০৩. যদুনাথের হল-ঘরে

পরদিন প্রভাতে বেলা আন্দাজ নটার সময় যদুনাথের হল-ঘরে টেবিল ঘিরিয়া বসিয়া আছেন : স্বয়ং যদুনাথ, ইউনিফর্ম-পরা একজন পুলিস ইন্সপেকটর এবং ড্রেসিং-গাউন-পরা মন্মথ। যদুনাথের চেয়ারের পিছনে নন্দা পিতামহের কাঁধে হাত রাখিয়া দাঁড়াইয়া আছে; ইন্সপেকটরের পিছনে দাঁড়াইয়া একজন নিম্নতর পুলিস কর্মচারী খাতা-পেন্সিল হাতে নোট লিখিতেছে; সেবক একটা খালি চেয়ারের পিঠ ধরিয়া দণ্ডায়মান আছে এবং সতর্কভাবে সওয়াল জবাব শুনিতেছে।

খোলা দরজা দিয়া ফটক পর্যন্ত দেখা যাইতেছে।

ইন্সপেকটর বলিলেন—তাহলে চুরি কিছুই যায়নি?

যদুনাথ বলিলেন-না, কিন্তু চোর বাড়ি ঢুকেছিল।

ইন্সপেকটর বলিলেন—তা বটে। চোরকে আপনারা কে কে দেখেছেন?

মন্মথ বলিল—আমি দেখেছি। কিন্তু এক নজর, ভাল করে দেখিনি।

সেবক বলিল—আমিও দেখেছি

ইন্সপেকটর সেবককে বলিলেন—দাঁড়াও, তোমার কথা পরে শুনব।–মন্মথবাবু, আপনি চোরের চেহারা কি রকম দেখছেন বলুন দেখি।

মন্মথ চিবুক চুকাইতে চুলকাইতে চোরের চেহারা স্মরণ করিবার চেষ্টা করিল। এই সময় নন্দা চক্ষু তুলিয়া দেখিল, একটি অপরিচিত যুবক সদর দরজা দিয়া প্রবেশ করিতেছে। যুবকের গোঁফ দাড়ি কামানো, ধারালো মুখ, শরীর ঈষৎ কৃশ, কিন্তু হাড় বাহির করা নয়। পরিধানে খদ্দরের পাঞ্জাবি ও ধোপদুরস্ত ধুতি। নন্দার বুকের ভিতর ধ্বক্ করিয়া উঠিল। এই কি গতরাত্রির চোর?

দিবাকর টেবিলের কাছাকাছি আসিয়া কুণ্ঠিতভাবে একটু কাশিল। সকলে একবার তাহার দিকে চাহিলেন; যদুনাথ চশমা খুলিয়া তাহাকে নিরীক্ষণ করিলেন।

কে তুমি বাপু? কি চাও?

দিবাকর বলিল—আজ্ঞে, শ্রীযুক্ত যদুনাথ চৌধুরী মহাশয়ের সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।

কণ্ঠস্বর শুনিয়া নন্দা দিবাকরকে নিশ্চয়ভাবে চিনিল; সে দাদুর শুভ্র মস্তকের উপর চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া হৃদযন্ত্রের দ্রুত স্পন্দন চাপিবার চেষ্টা করিল।

যদুনাথ বলিলেন-ও কি নাম তোমার?

আজ্ঞে, দিবাকর রায়।

আচ্ছা, তুমি একটু বোসো, তোমার কথা শুনব—সেবক!

সেবক শূন্য চেয়ারটা টেবিল হইতে একটু দূরে টানিয়া দিবাকরকে বসিতে ইঙ্গিত করিল; দিবাকর বসিল। কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া বিনীত ভাবলেশহীন মুখ লইয়া বসিয়া রহিল। বড় মানুষের বাড়িতে এমন কৃপাপ্রার্থী উমেদার কত আসে; কেহ আর তাহাকে লক্ষ্য করিল না।

ইন্সপেকটর তাঁহার প্রশ্নোত্তরের ছিন্নমূত্র তুলিয়া লইলেন—

হ্যাঁ, চোরের চেহারার কথা হচ্ছিল, (মন্মথকে) কি রকম চেহারা দেখেছিলেন মন্মথবাবু?

মন্মথ বলিল—মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ ছিল—রোগা-পটকা চেহারা

সেবক অমনি হাত নাড়িয়া প্রতিবাদ করিল। বলিল-না না, রোগা-পটকা হবে কেন? চোর কখনও রোগা-পটকা হয়?-কালো—মুষ্কো—ইয়া জোয়ান

দিবাকর নির্লিপ্তভাবে একবার সেবকের মুখের পানে তাকাইল। মন্মথ বিরক্ত হইয়া বলিল—তুই কি জানিস? আমি বলছি রোগা-পটকা!

সেবক আবার প্রতিবাদ করিবার জন্য মুখ খুলিয়াছিল, ইন্সপেকটর হাত তুলিয়া তাহাকে নিরস্ত করিলেন। তারপর মন্মথকে প্রশ্ন করিলেন–মন্মথবাবু, চোরের চেহারা যেমনই হোক, বলুন দেখি, চোরকে দেখলে সনাক্ত করতে পারবেন?

মন্মথ চিন্তিতভাবে এদিক ওদিক চাহিল। নন্দার মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল; দিবাকর কিন্তু নির্বিকার।

মন্মথ বলিল—তা ঠিক বলতে পারি না। বোধ হয় না।

ইন্সপেকটর সেবককে শুধাইলেন—আর তুমি? চোরকে দেখলে চিনতে পারবে?

সেবক সগর্বে বলিল—আপনি নিয়ে আসুন, আলবৎ চিনব। আমি দেখেছি, ইয়া মুষ্কো জোয়ান—ভূষকুণ্ডি কালো

ইন্সপেকটর হাসিয়া যদুনাথকে সম্বোধন করিলেন—

দেখছেন তো, ইনি বলছেন রোগা-পটকা, আর ও বলছে ইয়া মুস্কো জোয়ান। এ রকম অবস্থায় চোরকে সনাক্ত করার তো কোনও উপায় নেই।

উপায় আছে দারোগাবাবু। এই যে উপায়।–মেঝে হইতে টপ করিয়া চোরের জুতাজোড়া তুলিয়া লইয়া সেবক ইন্সপেকটরের সামনের টেবিলের উপর রাখিল এবং সহর্ষে হাত ঘষিতে লাগিল।

ইন্সপেকটর চমকিয়া বলিলেন—এ কি! বদ গন্ধ বেরুচ্ছে। কার জুতো?

সেবক বলিল—চোরের জুতো। উঁই ঝাড়ের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল, আমি খুঁজে বার করেছি।

ইন্সপেকটর রুমাল বাহির করিয়া নাকের উপর ধরিলেন। মন্মথ মুখ বিকৃত করিয়া উঠিয়া গেল এবং ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করিল।

ইন্সপেকটর বলিলেন——হুঁ–চোরের জুতো। কম্বল সিং, জুতা লে চলো।…যদি দাগী চোর হয়, হয়তো সনাক্ত করা যাবে।

কম্বল সিং নাক সিটকাইয়া আলাগোছে জুতাজোড়া তুলিয়া লইল।

যদুনাথ বলিলেন—দেখুন ইন্সপেকটরবাবু, কাল রাত্রে যে চোর ঢুকেছিল তার জন্যে আমি বেশি ভাবিনে, আমার মনে হয় ছিচকে চোর, ঘটিটা বাটিটা সরাবার মতলবে ঢুকেছিল।

ইন্সপেকটর বলিলেন–জুতোর অবস্থা দেখে তো তাই মনে হয়।

যদুনাথ বলিলেন—হ্যাঁ। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, আমার বাড়িতে এক অমূল্য জহরৎ আছে—আমার গৃহদেবতা। আপনি বোধ হয় সূর্যমণির নাম শোনেননি।

ইন্সপেকটর বলিলেন—বিলক্ষণ। সূর্যমণির নাম কে না শুনেছে। এমন রুবি বাংলা দেশে আর নেই—

যদুনাথ বলিলেন—হ্যাঁ। আমার ভয় সূর্যমণি নিয়ে। কে জানে, হয়তো কলকাতা শহরে যত পাকা চোর আছে সকলের নজর পড়েছে সূর্যমণির ওপর। এখন পুলিস যদি আমার সম্পত্তি রক্ষা না করে—

ইন্সপেকটর বলিলেন—সকলের সম্পত্তি রক্ষা করাই পুলিসের কাজ। আমরা চেষ্টার ত্রুটি করব না। কিন্তু আপনি যদি special protection চান তাহলে কমিশনার সাহেবকে দরখাস্ত করতে হবে। —আজ তাহলে উঠি। চলো কম্বল সিং।

ইন্সপেকটর নমস্কার করিয়া দ্বারের দিকে চলিলেন। কম্বল সিং জুতাজোড়া নাক হইতে যতদূর সম্ভব দূরে টাঙাইয়া লইয়া চলিল। সেবক তাহাদের ফটক পর্যন্ত আগাইয়া দিতে গেল। হল-ঘরে যদুনাথ, নন্দা ও দিবাকর ছাড়া আর কেহ রহিল না।

যদুনাথ অন্যমনস্কভাবে বসিয়া বোধ করি সূর্যমণির বিপদ-আপদের কথা চিন্তা করিতে লাগিলেন। নন্দা ও দিবাকর গোপনে একবার দৃষ্টি বিনিময় করিল। তারপর দিবাকর উঠিয়া দাঁড়াইয়া মৃদু রকম গলা ঝাড়া দিল। কিন্তু বিমনা যদুনাথ লক্ষ্য করিলেন না। নন্দা তখন তাঁহার কানের কাছে নত হইয়া বলিল—

দাদু, ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।

যদুনাথ সজাগ হইয়া বলিলেন-ও হ্যাঁ। তা—কি দরকার তোমার বাপু?

দিবাকর উঠিয়া জোড়হস্তে বলিল—আজ্ঞে, আপনার নাম শুনে এসেছি—আমাকে একটু অনুগ্রহ করতে হবে—

যদুনাথ বলিলেন—অনুগ্রহ! কি অনুগ্রহ?

দিবাকর বলিল—আমি শুনেছি জ্যোতিষ শাস্ত্রে আপনার অগাধ পাণ্ডিত্য। তাই এসেছিলাম–যদি আপনি

যদুনাথ খুশি হইলেন।

আঁ–তা—বোসো বোসো—কি নাম বললে? দিবাকর রায়–ব্রাহ্মণ সন্তান নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বেশ বেশ। তা জ্যোতিষ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করি বটে। তুমি কোত্থেকে খবর পেলে?

আজ্ঞে একথা কি চাপা থাকে। আমি আপনাকে একটু কষ্ট দিতে এসেছি। আমি বড় গরীব, কাজকর্ম কিছু নেই—আপনি যদি দয়া করে দেখে দেন—আর কতদিন কষ্ট ভোগ আছে। সময়টা বড় খারাপ যাচ্ছে—

সময় খারাপ যাচ্ছে? বেশ বেশ। তা ঠিকুজি-কোষ্ঠী এনেছ?

আজ্ঞে এনেছি।

দিবাকর পকেট হইতে কুণ্ডলিত ঠিকুজি বাহির করিয়া দিল। যদুনাথ চশমা পরিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত জাতচক্র পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। দিবাকর ভয়ে ভয়ে একবার নন্দার পানে চোখ তুলিল। যেন নীরবে প্রশ্ন করিল—ঠিক হচ্ছে তো? নন্দা একটু ঘাড় নাড়িল।

যদুনাথ হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন—বা বা! এ যে দেখছি মেষ!

দিবাকর হতবুদ্ধি হইয়া বলিল—আজ্ঞে মেষ।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার মেষ রাশি মেষ লগ্ন—একেবারে খাঁটি মেষ।

দিবাকর ঘাড় চুলকাইয়া বলিল—আজ্ঞে আপনি যখন বলছেন তখন তাই। কিন্তু আমার ভাল সময় কবে পড়বে?

যদুনাথ কোষ্ঠী দেখিতে দেখিতে বলিলেন—ভাল সময়? হুঁ–বৃহস্পতি গোচরে তোমার ভাগ্যস্থানে প্রবেশ করেছেন : শনি ষষ্ঠে; রাহু একাদশে। বা বা! তোমার তো ভাল সময় এসে পড়েছে হে!

আজ্ঞে তাই নাকি? কিন্তু কই কিছু তো দেখছি না। বরং খুবই দুঃসময় যাচ্ছে, চাকরিবাকরি নেই—

ও কিছু নয়, সব ঠিক হয়ে যাবে।

চাকরি পাব?

নিশ্চয় পাবে। মেষ রাশি, নবমে বৃহস্পতি, একাদশে রাহু—এ কখনও মিথ্যে হয়। দেখে নিও, শিগগিরই তোমার বরাত ফিরে যাবে।

যদুনাথ জন্মকুণ্ডলী দিবাকরকে ফেরত দিলেন; চশমা খুলিয়া নিশ্চিন্ত মনে তাহার কাচ পরিষ্কার করিতে লাগিলেন। দিবাকর কিছুক্ষণ উৎকণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করিল, কিন্তু যদুনাথ আর কিছু বলিলেন না। দিবাকর তখন ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল

আচ্ছা, আজ তাহলে আসি। নমস্কার।

অনিচ্ছা-মন্থর পদে দিবাকর দ্বারের দিকে চলিল। নন্দা অমনি যদুনাথের কানে কানে বলিল—দাদু, ওঁকে যেতে দিচ্ছ?

যদুনাথ বলিলেন—আঁ–কী?

নন্দা বলিল—উনি যদি চাকরি না পান, ভাববেন তুমি জ্যোতিষের কিচ্ছু জান না!

যদুনাথ বিচলিত হইয়া বলিলেন—আঁ–তা?

তোমার তো একজন সেক্রেটারি দরকার, ওঁকেই রেখে নাও না কেন?

ওঃ? আরে তাই তো!…ওহে… কি বলে—দিবাকর! শোনো শোনো

আজ্ঞে?

যদুনাথ বলিলেন—হ্যাঁ—দ্যাখো, আমার একজন সেক্রেটারি দরকার। তুমি পারবে?

দিবাকর ব্যগ্রস্বরে বলিল—আজ্ঞে পারব।

ত্রিশ টাকা মাইনে পাবে, আর খাওয়া-পরা রাজি?

আজ্ঞে রাজি।

রোজকার হিসেব রাখতে হবে, খুচরো খরচ নিজের হাতে করবে; বাড়ির সব কাজ দেখাশুনো করতে হবে-দরকার হলে বাজারে যেতে হবে, ফাই-ফরমাস খাটতে হবে বুঝলে?

আজ্ঞে।

তাহলে আজ থেকেই কাজে লেগে যাও। হ্যাঁ, আর একটা কথা। বাইরে থাকা চলবে না, এই বাড়িতেই থাকতে হবে। ওপরে যে-ঘরে আমার পুরোনো সেক্রেটারি থাকত, সেই ঘরে তুমি থাকবে।

আজ্ঞে থাকব।

সহসা যদুনাথের মনে সংশয়ের উদয় হইল। তিনি দ্বিধাভরে বলিলেন—কিন্তু—তোমার বিষয় কিছুই জানি না—তুমি লোক ভাল বটে তো হে?

দিবাকর আহতস্বরে বলিল—আজ্ঞে আপনি এখনি আমার ঠিকুজি-কোষ্ঠী দেখলেন, আমি ভাল কি মন্দ তা আপনার চেয়ে বেশি আর কে জানে? আপনি তো আমার নাড়ী-নক্ষত্র জেনে নিয়েছেন।

যদুনাথ নিরুদ্বেগ হইয়া বলিলেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, তা বটে। তুমি মেষ। মেষ কখনো ঠগ জোচ্চোর মিথ্যাবাদী হতে পারে না। আমিও মেষ কিনা।

দিবাকর পুলকিত স্বরে বলিল—আপনিও মেষ!

যদুনাথ বলিলেন—হুঁ। বেশ তুমি থাকো বলেছিলাম কিনা যে শিগগিরই বরাত ফিরে যাবে?

দিবাকর জোড়হস্তে বলিল—অদ্ভুত আপনার গণনা; বলতে না বলতে ফলে গেল। সত্যিই আমার বরাত ফিরেছে।

যদুনাথ স্মিতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং পিরানের বোম খুলিতে লাগিলেন।

নন্দা, দিবাকরকে ওর ঘর দেখিয়ে দে। আমার স্নানের সময় হল—

নন্দা দিবাকরকে বলিল—আসুন আমার সঙ্গে।

নন্দার অনুগামী হইয়া দিবাকর সিঁড়ির দিকে চলিল। তাহারা সিঁড়ির পাদমূল পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে এমন সময় মন্মথ খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে ড্রয়িংরুম হইতে বাহির হইয়া আসিল। দুই পক্ষের মুখোমুখি হইয়া গেল। নন্দা একটু থতমত হইল। বলিল—দাদা, ইনি দাদুর নতুন সেক্রেটারি দিবাকরবাবু।

দিবাকর সবিনয়ে নমস্কার করিল। মন্মথ তাচ্ছিল্যভরে তাহার দিকে একবার ঘাড় নাড়িয়া কাগজ পড়িতে পড়িতে চলিয়া গেল। নন্দা ও দিবাকর সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিল।

উপরের বারান্দায় নন্দা ও দিবাকর গিয়া দাঁড়াইয়াছে, নন্দার চোখে চাপা উত্তেজনা।

নন্দা খাটো গলায় বলিল-প্রথমটা আমিও আপনাকে চিনতে পারিনি, গলা শুনে চিনলাম। দাদা আর সেবক তো–

সে মুখে আঁচল দিয়া হাসি চাপা দিল।

দিবাকর বলিল—ওঁদের সঙ্গে এমন অবস্থায় দেখা করতে হয়েছিল যে। আমিও ওঁদের চিনতে পারিনি।

নন্দা গম্ভীর হইয়া বলিল—এটা আমার ঘর; এটা দাদার। আর এই ঘরে আপনি থাকবেন।

নন্দার দরজার লাগাও আর একটা দরজা ভেজানো ছিল, নন্দা তাহা ঠেলিয়া খুলিয়া দিল। ঘরটি অপেক্ষাকৃত ছোট; আসবাবের মধ্যে একটা উলঙ্গ খাট, টেবিল ও চেয়ার।

নন্দা বলিল—ঘরটা খালি পড়ে আছে, বিশেষ কিছু নেই। আমি আজই সাজিয়ে-গুছিয়ে দেব।

দিবাকর তদগতভাবে বলিল—আর কিছু দরকার নেই; এই আমার পক্ষে স্বর্গ।

নন্দা বলিল—কিন্তু দাদু চান আমরা যে ভাবে থাকি তাঁর সেক্রেটারিও সেইভারে থাকবে, ঠিক বাড়ির ছেলের মতো।

দিবাকর বলিল-দেবতুল্য মানুষ আপনার দাদু। ওঁর সেবা করবার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি।—ওঁর ঘর কোনটা?

নন্দা বলিল—দাদু ওপরে শোন না। একে তো বাতের ব্যথার জন্যে ওপর-নীচে করতে কষ্ট হয়, তাছাড়া ঠাকুরঘরে সূর্যমণি আছে—

দিবাকর সরলভাবে বলিল—সূর্যমণির নাম শুনলাম নীচে, কি জিনিস বুঝতে পারলাম না।

নন্দা ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল—সূর্যমণি আমাদের গৃহদেবতা।—দেখুন, আমি দাদুর কাছে আপনার সত্যিকার পরিচয় লুকিয়ে আপনাকে ভাল হবার সুযোগ দিয়েছি, একথা যেন ভুলে যাবেন না।

হাত জোড় করিয়া দীনকণ্ঠে দিবাকর বলিল—আপনার দয়া কখনও ভুলব না।

.

সেইদিন অপরাহ্নে খোলা ফটকের সামনে দাঁড়াইয়া সেবক ও গুর্খা দারোয়ান বাক্যালাপ করিতেছিল।

গুর্খা বলিল—আজ সুবেরকো পুলিস আয়ী থি। ফি ক্যা হুয়া, সেবকরামজী?

সেবক বলিল—অনেক ব্যাপার হুয়া। দাদাবাবু তো সব ভেস্তে দিয়েছিল, আমি শেষ রক্ষে করলুম।

ক্যাসা? ক্যাসা?

দাদাবাবু পুলিসকে বললে—চোরটা ছিল রোগা-পটকা। আচ্ছা তুমিই বল তো গুরুঘণ্টাল সিং, তুমি তো দশ বছর ধরে দারোয়ানগিরি করছ, চোর কখনও রোগা-পটকা হয়?

চোর হাম কভী দেখা নেই, সেবকরামজী। হামকো দেখনে সে হী দূরসে চোর ভাগতা হ্যায়।

এই সময় বিলাতী বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া মন্মথ বাহির হইয়া আসিল।

গুর্খা স্যালুট করিল। সেবক মন্মথর কাছে ঘেঁষিয়া নিম্নস্বরে বলিল—মনে আছে তো? আজ ফিরতে দেরি করেছ–

মন্মথ বিরক্তভাবে বলিল—আচ্ছা আচ্ছা

রাস্তা দিয়া একটা খালি ট্যাক্সি যাইতেছিল, মন্মথ তাহাতে চড়িয়া চলিয়া গেল। সেবক গুর্খার দিকে ফিরিল–

কি বলছিলে, চোর তোমাকে দেখেই পালিয়ে যায়? ভারি মদ্দ তুমি। কাল তবে বাড়িতে চোর ঢুকলো কি করে? তুমি যে বন্দুক ঘাড়ে করে পাহারা দিচ্ছিলে, কই, ধরতে পারলে না?

গুর্খা বলিল—আরে হা কৈসে পাকড়েগা। চোর ফাটকসে ঘুসাথা থোড়ই।

সেবক বলিল-নাই বা ঘুসা থা ফাটক দিয়ে। চোর ধরা তোমার কাজ, তুমি দারোয়ান। ধরনি কেন? তার বেলা এই সেবকরাম।

গুর্খা বলিল-ক্যা তুম চোর পাড়াথা? সেবক বলিল—পাড়া থা নেই, কিন্তু দেখা থা। আর চোরের জুতো খুঁজে বার কিয়া থা। চোর কা জুতা? হুঁ হ্যাঁ, জুতো। তো জুতা লেকে তুম্ কা করেগা, চবায় গা? চোর তো ভাগ গয়া।

সেবক চোখ পাকাইয়া বলিল—দ্যাখ গুরুঘন্টাল সিং, তুমি আমার সঙ্গে বুঝে-সমঝে কথা বলবে। চোরের জুতো আমি চিবোব কেন? চিবোতে হয় পুলিস চিবোক্।

সেবক রুষ্ট মুখে বাড়ির দিকে চলিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *