০৩. নিছক যে একটা উত্তেজনা

নিছক যে একটা উত্তেজনা বা কৌতূহলের বশবর্তী হয়েই সুশান্ত সরকার-ভিলায় এসেছিল

তা নয়।

মাস-দুই পূর্বে একটা সুইসাইডের বিচিত্র রহস্যপূর্ণ মামলার ব্যাপারে ঘটনাচক্রে সুশান্ত ও বিনয়ের বিখ্যাত সত্যসন্ধানী কিরীটী রায়ের সঙ্গে আলাপের সৌভাগ্য হয়েছিল।

সেই সময় থেকেই উভয়ের মন, বিশেষ করে সুশান্তর এই ধরনের রহস্যপূর্ণ তদন্তের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড হয়ে ওঠে।

সেই ইন্টারেস্টেই ওরা সরকার-ভিলায় এসেছিল মূলত খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

বাড়িটা সর্বসমেত দোতলা, পূর্বেই বলা হয়েছে। একতলায় খানপাঁচেক ও দ্বিতলে চারিটি ঘর।

দ্বিতলেরই দক্ষিণ প্রান্তের ঘরে বিমলের সঙ্গে সঙ্গে ওরা এসে প্রবেশ করল। সেই ঘরের মধ্যেই মৃত অবস্থায় সারদাচরণ সরকারকে পাওয়া গিয়েছে ঐদিন প্রত্যুষে।

বেশ প্রশস্ত ঘরখানি।

মেঝেতে দামী কার্পেট বিস্তৃত।

দেওয়ালে চারিদিকে দক্ষ চিত্রকরের আঁকা বিচিত্র মনোরম সব জাপানী ল্যাণ্ডস্কেপ। একধারে একটি দামী পালঙ্কে তখনও বেডকভার দিয়ে ঢাকা শয্যা।

শয্যাটি একেবারে নিভাঁজ।

ঘরের অন্য ধারে একটি ছোট রাইটিং টেবিল।

একখানা মোটা কি ইংরাজি বই ভোলা রয়েছে টেবিলের উপরে এবং তার পাশেই একটা মোটা বাঁধানো খাতা ও মুখবন্ধ একটি পাকার ঝরনা-কলম রয়েছে। তার পাশে একটি নিঃশেষিত চায়ের কাপ ও প্লেট। এবং কোরামিনের একটা শিশি।

টেবিলের উপরে টেবিল ল্যাম্পটি তখনও জ্বলছে। তার পাশেই সুদৃশ্য একটি জার্মান টেবিল ক্লক টিকটিক শব্দ করে চলেছে অন্তহীন সময়-সমুদ্রের বক্ষে যেন।

ঘরের পূর্ব দিকে ও দক্ষিণ দিকে দুটি গরাদহীন পাল্লা খোলা জানলা।

পূবের জানলার পাশেই একটি গডরেজের ছোট লোহার সিন্দুক। পালঙ্কের শিয়রের দিকে একটি টিপয়। তার উপরে একটি কাঁচের গ্লাসভর্তি জল ঢাকনি দিয়ে ঢাকা।

সারদাবাবুর মৃতদেহটা সেই রাইটিং টেবিলটারই সামনে পড়ে রয়েছে দেখা গেল এবং অল্প দূরে একটি গদি-আঁটা চেয়ার উল্টে রয়েছে মেঝেতে মৃতদেহের সামনে।

মৃতের পরিধানে পায়জামা ও গেরুয়া বর্ণের মিহি খদ্দরের পাঞ্জাবি।

একটি হাত বুকের তলায় চাপা পড়েছে, মৃতের অন্য হাতটি প্রসারিত মুষ্টিবদ্ধ।

পায়ে রবারের চপ্পল ছিল। চপ্পলজোড়া পাশে পড়ে আছে।

মৃতের মুখটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল।

প্রাণ না থাকলেও সেই মুখের প্রতিটি পেশীতে মর্মান্তিক যাতনার একটা চিহ্ন যেন সুস্পষ্ট হয়ে ছিল তখনও।

শেষ মুহূর্তের মৃত্যু-যন্ত্রণার সুস্পষ্ট চিহ্ন।

সত্যিই সে মুখের দিকে যেন তাকানো যায় না।

বিকৃত বিস্ফারিত ওষ্ঠের কষ বেয়ে লালা ও গ্যাঁজলা বেরুচ্ছে তখনও।

মৃদুকণ্ঠে সুশান্ত বিমলকে সম্বোধন করে বললে, তোর কি সত্যিই মনে হয় এটা সুইসাইড নয়?

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন? ভদ্রলোক সুইসাইডই যে করেননি বুঝলি কি করে? নিম্নকণ্ঠেই আবার প্রশ্ন করল সুশান্ত।

প্রত্যুত্তরে বিমল মৃদু পুলিসী হাসি হাসল।

চল, এখনও জবানবন্দি নেওয়া হয়নি, পাশের ঘরে বৃন্দাবনবাবু অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।

বৃন্দাবনবাবু!

হ্যাঁ, সারদাবাবুর একমাত্র ভাইপো আর কলকাতা বোম্বাই ও দিল্লীর সরকার ব্রাদার্স বিরাট প্রতিষ্ঠানটির এবং কলকাতা ও এখানকার বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশন ও বর্তমান মালিক।

কেন, আর কেউ ওয়ারিশন নেই বুঝি?

এখন পর্যন্ত তো তাই শুনছি। এখন দেখা যাক, জবানবন্দি থেকে কিছু জানা যায় কিনা।

চল চল! সুশান্ত বলে!

সকলে এসে পাশের ঘরে ঢুকল। নাতিপ্ৰশস্ত ঘরটি। এবং ঐ ঘরটিই ছিল মৃত সারদাবাবুর প্রিয় লাইব্রেরী বা গ্রন্থাগার।

চারিদিকে সুদৃশ্য সোকেসে থাকে থাকে সব বই সাজানো। অসংখ্য বই।

এ ঘরেও সুদৃশ্য কার্পেট বিছানো এবং ঘরের মধ্যস্থলে খান-দুই আরামকেদারা ও একটি গোলাকার নিচু টেবিল।

একটি আরামকেদারার উপরেই বসেছিলেন বৃন্দাবন সরকার।

সকলে ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন।

বয়স ত্রিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে হবে বলেই চেহারা দেখে মনে হয় ভদ্রলোকের।

তবে বেশ হৃষ্টপুষ্ট-যাকে বলে গোলগাল চেহারা।

গৌরবর্ণ। পরিধানে ধপধপে দামী কাঁচির ধুতি ও গায়ে দামী একটা শাল জড়ানো। পায়ে দামী চপ্পল।

মাথার চুল রুক্ষ এলোমেলো। মুখে একদিনের দাড়ি। বোঝা যায় তখনো ক্ষৌরকর্ম সমাধান হয়নি।

বসুন, বসুন বৃন্দাবনবাবু। আমাদের কথাবার্তা বসে বসেও চলতে পারে। বিমল বললে।

বৃন্দাবন আর দ্বিরুক্তি না করে পুনরায় সোফার উপরে বসে পড়লেন তখুনি।

এবং বিমলই অতঃপর প্রশ্ন করতে শুরু করে বৃন্দাবনবাবুকে।

আপনি কি এখানেই বরাবর থাকেন?

না। তবে প্রায় প্রতি হপ্তায়ই আসি। পরশু রাত্রে গাড়িতে এসেছিলাম, আজই সকালে আমার কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছিল।

ও। আচ্ছা আপনার কাকামশাইয়ের মৃত্যুটা আপনার কি বলে মনে হয় মিঃ সরকার?

কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না দারোগাবাবু! ব্যাপার যা দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে সুইসাইডই করেছেন। কিন্তু–

কি?

তাঁর মত লোক সুইসাইড করতে পারেন অ্যাটঅল, আমার চিন্তারও অতীত। তাছাড়া সুইসাইডই বা তিনি করতে যাবেন কেন এ বয়সে, কোন হেতুই তো ছিল না।

আপাতদৃষ্টিতে সেটা আমাদের চোখে না পড়লেও একেবারে যে থাকতে পারেই না তাও তো নয় মিঃ সরকার। গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল বিমল।

তা অবিশ্যি ঠিক। তবে—

তাছাড়া উনি সুইসাইডই যে করেছেন, তাই বা আমরা ধরে নিচ্ছি কেন মিঃ সরকার।

কি বলতে চান আপনি? কথাটা বলে উৎকণ্ঠিত ভাবে তাকালেন বৃন্দাবন সরকার বিমলের মুখের দিকে।

হ্যাঁ, এ কেস অফ হোমিসাইডও তো হতে পারে। তাঁকে কেউ হত্যাও তত করে থাকতে পারে।