০৪. চিত্রাঙ্গদা দেবী

চিত্রাঙ্গদা দেবীর আসন্ন জন্মদিন উৎসব উপলক্ষ্যে ইন্দ্ৰালয়ের সবাই ব্যস্ত।

খুব হৈ-চৈ করে রীতিমত সমারোহের সঙ্গেই চিত্রাঙ্গদা দেবীর জন্মোৎসব পালন করা হয়—৩রা মাঘ।

আর উৎসবটা রায় বাহাদুর হরপ্রসাদের আমল থেকেই হয়ে আসছে। একমাত্র সন্তান— আদরিণী কন্যার জন্মদিনটা খুব সাড়ম্বরেই যেন স্মরণ করিয়ে দিতেন সকলকে প্রতি বছর।

ইন্দ্ৰালয়ের পিছনে যে বাগান, সেখানেই পর পর সব তাবু পড়তো—চারদিকে নানারঙের আলোর উৎসব-যাত্ৰা থিয়েটার পুতুলনাচ ছাড়াও আর একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

হরপ্রসাদ নিজে বরাবর গানবাজনা ভালবাসতেন-নিজে গাইতে ও বাজাতে পারতেনতাই তিনি মেয়ের জন্মদিনটিকে উপলক্ষ্য করে এক বিরাট জলসার ব্যবস্থা করতেন প্রতি বছর-নানা জায়গা থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনতেন গুণীদের, আট-দশ দিন ধরে একটানা গান-বাজনার আসর চলত—আনন্দের স্রোত বইতো।

হরপ্রসাদ তাঁর যেখানে যত আত্মীয় আছে, সকলকেই সেই উৎসবে যোগ দিতে আহ্বান জানাতেন। তাদের যাতাযাত ও ওই কদিন ইন্দ্ৰালয়ে থাকার সব ব্যবস্থা করতেন, এবং ওই উৎসবের ব্যাপারটা হরপ্রসাদের মৃত্যুর পরও চলে এসেছে-চিত্রাঙ্গদার স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর প্রচেষ্টাতেই এবং সেটা আরো বেশি জাক-জমকের হয়েছে। জিতেন্দ্রর মৃত্যুর পর বৃদ্ধ সরকার যোগজীবনবাবু—যাকে চিত্রাঙ্গদা বরাবর জীবনকাকা বলে ডেকেছে, তিনিই করে এসেছেন।

অবশেষে জগদীন্দ্রদের আমলে জগদীন্দ্ৰই সেটা নিজের হাতে তুলে নেয়।

কটা দিনের ওই উৎসবে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়। আর বিশেষ একটা ব্যাপার হচ্ছে, ওই উৎসবের কাঁটা দিনের জন্য চিত্রাঙ্গদা দেবী তাঁর আভিজাত্য ও দাম্ভিকতার সকল ব্যবধান। ঘুচিয়ে অত্যন্ত সহজ সরল স্বাভাবিকতার মধ্যে যেন নেমে আসেন। প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেন, সহজ ভাবে হাসেন, আনন্দ করেন—সকলের মধ্যে তাদেরই একজন যেন হয়ে যান।

চিত্রাঙ্গদা দেবীর সে যেন সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ। এ যেন সকলের পরিচিত চিত্রাঙ্গদাই নয়। হাসিখুশি ভরা সম্পূর্ণ অন্য একটি মানুষ।

একটি ছোট মেয়ে—যে তার জন্মতিথি উৎসবে আনন্দে মেতে উঠেছে।

 

কিরীটী যখন ইন্দ্ৰালয়ে এসে পৌঁছল। সোজা কলকাতা থেকে তার গাড়িতেই, ইন্দ্ৰালয় তখন আলোয় আলোয় ঝলমল করছে চিত্রাঙ্গদা দেবীর আসন্ন জন্মতিথি উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়ে।

যোগীনবাবু করিডরের একপাশে দাঁড়িয়ে একজন কস্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তার পাশে ছিল জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র।

কিরীটীর পরিধানে ইউ. পি.র পোশাক ছিল-চোস্ত পায়জামা, গ্রে কলারের শেরওয়ানী, মাথায় কালো টুপি। চোখে চশমা। মুখে পাইপ।

যোগীনবাবুই সর্বাগ্রে এগিয়ে এলেন কিরীটী গাড়ি থেকে নামতেই তার সামনে।

নমস্তে। কিরীটী বলে যোগীনবাবুকে সম্বোধন করে।

নমস্তে। যোগীনবাবু বলেন, অৰ্জ্জুনপ্রসাদ মিশ্র বোধ হয় আপনি!

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ।

জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র চেয়েছিল কিরীটীর দিকে।

দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা-মাথার চুলে রাগের দুপাশে রুপালী ছোঁয়া লেগেছে। যদিও, তবু মনে হয় বার্ধক্য যেন ঠিক আজও ওর দেহকে ছুঁতে পারেনি।

মিসেস চৌধুরীর সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।

নিশ্চয়ই। আপনি বসবেন চলুন, আমি খবর দিচ্ছি ভিতরে।

চলুন।

জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্ৰই প্রশ্ন করে, ইনি?

যোগীনবাবু তাড়াতাড়ি থেমে বলেন, পরিচয় করিয়ে দিই—এরা স্বৰ্গত মিঃ চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের দুই ছেলে—জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্ৰকুমার চৌধুরী।

ও, নমস্কার। কিরীটী হাত তুলল।

ওরা দুই ভাইও প্রতিনমস্কার জানায় ঃ নমস্কার।

আর ইনি—অৰ্জ্জুনপ্রসাদ মিশ্র—আমাদের বিজনেস অ্যাডভাইসার হয়ে শীগগিরই আসছেন—উনি–

জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু কেউ কোন কথা বলে না।

নিচের তলাতে গেস্ট রুমেই কিরীটিার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল।

যোগীনবাবু যেতে যেতে গেস্ট রুমের দিকে তাকিয়ে একসময় কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন, কিছুদিন আপনি এখানেই থাকবেন তো?

হ্যাঁ, বুঝতেই পারছেন, সব কিছু বুঝে নিতে হবে সর্বপ্রথম মিসেস চৌধুরীর কাছ থেকে। এত বড় বিজনেস বুঝতে হলে মাসখানেক খুব কম করেও সময় তো লাগবেই।

তা তো লাগবেই।

হ্যাঁ, ভাল কথা, যে গাড়িটা করে আমি এলাম, সেটা আমার গাড়ি নয়-আমার এক বন্ধুর গাড়ি। কাল সকালেই আবার গাড়ি নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাবে।

আপনি কিছু ভাববেন না, সব ব্যবস্থা আমি করব।

গাড়ির ক্যারিয়ারে আমার দুটো স্যুটকেস আছে–

সে আমি নামিয়ে নেবার ব্যবস্থা করছি।

কথা বলতে বলতে দুজনে এসে ইন্দালয়ের গেস্টরুমে প্রবেশ করল।

 

পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি বড় সাইজের, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজের। একটিতে শয়ন ও অন্যটিতে বসবার ব্যবস্থা। দুই ঘরে যাতায়াত করবার জন্য মধ্যবতী একটি দরজা। আছে, এবং ওই দরজাটি শয়নকক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া যায়।

সর্বপ্রকার আধুনিক ও আরামদায়ক আসবাবপত্রে ঘর দুটি সুন্দর করে সাজানো, ঠিক যেন কলকাতা শহরের কোন বড় হোটেলের সুইট। শয়নকক্ষের সঙ্গে অ্যাটাচড় বাথরুম।

যোগীনবাবু ওই কক্ষে কিরীটীকে পৌঁছে দিয়ে বললেন, আপনি ততক্ষণ একটু বিশ্রাম করুন, চা পান করুন, ভেতরে আমি খবর দিচ্ছি।

যোগীনবাবু চলে গেলেন।

একটু পরে একজন ভৃত্য কিরীটীর সুটকেস দুটো ঐ কক্ষে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।

কিরীটী শয়নকক্ষে প্রবেশ করে কক্ষের মধ্যবর্তী দরজাটা বন্ধ করে পথের বেশভূষা বদল করে নিল। পায়জামা ও পাঞ্জাবির ওপর একটা গরম শাল গায়ে জড়িয়ে নিল।

বেশভূষা বদল করে একটা সোফায় বসে সবে পাইপটায় নতুন করে অগ্নিসংযোগ করেছে, মধ্যবয়সী একটি ভূত্য কক্ষে এসে প্রবেশ করল চায়ের ট্রে হাতে। ট্রের ওপরে শুধু চায়ের সরঞ্জামই নয়, ঐ সঙ্গে দু-তিনটে প্লেটে বিস্কিট, পেস্ট্রি, স্যাণ্ডউইচ, দু-চার রকম মিষ্টি এবং কিছু ড্রাই ফুটস। লোকটির চেহারা দেখে কিরীটীর বাঙালী বলেই মনে হয়, তবু হিন্দিতেই জিজ্ঞাসা করে তাকে, কেয়া নাম তুমারা?

বাবুজী, আমি বাঙালী, আমার নাম গণেশ সরকার। একটু থেমে শুধোয়, চা ঢালি বাবুজী?

ঢালো।

আপনি বাঙালী?

না গণেশ, তবে বহু বছর বাংলাদেশে আছি, বলতে পারো এক প্রকার বাঙালীই বনে গিয়েছি।

গণেশ মৃদু হাসল। হাসিটা যেন খুশিরই মনে হয়।

বয়েস গণেশের পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয়। মাথার ২/৩ অংশ চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। সামনের দিকে অনেকটা টাকা।

বেঁটে গোলগাল চেহারা। পরিষ্কার একটা ধুতি ও হাফসার্টের ওপর মোটা একটা সোয়েটার গায়ে।

ক’ চামচ চিনি দেবো বাবুজী?

দু’ চামচ দাও।

রাণীমা আমাকেই বলেছেন। আপনাকে দেখাশোনা করতে। আপনি তো এখন কিছুদিন এখানে থাকবেন?

হ্যাঁ, কিন্তু রাণীমা কে?

আজ্ঞে, এ বাড়ির কর্ত্রী।

তাঁকে বুঝি তোমরা রাণীমা বলে ডাকো? কিরীটী চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।

আজ্ঞে, চাকরিবাকির, দারোয়ান, ড্রাইভার আমরা সকলেই ওঁকে রাণীমাই বলি।

আর সরকারবাবু?

তিনি শুধু মা বলেই ডাকেন।

আর দাদাবাবুরা?

তারা ডাকে সবাই বড়মা বলে।

ওরা তো সকলে তোমাদের রাণীমার দেওরের ছেলেমেয়ে, তাই না গণেশ?

আজ্ঞে।

গণেশ।

আজ্ঞে?

এ বাড়িতে তুমি কতদিন কাজ করছো?

তা বাবুজী, জীবনটা তো একরকম এখানেই কেটে গেল। কুড়-বাইশ বছরের সময়। এসেছিলাম

ও, তবে তো তুমি তোমাদের কর্তবাবুকেও দেখেছ?

দেখেছি বৈকি। যেমন চেহারা তেমনি রূপ আর তেমনি ছিল দরাজ মন, ঠিক রাজামহারাজাদের মতই।

তোমাকে খুব ভালবাসতেন মনে হচ্ছো!

শুধু আমাকে কেন বাবুজী, সকলের প্রতিই তাঁর সমান। দয়া ছিল। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কারো কখনো এতটুকু ভয় করেনি।

আর তোমাদের রাণীমা?

রাণীমা! ওরে বাবা, না ডাকলে কারো সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস আছে নাকি!

খুব ভয় করো বুঝি সবাই তাকে?

শুধু ভয়! বাঘের মত সবাই ভয় করে তাঁকে। তবে আমাকে খুব স্নেহ করেন।

ওই সময় জয়ন্ত চৌধুরী এসে ঘরে প্রবেশ করল।

নমস্কার, মিস্টার মিশ্র।

নমস্কার।

জয়ন্তকে ঘরে ঢুকতে দেখে গণেশ ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।

বসুন মিঃ চৌধুরী। কিরীটী জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, বসুন—দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

না, বসব না। আপনাকে ডাকতে এসেছি।-বড়মা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। চলুন, ওঠা যাক। জয়ন্ত চৌধুরী বললে।

তাহলে চলুন, দেখা করেই আসি। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।