলল, বয়স হলে মরার চিন্তে মনটাকে কাকের মতন ছিঁড়ে খায়। আমারও কদিন থিকে মন কু’ গাইছে। জানি না এ শীতটা পার হবে কিনা!

-আমি তো যেতে চাই তবু সে যে আমাকে নিচ্ছে না। নিলে বাঁচি। আর পচা শরীলটাকে ঘষটাতে হয় না। কথাগুলো বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেল মুনিরাম। চুনারাম বলল, আমাদের চলে যাওয়াই ভালো। আমরা আর কুনো কাজে লাগব না। এখন আমরা হলাম গিয়ে আখের আলসে। গোরও খাবে না, আর ঘর ছাওয়াও যাবে না। শুধু আগুন ধরালে চোখের পলকে ছাই হয়ে বাতাসে উড়বে।

উত্তরের হাওয়া এসে হঠাৎই ঝাঁপিয়ে পড়ল মুনিরামের গায়ের উপর, শীতে গা-কাঁটা দিয়ে উঠল তার, গায়ের ছেঁড়াখোঁড়া কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সে কেমন করুণ চোখে তাকাল, ঘন্টি বেজে গিয়েছে, ইবার ছুটি হবে। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি-সে গটমট করে আসছে। তবে যেতে আমার দুঃখু নেই। শান্তিতে যেতে পারলে বুকের বিদনাটা কমত।

-তুর আবার অশান্তি কুথায়? ধার চাকুর মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল চুনারাম। মুনিরাম গলা খাদে নামিয়ে বলল, অশান্তি আচে রে, অশান্তি আচে। বলেই সে কাছে সরে আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল, বউমা তুকে কিছু বলে নাই?

-না তো!

-সারা ধাওড়াপাড়া জানে অথচ তুর ঘরের বউটা জানে না। কেমন বিকৃত স্বরে মুনিরাম বলল, আমার ঘরের বউটা এট্টা কাণ্ড করে বসেচে। পালিয়ে গিয়ে সে আবার ফিরে এল কিন্তু পেটে করে ছেলে নিয়ে এল। আমার ঘরের লুলাটা মানবে না। সে গরধপটা বলছে–ওটা তার সন্তান লয়। এ সন্তানের জিম্মা নিতে পারব নি।

-হায় কপাল, এ কী কাণ্ড! চুনারাম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, কী শুনালিরে, এ সব না শুনলে বুঝি ভালো হোত!

-এক দিন না একদিন তো তোকে শুনতেই হোত। তুই ঘরের বড়ো। তোকে তো শুনতেই হবে। বড় গাছে যে ঝড় লাগে বেশি। মুনিরাম অস্থিরতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি এখুন কি করি বলতো? আমার যেতে কাটে, আসতে কাটে। আমি ফাটা বাঁশের ফাঁকে এটকে আচি। তুই আমাকে বাঁচা। না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।

-তুই চুপচাপ থাক।

–তার মানে?

-বুবা হয়ে যা, কুনো কথা বলবি নে। মনে রাখিস বুবার শত্রু নেই। চুনারাম অনেক ভেবে বলল, বউমানুষ আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরলে অমন তো হবেই। সবই ভাগ্যের লিখন। তুই আমি কি করব বল?

নূপুর লাল চা নিয়ে এসেছে দুটো কাচের গ্লাসে। সঙ্গে বাটি ভর্তি আউস-চালের মুড়ি। সকালবেলার রোদ ঢ্যাঙ্গা ঢ্যাঁড়শগাছের পাতায় গা এলিয়ে দিয়েছে পরম তৃপ্তিতে, ঢ্যাঁড়শের ছড়ানো পাতা সেই রোদ্দুর গায়ে মেখে সুখী নজর মেলে দেখছে চারপাশ। এ সময় সুখী সাতভায়া পাখির দল বাঁশবাগানে হুটোটি খেলে বেড়ায়, যেন পুরো বাঁশবনটা ওদের, ওখানে বনকুয়ারও প্রবেশ নিষেধ। চুনারাম মুখ তুলে দেখল দলবদ্ধ পাখিগুলো যেন গায়ে ছাই মেখে থপর থপর করে হাঁটছে শুকনো বাঁশ পাতার উপর, অদ্ভুত একটা শব্দ হচ্ছে চতুর্দিকে, আর সেই শব্দের মাধুর্যে এই বয়সেও বাল্যবেলায় ফিরে যাচ্ছে চুনারাম। সাতভায়া পাখিগুলোকে সে ষাট বছর আগে যেমন দেখেছিল পাখিগুলো যেন আজও তেমন আছে। ওদের কোন পরিবর্তন হয়নি। তাহলে একটা পাখির গড় আয়ু কত? পাখিরা কি বৃদ্ধ হয় না, ওদের যৌবন কি তার মতো হারিয়ে যায় না?

সাতসকালে মাথাটা কেমন গুমগুমিয়ে উঠল চুনারামের। কাল রাতে জব্বর শীত পড়েছিল। দুর্গামণি জলঢালা ভাত খেতে দিলে মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে সে বলেছিল, বউমা, এখুন শীত পড়ছে। এখুন আর জল ঢালা ভাত দিয়ো না। শীতে জীবন বড়ো কাহিল গো!

বিছানা বলতে ছেঁড়া কাথা আর একটা লোমওঠা কম্বল। বাবুরাই দিয়েছিল গায়ে দেওয়ার জন্য। তালাই-মাদুর শ্রী হারিয়ে ঘাটে যাওয়ার অপেক্ষায়। ছারপোকাগুলো আর বসবাসের জায়গা পায়নি, বেছে নিয়েছে ছেঁড়া কাঁথা আর জীর্ণ মাদুর-তালাইয়ের আশ্রয়। বুড়ো বয়সের জোড়াতালি দেওয়া ঘুম ওরাই বরবাদ করে দেয়। রক্ত চুষে ওরা পেট ভরানোর পরেই ঘুমের দেবী বিছানায় এসে বিশ্রাম নেয়। তখন রাত গড়িয়ে গিয়ে বয়স বাড়ায় শরীরে। পানবরজের পাশ থেকে ভেসে আসে শেয়ালের ডাক, শিমুলগাছের ছড়ানো ডালপালার ভেতর থেকে উড়ে যায় হুতোম পেঁচা, ইঁদুরগুলো তখন ভয়ে মরে, ঠকঠকিয়ে কাঁপে জান বাঁচানোর তাগিদে।

মুনিরাম চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে এক খাবলা মুড়ি মুখের ভেতর ছুঁড়ে দেয়, ফোকলা মাড়ি দিয়ে চাপ দিয়ে পিষে দিতে চায় মুড়ির ফোলানো শরীর, মুখের লালায় পিছলে যায় আউস-চালের মুড়ি। শেষে মিইয়ে গিয়ে মিনমিনে স্বর হয়ে বেরয় মুনিরামের কণ্ঠ থেকে, গুয়ারামের কিছু খপর পেলি?

চুনারামের দুর্বল জায়গায় বুঝি পিন ফোঁটাল মুখিরাম, নিঃস্ব চোখে তাকিয়ে বুড়োটা বলল, ছেলেটার খপর বহুৎ দিন হলো পাইনি রে। ছেলেটা পরের দোরে খাটতে যাক এ আমি চাইনি! কিন্তু আজকালকার ছেলেপুলে কথা শুনল না, জেদ দেখিয়ে গেল! ইখানে আমি চিন্তায়-চিন্তায় আধখানা!

চিন্তা তো হবারই কথা! মুনিরাম কোড়ক লাগা মুরগির মতো গা ঝাড়া দিয়ে বলল, দুব্বো ঘাস যতই সোন্দর হোক সবাই তারে মাড়িয়ে চলে। কেউ তার দিকে ফিরে তাকায় না। বুড়োলুকদের এই মনোভাব আমি কুনোদিন মন থিকে মেনে নিতে পারিনি। চাইলে যখুন দেবে না তখন না বলে নিতে দুষ কুথায়। না বলে নিলে চুরি করা হয়। যারা মানুষ ঠকায় তাহলে তারাও তো চোর। আমি লুলারে বলেছি-দুব্বোঘাস হোস নে বাপ, বাঘহাতা ঘাসের মতো বাঁচ। যতদিন বাঁচবি, মাথা উঁচা করে বাঁচবি। কারো কাচে ছোট হবি নে। বুনো বলে যারা আমাদের ঘেন্না করে তাদের মুখে তুই ছেপ দে।

মুনিরাম কুঁকুড়ে যাওয়া গলায় বলল, জীবনে চুরি করাটাকে আমি কুনোদিন পাপ বলে ভাবিনি। আমি ভেবেচি-ওটাও একটা ধম্মো। শুধু মুনিষ খেটে, গোরু চরিয়ে, ভিখ মেঙে জীবন বাঁচে না। জীবনের জন্যি পয়সা চাই। চাঁদির জুতো হলো এমন জিনিস যা তুরে বাবু-ভদ্দর লুকদের মধ্যিখানে লিয়ে যাবে। যার পয়সা নেই তার পুড়া কপাল। মনে রাখিস চাঁদির জুতোয় কাঠের পুতুল হাঁ-করে।

–আমি এখুন উঠিরে। চুনারাম এই আলোচনায় হাঁপিয়ে উঠছিল, দলছুট বকের মতো সে যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইছে অন্য আকাশে। অভাব তাকে কোনোদিন টেনে নীচে নামায়নি, সে আধপেটা খেয়েছে তবু কোনোদিন বিসর্জন দেয়নি ধর্ম।

কুথায় যাবি সাতসকালে? মুনিরাম অস্থির চোখে তাকাল, আমারে টুকে লিয়ে যাবি? কদিন পাকুড়তলায় যাইনি। ওখানে গেলে পরে আমার মনের জোর বেড়ে যায়। পাকুড়তলার বাতাসে কি আচে জানি নে, আমার মনে হয় আমি আরো ঢেরদিন বাঁচব। চুনারামকে চিন্তিত দেখাল সহসা, তুই অতটা পথ হেঁটে যেতে পারবি? তুর কষ্ট হবে না তো?

কষ্ট হলে আর কি হবে? ঘর যদি বুকে চেপে বসে তাহলে বাইরে গিয়ে বুকের সেই খিল ছাড়াতে হয়। লাঠিতে ভর দিয়ে মুনিরাম বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল।

নোলক এসে তার নড়বড়ে অবস্থা দেখে বলল, দাদু গো, আমি কি তুমার সাথে যাবো?

দরকার হবে নি। মুনিরাম এড়িয়ে যেতে চাইল।

বেড়ার কাছে এসে আগড় খুলল চুনারাম। শীতের রোদ তখনও পথের কাদা সম্পূর্ণভাবে খড়খড়ে শুকনো করে দিতে পারেনি। তখনও ঘাসের ডগায় লেগে আছে শিশিরের ছোঁয়া, বসাকগাছের পাতা ভিজে আছে শিশির জলে, পাতামাছের মতো বাঁশপাতা হাওয়ায় দুলছে টলোমলো যেন সকালবেলায় তারা চুল্লু টেনেছে ভরপেট।

কাল সকালে থানা থেকে লোক এসেছিল লুলারামকে ডাকার জন্য। জিপে নয় সাইকেলে চেপে এসেছিল মুখ চেনা পুলিশটা। লুলারাম তখন ঘুমোচ্ছিল ঘরে। হাঁক ডাকে চোখ রগড়ে বাইরে এসে দেখেছিল খাকি পোশাক পরে মূর্তিমান দাঁড়িয়ে আছে। দাঁত বের করে বলল, তোমাকে বড়বাবু ডেকেছিল। এক্ষুণি চলো।

–পায়খানা-পিসাব করব না?

-না, সে সময় আমার হাতে নেই। কাল সারারাত ডিউটি ছিল। শরীর আর চলছে না। চলো, এক্ষুণি চলল। পুলিশটার তাড়া ছিল। শরীরে ছিল রাত্রি জাগরণের চিহ্ন। পোশাকও ঢিলেঢালা। রাজ্যের অলসতায় ডুবে ছিল তার চোখ দুটো।

লুলারাম চেনা পুলিশটাকে অবজ্ঞা করতে পারল না। থানা-পুলিশ-মামলা বড়ো ঝামেলার। বড়োবাবু ডেকে পাঠিয়েছেন মানে কেস জটিল। কেস জটিল হবারই কথা। ছোট কুলবেড়িয়ায় ডাকাতি করতে গিয়ে লুলারামের গুরু হাফিজ ধরা পড়ে গেল। সেই গ্যাংয়ে লুলারামও ছিল তবে সে অল্পের জন্য বেঁচে যায়। হাফিজকে গোল করে ঘিরে ফেলে গ্রামবাসী। বকুলতলায় চলে গণধোলাই। কেউ তাকে বাঁচাতে আসেনি। গ্রামবাসীদের পুরনো ক্রোধ হাফিজের জীবনদীপ নিভিয়ে দিল।

প্রথমে শাবল দিয়ে মেরে তার পা দুটো ভেঙে দেয়, তারপর হাঁটুর কাছে চাপ দিয়ে উল্টে দেয়। পরে মাথার ঘিলুতে ঢুকিয়ে দেয় বর্শার ডগা। ফিনকি দেওয়া রক্ত আর থামতে চায় না। কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে হাফিস।

টুকে পানি দাও গো, টুকে পানি দাও। তার আর্তস্বর বাতাস বিদীর্ণ করে অনেক দূর পৌঁছে যায়। জলের বদলে সে পায় লাঠির বেধড়ক প্রহার। বকুলতলায় লুটিয়ে পড়ে সে। তার মুখে ধুলো-কাদা ঢুকে গিয়ে বীভৎস দেখায়। তাতেও ক্ষান্ত থাকে না মারমুখী মানুষ। শেষমেষ একটা বড়ো বস্তায় ঢুকিয়ে মুখ বেঁধে তাকে চাপিয়ে দেওয়া হয় গোরুর গাড়িতে। গাড়োয়ানকে নির্দেশ দেওয়া হয় কালীগঞ্জ হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে চলে আসতে।

ভোর ভোর গোরুর গাড়ি পৌঁছেছিল কালীগঞ্জের হাসপাতালে। অবনী তখন ডিউটিতে। ধরাধরি করে নামানো হল হাফিজকে। বোরার মুখ খুলে তাকে শুইয়ে দেওয়া হল আউট-ডোরের বারান্দায়। কল-বুক পড়েই সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে এলেন ডাক্তারবাবু। ও.টিতে নিয়ে গিয়ে আইডিন লাগানোর সময় পেলেন না তিনি। তার আগে চোয়ালের দু পাশে, নাকের ছিদ্রে রক্ত উগলে প্রাণ ত্যাগ করল হাফিজ।

খবরটা সকালবেলায় কানে গিয়েছিল লুলারামের। বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে চোখের জল ফেলল নীরবে। হাফিজ না থাকলে তার এত বাড়বাড়ন্ত হত না। হাফিজ হাতে ধরে তাকে কাজটা শেখায়। কানে মন্ত্র দেয়। আর সতর্ক করে বলে, যে রাতে ঘরের বাইরে পা দিবি–সে রাতে মদের বোতল ছুঁবিনে ভাই। মদ আর মেয়েমানুষ দুটারে এড়িয়ে চলবি। তাহলে দেখবি এ লাইনে সিঁড়ির পর সিঁড়ি। ধনে-মানে তুর জীবন তখন কানায় কানায় ভরে যাবে।

হাফিজ ছিল শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত, খরগোসের চেয়েও চালাক তবু তার এই অন্তিম পরিণতি কোনমতে মন থেকে মেনে নিতে পারে না লুলারাম। তার বুকের ভেতরটা ভয়ে কাটা খাসীর মেটের মতো নড়ে। শুকিয়ে যায় গলা। গুরুর মৃত্যুতে লুলারাম ভেঙে পড়েছিল পুরোমাত্রায়। একবার চোখের দেখাও দেখতে পেল না হাসপাতালে গিয়ে। ওখানে গেলে তার ঝুঁকি বাড়ত বই কমত না। পুলিশের লোক ঘুরঘুর করছিল সাদা পোশাকে।

কৃষ্ণনগর থেকে ময়নাতদন্ত শেষে ফিরে এসেছিল হাফিজের লাশ। পরের দিন সন্ধেবেলায় হাফিজ ভ্যানে চেপে পৌঁছে গিয়েছিল তার নিজের গ্রাম ছোট-কুলবেড়িয়ায়। তার লাশের উপর আছাড় দিয়ে কাঁদছিল মোতিবিবি। হাফিজের ছোট-ছোট ছেলে দুটো ভ্যালভেলিয়ে দেখছিল, মৃত্যুর কি রূপ সেই ধারণা ওদের মনে স্পষ্টত গড়ে ওঠেনি।

সেদিন গভীর রাতে মোতিবিবির সাথে গোপনে দেখা করে এসেছিল লুলারাম। নগদ কিছু টাকা আর ডাকাতির কিছু সোনাদানা মোতিবিবির হাতে তুলে দিয়ে কাতর হয়ে বলেছিল, ভাবী যদি কুনোদিন দরকার হয় আমাকে খপর দিও। তুমাদের জন্যি সদা-সর্বদা আমার জান-হাজির থাকবে। হাফিজ ভাইয়ের কাছে এ বান্দার জীবন বাঁধা আচে। টাকা পয়সা সোনাদানা দিয়ে এ ঋণ কুনোদিনও শোধ হবে না।

ডাকাত দেখতে কালীগঞ্জ হাসপাতালে দুপুরবেলায় ছুটে গিয়েছিল রঘু। এর আগে সে কোনোদিন ডাকাত দেখার সুযোগ পায়নি। হাফিজ ডাকাতের নাম জ্ঞানপড়ার পর থেকে সে শুনছে। মানুষটা নাকি কাঁড়া-মোষের মতন দেখতে। মাংসখেগো বাঘের মতো নাকি তার রাগ। তেজে খরিস সাপকে সে হরিয়ে দেবে। এমন মানুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা। বাঁধ ধরে পইপই করে ছুটে গিয়েছিল রঘুনাথ। পাকা রাস্তা ধরে নয়, সে গিয়েছিল থানার পাশ দিয়ে। বড়ো পাকুড়গাছটার পাশ দিয়ে ঢালু পথ সোজা নেমে গিয়েছে কামারপাড়ার দিকে। কামারপাড়া শেষ হলে শুরু হয় হাসপাতালের পাঁচিল।

আউট-ডোরের সামনে বুক চিতিয়ে শুয়েছিল হাফিজ ডাকাত। বুনো মোষের মতো পেশিবহুল চেহারা, ভরাট মুখ, চওড়া কপাল। দুটো পা যেন দুটো ইলেকট্রিক খাম্বা। সেই খাম্বা কেউ ভেঙে দিয়েছে জোর করে। চামড়া ফুটো হয়ে বেরিয়ে আছে সাদা হাড়। জমাট বাঁধা কালচে রক্ত চাপ বেঁধে আছে শ্যামলা মুখে, বোজা চোখ ফুলে একেবারে কমলালেবুর কোয়া, থেতলানো ঠোঁট চিপসে গিয়েছে দাঁতে। সাদা দাঁতে লেগে আছে ঠোঁটের মাংস। রঘুনাথের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। ঘরে গিয়ে কাকাকে সবিস্তারে বলতে হবে। কাকা পথ চেয়ে থাকবে তার। রঘুনাথ বুঝতে পারল হাফিজের সঙ্গে তার কাকার দহরম মহরম ছিল জব্বর। হাফিজ ডাকাতের মৃত্যুতে বেজায় দুঃখ পেয়েছে লুলারাম।

হাসপাতালের ঘাসে ঢাকা মাঠটাতে ডাকাত দেখার ভিড় উপচে পড়ছে। ভেসে আসছে নানা মানুষের হাজার কথা। রঘুনাথের ঝাঁ-ঝাঁ করছিল কান। ভিড় কোনকালেই পছন্দ নয় তার। শুধু মেলার ভিড় তার যা ভালো লাগে।

ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে শুভ তার হাত ধরল, কখন এলি?

-এই তো। রঘুনাথ চোখ ছোট করে তাকাল, এমন মরণ চোখে দেখা যায় না। আহা রে, এভাবে কাউকে মারতে হয় বুঝি?

-হাফিজ ডাকাত ভীষণ রাগী ডাকাত। ওকে পুলিশও ধরতে পারত না।

-রাগী হলেও মানুষটার মন ভেষণ ভালো ছিল। রঘুনাথ সহানুভূতির সঙ্গে বলল, জানিস, ও আমার কাকার খুব জানাশোনা।

শুভ কি মনে করে ঠোঁটের উপর তর্জনী চেপে রঘুনাথকে সতর্ক করল, চুপ। ওকথা এখানে বলিস না। বিপদ ঘটে যাবে। চল ফাঁকায় দাঁড়াই।

ফাঁকায় দাঁড়িয়ে এই শীতেও ঘামছিল রঘুনাথ। মনে মনে তার ইচ্ছে ছিল সে বড়ো হয়ে ডাকাত হবে। কেন না ডাকাতদের সবাই ভয় করে। তাছাড়া চোর অপবাদের চাইতে ডাকাত অপবাদ ঢের ভালো।

শুভ বলল, হাফিজ ডাকাত যদি কোনমতে পালিয়ে যেতে পারত তাহলে যারা তাকে ধরেছিল তাদের সে পিঁপড়ের মতো টিপে টিপে মারত।

বুড়ো আঙুল কামড়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল রঘুনাথ। বারবার করে একটা মানুষের লাশ তার চোখে ভেসে উঠছে। হাফিজ ডাকাতের মুখটা সে কিছুতেই ভুলে যেতে পারছে না।

শুভ বলল, এত বেলায় যখন এসেছিস তখন খেয়ে যাবি। চল মাকে খবরটা দিয়ে আসি।

.

১৮.

হাসপাতালের কোয়ার্টারগুলো ছোট ছোট, মাটি উঁচু করে পথ বানিয়েছে হাসপাতালের কর্মীরা। বর্ষায় জল জমে যায় এসব পথে, তখন যাতায়াতের অসুবিধা। বড়ো একটা আমগাছ ছাড়া তেমন কোনো গাছ নজরে পড়ে না রঘুনাথের। কোণের দিকের ঘরটার সামনে মস্ত একটা আমড়াগাছ প্রায় ন্যাড়া শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর কদিন পরে কচি কচি পাতা গজাবে গাছের ডালে। বেশ রূপবান হয়ে উঠবে গাছটা। রঘুনাথকে দেখে সরস্বতী নরম করে হাসল, কখন এলি রঘু? আয়। বস।

–আমি ডাকত দেখতে এসেছিলাম। শুভর সাথে দেখা হতেই ও ধরে আনল।

বেশ ভালো তো। সরস্বতী বলল, খেয়ে-দেয়ে বিকেলে যাবি। শুভ তোর কথা খুব বলে। আর বলবে না কেন? তুই কত ভালো ছেলে বল তো?

মনে মনে হাসল রঘুনাথ। সে কত ভালো ছেলে তা সে নিজেই জানে। তার সহজ সরল মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক পরিণত মন। কমলাকে দেখলে সেই মনটা হঠাৎ যুবক হয়ে ওঠে। কমলা তবু গাল ফুলিয়ে বলে, তোমার কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, তুমি বোকার হদ্দ।

শুভদের একটাই ঘর। একটা কমা কাঠের খাট পাতা, অবনী বছর তিনেক আগে কালীপুজোর সময় কিনে ছিল খাটটা। সেই খাটের উপর তালাই যত্ন নিয়ে বিছিয়ে দিয়েছে সরস্বতী। অত বড়ো খাটে অবনী আর শুভ ছাড়া কেউ ঘুমায় না। সরস্বতী খাটে ঘুমালে ঘুম আসে না। সারারাত শুধু বিড়বিড় করে। তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে নেমে আসে খাট থেকে। নীচে বিছানা পেতে ঘুমায়। আর ঘুমানোর সাথে সাথে নাক ডাকে। তার নাক ডাকার শব্দে বিরক্ত হয় অবনী, আটা কল চলচে। বাপরে বাপ, কী শব্দ!

দুপুরবেলায় পালপুকুর থেকে গা ধুয়ে এল শুভ আর রঘুনাথ। ডুব সাঁতারে পালপুকুরের অন্য পাড় ছুঁয়ে দিল রঘুনাথ। তাই দেখে শুভর আর বিস্ময় ধরে না, বাপরে, কী দম তোর বুকে পোরা! তোর সাথে কেউ ডুব সাঁতারে পারবে-ই না।

শুভ সাঁতার জানে কিন্তু সেই জানাটা যথেষ্ট নয়। তবে সবুজ বলে, সাঁতার আর সাইকেল চড়া জীবনে কেউ ভোলে না। একবার শিখলে মরার আগের দিন পর্যন্ত মনে থাকে।

রঘুনাথ হাসল। জলে নামলে তার চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল হয়ে ওঠে। আবার ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হয়। তবে সময় লাগে।

পাশাপাশি খেতে বসে শুভ দেখল হাঁসের ডিমের ঝোল রেঁধেছে তার মা। ঝোলটার এত সুন্দর রঙ যা দেখলে জল চলে আসে জিভে। শুভ আড়চোখে দেখে নিল পাঁচটা ডিম ঝোলে ভাসছে পৃথিবীর বড়ো মোতির আকার নিয়ে। হিসাব মতে চারটে ডিম হলে ওদের সবার হয়ে যাবে। একটা অতিরিক্ত ডিম কিসের জন্য রাঁধল মা। এই প্রশ্নটা প্রশ্নই থেকে গেল শুভর ভেতর। হঠাৎ সে দেখল একটা আস্ত ডিম খুন্তি দিয়ে দু’ভাগ করে তার মা সাজিয়ে দিচ্ছে দু-জনের পাতে। কাটা ডিমের সুঘ্রাণটাই আলাদা, কারোর সঙ্গে মেলে না। এই গন্ধটাই বিশেষ পছন্দ শুভর। তাছাড়া ডিম খেতে তার ভালো লাগে। ভালো লাগার একটাই কারণ–ডিমে কোনো কাঁটা নেই।

বিকেলের আলো গড়িয়ে নামছিল পৃথিবীতে। শীতের বেলা চওড়া উঠোন নয়, হাতের তালুর মতো। শুভর ইচ্ছা ছিল আজও চামগুলতি নিয়ে বাঁশঝাড়ে যাওয়ার। রাজি হল না রঘুনাথ।

চোখ দুটো কুঁচকে সে বলল, এক একজন মানুষ থাকে যাদের দেখলে পরে মাথাটা কুদরীলতার মতো ভক্তিতে নুয়ে আসে। আমার মনে হয় হাফিজ ডাকাতও সেরকম মানুষ। আমার কাকা ভালোমানুষের সঙ্গে মিশেছিল। সে যে ভুল করেনি–এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। শুভ মুখটা আকাশের দিকে উঠিয়ে অদ্ভুত গলায় বলল, তোর কাকাকে আমি দেখিনি। তবে তার কথা শুনে শুনে আমি তার ভক্ত হয়ে গিয়েচি। একদিন আমাকে নিয়ে যাস, আমি তোর কাকার সঙ্গে আলাপ করে আসব।

রঘুনাথ নীরবে শুভর মুখের দিকে তাকাল, কবে যাবি বল? তুই গেলে আমি তীর-ধনুক নিয়ে মাঠে যাবো গুড়ুল পাখি আর খরগোস মারতে।

কথাটা শুনে ভালো লাগল শুভর। গুরুত্ব সবাই পেতে চায়। গুরুত্বহীন মানুষের কোনো মূল্য নেই এ পৃথিবীতে। রঘুনাথের কথাগুলো তার মনে কদমফুলের পাপড়ির মতো জায়গা করে নিল নিজস্ব ক্ষমতায়।

বিকেলের রোদ সব ঋতুতেই মিঠে।

হাসপাতালের মাঠের মাঝখান দিয়ে পায়ের চড়া ফেলা পথ, পদপিষ্ট ঘাস উঠে গিয়ে শিরদাঁড়ার হাড়ের মতো সরু। শুভ আর রঘুনাথ পাশাপাশি হাঁটছিল, ওদের পায়ে ব্যস্ততা কেন না রোদ ঢলার আগে রঘুনাথকে পৌঁছাতে হবে হলদিপোঁতা ধাওড়ায়। দুপুরে না যাওয়ার জন্য শুধু মা নয়, কাকাও চিন্তা করবে। যত তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায় ততই মঙ্গল।

শুভ সহজে ছাড়ার ছেলে নয়। রঘুনাথ তার চেয়ে বয়সে বড় হলেও ওরা দুটিতে বন্ধুর মতো মিশছে। সম্পর্কের জড়তা কেটে গিয়ে ওরা এখন একে অপরের কাছাকাছি।

হাসপাতালের কিচেনটা দূর থেকে দেখতে পেল রঘুনাথ। কাকিমা ভর্তি থাকার সময় কতবার সে এখানে এসেছে। শুভ আর সবুজ কোয়ার্টার থেকে চলে এসেছে গল্প করার টানে। ওদের গল্পের কোনো মাথা মুণ্ড নেই, ওদের কথাগুলো যেন স্বর্ণলতার মূল, যা ফুরোয় না, যার শেষ নেই শুরু নেই–আদি অনন্ত।

রঘুনাথ হাঁ করে শোনে ওদের কথা।

সবুজ অকপটে বলে, মেয়ে দেখলে বুক এখনও ঢিসঢিস করে। মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার বায়স্কোপ দেখার আনন্দ হয়। তার যদি বিয়ে হয়ে যেত তাহলে সে আর বেশি দূর পড়ত না। কয়লার ব্যবসা করত। দুপুরবেলায় ফিরে এসে বউয়ের বাড়া ভাত খেত।

সবুজের কথা শুনে হা-হা করে হাসল শুভ, তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস। তোর বাবা যদি এমন কথা শোনে তাহলে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দেবে।

সবুজ দুঃখী হল না, বরং খুশি হল আরও, ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলে আমি বেঁচে যাই। আমার বাবাকে তো চিনিস না–কী জিনিস। বাঁধের এপারে পুঁতে দিলে গাছের ওপারে গিয়ে গাছ বেরবে। মাথায় যদি পেরেক ঢুকিয়ে দিস তাহলে স্ক্রু হয়ে বেরিয়ে আসবে।

সবুজের কথা মিথ্যে নয়। টিকেদারবাবুর উপস্থিত বুদ্ধির কাছে এ হাসপাতালের সবাই বুঝি শিশু। এমন কী ডাক্তারবাবুও মানুষটাকে মান্য করে কথা বলেন। সমস্যায় পড়লে ডেকে আনেন টিকেদারবাবুকে।

সবুজের বিয়ে করার ইচ্ছেটা ক্লাস টেন-এ ওঠার পরে প্রবল হয়েছে। মেয়েদের সৌন্দর্য তাকে বানের জলের মতো টানে। মনে মনে সে পাগল হয়ে ওঠে। এটা বানানো নয়, একেবারে রক্তজাত। এর মধ্যে দু-চারজনকে প্রেম নিবেদন করে সে বকা খেয়েছে। সবাই তাকে ক্ষমা করে দিলেও মাধুরী তাকে ক্ষমা করেনি। এক ক্লাস নীচে পড়া মাধুরীর মানসম্মান জ্ঞান যথেষ্ট। সে ফালতু কথা পছন্দ করে না। সবুজকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, বাড়াবাড়ি করবি নে তাহলে তোর বাবাকে আমি সব বলে দেব। পিঠের চামড়া যদি ফাটাতে না চাস তাহলে মুখটাতে গামছা গুঁজে রাখ। তোর মুখ ড্রেনের চেয়েও নোংরা।

কী করে নোংরা হয়, আমি যে দু-বেলা দাঁত মাজি। সবুজের কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

যাওয়ার সময় সবুজের সঙ্গে দেখা হল না রঘুনাথের, সে পালদের গমকলে গিয়েছে থলি ভর্তি গম নিয়ে। শুভ জানে–একবার গম ভাঙাতে গেলে সবুজ সারা সপ্তাহের হাতখরচ উঠিয়ে নেবে। চাকিতে আটা বেচে দেয় সবুজ। দশ কেজি গমের আটা দশ কেজি হবার কথা। সেই দশ কেজির মধ্যে থেকে দেড় কেজি আটা বিক্রি করে দিলে ঘরে কার বোঝার সাধ্যি আছে। যদি কেউ সন্দেহ করে তাকে অন্যভাবে বোঝানো যাবে। সেসব কাজে সবুজ ভীষণ পারদর্শী। নাটুকে গলায় বলবে, নতুন চাকির আটা, একটু তো কম হবে। যাঁতাই তো কত আটা খেয়ে নেয়। মেশিন না খেলে মানুষ খাবে কি করে?

ফি হপ্তার আটা বিক্রির টাকাটা লুকিয়ে রাখে সবুজ। ইস্কুলে গিয়ে মিঠে বরফ কিনে খায়। মন হলে বেলডাঙার তিলের খাজা গুড়ের নাড়ু কত কি! হাতে যতক্ষণ পয়সা আছে ততক্ষণ সে রাজা। পয়সা ফুরোলে মন বিমর্ষ। তখন মনের ভেতর আবোল-তাবোল চিন্তা উঁকি মারে। সেই চিন্তাগুলো সুঁচলো কুশগাছের মতো মনটাকে খোঁচায়। তখন ক্লাসের মেয়েগুলোকে নিয়ে ভাবনা শুরু করে সে। সকালবেলায় সে সব ভাবনার কথা ফলাও করে বন্ধুদের বলবেই বলবে নাহলে ওর ভাত হজম হবে না।

কিচেনের সামনে দৌড়ে এসে রঘুনাথকে ধরে ফেলল সবুজ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তোর সাথে খুব দরকারি কথা আছে। আমি ভাবলাম–তোদের পাড়ার আমি জামাই হবো। দেখ না ভাই–চোখে লাগার মতো যদি কোনো মেয়ে থাকে?

রঘুনাথ হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেল না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, তাকে অবাক করে দিয়ে সবুজ বলল, আমি শুভর মতো ভালোছেলে জীবনে আর হবো না। আমার যা হবার হয়ে গিয়েছে। দ্যাখ না রঘু, আমার জন্য যদি কোনো ব্যবস্থা হয়। বিশ্বেস কর–আমি কোনো পণ নেব না। কথা দিচ্ছি–বুড়োমাতলায় গিয়ে বিয়ে করব। তোরা সব সাক্ষী দিবি। কি রে দিবি তো?

রঘুনাথ অনেকক্ষণ পরে গলা ফাড়িয়ে হাসল। শুভ ব্যাপারটাকে হাল্কা করার জন্য বলল, পাগলের কথা বাদ দে তো! পাগলে কী না বলে–ওসব কথা মনে রাখতে নেই।

সবুজ মননক্ষুণ্ণ হয়, সত্যি কথাকে তোরা কেন গুরুত্ব দিস না বল তো। জানিস আমার দাদু পনের বছরে বিয়ে করেছিল। তার পরের বছর আমার বাবা হয়। বলতে কি আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ওদের!

ঘরে যাওয়ার জন্য তাড়া ছিল রঘুনাথের, এতটা রাস্তা ফাঁকা বাঁধের ওপর দিয়ে একা যাওয়া মুখের কথা নয়। সাঁঝ নেমে এলে পথঘাট সব শুনশান হয়ে পড়ে, চরসুজাপুর-দোয়েমের রাস্তাটা একলা শুয়ে থাকে আঁধার বুকে জড়িয়ে। দশ দিনও হয়নি সুজাপুরের ঘোষেদের লোকটার সাইকেল কেড়ে নিয়েছিল কারা যেন এই বাঁধের গোড়ায়। শুধু সাইকেল ছিনিয়ে নিয়ে তারা শান্ত হয়নি, মানুষটার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে গেল। গাঁয়ে-ঘরে এসব ঘটনা এখন আকছার ঘটছে।

রঘুনাথ ব্যস্ততার সঙ্গে বলল, বেলা মরে গেল, এখুন আমি যাই।

শুভ মন খারাপ করা চোখে তাকাল। তুই চলে গেলে ভাল্ লাগে না। আবার কবে আসবি রঘু?

সময় পেলেই চলে আসব। রঘুনাথ ওদের কাছ থেকে দ্রুত আলাদা হতে চাইছিল তখনই হাসপাতালের স্টাফ অরূপবাবু কোঁচা দুলিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভদ্রলোক গায়ে পড়া নন তবে যেচে কথা বলার স্বভাব, এই যে তোমরা তিনজনে মিলে কী পরিকল্পনা করছো? আচ্ছা সামনে তোমাদের পরীক্ষা না? এখন গুলতানি দেওয়া কি উচিত? মনে রেখো-ছাত্ৰনাং অধ্যয়নং তপঃ।

শুভ তার বিরক্তি নিজের ভেতর লুকাতে চাইল। সবুজ উশখুশিয়ে উঠে ঘাসের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। রঘুনাথ এসবের ধার ধারে না। লেখাপড়া তার ধাতে নেই ফলে লেখাপড়ার চর্চা হলে তার মাথায় কিছু ঢোকে না, লেখাপড়া সংক্রান্ত আলোচনাগুলো আকাশের পাখির মতো তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়, নিজেকে সে তখন খুব অসহায় বোধ করে এবং হীনমন্যতায় ভোগে। দ্রুত আঁধার নেমে আসা চরাচরে আলোর স্বল্পতা তার চিন্তা উদ্বেগকে আরো ক্ষিপ্র করে তোলে, সে অস্থির হয়ে বেরসিকের মতো বলে, আমি যাই রে, বড্ড দেরি হয়ে গেল!

-এই যে তুমি, আমি তোমাকে বলছি–এই ভর সন্ধেবেলা তুমি কোথায় যেতে চাইছ? অরূপবাবুর টানা টানা, বিকৃত-স্বরের কথাগুলো মোটেও সুখ দিল না ওদের, শুভ মাথা তুলে সাহস করে বলল, কাকু ওর নাম রঘুনাথ। শেরপুর ধাওড়াপাড়ায় থাকে। ও সকালে ডাকাত দেখতে এসেছিল। এখন ঘরে ফিরে যাচ্ছে।

-ওঃ, দ্যাটস গুড! অরূপবাবু চশমা নাকের উপর ঝুলিয়ে তাকালেন, কি নাম বললে যেন?

-রঘুনাথ। সবুজ ঠোঁট টিপে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল, অরূপবাবুকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। মানুষটার বিকৃত স্বভাব। চিবিয়ে কথা বলার প্রবণতা তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা বুঝি অরূপবাবু হারিয়ে ফেলেছেন।

রঘুনাথ ওদের সম্মতির তোয়াক্কা না করে হনহনিয়ে হেঁটে গেল হাসপাতালের গেট পর্যন্ত। তাকে চলে যেতে দেখে এক ছুটে শুভও পৌঁছে গেল হাসপাতালের গেটে। রঘুনাথ শুভর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, আবার আসব রে। ইবার আসলে হাতে সময় নিয়ে আসবখন। তেমন দরকার হলে তোদের ঘরে থেকে যাব।

-এবার যখন আসবি, বাঁশি নিয়ে আসবি। রাতেরবেলায় বাঁশি শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। শুভ রাস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। রঘুনাথ অন্ধকারে দেবদারু গাছের মতো শিরদাঁড়া সোজা করে হেঁটে যাচ্ছে। তার স্বাভাবিক গতিতে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে লেবু চিপকানো দুধের মতো।

এক একদিন কুয়াশার দল বুড়িগাঙের জলের উপর ভেসে বেড়ায় মাছের গুঁড়ি গুঁড়ি ডিমের মতো, হাওয়া এলে ওরা চঞ্চল হয়ে ওঠে, বাতাসে ভাসতে ভাসতে মজাসে চলে যায় বহু দূরে, ওরা জানে রোদ উঠলে ওদের আর কেরামতি সাজবে না।

খুব ভোরে ওঠা দুর্গামণির স্বভাব। উঠোন ঝাঁটাতে গিয়ে তার হঠাৎ নজরে পড়ল ঢিলির উঁচু হওয়া পেটখানা। ঢিলির যে এই উন্নতি হয়েছে ঘুণাক্ষরেও জানত না দুর্গামণি। ফলে সকালবেলায় ঢিলিকে দেখে সে অবাক না হয়ে পারল না।

গোরুর গাড়ির চড়া পড়া পথটা সোজা চলে গিয়েছে গ্রামের ভিতর। সেই পথের পাশ ঘেঁষে কঞ্চির বেড়া। বেড়ার উল্টোদিকে সিঁদুর পড়লে তোলা যাবে এমন ঝকঝকে তকতকে নিকোনো উঠোন।

উৎসাহ আর আগ্রহ চাপতে অক্ষম হল দুর্গামণি, হাতের নারকেল ঝাঁটা মাঝ উঠোনে ফেলে সে এগিয়ে গেল ঢিলির কাছে। ঢিলিও তাকে দেখতে পেয়ে বেড়ার কাছে মুখ উঁচিয়ে দাঁড়াল, হা দিদি গো, কৎদিন পরে আমি তুমারে দেখলাম।

দুর্গামণির উৎসুক্য হারিয়ে গেল। সে শুধু চোখ ভরে দেখতে লাগল ঢিলির বদলে যাওয়া শরীরের গড়ন। এক সময় উৎসাহ চেপে না রাখতে পেরে শুধালো, তুর কি হয়েচে রে ঢিলি, এতদিন কুথায় ছিলিস? ঢিলি হালকা ভাবে হাসল, কুথায় আর যাবো দিদি, মরতে গেছিলাম। তখুন মাথার আমার ঠিক ছিল না। কে যে কখন আমারে বিষ ঢেলে দিল টের পেলাম না। হা দিদি, আমার এমুন পুকাড়ে ভাগ্য যে চিটেধানেও বীজতলায় ফলন হলো। সেই জ্বালায় তুমার দেওর মরচে। আমারে গলা টিপে মারতে চাইল দু-তিনবার। দু-তিনবারই মা শীতলাবুড়ি আমাকে বেঁচিয়ে দিল। নইলে কবে আমি মরে ভূত হয়ে যেতাম! তুমার সাথে আর দেখাই হত না।

-চুপ কর মুখপুড়ী, অমন কতা আর বলিস নে! চাপা গলায় সতর্ক করল দুর্গামণি।

ঢিলি হাসল না, শুধু শরীর ঝাঁকিয়ে কেমন অবজ্ঞার হাসি হেসে উঠল, কেনে চুপ করব দিদি, কিসের জন্যি? তুমার দেওর আমারে দুনিয়া থিকে সরিয়ে দিতে চায়। ও আমাকে মারবে তারপর দম লিবে। তবে আমিও বুনো-ঘরের ঝি। ওর মনোবাসনা আমি পূর্ণ হতে দিব না।

-চুপ কর, শান্ত হ। দুর্গামণি বড়ো দিদির মতো তাকে বোঝাল, যে এসেছে সে তো তুর সন্তান। অন্যকে সাজা দিতে গিয়ে পেটেরটাকে সরিয়ে দিবি নে। শরীরের ফুল আর গাছের ফুলের মধ্যে শুধু এইটুকুন ফারাক থাকে।

ঢিলি কথা বলতে পারল না, ওর ঠোঁট কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। দুর্গামণির মুখের দিকে তাকিয়ে সে কেঁদে উঠল ঝাঁকুনি দিয়ে, আমি মরব দিদি, মরব। আমি না মরলে ওর হাড়ে বাতাস লাগবে নি যে! ঢিলি চোখ মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।

দুর্গামণি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, লক্ষ্মী বুন আমার, মাথা গরম করিস নে।

 ভিকনাথের বউটারে আমি বুঝিয়ে বলব, সে যেন কদিন বাপের ঘর থিকে ঘুরে আসে।

–সে ঢেমনী তুমার কথা শুনবে নি। ঢিলি জোর গলায় বলল, লেড়ি কুত্তির লেজ কি কখনো সোজা হয় গো। যতই সোজা করো–সেই লেজ আবার যেই কে সেই।

–তবু চিষ্টা করতে দুষ কুথায়?

ঢিলি পানসে হেসে বলল, না, দোষের কিছু নাই। তবে কি জান দিদি, মেয়ে দুটো আমার পর হয়ে গেল! যেদিন শুনেচে আমার ছানাপুনা হবে সেদিন থিকে কথা বলে না। ওরা আমাকে ঘেন্না করে। নূপুরটা তো মুখের উপর বলে দিল, অমন মায়ের মুখ দেখাও পাপ।

–এসব লিয়ে ভাববিনে। নিজের রক্ত কুনোদিন পর হয় না।

–সে আমি জানি গো তবু মনটা কেমুন কেমুন করে।

দুর্গামণি আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, আগড় খুলে ভেতরে আয়। কদিন মুখোমুখি বসে তুর সাথে কথা বলিনি

-যাব না দিদি, মেলা কাজ আচে। পরে আসবখন। হাওয়া যেমন যায় ঢিলি তেমনই চলে গেল।

.

১৯.

সংসারের ঝামেলায় ঢিলির কথা ভুলে গিয়েছিল দুর্গামণি, হঠাৎ পাড়া ঘুরে এসে রঘুনাথ দ্বিধার সঙ্গে বলল, জানো মা, কাকিরে আবার পাওয়া যাচ্চে না। কাকারে দেখলাম মুকামপাড়ার দিকে যেতে। আমার সাথে চোখাচোখি হল কিন্তুক কথা বলল না।

–তার কি মাথার ঠিক আছে বাপ? দুর্গামণি সহজভাবে বলল, ওই মানুষটার মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল দশা। ও বলে এখুনো ঘুরচে-ফিরছে। অন্য কেউ হলে নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যেত।

-কাকা নিজের দোষে নিজে পাগল হয়েচে। কথাগুলো রঘুনাথ ফস করে বলে ফেলল।

অসহিষ্ণু চোখে তাকাল দুর্গামণি, তার চোখে মুখে বিরক্তির ঝাঁঝ ফুটে উঠল, তুই অতোটুকুন ছেলে, তুই কি বুঝিস মানুষের দুঃখ-জ্বালা। হট করে কারোর সম্বন্ধে কুনো কিছু বলা উচিত লয়। সব দিক বেচার-বিবেচনা করে কথা বলতে হয়। নাহলে লুকে তুরে বুকা ভাববে।

এতটা কড়া উত্তর মায়ের কাছ থেকে আশা করেনি রঘুনাথ, জবাব শুনে সে নিষ্প্রভ চোখে তাকাল, কাকি নাকি আর কুনোদিন ভালো হবে না? এসব কথা সত্যি, মা?

–আমি জানি নে যা। দুর্গামণি মুখ ঝামাটা দিয়ে উঠল, ছোট মুকে বড়ো কতা বললে খারাপ শোনায়। তুই আর এসব নিয়ে কুনোদিন কিছু বলবি নে।

রঘুনাথের বুকের ভেতরটায় বুঝি পাখি উড়ছিল, সে ছটফটিয়ে বলল, কাকি যে কুথায় গেল কে জানে।

দুর্গামণি রঘুনাথকে বুঝিয়ে বলল, তুর কাকি যেখানেই থাকুক তার দেখা আমরা ঠিক পাবই পাব। এ অবস্থায় সে বেশি দূর যাবে না। যাওয়া তার পক্ষে সম্ভবও নয়।

রঘুনাথ চলে যাওয়ার পর ঢিলির চিন্তায় দুর্গামণির মনটা অস্থির হয়ে উঠল। বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটা প্রশ্ন তার মনে উঁকি দিয়ে গেল–ঢিলিটা গেল কুথায়? তিন দিন ধরে বুনটা যাবে কুথায়?

.

তিন দিন নয় সাত দিনের মাথায় ঢিলিকে দেখে জ্ঞান হারাল নূপুর। টিপটিপ বৃষ্টিতে সকাল থেকে মেঘে ছেয়েছিল আকাশ। কাপড়চোপড় শুকানো দায়। একটু রোদ উঠলে আবার শুরু হয় বৃষ্টি। কখনো ঝিরঝিরে, কখনো মোটা দানার বৃষ্টি। আধ শুকনো কাপড় তুলতে এখন নূপুরকে ছুটে আসতে হয় বাইরে। কার এত সময় আছে হাতে যে বারবার ছুটে আসবে।

মাটির ঘরের দোতলা ছাদটা প্রায়ই ফাঁকাই পড়ে থাকে লুলারামের। বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা সামনের জায়গাটা। ফাঁক ফাঁক বেড়ার মতো। হাওয়া-বাতাস খেলে বেড়ায় সেই ফাঁক-ফোকর দিয়ে।

তালগাছ চেরাই করে তাতে আলকাতরা বুলিয়ে চালের কাঠামো তৈরি করেছে লুলারাম। ঢালু হয়ে নামা চালের খড় দাওয়াকে ছায়া দিচ্ছে সবসময়। সেখানে মোটা রশা এ মুড়ো থেকে সে মুড়ো বেঁধে দিয়েছে লুলারাম।

নূপুর সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠে এল ছাদে। দরকার ছাড়া ছাদে তার ওঠা হয় না। কেন ছাদে উঠবে সে? দোতলার ছাদে মোট একটাই ঘর। সেই ঘরে একটা মাত্র ছোট জানলা। পেছনের আমগাছ ডিঙিয়ে যেটুকু আলো আসে সেইটুকু আলোই ঘরের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট।

দড়িতে কাপড় মেলতে গিয়ে নূপুর কী মনে করে ঘরের দিকে তাকাল। ঝুলন্ত দুটো পা দেখে সবার আগে তার ভূতের কথা মনে হল। দিন দুপুরে ভূত অবিশ্বাস্য। টুকি দিয়ে দেখতে গিয়েই তার গলা ফুড়ে বেরিয়ে এল আর্তনাদ। বাবা গো’ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল নূপুর।

তার আর্তচিৎকার লুলারামকে উঠিয়ে আনল দোতলায়। নূপুরকে দেখার আগে সে দেখতে পায় ঢিলির লাশ। সায়ার খোলে হাওয়া ঢুকে ঘাঘরার মতো গোল হয়ে আছে চারপাশ। চুল ছড়িয়ে আঁধার পুরো মুখ। ফুলে ফেঁপে যাওয়া সেই মুখ আর চেনা যায় না। ঢিলির গায়ে কোনো জামা ছিল না ফলে তার পৃথুলা স্তন দুটো বরফের চাঁইয়ের চেয়েও শক্ত হয়ে লেপটে আছে বুকের নিচে। বিকৃত মুখ থেকে জিভ বেরিয়ে ঝুলে আছে বাঁ দিকে, সেই জিভের রঙ লালচে নয়, ফ্যাকাসে সাদা। শাঁখা রুলি-পলা সেঁটে গিয়েছে ফুলে ফেঁপে ওঠা হাতে। মাছি উড়ছিল ভনভনিয়ে। চতুর্দিকে নাক ঝাঁঝিয়ে ওঠা দুর্গন্ধ।

এক ঝটকায় লুলারামের বমি বেরিয়ে আসতে চাইল। ধুতির খুঁটে নাক চাপা দিয়ে বাইরে এসে ভেঙে পড়ল সে কান্নায়। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে দোতলার ছাদটাতে। পাড়ার ছেলে বুড়ো এমনকী বউরা-মেয়েরা এসে জড়ো হয়েছে উঠোনে।

নাকে-মুখে গামছা বেঁধে ঢিলিকে নামানো হল কড়িকাঠের ফাঁস কেটে। ঢিলি তার পরনের শাড়িটাকে শেষ সঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছে।

নূপুরের জ্ঞান ফিরতেই তার প্রথম প্রশ্ন, আমার মা কোথায়? ও বাবা, আজ তোমার জন্য আমরা মাকে হারালাম!

নূপুরের এই কান্না শুধু অন্ধ আবেগ নয়, এর মধ্যে অনেক সত্য মিশে আছে। চোরাকুঠুরীতে নিয়ে তার মাকে গুম করে দিতে চেয়েছিল লুলারাম। এই চেষ্টা সে পরপর তিন বার করেছে। তিন বারই মা শীতলাবুড়ি ঢিলিকে শক্তি জুগিয়েছে রুখে দাঁড়াবার।

রুখে দাঁড়ালেও নিজের প্রতি ঘেন্না জন্মেছিল ঢিলির। অমন সোয়ামীর সে আর ভাত খাবে না, অমন সোয়ামীর ঘর সে আর করবে না। সে মরবে।

গুমঘরে লুলারাম তিন ব্যাটারির টর্চ মেরে হন্যে হয়ে খুঁজছিল ঢিলিকে। এমনকী গভীর কুয়োটায় বউটার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে গেল কোথায়? যেখানেই যায় যাক,আর না ফিরলেই ভালো! যদি ফেরে তাহলে গুমঘরের মরণকুয়ায় তার শেষ কাজ সম্পন্ন হবে। কাক-পক্ষীতেও টের পাবে না।

-সাতদিন পরে এ কী বিপদ! লুলারাম কপাল চাপড়ে কেঁদে উঠল। এ কান্না লোক দেখানোর কান্না। এ কান্নার গতি বাড়ল যখন চুনারাম এসে সহানুভূতির হাতটা তার পিঠে রাখল।

-চুপ কর বাপ, মানুষ কি চিরদিন থাকে রে! মানুষ হল গিয়ে কচু পাতার জল, সামলে না রাখলে জল টলমল। চুনারামের কথা শুনে লুলারামের দাঁত লেগে যাবার জোগাড়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে যেন পুরো শরীরটাকে শিমুল তুলোর চাইতে হালকা করে দিল।

শ্মশান থেকে ফিরে বেদম মদ খেয়েছিল ভিকনাথ। হাঁটা চলার ক্ষমতা ছিল না তার। ফিনফিনে জ্যোৎস্নায় শীত ভেসে আসছিল বুড়িগাঙ ডিঙিয়ে। ঢিলি মারা যাওয়ার পর থেকে ভিকনাথের মনে এক ফোঁটাও শান্তি নেই। সে ঢিলির মৃত্যু চায়নি, সে চেয়েছিল লুলারাম যেন সুফল ওঝার অগ্নিবাণে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যায়। পাপীকে শাস্তি দিতে গিয়ে কী কাণ্ড বাঁধিয়ে বসল সুফল ওঝা।

চিতা ধরানোর আগে থেকে গলায় মদ ঢালছিল ভিকনাথ। ঘরে ঝারি তার নেশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নাকিসুরে আহ্লাদ করে সে বলেছে, আমার আর ইখানে থাকতে মন করছে না। তুমি আমারে বাপের ঘরে দিয়ে আসবে চলো।

ঝারি কেন চলে যেতে চায় ভিকনাথের তা অজানা নয়। ঢিলির আত্মহত্যার কারণ ঝারিও হতে পারে। বিশেষ করে নূপুরের কান্নায় সেই ঝাঁঝ পেয়েছে অনেকেই। ঝারির এখন পাড়া থেকে চলে যাওয়া মঙ্গলের। লুলারামের সঙ্গে লতায়-পাতায় সম্পর্কটা এখন ন’মাসের পেটের মতো স্পষ্ট ভাবে দেখা দিয়েছে সবার চোখে। ভিকনাথ ঝিঁঝি কানা। তাই সে দেখেও কিছু দেখতে পায় না। পাগল হয়ে সে এখন সুফল ওঝার পেছন পেছন ঘুরছে। সুফল ওঝাও কম ঘুঘু নয়, তার হাত দিয়ে ছাই গলে না, সে আবার প্রাণভরে মন্ত্র দেবে কি করে?

চিতা নিভিয়ে ফিরে গিয়েছে শ্মশানযাত্রী।

বাবলা গাছে ঠেস দিয়ে নেশার ঘোরে বসেছিল ভিকনাথ। তার কিছু দূরে হাত-পা ছড়িয়ে বালির উপর শুয়ে পড়েছে মদে ক্লান্ত সুফল ওঝা। মাঝেমাঝেই কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল ওর, সব ধ্বংস হয়ে যাবে। সব ছারখার হয়ে যাবে। এই তো খেল শুরু।

কথাগুলো সহ্য হল না ভিকনাথের। সুফল ওঝার বুজরুকি সে ধরে ফেলেছে। কথায় চিড়ে ভিজে না, কথায় শুধু ছলনা।

সুফল ওঝা জড়ানো গলায় বলল, ঢিলিকে শেষ করে দিলাম, এবার লুলাটাকে দেখব। ওর বড়ো বাড় বেড়েচে। ওর বাড় আমি ভাঙব। তারপর বুড়িগাঙে ডুব দিয়ে দায়মুক্ত হবো।

-কেনে মিচে কতা বলচো ওস্তাদ! রাগে চোখের তারা ঠিকরাতে শুরু করে ভিকনাথের, তুমার মুরোদ আমার জানা আছে। তুমি হলে গিয়ে খেলনা বাঘ, হাঁ করলে খড় বিচুলি বেরিয়ে পড়ে।

-কী বললি?

–যা বললাম তা তো নিজের কানে শুনতে পেলে! মাকালফল দেখেছো? দেখতে সোন্দর পারা। কিন্তু ভেতরটায় গু-গোবর পোরা। কুনো সুয়াদ নেই, ঘেরান নেই। তুমি হলে গিয়ে সেই মাকাল ফল। ভিকনাথ মুখের লালা হাতের চেটোয় মুছে নিল।

তবে রে শালা, যে পাতে খাওয়া সেই পাত ফুটো করা? হাঁপাতে লাগল সুফল ওঝা, তুর অতি বাড় বেড়েছে, ইবার হাতেনাতে তার ফল পাবি। তুর এমন দশা করে ছাড়ব যে ডুবে মরতেও জল পাবি না।

-মেল ফ্যাচর ফ্যাচর করো না তো? মাথায় রাগ চড়ে গেলে ওস্তাদ বলে রেহাই পাবে না। ভিকনাথ খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বিড়বিড়িয়ে উঠল তার ঠোঁট, মা গঙ্গাবুড়ি, আমারে শক্তি দাও। হারামীটার হাড় যেন আমি ভেগে দিতে পারি।

সুফল ওঝা টলোমলো পায়ে এগিয়ে এল ভিকনাথের সামনে। বুক চিতিয়ে সে হুঙ্কার দিয়ে বলল, গুরুর মুখে মুখে জবাব দিচ্ছিস, তুর ভালো হবেনি বলে দিচ্চি। এখনও সময় আচে নিজেকে সামলা। নাহলে পোড়া কাঠের মতুন তুর এই দেহ গাঙ্গের জলে ভেসে যাবে।

দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গরগরিয়ে উঠল ভিকনাথ, তারপর বুনো হাওয়ার মতো চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুফল ওঝার গায়ের উপর। এত আচমকাই ঘটনাটা ঘটল যে সুফল ওঝা নিজেকে বাঁচাবার আর সময় পেল না।

বালিয়াড়িতে জমে উঠল দু-জন মাতাল মানুষের জীবনমরণ লড়াই। গঙ্গা বয়ে যাওয়ার শব্দ হচ্ছিল কুলকুল। ভিকনাথ আক্রোশে সুফল ওঝার মুখ ঠুসে ধরেছে বালিতে, বল শালা, তুই আমার বউয়ের দিকে কেনে লজর উঠিয়ে দেখেছিলিস? ঘরে তুর বৌ নেই? শালা রাছুয়া, শালা লুলার ভাই! আজ তুর গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করে ছাড়ব।

ছাড়রে, ছাড়রে! বালিতে সুফল ওঝার দম আটকে যাবার জোগাড়, সেদিকে কোনো হুশ নেই ভিকনাথের। সে চুলের মুঠি ধরে ক্রমাগত মাথা ওঠায়, আবার নামায়। কখনও বা শুন্যে মাথা তুলে পাগলের মতো ঝকায়, আমার বউরে তুই রাঢ় রাখতে চাস, দাঁড়া তুর দেখাচ্চি মজা! মন্ত্রফন্ত্র সব তোর গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে দেব। মানুষ ঠকিয়ে বড়োলোক হওয়ার বাসনার বেলুনটা আমি বেবুর-কাঁটায় ফুটা করে দেব।

চাঁদ গড়িয়ে যায়, জেলে নৌকো ভাসে গাঙের জলে। জ্যোৎস্নায় চকচক করে বালিচর। দু-জন মাতাল এক সময় গা-হাত-পা এলিয়ে শুয়ে থাকে দু-দিকে, যেন মানুষ নয়, চরে বেকায়দায় আটকে যাওয়া দুটো দিকভ্রান্ত পথহারা বোয়ালমাছ।

.

সকালের আলো চিকচিক করছিল মোটা দানার বালিতে পড়ে। রোদের নরম কামড়ে গা গরম হয়ে উঠছিল ভিকনাথের। হঠাৎ গাঙের দিকে তাকিয়ে তার ঝারির কথা মনে পড়ল। ঝারি কী চায় তার কাছে। হলদিপোঁতা ধাওড়ার সব চাইতে সুন্দরী বউ সে, পাড়ার অন্য কোনো বউয়ের সঙ্গে তার আচার-ব্যবহার মেলে না। সে যেন আকাশ থেকে ঠিকরে পড়া নক্ষত্র। তার দীর্ঘদেহ তরলা বাঁশের মতো সুন্দর, মেদহীন। কাচবরণ শরীরে লাবণ্যর কোনো কমতি নেই। মুখখানা এতই কোমল যেন তা বুড়িগাঙের এঁটেল মাটির চেয়েও নরম এবং লতলতে। ভাসা ভাসা চোখ দুটোয় সর্বদা বিছিয়ে থাকে অপার মুগ্ধ বিস্ময়। দীর্ঘাঙ্গী শরীরের ঢেউ তোলা খাঁজ-ভাঁজ সব যেন মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। ঝারি তার কাছে কী চায় ভিকনাথ ভাবল। অমনি মনের ভেতরে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চের স্রোত বয়ে গেল তাকে পরাজিত করে। ভিকনাথ বুঝল তার পক্ষে ঝারিকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। ঝারি তার হৃৎস্পন্দন। রাতের ঝারি তার সারা দিনের সালসা।

নেশা ছেড়ে যাওয়ার পর শরীর যেন হালকা লাগে ভিকনাথের। দু-হাতে ভর দিয়ে সে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। প্রবাহিত গঙ্গার সামনে মানুষ নিজেকে বুঝি আবিষ্কার করে অপার মুগ্ধতায়। যে কোনো জলের একটা অদৃশ্য মন-কেমন করা শক্তি থাকে। সেই অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ভিকনাথের হঠাৎ মনে পড়ল সুফল ওঝার মুখখানা। গত রাতের পরপর ঘটনাগুলো তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল, এক সময় হাঁপিয়ে উঠল সে। বিবেকের তাড়নায় সে সুফল ওঝাকে দেখতে চাইল আশেপাশে। দৃষ্টির চারপাশে সে শ্মশানের হালকা ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। ঠিক মন খারাপ নয়, এক ধরনের শূন্যতা কিংবা নিঃসঙ্গতায় সে কেমন অসহায়বোধ করল নিজেকে। কাল রাতে নেশার ঘোরে অমন কাণ্ড না করলেই বুঝি ভালো হত। হাজার হোক সুফল ওঝাকে সে গুরু বলে মেনেছে। গুরু নিন্দে, গুরুর অপমান-অমর্যাদা ধর্মে সয় না। এ ঘোরতর পাপ।

ভিকনাথ জলের কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। দেশী মদের বাসি ঘ্রাণে মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে আছে। আঁজলা ভরে জল তুলে নিয়ে কুলকুচি করল সে। ভালোমতন চোখে-মুখে জলের ছিটে দিল। অতীতকে নেড়ে ঘেঁটে আর বিশেষ লাভ হবে না। অতীত ইঁদুরের গর্তের মতো, একবার ঢুকে গেলে সেই ঘুলঘুলি থেকে বেরনো দায়।

.

ভিকনাথ হাঁটতে লাগল ঘরের দিকে। ঝারির জন্য তার মন বড়ো অস্থির হয়ে উঠল নিমেষে। ঝারিকে ঘরে একা রেখে আসা উচিত হয়নি তার। ঝারির মন ফুলের চেয়েও নরম, তপতপে। সেখানে যে কেউ পাপের স্পর্শ দিয়ে দিতে পারে। ঝারি তো মাটির মতো। মাটিকে যে কেউ নাড়তে ঘাটতে পারে।

সুফল ওঝার নেশা ছুটে যাবার পর লাল কাপড়ে মোড়ানো পুঁটলিটা বগলদাবা করে নিশ্চয়ই গাঁয়ে ফিরে গিয়েছে। জ্যোৎস্না রাতে ওষুধের জন্য গাছের শেকড় তুলতে বেরয়। রাত জাগা তার অভ্যাস। গুণিন বিদ্যের ঘোরে সে ঝড়ো বাতাসের চেয়েও অস্থির। এই অস্থিরতা কেবল তাকেই মানায়। ভিকনাথ তার পেছন পেছন ঘুরে কি পাবে? ফলাফল শূন্য। ঝারি তাকে বারবার করে বুঝিয়েছে–যেও নি গো। যার পেছনে ঘুরচো সে হল গিয়ে সাহেব মাঠের ভূত-আলো। দুর থিকে দেখতে পাবা, কাছে গেলে কিছু নেই। আলেয়ার পেছনে ঘুরে নিজের শরীল এলিয়ে কী পাবে তুমি?

আমি ওঝাগিরি শিখে তুরে সুখে রাখব বউ। ভিকনাথের চোখে স্বপ্ন চিকচিকিয়ে উঠল।

সেই স্বপ্ন তাকে নিশি পাওয়া মানুষের মতো টেনে নিয়ে যায় সুফল ওঝার পেছন-পেছন। লুলারামকে বাণ মেরে মারতে পারলে তার বুকের গভীরে উথলে ওঠা ক্রোধের নদীটা কিছুটা হলেও শান্ত হবে। ঝারি তখন পুরোপুরি তার বুকের ছায়ায় চলে আসবে। একটা মন দু-ফাঁক রাস্তার মতন হয়ে গেলে কোন রাস্তাটা যে কার বোঝা দায়। মন যদিও বা দুটো হয়, শরীর তো দুটো হয় না। ভিকনাথের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল হাঁটতে হাঁটতে।

ঝারি তার সঙ্গে বেইমানী করেছে। মাঘ মাসে পরবের সময় বিয়ে হয়েছিল তার। প্রথমত ঘরের চালে উঠে গিয়েছিল ভিকনাথ। ঝারি তাকে গান গেয়ে গেয়ে তোয়াজ করে নামাল, নেমে এসো গো/বেঁধে বেড়ে খাওয়াব পো/ভালোবাসায় নাওয়াব পো/ নেমে এসো নেমে এসো গো, ও আমার প্রাণের নাগর/ভরা যৌবন জিয়োনো কই, বুক হয়েছে ডাগর।

পাঁচুই গিলে টলতে টলতে গান গাইছিল ঝারি, তার সাথের মেয়েরা সুর ভাসিয়ে হাতে হাত ধরে নাচছিল ভাদোর মাসের লকলকিয়া আখগাছের মতন। সেই সুখের দৃশ্য মানুষের জীবনে খুব কম আসে। ভিকনাথ চোখ মুদলেই এখনও শুনতে পায় ঝারির সুরেলা গান। চুল্লুর নেশার চাইতেও বেশি নেশা হয় তখন। সেই ঝারি এমনভাবে বিকিয়ে দেবে নিজেকে লুলারামের কাছে? জীবন থাকতে এসব মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের। এর চাইতে হাত ঢুকিয়ে বুকের ভেতর থেকে কলজে উপড়ে আনা সহজ কাজ।

নেশা কেটে গেছে তবু যেন পা জোড়া টলতে থাকল ভিকনাথের। লুলারাম তার বুকে শেয়ালকাঁটা গাছ পুঁতে দিয়েছে। ঝরি সেই গাছটাতে জল দেয়। কোনোদিনও চেষ্টা করে না গাছটাকে তুলে ফেলে দিতে। এ কেমন সম্পর্ক কিছুই মাথায় ঢোকে না লুলারামের। ছোটবেলায়, মনে পড়ে তার মামাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশে। কাকে যেন খুন করেছিল মামা। নারীঘটিত কেস। বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি দিয়ে জেলে গিয়েছিল মামা। সে সময় দাদুর জমিজমা এমনকী থালা বাসন ঘটি বিক্রি হয়ে যায় কেস চালাতে গিয়ে। একরকম পথের ভিখারি হয়ে যায় ওরা। এত কিছুর পরেও মামাকে মনে মনে সমর্থন করে ভিকনাথ। মামা সমাধান চেয়েছিল, সমাধান করেই ছেড়েছে। ভিকনাথের বিচারে ঝারিও কম অপরাধী নয়, সে যাত্রাদলের সখীগুলোর মতো নাটুকে ব্যবহার করছে। রোজ একটু একটু করে সরলতা খুন করছে ঝারি। পাপ আর অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে সে প্রমাণ করতে চাইছে–কত বড়ো নির্দোষ। ফুলে দাগ লাগলে সহজে তা নজরে পড়ে। ফুলেরও কলঙ্ক থাকে। সেই কলঙ্ক দাগ ফুল না ঝরে যাওয়া পর্যন্ত নিজের অস্তিত্বকে জাহির করে যায়। এমত অবস্থায় ভিকনাথের কি কর্তব্য সে বুঝে উঠতে পারে না। তার মাথা টলে ওঠে। ঝিনঝিন লাগে পায়ে। মনের মধ্যে সমস্যার ঘূর্ণিগুলো দলা পাকায়। চোখের কোণ দুটো করা ব্যাঙের মতো কটকটিয়ে ওঠে। চোখ রগড়ে নিয়ে সামনে তাকাতেই সে দেখতে পেল শ্মশানের ডোম হরনাথ লাল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।

হরনাথের চোখ জোড়া বলে দিচ্ছিল ঢিলিকে পোড়ানোর পর সে রাতভর ঘুমায়নি। নেশার মধ্যে ডুবে থেকে রাত পার করে দিয়েছে সে। লোকে বলে, মানিকডিহির ঘাট কোনোদিন ফাঁকা যায় না। ঘাট ফাঁকা গেলেও শ্মশান থাকে জমজমাট। শেরপুরের হরনাথকে কে না চেনে এই গ্রামের। দশ গাঁয়ের লোকে জানে তাকে। ঘর সংসার হরনাথের সব ছিল। বানের বছরে ঘর গেল, বউ-মেয়ে দুজনেই চলে গেল। সে বছর পুবে খাটতে গিয়েছিল হরনাথ। বউ-মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে গায়ে এসে সে দেখল শূন্যঘর, নিমগাছের ডালে বসে দুপুরবেলায় কা-কা করে ডাকছে কাক। তাকে দেখে পাড়াপ্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়ে শুকনো মুখে বলল, বড়ো দেরি করে এলি রে! কী করব, চারদিকে থৈ থৈ করচে জল। মানিকডিহির শ্মশানেও ডুব জল। উপায় না দেখে পচা লাশ বানের জলে ভেসিয়ে দিলাম।

তাদের হাহাকার বানানো নয়, বুকের গভীর থেকে উঠে আসা। ফাঁকা ঘরে সারারাত কাদল হরনাথ। পাশের বাড়ির টগরী তাকে বুঝিয়ে বলল, ও কাকা, কেঁদো না গো, তুমি কানলে আমি আর চোখের জল এটকে রাখতে পারব না! আমিও তুমার সাথে গলা ফাড়িয়ে কাঁনব।

টগরী আর শিউলি মিতে পাতিয়েছিল জুনানপুরের কালীতলায়। জুড়ানপুরের মা কালী বড়ো জাগ্রত। সবাই বলে-ওখানে মিতে পাতালে সে জোড় নাকি কুনোদিনও ভাঙে না।

টগরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, কাকা গো, আমাদের জোড় ভেঙে গেল গো! শিউলি আমারে বলেছিল, এবার বড়ো পুজোয় দুজনে মিলে নাগরদোলায় চাপব। আমাদের আর নাগরদোলায় চাপা হল নি গো-ও-ও-ও। টগরী সশব্দে কেঁদে উঠেছিল।

রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে পরের দিন বড়ো গঙ্গার পাড়ে চলে এসেছিল হরনাথ। মা গঙ্গার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজের ঝাঁকড়া চুল আক্রোশে চেপে ধরে সে অঝোরধারায় কাঁদল। ডুবা শাক খেয়ে পেটের দায়ে মরল তার বৌ আর মেয়ে। ভারতী আর শিউলিকে খাটিয়ায় চাপিয়ে হাসপাতাল অব্দি নিয়ে যেতে পারেনি কেউ। হাসপাতালেও কোমর জল। মালীপাড়ার কাছে বাঁধ ভেঙেছে। জল নামছিল শ’হাতির চেয়েও বেশি চিৎকারে। মালীপাড়া থেকে হাসপাতালের দূরত্ব একটা বিড়িরও পথ নয়। ফলে হাসপাতালের মাঠটাতে জলের তোড়ে কেউ ঢুকতে পারে না ভয়ে। জল থৈ-থৈ হাসপাতালের কর্মচারী আর ডাক্তার চলে গিয়েছেন জীবনের দায়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। এই অবস্থায় কে আর ঝুঁকি নিয়ে ওদের পৌঁছে দেবে হাসপাতালে। ফলে সম্পূর্ণ বিনা চিকিৎসায় মারা গেল ভারতী আর শিউলি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ওদের চিকিৎসায় বাধা হয়ে দাঁড়াল, ভাগ্যের কী পরিহাস মৃত্যুর পরেও মাটি পেল না ওরা। জলে ভাসিয়ে দিতে হল ওদের পচন ধরা লাশ।

এসব ভাবনা হরনাথকে পাগল করে তোলে, বোলতার কামড়ের চেয়েও তীব্র জ্বলনে অস্থির হয়ে ওঠে তার দেহ-মন। টগরীর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে, আমার শিউলি তোর মধ্যে বেঁচে থাকবে বিটি। কিন্তু তোর কাকিরে আমি আর পাব না। আমার পাপে ওরা চলে গেল। কার জন্যি এ ঘর আঁকড়ে পড়ে থাকব বল? আজ থিকে শ্মশানই আমার ঘর, শ্মশানই আমার সব। এই বড়ো গঙ্গার জলে ওরা ভেসে গিয়েছে। এই বড়ো গঙ্গায় ওদের শরীল মিশে আছে। যারা শেষবেলায় আগুন পায় না তাদের আমি আগুন দেব। তাদের সৎকার করব। নিজের বউ-মেয়ের তো সৎকার করার ভাগ্য হয়নি। দশের সৎকার করে আমি আমার পাপের বোঝা কম করব।

সেদিন থেকে শ্মশানের কাছে গাঙের পাড়ে কুঁড়ে বেঁধে পড়ে আছে হরনাথ। তার খাওয়া-পরা-শোওয়ার কোনো ঠিক নেই। সারাদিন পথের দিকে সে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে কখন মড়া আসবে, কখন বলহরি হরিবোল ধ্বনি ভেসে আসবে।

দাহ করার কাজে হরনাথের চেয়ে যোগ্য মানুষ এ অঞ্চলে আর দুটি নেই। দাহ শেষ হলে সে কারোর কাছে হাত পেতে দাঁড়ায় না। শ্মশানযাত্রীরা দু’ভাড় কাঁচা মদ দিলে তাতেই সে খুশি। সে চায় গ্রামের যত মড়া সব যেন তার হাতে দাহ হয়। মড়া পুড়িয়ে এখন এক ধরনের তৃপ্তি পায় হরনাথ। মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। আনন্দ আর পরিতৃপ্তি গাঙ্গার ঢেউ হয়ে বুকের উপর আছড়ে পড়ে। শিউলি আর ভারতী আগুন আর মাটি পায়নি। আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে তার জন্য মনে মনে সচেষ্ট থাকে হরনাথ।

মাটির হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে শ্মশানের পোড়াকাঠ সে ঠেলে দেয় তিন মাথার উনুনে। ধোঁয়ার পাশাপাশি লকলকায় আগুন। আর সেই আগুনে নিজেকে কাঁচা মাটির দলার মতো পুড়িয়ে আরও শক্ত করে নেয় হরনাথ। প্রায়ই তার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ে। চোখ রগড়ে নিয়ে সে কেমন ঝিমানো চোখে তাকায়। শোক চাম এঁটুলির চেয়েও বেয়ারা, শরীর ছেড়ে যায় না। হরনাথের কালো মহিষ বর্ণ চেহারাটায় রুক্ষ্মতা পাথর কুঁচির মতো মিশে থাকে। কপালে তার অজস্র দাগ, ভাঁজ, কাটাকুটির খেলা। মোটা আর জোড়া ভ্রূ তাকে করে তোলে শ্মশানভূমির অসুর।

হাঁটতে হাঁটতে ভিকনাথ ঘোর সন্দেহের চোখে হরনাথের দিকে তাকাল। একটা মানুষের এত পরিবর্তন সে ভাবতে পারে না। সময় মানুষকে কত বদলে দেয়। সময় বুঝি গঙ্গার ধারার চাইতে বলবান। কোনো কোনো শোক শেকড় চারানো বনস্পতির চেয়েও ক্ষমতাবান-সহজে যাদের উপড়ে ছুঁড়ে ফেলা যায় না। তবু কিছু বলতে হয় এই ভাবনা থেকে ভিকনাথ শুধোল, হরদা, কেমুন আচো গো ইখানে?

-শ্মশানে যেমুন মানুষ থাকে তেমুন। হরনাথের কণ্ঠস্বরে আফসোসের বেহালা কঁকিয়ে উঠল।

ভিকনাথ এরপরে আর কোনো কথা বলার সাহস পেল না। দুটো অকাল মৃত্যু পুরোপুরি বদলে দিয়েছে হাসি-খুশি মানুষটাকে। মনে হয় হরনাথ বুঝি রক্তমাংসের মানুষ নয়, ইট-পাথরের মানুষ। সে কখন খায় কখন ঘুমায়–এ সব কেউ টের পায় না। তবে খুব ভোরে ওঠা তার স্বভাব। গঙ্গাস্নান না সেরে সে কোনো কাজ শুরু করে না। তার লম্বা জটাধরা চুলগুলো বটের ঝুরির মতো ঘাড়ের উপর অবহেলায় পড়ে আছে। গোলাকার মুখটার স্বাভাবিক শ্রী হারিয়ে গিয়েছে সেই চেনা মুখ থেকে। এখন হরনাথকে দেখলে ভয় এসে গোপনে ঠুকায় মনের কোমল অংশ।

হরনাথ ছাতাধরা দাঁত বের করে বলে, লুলার কপালটাও ফোপরা। ওর বউটাও অসময়ে চলে গেল! আহা, মনে কত দুঃখ পেলে তবে না মানুষে গলায় ফাঁস নেয়। ভিকনাথ স্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠতে পারল না, তার বুকের মধ্যে খচখচ করছে কাঁটা, না, মানে… বৌদির মাথার গণ্ডগোল ছিল; বুঝতেই তো পারচো!

-সে আমি জানি। গমগমিয়ে উঠল হরনাথের গলা, মাথায় গণ্ডগোল থাকলে সবাই কি গলায় ফাঁস নেয়?

ভিকনাথ অসহায় চোখে তাকাল, অত ভেতরের ব্যাপার-স্যাপার আমি কি করে জানবো বলো?

-না না, তুমার তো জানার কথাই নয়। হরনাথ রহস্যভরা কণ্ঠে বলল, তবে এট্টা কথা, বৌদি পুড়তে বেশি সময় নিল না। ভালো মানুষরা চটজলদি পুড়ে ছাই হয়ে যায়

ছিপছিপে জল দাঁড়িয়ে আছে আখ খেতের গোড়ায়। সাদা বক আর চৈতন্যবক হাজির হয়েছে মাছ খাবার জন্য। মাছ না পাক অন্তত পোকা তো পাবে এই জমাট বাঁধা আখের খেতে। দু-ধারে চাপ বেঁধে আছে আখের জমি, তার মাঝখান দিয়ে গোরুরগাড়ি যাওয়ার মতো চওড়া পথ। সেই পথে গাঙধার থেকে উঠে আসছে ঠাণ্ডা হাওয়া, শিরশিরিয়ে ওঠে শরীর, তবু ভালো লাগার হালকা ছোঁয়া ছুঁয়ে যায় মনের আগল।

মাঝে মাঝে মন খারাপ করলে হরনাথ কোম্পানীর পাকাদালান পর্যন্ত এসে আবার ফিরে যায়। কাল ঢিলিকে পোড়ানোর সময় ভারতীর কথা মনে পড়ছিল হরনাথের। সেই থেকে চিনচিনে কষ্টটা শরীর জুড়ে রয়ে গেছে। রাতভর ভারতীর মুখটা মনে করে সে কষ্ট পেয়েছে, ঘুমাতে পারেনি এক ফোঁটা। এরকম ঘুম না এলে সে সিধা চলে আসে গোরা সাধুর ডেরায়। গোরা সাধুর আরেক নাম মৌনী সাধু, আসলে সে কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলে না, এ পৃথিবীর অনেক কিছুই তার মন থেকে পিছলে যায় কচু পাতার জলের মতো। গোরা সাধু কোন প্রদেশের মানুষ, কী তার মাতৃভাষা–এ সম্বন্ধে কারোর কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই এখনও। তবে গ্রামবাসীরা বলে, গোরা সাধু বানের জলে ভেসে এসে সাহেবমাঠের অশ্বথগাছে আটকে গেছে অনন্তকাল। এই গাছের মোহ ত্যাগ করে পৃথিবীর অন্য কোনোখানে গিয়ে সে সুখ পাবে না।

গোরা সাধুর ডেরা হরনাথকে বড্ড টানে। গাঙধারে হরনাথের একমাত্র প্রতিবেশী হল এই গোরা সাধু। দশটা কথা বললে যে মানুষটা একটাও কথার জবাব দেয় না তার সঙ্গে ভাব জমানো কঠিন কাজ। প্রথম প্রথম হরনাথ বিরক্ত হত–এখন আর হয় না।

গোরা সাধুর মনটা গঙ্গামাটির চেয়েও পবিত্র। তার লম্বা শরীর, মেদহীন চেহারা, টানা চোখ, সম্ভ্রান্ত মুখশ্রী …. সেই সঙ্গে শাঁখের চেয়েও ফর্সা গায়ের রঙ এ গাঁয়ের সব মানুষের চেয়ে তাকে আলাদা মর্যাদায় ঠাঁই দিয়েছে। সব চাইতে বড়ো কথা গোরা সাধু নিজের জন্য কখনো কারোর কাছে হাত পাতে না। এত বড়ো বন্যায় সে গাছ আঁকড়ে পনের দিন পড়ে রইল টানা। কপোতাক্ষবাবু পার্টি থেকে নৌকা পাঠিয়েছিলেন তাকে উদ্ধারের জন্য। গোরাসাধু সেই নৌকো ফিরিয়ে দিল। একটা মানুষ টানা পনের দিন না খেয়ে কী ভাবে বেঁচে থাকে এই প্রশ্ন এখনও হাজার প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় গ্রামবাসীদের। তারা আশ্চর্য না হয়ে পারে না। তারা গোরাসাধুর অলৌকিক ক্ষমতার কথা স্মরণ করে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। বুড়ো-বুড়িরা ক’কদম এগিয়ে গিয়ে বলে, নদের নিমাই ফিরে এসেছে গো! আহা, বিটা ছেলের এত রূপ, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না! হরি হে মাধব…..! ভিকনাথকে পিছনে ফেলে হরনাথ গোরাসাধুর ডেরায় গিয়ে দাঁড়াল। গ্রামের মানুষরা গোরাসাধুর অশ্বত্থ গাছটাকে সিমেন্ট-ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছে যত্ন করে। এতেও সাধুবাবাজী প্রতিক্রিয়াহীন। তার আবাহনও নেই, বিসর্জনও নেই। তবু গ্রাম ভেঙে মানুষ আসে কাতারে কাতারে। কেউ আসে রোগ সারাতে, কেউ আসে টাকা বানাতে। কেউ চায় ঘর বাড়ি বিষয় সম্পত্তি।

গোরাসাধু নির্বিকার চোখে চেয়ে থাকে। ঠোঁট নড়ে না, এমন কী চোখের পলকও পড়ে না। মায়েরা তার কাছে হাতজোড় করে বলে, বাবা, আমাদের দয়া করো। ঘরে আমাদের বিপদ। এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করো।

গোরা সাধুর কাঁধ ছাপানো চুল হাওয়ায় নড়ে, গলার একমুখী রুদ্রাক্ষটা ঘামে ভিজে যায়, পাথরের মালাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে দিনের আলোয়, লম্বা হাত বাড়িয়ে সাধুবাবা প্রসাদের থালা থেকে উঠিয়ে নেয় একটা ফল। এভাবে সারাদিনে জড়ো হতে থাকে ফলের সম্ভার। এত ফল, একা মানুষ খাবে কী করে? গোরা সাধু অবশিষ্ট ফল হরনাথকে দিয়ে দেয়। হরনাথকে তার বিশেষ পছন্দ। এ গাঁয়ের অনেকেরই ধারণা হরনাথের সঙ্গে সাধুবাবার চরম একটা মিল আছে। ওরা একা থাকলে নাকি কথা বলে।

সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের ভার অন্যের।

হরনাথ গোরা সাধুর সামনে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে প্রণাম করল। গোরা সাধু পিছন দিকে দৃষ্টি ফেলে কী যেন দেখছিল, হরনাথের উপস্থিতিতে সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এক সময় কিছু বলে গোরাসাধু উঠে গেল অশ্বত্থ গাছের ডালে। হরনাথ অবাক হয়ে দেখল গাছের ডালে ভাঁজ করে রাখা আছে কম্বল, একটি ভেড়ার লোমের আসন, রক্তজবার চেয়েও কটকটে লাল বর্ণের কয়েকটি বস্ত্রখণ্ড।

গত রাতে শীতের প্রকোপ আদৌ কম ছিল না তবু শুধুমাত্র এক টুকরো লাল কাপড় গায়ে জড়িয়ে সিমেন্টের বেদীটায় শিরদাঁড়া টানটান করে বসে ছিল গোরাসাধু। তার চোখযুগল অধো নীমিলিত, অদ্ভুত এক দিব্যকান্তি প্রসন্নতা তার শরীর থেকে নির্গত হচ্ছিল যা দেখে হরনাথ মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। তার যাবতীয় দুঃখ-জ্বালা, পাথরের চেয়েও কঠিন মনোকষ্ট সব যেন গলে জলের চেয়েও তরল হয়ে যায় গোরা সাধুর দর্শনে। কী এক যাদু আবেশ হরনাথের সমগ্র শরীরে সঞ্চারিত হতে থাকে। মনে মনে সে পুলকিত হয়ে ওঠে। তখন তার হৃদয় গঙ্গাবক্ষের চেয়েও প্রসারিত হয়, মন খুশিতে কাশফুলের মতো দোলে। এই মানুষটি গঙ্গাধারে আসার পর থেকে এখানকার আবহাওয়া পরিমণ্ডল সব কিছু বদলে গিয়েছে। গ্রামের মানুষের শ্রদ্ধা এবং আবেগ এই মানুষটিকে ঘিরে হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছে। যে কেউ গঙ্গাস্নানে এলে গোরা সাধুর দর্শন না নিয়ে গ্রামে ফেরে না। সাধুসঙ্গে আপামর মানুষের হৃদয় পুলকিত হয়ে ওঠে, সংসারে শান্তি এবং স্বাচ্ছন্দ্য পরিলক্ষিত হয়। সমস্যার গ্রন্থিগুলো এক এক করে খুলে যেতে থাকে। এক আশ্চর্য দৈবশক্তি গোরা সাধুকে যেন তড়িৎ-আবেশের মতো ঘিরে আছে সব সময়।

গতকাল হরনাথ গোরাসাধুর জন্য মাটির পাত্রে মদ এনেছিল বাঁধধার থেকে। সেই মদ গোরা সাধু প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেছে। হরনাথ সময় পেলে মাঝেমধ্যে গোরা সাধুকে গাঁজার কলকে সেজে দিয়ে যায়। সে ভুল করেও সাধুবাবার কলকেতে মুখ দেয় না, সে তার নিজের কলকে ছাড়া অন্য কোনো কলকেতে গাঁজা সেবন করে তৃপ্তি পায় না। এতদিন আসা যাওয়া তবু গোরা সাধুকে হরনাথ চিনতে পারেনি একবিন্দু। তবে এটুকু সে বুঝেছে মানুষটি অসৎ বা ধান্দাবাজ নয়। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ান আর দশ পাঁচটা সাধুর মতো লোভী বা আত্মকেন্দ্রিক নয়। মনের উদারতায় এই মানুষটি আকাশের কাছাকাছি। এত ভালো মানুষ হরনাথ এই গ্রামে আর একটিও দেখেনি।

এই মানুষটিকে নীলাক্ষবাবুর সন্দেহ হয়। এর জনপ্রিয়তা তাঁকে হীনমন্যতার পুকুরে চোবায়। নিজের অন্তঃস্থলের ঈর্ষাকে চাপা দিতে না পেরে তিনি সরাসরি থানার বড়োবাবুর কাছে গিয়ে বলেছিলেন, আপনি নিশ্চয়ই গোরাসাধুর কথা শুনে থাকবেন। লোকটিকে আমার প্রথম থেকে সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে মনে হয়। তাছাড়া ওর যা চেহারা, কাঠামো, হাবভাব তা দেখে ওকে আমার পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বলে মনে হয় না। এই মানুষটি অন্য কোনো রাজ্য থেকে এখানে পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে আসার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। নাহলে পৃথিবীর এত ভালো-ভালো জায়গা ফেলে গঙ্গার ধারে আশ্রয় নেওয়া হল কেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন উদ্দেশ্য আছে। গ্রামবাসীর স্বার্থে আপনাকে সেইটা খুঁজে বার করতে হবে। বড়ো কিছু অঘটন ঘটে যাওয়ার পূর্বেই আপনাকে এখন থেকেই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

থানার বড়োবাবু নীলাক্ষবাবুর কথাগুলো মন দিয়ে শুনেছিলেন। সন্দেহ তার মনেও জমাট বেঁধে আছে। সাধারণত এই ধরনের পলাতক মানুষরা খুনী কিংবা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মঞ্চের পক্ষপাতদুষ্ট মানুষ হন। গোরা সাধু কোন দলে অবশ্যই যাচাই করা প্রয়োজন। সাদা পোষাকের একজন পুলিশ প্রায় মাস তিনেক ঘুরঘুর করেছে গোরা সাধুর ডেরার চারধারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে কোনো তথ্যই সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি যা বড়োবাবুকে সগর্বে বলতে পারে। গোরা সাধু স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও পরিচ্ছন্ন মনের। তার জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত পরিশীলিত এবং উচ্চমানের। সৌজন্যতা, শিষ্টাচার তার মজ্জাগত। এমন দেবকান্তি মানুষ কোনোদিন খুনী বা দাগী আসামী হতে পারে না।

মৌনী সাধুর গাঁজার কলকে খুব যত্ন নিয়ে সেজে দেয় হরনাথ। আচ্ছন্নতা কাটিয়ে ভরাট হেসে ওঠে সাধুবাবা। তারপর ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করে গাঁজার কলকেয় লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া উগরে ঈষৎ লাল চোখে সে হরনাথের দিকে তাকাল। তাতেই সারা শরীরে খুশির বান ডাকল হরনাথের, অদ্ভুত আনন্দধারায় প্লাবিত হল তার খরায় পোড়া মন। যেন এইমাত্র গঙ্গার শীতল জলে সে স্নান সেরে এল–এমন তৃপ্তিময় আনন্দ অনুভূতিতে তার অন্তরাত্মা পুলকিত হয়ে উঠল।

প্রকৃত মানুষের সান্নিধ্য যে কোনো মানুষের ভালো লাগে। রোদের রঙ কড়া হতেই হরনাথ ফিরে এল তার নিজের কুঁড়েঘরে। সারাদিনের অনেক কাজ পড়ে আছে। মাটির কলসীতে গঙ্গার জল ভরে রোজ চিতার বাঁধানো বেদীটা ধুয়ে দেয় হরনাথ। চিতা সাফ-সুতরো রাখলে হরনাথের মনটাও পবিত্র হয়ে ওঠে। মানুষের শেষযাত্রায় শুদ্ধতা যাতে কম না হয় সেদিকে তার খেয়াল পুরোমাত্রায়। গঙ্গা যা পারে মানুষও কি তা পারে না? হরনাথের মন বলল, পারে, অবশ্যই তা পারে.

.

২০.

মাস খানিক পরে সূর্যাক্ষ আর দ্বীপীর ফাইনাল পরীক্ষা। রাত দশটা অব্দি একসাথে পড়ছে ওরা। সূর্যাক্ষর পড়া শেষ হলে দেবোত্তর হ্যারিকেন নিয়ে এগিয়ে দেন তাকে। পথ যদিও সামান্য তবু অন্ধকার শুয়ে থাকে ধুলো পথে। চন্দ্রিকাই জোর করে বলেছেন, যাও না গো, ছেলেটাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসো।

অন্ধকারকে বিশ্বাস নেই চন্দ্রিকার। শুধু অন্ধকার নয়, কাঁচা বয়সকে বিশ্বাস করেন না তিনি। আগুন আর ঘি পাশাপাশি থাকলে যে কোনো সময় হার মানতে পারে যে কেউ। এটা কোনো দোষের নয়, এটাই ধর্ম। তবু সব জেনেও দ্বীপীকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। ছোট থেকে সূর্যাক্ষ আর দ্বীপী এক সাথে স্কুলে যায়। ওদের খেলাধুলা হাসি গল্প দৌড় ঝাঁপ সব কিছু একসাথে। তবু চন্দ্রিকার মনে সন্দেহ ঘোঁট পাকায়।

সূর্যাক্ষকে তিনি মুখের উপর নিষেধ করতে পারেন না। সূর্যাক্ষ না এলে বরং ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দেবোত্তর মহাদেব মন্দির থেকে ফিরেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন, কি গো, আজ বুঝি সূর্য আসে নি?

চন্দ্রিকা তখন সামনে এসে উত্তর দেবেন, হ্যাঁ, এসেছিল গো। কী যেন কাজ আছে ঘরে, তাই আটটার মধ্যে চলে গেল!

-দ্বীপী মন দিয়ে পড়ছে তো? তুমি ওর উপর একটু নজর রেখো।

-আমি নজর রাখব না তো কি তুমি নজর রাখবে? চন্দ্রিকা অসন্তুষ্ট হন। দেবোত্তর বলেন, অ্যাঁ, রেগো না। যা বলছি-মন দিয়ে শোন। মেয়েটা বড়ো হচ্ছে। ওর দিকে খেয়াল তোমারই রাখা উচিত। আমি আর কী করতে পারি। আমি তো সারাদিনই বাইরে বাইরে থাকি।

-বাইরে বাইরেই থাকো। এসব নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। তুমি কি তোমার নিজের মেয়েকে চেনো না? দ্বীপীর মতো মেয়ে এ গ্রামে কটা আছে? চন্দ্রিকা জোর গলায় বললেন, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। ওরা দুটিতে যমজ ভাই-বোনের মতো মেশে। ওদের জন্য তোমার চিন্তা না করলেও চলবে।

–সেই ভালো। দেবোত্তর দীর্ঘশ্বাস ভাসালেন বাতাসে, মেয়েটাকে একটা টিউশনিও দিতে পারিনি। দেব কোথা থেকে। মন্দিরে যা দক্ষিণা পাই তা তো সংসার খরচে সব শেষ হয়ে যায়। তবু ভাল–ওরা মিলেমিশে পড়ছে। আমি শুনেছি–যারা সায়েন্স পড়ে তারা মিলে-মিশে পড়লে রেজাল্ট ভালো হয়।

চন্দ্রিকা চুপ করে থাকলেন, এসব বিষয়ে তার কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। দ্বীপী পড়তে পড়তে উঠে এল হঠাৎ মা, শোন।

চন্দ্রিকা মুখ তুলে তাকালেন, বাবাকে বলো কাল কালীগঞ্জ বাজার থেকে যেন দুটো প্র্যাকটিক্যাল খাতা কিনে আনে। আর তা যদি না হয় আমাকে টাকা দিলে আমি গিয়ে কিনে আনতে পারব। মনে রেখো খাতা দুটো আমার খুব দরকার। তিন দিনের মধ্যে ইস্কুলে জমা দিতে হবে। ওতে স্পেশ্যাল মার্কস আছে।

দেবোত্তর শুকনো মুখে কথাগুলো শুনছিলেন। দ্বীপীর আব্দার সামান্য, কিন্তু এর গুরুত্ব অনেকখানি। দুটো খাতার দাম নেহাৎ কম হবে না। এমনি খাতার চাইতে প্র্যাকটিক্যাল খাতার দাম বেশি। মেয়ে সায়েন্স নিয়ে পড়ছে বলে–এটুকু জেনেছেন দেবোত্তর। কিন্তু এখন জেনেও তিনি না জানার ভান করে দাঁড়িয়ে থাকেন।

চন্দ্রিকা কী বলবেন কিছু ভেবে পান না। জিনিসপত্রের যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে সংসার চালাতে তার নাভিশ্বাস উঠছে। নাহলে চক্রবর্তী বাড়ির দুধ কোনোদিন বাইরে যায়না। পরপর দুটো গোরু দুধ দিচ্ছে। এত দুধ খাবে কে? সূর্যাক্ষকে রোজ বড়ো কাচের গ্লাসে দুধ ভরে দেন চন্দ্রিকা। গাঢ়, ফুটানো দুধ সূর্যাক্ষ খেতে ভালোবাসে। আর তাকে খাইয়ে তৃপ্তি পান চন্দ্রিকা। দ্বীপী দুধ পছন্দ করে না। লহরী পায়েস খেতে ভালোবাসে। ঊর্মি এসবের কোনটাতেই নেই। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বরাবর ও নাক সিটকায়। দুধ নষ্ট করতে ভালো লাগে না চন্দ্রিকার। ঘরের জিনিস হলেও বাজারে তার একটা মূল্য আছে। রবি গোয়ালা ঘরে এসে দুধ দুইয়ে নিয়ে যায়। মাস গেলে ও যা টাকা দেয় তা সংসারের অনেক কাজে লাগে। দেবোত্তর দুধ বিক্রির ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি করলেও এখন তিনি নীরব থাকতে পছন্দ করেন।

মহাদেব মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব সামলে তার সংসার এখন টলমল। মাথার উপর দুটো মেয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, ওদের পাত্রস্থ করা আশু-প্রয়োজন। দু-একজন যে দেখে যায়নি তা নয়। মেয়ে ওদের পছন্দ। কিন্তু দাবীর কাছে নুইয়ে গেছেন দেবোত্তর। এত টাকা গয়না আসবে কোথা থেকে? চন্দ্রিকার গায়ের সামান্য গহনাগুলো খুলে নিলেও এ সমস্যার সমাধান হবে না।

ওদের কথার মাঝখানে সূর্যাক্ষ এসে দাঁড়াল। দ্বীপীকে উদ্দেশ্য করে সে বলল, কী রে আসি বলে তুই যে কাশী চলে গেলি! চল, ফিজিক্সের অঙ্কগুলো চটপট করে ফেলি। আর দেরি করলে প্র্যাকটিস করার সময় পাব না।

-সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমার দুটো প্র্যাকটিক্যাল খাতার দরকার। দ্বীপী খুব গুরুত্ব সহকারে বলল।

সূর্যাক্ষ ওদের বোবা হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে ফেলল, তুই কাল ঠিক খাতা পেয়ে যাবি।

-তার মানে?

-মানেটা খুব সহজ। কাল আমার কালীগঞ্জে কাজ আছে। কাল তোর জন্য ওখান থেকে খাতা কিনে আনব। এবার কথাটা তোর মাথায় ঢুকল তো?

তোর কিনে দেওয়া খাতা আমি নেব কেন? দ্বীপী ঝাঁঝাল সুরে বলল, তোর বুঝি পয়সা বেশি হয়েছে? দাঁড়া, আমি তোর মজা দেখাচ্ছি।

এবার সূর্যাক্ষ আহত হয়ে চন্দ্রিকার স্মরণাপন্ন হল, কাকিমা দেখলে তো দ্বীপীর কেমন ব্যবহার! একটু সুযোগ পেলে ওর ঝগড়া করা চাই। অন্য কেউ হলে ওকে একদম পাত্তা দিত না।

-না দিত, না দিত। তাতে আমার বয়ে গেছে। আমি কারোর খাই না, পরিও না।

–খাওয়া-পরার কথা আসছে কোথা থেকে? সূর্যাক্ষর চোখ-মুখ নিস্প্রভ দেখাল। সে চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে তার সমর্থন পাবার জন্য বলল, দেখলে কাকিমা কেমন ওর ব্যবহার। যেখানে বিয়ে হবে সে ঘর একেবারে জ্বালিয়ে দেবে।

কথা শেষ হল না, সূর্যাক্ষর দিকে তেড়ে এল দ্বীপী, নিজেকে কী ভাবিস বল তো? ভাবছিস মা’র সামনে মেয়ের নিন্দে করে পার পেয়ে যাবি? মা আমাকে তোর চেয়েও ভালো চেনে বুঝলি?

এবার অসহ্যবোধ হতেই ধমকে উঠলেন চন্দ্রিকা, দ্বীপী, তুই চুপ করবি! বড় ঝগড়ুটে হয়েছিস। কার সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় জানিস না বুঝি? সূর্য তো ঠিক বলেছে। মেয়েদের বেশি তেজ ভালো নয়।

ছেলেদের সব কিছুই ভালো, তাই না মা? দ্বীপী মুখ বিকৃতি করে হাসল। সূর্যাক্ষ বলল, তুই কি শুধু তর্ক করবি, কাজের কাজ কিছু করবি না? রাত বাড়ছে, আমি কিন্তু চলে যাবো।

দেবোক্তর সূর্যাক্ষর সমর্থনে বলল, যা মা, নিজের কাজ কর। কর্মই ঈশ্বর। কর্মই ধর্ম। ধর্মের পথে থাক। দেখবি তোর অমঙ্গল হবে না।

দ্বীপী থুতনি নাচিয়ে চলে এল পাশের ঘরে। সূর্যাক্ষ তাকে অনুসরণ করল। ঘরে ঢুকে তার জন্য এমন অভ্যর্থনা লুকিয়ে ছিল তা আগাম অনুমান করতে পারে নি সূর্যাক্ষ। তাকে মাথা উঁচু করে ঘরে ঢুকতে দেখে দ্বীপী গম্ভীর গলায় বলল, দাঁড়া। তখন কি যেন বলছিলিস? ওঃ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমার যেখানে বিয়ে হবে সেই ঘর আমি জ্বালিয়ে দেব তাই না?

দ্বীপীর ক্রুদ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে সূর্যাক্ষ ঢোক গিলে কিছু বলতে গেলেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দ্বীপী। চকিতে হাত বাড়িয়ে সে সজোরে চিমটি কাটল সূর্যাক্ষর পেটে। সামান্য চর্বি মুচড়ে যেতেই সূর্যাক্ষর গলা থেকে নিমেষে বেরিয়ে এল ওঃ আর্তনাদ।

দ্বীপী শরীর দুলিয়ে খিলখিল করে হাসল। হাসতে হাসতে সে বলল, তোর সব বাহাদুরী আমার জানা আছে। একটা রামচিমটিতেই তোর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। যদি আমড়াচিমটি কাটি তাহলে কি হবে তোর?

-মানে? হকচকিয়ে শুধাল সূর্যাক্ষ।

দ্বীপী একটুও দ্বিধা না করে বলল, আমার বিয়ে হয়ে গেলে তুই খুব সুখে থাকবি তাই না? কী নিষ্ঠুর রে তুই? অমন কথা বলতে তোর মুখে বাঁধল না?

-আমি তো ঠিকই বলেছি। একদিন না একদিন তোর তো বিয়ে হবেই।

দ্বীপীর ব্যথিত চোখে চিকচিকিয়ে উঠল জল, এতদিন ধরে তোর সাথে মিশছি, তোকে আমি আজও চিনে উঠতে পারলাম না। সত্যি বলতে আমাকে তুই কী ভাবিস?

-কেন বলবো? সূর্যাক্ষ জেদ ধরল।

–না, তোকে আজ বলতে হবে। যদি না বলিস তাহলে আমি তোর ফিজিক্স বই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেব।

-তাহলে তো বেশ ভালোই হবে, আর কষ্ট করে পড়তে হবে না। সূর্যাক্ষ দাঁত টিপে টিপে হেসে উঠল।

দ্বীপী রাগে কাঁপছে, লাল হয়ে গিয়েছে ওর সুন্দর মুখটা। কিছু বলতে গিয়ে জড়িয়ে গেল ওর কথা। মাথায় হাত দিতেই কাটা দাগটার কাছে আটকে গেল হাত। তখন কোন ক্লাস? সম্ভবত থ্রি। দ্বীপী আব্দার করেছে পাকা কুল পেড়ে দেবার জন্য। ইটের টুকরো সূর্যাক্ষ ছুঁড়ে মারছে গাছে। কুলগাছের নীচে শ্লেট-বই হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অবুঝ দ্বীপী। হঠাৎ একটা ইটের আঘাতে ফেটে গেল দ্বীপীর মাথা ব্যথায় শুকিয়ে গেল কচি মুখ। চুলের গোড়া ভিজিয়ে গরম রক্ত কানের পাশ দিয়ে চুঁইয়ে নামল। রক্ত দেখে দারুণ ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছে সূর্য। কী করবে, কী করা উচিত–তা তার ছোট্ট বুদ্ধিতে কুলাচ্ছে না। দ্বীপীই হাতের চেটোতে রক্ত মুছে এগিয়ে এল সামনে, তোর কোনো দোষ নেই। আমার নিজের দোষেই মাথা ফেটেছে। কুল খাওয়ার সখ হয়েছিল। সে সখ আমার মিটে গিয়েছে।

দ্বীপী সেদিন এক ফোঁটা কাঁদল না। বরং সাহস দিয়ে বলল, যা, হাড়মটমটির ঝোপ থেকে পাতা ছিঁড়ে আন। রস বের করে আমার ফাটা কপালে লাগিয়ে দে। জানিস তো সূর্য, আমার বাবা বলে–হাড়মটমটির রসে ফাটা কপাল জুড়ে যায়।

সেই দ্বীপী এখন রাগে কাঁপছে থরথরিয়ে, তাকে সামলানো দায়। সূর্যাক্ষ শান্ত হয়ে বলল, দ্বীপী, তোকে একটা কথা শুধাই, জবাব দিবি তো?

দ্বীপী ফাটা দাগ থেকে হাত সরিয়ে গুম হয়ে দাঁড়াল, তোর সাথে আমার কথা বলতেই ইচ্ছে করে না। তুই তো পাথর। পাথরের সাথে কি কথা বলা যায়?

সূর্যাক্ষ হাসল, আমি পাথর হলে তুই পাহাড়। বুঝলি? এই পাথরই একদিন পাহাড়কে বাঁচিয়ে দিল, তোর নিশ্চয়ই মনে আছে কথাটা। যদি মনে না থাকে তো বল–আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি।

দ্বীপী ঠোঁট শক্ত করে ভেংচে উঠল, মনে রাখতে আমার বয়ে গেছে। ওসব ছোট ছোট কথা যত মুছে যায় তত ভালো।

গঙ্গা স্নান করতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিলিস মনে নেই? কে বাঁচিয়েছিল তখন?

–তুই যা ভীতু, তুই কি আমাকে বাঁচিয়েছিলিস? দ্বীপীর গলায় ফুটে উঠল অবজ্ঞা।

সূর্যাক্ষ হার মানল না, আমি না থাকলে সেদিন তুই ঠিক পটল তুলতিস।

কী করে? দ্বীপী বিমূঢ়ভাবে তাকাল।

–কে চিৎকার করে ঘাটের মাঝিদের ডেকেছিল বল? মাঝিরা যদি না আসত সেদিন তো তোর মকরস্নান চিরদিনের মতো হয়ে যেত।

-হয়ে যেত তো হয়ে যেত–তাতে তোর কি? দ্বীপী ঝগড়ুটে বেড়ালের দৃষ্টি মেলে তাকাল, আমি বেঁচেছি আমার আয়ুর জোরে। তোর চেঁচানোর জোরে বাঁচিনি বুঝলি?

দ্বীপী লাল টুকটুকে জিভ বের করে ভেংচি কাটল। এবার সূর্যাক্ষ তেড়ে গেল তার দিকে। দ্বীপীকে ঠেলা মারতে মারতে নিয়ে এল বিছানায়। হুমড়ে ফেলে দিয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, এবার যদি তোকে আমি কামড়ে দিই কে তোকে বাঁচাবে?

ভয়ে চোখ বন্ধ করে দ্বীপী বলল, আমার ভগবান আছে, সে আমাকে বাঁচাবে।

-তাহলে তোর ভগবানকে ডাক। সূর্যাক্ষ দ্বীপীর গোলাপী গালে গাল রেখে শুষে নিতে চাইল উত্তাপ। এক সময় পাকানো দড়ির মতো মোচড় মেরে উঠল তার দেহ। সূর্যাক্ষকে দু-হাতে ঠেলে দিয়ে সে বলল, তুই একটা অসভ্য, তুই একটা

-বল, গ্যাপ রাখলি কেন বল। ফিল আপ দ্যা ব্ল্যাঙ্ক।

 দ্বীপী চোখ বন্ধ করে বলল, মনে রাখিস আমি এখন বড়ো হয়েছি। আগের মতো যখন তখন আমাকে তুই ছুঁবি না। কেউ দেখে ফেললে আমি লজ্জায় পড়ে যাবো। তাছাড়া লোকে আমাকে ভুল বুঝতে পারে।

সেই কথাটা তো আমিও তোকে বলতে চাই। আগে তো নিজের ফ্রকের হুক নিজে লাগাতে পারতিস না। আমাকে কেন বলতিস, সূর্য, হুকটা লাগিয়ে দে তো।

–তখন আমি ছোট ছিলাম।

–এখন আমি যদি তোর হুক লাগিয়ে দিই?

-সূর্য, মার খাবি কিন্তু। বড় ফাজিল হয়ে গিয়েছিস তুই। দাঁড়া আমি মাকে সব বলে দেব। সূর্যকে ঠেলে দিয়ে বিছানায় উঠে বসে দ্বীপী। সে ঘেমে গিয়েছে। ওর ঘামের প্রতিটি বিন্দুতে লেখা আছে ভালোবাসার কথা। এই ভালোবাসা ভুলে থাকা বড়ো কঠিন।

দ্বীপীকে একবেলা দেখতে না পেলে হাঁপিয়ে ওঠে সূর্যাক্ষ। একটা নেশার মতো কে যেন তাকে টেনে আনে দ্বীপীদের বাড়িতে। দ্বীপীর হাসি মুখটা দেখলেই তার শরীরের সমস্ত ক্লান্তি-অবসাদ দূর হয়ে যায়।

দেবোত্তর ওদের মেলামেশাটাকে মেনে না নিয়ে পারেন নি। ছোট থেকে একসঙ্গে এরা বড়ো হচ্ছে। পিঠাপিঠি ভাই-বোনের মতো ওদের সম্পর্ক। শুধু সম্পর্ক নয় ওদের ইস্কুল, ক্লাস সব এক।

তবু মাঝে মাঝে রাশ টেনে ধরেন চন্দ্রিকা। বেথুয়াডহরীতে দ্বীপীর সিনেমা দেখতে যাওয়ার আব্দার তিনি মেনে নিতে পারেন না।

-ওঃ মা, কেন যেতে দিচ্ছো না আমাকে? আমি কি একা যাচ্ছি নাকি? আমার সঙ্গে তো সূর্য যাচ্ছে। দ্বীপীর ছেলেমানুষী আব্দার চন্দ্রিকার মাথা গরম করে দেয়। ধমক দিয়ে তিনি বলেন, মনে রাখিস এখন তুই আর ছোট নোস। গ্রামের দিকে তোর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়ে ঘর-সংসার হয়ে যায়। লেখাপড়া শিখছিস, এই বয়সে এতো অবুঝ হওয়া তোর সাজে না।

-আমি কী করছি মা যার জন্য তুমি আমাকে এত কথা শোনাচ্ছো? দ্বীপী আর বিরক্তি চেপে রাখতে পারল না।

মেয়ের কাছ থেকে সামান্য ধাক্কা আসতেই চন্দ্রিকা নিজেকে কিছুটা সামলে নিল, কিছু করা না করা বড়ো প্রশ্ন নয়। তোর এখন থেকে মনে রাখা উচিত কার সঙ্গে কী ভাবে কতটা মিশবি।

-তুমি কি সূর্যকে নিয়ে কিছু বলতে চাইছে? দ্বীপী সরাসরি প্রশ্ন করল, আমার সঙ্গে সূর্যর রিলেশনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। এটা যে ঠিক কী ধরনের রিলেশন তা আমি তোমাকে ঠিক বোঝতে পারব না।

চন্দ্রিকা সামান্য সাহসী হলেন, আমরাও ঠিক বুঝতে পারি না। তাছাড়া সূর্যকে আমি ঘরের ছেলের মতো দেখি।

দ্বীপী গম্ভীর মুখে কপালে ভাঁজ ফেলে নীরব থাকল।

চন্দ্রিকা সামান্য হালকা গলায় বললেন, আমি বললাম বলে তুই কিছু মনে করিস না। আমি মা। আমাকে দশ দিক নজর রাখতে হয়।

এবার ফুঁসে উঠল দ্বীপী, তা বলে নিজের মেয়েকে তুমি ভুল বুঝবে? কালীপুজোর মেলায় পাঁপড় ভাজা কিনতে গিয়ে আমি হারিয়ে গেলাম। সেবার তো তুমি দেখেছ সূর্য আমাকে খুঁজে পেয়ে কেমন পাগলের মতো করছিল। ওর মতো ছটফটানী, উদ্বেগ আমি বাবার মধ্যেও দেখিনি।

-মনে রাখিস, ওরা বড়োলোক। ওর জ্যাঠা মানুষ হিসাবে ভালো নয়।

-কে কী রকম মানুষ, আমি সেই বিচারে যাব না। আমি শুধু সূর্যকে জানি। ও আমার ভীষণ ভালো বন্ধু। দ্বীপী জোর গলায় কথাগুলো বলে মায়ের মুখের দিকে তাকাল।

চন্দ্রিকা যে অনেকটাই কোণঠাসা তা তিনি হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলেন। আজকালকার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তর্কে পেরে ওঠা ভীষণ কঠিন। এ ব্যাপারে গ্রাম-শহর সমানভাবে এগিয়ে। কাজের অজুহাতে তিনি রান্নাঘরে চলে গেলে দ্বীপী তখনও স্বাভাবিক হতে পারে না। হাজার কথার মধ্যে দ্বীপীর একটা কথাই মনে পড়ে। সাহেব মাঠের ভোজপুরী দারোয়ান কিষাণজীর কাছ থেকে বাদশাহী গুড়াখু চেয়ে এনেছিল সূর্য। তার অর্ধেকটা দ্বীপীকে দিয়ে বলেছিল, এই গুড়া দিয়ে দাঁত মাজলে তোর দাঁতের ব্যথা সব সেরে যাবে, তোর দাঁত সাদা মুলোর চেয়েও আরও সাদা হয়ে যাবে।

-সত্যি? দ্বীপীর আকাশছোঁয়া আগ্রহ দেখে সূর্য বলল, গুড়াখু দিয়ে দাঁত মাজলে নেশা হয়। মাথা ঝিমঝিম করে। গা পাক দেয়। কারোর আবার বমি হয়। দ্বীপী গুড়াখু মুখে ঢুকিয়ে তর্জনী দিয়ে মাজতে মাজতে বলেছিল, আমার কি হবে না। সিগারেট খেয়ে আমার মাথা ঘোরা তো দূরে থাক-একটু পা-ও টলেনি।

-এত সাহস ভালো নয়। দ্বীপীকে সতর্ক করেছিল সূর্য, ফেলে দে, ফেলে দে বলছি। মাথা ঘুরে গেলে কে তোকে সামলাবে শুনি।

-কেন, তুই তো আছিস, তুই আমাকে দেখবি না?

সূর্যাক্ষ কোনো কিছু বলার আগে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল দ্বীপী, এক সময় বসে থাকার ক্ষমতাও তার নিঃশেষ হল, সাটপাট হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিল সে। সূর্যাক্ষ দেখল দ্বীপীর চোখের কোণে থেঁতো হয়ে যাচ্ছে জলকণা, বড়ো অসহায় দেখাচ্ছে তার সুন্দর মুখখানা।

প্রায় আধ ঘণ্টা এভাবেই কেটে যায়, দ্বীগী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আবার উঠে বসলে সূর্যাক্ষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দ্বীপী তার বদলে যাওয়া মুখের আদল দেখে বলল, বড্ড ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম তাই না? তবে আমি জানতাম আমার কিছু হবে না। কেন জানিস?

-না। সূর্যাক্ষ ঘাড় নাড়ল।

 দ্বীপী সতোর সঙ্গে বলল, তুই আমার সঙ্গে থাকলে যমরাজও আমার কিছু করতে পারবে না। তুই আমার শক্তি, তুই আমার আলো। কথা হারিয়ে দ্বীপী তার নীচের ঠোঁটটায় দাঁত বসিয়ে দিল আনমনে।

সম্পর্কের কদমগাছে কবে যে ফুল ধরেছে একথা কেউ জানত না। জীবনের কোনো এক বর্ষায় ওরা দেখল আষাঢ়ের জলবাহী মেঘ আগামী দিনের স্বপ্ন হয়ে ঝুলে আছে মাথার উপর। জলীয় আবহাওয়ায় এখন কদমগাছের ভরা সংসার। গাঢ় সবুজ রঙের চওড়া পাতাগুলো যেন কোনো এক অদেখা রাজকুমারীর মুখ। ফুলগুলো সব সুখের চিহ্ন হয়ে ঝুলছে। কোনো কোনো ফুলের আয়ু দীর্ঘস্থায়ী হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *