০৩. রাজচন্দ্র বললো

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

০১.

রাজচন্দ্র বললো–কেট, ডার্লিং, রবিবার কথাটা শিখলাম তোমরা গ্রামে আসার পরেই। জানলাম সেটা সপ্তাহের প্রথমে না এসে শেষে আসে, বিশ্রামের দিন হয়ে। কিন্তু হায়, দ্যাখো, রবিবারেই তোমার কর্তা কর্মব্যস্ত। ইতিমধ্যে শিব স্থাপন দশদিনের পুরনো ব্যাপার।

-আপনার কি কাজ ছিলো, রাজকুমার? কেট বললো।

রাজকুমারের কাজ থাকে এ-সংবাদ তোমাকে কে দিয়েছে মনস্বিনী?

ডেস্কের উপরে একগোছা খবরের কাগজ। পায়চারি থামিয়ে রাজচন্দ্র কাগজের গোছাটাকে কোলের উপরে তুলে নিয়ে একবার ডেস্কের উপরে পা ঝুলিয়ে বসলো।

স্থানটা হেডমাস্টার চন্দ্রকান্ত এভুজ বাগচীর বসবার ঘর। তখন রবিবারের সকাল আটটা হবে।

 কেট বললো– হেসে-ওটা কী সম্বোধন হলো?

-কোনটা? মনস্বিনী? ওর মানে তুমি এক মনের অধিকারিণী। রূপসী বলে সম্বোধন করলে কেউ আপত্তি করতে পারে, তাই মনকে সম্বোধন। কিন্তু এই কাগজগুলো কী? কীই-বা লেখে তা বলো বরং।

কেট সেলাই-এর ঝুড়িতে উলকাঁটা রেখে রাজুর দিকে চাইলো। সে উঠে রাজকুমারের। কাছে এসে দাঁড়ালো। ঠিক এই সময়ে সদরদরজায় বাঁধা রাজকুমারের ঘোড়া হুঁডই করে নাক ঝাড়লো। তার সাজ-লাগামের মৃদু শব্দ উঠলো।

তা শুনে হাসিমুখে বললো– কেটকী চঞ্চল!

রাজকুমারের দিকে চেয়ে তার কিন্তু একটু অবাক লাগলো। ন-দশ মাস পরে সে আবার রাজচন্দ্রকে দেখছে কাছে। ইতিমধ্যে বোধহয় সে আর একদিনই দেখেছিলো তাকে। জানলায়। পথের ধার ঘেঁষে কী যেন ভাবনা নিয়ে চলেছিলো রাজকুমার। অন্যদিকে, রাজচন্দ্র নিজে কেটদের বাড়িতে না এলেও বাগচী গত একমাসে অনেকদিনই রাজবাড়িতে গিয়েছে। সন্ধ্যায়। তার অনেকগুলিই রাজকুমারের বৈঠকখানায় কেটেছে তা কেউ জানে। কথাটা। এখানে এই : কিছু সময়ের ব্যবধানে দেখে অবাক লাগছে আজ। পাহাড়ী শহরে হাওয়া। বদলে এলে পরিচিত লোককে এমন দেখায় নাকি? গাঢ় হয়েছে রংটা। সরু জুলফি দাড়ি চিবুকের নিচে ছোটো এক ইম্পিরিয়ালে মিশেছে। অনুমান, মানুষটিও বেশ কিছুটা উচ্চতায় যেন বেড়েছে। এসবেরই এই কারণ হতে পারে, যেমন বাগচী বলেছে, যে দিনের বেশির ভাগ সময় রাজকুমারের মাঠে জঙ্গলে কাটে শিকারের খোঁজে অথবা নিছক ঘোড়া ছুটিয়ে। কিংবা সময় কাটে উত্তর-পশ্চিম সংযুক্ত প্রদেশে বেড়িয়ে।

-কিন্তু এগুলো তো পুরনো কাগজ। বললো– কেটরাজবাড়ি থেকেই এসেছে।

–তা হোক না। কিংবা বলো কী ভাবছো অমন গাল লাল করে?

কই, কোথায়? কিংবা যদি বলি অনেকদিন পরে দেখছি, এখন রাজকুমারকে আরো সুন্দর দেখায়। কিন্তু এখন কাগজ থাক। তার চাইতে বলুন কর্তার খোঁজ কেন?

–এই দেখ, পুরুষের কত দরকারীকথা থাকে। বললো– রাজকুমার। একটু পরেই আবার হেসে বললো, তাই বলে তুমি ব্যস্ত হয়ো না। এখন এখানে নিছক আড্ডা। আড্ডার খোঁজেই এসেছি।

-সে তো রোজ সন্ধ্যাতেই হয়।

–রোজ নয়, সুভগে, মাঝে মাঝে বলতে পারো। তাও ইদানীং।

-রোজ হলেও আপত্তি নেই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয় কী করেন আপনারা আড্ডায়?

রাজু হাসলো–বলতে পারো খুব ভালো ক্লারাট আর সত্যিকারের টার্কিশ। অথবা তোমার জানাই ভালো, কর্তাকে তোমার বিপথে নিচ্ছি না। আপাতত পিয়েত্রোর স্বজাতি অর্থাৎ ফরাসীদের সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা চলছে। ভারি কৌতুকের, জানো? পিয়েত্রো ফরাসীদের সম্বন্ধে অনেক কথা আমাকে বলতেন, কিন্তু যাকে ফরাসীদের বিদ্রোহ বলে সে সম্বন্ধে দেখছি বিশেষ কিছুই বলেননি।

–আপনার কি সেসব গল্প ভালো লাগতো? অত রক্ত আর শানানো ধারালো গিলোটিন?

-তা জানতে পারলে গল্পটা অত করে শোনার দরকার হতোনা। আমার তো মনে হয়েছে ওটা এক ধরনের ব্যর্থতা। কিছু পুরনো ধারণা বদলেছে। রাজাকে বরতরফ করে ওরা বুঝতে চেয়েছিলো রাজা আর ঈশ্বর এক নয়। কিন্তু তা বুঝতে অত নরহত্যা দরকার ছিলো না। পিয়েত্রো এজন্যই বোধহয় আলাপে আনতো না ওটাকে।

একটু ভেবে আবার বললো– রাজচন্দ্রকার কোন গল্প ভালো লাগবে তা কি আগে বলা যায়? বেশ লাগে তোমাদের রাজা চার্লসকে। তোমাদের রাজা চার্লস আর ফরাসীদের সেই সব মার্কুইস,কাউন্ট কেউ মৃত্যুভয়ে কাঁদেনি বলেই গল্পগুলো ভালো লেগে থাকবে আমার।

কথাটা শুনে কেট অবাক হয়ে গেলো।

রাজু বললো–তুমি নিশ্চয়ই জানো রানী মারিকে ওর যখন নিয়ে যাবে গিলোটিনে, তখনো কিন্তু তিনি তাঁর সাজপোশাকে ত্রুটি করেননি। তারা কেউ কিন্তু বলেননি, যা করেছি ভুল করেছি। সূর্য-ডোবার মতো ব্যাপার নয়? তেমনি ম্লান হয়ে যাওয়া কিন্তু অনেক রঙের মধ্যে। কোনো অনুতাপ নেই।

এসবই আড্ডার বিষয় নাকি আপনাদের। বিষণ্ন শোনালো কেটকে।

–বিষয়টা দুপক্ষের জানা না থাকলে কী আলোচনা হয়? বাগচী বলেন, আমি শুনি। এলোপাথাড়ি প্রশ্ন করেকখনোতার অসুবিধা ঘটাই। ভেবেছো তার সঙ্গে আমার মত মেলে? তার কাছে সব ব্যাপারটাই খারাপ। মানুষকে সমাজের চাপে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয়েছিলো। তারা যখন চাপ থেকে বেরিয়ে এলো তখন তাদের স্বভাবতই বিকলাঙ্গ সুতরাং কুৎসিতই দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু ভেবে দ্যাখো তোমাদের রাজা চার্লস ফরাসীদের রাজা লুই আর এদেশের রাজা বাহাদুর শা-এর মধ্যে কত তফাত! শুনেছি সে বুড়ো। জীবন ভোগ করার কোনো ক্ষমতাই আর নেই। কিন্তু মরতে জানলো না, ছি!–অবশ্য একা বাহাদুর শা নয়। অনেক নকল নবাব, অনেক নকল রাজা কেউ এ শহরে, কেউ অন্য শহরে বৃত্তি ভোগ করছে। জানো কলকাতায় এক ভালো গাইয়ে নবাব আছেন? ভালো ঠুংরি গান?

-যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। হেরে গেলে কী করা যায়?

-ও কেট! তুমি রীতিমতো মেয়েমানুষ। রাজু হেসে উঠলো। রাজা সন্ধি করতে পারে, কিন্তু নিজেকে বন্দী করতে দেবে কেন? তাও ব্যবসাদারদের বেনিয়ানের মতো বৃত্তি ভোগ করতে?

কেট বললো–বাহাদুর শা-এর উপরে আপনার ভয়ানক রাগ।

যথেষ্ট, যথেষ্ট। হাসি হাসি মুখে বললো– রাজু-মাঝে মাঝে বরং মনে হয়, অনেকদিন থেকেই মোমভরা নকল মোতির মতো নকল বাদশা ছিলেন দিল্লীর ভদ্রলোকেরা। কী যেন, দিল্লীসে পালাম তক। যেমন অন্য কোথাও কেউ নকল রাজকুমার থাকতে পারে।

কেট রাজুর মুখের দিকে চাইলো।

কিন্তু তখনই আবার বললো– রাজকুমার–অয়ি স্বর্ণলোচনে, গৃহকর্তা আসছেন না, তোমার হাতের সেবা চাই। রাজকুমার তো বটি। এসো এই কাগজটা পড়ো, নয় পিয়ানোর টুলে যাও, এসোনা হয় একসঙ্গে বাজাই, অথবা কী যেন সেই উষ্ণ পানীয়, কফি নয়?

কেট হেসে বললো–হবে রাজকুমার। এই বলে সে ত্বরায় কফি আনতে গেলো।

কেট যতক্ষণ কফি করে আনতে গেলো রাজু উঠে পায়চারি করছিলো। বাগচীর টেবলে এবং শেফে অনেক বই। রাজু হাত দিয়ে না ছুঁয়ে দেখলো। বাংলা হরফের বইও আছে। তার একবার ইচ্ছা হলো উল্টেপাল্টে দেখে কী আছে এসব বই-এ। এতসব লেখা, এ কি লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনাই শুধু, না, অন্যের মতামতের সংকলন? অন্যের মত বললেই কীবাসি মনে হয়না? কলকাতায় যেনানা মতের প্রচার চলছে তা নিয়ে একদিন আলোচনা হয়েছিলো–তখন হঠাৎ মনে হয়েছিলো রাজুরকী আশ্চর্য, সকলেই যেন নিজের মত দিয়ে সত্যটাকে ঢাকতে চায়।

সেসব মত দিয়ে জীবনের কোনো গূঢ় সূত্র খুঁজে পাওয়া দূরের কথা, নিজের চারপাশটাকেও চেনা যায় না। ভাবতে ইচ্ছা করে, কিন্তু লক্ষ্য করেছে যে কোন বিষয়ে ভাবতে গেলেই অন্য কারো মত এসে যেন মাঝখানে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে যায়। অনেকসময়ে মনে হতে পারে সে দেয়ালের গোড়ায় পৌঁছে যাওয়াই যেন চিন্তার ভবিতব্য।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজকুমারের জন্য কফিসেট সাজিয়ে আনলো কেট।

রাজু চেয়ারে বসলে কফি করতে করতে সে ভাবলো ভাগ্যে কফিটা সকালেই ভাজা হয়েছিলো। কফি ঢেলে দিয়ে বললো–আপনি বাহাদুর শা হলে কী করতেন, রাজকুমার? আচ্ছা, এখন এত সকাল, আপনার ছোটো হাজির হয়েছে তো? কিংবা রাজকুমার, বাহাদুর শা একা কেন? নেপোলিয়ন কী বন্দীদশা স্বীকার করেননি? কেট পাশের চেয়ারে বসলো নিজের জন্য ছোট্ট একটা কাপ ভরে নিয়ে।

–যা প্রমাণ করা যায় না, বলে লাভ নেই। আমি হয়তো বাহদুর শা-এর চাইতেও নিরেস কিছু করতাম।

-কিন্তু এরকম প্রবাদ আছে, বাঁচতে সবাই চায়। যুদ্ধক্ষেত্রে যার বুকে গুলি লেগেছে সে-ও। কেট হাসিমুখে আলাপটা চালিয়ে গেলো।

পেয়ালা হাতে নিয়ে রাজু বললো–প্রবন্ধটা শুনলাম, কিন্তু যুক্তিতে আমার সন্দেহ আছে। কেট। আঘাতটা যার সত্যি ভয়ঙ্কর, তাই সেই অবস্থায় সে বোধ হয় বাঁচা-মরার কথা ভাবে না। হয়তো জল চায়, সেটা শরীর; হয়তো বলে শীত লাগছে, সেটা শরীর। বর্তমানটাই তখন তার কাছে প্রবল, যদি তার চিন্তা করার ক্ষমতা থাকেই।

কেট বললো–রাজাও তো মানুষ। তারও শরীর আছে। তারও তো ব্যথা লাগে।

রাজকুমার হেসে উঠলো : এতদিন তুমি তাই জেনেছো? রাজা একটা ধারণামাত্র, তার শরীর কোথায়? সব রাজা জানে না, কিন্তু জানা তো উচিত যে রাজা অনেকগুলি মানুষের স্বাধীনতার ধারণা; শক্তির ধারণা। সেটা গেলে রাজাই-বা কোথায়? শরীরটা? তোমাকে একটা খুব গোপন কথা বলে দিই। তরকারি কাটতে কখনো আঙুল কেটেছো? কিংবা রান্না করতে আঙুল পুড়িয়েছো? গলা কেটে গেলে তার চাইতে বেশি যন্ত্রণা হয় না। কিন্তু তাই বা কেন? সকলে কী চায়, আর রাজা কী চায় তার মধ্যে পার্থক্য থাকবে না? সারা জীবন সকলের থেকে পৃথক, আর মৃত্যুর সম্মুখে একাকার তা হয় না, হলে অন্যায় হবে।

রাজুর হাতে কফির কাপ, সামনে কেট, রবিবারের আবহাওয়াই। তবু মুখটা এমন দেখালো রাজুর যে অনুমান হবে, সে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে।

কেট বললো–এটা একটু খেয়ে দেখবেন? এই বলে সে নিজে হাতে একটা পেস্ট্রি তুলে রাজকুমারের হাতে দিলো।

 বললো– আবার–শুনেছি লুই-এর রাজত্বে প্রজার কষ্টের সীমা ছিলো না! জনসাধারণ অত্যাচারী রাজার বদলে নিজেদের শাসন চাইছিলো।

-তোমারও তাই মত? কেক দেখে মনে হচ্ছে? কিন্তু বলো তো আবার নেপোলিয়ন অত সহজে সম্রাট হলেন কী করে? তার অধীনে যুদ্ধ করতে গর্ববোধ করেছিলো তারাই যারা ব্যাস্টিল ভেঙেছিলো। সেই প্রজাদের অত্যাচারী এক দলকে সরানোর ইচ্ছা ছিলো। তাদের দোষ দেওয়ার কিছু নেই। তাদের নিশ্চয় নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগানোর অধিকার আছে। অত্যাচার তাদের অমানুষের স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলো, তাদের ঘৃণায় হিংসায় রাক্ষুসে চেহারা ধরা পড়েছিলো। কিন্তু সেটা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। অন্যপক্ষ কী করেছিলো, যা করলে তাদের মানায় তা করেছিলো কি না আমরা এতক্ষণ তাই ভাবছিলাম। রাজা লুই মরতে জেনেছিলো তা মনে করো আবার।

–তাহলে কি বলবো নেপোলিয়ন লুই-এর চাইতে ছোটো ছিলেন?

দ্যাখো, খটকা আছে। তিনি একবার যেমন নির্বাসন থেকে প্যারিসে ফিরেছিলেন শেষ পর্যন্ত আবার তেমন ফেরার আশা করেছিলেন হয়তো। ওদিকে ইংরেজরা যে তাঁকে সেঁকো বিষ দিচ্ছে তা জানতে পারেননি। আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডে তখন রানী না থেকে রাজা থাকলে এমন কাণ্ডটা ঘটতো না।

–কি সর্বনাশ!

-কোনটি? সেঁকো বিষ, না মেয়েলি চক্রান্ত? দ্যাখো সেঁকো বিষের কথা বাগচী বিশ্বাস করেন না। আমি করি, কারণ পিয়েত্রো বলেছে বলেও বটে। রাজু হাসলো। বললো, আবার–দূর করো ইতিহাস। তুমি কি মনে করো আড্ডাটা আমাদের পাঠশালা? সেখানে ক্লারাট নেই? আর এখানে তুমি ক্লারাট-গ্লাসের চাইতেও মনোহরা, তোমার কফি এবং পিঠেও। তুমি বোধহয় এদেশী পিঠে খাওনি। এই শীতকাল, নয়নতারার এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

শুনলাম তিনি গ্রামে ফিরেছেন।

এসেছেন? আর একটু কফি দিই? কেটের মুখ উজ্জ্বল হলো।

–অবশ্যই নয়। বরং ডেস্কে চলো। তোমরা কি ভেবে দ্যাখোনা, কারোই দৃষ্টি নেই যে, কিছুদিনের মধ্যেই এ গ্রামের বইপড়া লোকেরা তোমার স্বামীর স্কুলের কল্যাণে অনায়াসে আমাকে মূর্খ বলতে পারবে। বুঝতে পারছি তুমি আমার প্রেমিকা নও।

-তা আমি জানি। কেট বললো– নতুবা নয়নঠাকরুন যতদিন ছিলেন না তখন অন্তত একবারও দেখা পেতাম। বরং উল্টো।

কেট হাসলো। হাসতে গিয়ে কি তার গালে রং লাগলো? আর সেজন্যই যেন এক মুহূর্ত আগে সে যা ভাবছিলো কথার আড়ালে তা অবিশ্বাস্য হলো। স্বভাবতই চিন্তাটা মাতৃভাষাতেই হয়। কিংবা তাকে চিন্তা না বলে অনুভূতি বলা সঙ্গত, একটা অনুভূতি যা শব্দের আকৃতি নিচ্ছে। হঠাৎ কথাটা মনে এসেছিলো কেটের নিজের ভাষাতেই-সিড অব ডেথ। এখন আবার রাজকুমারের মুখের দিকে চেয়ে তার মনে হলো তা কি হয়? মৃত্যুর বীজ কি এমন একজনে লুকিয়ে থাকে?

রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের দিকে গেলো। তাতে যেন ঘরের আলোটা নড়ে উঠে উজ্জ্বল হলো।

কেট তখন ভাবলো পরের ভাবনাটা। এই যে রাজকুমার বললেন লেখাপড়ার কথা–এর মধ্যে সত্যি কি গ্লানি আছে? গ্রামের কথাই নয়। কলকাতাসমেত গোটা দেশটাকে একটা সমাজ মনে করলে আধুনিক মানুষদের বই পড়াটাই একটা লক্ষণ। রাজকুমার পড়েন না। কিন্তু এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত কিছু বলতে পারোনা। কথাগুলো কী তার ক্ষোভ প্রকাশ করে? কিংবা সিনিসিজম? যেন কোনো বিষয়েই আস্থা নেই। সেজন্য সবকিছু এমনকী নিজের অস্তিত্বও ঠাট্টার বিষয় হতে পারে।

-আচ্ছা, রাজকুমার, এই বলে সে থামলো। কথাটা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলো, সুতরাং একটু চেষ্টা করে হেসে বললো, আর কী বলবে আমার স্বামীর ছাত্রেরা?

ডেস্কের সামনে দুখানা চেয়ারে বসলো দুজনে।

কী বলবে? রাজকুমার! আমাদের জমিদার অন্য জমিদারের চাইতে ভালো। রাজচন্দ্র ভাবলো, কেটের জানার কথা নয় জমিদার জাগীরদারে কী তফাত থাকতে পারে, আর এখন তফাতও নেই। এ ভাবটাকে বরং তাড়াতাড়ি অন্য কথার আড়ালে ফেলে দেওয়া ভালো।

সে বললো–বেশ, বলুক। এখন তুমি বলো লাঞ্চো কাকে বলে?

–আর, রাজকুমার!

-ঠিক বলিনি তবে? আমার কী হবে? ওদিকে শুনেছিকলকাতায় যেতে হবে কিছুদিনের মধ্যে যেখানে নাকি ওসবই ব্যবস্থা। আমার অবস্থাও দেখছি তাহলে ডানকানের মতোই। সে শুনেছি মনোহরকে মানোআর কালীমাঈকে কুল্লিমাদার, বাঈকে পাই বলে।

-ঠিক শিখলেই বা দোষ কী? কথাটা লাঞ্চ আর এটা ডেস্কো নয় ডেস্ক।

–আর এই কাগজটা টাইমেস নয় টাইমস। অগ্রসর হও। কিংবা থাক। লাঞ্চোর বয়ান একদিন আমাকে শুনতেই হবে, দু-দুবার বড্ড বেশি হবে। কাগজটাই পড়ো।

-কিন্তু কাগজটা তো অনেক পুরনো।

–হায়, বরাননে!

কাগজটা টাইমসই বটে। কেটের বাড়িতে নতুন। হরদয়ালের কাছ থেকে কালই মাত্র সংগ্রহ করেছে বাগচী। এবং তার মূলে লাঞ্চে কীবলের আলাপ। অন্যদিকে কাগজের তারিখটা ছ মাসের পুরনো। ইংল্যান্ড থেকে আসতেই তো সময় নিয়েছে।

এখানে একটা চমৎকার যোগাযোগের ব্যাপার ঘটে গেলো। কাগজের প্রথম পাতার ডান দিকে বিশেষ টাইপে একটা সংবাদ। রাজচন্দ্ৰ আঙুল দিয়ে সেটাকে দেখিয়ে বললো–এখানে নিশ্চয় কিছু মজার খবর থাকবে। ফ্লোরেন্সের খবর নাকি? বাগচী বলছিলেন ফ্লোরেন্স নাকি ভাস্কর্যের পীঠস্থান। সেটা কী ইংল্যান্ডের কাছে? নাকি নাইটইনজেল। দ্যাখোদ্যাখো ঠিক পড়লাম নাকি।

কেট রাজুর কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে কাগজ দেখতে শুরু করলো। সে অবাক হলো। নামটা সে-ও এই সেদিনমাত্র শুনেছে কীবলের মুখে। কাগজ খুলে তারই সংবাদ পাওয়া। যাবে ভাবতে অবাক লাগেনা? খবর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের। অন্যদিকে এতে বিস্ময়ের কী বা আছে! প্রায় ছয় মাসের কাগজ একত্রে। তখনকার ইংল্যান্ডে দু মাসে একবারও ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সম্বন্ধে ছোটো বড়ো কোনো সংবাদ থাকবে না এমন সম্ভব ছিলো না।

-লও, পড়ো–বলে রাজু কাগজটা কেটের হাতে দিলো।

কেট কাগজ নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। অবাক হলে যেমন হয়, মনে মনে পড়তে ভুলে গেলো। পোপোজ্যাল ফর ওপনিং এ ট্রেনিং স্কুল ফর নার্সের্স আট সেন্ট টমাসেস হসপিট্যাল। (সেন্ট টমাসের হসপিটালে নার্সদের জন্য ট্রেনিং স্কুল খোলার প্রস্তাব)।

বাংলায় বলো। বললো– রাজু।

কেট পড়ে বাংলায় অর্থকরে সংবাদটাকে এইরকম দাঁড় করালো। ক্রিমিয়ার অভিজ্ঞতার পর এই ধরনের প্রস্তাব যা মিস নাইটিঙ্গেলের দূরদৃষ্টি ও সাহসিকতার পরিচয় এবং একমাত্র তার কাছে থেকেই আশা করা যায়। এ বিষয়ে এ রকম মনে করা হচ্ছে স্যার সিডনি হার্বাটের সহানুভূতি পাওয়া যাবে। কবি আর্থার ক্লাপ এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সেন্ট টমাসের এই ট্রেনিং স্কুল যে গোটা পাশ্চাত্য জগতের হসপিটালে নার্সিং-এর ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন আনবে তাতে সন্দেহ নেই। মে-ফেয়ারের এই মহিলার অন্যান্য ব্যাপারে যেমন দেখা গিয়েছে নার্স ট্রেনিং-এর ব্যাপারেও নিশ্চয়ই অনেক সদ্বংশজা কুমারী এগিয়ে আসবেন।

রাজু বললো– কী রকম হলো ব্যাপারটা? নার্স কারে কয়? খুলে বলল।

সংবাদটা কেটকেও ভাবিয়ে তুলেছিলো, সে বললো–নার্স মানে জানি, কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে হতভম্ব করছে। সদ্বংশের এক মহিলার পক্ষে কেন, কোনো সৎ মহিলার পক্ষেই কি নিজের বাবা ভাই স্বামী ছাড়া আর কাউকে সেবা করা সম্ভব? বলুন, তা যায়? আর তিনি কিনা মে-ফেয়ারের মহিলা!

কেট ভাবলো, কীবল তাহলে উল্লেখযোগ্য খবর হিসাবেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের নাম করে থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে আলাপ এগোয় না, কারণ রাজু হসপিট্যাল দেখেনি, নার্স দূরের কথা। কেট রাজচন্দ্রকে বোঝনোর জন্য তুলনা দিলো–মনে করুন মিস নাইটিঙ্গেল নয়নতারার মতোই একজন রুচিবতী সুন্দরী মহিলা, যার স্যার সিডনি হার্বাটের মতো একজন শক্তিশালী বন্ধু আছেন।

রাজু হো-হো করে হেসে উঠলো। বললো–তাহলে আমাকেও তো একটা হসপিটাল করে দিতে হয়। সেখানে একা ফ্লোরেন্স, এখানে তুমি আর নয়ন।

রাজু বললো–দ্যাখো আর কী খবর আছে। চীনের খবর নাকি? টাইপিং কী? বিদ্রোহ বলছেনাকি? তাহলে একপক্ষে চীন? অন্যপক্ষে ইংরেজ নাকি? থাক থাক। কী যেন বললে, স্যার সিডনি হার্বাট না কী? তা তিনি আবার কীসের কারবারী? তুলল, না কয়লা?

-সিডনি হার্বাট বোঝা যাচ্ছে মন্ত্রী। তাছাড়া তিনি নাইট; জানেন রাজকুমার, আমাদের দেশে নাইটদের কিন্তু খুব সম্মান।

বটে? আমি শুনছিলাম তোমাদের দেশে কলওয়ালারাও আজকাল নাইট, লর্ড এসব হচ্ছেন।

বারে কলওয়ালা কি মানুষ নয়?

রাজচন্দ্র দুষ্টুমি করে চোখ সংকীর্ণ করলো, বললো–নিশ্চয়ই, আমারই ভুল। নেপোলিয়নও তো একজন সৈনিক ছিলেন মাত্র। তাছাড়া আমাদের দেশেও এখন অনেক নুনের বেনিয়ান, মুদি ইত্যাদি আকছার রাজা হচ্ছেন। কলকাতা আর লন্ডনে একই রীতি দ্যাখো। সেখানেও কি দশশালা?

খবরের কাগজ পড়া আর হলো না। রাজুর কিছু মনে পড়লো যেন। চেনে ঝোলানো ঘড়িটাকে বার করে সময় দেখে আবার তা জেবে ঢোকালো। এটা নিশ্চয়ই আলাপে একটা ছেদ।

রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। বললো–ওটা আমারই ভুল, কেট। তুমিই ঠিক বলেছো। বেঁচে থাকতেই হয়! নেপোলিয়নও অনেকদিন তার সেই মেঘে অন্ধকার দ্বীপে বেঁচে ছিলেন, বন্দী হয়েও, সেঁকো বিষ সত্ত্বেও।

আপাতত আমি বিদায় নিচ্ছি, স্বর্ণময়ী, হেডমাস্টারকে বোলো আজ যে দাবা খেলার কথা ছিলো সন্ধ্যায় তা হবে না। আজ হৈমী তাস খেলবে বলেছে। তাই সকালেই মিটিয়ে নিতে এসেছিলাম।

দরজার কাছে কেট বললল–এখন কোথায় যাবেন?

বিলপাড় থেকে ওদের আসবার কথা। গোটাকয়েক কুমীর নাকি ভারি উপদ্রব করছে। শিউরে উঠলে তো? যদি পাই চামড়াটা তোমাকে উপহার দেবো। এতদিন তো ক্রোকোডাইল নামটাই শুনেছো।

রাজকুমার, ক্রোকোডাইল মানুষের ক্ষতি করে না?

রাজু হেসে বললো–শক্ত চোয়ালে দুসারি ছুরির ফলা। সেই চোয়ালে মানুষকে ধরে জলের তলায় নিয়ে শুধু কি চুম্বন করে?

সদরদরজার আড়কাঠে বাঁধা লাগাম খুলে ঘোড়াটাকে সড়ক অবধি হাঁটিয়ে নিলো রাজু। ঘোড়াটা নতুন। গাঢ় খয়ের রং। আর বেশ উঁচু।

রাজু রাস্তা বরাবর চেয়ে হাসিমুখে ভাবলো, ও ব্যাপারে সে কেটের কাছে ঠকেছে–ওই জীবন-মৃত্যুর কথায়। নির্জন, সব সময়ে মেঘ আর স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার একটা দ্বীপের কথাই মনে হলো। নিঃসঙ্গ নয়? খুবই নিঃসঙ্গ, নিকটজন কয়েকজন থাকা সত্ত্বেও কেন ঠিক বলা যায় না বটে, কিন্তু বেঁচে থাকতেই হয়। আমাদের চিন্তাভাবনা সত্ত্বেও, জীবনের যেন নিজস্ব একটা টান আছে। মনে হয় যার জীবন আর যে ভাবে তারা এক নয় যেন।

তার মুখের হাসিটা সরে গেলো।

কেট রাজকুমারের পাশে পথের উপরে এসে দাঁড়িয়েছিলো। এমনটা সেবাগচীর জন্যও পারতো না। (সে অবশ্য এটাকে চিন্তাতেও আনলোনা)। ঠিক এ সময়ে সে নিজেকে অত্যন্ত দুর্বল বোধ করলো। সে রাজকুমারকে কিছুতেই বিপজ্জনক কুমীরগুলো থেকে দূরে রাখতে পারে না। কোনো জোরই নেই।

সামনে দিকে চাইতেই সে দেখতে পেলো, একজন তাদের দিকে হনহন করে আসছে। দূর থেকে তাকে ইউরোপীয় পোশাক পরেছে মনে হয়। কারো কারো হাঁটায় এমন বৈশিষ্ট্য থাকে যে তা-ই তাকে চিনিয়ে দেয়।

কেট বললো– রাজকুমার, স্কুলের নতুন ইংরেজি মাস্টারমশায় কী আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলো?

রাজুও সামনের দিকে চেয়েছিলো। বললো–কে, মিস্টার নিওগি? তিনিই তো আসছেন মনে হচ্ছে। এবং যথারীতি খুবই ব্যস্ত।

কেট বললো–ভদ্রলোক যেন সব সময়েই সময়ের অভাবে বিব্রত।

রাজু হেসে বললো–দুষ্টুমেয়ে, তা তুমি ওঁকে বলতে পারো-আমার এত সময় আছে, তা থেকে ওঁকে আমি বেশ কিছুটা দান করতে পারি।

রাজচন্দ্র সওয়ার হতেই ঘোড়া চলতে শুরু করলো।

কেট ততক্ষণই দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ ঘোড়া এবং সওয়ার অদৃশ্য না হলো। তারপর সে আবার বসবার ঘরেই ফিরলো। এখন তার কাজ আছে বটে লাঞ্চের জোগাড় করতে হবে। তাহলেও একটু বসে নিতে পারে। উলকাঁটার ঝুড়িটাকে সে কাছে টেনে নিলো।

মিস নাইটিঙ্গেলের কথাই কি সে ভাবছিলো? সে আর কোনোদিনই হয়তো ইংল্যান্ডে যাবে না, কিন্তু মে-ফেয়ারের এই মহিলার ব্যাপারটা কিন্তু ভারি কৌতূহলের।

কিন্তু রাজকুমার? (যেন সে ঘোড়া এবং তার সওয়ারকে আবার দেখতে পেলো)। তাঁর কথাগুলো কি আজকের সকালের মেজাজই মাত্র? চার্লস ও নেপোলিয়র মৃত্যু নিয়ে বলা কথাগুলো?

এবার তার মনে এলো যা সে যেন মনে মনে খুঁজছিলো। বিষণ্ণ হলো তার চোখ দুটি। সত্যি কি তা মৃত্যুর বীজ হতে পারে?

সিড অব ডেথ যার ইংরেজি হবে? যা রাজকুমারের মনে আছে?

কেটের এখন মনে হলো রাজকুমার এখন ঘোড়াতেই চলেছেন বটে, তা কিন্তু পথের পাশ দিয়ে, আর অমন তেজী ঘোড়াটাও যেন ধীরে চলেছে।

.

০২.

সেদিন শিকার হয়নি, দিন সাতেক পরের এক সকালে দেউড়িতে বিলমহলের লোকেরা রাজচন্দ্রের জন্য অপেক্ষা করছিলো।

কিন্তু তার আগে আর একদিন সেই একজন বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক এসেছিলো রাজবাড়িতে। তার কথা বলে নিতে হবে।

দুপুরের কিছু আগে পিলখানা তদারক করে রাজু তখন সবেমাত্র ঘরে এসেছে। পিয়েত্রোর হাতিকে পিলখানায় আনা হয়েছে এখন। এমন সময়ে রানী তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

নিজের বসবার ঘরে ছিলেন রানী। রাজচন্দ্র যেতেই তিনি একটু সরে বসে নিজের সোফাতেই পাশের জায়গাটাকে দেখিয়ে বলেছিলেন বসো, রাজু।

রানীমার আসনের কিছু দূরে গালিচার উপরে একজন বর্ষীয়সী। রানীমা বলেছিলেন–এই আমার ছেলে রাজচন্দ্র, আমাদের রাজকুমার। কেমন, দেখবার মতো হয়ে ওঠেনি?

অথবা এমন কিছুই বলেছিলেন যদি রাজুর স্মৃতিকে আমরা অনুসরণ করি। রাজু তখন লক্ষ্য করেছিলো রানীর এই আসনটা নতুন। বিঘৎ পরিমাণ সিংহ-থাবা পায়ার উপরে নিচু চওড়া সোফা। চাপা রঙের উপরে সবুজ তুলোর পাতা ও ফুল আঁকা ছিটে মোড়া। এসব নিয়েই ব্যস্ত হলো রাজচন্দ্রের মন, এবং তখনই যেন এই গুরুতর সিদ্ধান্ত করলো সে, এটাও সেই বুড়ো চীনাটার কাজ। কিন্তু ততটা নিচু আসনে রাজুর প্যান্ট পরে বসতে অসুবিধা হচ্ছিলো মনে আছে।

এও রাজুর মনে আছে যে সেই বর্ষীয়সীর কপালের উপরে ঘোমটার বাইরে কিছু চুল ধবধবে সাদা, এবং সেই সাদার মধ্যে মোটা করে দেওয়া সিন্দুর। আর সে সাধারণের তুলনায় স্থূলাঙ্গী হওয়ায় তার চিবুক বোধ হয় যাকে জোড়া চিবুক বলে তেমন ছিলো। কতকটা ধানরঙের ত্বক।

সে ঘরে আরো স্ত্রীলোক উপস্থিত ছিলো। তারা বসেছিলো একটু দূরে বরং দেয়াল ঘেঁষে, গালিচার উপরেই, কিন্তু রাজকুমারের দিকে পাশ দিয়ে। ঘোমটায় মুখগুলি আধাআধি ঢাকা, গায়ে চাদর। স্ত্রীলোক কয়েকটি সুরূপা, তাদের নানা বয়স সত্ত্বেও। বিশেষ করে লক্ষ্য না করলেও তাদের কারো কানের গহনায় উজ্জ্বল পাথর, কারো বা কপালের উপরে লতানো চুলের ঝাপটা, কারো চিবুকের তিল চোখে পড়া স্বাভাবিক।

রাজু লক্ষ্য করেছিলো যেন রামধনুরই একটা টুকরো, যা তার জুতোর উপরে, পাইপধরা হাতের উপর দিয়ে সোফায় গিয়েপড়েছে। সেই বর্ষীয়সী এবং রানী আলাপ শুরু করলেন। রাজু তখন রামধনুর উৎস খোঁজ করলো। এই সিদ্ধান্ত হলো তার, সিলিং-এর বেলদার ঝড়ে সূর্যের আলো পড়েই এমন হয়েছে। চুলের ঝাপটায় নিচে চোখ দুটি নয়নতারার নয়? চিবুকের তিল, যা আঁকা মনে হয়, হৈমীরই হবে।

বোধহয় রানী বলেছিলেন রাজু, তোমাদের স্কুলের নতুন মাস্টারমশাই নিয়োগীর বোন উনি।

রাজু নিজের হাতের পাইপের বউল থেকে ওঠা অলস ধোঁয়াটাকে লক্ষ্য রাখছিলো। আর কী কথা হয়েছিলো সেখানে?

রানী কী বলেছিলেন? -ইনি তোমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছেন একটি। বোধ হয় এমন কিছু বলে থাকবেন। তারপর তিনি বললেন–তোমার স্নান হয়নি রাজু? হৈম, তুমি একটু দ্যাখো তো।

রাজু উঠে এসেছিলো সে ঘর থেকে।

নিজের মহলের যাওয়ার অলিন্দ দিয়ে চলতে চলতে রাজু একবার পিছন ফিরে চেয়েছিলো। সে দেখেছিলো হৈমী পিছন পিছন আসছে। তাহলে সেই কি কিছুদিন যাবৎ রূপচাঁদের পিছনে থেকে তার স্নানাহারাদির ব্যাপারে তদারক করছে?

রাজচন্দ্র স্নানে গেলে সেই দরবার আরো কিছুক্ষণ চলেছিলো। তারই একসময়ে মহিলাদের একজন বলেছিলো, কনের গড়ন কী রকম? বয়স তো যোলো বললেন। আমাদের হৈম, কিংবা নয়নতারা এদের পাশে কি দাঁড় করানো যাবে? যিনি গেলেন তিনি হৈম, আর ইনি নয়নতারা।

নিয়োগীর বোন বললো– একটু ভেবে–যে বয়সের যা। পনরো যোললা বছরের মেয়ের গড়ন হাল্কা হবে এঁদের চাইতে।

-খুব ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ দেখাবে না তো?

বিদ্যাপতির সেই অল্পবয়সী বালা শুনেছেন তো?

গম্ভীর রানী বললেন–আচ্ছা, এখন এই পর্যন্ত। তিনি উঠলেন। বললেননয়ন, তুমি একটু কষ্ট করো, বাছা। এঁর জন্য পালকি জোগাড় করে দাও। আর তারপর আজ তুমি আমার ঘরে খেয়ো। দুপুরে তোমার সঙ্গে কথা আছে।

রানী চলে গেলে ঘটকীকে নিয়ে নয়নতারা বার হলো ঘর থেকে। দোতলা থেকে একতলায় পৌঁছনোর আগেই একজন পরিচারিকাকে দেখতে পেয়ে পালকির ব্যবস্থা করে ফেলো। বলে দিলো, আমরা নিচের হলঘরে দাঁড়াই। পালকি এলে খবর দিও।

নিচের হলঘরে পালকি আসার আগে ঘটকী বললো–দেখুন তো কী কথা! যোলো বছরের মেয়ে যত সুন্দরীই হোক, আর এ মেয়ে সুন্দরী কিনা তা আপনারা যাচাই করুন, কিন্তু যোলো বছর কখনো পঁচিশের রূপ হয়? কথায় বলে কুঁড়ি আর ফুল।

নয়নতারা হেসে বললো–তাতে আর কী হয়েছে? বিয়েতে লাখ কথা খরচ হয় শুনেছি। রানীমার সঙ্গে আপনার পাঁচশো কথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ। আপনি কনের চিত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।

ঘটকী বললো–আসল ব্যাপার কী, টকটকে একটা লাল গোলাপ সব পুরুষের চোখেই পড়ে, তার পাশের ছোটো কলিটা তখন নজরে আসে না। কিন্তু আমাদের রাজকুমার তো বছর বিশ বাইশ হবেন। যোলোর বেশি কী করে মানাবে তার সঙ্গে? পুরুষের বিশ বাইশ আর স্ত্রীলোকের পঁচিশ-ছাব্বিশে তেমন তফাত থাকে না। কিন্তু পুরুষের ত্রিশ আর স্ত্রীলোকের তেত্রিশ-চৌত্রিশে? তখন তফাতটা আগের চাইতে বেশি মনে হয় না? তারপরেও পুরুষের যখন চল্লিশ তখন চুয়াল্লিশ বছরে স্ত্রীলোক তো বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছে। সে কী চল্লিশ বছরের পুরুষের কাছে বোঝা হয়ে পড়ে না?

নয়নতারা বললো–এসব আমি ঠিক বুঝি না।

ঘটকী হেসে বললো–তাহলেও, রানীমা, আপনার কথাকেই মূল্য দেন আমার মনে হলো। কথাটা ভেবে দেখুন। এই হৈমীসুন্দরী, খুব সুন্দরী, আহা বেচারা বিধবা। এমন রূপ রাজকুমারদের পাশেই মানাতো। আমি শুধু মানানোর অর্থে বলছি। কিন্তু এখন থেকে বিশ বছর বাদে চল্লিশ-বেয়াল্লিশে আমাদের এই রাজকুমার তো যুবকই থাকবেন। কিন্তু হৈমীর মতো একজন কী তখন পাপড়ি ঝরে-যাওয়া ফুলের মতো হবেন না?

যেন নয়নতারার মুখই শুকিয়ে উঠেছিলো। এমন অনুভব করেই সে বললো–আমি তো বললুম আমি বুঝি না। আর রানীমার কাছে আপনার এসব যুক্তিও আমি তুলতে পারি না। এ বাড়িতে তেমন প্রথা নেই।

ঘটকীর কথাগুলি অত্যন্ত হিসাবী, যেনবা দোকানে শোনা যাবে এমন। কিছুদিন আগেও, সেসব গল্প যদি সত্যি হয়, ক্রীতদাসী বিক্রি হতো। সেই বাজারে যাদের আনাগোনা ছিলো তারা এমন সব হিসাব করতে কিনা ক্রীতদাসীদের বয়স নিয়ে তা বলা সহজ হচ্ছে না। সত্যর মতো এমন রূঢ় আর কী?

.

০৩.

সে যাই হোক, আমরা রাজকুমারের কুমীর শিকারের গল্প বলতে যাচ্ছিলাম। কেটকে এক রবিবারে যা সে বলে এসেছিলো। আজ আবার রবিবার।

সংবাদটায় ভুল নেই। বেশ বড় কুমীরই। বিলে মানুষ নামে জলের জন্য, স্নান করতেও; মাছনা ধরলে চলে না; তাছাড়া গোরু বাছুর বিলের মাঝে মাঝে জেগে থাকা ডাঙায় ঘাসের লোভে জল পেরিয়ে যাওয়া-আসা করে। যা রটেছে তা সত্য হলে পাঁচ-সাতটি গোরু-বাছুর খোয়া গিয়েছে ইতিমধ্যে এবং একজন মানুষ।

রাজচন্দ্র কর্মচারীটিকে বললো–এদের যেতে বলে দাও, জলযোগ করিয়ে দিও। পিলখানায়, পিয়েত্রোর হাতিটাকে দিতে বলো তার মাহুতকে। আজই কাজে লেগে যাক।

রাজচন্দ্র যখন নিজের মহলে ঢুকছে তখন দেউড়ির পেটাঘড়িতে এগারোটা বাজতে শুরু করলো। শব্দ তার উৎসর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে । কিন্তু ততক্ষণে রাজু যেখানে পৌঁছেছে সেখান থেকে দেউড়ি চোখে পড়ার কথা নয়, বরং শব্দটা খুঁজতে গিয়ে একটা টুকরো গোলাপী দেয়াল চোখে পড়লো তার। এটার প্রয়োজনীয়তা কী? এটা ছাড়া কি এতদিন ল্যান্ডিংটাকে ন্যাড়া মনে হতো–এই চৌকোন খাড়া দেয়ালটা ছাড়া? এটা নতুন দেখছে সে ফিরে।

শোবার ঘরে ঢুকলো সে। পেটাঘড়ির শব্দ তাকে অন্যমনস্ক করেছিলো। সম্ভবত সেজন্যই ব্যাপারটা ঘটলো। সে যখন দেয়াল-আলমারি খুলে গুলির বেল্ট একটা বেছে নিয়েছে তখন তার চোখে পড়লো পালঙ্কের ওপারে ফ্রেঞ্চ উইনভোটা খোলা, তার ওপারে ঝুলবারান্দায় কেউ যেন দুহাতে কান চেপে ধরে ঘরের দিকে পিছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ঝি কি? কিংবা হৈম? এই ভেবে সে চোখ সরিয়ে নিতে গেলো, কিন্তু মস্ত এলোখোঁপা, এবং খোঁপার নিচে সাদা ঘাড় তাকে আকৃষ্ট করলো। আর ডালিমফুলী শাড়িটাও। রাজুর বুকের ভিতরে—

রাজু তাড়াতাড়ি আলমারির পাল্লা বন্ধ করলো। বললো–ও, তা, শব্দটা কি এখনো লাগছে কানে?

যে মুখ ফিরালো সে নয়নতারাই বটে।

হাসি হাসি মুখে সে বললো–আপনাকে দেউড়িতে দেখেই এসেছিলাম, রাজকুমার। ঝুলবারান্দায় এসে পুকুরে মাছধরা চোখে পড়লো। ঘড়ির ওই রাক্ষুসে শব্দ না-হলে পায়ের শব্দ কানে যেতো।

রাজচন্দ্র ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিচে খিড়কির পুকুরের জলে নৌকো, জাল টানছে জেলেরা। তীরের গাছগুলোর ফাঁকে রোদ। চিল ও বক উড়ছে, মাছ চমকাচ্ছে, মাছরাঙা ঝুপ করে জলে নেমেই উড়ে যাচ্ছে আবার। কিন্তু এই মসলিন ডালিমফুলী!

সেদিকে পিঠ দিয়ে নয়নতারা রাজুর দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো।

সে বললো–অনেক বেলা হলো। এ পোশাকগুলো এখন পাল্টালে হয় না? তার জ্ব কিছু বাঁকা হলো।

-অহো, বিস্ময়! তুমি কী আমার খানসামাকে বরতরফ করেছো ললনা? কিংবা এই জানলাম হৈমী নাকি তদারক করে। ইতিমধ্যে সে কোথায় গেলো?

-এটা কী রকম হলো? ডানকানের কাছে গিয়েছিলেন নাকি সকালে?

-তার কাছে? রাজু বিস্মিতই হলো। পরক্ষণেই ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে বরং হাসিমুখেই বললো–তোমার কি ধারণা একজন রাজকুমারকে সামান্য মদের জন্য নিজের ঘরের বাইরে যেতে হয়! রূপচাঁদ পর্যন্ত জানে ডানকানটা হুইস্কি আর রম ছাড়া কিছু চেনে না।

বলতে চান এমন ভাষাই আজকাল স্বাভাবিক?

–এই দ্যাখো। রাজকুমারের ভাষা একটু পৃথক হবে না?

নয়নতারা যেন নিজেকে সামলে নিলো।

রাজু ঝুলবারান্দা থেকে ঘরে ফিরলো। দেয়াল-আলমারিটা খুললো। র‍্যাকের গায়ে রাখা বন্দুকগুলোর বাড়তি আরো দু-একটা সেখানে। কাগজের কাঠের বাক্সে গুলি। রাজু চামড়ার বেল্টটাতে কিছু গুলি বসিয়ে নিলো।

পিছন পিছন এসে নয়নতারা রাজচন্দ্রকে লক্ষ্য করছিলো। বললো–সময়মতো স্নানাহার করাটাকে কি আজকাল অন্যায় মনে হয়?

রাজু বললো–রূপচাঁদ নালিশ করেছে বুঝি? হতভাগাটার বাড় হয়েছে বিশেষ। ভেবেছিলাম আজ ও সঙ্গে যাবে। ওকে না-নিয়ে শাস্তি দিতে হচ্ছে।

নয়নতারা বললো–আপনি কী শিকারে যাবেন এখন? তা হলে কথা ছিলো।

–শিকার থেকে ফিরে এসে হয় না?

নয়নতারা ভাবলো। তার হাসি হাসি ঠোঁটের একটা কোণ দাঁতের ডগায় চাপা।

সে বললো–অনেকদিনের কথা তো, হয়তো প্রতিশ্রুতিটা মনে নেই।

রাজু একটা বন্দুক বাছাই করে র‍্যাকের কাছে থেকে সরে এসে বললো– বলল কেকয়কন্যা।

সে রুমাল দিয়ে বন্দুকের চোং মুছলো। তেলকালিতে রুমালটা বিশ্রী হতেই অ্যাঃবলে রুমালটাকে মেঝেতে ফেলে দিলো।

নয়নতারা বললো–আজ আমি শিকারে যাবো।

-তুমি? রাজু হাসিমুখে বললো–হা, অনেক অনেকদিন আগে এমন কথা ছিলো বটে। –হো-হো করে হেসে উঠলো সে। সেই পুরনো পরিস্থিতিটাকে মনে এনেই যেন। বললো–কিন্তু, না আজ হয় না, অন্তত।

-এতে আর এমন চিন্তার কী আছে? টোপর-হাওদা দিতে বলুন। আমি রানীমাকে বলে আসি।

রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো সেই ভঙ্গিতে নয়নতারার প্রস্তাব নাকচ করে।

-কিন্তু স্নানাহারও হলো না। একবেলায় কখনো বিলমহলের কুমীর মেরে ফেরা যায় না।

রাজচন্দ্র দরজা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হালকা গলায় বললো–স্নান সকালেই হয়। আর মাঝে মাঝে একবেলা না-খেলে মানুষের ক্ষতির চাইতে লাভই বেশি হয়ে থাকে।

হঠাৎ একেবারে ঘরটা শূন্য হয়ে গেলো এই অনুভূতি নিয়ে নয়নতারা ধীরে ধীরে রানীর মহলের দিকে চলে গেলো।

পিয়েত্রোর বেঁটে হাতিটাকে ওরা হাওদার সাজিয়ে এনেছিলো। কিন্তু পাইপ ধরানোর অজুহাতে রাজু খানিকটা সময় যেন অপেক্ষা করলে প্রথমে গাড়িবারান্দায়, তারপর হাতি যেখানে দাঁড়িয়েছে সেই চবুতরায়। কিংবা রোদটাই কি ভালো লাগলো? অবশেষে সে নয়নতারার চমকে দেওয়া শিকারে যাওয়ার প্রস্তাবের রসিকতাটাকে মনে করে হাসিমুখে হাতিকে বসতে বলার ইঙ্গিত করলো। কিন্তু এবার হাতিকেই একটু দেরি করতে হলো, কারণ তখনই অন্দরমহলের থেকে একটা ছোটো পালকি বেরিয়ে হাতির সম্মুখ দিয়ে আড়াআড়ি পার হচ্ছে। এটা সাধারণ পালকি। সাধারণ কোনো পুরস্ত্রী রাজবাড়ির বাইরে যেতে ব্যবহার করে থাকে। পরে হাতি যখন নিজের পথ নিয়েছে সে ভাবলো একবার, এটা কেমন হয়ে গেলোনা? নয়নতারাকে কুশলপ্রশ্নই করা হলো না। আজই তো প্রথম দেখা হলো কতদিন পরে। কতদিন হবে? গোটা বর্ষাকালটাই নয় কি? এবং শরৎও। আট-দশ মাস কম করেও; প্রায় বছরই ঘুরে আসে।

গ্রামের বাইরে এখন ক্রোশটাক পথ চলে এসেছে হাতি। পথটা এখানে ঘুরে গিয়েছে। একটা ফলের বাগানকে বেষ্ট করে। বাঁশের অনেক কঞ্চি এদিকে এমন ঝুঁকে রয়েছে যে হাওদায় লাগছে। মাহুত ধারালো দা দিয়ে কখনো কখনো পথের উপরে ঝুঁকেপড়া সেই বেয়ারা কঞ্চি কেটেও দিচ্ছে। ফলের বাগানের বেড়া সব সময়ে রাখা যায় না। গাছ বড়ো হয়ে গেলে সেটাকে নতুন করে দেওয়ার চেষ্টাও থাকে না। বাগানের গাছগুলোর নিচে নিচে বরং পায়ে চলা পথ।

একটা হুঁই-হাঁই শব্দ শোনা গেলো একবার। হাতি এগিয়ে চললো। হঠাৎ দেখতে পেলো। রাজু বাগানটার পাশ ঘেঁষে রাস্তা যেখানে মোড় নিচ্ছে সেদিকে একটা পালকি বাগানের গাছগুলোর ফাঁক থেকে বেরোচ্ছে। সেই পালকিটাই বটে। ভাবলো রাজু, রাজবাড়ি থেকে কেউ ফরাসডাঙায় যাচ্ছে পালকিতে। হয়তো তা রানীর শিবমন্দিরের সঙ্গে যুক্ত কোন ব্যাপারে। কিন্তু কিছুদূর যেতে না-যেতেই হাতিকেই থামতে হলো। কী মুশকিল! পালকিটা পথের উপরে নামানো। এমন ছুটে চলেছিলো সেটা যে ইতিমধ্যে শীতের দিনেও গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছে বেহারারা। তাদেরই একজন পথের ঠিক মাঝখানে হাতিকে দেখামাত্র হাত তুলে দাঁড়ালো।

কী ব্যাপার? বললো– রাজু-যেন শীতের রোদে ভিরমি!

কাছাকাছি এসে মাহুত জিজ্ঞাসা করলো বেহারাটি কিছু বলবে কিনা।

 বেহারা বললো–হুঁজুরের খাবার আর জল।

খাবার? বিরক্ত রাজু জিজ্ঞাসা করলো।

 বেহারাটির মুখ শুকিয়ে গেলো। মাহুত দ্বিধা করতে লাগলো। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই এরকম ভঙ্গিতে রাজু বললো–তুলে লও। বেহারা ভয়ে ভয়ে পালকির দিকে এগোলো। আর ঠিক তখনই পালকির দরজাটাও খুললো।

মোটা একটা রেশমের চাঁদরেই বটে–মাথা, মুখ,কাঁধ ঘিরে ঘেরাটোপের মতোই। কিন্তু নামতে দেখে, দাঁড়াতে দেখে রাজুর সন্দেহ রইলো না। রাজু কিছু বলার আগেই নয়নতারা বললো–মই আনেননি তো? এখন? নাকি হাত ধরবেন?

–কিন্তু

 নয়নতারা হাতির গা ঘেঁষে হাত উঁচু করে দাঁড়ালো।

একটু টানাটানি করেই তুলতে হলো। হাতি বসলো। হাতির পিছনের পায়ের উপরে উঠে দাঁড়াতে হলো নয়নতারাকে। পালকি ফিরে গেলো। হাওদার আসনে বসে অবগুণ্ঠন একটু সরালো নয়নতারা। হাঁপাতে হাঁপাতে হাসলো। বললো–বাব্বা, কী ভয় লেগেছিলো!

রাজচন্দ্র বললো–কিন্তু, নয়ন

নয়নতারা তাড়াতাড়ি নিঃশব্দে আঙুল দিয়ে মাহুতকে দেখালো। যেন সে বলতে চায় লোকটির কান আছে, কৌতূহল সেকানকে বরং সজাগ রাখবে। কিন্তু তখনকার দিনে এমন একটা প্রসিদ্ধি ছিলো যে যখন এরা তাড়াতাড়ি নিজেদের মধ্যে একটু বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলে তার সবটুকু বেহারা বা মাহুতরা বোঝে না। আন্দাজ কি করে না? করে, এবং তাতেই তো নানা রূপকথা ও কাহিনীর সৃষ্টি।

কিন্তু কীসের? আমি কি এর আগে কোনোদিন হাতির দশ হাতের মধ্যেও গিয়েছি? আর এ একেবারে তার গায়ের উপরে দাঁড়ানো!

রাজচন্দ্র কিছু ভাবলো।

নয়নতারা বললো–গল্পটা বলবো? টেনে তুলতে পারবেন ভাবিনি।

–তার আবার গল্প কী?

নয়নতারা একটু হাঁপাচ্ছে। সেজন্য ঠোঁটের ফাঁকেও নিঃশ্বাস নিচ্ছে, দাঁতের নিচে জিভের লাল ডগার আভাস যেন চোখে পড়বে। নয়নতারা বললো–ঠাকুমারদের মুখে শোনা। বাল্যবিবাহ খুব খারাপ জিনিস, জানেন? ছোটো ছেলেমেয়েরা ব্রতর কীই বা বোঝে তাই ঠাকুমার দুপাশে বরকনে শুয়ে থাকে। এদিকে তাদের ভারি ইচ্ছা গল্পগাছা করে। একবার সারাদিন দুজনায় পরামর্শ হলো। ধনুকের ছবি দেখেছেন? কাঠের দুকোটি উপরের দিকে বাঁকানো থাকে না? গভীর রাতে ছেলেটি ঠাকুমার গায়ের উপর দিয়ে ধনুকের কাঠটিই এগিয়ে দিলো। মেয়েটি ধনুকের এক কোটির ভঁজ নিজের কোমরের নিচে দিয়ে এমনভাবে রইলো যে ভারটা এদিক ওদিক না হয়। তারপর ধনুকের অন্য ডগা ধরে ছেলেটি ধনুক তুলতে শুরু করলো। কপাল আর কাকে বলে! অনেকটা উঠেছে মেয়েটি, আর একটু তুলে ঘুরিয়ে নিতে পারলেই হয়। মচ করে একটা শব্দ। ধনুকটার মাঝখানটায় ভেঙে গেলো। ঠাকুমারা এমনি ঠাকুমা হয় না। সবই বুঝলো সে। বললো–আউর কুছ দের বা। এই বলে বুড়ি পাশ ফিরে ঘুমো।

রাজু অনুভব করলো গল্পটা আশ্চর্য রকমে বলা হয়েছে। এক মুহূর্ত যেন মাধুর্য অনুভব করে পরে সে হাসলো। বললো–এবার সংগ্রহ করা নাকি?

নয়নতারা বললো–ঠাট্টা মনে করলেন?

না।

–কেমন টেনে তোলার গল্প নয়। উদ্বহন। উদ্বাহ।

সন্দেহ কী? ধনুকের ডগায় কনেকে তুলে আনার শক্তি না-হলে বিয়ে হয়নি মনে করতে হবে। কিন্তু নয়ন

কী?

এদিকে দ্যাখো কী করে ফেলেছো!

বটে?

 কারো হাত যে টেনে তোলার মতো শক্ত তা প্রমাণ করে ফেলেছে।

নয়নতারার মুখের খানিকটা রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু সে ঝটিতি বললো–সেজন্যই তো ব্রহ্মময়ীর আসা যাওয়া। জানেন, ব্রহ্মময়ী কিন্তু বেশ অঙ্কের ধাঁধা বানাতে পারেন!

–অঙ্কের ধাঁধা?

বেশ একটা কৌতুকের ব্যাপার ঘটলো। ঘটকী ব্ৰহ্মময়ী একটা অঙ্কের হিসাবই বলেছিলো বটে। সেটাই মনে এসেছিলো নয়নতারার। যখন সে প্রায় বলে ফেলেছেন হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে থামলো সে।

-কই, বললে না?

নয়নতারা তাড়াতাড়ি বললো–আচ্ছা, রাজকুমার, আপনি যে একবার পিয়েত্রো বুজরুকের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন সে কী এই পথ? সামনে ঘাসের জঙ্গল। হাতিটাও পথ চেনে যেন। রাতে যেমন ভূতের গল্প, এ জঙ্গলেও শিকারের গল্প তেমন।

রাজু বলতে যাচ্ছিলো, বাব্বা, কোথায় ঘটকীর অঙ্কের ফাঁদ আর কোথায় শিকারের গল্প, কীসের জঙ্গলটা তারও নজরে পড়েছে। বুজরুক পিয়েত্রোর সঙ্গে সে শিকারে গিয়েছিলো এমনই ঘাসের জঙ্গল পার হয়ে। সে দৃশ্যটা–যা দুটি অত্যন্ত প্রিয় মানুষের স্মৃতিতে জড়ানো তা ভোলার নয়, আর এখন তা মনে করাই হচ্ছে। রাজচন্দ্রর উজ্জ্বল মুখের উপরে একটা হালকা ছায়া পড়লো যেন।

তা দেখে নয়নতারা সময় নিয়ে পরে বললো–বাহ্, আমার শিকারের গল্পটা কী হলো? রাজু বললো–তোমাকে বরং একটা মজার কথা বলি। জানো নয়ন, পিয়েত্রো আর বুজরুক দুজনেই আমার চাইতে বয়সে বড়ো ছিলেন। সুতরাং তাদের কাল আর আমার কাল এক হতে পারে না প্রকৃতপক্ষে। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়

-কী?

–ঠিক বলতে পারছি না। একালে আমার নিজের ঘরবাড়ি নেই বললে তো ভাষা হয় না।

-বেশ কথাটা তো! চটুল সুরে নয়নতারা বললো। কিন্তু ভাবলো সে। হঠাৎ এসে পড়া এই একটা কথা রাজকুমারের যাতে কোথাও ঠাট্টা নেই। লুকিয়ে রাজুর মুখ দেখবে নাকি? কিন্তু বরং সে মন থেকে বাইরে চলে এলো। বললো–দ্যাখোদ্যাখো রাজকুমার, হাতি ডুবে যাচ্ছে এমন ঘাস। গ্রামের কাছে এমন দেখিনি। এমন ঘাস। ধানও হতে পারে তাহলে।

রাজুর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো। কিন্তু বাস্তবের ধাক্কায় হেসে সে বললো–কেন ধান হয় জানি না। হাত দিও না। ধার আছে ঘাসের। দ্যাখো হাতির গায়ে দাগ পড়ছে। একটু পরে সে আবার বললো–নয়নতারা, আমি কিন্তু তোমাকে কুশল প্রশ্ন করিনি।

–এতক্ষণে বুঝি মনে পড়ছে? ধাক্কাটা সামলে নিয়েছো বলো।

কীসের ধাক্কা? ও! এত গর্ব নাকি রূপের?

নয়নতারা ঠোঁটে আঙুল রেখে চোখের ইশারায় মাহুতকে দেখিয়ে দিলো। বললো–সবার কাছে শুনছি, নাকি বেড়েছে। তাই বললাম।

ঘাসের জঙ্গল কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নও বটে। সামনে কিছুটা ফাঁকা। তাতে ছোটো ঝোপঝাড় কাঁটাগাছ। লতা উঠেই যেন তাকে আরো দর্শনীয় করেছে।

রাজু তাড়াতাড়ি বললো–ওটা কি খদির, কবরেজ মহোদয়া?

-খয়ের? তাই কী? নয়নতারা বুঝতে পারলো রাজকুমার আন্দাজ করছে কবরেজি শিখতেই সে এতদিন গ্রামের বাইরে ছিলো। সে কি নিজেই বলতে পারে স্পষ্ট করে কেন সে দূরে চলে গিয়েছিলো? সে তাড়াতাড়ি বললো–আচ্ছা রাজকুমার, না-হয় এক কাজ করুন, আপনার এদিকের তহশীলটাই না-হয় আমাকে পত্তনি দিন। শুনেছি এদিকের তহশীল কাছারি নাকি একটা ভালো বাংলো। সেটাই পত্তনিদারের বাড়ি হতে পারবে। দিন না।

রাজু বললো–শুনেছি, উচ্চ অভিলাষ মহত্ত্বের ভিত্তিভূমি। আমি ভুল করেছি। সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো এতদিন কোথায় ছিলে, কেনইবা তেমন না বলে চলে গেলে?

রাজু, মানুষ শুধু কি বেড়াতে যায় না?

নয়নতারার চোখের কাছে কি ছায়া পড়লো? কিন্তু হাতির চলার একটা দোলা লাগলো কিনা-লাগলো, নয়নতারা হাসলো। আর তখন মনে হলো তার মতো চোখকেই খঞ্জন আঁখিও বলা যায়।

সে বললো–ওটা কী? বিল? কী সুন্দর যে! যদিনা-হাসেন বিল সম্বন্ধে আপনাকে একটা কথা বলি।

রাজু সম্মুখে চাইলো। দিগন্তের নীল রেখাটা যা বনে জন্য বিচ্ছন্ন হওয়ায় আরে বেশি বাঁকা মনে হচ্ছে সেটা মেঘ নয়।

নয়নতারা বললো–বিল নাকি কচ্ছপের মতো চলে বেড়ায়।

রাজু হো-হো করে হেসে উঠলো।

এদিকে বর্ষা মেই, তবু কখনো কখনো বিলের জল বেড়ে ওঠে, তা থেকেই মনে হয় বিল গুটিগুটি এগোচ্ছে। তা থেকেই এই প্রবাদ। আসলে হয়তো তা মরা নদীর খাত বেয়ে উত্তরের বর্ষার জল এসে পড়ার ফলেই।

এই বললো– নয়নতারা কিন্তু ভাবলো, এখানে রাজকুমারের সামনে কখনই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলা উচিত হবে না।

হাতি এগিয়ে চললো।

নয়ন বললো–রাজকুমার, গরম লাগছে।

–তা লাগতেই পারে। এই খোলা হাওদাটা মহিলাদের জন্য নয়।

নয়ন এদিক ওদিক চেয়ে একটা বড় গাছ দেখতে পেয়ে মাহুতকে সেদিকে হাতি নিতে বললো। ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়া দরকার। সেখানে হাতি পৌঁছলে নয়ন বললো– হাতিকে বসাতে। হাতি বসলে জানালো তার পিপাসা পেয়েছে। রাজু কিছু বলতে গেলে সে গলা নামিয়ে বললো–ভুল যা করেছি করেছিই, তুমি জল না-খেলে আমি খাই কী করে?

এটা একটা সাধারণ কৌশল যা মহিলারা অবলম্বন করে। আহার্য ও পানীয় তোত রাজবাড়ি থেকেই এসেছে। মাহুতকে যথেষ্ট খাবার দিয়ে তাকে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিলো। সে কিছু দূরে আড়ালে গেলে নয়ন বললো–রাজকুমার বন্দুক ধরে থেকে তোমার হাতে তেলকালি। এসো আমি খাইয়ে দিই।

রাজু অবাক হলো। সত্যি নয়নতারা তার মুখের কাছে খাবার তুলে ধরলো। যেন অভিমান হবে রাজুর। যেন জিজ্ঞাসা করবে–তাহলে এতদিন? কিন্তু নয়নতারা বললো–একটু তাড়াতাড়ি, মাহুতটার খাওয়া তাড়াতাড়ি হয়ে যেতে পারে।

রাজুর খাওয়া শেষ হলে তবে হাতি উঠলো। মনে হতে পারে এটাই সব চাইতে মূল্যবান–অন্তত এটাই অন্যতম কারণ যার জন্য নয়নতারা আজ শিকারে এসেছে।

এক কৌতুকের ব্যাপার হলো। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা বিলের বাঁক। তার একাংশ যখন প্রায় দিগন্তরেখায়, অন্য অংশ তখন হঠাৎ একেবারে চোখের সামনে খুলে গেলো। হাওদা পিছন দিকে ঝুঁকে ছিলো বলে অনুমান হচ্ছিলো বটে হাতি উপরে চড়ছে, নতুবা ঘাস, কাশ, নল, মাঝে মাঝে শিমূল, বাবলা, কচিৎ অশ্বত্থ হিজল, কদাচিৎ কিছু দূর ধরে বেতজঙ্গল, সব জায়গাতেই হাতির উচ্চতার তুলনায় সমান উঁচু বন।

ডানদিকে গড়ানে জমি শ্যাওলা জমেনি এমন জলের দিকে নেমে গিয়েছে। পারে এক অল্পবয়সী বট, যদিবা মানুষের অনুপাতে তাকে বিশেষ বৃদ্ধই বলতে হয়। বটের একটা ডাল জলের উপরে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। ডালটাকে অতদূর এগিয়ে যেতে দেওয়ার সুবিধা, করে দিতেই যেন জলের একেবারে ধার ঘেঁষে একটা মাঝারি মোটা বট। এগিয়ে যাওয়া । ডালটা থেকেও অনেক ঝুরি জলের উপরে জালের মতো ছড়িয়ে তাছে অথচ জল বলেই যেন আরো নামছে না। তেমন একটা ঝুরিতে একটা মাছরাঙাকে দেখতে পাওয়া গেলো। দেখতে দেখতে সোনা লাল সবুজের ঝিলিক দিয়ে এক পাক উড়ে ঝুপ করে জলে পড়ে আবার ঝুরিতে এসে বসলো। তখন দেখা গেলো কালো কালো গলা দিয়ে জল সেলাই করছে। অনেক পানকৌড়ি। তাদের কার্যকলাপই ছিলো মাছরাঙার নিশানায়।

নয়নতারা বললো–এমন সুন্দর দেখিনি।

তার চোখ দুটি ডাগর, তার লাল ঠোঁট দুটি একটু উন্মুক্ত, স্নিগ্ধ হাসিতে তার উজ্জ্বল দাঁতের দু-একটি ডগা চোখে পড়ছে। দেখে রাজুর মনে হলো এমন পাশ থেকে সে নয়নতারাকে কখনোই দেখেনি। কী আশ্চর্য!

সে, সোৎসাহে বললো–দ্যাখোদ্যাখো নয়ন, ডাহুক বোধ হয়, যাদের টিটিভ বলে।

হাতি বিলের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে। যেন একটা পায়ে-চলা পথও আছে সেখানে। অনুমান হয় তা থেকে এদিকে একটা গ্রাম থাকবে।

হঠাৎ নয়নতারা বললো, বলার আগেই হাসি ফুটলো তার মুখে–আচ্ছা রাজকুমার, টিটিভ না ডাহুক, কে ভালো?

রাজু বললো–নয়ন, তোমাদের রাজকুমার যে মূর্খ এটা প্রমাণ না করেই তা বলা যায়।

-আ, রাজু, আমি কি? দ্যাখো–নয়নতারা মুহূর্তের জন্য ভাবলো, সে কি বুঝিয়ে বলবে ডাহুক কথাটা অনেক বাংলা গানে আছে, টিট্টিভের সাক্ষাৎ বিষ্ণুশর্মার উপদেশের বাইরে নেই। সেজন্যই সে জিজ্ঞাসা করেছিলো।

কিন্তু বিলের দিকে চোখ রেখে রাজু বললো–ও কী, মুখের কেন অমন চেহারা? তুমি কি সত্যি ভেবেছো তোমাদের রাজকুমার মুখ থেকে যাচ্ছে? যদি তুমি সেই আড্ডাগুলো দেখতে নয়ন যা অনেক সন্ধ্যায় আমার বৈঠকখানায় বসে। কী শ্যাম্পেন! আর কত শের আমি শ্যারম, আঁশটে কত ঘনঘন! আমাদের বাগচী মাস্টারমশায় কিন্তু যত গম্ভীর দেখায় তত গম্ভীর নন।

নয়নতারা বললো–নিজের ব্যাপারে এখন দেখছি আপনার সব কথাই বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

রাজচন্দ্র হাসলো। বিলে সৌন্দর্যের প্রফুল্লতাই যেন তার মুখে। সে বললো–কে বলেছে? আমার এই বন্দুকের রেঞ্জ ভেলোসিটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করো কিংবা পিয়ানো সম্বন্ধে, দেখবে আমার কোনো কথাই বাঁকা নয়।

রাজকুমারের মুখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নয়নতারা চিন্তা করলো। কথার সুরে কোথাও কোথাও সুখ জড়ানো আছে, কিন্তু শেষ কথাটার চাইতে বাঁকা আর কী?

কিন্তু মাহুত, যে এতক্ষণ নিজেকে লুপ্ত করে রেখেছিলো, কথা বললো– সামনে লোকজন দেখছি।

-হ্যাঁ, ওরাই পথ দেখাবে।

নয়নতারাও লোকগুলিকে দেখতে পেয়েছিলো। হঠাৎ যেন তার মুখ রাঙা হয়ে উঠলো।

কী ভাবছো?

মৃদুস্বরে নয়নতারা বললো–কাজটা ভালো হয়নি। হাওদায় কবরেজকে দেখে না-জানি অন্যে কী ভাবে। তাছাড়া আমি বোধ হয় ভুলে আপনাকে কয়েকবার তুমি বলেছি।

রাজকুমারের চোখ দুটিতে দুষ্টুমি দেখা দিলো। সে বললো–তাই তো, এখন আর অন্তর্ধানেরও উপায় নেই। একেই অগত্যা বলে, দেবী? মনে হয় করণ বুঝি, কিংবা হেত্বর্থে। কিন্তু আসলে প্রকৃত্যাদিভিঃ।

হাতি এগিয়ে চললো।

নয়নতারা ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবলো, সামনের লোকগুলি ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার মধ্যেই মনে হলো তার একবার, এটা কি রাজুর একটা ঝকঝকে বাক্য তৈরির নেশা কিংবা শ্লেষ করে কিছু বলছে? স্ত্রীলোককেই তো প্রকৃতি বলে। সত্যি কী হেতু ছিলো এই শিকারে আসার তার পক্ষে?

.

০৪.

কীবল কেন এসেছিলো এই অঞ্চলে? নানা দিকে বিচার-বিবেচনা করার পর অনুমান হয়: তার অনেকটা জীবিকা অনুসন্ধান, কিছুটা পলাতকবৃত্তি। ক্রিমিয়া ফেরত সে তাইপিং বিদ্রোহ দমনে চীনে যেতে অনিচ্ছুক ছিলো কি? পরবর্তী জীবনে এদেশে আইন ব্যবসায় সে খ্যাতি ইত্যাদি লাভ করেছিলো। তার স্বদেশে কি তা হতে পারতো না? অথবা ভারতে তখন কয়েকটি হাইকোর্ট স্থাপিত হচ্ছে, সেইসব নতুন হাইকোর্টে নতুন আইনজীবীদের প্রতিযোগিতা করার সুবিধা ছিলো। অন্যদিকে তাহলে এই প্রশ্ন থাকে, কিছু বেশি টাকার জন্যই কি সহজে স্বদেশ ত্যাগ করা যায়? আসলে একথাও মনে রাখতে হবে, কারো কারো কাছে সাজানো-গোছানো লন্ডন সভ্যতার কেন্দ্রর চাইতে অসভ্যতার প্রান্তে যেখানে সভ্যতা গড়ে উঠছে এমন সংযোগস্থলেই আকর্ষণীয় বোধ হয়।

আপাতত সে রাজারগ্রামে চিঠি দিতে এসেছিলো ডাকে। কিন্তু সেটা এমন ব্যাপার নয় যে তাকে আসতেই হতো। মরেলগঞ্জের নিজস্ব ডাকহরকরা আছে। ঝোঁকের মাথায় কীবল কাল অনেক রাত পর্যন্ত একখানা চিঠি লিখেছে, এবং দ্বিতীয়বার না-পড়েই তা পোস্টকরতে ঝোঁকের মাথাতেই ডাকঘরে এসেছিলো। অনুপ্রেরণার স্বভাব এই যে দ্বিতীয়বার পড়লে তার অনেক কথাই বর্জনীয় মনে হয়।

কীবল চিঠি লিখেছিলো তার আত্মিক ভগ্নীকে। তাদের রোমান ক্যাথলিক ভিকারের বিধবা মেয়ে। বয়সে কীবলের চাইতে কিছু বড়ো হতে না-ও পারে, কিন্তু সম্মানে কীবলের চোখে গগনচুম্বী। তাকে চুম্বন করতে সুতরাং গগনই পারে। বিধবা এই মহিলাকে, তার নাম ম্যাগি হওয়ার সুবাদে, কীবলের চোখে ম্যাগডালেনের ঘোর লাগে। কিন্তু কী করে কী হয় বলা যায় না। বাইবেল নিয়েই বসা। কিন্তু সেই বিকেলের উজ্জ্বল আলোয় তারা বেশি বয়সে অল্পবয়সী ভাইবোনের মতো হাত কাড়াকাড়ি করছিলো। জাপ্টাজাস্টি শেষে বইটা দখল করে কীবল চেয়ারে বসতেই মুখোমুখি বসলো ম্যাগি। তখনো সে হাঁপাচ্ছে। হঠাৎ দেখতে পেয়েছিলো তখন কীবল। ব্লাউজের হুক খুলে গিয়েছে, পারঙের অর্গান্ডির আন্ডারগার্মেন্টের শাসনবিচ্যুত সুপক্ক পুষ্ট স্তনের অর্ধাংশ, যা নাকি স্বর্গের মতো। আর তখন হাঁপাচ্ছিলোও ম্যাগি।

কিন্তু তারা অবশ্যই নতুন সুতরাংক্যাথলিক কীবল তার আত্মিক ভগ্নীকেই চিঠি লিখতে অভ্যস্ত। কেননা চিঠিতে যেমন এই আত্মিকভগ্নীত্বের গভীরতা ছুঁয়ে চলা সম্ভব পাশাপাশির নৈকট্যে ততটা সাহস হয় না যেন।

চিঠি দেওয়ার পরে হাতে এখন অনেক সময়। সুতরাং সে এদিক-ওদিক ঘুরে। বেড়াচ্ছিলো। ঘণ্টাতিনেক আগে ব্রেকফাস্টহয়েছে। ঋতুটা এখন এমন যে চারিদিক থেকেই সূর্যের আলো তার গায়ে পড়ছে। ধুলো নয়, প্রচুর ঘাস; কাদা নয়, ট্যালকমের মতো মাটি। উপরন্তু যেদিকে তাকাও সবুজ, ময়ূরের পেখমের মতোনীলে জড়ানো সবুজ এবং উজ্জ্বল।

ঘোড়া ক্যানটারে চলছে। সে শিস দিতেও শুরু করেছিলো। তা এখানকার জলটাও ভাল, ক্যালকাটার তুলনায় বটেই। আর ক্যালকাটার নেটিভপাড়ার, এবং ক্যালকাটার বেশির ভাগই তাই, সেই খোলা পচা জলের নর্দমাগুলোর চাইতে এই বুনো পথও ভালো। ডিসাইডেড়লি। এখন আবার চিঠির কথাটা অথবা চিঠির প্রশ্নর কথাই তার মনে এলো। দুটো প্রশ্ন আছে এই চিঠিতে। সে প্রশ্ন দুটির বিষয়ে ম্যাগির ধারণা জানতে চেয়েছে : (১) সেন্ট পলের হাতে স্বর্গের যে চাবি আছে তা কি সোনার তৈরি? (২) সে হাত কি অ্যাঞ্জেলদের হাতের মতো? বস্তুত এই প্রশ্ন দুটো তৈরি না-হলে গত সপ্তাহের পর আজই আবার চিঠি কেন?

এখন মনে হলো, কীবলের অ্যাঞ্জেলদের হাতই বা কি? তা কী স্বচ্ছ একটা জমাটবাঁধা আলো? কিংবা অ্যামব্রোসিয়ায় তৈরি? কী আশ্চর্য, এ সম্বন্ধেও তার ধারণা স্বচ্ছ নয়।

কিন্তু চিঠিতে প্রশ্ন ছাড়াও অন্য কিছু থাকে। কীবল তার অভিজ্ঞতার কথাও কিছু লিখেছে। এটাকে মানে ইন্ডিয়াকে ন্যাংটো সন্ন্যাসী ও সাপুড়ের দেশ মনে করে বটে লোকে। এখানে অন্য অভিজ্ঞতাও হতে পারে। তোমাকে বলতে পারবো না সবটুকু। কিন্তু এখানে জননেন্দ্রিয় পূজা হয়ে থাকে। হ্যাঁ, আমি তা নিজের চোখে দেখেছি। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। তোমার মুখোনি আমার স্মৃতির দিগন্তে। আমি বিপথে যাবো না। তবে এ দেশটা, যা আমাদের সাম্রাজ্যের কোহিনুর, সত্যি অদ্ভুত। এখানে আমার পরিচিত ইংরেজ ভদ্রলোক কালীপূজা করেছিলো। এই কালী নাকি এক কালো ন্যুড গার্ল। এখানে এক কালো ভদ্রলোক আছে যার স্ত্রী বৃটিশ। এই কালো ভদ্রলোককে কখনো কোয়েকার মনে হয়। কখনো বিধর্মী। কিন্তু সবচাইতে বড়ো কথা একটি বৃটিশ গালা কী করে তার সঙ্গে টেলে বসে এবং ঘুমায়।

এটা বোধ হয় বেতের ঝোপ। ডানকানের কথা বিশ্বাস করতে হলে মালাক্কা কে আর এই বেত একই জিনিস। একটা নালার বরাবর তার দুপারে মানুষের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু বেতবোপ। ধারেকাছের গাছের ডালপালা আঁকড়ে ধরেও বেত উঠে পড়েছে। দুএকটি বড়ো গাছের মাথা ছাড়িয়ে রোদে ঝলমল করছে বেতের চূড়া।

ঘোড়াটা চমকে উঠলো। কারণ খুঁজে এদিক-ওদিক চাইতেই কীবল হাতি, হাওদা ও হাওদায় মানুষ দেখতে পেলো। বেশ দ্রুত চলেছে হাতি, আর তার ঘোড়াও ক্যান্টার করছে। আরো ভালো করে দেখতে হলে লাগাম টানতে হয়।

সে অনুভব করলো : মাইপ্লেনডিড! এর আগে কি হাতি দেখেছি, না তার সওয়ার!

আচমকা এরকম অনুভব করার পর তার মন যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলো। তুমি স্বপ্নও দ্যাখোনি। এমন রূপ সম্বন্ধে। কী আশ্চর্য, এমন রূপ কি হিদেন-নেটিভদের হয়? আচ্ছা, পুরুষটি রাজকুমার কি? কারণ প্রিন্সই হাতি চড়তে ভালোবাসে। পরবর্তী পর্যায়ে সে যুক্তি দিলো, মহিলাটি প্রকৃতপক্ষে ক্যাথারীনই? নতুন পোশাকেই তাকে তেমন দেখিয়েছে? অবশ্যই জিনুইন ব্রিটিশ ব্লাড়। নতুবা এত রূপ হয়! কীবলের চাপা ঠোঁটে ভাঙচুর দেখা দিলো, কিন্তু এই রাজকুমার অবশ্য হার ম্যাজিস্টির একজন সাবজেক্টমাত্র। বৃথা জাঁকজমক। এই সময়ে তার সদ্য শোনা প্রবাদটা মনে পড়লো :ইন্ডিয়ান প্রিন্সরা হাতিতে চড়ানোর লোভ দেখিয়ে স্ত্রীলোকদের সিডিউস করেন না, তাহলে কেট হয় না। প্রকৃতপক্ষে সে রাজচন্দ্র আর নয়নতারাকে দেখেছিলো।

এখন তার মরেলগঞ্জে ফেরারও তারা নেই। এদিকে দ্যাখো, সামনের ওই রাস্তাটা চওড়া। সে লাগাম টানতে ঘোড়াটা চওড়া পথটা ধরলো। কিছু দূরে গিয়েই গোল, সাদা, প্রকাণ্ড একটা ছাতার মতো গম্বুজ চোখে পড়লো। আচ্ছা! ওটাই নাকি রাজবাড়ি?

অতঃপর সে আবার রাজবাড়ির গম্বুজের টানেই যেন রাজারগ্রামের দিকে ফিরতে শুরু করলো।

তখন তার মনেও একটা উল্টো পাক দেখা দিয়েছে। সে ভাবলো, (যেন সে নৃতত্ত্ব সম্বন্ধেই উৎসুক) আসল কথা এদেশে অর্থাৎ এই ইন্ডিয়ায় বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ মানুষের যত রকমের দেহবর্ণ হতে পারে বোধ হয় সবরকমই এখানে পাওয়া যাবে আর তা হয়তো এইজন্য যে একের পরে এক মানবগোষ্ঠী এখানে তাদের বিভিন্ন বর্ণের দেহ নিয়ে এসেছে এবং থেকে গিয়েছে। হয়তো একদিন তেমন ইংরেজদেরও কিছু চিহ্ন পড়ে থাকবে। কীবলের মন থেমে দাঁড়ালো। নানা, অবশ্য তা প্রকৃতপক্ষে হবে না। কেননা কোন এমন জাত আছে পৃথিবীতে যা ইংরেজদের পরেও আবার এদেশে রাজ্য পাবে। অর্থাৎ ইংরেজ অপেক্ষা উন্নত ও শ্বেতকায়? রাজকুমার হয়তো এবং হয়তোবা রাজকুমারের সঙ্গীও তেমন কোনো অভিযাত্রী দলের বংশধর। তারা কী এরিয়ান ছিলো?

.

০৫.

অনেক সময়ে যোগাযোগ ঘটে যায়। চন্দ্রকান্ত এডুজ বাগচী তখন চরণদাসের বাড়ি থেকে নিজের কুঠিতে ফিরছিলো লাঞ্চের জন্য। তার পনিটা বেশ মোটা, গতিটাও শ্লথ। যদি কেউ দুএক বছর আগে দেখে থাকে তবে তার অনুমান হবে বাগচীর যত্নেই তার এই দৈহিক উন্নতি। হাঁটুর কাছে থোপা-থোপা পশম, ঘাড়ে সিংহসম কেশর ও লেজের মাটিছোঁয়া বালামচি দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাগচীর পোশাকও গ্রামে লক্ষণীয়। স্প্যাটস, ক্রাভ্যাট সমন্বিত পুরো ইংলন্ডীয় তার পোশাক। শুধু মাথার পেন্টহ্যাট যেন বেশ বড়ো। পনি মাথা ঝাঁকিয়ে টিকটিক করে চলেছে। বাগচীর লম্বমান পা দুখানা মাটির কয়েক আঙুল উপরে। দুষ্টু ছেলেরা গোপনে মন্তব্য করে ঘোড়া ও সওয়ার দুজনেই একসঙ্গে হাঁটে। কিন্তু তা গোপনে, খুবই গোপনে।

চরণদাসের বাড়িতে একটা দাঁতব্য হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারি গড়ে উঠেছে। সেখানে সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকালে কিংবা বিকেলে অন্তত একবার সে যায়ই। ছুটি ও রবিবারে দুবেলাই।

রবিবারে–আজ রোগীর ভিড় ছিলো। ফিরতে কিছু দেরি হয়েছে বাগচীর। বিলমহল থেকে, ফরাসডাঙা থেকে দু-চার ক্রোশ পায়ে হেঁটে কয়েকজন রোগী এসেছিলো। কারো বাত,কারো স্থায়ী মাথাধরা, একজনের তো ক্ষয়রোগ বলেই সন্দেহ হয়েছে, অজীর্ণ, আমাশা তো বটেই।

প্রশ্নের উত্তরে রোগীরা যে রোগলক্ষণ বলে চরণদাস তা সংক্ষেপে টুকে নেয়। বাগচী কিছুদিন যাবৎ চরণদাসকে প্রশ্ন করে, তুমি হলে কী দিতে? চরণদাস যদি সাহস করে কিছু বলে বাগচী কোনো ক্ষেত্রে তার ভুল দেখিয়ে দেয়, কোনো ক্ষেত্রে বলে দাও, দেখা যাক; অন্য কখনো বলে ঠিক বলেছো, আমারই ভুল হয়ে যাচ্ছিলো। এ সেই চরণদাস যে গ্রামের পোস্টমাস্টার, বাগচীর স্কুলে শিক্ষকতাও করে; এবং দেখা যাচ্ছে ডানকানের আত্মা বিচারের আগে লাখ-লাখ বছর ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ পাবে এমন গল্পও বানায়।

ডিসপেনসারির কাজ ভালোই চলেছিলো। বাগচী কখনো হেসে কখনো তিরস্কার করে রোগী দেখা শেষ করছিলো এবং চরণদাস ওষুধ দিয়ে চলেছিলা।

দেখা যাচ্ছে গুজবের মতো রসিকতাও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে কৌতুকের এই হলো : চরণদাসের সেই আমলের বিচার নিয়ে রসিকতা অন্যের মুখে ঘুরে চরণদাসের কানেই ফিরে এলো।

বিলমহলের সেই চিরস্থায়ী মাথাধরা রোগী, যার কপালে সুতোর ডোরে একটা সরু শিকড় বাঁধা, সেই বললো–চরণ কবরেজ, শুনেছো নাকি ডানকানার নাকি নরকেরও ভয় নেই।

চরণদাস ওষুধের ফোঁটা ঢালছিলো জলের শিশিতে।

বাগচী জিজ্ঞাসা করলোকে? কার কথা বলছো? ডানকানা কে? কিন্তু বাগচী নিজেই বুঝতে পারলো। সে হো-হো করে হেসে উঠলো। এরা ডানকান সাহেবকে একটামাত্র আকার দিয়েই কানা করে ছেড়েছে। রোগীটি বাগচীর সামনে লঘু কথা বলে ফেলে অপ্রস্তুত বোধ করছিলো। বাগচী হাসলেও রসিকতাটা আবার করা উচিত হবে কিনা এ বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ হলো।

বাগচীই বরং বললো– হাসতে হাসতে–সে আবার কী গো, নরকের ভয় কার নেই?

সাহস পেয়ে রোগীটি বললো–নরকে তো আত্মাই যায়। তা সে আত্মা যদি লাখ লাখ বছর ঘুমিয়েই থাকে তার তবে কিন্তু ভয় কমে গেলো।

এই কৌতুকের জনক চরণদাস কিন্তু বিব্রত বোধ করলো। সে ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য বললো–পাপ কি কেউ এড়াতে পারে? ওর আর তামাদি নেই।

রোগীটি যা শুনেছে তা ভোলেনি। বললো– সে, তামাদি নয় নেই। কিন্তু তুমিই বলো; হলোইবা ইংরেজ চিত্রগুপ্ত। তার সেরিস্তায় কাগজ কি লাখ-লাখ বছর পরের পর ঠিক থাকে? বিচার তো করে সেই শেষের একদিনে।

বাগচী অবাক। একবার মনে হলো সে আবার হেসে উঠবে। কিন্তু রসিকতা হলেও এটা কি ভালো রুচির? একটু গম্ভীর মুখেই সে বললো–সব ধর্মেই এমন কিছু থাকে যা অন্য ধর্মের লোকেরা সহজে বুঝতে পারে না। ওষুধটা ওকে দিয়ে দাও চরণ। দেরী হচ্ছে।

একটু হেসে সে রোগীটিকে বললো–ওষুধটা কীসের তৈরি জানো? স্রেফ ঘোল। তাই বলে ঘোল খেলে মাথা ধরা সারবে না। হু-হুঁ!

ওষুধ নিয়ে রোগীটি উঠে দাঁড়ালো। ট্র্যাক থেকে পাঁচসিকে পয়সা বার করে বাগচীর জুতোর সামনে রেখে বললো–কবে আবার আসবো, সার?

বাগচী বললো––ও কী, পয়সা কেন?

সার কত গরীব লোককে পথ্য দেন শুনি। পয়সা কটা সেই ধর্মভাণ্ডারে দেবেন। দেখা যাচ্ছে ছাত্রদের দেখাদেখি রোগীরাও কখনো কখনো তাকে সার বলে।

বাগচী রোগীটির মুখের দিকে চাইলো। এই পরার্থপরতা তার ভালো লাগলো। সে সস্নেহে বললো–ফের রবিবারে এসো। নিজে আসতে না-পারা কাউকে পাঠিও খবর দিয়ে। আবার হেসে বললো–তোমাকে ঘোল খাওয়াচ্ছি বলে আবার কেউ ঠাট্টা করবে না তত, হে?

–তা করবে, সার, মেন্তুজা শুনতে পেলে রক্ষা রাখবে না।

কিন্তু রসিকতা কখনো নাছোড়বান্দা হয়। দাওয়া থেকে পৈঠায় নামতে অন্য আর-এক রোগী বললো– আবার–তা চরণ, যাই বলল ভাই, ভাগ্যটাই ওদের ভালো। এদিকে ইহকালে রাজা হয়েই জেতে বসেছে, ওদিকে দ্যাখো পরকালেরও সাজার ভয় নেই। মজা আর কাকে বলে।

ওদিকের বেঞ্চের উপরে স্বগ্রামের কয়েকজন রোগী ছিলো। তাদের একজন রসিকতার সুরেই বললো–তা, ভূতোদা মিথ্যে বলোনি। কিন্তুক এক কাজ করা যায়। সবসমেত পুড়িয়ে দিলে হয় একদিন। তাহলে আত্মা ঘুমুতে জায়গা পায় না। সরাসরি নরকে পৌঁছায়।

সকলেই হেসে উঠলো।

রোগীর ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে। বাগচী কিছু ভাবলো। তার মুখে হাসি ফুটেছিলো,

.

মিলিয়ে গেলো। পাইপ বার করে ধরালো। বরং পায়ের উপরে পা তুলে আয়েশ করে নেয়ার ভঙ্গিতে বসে বললো–চরণ, ডাবা টেনে নাও। ওতে মাথা ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু একটা কথা, ১রণ।

চরণ বললো––বলুন সার।

–এই এখনই যা বলা হলো।

চরণদাস উত্তর দেয়ার আগে চিন্তা করলো। তামাক, শোলা, চকমকির বাক্সটাকে আঙুলে নির্দেশ করে একজন রোগীকে বললো–তামাক খাও, চেলোকাকা।

তারপর হঠাৎ বাগচীর দিকে ফিরে বললো–যদি লাগাই হয়, সার, সবসমেত পুরিয়ে দেয়াই মন্দ নয়! যাকে সকার বলে। আর তা করতে হবে পাপ করে উঠেছে ঠিক এমন সময়ে। অনুশোচনা কর পাপ কাটানো সুযোগ যাতে না-পায়।

বাগচীর মুখে কথা নেই। সে যেন ভেবেই পেলো না সে হাসবে, না চটে উঠবে। একবার তার মনে হলো সেদিন সে আর রোগী দেখতে পারবে না, পরে একবার ভাবলো যত তাড়াতাড়ি এদের বিদায় করা যায় ততই ভালো। কী সাংঘাতিক কথা!

তাই করলো সে। রোগীদের বিদায় করে পাইপটা জ্বালালো সে আবার। ভাবলো এটা কি পরধর্মবিদ্বেষ চরণের? তাই কি?

কথাটা তখন মনে পড়লো তার। মূল ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে সে মনে মনে হেসে বললো–তা, চরণ, তুমি কি হিন্দু পেট্রিয়টের নাম শুনেছো?

-তা শুনেছি, সার ডাকঘরে একখানা নিয়মিত আসে দেওয়ানসাহেবের নামে।

–পড়েছো?

–দেওয়ানসাহেবের কাগজ কি খোলা যায়, সার?

 বাগচী অনুমান করেছিলো চরণদাস হয়তো হিন্দু পেট্রিয়ট থেকেই নীলকরের প্রতি একটা গভীর বিদ্বেষ সংগ্রহ করে থাকবে, কারণ বাগচীর ধারণা ছিলো হিন্দু পেট্রিয়টের হরিশ নীলকরদের কঠোর সমালোচক। বিশেষত গত একবছর থেকে।

সে বললো–আচ্ছা, চরণ, তুমি কি কলকাতার নরেশবাবু, সুরেনবাবু এঁদের সঙ্গে আলাপ করোনি? দেখতে কলকাতার শিক্ষিত লোকেরা ক্রিশ্চান ধর্ম নিয়ে বিদ্রূপ করে না। বেশি কথা কী আমাদের নিয়োগীমশায়, তোমার কি মনে হয় না তিনি খৃস্টকে ঈশ্বর মনে করেন?

পথে বেরিয়ে ভাবলো বাগচী : এদিকেও লক্ষ্য করো শেষ বিচার, অনুতাপ এমন সব বিষয় সম্বন্ধে কিছু জানা না থাকলে তেমন বলা যায় না চরণদাস বলেছে। ভেবে দেখতে গেলে এটাকেই বরং বেশি আশ্চর্য মনে হওয়ার কথা। এখানে নীলকর অত্যাচার করে থাকলে হিন্দু পেট্রিয়টের সাহায্য ছাড়াই বিদ্বেষ জন্মানো সম্ভব। হিন্দু পেট্রিয়ট বরং দূরে, এরাই কাছে। কিন্তু ধর্মের তত্ত্ব কোথায় শেখে চরণ? বাগচী অনুমান করার চেষ্টায় স্কুলের নতুন মাস্টারমশাই নিয়োগী খুঁজে পেলো। তার কাছে কি শিখেছেচরণ অনুতাপে পাপমুক্তির তত্ত্ব? আচ্ছা!

কিছু দূর গিয়ে বাগচী এ ব্যাপারটা থেকে অন্যদিকে সরে গেলো। সে অনুভব করলো আজ ছুটির দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাঞ্চ আর বিশ্রাম।

মনের এই ঢিলে ভঙ্গীতে প্রিয় কিছু চিন্তা করা ভালো। এই ভাবতে-না-ভাবতে সে অন্য চিন্তায় ঢুকে গেলো। বিষয়টা তার স্কুলের পরীক্ষা সম্বন্ধে। প্রশ্নটা এই : জ্ঞানের বিষয়কে মূল্য দেয়া হবে, না যে-ভাষায় বিষয়টাকে বলা হয়েছে তাকে মূল্য দেয়া হবে? কোনো ছাত্র যদি হীমালয়, জমুনা, গংগা প্রভৃতি বানান লিখেও পর্বত নদীগুলোর যথাযথ পরিচয় দিতে পারে তাহলে কি তা মূল্যহীন? তার মনে হচ্ছে কলকেতার আধুনিক শিক্ষাও ভাষাজ্ঞানের উপরেই জোর দিচ্ছে। সে তার স্কুলের পরীক্ষায় ভাষা ও বানানের উপরে জোর না, দেয় যদি, যদি সে লিখিত পরীক্ষার বদলে মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করে উঁচু শ্রেণীতেও? ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞানের কথা শেখাই কি আসল কথা নয়? আর সাহিত্যই যদি বলল, তাতেই কি বানান আর ব্যাকরণের চাইতে রস বিষয়টা মূল্য পাবে না? শেকপীয়রের ব্যাকরণ আর বানান এখনকার কোনো ছাত্র ব্যবহার করলে সেসব প্রশ্নেই কি জেরোর বেশি পাবে? কিংবা এদেশের কৃষকের ধর্মজ্ঞানের কথা ভাবো। এক অক্ষর পড়তে লিখতে জানে। না। কিন্তু শুনো দেখি তার কথা? মূর্খ বলবে? অথচ কলকাতার ভাষাজ্ঞানের নিরিখে তারা মূখের অধম। অবশ্যই দেওয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে।

চিন্তার বিষয়টা তার বিশেষ প্রিয়। মনে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু মনের একটা কৌশলও যেন এখানে ধরা পড়ছে। সে ঠিক এখন এ-বিষয়টাকে কেন ভাবছে? অন্য কোনো চিন্তাকে দূরে রাখতে কি? সেই অন্য চিন্তাটা নতুন চিন্তার দুপাশে অন্ধকার ঝোপের মতো থেকে যায় কিন্তু।

খানিকটা যেতে-না-যেতে বাগচীএকা একাই হো-হো করে হেসে উঠলো, দ্যাখো কাণ্ড, শুধু নামে একটা আকার যোগ করেই কেমন তিরস্কার তৈরি করেছে। ডানদিকে কানা। ডানকানা। আর কেমন সে, বিচারের কল্পনাও করেছে কোর্টের মতো।

ওদিকে কিন্তু লজ্জা হলো তার। কেউ দেখে ফেলেনি তো তাকে হাসতে? সে তাড়াতাড়ি হ্যাটটাকে কপালের উপরে টেনে নামালো। মুখটাকেও গম্ভীর করলো।

টকাটক করে চলছে পনি। মাটির কাছাকাছি বাগচীর সুদৃশ্য ও সুদৃশ্যতর সকপরা পা দুখানা দুলছে তালে তালে।

বাগচী হঠাৎ অবাক হয়ে স্বগতোক্তি করলো, আমিই কি শেষ বিচার কিংবা ইটারন্যাল ড্যামনেশন সম্বন্ধে কিছু জানি? ওসব কিন্তু আমার কাছেও ঠিক পরিষ্কার নয়। সেটা সেই ইটারন্যাল ড্যামনেশন কি মিল্টনের জ্বলন্ত গন্ধক ও কালো আগুন, ব্রিমস্টোন অ্যান্ড ব্ল্যাক ফায়ার? নাকি সে এক ঈশ্বরের সম্পর্কহীন অন্ধকারে বায়ুভূত নিরালম্ব অবস্থা? নাকি ছবিতে যেমন?

তার দুখানা ছবিকে মনে পড়লো। সে দুটিই বিশ্ববিখ্যাত। মাইকেল এঞ্জেলো এবং রুবেন্স নামক চিত্রীদ্বয়ের আঁকা দুখানা শেষ বিচারের ছবি। বিশেষ করে মাইকেলএঞ্জেলো। পরমপিতার সিংহাসনের নিচে ক্রাইস্টের ভঙ্গিতেও সেদিন ক্রোধ। ক্রাইস্টের পাশে ভার্জিন মেরিও যেন ক্রাইস্টের অটল গাম্ভীর্যকে, তার রুদ্র রূপকে স্নিগ্ধ করতে পারছে না। দণ্ডিত পাপীদের আত্মা নিচে কেরনের নৌকোর দিকেই ঘুরে-ঘুরে পড়ছে দেখা যাচ্ছে, অথবা তাদের সবলে টেনে নেওয়া হচ্ছে সেই বিভীষিকার দিকে। বাগচী নিজের ডান হাত তুলে চোখের সামনে রাখলো। যেন তাতে স্মৃতি থেকে সেই ছবিগুলোকে মুছে দেওয়া যায়, সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর আর্য ন্যুড আকৃতিগুলিকে।

কী আশ্চর্য, এ কি সে বিশ্বাস করে? সে অনুভব করলো, নিজের বিশ্বাস নিয়ে চিন্তা করলে মন বরং খারাপ হয়ে যায়। তাই নয়?

এরকম কিছু বিশ্বাস করতে পারলে তো ভগবান ছ-দিনে বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করে একদিন বিশ্রাম করেছিলেন তা-ও বিশ্বাস করা যায়। অথচ সে মনপ্রাণ দিয়ে আজও এ তথ্যে বিশ্বাস আনতে পারলো না। রবিবারেই সে কি প্রার্থনা করে?

তার মুখের গাম্ভীর্য কমে গিয়ে একটা স্বপ্নময় দুঃখাতার ছাপ পড়লো। লুকনো চিন্তাটা আত্মপ্রকাশ করলো। ডানকান তার স্ত্রীর সম্বন্ধে চূড়ান্ত কুৎসা রটিয়েছে, তাকেও প্রতি সুযোগে অপমান করেছে, সেজন্যই কি ডানকানকে এরা বিদ্রূপ করায় সে হাসছিলো?

কিন্তু চোখ তুলতেই যোগাযোগটা ঘটে গেলো। ঘোড়ার পিঠে কীবলকে দেখতে পেলো বাগচী, গলির মুখে বড়োরাস্তাটা পার হয়ে যাচ্ছে তার ঘোড়া। কীবল কি প্রকৃত ইভান্‌জেলিস্ট, যেমন ডানকান বলেছিলো?

.

০৬.

চন্দ্রকান্ত এণ্ড্রুজ বাগচী তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানে ইংরেজ ঠোঁটটেপা জাত, গায়ে পড়ে আলাপ করে না, অন্য কেউ তেমন করে তাও চায় না। তা সত্ত্বেও কীবলের সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ দেখা দিলো তার মনে, নিছক ভদ্রতার চাইতে বরং বেশি গভীর সে আগ্রহ কি কারণ তার? মনের বিচিত্র গতি বলা হবে? কিংবা চরণের রসিকতায় উল্লেখ করা লাস্ট জাজমেন্ট ও ড্যামনেশন, ধর্ম সম্বন্ধে নিজের বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, কিংবা কীবল এই নামটা কি তার আগ্রহের মূলে ছিলো? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মকে কেন্দ্র করে আন্দোলন হয়েছিলো তার মধ্যে কীবল নামে প্রধান একজন ছিলেন বটে। এবং অক্সফোর্ডের সে আন্দোলন নিয়ে সে এবং তার শ্বশুর ফাদার এজ একসময়ে বহু আলোচনা করেছে। কখনো কখনো আবেগের সঙ্গে।

পনিকে দ্রুত চালানোর চেষ্টা করলো বাগচী। সে তার রাশি রাশি বালামচিসহ ঘাড় এবং মাথা এমনভাবে নাড়লো যেন তখনই ধাপে ছুটবে। অথচ সে অসহায়। হায় আদরপুষ্টতা!

কিন্তু কীবলও তাকে দেখতে পেয়েছিলো। ক্রিমিয়াখ্যাত লাইট বিগ্রেডের সওয়ারের কায়দাতেই যেন রাশ টেনে ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে আনলো সে।

হেলো ফাদার, গুডমর্নিং! এই বলে সে হাসলো। সুন্দর এবং স্বাস্থ্যবান তার দন্তপংক্তি এখনো। গুডমর্নিং বলতে গিয়ে কি সময়ের কথা মনে পড়লো বাগচীর? তারপরেই সেও হাসিমুখে বললো–গুডমর্নিং মিস্টার কীবল, কিন্তু আমাকে ফাদার বলা বৃথা। আমি একজন ভিলেজ স্কুলমাস্টারমাত্র। এদিকে যখন এসেছেনই আসুন আমার কুটিরে, অতি নিকটেই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে লাঞ্চের সময়টাকে আমরা এগিয়ে নেবো।

ইংল্যান্ডে অনুশীলিত কীবলের মনের ইংরেজি অভ্যাস অস্ফুটস্বরে একবার চিন্তা করলো, ইটনট ডান্ (এপ্রকার প্রথা না হয়)। কিন্তু পরক্ষণেই তার কী মনে হলো, আফটার অল দি ওনলি ইংলিশ গ্যার্ল দিশ সাইড ক্যালক্যাটা? (কলকাতার বাইরে ইংরেজদুহিতা আর কে? )। প্রকৃতপক্ষে তিনিই তো সম্ভাব্য হোস্টেস এক্ষেত্রে।

সে বললো–কিন্তু মিসেসের উপরে নির্যাতন হবে না? আচ্ছা, বরং এক কাপ কফি।

–আদৌ নয়-আদৌ নয়, বরং আমরা সম্মানিত জ্ঞান করবো। আসুন তাহলে। বাগচী ডান হাত প্রসারিত করে যেন তার বাংলোকে ইঙ্গিত করলো।

বাগচীর বাংলোর সামনে পৌঁছতেই, আর তাতে মিনিটকয়েক লাগলো, ঘোড়া দুটির ব্যবস্থা করলো সহিসই। তারা যখন বসবার ঘরে ঢুকছে ম্যান্টেলপিসের উপরে বসানো চার্চের আদলে তৈরি ছোটো ক্লকটায় একটা বাজতে কিছু দেরি আছে মাত্র।

ঘড়িটাতেই আগেকীবলৈর চোখ পড়ার একটা কারণ ছিলো। ক্লকের ফিট দুয়েক উপরে হলুদ-সাদা দেয়ালের গায়ে একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য। একটা বাড়ির, তার উপরের আকাশের, এবং একজোড়া গাছের ছবি। বাড়িটা অক্সফোর্ডের একটা কলেজের। কীবল যেটায় ছিলো অবশ্যই সেটা নয়। তাহলেও চেনা লাগলো তার। চিত্রকর এবং একজন অ-চিত্রকর ছাত্রের দেখায় পার্থক্য থাকেই। চিত্রকর আকাশের যে রং দেখে অথবা আকাশের যে রং লেগে কলেজবাড়ির এক বিশেষ অংশ ছবিতে আঁকার মতো হয়ে ওঠে তা চিত্রীর চোখেই ধরা পড়ে।

ততক্ষণে বাগচী বসুন-বসুন বলে চেয়ার এগিয়ে দিয়েছে।

এখন শীতকাল হলেও ঘরে অনেক আলো। একটা জানলার কাঁচে রোদও। কীবলের ত্বকে উষ্ণতাটা যেন একটু বেশি তীক্ষ্ণ মনে হলো, আরামদায়কের চাইতে তীক্ষ্ণ এবং হয়তো সেজন্যই বা কিছু উত্তেজক।

সে বললো–আজ দিনটা বেশ উষ্ণ।

–আরামদায়করূপে সে রকম, তাই নয়?

জানলার উপরে বসানো রঙিন কাঁচের স্কাইলাইট দিয়ে আলো আসছে। রঙিীন জ্যামিতিক ছবির মতো মেঝেতে।

বাগচী বললো–আপনি তো ধূমপান করেন না। কফি কিংবা অন্য পানীয় আনাই।

কীবল হাসিমুখে বললো–কফিই ভালো। যুদ্ধে খুব দামী মদ দেয় না, আর তাছাড়া অক্সফোর্ডে কিংবা ইন-এও দামী মদের জোগাড় করা কদাচিৎ সম্ভব।

বাগচী কীবলের কথা বলার সময়ে তার মুখের দিকে চেয়েছিলো। সে অনুভব করলো তার পরিচিত কোনো নীলকরের মুখে এমন সরল কথা সে শোনেনি। বেশ ভালো লাগলো তার। সেদিন লাঞ্চটা ভালোই হয়েছিলো, বেশ আলোকোজ্জ্বল এবং আধুনিক আবহাওয়ায়। বাগচীর বাংলোটা আকারে কিছু ছোটো হলেও ডানকানের বাংলোর সঙ্গে নকশায় একতা বুঝেছিলোকীবল। কিন্তু ডানকানের বসবার ঘর নিশ্চয় এমন গোছানো, আলোক-প্রতিফলিত নয়। মানানসই ছিটের পর্দা, ম্যান্টেলপিসের কিছু উপরে রাখা কটম্যানের আদত ছবি, বেশ বড়ো সেই পিয়ানোটা, সেলফে সাজানো বাগচীর বই, ডেস্কের উপরে রাখা টাইমস কাগজের ফাঁইল, আর সবকিছুতেই জানলা ও স্কাইলাইটের আলো। আর লাঞ্চে কিছু দেরি আছে বলে ঝকঝকে পাত্রে কফি নিয়ে কেট প্রবেশ করলো। সাদা প্রিন্টের স্কার্ট, তার উপরে নীল স্ট্রাইপের জ্যাকেট। তার লালচে চুল, যা বনেট পরলে ঢাকা থাকে, এখন বরং এলো খোঁপায় জড়ানো। অত অজু লাল রেশমি চুল! এ কি ভারতের জলবায়ুর প্রভাব? কীবল স্বীকার করেছিলো, তেমন সুন্দর পরিবেশ সে কল্পনাই করেনি। তার মনের কোথাও ঠোঁটচাপা কেউ সতর্ক করেছিলো–ইটস্ নট ডান। কিন্তু তার মনের অন্য অংশ তাকে উৎসাহিত করে বলেছিলো–এটা গ্রেট ব্রিটেন নয়, এখানে সীমার বাইরে যাওয়ার টান আছে। সে লাঞ্চে রাজি হয়ে টাইমস কাগজকে ইঙ্গিত করে বলেছিলো–লন্ডনের বাইরে এই প্রথম টাইমস দেখলাম। ক্যালকাটাতেওবা কজন রাখে?

তখন বাগচী বলেছিলো, কীবলের মুখে ইংল্যান্ডের কথা শুনেই তারা দেওয়ানসাহেবের কাছ থেকে টাইমস চেয়ে এনেছে। কাগজগুলো পুরনোই। তখন আবার বাষ্পীয় জাহাজ চললে কাগজও তাড়াতাড়ি আসবে, এবং তা কী অলৌকিক ব্যাপার তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। কফির সঙ্গে পিয়ানোর কথা উঠেছিলো। কীবল বলেছিলো, এমন দামী জিনিস নিছক খেয়ালের কথা। তখন কীবল ধর্মাচরণ এবং পিয়ানো বাজনা সম্বন্ধে এই গল্পটা বলেছিলো :

গল্পটা কার্ডিন্যাল নিউম্যানের প্রিয় শিষ্য ডব্লু. জি. ওয়ার্ড সম্বন্ধে। তাঁকে কীবল শেষবার দেখেছিলো অক্সফোর্ডের পথেই। বছর পঁয়তাল্লিশের একজন ইংরেজ ভদ্রলোক, কিন্তু ঘটনার সময়ে ওয়ার্ড যুবক। তখন ধর্মের ব্যাপারে ঝাঁজালো-ধারালো যুক্তি তৈরি এবং সঙ্গীতচর্চা এই দুইয়েতেই সমান প্রবল অনুরাগ তার। কখনো তিনি ইউক্যারিস্টের গুহ্যতত্ত্ব সম্বন্ধে পাণ্ডিত্যপূর্ণ রহস্যময়তার আঁধি তুলছেন, কখনো মোজার্টের কোনো ফিগারোর স্বরলহর ছড়িয়ে দিচ্ছেন কূজনের মতো। এই দুইয়ের কোনটিতে তার অন্তর সায় দিচ্ছে সে বিষয়ে তাঁর ধর্মগুরু ডক্টর পুসেরও দ্বিধা ছিলো। একদিন ওয়ার্ড শুকনো মুখে ডক্টর পুসের কাছে উপস্থিত হলেন। স্বীকার করলেন লেনটেনের সময়ে সঙ্গীতের মতো হালকা ব্যাপারে জড়িয়ে না-পড়ার যে প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন তা রাখতে গিয়ে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। এ বিষয়ে ডক্টর পুসে কি কিছু উপায় বাতলাতে পারেন?

ডক্টর স্থির করলেন, একটু-আধটু পবিত্র ধাঁচের বাজনা তেমন ক্ষতি করে না বোধ হয়। কৃতজ্ঞ ওয়ার্ড এক বন্ধুর ঘরে বাজনার আসর পাতলেন। শুরু হলো হেন্ডেলের গম্ভীর সঙ্গীত দিয়ে। চেরুবিনির ধর্মীয় স্বরলহরী তারপরে; ম্যাজিক ফুটের স্বর্গস্পর্শী স্বরগ্রাম এসে গেলো। কিন্তু হায় মোজার্টে অনেক বিপদ। কেউ হয়তো পাতাটা উল্টে দিয়েছিলো। আর সেইখানেই ছিলো পাপাজেনো-পাপাজেনার সেই দ্বৈতসঙ্গীত। রক্তমাংসের মানুষ আর কত সয়! সঙ্গীতের পর সঙ্গীত, স্বরগ্রাম হালকা ও দ্রুততর ক্রমে। যখন শেষ হলো মনে হলো। তখন দেয়ালের গায়ে কে মৃদু কিন্তু বারংবার টোকা দিয়ে চলেছে। হঠাৎ বন্ধুদের খেয়াল হলো, সর্বনাশ! পাশের ঘরটাতেই ডক্টর পুসে থাকেন বটে।

গল্পটা বলে কীবল, গল্পটা শুনে কেট ও বাগচী হেসে উঠলো। হাসতে-হাসতে সে বললো, না-না, আমি এমন পাদ্রী নই যে পিয়ানোতে আপত্তি থাকবে।

গল্পের মধ্যেই কফি শেষ হয়েছিলো। কেট উঠে দাঁড়ালো। কফির কাপ-প্লেট ট্রেতে কুড়িয়ে নিতে নিতে বললো– সে–আমাদের ঝি-চাকর নেই। লাঞ্চ কিছু বাকি আছে তৈরি করতে। আপনারা গল্প করুন। আমিও মাঝে-মাঝে আসবো।

কেট চলে গেলে বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–মিস্টার ওয়ার্ড কি রোমান ক্যাথলিক?

কীবল বললো–সম্ভবত। কিন্তু অ্যাংলো ক্যাথলিকদের সঙ্গে বিবাদ আছেবলেও শুনিনি। আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক ধরেছি। আপনি কোয়েকার। প্রকৃতপক্ষে আমি আজই চিঠি দিলাম বাড়িতে, তাতে লিখেছি, এখানে একজন প্রকৃত কোয়েকারের সাক্ষাৎ পেয়েছি।

বাগচী কোয়েকার শব্দ শুনে তার তাৎপর্য আবার উপলব্ধি করেই যেন শিউরে উঠলো। ঈশ্বরের সান্নিধ্যের অনুভূতিতে কম্পমান! সে বললো–সর্বনাশ! আপনি করেছেন কী?

-কেন আপনি কোয়েকার নন?

–হয়তো ডিসেন্টার। কেউ কেউ বলে ইউনিট্যারিয়ান।

-আদৌ না। আমি এবার লিখতে পারবো ইউনিট্যারিয়ানদের মধ্যে কোয়েকারের ভাব থাকে। আমি কিন্তু ইংলিশ চার্চেই অর্থাৎ অ্যাংলোক্যাথলিক আছি। যদিও আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকে এবং ক্রিমিয়ার কমরেডদের মধ্যে অনেকে বিশেষ করে যারা আইরিশ, রোম্যান ক্যাথলিক ছিলো।

বাগচী হাসিমুখে বললো–ডানকান আপনাকে ইভানজেলিস্ট এবং সেন্ট বলেছিলো।

কীবল হেসে বললো–আমাদের বন্ধু এসব ব্যাপারে পুরনো খবর রাখেন। তিনি অবশ্য ইভানজেলিস্টদের যে একসময়ে সেন্ট বলে ঠাট্টা করা হতো সে খবর রাখেন। কিন্তু এখন সেসব দিন বেশ বদলেছে।

এরপরে যে আলাপ হলো তা ইংল্যান্ডের ধর্ম-আন্দোলন সম্বন্ধে। বাগচী মাঝে-মাঝে প্রশ্ন করে এহংকীবল তার উত্তর দিয়ে যে আলোচনা তৈরি করলো তাকে সংক্ষেপে এরকম বলা যায় : রাষ্ট্রস্বীকৃত সুতরাং বৃত্তিপ্রাপ্ত পুরোহিত সম্প্রদায় যে ক্রমশই জনসাধারণের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলো, তার প্রমাণ তৎকালীন র‍্যাডিক্যাল প্রেসের বিদ্রূপ, পরিহাস, ক্যারিকেচার। ১৮৩১-এ রিফর্ম বিলের বিরুদ্ধে হাউস অভ লর্ডসে ধর্মীয় পীয়ররা ভোট দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ধূমায়িত অসন্তোষকেই বরং জ্বালিয়ে তুললেন। সেই বছরের শীতকালে রিফর্মসমর্থক জনতা বিশপদের গাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে এবং তাদের প্রাসাদে আগুন দিয়ে শুধু ছেলেমানুষি আনন্দই করেনি, প্রাপ্তবয়স্কের ক্রোধও দেখিয়েছিলো।

ভয়সন্ত্রস্ত চার্চম্যানেরা এবং তাদের উল্লসিত প্রতিপক্ষও স্থির করে নিয়েছিলো, ১৮৩৩ এর পার্লামেন্টের প্রথম কাজই হবে ডিসেন্টারদের স্বীকৃত অভিযোগগুলো দূর করা।

বাগচী বললো–তা বটে। এঁর বাবা এডুজ বলতেন, তখন বরং ধর্মীয় লর্ডদের, যাদের সামাজিক ও সংস্কৃতিক সম্বন্ধ উঁচুতলায় অন্য শ্রেণীর লর্ডদের সঙ্গে, তাদের কুটি উপেক্ষা করেও জনসাধারণের যে কোনো একজনেরই যে বাইবেল থেকে ধর্মপ্রচারের অধিকার আছে তা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিলো।

কীবল বললো, বলা বাহুল্য ডিসেন্টার এবং এভানজেলিস্টদের জনপ্রিয়তার কারণ যতখানি ধর্ম সম্বন্ধে তাদের ঐকান্তিকতা ঠিক ততখানিই তাদের সমাজসেবার আগ্রহ। উইলবারফোর্স এবং বাক্সটন যাঁরা ক্রীতদাসপ্রথা লোপ করার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা মনেপ্রাণে এভানজেলিস্ট ছিলেন সন্দেহ নেই। বাগচী বললো–বেন্থামের সেই কথাটাও মনে রাখতে হবে। তোমার নিশ্চয় মনে পড়বে কেট, তিনি বলেছিলেন সমাজের অন্যায় দূর করলে যদি সেন্ট বলে বিদ্রূপ করা হয় তবে তিনি সেন্ট অথবা এভানজেলিস্ট হতে আপত্তি করবেন না।

কীবল বললো–অন্যদিকে কেউ-কেউ এখনই মনে করে, ডিসেন্টারদের প্রাদুর্ভাব যে শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাতে সন্দেহ নেই। শিল্পবিপ্লবে কিছু কিছু শ্বেতকায় ক্রীতদাস তৈরি হয়েছিলো। ডিসেন্টারদের সকলকেই অল্পবিস্তর তাদের উন্নতির চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে। এককথায় হাই চার্চ-এর তারা যেমন রাজা, লর্ড, বিশপ এবং ধনী জমিদার ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে, লো চার্চ-এর ওরা তেমন মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত যারাই আকাশের তলে মাথা তুলতে চাইছিলো তাদের প্রতিভূ ছিলো–এরকম মোটামুটি বলা যায়।

কিন্তু কেট এলো। সে ইতিমধ্যে লাঞ্চের ফ্রায়েড রাইসের জল বসিয়ে এসেছে উনুনে।

বাগচীকে বললো–তুমি স্নান করবে তো? আমি বসি বরং অতিথির কাছে।

বাগচী উঠলো। অতিথিকে কিছুক্ষণের জন্য মাপ করুন বলে স্নান করতে গেলো সে।

কেট বললো–এখানে আপনার নিশ্চয় অসুবিধা হচ্ছে। আউটল্যান্ডিশ মনে হয় না?

-আউটল্যাভিশ? কীবল বললো–রোম্যান্টিক বরং, কিংবা রোম্যান্টিক বিষয়টাতেই আউটল্যান্ডিশ ভাব থাকে না? কিন্তু আপনি আমাকে মাপ করবেন যদি আমি আপনাদের ছবিগুলোকে ভালো করে দেখি।

-স্বচ্ছন্দে। বলে কেট উঠলো। বললো–আসুন।

ওয়াল-ক্লকের উপরে প্রিন্ট। বেশ খানিকটা সময় নিবিষ্ট হয়ে সেটিকে দেখলো কীবল। বললো–ক্রাইস্ট চার্চ নাকি?

কেট বললো–আগে ছবির তলায় পরিচয় লেখা ছিলো। নতুন করে ফ্রেমে পরানোর সময়ে ঢেকে গিয়েছে। ঠিক বলতে পারি না। এটা বোধহয় একারম্যানের প্রিন্ট, এরকম শুনেছিলাম মনে পড়ছে। হ্যাঁ, ক্রাইস্ট চার্চই হবে।

-কিন্তু এসব প্রিন্ট এখন ইংল্যান্ডেও দুর্লভ।

 প্রিন্ট ছবিটা দেখে বিপরীত দিকে দেয়ালের প্রাকৃতিক দৃশ্যের সেই জলরং ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কীবল। একটু উপরে ছবিটা। ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয় স্বদেশের দৃশ্য। চিত্রীও সুনিপুণ। কীবল মুগ্ধ হয়ে গেলো।

দেখতে-দেখতেই সে জিজ্ঞাসা করলো–এটা কি মূল ছবি? তাই যেন মনে হয়। টার্নার নাকি?

কেট পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। সে বললো–না, টার্নার নয়, এ জানতাম। এ ছবিটাও আমার বাবার সংগ্রহ। তার কাছে শুনেছিলাম এটা নরউইচ স্কুলের। দস্তখতটাকে দেখুন, কটম্যান মনে হয় না?

ছবিটাকে আর একটু ভালো করে দেখার জন্য পিছিয়ে আসতে গিয়ে ছেলেমানুষি কেলেঙ্কারি ঘটালো কীবল। গায়ে-গায়ে লাগলো কি না-লাগলো, কেটের সেন্টের সৌরভ কীবলকে অন্তরে বিদ্ধ করলো। এ অবস্থায় অনেকক্ষেত্রে পুরুষের চোখে পরিবর্তন দেখা দেয়। কীবল না বুঝে সে রকমভাবে চাইলো। ফলে কেটের মুখও লাল হয়ে উঠলো।

কীবল বললো–আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে দয়া করে ক্ষমা করুন।

মুহূর্তের মধ্যেই হেসে কেট বললো–আসুন, তার চাইতে বরং আপনার যুদ্ধের কথা শুনি।

কীবল বললো–দেখুন মিসেস বাগচী, এমন আশ্চর্য লাগছে আমার এখানে। আমি নিজেই ঠিক পাচ্ছি না ম্যানার্সের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি কিনা।

হয়তো ক্রিমিয়ার অভিজ্ঞতা কিছুটা আপনাকে নন কনভেনশ্যানাল করেছে। কেট হাসলো মিষ্টি করে।

বাগচী স্নান করে ফিরে এলো। মঞ্চের আগে গৃহকর্ত্রীরও বসে থাকে চলে না বিশেষ যদি সংসারের কাজ নিজে করতে হয়।

বাগচী বললো–এটা কিন্তু খুব মজার ব্যাপার। আমরা যখন ভাবতাম মানুষ ধর্মের কাছে। থেকে সরে যাচ্ছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ইনডাস্ট্রির প্রসারের ফলে, তখনই ধর্মটা আবার সর্বত্র প্রবল হয়ে উঠছে, তাই নয়! নতুন রোমান ক্যাথলিকদের সঙ্গে আমাদের মত না মিলতে পারে, কিন্তু তাদের সে ব্যাপারটায় একটা ঐকান্তিক অনুসন্ধান ধরা পড়ে, কেমন তাই মনে হয় না?

কীবল বললো–ঐকান্তিকতা তো বটেই। নিউম্যান, পুসে, কীবল, ম্যানিং প্রত্যেকেই ধর্মের ব্যাপারে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহশীল তাতে সন্দেহ কী?

লাঞ্চে বসেও আবার এই ধর্মের কথাটা উঠে পড়লো।

বাগচী বললো–কি লন্ডনে কি ক্যালকাটার শিক্ষিত মানুষমাত্রেই এখন ধর্ম সম্বন্ধে চিন্তা করে দেখুন। প্রচলিত পদ্ধতি যাচাই করে দেখছে অনেকেই। নতুন পথে অগ্রসর হতে চেষ্টা করছে যেন ঈশ্বরের দিকে। এসব খুবই ভালো, তুমি কী বলল কেট?

কেট বললো–সত্যর কাছে পৌঁছনোর আগ্রহ বলছো?

–আমার তো তাই মনে হয়। মিস্টার কীবল, আমি শুনেছিলাম শিক্ষিত সংস্কৃতিবান যুবকদের নিউম্যান, কীবল প্রভৃতি গুণীব্যক্তিরা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন। আপনার কি মনে হয় রোম্যান ক্যাথলিকদের সংখ্যা ইংল্যান্ডে এখন বিশেষভাবে বাড়বে?

একটু জল খেয়ে নিয়ে কীবল বললো–তা বলা শক্ত কিন্তু। ১৮৪৫-এর পরে অর্থাৎ নিউম্যান রোম্যান ক্যাথলিকে দীক্ষিত হওয়ার পরই অক্সফোর্ড আন্দোলন দুভাগ হয়ে গিয়েছে। পুসে ও কীবলের অ্যাংলো ক্যাথলিক; নিউম্যান-ম্যানিং-এর রোম্যান ক্যাথলিক সম্প্রদায়।

কেন, তার কী দরকার ছিলো? কেট জিজ্ঞাসা করলো।

–রোম্যান ক্যাথলিকদের পক্ষে শিক্ষা, কালচার এবং ধর্মে অনুরাগ থাকলেও সেই মতবাদ যে চট করে ইংল্যান্ডে বেড়ে উঠবে তা মনে হয় না। ভেবে দেখুন ১৮৫০-এ পোপ কয়েকজন রোম্যান ক্যাথলিক বিশপের এক্তিয়ার ঘোষণা করার সঙ্গে-সঙ্গে পোপের আক্রমণবলে যে আন্দোলন তৈরি হয়েছিলো তা এখনো থিতিয়ে যায়নি। ইংল্যান্ডে রোম্যান ক্যাথলিকদের সহ্য করা হচ্ছে, কিন্তু পোপের প্রভাব রাজনীতির দিকে এগিয়েছে মনে করা মাত্র ইংল্যান্ডে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। তাই স্বাভাবিক নয়? এবং এই কারণেই অ্যাংলো ক্যাথলিক হয়েছেন কেউ-কেউ। দেশপ্রেমের তত টান একটা আছে। (কীবল এই জায়গায় একটু হাসলো)।

বাগচী বললো–হ্যাঁ, তা বটে। এরকমও শুনেছি।

সে কৌতুক বোধ করলো। যেন মনে মনে বললো, স্বাজাত্যবোধ এবং বিদেশীধর্ম, যতই বলো ধর্ম জাতি দিয়ে বিভাজ্য নয়। আসলে কিন্তু ধর্ম জাতীয়তার সীমা লঙঘন করলেই মুশকিল।

তখন আলাপের থেকে লাঞ্চের সুস্বাদ তাদের আকর্ষণ করলো।

পরবর্তীকালে কীবল অনুভব করেছে সেদিনকার লাঞ্চটা ভালোই হয়েছিলো, যার অন্য বিশেষণটা হয়তো ইনফর্মালও হতে পারে। আলাপটা, কি লাঞ্চের আগে কি লাঞ্চের সময়ে, বেশ উত্তেজক হয়ে উঠেছিলো। কিংবা তার অন্য নাম ঐকান্তিক!

লাঞ্চের পরে ইউরোপের সভ্যতার উপরে পেগানদের প্রভাব কিছু আছে কিনা, রেনেশায় তাকতটা খুঁজে পাওয়া যায় এমন আলোচনা হবে বলে মনে হয়েছিলো একসময়ে। তারুণ্যের ফলে কীবলের যেন আলোচনার বাতিকও আছে। কিন্তু এদেশের খাদ্য সুস্বাদু হতে পারে, কেট বলেছিলো, অতি সহজপাচ্যও, কিন্তু তা ভারী আর যেন আয়েশ করতে প্ররোচনা দেয়। লাঞ্চের ওজনটা ভারীই ছিলো, মদের পরিমাণই বরং কম। এবং একটু ঝাল বেশি।

পথে বেরিয়ে, তার ঘোড়া তখন ছুট করছে, কীবলের মনে হলো, সে তার আত্মিক ভগ্নীকে এরপরেই যে চিঠি লিখবে তাতে একারম্যানের প্রিন্ট সম্বন্ধে না-হোক নরউইচ স্কুলের কটম্যানের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে বলবে।

ঠিক এই সময়েই তার মনে হলো, নাচতে গিয়ে সঙ্গিনীর মাড়িয়ে দেওয়া যেন। না, সে কথা আত্মিক ভগ্নীকে লেখা যায় না বোধহয় সেই কবোষ্ণ অনুভূতির কথা। অথচ এটা অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া কিছু নয়। একটা অনুভূতিই মাত্র, যার প্রমাণ নেই। এবং ভদ্রলোকের তা মনে রাখা উচিত নয়। না, উচিত হয় না।

কীবল অন্য মন দিলো, অর্থাৎ লাগাম দিয়ে আঘাত করে ঘোড়াটার গতি বাড়ালো।

বাগচী বললো–এখন কি আমরা বিশ্রাম করবো ডার্লিং?

–যদি কাজের কথা মনে না হয়। কেট হাসলো। চরণদাসের ডিসপেনসারি?

-বেশ লাগছে। সুন্দর লাঞ্চ, সুন্দর আলাপ। কেমন লাগলো কীবলকে? বাগচী লক্ষ্য করলো না, কেটের জতে একটা হালকা ছায়া পড়লো।

সে বললো–অন্যদিকে দ্যাখো কেট, মানুষ আবার তার ঈশ্বরকে ফিরে পাচ্ছে। নিছক অভ্যাসের ব্যাপারের চাইতে বেশি। ইংল্যান্ডের যাঁরা রোম্যান ক্যাথলিক নিদেন অ্যাংলো ক্যাথলিক হচ্ছেন, কলকাতার যাঁরা খৃস্টান ও ব্রাহ্ম হচ্ছেন, তারা সমান পিপাসা নিয়ে চলেছেন–এমন মনে হয় না? মনে হয় না যে, কি লন্ডনে, অক্সফোর্ডে, কি কলকাতায় যেন একই ঈশ্বরের প্রভাবে মানুষ ধর্মের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। একটা কথা কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। বিলেতের ওঁরা ইন্টারশেসনকে মূল্য দেন কিনা।

ইন্টারশেসন বলছো? আমার মনে হয় রোম্যান ক্যাথলিকরা তা মানবে।

 বাগচী ভাবলো–আমি এবং আমার ঈশ্বর–আমাদের মধ্যে আমার হয়ে ঈশ্বরকে নিবেদন করার জন্য সত্যি কি অন্য কাউকে দরকার হয়? যাকে ইন্টারশেসন বলা যাবে?

কিন্তু তখন বিশ্রামের সময়, ছুটির দিন। বাগচী পাইপ ধরালো। উল কাটা নিয়ে বসলো কেট।

কয়েকদিন পরে একদিন বাগচী এই প্রশ্ন তুলেছিলো :বিলেতের ইভাঞ্জেলিস্ট আন্দোলন তাদের দেশের সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। সে দেশের মধ্যবিত্তদের সাংস্কৃতিক প্রাধান্য লাভের ইচ্ছা তার পিছনে কাজ করছে। কলকাতায়? এখানে এই দেশে কেউ কি বলবে না, ধর্ম আছে, যথেষ্ট ধর্ম আছে। অন্য কিছু চাই। তখন তার মন কালো থাকায় সে কলকাতার ধর্ম-আন্দোলনটাকে বিলেতিয়ানা বলে অনুভব করেছিলো। বিলেতে যা হচ্ছে এখানে তা হোক এমন বিলেতিয়ানা নিছক নকল। কিন্তু এ ভাবনা পরে।

তখন কেট বললে, উঠছো তো?

বাগচী বললো, দেরি করে ফেলেছি, রোগীটা বসে আছে।

.

০৭.

নয়নতারা বললো–দূরে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাই কি শিকারের সঙ্গী?

ইতিমধ্যে কখন ঘোমটা উঠেছে খোঁপা ঢেকে। নয়নতারা একটা হাতে ঘোমটার দুপাশ ধরলো, তাতে রগ, কান, চিবুক আর-একটু ঢাকা পড়লো।

হাতি ক্রমশই লোকগুলির দিকে এগোচ্ছে।

নয়নতারা বললো– রাজকুমার, শুনেছি কুমীর শিকার নাকি জলের বুকে করতে হয়। ওই সরু-সরু নৌকোগুলোকেই ব্যবহার করা হবে?

দূরে বিলের বুকে সরু-সরু কয়েকটি নৌকো বটে।

নয়নতারা আবার বললো–জানো, কুমীর ইচ্ছা করলেই কাঠের গুঁড়ি হতে পারে? রাজু বললো–শুনেছি, বাঘও ঝোপঝাড় হতে পারে।

–কিন্তু

কী কিন্তু?

 রাজু দেখলো নয়নতারার ঝুঁকে পড়া মুখটায় চাঁদরের ঘের বাঁহাতে চিবুকের উপরে ধরা। ঠোঁট দুটো হাসছে। কিন্তু চোখ দুটি যেন বেশি টানা আর স্নিগ্ধ হয়ে উঠলো। নয়নতারা এই প্রথম রাজুর হাতের উপরে হাত রাখলো যেন স্পর্শেও তেমন স্নিগ্ধ কিছু বলবে। চাপা গলায় বললো–আমি ক্ষত্রিয়া নই, দোহাই রাজু।

কিন্তু ততক্ষণে হাতি দেখে গ্রামবাসীরা হৈচৈ করে এগিয়ে এলো।

নয়নতারা বললো–আর কখনো মই ছাড়া হাতি বার করার কথা ভেবো না। কী মুশকিল!

রাজু নামলো শুঁড় বেয়ে। মাটিতে দাঁড়িয়ে হেসে বললো–তাহলে ঠাকুরানী তোমার নতুন পত্তনিটাকে পছন্দ হয় কিনা তা দ্যাখো। মাহুতকে বললো– কাছারিতে তহশীলদারনা থাকে অন্য কেউ থাকবে, মোড়লদের বাড়িতে খবর দিও, সাহেবান কাছারির খাস কামরায় দুপুরে থাকবেন। আমরাও কাছারির ঘাটে উঠবো বিকেলে।

পরে একদিন নয়নতারা রাজুর এই উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করেছিলো।

.

 কেউ-কেউ বলে,কুমীরের নানা জাত আছে এবং তারা নাকি হিংস্র। তাদের গায়ের চর্ম বর্ম, চোয়ালে বসানো সারি-সারি বল্লমের ফলা, এবং জলের তলায় ডুবো জাহাজের গতিবিধি–এসবই নাকি তার গোপন হিংস্রতার কিছু কিছু প্রমাণ যা গোপন রাখতে পারেনি। কিন্তু কুমীর যে বোকা সে বিষয়েও অনেক গল্প আছে, বাঁদর, শিয়াল কার কাছেই না সে ঠকেছে। সুতরাং মানুষের সঙ্গে যারা সশস্ত্র এবং বন্দুকও আছে যাদের-তারা যখন দলবদ্ধ, তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাময়িকভাবে আতঙ্কজনক হলেও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তীব্র ব্যথা যা সমস্ত শিরা-উপশিরা স্নায়ুকে পাগল করে তোলে, লুকোনোর পালানোর চেষ্টা যা শরীরের সব যন্ত্রকে একসঙ্গে পুরোদমে চালাতে চেষ্টা করে, তারপরের সেই বিস্ময় যখন কোনো যন্ত্র চেষ্টা সত্ত্বেও কোনোদিনই যেমন অচল অকেজো দেখা যায়নি তার চাইতেও অকেজো হয়ে যায়, আর নিজের চারপাশেই সেই রংটা দেখা দেয় জলে যা খাদ্যসংগ্রহের সার্থক চেষ্টার লক্ষণ হিসেবেই তার পরিচিত, এবং তখন খাদ্যসংগ্রহ হয়েছে কী না-হয়েছে, শরীরের ভিতরের সেই জ্বালা খাদ্যসংগ্রহের সার্থকতাবোধই কিনা এমন অনুভব করতে করতে রোদ পোহানোর অনুভূতি আর আগ্রহ এসে মিশে যায় সেই অনুভূতিতে, স্থির হয়ে যায় কুমীরটা।

কিন্তু এর বেশি কুমীরের কথা আমরা কী বলতে পারি?

কিন্তু বিল? তা যেন একটা আলাদা জগৎ। কোথাও দু-চার-দশ বিঘা পরিমাণ দাম। দামে কাষা, হোগলা প্রভৃতি ঘাস তো আছেই, আশশেওড়া, আকন্দ, এমনকী বাবলাও জন্মেছে কোথাও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদিকের অধিবাসীরা দাম কেটে জলের গলিপথ বার করেছে। অন্য কোথাও টলটলে পরিষ্কার জল। সে জলে কোথাও কলমি, কোথাও শাপলা, অন্য কোথাও দশ-বিশ বিঘা পরিমাণ পদ্মবন। দামের উপরে বক, হাড়গিলে, মাছরাঙা; কলমি, শাপলার মাঝে মাঝে পানকৌড়ি আর মাছরাঙা।

রাজু যেখানে দাঁড়িয়েছিলো তার কাছাকাছি পারের সমান্তরাল একটা চর জেগেছে যেন। চরটার ওপারে অন্তত এক ঝাক বুনো হাঁস।

বিলমহলে রাজুদের কাছারি আছে বটে। গ্রামের লোকেরা বললো, তা প্রায় একক্রোশের পথ হবে। কিন্তু কুমীরের আজ্ঞ সামনের বাঁকটা থেকেই দেখা যাবে।

রাজু জানালো কাছারীতে তার কোনো কাজই নেই, এখনই বরংকুমারীর খোঁজে যাওয়া যেতে পারে। গ্রামের লোকেরাও বললো, সেটাই ঠিক হবে। রোদের তাপকমলে কুমীরকেও ডাঙায় পাওয়া যাবে না। তারাই স্থির করলো যত লোক জমেছে সবাই গেলে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে, কুমীর তো একচোখ খুলেই ঘুমোয়। সুতরাং শালতি আর তার সঙ্গে দুখানা। ডোঙামাত্র যাবে । রাজুর সামনের যে চরের কথা বলা হয়েছে সেই চর আর এ পারের মধ্যে বিলের জল একটা ছোটোখাটো নদীর মতো। শালতি বা ডোঙার পক্ষে যথেষ্ট গভীরও বটে।

শালতি একটু এগিয়ে যেতে রাজু দেখতে পেলো চর একটাই নয়, আর প্রথমটিই সব চাইতে উল্লেখযোগ্য নয়। কোনো চর পারের সমান্তরাল, কোনোটি বা কোনা কুনি পারের দিকে এগিয়ে এসেছে। যেখানে চরটা বড়ো এবং খালের পরিসর এবং কম সেখানে দু-তিনটি বাঁশ পাশাপাশি বেঁধে সাঁকো করা হয়েছে। এমন একটা সাঁকোর নিচে দিয়ে শালতিটা অনায়াসে গলে গেলো।

এদিকের চরগুলোর বৈশিষ্ট্য আছে। নদীর নয় যে কোথায় বালি আর কোথায় পলি খুঁজতে হবে। যেদিন চর জাগে সেদিনই চাষ দেওয়া যায়, কলাই আর ধান হবেই। যেখানে চরটা বড় সেখানে চাষ হয়েছে। কোনো কোনো চরে দু-চারটি ছোটো ছোটো ঘরও চোখে পড়ছে।

দিনটা পরিষ্কার। অনেক দূর পর্যন্ত খোলা আকাশ চোখে পড়ছে। নীল উঁচু আকাশে কোথাও সাদা তুলো ছড়ানো।

কোথাও জল একেবারে শান্ত কাঁচের ফলকের মতো। অন্য কোথাও, যেখানে জলটা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে, সেখানে, বিঘৎ পরিমাণ উঁচু ঢেউ উঠছে বাতাস লেগে। কোথাও শালতি দেখে জলের ধারের হাড়গিলে আকাশে উঠলো। কোথাও চাষ থামিয়ে কৃষক জলের ধারে এগিয়ে এলো বালতি-ডোঙার ছোটো বহরটাকে ভালো করে দেখতে। একবার একটা চর ঘুরে যেতে, না বুঝে এক ঝাক বুনো হাঁসের মধ্যে গিয়ে পড়লো শালতি। ডাহুক, হাঁস, করন্ডে সে কি প্রতিবাদ!

রাজুর সঙ্গীরা স্থির করেছিলো কুমীরকে তারা গ্রামের বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ করবে। কারণ দেখিয়েছে–তাড়া খেলে গভীর জলের দিকেই ঝুঁকবে সে। যদিবা গ্রামের দিকে যায় সেখানে এক কোমরের চাইতে বেশি জল নেই, ভাল্লা তেঁটায় সেখানে কুমীরকে ঠেকানো যাবে।

 আরো আধঘণ্টা শালতি এদিক-ওদিকে চলে একটা বড়ো চরের দু-তিনশো গজের মধ্যে এসে পড়লো। বড়ো চড়টার কাছেভিতে আরো কতগুলি ছোটো ছোটো চর কুমীরের পিঠের মতোই জেগে আছে।

কিন্তু কুমীর তো মাটির তৈরি নয়। আরো একঘণ্টা ধরে এ-চর সে-চরকে বেষ্টন করে ঘোরা হলো। কাদাখোঁচা পাখি আর টিটিভকে নড়তে-চড়তে দেখা গেলো, মাছ ধরার আশায় ডুবিয়ে রাখা ভোঙাকে ভুল বুঝে একবার খুব সন্তর্পণে এগিয়েও গেলো শালতি, কিন্তু কুমীরকে গল্প বলেই মনে হলো।

তখন রাজু আবার ঘড়ি বার করে দেখলো। চারটে বাজতে চলেছে। অনুমান হয় দিগন্তর বিস্তার ছোটো হয়ে আসছে। জলে লগির যে-ছায়া পড়েছে তা থেকে বোঝা যায় সূর্য ইতিমধ্যে পশ্চিমে নেমে পড়েছে। ঠিক এমন সময়ে লগিওয়ালাদের একজন চাপা গলায় ইশারা করলো। অন্য লগিওয়ালারা ইশারা বুঝে উল্টোদিকে লগি বসালো। সামান্য একটা আঁকি দিয়ে শালতি থামলো। হাতের ইশারায় ইশারায় জানাজানি হয়ে গেলো। শালতির দিকে মুখ করে একটা আর তার পেটের দিকে মুখ করে আর-একটা।

শালতির গলুই-এর কাছে খানিকটা পাটাতন, তার উপরেই বসেছিলো রাজু। তার উপরেই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলো সে। দুটো তো আর সম্ভবনয়। যেটিকে আড়াআড়ি পাওয়া গেলো সেটির সামনের পা আর ঘাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় লক্ষ্য করে একবার, গুলি খেয়ে সেটা লাফিয়ে উঠেই চলতে শুরু করতে না করতে পা ও পেটের মাঝামাঝি নিশানা পেয়ে আর একবার গুলি করলো রাজু। অন্য কুমীরটি ভয় পেয়ে শালতির দিকেই ছুটতে শুরু করলো। তার সুচলো মাথা ওপাশের ডোঙার হাত আট-দশের মধ্যে এসে পড়লো। ভোঙার লোকেরা চিৎকার করে উঠলো। কুমীরের মুশকিল হলো, কিংবা তার দুর্ভাগ্য। যেখান থেকে সে জলে নামতে ছুটছে সেখানে জল এক কোমরের বেশি নয়। আর একটু ঘুরে হাত-দশেক দূর দিয়ে গেলে সে গভীর জলই পেতো। ডোঙার মানুষরা তখন মরিয়া, কুমীর উপরে এসে পড়লে জলে পড়বে মানুষ; আর জলে কেউ কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করে না। টেটা আর বল্লমের (সবগুলোতেই দড়িবাঁধা) খোঁচায় কুমীরকে রুখতে চেষ্টা করলো তারা। কুমীর ছুটে আসছিলো, তার ভারি শরীরের ওজনের সঙ্গে সেই গতি গুণ হচ্ছে। একটা ধারালো টেটা বিধতে তার শরীরের চাপেই সেটা তার মর্মে পৌঁছলো। মুহূর্তে দিক বদলালো সে, টেটার রশিতে টান পড়লো, আর সেই টানে ডোঙা কুমীরের ডাঙ্গায় উঠে পড়লো। রাখো রাখো, গেলো-গেলো করতে করতে অন্য ডোঙাটা লগি ঠেলে শালতিকে ধাক্কা দিয়ে প্রথম ভোঙাটাকে সাহায্য করতে এগোলো। সে ডোঙা থেকেও টেটা ছোঁড়া হলো দু-তিনটি। দৈবাৎ তার একটি মানুষকে না-বিধে কুমীরকেই বিধলো। দু-দড়ির টান পড়লো কুমীরের উপরে।

চরের উপরে আড়াআড়ি দুটো নালা। অল্প জল বলেই মনে হয়। সেই নালার দিকে ততক্ষণে চলছে গুলি-খাওয়া প্রথম কুমীরটা। শালতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়েছে। সেটা লেজ আছড়াচ্ছে। রাগে, কিংবা একটা পা ভেঙেছে বলেই, চলতে গিয়ে লেজের অমন ব্যবহার হচ্ছে।

ডাঙার লোকরা গেলো-গেলো রাখো রাখো করছে, রাজু একবার সেদিকে চেয়ে দেখলো। শালতিকে চরের উপরের নালায় নিতে বললো। পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করলো। একমুহূর্তে কীই-বা বোঝা যায়! মাথার উপরে বন্দুক আর টোটার বেল্ট এক হাতে উঁচু করে ধরে সে জলে লাফিয়ে পড়লো। ওদিকেও কুমীরের টানে ডোঙা জলে ধাক্কা মারছে।

কী করবে তা শালতির লোকরা বুঝে উঠতে পারলো না। জল এখানে খুব বেশি না থাকার কথা, তাহলেও এক কোমর জল কেন হাঁটুজলেও কি মানুষ কুমীরের সমকক্ষ? কিন্তু রাজকুমার তো, কী বিপদ! শালতির একজন চিন্তা করে জলে নামলো। অন্য আর-একজন তাকে দেখে জলে লাফিয়ে পড়লো। ততক্ষণে রাজু জল ঠেলে, জল ছিটিয়ে চরের মাঝামাঝি গিয়ে পৌঁছেছে। তার ভিজে স্যুট থেকে জল গড়াচ্ছে।

রাজু একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা দেখলো, বন্দুকে দুটো গুলি পুরে সে আবার ছুটলো হাঁটুজল ভেঙে। জল ছিটোছে পায়ে-গায়ে। জলে গতি আটকাচ্ছে। কুমীরের সঙ্গে কি ছুটে পারা যাবে! ওদিকে ডুবো ঝোপঝাড়। কুমীর সেদিকে গেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, কিংবা চরের ওদিকে জল পায় যদি। চর অসমান, উঁচুনিচু, গাড়াগর্তও আছে।

না, কুমীরটা তেমন ছুটতে পারছেনা। চাকাভাঙা গাড়ির মতো অবস্থা তার। একটা ঢালু দেখে সে বোধ হয় আশা করলো সেদিকে জল আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটা গাড়া। নিচে নেমে গিয়ে জল না পেয়ে কুমীরটা দিক বদলে কিংবা ভুল করে বরং রাজুর দিকে এগিয়ে এলো, কিংবা পাশ কাটাতে গিয়ে দূরত্বটা কমিয়ে আনলো। হাঁটু গেড়ে রাজু কাদামাটিতে বসে পড়লো। একমুহূর্ত তাক করে রাজু গুলি করলো। এবার কুমীরের গতিটা থেমে গেলো।

 অন্য কুমীরটাকে নিয়ে ভোঙার লোকেরা বিপদেই পড়েছিলো। দুটো টেটার, তা অবশ্য কুমীর যত টানছে ততই তার নাড়িতে টান দিচ্ছে, দড়ি ধরা বটে কিন্তু তাতে তার লেজের আছড়ানো কমছেনা, চলাও বন্ধ করেনি সে। একজন সাহস করে বল্লম মারলো পাশ থেকে, কিন্তু যেন ঠিকরে এলো কুমীরের কাটার খোলা থেকে। তখন আর-একজন বরং তার মুখের দিকে এগিয়ে গিয়ে পেটের কাছাকাছি আর একটা টেটা বিধিয়ে দিতে পারলো। টেটাটার দড়িবাধা ডগাটা মাটি আর কুমীরের শরীরের চাপে পাটকাটির মতো ভেঙে গেলো, কিন্তু সেই চাপেই তার ধারালো ফলাটা কুমীরের শরীরের মধ্যে এক হাত পরিমাণ বসে গেলো।

তখন পশ্চিমের আকাশ লালচে হয়ে উঠেছে। শালতিটাকে চরের কোণে ভেড়ানো হয়েছে। রাজু শালতিটাতে বসে দেখলো, বাদামীবাদামী সেই আলোয় দুটো ভোঙার মতো দুটো কুমীর এখন স্থির হয়ে আছে।

শালতির একজন বললো–পা ঝুলিয়ে বসুন, হুজুর, জুতোর কাদা ধুয়ে দিই।

আর-একজন বললো–এখন হুজুর, আমাদের খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে। অন্ধকার হলে চরে-চরে গোলকধাঁধায় পড়বে।

রাজু বললো–একজন বরং বন্দুকটাকে একটু মুছে রাখো, জল লেগেছে।

রাজু ঘড়ি বার করলো। পাঁচটা পার হয়ে গিয়েছে। স্নান হেমন্তের সন্ধ্যা ছটাতেই গাঢ় হবে বটে। ঘড়িটার গায়ে জল। রুমাল দিয়ে রাজু মুছলো।

শালতির সেই লোকটি বললো–এখন হুজুর, শালতির দু মাথাতেই লগি মারা হবে, দুলবে শালতি, আপনার কি অসুবিধা হবে হুজুর?

রাজু বললো–একটার চামড়া কী আমাকে পৌঁছে দিতে পারো তোমরা?

রাজু হেসে বললো–অত তাড়াতাড়ি দরকার নেই।

শালতি চলতে শুরু করলো, শালতির আগেপিছে ডোঙা। একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে ছুটছে সেগুলো। ডোঙায় দুজন, শালতিতে চারজন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে লগি মারছে। একটা শব্দমাত্র করে চারটে লগি পড়ছে জলে। বাচ্ খেলার মতো চলছে শালতি। কী যেন একটা বিড়বিড় করছে লগিওয়ালারা, মন্ত্র যেন। হঠাৎ একসঙ্গে গানটা একটা চিৎকারে ফুটে উঠলো, প্রথমে শালতিতে, পরমুহূর্তে ভোঙা দুটিতেই।

জল কালো, শালতির দুপাশের দাম অথবা চরের আগাছার ঝোপঝাড় বরং কালচে খয়েরি। আকাশ ধোঁয়াটে আর নিচু। শীত শীত লাগছে ভিজে স্যুটে রাজুর।

কাছারির ঘাটে পৌঁছতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, তা হলোও না। অন্ধকারে পথ হারানোর ভয় রইলো না, কারণ সন্ধ্যার আগেই কাছারির সামনে বড়ো বড়ো মশাল জ্বালানো হয়েছিলো, উপরন্তু কাছারির বজরাই আলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো রাজকুমারকে বিকেলের আলোয় ফিরতে না-দেখে।

পারে উঠলো রাজু। জনতার আগ্রহই সীমা ভেঙে এগিয়ে গেলো, আধো অন্ধকারে পায়ের উপরে পা ফেলার জায়গা রইলো না। তখন হঠাৎ একজন মানুষ কোথা থেকে দুই বাহু ছড়িয়ে দিলো। তার দুই ছড়ানো হাতের তেলোর মধ্যে ব্যবধানটা গজচারেক হবে। দুই তেলো দিয়ে সে ভিড়কে চাপ দিয়ে পিছু হঠতে লাগলো যেন দাম কেটে নৌকোর পথ করছে। যেন সে এক অপরিচিত ইঙ্গিতে রাজুকে এগিয়ে যেতেও বলছে। তার হাঁড়ির মতো মাথা, প্রচণ্ড চৌকো চোয়ালের উপরে থাবা-থাবা মেদমাংস বসানো মুখমণ্ডল, উপরের এবং নিচের ঠোঁট-ঢাকা সিন্ধুসিংহের মতো গোঁফ সত্ত্বেও মনে হলো লোকটি নাচছে যেন। অন্তত ভিড় ঠেলতে ঠেলতে তার কাঁধ দুটো এবং বাহুর উপরিভাগ ওঠানামা করছে, মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে ফিরছে দুখানাও ঠিক সোজা পড়ছেনা। লোকটির গায়ে কাঁধকাটা পিরহান, কোমরে উড়নি জাতীয় কিছু জড়ানো, ধুতির ঝুল ছোটো তাই কেঁচা হাঁটুর কাছে দুলছে।

লোকটি পিছিয়ে পিছিয়ে যেখানে থামলো সেটা একটা গাছের তলা।

মশালে মশালে গলা সোনা রং। মাটিতে একটা সরু কাজ করা চাটাই বিছানো, তার উপরে একখানা চেয়ারের মতো উঁচু জলচৌকি।

কথা বলতে গেলে বোধহয় গোঁফ তুলে ধরতে হয়, তেমন করে গোঁফ পাকিয়ে লোকটি বললো– বসতে আজ্ঞা হোক, রাজকুমার।

ভিজে জামাকাপড়ে বসবে কিনা এই দ্বিধা করতে লাগলো রাজু। কিন্তু ততক্ষণে সেই বড়ো মাপের লোকটি আর-এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। সে বললো–জোকার দাও।

যারা ভিড় করছে তারা সবাই পুরুষ। অপটু, অনভ্যস্ত, পুরুষালি গলায় হুলুধ্বনির নকল করে দুএকজন ডুকরে উঠতেই হাসির গররা পড়ে গেলো।

লোকটি বললো–চপ! সে এদিক-ওদিক চাইলো, ভিড়ে কাউকে খুঁজে পেয়ে বললো–ও বামুন, ইদিকে, ইদিকে।

শুটকো কালো চেহারার, কিংবা শুটকো না, বলে, হাড়েমাসে দড়া পাকানো একজন প্রৌঢ় এগিয়ে এসে বললো–তোমার আর সুখের পিরবার নেই মণ্ডল। নাও, ধরো।

সে নিজের মুখের কাছে হাতের তেলো রেখে আ বাবা ইয়া বলে ফুকরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে সেই মেদের পাহাড়ও।

রাজুর বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠলো। সেই শুটকো বামুনের গোট শরীরটাই একটা শিঙা হলে তবেই তেমন ফুকরে ওঠা সম্ভব।

এই প্রাথমিক কর্তব্য সমাপ্ত হলে মেদমাংসের সেই বালিআড়ি (বালিআড়ি বলাই ভালো, পাহাড় স্থির কঠিন, এক্ষেত্রে পাহাড়ের গা যেন সবসময় সচল, খসে খসে পড়ছে উপরের স্তর হাসি হয়ে হয়ে), সে ট্যাক থেকে হলদে কিছু একটা বার করলো। ডান হাত স্পর্শ করে এগিয়ে ধরলো রাজুর সামনে; গোটা শরীর কোমরের কাছে ভঁজ করে ঝুঁকে দাঁড়ালো। বললো–নেকনজর দিতে আজ্ঞা হোক, রাজকুমার। দৃশ্যটা হেসে ওঠার মতো। কিন্তু ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মোহরটাকে ছুঁতে হলো রাজুকে।

রাজুর শীতশীত লাগছিলোই, এখন উত্তেজনার বদলে অস্বস্তি। কারণ সেই কাদাজল হাঁটুর উপর পর্যন্ত পৌঁছেছে। হাতির খোঁজে সে এদিক-ওদিক চাইলো। নিজের অস্বস্তির কথা প্রকাশ করা যায় না। সে বললো–আমার সঙ্গে সদরে দেখা করো, মণ্ডল।

লোকটি এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বললো–হুঁজুরের এই কোলের ছেলের নাম গজা। ওরে হাতি আন। হাতি আন। ভিজে পোশাকে হুজুরের খারাপ লাগছে।

চার মণ ওজনের সেই গজা কোলের ছেলেই বটে।

কিন্তু ততক্ষণে তহশীলদার নিজে পৌঁছতে পেরেছে। ঘণ্টার শব্দও হলো। তাহলে হাতি এবার নড়ছে। বোধহয় হাতিও এতক্ষণ কোণঠাসা হয়েছিলো।

হাতি বসলো। তহশীলদারের লোকরা আলো এগিয়ে আনলো। শালতির লোকেরা শিকারের সরঞ্জাম তুলে দিলো। রাজু হাতির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মাহুতের ইশারায় শুড় নামালো হাতি। রাজু শুড়ের উপরে দাঁড়াতেই শুড় উঁচু করলো। রাজু হাওদায় বসতেই হাতি চলতে শুরু করলো।

নয়নতারা বললো–একেবারে ভিজেছো তো অবেলায়?

রাজু হাসলো। বললো–পাইপ ধরাতে পারলে হতো।

সেই চামড়ার পাউচ বার করতে করতে নয়নতারাকে জিজ্ঞাসা করলো সে কোলের ছেলে গজা মণ্ডলকে দেখেছে কিনা?

মাহুতরা সাধারণত কথা বলে না। কিন্তু গজা সম্বন্ধে বোধহয় না বলে থাকা সহজ নয়। সে বললো–হুঁজুর গজাও নয়, মণ্ডলও নয়। ওর বাপঠাকুর্দা ছিলো মেজা। সেই মিলিয়ে নাম নিয়েছে গজা। তা কাঁধে মাপও গজ হবে।

রাজু দেখলো দেশলাই তামাক ভেজেনি।

অন্ধকার বেশ ঘন হচ্ছে ক্রমশ। ঘাসবনে হাতিও হাওদার তলায় অস্পষ্ট। পাইপেতামাক ভরে দেশলাই জ্বাললো রাজু। আর তখন তার নজরে পড়লো সেই আলোয় নয়নতারার কপালে মস্ত একটা গোল সিঁদুরের টিপ।

রাজু হেসে বললো–সে কী?

এতক্ষণে নয়নতারারও খেয়াল হলো।

রাজু বললো–গ্রামের মেয়েরা তাহলে দুয়ে-দুয়ে চার করে সাজিয়ে দিয়েছে?

নয়নতারা বললো–ছি ছি, উৎকণ্ঠায় কিছু কী মনে ছিলো! রুমালটা দিন।

নয়নতারা আবার বললো–কই দাও রুমালটা।

কপাল মুছতে মুছতে নয়নতারা বললো–আমি তখন জলের বুকে নৌকো খুঁজছি, ওরা এলো সাজাতে।

–তা বটে, রাজু হেসে বললো–কী করেই-বা বলো আমি কেউই নই।

ব্যাপারটা ঠিক তাই-ই নয় কি? কিন্তু এবার থামো৷ এমন ঘন অন্ধকারে এই বনে হাতি কি পথ খুঁজে পাবে? আমার ভয় করছে। এর চাইতে কাছারিতে রাত কাটালেও হত। সে ঠোঁট টিপে হাসলো।

.

০৮.

পেটাঘড়ির শব্দে রাত তখন আটটা, রূপচাঁদ হাই তুলো। রাজচন্দ্রর ঘরের সামনে আর একবার ঘুরপাক খেলো। রানীর ঘরের দরজায় উসখুশ করলো। তারপর সেই দরজার সামনেই খুকখুক করে কাশলো। শীতের রাত, রাত আটটা, মাঝরাত যেন।

ভিতরে তখন আরব্য রজনীর গল্প চলেছে। রানী হাসছিলেন মৃদুমৃদু আরব্য অভিজাত মহিলাদের আত্যন্তিক কাফ্রী ক্রীতদাস-প্রীতির কথায়। অবশ্য, তাঁর হাসি দেখে তার খোশমেজাজ কিংবা বিরক্তি বোঝা গেলে তো রাজবাড়িতে অনেক কিছুই সহজ হতো।

কাশির শব্দ শুনে রানী বললেন–রূপচাঁদ নাকি, এসো।

রূপচাঁদ এ ঘরে কদাচিৎ চোখ তোলে। মেঝের নকশায় চোখ রেখেই সে জানালো রাজকুমার বিলমহলে গিয়েছেন, তখনো ফেরেননি।

রানীর মুখে উদ্বেগ দেখা দেবে যেন। কিন্তু বললেন তিনি-তাই নাকি? হয়তো কোনো কারণে দেরি হচ্ছে।

রূপচাঁদ সরে যেতে ফিরলো। তখন রানী আবার বললেন–নয়নতারার খোঁজ নিয়ে তো একবার।

রূপচাঁদ চলে গেলো।

গল্প আবার শুরু হলো।

কিন্তু নতুন গল্পটার মাঝখানে রানী বললেন–সব দেশের গল্প এক নয়। তাই মনে হচ্ছে না? মন্দ নয়, মানদা, তুমি গল্প বলতে ভালোই শিখেছো। অন্য শ্রোতাদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন–তোমরা কি আরো শুনবে এখন? তাহলে বাটা থেকে পান নাও।

শ্রোতারা বাটা থেকে পান নিয়ে উঠে পড়লো।

যে গল্প বলছিলো তাকে রানী বললেন–আবার তোমাকে খবর দেবো, মানু।

সকলে চলে গেলে রানী উঠলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবলেন। দরজা থেকে একটু দূরে একজন ঝি দরজার দিকে চোখ রেখে বসে সুপারি কুচোচ্ছিলো। তার দিকে দু-পা এগিয়ে রানী বললেন–মোক্ষ, হরদয়ালকে এখনই একটু আসতে বলে এসো।

রানী ঘর থেকে বেরুলেন।

.

রূপচাঁদ নয়নতারার বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারলো সে বাড়িতে নেই। তাহলে জানলায় আলোর আভাস থাকতো। সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন নয়নতারার দাদা ন্যায়রত্নের চতুষ্পঠীর দাওয়ায় প্রথমে একটা প্রদীপ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাউকে যেন বসে থাকতে দেখতে পেলো।

কে?

–আমি, বলা।

লোকটি উঠে এলো। বলা এখন আর রূপচাঁদের অপরিচিত নয়।

 সে বললো–দিদি কি রাজবাড়িতে?

-আমিও খুঁজছি। বিলমহলে রাজকুমার গিয়েছেন। হয়তো মাসিও সঙ্গে আছেন। এত রাত হয়। অবিশ্যি চোরচোট্টা আর কে এ গ্রামে? তবে কিনা ফরাসডাঙায় এসে উঠতে বড়ো জঙ্গল পার হতে হবে তো!

বলা বললো–এগিয়ে দেখতে হয়, না?

কী যে করি! দরকার হচ্ছে আলোর নিশানা।

রূপচাঁদ রাজবাড়ির দিকে হনহন করে ফিরতে শুরু করলো। পথের উপরে খানিকটা এসেবলার বাড়ি। রোসো, আসি, রূপদাদা বলে সে ভিতরে গিয়ে তার লাঠিটা নিয়ে এলো।

বলা বললো–কিন্তু সে তো ঘাসেরও জঙ্গল। হাতিডোবা ঘাস। মশাল নিতে চারপাশের ঘাসে আগুন ধরে যাবে না? আর সে জঙ্গলে কি মানুষ?

রূপচাঁদ বললো–তাও তো।

সে ভাবতে-ভাবতে চললো।

রাজবাড়ির প্রাচীরের ভিতর দিকে একপাশে বরকন্দাজদের ছোটো ছোটো ঘর।

যে তিনজন বরকন্দাজ মাঝরাতে জাগবার জন্য এখন ঘুমোতে যাচ্ছিলো রূপচাঁদ তাদের আটকালো। সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলো। রাজকুমারকে এগিয়ে আনতে যেতে হবে। তৈরি হও, আসছি।

মশালচিদের ঘরে গিয়ে পাঁচ-সাতটি হারিকেন জ্বালিয়ে আনলো রূপচাঁদ। বলাকে দেখিয়ে পরামর্শ নিলো-কেমন, বলা, এই ভালো নয়?

–আগুনের ভয় থাকলো না।

বরকন্দাজ বন্দুক নিয়ে তৈরি হয়ে আসতেই ছুটতে শুরু করলো রূপচাঁদের দল।

.

রানী খানিকটা ইতস্তত চলে বেড়ালেন তার মহলে। বসবার ঘরে না ফিরে একটু বাঁয়ে চলে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলার ছাদে গিয়ে উঠলেন।

আকাশের অনেক তারা। রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আলোতে বাড়ির পরিসরটা ঠাহর হয়। প্রাচীর বলে যাকে মনে হচ্ছে তা ছাড়িয়েও গ্রামের মধ্যে এখানে-ওখানে দুচারটি আলোর বিন্দু। গাছপালা বাড়িঘরের আকৃতি ছায়া-ছায়া, কিংবা কালিতে আঁকা ছবিতে কালি পড়ে গেলে তার কোনো কোনো রেখা তা সত্ত্বেও যেমন ফুটে ওঠে। অবশ্যই হালকা গভীর কোনো সিহাই এমন রং নিতে পারে না-নীলের ধার ঘেঁষা কালো একখণ্ড স্ফটিক যেন। স্ফটিক–অর্থাৎ উজ্জ্বলতার একটা ভাব আছে। কিন্তু এখানে এরকম দেখালেও নিচে গাঢ় অন্ধকারই হবে গাছপালার কোলে বাড়িঘরের কোণে। শীতের রাত ইতিমধ্যে বেশ গভীর বাইরে। হঠাৎ তিনি দেখলেন কতগুলি আলোর বিন্দু যেন খুব তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে না, আর তাদের পরস্পরের দূরত্বও সমান থাকছে সারিতে। এ কি রাজকুমারের বিলম্বের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যাপার? বুকের মধ্যে কী যেন জোরে নড়ে উঠলো তার। একটু চঞ্চল হলেন রানী।

সিঁড়িতে এমন সময়ে পায়ের শব্দ হলো।

রানী জিজ্ঞাসা করলেন–কে, মোক্ষ, হরদয়ালকে খবর দিয়েছো?

ছাদের যে-প্রান্তে সিঁড়ি সেখান থেকে হরদয়াল জানালো, সে এসেছে, নিচে অপেক্ষা করছিলো, তাই দেরি।

রানী বললেন–হরদয়াল, রাজকুমার বিলমহলে গিয়েছিলেন, হয়তো শিকারে। এখনো ফেরেননি।

হরদয়াল বললো–সে কী কথা, একা নাকি?

রানী জানালেন-সঙ্গে নয়নঠাকরুন থাকতে পারে। তাও ভাবনার বিষয়।

হরদয়ালের নীরবতা তার চিন্তারই চিহ্ন। সে বললো– অবশেষে-হাতিতে গিয়েছেন?

 –পিয়েত্রোর হাতিতেই বলে অনুমান। কিন্তু পথে একটা বড়ো বন আছে শুনেছি।

–তা আছে। তবে পিয়েত্রোর হাতি, বনের পথ চিনবে ভরসা করি।

–কিন্তু অন্ধকার রাত হলো।

–তা হচ্ছে।

রানী একটু থেমে বললেন আবার–আজ গ্রামে কীবল এসেছিলো?

-হ্যাঁ, চার-পাঁচ ঘণ্টা ছিলো, বাগচীমাস্টারের বাড়িতে লাঞ্চ করেছে।

–একে কি দরকারী খবর মনে করো হরদয়াল?

–এখন পর্যন্ত তেমন মনে করার কোনো যুক্তি দেখছি না।

 কথাটা রানীর মনঃপূত হলো। খানিকটা চুপ করে থেকে আবার বললেন–আচ্ছা, হরদয়াল, ডানকান একটা সুরকির রাস্তা করেছিলো, সে রাস্তার খানিকটা কেটে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থানে এক রায়তের জমির ধান বিলমহলের লোকেরা কেটে তা আবার সেই রায়তের ঘরেই এমন করে রেখেছে যে রায়তের নিজেরই আর জায়গা হয়নি। রাস্তাটা কি তোমাদের রাজকুমারের জমি উপর দিয়ে হচ্ছিলো?

-সন্দেহ আছে, কিন্তু নয় তাও বলতে পারি না এখন আর। পিয়েত্রোর দরুন ফরাসডাঙাও হতে পারে।

রানীমা বললেন–হঠাৎ রাস্তাটাকে কেটে উড়িয়ে দেওয়ার কী দরকার হলো?

হরদয়াল একটু ভেবে বললো–সাধারণত বড়ো রকমের নালিশ না-হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে রাজবাড়ি থেকে প্রশ্ন করা হয় না। এক্ষেত্রে কেউ বোধ হয় নালিশ করেনি। কিন্তু, রানী, রাজকুমারের বিলম্বের কথা বলতে বলতে এসব সংবাদ আলোচনা করার কোনো যুক্তি দেখি না।

নিজের অমূলক আশঙ্কায় রানী কি হাসলেন? অন্ধকারে তা বোঝা গেলো না।

-চলো, হরদয়াল, নিচে বসি।

রানী ছাদের ঝরোকা-ঝিলিমিলির কাছে থেকে সরে এলেন। তার শাড়ি দুধে-গরদের বলেই হয়তো একেবারে অদৃশ্য নয়, তার হাতের বালার পাথর কিছু কিছু নিজের পরিচয় সেই অস্পষ্টতায় দিলেও অযুক্তির হয় না, কিন্তু কোনো কোনো দেহবর্ণও কি অন্ধকারে ঈষৎ আভাসিত হয়?

একটা সুঘ্রাণ পেলো হরদয়াল, যা বিহ্বল কিন্তু মৃদু, এখন যেন বিষণ্ণ। তাড়াতাড়ি দু পা পিছিয়ে গেলো সে সিঁড়ির মুখ থেকে। রানী সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন। হরদয়াল ধীরে ধীরে অনুসরণ করলো।

নিচের বসবার ঘরে চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে রানী বললেন–নায়েব অবশ্যই দৃষ্টি রাখছেন, মামলা হয়ই যদি কোম্পানীর আদালতে। আচ্ছা, হরদয়াল, কলকেতায় এবারই কি হাইকোর্ট হবে? বসো।

প্রসঙ্গান্তরে কি যাচ্ছে কথা? কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যেন রাজকুমারের সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা থেকে, ডানকানের সঙ্গে বিরোধ, বিরোধের হেতু হিসাবে নতুন ম্যাকাডাম রাস্তাটা কেটে দেওয়া, তার ফলে সম্ভাব্য মামলা, তা থেকে কলকাতার হাইকোর্ট।

হরদয়াল সঙ্গে সঙ্গে বললো–চেষ্টা তাই।

-তোমার কি মনে হয় তা সবদিক দিয়েই ভালো? মুন্সেফি আদালতও নাকি হবে?

–আমাদের গ্রামেও হতে পারে।

-সেটা কী, আচ্ছা হরদয়াল, তুমি ভেবে দ্যাখো, তোমাদের রাজকুমারের এক্তিয়ারের মধ্যে যদি আদালত বসে সেটা কি ভালো? ওরা কী প্রস্তাব করেছে? তোমাদের তো সদর আমিন আছেই।

হরদয়াল বলতে যাচ্ছিলো, আমাদের গ্রামের আয়তন লোকসংখ্যা ও গুরত্বের দিক দিয়ে তেমন হওয়াটাই উচিত হবে। কিন্তু চোখ তুলতেই রানীর আয়ত চোখ দুটিকে সে দেখতে পেলো। কিছু ভাবছেন তিনি।

রানী বললেন–শুনেছি বেহার রাজের নিজের আদালত আছে।

দেউড়ির পেটাঘড়িতে ঘণ্টা পড়লো দশটার। এমন সময়ে মোক্ষদা-ঝি এসে বললো–রূপচাঁদকাকা গেছে বরকন্দাজ নিয়ে।

রানী শুনে বললেন–আচ্ছা, মোক্ষদা।

মোক্ষদা দাঁড়ালো না।

রানী একটু পরেই আবার বললেন–তুমি কি আজকাল তেমন বই পড়ো না? বই কি তেমন আসছে না?

–আসছে।

বইটই আনতে কি তুমি এর মধ্যে কলকাতায় যাবে?

–তেমন স্থির করলে জানাবো আপনাকে।

হরদয়াল কান পেতে শুনলো কোথাও একটা ঘড়ি টিকটিক করছে। একে প্রতীক্ষা ছাড়া আর কী বলা যাবে? কিন্তু এখনই তো একটা নির্দিষ্ট মতও প্রকাশ হলো রানীর।

বললেন রানী আবার–আচ্ছা, রাজকুমারের বিয়ের কথা আর কী ভেবেছো?

রানীর কি মুখ নিচু করলেন? হরদয়ালকে কি বিচলিত দেখা গেলো?

হরদয়াল ভাবলো ইতিপূর্বে রানী দুবার দু-রকম সুরে বলেছেন নয়নতারা সঙ্গে থাকাতেই ভাবনা। যেন ভাবনাটা দুবারে দুজনের জন। কিন্তু এসবই কি প্রতীক্ষাকে অচঞ্চল রাখতে বলা?

সে বললো–আপনি হুকুম করলেই চেষ্টা করব। সেই পাত্রীই, যদি সেইতিপূর্বে পাত্রস্থ না-হয়ে থাকে।

রানী বললেন না।

তার ঠোঁট দুটিতে হাসি হাসি ভাবটাই রইলো, কিন্তু এই এক বর্ণের শব্দটা গোটা একটা বাক্যের মত ভারি শোনালো। কিন্তু প্রসঙ্গান্তরে গেলেন তিনি, বললেন, তোমার তত্ত্ববোধিনী আর সোমপ্রকাশ পত্রিকাগুলো পড়া হয়েছে। নিয়ে যেও। তোমার বইয়ের ঘরে কি একজন দপ্তরি দরকার?

হরদয়াল বললো–দরকার হলে জানাবো।

.

ততক্ষণে রূপচাঁদের দল ফরাসডাঙা পেরিয়ে বনে ঢুকেছে। হাঁপাচ্ছে তারা দৌড়ে এসে। ছুটতে ছুটতেই ভাবছিলো রূপচাঁদ–যে মাহুতই হোক সে চওড়া পথের দিকে আসবে, অন্তত আন্দাজে দিক ঠিক করে। ভয় আর-এক–বিলে গিয়ে না পড়ে। সুতরাং পুরনো নদীর পার ধরে, তারপর নদীর পুরনো শুকনো খাতের ডান পারে যেতে হবে। কিন্তু আলো এনে কি হয়েছে যদি-না হাতির সওয়ার তা দেখতে পায়? বনে ঢুকলে ঘাসবন মানুষের মাথা ছাড়িয়েই উঠবে। আলো দ্যাখে কে?

সে হনহন করে চলতে চলতে বললো–আলো দেখানোর কি বলা?

একটা গাছের কাছে এসে তার খেয়াল হলো। একজন বরকন্দাজকে সে বললো–ওঠো এই গাছে। গাছে গাছে আলো রাখা যাক।

যে কথা সেই কাজ। তা দেখে বলা বললো–মন্দ না। আধকোশ জুড়ে গাছে গাছে বেড় দিলে কোনো-না-কোনো আলো দেখবে হাতি আর সেদিকে কেটে উঠবে। তাছাড়া, ধরো, সেই বেড়ের কেউ-না-কেউ হাতির ঘণ্টা শুনবে।

ঘাসবনের মধ্যে ডুবে ডুবে মানুষ কয়েকটি রাস্তার অসমান লেশমাত্র ধরে ছুটে চললো। ঘাসেই হাত-পা কাটছে, কাঁটায় কী হচ্ছে বলা বেশি।

অবশেষে বলাও এক গাছে চড়লো আলো নিয়ে। রূপচাঁদ একা ছুটলো তখন। আর কিছুক্ষণ ছুটেই তার মনে পড়লো সে একা। এই মানুষ-ডোবা ঘাসবনে সে এমন একা যে মনে হয় দু-দশ ক্রোশে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। আর এই তো পুরনো নদীর খাত, আর পার, আর চরা, আর এখানে কি সেই আদিকাল থেকে লাখ মানুষ দাহ হয়নি! নিজের ঘামেই পিরহান ভিজে, ঘাসবনের ওম সত্ত্বেও তার শীত লেগে গেলো। পায়ের তলায় একটা শক্ত ঢেলা লাগতেই মড়ার মাথার খুলি এই বিশ্বাস হলো। সে আতঙ্কে চিৎকার করে দৌড়লো।

.

রাজু বললো–আচ্ছা বাঁদর তো, গছে কেন?

গলাটা রাজকুমারেরই বটে। রূপচাঁদ দেখলো হাতিটা গাছের নিচেই দাঁড়িয়েছে। মাহুত বললো–ওখান থেকেই নামো, রূপুদা হাতির পিঠে।

রূপচাঁদ বললো–তা যদি ঝুপ করে পড়ি, তোমার হাতি ভয় পাবে না তো?

মাহুতের হাতে লণ্ঠন ধরিয়ে দিয়ে রূপচাঁদ ডাল দুলিয়ে ঝুল খেয়ে নামতে গিয়ে পলক ডালটা ভেঙে থেবড়ে পড়লো। মাহুত অন্য হাত বাড়িয়ে না-ধরলে নিচেই পড়তো।

রাজু বললো–একেবারে বাঁদর।

রূপচাঁদ হেসে বললো–হনুমান, হুজুর। হাতি কিন্তুক ছুটে চলুক। আলোর বেড় বরাবর।

হরদয়াল ভাবলো : রানী বলেছিলেন, নয়ন সঙ্গে থাকাতেই ভাবনা। তারপর বললেন কলকাতা যাওয়ার আর রাজকুমারের বিয়ের কথা। এগুলি কি রানীর মনে পরস্পর সংবদ্ধ? বলা যায় এখন তেমন সময় যখন রানী আশংকায় সম্ভব-অসম্ভব সব অমঙ্গলকে যাচাই করে দেখছেন।

ঠিক এমন সময়েই দেউড়িতে এবং তারপরে বারমহলে হরদয়ালের চিন্তাকে ছিন্ন করে কলরব শোনা গেল, এবং তার মধ্যে হাতির ঘণ্টাও।

আগে হরদয়াল এবং পিছনে রানী বারমহলের দরজার দিকে এগোলেন।

হরদয়াল দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, রানী কিছু পিছনে দালানের একটা দেয়ালগিরির নিচে।

তখন হাতি থেকে নেমেছে রাজু। আলোতে বোঝা গেলো তার স্যুটের এখানে-ওখানে কাদা শুকিয়ে আছে।

নয়নতারার কথা জিজ্ঞাসা করা কি উচিত হবে? ভাবলো হরদয়াল।

ততক্ষণে রাজচন্দ্র এগিয়ে গিয়েছে। রূপচাঁদ তার শিকারের সরঞ্জাম নামাচ্ছে। রাজু রানীর কাছাকাছি যেতেই তিনি বললেন–এ কী রে? এত কাদা?

রাজু হেসে বললো–বাহ্, কুমীর তো কাদাতেই থাকে।

রানী যেন একটু চমকালেন। তার মুখ কিছু বিবর্ণ হলো। কিন্তু তখনই বললেন–আচ্ছা হরদয়াল।

বিচক্ষণ হরদয়াল তখন নিজের কুঠির দিকে চলতে শুরু করলো।

রাজুকে বললেন রানী–তুই জামাকাপড় ছাড়, রাজু, আমার ঘরে তোর খাবার দেব।

রানী আর দাঁড়ালেন না। রূপচাঁদকে নিয়ে রাজু নিজের মহলের দিকে এগিয়ে গেলো।

বাইরের জামাজোড়া ছেড়ে হরদয়াল বালাপোশ নিলো। ঘড়ি না-দেখলেও বলা যায় এখন অনেকটা রাত হয়েছে। কী করবে সে এখন? রানী ডেকে পাঠানোর আগে সে চিন্তা করছিলো। তার কলকাতার বন্ধু চিঠি লিখেছে। তা থেকেই চিন্তাটা। এখনো কি সে-চিন্তাই করবে। রাজকুমারের বিয়ের কথাই যেন। সে একবার চারদিকের বইয়ের আলমারিগুলোর দিকে চাইলো। রাত্রির একটা এই কৌতুক যে এই লাইব্রেরি-ঘরে সময় যেন মন্থরগতিতে চলে।

কখন কোন সূত্রে কোন চিন্তা আসবে বলা যায় না। হরদয়াল যেন একটা মৃদু সুবাস পেলো। তাকে নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা যায় না, উৎসটাও বোঝা যায় না। নিশ্চয়ই স্মৃতি।

হরদয়ালের হঠাৎ মনে হলো এই লাইব্রেরির অধিকাংশ বই রানীর উপহার। অর্থাৎ বই সে-ই কিনেছে বটে, টাকাটা দিয়েছে স্টেট, রানীর ইচ্ছা। আজ সকালেই সে একবার নিজেকে বলছিলো, আর কত? এমন হচ্ছে দুএকখানা পড়া না-হয়েই শেফে উঠছে।

বালাপোশটাকে বাহুর উপরে গুটিয়ে আলমারি থেকে সে একখানা বই টেনে নিলো।

কিন্তু সবসময়ে ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। বইটা খুলবার আগেই চাকর এলো, পিছন পিছন বাবুর্চি। বাবুর্চি-চাকরের সংসার তার। চাকর জিজ্ঞাসা করলো গড়গড়া দেবে কিনা। বাবুর্চি জানালো নদীর ধার থেকে ভালো রুই পাওয়া গিয়েছে। ভাজা হয়েছে।

সামনের দেয়ালঘড়িতে রাত এগারোটার কাছে এসেছে। হরদয়াল হেসে মাথা নাড়লো। বাবুর্চি টেবিল গোছতে গেলো। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এমন দেরির কথা ভাবাও যায় না।

হরদয়াল লক্ষ্য করলো, চাকর তার পাশেপাশে চলতে চলতে হাসছে। সে যেন কিছু বলতে চায়।

-কিছু বলবে?

বাবুর্চি বলছিলো, হুজুর।

কী?

নতুন মাস্টারমশাই নিউগিবাবু নাকি বাবুর্চিকে জিজ্ঞাসা করেছেন সে কী জাত?

–তাতে হাসির কী হলো?

 –ওই মগটাকে নাকি ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছেন।

–আচ্ছা?

বাবুর্চি বলছিলো সে নাকি প্রকৃতপক্ষে মুসলমানই ছিলো, যদিও নমাজ পড়ে না। জিজ্ঞাসা করছিলো এতদিন পরে নমাজ পড়লে আপনি রাগ করেন কিনা।

হরদয়াল হো-হো করে হেসে উঠলো খাবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *