০৪. ছয়-সাত বৎসর পূর্বে বিনয়কৃষ্ণবাবু

ছয়-সাত বৎসর পূর্বে বিনয়কৃষ্ণবাবু বেহার অঞ্চলের কোন বড় শহরের এক প্রসিদ্ধ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। সেই সময়ে বাঙ্গালী-বেহারীর মধ্যে অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা কিছু তীক্ষ হইয়া উঠিতেছিল। বেহার যে বেহারীদের জন্যই, আর কাহারও জন্য নহে, এই সনাতন সত্য নুতন করিয়া আবিষ্কৃত হইবার পর বেহারের আদিম এবং ন্যায্য অধিবাসিগণ বাঙ্গালীদের আড়ালে বাঙ্গালিয়া উপাধিতে সমোধিত করিয়া অবজ্ঞা ও নিজেদের আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞাপন করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বিনয়কৃষ্ণবাবুর বেহারী সহকর্মীরা—যাঁহারা এতদিন তাঁহাকে দেবতার মত ভক্তি করিতেন, তাঁহারা ভিতরে ভিতরে বিনয়বাবুর নানা দোষ-ত্রুটি ধরিয়া উপরওয়ালার কাছে পাঠাইতে লাগিলেন। নিজেদের মধ্যেও তাঁহার অযোগ্যতা সম্বন্ধে বিবিধ আলোচনা চলিতে লাগিল; এবং একজন বাঙ্গালী যে হাজার বারোশ টাকা মাহিনার একটা উচ্চ-পদ অধিকার করিয়া উহা হইতে আদিম অধিবাসীদিগকে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে, এ মনস্তাপের উষ্ম দুই-একখানা প্রাদেশিক সংবাদপত্রেও বাহির হইয়া পড়িল।

তাঁহার সম্বন্ধে এই সমস্ত গোপন ও প্রকাশ্য রুিদ্ধতার খবর পাইবামাত্র বিনয়কৃষ্ণবাবু কাজে ইস্তফা দিলেন। কলেজটি গভর্নমেন্টের প্রসাদলি,—তাই তাহার শাসক-সমিতি উপরের কোন উপদেবতার কটাক্ষ ইঙ্গিত অনুসরণ করিয়া একজন ইংরাজকে বিনয়বাবুর শূন্যপদে বহাল করিলেন। ইহাতে আদিম অধিবাসিগণ কোন প্রকার আপত্তি করিলেন কি না, তাহা বাহিরের কেহ জানিতে পারিল না।

কর্মত্যাগ করিয়া বিনয়কৃষ্ণবাবু কলিকাতায় চলিয়া আসিলেন। তাঁহার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি পূর্বেই কলিকাতা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। দুই-তিনটা কলেজ হইতে অধ্যাপনা করিবার জন্য তাঁহার নিমন্ত্রণ আসিল; কিন্তু তিনি গ্রহণ করিলেন না। অর্থোপার্জনের কোন প্রয়োজন ছিল না, সারা জীবনে তিনি অনেক অর্থ উপার্জন করিয়াছিলেন এবং তাঁহার স্ত্রী তাহার অধিকাংশ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। তাই তিনি অতঃপর নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রামে বিদ্যাচচা করিয়া বাকী জীবনটা কাটাইয়া দিতে মনস্থ করিলেন।

তারপর হঠাৎ একদিন তাঁহার স্ত্রী মারা গেলেন। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় তাঁহার নিশ্চিন্ত প্রশান্ত জীবনযাত্রা যেন ছন্নছাড়া হইয়া গেল। মনের অবস্থা এমনই হইল যে এক বাড়িতে দীর্ঘকাল থাকিতে মন টিকিত না, কলিকাতার মধ্যেই এবাড়ি ওবাড়ি করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন। কয়েকদিন পূর্বে শ্যামবাজারের বাড়িখানা অসহ্য মনে হওয়ায় আমহার্স্ট স্ট্রীটে কিশোরের পাশের বাড়িতে আসিয়া উঠিয়াছিলেন।

সে রাত্রির ঘটনার পরদিন প্রভাতে বিনয়কৃষ্ণবাবু দুই পাশের বাড়িতে সতর্কভাবে খোঁজ-খবর লইলেন, কিন্তু কেহই কিছু বলিতে পারিল না। গলির অপর পাশের বাড়িতে অবশ্য তিনি খোঁজ করেন নাই, সুতরাং গতরাত্রির লোকটার উপরে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হইল। সন্ধ্যার পর অনুপম আসিয়া সমস্ত শুনিয়া বলিল, দেখলেন তো, আগাগোড়া ধাপ্পাবাজি। আপনি তখন একেবারে করুণায় গলে গেলেন। আমি একনজর দেখেই বুঝেছিলুম, একেবারে পাকা বদমায়েস। ভুরু দেখে লোক চিনে নিতে পারি, সে ক্ষমতা আছে। বলিয়া ক্ষুদ্র নয়ন-যুগলে আত্ম-প্রীতি ভরিয়া সুহাসিনীর দিকে চাহিল।

সুহাসিনী মুখ নীচু করিল। সকলে প্রথম হইতেই যাহাকে বদলোক বলিয়া চিনিতে পারিয়াছে, দারুণ অনভিজ্ঞতার দোষে কেবল সে-ই যে তাহাকে ভদ্রলোক বলিয়া সন্দেহ করিয়াছিল, মানুষ চিনিবার এই অক্ষমতায় সে মনে মনে ভারি লজ্জা পাইল। গতরাত্রির আগন্তুকের স্বাভাবিক মন্দচরিত্র। ও উপস্থিত দুরভিসন্ধিতে কাহারও সংশয় রহিল না। বিনয়বাবু এ বাড়ি ছাড়িয়া অন্য কোথাও উঠিয়া যাইবেন কি না, উদ্বিগ্নভাবে তাহাই আলোচনা করিতে লাগিলেন। কিন্তু অনুপম তাঁহাকে ভরসা দিয়া গেল যে, ভয়ের কোন কারণ নাই; পুলিসের ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত লোক এখানে যাতায়াত করে জানিবার পর সে লোকটা খুব সম্ভব এদিকে আর ঘেঁষিবে না।

কিন্তু এত কাছাকাছি থাকিয়া দেখাশুনা না হওয়া অসম্ভব। দিন দুই পরে একদিন সন্ধ্যার সময় বিনয়কৃষ্ণবাবু বাড়ি হইতে বাহির হইয়া দারোয়ানকে ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিবার হুকুম দিয়া পদব্রজে হ্যারিসন রোডের চৌমাথার দিকে কিছুদুর অগ্রসর হইয়াছেন, এমন সময় সম্মুখ হইতে একজন লোক হাত তুলিয়া তাঁহাকে নমস্কার করিল। প্রথমটা ঠাহর করিতে পারেন নাই, কিন্তু চিনিতে পারিয়াই বিনয়বাবু একেবারে কাঠ হইয়া গেলেন। এ আর কেহ নহে—সেই গুণ্ডা।

কিশোর কাছে আসিয়া বলিল, সেরাত্রে আপনাদের ওপর বড় উৎপাত করেছিলুম। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের জুলুম আপনারা নিতান্ত ভদ্রলোক বলেই সহ্য করেছিলেন, আর কেউ হলে করত না।

জল হইতে সদ্য ডাঙ্গায় তোলা কাতলা মাছের মত বিনয়বাবু তিনবার খাবি খাইলেন, কিন্তু কোন প্রকার বাঙ্‌নিষ্পত্তি করিতে পারিলেন না।

কিশোর বলিল, সেদিন বড় উপকার করেছিলেন। একদিন গিয়ে আপনাদের সঙ্গে ভাল করে আলাপ করব ইচ্ছে ছিল কিন্তু নানা কারণে হয়ে ওঠেনি।

বিনয়বাবু খলিতকণ্ঠে বলিলেন, অ্যাঁ—তা—আপনাকে আমি কখনো কি বলে—আপনার সঙ্গে–

ওঃ, চিনতে পারেননি বুঝি? কিশোর হাসিয়া উঠিল, তা না পিরবারই কথা। গত শুক্রবার রাত্রিতে আপনাদের গান বাজনার মজলিসে গিয়ে যজ্ঞ-বিঘ্ন করেছিলুম। —তা চলুন না, আপনার যদি বিশেষ কাজ না থাকে তো আমার বাড়াতে গিয়েই একটু বসবেন। আপনি যখন প্রতিবেশী হলেন, তখন আলাপ-পরিচয় হওয়া চাই তো।

আবার আলাপ-পরিচয়। কম্পিত-কলেবরে বিনয়বাবু একবার পুলিস বলিয়া চেঁচাইবার চেষ্টা করিয়া, যে পথে আসিয়াছিলেন, সেই পথে উঠি কি পড়ি করিয়া ফিরিয়া চলিলেন।

কিশোর অবাক হইয়া কিছুক্ষণ তাকাইয়া রহিল, বৃদ্ধের এরূপ অদ্ভুত আচরণের কোনই কারণ খুঁজিয়া পাইল না। তারপর জোরে পা চালাইয়া সে তাঁহার পশ্চাদ্বর্তী হইল। তাহার ধারণা হইল, পথের মধ্যে বৃদ্ধ নিশ্চয় সহসা গুরুতর রকম অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন।

বিনয়বাবু নিজের গৃহসম্মুখে পৌঁছিয়া রুদ্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চেঁচাইতে ছিলেন, দারোয়ান, বরি, কে আছিস, শিগগির দরজা খোল।

এমন সময় কিশোর আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে বলুন তো। শরীর খারাপ মনে হচ্ছে কি?

বিনয়বাবু ঘাড় বাঁকাইয়া দেখিলেন, ডাকাতটা একেবারে তাঁহার পিঠের কাছে দাঁড়াইয়া আছে। তিনি নিশ্চয় একটা সাংঘাতিক কিছু করিয়া ফেলিতেন, কিন্তু ঠিক সেই সময় নিতান্ত পরিচিত কণ্ঠে কে একজন বলিল, কে ও, কিশোর না? তাই তো হে, বিনয়বাবুর সঙ্গে কবে আলাপ হল?

রাস্তায় তখন গ্যাস জ্বলিয়া উঠিতেছিল, কিশোর ফিরিয়া দেখিল, তাহার কলেজের সিনিয়র প্রফেসর এবং তাহার ভূতপুর্ব শিক্ষক দীনবন্ধুবাবু মোটা লাঠিটা হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন।

বিনয়বাবু এই জনাকীর্ণ শহরের মধ্যে এই প্রথম যেন একটিমাত্র মানুষ দেখিতে পাইলেন, সাগ্রহে টিয়া গিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন, এই যে দীনবন্ধু এসেছ—এসো এসো এসো! তোমাকে দেখে যে কত খুশি হলুম—

দীনবন্ধুবাবু তাঁহার ভাব দেখিয়া সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, কী ব্যাপার, বলুন তো? আপনাকে বড় বিচলিত দেখছি।–কিশোর, তুমি কিছু জান?

কিশোর বলিল, আজ্ঞে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। বোধ হয় ওঁর শরীরটা খারাপ হয়েছে।

দীনবন্ধু বলিলেন, তাই না কি? কিন্তু তাহলে এরকমভাবে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবার প্রয়োজন কী, তা তো বুঝতে পারছি না। বাড়ির ভেতর গেলে ক্ষতি কি?

বিনয়বাবু একবার ইহার মুখ, একবার উহার মুখ দেখিয়া শেষে বলিলেন, দীনবন্ধু, তুমি এই–এঁকে চেন না কি?

দীনবন্ধু বলিলেন, বিলক্ষণ, কিশোরকে চিনি না। ও হল গিয়ে আমার ছাত্র—অর্থাৎ এককালে ছাত্র ছিল, এখন কলীগ। ওর কথাই তো সেদিন আপনাকে বলছিলুম যে, আপনার নতুন পাড়াতে আমার একটি ছাত্র থাকে। ভেবেছিলুম, আমিই আজ আলাপ করিয়ে দেব, তা আলাপ তো হয়ে গেছে দেখছি।

বিনয়বাবু হতবুদ্ধি হইয়া বলিলেন, আলাপ! তা—হ্যাঁ কিন্তু অনুপম যে বললে

ইতিপূর্বে বাড়ির দরজা খোলা হইয়াছিল এবং সুহাসিনী পিতার হাঁক-ডাকে সন্ত্রস্ত হইয়া নীচে নামিয়া আসিয়াছিল, এতক্ষণ অর্ধমুক্ত দ্বার-মুখে দাঁড়াইয়া ইহাদের কথাবার্তা শুনিতেছিল।

দীনবন্ধু তাহাকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন, এই যে সুহাস-মায়ী, তোমার বাবার কী হল বল দেখি? রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন করছেন কেন?

প্রত্যুত্তরে সুহাসিনী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, তারপর মুখে আঁচল খুঁজিয়া হাসি চাপিতে চাপিতে বলিল, আপনারা ভেতরে আসুন; ফুটপাথে দাঁড়িয়ে অমন করলে রাস্তার লোকে পাগল মনে করবে যে।

আমিও তো সেই কথাই বলছি-দীনবন্ধুবাবু অগ্রে অগ্রে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। বিনয়বাবু তাঁহার পশ্চাতে অসংলগ্নভাবে বলিতে বলিতে চলিলেন, সবাই মিলে আমাকে বুঝিয়ে দিলে,–অনুপমটা একটা আস্ত ইয়ে,–আমি গোড়া থেকেই—ইত্যাদি।

কিশোরও একবার একটু ইতস্তত করিয়া ভিতরে অনুসরণ করিল। এই মেয়েটিকে সেদিনও সে দেখিয়াছিল বটে, কিন্তু ভাল করিয়া লক্ষ্য করে নাই। আজ তাহার ভিতরে আসিবার আহ্বানের মধ্যে সে-ও অন্তর্ভুক্ত কি না, তাহা ঠিক বুঝিতে না পারিলেও বিনয়বাবুর অদ্ভুত ব্যবহারের আড়ালে যে একটা মজার রহস্য লুকাইয়া আছে এবং সে নিজেও যে এই রহস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, তাহা এই মেয়েটির উচ্ছ্বসিত দমকা হাসি শুনিয়া টের পাইয়াছিল। তা ছাড়া এই সহসা উদ্বেলিত হাসির মধ্যে এমন একটি আশ্চর্য মাদকতা ছিল যে, ক্ষণকালের জন্য তাহাকে আবিষ্ট করিয়া ফেলিয়াছিল। তাই, একরকম যন্ত্রচালিতের মতই সে সকলের পিছু পিছু বারান্দা পার হইয়া ড্রয়িংরুমে গিয়া উপস্থিত। হইল।

সকলে উপবিষ্ট হইলে দীনবন্ধু বলিলেন, একটা কিছু হয়েছে, আমি ধরতে পারছি না। সুহাস-মায়ী, তুমিই বল তো ব্যাপারখানা কী?

সুহাস মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, বাবাকে জিজ্ঞাসা করুন না।

বিনয়বাবু অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়া আমতা-আমতা করিয়া বলিলেন, আমরা ভারি ভুল করে ফেলেছি, দীনবন্ধু। সেদিন রাত্রিতে উনি হঠাৎ,–কিশোরবাবু, আমাদের অপরাধ আপনাকে মাপ করতে হবে, ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। আমারই বোকামি—বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু সবাই মিলে, বিশেষ অনুপম—এমন করতে লাগল যে, আমারও সন্দেহ হল, হয়তো— বলিতে বলিতে লজ্জায় থামিয়া গেলেন।

দীনবন্ধু বলিলেন, নাঃ, এরা খোলসা করে কিছু বলবে না দেখছি। কিশোর, তুমিই বলো হে, শুনি।

কিশোর কহিল, আমি তো কিছুই জানি না।

সুহাসিনী আবার উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল; কিশোরের দিকে একটা পরিহাস-তরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, উনি কোত্থেকে জানবেন? আমি বলছি, শুনুন। বলিয়া সকৌতুকে ব্যাপারটা আগাগোড়া বিবৃত করিল।

গল্প শুনিয়া দীনবন্ধুবাবু হো হো করিয়া খুব হাসিতে লাগিলেন; কিশোরও সে হাসিতে যোগ দিল।

দীনবন্ধুবাবু কিশোরের উপর একবার চোখ বুলাইয়া বলিলেন, তা গুণ্ডার মত চেহারাখানা বটে, রাত-বিরেতে হঠাৎ দেখলে ডরিয়ে ওঠা বিচিত্র নয়। আরে, আমি যে সেদিন সায়েটিকার জন্যে

আসতেই পারলুম না, নইলে এ সব কোন ফ্যাসাদই হত না।

কিশোর সুহাসিনীর দিকে তাকাইয়া বলিল, আচ্ছা, সত্যি আপনারা সবাই আমাকে গুণ্ডা ভেবেছিলেন?

সুহাসিনী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ।

করুণভাবে কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, আপনিও?

সহাস্যে সুহাসিনীও বলিল, হ্যাঁ—আমিও।

মস্ত একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কিশোর বলিল, আমার কপালই খারাপ দেখছি। অপরিচিত লোকে আমাকে দেখবামাত্র যদি গুণ্ডা মনে করেন, তাহলে আমার চেহারায় নিশ্চয় মারাত্মক কোন দোষ আছে। বলিয়া দুঃখিতভাবে নিজের হস্ত-পদাদির দিকে দৃষ্টিপাত করিল।

সকলে হাসিয়া উঠিলেন।

দীনবন্ধু বলিলেন, কিশোর, দেখছ তো, বলবান হবারও অসুবিধা আছে। এ কথা আগে জানলে বোধ হয় ফুটবল হকি খেলে, জিমন্যাস্টিক করে সময়ের অপব্যয় করতে না।

কিশোর মাথা নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে না, কখনই করতুম না। কিন্তু এখন তো আর শোধরাবারও উপায় নেই, চিরজীবন এই ভয়াবহ শরীরটাকে বহন করে বেড়াতে হবে।

এই সব হাসি-তামাশার মধ্যে বিনয়বাবু আবার বেশ সুস্থ বোধ করিতেছিলেন। তিনি বলিলেন, কেন, কিশোরবাবুর তো বেশ ভাল চেহারা, পুরুষোচিত চেহারা! বাঙালীর ছেলের ঐ রকম শরীরই তো হওয়া চাই। কাঠির মত লিলিকে চেহারা আমি ভালবাসি না। যারা জীবন-যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে, যুদ্ধের উপযোগী স্বাস্থ্য না হলে তাদের চলবে কেন? যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া—যাকে বলে ব্যুঢ়োরস্কো বৃষস্কন্ধঃ শালপ্রাংশুমহাভুজঃ। সেই রকম হওয়া চাই।

দীনবন্ধু বলিলেন, সে তো ঠিক কথা। কিন্তু আমাদের দেশের বাপ-মায়েদের ছেলেকে বিদ্বান করে তোলবার আগ্রহ এত বেশী যে, তার স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া আর ঘটে ওঠে না।

এটি বিনয়বাবুর প্রিয় প্রসঙ্গ, তিনি উদ্দীপ্ত হইয়া বলিলেন, তুমি যথার্থ বলেছ, দীনবন্ধু! অথচ জা এই যে, শরীর ভাল রকম পুষ্ট না হলে মস্তিষ্ক কিছুতেই পুষ্টিলাভ করতে পারে না। শরীর থেকেই তো মস্তিষ্ক তার সারবস্তু আহরণ করবে। সেই শরীরই যদি পঙ্গু হয়ে রইল, তাহলে মস্তিষ্ক সর পাবে কোত্থেকে? এই কথাটা আমি বরাবর প্রচার করে এসেছি যখন কাজে ছিলুম, তখন সর্বদাই করতুম—যে, শরীর এবং বুদ্ধি দুইয়েরই সমান পুষ্টি হওয়া চাই, নইলে পরিপূর্ণ আস্ত মানুষটি তৈরি হয় না, একটিমাত্র পাল্লা-বিশিষ্ট তরাজুর মত অকর্মণ্যভাবে কেবল একদিকেই ঝুঁকে থাকে।

দীনবন্ধুবাবু কিশোরের পৃষ্ঠে হাত রাখিয়া বলিলেন, আপনি যে সত্য কথা প্রচার করেছেন, তার উদাহরণ আপনার সামনেই হাজির রয়েছে। এই ছেলেটির বাহিরটা যেমন নিরেট এবং প্রচুর পরিমাণে দৃষ্টিগোচর, ভিতরটিও তেমনি সবল ও সুগঠিত। ক্রমশ পরিচয় পাবেন।

উপর্যুপরি প্রশংসায় কিশোর লজ্জিত হইয়া পড়িতেছিল, তাই তাড়াতাড়ি বলিল, যে পরিচয় ওঁরা গোড়াতেই পেয়েছেন, তার বেশী পরিচয়ের বাসনা বোধ হয় নেই।

বিনয়বাবু বলিলেন, না না, সে কী কথা! ভুল তো আমাদেরই হয়েছিল, সেজন্যে আমরাই অপরাধী হয়ে আছি। এখন তো সত্যিকার পরিচয় হয়ে গেল, এখন মাঝে মাঝে আসলে আমি বড় খুশি হব।

গম্ভীরমুখে সুহাসিনীর দিকে ফিরিয়া কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কী বলেন?

মৃদু হাসিয়া সুহাসিনী উত্তর করিল, আমিও তাই বলি।

অতঃপর একথা-সেকথায় আরও কিছুক্ষণ কাটিবার পর সকলে উঠিয়া পড়িলেন। বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া কিশোর সম্মুখে বিমলাকে দেখিয়া বলিল, সাবধান! আমি একজন গুণ্ডা!

বিমলা বলিল, সে কী। গুণ্ডা হলে আবার কবে থেকে?

কিশোর কহিল, সম্প্রতি হয়েছি। তোমার কাছে টাকাকড়ি যা আছে শিগগির বার করো, নইলে বিপদ ঘটবে।

বিমলা গম্ভীর হইয়া বলিল, তা বার কচ্ছি, কিন্তু মাসের বাকি কটা দিন আমার চলবে কী করে তা বলে দাও।

কিশোর হতাশ হইয়া বলিল, নাঃ, তোমার কাছে আমার গুণ্ডা হওয়া চলল না। গুণ্ডার সঙ্গে বুঝি অমনি করে কথা কয়?

বিমলা বলিল, তা কী করব, গুণ্ডার সঙ্গে এই প্রথম পরিচয়, ক্রমশ শিখে নিতে হবে তো?

কিশোর হাসিয়া বলিল, আজ ভারি মজা হয়েছে, ওপরে চলো, বলছি।

বিমলা তাহা বুঝিয়াছিল। উপরে গিয়া কাহিনী শুনিয়া সে রাগিয়া উঠিল, যা নয় তাই। না হয় খালি গায়ে খালি পায়েই ছিলে, তাই বলে কি সত্যি চোর-ডাকাতের মত চেহারা! কেমন ধারা তোক ওরা? চোখে কি দেখতে পায় না! বুড়োর না হয় ছানি পড়বার বয়স হয়েছে, কিন্তু ঐ যে মেয়েটার কথা বললে, সে-ও কি চোখের মাথা খেয়েছে না কি?

কিশোর বলিল, উঁহু, চোখ আছে–বেশ বড় বড়। তবে?

বিমলা হাসিয়া ফেলিল, না, ঠাট্টা নয়, সত্যি বলো তো ওরা কী রকম লোক? উদোমাদা নয় তো? আচ্ছা, মেয়েটার বয়স কত হবে বলো দেখি?

ঘাড় চুলকাইয়া কিশোর বলিল, তা সতেরো-আঠারো হবে—

বিয়ে হয়েছে?

বোধ হয় না। কপালে সিঁদুর দেখলাম না।

চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বিমলা বলিল, অত বড় আইবুড়ো মেয়ে তোমার সামনে বেরুল? হ্যাঁ ঠাকুরপো, হিন্দু বটে তো?

কিশোর বলিল, কী জানি ভাই, ঠিক বুঝতে পারলুম না। তবে যে রকম ড্রয়িংরুম সাজাবার ঘটা, ব্রাহ্ম হওয়াও বিচিত্র নয়।

বিমলা বিজ্ঞভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ঐ ঠিক বলেছ—বেম্মই হবে। বেম্মরা শুনেছি কেউ কেউ ঐ রকম হয়, সাদা কথা বুঝতে পারে না, চোখ খুলে দেখতে পায় না, আরও কত কী তোমার দাদা তামাশা করে বলতেন—

অকস্মাৎ তীর্থনাথের কথা অজ্ঞাতসারে বিমলার মুখ দিয়া বাহির হইয়া পড়াতে তাহাদের প্রফুল্ল রহস্যালাপ যেন হেঁচকা দিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। যদিও কিশোর মনে মনে জানিত যে, দিবারাত্রির মধ্যে অন্তত কুড়ি ঘণ্টা স্বামীর চিন্তা সকল কাজকর্মের অন্তরালে বিমলার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, তবু কলিকাতায় আসিয়া অবধি সে ইঙ্গিতেও কখনও স্বামীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে নাই। স্বামীর কথা সে আলোচনা করিতে চাহে না, একান্ত নিজস্ব করিয়া রাখিতে চায়, তাহা কিশোর বুঝিয়াছিল, তাই সে-ও কখনও তীর্থনাথের কথা তোলে নাই। কিন্তু আজ সকল আলোচনার উৰ্ব্বস্থিত এই অন্তরতম কথাটি যখন বিমলারই মুখ দিয়া অতর্কিতে বাহির হইয়া পড়িল, তখন কিশোর যেন বিস্ময়ে ব্যথায় চমকিয়া উঠিল!

বিমলা ম্লানমুখে জানালার কাছে গিয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিল।

কিশোর বিষণ্ণভাবে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া শেষে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ভাত দেবে চলো, বৌদি! খিদে পাচ্ছে।

সে রাত্রিতে তাহাদের মধ্যে আর কোন কথা হইল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *