০৩. টিফিন পিরিয়ডে একটা ছেলে

টিফিন পিরিয়ডে একটা ছেলে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে চীনেবাদাম খাচ্ছিল। বাদাম দেখে জিভেয় পানি এসে যায় আনুর। সকালে স্কুলে আসবে বলে দুআনা পয়সা আদায় করেছিল।

ভাবলো, দুপয়সার বাদাম কিনলে মন্দ হয় না।

উঠতে যাবে, তার আগেই ছেলেটা তাকে বলে, বাদাম খাবে?

বলেই একমুঠো বাদাম তুলে দেয় তাকে। আনুর লজ্জা করতে থাকে। সে তো নিজেই কিনতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার কোনো কথাই শোনে না ছেলেটা। তাকে বাদাম দিয়ে বলে, খাও না। আমার মেলা অছে।

অল্পক্ষণের মধ্যে ভাব হয়ে যায় তার সঙ্গে। বেশ নাম—-পিন্টু। তার সঙ্গেই পড়ে। আনু জিগ্যেস করে, তোমার বাবা কি করে?

জুট মার্চেন্ট।

মানে?

বাবার বিরাট পাটগুদাম আছে। কত দূর দূর দেশে বাবা পাট পাঠায়। অস্ট্রেলিয়া, বিলাত, কলকাতা, ঢাকা। তিনটে চারটে মালগাড়ি ভর্তি।

আনুর খুব মজা লাগে। দূর দেশের কথা শুনে সারা গায়ে রোমাঞ্চ কাঁচা হয়ে ফুটে ওঠে। ঘন হয়ে বসে আনু। পিন্টুর হাতে হাত রেখে শুয়ে, তোমার বাবা যায় বিলাতে?

নাহ্।

তখন মনটা নিভে যায় আনুর।

কেন?

বাবা যাবে কেন? রেলগাড়িতে পাট নিয়ে যায়, সেখান থেকে জাহাজে করে চলে যায়। বাবার এখানে কত কাজ।

তবু খুশি হয় না আনু। পিন্টুর বাবা পাট পাঠায় আর নিজে যেতে পারে না? আনু যদি ও রকম হতো তাহলে নিজেই যেত জাহাজে চড়ে। চুপ করে বসে থাকে সে। বসে বসে ভাবতে থাকে। ছবির বইতে দেখেছিল সমুদ্রের জাহাজ, সেই জাহাজ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

হঠাৎ বলে, আবার জলদস্যুরা জাহাজ আক্রমণ করে, না পিন্টু?

পিন্টু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, দূর, ওসব খালি গল্পের বইয়ে লেখে। সায়েবরা কামান দিয়ে কবে সব জলদস্যুদের মেরে ফেলেছে।

সব মেরে ফেলেছে?

আনুর যে বিশ্বাসই হতে চায় না।

হ্যাঁ, সব। পিন্টু সবজান্তার মতো উত্তর দেয়। বাদামের খোসাগুলো কোল থেকে ঝেড়ে ফেলে। তারপর আচমকা বলে, তোমার চেহারাটা ঠিক মেয়েদের মতো।

যাহ।

কান পর্যন্ত লাল হয়ে যায় আনুর। কি যে বলে পিন্টু! তার চেহারা মেয়েদের মতো কে বলেছে? আয়নায় সে বুঝি দেখে নি? পিন্টু ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, তুমি আর আমি বন্ধু, কেমন?

আচ্ছা।

আর কারু বন্ধু হতে পারবে না কিন্তু।

আনু কিছু বলে না। তার কাঁধে ধাক্কা দেয় পিন্টু, কি?

আচ্ছা।

তোমার ক ভাই বোন?

আমরা দুভাই পাঁচ বোন। ভাই বোন সব আমার বড়।

পাঁচ বোন!

 পিন্টু তার কথার প্রতিধ্বনি করে। বলে, বিয়ে হয় নি?

না।

তাহলে খুব মজা তোমার বোনের, না?

বলে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে থাকে পিন্টু। হঠাৎ গা জ্বালা করে আনুর। পিন্টু আবার বলে, ভালোবাসে না তোমার বোনেরা? চিঠি লেখে না?

আনুর ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে পিন্টু।

দূর লজ্জা কি? আমার বোনের চিঠি কত নিয়ে যাই। মাসুদ ভাই আছে, বাবার গদিতে কাজ করে, আমাকে আট আনা করে পয়সা দেয়।

দিক্‌ গে।

বারে, মেয়েরা তো ঐ জন্যেই সাজে, গালে পাউডার মাখে, ফিতে বাঁধে। দূর বোকা!

হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আনু। তারপর কেউ কিছু ঠাহর করবার আগেই ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় পিন্টুকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, শয়তান। অসভ্য।

মাটিতে পড়েই পিন্টু বোকা হয়ে যায়। একমুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আনুর দিকে। তারপর উঠে গা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, যা, আজ কিছু বললাম না। এর শোধ নেবো দেখিস। তোর বোনেরা কত সাধু আমি খুব জানি।

অবাক হয়ে যায় আনু। এ একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা তার। কখনো কখনো দারোগার ছেলে বলে তাকে ছেলেরা খ্যাপাতো, তার সঙ্গে মিশতে বারণ করে দিত অনেকে, কিন্তু বোনের কথা তুলে এরকম বিচ্ছিরি কথা কেউ বলেনি। মহিমপুরে এসে অবধি স্কুলে ভর্তি হবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল সে, ভেবেছিল নতুন বন্ধু করবে, মনটা আনন্দে ভরে ছিল। এই নাকি এখানকার ছেলেরা!

আনুর কান্না পায় ভীষণ। সে ক্লাশে গিয়ে পেছনের বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকে। সারাটা ক্লাশ খালি। টিফিনে গেছে সবাই। বুকের মধ্যে হু–হুঁ করতে থাকে তার। আবার ভয় করতে থাকে, পিন্টু যদি তাকে হঠাৎ মার দেয়, লাল খাতায় যদি নাম উঠে যায় আনুর।

.

ঢং ঢং করে টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়ে। হুড়মুড় করে ছেলেরা ঢুকতে থাকে ক্লাশে। আনু নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসে। চোখ রাখে একেবারে সোজা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে! কোনোদিকে তাকাবে না সে। আবছা দেখতে পায়, পিন্টু এসে সেকেণ্ড বেঞ্চে বসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে আরো দুজন ছেলে ঘুরে দেখলো আনুকে। আনু বইয়ের পাতায় চোখ। নামালো তাড়াতাড়ি। ওরা কি বলাবলি করছে কে জানে। ভূগোলের স্যার এসে ঢুকলেন। সবাই উঠে দাঁড়াল।

ভূগোল পড়তে এত ভালো লাগে আনুর! সালু আপার ভূগোল বই নিয়ে সে পড়ে ফেলেছে। সেখানে আফ্রিকার কথা, এশিয়ার কথা, অগ্নিগিরির নাম কত কি আছে। এখানে খালি রংপুর জেলার ভূগোল। একটুও মজা লাগে না আনুর। পাশের ছেলের বইটা ভাগ করে দেখতে থাকে আনু।

স্যার একটা ছেলেকে বলেন এই তুমি। রিডিং পড়ো। আজ কোথা থেকে পড়াবার কথা ছিল?

খসখস করে সার ক্লাশে পাতা উল্টানোর শব্দ ওঠে। আরেকটা ছেলে বলে, এখান থেকে। স্যার। মহিমপুরের পাশ দিয়া ধরলা নদী প্রবাহিত হইয়াছে।

হ্যাঁ পড়ো।

ছেলেটা দাঁড়িয়েই ছিল। সে তখন আবৃত্তির ঢং–এ গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পড়তে থাকে।

মহিমপুরের পাশ দিয়া ধরলা নদী প্রবাহিত হইতেছে। এঁ-এঁ-এঁ ধরলা নদী তিস্তা নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে। এঁ-এঁ-এঁ-

আনু পাশের ছেলেটার বইয়ে চোখ রেখে মনে মনে পড়ে যায়। পড়তে পড়তে এগিয়ে যায় অনেকদূর। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক জায়গায় লেখা রয়েছে, শীতকালে যখন বাতাস স্বচ্ছ থাকে তখন প্রত্যুষে ধরলা নদীর পাড় হতে উত্তরে হিমালয় পর্বত ও পূর্বে গারো পাহাড় দেখা যায়। হিমালয় পর্বতের বিখ্যাত গিরিশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা মহিপুর হইতে দৃষ্টিগোচর হয়। বইয়ের পাতায় নিবিড় হতে থাকে আনুর মন। কাঞ্চনজঙ্ঘা! এতদিন সে নামই শুনে এসেছে; এখান থেকে দেখা যায় নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা? মনে মনে হিসাব করে দেখে শীত আসতে এখনো দুমাস বাকি। দুমাস তাকে বুক বাধতে হবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবার জন্যে। বাবাকে গিয়ে আজই এই খবরটা দেবে আনু।

 পড়া একবর্ণ আর তার মাথায় যায় না। পাহাড় সে কখনো দেখেনি। পাহাড়ের কল্পনা তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে।

এক সময়ে ভূগোলের ক্লাশ শেষ হয়ে যায়। তারপরে আসে স্বাস্থ্যের স্যার। স্বাস্থ্য পড়তে একেবারে জলো লাগে না আনুর। তার হাই ওঠে। হাই তুলতে গিয়ে ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকায়। আর পাশের ছেলেটা তখন বলছিল, এখানে নাকি খুব শাস্তি দেয়। আনু নিজেও হেডমাস্টারের রুমে এক গোছ বেত দেখে এসেছে। সোজা হয়ে শিষ্ট চেহারা করে আনু বসে।

স্বাস্থ্যের স্যার দেখতে রোগা পাতলা, একেবারে একটা কাঠির মতো। মনে হয় বাতাসে হেলে পড়েছেন সামনে। দাঁতগুলো বড় বড় আর বিশ্রী ফাঁক মাঝে মাঝে। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। নাম শুনলো, সুরেন বাবু।

স্যার ক্লাশে ঢুকেই ‘:’ করে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করলেন। তারপর চেয়ারে বসে দুপা। টেবিলে তুলে এপকেট ওপকেট হাতড়াতে লাগলেন। বেরুলো একটা নস্যির কৌটা আর নাকের ময়লা ভর্তি লালচে ভিজে জবজবে এক ফালি ন্যাকড়া। ফস্ করে নাকে নস্যি দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে নাক টিপে ধরে প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন সুরেন স্যার।

কাণ্ড দেখে প্রায় হেসেই ফেলেছিল আনু। পাশের ছেলেটা বলল, স্যার কিন্তু খুব রাগী। শুনে তাড়াতাড়ি মুখ শুকিয়ে ফেলল আনু। সুরেন স্যার হুংকার দিয়ে ডাকলেন, এইও। ইদিক আয়।

পয়লা বেঞ্চের পয়লা ছেলেটা ঠোঁট কান পর্যন্ত ফাঁক করে দাঁত দেখাল। চশমার ভেতর দিয়ে পিটপিট করে দেখলেন তিনি। তারপর বেত দুলিয়ে আবার হুকুম করলেন, জিহ্বা। আনুর আবার হাসি পাচ্ছিল জিউভা উচ্চারণ শুনে, কিন্তু জোর সামলে নিয়েছে সে।

জিভ দেখে কোনো খুঁত পেলেন না স্যার। বললেন, যা। নেকস্ট। পরের ছেলেটা উঠে গেল।

আনু ফিসফিস করে জিগ্যেস করলো, সবার দাঁত জিভ দেখবে নাকি ভাই?

হ্যাঁ।

রোজ দেখে?

না। প্রত্যেক বিষুৎবারে।

ভাগ্যিস আনু আজ নতুন স্কুলে আসবে বলে নিমডাল দিয়ে কষে দাঁতন করেছিল! জিভেটায় না জানি কত ময়লা পড়ে আছে। জিভ কোনদিন সাফ করেনি আনু। পানু ভাইকে দেখতে সে পিতলের একটা দুলুনি দিয়ে একেক দিন সকালে ময়লা কেটে ফেলতে। আনুর পা কাঁপতে লাগল ভয়ে। পয়লা দিনই মার খাবে নাকি স্যারের হাতে।

এতক্ষণে সেই পিন্টুর পালা এসেছে।

দাঁত।

দাঁত বার করলো পিন্টু। সপাং করে বেত পড়ল তার পাছায়।

হারামজাদা, কচুবনে কচু খাও গিয়ে? মায়ে ভাত দেয় না? দাঁত এত হলদে কেন? কেন?

একবার করে কেন বলেন আর একটা করে বেত লাগান সুরেন স্যার। সঙ্গে সঙ্গে তিড়তিড় করে ওঠে পিন্টু। আড়চোখে সে আনুকে দেখে। আনুর কেন যেন কষ্ট হয়। টিফিনে ঝগড়া। হয়েছে, তবু। চট করে চোখ নামিয়ে নেয় সে। পিন্টুর আর জিভ দেখা হয় না। শেষ একটা বেত লাগিয়ে সুরেন স্যার বলেন, গো ব্যাক। নেস্ট।

এক এক করে এক সময়ে আনুর ডাক পড়ে। সে মাথা নিচু করে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছু বলবার আগেই দাঁত বার করে। সুরেন স্যার বেত দুলিয়ে বলেন, মুখ না তুললে কি পিড়ি পেতে তোমার দাঁত দেখব?

চট করে মুখ তোলে আনু। চোখটা আপনা থেকেই বুজে আসে তার। গম্ভীর একটা আওয়াজ শুনতে পায়, হুঁ। জিভ। বেত লাগাবার সুযোগ না পেয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে বুঝি স্যারের। জিভ দেখি।

দেখাল আনু।

হঠাৎ সুরেন স্যার চোখ পিটপিট করলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে শুধোলেন, এটা কে র‍্যা? ক্লাশের মনিটর দাঁড়িয়ে বলল, নতুন ভর্তি হয়েছে স্যার।

তোমাকে জিগ্যেস করিনি স্যার। সিট ডাউন।

ম্যাজিকের মতো বসে পড়ল মনিটর ছেলেটা। আনুর পিলেও চমকে গিয়েছিল স্যারের সিট ডাউন চিৎকার শুনে। দরদর করে ঘামতে লাগল সে।

নাম কী?

আনোয়ার হোসেন।

বাবা কী করে?

বড় দারোগা। দাঁ

ত মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন সুরেন স্যার। দারোগার ছেলে, ঘোড়ার মত স্বাস্থ্য হবে এরকম লাউডগাটি হয়েছেন কেন? লেখাপড়ায় কেমন?

কী বলবে আনু। চোখ তুলে স্যারকে একবার দেখে আবার মাথা নিচু করে থাকে। সুরেন স্যার হঠাৎ জিগ্যেস করেন, আচ্ছা শুনি, বিশুদ্ধ জল কেমন?

বিশুদ্ধ জল? ঢোঁক গেলে আনু।

আজ্ঞে হাঁ। বলুন।

আনু ভারী অস্বস্তিবোধ করতে থাকে তাকে এই ঠাট্টা করে আপনি বলায়। কেন যেন রাগ হয় তার। উত্তরটা জানাই ছিল। চালাকি নাকি? চট করে সে জবাব দেয়, বিশুদ্ধ জলের কোনো বর্ণ নাই, স্বাদ নাই।

কিন্তু তাতেও খুশি হলেন না স্যার। এমনিতেই রোগ মানুষ, তার ওপর যখন দাঁত খিচোন মনে হয় দাঁত সর্বস্ব শরীর। আর সবচে শকিল ইলশেগুঁড়ির মতো থুতু ছিটোতে থাকে। থুতু ছিটিয়ে স্যার বলেন, আর গন্ধ! বিশুদ্ধ জলে পচা ভাগাড়ের গন্ধ থাকবে বুঝি?

আনু তাড়াতাড়ি যোগ করে, গন্ধও নাই।

বেতের ইশারায় তাকে ফিরে যেতে বললেন স্যার। আবার হাঁক পাড়লেন, নেকস্ট।

এমনি করে পিরিয়ড শেষ হলো। পাশের ছেলেটা বলল, এই স্যার কিছু পড়ায় না ভাই। খালি এই রকম করে।

সুরেন স্যার চলে যেতেই হি–হি করে হাসতে লাগল আনু। এতক্ষণের সব হাসি ফিনিক দিয়ে ছুটছে তার। উলটো বুঝলো পিন্টু। সে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে ঘোষণা করল, তোর পাছায় যেদিন বেত লাগাবে স্যার আমিও দাঁত বার করে হাসবো। হ্যাঁ।

শেষ পিরিয়ড। ড্রয়িং স্যার এসে ঢুকলেন। ফর্সা চৌকো চেহারা। সরু করে ছাঁটা গোঁফ। ধবধবে সাদা শার্ট গায়ে। হাসি হাসি মুখ। আনুর খুব ভালো লাগল।

স্যার বসতে বললেন সবাইকে। তারপর বোর্ডে অনেকক্ষণ ধরে একটা বিরাট আমপাতা আঁকলেন—-মাঝখানে ভাঁজ করা, পাতাটা দেখতে হয়েছে ইংরেজি ভি–এর মতো। সুন্দর হলো দেখতে, যেন সত্যি আমপাতা। একবারও মুছলেন না, ভুল হলো না—-একটানে এঁকে ফেললেন। তার হাতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আনু।

আঁকা শেষ হলে ছেলেদের তিনি বললেন, আমপাতা। চিনতে পারছো?

সমস্বরে সবাই বলে উঠল, হ্যাঁ।

এবার দেখে দেখে আঁকো। যার আগে হবে তার আগে ছুটি।

সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই খাতার পাতায়। স্যার চেয়ারে বসে একটা বই খুলে পড়তে লাগলেন।

দুমিনিটে আঁকা হয়ে গেল আনুর। তখনো কারো হয়নি, তাই খাতাটা প্রথমে সে স্যারের কাছে নিয়ে যাবে, কেমন সংকোচ করল তার। সে চুপ করে বসে রইলো। তারপর দুতিন জন যখন খাতা দেখিয়ে বাড়ি চলে গেল তখন আনু উঠে দাঁড়াল।

স্যার তার খাতা দেখেই মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, বাহ্ তোমার আঁকবার হাত ভারী সুন্দর। নতুন ভর্তি হয়েছ? প্রশংসা শুনে লাল হয়ে ওঠে আনু। স্যার কি জানবে, আনু আরো কত কি আঁকে। সালু আপা মিনু আপা সবাইকেও ফুল পাতা না কত কী একে দেয় এমব্রয়ডারী করবার জন্যে। তার নসার ওপর ডি–এম–সি সুতো দিয়ে ওরা যখন নক্সাগুলো বিচিত্র বর্ণে ফুটিয়ে তোলে, এত চমৎকার লাগে দেখতে। মনেই হয় না তার নিজের আঁকা।

দশের মধ্যে সাত নম্বর দিলেন স্যার। তার খাতাটা ক্লাশের সবাইকে দেখালেন। বললেন, তুমি আঁকবে আনু, রং দিয়ে এরপর থেকে আঁকবে। আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব। আচ্ছা।

আনু আজই গিয়ে বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে রং–এর বাকস কিনে আনবে। তার ভারী উৎসাহ লাগে। স্কুল থেকে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তাকে ছুটি দিয়ে দেন ড্রয়িং স্যার।

ক্লাশ থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, দারোয়ান বিল্টু বারান্দায় ঘণ্টার নিচে বসে বসে ঝিমুচ্ছে, কয়েকটা ক্লাশ ছুটি হয়ে গেছে আগেই, বেঞ্চগুলো খা খা করছে, টিউবওয়েল থেকে একটা ধুলোমাখ; বুড়ো লোক পানি টিপে খাচ্ছে। আনু দেখে জামরুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসিন সেপাই, তাকে নিয়ে যাবার জন্যে।

বারে, বাবাকে বললাম না, আমি একাই যেতে পারবো। ইয়াসিনকে দেখে আনু বলে ওঠে। তার হাত থেকে বই–খাতা নিয়ে ইয়াসিন হেসে বলে, হাঁ, হাঁ হামি মনে করলাম কে বড়সাবকে নিয়ে আসি।

আনুর ভারী মজা লাগে। বলে, তুমি আমাকে বড় সাব বলো কেন, ইয়াসিন?

আপনি যে বড় সাব আছেন, খোকাবাবু।

যাঃ!

হাঁ হাঁ, আপনি ভি বড় সাব হবেন। থানা মে বসবেন। হামি আপনার ঘোড়া দেখব, হাঁ।

লাল কাঁকর বিছানো টানা সড়ক দিয়ে হাঁটতে থাকে আনু। দুধারে প্রকাণ্ড গেটের মতো আড় হয়ে গাছের মাথাগুলো জড়াজড়ি করে আছে। যতদূর দেখা যায়, ভারী সুন্দর লাগছে। একেবারে শেষ মাথায় কার যেন একটা সাদা বাড়ি ছবির মতো দেখা যাচ্ছে। একটা টমটম চলে গেল টকটক টকাটক করতে করতে। আনু বলে, ইয়াসিন, তুমি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছ?

ইয়াসিন বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আনুর দিকে।

দূর, তুমি কিছু জানো না।

আপশোস করে ইয়াসিন বলে, আপনার মতো লেখাপড়া করলে তো জানবো খোকাবাবু। হামি তো জাহেল আছি।

হঠাৎ মনে পড়ে যায় আনুর। জিগ্যেস করে, ইয়াসিন, বাবা মফস্বলে চলে গেছে?

হাঁ, দুপুরে তো গেলেন।

মনটা ম্লান হয়ে যায় আনুর। এতক্ষণ এই কথাটা তার মনেই ছিল না। ভাবছিল বাবাকে গিয়ে ইস্কুলের গল্প বলবে! হয়ত আজ রাতে আর ফিরবেন না বাবা।

পিন্টুর কথা মনে হয়। তাকে যদি রাস্তায় ধরে মারে? একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। ইয়াসিনকে সে জিগ্যেস করে, তুমি কুস্তি করো?

বাপরে বাপ! হা, করে। কিউ?

আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমি কুস্তি লড়বো। গায়ে জোর করবো। শেখাবে তুমি?

হাঁ, খুব। লেকিন খোকাবাবু, খুব ফজরে উঠতে হবে, ফের কাচ্চা চানা খাইয়ে লড়তে হবে।

ইয়াসিন খুব খুশি হয়ে যায়। সে সবে, আনু দারোগা হবে, বড় সাহেব হবে, থানায় বসবে। তাই কুস্তি শিখতে চায়। সে বলে, ফের খোকাবাবু, আপনাকে ঘোড়ায় সোওয়ারি ভি শিখিয়ে দেব। এহি তো মরদ কা মাফিক কাম আছে। কেতাব ভি পড়বেন ই সব ভি শিখে লিবেন। হাঁ।

বলতে বলতে বাসার কাছে এসে যায় তারা। বাসার কাছে এসে হঠাৎ একটা দৌড় দেয় আনু। এক দৌড়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে বড় আপা বারান্দায় বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। তাকে দেখেই চিরুনি নামিয়ে উজ্জ্বল চোখ করে বললেন, এলি?

মা কোথায়?

বেড়াতে গেছে। তোর জন্যে দুধ–লাউ রেঁধেছি। মুখ ধুয়ে আয়। ইস্কুল কেমন রে?

আনু তার কোলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুলে-ওঠা গলায় বলে, এখানকার ছেলেরা এত খারাপ বড় আপা!

কেন, কী করেছে তারা?

খুব খারাপ। আমি কারো সঙ্গে মিশবো না।

আচ্ছা, আচ্ছা।

বড় আপা কোল থেকে ওকে নামিয়ে ওর রাঙা ক্লান্ত মুখখানা দেখেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *