উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

০৩. অতঃপর কুট্টিমামা

০৩. অতঃপর কুট্টিমামা

প্লেন এসে মাটিতে নামল।

ভালোই হল। চৈনিক রহস্য ভেদ করে এখন গলা একেবারে আঠা-আঠা হয়ে আছে—জিভটা যেন কাঁচাগোল্লা হয়ে আছে। জিভে কাঁচাগোল্লা চেপে বসলে ভালোই লাগে কিন্তু জিভটাই কাঁচাগোল্লা হয়ে গেলে কেমন বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি মনে হতে থাকে। এর মধ্যে আবার থেকে-থেকে কেমন গা গুলিয়ে উঠছিল। শেষকালে ক্যাবলার গায়েই খানিকটা বমি করে ফেলব কি না ভাবতে ভাবতেই দেখি, প্লেনটা সোজা থেমে গেল, আর বাইরে থেকে কারা টেনে দরজাটা খুলে দিলে।

দেখি, দুজন কুলি একটা ছোট লোহার সিঁড়ি লাগিয়ে দিয়েছে। নীচে পাঁচ-সাত জন লোক দাঁড়িয়ে।

চিনির বস্তার রাহাজানি ধরা পড়বার আগেই সরে পড়া দরকার। টুপ টুপ করে নেমে পড়লুম আমরা।

বা–রে—কোথায় এলুম? সামনে একটা টিনের ঘর, একটুখানি মাঠ–তার ভেতরে প্লেনখানা এসে নেমেছে। মাঠের তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গল–আর একদিকে মেঘের মতো মাথা তুলে আছে নীল পাহাড়। হাওয়ায় বড় বড় ঘাস দুলছে আশেপাশে।

হাবুল বললে, তাইলে আইস্যা পড়লাম।

কিন্তু কুট্টিমামা? কোথায় কুট্টিমামা! যেকজন তোক দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে তো কুট্টিমামা নেই? সেই লম্বা তালগাছের মতো চেহারা, মিশমিশে কালো রং—মাথায় খেজুরপাতার মতো ঝাঁকড়া চুল–মানে টেনিদা আমাদের কাছে যেরকম বর্ণনা দিয়েছে আগে সেরকম কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না?

বললুম, ও টেনিদা, কুট্টিমামা কোথায়?

টেনিদা বললে, ঘাবড়াসনি–ওই তো আসছে মামা।

চালাঘরটার পাশে একখানা জিপ গাড়ি এসে থেমেছে এক্ষুনি। তা থেকে নেমেছে বেঁটে-খাটো গোলগাল একটি ভালোমানুষ লোক। গায়ে নীল শার্ট, পরনে পেটুলুন। টেনিদা দেখিয়ে বললে, ওই তো কুট্টিমামা।

আমরা তিনজনে একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলুম, ওই কুট্টিমামা! হতেই পারে না! ঝাঁকড়া চুল তালগাছের মতো লম্বা কালিগোলা রং–সে কী করে অমন ছোটখাটো টাকমাথা গোলগাল মানুষ হয়ে যাবে। আর গায়ের রংও তো বেশ ফর্সা।

ক্যাবলা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই টেনিদা এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে একটা প্রণাম ঠুকে দিলে।

–মামা, আমরা সবাই এসে গেছি।

কী আর করা! কুট্টিমামার রহস্য পরে ভেদ করে যাবে আপাতত আমরাও একটা করে প্রণাম করলুম।

ভদ্রলোক খুশি হয়ে হেসে বললেন, বেশ বেশ, ভারি আনন্দ হল তোমাদের দেখে। তা পথে কোনও কষ্ট হয়নি তো?

ফস করে বলে ফেললুম, না মামা–বেশি কষ্ট হয়নি। মানে, চিনির বস্তাটা ছিল—

টেনিদার চোখের দিকে তাকিয়েই সামলে গেছি সঙ্গে সঙ্গে। মামা বললেন, চিনির বস্তা। সে আবার কী?

টেনিদা বললে, না মামা, ওসব কিছু না। চিনির বস্তাটা আমরা চিনি না। মানে, প্যালা খুব চিনি খেতে ভালোবাসে কিনা–তাই সারা রাস্তা স্বপ্ন দেখছিল।

কুট্টিমামা হেসে বললেন, তাই নাকি?

—হ্যাঁ মামা।—টেনিদা উৎসাহ পেয়ে বলতে আরম্ভ করলে, আমারও ওরকম হয়। তবে আমি আবার চপকাটলেটের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। এই হাবুল সেন খালি রাবড়ি আর চমচমের স্বপ্ন দেখে। আর এই ক্যাবলা মানে এই বাচ্চা ছেলেটা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পায় আর চুয়িং গামের স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করে।

ক্যাবলা ভীষণভাবে প্রতিবাদ করে উঠল, কক্ষনো না। চুয়িং গামের স্বপ্ন দেখতে আমি মোটই ভালোবাসি না। আমিও চপকাটলেট রাবড়ি চমচম—এইসবের স্বপ্ন দেখি।

কুট্টিমামা আবার অল্প একটু হেসে বললেন, দেখা যাক, স্বপ্নকে সফল করা যায় কি না। এখন চলল। মালপত্র প্লেনে কিছু নেই তো? সব হাতে? ঠিক আছে।

–তোমাদের বাগান কতদূরে মামা?

—এই মাইল-ছয়েক। দশবারো মিনিটের মধ্যেই চলে যাব। এসো—

একটু পরেই আমরা জিপে উঠে পড়লুম। ড্রাইভারের পাশে বসে মামা বললেন, একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে দেওয়ান বাহাদুর। অনেক দূরে থেকে আসছে এরা এদের খিদে পেয়েছে।

টেনিদা বললে, তা যা বলেছ মামা। সকালে বলতে গেলে কিছুই খাইনি–পেট চুঁই-চুঁই করছে।

টেনিদা কিছু খায়নি! বাড়ি থেকে গলা পর্যন্ত ঠেসে বেরিয়েছে প্লেনে এসে কমসে কম একসের চিনি মেরে দিয়েছে। টেনিদা যদি কিছু না খেয়ে থাকে, আমি তো তিনদিন উপোস করে আছি!

জিপ ছুটল।

জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কালো পিচের পথ পড়ে আছে মস্ত একটা ফিতের মতো। আমাদের জিপ চলেছে। ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ছায়া ছড়িয়ে আছে পথের উপর–কেমন মিষ্টি গলায় নানারকমের পাখি ডাকছে।

টেনিদা বসেছে আমাদের পাশেই। ফাঁক পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুমি যেরকম বলেছিলে, তোমার কুট্টিমামার চেহারা তো একদম সেরকম নয়! গুল দিয়েছিলে বুঝি? টেনিদা বললে, চুপ-চুপ! কুট্টিমামা শুনলে এখুনি একটা ভীষণ কাণ্ড হয়ে যাবে!

—ভীষণ কাণ্ড! কেন?

টেনিদা আমার কানে কানে বললে, সে এক লোমহর্ষক ব্যাপার–বুঝলি! বললে পেত্যয় যাবি না–নেপালী বাবার একটা ছু-মন্তরেই কুট্টিমামার চেহারা বিলকুল পালটে গেছে।

–ছু-মন্তর! সে আবার কী?

–পরে বলব, এখন ক্যাঁচম্যাচ করিসনি। কুট্টিমামা শুনলে দারুণ রাগ করবে। বলতে বারণ আছে কিনা!

আমি চুপ করে গেলুম। একটা যা-তা গল্প বানিয়ে দেবে এর পরে। কিন্তু টেনিদার কথায় আর বিশ্বাস করি আমি? আমি কি পাগল না পেন্টুলুন?

এর মধ্যে হাবুল সেন কুট্টিমামার পাশে বসে বকবকানি জুড়ে দিয়েছে : আইচ্ছা মামা, এই জঙ্গলটার নাম কী?

মামা বললেন, এর নাম দইপুর ফরেস্ট।

—এই জঙ্গলে বুঝি খুব দই পাওয়া যায়?

মামা বললে, দই তো জানি না—তবে বাঘ পাওয়া যায় বিস্তর।

এতক্ষণ পরে ক্যাবলা বললে, সেই বাঘের দুধেই দই হয়।

কুট্টিমামা হেসে বললেন, তা হতে পারে। কখনও খেয়ে দেখিনি।

শুনে দুচোখ কপালে তুলল হাবুল সেন : আরে মশয়, কন কী? আপনে বাঘের দই খান নাই? আপনার অসাধ্য কর্ম আছে নাকি? কালীসিঙ্গির মহাভারতের একখানা ঘাও দিয়া–বলেই হঠাৎ হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল হাবুল; গেছি–গেছি–খাইছে।

কুট্টিমামা অবাক হয়ে বললেন, কী হল তোমার? কিসে খেলে তোমাকে?

কিসে খেয়েছে সে আমি দেখেছি। টেনিদা কটাং করে একটা রাম-চিমটি বসিয়েছে। হাবুলের পিঠে।

—আমারে একখানা জব্বর চিমটি দিল। কুট্টিমামা পেছন ফিরে তাকালেন; কে চিমটি দিয়েছে?

টেনিদা চটপট বললে, না মামা, কেউ চিমটি দেয়নি। এই হাবুলটার মানে পিঠে বাত আছে কিনা, তাই যখন-তখন কড়াং করে চাগিয়ে ওঠে, আর অমনি ওর মনে হয় কেউ ওকে চিমটি কেটেছে।

হাবুল প্রতিবাদ করে বললে, কখনও না—কখনও না! আমার কোনও বাত নাই।

টেনিদা রেগে গিয়ে বললে, চুপ কর হাবলা, মুখে মুখে তক্কো করিসনি। বাত আছে। মামা-ও জানে না। ওর পিঠে বাত আছে-কানে বাত আছে, নাকে বাত আছে—

কুট্টিমামা বললেন, কী সাঙ্ঘাতিক! এইটুকু বয়সেই এসব ব্যারাম।

—তাই তো বলছি মামা টেনিদার মুখখানা করুণ হয়ে এল : এইজন্যেই তো ওকে নিয়ে আমাদের এত ভাবনা! কতবার ওকে বলেছি–হাবলা, অত বাতাবিনেবু খাসনি–খাসনি। বাতাবি খেলেই বাত হয়। এ তো জানা কথা। কিন্তু ভালো কথা কি ওর কানে যায়? তার ওপর বাতাসা দেখলে তো কথাই নেই–তক্ষুনি খেতে শুরু করে দেবে। এতেও যদি বাত না হয়—

হাবুল আবার হাউমাউ করে কী সব বলতে যাচ্ছিল, কুট্টিমামা তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, বাতাবিলেবু আর বাতাসা খেলে বাত হয়? তা তো কখনও শুনিনি।

—হচ্ছে মামা, আজকাল আকছার হচ্ছে। কলকাতায় আজকাল কী যে সব বিচ্ছিরি কাণ্ডকারখানা ঘটছে সে আর তোমায় কী বলব! এমনকি একটু বেশি করে জল খেয়েছ তো সঙ্গে সঙ্গেই জলাতঙ্ক।

শুনে কুট্টিমামা চোখ কপালে তুলে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। বললেন, কী সর্বনাশ!

কথা বলে কিছু লাভ হবে না বুঝে হাবুল একদম চুপ। আমি গ্যাঁট হয়ে বসে টেনিদার চালিয়াতি শুনছি। কিন্তু ক্যাবলাটা আর থাকতে পারল না, ফস করে বলে ফেলল, গুল!

টেনিদা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী বললি?

ক্যাবলা দারুণ হুঁশিয়ার–সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়েছে। নইলে জিপ থেকে নেমেই নির্ঘাত টেনিদা ওকে পটাপট কয়েকটা চাঁটি বসিয়ে দিত চাঁদির ওপর। বললে, না-না, চারদিকে কী সুন্দর ফুল ফুটেছে!

আমি অবশ্যি কোথাও কোনও ফুল-টুল দেখতে পেলুম না। কিন্তু ক্যাবলা বেশ ম্যানেজ করে নিয়েছে।

কুট্টিমামা খুশি হয়ে বললেন, হুঁ, ফুল এদিকে খুব ফোটে। কাল জঙ্গলে যখন বেড়াতে নিয়ে যাব, তখন দেখবে ফুলের বাহার!

হাবুলটা এক নম্বরের বোকা, এর মধ্যেই আবার বলে ফেলেছে, মামা আপনার পোষা বাঘটা–

মামা ভীষণ চমকে গেলেন।

কী বললে! পোষা বাঘ! সে আবার কী? কিন্তু টেনিদা তক্ষুনি উল্টে দিয়েছে কথাটা। হাঁ হাঁ করে বললে, না-না মামা, বাঘ-টাঘ নয়। হাবুলের নাকেও বাত হয়েছে কিনা, তাই কথাগুলো ওইরকম শোনায়। ও বলছিল তোমার বোসা রাগটা মানে সেই ধুসো কম্বলটা যেটা তুমি দার্জিলিঙে কিনেছিলে সেটা আছে তো?

হাবুল একবার হাঁ করেই মুখ বন্ধ করে ফেললে। কুট্টিমামা আবার দারুণ অবাক হয়ে বললেন, তা সে কম্বলটার কথা এরা জানলে কী করে?

—হেঁ—হেঁ–টেনিদা খুব কায়দা করে বললে, তোমার সব গল্পই আমি এদের কাছে করি কিনা! এরা যে তোমাকে কী ভক্তি করে মামা, সে আর তোমায়–

কথাটা শেষ হল না। ঠিক তখুনি—

জিপের বাঁ দিকের জঙ্গলটা নড়ে উঠল। আর জিপের সামনে দিয়ে এক লাফে যে রাস্তার ওপারে গিয়ে পড়ল, তাকে দেখামাত্র চিনতে ভুল হয় না। তার হলদে রঙের মস্ত শরীরটার উপর কালো কালো ডোরা–ঠিক যেন রোদের আলোয় একটা সোনালি তীর ছুটে গেল সামনে দিয়ে।

আমি বললুম, বা—বা—বা—

ঘ-টা বেরুবার আগেই টেনিদা জাপটে ধরেছে ক্যাবলাকে–আবার ক্যাবলা পড়েছে। আমার ঘাড়ের ওপর। আর হাবুল আর্তনাদ করে উঠেছে : খাইছে—খাইছে!