প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৩. ভারতের আদিপর্ব

ভারতের আদিপর্ব

কিন্তু দার্শনিক হেগেলের পক্ষে কথাটা যতোই অসন্তোষজনক হোক না কেন, ভারতবর্ষেরও একটা অতীত ইতিহাস সত্যিই আছে। বরং, ওই যে তেত্রিশকোটি দেবদেবীর নজির দেখিয়ে হেগেল প্রমাণ করতে চেয়েছেন এ-দেশের কোনো ইতিহাস নেই,—ওঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেই এ-দেশের অতীত ইতিহাসটার আভাস পাওয়া যেতে পারে। কেননা, এই দেবদেবীদের নিজেদের ইতিহাস আছে এবং সে-ইতিহাস শুধুই যে চিত্তাকর্ষক তাই নয়, তারই মধ্যে দেশের ইতিহাসও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

দেশের সেই আদিপর্বের ইতিহাসটির সন্ধান পেলে দেখা যায় অবস্থাটা চিরকালই স্বপ্নের ঘোরের মতো নয়। আর, হেগেল ওই যে স্বপ্ন-লাবণ্যের কথা বলছেন,—যা-কিছু কঠিন, যা-কিছু কঠোর, যা-কিছু দ্বন্দ্বকণ্টকিত ও সংঘাতচঞ্চল তা সবই স্বপ্নের দশায় শান্ত সমাধিস্থ হয়ে যাওয়ার লাবণ্য—তা আর যাই হোক অন্তত ভারতীয় ইতিহাসের আদিপর্বের বেলায় অলীক কল্পনামাত্র।

কিন্তু দেবদেবীদের আবার ইতিহাস কী? স্বর্গের কাহিনীর সঙ্গে মর্তের মানুষদের সম্পর্কই বা কী করে সম্ভবপর?

আসলে এই দেবদেবীরা চিরকালই স্বর্গের বাসিন্দা ছিলেন না। তার মানে, এমন একটা যুগ ছিলো যখন তাঁরা আধুনিক অর্থে দেবদেবীই হয়ে ওঠেননি। তাই মর্তের মানুষের সংগেই তাঁদের সম্পর্ক তখন খুব নিবিড়। মানুষের উৎপন্ন অন্ন থেকে নৈবেদ্য পাবার বদলে তখন তাঁরা অনেকেই মানুষের উৎপাদন-উৎসাহে, এমনকি প্রজনন-উৎসাহেও, প্রকাশ্যভাবেই নেতৃত্বগ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি।

 

ভারতবর্ষের সেই আদিপর্বের চিত্রটি তাই আশ্চর্য, অপরূপ। মানুষের সমাজে তখনো উদ্বৃত্তজীবী শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেনি আর তাই সে-শ্রেণীর চেতনা দিয়ে গড়া নৈবেদ্যজীবী দেবদেবীরাও নয়।

তারপর অবশ্যই উদ্বৃত্তশ্রণীর মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। যদিও অবশ্য, ঠিক কী করে তা হলো সে-প্রশ্ন খুবই জটিল। প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি-ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। কিন্তু এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আসমুদ্রহিমাচল এই বিরাট দেশে সমস্ত মানুষের জীবনে একই তালে পরিবর্তন দেখা দেয়নি। রাষ্ট্রশক্তি গড়ে ওঠবার পাশাপাশিই থেকে গিয়েছে প্রাগ্‌-বিভক্ত প্রাচীন সমাজ। আর, ওর রাষ্ট্রশক্তির বর্ণধারেরা প্রাগ্‌-বিভক্ত সমাজের মানুষগুলিকে যে কী রকম বিষনজরে দেখেছিলেন তার দলিল রচনা করে গিয়েছেন স্বয়ং কৌটিল্য। কৌটিল্যের রচনা অনুসরণ করেই যৌথ-সমাজের প্রতি শ্রেণীবিভক্ত-সমাজের শাসক-সম্প্রদায়ের মনোভাব সম্বন্ধে পরে আলোচনা তুলবো। আপাতত প্রশ্ন হলো, দেবদেবীদের আদিরূপটির প্রতি ওই শাসক-শ্রেণীর মনোভাব কী রকম? যে-মানুষদের সঙ্গে তখনো ওই দেবদেবীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেই মানুষদের প্রতি যে-রকম মনোভাব, সেই রকমই। অর্থাৎ, দেশের শাসক-সম্প্রদায়ও এঁদের মোটেই সুনজরে দেখেনি, এমনকি খোদ আইনকর্তারাও এঁদের বিরুদ্ধে আইনজারি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্থাৎ, দেবলোকের অনেক যুদ্ধই তখন পর্যন্ত ঘটে চলেছিলো মরলোকের বুকেই।

আর্য-অনার্য মতবাদের জটিলতায় ভারতের আদিপর্বে শ্রেণীসমাজের আবির্ভাব-কাহিনী আজো অনেকখানি অস্পষ্ট হয়ে রয়েছে। অথচ, ওই আদিপর্বের ইতিহাস খুঁজে না পেলে প্রাচীন ভারতে ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে সংগ্রাম ও সংঘাতকে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তার কারণ, ধ্যানধারণাগুলি স্বয়ম্ভূ নয়। মানুষের মূর্ত জীবনেরই প্রতিবিম্ব।

অতএব, লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-আবিষ্কারের প্রচেষ্টা ভারতের আদিপর্ব ইতিহাসটি খোঁজবার চেষ্টাও হতে বাধ্য। এবং, যে দেবদেবীদের নজির দেখিয়ে হেগেল ভারতবর্ষের গোটা ইতিহাসটাকেই অস্বীকার করতে চান তাঁদেরই অনুসরণ করে আমরা হয়তো ভারতের আদিপর্বের ওই ইতিহাসটির সন্ধান পাবো।