০৩. পনের বছর আগেকার ঘটনা

পনের বছর আগেকার ঘটনা। ছোটখাট অনেক ঘটনাই মনে নেই, ভুলে গেছি। তবে মনে আছে দেবব্রত চৌধুরী তিন-চারদিন আমার হোটেলে এসেছে, গল্প করেছে, খেয়েছে। একদিন কথায় কথায় বললো, আপনার সঙ্গে আগে আলাপ হলে আমি নিশ্চয়ই জার্নালিস্ট হতাম।

আমি হাসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

কেন নয় বলুন? চাকরি করলেও দাসত্বের শৃঙ্খল নেই, তাছাড়া কি দারুণ একসাইটিং অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং কাজ বলুন তো?

আমি কোনো জবাব দিলাম না। একটু চাপা হাসি হাসতে হাসতে হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিলাম। ও কিছু শুনতে চাইছিল। আমার নীরবতা বোধহয় ভালো লাগছিল না। কি হলো? কিছু বলছেন না শুধু হাসছে?

এবারে আমি জবাব দিলাম, আমি যদি ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীর ভাই হতাম তাহলে আমি নিশ্চয়ই ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তাম,আবার একটু হুইস্কি গলায় ঢেলে বললাম, আদার্স লন ইজ

অলওয়েজ গ্রীনার, তাই না?

দেবব্রত বললো, যাই বলুন জার্নালিস্টদের রেসপেক্টই আলাদা। তাছাড়া দারুণ গ্লামারস প্রফেশন।

এককালে সত্যি সাংবাদিকদের সম্মান ছিল কিন্তু এখন নেই।

কেন?

থাক। এসব আলোচনা না করাই ভালো।

দেবব্রত আর তর্ক করেনি। ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তে অবশ্য আমার ভালোই লাগছে। ভারি ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট।

.

আমি সাংবাদিক। সংবাদপত্রের পরিভাষায় স্পেশাল করসপনডেন্ট। বিশেষ সংবাদদাতা। প্রাইম মিনিস্টার মিনিস্টার এম পি-দের নিয়েই আমার কারবার। পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে আড্ডা দিই। চা কফি সিগারেট। পরনিন্দা-পরচর্চা। নোট বই-পেন্সিল-টাইপ রাইটার। টেলিফোন, ট্রাংকল। টেলিপ্রিন্টার-টেলেক্স। দিনটা এইভাবেই কাটে। সন্ধ্যার পর কালো স্যুট টাই। হায়দ্রাবাদ হাউস অথবা অশোকা হোটেল। অথবা ডিপ্লোম্যাটিক পার্টি। রিসেপসন। স্কচ। ওয়াইন। অথবা ভডকা। তবুকান সতর্ক থাকে। নতুন গোপন কোনো খবর পেলেই পাঠিয়ে দেব অফিসে। ছাপা হবে পরের দিন সকালের কাগজে।

এই ত আমার, আমাদের দিল্লির জীবন। কখনও কখনও বাইরে যেতে হয়। দূরে, কাছে। বাসে ট্রেনে মোটরে প্লেনে। কখনও পাড়ি দিতে হয় বিদেশ। ছায়ার মতো অনুসরণ করতে হয় ভি আই পিদের। কত কি দেখি, শুনি, জানতে পারি কিন্তু রাজনৈতিক দুনিয়ার বাইরের কোনো কিছু জানি না বললেই চলে। বিভিন্ন রাজ্যের ডজন ডজন মন্ত্রী বা নেতাদের নাম আমাদের মুখস্থ কিন্তু কলকাতা দিলি বোম্বে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ভাইস-চ্যান্সেলারের নাম জানেন, এমন সাংবাদিক ভারতবর্ষে নেই বললেই চলে। তবু কিছু কিছু সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিকের খবর আমাদের রাখতে হয়। নানা কারণে, নানা উপলক্ষ্যে এদের জানতে হয়, চিনতে হয়। তিন মূর্তি ভবনে বা সাউথ ব্লকের অফিসে প্রাইম মিনিস্টার মাঝে মাঝেই দুচারজন বৈজ্ঞানিক বা অর্থনীতিবিদ বা ওই ধরনের কিছু জ্ঞানী-গুণীকে আমন্ত্রণ জানান। আলোচনা করেন, পরামর্শ করেন। প্রাইম মিনিস্টারের ঘর থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এদের ঘিরে ধরি, প্রশ্ন করি। এক্সকিউজ মী স্যার, কাশ্মীর ক্রাইসিসের জন্য কি ফাইভ ইয়ার প্ল্যানের কিছু মেজর চেঞ্জ হচ্ছে?

লাইব্রেরিয়ান ফ্রেমের মোটা চশমাটা ঠিক করতে করতে প্রফেসর প্রসাদ বললেন, ডোন্ট থিংক সো তবে বর্ডার এরিয়া কিছু স্পেশ্যাল ট্রিটমেন্ট পাবে বলে মনে হয়।

আমাদের দেশের যা অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে এগ্রিকালচার, হেভী ইন্ডাস্ট্রি ও ডিফেন্স–এই তিনটি ক্ষেত্রেই কি সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব?

ডাঃ দত্ত বললেন, কোনোটাকে নেগলেক্ট করতে চান? কোনোটাকেই নেগলেক্ট করা যাবে না এবং হবে না।

পরের দিন সকালে সব খবরের কাগজে সে সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়। এই রকম একটা মিটিং-এর পরই ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি।

আমার বেশ মনে আছে সেদিনের কথা। আমন্ত্রিত সব বৈজ্ঞানিকই স্যুট পরে এসেছিলেন। ডক্টর চৌধুরী এসেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। দেখে ভারি ভালো লেগেছিল। তাছাড়া চেহারাটি মনে রাখার মতো। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সাহিত্য বা দর্শনের অধ্যাপক। মনেই হয় না ইনি ল্যাবরেটরিতে বসে সূর্যরশ্মি নিয়ে গবেষণা করে যশস্বী হয়েছেন।

.

দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, দাদার সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?

না, আলাপ নেই। তবে দেখেছি, দু-একবার সামান্য দুচারটে কথাও বলেছি।

এবার দিল্লি ফিরে দাদার সঙ্গে দেখা করবেন।

নিশ্চয়ই দেখা করব।

দাদা খুব খুশী হবেন। দেবব্রত একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অমন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে আপনারও ভালো লাগবে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কিন্তু ওর সঙ্গে তো আমি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না।

কেন?

অত বড় পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে কি বেশিক্ষণ কথা বলা যায়?

দেবব্রত হাসল, এখন কিছু বলব না, আলাপ করে আমাকে চিঠি দেবেন।

তিন সপ্তাহ পরে দিল্লি ফিরেই টেলিফোন করলাম। পেলাম না, পুণা গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পরে আবার টেলিফোন করতেই ডক্টর চৌধুরী নিজে টেলিফোন ধরলেন। পরিচয় দিতেই বললেন, দেবুর চিঠিতে আপনার কথা জানলাম। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ওর শরীর ভালো আছে তো?

ভালোই আছে।

আপনি কদিন ওকে খুব খাইয়েছেন।

আমি না হেসে পারলাম না, সে কথাও লিখেছে?

ডক্টর চৌধুরীও হাসলেন, ও একটু পেটুক আছে। তাছাড়া আমাকে ও সব কথাই জানায়।

আমি যেদিন ডক্টর চৌধুরীর বাড়ি প্রথম গেলাম সেদিন রবিবার। দরজার সামনে দাঁড়াতেই গান শুনতে পেলাম। শিল্পীর কণ্ঠস্বর চিনতে না পারলেও সুর শুনে বুঝলাম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড। মিনিট খানেক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বেল বাজালাম। প্রথমে চাকর, তারপর স্বয়ং ডক্টর চৌধুরী। আসুন আসুন।

ছোট্ট লবী পার হয়ে লিভিংরুমে ঢুকতে ঢুকতে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, অনেকবার বেল বাজিয়েছেন?

না, না, একবারই বাজিয়েছি।

দেন ইউ আর রিয়েলি লাকি।

কেন বলুন তো?

হঠাৎ একটু প্রাণ খুলে হাসলেন ডক্টর চৌধুরী। যখন তখন এমন গান শুনতে মেতে যাই যে কেউ বেল বাজালেও শুনতে পাই না। অবশ্য চাকরটাকে বার বার বলে রেখেছিলাম।

লিভিংরুমে ঢুকতেই অবাক হলাম, বাঃ! চমৎকার! পর পর অতগুলো কাংড়া ভ্যালী পেন্টিং দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।

ডু ইউ লাইক পেন্টিং?

কিছু বুঝি না কিন্তু দেখতে ভালো লাগে।

কাম টু মাই স্টাডি।

ডক্টর চৌধুরীকে অনুসরণ করে ওঁর পড়ার ঘরে ঢুকতেই সারা দেওয়াল ভর্তি স্কেচ দেখতে পেলাম।

আমার পোর্ট্রেটটা দেখেছেন?

বাঃ! ভারি সুন্দর!

ডু ইউ নো হু ইজ দ্য আর্টিস্ট?

আপনি নিশ্চয়ই!

না, না, আমার এত গুণ নেই…

কোনো ছাত্রের বুঝি?

না, দেবু।

মাই গড! পোর্ট্রেটটা ওর করা?

অব কোর্স। এ ঘরের সব স্কেচ আর পোর্ট্রেটই ওর করা। মুহূর্তের জন্য নিজের পোর্ট্রেটটা দেখে ডক্টর চৌধুরী একটু চাপা গলায় গর্বের সঙ্গে বললেন, দেবু রিয়েলি একটা জুয়েল।

পনের বছর আগের কথা। সব কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, ডক্টর চৌধুরীর প্রতিটি কথায় ছোট ভাই সম্পর্কে তার গভীর ভালোবাসা ও দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। ওঁর একটা কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না–দেবু ইজ এ পীস অব ড্রিম, দেবু আমার একটা স্বপ্ন, সাধনা। আমি অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে চাইতেই উনি বললেন, রিসার্চ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও আমার দুঃখ নেই। আজ না হয় কাল, কাল না পরশু কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হবেনই কিন্তু দেবুর ব্যাপারে ব্যর্থ হলে আমার সব স্বপ্ন, সাধনা…..

আমি ওঁকে কথাটা শেষ করতে দিলাম না, না না সে ভয় আপনার নেই।

.

এই পৃথিবীর অজস্র কোটি কোটি মানুষ আপন আপন কাজে নিমগ্ন। কবি কাব্য রচনা করেন, শিল্পী রূপ দেন তার মনের স্বপ্নকে, বৈজ্ঞানিক সাধনা করেন আপন গবেষণাগারে, সাহিত্যিক মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন। মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে, কলকারখানায় অসংখ্য মানুষ সংগ্রাম করছেন দিন রাত্রি কিন্তু কেন? শুধুই কি অর্থ যশ প্রতিপত্তির জন্য? দুমুঠো অন্নের জন্য? না,কখনই নয়। আপন মুক্তির জন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণ সাধনা করেননি, খ্যাতির জন্য বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ দেননি, কিছু ফিরিঙ্গি সাহেবের প্রশংসার জন্যও রাজা রামমোহন সতীদাহ প্রথা রদ করতে উদ্যোগী হননি। মার্কস বা এডিসন বা অন্য কোনো মহাপুরুষই শুধু আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেননি। কোনো মানুষই করে না। সব কর্মকাণ্ডের পিছনেই, সাধনার অন্তরালে কিছু মানুষের কল্যাণ, ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। ডক্টর চৌধুরীর কথা শুনে, দেবব্রতর প্রতি ওঁর ভালোবাসা দেখে এই কথাগুলো আবার নতুন করে আমার মনে পড়ল।

বেশিক্ষণ ছিলাম না। ঘণ্টা খানেক বা ঘণ্টা দেড়েক। একজন মানুষকে চেনার পক্ষে সময়টা কিছুই নয়। তবু বড় ভালো লেগেছিল দেবব্রতর দাদাকে। এত বড় বৈজ্ঞানিক হয়েও বড় সহজ, সরল অমায়িক ব্যবহার। বিয়ে করেননি। নিশ্চয়ই করবেন না। বিয়ে করার কোনো বয়স নেই ঠিকই কিন্তু মন তো চাই। আনন্দের জন্য, উপভোগের জন্য, সম্ভোগের জন্য ডক্টর চৌধুরীর বিয়ে করার দরকার। নেই। ল্যাবরেটরি, মিটিং, সেমিনার করে যেটুকু সময় হাতে থাকে সেটুকু সময় পরিপূর্ণভাবে উনি উপভোগ করেন। সকালবেলা বেরুবার সময় রেডিওগ্রামে কয়েকটা রেকর্ড চাপিয়ে চলে যান। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেই সুইচ টিপে দেন। ঘর ভর্তি বাংলা বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই। দিল্লিতে কারুর বাড়িতে এত বাংলা বই দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একটু অবাক হয়ে একবার বললাম, আপনার তো বাংলা বইয়ের দারুণ কালেকশন।

ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, বাড়িতে বাংলা বই আর গানের রেকর্ড না থাকলে দেবুর স্ত্রী সারাদিন কাটাবে কি ভাবে?

আমি হাসলাম।

উনিও হাসলেন। এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে বললেন, সুভাষ মুখার্জির একটা কবিতায় পড়েছিলাম–বিংশ শতাব্দীতে।

মানুষের শোকের আয়ু
বড় জোর এক বছর।

উনি চুপ করে রইলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হঠাৎ ঐ কবিতাটা মনে হলো কেন?

কথাটা নির্মম হলেও বড় সত্যি। এ যুগের কোনো শোকের আয়ুই এক বছরের বেশি নয়। আমি মরে গেলেও হয়তো দেবু বা বৌমা এক বছর পর আমাকেও ভুলে যাবে কিন্তু এই বইগুলো, এই সব পেন্টিং বা গানের রেকর্ড শুনতে শুনতে নিশ্চয়ই আমার কথা ওদের মনে পড়বে।

মুগ্ধ হয়ে, বিস্মিত হয়ে আমি ওর কথা শুনছিলাম।

বিদায় নেবার আগে ডক্টর চৌধুরী বললেন, এরপর যেদিন আসবেন সেদিন আপনাকে আমার তোলা ফিল্মের প্রজেকশন দেখাব।

আপনি বুঝি ছবিও তোলেন?

তুলবো না? জ্যেঠু বড় না হলে তো বই পড়বে না বা গান শুনবে না। তাই তো ওর জন্য ছবি তুলে রাখছি।

.

এ সব পনের বছর আগেকার কথা। কত কি ঘটে গেছে এই দীর্ঘ পরিসরে। দ্বিতীয় বার বিলেত গেলাম তখন দেবব্রতর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রিজেন্ট পার্ক লেকের ধারে বসে দুজনে গল্প করেছি, ডুরি লেন থিয়েটারে মাই ফেয়ার লেডির অভিনয় দেখেছি। আরো কত কি। দুদিনের জন্য এসেক্সের সমুদ্র সৈকত ঘুরে এলাম। ঐ দুদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত সমুদ্র পাড়ে বসে দুজনে গল্প করেছিলাম।

আমি দিল্লি ফিরে আসার কয়েক দিন পরেই দেবব্রত চিঠিতে জানলাম ভালোভাবে পাস করেছে। দুতিন সপ্তাহ পরে দিল্লি ফিরেই আমাকে টেলিফোন করেছিল কিন্তু পায়নি। আমি ছুটিতে কলকাতা গিয়েছিলাম। ছুটির শেষে দিল্লি ফিরে এলাম। মাস খানেক কেটে গেল। হঠাৎ একদিন পুরনো চিঠিপত্তর ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেবব্রতর একটা চিঠি হাতে পড়তেই ডক্টর চৌধুরীকে একবার টেলিফোন করলাম, দেবু ফিরছে কবে?

ও তো অনেক দিন হলো ফিরেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

ও কি এখানেই আছে?

ও তো চাকরি নিয়ে বাঙ্গালোরে চলে গেছে।

আমি একটু অবাক হলাম, দুঃখিত হলাম। আমার সঙ্গে একবার দেখা না করেই চলে গেল।

ডক্টর চৌধুরীও অবাক হলেন, সেকি? ও তো আপনার ওখানে কয়েক দিন গিয়েছে, দেখা হয়নি?

না। তাহলে বোধহয় আমি তখন কলকাতায় ছিলাম।

তাই হবে।

দেবব্রত হারিয়ে গেল। চিঠি লেখার অভ্যাস আমার নেই। বোধহয় ওরও তাই। তাছাড়া এমন। বিশ্রী অর্থহীন উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেটে যায় যে বহু পরিচিত, ঘনিষ্ঠ মানুষের কথাও মনে পড়ে না। হঠাৎ মাঝে মাঝে খবরের পাতায় পড়ে বা রেডিওতে ডক্টর চৌধুরীর নাম শুনলেই লন্ডনের সেই ছাত্রসভার ছেলেটির কথাও মনে পড়ে। ভাবি চিঠি লিখব কিন্তু লিখি না। পরের দিনের উত্তেজনায় সে ইচ্ছা হারিয়ে যায়। তলিয়ে যায়।

ডক্টর চৌধুরীর সঙ্গেও আর যোগাযোগ নেই। কারণ আছে। উনি আর এখন ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির অন্ধকার গবেষণাগারের মধ্যে বন্দী নন। উনি এখন ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের সদস্য ছাড়াও প্ল্যানিং কমিশনের উপদেষ্টা। প্রায় ভি আই পি। খবরের কাগজের পাতায় প্রায় নিত্যই নাম ছাপা হচ্ছে। আজ শিলং, কাল সিমলা। দুদিন পরেই হায়দ্রাবাদ। পরের দিনই মাদ্রাজ হয়ে সিঙ্গাপুর। কলম্বো প্ল্যানের কনসালটেটিভ কমিটি মিটিং। কদাচিৎ কখনও বিজ্ঞান ভবনের কমিটি রুমে বা লবীতে দেখা হয়। আমাকে উনি চিনতে পারেন। জিজ্ঞাসা করেন, ভালো আছেন? আমি ছোট্ট জবাব দিই, হ্যাঁ। ওঁর কুশল জিজ্ঞাসা করার অবকাশ আমার হয় না, তার আগেই উনি কোনো মন্ত্রী বা আই-সিএস সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যান। ডক্টর চৌধুরীর এই উন্নতির জন্য দেবব্রতর অহঙ্কার হয়েছে কিনা জানতে পারি না। কিন্তু মনে মনে আশঙ্কা হয়, ভয় হয়। মাঝে মাঝে ওকে চিঠি লেখার ইচ্ছা হলেও ঠিক উৎসাহবোধ করিনা। পিছিয়ে যাই। কাগজ কলম নিয়ে বসেও লিখতে পারি না।

দুটি বছরে আরো কত কি ঘটে গেল। আরো কত মানুষকে জানলাম, চিনলাম, ভালোবাসলাম, কত মানুষকে ভুলে গেলাম দূরে সরিয়ে রাখলাম।

.

বেশ মনে আছে তার আগের দিন পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি দীর্ঘ ভাষণ নিয়ে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মে মাসের বিশে পর্যন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা নিয়ে সাড়ে সাত শ এম পির মতামত শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সকালে ওঠার তাড়া নেই। রাধাকিষণকে বলেছি, চা নিয়ে ডাকাডাকি করিস না। অনেক বেলা অবধি ঘুমুব বলে টেলিফোনের প্লাগ খুলে রেখেছি। তাছাড়া রবিবার। নটা বেজে গেলেও আমি ঘুমুচ্ছিলাম। মোটা পর্দার ব্যুহ ভেদ করে সূর্যরশ্মি পর্যন্ত আমার শোবার ঘরে ঢুকতে পারেনি কিন্তু সুভাষ রায় এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই চিৎকার, গেট আপ জার্নালিস্ট! গেট আপ

চাদর সরিয়ে মুখ বের করতেই সুভাষদা বললেন, ভয় নেই, কোনো পাওনাদার না, আমি তোমার সুভাষদা।

সুভাষদা!

আমি ভূত দেখার মতো চমকে লাফিয়ে উঠলাম। সুভাষদা, আপনি?

এখনও কি তোমার সন্দেহ হচ্ছে?

না কিন্তু আপনি কবে এলেন? বৌদি কোথায়? রমার কি খবর? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললাম।

সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, সবাই এসেছে। তুমি চোখে মুখে জল দিয়ে এসো, তারপর সব বলছি।

আমি বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, কই ওরা কোথায়? বৌদি আর রমা কি গাড়িতে…।

ওরা এখন আমার সঙ্গে আসেনি; তবে দিল্লিতেই আছে।

ওদের নিয়ে এলেন না কেন?

বলছি তো চোখে-মুখে জল দিয়ে এসো, তারপর সব জানতে পারবে।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে রাধাকিষণকে ডেকে বললাম, পর্দা হঠাও আর চা বানাও।

তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জল দিয়ে ফিরে আসতেই সুভাষদা বললেন, কত কাণ্ড করে যে তোমার এখানে এসেছি তা ভাবতে পারবে না।

কেন, আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা জানতেন না?

সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, তোমার মতো নটোরিয়াস ব্যাচেলার কখনও বাড়ির ঠিকানা জানায়?

লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, খুব ঘুরতে হয়েছে বুঝি?

টেলিফোন এনকোয়ারি থেকে ভুল ঠিকানা জানাল। তাছাড়া দিল্লি এত বদলে গেছে যে নতুন এসে তালগোল পাকিয়ে যায়।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, দেখে-শুনে মনে হয় এরা বোধহয় দিল্লিকে প্যারিস বানাতে চায়।

গৌরী সেনের টাকায় নিত্যনতুন স্কীম হচ্ছে আর মাসে-মাসে শহরের চেহারা বদলে যাচ্ছে।

কিন্তু তার ঠেলায় তো আমাদের মতো নিউকামারদের জান বেরিয়ে যায়।

আই অ্যাম সরি। যাই হোক আর চিন্তা নেই। এবার বলুন কবে এলেন, কোথায় উঠেছেন?

রাধাকিষণ চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুভাষদা বললেন, রাগ করো না, ঠিক একমাস হলো এসেছি…।

আমি অবাক হই, একমাস?

একমাস এসেছি ঠিকই কিন্তু নতুন করে সংসার পাতার যা ঝামেলা, সে আর বলার না। তাছাড়া অফিসেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকি অথচ তোমার বৌদি তোমাকে খুঁজে বের করার জন্য পাগল করে ছাড়ছেন…

হাসলাম। তারপর?

রোজই ভাবি আমাদের কোনো পি আর ওকে তোমার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করব কিন্তু রোজই ভুলে যাই। আজ সকালে তোমার বৌদি এমন বকবক করতে শুরু করলেন যে না বেরিয়ে পারলাম না।

আমি শুকনো হাসি হেসে বললাম, আপনি যাই কৈফিয়ত দিন আমি স্যাটিসফায়েড হচ্ছি না।

সত্যি বিশ্বাস কর ভাই, এবার দিল্লিতে এসে যা হয়রানি সহ্য করেছি, তা তুমি ভাবতে পারবে না।

সে তো বুঝলাম, কিন্তু এসেই কেন আমার খোঁজ করলেন না?

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সুভাষদা বললেন, আই জাস্ট গট লস্ট ইন প্রবলেমস।

সুভাষদার স্ত্রী, মিসেস জয়তী রায়, আমার বৌদি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন। ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমেরিকা গিয়ে ওঁদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। আমাদের অ্যাম্বাসীর ডিপ্লোম্যাট অন্যান্য স্টাফ ও তাদের ফ্যামিলী মেম্বারদের ইনফরম্যাল গেট-টুগেদার এ বৌদিকে দেখেই ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ জিজ্ঞাসা করলেন, হাউ আর ইউ জয়ন্তী?

বৌদি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ডক্টর রাধাকৃষ্ণণকে প্রণাম করে বললেন, ভালো আছি স্যার।

শুধু ফ্যাশান শো অর্গানাইজ করছ না কি কিছু লেখাপড়াও করছ?

সামান্য কিছু লেখাপড়াও করছি স্যার।

গুড। ভেরি গুড। এবার আমার দিকে ফিরে ডক্টর রাধাকৃষ্ণন বললেন, ডু ইউ নো, জয়ন্তী আমার কিছু কিছু লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছে অ্যান্ড আই অ্যাম টোন্ড দে আর ভেরি গুড।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি?

.

আমি একটু মুগ্ধ দৃষ্টিতে বৌদির দিকে তাকালাম, বৌদিও আমাকে দেখলেন। পরে মাঝে মাঝেই বৌদি মজা করে হাসতে হাসতে সুভাষদাকে বলতেন, তোমার জার্নালিস্ট সেদিন যে কি রোমান্টিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল তা তুমি ভাবতে পারবে না।

সুভাষদা আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইশারা করেই বৌদিকে বললেন, তোমারও নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল।

তুমি তো জীবনেও কোনোদিন অমন করে তাকাওনি, সুতরাং ভালো না লাগার তো কারণ নেই।

এবার সুভাষদা স্ত্রীকে খুশী করার জন্য বললেন, তাছাড়া জার্নালিস্টের রোমান্টিক হবার কারণ ছিল। তোমাকে দেখে তো বোঝা যায় না তোমার কত বয়স! নো ডাউট ইউ আর স্টিল ভেরী চার্মিং।

সুভাষদা স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ঠাট্টা করলেও কথাটা ঠিক। জয়ন্তী বৌদি সত্যি সুন্দরী! পরিপূর্ণ নারীত্বের সৌন্দর্য ছাড়াও চোখে-মুখে বুদ্ধিদীপ্তির ছাপ বৌদিকে আরো সুন্দরী করেছিল। রমার মধ্যে এটা আরো বেশি স্পষ্টভাবে চোখে পড়ত।

বহু মেয়ের দৈহিক সৌন্দর্য থাকে। বিদ্যাবুদ্ধিরও একটা নিজস্ব লাবণ্য আছে। রমার মধ্যে এই সৌন্দর্য আর লাবণ্যের মিলনে একটা অদ্ভুত শ্রী সবার দৃষ্টি টেনে নিত।

বৌদির অনুরোধ রক্ষা করতে কলকাতা যাবার পথে বেনারস গেছি রমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি আগে থেকে ওকে চিঠি দিয়েছিলাম আমার আসার সব কিছু খবর জানিয়ে। ওদের হোস্টেলের কাছাকাছি এসে দোতলার বারান্দায কয়েকটি মেয়েকে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিটা নামিয়ে নিলাম। ঠিকই কিন্তু ঐ সামান্য কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই একটা শ্ৰীমণ্ডিত মুখের চেহারা আমার মনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঐ মেয়েটিই আমার সামনে এসে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হোস্টেল খুঁজতে বেশি কষ্ট হয়নি তো?

আমি ওর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি করে জানলে আমিই…

আপনার কতগুলো ছবি আমার কাছে তা জানেন?

আমার ছবি?

হ্যাঁ, আপনার ছবি। মা পাঠিয়েছেন।

তাই নাকি?

তা না হলে আমি কি করে আপনাকে দেখেই উপরের বারান্দা থেকে নেমে এলাম?

সেদিন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কিছু সময় কাটিয়েই হোটেলে ফিরে এলাম। ফিরে আসার আগে রমা জিজ্ঞাসা করল, কদিন এখানে থাকবেন?

কদিন মানে? কালই রাত্রে চলে যাব।

সেকি? দুচার দিন থাকবেন না?

দুচার দিন কেন থাকব?

আপনি থাকলে আমিও একটু ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারব, নয়তো ওই হোস্টেলের মধ্যেই…

কেন? তোমরা বেড়াতে যাও না?

বেরুতে দেয় নাকি? বাবা চিঠি দিয়েছিলেন বলেই তো আপনার সঙ্গে একটু বেরুতে পারব।

পরের দিন রাত্রেই আমি কলকাতা রওনা হলেও সারাদিন দুজনে খুব ঘুরেছিলাম। টাঙ্গায় চড়ে সারনাথ যাবার পথে আমি আর না বলে পারলাম না, তুমি বাবার বুদ্ধি আর মার সৌন্দর্য পেয়েছ, তাই না?

রমা হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ একথা বলছেন?

ভাবছিলাম বলব না কিন্তু শেষ পর্যন্ত না বলে থাকতে পারলাম না।

.

এবার রাষ্ট্রপতি আমাকে দেখিয়ে বললেন, একে একদিন রাইস অ্যান্ড ফিসকারী খাইয়ে দিও। মাছের ঝোল-ভাত না খেলে তো কোনো বাঙালিরই শান্তি নেই।

তিনদিন ওয়াশিংটনে কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। ওয়াশিংটন থেকে রওনা হবার আগে বৌদি আমাকে বললেন, নিউইয়র্ক থেকেই পালিয়ে যাবেন না, ওঁর সঙ্গে ফিরে আসবেন। সুভাষদাকেও সতর্ক করে দিলেন, না পারলে বলল আমি স্যারকে বলছি।

সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, তুমি প্রেসিডেন্টের ছাত্রী বলে সামান্য একজন ফাস্ট সেক্রেটারিকে ভয় দেখাচ্ছ কেন?

ওয়াশিংটন ছাড়ার সময় বৌদির আতিথ্য উপভোগ করে ফিরে আসার সঠিক কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও ফিরে এসেছিলাম। ওয়াশিংটন থেকে অ্যাম্বাসেডর, মিনিস্টার কাউন্সেলার আর ফাস্ট সেক্রেটারি সুভাষদা-ও প্রেসিডেন্টস পার্টিতে যোগ দিলেন। ঘুরলাম চিকাগো, বস্টন স্যানফ্রান্সিসকো, নিউইয়র্ক।এ সাত দিন সুভাষদার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশলাম। রোজ রাত্রে আমরা দুজনে অনেক গল্প করতাম। সুভাষদা ডিপ্লোম্যাট। কুটনীতিবিদ। উঁচু গলায় কোনো কিছুপ্রচার করা তার ধর্ম নয়। স্বভাবও নয়। উন্মত্ত পদ্মা পাড়ের মানুষ হয়েও ওঁর স্বভাবটি ভাগীরথীর মতো শান্ত ও মিষ্টি। উচ্ছ্বাস নেই কিন্তু মাধুর্য আছে। সুভাষদার সঙ্গে নিউইয়র্ক থেকে আবার ওয়াশিংটন ফিরে গেলাম। সাতদিন ওদের অ্যাডান্স মিল রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম। অবিস্মরণীয় সাতটি দিন। রমা তখন ছিল না। বৌদির পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। কথা দিয়েছিলাম দেশে ফিরে এসে রমার সঙ্গে দেখা করব।

.

এর কবছর পর ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কায়রো গিয়ে দেখি সুভাষদা আমাদের অ্যাম্বাসীর মিনিস্টার কাউন্সেলার। তখন রমাও ওখানে। বেশিদিন নয়, মাত্র দুটি দিন ওদের কাছে ছিলাম। আসার দিন এয়ারপোর্টে পৌঁছে বৌদিকে বললাম, বৌদি, ঋণের বোঝা বড্ড বেশি বাড়ছে।

কার? তোমার না আমার?

আমি না হেসে পারলাম না। বললাম, আপনার।

বৌদি জবাব দিলেন, ন্যাকামি না করে মেয়েটার একটা পাত্র দেখে দাও তো।

বৌদির অনুরোধটা শুনতে আমার ভালো লাগেনি। কেন, তা জানি না। তবে বড় বেসুরো মনে হয়েছিল। একটু আহত, একটু বেদনাবোধ করেছিলাম মনে মনে। রমাকে আমি ভালোবাসিনি কিন্তু তবুও ও বিয়ে হয়ে বহু দূরে চলে যাক, তাও চাইনি। চাইতে পারিনি। বললাম, বিয়ের জন্য এত ব্যস্ত কি?

ব্যস্ত না হলেও চুপ করে বসে থাকার মতো বয়সও আর ওর নেই।

না, না, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না। আগে এম. এ. পাস করুক, তারপর ভেবে দেখা যাবে। এবার রমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি রমা, এম. এ. পড়বে তো?

ও সোজাসুজি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু বাঁকা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ছেলেদের মতো মেয়েরা বিয়ে পাগল হয় না।

ওসব কথা আমাকে বলল না। আমি বরযাত্রী পর্যন্ত যাই না। একটু থেমে ওদের দুজনকে দেখে নিয়ে বললাম, বরযাত্রী না গেলেও তোমার বিয়েতে নিশ্চয়ই মাতব্বরি করব।

কেউ আপনাকে মাতব্বরি করতে বলছে না।

.

সুভাষদার কায়রো বাসের পালা শেষ হলো, দিল্লি ফিরে এলেন। রমার পাত্রের হদিশ এখনও দিতে পারিনি কিন্তু তবুও যে বৌদি দিল্লি এসেই আমার কথা মনে করেছেন, সুভাষদার মতো কুঁড়ে ঘরকুনো লোককে যে ছুটির দিন সকালে বের করতে পেরেছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞ না হয়ে পারলাম। না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সুভাষদার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। বৌদি সাদরে অভ্যর্থনা করলেন, একটু ঝগড়া একটু বকাবকি করলেন। ঠিক সেই আগের মতোই; একটুও পরিবর্তন হয়নি কিন্তু রমা যেন কেমন পাল্টে গেছে। সোজাসুজি আমার দিকে তাকাতে পারল না, দৃষ্টিতে সলজ্জ আবরণ। কথাবার্তা আলাপ-আচরণে একটু সংযত ভাব। সামান্য জড়তা, দ্বিধা। বুঝলাম শরৎ হেমন্ত শেষে। বসন্ত সমাগত। অস্বাভাবিক নয়। থার্ড ইয়ারের ছাত্রী।

খাওয়া-দাওয়ার আগে আমি আর সুভাষদা ড্রইংরুমে বসে গল্প করছিলাম। রাজনৈতিক, কুটনৈতিক বিষয়ের গল্প। আচ্ছা সুভাষদা, ইন্ডিয়া সম্পর্কে ইজিপ্টের অ্যাটিচিউড কি একটু বদলেছে?

না তা ঠিক নয়, তবে নাসেরের মতো অন্যান্য লীডাররা ঠিক অতটা প্রগ্রেসিভ নয় বলেই মাঝে মাঝে আমরা অনেক ডিফিকাল্টি ফেস করছি।

একজন নেতাকে কেন্দ্র করে কি একটা দেশের প্রতি আমাদের পলিসি ঠিক করা উচিত?

সমস্ত মিডল-ইস্ট আর ব্ল্যাক আফ্রিকাতে দেশের চাইতে ব্যক্তিই বড়।

হঠাৎ রমা ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে একটু বইয়ের দোকানে নিয়ে যাবেন?

কি বই কিনবে?

আমার কয়েকটা রেফারেন্স বই।

এমনি বইয়ের দোকান তো অনেক চিনি কিন্তু তোমাদের রেফারেন্স বই ঐসব দোকানে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।

না পাওয়া গেলেও ওরা বলে দেবে নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ, তা তো বলবেই।

খাওয়া-দাওয়ার পরে নিয়ে যাবেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর তো দুরের কথা, আজ রাত্রেও আমি বাড়ি ফিরছি কিনা সন্দেহ।

সুভাষদা বললেন, সেই ভালো। তুমি আর আজ বাড়ি যেও না।

রমা একটু বিরক্ত হয়েই বললো, বাড়ি ফিরবেন না বলে কি দু এক ঘণ্টার জন্য বইয়ের দোকানেও যাওয়া যায় না?

হঠাৎ খেয়াল হলো আজ রবিবার। আজ রবিবার তো সব দোকান আজ বন্ধ।

কাল আবার ভুলে যাবেন না।

আমি হাসি। বলি, তোমার হুকুম আমি ভুলব?

আমি হুকুম করব আপনাকে? অত সাহস আমার নেই।

রমা চলে যাচ্ছিল। সুভাষদা ডাক দিলেন, একটু দাঁড়া। এবার আমার দিকে তাকিয়ে সুভাষদা জিজ্ঞাসা করলেন, ভালো জিন আছে, একটু খাবে?

আমি রমার দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, আপনার স্ত্রী আর মেয়ে অসন্তুষ্ট না হলে একটু খেতে পারি।

রমা আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই দু গেলাস জিন দিয়ে বললো, অসন্তুষ্ট না হয়েই দিলাম।

এ বাড়িতে আমার জন্য কেউ কোনোদিন অসন্তুষ্ট হবে না, তা আমি জানি।

সত্যিই তাই; দুপুরবেলায় খেতে বসে ছোলার ডালে নারকেল দেখেই বৌদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার এ দুর্বলতার কথা জানলেন কি করে?

সব দুর্বলতার কথা কি আমাকে বলেছ?

তেমন কিছু দুর্বলতা তো আমার নেই বৌদি।

খেতে খেতে অবাক লাগে কবে কোনদিন কোথায় বৌদিকে বলেছিলাম ছোলার ডালে নারকেল বা মিষ্টি চাটনী খেতে ভালোবাসি, তাও ওঁর মনে আছে। ভোলেননি মাছে বেশি কাঁটা থাকলে খেতে পারি না। আমি খাওয়া-দাওয়ার শেষে খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, আমি আজই আমার চাকরটাকে বিদায় করে দেব।

বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?

এই রান্না খাবার পর আর ওর রান্না মুখে তুলতে পারব?

ওঁরা তিনজনেই হাসলেন।

বৌদি বললেন, কায়রোতে তোমার দাদার আন্ডারেই শ্রীনিবাসন সেকেন্ড সেক্রেটারি ছিল। হোম লিভ থেকে ফিরে যাবার সময় কয়েকটা নারকেল নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে দুটো নারকেল দিয়েছিল। আমরা দুজনেই বলাবলি করতাম ঐ সময় তুমি যদি একবার হঠাৎ এসে হাজির হও…

তাহলে খুব নারকেল খাওয়াতেন! এই তো?

খুব না হলেও খাওয়াতাম।

সে দুঃখ এবার ঘুচিয়ে নেবেন।

ওসব কথা বাদ দাও। তবে এবার সময় পেলেই চলে আসবে।

সময় না পেলেও আসব।

ওঁরা আবার হাসেন। সুভাষদা উঠে গেলেন, আমি উঠছি।

বৌদি বললেন, যাও! তোমার মতো বেরসিক লোক না বসে থাকাই ভালো।

রমা প্রতিবাদ করে, তুমি বাবাকে অমন করে বলবে না তো!

কি এমন খারাপ কথা বললাম?

আমি হাসতে হাসতে রমাকে বললাম, আমার ব্যক্তিত্বের কাছে তোমার বাবা একটু ম্লান হয়ে যাচ্ছেন বলেই বোধহয়…।

তা তো বটেই! আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট লোক তো আমরা কোনোদিন দেখিনি!

এ বাড়িতে তুমিই বোধহয় আমাকে ঠিক সহ্য করতে পার না, তাই না রমা?

রমা কিছু বলার আগেই বৌদি বললেন, তোমাকে দেখেই তো ও মাঝে মাঝে জার্নালিস্ট হতে চায়।

পরের দিন বইয়ের দোকানে নিয়ে যাবার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি জার্নালিস্ট হতে চাও নাকি?

হতে চাইলেই কি হতে পারব?

কেন হতে পারবে না?

সে অনেক অসুবিধে আছে।

অনেক অসুবিধা আবার কি?

সে আপনি বুঝবেন না।

আমি বোধহয় তোমার কোন ব্যাপারই বুঝব না, তাই না রমা?

রমা কোন জবাব দিল না। চুপ করে রইল। একটু পরে জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাড়িটা কতদূর?

দিল্লিতে কোনো কিছুই কাছাকাছি নয়; এমনকি মানুষগুলোও না।

রমা হাসল। অনেক দূর?

খানিকটা দূর ঠিকই, তবে ইচ্ছা করলে সে দূরত্ব অতিক্রম করা যায়।

মোতিবাগ থেকে শান্তি পথ দিয়ে তিন মূর্তি ভবন-সাউথ অ্যাভিনিউ পার হয়ে আস্তে আস্তে কনট প্লেসের কাছে এলাম। যন্তর মন্তরের কাছে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে বেরুতেই রমা বললো, কি দারুণ গরম!

এই মে-জুন মাস দুটো সত্যি বড় খারাপ।

আর এই দুটো মাসই আমাকে এখানে কাটাতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে বললাম, গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি তো মাঝে মাঝে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ি।

আপনি বুঝি খুব সিনেমা দেখেন?

বিশেষ সময় তো পাই না, তবে মাঝে মাঝে দেখি।

আপনি কখন অফিস যান?

পার্লামেন্ট থাকলে এগারোটার মধ্যে বেরুতে হয়; নয়তো একটা-দেড়টার পর অফিস যাই।

কখন ফেরেন?

তার কোনো ঠিক নেই।

ঠিক নেই মানে রাত্রে আটটানটা হয়ে যায়?

কাজ না থাকলে আটটানটা, থাকলে আরো বেশি রাত হয়।

সে কি?

সপ্তাহে দুএকদিন সাড়ে এগারোটা বাবোটা হয়ই।

রমা চমকে ওঠে, বলেন কি?

আমরা যদি রাত্রে কাজ না করি তাহলে ভোরবেলায় কাগজে সব খবর পাবে কি করে?

দুটো-তিনটে দোকানে ঘোরাঘুরি করে ওর বইগুলো পাওয়া গেল। আবার হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবে?

না।

জল পিপাসা লাগেনি?

আপনার বাড়ি গিয়ে চা খাব।

যাবে?

যাব না কেন?

পাঁচ মিনিটে আমার কাকানগরের আস্তানায় এসে হাজির হলাম। রাধাকিষণ দরজা খুলতেই বললাম, সকালবেলায় যে বাবুজি এসে আমাকে নিয়ে গেলেন, তার মেয়ে। রমা।

রাধাকিষণ হাত জোড় করে নমস্কার করল, নমস্তে দিদি!

নমস্তে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রমা বললো, তোমার কাছে চা খেতে এলাম।

জরুর। আপনারা বাবুজিকে এত ভালোবাসেন আর আমি আপনাকে চা খাওয়াব না?

রমা তখনও দাঁড়িয়ে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, আমরা তোমার বাবুজিকে ভালোবাসি সেকথা তোমাকে কে বললো?

বিলাইত-আমেরিকা গেলে আপনারা বাবুজিকে কত যত্ন করেন, সে-সব আমি জানি।

রমা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি ওকে সবকিছু বলেন?

আর কাকে বলব বল?

রাধাকিষণ ভিতরে গেল। আমি বললাম, বসো।

আপনার বাড়িটা দেখব না?

সেজন্যে তো অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই।

আমি ড্রইংরুমে বসলাম। রমা আমার আস্তানা দেখার জন্য ভিতরে চলে গেল। খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে বললো, আপনার টেবিলের উপর আমার একটা জিনিস ছিল। আমি নিয়ে নিলাম।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার টেবিলে তোমার জিনিস?

হ্যাঁ।

কি ছিল?

আপনি জানেন না?

কই না তো।

আমার একটা চিঠি ছিল। আমি নিয়ে নিলাম।

হেসে উঠলাম।তোমার বাবা মার চিঠি পেলেই তোমাকে একটা চিঠি লিখতাম কিন্তু অধিকাংশ চিঠিই শেষ করতে পারতাম না বলে পোস্ট করা হতো না।

রমা বসতে বসতে বললো, সে তো চিঠি দেখেই বুঝতে পারছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, শেষ করতে পারতেন না কেন?

কি লিখব কিছুতেই ভেবে পেতাম না।

চমৎকার লোক আপনি।

চমৎকার না হলেও একটু অদ্ভুত নিশ্চয়ই।

রাধাকিষণ চা আর এক প্লেট স্যান্ডউইচ সেন্টার টেবিলে রেখে জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু আনব?

রমা বললো, না, না, আমি শুধু চা খাব।

আমি বললাম, প্রথম দিন আমার বাড়িতে এসে শুধু চা খেয়ে যেও না।

আপনি তো আমাকে আসতে বলেননি; আমি নিজেই তো এলাম।

ঠিক, সামাজিক কাণ্ডজ্ঞান যে আমার বিশেষ নেই, তা বোধহয় এতদিনে তোমরা বুঝেছ?

শুধু সামাজিক কেন, অনেক কাণ্ডজ্ঞানই আপনার নেই।

ছেলেদের চাইতে মেয়েদের কাণ্ডজ্ঞান অনেক বিষয়েই বেশি হয়। রমা আমার চাইতে বেশ কয়েক বছরের ছোট হলেও হয়তো আমার চাইতে ওর কাণ্ডজ্ঞান বেশি। আমি চুপ করে গেলাম।

কি হলো? কথা বলছেন না যে? রমা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

কই কিছু না তো।

আপনি নিশ্চয়ই আমার কথায় রাগ করেছেন।

না, না, রাগ করবো কেন?

তবুও রমা একটু কৈফিয়ত না দিয়ে পারল না, আপনার সঙ্গে আমরা বড় বেশি জড়িয়ে পড়েছি। তাই কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই অনেক সময় অনেক কথা বলি কিন্তু মনে কোনো…

মাঝ পথেই আমি ওকে বাধা দিলাম, তা আমি জানি। খুব ভালো করেই জানি।

আমার উপর রাগ করেননি তো?

না।

ঠিক বলছেন?

তোমার উপর বোধহয় আমি কোনদিনই রাগ করব না।

.

গরমের ছুটিটা দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল। তারপর একদিন রমা বেনারস ফিরে গেল। সুভাষদার কাছে পৌঁছানোর সংবাদ এলো টেলিগ্রামে, রিচড় সেফলি। কদিন পরে আমার কাছেও একটা চিঠি এলো, ছুটির পর হোস্টেলে ফিরে এসে প্রত্যেকবারই খারাপ লাগে। এবার আরো বেশি। খারাপ লাগছে। বিদেশের চাইতে দিল্লিতে বাবা-মাকে আরো আরো অনেক বেশি কাছে পেয়েছি। তাছাড়া আপনার জন্য মে-জুন মাসের দিল্লির রুক্ষতা কখনও অনুভবই করলাম না। কলকাতা যাতায়াতের পথে নিশ্চয়ই বেনারস ঘুরে যাবেন।

শেষে ছোট একটা টিপ্পনী–অসমাপ্ত চিঠিই ডাক বাক্সে ফেলবেন।

ঐ ছোট্ট টিপ্পনীর জন্যই একটা চিঠি লিখে ফেললাম। চিঠি লেখার অভ্যাস আমার নেই, তা তুমি জান। তবুও যা দুটো-একটা চিঠি লিখব, তা কখনই অসমাপ্ত হবে না। টাইপ রাইটার খট খট করে রিপোর্ট লিখতে লিখতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে কলম ধরতে পারি না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন এজন্য অনেকেই আমার উপর অসন্তুষ্ট কিন্তু তোমাদের মতো যাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা মানসিক, তারা কখনই আমাকে ভুল বুঝবে না। কলকাতায় যাতায়াতের পথে সব সময় বেনারস যাওয়া সম্ভব না হলেও মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই দেখা হবে।

.

সুভাষদা আর জয়ন্তী-বৌদির জন্য আমার জীবনধারাটাও বদলে গেল। শনিবার একটু রাত করে গেছি। দরজা খুলেই বৌদি বললেন, নিশ্চয়ই কোনো ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে হুইস্কি খেতে গিয়েছিলে?

বৌদির কথায় আমি হাসি। বলি, ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে হুইস্কির জন্য যাই না, যাই কিছু নিউজ পাবার লোভে।

ওই ছুতোর নাম করে জার্নালিস্টগুলো শুধু মদ খেতেই যায়।

বৌদির মুখের সামনে আলতো করে একটা হাত দিয়ে বললাম, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর বকাবকি করবেন না। আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন শুনলে কি ভাববে বলুন তো?

বৌদি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তোমার একটু বদনাম হওয়াই দরকার।

ঘরে ঢুকতেই সুভাষদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যদি বৌদির রূপ হয় তাহলে কি হতো ভাবতে পার?

বৌদি গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরা না থাকলে তোমাদের যে কি দশা হতো তা একবার দেখতে ইচ্ছে করে।

আমি সুভাষদার পাশে বসে বললাম, আমাকে দেখেও তা বুঝতে পারছেন না?

তুমি তো হাফ ব্যাচেলার!

তার মানে?

তোমার সঙ্গে কত বৌ-বৌদির কত রকমের ঘনিষ্ঠতা যে…

আমি মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, শুধু একবার প্রেম করে ব্যর্থ হওয়া ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো মেয়ের আবির্ভাব হয়নি।

বৌদি হাসতে হাসতে ড্রইংরুম থেকে ভিতরে চলে গেলেন।

সুভাষদা বললেন, ও তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে সিনেমায় যাবে ভেবেছিল। তুমি দেরি করে আসার জন্য…

সে কথা তো আমাকে আগে বলতে হয়।

খেতে বসে খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, জানেন বৌদি, আজ ভীষণ সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু…

সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বৌদি বললেন, নিশ্চয়ই তোমার দাদা কিছু বলেছেন।

সুভাষদা বললেন, আমি তো কিছু বলিনি।

আমিও বললাম, দাদা কি বলবেন? সঙ্গে সঙ্গে বললাম, কালকে নিশ্চয়ই যাব।

দয়া করে একটু আগে থেকে জানিও।

.

দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার জন্য হিন্দী বাংলা সিনেমা দেখার জন্য বৌদির খুব আগ্রহ। সময় পেলেই আমরা দুজনে সিনেমায় যাই। সুভাষদা যান না। সিনেমায় ওঁর ভীষণ অরুচি। উনি বাড়িতে বসে বসে বই পড়েন অথবা কোনো পার্টিতে যান। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা দিয়ে, সিনেমা দেখে, এখানে-ওখানে বেড়িয়ে দিনগুলো হারিয়ে যায়। ফুরিয়ে যায়। ওঁরা ছুটিতে কলকাতা যাবার পথে বেনারস থেকে রমাকে নিয়ে নেন। আমি দিল্লিতেই থাকি। কাজ করি। অফিসের কাজে বাইরে যাই। যাই কলকাতাতেও। দুটো একটা দিন খুব হৈ-চৈ করে আবার ফিরে আসি রাধাকিষণের কাছে।

রমা বি. এ. পাস করে। এম. এ. পড়তে শুরু করে। দিল্লি আসে।

বাবুজি! বাবুজি! চা

দর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়েই উত্তর দিই, কি হলো?

দিদি আয়া হ্যায়।

কোনো দিদি এলো রে?

রমা দিদি।

মুখ থেকে চাদর সরিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করি, কে এসেছে?

রমা দিদি।

সঙ্গে সঙ্গে রমা ঘরে ঢুকল। কটা বাজে জানেন!

কটা?

পৌনে দশটা!

পৌনে দশটা?

বিশ্বাস না হয় নিজের ঘড়িটা দেখুন!

রাধাকিষণ চলে গেল। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘড়ি খুঁজছি। রমা বললো, আপনার হাতেই তো ঘড়ি আছে।

ঘড়িটা দেখেই লজ্জিত হয়ে ওর দিকে তাকালাম।

কোনো স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি? হাসতে হাসতে রমা প্রশ্ন করল।

কেন বলল তো?

হাতে ঘড়ি রয়েছে আর খুঁজে বেড়াচ্ছেন…

স্বপ্ন দেখার বয়স কি আর আছে?

আর লেকচার দিতে হবে না। এবার উঠুন।

কিন্তু তুমি কবে এলে, তাই আগে বল।

কাল রাত্রে এসেছি।

কই তোমার মা বাবা তো কিছু জানাননি আমাকে।

ওঁরাও ঠিক জানতেন না। রিজার্ভেশন পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চারটি মেয়ে একসঙ্গে চলে এলাম।

ভালোই করেছ। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম, একটু বসো। এক্ষুনি আসছি।

বাথরুম থেকে বেরুতেই রাধাকিষণ চা দিল। রমাকে শুধু চা দেবার জন্য খারাপ লাগল। ওকে শুধু চা দিলে কেন?

রমা বললো, আমি খেয়ে এসেছি।

তাহলেও সামান্য কিছু তো…

এখন কিছু খাব না।

ঠিক তো?

তবে কি আমি মিথ্যে বলছি?

রাধাকিষণ চলে যেতেই রমা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আমি একটু মোটা হয়েছি, তাই না?

একবার ভালো করে ওকে দেখলাম।মোটা হয়েছ কিনা জানি না, তবে তোমাকে দেখতে আরো ভালো লাগছে।

ঐসব আজেবাজে কথা বললে এক্ষুনি চলে যাব।

আজেবাজে কথা বলছি নাকি?

তবে কি?

সত্যি বলছি, ইউ লুক ভেরী প্রেটি!

থাক। আর আমার রূপের তারিফ করতে হবে না।

খালি চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, বল কেমন আছো?

ভালোই আছি।

পড়াশুনা কেমন চলছে?

মোটামুটি।

মোটামুটি কেন?

খুব বেশি পড়াশুনা করতে আর ভালো লাগে না।

তাহলে কি এবার বিয়ে করতে চাও?

হ্যাঁ। বিয়ে করার জন্য তো আমি পাগল হয়ে উঠেছি।

খুব অস্বাভাবিক নয়।

থাক! ওসব কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।

সেই ভালো। এইভাবে যতদিন থাকো, ততই ভালো।

মাত্র দেড় মাসের ছুটি। তাহোক খুব আনন্দে কাটল দিনগুলো। রমা এলে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত বেড়ে যায়। বৌদি প্রায়ই কিছু স্পেশাল রান্না করেন আর আমিও তার অংশীদার হই। দুচারদিন পর পর রমাও আমার আস্তানায় আসে।

জান রমা, তুমি এলে দিনগুলো বেশ কেটে যায়।

তাই তো দিল্লি থেকে গেলেই ভুলে যান।

চিঠি লিখি না মানেই কি ভুলে যাই?

কলকাতায় যাতায়াতের পথেও তো একবার নামতে পারেন।

সব সময় ঠিক সম্ভব হয় না।

এই এক বছরের মধ্যে একবারও সম্ভব হলো না?

এবার ঠিক যাবো।

কথা দিচ্ছেন?

হঠাৎ ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম, তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।

আমি তাড়াতাডি হাতটা সরিয়ে নিতেই ও হাসতে হাসতে বললো, আসবেন। খুব খুশী হব।

.

সুভাষদার দিল্লি বাসের মেয়াদ তিন বছর। কোথা দিয়ে কেমন করে যে তিনটি বছর পালিয়ে গেল, তা বুঝতেই পারলাম না। দুঃখ দুর্দিনের রাত্রি শেষ হতে চায় না, অন্ধকার চিরস্থায়ী মনে হয় কিন্তু আনন্দের দিনগুলো, বাসর রাত্রি যেন নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। সুভাষদা মস্কো বদলী হলেন। রমা বেনারস থেকে আসতে পারেনি। কয়েক মাস পরেই এমএ পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়েই মস্কো যাবে। যাবার দিন শুধু বৌদি নয়, সুভাষদাও রমার জন্য একটা ছেলে দেখতে বললেন।

নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।

বৌদি বললেন, বিয়ে দিতে পারছিলাম না বলেই এম-এ পড়ালাম কিন্তু এবার তো বিয়ে না দিলেই নয়। তাছাড়া ওর রিটায়ার করার টাইমও এসে গেল।

আমি চুপ করে সব কিছু শুনলাম কিন্তু মনে মনে জানতাম, রমার বিয়ের পাত্র আমি কখনই খুঁজে বের করব না।

সুভাষদা মস্কো রওনা হয়ে যাবার পরই রমাকে একটা চিঠি লিখলাম, তোমার বাবা-মাকে মস্কোর প্লেনে চড়িয়ে দেবার পরই খেয়াল হলো তোমার বেনারস বাসের মেয়াদও দীর্ঘ নয়। কয়েক মাস পরেই তোমার ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর তুমি মস্কো যাবে। তারপর? অনেক কিছু ঘটতে পারে তারপরে। হয়ত তুমি হারিয়েই যাবে। আর তোমার সঙ্গে আমার দেখাই হবে না। হওয়া সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে আরো কত কি হতে পারে, তাই না? যাই হোক দু একদিনের জন্য বেনারস যাব ভাবছি। তোমার পড়াশুনার বিশেষ ক্ষতি না হলেই যাব। নয়তো তোমার মস্কো যাবার সময় নিশ্চয়ই দেখা হবে।

এক সপ্তাহের মধ্যেই রমার চিঠি পেলাম, আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লাগল। রবিবার ছুটি। সোমবার আমাদের কোনো ক্লাস থাকে না। সুতরাং যে কোনো রবিবার সকালে আসতে পারেন। আমি কী গেস্ট হাউসে আপনার থাকার ব্যবস্থা করব? নাকি হোটলেই থাকবেন? জানাবেন। আসার আগে হোস্টেল সুপারিন্টেডেন্টকে নিশ্চয়ই একটা টেলিগ্রাম করবেন।

শেষে লিখেছে, আমি হারিয়ে যাব কেন? আপনার সঙ্গে আমাদের কি সেই সম্পর্ক?

.

আমি বেনারস গেলাম। না গিয়ে পারলাম না কিন্তু কেন গেলাম তা জানি না। আসার দিন স্টেশনে রমাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, কেন এলাম বলো তো রমা?

ভালো লাগল না বুঝি?

ভালো লাগল বৈকি কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে যে জন্য এসেছিলাম তা বোধহয় হলো না।

আমাকে কিছু বলবেন?

না। কি আর বলব? সঙ্গে সঙ্গেই আবার প্রশ্ন করলাম, তুমি কিছু বলবে?

ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার প্রশ্নের জবাব দেবার অবকাশ পেল না রমা।

অদৃষ্টের এমনই যোগাযোগ ও মস্কো যাবার সময় আমি দিল্লিতেই থাকতে পারলাম না। কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে এক বছরের জন্য লন্ডন চলে গেলাম।

.

এই রমার সঙ্গেই দেবব্রতর বিয়ে হলো। কার্ড দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি। ওর ভালো নাম যে রঞ্জনা, তা আমি জানতাম না। তাছাড়া দেবব্রতর এক দিদি খুব ছেলেবেলায় মারা যান। তার নামও রমা ছিল বলে ওরা রঞ্জনা বলেই ডাকেন।

ঢাকুরিয়ায় সুভাষদাদের বাড়ি আছে। তাছাড়া ওঁর বাবা জীবিত বলে কলকাতাতেই বিয়ে হয়। এর কদিন পরেই আমি ফিরে এলাম। বিয়ের পর ডক্টর চৌধুরী দিল্লিতে রিসেপসন দিলেন। ঐ রিসেপসনে গিয়ে বিয়ের গল্প শুনে আমি তাজ্জব।

এম-এ পরীক্ষা দিয়ে রমা মস্কো যাচ্ছিল। অত্যন্ত জরুরী কারণে ডক্টর চৌধুরীও মস্কো যাচ্ছিলেন ঐ একই ফ্লাইটে। পালামের ডিপারচার লাউঞ্জে কেউই কাউকে খেয়াল করেননি। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট। অনেক ভারতীয় যাত্রী। সুতরাং খেয়াল হবার কোনো অবকাশও ছিল না। দিল্লি থেকে সোজা মস্কো, তারপরই লন্ডন। ঠিক সময়ই প্লেন টেক অফ করল। কাবুল ওভার-ফ্লাই করে হিন্দুকুশ পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময়ই এঞ্জিনে গণ্ডগোল দেখা দিল। মস্কো নয়, তাসখন্দেই প্লেন ল্যান্ড করল। তাসখন্দ এয়ার পোর্টের ট্রানজিটে লাউঞ্জেই রমার সঙ্গে ডক্টর চৌধুরীর প্রথম আলাপ। অনেকক্ষণ চুপচাপ পাশাপাশি বসেছিলেন দুজনে। তারপর ডক্টর চৌধুরীই প্রথম আলাপ শুরু করলেন, লন্ডন যাচ্ছেন?

না, মস্কো।

কেন, স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে যাচ্ছেন?

আমি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, মানে এম-এ পরীক্ষা দিয়ে বাবা-মার কাছে যাচ্ছি।

আপনার বাবা-মা মস্কো থাকেন?

থাকেন মানে এখন ওখানেই পোস্টেড।

দুজনেই ইংরেজিতে কথা বলছেন। কেউই জানেন না কে কোথাকার লোক। ডক্টর চৌধুরী। জানতে চাইলেন, আপনার বাবা কি আমাদের এম্বাসীতে আছেন?

হ্যাঁ।

আপনার বাবার নামটা জানতে পারি?

রমা হাসতে হাসতে বললো, নিশ্চয়ই। আমার বাবার নাম সুভাষ রায়।

এবার ডক্টর চৌধুরী খুশীতে চমকে উঠলেন, আপনি বাঙালি?

আমাকে আপনি বলার দরকার নেই। আমি আপনার চাইতে অনেক ছোট।

দেবতোষ চৌধুরী খুশী হয়ে বললেন, আজকাল আপনি বলাটাই নিরাপদ–কারণ অধিকাংশ। ছেলেমেয়েরাই তুমি বলা পছন্দ করে না।

বড়দের কাছে ছোট হতে আমার ভালোই লাগে।

আধুনিক বিমান যত দ্রুত গতিতে দেশ দেশান্তর পার হয়, বিকল হলে তত বেশি সময় নষ্ট করে। অধিকাংশ যাত্রী অধৈর্য হলেও ডক্টর চৌধুরী আর রমা মনের আনন্দে গল্প করেন।

কি আশ্চর্য! এতক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করছি কিন্তু তোমার নামটাও জানলাম না।

আমার নাম রঞ্জনা রায়।

বাঃ! বেশ সুন্দর নাম! আমার নাম দেবতোষ চৌধুরী। লোকে বলে ডক্টর চৌধুরী।

মস্কো এয়ারপোর্টেই সুভাষদা আর বৌদির সঙ্গে ডক্টর চৌধুরীর আলাপ হলো। আলাপ না থাকলেও ডক্টর চৌধুরী সুভাষদার অপরিচিত ছিলেন না। ফার্স্ট সেক্রেটারি পদ্মনাভন ও সোভিয়েট একাডেমী অফ সায়েন্সের একজন প্রতিনিধি তাকে রিসিভ করতেই এয়ারপোর্টে এসেছে, তাও জানেন। আলাপ হয়ে খুব খুশী হলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নেবার আগে ডক্টর চৌধুরী সুভাষদাকে বললেন, মিঃ রায়, রঞ্জনা একদিন আমাকে খাওয়াবে বলছে। আপনার আপত্তি নেই তো?

সে তো সৌভাগ্যের কথা।

মাত্র একদিন নয়, চার-পাঁচ দিন উনি সুভাষদার অ্যাপার্টমেন্টে এলেন, খেলেন, গল্প করলেন। একদিন রমাকে নিয়ে ক্রেমলিন প্যালেস দেখতে গেলেন। গ্রান্ড ক্রেমলিন প্যালেস, লেনিনের। পড়াশুনার ঘর, রেড স্কোয়ার ঘুরতেই ডক্টর চৌধুরী নিজেদের পরিবারের, নিজের, দেবব্রতর অনেক কথা বলেন। একটা কথা বলব রঞ্জনা?

সেজন্য অনুমতি চাইছেন কেন?

কথাটা একটু জরুরী। তাছাড়া তোমার ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত বলেই অনুমতি চাইছিলাম।

রমা চুপ করে রইল।

তুমি অনুমতি দিলে দেবুর সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব করতাম তোমার বাবা-মার কাছে।

রমা নিরুত্তর থেকেছে।

রমা রঞ্জনা হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *