০২. মন বড় আনমনা

সে বছর দুই ভাইয়েরই মন বড় আনমনা। পাঁচুর আর নিবারণের দুজনের বউয়েরই ভরা গর্ভ। দুই বউ, রাঁধছে বাড়ছে সবই করছে। এদিকে ছাইচাপা আগুনের মতো ধুঁইয়ে উঠছে ব্যথা। প্রথম বিয়োনি তো নয়। ব্যথার রকম দেখে টের পেয়েছে, সময় আর নেই। এখন তখন অবস্থা।

ওদিকে নৌকা সাজানো হয়েছে। বড় রকমের যাত্রা। হাসনাবাদের নীচে, রাইমঙ্গল নদীতে আঠারো গণ্ডা নৌকার শাবর নিয়ে বসে আছে দশকুড়ি জেলে। দাঁড়িয়ে আছে কোম্পানির ভাড়া-করা লঞ্চ। চাল ডাল তেল নুন, কম করে মাসখানেকের খোরাক নিয়েছে সবাই। থাকতে হবে তিন মাস। বাকি দু মাস খাবে মাছ-মারার পয়সা দিয়ে। খাবে, আবার কমপক্ষে মাস ছয়েকের ঘরে খাবার পয়সা আনতে হবে। না গিয়ে উপায় কী!

আঁতুড় পাতাও হয়ে গেল। পাড়ার এক বুড়ি মেয়েমানুষ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেখলে দুই বউকে। দুই ভাই হুতোশে, পরস্পরের হাতে টানাটানি করে হুঁকো টানছে। হুঁকোর আর বিরাম নেই। বুড়ি বেরিয়ে এসে বললে, দরজা খুলছে গো! ব্যথা চড়েছে। দিম ভারী হয়েছে। পেটেও পাক লেগেছে।

কিন্তু সময় আর নেই। পাঁজি-পুঁথি-দেখা সময়। অগ্রহায়ণের বেলা। দক্ষিণ ভিটের চালায় অর্ধেকের উপর রোদ উঠে গেছে। মাথার কাছে বাঁধা আছে কঞ্চি। কঞ্চির গায়ে যতক্ষণ রোদ না। লাগবে, ততক্ষণ যাত্রার সময়। রোদ লেগে গেলে যাত্ৰা নাস্তি।

নৌকা ভাসিয়ে দু ভাই গিয়ে দাঁড়াল তেঁতুলে ফোড়নের মুখে। ফোড়ন হল ছোট খাল। একটু পরেই ছুটতে ছুটতে এসে নিবারণের বড় ছেলে খবর দিয়ে গেল, খুড়ির মেইয়ে হয়েছে, রং লাল। মায়ের এখনও হয়নি।

অর্থাৎ পাঁচুর মেয়ে হয়েছে। নিবারণের কিছু হয়নি। ওদিকে ডানসার মুখে দক্ষিণের যাত্রীরা ছটফট করছে। উপায় নেই। নিবারণ নিজেই হাল কাত করে চাড় দিল।

পাঁচু বলে উঠল, আর-এক দণ্ড দেখে যাই।

নিবারণ সাইদার। তাকে সব দেখাশোনা করতে হবে গিয়ে। সবাই যাত্রা করে বসে আছে।। উপায় নেই। বলল, এটা যখন বেইরেছে, আর এট্টাও বেরুবে। দু-দণ্ড আগে আর পরে। কিন্তুন আর দেরি করা যায় না। লোকগুলান ভাবনায় পড়ে গেছে।

বলে, ফোড়নের মুখ থেকে আবার ইছামতীতে পড়ল। শীতটা পড়েছিল মন্দ নয়। উত্তর বাতাসেরও টান ছিল। নিবারণ বলল, পাল তুলে দে।

সাইদারের হুকুম। যুদ্ধক্ষেত্রে পা দিয়ে সেনাপতির আদেশ অমান্য করা যায় না। পাল তুলে দিল পাঁচু। দিয়ে পালের কানদাড়ি দিলে পায়ের পাতায় পেচিয়ে।

গুপুস করে শব্দ হল পশ্চিম পাড়ে। দুভাই-ই ফিরে তাকাল। কচ্ছপ। মাদি-মদা, জোড়া কচ্ছপ। একটু রোদ পোয়াতে উঠেছিল। মানুষের সাড়াশব্দ পেয়ে, একটা জলে পড়েছে। আর একটি গড়াচ্ছে, জলে পড়বে বলে।

চোখাচোখি হল দু-ভাইয়ের। যাত্রাপথে কচ্ছপ। কাঁকড়া, কচ্ছপ, কলা-যাত্রার সময় অলুক্ষণে চিহ্ন। দুই ভাইয়েরই বুকের মধ্যে নিঃশব্দ বিদ্যুৎশিখা একবার চিকচিক করে উঠল। এ কীসের ইঙ্গিত।

কিন্তু নিবারণ বড় শক্ত মানুষ। জোরে হাল চেপে বলল, বেরুবার সময় দেখা দিলে খারাপ।। পথে ঘাটে কত কী চোখে পড়বে। তার জন্যে যাওয়া আটকায় না। কান-দড়িটে আর এট্টু খাটো কর দিনি।

কান-দড়ি খাটো করল সে। পালে টান পড়ে আরও ফুলে উঠল। নৌকা বাঁয়ে কাত হল আর-একটু। একত্ৰিশ হাত বাছাড়ি নৌকা চলল ছলছলাত করে।

পাঁচু ভাবছিল কেবল বাড়ির কথা। বউ দুটির কথা। তার মধ্যে বড় ভাজের ভাবনা বেশি। ভাবতে ভাবতে সময় গেল। নৌক এসে লাগল বিল্লেী আর রাইমঙ্গলের মোহনায়। সাই যাবার কুড়ি গণ্ডা নৌক শবর করে আছে সেখানে। অপেক্ষা করে আছে সাইদার নিবারণের জন্যে।

সাইদারের হুকুমে শাবর ভেঙে যাত্রা হল। আড়াই দিন পর অফিসের কাছে এসে, রেজিস্ট্রি করাতে সময় গেল একদিন। নৌকাপিছু আট আনা। জেলেদের মাথাপিছু হগুপ্তার টিকেট তিন আনা। ওখান থেকে যাত্রার দিন একবার বলেছিল নিবারণ, মেইয়ে মানুষটা অ্যাদিনে বোধ করি বিয়োল রে পাঁচু। তোর বোঠানের কথা বলছি।

পাঁচু বলেছিল, তা কি আর বসে আছে অ্যাদিনে?

নিবারণ বোধ হয় ওইটুকুই শুনতে চেয়েছিল। জোয়ারের টান পড়ে যাওয়ার ভয়ে, তাড়া ছিল সকলেরই। রাইমঙ্গল থেকে বিদ্যোধরীর আকবাঁক দিয়ে ডাইনে রেখে এসেছে বাসন্তীর সরকারি বাংলা, মজিদবাড়ির বন অফিস। মাতলা থেকে বেঁকেছে কৈকালামারিতে। এবার আস্তে আস্তে চওড়া হচ্ছে। ঠাকরুন। বনের সীমানায় পড়ে গেল নৌক। মজিদবাড়ি থেকেই পড়ে। কিন্তু যত নামতে হয়, ততই বন গভীর। যেন জীবন্ত। কেমন একটি অদ্ভুত গন্ধ ছাড়ে এখানকার বাতাসে। অজানা অচেনা বনবাদোড় আর সমুদ্র মিলিয়ে এখানে এক অদ্ভুত গন্ধ। নাকে এলেই বোঝা যায়, কাছাকাছি আসা গেছে। সামনে তখনও বাঁকের মুখে জঙ্গলের আভাস। অকুল সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না। শেষ বন-অফিস সুরিনগঞ্জের সীমানায় আসা গেছে। সুরিনগঞ্জ হল সুরেন্দ্রগঞ্জ। নিবারণ বলেছিল, হ্যাঁ, অ্যাদিন কি আর বসে থাকে! ছেইলে কি মেইয়ে হল, জানা গেল না। যাগ, জানা যাবে ঘুরে এসে!

মনটা বড় অস্থির-অস্থির করছিল পাঁচুর। বাড়ির খবরটা যদি কোনওরকমে পাওয়া যেত, দাদার মনটা থর হত একটু। বাড়ির ভাবনাই ভেবেছিল পাঁচু। আর তো কিছু ভাবেনি।

কিন্তু কাল হল আর-এক দিক দিয়ে। দক্ষিণে রেখে এল দাদাকে। এসে দেখল, উত্তর ভিটের গোলপাতার ছাউনি ধসে পড়েছে পেছনে। ছিটে বেড়া দুমড়ে পড়ে আছে হুমড়ি খেয়ে। সবকিছুই এলোমেলো ছড়ানো। দক্ষিণ ভিটের ঘরটা আছে। কিন্তু যেন কোনও বিরাটকায় প্রেতি তার আকাশ ছোঁয়া থাবা দিয়ে ঘরটির বুটি ধরে দিয়েছে নেড়ে। চালের বাতায় পাতা নেই খানে খানে। বেড়াটা বাঁকাচোরা, গোঁজা-খোঁচা হয়ে বেরিয়ে আছে। এখানে সেখানে। আর তার বউঠান, উঠোনে বসে,, রোদে বুক খুলে স্তন্যপান করাচ্ছে নতুন ছেলেকে। চোখে গড়াচ্ছে জল। নজর নেই সেই চোখে। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি অসময়ে গেছে বড় বিষৰ্ণ। কথায় বলে, যদি বর্ষে আগনে, রাজা যান মাগনে। কি জলে আর কি মাটিতে। ফলন নেই কোনওখানে।

সব দেখে-শুনে পাঁচু আর কথা বলতে পারেনি। বোঠানের পায়ের কাছে গিয়ে পড়েছিল হুমড়ি খেয়ে। সাত দিন কোনও কথা বলতে পারেনি। খালি এদিক ওদিক করেছে। যেন লুকোচুরি খেলেছে। ঘরামি ডেকে ঘর তুলেছে নিজেও। বোঠান। আপন মনে বলেছে, তোমার বড় ভাই সাইদার। নিজে আসতে পারেনি, তাই তোমাকে পেটিয়ে দিইছে। তুমি সুমুদুরে ফিরে গে বোলো, তার ছেলে হয়েছে, ঝড়ে তাকে রক্ষে করেছি। আমি। শোনো ঠারপো, আর বোলো…

আর চুপ করে থাকতে পারেনি। পাঁচু। বোঠানের পা দুখানি ধরে বলেছিল, ওগ, দক্ষিণে যমের দোরে রেখে এসেছি। সব।

বোঠান বুক চাপড়ে চাপড়ে বলেছিল, অগ আমার পাপ মন তো এ-ই গেয়েছেল গ। আগনে এল পচ্চিমে শ্যাওটা। কী শীত। থেকে থেকে আগনে আবার দখনে বাওড়া। দেখে আমার বুক কাঁপতে নাগল। একী অঘটন গ। এমন তো দেখিনি গ বাপের জন্মে। সেই আমার বুক কাঁপল। কোলের ছেইলে আমার শুদু শুদু কেঁপ্পেকুঁপ্পে কেঁদে অস্থির। সেই তো আমার মন বলেছিল গ।

 

তারপরে জীবনে একবার গেছে পাঁচু দক্ষিণে। গেলে থাকতে পারে না। সমুদ্রের নীলাম্বুধি অন্ধকার গিলতে আসে তাকে। বাতাসের সাঁই সাঁই রবে কানে বাজে। শুধু সাইদারের হাঁক। কালো কুচকুচে সর্বনেশে জঙ্গল তাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। ডাকে আর বাতাসে ফিসফিস করে। বলে, ভাইরে পাঁচু, এইখেনে আছি।

আজও ভুলতে পারেনি। পাঁচু সেদিনের কথা। বাগবাজারের এই খালের মোড়ে বসেও সেই দিনটির কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। অগ্রহায়ণের আকাশ ঘোলাটে। গাঁজানো-রস-খাওয়া বাতাস। তার দিক ঠিক নেই। সেই সময়ে দেখা দিল জলের বুকে স্পষ্ট দাগ।

সমুদ্রে জোয়ার ডেকেছে। ট্যাকের মুখে শাবির করে আছে গোটা সাই। আকাশ-বাতাসের গতিক বড় সুবিধের লাগছিল না। বাতাস এক বগা নিশেনা হারিয়েছে। তার দিক ঠিক নেই। অগ্রহায়ণের সমুদ্র। কিন্তু তারও গতিক ভাল নয়। আগনার মুখে বড় বড় হাঁকা ভাঙছে। আগনা হল জোয়ারের আগমন। শাবর বলে সাইয়ের নৌক-জমায়েতকে। অবস্থা দেখে, শাবর ভেঙে সাইয়ের মাছমারারা সেদিন মাছ মারতে বেরোয়নি।

সাইদার নিবারণের প্রাণে ভয় ছিল না। কিন্তু সবাইকে অভয় দিতে পারেনি সে। অগ্রহায়ণের মেঘকে ভয় নেই। তবু বলা তো যায় না। এটা সমুদ্রের সংসার। কে কোথায় কী বেশে ওত পেতে আছে, সব দেখা যায় না। যার তুমি সবটুকু চেনো না, চিনে নাও। তবে যাও।

এমনি হয়, এই নিয়মের মাঝে অনিয়মের মতো। একে বলে রোগ। যাবৎ জীবকে নিয়ে জগৎ। জগৎও একটি জীব। তার প্রাণ আছে, ঠাওর করলে মনের দেখাও মিলবে। তাই বৈশাখ ছেড়েও তার আকাশে ঝড় ওঠে ঘাড়-মুচড়ানো। শাঙন ছেড়ে অঘ্রানেও সংসার ভাসাতে পারে সে।

মাছমারা আছে আকুল সাগরে। নিয়ম ছেড়ে সে নিজের চোখে চেয়ে দেখুক, জলের রকম কী। বাতাসের গতিক কেমন। আকাশ কী বলে। সেইটি হল আসল নিয়ম।

ট্যাঁকের মুখে তেমন হ্যাঁকা নেই। থাকলে তিষ্ঠানো যেত না। নৌকায় নৌকায় উনুন ধরেছে। খাওয়া সেরে রেখে অপেক্ষা করা ভাল। সময় বয়ে যায়। হাত-পা গুটিয়ে, দুদিন বসে খেতে হলেই প্ৰাণে পাষাণ চাপে।

সামনে চুকিম জায়গাটুকু পেরিয়ে কাশ্য মরছে মাথা দুলিয়ে। চুকম হল ফাঁকা জায়গা। ঠিক যেন মুখ-ঢাকা ঘোমটা-পরা বউগুলির মতো। জলের সন্ধান পাওয়া গেছে ওখানে। থেকে থেকে বাতাসের ডাকটা বাঘওয়ানোর মতো শোনা যাচ্ছে। সুঁদুরী-হেঁতালের অন্ধকার জটায় বড় রহস্য। কে ডাকে সেখানে, কে জানে। কিছু বোঝবার উপায় নেই।

পাঁচুর রান্না হয়ে গেছে। তিবড়িতে এখনও আগুন। বাতাসে শীত মালুম দিচ্ছে বেশ। তিবড়ির উপরে হাত দুখানি মেলে। ঘরের কথাই ভাবছে সে! বোঠান কী বিয়োল, কে জানে।

সেই সময়ে জলের বুকে দেখা দিল স্পষ্ট দাগ। গলুই থেকে ডাক দিল নিবারণ, পাঁচু, পাটা জালটা কমনে আছে?

এমন অসময়ে পাটা জালের খোঁজ কেন। বলল, এই গলুয়ের নীচখানটিতেই আছে। কেন?

জবাব নেই। তাকিয়ে দেখল পাঁচু, দাদার নজর দূরে। জল দেখে টের পেল, মাছের চক দেখা যায়। ভাঙা চক।

একটু পরে বলল, রান্না ভাত-ডাল নে তুই পাশের লৌকোয় যা দিনি। দেখি এক খ্যাপ মেরে।

পাঁচু গজগজ করে উঠল আপন মনে। সকলের খেতে বসবার সময়। একজন যাবে এখন খ্যাপ মারতে। কিন্তু কথা যখন একবার মুখ থেকে বেরিয়েছে, সে বেদবাক্যি। খ্যাপ মারতেই হবে।

এমন যে কেউ না যায়, তা নয়। তবে দুজনে যায়। নিবারণ সাইদার যায় একলা। ভয়েরও তেমন কিছু নেই। জোয়ারের বেলা, উপরের টান। বার-সমুদ্রে যাওয়ার ভয় নেই।

বশীর বলে উঠল, কীসের চক দেখলে নিবারণদাদা?

—বাটা চক।

পাঁচু বলে উঠল, কিন্তুন পাটা জাল নে একলা কী করে পারবে?

নিবারণ বলল, পাটা জাল কি আর পাততে যাচ্ছি। খানিকটে তুলে নে ফেলব কোনও ফোড়নের মুখে। চক তাইড়ে নে যাব খালের দিকে।

নৌকা নিয়ে বেহসে গেল একলা। চকের পিছন পিছন হারিয়ে গেল বাঁকের মুখে। ঠাহর করে দেখেছে পাঁচু, চকভঙা বাটা মাছের দঙ্গল ভেসে চলেছে জোয়ারের টানে। একলা একলা পেছন ধাওয়া করে, ওই মাছ কোণঠাসা করা কি চাট্টিখানি কথা। কিন্তু কে বলবে। না পারলে, ঘুরে এসে শুয়ে থাকবে চুপচাপ। খেতে বসে দুষবে খালি পাঁচুকে। কেন, না, ভাত কম, পেট কিছুতেই ভরে না। ভাবখানা যেন পাঁচু বেশি খেয়ে ফেলেছে।

আর দশজন খেতে বসল। কিন্তু ভাল লাগে নাকি খেতে। রাঁধলে দুটি মানুষের জন্যে। বেড়ে বসতে হল একজনের ভাত।

কোনওরকমে দুটি খেয়ে, বসিরহাটের গণেশের নৌকায় গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। ভাতের নেশটুকু কাটবার অপেক্ষা। তারপরে আর দুচোখের পাতা এক হল না। একসময়ে জলের দিকে তাকিয়ে দেখল, টান-ভাটার লক্ষণ। মনটা আনচান করে উঠল।

বশীরকে বলল, টান-ভাটা পড়ে গেল যে।

বশীরও বোধ হয় তাই ভাবছিল। সাইদার গুণিনের সে শাকরেদ। নিবারণ তার গুরু।

বলল, এটুসখানি সবুর কর। গেছে গোনে, এবার টানের মুখে এসে পড়বে। গোনে অর্থাৎ জোয়ারে। সেই আশায়, বসে রইল পাঁচু কিন্তু টান-ভাটা ছাড়িয়ে পুরো ভাটা দেখা দিল। অন্তরে অন্তরে হাকপাক করে উঠল মনটা। সে কিছু বলার আগে বশীর নিজেই পাঁচুকে বললে, আসো দিকি আমার নৌকায়, একবার ঠেলে যাই ওই বাঁকের মুখে, বিত্তান্তটা কী জেনে আসি।

গণেশ বলল, সেও যাবে। আর একটি নৌকাও বেরুল। তিন নৌকা গেল উজান ঠেলে।

আকাশের সেই এক ভাব। বাতাসও তেমনি মাতাল। কেবল মেঘ যেন আরও জমাট বাঁধছে। বনের মধ্যে। বেলা তখন বড় জোর দুটো। কিন্তু মেঘের ছায়ায় তা ঠাহর করবার উপায় নেই।

ঠাকুরনের মোহনা। একটু পুবে খোঁচ দিয়ে হারিয়ে গেছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে। একটি কাকপক্ষীরও দেখা পাওয়া যায় না। মোহনার মুখ থেকে যত দূর চোখ যায়, সেও অকুল সাগর। ভাটার টানে, ঢেউয়ের মাতন লেগেছে সেখানে।

দূরে দূরে অনেকগুলি ফ্যালি-ফ্যাকড়া নদী থেকে ঢুকে গেছে বনের জন্টার মধ্যে। অধিকাংশেরই নাম নেই। এক নাম, ফোড়নখাল। হোগলা-হেঁতালের মাঝখান দিয়ে যেন আঁকাবাঁকা নাগিনী কিলবিল করে গেছে এগিয়ে।

সবাই দেখে নজর উচিয়ে, পুবে পশ্চিমে উত্তর দক্ষিণে। কোনও নৌকা দেখা যায় না। শুধু বাতাসলাগা বনের গোঙানি আর মাথাভাঙা ঢেউয়ের শব্দ। দুবার দুটি ফোড়নখালের মুখে দাঁড়াল তিন নৌকা। কে জানে, এর মধ্যে ঢুকেছে কি না নিবারণ।

বশীর বলল, আর এটুস এইগে চলো দিনি। এত কাছে হলে, এতক্ষণ দেখা দিত। ফোঁড়ানখালের মুখে আর কদূর যাবে। ভাটা পড়ে গেছে।

আর-একটু এগিয়ে গেল। তিন নৌকা। একটু একটু করে, অনেকখানি এসে শব্দ শুনে ডাঙার দিকে হাল মারল সবাই। শব্দ শোনা গেছে। হাল টানার। কিন্তু নিয়মিত নয়, যেন হাঁপিয়ে-পড়া মাঝির থেকে থেকে বৈঠা টানার বিলম্বিত ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ।

সামনেই আর-একটি ফোড়নখাল। আবার শোনা গেল, যেন ঝিমিয়ে পড়ে হাল টান দিচ্ছে কে। বোঝে, চকভাঙা মাছের পিছনে একলা আসার ঠেলা কতখানি। হাতে পায়ে বোধহয় আর তাগাদ নেই।

পাঁচুর রাগ চড়ল। মারুক আর ধরুক, গুণিন হোক আর সাইদার হোক, দুটো কথা না বলে ছাড়বে না পাঁচু।

কিন্তু শব্দটা চাপা পড়ে গেল। আবার। ফোড়নখালের মুখ গেছে বেঁকে। বুক থেকে জল নামছে হোগলার, বাতাসে দুলছে, কাঁপছে ভাটার টানে।

আবার শব্দ শোনা গেল। পরমুহূর্তেই কাঁড়ারের মুখ দেখা দিল বাঁকের মুখে। কিন্তু কাঁড়ার তো নয়, গলুই। হাল পিছনে, মুখ উলটো দিকে।

লাগি ঠেলে, স্তম্ভিত হয়ে রইল তিন নৌকা। দেখল বাতাস আর ভাটার টানে হাল নড়ে উঠছে। নৌকা খালি, মানুষ নেই। ভাটার টানে, আপনি আপনি আসছে ভেসে।

বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাল পাঁচুর। আগে নজর পড়ল বশীরের মুখের দিকে। সে মুখ দল-দলা মেঘে। থমথম করছে।

যেন আসতে মন নেই, এমনি করে ফোড়নের মুখে ঠেকতে এল নৌকা। একত্রিশ-হাত বাছাড়ি নৌকা, বাপের নৌকা পাঁচু আর নিবারণের। ওই তো দেখা যায়, ছাঁইয়ের মুখছাট তেমনি খোলা। শিল-নোড়া তেমনি পাতা। শিলের কপালে বাড়ন্ত হলুদটুকু রয়েছে তেমনি।

কাছে আসতে দেখা গেল, কাঁড়ারে জাল, ছাঁকা বাটা মাছে তখনও জাল ভরতি। খোলা হয়নি।

কিন্তু মানুষটা।

কথা বলতে গিয়ে শব্দ বেরুল না পাঁচুর গলায়। চিৎকার করতে গিয়ে বুকের আর গলার পেশি গেল কেঁপে।

ঠাকুরনের মোহনায় যেন বাতাস গেল পড়ে। জলের টান গেল মরে। গোটা বন গেল। থমকে। তিন নৌকায় পাঁচজন মাছমারা। সব যেন কোনও এক মায়াবিনীর রাজ্যে এসে বোবা হয়ে গেল।

খালি নৌকায় লাফ দিয়ে উঠল বশীর। ছাঁইয়ের পাশ দিয়ে গিয়ে হাল ধরে বলল, ঢোকাও, সবাই লৌকো ঢোকাও ফোড়নখালে, একবার দেখে আসি।

চার নৌকা ভাটি ঠেলে ঢুকল খালের মধ্যে, হোগলা-হেঁতালের গহনে। সুদূরীর ঠাসাঠাসি, নেলো, বিষকাটারি। আর বাসক ঝাড়ে বাতাসের ক্রুদ্ধ শাসনি। অশেষ আকাশ এখানে শাসিত, নিবাসিত অসূর্যাম্পশ্য এই অরণ্যে মেঘে মেঘে নেমেছে সন্ধ্যার ঘোর।

চার হালের মচমচে শব্দ। গণেশ কাশছে খকখক করে।

সর্পিল খাল বেশিদূর যেতে পারেনি।

বন আছে খাল আছে, একত্রিশ-হাত বাছাড়ি নৌকাখানি আছে। পাঁচু চেয়ে দেখছে, পুটকে-পরানি বাটা মাছগুলি এখনও চকচক করছে। নিষ্পলক চকচকে গোল চোখে যেন সবকিছু দেখছে। নির্দয় শমনের ভাবলেশহীন দৃষ্টি। ওই তো ছাইয়ে হুঁকো-কলকে, গলুয়ের গুড়োর ওপর পোড়া বিড়ি, দেশলাইখানি। ছাঁইয়ের মুখছাটের কাছে গামছা, তেলচিটে গেঞ্জি নিবারণের। সব আছে।

বাড়িতে আছে বউ। কোলে নিয়ে বসে আছে নবজাতক।

মানুষটা নেই। কী এক সর্বনাশের খেলায় মেতে, সে যেন খালের ধারে বনের আড়াল দিয়ে চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। চারদিকে অশরীরীরা ঘিরে চলেছে চার নৌকা।

নয়, আর-কিছুর পায়ের চিহ্ন, যার নামও করতে নেই মনে মনে। সে চলে নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে, গাছের আড়ালে আড়ালে। চোখে তার আগুন, গায়ে কালো ডোরা কাটা। খপিশ চোখে চেয়ে দেখল, কোনও গাছের মুণ্ডু মুচড়ে দুমড়ে গেছে। কিনা কেউ। এ তো এমনি মাছমারার মরণ নয়। গুণিন লোপাটের ষড়যন্ত্র হতে পারে মহা দানোর। কে বলতে পারে, চকভাঙা মাছের লোভানি দিয়ে ডেকে আনেনি সে। কিন্তু কোনও চিহ্ন নেই। খাল শেষ হয়ে এল, বন হল আরও গভীর। মানুষটা নেই।

হাল ছেড়ে, দু হাত মুখের উপর তুলে পাঁচু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাক দিয়ে উঠল, হেই দা—দা!…

বাতাসের শব্দ হয়ে উঠল দ্বিগুণ। গাছে গাছে ঘর্ষণে ক্রূর দাঁত কড়মড়ানি গেল শোনা। পাঁচুর ডাক গাছে গাছে ডালে ডালে গেল পেচিয়ে জড়িয়ে। সকলের বুকের মধ্যে পাক দিতে লাগল, হেই দাদা!…এমন ভয়ংকর ডাক আর কেউ কোনওদিন যেন শোনেনি।

বশীর নৌকা ঘোরাল। সাইদার আজও গেছে, কালও গেছে। সমুদ্রে আবার জোয়ার আসবে, ভাটা নামবে। মাছের চক আসবে ভেসে মহাসমুদ্রের বুক থেকে। শুধু এই বন যাকে একবার নিশ্চিহ্ন করেছে, তার চিহ্ন আর কোনওদিন পাওয়া যাবে না। কোনওকালে যায়নি। এ শুধু সাইদারের যাওয়া নয়। গোটা সাইয়ের নিপাত যাওয়ার সঙ্কেত এবার বনে, জলে, আকাশে। সবাইকেই ফিরতে হবে এ বছর, আজকের মধ্যেই। নইলে আর কেউ ফিরবে না।

তবু প্রৌঢ় পাঁচু, অবোধ শিশুর মতো, আরও জোরে প্রাণপণ চিৎকার করে, আবার ডাক দিল, অই। দা-দা-গা-অ-অ-অ!

বাতাসের টানে সে ডাক বন থেকে বানান্তরে গেছে, মাতলা, ঠাকুরন, রাইমঙ্গলের জোয়ারে জোয়ারে গেছে অনেক দূর। অকুল সাগরের দ্বীপে দ্বীপে ঘুরেছে। মানুষটা নেই।

সেই রাত্রেই এল প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। অগ্রহায়ণের সেই ঝড়, নিপাত দিয়েছিল ঘরসুদ্ধ।

 

হঠাৎ থতিয়ে চমকে ওঠে। পাঁচু। ডাকে পাঁচুর বুকের মধ্যে, দাদাকে ডাকে যেন কে বুকের মধ্যে বসে।

তারপর দূর সমুদ্র থেকে যেন তার চোখ পড়ে বিলাসের দিকে। মনটা আবার থমকে যায়।

থাক সে সব কথা। সামনে ছেলেটা বসে রয়েছে। সে সব কথা ভেবে এ শুভযাত্রায় কেন মন ভার করে থাকবে। ছেলেটার দিকে তাকাল সে। নৌকার পেছনে, কাঁড়ারের সামনে, তিবড়িতে ফুঁ দিচ্ছে তলদা বাঁশের নল দিয়ে। নৌকার তোলা উনুনের নাম তিবড়ি। ভাত বসিয়েছে ছেলে। বোধহয় ভেজা কাঠ ভাল জ্বলছে না বলে ওসাকাতে হচ্ছে।

দাদার বড় ছেলে। নাম বিলে। তেঁতুলে বিলেস, অর্থাৎ তেঁতুলতলার বিলাস। যেন দ্বিতীয় নিবারণ মালো। এমনি চেহারাখনিই ছিল দাদারও। কালো কুচকুচে রং, পেটানো শরীর। নেহাইয়ের মতো শক্ত। যেন নিমকাঠের কালো রং মাখা চকচকে মূর্তি। নাকটি ছোট। চোখ দুটি ঈষৎ গোল। ভ্ৰ কুঁচকে মুখ তুলে তাকালে মনে হয়, কেউটে সাপ যেন ফণা ধরে আছে। ভেড়ার লোমের মতো কালো কোঁচকানো চুল। যেন জাতসাপের ডিম-ফোটা শলুই কিলবিল করছে। মাথায়। হাসলে পরে চোখ ঢেকে যায়। চোখ নেই, নাক নেই, খালি এক মুখ হাসি। সাক্ষাৎ নিবারণ মালো। বনে জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকলে রঙে রং মিশে যায়। গাব-আঠা-মাখানো নৌকার কাঁড়ারে শুয়ে থাকলে, মানুষ থাকলে টের পাওয়া যায় না। এমন কালো।

পাঁচুর বাপের চেহারাও কালো। তবে এমনটি নয়। এমন কালো নাগের মতো চকচকে নয়। চুলের রকমও নয় এমন। পাকানো চুলের ভাঁজে ভাঁজে যেন কত গুণ, কত অন্ধিসন্ধি রেখেছে। পুরে। পাঁচুর বাপেরও বাপের চেহারা ছিল এমনি। পাঁচু দেখেছে তার সেই ঠাকুরদাকে।

ধলতিতার রাম মালো বলত নিবারণকে দেখিয়ে, শুনিচি, এমনি ছেল ওয়ার মুক্তিখানি। মালোর ঘরের সেই পেখম পুরুষ। না, মালো জাতের কথা বলছিনে। এই তোমার সেকালের বাদার মালোদের পেখম পুরুষদের কথা বলছি। সে কি আজকের কথা। চোদ পুরুষেরও চোদ পুরুষ আগে। ওয়ার কল্যাণেই সমুদ্দুর পারের মালো বংশ বড় হয়েছেলে, ছাইড়ে পড়েছেলে। মালোরা ত্যাখন রাজা হয়েছেল দেশের। শুনিচি, দক্ষিণ দে হেঁটে এয়েছেলেন। হ্যাঁ, সমুদুরের ওপর দে, দিব্যি পা ফেলে ফেলে হেঁটে এয়েছেলেন। দিগম্বর কালো কুচকুচে এক পুরুষ, কোঁচকানো চুল ফণা ধরে আছে কপালের ওপর। গায়ে আর কিছু নেই। হাতে এক মস্ত ক্যাঁচা। ডাঙায় এসে ওয়ার বড় বেপদ হল। দক্ষিণ রায়ের রাজ্যি। ছেড়ে কি কথা কয়। ত্যাখন অবশ্যি ধলতিতেও বাদা। আসার পথে নড়ুই হল দক্ষিণ রায়ের চেলাদের সঙ্গে। জিতলেন উনি। দক্ষিণ রায় খুশি হয়ে মস্ত একখানি গায়ের ছাল দিলেন ওয়ারকে পরতে। ওই হল ওয়ার আসল মুক্তি। বাঘের-ছাল-পরা, ক্যাঁচা-হাতে কালো কুঁচকুঁচে পুরুষ। তোমার গোটা সমুদুরের পর ধরেই ছেল ওয়ার রাজ্যি।

রাম মালোর কথার মধ্যে কতখানি সত্যতা আছে কে জানে। কিন্তু আদিগন্ত সমুদ্র, ফণা তুলে গজাচ্ছে খলখল করে। সেই সমুদ্রের উপর, ক্যাঁচা হাতে ঘুরছে একটি মানুষ-মুর্তি। বাঘছাল তার পরনে। শিকারির নিবিষ্ট চোখে খুঁজছে মাছ। এ স্বপ্ন দেখতে দেখতে যখন নিজেদের দিকে ফিরে তাকায়, তখন যুগপৎ ভয়ে ও গর্বে ভরে ওঠে পাঁচুদের বুক।

পাঁচু তার দাদাকে সেইজন্যে আরও সম্মানের চোখে দেখত। দক্ষিণে গিয়ে, কী সমুদ্রে, কী ডাঙায়, দাদার পাশে পাশে চলতে রাম মালোর গল্প মনে পড়ে যেত। আর দেখে নিত মিলিয়ে। ঠিক যেন সেই পুরুষ। গুণ আর কি সাধে জানত! তেমনি চেহারাখনি বিলাসেরও। তেমনি হাঁক-ডাক, তেজ-জেন্দ, সবই আছে। কাজে যদি মন দেয়, তা হলে খুব দড়ো। তবে দিনকাল বড় খারাপ পড়েছে। আর বাপ-মরা ছেলে। বাপের ব্যাটা তো! সেই বাপ না হলে ওর রাশ টানবে কে। তাই ছেলের একটু উড়ু-উড়ু ভাব।

বয়স হল এক কুড়ি দুই। বাপ থাকলে এতদিনে ছেলের বিয়ে হত। ওর বাপের দরুন সংসারে লক্ষ্মী ঠাঁই নিয়েছিল। ঠাকুরদার আমলে ছিল তাদের নৌকা। বাছাড়ি জাল, টান জাল, পাটা জাল, কোনও কিছুর অভাব ছিল না। কিন্তু এক পুরুষেই সব কাবার। বাপের অবস্থা ভাল যায়নি। আবার নিবারণের সময় নৌকা হল। এই নৌকা একত্রিশ-হাত বাছাড়ি নৌকা। সেগুন কাঠের নৌকা, জলে উলটাবে, তবু ড়ুববে না।

গত মাঘ মাসে নৌকা বাঁধা পড়েছিল মহাজনের কাছে। মাঘ ফাগুন চৈত্র বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ আষাঢ়। আষাঢ়ের আজ অর্ধেক পার হয়ে গেল। এতদিন বাদে দেনার উপরে আবার নতুন মুচলেকা দিয়ে, নৌকা ছাড়ানো হল। আজ পাঁচ বছর ধরে, ফি বছরে নৌকা বাঁধা পড়ছে। চক্রাকারে বাড়ছে দেনা।

কিন্তু উপায় কী। এ সময়ে যেমন করে হোক গঙ্গায় আসতেই হবে। প্রতি বছরই আশা থাকে, এ বছর হয়তো মহাজনের ঋণ শোধ হবে। হয় না। যদি গঙ্গার দয়া হয়, তবে কয়েক মাস চলে। তারপর আবার যে-কে—সেই।

তবু আসতে হবে। যার নৌকা নেই, মহাজনের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া নিয়েও সে আসবে। এ মিঠে জলের টান, বড় টান। যদি দেয় তো, গঙ্গাই দেবে হাত ভরে। না দিলে মরণ।

তাই সবাই আসছে এদিকে। উত্তর-দক্ষিণ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নৌকা আসছে, আসবে। পুবের আরও উঁচু, সেই গাঁয়ের লোকেরা যাবে ইছামতী দিয়ে। যাবে সেই গোপালনগর, মোল্লাহাট, গরিবপুরের পাশ দিয়ে। ইছামতী থেকে পড়বে খালে। খাল দিয়ে চুণী নদীতে। রানাঘাটের সীমানায়। খবর নেবে আগে থাকতে, বনগাঁয়ের পুল খুলবে কবে। সেই রেলপুলের গেট সাতদিনে খোলে একবার। আগে গিয়ে পড়লে, যে কদিন থাকতে হবে পুলগেটে, সেই কদিন একেবারে কুকুর বসে থাকতে হবে। গলা দিয়ে ভাত নামতে চায় না। গোনা দিনের চাল! বসে খেতে বড় কষ্ট হয়।

কিন্তু আসতে হবে। যেদিক দিয়েই হোক। যদি মাছমারা হও, তবে মাছের পিছে পিছে আসতে হবে। সে জলে, তুমি ডাঙায়। তার মরণ, তোমার জীবন। এই নিয়ম। জীবন-মরণের পাশাপাশি বাস। তারও মন-মেজাজ বুঝতে হবে। জানতে হবে রীতিনীতি। কোন স্রোতে, কেমন টানে, কত তলায় তার গতিবিধি। সে যখন যেখানে, তোমাকে যেতে হবে সেখানে।

সে কখনও নোনায়, কখনও মিঠেনে। বিশেষ মাছের রাজা ইলিশ। এখন নোনা জলে তার মন নেই। সে আসবে ঘোলা মিঠে জলে। শুধু জলে নয়। যেখানে যত টান, তত টান ঠেলে আসবে সে। সে গা-ভাসানে মাছ নয়, উজনি মাছ। এখন ঠেলে সে ওপরে উঠবে। কেন উঠবে? না, এমনি এমনি নয়। কাজ আছে তার। কাজ…

সহসা নজর পড়ে পাঁচুর। নজর পড়ে ভাইপো বিলাসের দিকে। দ্যাখো ছোঁড়ার কাণ্ড। তিবড়ি নিভে ভুস। ছেলে আমার হাঁ করে তাকিয়ে আছে। শহরপারের দিকে। ওই যে শহরের গাড়ির শব্দ। ঘন ঘন ঘন-হুস! ঘ্যাচ। গাড়ি দেখা যায় না। সামনে সব পোল্লায় পোল্লায় মালগুদাম। তার পরে সব আকাশছোঁয়া বাড়ি। তার ওপরে আকাশের গায়ে গাড়ির শব্দ। ঘন ঘন ঘন-ঘ্যাঁচ। আর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো চিকচিক করে নীলচে বিদ্যুৎ চমকায় অন্ধকার আকাশে। দেখে এসেছে পাঁচু। এক রকমের বিজলি গাড়ি। চেপে দেখেনি কোনওদিন। শুনেছে, নাম তার টেরামগাড়ি।

প্রথম প্রথম পাঁচুও চমকাত। সে কি আজকের কথা। নিবারণের সঙ্গে সেই প্রথম হাতেখড়ি বছরগুলো যাচ্ছিল তার। বছর তিনেক চমকেছে। জাল বুনছে, কিংবা অমনি তিবড়ি জ্বালিয়ে রান্না করেছে। আচমকা অন্ধকার আকাশে বিদ্যুৎ-চিকচিক দেখে চমকে উঠেছে। নিবারণ হেসে উঠেছে। হা হা করে। তবে ওই পর্যন্ত। কোনওদিন পাড়ে উঠে দেখবার সাধ হয়নি। শহর বলে কথা! কীসের থেকে কী হয়, কে জানে। তারপর নিবারণ একদিন নিজের হাত ধরে নিয়ে গেছল। পরে বয়সকালে দেখে দেখে পাঁচুর চোখ পচে গেছে। শেষের দিকে নিবারণের একটু শহর-টান হয়েছিল। পাঁচুকে বসিয়ে রেখে শহরে উঠে যেত। বলে যেত, বোস, আসছি। ঘুরে।

ঘুরে যখন আসত, চোখ একেবারে ভাঁটার মতো লাল। মুখের বাক্যি হরে যেত। ভয়ে পাঁচুর মুখে কথা সরত না। নিবারণ এসে কথাটি না কয়ে গলুইয়ের গুড়োর ওপর একেবারে চিতপটাং। রান্না ভাত থাকত পড়ে। সারা রাত্রে আর সাড়া পাওয়া যেত না। সেই ভোরবেলা উঠে গঙ্গায় ড়ুব দিয়ে, নিয়ে বসত আমনি পান্তা।

আশে-পাশে আর সব জেলে-মালোরা বলত, ওস্তাদ মানুষদের ওই বড় মুশকিল। শহর গাঁ বাদা সমুদূর অনেক দেখেছে ঘেঁটেছে, ঘুরেছে কিনা! ও সব মানুষের এটু আধটু অমন হবেই। সগগলার হয় না।

তা ঠিক। ওস্তাদ না হয়েও বয়সকালে পাঁচু কয়েকবার তাড়ি গিলেছে। চৈত্রমাসে প্রায় প্রতি বছরই সন্ন্যাস নিয়েছে। না নিয়েই বা উপায় কী। মাছমারার ঘরে কয়েক টোটার এক টোটা হল চোত-টোটা। অথাৎ চৈত্রের মম্বন্তর। যাকে বলে, চোত-পোড়া। এর আগে যায় পোষ-পোড়া। পোড়ার অভাব নেই। ফাল্লুনেও কিছু সুদিন আসে না। গোটা শুকনো মরশুমটা সমুদ্রের কাল। নোনার সুদিন। তখন সাই যায়। নাম যার সমুদ্ৰ-যাত্ৰা। জীবনের সবচেয়ে বড় যাত্ৰা। ওতে অবিশ্যি তোমার মতান্তর আছে। যা দেবেন তা মা গঙ্গা। সমুদ্রে গিয়েও, মানুষকে কি খালি হাতে ফিরতে হয় না! হয়, তাও হয়। জেলে, মালো, ব্যাপারি, কারবারি, আড়তদার, সব মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। এদিকে হাসনাবাদ, ওদিকে ক্যানিং। লাইনবাঁধা মোটর-লরি। আর চাকা-চাকা বরফ নিয়ে বসে আছে শহরের কারবারিরা। মস্ত বড় মানুষ সব। কলকাতায় তাদের বাড়ি-গাড়ি। বলে, লাখ টাকার মালিক, তা হবে! পাঁচু দেখেছে। তাদের হাতে পাঁজ-পাঁজা নোট। গুনে দেয়। সাইদারের হাতে। সে এক কাল। ওই টাকা। সুদিনের পাশে পাশে ফেরে দুর্দিন। এও সে পাশাপাশি বাস জীবন মরণের। এই যে, টাকা রয়েছে সঙ্গে!

অভাব নেই কোনওটিরই। মানুষ আর টাকার। সময়ে ওইতেই বড় টান ধরে যায়। মানুষ ফলায় টাকা। দক্ষিণ রায় মশাই ফেরেন ডাঙায় মানুষের খোঁজে আর ওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাপটি মেরে ফেরে আর-একদল। তারা সুযোগ বুঝে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে সাইয়ের ওপরে। টাকা আছে যে! বড় শেয়ালের রাজ্যে বিনা খাজনায় মালিকানা করে এরা। তারা সুন্দরবনের ডাকাত।

তাদের হাতেও একবার পড়েছিল পাঁচুরা। কাছেপিঠে ফেরে তারা সব সময়েই। তবে কিনা, এ সংসারে প্রাণের মায়া আছে যাবৎ জীবের! বেঘোরে প্রাণ কেউ দিতে চায় না। সে স্বয়ং দক্ষিণ রায় থেকে চুনোপুটিও। ঝাঁপ দেবার আগে ডাকাতদলকেও একবার ভেবে নিতে হয়। হোগলা-হেতাল বনে, নিশীথ রাত্রে যখন সর্বনাশা অন্ধকারের হাজার চোখ পিটপিট করে জোনাকির আলোয়, ফেউয়ের ডাকে ভয়াবহ সন্দেহে কাঁপে বুকের মধ্যে আর মনে হয়, দিকে দিকে ভাটার মতো চোখ জ্বলছে চার পাশে, তখন সেখানে কোনও আইন-কানুনের বালাই থাকে না। হয়, প্ৰাণ দিতে হবে, নয়। ধন্যপ্ৰাণ সব নিয়ে যেতে হবে। মাঝামাঝি কোনও রাস্তা নেই। তাই ঝাঁপ দেবার আগে একবার ভাবতে হয়।

নিবারণ সাইদারকে জব্দ করা বড় সহজ ছিল না। চারদিকে চোখ। যেমন সজাগ, তেমনি সাহস। একটু সন্দেহ হল তো, একলাই নিজের নৌকার নোঙর তুলে ছুটিল। রাতের অন্ধকারকেও পরোয়া নেই। মাঝখান থেকে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত পাঁচু। সেও যে একই নৌকায়। কিন্তু কিছু বলবার জো নেই। বললেই খেঁকিয়ে উঠত। অত যদি ভয় তো, বউয়ের কাছে থাকলেই পারতিস। সমুদূরে আসবার কী দরকার ছেল।

একবার গণ্ডগোল হয়ে গেল। ট্যাকের মুখে অথাৎ নদীর মাথায় রান্নাবান্না চেপেছে সব নৌকায়। তিবড়ির আগুনে আর ধোঁয়ায়, অদূরের ঘন জঙ্গল কাঁপছে অস্পষ্ট আলোছায়ায়। কত নম্বরের ট্যাক আজ আর মনে নেই। কাঁড়ারের সামনে বসে কালো কালো ছায়ার মতো মানুষ সব। রাঁধতে রাঁধতে কেউ জাল ছেড়া ছিদ্র সারছে, ছোল কষছে। শীতের দিন, গায়ে মাথায় কিছু মুকুকি দিয়ে বসেছে সবাই। ঠাকুরের নাম করছে। কেউ কেউ। ট্যাকের মুখে যেন হাট বসেছে একটি।

নৌকার হাট। অথাৎ শাবর। তখন ভাটার টান। গায়ে গায়ে সব নৌকা। এক-আধ হাতের ফারাক আছে। রাখতে হয়। প্রাকৃত কাজকর্ম সারবার জন্যে একটু ফাঁকা-ফারাক দরকার। ভাটার টানও বড় টান। বড় সাবধানে রাখতে হয় নৌকা। একটিও যদি ফাঁক পেয়ে ভাটার টানে ভাসে, তবে একেবারে সাগরে। আর ফিরবে না। এমনও কত গেছে। বাদবাকিরা সব বিস্ময়ে দূর সমুদ্রের ঝিকিমিকি অন্ধকারের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখেছে। দিনের বেলা রোদের ছটায় বড় বড় হ্যাঁকা আছড়ে পড়ে। গলানো রূপা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। চৌদিকে। নেই, কোথাও পাত্তা নেই। সেই নৌকার। সবারই বুকের মধ্যে কেমন যেন চমকে চমকে ওঠে। শোনে কান পেতে। যেন সেই আকাশের কোল থেকে শব্দ আসছে, আগ ভেইসে গেলুম গাঁ, বাঁচাও।

তারপর আবার জোয়ারের মুখে হয়তো দেখা যায়, নৌকা এসেছে ফিরে। ঠেকে আছে হয়তো কোনও ট্যাকের মুখে। সেগুন কাঠের নৌকা যে। ছই আছে কি নেই। জিনিসপত্র নেই, মানুষও নেই। নেই। চোখের সামনে সমুদ্রের জল এক পলকের জন্য লাল হয়ে ওঠে, আর টুকরো টুকরো মাংস, জ্যান্ত মানুষের।

সবচেয়ে বড় রকমের ভোগ ছিল অনেক সন আগে। সে ছিল খুলনার ওদিককার পানসা সাই। পানসা হল, ভাঙন, ভেটকি, বাটা, ভোলা মাছের পাটা জালের সাই। খুব বড় সাই ছিল। নৌকা ছিল কুল্যে প্রায় ছত্রিশ গণ্ডা। নৌকা পিছু তিনজন মাঝি। তার মধ্যে কুড়িগণ্ডা গিয়েছিল সমুদ্রের মধ্যে। বোধহয় পোল্লায় মাছের চকের দেখা পেয়ে পেছু নিয়েছিল। এ তো আর লঞ্চ স্টিমার নয়, মাছ। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সে হাওয়া। কুড়িগণ্ডা নৌকা কী করেছিল কে জানে। নিশ্চয়ই দ্যাখ-দ্যােখ করে পেছনে ধাওয়া করেছিল। হয়তো ঘিরেও ছিল মাছের বিরাট চক। ক-নৌকা বোঝাই করেছিল, কে জানে। ওর যে বড় দুর্জয় টান। নেশার চেয়েও দামি জিনিস। তখন আর ঘর-গৃহস্থ, সামনে পিছনে, কোনও কিছুর খেয়াল থাকে না। মনে থাকে না। টাকার লালসা।–আদিগন্ত সমুদ্রের ফোঁসানি গর্জানি কানেও ঢোকে না। কারুর। চক ঘিরে পাটা জাল ফেলে তুলে ফেলা নিয়ে কথা। ওই ফেলে তুলতে তুলতেই যে কতদূর টেনে নিয়ে যায়, সে খেয়াল হয়। পরে। কে জানে সেই কুড়ি গণ্ডা কত দূর গিয়েছিল। যখন খেয়াল হয়েছিল, তখন সমুদ্রের কোন সীমায় গিয়ে পৌঁছেছিল, কে জানে। কিন্তু আর ফেরেনি কোনওদিন, একটিও না। কুড়ি গণ্ডা নৌকা, নৌকা পিছু তিন জন মানুষ। কুলছাড়া, দিকহারা, এতগুলি মানুষের হাঁকেও সমুদ্রের হ্যাঁকা থম খায়নি। তাঁর আকাশজোড়া, কালো কুচকুচে লকলকে ফণা। সেই কোন গহনে, পাতালে তাঁর শরীর গিয়ে ঠেকেছে। স্বয়ং নর নারায়ণ উদ্ভাসিত ওয়ার কোল জুড়ে। ভগবানের আশ্রয়। উনিই বোধহয় ফুঁসে উঠেছিলেন উল্লাসে। উনিই তো মহাসমুদ্রের বেশে জুড়ে আছেন তাবৎ সংসার। এবার আর মাছের চক নয়, মানুষের চক।

তুমি মারো মাছ, তোমাকে মারেন। আর এক জন। সংসারের নিয়ম। কুড়ি গণ্ডাটা ব্যতিক্রম, তবে মাছমারাদের কাছে ব্যতিক্রম নয়। তার মরণের লিখন একটু অন্য রকম হয়। যার সঙ্গে তোমার বাস, যে তোমার শ্বাস, সেই মাছের সঙ্গে তোমার মরণের সুতো গাঁথা হয়। বাইরে মরো আর ঘরেই মরো। নিদেনকালে একবার রক্তমাখা মীনচক্ষুর সঙ্গে চোখাচোখি হবে তোমার।

মাছের চক ভুলিয়ে নিয়ে গেছল মানুষের চক। মাছমারাদের ঘরে, মহাসমুদ্রের মহাত্মকুধা এমন রুদ্ররূপে আর দেখা দেয়নি। জিজ্ঞেস করো পুরনো মানুষদের, টাকি হাসনাবাদের বুড়ো মেছুড়েদের, বসিরহাট বীরপুর পুরোখোঁড়গাছিদের, বুড়ো ব্যাপারি। আড়তদারদের। সমুদ্রের সঙ্গে যাদের কারবার জিজ্ঞেস করো তাদের। সবাই জানে সেই কুড়ি গণ্ডার কথা। এখনও যারা চকের পেছন নেয়, তাদের একবার মনে পড়ে বোধহয় সেই কথা। কান পাতলে শোনা যায় নাকি সেই অগুন্তি মাছমারাদের নিদেন কান্না।

শোনা যায় বইকী! ঘোর নিশিতে সাইয়ের জেলেরা যখন ঘুমোয় ছাঁইয়ের মুখছাটের কাছে, আধখানা মাদুরে শুয়ে আর আধখানায় গা ঢেকে, তখন সুদূরী গাছের বাতাসে, দূর সমুদ্রের বুকে শোনা যায়। সেই কান্না। অচেতন ঘুমের মধ্যে তখন লাগে নিশির ঘোর।

তারা তোমার মতোই। বউ-ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি রেখে এসেছিল। ঘরে। বলে এসেছিল অনেক কথা। ঋণ শোধ করবে। মহাজনের, ভাঙা ঘর সারবে, চাওয়া-পাওয়া মেটাবে ঘরের মানুষের, বিয়ে দেবে ছেলেমেয়েদের। কত জনোর কত ভাবনা, কত আশা। ঠিক তোমার মতো।

তাই সারাদিন পরে তাদের কান্না এসে বাজে তোমার কানো। এই সমুদ্রের বুকে তোমার ঘুম আচমকা ভাঙিয়ে জানান দিয়ে যায়। মনে করিয়ে দিয়ে যায়। তাদের প্রাণ থেকে মানুষের লীলা বিদায় নিয়েছে। এই আদিগন্ত জলে, কুড়ি গণ্ডাকেও বড় একলা লাগে তাদের। তারা তোমাকে ডাকে। কখন কোন বেশে এসে যে ডাকবে, তুমি জানো না।

তবে অভয় আছে সঙ্গেই। দলের মধ্যে থাকে গুণিন। সে জেগে বসে পাহারা দেয়। বিপদ বুঝলে, সে-ই রক্ষে করে। এর মধ্যে তো না-বলার কিছু নেই। সকলেই জানে যারা সমুদ্রে এসে আর ফিরে যায় না, তারা ভিন্ন রূপ ধরে বাস করে এখানে। তাদেরই মায়া ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। মায়াবীরা নানান বেশে তোমাকে ডাকবে। কখনও পানসা চক হয়ে লোভ দেখাবে, ইলিশ মাছের চক হয়ে ডেকে নিয়ে যাবে। এ সব ব্যাপারে গুণিন যা বলবে, তা-ই মানতে হয়। না শুনলে, মরণ।

যাক, সে সব অনেক কথা। যে বারে সেই গণ্ডগোলটা ঘটে গেল, সে বারে সে দিনে, ভাটার সময় ট্যাকের মুখে পাঁচুদের সাই। রান্না চেপেছে, কোনও কোনও নৌকায় চুকে গেছে রান্না-খাওয়ার পাট। ঠাকুরের নামের সুরে ঘুম-ঘুম আমেজ লেগেছে অনেকের। পাঁচু তখন খাড়ি মুসুরির ডালে কাঠের কাঁটা ঘুঁটছে। তিবড়িতে ফোঁসফোঁস করছে আগুন।

সেই আলোয় দেখতে পাচ্ছে, দাদা নিবারণ সুতোর কাটিম কোলে ফেলে সেলাই করছে জাল। কিন্তু চোখের নজরটা যেন কেমন কেমন। মাথার সহস্ৰ-শলুই কিলবিলে চুল বেয়ে পড়েছে ঘাড়ে। গালে দাড়ি নেই। কিন্তু থুতনিতে আর গালে গোঁফদাড়ি বড় হয়ে ঝুলে পড়েছে।

সাইদার কিনা! সমুদ্রের নিয়ম, যারা আসবে, সেই মাছামারারা চুল-দাড়ি কাটবে না, কাপড় ছাড়বে না। করলেই অনাচার। যখন যেমন, তখন তেমন। জলের আচার-বিচার ডাঙায় চলে না। সমুদ্রে এলে, সমুদ্রের মতো। অনাচার করলে মরণ। ওই একটি জিনিস, মরণ। জীবনের শেষ আর প্রথম, এইখানে পদে পদে ফেরে। জীবন মরণের পাশাপাশি বাস যে!

তবে দিনকাল বদলে গেছে। আগের মতো কিছুই নেই। আর। এখন দু-শো আড়াই-শো লোকের হয়ে শুধু সাইদার না কামালে, না কাপড় ছাড়লেই হয়। তাই নিবারণের মুখে গোঁফ-দাড়ি, মাথা-ভরতি চুল। তিবড়ির আগুনের আলোয় পাঁচু দেখলে, সামনে তার বসে আছে হিংস্র বাঘ। নিবারণের নাকের পাটা উঠছে ফুলে ফুলে। চোখ জ্বলছে। ধকধক করে। নজরে যেন শিকার খোঁজার ছিল। কীসের যেন গন্ধ শুকছে। একবার দেখছে বনের দিকে, আর একবার বারোগণ্ডা নৌকার উপর। পাঁচুর মনটা কু গাইতে লাগল। এ তো রকমসকম ভাল নয়। গুণিনের। কীসের সন্ধান পেল, কে জানে। বুকের ছাতি শক্ত হয়ে উঠেছে। হাত পায়ের পেশি পাকিয়ে পাকিয়ে। উঠছে আওড়ের জলের মতো। দানের খোঁজ পাওয়া গেল নাকি।

পাঁচুর আর ডালের কাঁটা ঘোঁটা হল না। দেখল, দাদা তার ছাঁইয়ের ওপর লটকানো লগার উপরে জাল ছড়িয়ে দিল। দিয়ে ডাকল চুনুরি বশীরকে। বশীরও গুণিন মানুষ, তবে জোয়ান বলেই নাম বেশি। বশীর আসতেই নিবারণ বললে, কিছু টের পাচ্ছ বশীর?

চোখে চোখ মিলল দুজনের। যেন ঘষাঘষি হল চকমকি পাথরে। তাতে অন্ধকারে আলো জ্বলে উঠল পাঁচুর চোখে। সেও টের পেল।

বশীর বলল, একবার পড়েছে আমার চকে। তবে, ত্যাখন তাতো গা দি নাই। তোমার চকেও যাখন পড়েছে, ত্যাখন আর ভুল নাই নিবারণদা। কবার দেখলে?

নিবারণ বললে, বার তিনেক। ওই, সামনের হেতাল বন দেখতেছ, পেছনে তার সুঁদূরী। ওই সঁদরীর আগডাল থেকে মেরেছে।

বশীর বললে, আমুও তাই দেখেছি। শলাইয়ের কাটি জ্বালার ইশারা মনে হল।

নিবারণ ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, ওতে আর সন্দেহ নাই। কিন্তু ইশারাটা মারছে কাকে? সে তা হলে এই বারো গণ্ডার মধ্যে আছে।

আবার চোখাচোখি হল দুজনের। সর্বনাশ! আট হাজার টাকা রয়েছে সাইয়ের সঙ্গে। উপায়? দিনমান নয় যে, নৌকার মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে যাবে। নোঙর তুললে টেনে নিয়ে যাবে ভাটার সমুদ্র। অন্ধকারে দিকশূল হয়ে, চির-জীবনের জন্যে সমুদ্রে ড়ুবে থাকতে হবে।

নিবারণ বলে উঠল, বশীর, বারো গণ্ডার বেশি লৌকো আছে। তবে সাইয়ে। শালারা আছে আমাদের ভিড়ের মধ্যেই। কখানা লৌকো আছে গুনে দেখতে হয়।

আরে বাপরে, সেকি চাট্টিখানি কথা! আটচল্লিশটি নৌকার মধ্যে যদি দুখানি বেশি থাকে, কে গুনবে এই অন্ধকারে। গাছ-গাছালির অন্ধকারে মাস্তুলও অস্পষ্ট। নইলে মাস্তুল দেখে গোনা যেত।

নিবারণ এক মুহূর্ত দূরের বনের দিকে তাকিয়ে রইল। শীত-আড়ষ্ট গভীর জঙ্গল, দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল জুজুবুড়ির মতো। চোখ ফিরিয়ে নিবারণ বলল, মনে হয়, পাড়ের দিকে আমাদের যে লৌকোগুলান ভিড় করে রয়েছে, ওদিকেই ওদের লৌকো আছে। ইশারা চলছে। ওখেন থেকেই। এক কাজ করো। তুমি এক দিক দিয়ে যাও বশীর, আমি এক দিক দিয়ে যাই। পিতি লৌকোর লোকজন-ই আমাদের চেনা। যে লৌকোয় দেখবে, সবাই শুয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই, ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, কে আছে সে লৌকোয়। তিন ডাকে জবাব না পেলে ছেড়ে দেবে, নজর রাখবে। তবে আমাদের কিন্তু নোঙর তুলতে হবে।

নোঙর তুলতে হবে? এই ভাটার সময়ে? সমুদ্র টেনে নিয়ে যাবে যে!

নিবারণ বলল, এখন নয় পরে। জোয়ারের মুখে। এই যে দেখছ, পুব কোলের তারাটা, বনবন করে ঘুরছে, লাল-নীল-হলদে রং বদলাচ্ছে, ওটা য্যাখন মাথার উপরে আসবে, ত্যাখন জোয়ার ডাকবে। তার দেরি আছে এখনও। ত্যাতখোনে ইশারাটা বন্ধ রাখতে হবে। যে লৌকো থেকে ডাঙার ইশারা চালাচালি হচ্ছে, সেই লৌকোর কাছে থাকতে হবে আমাদের কয়েকজনার; বুইলে? সুমুন্দিদের টু শব্দটি করতে না দে, ওখানেই পেড়ে ফেলতে হবে। ইশারা না পেয়ে সুদূরী গাছে সুমুন্দিরা ওত পেতে বসে থাকবে আশায় আশায়। যেমনি জোয়ার আসবে, নোঙর তুলে ফেলে একেবারে ওপারে।

পাঁচু বলে উঠল, যদি পেছু নেয়?

নিবারণ বলল, ত্যাখন দেখা যাবে। পোঁচো, তুই ডাল নামমে খেয়েনে, আর খাওয়া ধোয়ার ফাঁকে খবর দে আশপাশে।

বলে উঠে গেল দুজনেই। বোঝ ব্যাপার! ডাল নামিয়ে তখন আবার খাওয়া। বলে, নজর সেই যে গিয়ে পড়ল আধার বনে, তাই আর নড়ল না পাঁচুর, সে খাবে! কোনওরকমে ভাত ডাল চাপা দিয়ে রেখে, পাশের নৌকার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বললে সে। পাশের নৌকা বলল, তার পাশের মাঝিকে। দেখতে দেখতে অনুমান করা গেল, সাই সজাগ হয়ে গেছে। সাই-এর সঙ্গে মোটরলঞ্চের সারেঙ, খালাসিও সজাগ।

দেখা গেল, বারো গণ্ডার উপরে তিন নৌকা বেশি। ঘাপটি মেরে আছে সাই-এর তিন দিকে। সজাগ হয়েছে তারাও। উশখুশ করছে। তিন নৌকায় লোক আছে জনা সাতেক।

একে একে সব নৌকার তিবড়ির আগুন আর হ্যারিকেন নিভল। অন্ধকার দরকার। তারপর নিবারণ আর বশীর দুজন বাছা লোক নিয়ে এক-এক নৌকায় ঢুকল। সাতটাকে খ্যাপলা জালে ধরার মতো পিছমোড়া করে আর মুখ বেঁধে ঢুকিয়ে দিল ছাঁইয়ের মধ্যে। কিন্তু গোটা বারো গণ্ডা-ই তখন ভয়ে কাঁপছে। সকলের নজর সূদুরী বনের আগডালে আর আকাশের তারার দিকে।

বশীর বলল, সব কটাকে একটা লৌকোর মধ্যে ঢুককে ছেইড়ে দেও ভাটার মুখে। যাক সমুদুরে।

নিবারণ বলল, না। আকচ বাড়িয়ে দরকার নেই। রক্ত-জাল-করা টাকাটা চালান করে দিতে পারি তবেই রক্ষে। পাণে মারলে আমাদেরও পাণ নে টানাটানি হবে। শালারা থাকবে এখানে নোঙর করে। সকাল বেলা এসে ওদের নোকেরা নে যাবে।

সাইদারের উপযুক্ত কথা। প্ৰাণ নিয়ে কারুর সঙ্গে টানাটানি করে লাভ নেই। তুমি মাছমারা। মাছ তোমাকে সাক্ষাৎ মারে না। কিন্তু মাছেরই ঝাঁকে, তারই চলাচলের পথে, গহিন আশ্রয়ে ওত পেতে থাকে তোমার মরণ। যতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখবার, সে বাঁচিয়ে রাখবে তোমাকে। লীলা শেষ হলেই সে আসবে অন্য মূর্তি ধরে।

সে যে শুধু সমুদ্রে তা নয়। খালে বিলে, এমনকী গঙ্গায়ও আসে সে নানান বেশ ধরে–যেমন এল এবারে ডাকাতের বেশ ধরে। কিন্তু এ শুধু তোমাকে ভয় দেখানো, ওসাকানো। তোমাকে ইশিয়ার করা। জলে ডাঙায় সমান নজরে ইহঁশিয়ার থাকতে বলছে তোমাকে। ভাগ্য নিয়ে খেলা। একটু ভুল করবে। আর ফিরতে পারবে না প্ৰাণ নিয়ে। এইটা সংসারের নিয়ম। মানুষের সংসারের বাইরে তোমার বাঁচার জায়গা। যেখানে জীবনকে আড়াল করে মরণ সব সময় হাত বাড়িয়ে আছে। ওই হাতের পাশ কাটিয়ে ফিরতে হবে, যতক্ষণ বুকের ধুকধুকি চলবে।

সাতজনকে মারলে, আমাদের চৌদ্দজন মরতে পারে। টাকার জন্যে ডাকাতেরা পিছন ছাড়বে না। ওইটাকে বাঁচাতে পারলে, ওদের স্বার্থ গেল। আক্রোশ থাকবে, কিন্তু তার রকম হবে আলাদা। সে ফুসবে, সুযোগ খুঁজবে। সবাই সুযোগ খোঁজে, না পেলে ফুঁসে মরে। তুমি মাছ না পেলে ফোঁসো। তোমার মরণও ফুসবে। যতক্ষণ পারে, তাকে সুযোগ দিয়ো না।

সুঁদুরী বনের মাথা থেকে আবার চকমকি কাঠি জ্বলল। ওদের ভয় আছে নীচে থাকতে। যদি বাঘের পেটে যায়? এবার দেখল। সবাই সভয়ে। টেরও পায়নি, কী ঘটে গেছে বাছাধনদের। সাইদার নিবারণের পেছনে লাগা সহজ নয়। ভেবেছিল সবাই ঘুমুবে, আর তিন নৌকা নিঃশব্দে তরতর করে যাবে পারে। কিংবা ওই হোগলা-হোতালে ঢোকানো আছে হয়তো আরও নৌকা। ইশারা পেয়ে, এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘুমন্ত সাইয়ের ওপর।

তারপর চাক্ষুষ-ঘুরন্ত তারাটা এল প্রায় মাথায় মাথায়। নৌকা ঠেলা খেল উত্তরে। ঢেউয়ের বাড়াবাড়ি কমেছে। গর্জনও ড়ুব দিয়েছে একটু জলে। জোয়ার ডেকেছে। সাড়া-শব্দ নয়। নিঃশব্দে নোঙর তুলল বারো গণ্ডা। তরতর করে ভেসে গেল নতুন চটির দিকে। নতুন বাংলো হয়েছে সেখানে। ডাকাতের সাহস করে সেখানে আসতে পারে না।

তবে ব্যাঘাত বলে একটা কথা আছে। সব সময়ই সে বার মনে হত, ডাকাতেরা আছে। পিছনে পিছনে। সারা সাইয়ের বুকে কাঁটা বিঁধেছিল সে মরশুমটা। কাঁটাটা আর কিছু নয়, আসলে সাবধানতা। সাবধানের মার নেই। সেই বারো গণ্ডা-ই সেই ট্যাকের মুখে রাত কাটিয়েছে আবার। কিন্তু কোনও বিপদ-আপদ হয়নি।

 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *