০২. বুড়িকে সঙ্গে আনলে

বুড়িকে সঙ্গে আনলে মাছ মারা আর হয়ে ওঠে না গফুরের। মাছ ধরার চাইতে বেশি হয় কথা আর তারও বেশি খুনসুটি। খলুই অর্ধেকও ভরে না। এমন দিনও গেছে যেদিন শুকনো জাল শুকনোই থাকে, জলে আর ভেজে না। খলুই গড়াগড়ি যায় পাটাতনে। সেদিন গফুর ঘরে ফেরে না। বুড়িকে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে সোজা চলে যায় গঞ্জের হাটে। শূন্য খলুই দেখলে পড়শিরা হাসাহাসি করে। বুড়িকে বাঁকা কথা শোনায়। সেদিন বুড়ি চুপচাপ গিয়ে সলীম লীমের পাশে শুয়ে থাকে। যেন গফুর কোথায় গেছে ও তা জানে না। মাছ ধরতে না পারলেও গফুরের কোন ক্ষোভ থাকে না। বুড়িকে নিয়ে ডিঙি বাওয়াটাই মজা। আঁধার থাকতে বেরিয়ে যায়, আঁধার কাটার আগেই ফিরে আসে। তবু কখনো কারো কারো সামনে পড়ে যায়। দুচার কথা শুনলেও সেটা হজম করে নেয় গফুর। এ আনন্দ ওর জীবনে কোনদিন আসবে ও কি তা ভেবেছিল! জীবনের এ পরিবর্তন গফুরের কাছে পরম রমণীয় মনে হয়। মাছের খলুইয়ের শুকনো ভেজা হিসেব নিরর্থক হয়ে যায়। মনে হয় এদিন প্রতিদিন হোক। বুড়ি এমনি করে খুব কাছাকাছি এসে ধরা দিক। ঘরে বুড়ি শামুকের মতো গুটিয়ে যায়। হদিস বের করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে গফুর। বুড়ি নির্বিকার। গফুরের কাছেও ঘেঁষে না। সলীম কলীমকে নিয়ে মাতামাতি করে। গফুর কৃত্রিম অভিযোগ করে, ছেলে দুটো তোকেই ভালোবাসে বেশি। আমাকে পর করে দিল।

–হিংসা কর?

–করিইতো। মাঝে মাঝে আমার সয় না। তুই জাদু জানিস বুড়ি।

–উঁহু মোটোই জাদু না। ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা মিলে।

–মিছা কথা। ভালোবাসা দিলেই কি আর ভালোবাসা মিলে? মনে হয় না। নইলে আমি হাপিত্যেস করি কেনো?

গফুরের চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। কণ্ঠস্বরও।

–বাবা অতো কথা বুঝি না। আমার কাজ আছে যাই।

বুড়ি গফুরের সামনে থেকে সরে পড়ে। কাছে থাকলেই কোন না কোনভাবে ধরা দিতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও দিতে হবে। কিছুতেই যেন গফুরের আশ মেটে না। বুড়ি সলীম কলীমকে নিয়ে নাইতে চলে যায়। মন দিয়ে ঘরের কাজ করে। বিরোধহীন দিনগুলো নির্বিবাদে গড়ায়। গফুর হাল বায়, মাছ ধরে, হাটে যায়। বুড়ি ঘর সামলায়। কখনো ঠিকঠাক সব সামলে যায়, কখনো এলোমেলো হয়ে যায়। পাড়াপড়শি, আত্মীয় স্বজনের দুচারটে কথা শোনে–গালমন্দ খায়। ভাই বকাবকি করে। মা উপদেশ দেয়। তবুও ওসবের বাইরে বেহিসাবী কল্পনার রাশটা যখন আলগা হয়ে যায় তখন মন কেমন করে। নইলে নিজের মনের মধ্যে একটা নিপুণ সুখের খাঁচা বুনে নিয়েছে বুড়ি। নিতে বাধ্য হয়েছে। জানে এর বাইরে ওর কিছু করবার নেই। তাই পারিপার্শ্বিকের ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো, ওঠানামা, সমতল-অসমতল বিস্তার বুড়ি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে।

কিন্তু বাধ সাধলো প্রকৃতি। অনুভবটা বুড়ির নিজের মনের এবং সেটা বড় বেশি তীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী। যে চপলতা, চাঞ্চল্য, বাইরের ডাক বুড়ির নাড়িতে সেই একই তীব্রতা ওকে ঠেলে নিয়ে যায় সন্তানের আকাক্সক্ষায়। বিবাহিত জীবনের তিন বৎসর ভালোই কেটেছে। চার বছর থেকে শুরু হলো বুড়ির দিন গোনার পালা। মাঝে মাঝে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে ওর ঘৃণা হয়। এই শরীরটা কি মা হওয়ার উপযুক্ত নয়? কেননা শরীরের মধ্যে পরিবর্তন অনুভব করে না? কেনো কিছু একটা নড়ে ওঠার ধাক্কায় আচমকা চমকে ওঠে না? বুড়ির মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কারো কাছে খুলে বলতে পারে

মনের কথা। অহরহ নিজের ভেতরে গুমরে মরে। গফুর সন্তানের জন্য খুব বেশি উচ্চবাচ্য করে না। ছেলেতো রয়েছে। আর না হলেই বা কি? এইতো ভালো আছে বুড়ি, কেমন নির্ঝাঞ্ঝাট। যখন যা খুশি তখন তা করতে পারে। দিনে রাতে অনেক কাছে পাওয়া যায় ওকে। হুটোপুটি মাতামাতিতে কোনো বাধা নেই। আসলে গফুর চায় না যে। বুড়ি অন্য কোথাও বাঁধা পড়ুক। ও আর কিছু নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখুক। তাছাড়া একটা বাচ্চার ঝক্কি কি কম! ধুত! দরকার নেই। বুড়ি গফুরের একলার। আর কারো নয়। কিন্তু গফুর যাই ভাবুক না কেনো বুড়ির দিন আর কাটতে চায় না। দিন দিন নিজের মনে কুঁকড়ে যেতে থাকে। এখন বাইরে যেতেও ভালোলাগে না। ঘরেতো মন বসেই না। এখন অন্য কিছু চাই। চারটি বছরের আনন্দ উত্তেজনা বুড়ির জীবনে বোঝা হয়ে চেপে বসে। গফুর ওকে সান্ত্বনা দেয়।

–তুই এত ব্যস্ত হয়েছিস কেনো বুড়ি? ছেলেতো আমাদের রয়েছে? ওরা কি তোকে সুখ দেয় না?

–দেয় কিন্তু তেমন করে দেয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা আমার কেউ না। এবার আমার নিজের চাই। নাড়িছেঁড়া ধন চাই! আমার শরীরের ভেতর উথাল পাথাল চাই! আমার–আমার–

বুড়ি আর কিছু বলতে পারে না, মুখে কথা আটকে যায়। কেমন করে গফুরকে বোঝাবে? গফুর পুরুষ। সন্তানের উপলব্ধি এত নিবিড় করে ও কোথায় পাবে? সেজন্য মাঝ পথে বুড়ির কথা থেমে যায়, বুকের দরজা বন্ধ করে ফেলে।

বুড়ির মুখ করুণ দেখায়। সেই বাঁধ-ভাঙা হাসি কমে গেছে। চেহারার দীপ্তিময় লাবণ্যে ছায়া পড়েছে। বুড়ি আর আগের মতো নেই। বদলে যাচ্ছে। এ পরিবর্তন গফুরকে কষ্ট দেয়। কিছু করতে না পারার অক্ষমতায় চুপসে থাকে। ভোররাতে একা একা জাল নিয়ে বেরুলে গফুর সেই উচ্ছ্বাস ফিরে পায় না। যাকে কেন্দ্র করে ওর পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবন অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। কখনো কাছে বসিয়ে বুড়িকে আদর করে সান্ত্বনা দেয়।

–ছেলের জন্যে অনেক কষ্ট সইতে হয় বুড়ি?

–জানি। কষ্ট না সইলে বুঝব কি করে মা হওয়ার কি জ্বালা। আমার আর কিইবা করার আছে? দুবেলা রাধাবাড়া, খাওয়া-দাওয়া, ধান সেদ্ধ, হাঁস-মুরগির খোয়াড় খোলা? না আমার আরো কিছু চাই। ছেলে-পুলে না হলে আমি নদীতে ডুবে মরবো?

বুড়ি ফিকে হাসে। গফুর চুপচাপ বসে থাকে। এর বাইরে ওকে আর কিছু বলা যায় না। ও এখন যন্ত্রণা চায়। যন্ত্রণার ভেতর থেকে নিংড়ে আনতে চায় পরিশুদ্ধ আনন্দের ফুল। নইলে জীবন ব্যর্থ। আশা-আকাঙ্ক্ষা ঐ এক জায়গায় এসে থেমে গেছে। এমনকি গফুরকেও একপাশে ঠেলে রেখেছে। বুড়ি এখন আর কিছু বুঝে উঠতে চাইছে না। মা হওয়া ওর একান্ত দরকার।

মাঝে মাঝে পড়শিরা খোঁচা দেয়।

অমন ধিঙ্গি মেয়ে ধেই ধেই করে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ালে পোলাপান হয় নাকি? হাওয়া বাতাস বলে একটা জিনিস আছে না? বেলা অবেলা আছে না? মেয়ে মানুষের সব সময় সব জায়গায় যাওয়া ঠিক নাকি?

বুড়োদের মুখ ঝামটা খেয়ে বুড়ি চুপ করে থাকে। হাওয়া বাতাস, বেলা অবেলা যত কিছুই ওরা বলুক না কেন তার সঙ্গে মা হওয়ার কি সম্পর্ক বুড়ি বুঝতে পারে না। তবু কথা বাড়াতে সাহস হয় না। অনেক কিছুই তো ও জানে না। হয়তো গৃঢ় কোন কিছু থাকতে পারে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো। ও এখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় আবর্তিত। কিছুদিন আগে হলেও যেটা সে হেসে উড়িয়ে দিতে পারতো, এখন কীসের যেন ভয়। যদি ওর অবিশ্বাসে ক্ষতি হয়? যদি আকাক্সিক্ষত ফল লাভ না হয়? বুড়ি তাই মনেপ্রাণে মুরুব্বিদের কথা মেনে চলার চেষ্টা করে।

শুরু হয় গ্রামের টোটকা ওষুধের ব্যবহার। যত রকমের যত কিছু থাকতে পারে কোনটাই বাদ দেয় না। যে যা বলে বিনাদ্বিধায় তা বিশ্বাস করে এবং খুব নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করে। আরো দুটা বৎসর কেটে যায়। প্রহর গোনা শেষ হয় না। আকাঙ্ক্ষাতেও ভাটা পড়ে না। বরং তা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। আজকাল সলীম, কলীম যখন মা, মা বলে আবদার করে তখন মাঝে মাঝে কেমন বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঐ শব্দটা ওকে একদম বিহবল করে ফেলে। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করে। কোন দিন এক ঝটকায় দূরে ফেলে দিয়ে চুপচাপ পুকুরঘাটে গিয়ে বসে থাকে। জলের বুকে মাছের ফুটকি কাটা দেখে। নিজের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করে, নিজের আচরণের জন্যে লজ্জা পায়। সলীম লীমের মলিন মুখের কথা মনে করে ওর কষ্ট হয়। তবুও নিজের সঙ্গে আপস করতে পারে না বুড়ি, বুকে আকণ্ঠ পিপাসা।

মনোবিকলনের এমনি মুহূর্তে একদিন দক্ষিণ পাড়ায় বেড়াতে এলো ওর ছোটবেলার সই নমিতা। অন্যগাঁয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে ওর সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়। বুড়ির। অনেকদিন পর নমিতাকে দেখে বুড়ির আনন্দের সীমা নেই। দুজনে পানের বাটা সামনে নিয়ে পা বিছিয়ে গল্প করতে বসে।

একথা সেকথার পর নমিতাই বলে, তোর যেন কি হয়েছে বুড়ি।

–কৈ কিছু না তো?

–তুই আর আগের মতো নেই।

–বয়স হচ্ছে তো। বুড়ি আর কথা বলতে পারে না। নমিতাও চুপ থাকে।

–তোর ছেলে পুলে কটি নমিতা?।

–আটটি। এক দঙ্গল ছেলেপুলে নিয়ে সারাদিনে একটুও সময় পাই না। তুই বেশ নির্ঝাঞ্ঝাট আছিস।

–আমি নির্ঝাঞ্ঝাট থাকতে চাই না নমিতা। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে নমিতার বুক মুচড়ে ওঠে।

–তুই শ্রীনাইল ধামে গিয়ে সিদ্ধপুরুষ কেশা বাবার নামে মানত কর।

নমিতার কথা বুড়ির দুকান ভরে বাজতে থাকে। সন্ধ্যা উতরে গেছে, ঘরে আলো দেয়া হয়নি। সলীম কলীম খেলা শেষে ঘরে ফিরেছে। গফুর এখনো ফিরেনি। তবু উঠতে পারে না বুড়ি, চুপচাপ বসেই থাকে। ওর মনে হয় নমিতার কথাগুলো ঘরের। চাল থেকে, বাঁশের বেড়া থেকে, পানের বাটা থেকে, ওর শাড়ির মধ্য থেকে, অনবরত উঠে আসছে। নমিতা চলে গেছে বেলা থাকতে। অথচ বুড়ি আচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে।

প্রতি বৎসর শ্রীনাইল ধামে পৌষ মেলা হয়। হাজার হাজার নারী-পুরুষ হৃদয়ে বহুবিধ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এখানে আসে। ধামের বুড়ো নিম গাছের নিচে গড়াগড়ি যায় ধুলো মাখে মুখে বুকে গলায়। এখানে মানত করলে বন্ধ্যা নারী সন্তান পায়, অসুস্থ রুগী সুস্থ হয়, ক্ষেতে ফসল ফলে, ক্ষেত পোকামুক্ত হয় ইত্যাদি। ধামের প্রতিষ্ঠাতা কেশাবাবা সিদ্ধপুরুষ। শ্রীনাইলের দশ বিশ ত্রিশ মাইল পর্যন্ত তাঁর নাম কিংবদন্তির মতো প্রচলিত। পৌষ মেলায় হাজার হাজার লোকজনের উপস্থিতি সে কথাই প্রমাণ করে। তার নামে সোয়া পাঁচ আনার পুটলী ভক্তি ভরে নিম গাছের ডালে বেঁধে রাখলে আকাঙিক্ষত ফল পাওয়া যায়।

নমিতার অসুস্থ স্বামীকে ডাক্তার সারাতে পারেনি। সাধ্যমতো বড় বড় ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল ও। জমি বিক্রি করে টাকা পয়সা খরচ করেছিল, লাভ হয়নি কিছু। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছিল ভাল হবে না বলে। বলেছিল, তোমার স্বামী যা যা খেতে চায় তা খাওয়াও গিয়ে। আর কোনো আশা নেই।

এ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পর বুক ভেঙে গিয়েছিল নমিতার। চারদিক অন্ধকার দেখছিল। সামনে বৈধব্যের এক নিরেট শূন্যতা। আর সেই সঙ্গে অভাবের বিরাট হাঁ করা গর্ত। দিশেহারা নমিতার কিছুতেই বিশ্বাস হয়নি যে ধুকে ধুকে মরবে অক্ষয় দাস। ভেঙে না পড়ে মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করেছিল কেবল। শেষ পর্যন্ত অনেক আশা নিয়ে শ্রীনাইল ধামে গিয়েছিল। তারপর থেকে আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে অক্ষয় দাস। এখন একদম ভালো। সে সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে নমিতার কণ্ঠ ভক্তিতে গদ্গদ হয়ে ওঠে। অদৃশ্য সে মহান পুরুষের প্রতি প্রণাম জানায়। সেই তাঁর সিথির সিঁদুর হাতের শাঁখা অক্ষয় রেখেছে। আঁচলে চোখের জল মুছে নমিতা বলেছিল, খাওয়াতে পারি না তবু যে ভগবান আমাকে কেননা এতো ছেলেপুলে দেয়।

বুড়ি চমকে নমিতার মুখের দিকে তাকায়।

খাওয়া পরার বড় কষ্ট রে বুড়ি। মানুষটা এতোগুলো পেটের অন্ন জোগাতে পারে। ভগবানকে রাতদিন বলি আর না। তবু আবার এসে গেছে, মাস তিনেক চলছে।

বুড়ি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। নমিতা চলে গেছে অনেকক্ষণ। বুড়ি এসবই ভাবে। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। নমিতার অক্ষয় দাস বেঁচে গেছে, নমিতা বেঁচে গেছে। ওর মতো গভীর বিশ্বাস না থাকলেও বুড়ি সব কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারে না। আশায় আকাঙক্ষায় দুলে ওঠে ওর দুর্বল মন। সত্যি যদি কিছু ঘটে, সত্যি যদি কোনো অলৌকিক শক্তি ওর জীবনের মরুভূমিতে ফুল ফুটিয়ে যায়। নমিতার পরিতৃপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ি একটা অবলম্বন খুঁজে পায়। নিজের ভিতটা পাকা করে। কিন্তু পরক্ষণেই নমিতার রুগ্ন-দারিদ্র্যে ভরা চেহারার কথা মনে হলে বুক কটু করে ওঠে। খাওয়াতে পারি না তবু যে এত ছেলেপুলে ভগবান কেননা আমাকে দেয়। ওহ্ নমিতারে তোর কষ্ট আমি বুঝি না। আমি তোর মতো হতে চাই নমিতা। শ্রীনাইল ধামের দিকে ছুটে যাওয়ার জন্যে প্রবল তাগিদ অনুভব করে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসা সেই পরিচিত প্রবাদটা যেন আজ বুড়ির কাছে অর্থবহ হয়ে ওঠে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। কিন্তু পৌষ মেলার এখনো আট মাস বাকি। বুড়ি অন্ধকারে খড়ের

তূপের দিকে তাকায়, জমাট অন্ধকার কেমন লেপটে আছে।

ঐ সলীমের মা ঘরে আলো দিসনি কেননা? কি অলুক্ষণে কাজ কারবার যে মেয়েটার। সন্ধ্যা উতরে গেলো তবু সাঁঝের বাতি নেই ঘরে।

বুড়ি পানের বাটা গুটিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে। সলীম কলীম দৌড়ে এসে বুড়িকে জড়িয়ে ধরে।

–মা, মাগো–

–আরে ছাড়, ছাড়! অমন করে ধরলে পড়ে যাবো তো?

–ক্ষিধে পেয়েছে মা?

–চল খেতে দিচ্ছি।

বুড়ি ঘরে আলো জ্বালে। কুপির সেই শিখার দিকে তাকিয়ে বুড়ির কেবলই মনে হয়, পৌষ মেলার এখনো আট মাস বাকি। এই দীর্ঘ সময়ের কথা ভেবে ও ক্লান্তি অনুভব করে।

এর মাঝে একদিন দোতরা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে নীতা বৈরাগিণী এসে উপস্থিত হয়। বুড়ির সঙ্গে ওর অনেকদিনের হৃদ্যতা। গফুরের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই। নীতাকে দেখলেই ওর পিছু নিত বুড়ি। হাঁটতে হাঁটতে নীতার সঙ্গে অনেক দূরে যেতো। এক সময় নীতা ওকে ভাগিয়ে দিতো।

–ঘরে যা বুড়ি?

–না। আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও।

নীতা হা হা করে হাসতো। বুড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, পাগল। ঘরে যা। তোর জন্যে ঘর আছে। আমার তো ঘর নেই রে।

বুড়ি নীতার কথা বুঝতো না। কেন ওর ঘর নেই এ কথাও বুঝতো না। কিন্তু নীতা ওকে গাঁয়ের ঐ শিমুল গাছ পর্যন্ত আসতে দিত, তারপর আর না। ঐ গাছের পর আর কিছুতেই যেতে পারত না বুড়ি। ঐটুকুই ছিল ওর সীমানা। নীতা বৈরাগিণী সোজা রাস্তায় না গিয়ে মেঠো পথে অন্য গায়ে যেত। বুড়ি সেদিকে চেয়ে থাকত। নীতা গাছ গাছালির আড়ালে হারিয়ে যাবার পরও শিমুল গাছের গোড়ায় বসে থাকত ও। ঘরে ফিরতে পারত না।

এখনো এ গাঁয়ে এলে বুড়ির সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যায় না নীতা। বয়সের বেশ একটা ব্যবধান সত্ত্বেও বুড়ির সঙ্গে ওর সখিভাব। আজও উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে দোতরার টুংটাং বাজনার সঙ্গে নীতার কণ্ঠ এক চমৎকার মিড় রচনা করে–

কঠিন বন্ধুরে–
সুখে না রহিতে দিলা ঘরে
সাজাইয়া পাগলের বেশ
ঘুরাইলে দেশ দেশান্তরে
সুখে না রহিতে দিলা ঘরে–

নীতার উপস্থিতি টের পেয়ে বুড়ি চুলোর তরকারীর হাঁড়ি নামিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে আসে উঠোনে। সজনে গাছের নিচে বসা ক্লান্ত শ্রান্ত ধুলোমাখা নীতার চেহারা দেখে বুড়ি থমকে দাঁড়ায়। নীতাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে, তেলহীন রুক্ষ চুলে জটা ধরেছে। বুড়িকে দেখেই বলে, জল দে সই?

বুড়ি ঘটিতে করে পানি নিয়ে আসে। নীতা ছোঁ মেরে নিয়ে ঢক্ত করে শেষ করে ফেলে।

–অনেক দূর থেকে আসছি সই। তেষ্টায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিলো। পথে কোথাও দাঁড়াইনি। ভাবলাম তোর কাছে গিয়ে একবারে জল খাব।

–ভালোই করেছিস। কতদিন তোর কথা ভেবেছি আমি। চল ঘরে চল।

–না এখানেই বসি। এই গাছের ছায়াই ভালো। তাছাড়া এমন শীতল হাওয়া ঘরে কি পাব? এতক্ষণে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো।

নীতা কোমরে গুজে রাখা তামাক বের করে চিবোয়। শ্রান্তির ভাব কেটে যাচ্ছে। ভীষণ ভালো লাগছে। বুড়ি যেন ওর মায়ের পেটের বোন। এখানে এলেই নীতা বদলে যায়।

–এতোদিন আসিস নি যে সই?

–অনেকদিন হলো না? অথচ মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। তোর কাছে এলে সময়টা বড়ো ভালো যায় রে?

বুড়ি ওর দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে। তারপর সজনে গাছের সঙ্গে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে থাকে।

–এতদিন কোথায় ছিলি সই?

–গিয়েছিলাম মনের মানুষের খোঁজে।

–খোঁজে কেনো? তোর মনের মানুষ রামদাস কৈ?

–মরে গেছে।

–মরে গেছে? কি বলিস? নীতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, হ্যাঁ, সত্যি।

–কি হয়েছিল?

বুড়ি চুলোর তরকারির কথা ভুলে গিয়ে ওর সামনে উবু হয়ে বসে। নীতা দোতরায়

টুং টাং করে। মাথা ঝুঁকে থাকে কোলের ওপর।

–ওটা রাখ সই? কি হয়েছিল বল?

–কি হয়েছিল তা বুঝতে পারিনি। সাতদিন একনাগাড়ে জ্বর ছিল। সেদিনটা ছিল আষাঢ়ের শেষ। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।

–সাগরেদ সুবল ছিল আমাদের সঙ্গে। চোখ বুজে শুয়েছিল রামদাস। জ্বলছিল কুপি। দরজার পিঠে হেলান দিয়ে বসেছিল সুবল। বাইরে সোমেশ্বরীর বুকে দেবদারুর পাতায় বৃষ্টির একটানা শব্দ আমি শুনছিলাম। ভেতরে অসুস্থ রামদাস বেহুশ হয়ে শুয়ে আছে। আমার মনটা যেন কেমন করছিল। বারবার রামদাসের মুখের উপরে ঝুঁকে দেখছিলাম–দোতরাটা নাড়াচাড়া করছিলাম–কখনো জানালা দিয়ে তাকাচ্ছিলাম আকাশের দিকে।

–সুবল জিজ্ঞাসা করেছিল, অমন ছটফট করছো কেনো?

–আমি ওর সঙ্গে কথা বলিনি। আমি দেখছিলাম রামদাসের মুখের আঁধার, গাল দুটো গর্তে বসে গেছে। মুখের হাড় উঁচু হয়ে উঠেছে। ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, ও বুঝি আর বাঁচবে না। সময় ফুরিয়ে এসেছে। মানুষের মুখ যে মৃত্যুর আগে অমন হয়ে যায় আমি আগে আর তা কোনদিন দেখিনি সই। রামদাস এক সময় চোখ মেলে আমাকে বলল, দোতরাটা বাজাত নীতা।

–আমি একটু অবাক হলাম। ডাকলে সাড়া দিচ্ছিল না–দেখে মনে হচ্ছিল হুঁশ নেই, অথচ আমাকে দোতরা বাজাতে বলে। আরো দুএকবার নাম ধরে ডাকলাম। সাড়া দিল না। কি আর করি দোতরা টেনে নিয়ে বসলাম। মন ঠিক ছিল না। হাত কাঁপছিল। বুকের ভেতর ভয় করছিল সই। বারবার চেষ্টা করেও সেদিন ঐ দোতরায়। সুর ওঠাতে পারিনি। কেবল মনে হচ্ছিল, এ যন্ত্রটা আমি কোনদিন বাজাতে শিখিনি। রামদাসের কাছে আমি শিখিনি দোতরা ধরা।

নীতা চোখ মোছে। বুড়ির গলাও ধরে আসে। কথা বলতে পারে না। স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে সোমেশ্বরীর পাড়ে এক ছোট্ট কুটির। নীতার মুখে বহুবার সেই কুটিরের গল্প শুনেছে বুড়ি। শুনতে শুনতে ওর যেন সব কিছু চেনা হয়ে গেছে। চোখ বুজলেই সেইসব দৃশ্য দেখতে পায়। আরো শুনেছে রামদাসের কথা। রামদাস ওর মনের মানুষ। বিয়েকে ওরা স্বীকার করে না। বিয়ে ওদের কাছে কেবল অনুষ্ঠান। ওতে ওদের। প্রয়োজন নেই। ওদের কাছে মনের মানুষই সত্য। কখনো দেবদারুর ছায়ায় বসে কিংবা সোমেশ্বরীর বুকে পা ডুবিয়ে দোতরা বাজায় ওরা। কেউ কোনো কথা বলে না। কোন পাখি ডাকে না। বাতাসের শনৃশ থাকে না। শুধু দোতরার টুংটাং মূর্ধনা দেবদারুর পাতায় পাতায় অপরূপ মিড় বুনিয়ে যায়। সেই কুটিরের চারদিকে আছে শান্ত বুজের অবিচল নিষ্ঠা। দূরে মেঘালয়ের অস্পষ্ট পাহাড়ের হাতছানি। নীলাভ দেখায় সে পাহাড়ের মাথা। নীতার কাছে গল্প শুনলে বুড়ির বুকের ভেতর কাঁপন জাগে, অজানা সুখের কাঁপন। মনে হয় ও যেন নীতা হয়ে গেছে। ওর জীবনে কোথাও আর কোন বাধা নেই। চলেছে পথে পথে, গ্রাম থেকে গ্রামে, সঙ্গে ওর মনের মানুষ। সে মনের মানুষের জন্যে বিয়ে নামক অনুষ্ঠানের দরকার হয় না। লোক-লজ্জার বালাই নেই, শুধুই নিজের মনের চলা। ভাবতে গিয়ে বুড়ি উদাস হয়ে যায়।

নীতা জল খায়। মুখ মুছে বলে, তোর শুনতে খারাপ লাগছে সই?

–না তুই বল। তোর কথা শোনার জন্যে আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।

–জানিস সেদিন ভয়ানক বেসুরো বেজেছিল রামদাসের সুরের দোতরা। কেন যে অমন বাজছিল আমি নিজেও তা বুঝতে পারিনি। একসময় রামদাস চোখ খোলে। হাত বাড়িয়ে দোতরাটা টেনে নেয়। সুবলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এটা তোকেই দিলাম সুবল। তুই বাজাবি। তারপর রামদাস আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমার দোতরায় তুই আর সুর তুলতে পারবি না নীতা।

আমার চোখে জল এসেছিল। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল সই। আমি রামদাসের হাত আমার বুকে চেপে ধরেছিলাম। ওর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম।

–আমার কেন এমন হলো রামদাস?

ও সে প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।

–আমার আর সময় নেই রে। তুই তোর মনের মানুষ খুঁজে নিস।

রামদাস ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে বসায়। মাথায় হাত রাখে। বলে, কাদিস। চোখের জল সইতে পারি না। আমাকে সুখ দিতে চাইলে চোখের জল মোছ। নীতারে কেউ কারো জীবনে থাকে না। কাউকে না কাউকে যেতেই হয়। সেজন্য আমার দুঃখ নেই। তুই আর আমি যে কদিন ছিলাম ভালোই ছিলাম।

রামদাসের ঐ কথায় সুখ ছিল না সই। ঐ কথায় কি আর চোখের জল ঠেকিয়ে রাখা যায়। রামদাসের বুকের ওপর মাথা রেখে সারারাত কেঁদেছি আমি। ও আর কোনো কথা বলেনি। অনুভব করেছিলাম রামদাসের বুকের ধুকধুকানি কেবল আস্তে আস্তে কমে আসছে। সুবল দরজার কাছে মাদুর পেতে শুয়েছিল। আমি একলা মানুষটাকে আগলে বসেছিলাম। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। পুরো বর্ষায় অমন বৃষ্টি আর কোন দিন হয়নি। বাতাসে কুপি নিভে যায়। কি যে আঁধার ছিল সই। ভীষণ ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল আমিও বুঝি মরে যাচ্ছি। শেষ রাতে রামদাস মারা যায়।

নীতা উদাস চোখে চুপ করে থাকে। ঘটির জলটুকু এক ঢোকে শেষ করে। বুড়ি একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

জানিস সেদিন বাকি রাতটুকু আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ রামদাসের গানের মতো লাগছিল। রামদাসের গলা বড় মিষ্টি ছিল সই। আমি পাগল হয়ে উঠেছিলাম। সুবল একবার বাঁকা করে তাকিয়ে বলেছিল, রামদাসকে কি ধুয়ে ফেলছে বৃষ্টির জলে? আমি ওর কথার উত্তর দেইনি। ঐ কথার কি উত্তর দেয়া যায়। তুই বল সই? পরদিন সকালে বৃষ্টি থামলে আমরা দুজনে রামদাসকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম সোমেশ্বরীর বুকে। তারপর ঝোলাঝুলি কাঁধে নিয়ে যখন বেরিয়ে পড়ি তখন সুবল দোতরা বাজাচ্ছিল।

বললাম, সুবল এখানে তুমিই থাকো। আমি আর কোনদিন ফিরবো না।

–সে আমি জানি। সুবল মুখ না তুলেই বলেছিল।

–তুমি অনেক বেশি বোঝ সুবল।

সুবল আমার কথার জবাব দেয়নি। ফিরেও তাকায়নি। কেন যে ও আমাকে পছন্দ করতো না বুঝতাম না। ওর কাছে থেকে সাড়া না পেয়ে আমি আর দাঁড়াইনি। কোন দিন সোমেশ্বরীর ধারে ফিরেও যাইনি।

এ পথই হলো আমার ঘর। বহুদিন বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি সই কিন্তু সুখ পাইনি। কত আখড়ায় গেলাম। কিন্তু শান্তি কৈ? কেউ কেউ আছে সই পথের ধুলোর মতো। না চাইলেও পায়ে এসে জড়ায়। কেউ আকাশের মেঘ। হাপিত্যেশ করলেও বৃষ্টি হয়ে নামে না। এ করেই তো পথ চলি, মন না চাইলেও চলতে হয়।

নীতা গান ধরে—

সুজন মন আমার
খুঁজে দেখ তুই
তোর মনের মানুষ কই?

নীতা গান গায়, অনেকটা গুনগুনিয়ে, দোতরার শব্দ নেই।

বুড়ি চুপচাপ বসে থাকে। গান শোনার চেষ্টা করে। নীতার সঙ্গে কথা বললেই ওর মন অস্থির হয়ে ওঠে। নীতা বুড়ির জীবনে এক নিষিদ্ধ বাহকের মতো। নিষিদ্ধ জগতের খবর বয়ে নিয়ে আসে। যে খবরে ওর কোনো অধিকার নেই। বুড়ির হঠাৎ মনে হয় ওর মনের মানুষ নেই। গফুর ওর মনের মানুষ হতে পারেনি। ওদের জীবনে কেবল অনুষ্ঠান সত্য। অনুষ্ঠানের জের টেনে একটা মেকি লৌকিকতা বজায় রাখতে হয়। সমাজের নামে, ধর্মের নামে। আর এজন্যেই নীতা যা পারে বুড়ি তা পারে না। নীতার জীবন দক্ষিণা বাতাস। যেদিক খুশি সেদিক বয়। আর বুড়ি? বুড়ি বদ্ধ ঘরের গুমোট গরমে তালপাতার ক্ষীণ বাতাস। কোন দিকেই নড়তে পারে না। ইচ্ছে মতো ছোটাও যায় না। বিয়ে নামক অনুষ্ঠান আর গফুর নামক স্বামী দুটোই এখন বুড়ির জীবনের একমাত্র সত্য। এ গণ্ডির বাইরে বুড়ির আর কিছু করার ক্ষমতা নেই।

হঠাৎ নীতা গান থামিয়ে বুড়ির দিকে অবাক হয়ে তাকায়।

–তুই যেন কি ভাবছিস সই? তোর কি হয়েছে রে?

নীতা দরদ দিয়ে বুড়ির সঙ্গে কথা বলে।

–আমি যদি তোর মতো হতে পারতাম।

–যা এ জীবন আবার কেউ চায় না কি। তোর কত সুখ! তুই কেনো আমার মতো ভবঘুরে হতে যাবি। তোর মতো জীবন পেলে আমি আর কিছু চাইতাম নারে? এমন গোছানো সংসার, স্বামী, ছেলে

–ছেলে? বুড়ির কণ্ঠ যেন চিরে যায়।

নীতা একটু বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা ও জানে। বুড়ি কষ্ট পাবে এটা ও ভাবেনি। বুড়ি আঁচলে চোখ মোছে। নীতা ওকে খুশি করার জন্যে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, আসছে পৌষ মেলায় তাকে আমি শ্রীনাইল ধাম নিয়ে যাব সই। কেশা বাবার নামে মানত করলে নির্ঘাৎ তোর ছেলে হবে। কেশা বাবা সিদ্ধপুরুষ। কত লোক যে ওখানে যায় না দেখলে তোর বিশ্বাস হবে না। ওখানে গেলে পরাণটা একদম শীতল হয়ে যায় রে সই।

নমিতার মতো ভক্তিতে গদ্গদ করে নীতার কণ্ঠ। একই বিশ্বাসের আবর্তে নীতাও দোলায়িত। বুড়ির মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে এখনই ছুটে যেতে। নমিতার ক্ষীণ সূত্র নীতা আরো পাকাপোক্ত করে দিল। বুড়ির মন হালকা হয়ে যায়। এখন এই দুর্বল সময়ে ওর মন সবসময় একটা অবলম্বন খুঁজে বেড়ায়। কেউ কিছু বললে সেটা অনবরত স্বস্তির ঝরণা বইতে থাকে। মনের গুমোট কেটে যায়। বুড়ির কষ্ট আর ঘুণপোকা হয়ে হৃৎপিণ্ড কেটে ঝাঁঝরা করে না।

–তুই হাত-মুখ ধুয়ে নে সই। আমি খাবার ব্যবস্থা করি।

নামিয়ে রাখা তরকারির হাঁড়িটা আবার চুলোয় চাপায় বুড়ি। তড়িঘড়ি করে রান্না শেষ করে। কলাপাতা কেটে এনে নীতাকে ভাত খেতে দেয়। নীতা বাসনে খায় না। মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত, সেই সঙ্গে ডিমাই শাকের ভাজি। অপূর্ব লাগে নীতার। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায় বলে খাওয়াটা সব সময় ঠিক হয় না। তাছাড়া ভিক্ষের চালে কি ভাত হয়? হয়তো জাউ। নীতা মনে মনে হাসে। খাওয়ার জন্যে ওর লোভ নেই। কতোদিন ভাত না খেয়ে কাটিয়ে দেয় তার কি হিসেব রাখে! তবে বুড়ি ওকে খুব যত্ন করে খাওয়ায়। কখনো না খেয়ে যেতে দেয় না। আর বুড়ির হাতের রান্নার জন্যে নীতার জিভে জল গড়ায়। কি যে ভালো লাগে! খেয়েদেয়ে পান মুখে দিয়ে নীতা দোতারা আর পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

–আসি রে সই?

–কোথায় যাবি এখন?

নীতা হেসে উত্তর দেয়, মনের মানুষের খোঁজে। যতদিন না পাই ততদিন খোজারও শেষ নেই। পথে পথে ভিক্ষে করি আর গান গাই। মনের মানুষ না হলে চলে নারে। একলা পথ চলা বড় কষ্ট। পথের কষ্ট তোকে বুঝতে হয় না বুড়ি।

নীতা মন খুলে হাসে। চলতে চলতে গান ধরে—

বন্ধু আমার নির্ধনিয়ার ধন।

তারে দেখিলে জুড়ায় জীবন যৌবন।

দেখিলে মরণ রে–।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *