রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

০৩. পানু ও সুনীল

পানু ও সুনীল

কিরীটী তখনো বুঝতে পারেনি-করালীচরণের মৃত্যুটা একটা সামান্য দুর্ঘটনা নয়। তার পশ্চাতে একটা কার্যকরণ ছিল।

কিন্তু তার আগে পানু ও সুনীলের ব্যাপারটা জানা দরকার।

 

পানু আর সুনীল—

রিটায়ার্ড জজ পরমেশবাবুর মেয়ে বিধবা রমার দুটি ছেলে।

পানুর চাইতে সুনীল বছর চারেকের বড় বয়সে।

পানু শান্ত, ধীর।

সুনীল অশান্ত, অধীর।

সুনীলের বয়স, ষোল থেকে আঠারোর মধ্যে হবে। ম্যাট্রিক পাশ করে সে বর্তমানে শ্ৰীরামপুর কলেজেই আই-এ পড়ছে সেকেণ্ড ইয়ারে। অস্থির, চঞ্চল সুনীল একটি মুহূর্তের জন্যও বাড়ি থাকে না। একটা সাইকেল আছে। সেটায় চড়ে দিবারাত্ৰ টো টো করে কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় তা সেই জানে।

আর পানুর বয়স বছর পনের-কিশোর বালক।

সুনীলের গায়ের রঙ ফর্সা-টকটকে একেবারে গোলাপের মত, আর পানু কালো।

কিন্তু সেই কালোর মধ্যেও যেন অপরূপ একটা শ্ৰী আছে।

অপূর্ব একটা লালিত্য-লাবণ্য।

রোগা লিকলিকে চেহারা সুনীলের। হাওয়ায় হেলে পড়ে। একমাথা রুক্ষ এলোমেলো চুল। সাতজন্ম তেলের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। কত রকমের উদ্ভট খেয়ালই যে শ্ৰীমান সুনীলচন্দ্রের ছোট মাথাটার মধ্যে ঘূর্ণির পাকের মত পাক খেয়ে খেয়ে ফেরে তা সেই জানে।

পানু-স্কুল ছাড়া সৰ্বক্ষণ প্ৰায় বাড়িতেই থাকে। নিজের বই-খাতা-পত্ৰ পড়াশুনা নিয়ে ডুবে থাকে।

আর সুনীল—

প্রায়ই সে তার সাইকেল চেপে দুচার দিনের মত কোথায় যে ডুব দেয়। আবার হয়ত হুট করে একদিন ধুলি ধূসরিত দেহে হাঁপাতে হাঁপাতে আসে ফিরে বাড়িতে।

রমা দুরন্ত খেয়ালী ছেলেটিকে নিয়ে সদাই অস্থির।

মা হয়ত জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় ছিলি সুনু এ দুদিন।

ঘুরে এলাম মা মণি, ঘুরে এলাম সাইকেলে আসানসোল, ধানবাদ, upto কাত্ৰাসগড়।

কী যে তোর খেয়াল সুনু? মা বলেন, একটা আপদ বিপদ না ঘটিয়ে আর তুই ছাড়াবিনে দেখছি। দেখত পানু কত স্থির, কত ধীর।

আর কি রক্ষা আছে? আমনি হাত পা নেড়ে সুনীল বক্তৃতা শুরু করে দিল। জান মা, আমাদের বিশ্বকবি কি বলেছেন?

“দেশ দেশান্তর মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দা’ও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে,
বেঁধে বেঁধে রাখিওনা ভাল ছেলে করে।

শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধীরে
দাও সবে গৃহ ছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে।
সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করেনি।”

বুঝলে? ওগো আমার জননী, বুঝলে কিছু।

মা মুখটাকে গম্ভীর করে বললেন, জানিনে বাপু তোদের বিশ্বকবি টবি। যেমন হয়েছে ছেলেগুলো, তেমনি হয়েছে সব কবিতা। যা ইচ্ছা করগে যা।

সুনীল হাঃ হাঃ করে মার কথায় হেসে ওঠে। তারপর একসময় মার দিকে আব্দারের সুরে বলে, কিন্তু খিদে যে বড্ড পেয়েছে মাশীগগিরী কিছু খেতে দাও।

মা আবার খাবার আনতে গেলেন।

সুনীল ঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে গুণ গুণ করে গান গাইতে থাকে।

“কোন পাস্থ এ চঞ্চলতা?
কোন শূন্য হতে এলো কার বারতা।”

শান্ত পানু হয়ত তখন তার নিজের ঘরে বসে বইয়ের মধ্যে ডুবে আছে।

এবারে ও প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবে।
খুব ভাল ছেলে পানু লেখায় পড়ায়।
মাস্টারদের অনেক আশা ওর উপর।
সুনীল এসে পানুর ঘরের মধ্যেই যেন একটা দমকা হাওয়ার মতো ঢুকে পড়ে। তারপর পানুর মাথাটা ধরে একটা বঁকি দিয়ে বলে ওঠে, দেখা পানু, তুই একটা প্ৰকাণ্ড ফুলস্টপ। একটা দাঁড়ি, একটা পরিপূর্ণ পূর্ণচ্ছেদ। এই অনন্ত জীবন-দিকে দিকে যার হাতছানি-এ তোকে বিচলিত করেনা? মাথার উপর সীমাহীন ঐ সুনীল আকাশ-অসীম থেকে ভেসে ভেসে আসে পাখীর কলগীতি। এ-সবের কোন মূল্য তোর কাছে নেই? কি রে তুই—

পানু সুনীলকে অত্যন্ত ভালবাসে, ওর মুখের দিকে চেয়ে মিটমিটি হাসে।

সুনীল বলে চলে, অদেখা সমুদ্রের ডাক তোর কানে পৌঁছায় না? সীমাহীন মরু তোর প্রাণে স্বপ্ন জাগায় না? তুই একটা মানুষ!

পানু দাদার কথায় হাসে-বলে, তবে কি দাদা?

তুই, তুই মার একটা ছোট্ট খোকন মণি সোনা। তোমায় কে মেরেছে ঠোনা। আদর করে চুমো দেবো, গড়িয়ে দেবো দানা।

মা এসে ঘরে ঢোকেন। সুনু আবার পানুর মাথা খাচ্ছিস। নিজের তো খেয়ালের অন্ত নেই, আবার ওকে নাচাস কেন?

ভয় নেই মা। তোমার ও money bagটি লুট করব না। বলতে বলতে স্যাণ্ডেল ফটু ফটু করতে করতে সুনীল দরজার বাইরে পা বাড়ায়।

আবার এই অবেলায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? মা বলেন। খাবার আনতে বললি–

এখন নয়। মা-এখন নয়, একটু ঘুরে আসছি—বলতে বলতে সুনীল অদৃশ্য হয়।

কাল থেকে কলেজে গ্ৰীষ্মের ছুটি শুরু।

সকালবেলা উঠে চেয়ারে বসে টাইমটেবিলটা খুলে সুনীল আপন মনে পাতা উল্টে চলেছে, এই লম্বা ছুটিটায় কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে? কতদূর পর্যন্ত? পেশোয়ার গেলে মন্দ হত না। তবে একটু বেশী দূর এই যা।

একপাশে বসে পানু কী একটা বই পড়ছে।

জলখাবারের প্লেট হাতে মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

সকল বেলাতেই টাইম টেবল নিয়ে বসেছিল কেন?

সুনীল গভীর কণ্ঠে জবাব দিল—

জননীগো, অনেক চিন্তার পর এই স্থির করি,
সুদুর পেশোয়ার ব্যারেক আসব ঘুরি।

রমা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল, না, না-ওসব মতলব ছাড়-সামনের বছর না। তোর পরীক্ষা–

জানি-পরীক্ষা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে কিন্তু জীবনের এই মুহূর্তগুলো একবার গেলে আর আসবে না। বাধা দিও না জননী–প্ৰসন্ন মনে বলো, যাও-পুত্র-পেশোয়ায়-যাও।

রামা বলেন, না—

সুনীল বলে, হ্যাঁ—

পানু মৃদু মৃদু হাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *