০৩. নীতা ধূলো-ওড়া পথ দিয়ে চলে যায়

নীতা ধূলো-ওড়া পথ দিয়ে চলে যায়। কিন্তু তার ফেলে যাওয়া কথাগুলো সারাদিন বুড়িকে ব্যস্ত করে রাখে। পুকুরে গোসল করতে নেমে থমকে থাকে বুড়ি, তেঁতুল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে চুল ঝাড়তে গিয়ে থমকে যায় বুড়ির হাত। চুলোর তরকারি নাড়তে গিয়ে চুপ হয়ে যায় বুড়ি। বারান্দায় বসে বসে আবোল-তাবোল ভাবে। দেহে অবসাদ, ক্লান্তি জড়িয়ে ধরে। প্রতিটি স্নায়ু প্রার্থিত উত্তেজনার অভাবে ঝিমিয়ে যেতে চায়। কি যে জ্বালা! গফুর হাটে গেছে। ফিরবে সন্ধ্যায়। সলীম কলীম ভাত খেয়ে কোথায় খেলতে চলে গেছে। বুড়ির কিছু ভালো লাগে না। খাওয়া-দাওয়ার পর নকসীকাঁথা বিছিয়ে সেলাই করতে বসে। নকসিকাথার রঙিন সুতো বুড়ির হৃদয়ের পরতে নকসা বুনে চলে। কত উজ্জ্বল সুখস্বপ্ন বুড়িকে মাতিয়ে রাখে।

তখুনি সলীম কলীম ছুটতে ছুটতে আসে।

–মা, মা? মা জাননা সখিনাবু না কোথা থেকে একটা ছোট ছেলে এনেছে। এই এতটুকু?

কলীম হাত দিয়ে দেখায়। ও ছোট বলে ওর উত্তেজনা একটু বেশি। সলীম একটু ধীরস্থির।

কলীম বুড়ির গলা জড়িয়ে ধরে।

–মা তুমি আমাদের জন্য একটা বোন আন না?

–আনবো, আনবো। এখন ছাড়।

–জানো মা ছেলেটা না কেমন করে কাঁদছিল। ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া……

কলীম অনুকরণ করে দেখায়। ওদের কাণ্ড দেখে বুড়ি না হেসে পারে না।

–আমাদের জন্যে কবে বোন আনবে মা? সত্যি করে বল?

–দেখি কবে আনা যায়। বললেই কি আর হুট করে আনা যাবে? দিনক্ষণ ঠিক করে শুভদিন দেখে তবে আনতে হয়। বুঝলি বোকা ছেলে?

বুড়ি কলীমের থুতনি নেড়ে আদর করে।

–সত্যি আনবে তো? তিন সত্যি কর?

–এই করলাম। সর এখন খেলগে যা।

কলীমের আবদার সবচেয়ে বেশি। যখন তখন বুড়িকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। সলীম ঠাণ্ডা। অতোটা আদর আবদারের মধ্যে নেই। ওরা যেমনি ছুটতে ছুটতে এসেছিলো তেমনি ছুটতে ছুটতে চলে যায়। ওরা হাঁটে না। এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে যেন। কেবলই লাফায়। ছোটা ছাড়া কথা নেই। বুড়ির মনে হয় ছোটবেলায় ও নিজেও অমনি ছুটতো। ছুটতে না পারলে ভালো লাগতো না। ছি-বুড়ি খেলায় কেউ পারতো না ওর সঙ্গে। বাই বাই করে যে ছুটতে ডানে বামে তাকাতো না। কতদিন গাছ-গাছালির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে যে ব্যথা পেয়েছে। কখনো হাত-পা কেটে গেছে। কোন দিন সেগুলো আমলই দেয়নি। কেটে গেলে শিয়ালমুখা দাঁতের তলে চিবিয়ে লাগিয়ে দিত। রক্ত বন্ধ হয়ে যেত। জলিল বলত, তুই বড় শক্ত মেয়ে বুড়ি। কেমন করে যে সইতে পারিস? আমার কাটলে কেঁদেকেটে হুলস্থূল বাধাতাম। মাগো কাটাকুটি আমি সইতে পারি না।

বুড়ি হেসে গড়িয়ে পড়ত, তোর ছেলে হওয়াটাই ভুল হয়েছে জলিল। তুই তাহলে বুড়ি হয়ে যা, আমি জলিল হই।

–কি যে আজগুবী কথা। জলিল হলে তুই কি করবি?

–বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতাম। আর কোন দিন ফিরতাম না।

–আমিও তাই করব।

জলিল উদাস হয়ে বলেছিল।

–তুই পারবি কাঁচকলা।

–দেখিস পারব। তবে তোর মতো অত তেজ আমার নাই বুড়ি। তুই যেন কেমন।

বুড়ি ভেবে দেখলো এখন আর সেই তেজ নেই ওর। ও এখন পালাতে চায় না, চায় বন্ধন। চায় মাতৃত্বের গৌরব এবং অহংকার। সলীম কলীম চলে যেতেই বুড়ির মনের সুতো ছিঁড়ে যায়। গত বছর বিয়ে হয়েছে সখিনার। বছর না ঘুরতেই ছেলে হলো। বুড়ি কাথা গুটিয়ে উঠে পড়ে। সমস্ত দুপুরটা ওর শূন্য জীবনের ওপর হাঁসফাঁস করছে যেন। ও উঠোনে নেমে দাঁড়ায়। কোথায় একটা ঘুঘু একটানা ডেকে যাচ্ছে। নির্জন দুপুরে ঘুঘুর ডাক বুড়ির বুকের ভেতর কটুকটু শব্দ করে।

রাতের অন্ধকারে গফুরের কাছে কথাটা বলতেই গফুর হেসে চুপ করে যায়। বুড়ির বেদনাকে ও সবসময় সহানুভূতির সঙ্গেই দেখেছে। কখনো রাগ করে, বিরূপ মনোভাব। প্রকাশ করে অথবা পাড়াপড়শীর মতো বুড়ির বন্ধ্যাত্বকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে বিরক্তি প্রকাশ করেনি। ওর আকাঙ্ক্ষাকে একান্ত স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছে। সন্তান কামনা গফুরের মধ্যে থাকলেও সেটা তত প্রবল নয়। দুটো ছেলে তার রয়েছে। বুড়ির না হলেই বা কি? বরং এই ভালো। বুড়ির এই সপ্রতিভ গফুরকে ভয়ানক আনন্দ দেয়। ছেলে হলেই তো বুড়িকে আর এখনকার মতো এমন করে কাছে পাওয়া যাবে না। আজও গফুর বুড়ির কথার কোন উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়। ঘুমুবার চেষ্টা করে। ওর ধারণা সন্তান যদি হয় এমনিতে হবে। ঐসব মানত-টানতে কিছু হবে না। গফুরের নির্বিকার আচরণে ওর মনটা যেন কেমন করে। ঘুম আসে না।

গফুরের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলা দেয়। ডাকে।

–কিছু বলছ না যে?

–ঝাড়ফুক, তাবিজতুমার, গাছগাছালির ওষুধ সবই তো হলো আর কত করবি বুড়ি?

–এইবার শেষ। আর কখনো তোমাকে বলব না।

বুড়ির কণ্ঠ করুণ শোনায়। বেঁচে থাকার শেষ তৃণটুকু আঁকড়ে ধরার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

–তুই কিছু জানিস না বুড়ি। শ্রীনাইল ধাম পাক্কা ছয় মাইলের পথ। তিন মাইল হেঁটে, তিন মাইল গরুর গাড়িতে। বড় কষ্ট। পারবি না যেতে।

–খুব পারবো। তুমি দেখে নিও। ওগো তুমি না কর না। বুড়ির কণ্ঠ মিনতিতে ভেঙে পড়ে। সেই কণ্ঠস্বরে এমন একটা সমর্পিত আবেদন ছিল যে গফুর আর না করতে পারেনি।

–আচ্ছা ঠিক আছে। সময় হলে নিয়ে যাব। তাও যদি তোর মনের সাধ মিটে। গফুরের বুকে মুখ গুঁজে গুটিশুটি শুয়ে পড়ে বুড়ি। খুশি খুশি লাগছে। আজ রাতে গফুরের ইচ্ছের কাছে নিজেকে একদম নিবেদন করে দেয়। একটা কথাও বলে না। একটা আপত্তি না। পলকে অনুভব করে ওর নিজের ভেতরেও কেমন একটা ইচ্ছে সমস্ত রক্তে চলাচল করে। রাতের অন্ধকারের মতো সব আকাঙ্ক্ষাও গাঢ় হয়ে ওঠে। বাইরে লক্ষ্মী পেঁচা ডাকে। হয়তো আকাশে চাদও আছে। বাঁশবন সন্সর করে। ভোররাতে দুজনে ডিঙি নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়ে। আজকের উদ্দেশ্য আর মাছ ধরা নয়। খালের বুকে নিজের খুশি ছড়িয়ে দেবার বাসনায় বুড়ির তাগিদ ছিলো বেশি। আর গফুরতে উন্মুখ হয়ে থাকে। এমনি করে বুড়ির খেয়ালের স্রোতে ডুবে যাওয়ায় কি যে আনন্দ! কাদার গায়ে খালের জল ছলাৎ ছলাৎ করে। পাড়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে কাশবন। লম্বা লম্বা ঘাসের মাথা দেখা যায় পানির তলে। কেমন কাল দেখায় পানি। সে পানিতে নিজের ছায়া দেখতে পায় না বুড়ি। দেখার চেষ্টাও করে না! এখন আর অন্য কিছুতে মন নেই ওর। পাটাতনের ওপর শান্ত হয়ে বসে থাকে। মনে মনে ভাবে, গফুরের এখন শালুক কামড়ে খেতে ইচ্ছে করছে। গফুর যে কি! শালুক পেলে মাছের কথা বেমালুম ভুলে যায়। নৌকায় এলেই ও বেশি চুকচুক করে। গফুর বলে ঘরের চাইতে নৌকায় পেতে সুখ লাগে। ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে বুড়ি হাসে। ডিঙি তরতরিয়ে চলে। গফুর নিশ্চয় কোন নিরাপদ জায়গা খোঁজে। যেখানে নিবিড় আচ্ছাদন প্রাকৃতিক উষ্ণতা দেয়। গফুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ি ওকে বুঝতে চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকারে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না। এখন ওর জলিলের কথা মনে হয়। জলিল ওর স্মৃতিপট দখল করে নেয়। ও কিছুতেই জলিলকে তাড়াতে পারে না। বুড়ির বিয়ে হবার পরই পালিয়ে শহরে চলে যায়। রিকশা চালায়। শহরে নাকি ও বেশ ভালোই আছে! জলিল গাঁয়ে এলে ওর কাছে শহরের অনেক গল্প শোনে বুড়ি। শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যায়।

জলিল একদিন চুপি চুপি বলেছিল, আমার সঙ্গে বিয়ে হলে তোকে আমি শহরে নিয়ে যেতাম বুড়ি। বুড়ি ওর কথায় রাগ করতে গিয়েও পারেনি। আসলে এটাই হওয়া উচিত ছিল। জলিল পালিয়ে যাবার পর কত জায়গা ঘুরেছে, কত কাজ করেছে। চায়ের দোকান, মানুষের বাসা, হোটেল, মোটর গ্যারেজ ইত্যাদি অনেক জায়গার পর ও এখন রিকসা চালায়। বুড়ির বুক কেমন করে। আচ্ছা জলিল কি ওর মনের মানুষ হতে পারতো? এটা কখনও ভেবে দেখেনি ও। অনবরত জলিল ওর হৃদয়ে লেপ্টে যায়। আস্তে আস্তে জলিল ওর শরীরে প্রসারিত হতে থাকে। বুড়ি শক্ত করে নৌকা চেপে ধরে। দাঁত কিড়মিড় করে।

–তোর কি হয়েছে বুড়ি? কি ভাবছিস যেন?

–জলিলের কথা ভাবছি?

–জলিল? গফুর ভুরু কুঁচকে তাকায়।

–জলিলের কথা ভাবছিস কেন?

–এমনি। মনে এলো তাই।

বুড়ি খান-খান হাসিতে ভেঙে পড়ে। চরাচরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। গফুরের হাতের বৈঠা থেমে যায়। সেই পরিচিত তেঁতুল গাছটার কাছে এসেছে ওরা।

–কি ভয় পেলে নাকি?

–কত ধরনের রসিকতা যে তুই জানিস বুড়ি?

গফুর হেসে সহজ হবার চেষ্টা করে। ডিঙি বাঁধার জন্যে লাফ দিয়ে নামে। বুড়ি মনে মনে হাসে। গফুরের কাছে ওটা রসিকতা হয়েই থাক। ও আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়।

পৌষ মেলার দুদিন আগে নীতা এসে হাজির। সঙ্গে তার সঙ্গী চরণদাস। বেঁটেখাটো ফর্সা, মোটা মানুষটি। মুখে হাসি লেগেই থাকে। গানের গলা ভাল না। ফ্যাসফ্যাস করে কণ্ঠ। দোতরার টুংটাং শব্দে বুড়ি ঘর থেকে ছুটে আসে। ধানের মাড়াই। হচ্ছে উঠোনে। পা ফেলার জায়গা নেই। বুড়ি চরণদাসকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। নীতা হাসে।

–অমন করে দেখছিস কি সই? মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছি রে।

–ওমা, তাই নাকি।

বুড়ি ফিক করে হেসে ফেলে। ধান মাড়াইয়ের পাশ দিয়ে ওদের ডেকে এনে বারান্দায় বসায়। কামলাগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নীতা পোঁটলা-পুঁটলি নামিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। ধূলি-ধূসরিত পা। রুক্ষ চুল বাতাসে ওড়ে। গায়ে-পিঠে ঠিকমত কাপড় নেই। সব এলোমেলো। জোরে একটা শ্বাস টেনে বলে, কাঁচা ধানের গন্ধে মন ভরে গেলো সই। তোর মতো সারা বছর এমন ধানের মধ্যে থাকতে পারলে জীবনে আর কিছু চাইতাম না।

–তোকে কি কারো ধরে রাখার সাধ্যি আছে সই। পথে পথে না ঘুরলে তোর জনমই বৃথা।

নীতা মুখ নিচু করে হাসে।

–জল দে সই।

বুড়ি পানি আনতে যায়। চরণদাস দোতরা বাজায়।

–তোমার সই মন্দ না।

–মনে ধরেছে বুঝি?

–মনে ধরলেই বা কি এসে যায়?

চরণদাস মুখ টিপে হাসে। বুড়ি ঘটি-ভরা পানি নিয়ে আসে। নীতা অর্ধেকটা খেয়ে চরণদাসকে দেয়। চরণদাস এক চুমুকে বাকিটা শেষ করে। বুড়ি হাঁ করে থাকে।

–ভাগাভাগি কেন? আর দেব?

–আমরা অমন করেই খাই। নইলে পেট ভরে না।

নীতাকে আজ একদম অন্যরকম লাগে। এই নীতাকে বুড়ি যেন চেনে না। বুড়ির সঙ্গে ওর অনেক তফাৎ।

–যাবি না সই পৌষ মেলায়? তোকে নিতে এলাম?

–যাব সই যাব। সলীমের বাপ গরুর গাড়ি ঠিক করতে গেছে। বুড়ির চোখে-মুখে খুশির রেণু ছড়িয়ে যায়।

–ও তুই গরুর গাড়িতে যাবি? আমার চরণ দুখানাই ভরসা। সঙ্গে আমার চরণদাসও রয়েছে।

চরণদাসের দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসে নীতা। চরণদাস চোখ টিপি দেয়। তারপর আবার দোতরার ওপর ঝুঁকে পড়ে। বুড়ি ওদের ভাবসাব দেখে অবাক হয়। ভালও লাগে। মনে হয় গফুর না হয়ে জলিল হলে হয়ত ওর জীবনটা এমনই হতো। কামলারা হেই হেই করে গরু তাড়াচ্ছে। ধান মাড়াই হচ্ছে। এ সময়টা ভীষণ ব্যস্ত থাকে বুড়ি। ছবিগুলো ওর মনের মধ্যে ওলোট পালোট খায়।

আমরা উঠি-রে সই। এখুনি রওনা করা দরকার। নইলে আবার ঠিকমত পৌছতে পারব না। জানিস তো পথে পথে কত জায়গায় বসতে হয়।

বুড়ি ঘরে গিয়ে ডালা ভর্তি মুড়ি আর গুড় নিয়ে আসে।

–তোর তাড়া আছে। আমার তো রান্না হয়নি সই। এখন এই খা।

–খাও ঠাকুর। সই আমাদের পেসাদ দিয়েছে।

নীতা এক মুঠি মুড়ি গালে পুরে।

সই আমাদের যা দেয় তাতেই মন ভরে যায়। চরণদাস মুখ তোলে না। লম্বা বাবরি ঘাড়ের ওপর ছড়িয়ে থাকে। টুংটাং করে দোতরা বাজায়। যেন চরণদাসের অন্য কোন দিকে মন নেই। বুড়ি চরণদাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।

–কি গো ঠাকুর তুমি যে আমার সইয়ের দিকে মুখ তুলেই চাইছ না?

–তোমার ঠাকুর রসের নাগর নয়? বুড়ি খিলখিলিয়ে হাসে।

–দিল তো সই তোমাকে ঠুকে? নীতা চরণদাসের হাঁটুতে চাপ দেয়।

চরণদাস কপালের উপর এসে পড়া চুল হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে বড় বড় চোখে বুড়ির দিকে তাকায়। সে দৃষ্টিতে বুড়ি হকচকিয়ে যায়। কিছুটা ব্রিত বোধ করে। চরণদাসও চোখে চোখ রেখে বলে, সে কি আর যেখানে সেখানে পড়ে সই? জায়গামত পড়লে যে রস শুকিয়ে যায়।

–ওমা তাই নাকি? তোর মনের মানুষ চুপচাপ থাকলে কি হবে সই কথার তীর তৈরি করে রাখে। জায়গা মত ছুড়ে মেরে একদম ঘায়েল করে দেয়।

চরণদাস কিছু বলার আগে বুড়ি রণেভঙ্গ দিয়ে পালায়। ওরা দুজনে হাসতে থাকে।

নীতা ফিসফিসিয়ে বলে, যেখানে রস ফেলেছো সেটা জায়গামতো হয়েছে তো?

–একদম। না হলে কি আর সঙ্গে নিয়ে পথে পথে ঘুরি।

চরণদাস একমুঠি মুড়ি গালে পুরে এবং মুড়ি খেতেই মনোযোগী হয়ে ওঠে। নীতা এক মনে মুড়ি চিবোয় আর ধান মাড়াই দেখে। এ দৃশ্যের সঙ্গে ওর জীবনের কোন যোগ নেই। কেবল ভিক্ষে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। গোলা ভরা ধান কি নীতা জানে না। পরক্ষণে ও হেসে ওঠে। এ বন্ধন ও চায় না। এর চেয়ে পথে পথে ঘোরাতেই। আনন্দ বেশি। সব কাজ কি আর সবার সাজে? চরণদাস অবাক হয়, হাসছিস যে?

–এমনি।

–বল না কি?

–ভাবলাম বুড়ির মতো সংসার আমি করতে পারব না।

–আর বুড়িও তোর মতো পথে পথে ঘুরতে পারবে না।

–ঠিক। দুজনেই হাসে।

–এই যে সই এবার তাহলে উঠতে হয়।

–যা-বি? আবার কবে আসবি? বুড়ির কণ্ঠে ব্যাকুলতা ফুঠে ওঠে।

–মেলায় তো তোর সঙ্গে দেখা হবে।

–হবে তো?

–হ্যাঁ-রে হবে। আমি তোকে খুঁজে নেব। তুই কিছু ভাবিস না। এবার তোর মনের সাধ পুরবে সই। তুই দেখিস আমার কথা ফলে কি না?

–তাই যেন হয়।

বুড়ি মনে মনে বলে। ওরা ঝোলাঝুলি কাঁধে বেরিয়ে যায়। ওদের অপসৃয়মাণ দেহ পথের বাঁকে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বুড়ি। এই ধান মাড়াই, গরু, কাজের লোক, সজনে গাছ বুড়ি ভুলে যায়। পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে এই পরিচিত সব কিছু কেমন বিস্বাদ হয়ে যায়। জঘন্য, নোনাধরা এই ঘর-সংসার। বুক ভেঙে যায়। চোখ ফেটে জল আসে। ঘরে ফিরে কথায় মুখ গুজে প্রাণ খুলে কাঁদে বুড়ি।

পরদিন বুড়িকে নিয়ে রওনা হয় গফুর। পথের কষ্ট বুড়ির কাছে কোন কষ্ট বলেই মনে হয় না। গফুরের মনে হয় ওর ভেতর এখন একটা দৈবশক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। সব কষ্ট উপেক্ষা করার জীয়নকাঠি পেয়েছে। গরুর গাড়ির দুলুনির সঙ্গে ভাবনা মিলিয়ে চুপচাপ বসে থাকে বুড়ি। পথের দিকে দুচোখ মেলে রাখে। হলদী গাঁ-র বাইরে এই প্রথম ওর যাত্রা। গাঁ-র বাইরে গাঁ আছে। মাঠের বাইরে মাঠ। সেই মাঠের উপর দিয়ে দৃষ্টি চালালে কোথাও আটকায় না। পথের বাঁকে নতুন পথ বেরিয়ে যায়। সে পথ কত নাম না জানা দিকে চলে গেছে। ও কেবল অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। গাঁর বাইরে গায়ের রূপ বদলে যায়। পরিচিত গাছ গাছালি, একই ধরনের ঘর-বাড়ি তবুও বুড়ির মনে হয় সব গাছের রঙ আলাদা, সব ঘরের আদল আলাদা। কোন কিছু চিনতে পারছে না ও। বুড়ি বুক ভরে এই অচেনা জায়গায় শ্বাস নেয়। গন্ধেও পরিচিত হলদী গা-টা কোথাও আর খুঁজে পাচ্ছে না ও। বুক ভরে যায়। ও একটা নতুন জায়গায় আসতে পেরেছে। এই আনন্দকে সম্বল করে ও কৈশোরে ফিরে যায়। ক্রমেই শ্রীনাইল ধাম এগিয়ে আসে।

গরুর গাড়ির রাস্তা একসময় শেষ হয়। মাঠের আল ধরে পায়ে হাঁটা পথ। ক্লান্তি নেই বুড়ির। ধান কাটা হয়ে গেছে। নেড়া মাঠ ধূ-ধূ করে। হাঁটতে ভাল লাগে ওর। ছোটবেলায় এমনি মাঠে মাঠে কত ঘুরে বেড়িয়েছে। নাড়ার আগুন জ্বালিয়ে ছোট হাঁড়িতে রস জাল দিয়েছে। মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খেয়েছে। শৈশব আর কৈশোর বুড়ির জীবনের লুকানো গুহার মণি-মানিক্য। মাঝে মাঝে সে গুহার দরজা খুলে সেই চাকচিক্য নাড়াচাড়া করে। স্বপ্নের ঘোরে পথ চলতে গিয়ে হোঁচট খায় বুড়ি। পেছন থেকে ধরে ফেলে গফুর।

–একটু দেখে শুনে হাঁটতে হয় তো? ভীষণ লজ্জা পায় ও।

–কেমন করে যে হয়ে গেলো।

বুড়ি একমনে মানুষের পথচলা দেখে এগিয়ে চলে। যতই শ্রীনাইল ধাম এগিয়ে আসে ততই মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কাল কাল মাথা অগণিত হয়ে ওঠে। দূরে মেলার ঘরের চালা দেখা যায়। একটা মৃদু গুঞ্জনও ভেসে আসে। ধান ক্ষেতের আল ছাড়িয়ে বুড়ি সমতলে এসে ওঠে। খালি পা ধূলিধূসরিত হয়ে যায়। গফুর ওকে পেছন থেকে ডাক দেয়, আস্তে চল বুড়ি।

বুড়ি আবার লজ্জা পায়। চলার গতি কমিয়ে দেয়। বুড়ো নিমের চিরল পাতায় ওর স্বপ্ন-রঙিন মনের পট আঁকা হয়ে যায়। ও আবেগে কাপড়ের পুঁটলিটা বুকের কাছে চেপে ধরে।

ধামে গিয়ে ভক্তিভরে বাবার নামে মানত করে নিমগাছে পুঁটলি বাঁধে। ধুলো মাখে সারা শরীরে। তবে অন্যসব নারী-পুরুষের মতো মাটিতে গড়াগড়ি দেয় না। ভীষণ সংকোচ লাগে ওর। কিছুতেই নিজের সঙ্গে পেরে ওঠে না। নিজের মনকে কয়েকবার শাসন করে। মনে মনে বলে, বিশ্বাসে ফুটো রাখতে নেই। তবুও হয় না। নিঃশব্দে ধুলো মেখে উঠে আসে। গফুরকে বলে, আমি যে গড়াগড়ি করলাম না ফল পাবো তো?

গফুর হেসে ওর আশংকা উড়িয়ে দেয়।

ওতে কিছু হয় না। বিশ্বাসটাই আসল। তুই যেমন কেশা বাবাকে ধ্যানজ্ঞান করেছিস ওতেই হবে।

গফুরের কথায় বুড়ি আশ্বস্ত হয়। গফুর এখানে এসে মাতামাতি করেনি। কোন কথাও বলেনি। বুড়ির বিশ্বাস ভক্তিকে উপেক্ষা করে অবহেলায় উড়িয়ে দিতে পারেনি। যদিও নিজের মধ্যে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোন ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। বিশ্বাসের চাইতে যুক্তি প্রবল হয়ে উঠলে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায় ও। গফুর মনে মনে বুড়ির জন্যে আপস করে।

কেশাবাবার ধামে মানত করার পর হালকা হয়ে যায় বুড়ির মন। গফুরের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে মেলা দেখে। মাটির পুতুল, কাঠের খেলনা, কাগজের পাখি, রকমারি খাবার। আরো কত কি নিয়ে বসে আছে! সলীম লীমের জন্যে কাঠের ঘোড়া আর হাতি কেনে। মাটির পাখিও নেয়। কলীমের বায়না ছিল বাঁশি। বুড়ি কেনে হাত-ভর্তি কাঁচের চুড়ি, নাকের নোলক, কানফুল। খুশির অন্ত নেই ওর। গফুরের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কি নেবে?

–আমি? আমি আর কি নেব?

–তুমি একটা গামছা নাও আর একটা খলুই।

–খলুই? খলুই দিয়ে কি হবে? তুইতো আর মাছ ধরতে যাস না?

–এই জন্যেই তো নেবে। আমি গেলে তো আর মাছ ধরা হয় না। শূন্য খলুই ঘরে ফেরে।

–তাই তো, ঠিক বলেছিস। তবু শূন্য খলুই আমার জন্যে ভালই ছিল বুড়ি।

বুড়ি গফুরের চোখে একপলক দৃষ্টি ফেলে অন্যদিকে মুখ ফেরায়। গফুরের কণ্ঠে ওর মন ছুঁয়ে যায়। তারপর দুজনে মিলে গামছা আর খলুই কেনে। ঘুরতে ঘুরতে দেখে বিরাট এক কড়ই গাছের নিচে নীতা আর চরণদাস দলবল নিয়ে আসর জমিয়ে তুলেছে। বুড়ি থমকে দাঁড়ায়। কত আবেশভরে গান গাইছে নীতা। চোখ দুটো বোজা, টুংটাং দোতরা বাজায় চরণদাস। বুড়ির মনে হয় এ নীতা সইকে ও চেনে না। সেই পরিহাস প্রিয় চটুল নীতা এ নয়। ও এখন অন্য জগতের বাসিন্দা। এ জগৎ বুড়ির একদম অপরিচিত; এ জগতের মর্মও ও বোঝে না। হঠাৎ মনে হয় কেশাবাবার ধ্যানে নীতাকেই মানায়, বুড়ি এখানে বড্ড বেমানান। নীতার মত সব ভুলে ডুবে যাওয়া মন বুড়ি কোথায় পাবে? নীতার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। বলবে, সই তোর মত আমাকে করে নে। নইলে আমার মনের আশা বোধহয় পুরবে না।

গফুর ওর হাত ধরে টানে, চল। বেলা পড়ে যাবে।

বুড়ি মন্ত্রমুগ্ধের মত বলে নীতা?

–ও এখন তোকে চিনবে না। দেখছিস না ধ্যানে রয়েছে।

–ধ্যান বুঝি? গান গাইছে তো?

–ওই একই কথা। ওদের গানই ধ্যান।

–তাই তো।

বুড়ি এতক্ষণে বুঝতে পারে। ঐ গানই নীতার একমাত্র অবলম্বন। অত লোকের মাঝ থেকে নীতাকে ডাকা সম্ভব হয় না। বুড়ি গফুরের সঙ্গে চলে আসে। দোতরার টুংটাং ধ্বনি ওর মনটাকে নরম করে রাখে। নীতার নির্লিপ্ত মুখটা ছবি হয়ে আটকে থাকে মনের পটে। মনে মনে বলে, নীতার বিশ্বাস, নমিতার বিশ্বাস আমার জীবনকে ভরিয়ে তুলুক।

সারাদিন মেলায় ঘোরাঘুরি করে বুড়ির মনে হয় একটা নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে। মুক্তছন্দ বিহঙ্গের মতো এমন করে কোন দিন বুড়ি নিজেকে একান্ত আপন করে পায়নি। বুড়ির নিজস্ব কতগুলো মুহূর্ত ছিল। এক একটা দিনতো ওর কাছে স্বপ্নের মতো। তাই মনে হয় আজকের এই দিনটি ওর একলার। শুধু ওর নিজের। আর কারো না। আর কোন লোকের নয়। পৌষমেলার শত শত নারী-পুরুষের অন্তরে বুড়ি কেবল নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। শুকনো ধুলো-ওড়া দিন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বাতাসের কনকনে স্পর্শ, মেলার হৈচৈ কোন কিছুই বুড়িকে ক্লান্ত করে না। ক্লান্ত হয় গফুর। ধুলোয় চোখ-মুখ ঝাঝা করে। কাশতে কাশতে গলা চিরে যায়। তাছাড়া এত লোকের ঠেলাঠেলিতে ও আরো বিরক্ত হয়ে ওঠে। শীতের মিষ্টি আমেজময় রোদও আজ কেমন। পানসে ঠেকে। মেজাজ তেতে উঠলে গফুরের শরীরের ভেতরটা রি রি করে। তবু বুড়ির অনাবিল আনন্দঘন উজ্জ্বল মুখাবয়ব গফুরকে বিমুগ্ধ করে। অনেকদিন পর বুড়ি যেন কৈশোরের লাবণ্য ফিরে পেয়েছে। আর সে কারণেই গফুর ওর মেজাজের ঘোড়াটার লাগাম টেনে রাখে। ভেবে অবাক হয় এমন তেজ বুড়ি কোথায় পেল? গফুর কেন জোর। করেও এই তেজ ধরে রাখতে পারছে না? কেন বারবার মনের সুতো ছিঁড়ে যায়?

–ওগো তুমি কি ভাব?

–কিছু না রে বুড়ি। চল ফিরে যাই।

–এখনও তো বেলা পড়েনি। বুড়ির কণ্ঠে আপত্তি।

–ছোট দিনের বেলা। ফিরতে আঁধার নামবে!

–নামুক!

বুড়ি ঘাড় বাঁকা করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। গফুর হেসে ফেলে।

–ঠিক আছে চল ভাত খাই।

রাস্তার পাশে বেড়ায় ঘেরা ছোট এক হোটেলে ঢুকে ভাত খায় দুজনে। তার পরই ঘুম পায় গফুরের। কিন্তু বুড়ির বায়না ম্যাজিক দেখবে। অগত্যা ম্যাজিকের জন্যে বসতে হয় গফুরকে। গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে ঝিমিয়ে আসে শরীর। মাঝে মাঝে বুড়ির ছেলেমানুষী হাততালি ওকে সচকিত করে তোলে কেবল।

ফেরার পথে বুড়ির চোখে ঝিলমিল করে আলোর নাচন। আলের উপর দিয়ে হাঁটা পথটুকু লাফিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যায়। বার বার পেছনে পড়ে যায় গফুর। এত ক্লান্ত ও বুঝি আর কোনদিন হয়নি। মাঠ পেরিয়ে গরুর গাড়িতে ওঠার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। গাড়ির ক্যাচর ক্যাচর শব্দের সঙ্গে শীতের রুক্ষ দিন বার বার হতাশ করে দিচ্ছিল গফুরকে। বুকের ভেতর স্বপ্নের নীল পাখিটা আর গান গায় না। গফুরের মনে হয় কি যেন এখানে রেখে যাচ্ছে। শ্রীনাইল ধাম ওর সমস্ত সুখটুকু কেড়ে রেখে ওকে দেউলে করে দিয়েছে। এখন বুড়ির দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছে ওর। যদি ব্যর্থ হয় দিন গোনার প্রহর? তাহলে সেই নিরুত্তাপ জীবনহীন বুড়িকে নিয়ে ঘর করবে কেমন করে ও? একটা আতঙ্ক বুকে তীরের মত বিধে থাকে। কোনক্রমেই তাকে আর টেনে বের করা যায়। না। গফুর উদাসী দৃষ্টি মেলে রাখে রুক্ষ মাটি, শুকনো গাছ, হলদে পাতা, বিবর্ণ ঘাসের বুকে। গরুর গাড়ির প্রাণহীন পথ চলা বুড়ির আশাহীন ভবিষ্যতের মতো।

বুড়িকে বুঝতে পারে না গফুর। বুড়ির ভাসা ভাসা চোখ দুটো কল্পনার উচ্ছ্বাসে মুগ্ধ। যেহেতু বুড়ি জাগতিক সব ব্যর্থতা ও শূন্যতাকে একপাশে রেখে সুখের খাঁচা বুনতে পারে সেহেতু ওর চোখের তারা সহজেই ভেসে ওঠে। ও এখন মরুভূমিতে স্বপ্নের ফুল ফুটিয়ে চলেছে। ক্লান্তিহীন সে উৎসবে গফুরের কোন আমন্ত্রণ নেই। গফুর এখন পথের ধারে একলা। বুড়ির উৎসবে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে–বুড়ির উল্লাসমুখর হদয়ে ময়ূর নৃত্যের মতো।

–ওগো তুমি কি খুশি হওনি? বুড়ি আচমকা প্রশ্ন করে।

–একথা কেন বুড়ি?

–তোমার চোখ-মুখ কেমন শুকনো দেখাচ্ছে?

–ও কিছু না!

গফুর হেসে সহজ হবার চেষ্টা করে। বুড়িও আর প্রশ্ন করে না।

একটু পরেই গরুর গাড়ির ঢুলুনীতে ঘুমিয়ে পড়ে ও। গফুর দ্বিধান্বিত মন নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। শ্রীনাইল ধামের বুড়ো নিমগাছের ক্ষুদ্র বিশ্বাসের অঞ্জলি কি বুড়ির অনুর্বর জীবনকে ধন্য করতে পারবে? ছয় বছরের ব্যর্থ প্রহর গোনা কি শেষ হবে? নমিতার বিশ্বাস কি বুড়ির বিশ্বাসকেও মহীয়ান করবে?

ঘুমন্ত বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে গফুর কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তাকিয়ে দেখে জনস্রোত। এখনো যাওয়া-আসা চলছে। দুদিন ধরে মেলা হবে। সবার লক্ষ্য এক–পৌষমেলা উপলক্ষে শ্রীনাইল ধাম। সবার বিশ্বাস এক বুড়ো নিমগাছে বাবার নামে সোয়া পাঁচ আনার পুঁটলি বাঁধলে আকাক্ষিত বস্তু পাওয়া যায়। কত দূর দূরান্ত থেকে লোক আসে। কত জনে সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে এই মেলার জন্যে। আশায় বুক বেঁধে রাখে। তাই ছুটছে সবাই। ছোটার শেষ নেই। আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ চাই। আকাঙ্ক্ষার পরিণতি চাই।

গফুর অনেক দূরের তাল গাছের মাথায় তাকিয়ে থাকে। ওর শরীর ভেঙে আসছে। ইদানীং কেমন চট করে ক্লান্ত হয়ে যায়। এই মুহূর্তে গফুরের বড় বেশি খুঁকো টানতে ইচ্ছে করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *