০৩. মালতীনগর জায়গাটা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

মালতীনগর জায়গাটা কাজলের খুব খারাপ লাগিল না। ঘনবসতি সে ভালোবাসে না, মালতীনগরে তাহা নাই। বাবা যে বাসা ভাড়া লইয়াছে সেটা শহরের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায়। জানালায় দাঁড়াইলে অনেক দূর দেখা যায়, দৃষ্টির কোন প্রতিবন্ধক নাই। একটা জানালা আর মুক্ত আদর্শ কাজলের অত্যন্ত প্রয়োজন। দুপুরের আকাশে চিল ওড়া দেখিয়া সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাইয়া দিতে পারে। তাই জানালা একটা অবশ্যই দরকার প্রান্তরের দিকে। সে যে শুধু চিল দেখিবার জন্যই দাঁড়াইয়া থাকে। এমন নহে। আসলে চিলগুলা উঠিতে উঠিতে যখন বিন্দুবৎ হইয়া আসে তখন কাজলের মনটা হঠাৎ বিপুল একটা প্রসারলাভ করে। মনে মনে রোজ ভাবে-বাব্বাঃ, কোথায় উঠে গিয়েছে। চিলগুলো, এই এতোটুকু দেখাচ্চে একেবারে! আচ্ছ, ওখান থেকে না জানি পৃথিবীটা কেমন দেখায়। সুদূরের কল্পনা তাহার শিশুমনে স্বপ্নের রঙ বুলাইয়া দেয়। আরও কী একটা মনের মধ্যে হয়, সেটা সে ঠিক বুঝাইয়া উঠিতে পারে না, সেটা বুঝাইবার উপযুক্ত ভাষা তার আয়ত্তে নাই। দুরের কথা ভাবিলে দুপুরের জানালায় বসিয়া মেঘস্পশী পাখি দেখিলে তাহার বুকের গভীরে কী একটা কথা গুমরাইয়া উঠে, সে তাহা ভাষায় অনুবাদ করিতে পারে না।

একদিন অপু বাহির হইতে আসিয়া কাজলকে জানালায় দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল-কী রে, কী দেখছিস হ্যাঁ করে?

কী দেখিতেছিল তাহা সে বাবাকে মোটেই বুঝাইয়া উঠিতে পারে নাই, প্রকাশের চেষ্টায় তাহার মুখ লাল হইয়া গিয়াছিল। চিলগুলি নহে, অগ্নিবৰ্ষী আকাশটা নহে, মাঠ-প্ৰস্তর নহে, মেঘ নহে, অথচ এই সবগুলি মিলিয়া যে গভীর ঐকতান সাধারণ মানুষের ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্যতার বাহিরে সর্বদাই বাজিতেছে, তাহা সে কেমন করিয়া শুনিয়া ফেলিয়াছে। অপু একেবারে অবাক হইয়া গিয়াছিল। তাহার নিজের শৈশবের চিন্তা হুবহু কাজলের মনে প্রতিফলিত হইয়াছে–হুবহু। ছোটবেলায় সেও রোয়াকে বসিয়া গ্ৰীষ্মের দুপুরে অবাক হইয়া আকাশ দেখিত। প্রকৃতির আশ্চর্য নিয়মগুলির কাছে শ্রদ্ধায় তাহার মাথা নত হইয়া আসে। মানুষের মতামত, ইতিহাসের গতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া প্রকৃতি কঠোর হাতে পৃথিবী শাসন করিতেছে। প্রকৃতি স্পষ্ট, জড়তাশূন্য অথচ রহস্যময়। প্রকৃতির রহস্যময়তার প্রতি আকর্ষণ কাজলের রক্তেও সঞ্চারিত। আর মুক্তি নাই। সে মুক্তি পায় নাই, কাজলও পাইবে না।

রান্নাবান্না কোন রকমে হইতেছিল। সৌভাগ্যের কথা এই যে, কাজলের মুখে অপুর রান্না মোটামুটি খারাপ লাগে না।

কিন্তু এইভাবে বেশিদিন চলিবে না, তাহা অপু বুঝিতে পারিয়া একটি বুড়িকে রান্নার জন্য ধরিয়া আনিল। খুব বুড়ি নয়, দুইজনের রান্নার কাজ চালাইয়া লইতে পারে। বুড়িরও কোথাও আশ্রয় মিলিতেছিল না, বলিবামাত্র পোটল হাতে করিয়া আসিয়া পড়িল। তাহার ব্যস্ততা দেখিয়া অপু মনে মনে ভাবিল–আহা, বুড়ি মানুষ, কোথাও কেউই নেই। একে তাড়াব না, রেখে দেব যতদিন থাকে। মুখে বলিল–তোমাকে কী বলে ডাকব বলো দেখি? তোমার ছেলের নাম তো গোপাল? তাহলে গোপালের মা বলে ডাকব, কেমন?

–আর বাবা ছেলে। সে কী আমায় দেখে, না খেতে দেয়? তবুও কী জ্বালা, তার নাম ধবেই লোকে আমায় ডাকবে। যেখানে যাই, শুধু গোপালের মা আর গোপালের মা–

–তবে অন্য একটা কিছু বলো, সেভাবেই ডাকবাখন।

তাহাতেও বুড়ির আপত্তি। দেখা গেল যে ছেলে খাইতে বা পরিতে দেয় না, মুখে আপত্তি করা সত্ত্বেও বুড়ি তাহারই নামে পরিচিত হইতে চায়। অপুর কেমন মায়া পড়িয়া যাওয়ায় গোপালের মা থাকিয়া গেল।

মালতীনগরে আসিবার পরদিন অপু কাজলকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইল। পথটা বাজারেব মধ্য দিয়া গিয়া রেললাইন পার হইয়াছে, সে পথ ধরিয়া দুজনে কিছুক্ষণ হাঁটিল। বাজার ছাড়াইবাব পর বাঁদিকে একটি দোকান হইতে অপু একটা সিগারেট কিনিল। লুঙ্গি পর একজন মানুষ হাত-পা নাড়িয়া বলিতেছে–বেরিয়েছে কি এখন! সেই দুপুরের আগে একবার জাবনা খেয়ে বেরিযেছে। তা কোথাও খুঁজে পাচ্চি নে, কী করি বলো দেখি হরিধান? দুধেলো গাই–কোথাও বেঁধে রেখে দুধ টুধ দুয়ে নিচ্ছে না তো?

হরিধান, দোকানের মালিক, অপুকে পয়সা ফেরত দিতে দিতে বলিল–খুঁজে দেখা পাবে’খন, এখনও তো সন্ধে লাগে নি। তুমি বড়ো বেশি ভাবে কামাল।

কামাল একটা বিড়ি ধরাইয়া বসিল।

বাজার ছাড়াইয়া কাজল বলিল–বাবা, শোনো।

–কী রে!

–আমায় আর একবার কলকাতায় নিয়ে যাবে?

-কেন রে? শহর বুঝি খুব ভালো লাগে? বায়োস্কোপ দেখবি?

–না।

–তবে?

একটু চুপ করিয়া কাজল বলিল–যাদুঘর আবার দেখব।

অপু অবাক হইল, আনন্দিতও হইল।

–নিশ্চয় নিয়ে যাবো। আমারও দু-চার দিনের মধ্যে একবার কলকাতায় যেতে হবে। তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো’খন।

পথটা এখন নির্জন, ফাঁকা। শহরের এদিকে লোকবসতি কম। কাজল চারিদিকে তাকাইতে তাকাইতে চলিয়াছিল। সারাদিন রৌদ্রে পুড়িবার পর সন্ধ্যায় মাটি হইতে কেমন চমৎকার একটা গন্ধ বাহির হয়। গন্ধটার সহিত গরমকালের একটা যোগাযোগ আছে। শীতকালেও তো রৌদ্র ওঠেকিন্তু তখন এমন গন্ধ বাহির হয় না। এক জায়গায় পথের ধারে অনেকগুলি রাধাকুড়া গাছ-হলদে। ফুল ফুটিয়া আছে। অপু ছেলেকে চিনাইয়া দিল-ওই দেখ, ওই হচ্ছে রাধান্ডুড়া ফুল। কালকেই নাম করেছিলাম, মনে আছে?

বেশ শান্ত সুন্দর সন্ধ্যা। এইবার একটি একটি করিয়া নক্ষত্ৰ উঠিবে। অপুর হঠাৎ মনে হইলবেশ হতো, যদি বাড়ি গিয়ে দেখতাম অপর্ণ জলখাবার তৈরি করে বসে আছে। কাজলের হাতমুখ ধুইয়ে খাবার খাইয়ে পড়তে বসাতো। আমায় লুচি আর বেগুনভাজা এনে দিয়ে চা চড়াতে যেতো। মন্দ হয় না। যদি সত্যিই–

অনেক দূর আসা হইয়াছে। সামনেই রেললাইন।

ফিরিবার জন্য অপু ছেলের হাত ধরিয়া টানিবে, এমন সময় কাজল মুখে একটা শব্দ করিয়া দাঁড়াইয়া গেল।

অপু সবিস্ময়ে তাকাইয়া দেখিল কাজল রেললাইনেব ধাবে ঢালু জমিটার দিকে চাহিয়া ভয়ে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।

রেললাইনের পাশে একটা গরু পড়িয়া রহিয়াছে—মৃত। ট্রেনের ধাক্কায় নিশ্চয় মাবা গিয়াছে। শিং দুইটা ভাঙিয়া কোথায় গিয়াছে কে জানে, মেরুদণ্ড ভাঙিয়া শরীরটাকে প্রায় একটা মাংসপিণ্ডে পরিণত করিয়াছে। পিঠের কাছে চামড়া ফুটা হইয়া একটুকরা রক্তাক্ত মেরুদণ্ডের হাড় বাহির হইয়া আছে। ঘাড় ভাঙা, মুখের কোণে রক্তমাখা ফেনা।

–বাবা!

কাজল যেন কেমন হইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে উবু হইয়া বসিয়া পড়িল, তাহার মুখের ভাব দেখিয়া অপু ভয় পাইয়া গেল।

-কী রে? ভয় কী? ওঠে। বাবা, মানিক আমার। কোন ভয় নেই।

কাজল রক্তশূন্য মুখে বলিল–সেই লোকটার গরু। একেবারে মরে গেছে বাবা? আমার খারাপ লাগছে।

বাড়ি আসিবার পথে কাজল কাঁদিয়া অস্থির। জোরে কাঁদে নাই, ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে। অপু অনুভব করিতেছিল, তাহার হাতের ভিতর কাজলের হাত বরফের মতো ঠাণ্ডা। অপুর নিজেরও খারাপ লাগিতেছিল। বীভৎস দৃশ্যটা। কেন যে ওই পথে গেল তাহারা।

–তুই অত ভয় পেলি কেন? হ্যাঁ রে?

কাজল জবাব দিতে পারিল না। তাহার মনের মধ্যে ঘুরিতেছিল ঈষৎ ফাঁক হওয়া রক্তফেনামাখা মুখ, ভাঙা মেরুদণ্ডের বাহির হইয়া থাকা হাড়টা আর মৃত গরুর পড়িয়া থাকিবার অস্বাভাবিক ভঙ্গি।

অসুন্দর জিনিসের সহিত তাহার পরিচয় কম, সুন্দর সন্ধ্যায় বেড়াইতে বাহির হইয়া এই প্রথম সরাসরি অসুন্দরের সহিত পরিচয় হইয়া গেল।

এ দিনটা কাজল ভুলিতে পারে নাই।

মালতীনগরে যে স্কুলে কাজল ভর্তি হইয়াছে, সেটা অপুর বাসা হইতে খুব একটা দূর নহে। তবু অপু কাজলকে স্কুলে পৌঁছাইয়া দিয়া আসে। আবার ছুটি হইলে লইয়া আসে। বাদবাকি সময় তাহার একবি, নিজস্ব। এই সময় সে একটি নূতন উপন্যাস লিখিয়া থাকে। প্রথম উপন্যাসের সাফল্য তাহাকে সাহসী করিয়াছে। এক উপন্যাসেই তাহার বলিবার কথা শেষ হইয়া যায় নাই। অনেক বাকি বহিয়াছে। এই উপন্যাসে তাহা লিখিবে।

আশেপাশের দুই একজন প্রতিবেশী অপুর কাছে যাতায়াত করিয়া থাকেন। ইঁহারা জানিয়া গিয়াছেন, অপু লেখক। অপুর উপন্যাস এরা পড়েন নাই, কিন্তু লেখকের উপর এঁদের অবিচল ভক্তি। ফলে শহরে সাহিত্যিকের আগমন সংবাদ রটিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না। তাহার বাসায় কয়েকটি ছোকরা যাতায়াত শুরু করিল! ইহাদের রচনা অপুকে মনোযোগ দিয়া শুনিতে হইত– দরকার হইলে কলম চালাইয়া ঠিক করিয়া দিতে হইত। অপুর উপন্যাস ইহারা পড়িয়াছে। অপু অবাক হইয়া লক্ষ করিল, তাহার নাম বেশ ছাড়াইয়াছে। এত দ্রুত খ্যাতি আসিবে ইহা তাহার কল্পনার বাহিরে ছিল। একদিক দিয়া ভালেই হইয়াছে। একা থাকিতে হয়, এ ধরনের কিছু তরুণের সহিত আলাপ থাকা ভালো।

কাজলকে প্রতিবেশীব বাড়িতে রাখিয়া মাঝে মাঝে সে একদিনের জন্য কলিকাতায় যায়। বই হইতে আৰ্য হইতেছে মন্দ নহে! পাবলিশারের কাছে গিয়া অপু টাকা লইয়া যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মালতীনগরে ফেরে। কাজলকে ছাড়িয়া সে বেশিক্ষণ থাকিতে পারে না। আজকাল তাহার এই ভাবিয়া অবাক লাগে যে, কাজলকে ফেলিয়া কীভাবে এতদিন সে বাহিরে পড়িয়া ছিল। হৌক ফিজি সুন্দর স্থান, কাজল সুন্দরতর।

কলিকাতায় একদিন তাহাকে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে পাণ্ডুলিপি লইয়া ফিরিতে হইয়াছে। নূতন লেখকের উপন্যাস কেউ ছাপিতে রাজি হয় নাই। এখন পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম। প্রকাশক খাতির করিতেছে যত্ন করিতেছে। পূর্বের সে হেনস্থার দিন আর নাই।

একদিন প্রকাশকের দোকানে ঢুকিতেই প্রকাশক হাসিয়া বলিলেন, আসুন অপূর্ববাবু, বহুদিন বঁচবেন। এইমাত্র আপনার কথাই হচ্ছিল; ইনি হচ্ছেন ‘শরবী’ কাগজের সম্পাদক। আপনার একটা উপন্যাস চান, তাই ঠিকানা চাইছিলেন। তা আপনার নাম করতে কবতে আপনি এসে হাজির।

পরে পার্শ্বস্থ স্থূলকায় ব্যক্তিটির দিকে ফিরিয়া বলিলেন—নিন, আর ঠিকানা দিতে হল না, একেবারে লেখক মশাইকে ধবে দিলাম।

কথার্বতা ঠিক হইয়া গেল। আগামী সংখ্যা হইতে অপু লিখিবে। একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হইতেছে। সম্পাদক ভদ্রলোক অপুর লেখার অত্যন্ত প্রশংসা করিলেন।

অগ্রিম টাকা পকেটে লইয়া অপু পুরাতন দিনের মতো খেয়ালে কিছুক্ষণ রাস্তায় বাস্তায় বেড়াইল। এখন সে হোটেলে ঢুকিয়া যাহা ইচ্ছা এবং যত ইচ্ছা খাইতে পারে, ইচ্ছা করিলে নোটগুলি একটা একটা করিয়া হাওয়ায় উড়াইয়া দিতে পারে। আজ হইতে অনেকদিন আগে, অবশ্য খুব বেশিদিন আর কী, তাহাকে অভুক্ত অবস্থায় রাস্তায় বেড়াইতে হইয়াছে শুকনো মুখে। কেহ ভালোবাসিয়া বলে নাই, আহা, তোমার বুঝি খাওয়া হয় নি? এসো, যা হয় দুটো ডাল-ভাত–না, সেরূপ কেহ বলে নাই; ববং তেওয়ারী-বধূ বেশ ভালো ছিল, তাহার স্নেহে খাদ ছিল না। জীবনের পথে তেওয়ারী-বধূর মতো কয়েকজনের নিকট হইতে স্নেহস্পর্শ পাইয়াই তো কষ্টের মধ্যেও মানুষ সম্বন্ধে সে হতাশ হইয়া পড়ে নাই। আজ টাকা কয়টা পকেটে করিয়া সে পরিচিত স্থানগুলিতেঁ একবার করিয়া গেল। মনে মনে ভাবিল, মানুষ যেখানে কষ্ট পায়, ভগবান সেইখানেই আবার তাকে সুখ দেন। আমার সেই পুরোনো মেসের সামনেই পকেটে আজ একগাদা টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কথাটা ভাবিয়া তাহার কেমন অদ্ভুত লাগিল। মনে হইল, রাস্তার ওপারের ওই দোকানে বসিয়া থাকা ধূমপানরত মানুষটিকে ডাকিয়া বলে—শুনুন, আমি ওই গলিতে থাকতাম অনেকদিন আগে। খেতে পেতাম না, কলেজের মাইনে দিতে পারতাম না। মা বাড়িতে কষ্ট পেতেন, টাকা পাঠাতে পারতাম না। আর এখন আমার পকেটে এই দেখুন, অনেক টাকা-অনেক। এ দিয়ে আমি কী করি বলুন তো?

কিছুদিনের মধ্যেই অপু আরও একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখিতে শুরু করিল। বাজারে তাহার বেশ নাম। বিশেষ করিয়া তরুণদের কাছে তাহার নূতন দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত আদর পাইতেছে। মালতীনগরের সেই তরুণ বাহিনী রোজ তাহার দুর্গ আক্ৰমণ করে, সে মাঝে মাঝে বিরক্ত হইলেও মুখে কিছু বলিতে পারে না। ছেলেগুলোকে সে পছন্দ করে, কিন্তু বড়ো বেশি বক বক করে তাহারা। অপুর মাথা ধরিয়া যায়।

অপু প্ৰতি মাসে একগাদা পত্রিকা ও বই কিনিয়া থাকে। ছেলের জন্য ভালো শিশুসাহিত্য আনে। এমন বই আনে, যাহা কাজলের মনেব গভীরে ঘুমন্ত ইন্দ্ৰিয়গুলিকে জাগাইয়া তোলে। কূপমণ্ডুক হইয়া বাঁচিয়া থাকিবার কোন অর্থ হয় না, ছেলেকে সে মধ্যবিত্ত মনের অধিকারী করিয়া গড়িবে না। অপু নিজে ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিন পড়িতে ভালোবাসে। সে পড়ে ও ভালো গল্প পাইলে তৎক্ষণাৎ ছেলেকে ডাকিয়া শোনায়। এইভাবে অপু ছেলের মনে একটা পিপাসা জাগায়।

কাজলের বিশেষ বন্ধু কেহ নাই। স্কুলে নাই, পাড়াতেও নাই। সে সমবয়সীদের মতো দৌড়ঝাপ করিতে পারে না-যেসব খেলায় শারীরিক কসরতের প্রযোজন, সেগুলি কাজল সভয়ে এড়াইয়া চলে। চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছে, সে পারে না। এই তো সেদিন বেণু আর শ্ৰীশ আম পাড়িবার জন্য মুখুজ্যেদের বাগানে পাচিল ডিঙাইয়া ঢুকিতেছিল। আম খাইতে কাজলের আপত্তি নাই, কিন্তু মধ্যে প্রাচীররূপী বড়ো একটা বাধা রহিয়াছে। অতি উঁচু পাঁচিল তাহার পার হইবার সাধ্য নাই! বেণু আর শ্ৰীশ অদ্ভুত কৌশলে তর তর করিয়া পাঁচিলের মাথায় উঠিয়া গেল। শ্ৰীশ মিটমিটি হাসিয়া বলিল–কী রে, পাববি নে?

তাহাদের উঠিবার কায়দা দেখিয়া কাজলের মনে হইতেছিল, ভূমিষ্ঠ হইয়া অবধি তাহারা এই কার্যের অনুশীলন করিয়াছে। মনে মনে নিজের অক্ষমতা বুঝিয়া কাজল ম্রিযমাণ হইয়া বলিল–না ভাই, আমার ডান পায়ে ব্যথা। একটা ফেলে দে না ভাই, খাই।

শ্ৰীশ এবং বেণুরা। দয়া করিয়া একটা দুইটা আমি তাহাকে খাইতে দেয়। উপায় কী! নিজ উঠিয়া পাড়িবার সাধা তাহার নাই।

বাহিরের দুনিয়ায় লাফালাফি করিয়া বেড়াইবার সমর্থ্য নাই বলিয়া সে ঘরের মধ্যে অধিকাংশ সময় কাটায়। মাঝে মাঝে কাজল বাবার ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিনগুলি নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখে। গল্পগুলির আকর্ষণ তীব্র। ছবি দেখিয়া তাহার গায়ের লোম কাঁটা দিয়া ওঠে- যে ছবিটায় খুব রহস্যজনক ঘটনার আভাস পাওয়া যায়, বাবাকে বলিয়া গল্পটা কাজল শুনিয়া লয়।

অপু বুঝিতে পারে, কাজলের মানসিক বৃদ্ধি শুরু হইয়াছে। ঠিক এই একই জিনিস সেও করিত দেওয়ানপুরের স্কুলে। কঠিন ইংরাজি বুঝিতে না পারিলে ছবি দেখিয়া কিছুটা আভাস পাইবার চেষ্টা করিত, অনেক সময় রমাপতিদাকে ধরিয়া গল্পটা বুঝিয়া লইত। সেই একই জিনিস আবার ঘটিতেছে। রক্তের ভিতর অদৃশ্য বীজ রহিয়াছে–তাহাই এ সব সম্ভব করিতেছে।

ধারাবাহিক উপন্যাস দুইখানি শুরু করিবার কিছুদিন পরে অপু বিকালে বসিয়া ছেলের সঙ্গে জলখাবার খাইতেছিল। গোপালের মা পরোটা ভাজিয়া দিয়া রাস্তার ও পারের দোকানে দোক্তা আনিতে গিয়াছে। এমন সময় বসিবার ঘরের দরজার মুখে আসিয়া দাঁড়াইল একটি মেয়ে! কিশোরী বলাই অধিক সঙ্গত, মেয়েটির বয়স কোনমতেই পনেরো-ষোলর বেশি নহে। অপু অবশিষ্ট পরোটাসুদ্ধ থালাখানা তাড়াতাড়ি খাটের নিচে লুকাইবার চেষ্টা করিল।

আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য! মেয়েটি একা আসে নাই, তাহার পিছনে আরও একটি মেয়ে আসিয়াছে। এ মেয়েটি হয়তো প্রথমটির চেয়ে বৎসর দুই-তিনের বড়ো হইবে।

অপু উঠিয়া কোঁচা দিয়া খাটটা পরিষ্কার করিয়া মেয়ে দুটিকে বসিতে দিল। কাজল অবাক হইয়া ব্যাপারটা দেখিতেছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েটি লজ্জিত সুরে বলিল–আপনিই তো অপূর্বকুমার রায়, লেখক?

অপুর মনে ভারি আনন্দ হইল। সে লেখক বলিয়া মেয়ে দুটি দেখা করিতে আসিয়াছে। এ অভিজ্ঞতার স্বাদ তাহার নিকট একেবারে নূতন। প্রশংসা সে আগেও পাইয়াছে, কিন্তু মেয়েদের নিকট হইতে তাহ পাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ রহিয়াছে।

মেয়ে দুটি মালতীনগরেই থাকে। ছোট মেয়েটির নাম হৈমন্তী, বড়টি তাহার দিদি, নাম—সরযূ। হৈমন্তীর সাহিত্যে গভীর অনুরাগ আছে, সে অপুর লেখা পড়িয়া অবাক হইয়াছে তাহার ক্ষমতায়। অপু কি তাহাকে একটা অটোগ্রাফ দিবে?

অপু সত্যই অবাক হইল। মফঃস্বলে মেয়েরা একা বেড়াইতেছে, ইহা বেশ নূতন দৃশ্য। তাহা ব্যতীত কলিকাতায় অটোগ্রাফ চাহিলে ততটা অবাক হইবার কারণ থাকে না, কিন্তু মালতীনগরে অটোগ্রাফা! নাঃ, মেয়ে দুটি দেখা যাইতেছে বেশ আলোকপ্ৰাপ্তা।

অটোগ্রাফ দেওয়ার পর অপু তাহাদের চা খাইতে অনুরোধ করিল। তাহারা লেখকের সহিত কথা বলিতেই আসিয়াছিল, অতএব বিশেষ আপত্তি করিল না।

কথায় কথায় প্রকাশ পাইল হৈমন্তী গল্প লিখিয়া থাকে। অপু বলিল– সেটা আগে বলেন নি কেন? বাঃ, খুব ভালো কথা। একদিন নিয়ে আসুন, পড়া যাক। দিদি কথাটা প্রকাশ করিয়াছিল। হৈমন্তী সরযূর দিকে কটমট করিয়া তাকাইল। অপুর মজা লাগিতেছিল। হৈমন্তীর ছেলেমানুযি তাহার মনের আনন্দকে হঠাৎ জগোইয়া তুলিল। নারীর স্পর্শ না থাকিলে জীবনটা পানসে লাগে, নারীর কল্যাণ-হস্তই জীবনের রূপ পালটাইয়া দেয়।

হৈমন্তী একখানা চাঁপাফুল রঙের শাড়ি পরিয়া আসিয়াছিল, শাড়ির আঁচল হাতে জড়াইতে জড়াইতে লজ্জিত মুখে বলিল–দিদির যেমন কাণ্ড! লেখা-টেখা কিছু নয়, ও এমনি–

সবযু বাধা দিয়া বলিল–না অপূর্ববাবু বিশ্বাস করবেন না। ওর কথা। এই সেদিনও ওর লেখা বেরিয়েছে কাগজে।

সরযূ যে পত্রিকার নাম করিল, সেটা শুনিয়া অপু সত্যিই বিস্মিত হইল। বাংলা দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাসিকপত্রে যদি এই দুগ্ধপোষ্য বালিকার রচনা ছাপা হইয়া থাকে, তবে অবশ্যই একবার পড়িয়া দেখিতে হইতেছে।

অপু বলিল–কোনো আপত্তি শুনছি নে, কবে লেখা আনবেন বলুন। ফাঁকি দিলে চলবে না।

সরযূ বলিল–বাবাও শুনেছেন। আপনি এখানে থাকেন। উনি বলেছিলেন একদিন আপনাকে দুপুরে খাবার কথা বলতে। না, আপনারও কোন আপত্তি শোনা হবে না। কবে যাবেন বলুন।–যেদিন যাবেন, সেইদিন হৈমন্তী আপনাকে লেখা শোনাবে।

অপু বিশেষ আপত্তি করিল না। রবিবারে নিমন্ত্রণ রহিল। কাজলও সঙ্গে যাইবে হৈমন্তী এবং সরযূ দুইজনে কাজলকে অনেক আদর করিয়া বিদায় লইল। ঠিকানাটা অপু রাখিয়া দিল।

মেয়ে দুটি বিদায় লইলে অপু বিছানার কাছে আসিয়া বসিতে যাইবে, চাদরের উপর নজর পড়িল-কয়েকটা বেলফুল। তখনও বেশ তাজা, বেশিক্ষণ তোলা হয় নাই। অপু মনে মনে ভাবিল-এখানটায় হৈমন্তী বসেছিল। ওই নিয়ে এসেছিল ফুলগুলো। ভুলে ফেলে গেছে, আচ্ছা! মেয়ে যাহোক–

অপু ফুলগুলি তুলিয়া একবার গভীর ঘ্রাণ লইল।

রবিবারে ছেলেকে লইয়া অপু নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গেল। নিজে একটু বিলাসিত করিতে ছাড়ে নাই, একটা শাস্তিপুরী ধুতি পরিয়াছে। কিন্তু সেই তুলনায় জামাটা ভালো হইল না–ময়লা মতো। অথচ এই ধুতিটা পরিয়া নিমন্ত্রণ খাইতে যাইবার তাহার বড়ো শখ। ফলে বিসদৃশ জামাকাপড় পরিহিত অপু নিমন্ত্রণ খাইতে গেল।

বাড়িতে পা দিতেই হৈমন্ঠীর বাবা আসিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন। ভদ্রলোক সরকারি কাজ করেন–বদলির চাকরি। তিনি অপুর উপন্যাসটি পড়িয়াছেন। সম্প্রতি যে পত্রিকা দুটিতে অপু উপন্যাস লিখিতেছে, সেগুলিও তাহার বাড়িতে রাখা হয়।

অপু অবাক হইয়া দেখিল, বাড়িময় সাহিত্যের আরহাওয়া। বাবা, ভাই, বোন সবাই বেশ শিক্ষিত ও উদার। বসিবার ঘরে প্রচুর বই রহিয়াছে—অগোছালোভাবে খাটের উপর ও টেবিলের উপর ছড়ানো। অপু নিজের অভিজ্ঞতা হইতে দেখিয়াছে যে বাড়িতে বই সাজানো থাকে, সে বাড়িতে পাঠক কম। পড়ুয়াদের বই কখনও গোছানো থাকিতে পারে না। যাহারা শখের আসবারের মতো বই দিয়া ঘর সাজাইয়া সুরুচির পরিচয় দিতে চায়—তাহদের বই সাজানো থাকিতে পারে। হৈমন্তীদের পরিবার সম্বন্ধে অপুর বেশ একটা শ্রদ্ধা জন্মিল। তাহার মনে বদ্ধমূল ধারণা আছে-যাহারা বই পড়িতে ভালোবাসে তাহারা কখনও খারাপ মানুষ হইতে পাবে না। অনেকদিন পরে এই বাড়িতে আসিয়া অপুর মনে হইল, বেশ সহজ পছন্দসই আবেষ্টনীর মধ্যে আসিয়াছে। কাজল আসিবামাত্রই বই-এর কাছে গিয়া বসিয়াছে, বই পাইলে সে আর কিছু চায় না। অপু কিছুক্ষণ বাদে বলিল–তা, এবার লেখাগুলো পড়লে হতো না?

হৈমন্তী কিছুটা সঙ্কোচের সহিত খান দুই পত্রিকা আনিয়া অপুর হাতে দিল। অপু ব্যগ্রতার সহিত একটি হইতে সূচিপত্র দেখিয়া গল্প খুঁজিয়া পড়িতে শুরু করিল। ভাবিয়াছিল, মেয়েলি প্রেমের মিষ্টি মিষ্টি গল্প হইবে। একটি মেয়েকে একজন ছেলে দূর হইতে ভালোবাসিল, দুই-একটা চিঠি দিল। বাগানে একবার দেখাও হইল–পরে অভিভাবকগণ জানিতে পাবিয়া মেয়েটিকে ঘরে বন্দী করিল। ইহার পর নায়ক দাড়ি কামানো বন্ধ করিল, বোগা হইতে লাগিল এবং স্কুল-মাস্টারিতে ঢুকিয়া বড়ো বড়ো কবিতা লিখিয়া পরে টিবি হইয়া সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করিল। ইহা ব্যতীত মেয়েরা আর লিখিবেই বা কী?

একটু তাচ্ছিল্যের সহিত পড়িতে শুরু করিয়াছিল বলিয়াই বোধ হয় ধাক্কাটা জোরে লাগিল। সাধারণ ন্যাকা-ন্যাক ভাষায় লেখা নহে–প্রেমের গল্পও নহে। একটি মেয়ে গল্প লিখিতে ভালোবাসিত। বিবাহ হইয়া পতিগৃহে অজস্র সাংসারিক কাজের ভিড়ে তাহার লেখিকা-সত্তা গেল চাপা পড়িয়া। একদিন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় মেয়েটি অবসর পাইয়া টিনের তোরঙ্গ খুলিয়া তাহার লেখার খাতা বাহির করিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে ভিজা বাতাসের সহিত তাহার কুমারী জীবনের স্মৃতি যেন হু হু করিয়া ঢুকিয়া পড়িল ঘরের ভিতর। এই গল্প। ভাষার উপর লেখিকার দখলের কথা সহজেই বোঝা যায়। অপু অবাক হইল। গল্প পড়িয়া মামুলি ধরনের কী প্রশংসা করিবে তাহা ঠিক ছিল, এখন গল্পটা সত্য সত্যই ভালো হইয়া পড়ান্য সে কিছু বলিতে পারিল না।

খাইতে বসিয়া অপু বলিল–সত্যিই খুব ভালো লেখা আপনার। এতটা ভালো, মিথ্যে বলবো না, আমি আশা করতে পারি নি।

হৈমন্তী বলিল–আমাকে আর আপনি বলছেন কেন, তুমি বলুন।

–তোমার গল্প সত্যিই ভালো লাগল হৈমন্তী। এত সাধাবণ প্লট নিয়ে এত চমৎকার কবে তা ফুটিয়ে তোলা–না, তোমার মধ্যে শিল্পীমান লুকিয়ে আছে।

হৈমন্তীর বাবা হাসিয়া বলিলেন-অত প্রশংসা করবেন না অপূর্ববাবু, মাথা বিগড়ে যাবে ওর। তবে হ্যাঁ, এ মেয়েটি আমার সত্যিই–পড়াশুনোতেও বড়ো ভালো ছিল। বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হতো। বড়ো অসুখে পড়েছিল বলে বছরখানেক পড়া বন্ধ আছে।

খাওয়া হইলে হৈমন্তী অপুর জন্য মশলা আনিল। মশলা লইতে লইতে অপু জিজ্ঞাসা করিল–আচ্ছা, সেদিন তুমি আমার খাটের ওপরে বেলফুল ফেলে এসেছিলে, না? তুমি যাবার পর দেখি পড়ে আছে। আমার অবশ্য ভালেই হয়েছিল, সারা সন্ধে গন্ধ শুঁকে শুঁকে বেশ কবিত্ব করা গেল।

মাথা নিচু করিয়া হৈমন্তী বলিল–ফেলে আসি নি, আপনার জন্যেই নিয়ে গিয়েছিলাম, রেখে এসেছি। আপনার লেখা পড়ে মনে হয়েছিল ফুল পেলে আপনি খুশি হবেন।

-আমার জন্য নিয়ে গিয়েছ। তো আমাকেই দিলে না কেন?

উত্তরে হৈমন্তী কিছু বলিল না, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া পরে মাথা তুলিয়া অপুর দিকে তাকাইয়া একটু সলজ্জ হাসি হাসিল।

-কই বললে না তো দাওনি কেন?

–দিয়েই তো এসেছিলাম। আপনি বুঝতে পারেন নি, সে কি আমার দোষ?

বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে কাজল বলিল–বেশ লোক এরা, না বাবা! উত্তর না পাইয়া অভিযোগের সুরে বলিল–হুঁ। বাবা, তুমি সেই থেকে শুনছো না কিছু!

অপু চমক ভাঙিয়া বলিল–অ্যাঁ, ও হ্যাঁ তা ভালো লোক। বেশ ভালো লোক–নাও, এখন তাড়াতাড়ি পা চালাও, বাড়ি গিয়ে তোমার ইংরাজি বানানগুলো—

হৈমন্তী প্রায়ই অপুর বাসায় আসে। অপু সম্প্রতি খ্যাতি পাইতেছে–কিন্তু এই মেয়েটি তাঁহাকে সত্য করিয়া চিনিয়াছে। পুস্তক সমালোচকদেব দায়সারা ভাসা ভাসা আলোচনা নহে, হৈমন্তী তার অন্তরে প্রবেশ করিয়া তার চোখ দিয়া বিচার করিয়াছে। অপুর লেখক এবং ব্যক্তিসত্তাকে এমন করিয়া আর কেহ আদর করে নাই–এক লীলা ছাড়া। হৈমন্তী তাহাকে বুঝিতে পারিয়াছে, চিনিতে পারিয়াছে। অপুর মনে ধীরে ধীরে কেমন একটা বুভুক্ষা জাগিয়া উঠিল। ভালোবাসা পাইবার ক্ষুধা। তার মনে হইল, সারাজীবন এইভাবে ভাসিয়া বেড়ানো সম্ভব নহে, জীবনের মূল মাটির মধ্যে চালাইয়া নিজেকে মৃত্তিকার উপরে প্রতিষ্ঠিত করিবার দিন আসিয়াছে। যতবার সে স্থায়ী হইবাব চেষ্টা করিয়াছে, দুর্ভাগ্যের ঝড়ে তাকে ভাসাইয়া লইয়াছে দূরে। এখন গৃহের শাস্তি পাইতে ইচ্ছা করে। তবে সে স্থাণু হইয়া পড়িতে চায় না, গৃহকে সে পায়ের বেড়ি না ভাবিয়া জীবনানন্দের একটি দিক হিসাবে পাইতে চায়।

একদিন বিকালে হৈমন্তী আসিল। সঙ্গে তাহার ভাই। অপু হাসিয়া বলিল–আরে, এসো, এসো। ভালোই হলো। বিকেলটা মোটে কাটছিল না, এখন বেশ গল্প করা যাবে তোমার সঙ্গে।

–তা তো করবেন। কিন্তু আজ আমার একটা গল্প শুনতে হবে আপনাকে। দেখছেন তো, একদিন প্রশ্ৰয় দিয়ে কী কাণ্ড করেছেন!

–বারে, সে কী কথা! নিশ্চয় শুনব গল্প। তোমার গল্প আমার সত্যিই ভালো লাগে হৈমন্তী, সেদিন তোমায় মিথ্যে বলিনি। মামুলি প্রশংসাও করিনি। সত্যিই তোমার মধ্যে অদ্ভুত গুণ আছে। কোত্থেকে পেলে বলে তো?

-বাড়িয়ে বলা আপনার অভ্যোস। আমার লেখা এমন কিছু নয়—

জোর তর্ক শুরু হইয়া গেল। অপু প্রমাণ করিবেই হৈমন্তী ভালো লিখিয়া থাকে। আধঘণ্টা বাগযুদ্ধের পর হৈমন্তী হার মানিল। অপু বলিল–চলো, উঠোনে মাদুর পেতে বসি, ভেতরে বড্ড গরম।

চারজনে উঠানে বসিল। কাজলের সহিত হৈমন্তীর আশ্চর্য সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রথম প্রথম কাজল তাহাকে তত পছন্দ করিতে পারে নাই। কিন্তু পরে কী ভাবে যেন কাজলের মতের পরিবর্তন ঘটিয়াছে, এখন সে সর্বদা হৈমন্তীর কাছে কাছে ঘোরে। হৈমন্তী প্ৰথম দিন দেখিয়াই ভালোবাসিয়াছিল। কাজলের উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, মুখের গড়ন, সবটাই যেন অপুর ধাঁচে গড়া। দেখিলে আদর না করিয়া থাকা যায় না।

সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল। কাজল হৈমন্তীর কোলের কাছে ঘোষিয়া বসিয়াছে। প্ৰতাপ (হৈমন্তীর ভাই) হাঁটুর উপরে থুতনি রাখিয়া কী যেন ভাবিতেছে। উঠানের সন্ধ্যামালতীর ঝাড়ে ঝিঁঝির শব্দ। সমস্ত দিনের তাপের পর এখন চারিদিকে কেমন শান্ত স্তব্ধতা।

হঠাৎ একমুহূর্তের জন্য অপুর কেন যেন ফিজির সমুদ্রবেলার কথা মনে পড়িল। এই সময় স্কুল হইতে বাড়ি ফিরিয়া পাউরুটি ও সামুদ্রিক মাছের ঝোল দিয়া জলযোগ করিয়া সে বেলাভূমিতে আসিয়া বসিত। সমুদ্রের ওপরেই একটি ছোট শহরে সে মাস্টারি করিত। কোনদিনই তার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা হইত না। সে পা ছাড়াইয়া বসিয়া থাকিত। সামনে অবিশ্রাস্ত গর্জন করিতেছে সমুদ্র। মাঝে মাঝে ঢেউগুলি তাহার কাছ বরাবর আসিয়া পড়িতেছে, চলিয়া যাইবার সময় ফেলিয়া যাইতেছে একটি টানা লম্বা সাদা রেখা আর কয়েকটি ঝিনুক। অপুর অদ্ভুত অনুভূতি হইত-একটা অপার রহস্যের অনুভূতি। সমুদ্রের প্রকাণ্ডত্বের সহিত নিজেকে একাত্ম করিবার মহৎ অনুভূতি। অথচ এই এখন সে মালতীনগরে বসিয়াও তো বেশ আনন্দ পাইতেছে। অত বিশাল দৃশ্যের সম্মুখীন যে হইয়াছে—তাহার এই ক্ষুদ্র স্থানে আরদ্ধ থাকিয়াও কি আনন্দ পাওয়া সম্ভব?

অপু মনে মনে নিজের আনন্দের কারণটা অনুভব করিল। উন্মত্তের মতো উল্কাবেগে পৃথিবীর এ প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিয়া মরিলেই সার্থকতা লাভ হয় না। জীবনের আনন্দ রহিয়াছে অনুভূতির গাঢ়ত্বের ভিতর, জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করিবার ভিতর। ফিজির সমুদ্রতীরে বসিয়া সে যেমন হইতে পারে–মালতীনগরেও হইতে পারে।

স্তব্ধতা ভাঙিয়া অপু বলিল–তুমি গান গাইতে পারো হৈমন্তী?

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হৈমন্তী বলিল–পারি।

—একখানা গাও না, শুনি।

সামান্য পরেই হৈমন্তী গাহিল—’দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া, ভুলালো রে ভুলালো মোর প্ৰাণ।’

অপু সামনের দিকে ঝুঁকিয়া শুনিতেছিল। হৈমন্তীর গলা ভালো। বিশেষ করিয়া গানেব কথা এবং উদাস সুব অপুর হৃদয় স্পর্শ করিল। পরিবেশের সঙ্গে গানটা যেন কেমন করিয়া মিলিয়া গেল।

‘ঘরেও নহে পারেও নহে
যে জন আছে মাঝখানে
সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়-’

গান শেষ হইয়া গেল। অন্ধকার নামিয়াছে। বেশ বাতাস। অপু ওপরে তাকাইল–সব নক্ষত্র এখনও দেখা যাইতেছে না বটে, কিন্তু বৃহস্পতি গ্ৰহ ঝকঝক করিতেছে। অপু বলিল–বৃহস্পতি চেনো? ওই দেখ। ওই যেটা ও-বাড়ির কার্নিসের ডানদিকে জ্বল জ্বল করছ–দেখছো?

–হ্যাঁ।

—ভাবো দেখি, ওটা পৃথিবীর চেয়ে কত বড়। অন্ধকারের বুকে দীর্ঘপথে সূর্যকে পরিক্রমা করছে সৃষ্টির উষাকাল থেকে। ও রকম কত গ্রহ, কত নীহারিকা ধূমকেতু মহাশূন্যের। অকল্পনীয় ব্যাপ্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবনটা বড়ো অদ্ভুত, বড়ো সুন্দর, না? তুমি অনুভব করো?

–করি। সেজন্যই তো আপনার লেখা আমার ভালো লাগে।

একটা দমকা বাতাস আসিল। সন্ধ্যামালতীর ঝাড়ে লাগিল দোলা। অনেক শূকনো পাতা খড়খাড় শব্দ করিয়া উঠানের উপর দিয়া সরিয়া গেল। কাজল বলিল–সেই যে বাবা তুমি বলেছিলে, এদের দেবে সেই জিনিস–

অপু হাসিয়া বলিল–ওই দ্যাখো, একদম ভুলে বসে আছি। কলকাতা থেকে অরেঞ্জ ক্রীম দেওয়া বিস্কুট এনেছি। তাই কাজলকে বলেছিলাম, তোমরা এলে দেবার কথা। ভাগ্যিস তুই মনে করিয়ে দিলি খোকা–

অপু উঠিয়া ঘরে বিস্কুট আনিতে গেল।

হৈমন্তীদের বাড়িতে অপু প্রায়ই যাতায়াত করে আজকাল। হৈমন্তীর বাবা-মা তাহাকে পাইলে সত্যই খুশি হন। সে গিয়া গল্পগুজব করিয়া জলখাবার খাইয়া বাড়ি ফেরে। কাজলও সঙ্গে যায়। মাঝে মাঝে গানের আসর বসে, হৈমন্তী আগে হইতে নিমন্ত্ৰণ করিয়া যায়। সাংস্কৃতিক আরহাওয়া অপু পছন্দ করে, ফলে এ বাড়ির সহিত তাহার ঘনিষ্ঠতা গড়িয়া উঠিতে বেশি দেরি হয় নাই।

অপু অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছে, এক সারাজীবন কাটানো তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে। অপর্ণর কথা ভাবিয়াই সে অন্তর হইতে সায় পাইতেছিল না। কিন্তু পরে চিন্তা করিয়া দেখিল, অপর্ণার স্মৃতি তাহার মনের যে গোপন কন্দরে স্থায়ী রঙে আঁকা হইয়া গিয়াছে—সেখানে আর কাহারও স্থান নাই। কিন্তু হৈমন্তীকে সে অস্বীকার করিতে পারিবে না। সে যদি বলে-আমি হৈমন্তীকে ভালবাসি না, তবে তাহা মিথ্যা কথা বলিবে।

অপর্ণার স্মৃতিকে শ্রদ্ধার আলোয় বাঁচাইয়া রাখিয়াই সে বর্তমান সত্যকে মর্যাদা দিবে। একমাত্র ভয় ছিল কাজলকে লইয়া। কিন্তু কাজল ও হৈমন্তী পরস্পরকে নিকটবন্ধনে বাঁধিয়াছে। সেদিক দিয়া চিন্তার আর কারণ নাই।

একদিন অপু কথাটা হৈমন্তীর বাবার কাছে পাড়িল। ভদ্রলোক আপত্তি করিলেন না। অপু সজ্জন, সুপুরুষ, বাজারে নামডাক হইয়াছে। সম্প্রতি বই লিখিয়া ভালো উপার্জন করিতেছে। এমন পাত্রের সহিত বিবাহ না দিবার কোনো কারণ নাই। তিনি নিজেও বুদ্ধিমান এবং সাহিত্যরসিক। অপুর ব্যক্তিত্ব এবং রচনা-ক্ষমতা তাহাকে মুগ্ধ করিয়াছিল। তিনি মত দিলেন।

দিনস্থির করিবার জন্য ভিতর বাড়ি হইতে পঞ্জিকা আনানো হইল।

1 Comment
Collapse Comments
অপরাজিতা দাস June 20, 2021 at 8:17 pm

আমার মনে হয় এই উপন্যাসটি বিভূতিভূষণ লিখলে কোনোদিনই অপুর আরেকটি বিয়ে দিতেন না। তাও আবার স্বেচ্ছায়। অপু সর্বদাই মুক্তি খুঁজত। তবে অপুর জীবনের পরিণতির চেষ্টার জন্য তারাদাস বন্দোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *