০৪. গাঁয়ে ফিরে বুড়ি

গাঁয়ে ফিরে বুড়ি বেশ একটা পবিতৃপ্তির ভাব নিয়ে দিন কাটায়। গফুর লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখে। দেখতে ভালো লাগে। ঘাসের বুকে রঙিন প্রজাপতির কথা গফুরের মনে হয়। সংসারটা বুড়ির উচ্ছাসে একটা সবুজ মাঠ হয়ে গেছে। গফুরের। অশুভ আকাঙ্ক্ষা মিথ্যে হয়েছে দেখে ও আশ্বস্ত। বুড়ির মধ্যে সে হতাশা এখন নেই। মন খারাপ করে মুখ কালো করে দিন কাটায় না। চুপে চুপে কাঁদে না। সবার কথা ভুলে গিয়ে পুকুরঘাটে বসে থাকে না। যখন তখন গফুরের কাছে এসে দাঁড়ায়। ছেলেমানুষী করে। গফুরের মনে হয় বুড়ি এখন বাতাসে আঁচল ওড়ায়। ওর পালে হাওয়া লেগেছে। ছুটে ছুটে কাজ করে। সলীম কলীমকে আদরে ভরে তোলে। কলীম

একদিন অবাক হয়ে বলে, মা তুমি এত খুশি কেন?

অকস্মাৎ লজ্জা পায় বুড়ি।

–দূর পাগল খুশি কৈ রে?

–হ্যাঁ তুমি অনেক ভাল হয়ে গেছ। এখন আর আগের মত বক না।

–তোকে আমি কখনো বকি?

–আগে একটু একটু বকতে এখন তাও না। বল না মা তোমার কি হয়েছে। বুড়ি উত্তর দিতে পারে না। ব্ৰিত বোধ করে। পাশ কাটাবার চেষ্টা করে।

–আমার বুড়ো বাপের মত প্রশ্ন শুরু করেছে। যা খেলগে যা।

–না বললে যাব না। কিছুতেই যাব না। কলীম জেদ করে।

–এখন খেলতে গেলে বিকেলে কিন্তু নাড় বানিয়ে দেব।

–সত্যি তো?

–হ্যাঁ সত্যি।

কলীম চলে যায়। গফুর মিটমিটিয়ে হাসে।

–তোমার হাসি দেখলে গা জ্বালা করে।

বুড়ির মুখ লাল হয়ে ওঠে। গফুর আরো জোরে জোরে হাসে। হাসতে হাসতে বুড়ি কে জড়িয়ে ধরে। শ্রীনাইল ধামে যাবার আগের দিনগুলোর বুড়ির জঘন্য বিষন্নতার নিচে গফুর তলিয়ে যাচ্ছিল যেন। ওখান থেকে ফিরে আসার পর আবার মাথা উঁচিয়ে উঠেছে। বুড়ি এখন আশ্চর্য সতেজ আর প্রফুল্ল। এমন কি কলীমের বেশি আবদারে মাঝে মাঝে রান্না ঘরের পাশে মারবেলও খেলে। পড়শিদের সঙ্গে এখন গভীর হৃদ্যতা। গফুরের মনে হয় বুড়ি কি নমিতার মতো এক গভীর বিশ্বাসের আকাঙ্ক্ষাকে বুকে লালন করছে। এখন বুড়ির বুকের মধ্যে এক নিষ্ঠার স্রোত বয়ে যাচ্ছে।

দিন গড়ায়। মাস গড়ায়। মাস আটেক কেটে যায়। বুড়ি তবু বিশ্বাস হারায় না। গফুর একদিন ঠাট্টা করে।

–তোর বাবাতো দয়া করছে না বুড়ি?

বুড়ি গফুরের মুখ চেপে ধরে।

–ছি বাবার নামে এমন করে বলে না। একদিনে কি আর সব হয়? জানো না সবুরে মেওয়া ফলে। ধৈর্য ধরলে ঠিক ফল পাব।

–হ্যাঁ ভাল। আস্থা রাখা ভাল।

গফুর মনে মনে আশ্বস্ত হয়। বুড়ির ছেলেমেয়ে হোক বা না হোক গফুরের কিছু আসে যায় না। কিন্তু বুড়িকে যে নতুন করে পাওয়া গেছে এটাই লাভ। এ উপরি পাওনার মূল্যও তো কম নয়। ও মনে মনে শ্রীনাইল ধামের কেশাবাবাকে কৃতজ্ঞতা জানায়। বাবা তাকে দয়া করেছে ঠিকই।

এর মাঝে জলিল আসে শহর থেকে। ওর বিয়ে ঠিক করেছে ওর মা। বৌ খুব সুন্দরী। বৌ নিয়ে শহরে চলে যাবে। জলিলের বাবা নাই। মা-ই সব। আর মায়ের ও একই ছেলে। জলিলকে দেখেই বুড়ি বিষন্ন হয়ে যায়। জলিল কিছু বলার আগেই বলে, তোমার বিয়েতে আমি যাব না জলিল?

জলিল বিস্মিত হয়। ছোটবেলায় দুজন দুজনকে তুই বললেও এখন কেউ কাউকে তুই বলে না। বুড়ির মুখের দিকে চেয়ে জলিল কিছুই আঁচ করতে পারে না।

–তোমার কি হয়েছে বুড়ি?

–কিছু না।

–তবে আমার বিয়েতে কি দোষ হলো?

–কিছু না।

জলিল কি বলবে ভেবে পায় না। দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটায়। বুড়ি একমনে কুটুস-কুটুস সুপোরি কাটে। বুড়ির মতো এমন চিকন করে সুপপারি আর কেউ কাটতে পারে না। বিয়ে, উৎসবে ওর খাটুনি বেড়ে যায়। ডালা ডালা সুপারি কাটতে কাটতে কোমর ব্যথা হয়।

–এত সুপপারি কি হবে?

–সকিনার ছেলের আকিকা হবে। ওরা কাটতে দিয়ে গেছে।

–শুনলাম শ্রীনাইল ধাম গিয়েছিলে?

–হ্যাঁ। কেশাবাবার ধামে মানত করে এলাম।

বুড়ির মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! জলিল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আসলে মানত করে কিছু হবে না। ডাক্তার দেখানো দরকার। গফুর ভাইকে বললো তোমাকে শহরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে।

–ডাক্তার? ডাক্তার কেননা? আমার তো কিছু হয়নি?

–সে সব মেলা কথা। আমিও অতো বুঝি না। আমার এক দোস্তকে দেখেছি ওর বউকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। ডাক্তার দেখেটেখে বলেছে ওদের কোন দিন ছেলেমেয়ে হবে না। ডাক্তাররা সব বুঝতে পারে।

জলিলের এমন আজগুবি কথা বুড়ি কিছু বুঝতে পারে না। হাঁ করে চেয়ে থাকে। ওতো জানে কেবল অসুখ করলেই লোকে ডাক্তারের কাছে যায়।

–কি সব আজেবাজে কথা।

–আজেবাজে নয় বুড়ি। খাটি কথা।

–থাকগে আমি শুনতে চাই না। বুড়ি রেগে যায়। সুপপারি কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলে।

–উঃ মাগো।

বুড়ি আঙুল চেপে ধরে উঠে যায়। ন্যাকড়া ছিঁড়ে আঙুল বাঁধে।

–দেখি বুড়ি কতোটা কেটেছে?

–না।

ও পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ায়। জলিলের কোন কিছু করার থাকে না। বুড়ির আচরণে বিরক্ত হয়। এসেছিল বুড়ির সঙ্গে ওর বিয়ে নিয়ে কিছু হাসি-তামাসা করবে। বুড়ি খুশি হবে। জলিলের মনতো খুশিতে টইটম্বুর। সব আনন্দ এমন করে মাটি হলো দেখে ও আর দাঁড়ায় না। কিছু কেনাকাটার জন্যে বাজারের দিকে যায়।

ঘাটের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে বিরক্ত হয় বুড়িও। জলিল এলেই এমন এক একটা কথা বলে যাতে বুড়ির সমস্ত অনুভূতি ওলোটপালোট হয়ে যায়। সেই কথাগুলো বুড়ি তার পারিপার্শ্বিকের জীবনযাপনের সঙ্গে মেলাতে পারে না। তখন বুড়ির কষ্ট বাড়তে থাকে। বুকের ভেতর যন্ত্রণার স্রোত প্রবলবেগে গর্জন করে। ও নিঝুম হয়ে যায়। কথা বলতে ভাল লাগে না। কাজ করতে ভাল লাগে না। কারো সঙ্গ অসহ্য ঠেকে। বুড়ি আজও পুকুর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। কলাগাছের আড়ে আড়ে প্রায় খালের কাছাকাছি যায়। ডৌয়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে খালের বুকে জোয়ার আসা দেখে। এই জোয়ার আসা দেখতে ওর ভীষণ আনন্দ। আস্তে আস্তে খালের বুক কেমন করে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বিরক্তি ভুলে যায়। ও আবার আগের ধ্যানে নিমগ্ন হতে পারে। জলিলের আজেবাজে কথাগুলো জোয়ারের জলে ভাসিয়ে দেয়।

ধুমধাম করে জলিলের বিয়ে হয়। দুদিন পর ও বৌ নিয়ে শহরে চলে যায়। বুডির মন খারাপ হয়ে থাকে। কখনো চোখে জল এসে পড়ে। নিজেকে শাসন করে কুলিয়ে উঠতে পারে না। এর মধ্যে বুড়ির খুনখুনে বয়সী মা মারা যায়। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার দরুণ ওর মা-র মৃত্যু বাড়ির সকলের কাছে স্বস্তির কারণ হয়। সে মৃত্যু ওকেও তেমন ঘায়েল করে না। বরং মার কষ্টটাই ওর বেশি খারাপ লাগতো। তবু বুড়ি ডাক ছেড়ে কাঁদলো। ওর মনে হলো ওর জীবন থেকে একটা শীতল ছায়া সরে গেল। মার মৃত্যুর চাইতেও জলিলের বিয়ে বুড়ির মনে বড় বেশি দাগ কাটলো। বুড়ি কিছুতেই ভুলতে পারল না। যেন জীবনের সীমানা বদল হয়ে গেল। মানসিক আশ্রয়হীন হয়ে খোলা প্রান্ত রে ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে উদোম, গায়ে ছিটকে পড়ল। বুড়ির সব অবলম্বন যেন নিঃশেষ।

যাবার আগে জলিল একদিন ঘাটলায় দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমার বউ কেমন বুড়ি?

–চাঁদের মত। শহরে তো নিচ্ছ। ধরে রাখতে পারবে তো? বুড়ি বাঁকা করে তাকিয়েছিল।

–এমন কথা কেন?

–এমনি বললাম।

বুড়ি হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল।

–তোমাকে কখনোই বুঝতে পারি না।

জলিল মুখ কালো করে চলে গিয়েছিল। শহরে যাবার দিন আর দেখা হয় নি। এখন ঘুরেফিরে সেকথা মনে হয়। বুড়ি বুঝতে পারে না এত জটিলতা ওকে আক্রান্ত করে রাখে কেন?

ওদের বিবাহিত জীবনের সাত বছর কেটে যাবার পর ঠিক আট বছরের মাথায় বুড়ি সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠে। লক্ষণগুলো সব একে একে যতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ও ততই অস্থির হয়। যেদিন বুঝলো যে হ্যাঁ সত্যিই ওর ভেতরে পরিবর্তন এসেছে সেদিন দৌড়ে গফুরের কাছে আসে। গফুর কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছিল। বুড়ি এক টানে কথা সরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে।

–কি হয়েছে তোর বুড়ি?

–দাঁড়াও বলছি।

বুড়ি পাগলের মত গফুরের বুকে মুখ ঘষে। বুড়ির এমন বেহিসাবি উচ্ছাস গফুর আর কোনদিন দেখেনি। কখনো এমন করে এত কাছে এসে ও ধরা দেয়নি। ওর যে কখন কি হয় বোঝা মুশকিল। আজ আবার কি হলো? অনেকটা সময় বুড়িকে শান্ত হতে দিয়ে গফুর আস্তে আস্তে ওর মুখ তুলে ধরে।

–কি হয়েছে বলবি তো? কিছু না বললে বুঝবো কি করে যে তোর সুখ না দুঃখ?

–ওগো বাবা দয়া করেছে।

–সত্যি?

–হ্যাঁ, আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।

বুড়ি উত্তেজনায় হাঁফায়। এবার গফুরের পালা। খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে ও নিজেও। হঠাৎ মনে হয় খুশিটা শুধু বুড়ির একলার নয়। ওর নিজের ভেতরেও যে এত আনন্দ ছিল খবরটা না শোনা পর্যন্ত ও টের পায়নি। লজ্জায়, আনন্দে উদ্ভাসিত বুড়ির মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে গফুর। খুব সহজে সন্তান পেয়েছিল বলে সলীমের মা এমন করে খুশি হয়নি। আর দশটা সহজ পাওয়া বস্তুর মত ছিল সাদামাটা। বাচ্চা পেটে এসে গেছে চার মাস পর্যন্ত এটা সে নিজেও টের পায়নি। খবরটা জানার পর। গফুর ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল।

–ধুত্ কি যে ঝামেলা?

–সলীমের মা মিনমিন করে বলেছিল, তুমি খুশি হও নি?

–না, একটুও না!

গফুর চেঁচিয়ে উঠেছিল।

–আমারও ভাল লাগছে না?

একই মিনমিনে ভঙ্গিতে সলীমের মা বলেছিল। সে ঘটনার পুরো ছবিটা গফুরের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু বুড়ি? বুড়ি যে কি পেয়েছে গফুরের তা বোঝার ক্ষমতা নেই। গফুর সে চেষ্টাও করে না।

বুড়ি এখন সাধক পুরুষের মত নিবেদিত চিত্ত। ব্যাপারটার মধ্যে সে সিদ্ধ পুরুষের আলৌকিক ক্ষমতা আবিষ্কার করে। ও এখন মুরুব্বিরা যা বলে সব শোনে। একটুও এদিক ওদিক করে না। খাওয়ার নিয়ম, গোসলের নিয়ম, রাত-বিরেতে বাইরে যাওয়ার নিয়ম কোনটাই বাদ দেয় না ও। মুরুব্বিদের চাপানো নিয়মগুলো বুড়ির মাথার উপর জগদ্দল পাথর। তবু দারুণ শান্ত মেয়ের মত সব পালন করে। একটুও কষ্ট নেই ওর। নিয়ম ভাঙ্গার দুর্বিনীত বেপরোয়া সাহসও নেই আর। গফুর মিটিমিটি হাসে–তুই একদম পাল্টে গেলি বুড়ি?

–পাল্টালাম কৈ? যখন যেমন তখন তেমন তো থাকতে হয়। বু

ড়ি চোখ কপালে ওঠায়।

–ইস একদম লক্ষ্মী মেয়ে। কদিন আগেও পাশের ঘরের চাচী কি বকাটাই না দিল তোকে।

–দেখ ভাল হবে না বলছি। সেততা মেলা দিন আগের কথা।

–ও তাই তো। ঠিক আছে একটু তামুক সাজ বুড়ি।

বুড়ি গম্ভীর মুখে তামুক সেজে আনে। গফুর ওর সঙ্গে রসিকতা করে। কখনো যেটা ওর একদম ভাল লাগে না। গফুর ওর গম্ভীর চেহারা দেখে আর কথা বাড়ায় না। পাছে কোন অঘটন ঘটে যায় সেজন্য বুড়ি এখন ভীষণ নিষ্ঠাবতী। ( ঠিক আট মাস পর বুড়ির ছেলে হয়। মাস পোরে না। মুরুব্বীরা বলে আট মাসে ছেলে হলে সেই ছেলে ভাগ্যবান হয়। বুড়ি অতশত ভাবতে চায় না। শুধু ফুটফুটে সেই ছেলের দিকে তাকিয়ে ও যাবতীয় দুঃখ ভুলে যায়। নিজের মধ্যে ভয়ানক পরিবর্তন অনুভব করে। সে ছোট শিশুর কচিমুখ ওর সমস্ত ভাবাবেগের শিকড় নাড়িয়ে দিয়ে গেল। কানে কানে বলে গেল, জীবনের অর্থ কত দ্রুত পাল্টে যায়। বুড়ি এখন অনেক বেশি আত্মস্থ। অস্থিরতা ওকে মাতিয়ে রাখে না।

ছেলের নাম রাখা হল রইস।

সলীম কলীম তো ছেলে দেখে মহা খাপ্পা। বাচ্চার হাত পা নেড়ে ওরা খুশি হতে পারে না।

–মা তোমাকে বললাম একটা বোন আনতে তুমি ভাই আনলে কেন?

–ঠিক আছে এর পরে একটা বোন আনবো।

–ভাই ভালো না খালি মারামারি হয়।

–আমার কোলে একটু দাওনা মা। কলীম বুড়ির গা ঘেঁষে বসে। ওদের কৌতূহলের অন্ত নেই।

–তুই ফেলে দিবি। দেখছিস না ও কত ছোট?

–ও বুঝেছি তুমি ওকে এখন থেকেই বেশি আদর কর।

–মোটেই না তোকে সবচেয়ে বেশি আদর করি। বুড়ি কলীমের কপালে চুমু দেয়।

–তুমি যখন ঘরে থাকবে না তখন আমি ওকে বাটুল দিয়ে মেরে ফেলব। ঠিক মারব। তুমি তখন ভেউ ভেউ করে কাঁদবে।

–তুই যেমন কাঁদিস অমন না রে?

বুড়ি হাসতে থাকে। সলীম কলীমের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। মুখে যত কথাই বলুক কলীমই রইসকে পছন্দ করে বেশি। ঘরে কেউ না থাকলে চুপিচুপি আদর করতে আসে। আর বেশি আদর করতে গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে কাঁদিয়ে দেয়।

যত দিন যায় বুড়ি লক্ষ্য করে রইস যেন ঠিক স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে না। ওর দৃষ্টির মধ্যে আর দশটা ছেলের চপলতা নেই। ও কেমন বোকা হাবার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওর সামনে শব্দ করলেও চমকায় না। ও বুক চেপে ধরে। দম আটকে আসতে চায়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না তবু খটকা লাগে। এত সাধের ছেলে কি ওর বোবা আর কালা হল!

তবু ধৈর্য ধরে বুড়ি। কাউকে কিছু বলে না। নিজে নিজেই ছেলেকে বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করতে থাকে। যতই দিন যায় বুড়ির ভয়টা গুটিসুটি পাকিয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে আশঙ্কাটা সত্যে পরিণত হয়। বুড়ি একদিন আর্তনাদ করে ওঠে।

–ওগো দেখতো রইস আমার ডাকে সাড়া দেয় না কেন?

গফুর অনুভব করে বুড়ির ডাকটা সব হারানোর বেদনায় মুহ্যমান। ওর সর্বস্ব যেন খোয়া গিয়েছে। গফুরও ব্যর্থ হয়। না রইসের কোন রকম চেতনা নেই। ও আপন মনেই হাত-পা নেড়ে খেলে। হাসে। বাবা মা ভাইদের ডাকে ওর কিছু যায় আসে না। শব্দও করে না। রইসের হাবভাব লক্ষ্য করে গফুরও নিরাশ হয়। বুক ভার হয়ে থাকে। হ্যাঁ ঠিকই, পাশের ঘরের রমজান আলীর মেয়েটির মত ও সপ্রতিভ নয়। গফুরের মনে হয় সব অপরাধ ওর নিজের। বুড়ির মুখের দিকে ও চাইতে পারে না।

দিন যতই গড়াল ততই বুড়ির আকাঙ্ক্ষা নিঃশেষ করে দিয়ে রইস আর কথা বলল। হাবা-বোবা ছেলেটা বুড়ির সুখের খাচার দ্বিতীয় ভাঙন। ওর মনে আর কোন নতুন ভাবনার জন্ম হয় না। অন্য কোন কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারে না। সব কিছু ঝেড়ে ফেলে রইসকে নিয়ে মেতে ওঠে। রইসই বর্তমানে ওর সব আনন্দের উৎস। ওর পঙ্গুত্ব, ওর অসহায়ত্ব বুড়ির মাতৃত্বকে আরো বেশি উদ্বেল করে। অনুভব করে ছেলেটা ওকে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। এমনকি গফুরের প্রতিও ওর বিশেষ কোন আকর্ষণ নেই। গফুর কোলে নিতে চাইলেও যায় না। কেঁদেকেটে নেমে আসে। একদিন গফুর ওকে জোর করে আদর করতে গিয়েছিল বলে নাকের ডগার ওপর খামচে দিয়েছিল। রাগে গফুর ওকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।

–তোমার ছেলে তুমিই নাও।

বুড়ির খারাপ লেগেছিল। নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল গফুরকে। ফুসে উঠেছিল ও নিজেও।

–ছেলে আছে বলে ওর মর্ম তুমি বোঝ না।

গফুর রাগে আর কথা বলেনি। প্রায় সাত আট দিন কথা বন্ধ ছিল দুজনের।

কলীমের অনেক উৎসাহ ছিল রইসকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বোবা হওয়ায় কলীমও দমে যায়। কখনো রেগে ওঠে, মা ও কথা বলে না কেন? আমার একটুও ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে দুটো ঘুষি লাগিয়ে দেই।

বুড়ির বুক ভার হয়ে থাকে। ও কাউকে ওর বুকটা খুলে দেখাতে পারে না। সেখানে বেদনার পাহাড় গড়ে উঠেছে। কখনো রইসকে বুকের মধ্যে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ওকে বেশি করে আঁকড়ে ধরে। রইসের যেমন মা, তেমন রইস ছাড়াও বুড়ির পৃথিবী অন্ধকার।

রইসের তিন বৎসর বয়সে বুড়ি আর গফুর আর একবার শ্রীনাইল ধামে যায়। কেশাবাবার নামে মানত করে নিম গাছের ডালে পুঁটলি বাঁধে। এবার আর গফুরকে সাধাসাধি করতে হয়নি। বুড়ির প্রস্তাবে হেসেছিল।

বলেছিল, তুই না বললেও আমি তোকে নিয়ে যেতাম বুড়ি। জানি তোর ইচ্ছার তৃপ্তি হয়নি।

–ছি ওকথা বলতে নেই।

–সত্যি করে বলতো রইসকে নিয়ে তুই খুশি হয়েছিস?

–বাপ হয়ে এমন কথা বলতে নেই।

বুড়ি সরাসরি উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। একটা পঙ্গু ছেলে তার মাকে ক্লান্তিহীন যন্ত্রণা ছাড়া আর কিইবা দিতে পারে? গফুর তা বোঝে। বোঝে বলেই বুড়ির মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়।

শ্ৰীনাইল ধামে যাবার সময় গফুরের মনে হয়েছিল কে যেন সারাপথ জুড়ে এক বিরাট কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। গতবারের মত বুড়ি এবার আর তেমন উৎফুল্ল নয়। পথের কষ্টে একটুতেই ক্লান্ত হয়ে যায়। উপরন্তু রইস বিরক্ত করে। কান্নাকাটি করে। মেঠো পথে হাঁটতেও কষ্ট হয়। কয়েকবার পথের মাঝে গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিয়ে তারপর মেলায় পৌছে ও। কোন রকমে নিম গাছে পুঁটলি বেঁধে ঘরে ফেরার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মেলায় সারাদিন ঘোরাঘুরি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও অনুভব করে না। বুড়ির চোখে-মুখে ক্লান্তি ছাড়া আকাঙ্ক্ষার কোন উজ্জ্বল আলোর রেখা আবিষ্কার করতে পারে না গফুর। ওর খুব খারাপ লাগে। মনে হয় বুড়ি হারিয়ে যাচ্ছে ওর জীবন থেকে। অথচ এবার ওর মনে কোন দ্বিধা ছিল না। ও ছিল সাধক পুরুষের সাধনার মত নিবেদিত চিত্ত। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোন আশঙ্কা গফুরকে পিছু টেনে রাখেনি। গফুর আবার বুড়িকে ওর আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে চায়। চায় বুড়ির সাহচর্যের ঘনিষ্ঠ উত্তাপ, নির্মল আনন্দ আর বেড়ার মধ্যে আটকে থাকা ঘর-ঘর খেলার সুখ।

তা কিন্তু না ফল হয়নি। জীবনের সোনার গোলাপ আর ফুটল না। সঙ্গত কারণেই রইস বুড়ির জীবনে আরো অপরিহার্য হয়ে ওঠে। গফুর সারাদিন বাইরে থাকলে, সলীম কলীম স্কুলে গেলে রইস ছাড়া পাশে আর কেউ থাকে না। মায়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ায় ছেলে–পুকুরঘাটে, রান্নাঘরে, চেঁকিঘরে, সুপোরি বাগানে। রইস কথা বলতে পারে না বলেই একা একা কথা বলা বুড়ির অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। এ জিনিসটা আগে ওর মধ্যে ছিল না। মনে হয় ওর মধ্যে একটা দিক পরিবর্তন হচ্ছে। ছেলেকে কেন্দ্র করে একটা অদলবদল ঘটছে। একা একা কথা বলতে দারুণ ভয় লাগে। সুপোরি বাগানে। লাল টকটকে সুপপারি কুড়োতে কুড়োতে বুকের ঝরনা খুলে যায়।

ও রইস, রইসরে তুই আমার একটা হাড়-জ্বালানি, পরাণ-পোড়ানি পোলা হলি রে। তোরে নিয়ে আমার দুঃখ ছাড়া সুখ নাই। তবু ভাল, তুই আছিস। না থাকলে তো সারা জীবন হা-হুতাশ করতাম। তুই আমার কানা ছেলে পদ্মলোচন।

বুড়ি শব্দ করে হেসে ওঠে। একটা লাল সুপোরি রইস মুখে পোরে। ও সেটা কোচরে পুরে রইসকে কোলে উঠিয়ে নেয়। বুকে জড়িয়ে ধরে চুমায় চুমোয় অস্থির করে তোলে। রইস হাত পা ছুড়ে নিচে নামতে চায়। বুড়ি সজোরে জাপটে ধরে। ও তখন কেঁদে ফেলে। বুড়ি দুম করে ওকে মাটির ওপর বসিয়ে দেয়।

–মায়ের আদর তোর সয় না। হতভাগা ছেলে। * বুড়ির চোখ ছলছল করে। আঁচলে চোখ মুছে নেয়। রইস গুটিগুটি পা ফেলে বুনো আগাছার মধ্য থেকে একটা সুপোরি উঠিয়ে আনে। বুড়ির দিকে তাকিয়ে হাসে।

ওরে দুষ্টু ছেলে মার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে? আবার সুপপারি কুড়ানো হয়েছে। মাগো কত আমার উপযুক্ত ছেলে। হ্যাঁ রে রইস আমার বুড়ো বয়সে তুই আমাকে ভাত দিতে পারবি না? ওরে রইস বড় হলে মাকে কি তুই এখনকার মত ভালবাসবি না কি বৌর ন্যাওটা হয়ে যাবি?

রইস বুড়ির হাঁটু জড়িয়ে ধরে। দুহাত বাড়িয়ে কোলে উঠতে চায়। ও রইসকে বুকে তুলে কোচড় ভর্তি সুপপারি নিয়ে ঘরে ফেরে।

মাঝে মাঝে অবাক হয় গফুর। আশ্চর্য ধৈর্য বুড়ির। কোন দিন ছেলের গায়ে হাত তোলে না, একটুও বিরক্ত হয় না। সারাক্ষণ যেন দেয়াল তুলে আগলে বেড়ায়। এখন বড় আনন্দের সময় রইসের।

গফুর হুঁকো টানতে টানতে বলে, তুই বড্ড বেশি সইতে পারিস বুড়ি? এমন মা

আমি আর দেখিনি?

–আমি না সইলে ওর কে আছে বল?

গফুরের প্রশ্নের উত্তরে থমথম করে বুড়ির কণ্ঠ।

ছেলেটা কেন এমন হল বলত বুড়ি?

ও একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সুপপারি কাটায় মন দেয়। গফুরের হুঁকো থেকে গুড়গুড় শব্দ হয়। এক সময় সুপোরি কাটা থামিয়ে গফুরের মুখের দিকে তাকায়, ওগো আমার বোধহয় কোন পাপ ছিল।

গফুরের হুঁকো টানা থেমে যায়।

–না বুড়ি না। সব বাজে কথা।

বুড়ি ফিকে হাসে।

–মুরুব্বিরা তো বলে।

–ধুত! ওদের আবার কথা। ওরা মানুষের দোষ ধরতে পারলে বাঁচে।

* গফুর আবার হুঁকো উঠিয়ে নেয়। বুড়ি সুপপারি কাটে। কেউ কথা বলে না। কেবল কিছু শব্দ হয়। শব্দটা ছড়িয়ে যায় বাতাসে। বাইরে ঘুটঘুটে রাত। আজ অমাবস্যা। ছেলেরা ঘুমিয়ে গেছে। বুড়ি কুপি উস্কে দিয়ে উঠে যায়। গফুর বুড়িকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে হাজার রকম চেষ্টা করে। জানে ও আগলে ধরে না রাখলে বুড়ি ভেঙে যায়। ওর চোখ দিয়ে জল গড়ায়। চুপচাপ গিয়ে পুকুরঘাটে বসে থাকে। আসলে পাপ নয়। পাপের কথায় গফুরের বিশ্বাস নেই। পবিত্র ফুলের মত বুড়ি। পাপের স্পর্শ কেন থাকবে ওর জীবনে। ও তো কোথাও কোন ফাঁকি দেয়নি। কাউকেও ঠকায়নি। তবুও কেন যে এমন হয়ে যায় জীবনটা!

এক সময় যৌবনের দিন ফুরিয়ে যায়। শীতে বর্ষায় বসন্তে টুপটাপ পাতা অনবরত ঝরে। বিরোধহীন দিনগুলো নির্বিবাদে গড়ায় ওদের। জলিল কয়েকবার গায়ে এসেছে একবারও দেখা করেনি বুড়ির সঙ্গে। ওর মেয়ে হয়েছে দুটো। কারো কারো কাছে জলিলের কথা জিজ্ঞেস করে বুড়ি। ও নাকি ভালই আছে। শহরে একটা দোকান। করেছে। এখন আর রিকশা চালায় না। গফুরের স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। হাঁপানি ধরেছে। ওকে। জমজমাট কাশি। রাতে ঘুমোতে পারে না। ঘোলা চোখে বুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর জন্যে খারাপ লাগে। বুড়ির শরীর এখনো ভাঙেনি। ও কোমর সোজা করে হাঁটে। গফুরের হাঁটতে কষ্ট হয়! কিছুই ভালো লাগে না। মনে হয় দিন ফুরিয়েছে। তখুনি বুকের ভেতর আকাঙ্ক্ষা চড়চড়িয়ে বাড়ে। যৌবনের দিন ফিরে পেতে ইচ্ছে করে কেবল। পায় না বলে মেজাজ খারাপ থাকে। সবার সঙ্গে রাগারাগি করে। রইসকে দুমদাম পিটুনি দেয়। বুড়ির সঙ্গে খেকিয়ে কথা বলে। ও রাতদিন সেবা করে। গফুরের মন ভরে না। সব সময় খুঁতখুঁত করে। একদিকে অসুস্থ স্বামী, অন্যদিকে পঙ্গু ছেলে দুয়ের মাঝে ও হিমশিম খায়। কখনো সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। জলিলের কথা মনে হয়। জলিল ওর সঙ্গে আর দেখা করে না। অনেকদিন ও গাঁয়ে আসে না। শহরে জলিল বেশ গুছিয়ে বসেছে। জলিলকে দেখার বড় সাধ হয়। যখন ও কাছে আসতো তখন অত টান ছিল না। দূরে সরে গিয়ে জলিল বুড়িকে উদাস করে দিয়েছে। এখন ওর মনের মধ্যে ব্যাকুল আর্তনাদ।

বুড়ি বুঝতে পারে না যে বুড়ো বয়সে গফুর কেন এত বদলে গেল? যে মানুষটা ওর জীবনের চারদিকে একটা বেড়া রেখেছিল সে এখন বেড়া ভাঙা পাগলা ঘোড়া। ওকে তছনছ করে দিতে চায়। ওর জীবনে এখন পারিবারিক শান্তি নেই। গফুর ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া বুড়িকে আক্রান্ত করে রাখে। রইসকে নিয়ে ক্ষেতে লাল শাক তুলতে গেলে ওর সঙ্গে কথা বলে, বুঝলি রইস তোর বাপটা একটা আস্ত হারামী। মাগো মা এমন লোক আমি দেখিনি। হতো যদি আমার জলিলের সঙ্গে বিয়া তাহলে ঠিক হতো। এখন শহরে থাকতে পারতাম রে রইস। উঃ কি যে মজা হতো। কেমন করে গাড়ি যায় ভো বাজিয়ে দেখতে পেতাম। দেখতাম শহরের মানুষকে। রইসরে তুই বড় হয়ে শহরে একটা চাকরি নিবি। তারপর আমাকে নিয়ে যাবি শহরে। ছয় মাস রাখলেই হবে। কি রে পারবি না? অমা হাঁ করে দেখছিস কি?

রইস অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে থাকে। চট করে একটা লাল শাকের মাথা ভেঙ্গে বুড়ির দিকে এগিয়ে দেয়। রইসকে বুকে তুলে কেঁচড় ভর্তি লাল শাক নিয়ে ঘরে ফেরে। রান্না ঘরের দাওয়ায় পা ছড়িয়ে শাক বাছতে বসে। ঘর থেকে গফুরের কাশির শব্দ আসে। বুড়ি, বুড়ি করে কয়েকবার ডাকে। ও সাড়া দেয় না। দিতে ভালো লাগে না। গফুর ডেকে ডেকে চুপ করে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *