প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

০৩. বাজির খেলা

দশ পেসো-দে অরোর বাজির খেলা। সারা জাহাজে যে সাড়া পড়ে গেছে তাআর বলবার দরকার নেই।

সালাজার এ-খেলায় থাকতে রাজি হয়নি। জুয়ার নেশার কী করতে কী করব কে জানে! শেষে সম্রাটের সোনায় হাত দিয়ে ফেলি যদি!—হালকা ঠাট্টার সুরে এই অজুহাত দেখিয়ে সে সরে দাঁড়িয়েছে।

বাকি শুধু অ্যালনসো কিনটেরো। সে স্পষ্টই জানিয়েছে, দশ সোনার পেসো করে। বাজি ধরার মুরোদ তার নেই। তা ছাড়া স্পেনে শুধু ঘোড়া কিনতে নয়, সে বিয়েও করতে যাচ্ছে তার প্রেমিকাকে। সুতরাং জুয়ায় ফকির হবার যেমন তার ভয় আমির হবারও তেমনই। কথায় বলে জুয়ায় হার মানে প্রেমে জিৎ। তার উলটোটাও সত্যি। তাই জুয়ায় জিতে সে প্রেমিকাকে হারাতে চায় না।

খেলা তাহলে শুধু সোরাবিয়া আর ঘনরামের মধ্যেই হতে পারে। তাতে আপত্তি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া বেশ ঠেস দিয়ে।

আছে, আপত্তির ঠিক বিপরীত। জুয়ায় দ্বন্দ্বযুদ্ধই আমার পছন্দ। বলেছেন ঘনরাম।

খেলতে বসার আগে বাধা এসেছে দু-দিক থেকে দুবার। খবর পেয়ে প্রথমে ফ্রানসিসকান ফাদার ছুটে এসে ধর্মোপদেশ দিয়ে তাদের নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। জুয়া যে কত বড় পাপ তা বুঝিয়েছেন।

সোরাবিয়া খানিকক্ষণ সহ্য করে বিরক্ত হয়ে বলেছে, আমরা পাপ না করলে আপনারা উদ্ধার করবেন কাকে?

আমরা উদ্ধার করবার কেউ নই। তৃণাদপি সুনীচ হয়ে বলেছেন পাদরিবাবা, উদ্ধার করবার তিনিই মালিক। তবে জ্ঞানপাপীর উদ্ধার পাওয়া যে বড় কঠিন।

এবার ঘনরাম একটু হেসে বলেছেন, কিন্তু উদ্ধার যিনি করেন তিনি চোখে কম দেখেন না নিশ্চয়ই!

চোখে কম দেখেন! পাদরিবাবার সঙ্গে আর সবাইও অবাক হয়ে তাকিয়েছে ঘনরামের দিকে।

পাদরিমশাই বলেছেন, কথাটা যে বুঝতে পারলাম না, বাছা।

না, আমি বলছিলাম, ঘনরাম বুঝিয়ে বলেছেন, চোখে কম না দেখলে তিনি দশ নোনার পেসোও যেমন, এক রুপোর পেসোও তেমনই স্পষ্ট দেখতে পান। সে চাঁদির পেসোর জুয়ার সময় তাঁর হয়ে মাল্লাদের পাপের কথা শোনাতে আপনি কেন আসেননি তাই ভাবছিলাম।

সবাই হেসে উঠেছে। পারিবাবা খেপে গিয়ে একেবারে অন্যমূর্তি ধরে গালাগাল। দিয়েছেন, তুই! তুই পাষণ্ড! জার্মানির সেই শয়তানের দূত নাস্তিকটার চেলা নিশ্চয়। চিরকাল নরকে পচে মরবি!

জার্মানির শয়তানের দূত মানে অবশ্য মার্টিন লুথার। তাঁর ধর্মের স্বাধীনতার আন্দোলনকে যে কোনও ছুতোয় শাপান্ত করে না, দক্ষিণ ইউরোপে তখন এমন ক্যাথলিক নেই।

পাইলট সানসেদো নিজে এসে না থামালে পারিবাবাকে ঠাণ্ডা করা সেদিন শক্ত হত।

সানসেদোও কিন্তু দু-জনকে অত চড়া বাজি ধরে না খেলতে বলেছেন। নাবিক সৈনিকদের জুয়া খেলতে মানা করা মিথ্যে, তিনি জানেন। জীবন নিয়েই যারা জুয়া খেলছে তারা দুটো পয়সা লোকসানের কী পরোয়া করে!

তবে খুব বেশি চড়া দানের জুয়ায় বেশির ভাগ কিছু-না-কিছু কাজিয়া কেলেঙ্কারি হয়ই। সে-কেলেঙ্কারি রক্তারক্তি পর্যন্ত গড়ায়। তাঁর নিজের জাহাজে সেটা তিনি চান না। বিশেষত কর্টেজ যাকে খাতির করে পৌঁছে দেবার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছেন তার প্রতি সানসেদোর একটা দায়িত্ব আছে।

ঘনরামকেই তাই তিনি অনুরোধ করেছেন বাজিটা একটু নামিয়ে ধরতে।

ঘনরাম হেসে বলেছেন, কত নামিয়ে ধরব বলুন! দশ থেকে পাঁচ? ভাগ্য যদি বেঁকে দাঁড়ায় তাহলে কাটা যে পড়বার সে এক কোপের জায়গায় দু কোপে পড়বে। এই তো! তাতে লাভ কিছু হবে কি? না, কাপিন, ছুড়ে দেওয়া দস্তানা আমি তুলে নিয়েছি। এ-জেদের লড়াইয়ে আমি মাথা নোয়াতে রাজি নই।

আমিও নই! গরম হয়ে বলেছে সোরাবিয়া।

দশ সোনার পেসো ফি দানে বাজি ধরেই খেলা শুরু হয়েছে। এমন খেলা দেখবার সুযোগ কালেভদ্রে হয়। মাঝি-মাল্লারা নিজেদের খেলা ফেলে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। পাদরিবাবা পর্যন্ত চলে যেতে পারেননি জায়গা ছেড়ে। কাপিন সানসেদো অপ্রসন্ন মুখে দু-জনের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থেকেছেন বেশ একটু উদ্বেগ নিয়ে।

সমস্ত মন খেলায় নিবদ্ধ করে রাখলেও এমন কিছুর আভাস ঘনরাম একসময় হঠাৎ পেয়েছেন যা সত্যিই তিনি ভাবতে পারেননি।

তাঁদের চারধারের ভিড় এক দিকে একবার একটু যেন ফাঁক হয়ে গেছে। মসৃণ রেশমি কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে মৃদু ঘর্ষণ লাগার একটা ফিসফিস শব্দ শোনা গেছে। সেই সঙ্গে একটা সুবাসের ঝলক।

সব আদব-কায়দা ভেঙে কে যে একবার উঁকি দিয়ে গেছে অনায়াসে বুঝলেও ঘনরাম মুখ তোলেননি।

তখন তিনি হারতে হারতে তাঁর পুঁজির প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছেন। কিন্তু তাঁর মুখ দেখে শুধু চোয়ালের একটু কাঠিন্য ছাড়া আর কিছু ভাবান্তর বোঝবার নেই।

ওদিকে সোরাবিয়া চোখ মুখ তখন সাফল্যের উল্লাসে জ্বলছে! উদ্ধত দম্ভে সে যেন ফেটেই পড়বে। অবজ্ঞাভরে তাস বাঁটতে বাঁটতে সে বলেছে, আর ক-দান খেলতে চান আমাদের ভালিয়েন্তে কাবালিয়েরো।

ভালিয়েন্তে কাবালিয়েরো অর্থাৎ সাহসী ভদ্রলোক বলে ব্যঙ্গটা এ সময়ে একেবারে বিষাক্ত হুলের মতো বিধেছে ঘনরামকে।

সাহসের তাঁর অভাব নেই, কিন্তু ভদ্রলোক থাকা আর খানিক বাদে কঠিন হয়ে পড়বে তাঁর পক্ষে বুঝতে পারছেন।

কাবালিয়েরো অর্থাৎ ভদ্রলোকের মান-মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে, যদি জুয়ার। দেনা সে শোধ না করে। মনে মনে হিসেব করে ঘনরাম তখন বুঝেছেন যে, আর কয়েকটা দান এমনই তাসের পড়তা পড়লে জমে-ওঠা-দেনা তাঁর পক্ষে শোধ করা সম্ভব হবে না।

কেন যে ভাগ্য তাঁর এত বিপক্ষে তিনি বুঝতে পারছেন না। সোরাবিয়া ভালো খেলোয়াড় এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু খেলার দোষে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন হার হচ্ছে বলা ঠিক হবে না। আগাগোড়াই খারাপ তাস পাচ্ছেন বলেও নয়। কারণ তাস তিনি মাঝে মাঝে বেশ ভালই পাচ্ছেন। ভাল করে লক্ষ করে তিনি দেখেছেন সোরাবিয়ার তাস দেওয়ার সময়ই তাঁর হাত যে খারাপ পড়ছে এমন নয়। সুতরাং সোরাবিয়ার হাতের কারসাজি বলে সন্দেহ করবার কোনও কারণই তিনি পাননি। তাস ভাল-মন্দ দু-জনের। হাতেই আসছে। শুধু সোরাবিয়া ভাল তাসের বেলা তার লাভ ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা নিংড়ে আদায় করে খারাপ তাসের বেলা কেমন যেন পিছলে আগে থাকতে পালিয়ে যাচ্ছে।

এ কি শুধু তার ভাগ্য না তার সঙ্গে ফ্রানসিসকান পারিবাবার অভিশাপও কাঁধ লাগিয়েছে।

ঘনরামের হারে প্রায় সোরাবিয়ার সমান খুশি যদি কেউ হয়ে থাকেন তাহলে তিনি পাদরিবাবা। খেলা শুরুর আগেই তিনি ঘনরামের দিকে প্রায় ভস্ম করা-দৃষ্টি ফেলছিলেন। ঘনরামের গো-হারান-হার ক্রমশই বাড়বার পর সে দৃষ্টিতে ব্যাভেরিয়ার পাষণ্ড নাস্তিকের চেলার উপযুক্ত শাস্তিতে ধর্মের জয়ের উল্লাস ফুটে উঠেছে।

অন্য দর্শকেরা কিন্তু তখন স্তব্ধ হয়ে গেছে। কাপিন সানসেদো সত্যিই শঙ্কিত হয়ে ঘনরামকে এবার খেলায় ক্ষান্ত হতে অনুরোধ করেছেন।

ঠিকই বলেছেন, কাপিন! ঘনরাম স্বীকার করেছেন, লাভ থাকতে থাকতে সেনর সোরাবিয়াকে এবার উঠে পড়ার সুযোগই দেওয়া উচিত।

নিজের বিদ্রূপের উপযুক্ত জবাবের বিচুটির জ্বালায় চিড়বিড়িয়ে উঠেছে সোরাবিয়া। তার পক্ষে সৌজন্যের আবরণ বজায় রাখাই শক্ত হয়েছে।

দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সে বলেছে, আমায় সুযোগ দেবার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। আপনার কতখানি দৌড় তাই দেখিয়ে যান।

তাহলে একটা প্রস্তাব করি, সেনর সোরাবিয়া। একটু যেন কৌতুক মুখে ফুটিয়েই ঘনরাম হঠাৎ নিজের হাতের আংটিটা টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে বলেছেন, হারজিতের হিসেব যা লেখা হচ্ছে তা তো খেলার শেষে শোধ হবেই, কিন্তু শুধু ওই লেখালেখির বদলে একবার চাক্ষুষ হারজিতের খেলা হোক। আমার এই আংটি রইল বাজি আপনার হাতের ওই আংটির বিরুদ্ধে। তিন দান খেলায় দু-দান যে জিতবে দুটো আংটিই তার।

না, আংটির খেলা খেলতে আমি বসিনি! গজরে উঠেছে সোরাবিয়া, যা ঠিক। হয়েছে আমি সেই দশ পেসোর খেলাই খেলব।

ও, দশ পেসোর চেয়ে আংটি খোয়াবার ভয় আপনার তাহলে বেশি, সেনর সোরাবিয়া? মিছরির ছুরির মতো গলায় বলেছেন ঘনরাম, আপনারটার কথা জানি না, কিন্তু আমার আংটিটার দাম দশ পেসো-দে-অরো-র অন্তত পাঁচ গুণ। কাপিন সানসেদো কি আপনার বন্ধু সেনর সালাজারকেই পরীক্ষা করতে বলতে পারেন।

সানসেদো ঘনরামের মুখের কথা খসতে না খসতেই আংটিটা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ভাল করে পরীক্ষা করে তিনি সালাজারের হাতে তা দিয়ে বলেছেন, আপনিও দেখুন, সেনর সালাজার। এ আংটির শুধু পান্নাটারই দাম অন্তত পঞ্চাশ পেসো।

সালাজার কাপিন সানসেদোর কথায় সম্পূর্ণ সায় দিয়েছে। সায় দেওয়াটা আশ্চর্য কিছু নয়। আংটিটা আজেবাজে সস্তা কিছু নয়, সত্যিই দামি। মেক্সিকো থেকে আসবার সময় ঘনরামকে এই আংটিটই উপহার দিয়েছিল ডোনা মারিনা। বলেছিল, তোমাকে নিজের ভাই-এর মতোই দেখেছি, গানাদো। বোনের এই উপহারটুকু তোমায় নিয়ে যেতেই হবে।

সাত সমুদ্র পারের এই পাতানো বোনের স্নেহের পরিচয়ে সত্যিই সেদিন চোখে জল এসেছিল ঘনরামের।

আজ তারই দেওয়া আংটি বাজি ধরার সময় মনটা বিদ্রোহ করে উঠেছিল একবার। কিন্তু তারপর নিজেকে বুঝিয়েছিল—এ ছাড়া উপায় নেই বলে।

এদিকে সানসেদো শুধু নয়, সমস্ত নাবিকরা পর্যন্ত ঘনরামের পক্ষ নিয়ে তখন। আংটির বাজি সোরাবিয়াকে দিয়ে না ধরিয়ে ছাড়বে না।

কাপিন তো রেগে উঠেই বলেছেন, কী রকম জুয়াড়ি আপনি! জুয়ায় তালঠোকার জবাব দেওয়াই তো কাবালিয়েরো-র লক্ষণ বলে জানি। বিশেষ দাস যখন আপনাকে সে জবাব দিয়েছে।

আর নারাজ হওয়া সোরাবিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি। রাগে ফুলতে ফুলতে সে বাঁ-হাতের অনামিকা থেকে আংটিটা খুলে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে।

এ আংটিটাও একেবারে ফেলনা না হলেও ঘনরামের আংটির চেয়ে যে অনেক। নিরেস তা পাশাপাশি দুটো আংটির চেহারা দেখেই নেহাত গোলা লোকের কাছেও ধরা পড়বে। সোরাবিয়ার আংটির পাথরটা একটু যা বড়, কিন্তু ঘনরামের আসল পান্নার কাছে তা সস্তা কাঁচের শামিল।

এত হারের পর এ দামি জিনিসটা তার চেয়ে খেলো আংটির বিরুদ্ধে বাজি রাখাটা ঘনরামের আহাম্মুকি বলেই মনে হচ্ছিল কাপিন সানসেদোর। কিন্তু জুয়াড়িদের মতিগতিই আলাদা। দুই-এ দুই-এ চারের হিসেব মানলে তারা ক-টা খুঁটির চাল কি তাসের পড়তার ওপর তাদের সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিতে তৈরি থাকবে কেন?

খেলা এতক্ষণ যথেষ্ট জমেছিল। কিন্তু এইবার যারা দেখছে তাদেরও যেন নিশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছে।

তাসের এ প্রিমিয়েরো খেলা পোর্তুগালের আমদানি। অজানা মহাদেশ আবিষ্কারের পর যারা সেখানে যশ আর ঐশ্বর্যের ললাভে প্রাণ তুচ্ছ করে যায় তাদের মধ্যে এ খেলার চল তখন দিন দিন বাড়ছে। য়ুকাটানের জঙ্গলে জান দিতে দিতে বেঁচে এসে সেখানকার সমস্ত রোজগার আর লুঠ এক রাত্রের প্রিমিয়েরোতে উড়িয়ে দিয়েছে এমন জুয়াড়ি কাবালিয়েরোর তখন অভাব নেই।

মোক্ষম সময়ে তাসের ভেতর দিয়ে ভাগ্য কী মুখ দেখাবে, তার ওপরই এ খেলার হার জিৎ।

প্রথম খেলা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে হয়েছে সবাইকে। এক একটি তাসের টানে ভাগ্য একবার যেন ঘনরাম একবার সোরাবিয়ার দিকে হেলেছে।

শেষপর্যন্ত জয় হয়েছে সোরাবিয়ার।

তারপর দ্বিতীয় খেলা। এ খেলায় হারলেই ডোনা মারিনার উপহারের চরম অপমান তো বটেই, শেষ কড়ি দিয়ে জুয়ার দেনা শোধ করে একেবারে ফতুর হতে হবে, ঘনরাম তা বুঝেছেন।

তবু বুকে যেন তাঁর এখন নতুন সাহস আর বিশ্বাসের জোর। ভাগ্য চরম বেইমানি করলে তিনি হারবেন না এ যেন তিনি জানেন।

সত্যিই দ্বিতীয় খেলায় ঘনরামের জিৎ হয়েছে। জিৎ হয়েছে সোরাবিয়ার খেলার ভুলে এইটেই আশ্চর্য ব্যাপার। এতক্ষণের দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের ভিত হঠাৎ তার নড়ে গিয়েছে। দোনামোনা হয়ে চালের ভুল করেছে সে। তাস টেনে আগের মতো নির্ভুল আন্দাজে তার দান বুঝে উলটে রাখবার সাহস তার হয়নি। পাকা তাসের হাত কাঁচা করে দিয়েছে নিজেই বেশি তাস টেনে।

সোরাবিয়ার হঠাৎ এই পরিবর্তনে অবাক হলেও দর্শকরা যেন তার পরাজয়ে খুশি বলে মনে হয়েছে।

সেটা হয়তো পরাজিতের প্রতি সাধারণের স্বাভাবিক সহানুভূতি, হয়তো সোরাবিয়ার দম্ভ আর আস্ফালনের বিরুদ্ধে আক্রোশ।

এবার তৃতীয় খেলা।

সোরাবিয়ার চোখ দুটো যেন ছুরির ফলা হয়ে ঘনরামকে বিদ্ধ করতে চায়।

ঘনরামের মুখে কিন্তু এবার একটু বিদ্রূপের হাসি।

আপনার আংটিটা খুব পয়া—তাই না, সেনর সোরাবিয়া? সরলতার ভান করে জিজ্ঞাসা করেছেন ঘনরাম।

সোরাবিয়া জবাব না দিয়ে চোখের দৃষ্টিতে ছুরি চালিয়ে তাস টেনেছে।

তাস টেনেছেন ঘনরামও।

দু-জনের তাস উপুড় করে রাখা।

আর তাস টানবেন নাকি, সেনর? বিদ্রূপের সুর ছুঁইয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন ঘনরাম।

সোরাবিয়ার মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে তখন। কপালের ওপর একটা শিরা স্পষ্টই দপদপ করে কাঁপছে। একবার ঘনরামের সামনে উপুড় করে রাখা তাসটার দিকে, একবার তাঁর মুখের দিকে চেয়ে কী যেন বোঝবার চেষ্টা করে কিছুতেই সে মনঃস্থির করতে পারেনি।

কী, সেনর সোরাবিয়া? বিঁধিয়ে বলেছেন ঘনরাম, হঠাৎ যেন বড় বেশি সাবধানী হয়ে পড়লেন! আগে তো চটপট দান চুকিয়ে ফেলছিলেন!

নাবিকরাও কেউ কেউ একথায় হেসে উঠেছে। সেই সঙ্গে তরল জলতরঙ্গের মতো একটা মৃদু হাসির ঝংকার শোনা গেছে।

এবার ঘনরাম মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেছেন। হ্যাঁ, আর কারও নয় হাসিটা, সেনোরা। আনারই। এ উত্তেজনার টান কাটাতে না পেরে ডেকে বেড়াবার ছলেই বৃদ্ধা ঝিকে নিয়ে তাদের আসরের পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সে সংবরণ করতে পারেনি।

সারাবিয়ার কানেও সে ঝংকার গেছে, তবে মধু নয়, তরল বিষের মতো। সেনোরা আনার চকিত দৃষ্টির মুগ্ধতাটুকু কার দিকে যে ফেরানো ওই অবস্থাতেই তার চেয়ে বেশি কেউ বোধহয় লক্ষ করেনি।

কিন্তু আর দ্বিধাভরে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলে না। মনঃস্থির এবার করতেই হয়। যা টেনেছে তারই ওপর ভরসা করে শক্ত হয়ে থাকতে সাহস করেনি সোরাবিয়া। প্রায় কম্পিত হাতে আর একটা তাস টেনেছে।

চেয়ে দেখেছে ঘনরামের দিকে তার মতলব বোঝবার জন্যে।

ঘনরামের মুখ কিন্তু এখন মুখোশ, গাম্ভীর্যের নয়, বিদ্রূপের বাঁকা কৌতুকের। সে মুখোশের তলায় ঘনরামের মনের খবর একেবারে লুকোনো।

কী করবেন এবার? কাপিন সানসেদো জিজ্ঞাসা করেছে ঘনরামকে।

কিছুই করব না! সেই মুখোশের মতো মুখেই বলেছেন ঘনরাম, যদি চান তো আমাদের ভালিয়েন্তে কাবালিয়েরো তাঁর প্রাপ্য শেষ তাসটাও টানতে পারেন।

তাই টেনেছে সোরাবিয়া দাঁতে দাঁত চেপে। আর দু-জনের তাস চিত করবার পর দেখা গেছে তাতেই সর্বনাশ হয়ে গেছে।

ঘনরামের একটিমাত্র টানা তাস বেশ বড়ই ছিল, কিন্তু সোরাবিয়ার প্রথম দুটো তাস মিলে তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল দামে। তিনবারের বার টানা তাসটি টেনেই সোরাবিয়া সে ভাল হাতটা পচিয়ে দিয়েছে।

নাবিকেরা চিৎকার করে উঠেছে আনন্দে। কাপিন পর্যন্ত নিজের আনন্দটা গোপন করতে পারেননি। শুধু পারিবাবাকে পেছন থেকে বেশ একটু জোরে জোরে পা ফেলে চলে যেতে দেখা গেছে। তিনি এতক্ষণ এই পাপের সংস্পর্শে ছিলেন এইটেই আশ্চর্য।

উপুড় করা তাস চিত করে ফেলার পর সোরাবিয়া কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো একদৃষ্টে সেগুলোর দিকে চেয়ে ছিল। নাবিকরা তখন কে কী উল্লাস প্রকাশ করেছে তা লক্ষ করবার হুঁশই তার ছিল না।

তারপর ঘনরামকে আংটি দুটো নিজের দিকে টেনে আনতে দেখে গায়ের সমস্ত হিংস্র জ্বালাটা তাসগুলোর ওপরই ফলিয়ে সেগুলো টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে সে উঠে পড়তে গেছে।

ও কী! উঠছেন কী, সেনর সোরাবিয়া! কাপিন সানসেদো তাকে বাধা দিয়ে বলেছেন, খেলা কি এখনই শেষ নাকি?

উনি বোধহয় আর আমার দৌড় দেখতে চান না! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো চিপটেন কেটেছেন ঘনরাম।

সোরাবিয়াকে মুখোনা কালো করে আবার খেলতে বসতে হয়েছে। নজর তাঁর তখন নিজের আংটিটার দিকেই। ঘনরাম নিজের আংটির সঙ্গে সেটা কাছের দিকে টেনে আনলেও কোনওটাই কিন্তু আঙুলে আর পরেননি।

একটু বেশ অদ্ভুতভাবেই সোরাবিয়ার দিকে চেয়ে থেকে বলেছেন, আপনার আংটির পয়টা না নিয়েই ভাগ্যের চাকা ঘঘারে কিনা দেখা যাক।

তা ভাগ্যের চাকা ধীরে ধীরে সত্যিই ঘুরে গেছে। কাগজে লেখা সোরাবিয়ার লাভের হিসেব নামতে নামতে সত্যিই শূন্যে গিয়ে ঠেকবার পর হঠাৎ ঘনরামই তাসটা ঠেলে দিয়ে বলেছেন, যাক, আমাদের পাওনা দেনা কারও কাছেই কারও কিছু আর নেই। এইখানেই সুতরাং দাঁড়ি টানা যাক। শুধু আপনার এই আংটিটা–

ঘনরাম সোরাবিয়ার আংটিটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে যা বলতে যাচ্ছিলেন তা তক্ষুনি আর বলতে পারেননি। কাপিন সানসেদো আগেকার খেলা এইভাবে মোড় ঘুরে যাওয়ার পর থেকেই ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবছিলেন। ঘনরাম আংটিটা তুলতেই সেদিকে ব্যস্তভাবে হাত বাড়িয়ে সন্দিগ্ধ স্বরে বলেছেন, দেখি একবার আংটিটা!

ঘনরাম কিন্তু আংটিটা সানসেদোকে দেননি। হাতটা সরিয়ে নিয়ে হেসে বলেছেন,

কাপিন, এ আংটির জাদু আর পয় বড় বেশি। আপনার মতো লোককেও জুয়ায় টানতে পারে। তার চেয়ে এটিকে সবার নাগালের বাইরে রাখাই ভাল।

ঘনরাম তারপর যা করেছেন সকলে তাতে তাজ্জব! হাঁ হাঁ করে ওঠা সত্ত্বেও ঘনরাম ডেক-এর ওপর থেকে ছুঁড়ে আংটিটা সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে উঠে চলে গেছেন আর একটি কথাও না বলে।

সোরাবিয়ার মাথা তখন নিজের অজান্তেই বুঝি একটু নিচু হয়ে গেছল। দৃষ্টিটাও কেমন বিমূঢ়। কাপিন সানসেদো আর সেনর সালাজার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেছেন।

নাবিকেরা এ রেষারেষির জুয়া যে যার নিজের মতো বুঝে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করতে করতে চলে যাবার পর নিজে উঠে পড়ে কাপিন শুধু বলেছেন, কাবালিয়েরো কাকে বলে আজ দেখবার সৌভাগ্য হল! কী বলেন, সেনর সোরাবিয়া?

সোরাবিয়া কোনও জবাব দেয়নি।

আশা করি আজকের কথা কেউ আমরা ভুলব না, বলে কাপিতান সেনর। সালাজারের সঙ্গে চলে গেছেন।