০২. পিয়েত্রোর বাংলো

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

পিয়েত্রোর বাংলোর একটা সাধারণ লাঞ্চ অবশ্যই ছিলো না। আমন্ত্রণপত্রে স্বাক্ষর ছিলো হরদয়ালের। তা কিন্তু রাজবাড়ির পক্ষ থেকেই হয়ে থাকবে এই ভেবেছিলো ডানকান, কারণ উপলক্ষ তো ফরাসডাঙায় রানীমার শিবমন্দির স্থাপন। প্রটোকল নিয়ে খুব একটা চিন্তা। করেনি ডানকান। কেননা মরেলগঞ্জ নীলকুঠির ম্যানেজার হিসাবে সে নিজে রাজবাড়ির ঠিক কার সমকক্ষ এ নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। তাছাড়া এটা এমন অনেকদিন থেকে চলে আসছে রাজবাড়ির নিমন্ত্রণ আসে হরদয়ালের কাছ থেকে। এবং খানাপিনা হয়। দেওয়ানকুঠিতে। সেও তো হরদয়ালের কুঠিই। অবশ্য রোজ রোজ হয় না। রানীমার জন্মতিথি উৎসবে হয়।

প্রথমেই ডানকান বোতলের দিকে আঙুল তুলেইঙ্গিত করলো। বাবুর্চির সাগরেদ এগিয়ে এসে নির্দেশমতো বোতল খুলে গ্লাসে ঢেলে দিলো।

এ ব্যাপারে সম্ভবত আমাদের আশ্চর্য হওয়া সঙ্গত নয়। কারণ এ সময়ের কাছাকাছি কলকাতায় মদ্যপান নিবারণী সমিতি স্থাপনের কথা শোনা যায় বটে;প্রকৃতপক্ষে সেটা তখন তিনবোতলী মানুষদের ভিক্টোরীয় যুগ। তাদের উদরও নিতান্ত উদার ছিলো। টেবিলের পায়া জড়িয়ে ধরে অনেকে ডিনার শেষ করার খ্যাতি অর্জন করতেন তখন।

টেবিলটা গোল। ঢুকতেই চোখে পড়ে কেটকে। পরনে চকোলেট রঙের স্কার্ট ব্লাউজ। মাথায় সাদা বনেট, তাহলেও তার লাল চুল কিছু চোখে পড়ছে। কুনুই অবধি সাদা গ্লাবস ছিলো, এখন পাশে খুলে রাখা। তার বিপরীত দিকে তার স্বামী বাগচী-চন্দ্রকান্ত এজ বাগচী। হালকা কালো ওরস্টেডের ব্রিচেস, কালো ভেলভেটের কোট, গলার সাদা বো। তার চিবুকে এখন দু-চারটে সাদা দাড়ি চোখ পড়ে। তাকে কালোই দেখায়।

কিন্তু সুবিচার করতে হলে বলতে হবে হরদয়ালের গায়ের রং আরও কালো। সে রং আরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে এজন্য যে তার নাক নিখুঁত এবং ধারালো। চোখ দুটি টানা। চিবুক সুগঠিত। ঠোঁট দুটি বিশেষ পাতলা এবং পরস্পরসংবদ্ধ। তার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের কোণে কিছু কালি। তা কি অস্বাস্থ্যের? বরং হয়তো কাল রাতের লাল মদের ফলে। তার গায়ে গরদ রং-এর গলাবন্ধ কোট।

কে বললো–আজকের আবহাওয়াটা খুব সুন্দর।

হরদয়াল বললো–তাপটা কোমল এবং আরামদায়ক।

কেটের বাঁয়ে হরদয়াল ডাইনে ডানকান। রং যদি দেখতে হয় তাকেই লক্ষ্য করতে হবে যদিও তার পদবী হোয়াইট। গাজরের মতো রং। মাথার বিরল চুল তামার ভাবযুক্ত হলুদ। কাছে থেকে দেখার ফলে বোঝা যাচ্ছে তার নাকের মাথাটা মোটা এবং লাল। মুখে যথেষ্ট গর্ত গাড়া এবং গুটি। টুইডের কোট এবং ফ্ল্যানেল ব্রিচস। ঘরে ঢুকে সে রুপোবাঁধানো মালাক্কা লাঠি জমা রেখেছে দরজার পাশে স্ট্যান্ডে। সে যে মরেলগঞ্জের ইন্ডিয়া লিমিটেডের ম্যানেজার তা তার ঘোরাফেরা ওঠাবসায় প্রমাণ, যদিও ইদানীং তার মধ্যে কিছু আড়ষ্টতা ফুটছে; সেই উনবিংশ শতকীয় বাত-যা ইংরেজ ভদ্রলোকের লক্ষণ।

ডানকান বললো–মৃদু এবং মধুর।

কেটের বিপরীতে বাগচী। বাগচী এবং হরদয়ালের মধ্যে মনোহর সিং, বাগচী এবং ডানকানের মধ্যে কীবল। মন্দির দেখতে যাওয়ার আগেই হরদয়াল কেটকে আওয়ার হোস্টেস বলে পরিচিত করে দিয়েছিলো।

মনোহর চোগা চাপকান পরেছে। মাথায় জড়ির কাজ করা শামলা। তার মুখের গড়ন রোগাটে, কিন্তু গালের মাঝামাঝি তক্ নেমে আসা চওড়া জুলফি, এবং ঠোঁটের কোণ বেয়ে ঝুলে পড়া ঝোরা ঝোরা গোঁফ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কীবল এখানে বয়ঃকনিষ্ঠ। যেন খড়ির তৈরি এমন সাদা। মুখের গড়নে চৌকো চোয়াল এবং প্রয়োজনের চাইতে বড়োনাক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একেবারে কটা চোখ, চুল তামাটের চাইতে লাল। বাদামি লালে ডোরাকাটা টুইডের কোটে, গলাখোলা কামিজে দেখাচ্ছে যেন তাদের দেশের একজন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট।

হরদয়ালের মুখোমুখি সে।

হরদয়াল বললো–মাছটা কি কিছু শক্ত ভেজেছে মনে হয়?

 ডেলিশাস। কী বললো– কীবল।

কারো কারো চরিত্র তার প্রথম কথাতেই প্রকাশ পায়। মনোহর সিং বললো–কিন্তু তা বলে কি সার, এ কি আর টেমসের হেরিং।

কীবল বললো–ইউ নো টেমস?

সে কিছুটা অবাক। মনোহর কৃতার্থ।

বাট, বললো– হেসে কীবল–টেমস্ ওঅজ নেবার ফেমাস্ ফর ফিশ। ইজ ইট হিলসা দো?

বলা বাহুল্য তাদের ইংরেজি আলাপে ভাঙাচোরা বাংলা ও রংছুট বাঙালি ইংরাজির। মিশেল থাকছিলো।

হো হো করে হেসে উঠে ডানকান বললো–অ্যাংলো ক্যালকাটানদের রোগ টোমাকে ঢরেছে আমি ডেকছি। কিন্তু হিলসা টোমার টামির পক্ষে ভালো যথেষ্ট নয়। ডিসেন্ট্রি ঘটায়। হোঅট ফিশ দিস হৃদলাল?

হরদয়াল–উচিত ছিলো রুই, দেখছি কাতল।

মিষ্টি হেসে কেট বললো–আমি যে তার ব্যাপারে বিশেষ নস্ট্যালজিক তা নয়। বাট টেমস্ হ্যাজ হার ফিশে দো হেরিং ইজন্ট এ গুড ফ্রাই।

মাছের গ্রাসটাকে চিবিয়ে নিয়ে কীবল বললো– হাসিমুখে–হয়তো, হয়তো। হোয়েন ইউ লাস্ট স্ব হার। দা ব্ল্যাক ব্রাকিশ ওঅটর দ্যাটস্ নাউ টেমস্ ইজ এ ডেড রিভার ফর অল পারপাসেস। (এখন যে কালো বিস্বাদ জলকে টেমস বলা হয় তা সব রকমেই এক মৃত নদী)।

ডানকান যে বোতলটাকে খুলিয়েছিলো কীবল সেটাকে পছন্দ না করে ক্লারাট লেখা বোতলটাকে ইঙ্গিত করতে সেটা খুলে দিলো এক খানাবরদার। কীবল নিজের হাতে গ্লাস ভরে নিলো।

বাগচী আলাপে যোগ দিতে বললো–এরকম হলো কেন?

কীবল-এর বক্তব্যর অনুবাদ এই রকম–সবই কালো হতে চলেছে এখন, নদীর জল একসেপসন নয়। তাতে দুঃখও নেই। কারণ এ যুগটা কয়লা এবং লোহার–বোথ ব্ল্যাক। নয় কি? অন্য রং যদি কোথাও থাকে তবে তা হোয়াইটের নীলে।

সে হাসলো। ডানকান এই মৃদু রসিকতায় বললো—হ।

আলাপটা দ্বিতীয় কোর্সে লোহাকয়লা কারখানার দিকে গড়িয়ে তা থেকে স্টিম এঞ্জিন অবশেষে স্টিমারের গল্পে পৌঁছালো। স্টিমার যা নাকি বাষ্পের সাহায্যে সমুদ্রে চলে। কিমাশ্চর্যম্ অতঃপরং।

ডানকান বললো–কাম কাম, ফলমাউথের খেলনাগুলো ভালো কিংবা কলকেতা বন্দরে কিন্তু আমাদের বয়সে

কীবল বললো, মিট মিট করে হেসে, সে নিজের চোখে প্লীমাথেও স্টিমার দেখেছে এবং তা ম্যান অব ওআরদের মধ্যে ঘুরতে। এই শীতে ব্রিন্ডিসি পর্যন্ত আসবে স্টিমার যদি না আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত পারে।

হোয়াট ডু ই’মিন ব্রিন্ডিসি, ডানকান বললো–তুমি ডেখো, এই সমুদায় টয়েস্ সাহায্যে বড়োজোর ব্রিন্ডিসি আসা যাইবে কারণ তা ভূমধ্যসাগর।

কীবল হেসে বললো–ভূমধ্য হলেও তা সাগর।

ডানকান বললো–আটলান্টিক, প্যাসিফিক অথবা ভারতসাগরে স্টিমার আসিবে? ও নো, তুমি তেমন বলল না। কিংবা তা স্টিমারই থাকে কিন্তু হার ম্যাজেস্টির শিপ অফ দা লাইন হয় না। তুমি কি বলো ব্রিটেন ওন্ট সেইল দা সিস্।

কীবল বললো–ইনডিড, শি উইল। কিন্তু সেইল-এর অর্থ হবে তখন স্টিম অ্যাক্রস।

হরদয়াল বললো–জুলাই-এর টাইমসে এরকম একটা কথা সে দেখেছে বটে। কিন্তু তা কি সত্যি হবে। তা কি একটা সায়েন্টিফিক ফিকশনমাত্র নয়?

ডানকান টাইমস পড়ে না। কলকেতার ইংলিশম্যান বরং কেনে। কিন্তু ইতিপূর্বে সে কীবলের কাছে স্টিমারের উন্নতি সম্বন্ধে অবশ্যই জেনে থাকবে। তার কথায় বিস্ময়ের পরপরই যে কৌতূহলী অবিশ্বাস আসে তা দেখা দিয়েছে এখন।

মনোহর সিং বললো–ভগবানের কী সুবিচার। ইংরেজদের পক্ষেই এমন আবিষ্কার সম্ভব।

সে যে ইতিমধ্যে নতুন এক জমিদারবংশ স্থাপনের স্বপ্ন দেখছে তা ভিত্তিহীন নয়।

বাগচী কেটের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। বললো–এও যদি সত্যি, বিস্ময় বলতে আর কিছু রইলো না।

মৃদুস্বরে কেট বললো–আশ্চর্য, ইউ নেভার ক্যান টেল।

বাগচী বললো– মানুষ হয়তো শূন্যপথেও চলবে আর ইঞ্জিনই তা পারবে।

কেট হেসে বললো–তা কি সম্ভব যে মানুষ এঞ্জেল হবে? উই আর নট অব দি এয়ার। স্টিম, তার শক্তি, ইংরেজদের স্বজাতি-প্রীতি, মনোহরের ইংরেজ প্রশংসা নিয়ে আলাপ জমে উঠলো। তখন তৃতীয় কোর্স চলেছে।

কিন্তু কেউ কেউ থাকে যাদের শৈশবেনাক টিপে ধরে নিঃশ্বাসে সমতা রাখতে শেখানো হয়েছে। মৃদু হেসে হরদয়াল বললো, বাট দি ওয়াইন উইল চাইড! সে একটা নতুন গ্লাসে ক্লারাট ঢেলে কেকে এগিয়ে দিলো। নিজের গ্লাসটা পূর্ণ করে নিয়ে বললো–লেটস ড্রিঙ্ক টু হিউম্যান উইজডম অ্যান্ড বিউটি।

টেবলের দু-তিনটি গ্লাস শূন্যে চিনক করে উঠলো।

লাঞ্চের ভার তার নিজের বাবুর্চির উপরেই যদিও তাকে সাহায্য করতে পিয়েত্রোর বাবুর্চি বন্দাকে পাওয়া গিয়েছিলো। তার বাবুর্চি নিশ্চয়ই তার পদ শেষের ইঙ্গিত বোঝে। তখন তাদের রোস্টবিরিয়ানি নিয়ে আসতে দেখা গেলো।

ডানকান বললো–হৃদলাল, মাই ফ্রেন্ড হিয়ার ইজ এ সোলজার, এ সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড এ সেন্ট অল ইন উয়ান। ইউ উইল লাভ টু নো হিম।

কীবল হাসিমুখে বললো–এ সোলজার ইয়েস,এ সায়েন্টিস্ট মে বি, বাট হাউ এ সেন্ট?

এইস্ট ইউ উয়ান অব দোজ এভানজেলিস্ট?

এই রসিকতা করতে পেরে ডানকান আত্মপ্রীতিতে হু হু করে হেসে উঠলো।

কীবল দুএক মুহূর্ত যেন এই রসিকতাটাকে অনুভব করলো, তারপর আলাপের ধারাটা বদলে নিলো। বললো, নিমন্ত্রণের কথায় সে আশঙ্কা করেছিলো কী ভয়ঙ্কর টেবলম্যানার্সের মধ্যে না পড়তে হয় কিন্তু এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ইটস এ রিলিফ। বোঝা গেলো সে লাঞ্চটাকে প্রকৃতপক্ষে উপভোগ্যই মনে করছে।

হরদয়াল চিন্তা করলো একই টেবলে বসে অন্যের টেবলম্যানার্স নিয়ে আলোচনা করা ইংরেজ আভিজাত্য কিনা তা ঠিক তার জানা নেই। যদিও ও ছোকরার ইংরেজিটা উচ্চারণে ও শব্দ বাছাইতে ভালো। কিন্তু তার কোনো কোনো চিন্তা জিহ্বায় ধারালো না হয়ে চোখের কোণে ঝকঝক করে।

বাগচীও তখন কিছু সমস্যায় পড়লো। মনস্তত্ত্বগত কারণ হয়তো কীলের কথা এবং কীবলের কথার মূলেও হয়তো মনস্তত্ত্বগত এই কারণ ছিলো যে সদ্য বিলেত-আগত তার চোখে এখানকার টেবলম্যানার্স ঠিক বিলেতীনয়। বাগচী ভাবলো টেবলের মাথায় সে, যদিও এটা তার বাড়ির ভোজ নয়। সে কি প্রথম ছুরি বসাবে রোস্টে?

সমস্যার সমাধান করলো ডানকান। সেই প্রথম ছুরি বসালো বাদামী করে ভাজা পিগলেট রোস্টে। মরেলগঞ্জ ইন্ডিগোর ম্যানেজার হিসাবে সেই কি এদিকের সব আসরের হেড নয়।

যেন এটাকে, ডানকানের এই ম্যানার্স বিচ্যুতিকে ঢাকতেই বাগচী বললো– তাড়াতাড়ি–এটা উৎসব বটে, কিন্তু আমাদের স্বীকার করতেই হবে মরেলগঞ্জের সেই উৎসবের তুলনায় এটা কিছু নয়।

খুশী ডানকান বললো–কোনটে মনে করছে বাগচী?

–লোকে যাকে এখনো হোআইট সাহেবের কালীপূজা বলে।

কীবল বিস্ময়ে ভ্রূ তুলে জিজ্ঞাসা করলো কী বললেন, কী পুজো?

বাগচীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মনোহর সিং বললো–সে যে কী নাচ গান, কী পুজো আর কত হাউই তুবড়ি।

–এঃ! কীবল বিস্ময়ে থই পাচ্ছে না।

 মনোহর বললো–শট অনলি বেঙ্গল লাইটস সার, রকেটস, বুমবুম, থাউজান্ড রুপি ড্যান্সিং ফাউন্টেন্স অব ফায়ার। সে এই জায়গায় হাউই ও তুবড়ির উৎক্ষেপ বোঝাতে হাত ও আঙুলের যথোচিত ভঙ্গি করতে ছাড়লো না।

কীবলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। -সব্লাড ওঅজ ইট এ পেগান গড হোয়াইট?

ডানকান হাসলো-দি হেল ইট ওঅজ। এ গডেশ দো। সাম টাইমস ইউ হ্যাভ টু ইল্ড টু দা নাইট।

কৌতুক বুঝে কীবল বললো–অ্যান্ড হিয়ার ইন ইন্ডিয়া নাইট হ্যাজ হার ওয়ে। কি, এসব কি মিউটিনির পরে ঘটিয়া থাকে?

ডানকান বললো– (তার স্বরবর্ণকখনো কখনো বিশেষ চওড়া)-ওয়াল, সব পেগান ভালো না আছে। মানোআর এখানে ভালো পেগান হয়। ওয়াল তুমি কি জানো তাহার তিন ইস্ত্রি থাকে। সব ছোটোটি তেরো হবে। সি মাস্ট হ্যাভ হার ওন সুইটস।

কীবল কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু থমকে গিয়ে বললো–উই আর এ মিক্সড কোম্পানি, হোয়াইট। সে কেটের দিকে তাকালো। তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে কেয়ার না করে সেই রূপ তার ভাল লাগলো। সে বললো–ডেলিশাস। ইজ ইট পোলট্রি দো? হরদয়াল কেটকে। সাহায্য করে বললো–নো, ফ্রম এ হান্টার্স ব্যাগ।

কিন্তু ডানকান বললো–হঃ।

কিন্তু যেন সে মত বদলালো। কেটের উপস্থিতিকে মর্যাদা দিলো। ইতিমধ্যে কি তার মন টেবিলের সময়ের চাইতে ধীরে চলছে? বললো, কিন্তু মনোআর রাজপুট আছে। রিঅ্যাল রাজপুট। দে হেল্পড আস দা রাজপুটস। ইউ নো।

সে যেন সোৎসাহে পাশে দাঁড়ানো খানাবরদারকে ক্লারাট দিতে ইঙ্গিত করলো। কীবল বললো–কিন্তু এসবে তোমার পেগান গডেস পূজা করার আগুমেন্ট নেই। হোয়াইট, এখানে কি পিওর স্টিকিংএর সুবিধা আছে ডেওয়ানজি?

ক্লারাটটা হাতে নিয়ে ডানকান বক্তৃতার ঢঙে বললো–আনঅ্যালোয়েড পেগানরা ভালো হয় যাহারা ক্যালিকে মাদার বলে। অবশ্যই বিঅতিক্রম আছে। হৃদলাল এথা, আমি টোমাকে আবার ধন্যবাদি হৃদলাল, তোমার স্কুল ভালো চলে তো? এবং প্রিন্স! ইহাদের মতো না থাকিলে, জানো, এ জেলাতেই লাখনাউ হইয়া যেতো। দ্যাট ব্ল্যগর্ড শন অব এ বিচ পিয়েত্রো। কিন্তু ভালো খুবই ভালো। অ্যাডোলেসেন্স পার হওয়া কলে ঘটে। মিউটিনি ওঅজ গডসেন্ট।

শামলাসহ মাথা নুইয়ে মনোহর বললো–না, না, সার। কেন, সার, কী ভাবে, সার? ঈশ্বরের ইচ্ছা হবে কেন মিউটনি?

ডানকান বললো–ডেখো, মানোয়ার তুমি সব জানে না, ডেখো। ক্রিমিয়ায় মার খাইয়ে ব্রিটিশ আর্মসের লজ্জা হইয়েছে। ভালো লজ্জা। মিউটিনিতে লজ্জা ধুইয়া গেলো। কেমন, কীবল?

ডানকান হাত ধোয়ার ভঙ্গি করলো। ক্লারাটের বোতল উপুড় করে গ্লাস ভরে নিলো।

একটু ভেবে, প্লেটটাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে একটু ঠেলে দিয়ে কীবল বললো–তাহলেও আমি রিফর্ম সম্বন্ধে কিন্তু এখনো কেউ ভাবছে না, হোয়াইট। এটা দরকার, যদিও মিস্ নাইটিঙ্গেলই সেদিকে হয়তো একদিন দৃষ্টি দেবে। আর তাহলে তা হবে, অন্ড বাই ডাব কুইক মার্চেস। বিস্মিত কেট বললো–ক্রিমিয়ায় কি এর মধ্যে যুদ্ধ হয়ে গেলো নাকি? সংবাদটা যে তার কাছে নতুন সে বিষয়ে সন্দেহ রইলো না।

বিস্ময়টা বাগচীরও। তার ভ্রূ উঠলো। ক্রিমিয়া সম্বন্ধে ভাসা ভাসা কিছু সে শুনেছে, কিন্তু সেখানে কি বড়ো যুদ্ধ হয়েছে! কী হয়েছে সে যুদ্ধে? একবার কীবল আর একবার ডানকানের মুখের দিকে চাইলো সে। পরে হেসে বললো–দেখো, ডার্লিং, কেমন আছি আমরা। যুদ্ধের এসব খবর ও আমাদের কানে পৌঁছায় না। আমরা ঘড়ির বিপরীত গতিতে চলছি না তো?

ডানকান বললো–এইটা কি সত্য অজানিত ছিলো? স্ট্রেঞ্জ! ভালো আমার ধারণা ফরাসীরা জানিত। যেমন সেই ওয়ালি ফক্স পিয়েত্রো ফর উয়ান। এবং তাহাদের কাছে। মারাঠীরা এবং দিল্লীর সেই বুড়া শয়তান। নিশ্চয়ই তাহারা সেকালে জানে আমরা ক্রিমিয়ার বেকায়দা পড়ি, ভালো বেকায়দা। আর তখন তাহারা মিউটিনি করে।

কীবল হেসে বললো–এখন আর বেকায়দা নেই হোয়াইট। আর তোমার পেগান গডেস পূজার কথাও অনেক লোক জানে না। কিন্তু তুমি যে বলছিলে এখানে কি সত্যি স্কুল আছে। অর্থাৎ যাকে ইংরেজিতে স্কুল বলে?

ডানকান বললো–আ, সার উইলিয়াম, নিশ্চয়। এখানে এই হৃদলালের স্কুল। আমি তাকে সাহায্য করিব তুমি ডেখো। এটা হৃদলালেরই থিয়োরি যে এইসব স্কুল আমাদের বিপদে আমাদের পাশে দাঁড়াবে। এই থিয়োরিতে কিছু আছে। হুঁ হুঁ। দি জেন্টস ইন ক্যালকাটা গেভ আস মর‍্যাল সাপোর্ট।

কীবল বললো–দেয়ার্স নাথিং রং উইথ স্যার উইলিয়াম জোনস। ইজ দেয়ার? আমি বাস্তবিক স্কুলের ব্যাপারে ইনট্রেস্টেড। এবং সাংস্ক্রিট পড়িতে চাই।

হরদয়াল প্লেটের উপরে কাটা-চামচ শুইয়ে রেখেছিলো। এবার প্লেটটাকে মৃদুভাবে ঠেলেও দিলো। তার মুখ যেন বিরস, কিন্তু হেসে বললো– সে-আসুন একদিন স্কুলে। জাস্ট এ বিগিনিং দো।

বাবুর্চিরা সম্ভবত হরদয়ালের ভঙ্গির উপরেই চোখ রাখছিলো, তারা প্লেট বদলাতে শুরু করলো।

নতুন কোর্সের সঙ্গে আলাপটা ঝুঁকলো আজকের উৎসব শিবলিঙ্গ স্থাপনের কথায়। ততক্ষণে প্রত্যেকের প্লেটের সামনে একাধিক পানীয়ের গ্লাস জমেছে। কারো বেশি, কারো কম। বোঝা যাচ্ছে তারা প্রায় প্রত্যেকেই নানারকমের পানীয়ের স্বাদ নিয়েছে; কেউ হয়তো একই পানীয় গ্লাস বদলে একাধিকবার, অন্য কেউ বা একই গ্লাসে একাধিক পানীয় মিশিয়ে।

কীবল বললো–মিস্টার হৃদলাল, ধর্ম নিয়ে কথা বললে আশা করছি এ টেবলে কেউ দুঃখ পায় না। আজ যা দেখিলাম তা হয় অর্থোডক্স পেগানিজম, পাথরপূজা, না? আর। আমাদের হোয়াইট হয়তো রিফর্মড পেগানিজমের উপাসক হয়।

ডানকান পোর্ট ঢেলে নিয়েছে এক গ্লাসে, অন্যটিতে শ্যাম্পেন। যেন তা মাপ করে মিশালে নতুন কিছু হয়। সে হোয়া হোয়া করে হাসলো। বললো–সইত্য। এ, মানোয়ার, তোমার আইডল ছিলো। দ্যাট ব্ল্যাক নেকেড গ্যাল, ওয়েলফমড় দো। শি ওঅজ অ্যান আইফুল, আই বেট। মনোহর তাদেরই একজন যারা নিজের জ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন। সে বললো–এটাও একরকমের আইডল, সার, তবে একে বরং ফ্যালাস অর্শিপ বলতে হবে।

কীবল যেন শিউরে উঠলো। বললো–আক্‌ গশ।

বাগচীর মুখে কী একটা হাড়ের কুচি পড়েছিলো? কিছু সময় যেন সেজন্যই বিব্রত রইলো। কিন্তু হঠাৎ সে বললো–বাট মাচ অব ইট ইজ সিম্বলিজম। অ্যান্ড ইন এভরি। রিলিজিআন দেয়ার আর সিম্বলস দ্যাট ক্যান বি মিসইন্টারপ্রিটেড। (ইহার অনেকাংশই প্রতীক ব্যবহার। সব ধর্মেই প্রতীক ব্যবহার হয় যার কদর্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব)।

কীবল বললো–ইন পেগানিজম ডু ইউ সে।

বাগচী হাসতে হাসতেই বললো–হোয়াই, মাচ অব আওয়ার স্যাক্ৰামেন্ট ইজ সিম্বলিক। হাউ ডু ইউ ইন্টারপ্রেট ইউক্যারিস্ট ওয়েফার? (কেন, স্যাক্রামেন্টের অনেকটা সিম্বলিক। ইউক্যারিস্টের রুটির কী ব্যাখ্যা হবে)?

কীবলের মুখ লাল হয়ে উঠলো। স্যাক্রামেন্ট-ইউক্যারিস্টকে লিঙ্গোপাসনার মতো অপবিত্র বিষয়ের সঙ্গে তুলনা? সে বেশ শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো, মিস্টার বাগচী তালে ক্রিশ্চিয়ান নয়?

বাগচী কাঁটা-চামচ রাখলো।

ডানকান চোখ দিয়ে ইশারা করলো কীবলকে। এমনকী স্পষ্ট করেই বললো–নাও মিট হিম। অবশ্যই ইতিপূর্বে কীবলকে বাগচী সম্বন্ধে কিছু বলছে সে, আর এখন তা মিলেও যাচ্ছে যেন।

হেসে হরদয়াল বললো–বাগচী বলে থাকেন এখনো ক্রিশ্চিয়ান হতে পারলাম না।

বাগচী হাসলো। বললো–দেওয়ানজি,কথাটা মিথ্যাও নয়। লাখনাউ কিংবা দিল্লী কিলিং কোনটাকেই অন্তর থেকে ক্ষমা করতে পারিনি। এ রকম আর আছে?

ডানকান যেন চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো। ঝাঁজের সঙ্গে বললো–হোয়াট ডু ইউ মিন–দিল্লী কিলিং!

বাগচী বললো–লাখনাউতে যদি নরহত্যা হয়ে থাকে দিল্লীতেও হয়েছে। লেটস্ ড্রপ ইট।

অস্তস্তি বোধ করে গলা সাফ করলো হরদয়াল। অনেকসময়ে সুযোগ পাওয়ামাত্র তা ধরতে হয়। এই সময়ে বাবুর্চিরা ঢুকলো। ট্রের দিকে চেয়েই হরদয়াল উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো–চিকেন প্যাটিস আর দে? ওয়েল, মিস্টার হোয়াইট, আই স্পেশ্যালি ইনভাইট ইউ টু দেম। দে আর সামহোয়াট অভ এ স্পেশ্যালিটি অব মাই সোলটান আহমেদ।

হঠাৎ কী হয়ে গেলো। এই সাজানো গোছানো ঝকঝকে টেবলের পাশের মানুষগুলোকে আর যেন উৎসবের অঙ্গ বলে মনে হবে না। তাদের কথাগুলো তাদের চিন্তা যেন চীনামাটির ও কাঁচের পাত্রগুলোতে পুরনো ফাটল সৃষ্টি করছে। কেট অদ্ভুত সাহসে হোস্টেসের কাজ করলো। মধুর হেসে বললো–মিস্টারকীবল, ক্রিমিয়ায় প্রভিশন কেমন ছিলো? আপনাদের নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে?

কীবলও বোধ হয় সেই মুহূর্তেই সম্বিৎ পেয়েছে। সে একটু জোর দিয়ে বললো–রাম ফর ব্রেকফাস্ট, রাম ফর ডিনার, রাম ফর ব্রোকেন লিম্বস। মিস নাইটিঙ্গেল ইজ থিংকিং অ্যাবাউট লাইস অ্যান্ড ভার্মিন অন দা সোলজার্স, ওয়েল সামাদার লেডি উইল্যাব টু থিংক আউট হোয়াট গোস অনসাইড দেম। (প্রাতরাশেরাম, ডিনারে রাম, হাত-পা গুঁড়োলে রাম। মিস নাইটিঙ্গেল সৈনিকদের গায়ের উকুন আর পোকার কথা ভাবছে। আর কাউকে ভাবতে হবে তাদের ভিতরে কী যায়)। সে হাসলো।

ডানকান তার উত্তেজনার বিষয়টা থেকে সরতে পেরেছিলো, কিন্তু ভিতরে ছিলো বিরক্তি। সে বিরক্তমুখে বললো–শি উইল আনম্যান দি সোলজার্স, দ্যাটস হোয়াট শি ইজ আফটার। (সৈনিকদের সে স্ত্রীলোক না করে ছাড়বে না। সেটাই তার উদ্দেশ্য)।

কে? কীবল জিজ্ঞাসা করলো।

ইওর লেডি উইথ দা ল্যান্টার্ন।

কীবল হো হো করে হেসে উঠলো। গশ, হোয়াইট? মিস নাইটিঙ্গেলকে লেডি উইথ দা ল্যাম্পই তো বলছে। তুমি তার হাতে লণ্ঠন দিলে?

সুতরাং প্যাটিসে কাঁটা ছোঁয়ালো তারা।

প্যাটির পর ফল-ফল আর মিষ্টি। তখন একটা যোগাযোগ ঘটে গেলো হরদয়ালের বাবুর্চির অসাবধানতায়। যেহেতু সে দেওয়ানকুঠি থেকে আনা মদের বোতলগুলোকে ভোরের অন্ধকার থাকতেই পিয়েত্রোর প্রভিশনের আলমারিতে তুলেছিলো, এবং টেবল প্রায় মদশূন্য অবস্থায় দেখে মদের আর একটা বোতল আনতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে খেয়াল করলো না যেটা সে নিয়ে যাচ্ছে তার গায়ে অনেক মাকড়সার জাল, যা থাকা উচিত নয়। এবং বোতলটাও কালচে কাঁচের বেঁটে, মোটা এবং বেশ বড়ো। পিয়েত্রোর বাবুর্চির বান্দা লক্ষ্য করেছিলো, কিন্তু তার হাতের ইশারা হরদয়ালের বাবুর্চি সোলটান বুঝতে পারলো না।

বোতলটাকে কোমরের ঝাড়নে মুছে টেবলে রাখতে যে প্রথম অবাক হলো সে হরদয়াল। সে হাতে নিয়ে দেখলো ভিনটেজের তারিখটা ১৮৩৫। শব্দগুলো অপরিচিত।

ডানকান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলোকী এটা? হাতে নিয়ে পড়লো, উচ্চারণ করলো চ্যাম্বার্টিন। প্রকৃত ইংরেজ কখনো ফরাসী পড়ার সুযোগ ছাড়ে না।

মদটা লাল রঙের। ইঙ্গিতে বাবুর্চি খুলে দিলো। নতুন গ্লাস দিলো সকলের সামনে।

ডানকান হয়তো আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো যে এই আসরে অন্তত একবার তা করতেই হবে কেননা সে ইংরেজ। গ্লাস হাতে নিয়ে সে বললো, আসুন আমরা স্বাস্থ্য পান করি।

সে গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালো। দেখে কীবল এবং হরদয়ালও দাঁড়ালো। গ্লাসগুলো মৃদু ঝনৎকার তুলে টেবিলের উপরে শূন্যে একত্র হলো।

অট্টহাস্য করে ডানকান বললো–হিয়ার্স টু হার ম্যাজেস্টি কুইন বিক্টোরিয়া। কীবল ও হরদয়াল যুগপৎ বললো–টু হার ম্যাজিস্টি। বাগচী, কেট ও মনোহরকেও উঠতে হলো।

ফরাসী মদটা গলায় ঢেলে বসতে বসতে সশব্দে গ্লাসটা বসালো টেবলে ডানকান। সেটা তার হাতের নিচে ফাটলো কি?

সে কি ফরাসী নাম থেকে মদটা পিয়েত্রোর ভাঁড়ারের এমন আন্দাজ করেছিলো? অথবা ফরাসী শব্দগুলোই একজন পরিচিত ফরাসীর কথা মনে আনতে পারে?

হরদয়াল তার গ্লাসে আবার একটু মদ নিলো। একাই উঠে দাঁড়ালো। শূন্যে হাত তুলে বললো–দিস্ টু রানীমাতা। মে গড ব্লেস হার। পান শেষে গ্লাসটাকে সে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে ছুঁড়ে দিলো। দেয়ালে লেগে সেটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়লো।

ফলে হাত দিলো সবাই। সেগুলি অবশ্যই দুষ্প্রাপ্য এ অঞ্চলে এবং ইউরোপেও। হরদয়ালের ইঙ্গিতে বাবুর্চি তার চুরুটের বাক্স বার করলোকীবলের দিকে তা এগিয়ে ধরলো হরদয়াল।

কীবল এক্সকিউজ মি বলে প্রত্যাখ্যান করলো।

মনোহরই আবার সকলের চাইতে বেশি বিস্মিত হলো–সে কী, সার, সোলজার হয়েও খান না! ভালো জিনিস কিন্তু। আমাদের দেওয়ানসাহেব বিশেষ সৌখীন জানবেন।

কীবল হাসিমুখে বললো–ক্রিমিয়া-ফেরত সোলজাররা দাড়ি এবং তামাক ইংল্যান্ডে আবার ফিরিয়ে আনছে বটে। আমি কিন্তু পাইওনিয়ার্সদের একজন নই।

স্বচ্ছ কৌতুকের আশ্বাসে বাগচী বললো, ফিরিয়ে আনছে কী রকম?

মৃদু হেসে কীবল বললো–এইভাবে ফ্যাশান যাওয়া আসা করে। ইংল্যান্ডে তামাক ও দাড়ির আদল সত্তর আশি বছর ছিলো না। আবার প্রাদুর্ভাব হয়েছে। নস্য নয়, ধোঁয়া। এবং তা ক্রিমিয়ার পর।

ডানকান বললো–ইহার জন্যও কি তোমার উওম্যান উইথ ল্যাম্পকে ধন্যবাদি?

কীবল হো হো করে হেসে উঠলো। –হোয়াইট, তুমি লেডি উইথ দা ল্যাম্পকে নিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়েছে। কিন্তু অসুস্থ আহত ক্রিমিয়ার সেই সৈন্যদলের শয্যার পাশে তাকে কিন্তু অ্যাঞ্জেল বলেই মনে হতো। আর আমাদের মতো ভুক্তভোগী কে?

হরদয়াল বললো–গত সপ্তাহে টাইমসে একটি সংবাদ পড়ছিলাম। লন্ডনে সেন্ট টমাসের হসপিটালে নার্স ট্রেনিং স্কুল খোলা হয়েছে। এবং আশা করা হচ্ছে তা গোটা পাশ্চাত্য জগতে নার্সিং-এর ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন আনবে। স্যার সিডনি হার্বাটের সহানুভূতি আকৃষ্ট হয়েছে। এসবের মূলেও মে-ফেয়ারের এক মিস নাইটিঙ্গেল।

কীবল বিশেষ বিস্মিত হলো। সে বললো–বটে? স্যার সিডনি যখন, তখন সংবাদের এই মহিলাই মিস নাইটিঙ্গেল। কিন্তু এটা বিশেষ আশ্চর্যের ব্যাপার যে এই গ্রামে এক ব্যক্তি টাইমস কাগজ পড়ে। এবং সেন্ট টমাস হাসপাতালে নার্সিং স্কুলের খবর একেবারেই নতুন তার নিজের কাছে।

সে বললো–আশ্চর্য! এখানে টাইমস আসে? সেন্ট টমাসে নার্সিং স্কুল হচ্ছে?

হরদয়াল লজ্জায় পড়লো। সে বললো–তাকে সাবসক্রাইবার হওয়া বলে না। আর কাগজগুলো আসতেও সময় নেয়। গত সপ্তাহে পড়েছি, কিন্তু সংবাদটা বেশ পুরনো।

কিন্তু, কীবল বললো–তাহলেও সংবাদটা এদিকে নতুন। আমি জানতাম না। ছমাস পিছিয়ে হলেও আধুনিক ইংল্যান্ডের খবর আপনি রাখছেন যা আমরাও অনেকে জানি না। না, ক্যালকাটাতেও অনেকেই নয়।

হরদয়াল মৃদু হেসে বললো– না জানলে মোকাবিলা হয় না।

লাঞ্চ কিংবা সে নামেরই অন্য কিছু হোক ঘণ্টাদুয়েক শেষ হয়েছে। দিনের আলো তখনো উজ্জ্বল। জানলা ও পর্দার ফাঁকে একটা আলোর ফলক এসে পড়লো টেবিলের কাঁচের উপর।

সিগার ধরালো হরদয়াল এবং ডানকান। বাগচী তার পাইপ।

ডানকান বললো–হৃদলাল, তোমাকে আবার পুনরায় ধন্যবাদি। হঁহঁ মরেলগঞ্জের পক্ষ হইয়া ধন্যবাদ। ফাইন কুকিং, ফাইন ওয়াইন।

ডানকানের ঘাড়টা কি একটু নড়লো কথা বলতে গিয়ে। সেই চ্যাম্বার্টিনের বোতলটার দুপাশে টেবিলের উপরে তার হাত দুটো ছড়ানো। মনে হলো আঙুলগুলো যেন টেবিলের উপরে ড্রাম বাজানোর চেষ্টায় আছে। তার মুখ তো বটেই চোখ দুটোও লাল। সে বোতলটাকে তুলে আলোয় ধরলোর তলায় কিছু মদ আছে তখনো।

হরদয়াল বললো–আর একটা আনিয়ে নেবো?

ডানকান বললো–ও নো। উই মাস্ট লিভ। আমাদের যাইতে হইবে। বৈকাল হয়।

কীবল রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করলো–আর উই স্যুয়োর।

ডানকান বললো–যদি না স্কুলমাস্টারের বউ-এর প্রেমে পড়ে থাকো। ইজিন্ট শি বিউটিফুল? হো হো করে সে হাসলো।

সে উঠে দাঁড়ালো। এবং সেজন্যই তার হিক্কা উঠলো। মনোহরের পাশে গিয়ে তার বগলের তলে হাত দিয়ে ঠেলে তোলার চেষ্টা করলো। বললো–ওয়াল মাই ডার্লিং গার্ল।

হরদয়াল অল্প, বাগচী ঠোঁট টিপে, কেট হাত দিয়ে মুখ ঢেকে, কীবল প্রকাশে হো হো করে হেসে উঠলো। হরদয়াল ভাবলো, এই খুশীর ভাবটা কি লাঞ্চকে সার্থক করলো!

ডানকান হোয়াইটের রসিকতার কারণটা কী–তা কি নারীবর্জিত কুঠিতে দীর্ঘদিন থাকার ফল? অথবা ব্যার্গান্ডি যার ভিনটেজ ১৮৩৫? সে দস্তানা আর চাবুক সংগ্রহ করলো। একটু কি অসমান পড়লো তার পা? যখন এইসব বিষয়ে ভাবা যাবে এক অপ্রত্যাশিত পরিসমাপ্তির সূচনা করলো বাগচী।

ডানকান ও কীবলের ঘোড়া। রাজবাড়ির ভৃত্যরাই ঘোড়াদুটিকে এগিয়ে আনলো। তাদের পিছনে হরদয়ালের পালকি নিয়ে বেহারারা, শেষে মনোহর সিং-এর এক্কা নিয়ে তার সহিস এগোলো।

বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে নামছে মনোহর আর ডানকান তখন। বাগচী বারান্দায় কীবলের পাশে। বাগচী বললো–মিস্টার কীবল, আপনি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছেন? আমি এই পেগান রাইটের সঙ্গে স্যাক্ৰামেন্ট ইউক্যারিস্টের কথা বলে আপনার অনুভবকে আঘাত দিয়ে থাকবো। আমি দুঃখিত।

কীবল বাগচীর দিকে মুখ তুলো। কিন্তু কী বলা উচিত চট করে তা যেন খুঁজে পেলো না। এক্ষেত্রে এদেশে কিছু বলাই কি প্রথা?

শেষ সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে ডানকান পিছন ফিরলো।

সে বললো–গুডবাই হৃদলাল, গুডবাই বাগচী। আইস, কীবল। বাগচী, তোমার বোধ হয় অনুতাপে স্মরণ হয় (হিক্কা) অসাম্প্রদায়িক ক্রিশ্চিয়ানিটি আই মিন (হিক্কা) চার্চ ছাড়া যাহা তোমার তাহা মানুষকে সভ্য করে না। মানুষ হিদেনই রহে। টোমার মতো হইবে বাগডির ন্যায়।

হাসতে গেলে আবার হিক্কা উঠলো তার।

হয়তো, হয়তো–বাগচী বাও করলো। তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি স্পষ্ট হলো। কীবল ও কেটের মধ্যে নামতে নামতে সে বললো, ধর্মের সিম্বলগুলোর লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়াই বোকামি। ইউক্যারিস্টের ওয়েফার ছিঁড়ে মুখে দেওয়াকে নিশ্চয়ই কেউ নরমাংস ভক্ষণ মনে করে না, সত্যি তো সেটা ক্রাইস্টের মাংস নয়।

সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়েই ঘোড়ার লাগাম ধরলো ডানকান, ঘোড়ায় উঠতে যে জোরটা লাগে তা যেন তার মুখে প্রকাশ পেলো। হঠাৎ রেগে উঠে বললো–চও! ফের বলিলে হাড্ডি গুড়াগুড়া করিব।

কী যেন একটা ভেঙে পড়বে, যেন লাঞ্চটাই। বাগচীর মুখ এত কালো যেন তাকে চেনাই যাবে না। মনে হলো পাদরীদের পক্ষে তার কাঁধটা বিশেষ চওড়া দেখাচ্ছে। কিন্তু হো হো করে হেসে উঠলো বাগচী, বললো–লেট হিম স্লিপ ইট অফ, মিস্টার কীবল। (ঘুমিয়ে নেশাটা কাটাক)।

সিঁড়ির পাশে তখন কীবলের ঘোড়াটাও। সে কি কিছু বলবে? কিছু ভাবছে কি সে? ডানকানের ঘোড়াটা উল্টোপাল্টা নির্দেশের জন্য ল্যাজ দুলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে একটা পাক খেয়ে সিঁড়ির দিকে ফিরে এলো। হরদয়াল হেসে বললো–গুডবাই মিস্টার হোয়াইট।

ডানকান বললো–আইম অ রাইট।

কিছুদুরে যখন কীবল ডানকানের কাছে পৌঁছেছে, মনে হলো ডানকান কিছু বললো, আর তা শুনে কীবল হাসলো। পরে ডানকানও হো হো করে মদো গলায় হাসলো। ঘোড়ার উপরে একবার সে শোয়ার চেষ্টা করলো যেন, পরে সেটাকে কাটিয়ে উঠলো। হাজার হলেও ইংরেজ তো।

.

০৭.

সস্ত্রীক বাগচী পিয়েত্রোর বাংলোর বারান্দায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করলো। গাড়ি অর্থাৎ গোরুর গাড়ি। জেনে রাখা ভালো, মরেলগঞ্জে দু-তিনখানা ঘোড়ায় টানা গাড়ি আছে। রাজার গ্রামে যানবাহন বলতে পাল্কি, ডুলি, গোরুর গাড়ি, হাতি, ঘোড়া বুঝিয়ে থাকে। মরেলগঞ্জের ওরা কুঠি তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম যোগচিহ্নের মতো দুটো সুরকির সড়ক তৈরি করেছে। সে জন্যই কি ঘোড়ার গাড়ি? যদিও বর্ষা ছাড়া অন্যসময়ে প্রচুর ধুলো উড়িয়ে মরেলগঞ্জের বাইরে এ গ্রামে ও গ্রামে মরেলগঞ্জের এক্কা ফিটনগুলি চলে। এটা এক আধুনিকতা যা রাজার গ্রামে এসেও আসছে না।

কথা বলছ না যে? –কেট বললো।

বলছি তো। আমি বেশ একটু অবাক বোধ করছি। বাগচী বললো–রেলগাড়ি হলে স্টিমার জাহাজও হতে পারে, কিন্তু কত তাড়াতাড়ি হলো তা দ্যাখো। কিছুদিন আগেই হয়েছে, আমরা খবর রাখিনি। কলকাতা থেকে দূরে।

কেট হঁ বলে নিজের চিন্তায় আবার ফিরলো। চিন্তার অনেক বিষয়ই থাকতে পারে। পিয়েত্রোর বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে অনুভূতি তার হচ্ছে তা নিয়ে কি আলাপ করা যায়? কখনো সেপিয়েত্রোকে দেখেনি। কিন্তু এটা পিয়েত্রোর বাংলো, যার মতো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এদিকে কম দেখা যায়। সামনে পিয়েত্রোর হাওয়াঘর যেখানে মন্দিরটা উঠছে, আর, গুজব অনুসারে, যেখানে সিপাহীবিদ্রোহের আগুনের আভা দেখা দিয়েছিলো। বাগচী কিছু জানে। কিন্তু বাগচী বললো, আমরা ক্রিমিয়ার কথা কতটুকু জানতাম?

–আমরা ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ি না।

হুঁ। কেন পড়ি না? ইংলিশম্যান পছন্দ হয় না? রোসোআজ থেকেই ব্যবস্থা হবে। দেওয়ানসাহেবের টাইমস আসে। চেয়ে আনলেই হলো।

-আচ্ছা, লন্ডনের মে-ফেয়ারের মহিলা হসপিটালে সোলজারদের নার্স করছে–এটা কি সমাজে আলোড়ন আনে না?

-আনে। বোধ হয় স্টিমারের চাইতে কম নয়। যদিও আমি জানি না স্যার সিডনি এখন ঠিক কোন পদে আছেন। মনে হয় এটা লন্ডনের একেবারে নতুন খবরের একটা। আর সেজন্যই কীবলের বিস্ময়।

বাগচীও যেন কিছু ভাবছে। তা কি লন্ডনে যে পরিবর্তন হচ্ছে তার কথা?

কিছুক্ষণ পরে কেট আবার বললো–আচ্ছা, মোকাবেলা কথাটার মানে কী?

–দেওয়ানজি যা বলেছিলেন, সামনা-সামনি হওয়া বলতে পারো। তবে তোমার আমার মুখোমুখি হওয়া নয়। সাধারণত একটা বিপদ বা আশঙ্কার আভাস পিছনে থাকা চাই।

অল্পসময়েই তাদের গাড়িটা এলো। গোরুগাড়িটা অসাধারণ কিছু নয়। কিন্তু তখনকার দিনে অর্থবান লোকেরা ব্যবহার করতো বলে পরিচ্ছন্ন এবং চোখের পক্ষে তৃপ্তিকর রাখার চেষ্টা ছিলো।

বাগচী হাসলো–কিন্তু, ডার্লিং, এটাও কি একরকমের টাইমলেসনেস নয়–ওই কাগজ পড়া?

কেট বারান্দা থেকে নেমে গাড়ির দিকে রওনা হলো, বললো–এসো, আমি কিন্তু এই সময়হীনের শকট থেকে হেঁটে যাওয়া পছন্দ করতাম।

কেটকে হাত ধরে গাড়িতে তুলতে গিয়ে বাগচী বললো–এর চাইতে ভালো হতো ঘোড়া। এরপরে এরকম কোথাও যেতে হলে দেওয়ানজিকে জোড়া ঘোড়ার কথা বলবো।

কেট বলেছিলো, সে তো পরে। আজ এ ব্যাপারটাকে সামলে নিই।

তার মুখ সত্যি কিছু বিবর্ণ।

এখন, গোরুর গাড়ির এই অভ্যাস যে তা আরোহীকে নানারকমে পরীক্ষা করে থাকে। এপাশ থেকে ওপাশে গাড়িয়ে, সাধারণভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে, উপর থেকে নিচে ছোটোখাটো আছাড় দিয়ে সে পরীক্ষা। তখন কোনো চিন্তা করা যায় না, করলেও চিন্তাই বরং ভেঙে টুকরো হয়ে যায়।

দুএকবার বাগচী হেসে উঠলো গাড়ির রসিকতায়, কেট অনেকবার কুটি করলো। একবার কেট মনে করলো রানীমার এই লাঞ্চ সম্বন্ধে আলোচনা করবে–এটা তার রাজনীতি হতে পারে যার স্বরূপ কিছু না বুঝে তাকে সার্থক করতে তারা আজ সহায়তা করেছে। যদিও তারা রাজকর্মচারী নয়। কেন আদৌ তাদের এ লাঞ্চে যোগ দিতে হলো। বাগচী বলেছিলো দেওয়ানজি বলেছেন। আর তোমাকেই হোস্টেসের দায়িত্ব নিতে হবে। দেওয়ানজি শুধু নিয়োগকর্তা নন। বলা যেতে পারে বন্ধু, পেট্রন। কিন্তু তাদের নিজেদের মনের মধ্যে কি দ্বিধা ছিলো না? কিন্তু ঠিক তখনই গাড়ির আচ্ছাদন, যাকে ছই বলে, কেটের মাথা তাতে ঠুকে গেলো। কেট মুখ লাল করে সামলালো কিন্তু চিন্তাটা ভেঙে গেলো।

গাড়িটা যখন রাজার গ্রামে ঢুকছে কেট তখন বললো–তুমি কি এর মধ্যে মরেলগঞ্জে যাচ্ছো নাকি?

-কেন? সেখানে কী?

–যদি ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা হয়।

–এই দ্যাখো! কী অন্যায় করেছি কখন? তা মদ একটু বেশিই হয়েছে আজ। তার জন্য কার কাছে ক্ষমা চাইবো?

–আমার ধারণা ছিলো পাদরিরা সত্য বলে থাকে।

বাগচী হেসে উঠলো। –আ ডার্লিং, যদি সত্যি পাদরি হতাম।

অনেকসময়ে কিন্তু সাধারণ একটা দিনেও চিন্তা গুরুতর হয়ে যায়। বাগচীর মনে খানিকটা অনুপ দেখা দিলো। মদ খাওয়ার কথা মনে এলো তার। মদ স্পর্শ করবো না বলাটার মধ্যে একরকমের গোঁড়ামি দেখা দিচ্ছিলো বলে মদ একটু খেয়েছিলো সে। তখন সে ভেবেছিলো খাওয়া না খাওয়া কোনোটাকেই সে মূল্যবান করতে চায় না। কিন্তু তার ফলে কি খাওয়ার দিকে ঝোঁক আসছে? বিষণ্ণ লাগছে না? এই দ্যাখো, আমি ভাবতাম আমার চরিত্র ইতিমধ্যে কিছু স্থির হয়েছে।

কেট বললো–যা তার্কিক তুমি। তোমার মনে হতে পারে, ইউক্যারিস্ট নিয়ে কীবলের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

এঃ? বলে হাসলো বাগচী। কিন্তু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে সে ভাবলো, খ্রিশ্চিয়ান স্যাক্রামেন্টের আচরণ বিধিতে যে প্রতীকরূপে ইউক্যারিস্টের মদ আর রুটির কথা আছে তা তার কাছে কিছু স্থূল ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু তাহলেও তার সঙ্গে শিবপূজার প্রতীকময়তার তুলনা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। বিষণ্ণ হলো সে!

সে নিজে ইউক্যারিস্ট মানে না। এটা কি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা যে সে, নিজের অজ্ঞাতেই প্রায়, স্যাক্রামেন্টের প্রতীককে আর এক স্কুল প্রতাঁকের সঙ্গে তুলনায় এনেছে? অর্থাৎ যেন এই কারণেই সে স্যাক্ৰামেন্ট থেকে দূরে থাকে?

তার বিষণ্ণ মন কিছুক্ষণের জন্য যেন চিন্তাশূন্য হলো। অন্য কথায় তার মন চোখের দেখা বিষয়গুলিকে অবলম্বন করলো। গাড়িটা চলছে। যেমন শব্দ করার ও ঝাঁকি দেবার তা হচ্ছে। রাস্তা দিক বদলাচ্ছে। পথের ধারে কোথাও ফাঁকা, কোথাও ছায়ার গাছ। ছই-এর ভিতরে সবসময়েই দুপুরের আলো। তাহলেও তা কিছুটা তীক্ষ্ণ, অথবা ম্যাটমেটে হচ্ছে থেকে থেকে। একবার একটা বড়ো গোছের আঁকুনি কেট ছই-এর বাতা ধরে সামলে নিলো।

বাগচী ভাবলো, রোসো, রোসো। কোথায় ঠিক মনে পড়ছে না, সে শুনেছে শালগ্রাম শিলাতেও শিবপূজা হয়ে থাকে। তাহলে? পূজার জন্য এই স্কুল প্রতীকটাই অনিবার্য না ও হতে পারে। শালগ্রামশিলা শোনা যায় অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, আর বৃত্তের চাইতে, স্ফিয়ারের চাইতে পরিপূর্ণ কী আর কল্পনা করেছে মানুষ?

আসল কথা–আরো কিছু লেখাপড়া দরকার। বেশ কিছুদিন থেকে সে যা পড়ছে তা ধর্মগ্রন্থ নয়–চিকিৎসাশাস্ত্র। এটা ভালো নয়। বাগচী হেসে ফেলো আপন মনে। রোসো, আর একবার ক্যাম্পানেলা থেকে শুরু করতে হবে। গ্রীকরাও গোলককে পরিপূর্ণ মনে করতো।

কেট বললো–কথা বলছো না যে?

না, ডার্লিং, গুঁতো খাওয়া না খাওয়ার মধ্যে যখন কাগজের মতো পাতলা সতর্কতা, তখন অন্যমনস্ক হতে চাই না।

সে হেসে নিলো। ভাবলো : হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠার উৎসবে বিলেতি খানা নিষিদ্ধ খানাই বলতে পারো। তারা রাজী হলো কেন? দেওয়ানজি, যিনি বন্ধু ও পেট্রন, বলেছিলেন বলে? ডানকান তাকে বিদ্বেষ করে, বিদ্রূপ করে, কেটের নামে চূড়ান্ত কুৎসা রটায়। অথচ এখানে কেট আজ হোস্টেস! প্রমাণ করা হলো তার। ক্রিশ্চিয়ান?

সে অবাক হলো।

.

০৮.

শিব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে এয়োস্ত্রীরা এসেছিলো তাদের পুরোধা ছিলো নায়েবমশায়ের স্ত্রী। রানী যাকে বড়োবউ বলেন। রানী চলে গেলেও তার কিছু কাজ ছিলো। এয়োস্ত্রীদের সবাইকে পান, গন্ধতেলের মশলা, বাতাসা প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা সেই কাজের একটি। বিশেষ করে রাজবাড়ির ব্যাপারে এয়োদের সংখ্যার শেষ নেই। কিন্তু সে কাজও একসময়ে শেষ হলো।

ভিড় এখন কমে গিয়েছে, যে মেলা জমে উঠেছিলো তাও এখন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, যদিও দু-চারজন করে লোক এখনো আসছে। সিঁড়ি বেয়ে সেকালের হাওয়াঘর একালের মন্দিরের চত্বরে ওঠাও কম কৌতুক নয়। মিস্ত্রিরা কাজ করছে, নিচে কুমোর ছবি-টালি বানাচ্ছে–এসবই কৌতূহলের ব্যাপার। এমন সময়ে নায়েবমশায় এলেন গিন্নিকে বাড়ি নিয়ে যেতে। অনেক বেলা হয়েছে, নাহার হয়নি।

নায়েবমশায় দেখলেন, ভিড়ের থেকে কিছু দূরে, চত্বরের উপরে, নদীর দিকে এগিয়ে, রোদ মাথায় একা দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী। যেন নদীর দিকে কিছু দেখছে। কিন্তু এখন সেখানে কীই বা দেখা যাবে! রোদে জল ঝলমল করছে। আসলে তো বালু। চোখে ধাঁধা লাগবে। শেষ হেমন্তের দুপুর শেষ হচ্ছে।

নায়েবমশায়ের মনে হলো সেই কবে এসেছিলো তার সংসারে আট বছরের খুকিটি; তারপর এই চল্লিশ বছর গেলো চার দেয়ালের মধ্যে; এতটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে এতখানি নদীই বা কবে দেখেছে! অথচ–না, ভঙ্গিটা ভালো লাগলো না যেন।

কিন্তু সেও তো নায়েব। কথায় বলে পরগনাগুলো তার হাতের তেলো। সে তাড়াতাড়ি বললো–গাড়ি এসেছে, এসো।

মনে মনে বললো–হ্মুঃ।

 হাওয়াঘরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে বললো– আবার–তাছাড়া দ্যাখো, তোমাকে তোতা বলেছি তাঁতাঁকে বলে দিও। ধুতির ঝুল সে ক্রমেই বাড়াচ্ছে। কোচার নিচেয় দ্যাখো কাদা মাটিতে একসা। নয় মিলের খাটো ধুতিই দেখো। তাই তো পরে সকলে আজকাল।

নায়েবগিন্নি চোখ নামিয়ে আনলো। চত্বরের নিচে কিছুদুরে নায়েবমশায়ের সাদা ক্যানভাসের ছইসমেত গোরুগাড়িটা চোখে পড়লো। বললো–অনেক বেলা হলো। চলো, তোমার স্নান খাওয়া হয়নি।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছাকাছি এসে মৃদু হেসে,নায়েবগিন্নি বললো, একটু বোসো, পুরুতঠাকুরের সঙ্গে একটা কথাকয়ে আসি। নায়েবগিন্নি পূজারীদের জন্য তৈরি ঘরগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। পাশে নায়েবমশায়।

নায়েবগিন্নি হাসতে হাসতে বললো–লাঞ্চো করলেও পারতে। না খেয়ে কষ্ট হতো না। কিন্তু ভাগ্যে তুমি লাঞ্চো করতে যাওনি, একা একা ফাঁপরে পড়তেম।

নায়েব বললো–হ্মুঃ!

পুরুতঠাকুরের ঘরে কাছে এসে নায়েবগিন্নি বললো–শিবপূজায় রক্তচন্দন কেন লাগে তা একটু জিজ্ঞাসা করবো। আমরাও তো গ্রামে একটা পিতিষ্ঠে করেছি, আর সার্বভৌম ঠাকুরই তখন বিধান দিয়েছিলেন। রক্তচন্দনের বাটির উপরে অষ্টধাতুর শতদোল রাখার বিধান দেননি কিন্তু।

নায়েব বললো–প্রথা, তায় আবার কথা।

পুরুতঠাকুরের দরজায় এসে নায়েবগিন্নি বললো–তুমি কিন্তু, বাপু বাইরে থাকে। স্নান করোনি, পায়ে জুতো।

দরজার বাইরে নায়েব। তা দাঁড়ানোই বা কেন? তারই বা কাজের অভাব কী? এখানেও তো রাজবাড়ির টাকাতেই কাজ হচ্ছে, আর এসবের হিসাবও যাবে যথাকালে তার সেরেস্তাতেই। যদিও তার হিসেবী মনে গোড়া থেকেই এটা অপচয়। কার বাড়ি, কে করে মেরামত! এই বাংলোরই ওদিকে হচ্ছে লাঞ্চ। সবই তো সেই বেওয়ারিশ ফৌৎ ফিরিঙ্গি পিয়েত্রোর। ঘরগুলোর দেয়াল পাকা, ছাদ খড়ের। তিনপো হাত পুরু খড়ের ছাদ। নতুন খড়ে ছাওয়া চলছে। চৌচালার জোড়গুলি বাঁশের জাফরি করে চেপে বসানো চলছে। দেয়ালে রং পড়বে, ভাঙা শার্সিগুলোকে পাল্টানো হচ্ছে। কিন্তু মিস্ত্রি কারিগরদের এখন কেউ নেই। ছাদে দুচারজন আছে, হাতের কাজ শেষ না করে গেলে যাদের অসুবিধা। তা বেলা হয়েছে বৈকি। রোদটা আর মিষ্টি নয়। লাঞ্চের জন্যই মেরামত, সে তো কাবার, কিন্তু মেরামত আরো দুচার দিন চলবে। তো, রানীর হুকমৎ।

মিনিটদশেক পরে নায়েবগিন্নি ফিরলো। দুপুর রোদের ঘাসে ঢাকা মাঠ পার হয়ে নায়েব তার পিছনে গোরুর গাড়িতে গিয়ে বসলো।

গাড়ির বাইরেটা যেমন সুদৃশ্য, ভেতরটা তেমনি সযত্নে গোছানো। পুরু করে খড় বিছানো, খড়ের চাটাই, তার উপরে সতরঞ্চ তোশক, তার উপরে সাদা জাজিমের ধবধবে ফরাস। দু-তিনটে তাকিয়া গির্দা। দুজন তোবসে-শুয়ে সুখে যেতে পারবে। ধাক্কাধাক্কি, ঝাঁকি ঝাপ্টা নিশ্চয়ই কম।

প্রথমে গিন্নি পরে নায়েব গাড়িতে উঠলে গাড়োয়ান বলদ এনে জুতলো। দুই-ই সাদা, দুটোই বেশ বড়ো।

নায়েবগিন্নি বললো–আরাম করে বসোনা হয় এই তাকিয়া নিয়ে শোও। গাড়ির পাশেই নগদী। নায়েবগিন্নি মুখ বাড়িয়ে বললো–বাবুমশায়কে তামুক দিও।

নগদী প্রস্তুতই ছিলো। গাড়ি ছাড়বার আগে নায়েবমশাই-এর রুপোর ডাবায় তামার ঢাকনদার ছিলিম পরিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলো। নায়েব জোড়াসনে বসে ডাবায় মুখ দিলো।

গাড়ি ছাড়লে নায়েবগিন্নি হাসলো, বললো–—রক্তচন্দন না ছাই!রাজবাড়ির শিবপূজাতেও শ্বেতচন্দনই লাগে যেমন আমরা দিই। লাল রঙের জন্য একছিটে লালই লাগে। কিন্তু তাই বা কেন বলো?

কী?

–সে নাকি? বলবো কথাটা? তোমাকে বলতে আর কী? আর পুরুত যেমন মুখপাতলা দেখলাম সবাই জানবে ক্রেমে।

কী? বললো– নায়েব।

সে ভাবলো : এই চিরদিনের স্বভাব, আধখানা করে কথা বলে আস্ত মানুষকে পাগল করে। তা ভালো বাপু, দুপুরে অমন করে একদৃষ্টে নদী দেখার চাইতে এও ভালো।

 বললো– নায়েব আবার বলল শুনছি।

–সে নাকি, নায়েবগিন্নি বললো, গাড়োয়ান না শোনে এমন করে গলা নামিয়ে রানীর নিজের বুকের রক্ত!

নায়েবগিন্নি কতদূর অবাক হয়েছে তা বোঝানোর জন্য গালে হাত রেখে মুখটাকেও চট করে ঘোরালো একদিকে। বুকের রক্ত? রানীমার? পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে বসানো শিবলিঙ্গের গোড়ায়!

নায়েবগিন্নি বললো––শুনছো?

নায়েব ভাবলো, কী যেন সে ভাবছিলো, তাই তো, কেমন হলো না! এরকম সময়ে। সে সাধারণত যা বলে তাই সে বললো, তা হবে।

গাড়ি চলছে; এখনো এক-দেড় ঘণ্টার পথ। নায়েবগিন্নি বাইরের দিকে চাইলো। বলদ দুটো দেখার মতোই। একটু ভালো করে দেখলে কিন্তু বোঝা যায়, দুটোই সমান সাদা নয়। একটার ঝুঁটির কাছে পিঠে বেশ খানিকটা কালচে দাগ আছে। ওদিকে দুটোর শিঙেই এক বকমের পিতলের তাগা পরানো। গলাতে ঘণ্টা বাজছে টিং-টিং করে।

চোখ সরিয়ে আনলো নায়েবগিন্নি। নগদীকে ডাবা ফিরিয়ে দিয়ে নায়েব তখন থেকেই তাকিয়ায় মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়েছে। ঘুম নয়। অনুমান হয়, ছই-এর ভিতর দিকের বাঁশ ও বেতের কাজ একদৃষ্টিতে দেখছে। তা দেখার মতোই, বাঁশের বাতা দিয়ে যেন বালুচরীর নকসা তুলেছে।

নায়েবগিন্নি শায়িত নায়েব-ই-রিয়াসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। পদের সঙ্গে এখন পোশাকে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যেমন হাতের হীরার আংটি, হাতির দাঁতের ছড়ি, গরদের পিরহান। এসবে রানীমা খুশি হয়েছেন। নায়েবগিন্নিকে প্রকাশ্যে সুগৃহিণী বলেছেন। কিন্তু ধুতি? দ্যাখো ব্যাপারটা। চওড়া কালোপাড় ধুতিটার পাড় বরাবর সত্যি খানিকটা ধুলো কাদায় ময়লা। চিরদিনই তো এরকম ধুতিই পরেন। তাহলে কি চালটা বদলেছে? আগের তুলনায় অতটাই ঝুঁকে পড়েই হাঁটেন নাকি?

নায়েবগিন্নির চোখ দুটি পিটপিট করলো। মণির চারিদিকে সাদা জায়গাটা ব্যথা করে উঠলো। গোপনে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো সে। ঠোঁট চেপে ধরা যায় দাঁত দিয়ে, কিন্তু মণির চারিদিকে সাদা জায়গাগুলোতে যখন জল আসছে মনে হয়, বুকের মধ্যে অনেক জলের ঢেউয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসে, তখন চোখের কোণ প্রায়ই শুকনো থাকে না। বুকের ওঠাপড়াও গোপন রাখা যায় কি? তখন আবার বুজরুক, পিয়েত্রো, গোবর্ধনদের সেই ব্যাপারটা মনে ফিরে এলো নায়েব এখন ঝুঁকে পড়ে হাঁটেন তা ভাবতে গিয়েই যেন! যেন সে ব্যাপারটাই দশাসই মানুষটাকে নুইয়ে দিয়েছে।

নায়েব নিশ্চিতই ছই-এর বাঁশের সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখছিলো, কিন্তু সে তোনায়েবও বটে। সে কি নায়েবগিন্নির বুকের ওঠাপড়া দেখেনি? সে মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে শুলো।

নায়েবগিন্নি বললো–আর পুরুষের কী বুদ্ধি দেখো! ঘোড়া আর বন্দুক কেনার টাকা আমিই তো দিয়েছিলাম ছেলেকে। ভাবতাম, যে কালের যা। একদিন, দ্যাখো, খামে পুরে সেসব টাকা ফিরত পাঠালো পেত্রো। বলো, তখন কি আর গোপন রইলো? টাকা নেয়াটা ছিলো, তাহলে, আমার ছেলেকে পরখ করা।

 নায়েব এদিকে ফিরলো। বললো– সে-ঝকমারি করেছে, এ কি নগদীর কাজ রে বাপু! গাড়িই থামাক, তামুক খাবো যে।

নগদী সঙ্গে সঙ্গে ছিলো। দৌড়ে এলো। গাড়োয়ানের কাছে জানলো তামাক চেয়েছেন। তামাক সেজে আনতে আর কতক্ষণ, নইলে কীসের নগদী। নায়েব উঠে বসে তামাকে মন দিলো। গাড়ি ছাড়লো। তেমন লোকের কাছে ডাবায় ভোমরার শব্দ ওঠে। তা উঠলে নায়েব বললো, ঠোঁট থেকে ডাবা সরিয়ে–গোপন আর কী, গ্রামের সবাই অল্পবিস্তর জানেও এখন।

ডাবাটা গাড়োয়ানের হাতে দিলো নায়েব, গাড়োয়ান গোরুর পিঠের উপর দিয়ে তা নগদীকে পৌঁছে দিলো। নায়েব যেন আবার গির্দায় কাত হবে। কিন্তু সে বসেই রইলো। বরং গির্দা টেনে নিলো। একটু বা চিন্তাকুল দেখালো তাকে।

হঠাৎ সে বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো, দ্যাখো, গিন্নি, সেই আট বছরের এয়েছিলে। শাড়ি নিয়ে বলতে পরিয়ে দাও। তারপর চল্লিশ বছর কাটলো সুখেদুখে। এখন তো আর ছোট্টটি নও, কেমন কিনা? নির্যাস কথা বলি শোনো। নদীর কাছে এলে কারো মাছের কথা মনে হয়, কেউ ভাবে তপ্পন করি। যাদৃশী ভাবনা যস্য। কিন্তু ভাবনা তো আগেই ছিলো,নদী দেখেই না মনে আসে? তা তোমার তো এখানে এসে মনে পড়ছে গোবরার কথা সব নতুন করে। কারণ তুমি আর আমি এই প্রথম এলেম সেখানে, যেখানে গোবরা সেপাই-টেরনিং নিতো। আরে, বাবা, আমার কাছে গোপন! এখন সুড়সুড় করে সবই বেরিয়ে আসছে। বুজরুক ছিলো গোঁয়ার। তা সাহস ছিলো বৈকি। রাবণরাজার কি সাহস ছিলো না? আসল মন্ত্রের নারদমুনি কিন্তু বুড়ো পিয়েত্রো। আর এসবই তোমার মনে হয়েছে। কিন্তু ভস্মীভূতস্য পুনরাগমনংকৃতঃ। ফেরেনা। ফিরলে এই তিন বছরে? আর, দ্যাখো, শোকও ভোলার কথা। নিজের ছেলের শোক ভোলে না? এ তো পরের ছেলে, ভাগনা। তুমি তাকে মানুষ করেছিলে বলেই কি বেশিদিন শোক করবে? আঁ? আমার মতো শক্ত হতে পারো না? আর তাছাড়া গ্রামের সব লোক জানে সে তো রাজদ্রোহ। নায়েব থামলো। বক্তৃতা সামলাতেই যেন বুক ওঠানামা করছে তার। নায়েবগিন্নি বলদ দুটোর মাথার উপর দিয়ে তাকালো পথের দিকে। চওড়া কিন্তু মাটির পথ। এখানে ওখানে বাতাস লেগে ধুলো উড়ছে। নায়েব বুকের তলায় গির্দা টেনে নিলো। নায়েবগিন্নি ভাবলো ব্যাপারটা নায়েব ঠিকই ধরেছে। খুব সহজ করেই তো বলা যায়। তাদের ভাগনা গোবর্ধন বুজরুকের সঙ্গে সিপাহীদের যুদ্ধে গিয়েছিলো, আর ফিরবে না। আর আজ সে কথা আবার মনে হয়েছে নতুন করে পেত্রোর হাওয়াঘরে। কিন্তু শক্ত হওয়া? তোমার মতো দশাসই পুরুষটা যে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে হাঁটছো সে কীসের বোঝার চাপে? সে আঙুলের ডগায় চোখ মুছলো।

কাঁচা পথ। পথের ধারে কোথাও আকন্দর ঝোপ, একটা-দুটো বাবলা গাছ, কোথাও বা প্রকাণ্ড সেগুনা সংখ্যায় বটগুলোই কম, কিন্তু তার তলায় পালকি নামায়, গোরুগাড়ি থামিয়ে বলদকেও জিরিয়ে নেওয়া হয়।

পথটা ফরাসডাঙা থেকে মরেলগঞ্জের ধার ঘেঁষে রাজার গ্রামের দিকে গিয়েছে। চওড়া যার ফলে রাষ্ট্রবাদ দিয়ে চলা যায়। ঝাঁকুনি কম। সেজন্যই এ পথে আসা। নায়েবগিন্নি দেখতে পেলো, গাড়ির রাস্তার উপরে ডানদিক থেকে একটা ছোটোপথ এসে মিশেছে। পথটা কি অপেক্ষাকৃত নতুন? কারণ সেটার এক জায়গায় যেন মাটিকাটার কাজ হচ্ছে এখনো, হয়তো পথটাকে আরো উঁচু আরো চওড়া করার চেষ্টা। গাড়িটা আর একটু এগোলে আর একটু ঝুঁকে দেখলো নায়েবগিন্নি। যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে সেটা ধানের খেত। আধপাকা ধান আছে। তার এত কাছে মাটি পড়ছে যে মনে হবে পাকা ধানও চাপা দেবে মাটি। কৌতুকের ব্যাপার তো! আরো ভিতর দিকে, যেখানে মাটি পড়ছে তারও ওদিকে রাস্তাটাকে সুরকির মনে হয়। বেশ লাল, চারিদিকের সবুজ কালচে-মেটের মধ্যে বেশ রঙিন। ভাবলো সে : তুষের আগুনের কাছে দু মিনিট হাত রেখেছো, সেই ছাইচাপার কী তেজ? আর তার এক হাঁড়ি যদি বুকের মধ্যে জ্বলে? বলার উপায় নেই, কাদার উপায় নেই। আমার তবু তো পোষ্য আর এই পুরুষটার তো রক্তের সম্বন্ধ, ভাগনা। সে তাড়াতাড়ি ভাবলো, না, এ নয়, অন্য কথা ভালো। লুকিয়ে চোখ মোছা তার অভ্যাসেই আছে। কর্তার গায়ে আঙুল দিয়ে সে বললো–ওটা কোন পাকা সড়ক গো, সদরের বুঝি? দ্যাখো, দ্যাখো।

নায়েব না দেখেই বললো–সদর? সদর কোথায় এখানে? সে তো আগে যাকে বৈরামপুর দিয়ারা বলতো কায়েতবাড়ি ছআনীদের সেখানে। সদর ছিলো বটে এটাই, তা সে কি আজকের কথা? তখন খাঁয়েরাই ছিলো নায়েব-নাজিম। আর গড়ের জঙ্গলে ছিলো তাদের কিল্লা।

-তা বলছি না। এ পথে কি সদরে যাওয়া যায়? লাল সুরকির।

সব পথই সদরে যায়। নরেশ ওভারসিয়ারের কাজ হবে, রাজবাড়ির হাত থেকে শুরু দ্যাখো কী?

নায়েবগিন্নি হেসে ধাক্কা দিলোনায়েবের গায়ে। স্বপ্ন দেখছো নাকি, স্বপ্নেকথা কইছো? দ্যাখো না, ওই যে পথটা। এখানে রাজবাড়ি কোথায়?

তাকিয়া থেকে মাথা তুলতে হলো নায়েবের এবার। -ওটা, তা ওটা তো সকালেই দেখেছো। মরেলগঞ্জের সাহেবরা করছে। আবার তাকিয়ার মাথা রাখলো নায়েব। বললো–: তা এখানেই সদর থাকলে খুব সুবিধার দিন ছিলো না বোধ হয়। শুনেছি, শুধু খায়েরা না, তাদের অনেক আমলাও কোমরে কিরিচ বেঁধে তবে রাস্তায় নামতো। রিসালা ছাড়া মেয়েরা স্নানে যেতো না।

–তখন কি বিচার ছিলো না?

ছিলো না আবার! নায়েব বললো–এখানকার পথেই কাজীর তুরুকদের সঙ্গে বেঁধে গেলেই হলো। তা এরাও বিচার চাইতো না। বরং ধরে নিয়েছিলো মারকাট করতে করতে বংশে গড়ে একজন পুরুষ থাকলেই হলো। ছোটোকালে মাসিদিদিমার কোলে রাখো লুকে। তারপর সে-ও আবার কোমরে কিরিচ বেঁধে হাঁটবে। তা বাপু সেসব দিনের চাইতে নাকি এ রাজ্য ভালো। এই তো দ্যাখো, অত বড়ো মন্দির উঠছে, কেউ ভাঙতে এগোচ্ছে না।

গাড়ি একটু এগিয়ে গেলো। হঠাৎ নায়েব খাড়া হয়ে বসলোতা দ্যাখো এরাও তো রাজা। আর তার বিদ্বেষী তোমার ছেলে। বলল, রাজদ্রোহ তো পাপ। দ্যাখো কত লোকের ছেলে কমিসরিঅটে চাকরি করে কলকেতাতেই কত বাড়বাড়ন্ত। আর তোমার ছেলে? ফিরলো বলো তোমার তিন সালের কান্নায়? পাপ নয়? লুক্কে রাখতে হয় না? কেমন কি না! তাহলেই দ্যাখো, চোরের মায়ের কাদন নেই।

হঠাৎ নায়েব হা হা করে হেসে উঠলো। আর তখনই যেন তার উত্তাপ লেগে তার নিজেরই সারা মুখ ঝলসে গেলো। বললো–ওরে তোরা তামুক দিতে ভুলছিস। না থাক। আরে ও গাড়োয়ান, থামা বাপা, থামা। নামবো একটুকন। চারিভিত উজল যে। লালে লাল দেখি। শিমূল নাকি অকালের?

গাড়ি থামলো। নামলে গাড়ি থেকে নায়েব। কয়েক পা এগিয়ে পাকা সুরকির সড়কটার। মুখে যেখানে মাটি পড়ছে সেই বরাবর গিয়ে দাঁড়ালো সে। ঝুড়ি করে মাটি ফেলছে পাঁচ সাতজন, কোদালে মাটি কাটছে জনাপাঁচেক। একজন তো পথের ধারেই।

নায়েব ইশারায় তাকেই ডাকলো। সে এলে বললো–লাল সড়কের ধারে উই ছাতনা। গাছ নাকি বাদামগাছ–ওটাই না মরেলগঞ্জের সীমানা? বটে তো? ওখানেই তো মনোহর। সিং-এর মকান। তা, এখানে এ রাস্তা পাতে কে?

-শুনি তো সিংজী, আসলে নীলেসাহেব আজ্ঞা। শুনি যে কুতঘাট তক যাবে।

বাঃ। একেবারে ফরাসডাঙা ফুঁড়ে? আহা বড়ো ভালো গো। তোমাদের আর কষ্ট থাকবে না। তা বলি, এই যে জমির মাটি কাটছে আর যে ধানের উপরে মাটি ঢালছো–এ সবই বুঝি নীলসাহেবের!

লোকটি ভয়ে ভয়ে বললো–জমিটা কর্তা ওই মাথায় করে মাটি ঢালছে-ওরই।

এই বলে সে থামলো। কেমন যেন ভাষা না বাবুটির? আর মুখের সঙ্গে তাও মানায় না। ফিনফিন ধবধবে জামা-পিরহান। কিন্তু পিতলের গরম পিদিমের মতো যেন চোখ দুটি।

তাহলে নিজের ধানে মাটি ঢালে কেন? নায়েব হো হোকরে হাসলো। একদম বেহেড। দেখছি। লোকটি এদিক ওদিক দেখে স্বর নিচু করে বললো–ধান তো গেয়েই আছে। কাল নয় পরশু আসবে মনোহরের নোক ধান কেটতে। তা সামচাচা কইলে মরার বাড়া গাল। নেই, দে গোরে ধান।

সাফ মাথা। তা মনোহর তোমরা চাচার জমির ধান কাটে। তার বর্গা বুঝি? নাকি তারও চাচেরা লাগে।

সাদা ধবধবে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে রাজার গ্রামে যাওয়ার সড়কে। এই ভদ্রলোক তাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলছে। যারা কাজ করছিলো তারা এই আকর্ষণেই কাজ ফেলে ক্রমশ নায়েবমশায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলো।

তাদের একজন বললো–কও না, সামচাচা, মনোহরমশাইয়ের ফয়সলা। কেন ধানে মাটি। ডানকানের সুবিধার জন্যেই এই সড়ক হবে মনোহরের বাড়ির তল দে কুতঘাট পর্যন্ত।

নায়েব খুক করে হাসলো–তা সামসুদ্দি নাকি শ্যামাচাঁদ, তা যাই হোক জমির খাজনা নেয় কে?

-জী? সামসুদ্দিন, হুজুর। খাজনা লেয় না।

লাখেরাজ বুঝি? নায়েব হেসে উঠলো। কিন্তু হঠাৎ থামলো সে। কিছু যেন তার মনে এলো, কপালটা কোঁচকালো। তারপর তার বোধ হয় মনে হলো অনেক বেলা হয়েছে, সে গাড়ির দিকে ফিরলো। লোকগুলি কী করা উচিত বুঝতে না পেরে পায়ে পায়ে তার পিছন পিছন হেঁটে এলো গাড়ির দিকেই।

নায়েব যখন গাড়িতে উঠছে, সামসুদ্দিনের কী মনে হলো। ঝপ করে সত্যটা প্রকাশ করে ফেলো। আজ্ঞে, পেত্রোসাহেবকে খাজনা দিতাম না। বাপ ছিলো কারিগর। চাকরান স্বত্ব এই পাঁচ বিঘার। ফরাসডাঙার ছিটমহলে আজ্ঞা।

নায়েব বললো–এদিক ওদিক বুঝি সবই পেত্রোর ব্রহ্মোত্তর?

–আজ্ঞে, ব্রহ্মোত্তর? মানে তিনি তো খেস্টান; তা উদিকে রাস্তার পুবে হৈ শিমূল গাছ থেকে ইদিকেও রাজবাড়ির রাস্তার পুবে আর পশ্চিমে তাই। এ দুশো বিঘার টোকটা পেত্রোর ছিট শুনি।

নায়েবকীভাবলো, বললো–শোনো সামসুদ্দিন,আর এক কোদালমাটিও উঠবেনা। কাল প্রেভাতে আমিন আসবে, চেন আসবে। পেত্রোর ফরাসডাঙা এখানে ফালা হয়ে সেঁধিয়েছে, না? টোঁক? সাতপুরুষে জোলা, জমি বোঝো? কার জমিতে কে সড়ক বাঁধে, হ্যাঁ?

শেষ কথায় নায়েব হঠাৎ সাপটে উঠলো। আরে বাপ–বলে সামচাচা দুধাপ পিছিয়ে গেলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। চলতি গাড়িটার পিছনে সেলাম আদাব বলে সামসুদ্দির দল খানিকটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই সাপটেই যেন চেনা চেনা লাগলো। দেওয়ানজি নিজেই নাকি?

গাড়ির ভিতরে বসে নায়েব নিজের বাঁ হাতের তেলোটা চোখের সামনে মেলে ধরলো। গাড়ি চলতে ঝাঁকুনি লাগে তাতেই যেন তার মুখটা আরো একবার কঠিন হয়ে উঠলো।

সে বললো–গিন্নি, সেই থেকে বসে ঝাঁকুনি খাচ্ছো। বাড়ি গিয়ে মাজা খুঁজে পাবে না; শাও দেখি।

প্রায় জোর করে সে শুইয়ে দিলো স্ত্রীকে।

 বললো–এখন আর তামুক না, কী বলল। বেলা গড়িয়ে গেলো।

-তুমিই তো না হক সময় নষ্ট করে এলে।

–তাও বটে। নায়েব হাসলো। কিন্তু যেন রোদ লাগার ফলেই তার মুখটা শুধু থমথমে নয়, পোড়া পোড়া দেখালোতা তুমিও বাপুকমনও। সেই থেকে পাকা সড়ক লাল সড়ক করছিলে। এটা তোমার ধাত হলো দেখছি, কাঁথার নকশা নিয়েও এমন রাতভর বকর বকর করো। তাছাড়া ইংরেজ দেশের রাজা। ডানকানই দাখো লাল সড়ক করছে। সেই গল্প, সব লাল হো যায়গা। হ্মুঃ!

গাড়ি তখন রাজারে গ্রামেই ঢুকছে। নায়েব বললো–বড়োবউ, তুমি কিন্তু কান্নাকাটা একটু কম করে করো।

-কেন নিজের ঘরে মধ্যে কাঁদবো না?

-এই দ্যাখো বাপু, তা আমাকে দুষো না। আমি কিন্তু আর একজনকে পরপরই এনে দিয়েছিলাম। আর এই ভদ্রলোক? লোকের মুখে মুখে শোনা আগের চাইতে নাকি দপ্তরে দশগুণ কড়া হয়েছেন। আমলা ফামলা রাগের ভয়ে তটস্থ। কিন্তু তারাও নাকি বোঝে না। ক্ষুঃ বলে উঠলে গলদঘর্ম হয়। কার ভিতরটা কতখানি পুড়েছে তা বোধ হয় বোঝা যায় না। নায়েবগিন্নি ভয় পেলো। সে বললো–ওখানে কী করে এলে? তোমার কথার পাত আমি বুঝি। রাগের মাথায় সড়ক বন্ধ করে এলে নাকি নীলসাহেবের?

নায়েব বললো–মেয়েমানুষ আর কাকে বলে। রাগের মাথায় কাজ হয়!

এখানে সময়ের দিক দিয়ে অসামঞ্জস্যের হলেও পরের দিন সকাল হতেই যা ঘটতে শুরু করেছিলো তা বলা মন্দ হবে না।

সামচাচা ভেবে ভেবে কিনারা পায়নি, লাভের মধ্যে ঘুম বরবাদ। হাসিখুশি লোকটি যে হঠাৎসাপটে উঠেছিলো তা ভোলা গেলো কোথায়? মোরগের ডাকেই সেউঠে বসেছিলো। বাইরে বেরিয়ে সে দেখলো তার সেই সড়কে গ্রাস করা জমিটার উপরে যেন হাজার লোক পিলপিল করছে। তার জমি ছাড়িয়েও নতুন সড়ক বরাবর আরো অনেকে।

কী আপদ বলে সে এগিয়ে যা দেখলো তা বরং দূর থেকে হাজার লোকের ভিড় কল্পনার। চাইতেও খারাপ। অস্থত পঞ্চাশটা কান্তে চলছে তারই ধানে। এর মধ্যে বারো আনা কাটা শেষ, আঁটিতেও বাধ্য হয়েছে! ওদিকে মরেলগঞ্জের সীমা ঘেঁষে নতুন সড়কের আড়াআড়ি খাম্বা বাঁশের খোঁটা বসেছে সারিসারি। আর তার এপারে ঝুপঝাঁপ ত্রিশখানা কোদাল পড়ছে, নতুন সড়ক কেটে মিশিয়ে দিচ্ছে দুপারের জমি বরাবর। ফর্দাফাই মাঠান জমি। দুমাসের সড়ক একবেলায় মাঠ।

ভয়ে হাত-পা সেঁদিয়ে যাওয়া বোধ হয় একেই বলে। বাড়িতে ফিরে তবু তারই মধ্যে ভাবলো সে একবার মনোহর সিংকে একটা খবর দেওয়া উচিত; অন্তত বলা দরকার আমি এসবে নেই। একটু বেলা হলেই তা করবে সে, এই ঠিক করলো। কিন্তু তাই বা কী, এতক্ষণ ননোহর সিং কি আর খবর পেয়ে যায়নি? আর এতক্ষণে সে বা কী মূর্তি ধরেছে। কাল যে গোরুগাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সঙ্গে সে কথা বলেছিল তা কি আর ছাপানো আছে? সে কল্পনায় লাল সূর্যে কখনো মনোহর সিং-এর চোখ, নীলসাহেবের মুখ দেখতে লাগলো। আর তা হবেই, কারণ বাঁধা সড়ক কেটে নামিয়ে দেওয়া তা গিয়ে লাথ ঝাড়ারই সামিল আর তা জোরসে এবং নাক বরাবর। বাঁদরামির হাসির মুখে ডান হাতের এক থাপ্পড়।

কথায় বলে হস্তিমূর্খ পণ্ডিত আর বলদবোকাই তাঁতী। নীলবাবুদের রেশমদাদন মেটাতে–পেরে ওনকানের নীলের দাদন। বোঝ এখন? পণ্ডিত তার শাস্ত্রের বাইরে কানা, তাতীও তার তাতের নকশার বাইরে কীই বা দেখে? সামসুদ্দিনের ততও নেই, কিন্তু টানা দেখে বালুচরীর নকশা কেউ ধরতে পারে না এ সে বোঝে। তার গোটা বুকের মধ্যে সাতপুরুষের ভাবনা উথাল পাথাল করে উঠলো। নইলে তাতের ভুলো যাওয়া কথা এমন করে মনে আসে? লোকে বলে মাথায় বাড়ি পড়লে ভিরমি যাওয়ার আগে শৈশবকালের ঘটনাও নাকি মনে ফেরে। সূচনা আর পরিণতি, টানা আর নকশায় অনেক তফাত। কালকের সেই সাদা ছই-এর গাড়ি আর আজ সকালের এই দৃশ্য। কিছু কি বোঝা গিয়েছিলো কতটা বাগ? একবারই সাপটেছিলো বটে!

কিন্তু আরো আছে। জমি থেকে ধানের বোঝা সব মাথায় উঠছে এবার। রাস্তা চৌরস করে এবার ধানকাটা জমিতে কোদাল দিচ্ছে। কোদালেই চাষ। ক্রমে তারা জমি আর সড়ক ছেড়ে উঠে আসছে। সরষেও ছিটায় নাকি? আল্লা! এগিয়ে আসছে আর সামসুদ্দিনের ঘরের সামনেই ঝুপঝাঁপ ফেলছে কাঁচাপাকা ধানের বোঝাগুলি। উঁই করে ফেলছে। সামসুদ্দিন ফকির দরবেশের মতো নির্ভাজ হয়ে বসে রইলো। কে কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে?

ধানের বোঝা ফেলা শেষ হলে লোকগুলি দল বেঁধে ফরাসডাঙার দিকে হাঁটতে শুরু করলো। তখন হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে গেলো সামসুদ্দিনের। বাড়ির ভিতরে গিয়ে বউকে বললো–বেলরা তো। বেরো, আয় আমার সঙ্গে। ছোটোমেয়েটা দাওয়ায় খেলছিলো, তাকে টেনে কোলে তুলো। ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে কী বায়না করছিলো, আঁচলসমেতই তার হাতে চেপে ধরলো। –আয় আমার পিছনে। বললো– বউকে। -আয় বলছি।

যারা দল বেঁধে ফরাসডাঙার দিকে যাচ্ছিলো তাদের লাগ রবার জন্য সামসুদ্দিন লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করলো বউ-এর আঁচলসমেত ছেলের হাত চেপে ধরে মেয়ে-কাঁকালে।

বউ বললো–আরে আরে, করো কী? ছাড়ো, আঃ!

–শশুরের বাড়ি যাই।

তা শ্বশুড়ের বাড়ি বটে, ফরাসডাঙার অন্য প্রান্তে নদীর ধারে।

বউ বললো–এক বস্ত্রে? করো কী? খেপলে? ছাড়ো। লোক?

চপ। সাপূটে উঠলো সামসুদ্দিন।

সামসুদ্দিন জানে টানা টানাই, নকশা নকশা। এই তো সবে সূচনা। অথচ ভাবো একবার কাল সেই বাবুমশায় রাস্তা সড়ক হচ্ছে দেখে কত প্রশংসা না করলো নীলেদের। কেমন হলো না? আকাশে ভাসা মেঘ দেখে বিদ্যুতের পোড়ানি বোঝো? ওদিকে আবার ডানকান আর মনোহর। তাদের লেঠেলরাও বোধ হয় এতক্ষণ বেড়ার গায়ে দুমড়ে পড়েছে।

এসবই পরের দিন ঘটেছিলো।

.

০৯.

শেষ হেমন্তের দুপুর দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়, ১৮৬০, মতান্তরে ১৮৬১-র সেই দুপুরও হয়েছে। এখন সবকিছুই কাছের হলে বাদামী, দূরের হলে কালচে।

জয়নালের বয়স হয়েছে। তার গায়ে চকখড়ি এবং সিঁদুরের আলপনা যেটুকু সকালে দেখা গিয়েছিলো এখন চোখে পড়ছে না, বনজঙ্গলের ডালপালায় ঘষে উঠে গিয়ে থাকবে। কিংবা বাতাসে এখন রং থাকায় সেই নকশা এখন অস্পষ্ট। জয়নালের গুঁড়ে জড়ানো বেশ মোটা কিন্তু খাটো একটা কলাগাছের ডুমো। তার হাঁটা দেখে মনে হয় যেন সে ভাবছে কতক্ষণে হাওদা খুলবে, আর সে সেইনরম ডুমোটাকে সদ্ব্যবহার করবে। সেজন্য তার চলার মধ্যে যেন একটা খুশির ভাব।

হাওদায় রাজু রাজকুমার, রাজচন্দ্র। সারাদিনের পরে শিকার থেকে ফিরছে সে।

রাজুর সকালের কথা মনে হলো। শিবমন্দিরটা অনেকটা উঁচুই হবে! মেঝে থেকে অন্তত বিশ বাইশ হাত উঁচুতে থাকবে চূড়া। আর সেই মেঝে, যা সেই হাওয়াঘরের, তা না কোন দশ হাত। রাজবাড়ির চূড়া শোনা যায় মাটি থেকে পঁচিশ হাত। কিন্তু রাজবাড়ির চূড়াটা গম্বুজের। মন্দিরের চূড়া যেন রথ। রাজবাড়ির গম্বুজের কাছে দাঁড়ালে সেই চূড়া চোখে পড়বে কি?

গোটা মন্দির কী রকম হবে তার ছবি রাজু দেখেছে। রানী নিজেই দেখিয়েছিলেন। জয়পুরী সেই মিস্ত্রির নকশা।

হঠাৎ মনে হলো রাজুর, হাওয়াঘরটা থাকবে না। বলতে পারো এখনই নেই। কিছুদিন আগেই টেনে নামানো হয়েছে খড়ের সেই পুরু ছাদ, লোহা আর কাঠের তির বরগা। যেন হঠাৎ একটা ধাক্কা লেগে শূন্য হয়ে গেলো তার মন।

ওখানেই, ওই হাওয়াঘরেই, প্রথম বন্দুক চালাতে শিখেছিলো সে। শিখিয়েছিলো বুজরুক। কত তাড়াতাড়ি বর্তমান অতীত হয়ে যায়!

আর অতীত এমন বিষয় যে বর্তমানে পৌঁছে সবকিছু যেমন করে ঘটেছিলো পরপর তেমন করে দেখবারও উপায় থাকে না।

শাখা-পথটার কাছে জয়নাল দাঁড়ালো না।

আর এই শাখা-পথের উপরেই কিছুদূরে এগিয়ে গিয়ে সেই ঘটনাটা ঘটেছিলো। পালকি বেহারার হুমহাম শব্দে তার ঘোড়া বারবার শিষপায়ে দাঁড়াচ্ছে। ঘোড়ার উপর থেকে সে যেমন, পালকির ভিতর থেকেও তেমন বিরক্ত বুজরুক কে যায় বলে কেঁঝে উঠেছিলো। সারাক্ষণ বুজরুকের কথাই ছিলো মনের কাছে, ইংরেজের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরছে। বুজরুক। অথচ তখন সেই পালকিতেই বুজরুক তা সে ভাবতেও পারেনি।

দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো রাজুর। তখন দেখা হয়ে গেলে কী না কৌতুকের হতো! সন্ধ্যার ম্লানভাবটা রাজু অনুভব করলো তার মনে। আসলে বোঝা যায় না। একই পথের উপরে মুখোমুখি অবস্থান করলেও চেনা যায় না, জানাও যায় না কী কার পরিণতি হবে। কেউ কি জানে পিয়েত্রো ঠিক কী আশা করেছিলো? তা কী ইংরেজদের প্রতি ফরাসীর মিথ্যা অর্থহীন আক্রোশ? একদিন গল্পের ঝোঁকে বলেছিলেন বটে এক হাজার লোক নিয়ে শুরু করে এক রাজ্য স্থাপন করা যায়–ভাগ্য সহায়তা করলে এবং অশেষ কষ্ট সহ্য করার উৎসাহ থাকলে।

রাজু হাসলো। হাওয়াঘরের কথাটাই আবার ঘুরে এলো মনে। সে অনুভব করলো ছাদ টেনে নামানোর পরেও সেদিকে চাইলে যেন হাওয়াঘরটার ছায়া সেখানে এতদিন দেখা যেতো। এরপর সেদিকে চাইলে নিরেট বিপুল শিবমন্দিরটাই চোখে পড়বে। এরপর পিয়েত্রোর বলা কোনো প্রতিধ্বনিও মনে আসতে আসতে হয়তো মন্দিরে ঘণ্টাশব্দে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাবে।

হাতের উপরে চিবুক রেখে সামনের দিকে চাইলো রাজু। তাহলে শব্দটা উঠছে জয়নালের গলায় ঝুলনো ঘণ্টা থেকেই? গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছেহাতি। শিকারের হাতির ঘণ্টা বাজালে চলে না। গ্রামে ঢুকেই সোভান দড়ির বাঁধনটা ছাড়িয়ে দিতেই বড়ো পিতলের ঘণ্টাটা হাতির গলার ডোর থেকে দোল খেয়ে খেয়ে বাজছে।

আর জয়নাল এখন গতিও বাড়িয়েছে যেন। বাড়ি ফেরার পথ, মাহুতকে অঙ্কুশ ব্যবহার করতে হচ্ছে না। কানের পিছনে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে মাঝে মাঝে। কিন্তু অঙ্কুশটাও হাতে আছে। গ্রামে ঢুকে পিলখানার দিকে ছুটতে পারে, রাজবাড়ির দিকে না গিয়ে।

হ্যাঁ, গ্রামেই তো। খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামছে এখন। তাহলেও পথ চেনা যাচ্ছে। লোজন আছে পথে। তারা সরে সরে যাচ্ছে হাতি বাঁচিয়ে।

হাওদায় বসে দুলুনিটা ডাইনে-বাঁয়ে লাগে ঠিকই, কিন্তু কাঁধের কাছেবসা মাহুত অনবরত উঠছে আর নামছে সন্ধ্যার অন্ধকারে।

এমন অন্ধকারেই পিয়েত্রোর হাতিটা একা একা এক গাছতলায় সামনে পিছনে দোলে। শুড় তোলে। কী ধরতে চায়? কিছু যেন শুড়ে টেনে পায়ে ফেলছে মনে হবে। মিথ্যা কিংবা উদ্দেশ্যহীন আক্রোশে।

পিয়েত্রোর হাতিটা ছোটো। তার পিঠে হাওদা, হাওদায় পিয়েত্রো। অন্য হাতিতে ছিলো বুজরুক।

রাজু ভাবলো সে শিকারের তুলনায় অন্য কোনোদিনের কোনো শিকারকেই সে নাম দেওয়া যায় না। অথবা তাকে কী শিকার বলা হবে? আহত বাঘের দিকে বুজরুক যেভাবে খোলা কিরিচ হাতে ছুটে গিয়েছিলো? সেটা হয়তো তার পক্ষে শিকার-খেলার অংশমাত্র ছিলো। কিন্তু আহত বাঘের সঙ্গে-ঘটনাটা যেন রাজুকে বলতে পারে, দ্যাখো, পুরুষের কত সাহস হতে পারে, নিজের হাতের কিরিচে কত বিশ্বাস রাখতে হয়!

আজকের হরিণটা কিছুমাত্র খেলেনি। পাকা ধান খেতে বনের ধার-ঘেঁষা ধানক্ষেতে ঢুকেছিলো। বেশি খেয়ে যেন ছুটতেও পারছিলো না।

এ জাতের হরিণ, অবশ্য, কচিৎ মেলে জঙ্গলে। প্রচলিত গল্প মানতে হলে বলতে হবে, রাজুর বৃদ্ধ পিতামহের সময়ে পুরনো বাড়িতে বন্যার জল পৌঁছলে হাতার চিড়িয়াখানার হরিণগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। এ হরিণ তাদেরই জ্ঞাতিগুষ্টি হবে।

রাজু ভাবলো, বনে বুনোমোষও আছে। বাঘও আসে হরিণের লোভে। তারপর বনের ধারে গ্রামে গোরু বলদের উপরেও হামলা করে।

হরিণ যদি তেমনভাবে এসে থাকে বুনোমোষও কি তবে গৃহস্থের হারিয়ে যাওয়া মোষ থেকেই এ অঞ্চলের বনে তৈরি হয়েছে? কিন্তু তা কি সত্যি হয়–পুরনো ঝাড় থেকে একেবারে নতুন বেপরোয়া এক বংশ। তা কি হতে পারে? গৃহস্থ মানুষ থেকে স্বাধীন এক পুরুষ!

এখন গ্রামের প্রধান পথে উঠেছে হাতি। তাই এ সন্ধ্যাতেও লোকচলাচল একটু বেশি এখানে তাদের কারো কারো কাঁধে অথবা মাথায় ধামা। ওদিকে কাঠুরেপাড়ার হাট ছিলো তবে দু-একজন এ-গলি ও-গলি থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে হাতির পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকে। শেষ হাটে কিছু কিনতে আশা রাখে। তাদের কেউ কেউ আবার দাঁড়িয়ে পড়ে হাতি ও হাতির পিঠের শিকারকরা জানোয়ারটাকে দেখে নিচ্ছে। এমন অস্পষ্ট আলোয় তা কি ঠাহর হবে?

প্রধান পথই সুরকির রং ধরেছে চোখে, সুরেন ওভারশিয়ারের রাস্তা। এখান থেকেই সার্বভৌমপাড়া শুরু। কাঠুরেপাড়াটা বরং সাহেবপাড়ার পিছনে। নাম সার্বভৌমপাড়া। তার অর্থ এই নয়, এ পাড়ায় একাধিক সার্বভৌম থাকেন। একজনই ছিলেন। তাতেই এই নাম। ব্রাহ্মণপ্রধান পল্লী এখনো।

কিন্তু সবসময় তাও হয় না। যেমন কাঠুরেপাড়াটা খুব পুরনো হলেও সেখানে এখন যারা থাকে তাদের অধিকাংশ রাজকাছারির আমলা। আর সাহেবপাড়া তো এখনো কাগজপত্রে ওঠেনি, মুখেমুখে চলছে। আগে নাম ছিলো গঞ্জ। প্রধান হাট বসতো। সুতার হাট, কাপড়ের হাট। এদিক ওদিকে এখনো কয়েকজন মহাজনের স্থায়ী আড়ত, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওখানে স্কুল-হরদয়ালের। স্কুলের হেডমাস্টার বাগচীসাহেবের বাসা। তা থেকেই সাহেবপাড়া বলছে। এটাও নতুন হওয়ার ঘটনা বইকি।

ইতিমধ্যে রাজবাড়ির দোতলার কোনো কোনো জানলার আলো চোখে পড়ছে। রাজু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলো, কিন্তু সোজা হয়েও বসলো। প্রায় সারাটা দিন কেটেছে হাতির পিঠে, এবার নামতে হবে। আসল কথা, এই অত্যন্ত পুরনো কথাটাকে টানাসুরে ভাবলে সে বদলে যায়, পুরনোকে ধরে রাখা যায় না।

মাহুত বললো–হুঁজুর!

কিছু বলবে?

-হাতি নিয়ে কইবেন বলেছিলেন।

–ও, হ্যাঁ। ওর বাঁ কানটার কথা।

সোভান মাহুত যা বললো– : তিন-চার বছর আগে জয়নাল সেই যে একটু খ্যাপাটে হয়, তখন বাগে আনতে তার উপরে অত্যাচার হয়েছিলো। বাঁকানের নিচে চার-পাঁচ আঙুল চেরা, সে সময়ের বল্লমের চিহ্ন। আর দাঁত দুটোর ডগা গোল নয়, মাপেও ছোটোবড়ো। সেও খ্যাপামির ফল। সে সময়ে একটা দাঁতের আগা বেশ খানিকটা ফেটে গিয়েছিলো। আসাম থেকে লোক আনিয়ে সমান করে কাটিয়ে নিতে হয়েছে। একবার কথা উঠেছিলো দাঁত দুটোয় সোনার রিং পরানো হবে। এখনো কিন্তু খুব ছুটতে পারে জয়নাল।

কারণটা মনে পড়লো রাজুরও। রিং পরানোর কথা হয়েছিলো, পরে কিছু আর করা হয়নি। কে ব্যবহার করবে জয়নালকে? কিছুদিন তার একমাত্র কাজ ছিলো বিলমহলে যাওয়ার জন্য কর্মচারীদের বাহন হওয়া। রাজুই ইদানীং তাকে তুলে এনে নতুন করে কাজে লাগাচ্ছে। এমন শিকারী হাতি হয় না, যদিও কানের ক্ষত চিহ্ন আর মুছবে না, দাঁতের গোল ডগাটা আর ফিরে পাবে না। দ্যাখো, এতদিন পরেও বনের স্মৃতি খেপিয়ে তোলে নাকি?

রাজু বললো–সোভান, হাতিটার গায়ে রং দিতে হয়।

-জী, তাই দেবো।

-পুরনো রং বেশ রগড়ে ঘষে তুলে দিও। রামপিয়ারী বা চন্দনের গায়ে যেমন অবিকল তেমন করো না। নকশাটা ভিন্ন করো। এখন তো জয়নাল আমার কাজেই লাগছে। ও আর। খেপবে না, দেখো। সবকিছু মেনে নেবে।

জী, হুজুর।

একটু পরে আবার বললো– রাজু-পিয়েত্রোর হাতিটার কী অবস্থা, সোভান?

-ওর মাহুতই ওকে দেখে, হুজুর। মাহুত মানে বান্দা, পেত্রার বাবুর্চি।

–সে কী? তার বেতন-তনখা?

–শুনি শেষমেস অনেককে চাকরান দিয়ে গিয়েছে পিয়েত্রো।

–আচ্ছা, সোভান, তোমাদের পিলখানাতে পিয়েত্রোর হাতিটাকে এনে রাখলে হয়।

–তা হয়, হুজুর।

–আমার তো মনে হয়, একা একা প্রাণীরাও বোঝে।

–হাতি তা বুঝবে, হুজুর।

রাজু ভাবলো, হ্যাঁ, কী আর কাজে লাগবে। তার নিজের হাতি তো নয়। কোথায় যেন পথের ধারের ঘাস-ঝোপ থেকে ঝিঁঝি ডেকে উঠলো। ঝিঁঝির ডাকের এই এক কৌতুক, তাতে যেন একটা ইশারা থাকে। যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু যেন টানে, যেন দূরে নিতে চায়। আর তখন মন উদাস হয়।

রাজবাড়ির দরজায় হাতি বসছে, ভিতরে যেতে পারছে না। সদরদরজার কাছেই গোলমাল। ভারা বেঁধে কাজ করছে মিস্ত্রিরা। যদিও আগেরটাই যথেষ্ট সুন্দর এবং উঁচু ছিলো। এখন নাকি বিশ হাত ওপরে, চওড়াতেও বারো হাত আর সেই অনুপাতে কিছু হচ্ছে। রাজু মনে মনে হাসলো। এইসবই সে এবার ফিরে আসার পর দেখছে। ছ মাসের উপর ছিলো না সে। হঠাৎ একদিন স্থির হয়েছিলো। হঠাৎ একদিন বোট ভেসেছিলো তাকে নিয়ে। পাটনা, মুঙ্গের কাশী; এদিকে লক্ষ্ণৌ, দিল্লী, আলমোড়া। লক্ষ্ণৌ রেসিডেন্সি দেখেছে সে। অনেক কবর, গোলাগুলির চিহ্ন অনেক। দিল্লীর ভাঙা প্রাসাদগুলো, ভাঙা দরওয়াজাগুলো। ওহহ, এটাই তো বুলন্দ দরওয়াজার নকল বলছিল সুরেন। মাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, হাতে কাজ নেই বুঝি? পুরনোকে ভেঙে নতুন করছে সব? পুরনোকে ভাঙলে নতুন হওয়া যায় বুঝি? সে আবার মনে মনে হাসলো ।

ভারা থেকে মিস্ত্রি মজুররানামছে। রাজু হাওদা থেকে লক্ষ্য করলো, কয়েকজন কর্মচারী বেরিয়ে আসছে কাজ শেষ করে। তাদের মধ্যে সোনাউল্লা কাজীকে চিনতে পারলো সে। হাতির উপর থেকে সে বললো–আমিনসাহেব, শোনন। আমলারা দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, এখন তটস্থ হলো।

হাতি থেকে নেমে রাজু বললো–হাতির উপরে হরিণ আছে।

সোনাউল্লা বললো–জী মেহেরবান।

–ওটার সদ্গতি করো তোমরা। চামড়াটা শুধু

–জী, রাজবাড়িতে পাঠাবো?

না। একটু হেসে রাজু বললো–শিবমন্দিরের পুরোহিতকে বরং পাঠিয়ে দিও। যদি তার কাজে লাগে। কেউ নাকি অজিন পছন্দ করে।

-বহোৎ খুব, হুজুর।

.

১০.

রাজবাড়িতে মশালচিরা তখনো আলো জ্বালিয়ে ফিরছে। অন্দরে সামনে দরদালানের সিঁড়ির গোড়ায় বেশ ধোঁয়া। ওখানে দাসীরা ধুনুচি ঠিক করছে তাহলে। সব ঘরে ধূপ দেওয়া শেষ করতে পারেনি।

রাজু তার মহলের সিঁড়ির কাছে পৌঁছতেই রূপচাঁদের সঙ্গে দেখা হলো। হাত বাড়িয়ে বন্দুক নিলো সে, গুলির বেল্টও। পিছন পিছন যেতে যেতে সে বললো, মাসি বললেন—

রূপচাঁদ ভয়ে ভয়ে বলছিলো। রাজুও অন্যমনস্ক ছিলো। সে বললো, কে, হৈমী? সে ভাবলো, দ্যাখো পাটনায় যখন তার বোটে এলো তখন কী করুণ অবস্থা! ইতিমধ্যে কিন্তু সামলে নিয়েছে। তার সুখ-সুবিধার বিশেষ ভার নিয়েছে। রূপচাঁদ বললো–আজ্ঞে না, মাসি!

-তোমার মাসি? কে? নয়নতারা? সে কি ফিরেছে?

বললেন তিনি রাজবাড়িতেই আছেন।

কয়েক ধাপ উঠে বললো– রাজু–রূপচাঁদ, স্নানের ব্যবস্থা করো।

-গরম জল তো?

-আ, রূপচাঁদ, এখন আমি বেশ বড়োই হয়েছি। তাছাড়া সাতদিন আগে যে ঠাণ্ডা লেগেছিলোনা না, থাক, গরম জলই দাও স্নানের ঘরে। এখন আর মাকে বিরক্ত করে মত আনতে যেতে হবে না। মা কোথায় রে, রূপচাঁদ?

-জেনে আসি, হুজুর।

না। শেষ কী করতে দেখেছিলে? রাজু হাসলো রূপচাঁদের চালাকিতে।

–আজ্ঞে, রানীমা বোধহয় মহাভারত শুনছিলেন।

–আর তোমার মাসিই পড়ছিলেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ, না–কোনটা ভালো হবে তা ঠাহর করতে পারলো না রূপচাঁদ। মহাভারত পড়ার সব ব্যাপারটাই তার অনুমান।

এক মশালচি দোতলার সিঁড়ির দেয়ালে দেয়ালগিরি জ্বালছে। বেশ খানিকটা কসরত সেটা। এপাশের রেলিং-এ উঠেদাঁড়িয়ে মশালবাঁধা লাঠি দিয়ে দেয়ালগিরির উপরেই যেন ভর রাখতে হয়। যেন একটা পতঙ্গ, মশাল-লাঠিটা যার একটা শুড়ো। আসলে নিশ্চিতই তা নয়। তাহলে দেয়ালগিরির করবী ফুলের মতো চেহারার লাল কাঁচের ডোমটা, যা নাকি পিতলের কয়েক প্যাঁচে মাত্র বসানো খানখান হয়ে ভেঙে পড়তো।

একটু দাঁড়াতে হলো রাজুকে।

 মশালচি আলো জ্বেলে নেমে দাঁড়িয়ে সেলাম করলো।

রাজু নিজের ঘরের দিকে চললো।

এ ঘরের আসবাব খুব কম, কিংবা এমন হতে পারে ঘরখানি বিশেষ বড়ো বলেই তেমন দেখায়। দেয়ালে বসানো আলমারিটা বেশ বড়ো। অপরিচিত লোকের কাছে আর একটা দরজা মনে হবে। শুধু তার পাল্লাগুলোর মেহগ্নি রং দরজার পালিশের চাইতে উজ্জ্বল এবং গভীর। বরং তা রঙের দিক দিয়ে খাট, চেয়ার, দেরাজের ডেক্সটার সঙ্গে মেলে। কিন্তু গাঢ় রং দেখতে গেলে মস্ত পিয়ানোটাকে লক্ষ্যে আনতে হবে যা উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে।

ঘরের মাঝামাঝি থেকে কিছু পিছিয়ে রাজুর খাট। স্বভাবতই তাতে নেটের মশারি এবং দুধে-সাদা চাদর। দেয়াল-আলমারি থেকে কিছু দূরে একটা ছোট র‍্যাক। রূপচাঁদ তাতে বন্দুকটা রাখলো। আরো বন্দুক সেখানে। ডেস্কের সামনে খান দু-তিন চেয়ার। পিয়ানোর সামনে গদিদার টুল। ডেস্কের উপরে হিংকসের বড় টেবল ল্যাম্পটা জ্বালানো হয়নি। ঘরের ঠিক মাঝখানে ছাত থেকে ঝোলানো ঝাড়টাও জ্বলছে না, যদিও দেয়ালের দেয়ালগিরির আলোয় ঝাড়ের ত্রিশিরা কাঁচগুলো ঝিকমিক করছে। ঝাড়টার ঠিক নিচে গালিচা।

ঠিক এই সময়েই সে ব্যাপারটা ঘটলো। একটা হীরা বসানো বাঁটের সোনার কিন্তু তীব্ৰধার তরোয়াল। রাজুর মনের মধ্যে হিংস্র হয়ে উঠলো। যেন প্রতিদ্বন্দ্বীর বুকের রক্তে তার পিপাসা। কিন্তু অবাক, সে রক্ত যেন তার নিজের চোখের জল যার ফলে তার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, কথা রাখোনি।

কিন্তু এখন ঠোঁটকে ফুলতে দেওয়া যায় না। এই কয়েক মাস গঙ্গায় বোটে কাটিয়ে তার ঠোঁটের উপরে সরু কালো গোঁফের রেখা বেশ স্পষ্ট। গালেও ইম্পীরিয়াল দাড়ি।

হেঁটে গিয়ে ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসতে বসতে ডেস্কের উপরে আখরোট কাঠের বারকোশটায় চোখ পড়লো। ধারগুলো কারুকার্য করা। কাঠের অথচ স্বর্ণকারের কাজ মনে হয়। কিন্তু বারকোশে ফলও। রাজু কয়েকটা তুলে মুখে দিলো।

খেতে খেতে জুতো খুলতে গেলো রাজু। রূপচাঁদ তখন হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো। নিচু হয়ে বসে জুতো খুলতে খুলতে বললো–জুতোয় হাত দেবেন, হুজুর, খাচ্ছেন যে।

-তুমি বুঝি হাট থেকে এনেছো? বেশ তো।

না, হুজুর, পিয়েত্রা কুঠির লাঞ্চোর জন্য সফর থেকে এসেছিলো। হৈমীদিদি ছাড়িয়ে হুজুরের ঘরে রাখতে দিলেন।

জুতো খুলে, চটিজোড়া পায়ের কাছে এগিয়ে দিয়ে রূপচাঁদ উঠে দাঁড়ালো। বললো–স্নানের জল তৈরিই থাকবে, দিতে বলি। আর এখন কি খাবারঘরে যাবেন? সারাটা দুপুর না খেয়ে কাটলো হুজুর।

-তাই তো দেখছি। স্নানটাই এখন দরকার।

 ফিতে কষা জুতোমোজা খুলে ঢিলে চটি পরার একটা সুখ আছে। শিরশির করে রক্ত বয়ে যায় যেন আরাম দিয়ে দিয়ে পায়ের আঙুলগুলোতে। রূপচাঁদ চলে গেলে একটু পায়চারি করলো রাজু, বিছানার পাশ দিয়ে গিয়ে ওদিকের গরাদটার একটা জানলা খুললো। এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এলো ঘরে। জানলা দিয়ে বাইরে চেয়েও খানিকটা সময় কাটলো। সে কি কিছু প্রত্যাশা করছে? সে কি জিজ্ঞাসা করবে, এই এক বছর কোথায় থাকলে? কিছু না বলে চলে গেলে কেন?

দরজার কাছে মৃদু শব্দ হলো।

একজন কে ঢুকছে। অল্পবয়সী, মুখটা ভরাভরা, চোখ দুটো বড়ো, ছোটো নাক, তাতে ঝুটা মুক্তার মোলক। চুল টেনে বাঁধা, সম্ভবত বেশি তেল দেওয়ায় আলোয় চকচক করছে। দুহাতে সাদা শাখার বালা। গায়ের উপর দিয়ে টেনে কোমরে এনে জড়ানো রাজবাড়ির থোসা। কাজ করছে বলে হাত দুখানা প্রায় কাঁধ থেকেই আবরণের বাইরে। তার হাতে ধুনুচি, ধোঁয়াচ্ছে। রাজুকে দেখে সে শশব্যস্তে ফিরে যাচ্ছিলো। রাজু বললো–ধূপ দেবে? দাও, আমি স্নানে যাচ্ছি। সে বেরিয়ে গেলো। কেমন ঠকলো সে আবার।

বিধান এই, ঝিরা রাজপরিবারের পুরুষদের সামনে চলতে ভয় পায়। বিধানও এই, যে ঘরে তারা থাকবেন না-ডাকলে সেখানে যাবে না। বিধানটা নতুন। পুরুষ ভৃত্যদের বেলায় এ বিধানটা খানিকটা শিথিল, কারণ তাদের সংবাদ আদানপ্রদান করতে হয়।

ঝিটি এখানে ওখানে ধূপ দিলো ধুনুচি দুলিয়ে। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে তার। সে কি বেআইনী কিছু করে ফেলেছে?

তবু কর্তব্য তো করতে হবে। ডেস্কের কাছে এলো সে ধূপ দিতে দিতে। ডেস্কের চারপাশে তার উপরে দেয়ালের গায়ে ধূপ দিতে দিতে সে যেন সৌন্দর্যে অবাক হয়ে গেলো। বারকোশটা আর বারকোশে সাজানো ফল। ধুনুচি দোলাতে দোলাতে সে সরে গেলো। এখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে পিয়ানোর দিকে ধূপ দেওয়া শেষ হলে। কিন্তু পিয়ানোর দিকে না গিয়ে বরং সে ডেস্কের কাছে সরে এসেই আবার ধুনুচি দোলালো। আর সেই সুযোগে বারকোশ এবং বারকোশের উপরে রাখা ফলগুলোকে আবার দেখলো। ধূপ দেওয়া কি আর হয়নি? দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে এদিক ওদিক দেখলো। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে ধুনুচিটা মেঝেতে রাখলো। বারকোশের উপর থেকে একমুঠো যা উঠলো একবারে তুলে নিয়ে আঁচলে বাঁধলো। আঁচল কোমরে জড়িয়ে ধোসা দিয়ে ঢাকলো। তার মনে হলো এগুলোকেই কাবুলী-মেওয়া বলে। না জানি কী অমর্ত সোয়াদ। কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে না-বেরোতে কিছু যেন তার বুক চেপে ধরলো। রক্ত চলাচলের অভাবে তার হাত-পা বিবশ হয়ে আসছে, মুখ বিবর্ণ।

দুড়দাড় করে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। সেখানে প্রাচীন একজন অন্য ঝিদের দিয়ে এদিক ওদিক ধূপ দেওয়াচ্ছে। প্রাচীনা বললো–কী রে, হাঁপাচ্ছিস কেন?

রাজকুমার ঘরে ছিলেন। তার পেটের কাছে বাঁধা মেওয়াগুলো লোহার দলার মতো ভারী আর শক্ত বোধ হলো।

-তা রাজকুমার ঘরে থাকলে–প্রাচীনা বললো–কিন্তু, আমি কিন্তু দরজার বাইরে পর্যন্ত গিয়েছিলাম তোর সঙ্গে, তাই না?

–ছাই গিয়েছিলে।

এবার প্রাচীনার মুখও বিবর্ণ হলো। সে ভাবতে লাগলো রানীমাকে কি এখনই গিয়ে বলা উচিত, সে যায়নি? বলে কি ক্ষমা পাওয়া যাবে? রানীমার হুকুমই এই নতুন নতুন ঝিয়েরা যখন কাজ করবে পুরনো বিশ্বাসী ঝিয়েরা তখন সঙ্গে থাকবে।

তাদের সে অবস্থায় দেখে কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করে অন্য ঝিয়েরা এগিয়ে আসছিলো কৌতূহলের টানে। প্রাচীনা বেঁজে উঠে বললো–যা-যা, কাজ শেষ কর। আমি কটাকে সামলাই বল। এটাকে বললাম দাঁড়া, তো ওটা একাই ছুটলো রাজকুমারের ঘরের দিকে।

অন্য ঝিয়েরা নিজের গালে হাত দিয়ে এদিক ওদিক মুখ ফেরালো যেন ঘটনাটায় কী না বিস্ময়কর অভাবনীয়তা আছে। কী না গা শিরশির করা ঘটেছে।

নতুন ঝিটি যেন প্রাচীনার এই বিড়ম্বনার পিছনেই নিজের বিবশতাকে আড়াল করতে পারলো। পরামর্শ করার ভঙ্গিতে বললো–তা দিদি, তুমি তো ছিলেই দরজার কাছে! ধোঁয়ার। আমরা ঠাহর করতে পারিনি রাজকুমার ছিলেন ঘরে।

–তাই বল। তুই যে কখন কী ভয় দেখাস না!

কিন্তু তার গা তখনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে একবার ভাবলো, কিন্তু বারকোশটা কী বেশি খালি হয়ে যায়নি! প্রাচীনা তার মুখের দিকে চাইলো আবার। জিজ্ঞাসা করলোতোর শরীরটা কী খারাপ নাকি লো?

-মাথাটা ধরেছে খুব।

-তাহলে বাড়ি যাবি? সেই ভালো। প্রাচীন এই বলে ভাবলো, একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছে। দূরে দূরে থাকে এখন তাই ভালো। সামলে নেওয়ার সময় পাওয়া যাবে। নবীনা ধুনুচি নামিয়ে রেখে বাড়ির দিকে চললো।

রাজবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের সকলের ছুটি একসঙ্গে হয় না। এবং বর্তমানে ঝি বলতে যা বোঝায় সকলেই সে স্তরের ছিলো না। ঝি এবং কন্যায় যে কোথাও কোথাও মিলের আভাস আছে তা তখন এখানে অযুক্তির ছিলো না।

প্রথম পরিচারিকা পথে বেরিয়ে একজন সঙ্গী পেলো। এই দ্বিতীয়ার নাম সুন্দরী বামনি, এবং প্রকৃতপক্ষে তাকে সুন্দরীই বলা যায়। প্রথমার চাইতেও সে কিছু বয়সে বড়। সেজন্যই হয়তো সে সাহসিকা এবং হয়তোবা সেজন্যই তার সৌন্দর্য লোকের চোখে লাগে। টানা চোখ, নাকে ঝুটা পান্নার ফুল, কানে মাকড়ি। সবসময়েই সে পরিচ্ছন্ন কিন্তু অনেকসময়ে যেন ক্লান্ত দেখায় তাকে।

একই রাস্তায় যাবে তারা, আগে সুন্দরীর বাড়ি পড়বে।

খানিকটা দূরে গিয়ে সুন্দরী খুব ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলো–সৌভাগ্য নাকি লো?

 প্রথমা ঝি অবাক হলো। –কিসের? কী সৌভাগ্য দিদি?

রাজকুমারের ঘর থেকে এসে অমন হাঁপাচ্ছিলি।

সুখ? ও? আছি ছি! তুমি একমুঠো ছাই ধরেছো সুন্দরীদি।

দুজনে আর কথা না বলে হাঁটতে লাগলো। সুন্দরীকে যেন বিবর্ণ দেখালো। সুন্দরী বামনির বাড়ি এসে পড়েছিলো। বাড়ির দরজায় তার ফুটফুটে ছেলেটি আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে। বোঝা যায় স্বামীও আছে কাছাকাছি। সুন্দরী তাড়াতাড়ি এগিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। একটু বেশি জোরে।

প্রথমা ঝি ভাবলোনা, তার ছেলে খেতে পারেনা। তার দাঁত ওঠেনি। অন্যান্যেরা প্রায়ই লোভের জিনিস এটা ওটা ছেলেমেয়ের নাম করে চেয়ে নেয়। আটকুড়ি ব্রজবালার কথা সকলেই জানে। স্বামীর অসুখ বলে তো সে রানীমার মঞ্জুরই নিয়ে রেখেছে-মাছটা, দুধটা, ভালো খাবারের একটু বেশি বাড়িতে নিয়ে যাবেই। কিন্তু, না, তার স্বামীকেও সে দিতে পারবে না এই কাবুলী-মেওয়া। স্বামী তাকে কী ভাববে? চোখে জল এসে গেলো তার। না, শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে লুকিয়ে একাই খেতে হবে, এখানে অন্ধকার হলেও ফেলে দেওয়া যায় না। কারো চোখে পড়বে কাল। আর সোয়াদে অর্মত্য।

কিন্তু তা কি পাপ, যা তার মনে আসছে? সুন্দরীর জিভে পাপ আছে। পরিচারিকা বিবাহিতা। সে জানে পুরুষের কামনা কখনো কখনো একটা কোমল স্নিগ্ধ প্রার্থনার মতো। সুকুমার সুবেশ রাজকুমারের যদি তেমন নিঃশব্দ অনুরোধ-পরিচারিকা হাঁপাতে লাগলো। আছি, ছি-ছি, না।

রাজু যখন স্নান করে ফিরলো অন্ধকার গাঢ় হয়েছে বলেই যেন ঘরের দেয়ালগিরিগুলিকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

এখন আলগা জামার উপরে শাল! এখনই স্নান করে এসেছে ঠাণ্ডায়, মুখটা লালচে দেখাচ্ছে দাড়ি সত্ত্বেও। এখন তাকে কি একটু অন্যরকমই দেখায়–আট-দশ মাস আগে যারা দেখেছে তাদের চোখেও আট-দশ মাস আগে কুড়ি ছিল না, এবার কুড়ি পার হলো!

রূপচাঁদ এসে জিজ্ঞাসা করলো ডেস্কের আলোটা জ্বেলে দেবে কিনা?

না। বলে রাজু খাটের দিকে এগিয়ে গেলো। বললো–আর কিছু দরকার নেই এখন।

রূপচাঁদ চলে গেলে সে ভাবলোকিংবা আরও স্পষ্ট করে বলতে হলে তার এই কথাটা মনে হলো–নয়নতারা ফিরেছে। কথাটার আগে এবং পরে যেন আর কিছু নেই।

ডেস্কের সামনে চেয়ার টেনে সে বসলো। যেন তার জাকুটি চিন্তায় কুটিল হবে, কিন্তু সে হাসলো। দু-এক মিনিটেই উঠে গিয়ে পিয়ানোর ডালা খুলে টুলের উপর বসলো। ডানার ভিতর দিকে একটা খাপে স্বরলিপি। কয়েকখানা বার করে কোলের উপর রেখে উল্টেপাল্টে দেখলো। ভাব দেখে মনে হলো কোনোটাই যেন তার পছন্দ হচ্ছে না। অথচ এগুলো তার খুবই পছন্দের জিনিস।

ব্যাপারটা যেন এই রকম : সদ্য স্নানশেষে শরীর থেকে যে সারাদিনটাকে সে সরিয়ে দিতে পেরেছে সেটাই তার বন, রৌদ্র, জনতা, উত্তাপ, ক্লান্তি, মৃত হরিণ, তার ব্যথা সব নিয়ে যেন তার শরীরের বাইরে অথচ মনের সামনে এসে পড়েছে। বাজানো যায় পিয়ানোতে সেই অনুভূতি? এদিকে ওদিকে এ-ঘাট ও-ঘাটে ঘা দিয়ে দিয়ে সে অন্যমনস্কের মতো শব্দঝঙ্কার তুলো, যার সবটুকু তার নিজের কানেও ধরা দিলো কিনা বলা কঠিন।

তারপর সে কিছু ভেবে স্থির করে নিলো। বেশ কিছুদিন আগে নয়নতারা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো, সে বোধ হয় তার কাশীনা কোথায় যাওয়ারও কিছুদিন আগে, সে তখন বাজাচ্ছিলো। হাতে লেখা স্বরলিপির পাতাগুলো আবার কোলের উপরে নামালো সে। উল্টে উল্টে দেখতে দেখতে সেই ঝঙ্কারগুলো যেন স্মৃতিতে ফিরলো, স্কোর শীটটাকে খুঁজে পেলো সে। ডালার খাঁজে সেটিকে বসালো, ডাইনে থেকে বাঁয়ে চেয়ে যেন সবগুলি ঘাট দেখে নিলো এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।

বাজাতে শুরু করলে অবশ্য সমস্ত মনটাই বাজনাতে রাখতে হয়। প্রায় মুখস্থই পাতাখানা, পিয়েত্রো যা বলেছিলো তাও মনে আছে :এদের সম্বন্ধে কখনই অতি সাহস দেখাবে না; তা হেন্ডেল, অথবা বাখ যে-ই হোন। নোটেশন সামনে রাখা চাই।

চারিদিক স্তব্ধ। পিয়ানোর সুর সে স্তব্ধতায় অনেকটা দূর দূর ছড়ায়। কেউ যদি অনুমান করে রাজবাড়ির বাইরে দেওয়ানের কুঠিতে বসে হরদয়াল তা শুনতে পাবে কিংবা পাচ্ছে তাহলে সে অনুমান অন্তত অযুক্তির হবে না।

.

১১.

রূপচাঁদ রাজকুমারের ঘর থেকে বেরিয়ে রানীর মহলের দিকে চললো। ঠিক এখন আর তার কোনো কাজ নেই। তাছাড়া কেউ তাকে কিছু করতেও বলেনি। তবু পায়ে পায়ে সে রানীর ঘরের দিকে এগোলো। চলতে চলতে তার মনে হলো একটা কাজ সে করতে পারে–নয়নঠাকরুনের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে খবর দিতে পারে রাজকুমার শিকার থেকে  নিরাপদে ফিরে এসেছেন।

দুটো অলিন্দ যেখানে মিশেছে সেখানে তাকে থেমে দাঁড়াতে হলো। রানীমার ঘরের থেকে একটা আলোর বৃত্ত দরজার বাইরে এসে পড়েছে। এদিকে পাশে সিঁড়ির উপরে বড়ো হিংকসের লণ্ঠন। সে আলোও একটা বৃত্ত তৈরি করেছে। বৃত্ত দুটি যেখানে পরস্পরকে ছেদ করেছে সেখানে একটু আগে পিছে তিনজোড়া পা লক্ষ্য করলো সে। আলো বড়োজোর হাঁটু পর্যন্ত উজ্জ্বল। উপরের দিকে তিনজনেরই প্রায় একই রকম চাদরমোড়া ঘোমটা-দেওয়া আকৃতি। কিছু যেন রঙের তফাত চাঁদরে-তার কোনটি কাশ্মীরি শাল, কোনটি আলোয়ান তা ধরা যায় না।

রানী বললেন (অনেক দূর থেকেই এই গলা রাজবাড়ির লোকেরা ঠাহর করতে পারে, যদিও তা কখনই উঁচু নয়) নয়ন, ইচ্ছা তো একটা শক্তি, তোমার কী মনে হয় যে অন্যের যা আছে তার উপরে লোভ থেকেই ইচ্ছার জন্ম, আর অন্যের যা আছে তানা-দেখলে লোভ জন্মায় না?

রানীমা বোধ হয় হাসলেন নিঃশব্দে। রূপচাঁদ আন্দাজ করলো, নতুবা নয়নঠাকরুণের হাসি শোনা যেতো না। উঁচু গলার না-হলেও কথায় হাসি জড়িয়ে থাকলে তা বোঝা যায় বৈকি।

-আমি কিন্তু সব ইচ্ছাকেই পরশ্রীকাতরতা বলিনি। তাছাড়া সদরদরজার পুরনো চেহারা ভেঙে নতুন নকশায় যা হচ্ছে তাতে অন্য কারো দরজা দেখে আপনার লোভ এমন নাও। হতে পারে। কবি-কল্পনা বলে কিছু আছে। যদিও দুপুরের লাঞ্চে খাওয়ার যে বর্ণনা শুনলাম। হয়তো একদিন আমাদের সেসব নানাবিধ মদ্য ও খাদ্যে লোভ হতে পারে।

রানী হেসে বললেন–দুষ্টু মেয়ে, তোমার কথায় মনে হবে লোভ যখন অসমর্থ তখন তা পরশ্রীকাতর হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু নয়ন,সত্যি ভেবে দেখো কথাটা কতটা আমাদের সত্যিকারের অভাব আর কতটুকু তা বণিকের তৈরি।

রানীমা, হিংকসের হারিকেন দেখা দেবার আগেও আলোর অভাব ছিলো। তা হয়তো প্রদীপ, মশালে মিটতো। কিন্তু হিংসের হারিকেনে যদি তার চাইতে ভালো মেটে তাহলে বণিককে দোষ দেবো কেন?

রানী বলতে শুরু করলেন–সত্যিকারের অভাবটা হবে সত্যিকারের মানুষটার। তার তেমন চোখ নেই যে প্রদীপ আর লণ্ঠনে তফাত বোঝে। কিন্তু হঠাৎ এক কৌতুকবোধে। তিনি হেসে উঠলেন। বললেন–জানো নয়ন, কায়েতবাড়িতে নাকি নকল পাথুরে তৈজস ব্যবহার হবে। নাকি চীনামাটি বলে। বিলেতে নাকি তৈরি। শুনে নায়েবমশাই খোঁজ করেছিলেন যদি রূপোর কিছু তৈজস দরকার হয়ে থাকে। দূর করো। রূপোর দামেই নাকি সেসব চীনামাটি।

রানীর অন্য সঙ্গিনী বললো–আপনি তো হাসতে হাসতেই মঞ্জুরি দিলেন। -ওটা আমরা আলোচনা করি না,বলে রানী আবার হাসলেন। বললেন আবার–যাকগে, খুব কথা তুলেছে, নয়ন, পারো তো দুএকদিনের মধ্যে আবার এসো। তোমার বিদেশবাসের গল্পই শোনা হয়নি। সাবি, তুমি কি একা পারবেনয়নকে পৌঁছে দিতে। আচ্ছা,না হয় রূপচাঁদকে দ্যাখো। আমরা এখানে দাঁড়াই।

রূপচাঁদ খুক করে কাশলো। সাড়া দিলো, সে এসে পড়েছে। হিংসের লণ্ঠনটা যে নয়নতারাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে তা বোঝা গেলো।

রূপচাঁদ আগে আগে চললো। এই সময়ে কথাটা তার অনুভূতিতে এসেছিলো। একটু পরিবর্তন হয়েছে। আগেও নয়নঠাকরুন ঠাকুরানীদের মতোই ছিলেন। কিন্তু যেন ঘরোয়া, লক্ষ্মীঠাকরুন যেন। আসলে হয়তো এখনো তেমনি মিষ্টি করে হাসেন। কিন্তু চেহারা হাল্কা হলে কী হয় যেন চালির মধ্যে দুর্গা। হয়তো এ কয়েকমাস ছিলেন না বলেই ধরা পড়ছে। কতকটা যেন রানীমার মতো হয়ে উঠতে লেগেছে।

লণ্ঠন হাতে রূপচাঁদ। পিছনে নয়নতারা। নিজের বাড়ির দিকে চলতে চলতে নয়নতারা ভাবলো : অন্যের যা আছে তা দেখে তাকে পেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু এটার অন্য দিক আছে। কাব্য তো সকলেই দেখে, পাঠ করে, কিন্তু সকলেই কি কবি হতে চায়? ইতিহাসের গল্প অনেকেই শোনে, কিন্তু বালক বয়স পার হলে সকলেই কি রাজা হতে চায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *