০৩. যৌনাচারের উপর স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভাব

০৩.  যৌনাচারের উপর স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভাব

পূর্ব অধ্যায়ে মহাভারতীয় যুগের বিশ্রস্ত যৌনজীবনের যে চিত্র দেওয়া হয়েছে, তা নানারকম ভাবে বিধান ও অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল স্মৃতি ও পুরাণের যুগে। স্মৃতি বলতে হিন্দুদের বিধান শাস্ত্রসমূহকে বোঝায়। এগুলির অপর নাম ছিল ধর্মশাস্ত্র। এগুলি সনাতন ধর্মের আধার। পুরাণগুলি প্রাচীন ঐতিহ্যের সংগ্ৰহ ভাণ্ডার। ধর্মশাস্ত্রকারদের মধ্যে যারা প্রাধান্ত লাভ করেছিলেন র্তারা হচ্ছেন মনু, বিষ্ণু, যাজ্ঞবল্ক্য, বৃহস্পতি, নারদ ও আপস্তম্ভ। তবে এগুলির মধ্যে মনু রচিত মানব ধর্মশাস্ত্র বা মনুসংহিতাই হিন্দুর ধর্ম, সমাজ, আচার ব্যবহার ও বিধানের আদর্শ নির্দেশক গ্রন্থ। হিন্দুর কাছে মনুর বিধানই শিরোধার্য। একথা বৃহস্পতি স্বীকার করে গেছেন। বৃহস্পতি বলেছেন, “মস্বর্থবিপরীত যা সা স্মৃতির্ণ প্রশস্ততে।” তার মানে, যে স্মৃতি মনুর বিপক্ষে বিধান দেয়, সে স্মৃতি স্মৃতিই নয়। যদিও মনুর উক্তিসমূহ অতি প্রাচীন, তথাপি সংগৃহীত অবস্থায় মনুর মানবধর্মশাস্ত্র অনেক পরে সংকলিত হয়েছিল। কথিত আছে, সর্বপ্রথম এতে একলক্ষ শ্লোক ছিল, কিন্তু এখন মাত্র ২,৬৮৪টি শ্লোক আছে। পণ্ডিতমহল এরূপ অনুমান করেন যে ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণ সমূহ খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্ৰীষ্টাব্দের পঞ্চম শতকের মধ্যে সংকলিত হয়েছিল।

মনুর মানবধর্মশাস্ত্রে যে সমাজবিদ্যাসের চিত্র দেওয়া হয়েছে, তা চতুবণের উপর প্রতিষ্ঠিত। চতুবৰ্ণ বলতে মৌলিক চারটি শ্রেণীকে বোঝাতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্ব ও শূদ্র। তবে মানবধর্ম শাস্ত্রের দশম অধ্যায়ে এক সম্প্রসারিত সমাজের চেহারাও দেখতে পাওয়া যায়। উপরোক্ত চারিবর্ণের মধ্যে অসবর্ণ যৌনসংসর্গের ফলে অনেক সংকরজাতির উদ্ভব হয়েছিল। দশম অধ্যায়ে এই সকল সংকর জাতির যে নাম দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে মুর্ধাভিষিক্ত, মাহিষ, করণ বা কায়স্থ অম্বষ্ট বা বৈদ্য, অয়োগব, ধিগবন, পুঙ্কস ও চণ্ডাল। এদের সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন কর্ম বা বৃত্তি ছিল । সুতরাং বৃত্তিভিত্তিক জাতি ব। শ্রেণীর উদ্ভব এযুগেই হয়েছিল।

স্মৃতিকারদের দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবাহ ছিল ধর্মবিহিত কর্তব্য কর্ম বা সংস্কার। সকল ব্যক্তির পক্ষেই এই কর্তব্য পালন বাধ্যতামূলক ছিল, বিশেষ করে নরক থেকে পিতৃ-পুরুষদের উদ্ধারের নিমিত্ত পুত্র উৎপাদন করবার জন্য। যদিও মনুসংহিতায় আট রকম বিবাহেব উল্লেখ করা হয়েছে এবং আপস্তম্ভ ও বশিষ্ঠ ছয় রকম বিবাহের অনুমোদন করেছেন, তথাপি মাত্র সেই বিবাহকেই স্মৃতিশাস্ত্রের যুগে শাস্ত্রসম্মত বিবাহ বলে গণ্য কব হতো, যে বিবাহে মন্ত্র উচ্চারিত হতো, হোম ও যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো ও সপ্তপদীগমণ অবলম্বিত হতো। এরূপ বিবাহকে শাস্ত্রে ব্রাহ্ম বিবাহ বলা হতো। এাহ্মণের পক্ষে এই বিবাহই প্রশস্ত বিবাহ ছিল। তবে ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে আস্থর বিবাহের প্রচলনও ছিল। আস্থর বিবাহে মূল্যদান করে কন্যার পাণিগ্রহণ কবা হতে। মানবগৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে যে বিবাহ মাত্র দুই প্রকার—ব্রাহ্ম ও আস্থর ।

যদিও মহাভারতীয় যুগে গান্ধব ও রাক্ষস বিবাহ আদর্শ বিবাহ বলে গণ্য হতো, স্মৃতির যুগে এই উভয় প্রকাব বিবাহই অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মশাস্ত্রসমূহে বলা হয়েছে যে এরূপ বিবাহ করলে মানুষকে মহাপাপে লিপ্ত হতে হয়। বৌধায়ন একথাও বলেছেন যে, যদি কোন মেয়েকে বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে বিন মন্ত্রপাঠে বিবাহ করা হয় (রাক্ষস বিবাহ ), তা হলে তাকে কুমারী কন্যা হিসাবে পুনরায় বিবাহ দেওয়া চলে। পুরাণে এইরূপ বিবাহকে অস্বীকার করা হয়েছে, যদিও মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে যে, বীরপুরুষদের পক্ষে গান্ধৰ্ব অপেক্ষ রাক্ষস বিবাহ অধিকতর শ্রেয়।

যদিও আস্থর বিবাহের প্রচলন নিশ্চয়ই ছিল,তথাপি স্মৃতিকারগণ ক্রমশ এরূপ বিবাহের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। মনু এরূপ বিবাহের অনুমোদন করে এক জায়গায় বলেছেন যে, “কস্তার জন্ত পণ বা মূল্য গ্রহণ করা, পিতার স্বাভাবিক অধিকার।” আবার অন্যত্র আমুর বিবাহ সম্পর্কে মনু বিরূপ মত প্রকাশ করেছেন। মনুসংহিতার দুজন প্রধান টীকাকার মেধাতিথি ও কুল্লুকভট্টও এরূপ বিবাহকে নিকৃষ্ট বিবাহ বলেছেন। অনুরূপভাবে বৌধায়নও এক স্থানে বলেছেন যে, “ক্ষত্রিয়ের পক্ষে আস্থর বিবাহ বৈধ”, আবার অন্যত্র তিনি এর অননুমোদন করেছেন। নারদও এর নিন্দ করে বলেছেন, “বিনাপণে যেখানে স্ত্রী গ্রহণ করা হয়েছে, মাত্র সে ক্ষেত্রেই স্বামী প্রকৃত স্বামী ; অপর পক্ষে যেখানে কন্যাপণ দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের অধিকারিণী স্ত্রী, স্বামী নন।” যা হউক, স্মৃতিকারগণ কর্তৃক এরূপ বিরূপ মত প্রকাশ করা সত্বেও পরবর্তীকালে আস্থর বিবাহই এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কেন-না, বর্তমানে আস্থর বিবাহ হিন্দু সমাজে নিম্ন জাতিসমূহের মধ্যে ও আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে।

এ সম্পর্কে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় অবস্থিত গ্রীক দেশীয় রাজদূত মেগাস্থিনিস তক্ষশিলায় যে প্রথা প্রচলিত থাকতে দেখেছিলেন তার উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, “যারা দারিদ্র্যের জন্য কন্যাকে সুপাত্রে দিতেপারেন না, তারা যুবতী কন্যাদের হাটে নিয়ে গিয়ে, সেখানে ঢাক ঢোল বাজিয়ে জনতার সমাবেশ করান। যখন জনতার মধ্য থেকে কেহ বিবাহ ইচ্ছুক হয়ে এগিয়ে আসে, তখন কস্তাকে সম্পূর্ণ অনাবৃত করে তাকে নিরীক্ষণ করতে দেওয়া হয়। প্রথমে সে কন্যার পশ্চাদভাগ নিরীক্ষণ করে, পরে নিরীক্ষণ করে তার সম্মুখভাগ। যদি কন্যাকে তার পছন্দ হয় তা হলে উপযুক্ত পণ দিয়ে সে তাকে নিয়ে যায় এবং তার সঙ্গে স্বামীস্ত্রী রূপে বসবাস করে।

স্মৃতির যুগে বিবাহ যে কেবল সর্বজনীন ছিল তা নয়, বিবাহ বাধ্যতামূলক-ও ছিল। পুত্র উৎপাদন করে পিতৃপুরুষদের নরক থেকে উদ্ধার করবার জন্য পুরুষদের তো বিবাহ করতেই হতো। যথাসময়ে মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধেও সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থেই বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মেয়েদের পক্ষে বিবাহের উপযুক্ত বয়স হচ্ছে দশ, যখন সে “কন্যা” আখ্যা লাভ করে। আরও বলা হয়েছে যে এই বয়সেই কন্যা, নারীর দৈহিক উৎকর্ষতা লাভ করে। পরাশর বিধান দিয়ে বলেছেন যে “যথাসময়ে যদি মেয়ের বিবাহ দেওয়া না হয় তা হলে সেই কন্যার মাসিক রজঃ অপর জগতে তার পিতৃপুরুষদের পান করতে হয় এবং যে তাকে বিবাহ করে, তাকে হতভাগ্য হতে হয়।” তবে বিষ্ণু বলেছেন, “বিবাহের পূর্বে কন্যা যদি পিতৃগৃহে রজস্বলা হয়, তা হলে সে “বৃষলী” ( অস্পৃষ্ঠা ) অবস্থা প্রাপ্ত হয় কিন্তু যে তাকে বিবাহ করে তার কোন অপরাধ হয় না।” বশিষ্ঠ, বৌধায়ন, নারদ ও যাজ্ঞবল্ক্য এ সম্পর্কে খুব রেগে গিয়ে বলেছেন, “কুমারী অবস্থায় কন্যা যতবার রজস্বলা হবে, ততবার তার পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের ভ্রুণহত্যার পাপে লিপ্ত হতে হবে।” গৌতমও এ সম্বন্ধে অন্যান্য স্মৃতিকারগণের সঙ্গে মতৈক্য দেখিয়ে বলেছেন “রজস্বলা হবার আগেই কন্যার বিবাহ দেওয়া চাই।”

ঋতু সঞ্চারের পূর্বেই কন্যার বিবাহ দেওয়া সম্বন্ধে স্মৃতিকারদের যত্নবান হবার কারণ হচ্ছে কন্যার ঋতুর যাতে সদ্ব্যবহার হয়। বলা হয়েছে, “ঋতু কন্যাকে কলুষমুক্ত করে তাকে বিশোধন করে এবং তাকে গর্ভধারণের উপযুক্ত করে।” এই কারণে স্মৃতিকারগণ বিশেষ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, ঋতু যেন অব্যবহৃত থাকে, বৃথা নষ্ট না হয়। আরও বলা হয়েছে যে “ঋতুর প্রথম চারদিন ছেড়ে দিয়ে স্বামী যেন নিশ্চয়ই স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হন।” “যে ব্যক্তি ঋতুচক্রকালে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হন না, তিনি অনন্তকাল নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন ।” অনুরূপভাবে বলা হয়েছে, যে স্ত্ৰী ঋতুকালে তার কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে স্বামীর সঙ্গে মিলিত হয় না, তাকে নরক বাস করতে হয় এবং তার স্বামী ভ্রুণহত্যার পাপে লিপ্ত হন ।”

ঋতুকালে স্বামী-স্ত্রীর মিলন সম্বন্ধে স্মৃতিকারগণ বিশেষ জোরের সঙ্গে বিধান দিলেও, ঋতুসঞ্চারের প্রথম চারদিনে মিলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন। বলা হয়েছে যে, ঋতুসঞ্চারের প্রথম চারদিন নারী সঙ্গমের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে অনুপযুক্ত থাকে, ঐ সময় স্ত্রীতে উপগত হলে পুরুষকে পাপে লিপ্ত হতে হয় এবং সে ভবিষ্যতে সুখ, শান্তি ও আয়ু থেকে বঞ্চিত হয়। এই পাপকে গুরুতল্প ( গুরুপত্নীর সঙ্গে যৌন সংসৰ্গ ) পাপের সহিত তুলনা করা হয়েছে।

স্মৃতিগ্রন্থসমূহে আরও বলা হয়েছে যে, যেহেতু ঋতু সঞ্চারের প্রথম চারদিন নারী সম্পূর্ণ অশুদ্ধ থাকে, সেইহেতু এই সময় সে অপরের সামনে উপস্থিত হবে না, যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে দূরে থাকবে, তার দ্বারা স্পৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য অপরে গ্রহণ করবে না। যদি ওই সময় কেউ তাকে স্পর্শ করে তবে সে নিজেকে কলুষিত করবে আর ইচ্ছাপূর্বক যদি নারী নিজে কোন ব্রাহ্মণকে স্পর্শ করে, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে কষাঘাত করা হবে । বলা হয়েছে যে, স্থষ্টির প্রারম্ভে নারী রজস্বলা হতো না । সেজন্য সঙ্গম সত্ত্বেও নারীর গর্ভ হতো না। পরে যখন কামের জন্ম হয়, তখন সে রজস্বলা হতে সুরু করে এবং সঙ্গমের ফলে গর্ভধারণও করতে থাকে। তার আগে পর্যন্ত মানবসমাজে যোগসাহায্যে সন্তান উৎপাদন করা হতো। মহাভারতের একস্থানে ভীষ্মও বলেছেন “দেবতারা পাচ প্রকারে সন্তান উৎপাদন করেন, বাসনা দ্বারা, বাক্য দ্বারা, দর্শন দ্বারা, স্পর্শন দ্বারা ও যৌনসঙ্গম দ্বারা ।

যদিও স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ ও পুরাণের যুগে জাতিসমূহের মধ্যে সবর্ণ বিবাহই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ কর্তৃক শুদ্রকষ্ঠার পাণিগ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত আছে। আগেই বলা হয়েছে যে, যেখানে উচ্চ বর্ণের পুরুষের সঙ্গে হীনবর্ণের মেয়ের বিবাহ হতো, সেরূপ বিবাহকে অমুলোম বিবাহ বলা হতো। আর যেখানে উচ্চ বর্ণের মেয়ের সঙ্গে হীনবর্ণের পুরুষের বিবাহ হতো, তাকে বলা হতে প্রতিলোম বিবাহ। অমুলোম বিবাহ বৈধ ছিল কিন্তু প্রতিলোম বিবাহ নিন্দিত ছিল। এরূপ ব্যতিক্রম থাকলেও সবর্ণ বিবাহই সকল জাতির পক্ষে বিধিসম্মত বিবাহ ছিল ।

সবর্ণে বিবাহের বিধি ছাড়া, স্মৃতি ও পুরাণের যুগে বিবাহ নিয়ন্ত্রিত হতে আরম্ভ হয়েছিল গোত্রপ্রবর ও সপিণ্ড দ্বারা। একই গোত্রে বা প্রবরে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। মনে হয়, গোত্রবিধি প্রথম ব্রাহ্মণদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, পরে তা ক্ষত্রিয়গণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু “প্রবর” মাত্র ব্রাহ্মণদেরই ছিল, ক্ষত্রিয়দের ছিল না। ক্ষত্রিয়দের এর বদলে ছিল “কুল”। প্রাচীন ভারতে প্রবর ও কুল এই উভয়েরই বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কেন-না যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় নিজ প্রবর বা কুল ঘোষণা করতে পারতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে স্বীকার করা হতো না। এই কারণেই আমরা মহাভারতের আদিপর্বে দেখতে পাই যে কৰ্ণ নিজকুল ঘোষণা করতে না পারায় অজুন তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে অসম্মত হয়েছিলেন। শতপথ ব্রাহ্মণে সত্যকাম জাবালির কাহিনী থেকেও এ প্রকাশ পায়। “গোত্র” শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে “গো-বেষ্টনী” । কার্যক্ষেত্রে কিন্তু গোত্র বলতে, বংশের পূর্বপুরুষ ঋষির নাম বুঝাতে । মনে হয়, উত্তর ভারতে প্রথমে গোত্রপ্রেথা প্রচলিত ছিল না এবং পূর্ব বা দক্ষিণ ভারত থেকে এর প্রবর্তন হয়েছিল উত্তর ভারতে। শাস্ত্রানুসারে দক্ষিণ ভারতের ঋষি বৌধায়নই উত্তর ভারতে এর প্রচলন করেছিলেন। বৌধায়ন শ্রোতসূত্রে আটজন গোত্র-প্রবর্তক ঋষির নাম পাওয়া যায়। এই আটজনের নাম যথাক্রমে—ভরদ্বাজ, জমদগ্নি, গৌতম, অত্রি, বিশ্বামিত্র, বসিষ্ঠ ( বশিষ্ঠ ), কশ্যপ এবং অগস্ত্য । বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণরা সকলেই এই আটজন ঋষির মধ্যে কোন না কোন ঋষির সন্তান। যারা একই গোত্রের অন্তভুক্ত, তাদের বলা হয় সগোত্র। সগোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বর্হিবিবাহের একটা সুনির্দিষ্ট প্রণালী প্রতিষ্ঠার জন্যই বৌধায়ন গোত্রপ্রথার প্রচলন করেছিলেন । পরবর্তীকালে অবশ্য আরও অনেক গোত্র-প্রবর্তক ঋষির নাম পাওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বর্তমানে বঙ্গদেশে যে সকল গোত্র প্রচলিত আছে, সেগুলি যথাক্রমে—অত্রি, অগস্ত্য, অনাবৃকাক্ষ, অব্য, আত্ৰেয়, আংগিরস, আলম্ব্যায়ণ, কাঞ্চন, কাত্যায়ণ, কান্ধ, কাস্বায়ণ, কুষিক, কৌশিক, কৃষ্ণাত্রেয়, কাশ্যপ, গৌতম, গাৰ্গ, জৈমিনি, বশিষ্ঠ, বৈয়াস্ত্ৰপদ্য, বিশ্বামিত্র, বিষ্ণু,বাৎস্ত, বৃদ্ধি,স্কৃতকৌশিক, পরাশর, ভরদ্বাজ, মৌদগল্য, জমদগ্নি, রথিতরু, শাণ্ডিল্য, শকত্রি, শুনক, সাংকৃতি, সৌপায়ণ, জাতুকৰ্ণ, ক্ষেত্রি, মৈত্রায়ণি ও ধন্বন্তরি। আগেই বলা হয়েছে যে, গোত্র প্রথমে মাত্র ব্রাহ্মণদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য বর্ণের, প্রকৃত পক্ষে কোন গোত্র ছিল না। পরবর্তীকালে র্তারা তাদের কুলপুরোহিতগণের গোত্রসমূহই গ্রহণ করেছিলেন ।

হিন্দুর বিবাহের উপর গোত্রবিধির প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেন-না সগোত্রে বিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ ব্যাপার। ১৯৪৬ সালে “হিন্দু বিবাহে অযোগ্যতা নিরোধক” আইন বিধিবদ্ধ হবার পূর্ব পর্যন্ত সগোত্রে বিবাহ অবৈধ বলেই বিবেচিত হতো। শাস্ত্রে এরূপ বিবাহকে অজাচার বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

“প্রবর” বলতে প্রাচীন পূর্বপুরুষ ঋষিগণের নামের তালিকা বোঝায়। আসলে এগুলি গোত্রের মধ্যে ছোট ছোট পরিবারের নাম। এগুলি গোত্র-প্রবর্তক ঋষিদের পুত্র-পৌত্রদের নামানুসারে চিহ্নিত। প্রত্যেক প্রবরে এক, দুই, তিন বা পাচজন ঋষির নাম দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি গোত্রের সঙ্গে ওই গোত্র সংশ্লিষ্ট প্রবর নামগুলিও কীর্তিত হয়ে থাকে। যদি তুই গোত্রপ্রবরে একই ঋষির নাম থাকে তাহলে গোত্র ত্বটির অভিন্নতা প্রতিপন্ন হয়। এরূপ সমানপ্রবরবিশিষ্ট গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ।

স্মৃতির যুগে, গোত্রপ্রবর ছাড়া হিন্দুদের মধ্যে অবাধ বিবাহের আর এক প্রতিবন্ধকতার স্থষ্টি হয়েছিল। সেটা হচ্ছে সপিণ্ড বিধি। আগেই বলা হয়েছে যে সপিণ্ড বলতে পিতৃকুলে উৰ্দ্ধতম পাচপুরুষের জ্ঞাতিবর্গকে বোঝায়। পিতৃকুলের সপিণ্ডগণকে “গোত্রজ সপিণ্ড” ও মাতৃকুলের সপিণ্ডগণকে “ভিন্নগোত্র সপিণ্ড” বা “বন্ধু” বলা হয়। সপিণ্ডদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। তবে উত্তর ভারতে সপিণ্ড বিবাহ নিষেধবিধি যেরূপ কঠোরতার সঙ্গে পালিত হয়, দক্ষিণ ভারতে তা হয় না। তার কারণ, দক্ষিণ ভারতে “বাঞ্ছনীয় বিবাহ”-এর প্রচলন আছে।

ভাই বোন সকলে কি অনুক্রমে বিবাহ করবে ! তার-ও একটা নির্দেশ স্মৃতিকাররা দিয়েছেন। বলা হয়েছে যে, জ্যেষ্ঠ ভগিনীর বিবাহের পূর্বে কনিষ্ঠ ভগিনী যদি বিবাহ করে, তাহলে তা শাস্ত্র বিরুদ্ধ আচরণ হবে। এরূপ বিবাহ হলে বিবাহিত কনিষ্ঠা কন্যার স্বামী ও পরে বিবাহিত জ্যেষ্ঠ ভগিনীর স্বামী, এই উভয়কে জাতি থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হবে এবং তাদের কোন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগদান করতে দেওয়া হবে না। বশিষ্ঠ এ সম্পর্কে কৃচ্ছ, ও অতিকৃচ্ছ, এই দুই প্রকার প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এরূপ ক্ষেত্রে কনিষ্ঠার স্বামীকে বারদিন কৃচ্ছসাধন করতে হবে এবং কনিষ্ঠাকে জ্যেষ্ঠ কন্যার স্বামীর হাতে সমর্পণ করতে হবে এবং অনুরূপভাবে জ্যেষ্ঠ কন্যার স্বামীকে কৃচ্ছ_ ও অতিকৃচ্ছ, এই উভয়বিধ প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে এবং জ্যেষ্ঠা কন্যাকে কনিষ্ঠ কন্যার স্বামীর হাতে অৰ্পণ করতে হবে। তারপর তারা পরস্পর পরস্পরের স্ত্রীকে তাদের প্রকৃত স্বামীর হাতে আবার প্রত্যপণ করবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তারা পুনরায় বিবাহিত হবে। পরাশর অবশ্য বলেছেন যে, জ্যেষ্ঠ যদি জন্মাবধি কুজা, বামনাকৃতি, দুর্বলচিত্ত, অন্ধ, মুক বা বধির হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে কনিষ্ঠ বিনাদণ্ডে জ্যেষ্ঠার আগেই বিবাহ করতে পারবে।

নরক থেকে পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করবার জন্য পুত্র উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার উপর স্মৃতিকাররা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এই কারণে বিবাহিত জীবনে যদি সন্তান উৎপন্ন না হয়, কী নিঃসন্তান অবস্থায় যদি কেহ মারা যায়, তা হলে তার স্ত্রী বা বিধবার “ক্ষেত্রে” অপরের দ্বারা সন্তান উৎপাদনের বিধান স্মৃতিকাররা দিয়েছিলেন । এই ব্যবস্থাকে “নিয়োগ” প্রথা বলা হতো। “নিয়োগ” আর কিছুই নয়, স্বামীর পরিবর্ত হিসাবে কোন নিযুক্ত ব্যক্তিকে উৎপাদকরূপে গ্রহণ করা। শাস্ত্র অনুযায়ী মৃতব্যক্তির ভ্রাতা বা কোন নিকট আত্মীয়, বিশেষ করে সপিণ্ড বা সগোত্রকে নিযুক্ত করা হতো। “নিয়োগ” প্রথা অনুযায়ী মাত্র এক বা ফুটি সন্তান পর্যন্ত উৎপন্ন করা যেতো, তার অধিক নয়। মনু এবং গৌতম মাত্র দুটি সন্তান উৎপাদনেরই অনুমতি দিয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে কামবর্জিত হয়ে এবং অত্যন্ত শুচিপূর্ণ অন্তকরণে এই প্রথানুযায়ী সন্তান উৎপাদন করা হতো। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সন্তান প্রজননের সময় উভয়ে নিজ নিজ চিত্তবৃত্তিকে এমনভাবে উন্নীত করবে যে, পরস্পর পরস্পরকে শ্বশুর ও পুত্রবধুরূপে বিবেচনা করবে। এক কথায়, সন্তান প্রজননের সময় সকল প্রকার কামভাব পরিহারের উপর শাস্ত্রকাররা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ সম্বন্ধে বশিষ্ঠ বলেছেন যে, বিধবাকে প্রথম ছয়মাস কৃচ্ছসাধন করতে হবে, তারপর ঋতুকালে তাকে নিযুক্ত ব্যক্তির কাছে যেতে হবে। বৌধায়ন কিন্তু কৃচ্ছ সাধনের জন্য এক বৎসর সময়ের ব্যবস্থা করেছেন। যেহেতু নিজের স্ত্রী নয়, এরূপ স্ত্রীলোকের গর্ভে সন্তান উৎপাদিত হচ্ছে, সেইহেতু এরূপ ভাবে উৎপন্ন সন্তানকে “ক্ষেত্ৰজ” সন্তান বলা হতো। স্মৃতিযুগের শেষের দিকে কিন্তু “নিয়োগ” প্রথা পরিত্যক্ত হয়েছিল। সেজন্ত দেখতে পাওয়া যায় যে, মনু যদিও তার ধর্মশাস্ত্রের এক অংশে এর অনুমোদন করেছেন, অপর অংশে কিন্তু তিনি এই প্রথাকে সম্পূর্ণভাবে গর্হিত বলে ঘোষণা করেছেন। বৃহস্পতিও বলেছেন যে, কলিযুগে “নিয়োগ” প্রথা যথাযথ নয়।

যে অংশে মন্ত্র নিয়োগ প্রথার অনুমোদন করেছেন, সেখানে তিনি একথা পরিষ্কার ভাবেই বলেছেন, যে স্ত্রীলোকের কোন সন্তান হয় নি, মাত্র সেই স্ত্রীলোকই “নিয়োগ” প্রথা অবলম্বনের প্রকৃত অধিকারিণী। একথাও তিনি বলেছেন যে, নিঃসন্তান হলে স্বামীর

জীবদ্দশাতেই স্বামী কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে স্ত্রী “নিয়োগ” প্রথানুযায়ী সন্তান উৎপাদনের জন্য অপর পুরুষকে আহবান করতে পারেন। তবে

একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, এই উদ্দেশ্যে মাত্র কোন আত্মীয়কেই স্বাহবান করা যেতো, অপরকে নয়। স্বামীর জীবদ্দশাতেই নিয়োগপ্রথা অবলম্বনের অধিকার, স্ত্রীকে অন্যান্য স্মৃতিগ্রস্থ ও পুরাণেও দেওয়া হয়েছে। মহাভারতেও উক্ত হয়েছে যে, পাণ্ডু এই অধিকার কুন্তীকে দিয়েছিলেন।

আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, “সন্তান প্রজননের জন্য স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অপরের হস্তে সমর্পণ করা কলিযুগে নিষিদ্ধ হয়েছে। কলিযুগে এরূপ যৌনমিলন ব্যভিচাররূপে গণ্য হয় এবং এরজন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।” এই উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্ববর্তীকালের সমাজে “নিয়োগ” প্রথা অনুমোদিত হলেও, পরবর্তীকালের সমাজে এ প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল। নিয়োগ প্রথার পিছনে যে যুক্তি ছিল তা হচ্ছে, “যেহেতু স্ত্রী স্বামীর পুত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রস্বরূপ, সেইহেতু ক্ষেত্রের মালিক হিসাবে তার অধিকার আছে ওই ক্ষেত্র নিজে বা অপরকে দিয়ে কৰ্ষিত করবার।” যাহোক, শাস্ত্রকারদের পরস্পর বিরোধী বিধানসমূহ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, প্রাক্তনকালের প্রথা পরবর্তীকালে অবৈধ এবং গৰ্হিত বলে ঘোষিত হয়েছিল। বস্তুতঃ একথা অনেক জায়গায় বলা হয়েছে যে, প্রাচীনকালে দেবতা ও ঋষিদের পক্ষে যা বৈধ এবং প্রশস্ত ছিল, পরবর্তীকালের মানুষের পক্ষে তা গৰ্হিত ও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

“নিয়োগ” প্রথানুযায়ী প্রসূত সন্তানের পিতৃত্ব সম্পর্কে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, “কোন অপুত্রক ব্যক্তি যদি অপর কোন অপুত্রক ব্যক্তির “ক্ষেত্রে” সন্তান উৎপাদন করে তাহলে উভয় অপুত্ৰক ব্যক্তিই সেই সন্তানের পিতা বলে গণ্য হবে এবং সেই সন্তান উভয় ব্যক্তিরই শ্রাদ্ধ সম্পাদনের অধিকারী হবে।” পরাশর বলেছেন, “ক্ষেত্রের অধিকারীর ( স্বামীর ) অনুমতি পেয়ে কেহ যদি অধিকারীর ক্ষেত্রে বীজ বপন করে, তাহলে সেই উৎপন্ন ফলের অধিকারী উভয়েই, ‘ক্ষেত্র’ অধিকারী ও বীজ অধিকারী। তবে বীজ অধিকারী যদি ক্ষেত্র অধিকারীর গৃহে গিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়, তবে সেক্ষেত্রে বীজ অধিকারী সন্তানের মালিক নয়। শাস্ত্রকাররা এইরূপ মিলনকে ব্যভিচার বলে গণ্য করেছেন। আর স্ত্রী যদি বীজ অধিকারীর গৃহে তার সঙ্গে মিলিত হয়, তবেই বীজ অধিকারী সেই উৎপন্ন সন্তানের অধিকারী হয়।” কৌটিল্যও বলেছেন যে, স্ত্রী যদি স্বামী গৃহেই অপরের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করান, তাহলে স্বামীই উৎপন্ন সন্তানের মালিক। বীজ আধিকারীর সন্তানের উপর অধিকার, মাত্র তখনই অর্সায় যখন স্ত্রী বীজ অধিকারীর গৃহে গিয়ে সস্তান উৎপাদন করান ।

নারীর পুনর্বিবাহ সম্বন্ধে স্মৃতিকাররা কতকগুলি কৌতুহলোদ্দীপক কথা ৰলেছেন। এ সম্বন্ধে সাধারণ বিধি ছিল এই যে, কন্যাকে মাত্র একবারই সম্প্রদান করা যেতে পারে। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, “অধিকতর গুণবিশিষ্ট পাত্র পাওয়া গেলে দত্ত কন্যাকে আবার দ্বিতীয় বার দান করা যেতে পারে।” নারদও বলেছেন, “অনুঢ়া কন্যাকে দান করবার জন্য যদি একবার মূল্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে এবং পরে যদি অধিকতর গুণবিশিষ্ট পাত্র পাওয়া যায় তাহলে পূর্বপ্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যেতে পারে।” নারদ আরও বলেছেন, “কন্যাকে মাত্র একবারই দান করা চলে”–এই বিধি মাত্র ব্রাহ্ম, আর্শ, দৈব, প্রাজাপত্য ও গান্ধৰ্ববিবাহের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত, অন্য ক্ষেত্রে এটা পাত্রের গুণাগুণের উপর নির্ভর করে। মনু বলেছেন, “যদি বিবাহ অনুষ্ঠিত হবার পূর্বেই পাত্র মারা যায়, তাহলে কন্যাকে পাত্রের ভ্রাতার হস্তে দান করা যেতে পারে।” তবে বশিষ্ঠ ও বৌধায়ন উভয়েই বলেছেন, “যে ক্ষেত্রে কন্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহে দান করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও কন্যার দ্বিতীয়বার বিবাহ দেওয়া চলে।” এ-কথারই প্রতিধ্বনি করে মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, শিবের বিধান অনুযায়ী কন্যার দ্বিতীয়বার বিবাহ দেওয়া চলে। অত্যয় অবস্থাতেও নারীর দ্বিতীয়বার বিবাহ স্মৃতিকাররা অনুমোদন করেছেন। স্বামী যদি বিদেশ ভ্রমণে যান এবং শাস্ত্রনির্দিষ্টকালের মধ্যে প্রত্যাগমন না করেন, তাহলে স্ত্রী দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে। নির্দিষ্ট কি সময় উত্তীর্ণ হলে স্ত্রী আবার দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে, সে সম্বন্ধে নারদ বলেছেন,“সন্তানবতী ব্রাহ্মণবর্ণেব নারীকে আট বৎসর অপেক্ষা করতে হবে আর সন্তানহীনা নারীকে চার বৎসর। অনুরূপভাবে ক্ষত্রিয়া নারীকে যথাক্রমে ছয় বৎসর ও তিন বৎসর, বৈশ্রাণ নারীকে চার বৎসর ও দুই বৎসর অপেক্ষা করতে হবে। শূদ্র নারীর পক্ষে কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, যে কোন সময় সে পুনরায় বিবাহ করতে পারে।” বশিষ্ঠ বলেন যে, এরূপ বিবাহ নিজবংশেরই অন্ত কোন ব্যক্তির সঙ্গে হওয়া চাই। বশিষ্ঠ এ সম্পর্কে যে সময় অতিবাহনের নির্দেশ দিয়েছেন, তা হচ্ছে ব্রাহ্মণীর পক্ষে সাড়ে পাচ ও চার বৎসর, ক্ষত্রিয়ার পক্ষে পাচ ও তিন বৎসর, বৈষ্ঠার পক্ষে চার ও দুই বৎসর এবং শূদ্রার পক্ষে তিন ও এক বৎসর। মনু এ সম্বন্ধে জাতিনির্বিশেষে বিধান দিয়েছেন যে, স্বামী যদি তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে বিদেশে যান, তাহলে স্ত্রীকে আট বৎসর অপেক্ষা করতে হবে আর যদি যশার্জনের জন্য যান তাহলে ছয় বৎসর এবং যদি মৃগয়া বা প্রমোদের জন্য যান তাহলে তিন বৎসর অপেক্ষা করতে হবে ।

সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণে একথা অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত হয়েছে যে, স্বামী যদি মৃত কী নিরুদ্দিষ্ট হন, কী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, কী নপুংসক প্রতিপন্ন হন, কী সমাজে পতিত হন, তাহলে এই পাচ প্রকার অত্যয়কালে স্ত্রী পুনরায় স্বামী গ্রহণ করতে পারেন। আরও বলা হয়েছে যে, কোন নিষ্কলঙ্কা কন্যা যদি ভুলক্রমে কোন চিরব্যাধিগ্রস্ত, কী কুৎসিত ব্যাধিগ্রস্ত, কী বিকলাঙ্গ, কী গৃহহীন, কী জাতিভ্রষ্ট বা জ্ঞাতিকুটুম্ব পরিত্যক্ত, কী দারিদ্র্যক্লিষ্ট ব্যক্তির সহিত বিবাহিত হয়, তবে সে স্বামীকে পরিত্যাগ করে পুনরায় বিবাহ করতে পারে।

উত্তরকালের হিন্দুসমাজের দৃষ্টিতে বিবাহিত নারীর পুনরায় বিবাহ অবশ্য সহনীয় রীতি ছিল। না। এমন কি স্বামী নিরুদিষ্ট হলেও নারীকে শাস্ত্রনির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করে, সধবা স্ত্রীলোকের সমস্ত চিহ্ন পরিহার করে বিধবার ভূষণ গ্রহণ করে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হতো। মনে হয় যে, উত্তরকালে নারীর সতীত্ব সম্বন্ধে যে নুতন ধ্যান গৃহীত হয়েছিল, তারই প্রতিক্রিয়ায় এই পরিবর্তন ঘটেছিল।

“নিয়োগ” প্রথানুযায়ী অপর পুরুষের দ্বারা গর্ভসঞ্চারণ করানোর রীতি যখন বিলুপ্ত হলো, তখন নারীর সতীত্ব সম্পর্কে হিন্দুসমাজে এক নূতন ধারণা কল্পিত হলো। চরিত্রবর্তী সতী নারী পতিব্ৰতারূপে পরিগণিত হলো। পতিব্ৰতা নারী বলতে বুঝালে৷ সেই স্ত্রীকে যে মনেপ্রাণে স্বামীর প্রতি অনুরক্ত এবং শয়নে-স্বপনে ও সকল কর্মে স্বামীর অনুবর্তিনী। স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের সহিত যৌনসংস্রব ব্যভিচার বলে পরিগণিত হলো। নিজ স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন নারীর সহিত যৌনসংস্রব পুরুষের পক্ষেও নিষিদ্ধ হলো। মনু নূতন সামাজিক চিন্তার স্রষ্টা হয়ে দাড়ালেন। মনু বিধান দিলেন, “পরদার গমনের তুল্য পাপ ইহজগতে এমন কিছু নেই যা মানুষকে স্বল্পায়ু করে তোলে। স্ত্রীলোকের গাত্রে যত লোমকূপ বা রন্ধ আছে, পরদারগামী পুরুষকে তত বৎসর নরকে বাস করতে হয়।” পরদার গমন অপরাধের জন্য স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণসমূহে অতি কঠোর শাস্তি ব্যবস্থিত হলো। বৌধায়ন ও মনু উভয়েই ব্যভিচারীর জন্য মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা করলেন। আপস্তম্ভ বললেন যে, ব্যভিচার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ কর্তন করে শাস্তি দেওয়া হবে এবং যদি সে কোন অনুঢ়া কন্যার সঙ্গে ব্যভিচার করে থাকে তাহলে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তাকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হবে। আরও বলা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট নারী বা কুমারীকে রাজা সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত করবেন এবং তার অভিভাবকদের হাতে তাকে প্রত্যপণ করবেন, যদি অভিভাবক তার দ্বারা যথোচিত প্রায়শ্চিত্ত নিম্পাদনের ব্যবস্থা করেন। ব্যভিচারীর শাস্তিস্বরূপ নারদ যে দণ্ড বিধান করেছেন তা হচ্ছে, ১০০ পণ অর্থদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, পুরুষাঙ্গছেদন ও মৃত্যু। মোটকথা, সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থেই ব্যভিচার অপরাধের জন্য নানারূপ কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি নিজ স্ত্রীকে অপরের সহিত আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় দেখে এবং রোষাম্বিত হয়ে উভয়কেই হত্যা করে, তবে তার জন্য সে কোন দণ্ড পাবে না ।

একথা এখানে বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে স্মৃতিশাস্ত্র সমূহের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যভিচার মাত্র যৌনসঙ্গমের দ্বারাই সংঘটিত হতো না। কেননা শাস্ত্রানুযায়ী মৈথুন আট প্রকাবে নিম্পন্ন হয়। স্মরণ, কীর্তন, কেলি, প্রেক্ষণ, গৃহভাষণ, সঙ্কল্প, অধ্যবসায় ও ক্রিয়ানিস্পত্তি দ্বারা। শাস্ত্রকাররা বলেছেন যে, যদি কাহাকেও অপরের স্ত্রীর সঙ্গে নদীর সঙ্গমস্থলে, কী স্বানের ঘাটে, কী উদ্যানে, কী অরণ্যে বাক্যালাপ করতে দেখা যায় বা তার সঙ্গে বিহার করতে দেখা যায় বা তাকে চুম্বন করতে দেখা যায় বা তার প্রতি চক্ষুদ্বারা ইঙ্গিত করতে বা হাস্য করতে দেখা যায় বা তার বস্ত্র বা আভরণ অনুচিতস্থানে স্পর্শ করতে দেখা যায় বা তার সঙ্গে একই শয্যায় উপবিষ্ট থাকতে দেখা

যায় বা তার হস্ত, কেশ বা বস্ত্রপ্রান্ত ধরতে দেখা যায়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচার অপরাধে লিপ্ত বলে গণ্য হবে। নারদ একথাও বলেছেন যে, যদি কোন ব্যক্তি মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে গর্বসহকারে বলে যে, সে অমুক স্ত্রীলোককে সম্ভোগ করেছে, তাহলে শাস্ত্রানুযায়ী সেও ব্যভিচার দোষে লিপ্ত ।

যতপ্রকার ব্যভিচার আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত ও কদৰ্য বলে শাস্ত্রে নিন্দিত হয়েছে, গুরুতল্প বা গুরুস্ত্রীগমন। গুরুস্ত্রীর সঙ্গে যৌনসংস্রবের জন্য শাস্ত্রে অতি কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মনু বলেছেন, যে ব্যক্তি গুরুতল্প অপরাধে অভিযুক্ত, তাকে জলন্ত লৌহকটাহের উপর উপবিষ্ট করাতে হবে, তার পুরুষাঙ্গ কর্তন করতে হবে এবং তার দুই চক্ষু উৎপাটিত করতে হবে।

সতীত্ব সম্পর্কে নূতন ধারণার উদ্ভবের সঙ্গে বিধবার পক্ষে নিষ্কাম, নিষ্কলঙ্ক ও পবিত্র জীবনযাপন করবার উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হলো। পরাশর বললেন যে, বিধবা নিষ্কাম ও সতীত্বপূর্ণ জীবনযাপন করলে তার উচ্চতম স্বর্গে স্থান হবে। পরাশর আরও বললেন যে, বিধবা যদি বৈধব্য অবস্থায় গর্ভবতী হয়, তাহলে তাকে দেশ থেকে বহির্ভূত করে দেওয়া হবে।

পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, স্মৃতিপুরাণ যুগের যৌনজীবনের ডামাডোলের ভেতর দিয়ে একটা সুস্থিত আদশের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। বিভিন্ন স্মৃতিকারদের পরস্পরবিরোধী বিধানসমূহের মধ্যে একট। সমন্বয় আনবার চেষ্টা করেছিলেন মমু। পরবর্তীকালে মনুর বিধানই প্রাধান্ত লাভ করেছিল। র্তার বিধানের ভিত্তিতে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল সেই আদর্শ

রচিত হয়েছিল নিম্নলিখিত বিধিগুলি নিয়ে—

১। বিবাহ নিম্পন্ন হবে মাত্র মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ সম্পাদন ও সপ্তপদী গমনদ্বারা ।

২। জাতি নির্বিশেষে সকলকেই পুত্র উৎপাদনের জন্য বিবাহ অবশুই করতে হবে।

৩। কস্তার বিবাহ দিতে হবে সে ঋতুমতী হবার পূর্বে।

৪ । বিবাহ সংঘটিত হবে মাত্র জাতির মধ্যে ।

৫ । বিবাহ সগোত্রে, সপ্রবরে ও সপিণ্ডের মধ্যে হতে পারবে না।

৬। বিবাহিত নারীকে সতীত্বের সমস্ত বিধান অনুসরণ করে পতিব্ৰতা হয়ে থাকতে হবে ।

৭। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাকে সধবার সমস্ত ভূষণ পরিহার করে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে ।

৮ । পরস্ত্রীগমন ব্যভিচাব বলে গণ্য হবে এবং তার জন্ম ব্যভিচারীকে গুরুদণ্ড পেতে হবে ।

বলাবাহুল্য, উত্তরকালের নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের যৌনজীবন এই সকল বিধির উপব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *