০৩. দীপ্তেনের সঙ্গে মালঞ্চর আলাপ

আজ এক বছর ধরে দীপ্তেনের সঙ্গে মালঞ্চর আলাপটা জমে উঠেছে। গত বছর মার্চে সে আর সুরজিৎ পুরী গিয়েছিল কয়েক দিনের জন্যে, সেই সময়ই একদিন সী বীচে। দীপ্তেনের সঙ্গে মালঞ্চর আলাপ হয়।

বছর বত্রিশ তেত্রিশ বয়স হবে দীপ্তেনের, লম্বা চওত বলিষ্ঠ চেহারা। এখনো বিয়েথা করেনি, ব্যাচেলার। বিলেত থেকে কি সব ম্যানেজমেন্ট না কি পড়ে এসেছে। একটা বড় ফার্মে বেশ মোটা মাইনের চাকরি করে।

দীপ্তেন ভৌমিককে দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিল মালঞ্চ, দীপ্তেনও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। আলাপ ঘনীভূত হয় কলকাতায় এসে, আজ প্রায় মাস ছয়েক হল। দুপুরে মাঝে মধ্যে তার ওখানে আসতে শুরু করে দীপ্তেন।

একদিন দীপ্তেন হাসতে হাসতে বলেছিল, তোমার স্বামী যদি টের পেয়ে যান?

–এ সময় তো সে থাকে না।

—আরে সেইজন্যেই তো আমি এ সময় আসি, তাহলেও টের পেয়ে গেলে—

সুরজিৎ আমার স্বামী নয় দীপ্তেন— দীপ্তেন তো কথাটা শুনে একেবারে বোকা। বলেছিল, কি বলছ তুমি।

—ঠিকই বলছি—

—তবে সুরজিৎ ঘোষালের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?

–We are friends. Just friends!

–ফ্রেন্ডস্!

–হ্যাঁ।

—তাহলে তোমার স্বামী? তুমি তো বিবাহিতা?

–তাই, কিন্তু সে থেকেও নেই।

—এ বাড়িটা তবে কার?

সুরজিৎ আমাকে কিনে দিয়েছে। আমার। দীপ্তেন মৃদু হেসেছিল মাত্র, তারপর একটু থেমে প্রশ্ন করেছিল, সুরজিঃ ঘোষালের সঙ্গে তোমার আলাপ হল কি করে?

–হয়ে গেল।

—কত দিন হবে?

—তা অনেক দিন হল। তারপরই মালঞ্চ বলেছিল, ও একটা ফার্মের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। ওর স্ত্রী আছে, দুটি ছেলে আছে। বড় ছেলে যুধাজিতের বয়সই তো প্রায় ছাব্বিশ—কথাগুলো বলে হাসতে থাকে মালঞ্চ।

—যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল-দীপ্তেন বলেছিল।

দীপ্তেনের একটা তীব্র আকর্ষণ আছে, সে আকর্ষণকে এড়াতে পারেনি মালঞ্চ। তাছাড়া মালঞ্চ নিশ্চিত ছিল সুরজিৎ ব্যাপারটা কিছুতেই জানতে পারবে না। মানদা বা রতন কিছু বলবে না, কারণ যাতে না বলে সে ব্যবস্থা মালঞ্চ করেছিল আর নীচের তলায় থাকলেও স্বামী সুশান্ত কিছুই বলবে না। কারণ সুরজিতের সঙ্গে সে কথাই বলে না।

তবু দীপ্তেন একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল, ঐ বুড়ো ভাল্লুকটাকে তুমি কি করে সহ্য কর মালঞ্চ?

—ছিঃ, ও কথা বলতে নেই।

–ও তো তোমার বাপের বয়সী।

—তাহলেও সব কিছু আমাকে সে-ই দিয়েছে।

—এ সব ছেড়ে দাও, চলে এসো তুমি আমার পাশের ফ্ল্যাটে, ফ্ল্যাটটা খালি আছে।

–কেন, তোমার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে এখানে?

—অসুবিধা হচ্ছে বৈকি। আমি তোমাকে একান্ত ভাবে পেতে চাই মালা, একমাত্র আমারই হয়ে থাকবে তুমি।

—সেটা কি নিদারুণ একটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে না দীপ্তেন? যে লোকটা এত দিন ধরে আমাকে এত সুখ, প্রাচুর্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে রেখেছে, বাড়ি গাড়ি সব কিছু দিয়েছে

—আপাতত বাড়ি গাড়ি না দিতে পারলেও, স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম আমিও তোমাকে দিতে পারব মালঞ্চ। চল তুমি আমার সঙ্গে, অবিশ্যি সুরজিৎবাবুকে বলেই যাবে, না বলে তোমাকে যেতে বলছি না আমি।

—সেটা কি ভাল হবে দীপ্তেন?

—কেন ভাল হবে না? জানি না কি পেয়েছ তুমি ঐ বুড়ো ভাল্লুকটার মধ্যে।

দীপ্তেন জানত না এ সংসারে এমন মেয়েমানুষও আছে যাদের কাছে দৈহিক আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য ও সাচ্ছল্যটাই সব কিছু এবং তার জন্যে নিজেদের বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করে না। স্বামীর কাছ থেকে সেটা পাবার কোন আশা ছিল না বলেই মালঞ্চ সুরজিৎকে আঁকড়ে ধরেছিল। দেহ ও রূপ যৌবন তাদের কাছে কিছুই না, উচিত মূল্য পেলে তারা সবকিছুই করতে পারে।

মিনিট কুড়ির মধ্যে দীপ্তেন এলো। রাত তখন পৌনে আটটা।

—একটা প্রেজেন্টেশন এনেছি তোমার জন্যে দীপ্তেন হাসতে হাসতে বলল।

–সত্যি কি?

—Just guess, বল তো কি হতে পারে?

—কেমন করে বলব বল। পকেট থেকে দীপ্তেন একটা মরক্কো লেদারের ছোট বাক্স বের করল। বোতাম টিপতেই বাক্সের ডালাটা খুলে গেল—ভিতরে একটা মুক্তোর নেকলেস।

—দেখি, দেখি—how lovely! দাও, পরিয়ে দাও।

দীপ্তেন মুক্তোর নেকলেসটা মালঞ্চর শঙ্খের মত গ্রীবায় পরিয়ে দিল।

You are really sweet দীপ্তেন। মালঞ্চ দুহাতে দীপ্তেনকে জড়িয়ে ধরল। ঐ সময় সুরজিতের গাড়ির হর্ন শোনা গেল।

—সর্বনাশ! সুরজিতের গাড়ির হর্ন! মালঞ্চ বলল, দীপ্তেন, শীঘ্রি তুমি বাথরুমের পিছনের দরজা খুলে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাও।

—আসতে দাও সুরজিৎবাবুকে। তুমি তো পারবে না, আজ আমিই এর চূড়ান্ত ফয়সালা করে নেব—

-না না, তুমি যাও। কেন বুঝতে পারছ না দীপ্তেন, সুরজিৎ তোমাকে এখানে দেখলেই–

-দেখুক না। তোমার ওপর তারও যেমন অধিকার আছে, আমারও ঠিক তেমনি অধিকার আছে।

—দীপ্তেন, কি করছ! যাও প্লীজ।

-–ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। কিন্তু একজনকে তোমাকে বেছে নিতে হবে মালঞ্চ—হয়। সুরজিৎ ঘোষাল, না হয় দীপ্তেন ভৌমিক—দুজনের সঙ্গে তুমি খেলা চালিয়ে যাবে তা দীপ্তেন হতে দেবে না, বুঝেছ? কথাগুলো বলে দীপ্তেন বাথরুমের মধ্যে ঢুকে গেল। যাওভার সময় হাতের সিগ্রেটটা অ্যাশট্রের মধ্যে ঘষে দিয়ে গেল। সিঁড়িতে তখন সুরজিতের জুতোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।

মালঞ্চ সুরজিৎ সম্পর্কে একটু ভুল করেছিল। সে ভেবেছিল তার আর দীপ্তেনের গোপন মিলনের ব্যাপারটা সুরজিৎ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না। জানবার একমাত্র উপায় মানদা আর রতন, কিন্তু টাকার লোভে তারা সুরজিতের কানে কথাটা তুলবে না।

কিন্তু তার ঐখানেই হিসেবে ভুল হয়েছিল। রতন বলেনি কিন্তু মানদা সুরজিতের কানে কথাটা আকারে ইঙ্গিতে তুলে দিয়েছিল, সুরজিতের ইদানীং ভাবান্তরের কারণও তাই। সেটা মালঞ্চ অনুমানও করতে পারেনি।

কিন্তু সুরজিৎ মুখে কিছু প্রকাশ করেনি, তক্কে তক্কে ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। তবু দীপ্তেনকে ধরতে পারেনি সুরজিৎ, কারণ দীপ্তেন এমনই সময় আসত যখন সুরজিতের আসার সম্ভাবনা নেই। দু-একবার তথ্যপি সে surprise visit দিয়েছে, তবু দীপ্তেনকে ধরতে পারেনি মালঞ্চরই সাবধানতার জন্য।

আজ ঘরে ঢুকেই সুরজিৎ থমকে দাঁড়াল। মালঞ্চ সুরজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে মদির কটাক্ষে মুখে মৃদু হাসি টেনে বলল, কি সৌভাগ্য, আজ একেবারে নির্ধারিত সময়ের আগেই?

–আগে এসে পড়ে তোমার অসুবিধা ঘটালাম মালঞ্চ?

–কি যা-তা বলছ সুরজিৎ? জানো, আজ মার্কেট থেকে মটন এনে আমি নিজে স্টু বেঁধেছি তোমার জন্যে, সঙ্গে কি খাবে বল—পরটা না লুচি? কি হল, অমন ভূতের মত দাঁড়িয়ে রইলে কেন—পোশাক ছাড়বে না?

–বাঃ, তোমার হারটা তো চমৎকার-সুরজিৎ ঘোষাল বলে ওঠে।

–আমার গলায়! সঙ্গে সঙ্গে হারটার কথা মনে পড়ে যায় মালঞ্চর, মুখের হাসি তার। উবে যায়।

—তা কিনলে বুঝি হারটা—না কোন প্রেমিকের প্রেমোপহার?

—ছিঃ সুরজিৎ, তোমার মন এত ছোট! হারটা আমি আজই কিনে এনেছি।

—কোন্ দোকান থেকে কিনলে? সাচ্চা মুক্তো বলেই যেন মনে হচ্ছে—বলতে বলতে হঠাৎ সুরজিতের নজর পড়ে সামনের ত্রিপয়ে অ্যাশট্রেটার ওপর।

এগিয়ে গেল সুরজিৎ–অর্ধদগ্ধ, দুমড়ানো সিগ্রেটটা অ্যাশট্রে থেকে তুলে নিল। তারপর শান্ত গলায় সুরজিৎ বলল, দীপ্তেন ভৌমিক কখন এসেছিল মালঞ্চ?

–দীপ্তেন ভৌমিক!

—আকাশ থেকে পড়ার ভাব কোরো না মালঞ্চ, ব্যাপারটা আমার কাছে আর গোপন নেই।

–কি গোপন নেই।

—তুমি যে বেশ কিছুকাল ধরেই দীপ্তেন ভৌমিকের সঙ্গে মাতামাতি করছ—আমি সেটা জানি।

হঠাৎ সোজা ঋজু হয়ে দাঁড়াল মালঞ্চ। বলল, হ্যাঁ, এসেছিল।

-কেন, কেন সে এখানে আসে?

–কৈফিয়ৎ চাইছ?

—চাওয়াটা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়।

—কিন্তু ভুলো না সুরজিৎ, আমি তোমার বিয়ে করা স্ত্রী নই।

–জানি, তুমি আমার রক্ষিতা।

–ভদ্রভাবে কথা বল সুরজিৎ।

–ভদ্রভাবে কথা বলব কার সঙ্গে, তোমার সঙ্গে—একটা হার্লটের সঙ্গে?

—Shut up!

—হারামজাদী, তুই আমারই খাবি, আমারই ঘরে থাকবি, আর–

—বের হয়ে যাও—মালঞ্চ চিৎকার করে ওঠে, এই মুহূর্তে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও সুরজিৎ-এটা আমার বাড়ি।

সুরজিতের বোধহয় মনে পড়ে যায় যে বৎসর খানেক পূর্বে পাকাপোক্তভাবে বাড়িটার দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়ে গিয়েছে মালঞ্চর নামে।

তাই বলে, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। কিন্তু তোকেও আমি ছেড়ে দেব না হারামজাদী, গলা টিপে তোকে আমি শেষ করে দেব—মুহূর্তে সুরজিৎ ঘর থেকে হনহন করে বের হয়ে গেল।

রাগে মালঞ্চ তখন ফুসছে।

একটু পরেই মানদা এসে ঘরে ঢুকল।—কি হয়েছে মা, বাবু চলে গেলেন?

—নীচের দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা আমায় এনে দে মানদা!

—কিন্তু নীচের বাবু যদি ফিরে আসেন?

-–ঠিক আছে, হ্যাঁ। আর হ্যাঁ, শোন, ঐ নীচের বাবু এলে আমাকে জানাবি।