০২. তখন দরজায় টুকটুক শব্দ হয়

তখন দরজায় টুকটুক শব্দ হয়।

সামনের দরজা দিয়ে ঢেকে দুজন। ওমর আর কায়েস।

এসো, বাবারা।

আয়শা খাতুন দুহাত বাড়ালে ওরা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আকমল হোসেন ওদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। একটু পরে গ্যারেজের পাশের দরজায় শব্দ হয়। ছুটে যায় মারুফ। দরজা খুললে ঢোকে তিনজন। মিজারুল, স্বপন আর ফয়েজ।

এসো, বাবারা।

ওরা আয়শা খাতুনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।

ভালো আছেন, খালাম্মা?

তোমাদের দেখলে ভালো থাকার সাধ বেড়ে যায়। বসো।

মেরিনা ততক্ষণে জগভর্তি পানি আর গ্লাস নিয়ে আসে। ওদের পানি খাওয়া শেষ হলে আকমল হোসেন জিজ্ঞেস করেন, রাস্তা কেমন দেখলে?

এতক্ষণে রাস্তা নীরব হয়ে গেছে।

মানুষজন গেরিলাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

ওমর দুহাত তুলে বলে, আজ একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে।

প্রশ্ন না করে সবাই ওর দিকে তাকায়।

আমি আর কায়েস এক রিকশায় এসেছি। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছে, আপনারা কোথায় যাবেন, ভাইজান? আমি বললাম, হাটখোলায়। ও সঙ্গে সঙ্গে বলল, সে তো আমি জানি। রিকশায় ওঠার সময় বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আপনারা আরও কোথাও যাবেন। জিজ্ঞেস করলাম, এ কথা কেন মনে হলো তোমার? বলল, এমনি মনে হলো। আপনাদের দেখে মনে হলো, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাই। নেবেন আমাকে? বলেছি, আর একদিন। আজকে আমরা মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব। আমাদের তাড়া আছে। ও মৃদু হেসে বলল, আমি জানি, আপনাদের তাড়া আছে। আমরা তো এ বাড়ি থেকে বেশ অনেকখানি দূরে নেমেছি। ওকে ভাড়া দিতে গেলে বলল, যেদিন আবার দেখা হবে সেদিন ভাড়া নেব। আজ থাক। এই বলে ও রিকশা নিয়ে চলে যায়। আমাদের দিকে পেছন ফিরে তাকায় না। ও চোখের আড়ালে চলে গেলে আমরা অন্য গলিতে ঢুকে আবার অন্যদিকে বের হয়ে এই বাড়িতে আসি।

আকমল হোসেন ঠান্ডা মাথায় শান্তস্বরে বলেন, মে গড় ব্লেস ইউ, মাই বয়েজ।

ওদের নিয়ে আমার ঘরে যাই, আব্বা?

হ্যাঁ, যাও। অপারেশন-পরিকল্পনার কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে আমাকে ডেকো।

আপনি তো কালকে আমাদের নিয়ে গাড়ি চালাবেন?

হ্যাঁ, কাল আমিই তোমাদের চালক। এখন তোমরা কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। খাবার টেবিলে বসে তোমাদের অন্য কথা শুনব।

যোদ্ধারা মারুফের পিছু পিছু ওর ঘরে যায়। ওরা সে ঘরে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় আয়শা খাতুনের কণ্ঠে গুনগুন গান। তিনি কাজ করতে করতে গাইছেন, ওই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে–

ছেলেরা বিছানায়-মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। কেউ হাঁটু মুড়িয়ে, কেউ কাত হয়ে। কেউ দেয়ালে ঠেস দিয়ে। তখন প্রশ্নটি ওমরকে করে মারুফ। প্রশ্নটি এতক্ষণ ওর বুকের ভেতর খচখচ করছিল। বলে, রিকশাওয়ালার কথায় তোর কী মনে হয়েছে, মারুফ?

ওমর নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। এত সহজে সাধারণ মানুষের কাছে ধরা পড়া উচিত নয়। আমরা সাধারণ মানুষের ছায়ায় মিশে থাকব, কিন্তু কেউ আমাদের চিনতে পারবে না।

স্বপন সোজা হয়ে বসে বলে, হ্যাঁ, আমারও তা-ই মনে হয়েছে। ওরা এত তাড়াতাড়ি আমাদের চিনবে কেন? কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের বড় ধরনের বোকামি হয়েছে।

মিজারুলও তা-ই বলে, আমিও তা-ই ভেবেছি। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে খালেদ মোশাররফ বলেন, গেরিলাযুদ্ধ কাউবয় অ্যাডভেঞ্চার নয়।

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ে।

ঠিক।

আমাদের উত্তেজনা কমাতে হবে। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।

বাইরে থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসে। সঙ্গে প্রবল আর্তচিৎকার। ওরা পরস্পরের হাত চেপে ধরে। মেরিনা হাতে ট্রে-ভর্তি চায়ের কাপ আর স্যান্ডউইচ নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। পেছন থেকে আকমল হোসেন হাত বাড়িয়ে বাতির সুইচ অফ করে দেন। অন্য ঘরের বাতিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ড়ুবে যায়। সবাই স্তব্ধ হয়ে কান পেতে আর্তচিৎকার শোনে। কিছুক্ষণের মধ্যে চিকার থেমে যায়। রাস্তায় আর্মির গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ হয়। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। শুধু আকমল হোসেন ঘড়ঘড়ে গলায় বলেন, আল্লাহ মালুম, কয়জন গেল!

মেরিনা পাশে দাঁড়িয়ে বলে, একজনের বেশি, আব্বা। চিক্কার একজনের ছিল না।

আমারও তা-ই মনে হয়েছে, মা। চিৎকার কয়েকজনের ছিল।

গেরিলাদের কেউ একজন বলে, প্রতিশোধ।

ওরা একসঙ্গে বলে, মৃত্যুর বদলে মৃত্যু চাই।

মেরিনা ঘরের মধ্যে এক পা বাড়িয়ে বলে, ভাইয়া, তোমাদের চা।

দে। মারুফ উঠে ট্রেটা নেয়। তোমরা স্যান্ডউইচ খাও। আমি পানি আনছি।

মেরিনা বাবার হাত ধরে।

আব্বা, আপনাকে চা দেব?

হ্যাঁ, দে মা। আমি ডাইনিং টেবিলে আসছি। তোর মা কই? সাড়া পাচ্ছি না যে?

বুঝতে পারছি, গুলির শব্দ শুনে মা গান থামিয়েছেন।

তোর মাকে গুনগুন করতে বল। গুলির বিপরীতে গান তো গাইতে হবে। গুলি মৃত্যু হলে গান জীবন।

আপনার কথা খুব কঠিন, আব্বা। আপনি নিজে মাকে গুনগুন করতে বলেন।

আকমল হোসেন হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখেন। আয়শা খাতুন তখন রান্নাঘরে বসে প্রতি ঘরের জন্য একটি করে মোমবাতি জ্বালান। মোমবাতির মৃদু আলো দেবদূতের উড়ে আসার কথা মনে করিয়ে দেয়। আয়শা খাতুন প্রতিটি মোমের শিখার দিকে তাকিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করার মতো করে বলেন, আজ বোধ হয় আমার জন্মদিন। কোন তারিখে আমার জন্ম হয়েছিল, আমার মা তা আমাকে বলতে পারেননি। আমি তো নিজে নিজে একটা দিন ভাবতেই পারি।

আকমল হোসেন দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাকেন, আয়শা।

বলল, শুনছি। কয়জন চিৎকার করেছে বলে তোমার মনে হয়?

তিন থেকে পাঁচজন।

আমার মনে হয় ওরা তিনজনই ছিল।

কাল সকালে হয়তো আমরা লাশগুলো পাব।

হাসপাতালে নিয়ে যাবে, নাকি কবরস্থানে?

সরাসরি কবরস্থানে যাওয়া তো উচিত। গাড়ি চলাচলের জন্য ওরা রাস্তা পরিষ্কারও করতে পারে।

হ্যাঁ, সে জন্য ওরা হয়তো লাশগুলো নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে মাটিচাপা দিতে পারে। দাফন করবে না।

ওরা কারা হতে পারে? সাধারণ মানুষ, নাকি গেরিলা।

আকমল হোসেন দুপা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, আমি জানি না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলেন, এই শহরে যারা শত্রুপক্ষের সঙ্গে মিশে যায়নি, তাদের সবাই গেরিলা—যোদ্ধা কিংবা সহযোগী। শহরের সব মানুষের চরিত্র এখন এমন।

আয়শা খাতুন তীব্র দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকান। আকমল হোসেন থমকে গিয়ে ভাবেন, আয়শা খাতুন এই মুহূর্তে এমন অচেনা কেন?

মেরিনা পাশে এসে দাঁড়ায়।

আপনাদের কী হয়েছে?

ওদের পানি দিয়েছিস?

দিয়েছি। ওরা এক জগ পানি শেষ করে আরেক জগ পানি চেয়েছে। আমি দেখেছি পাঁচজনই দুই গ্লাসের বেশি পানি খেয়েছে।

খেতেই পারে। তাই বলে ওরা ক্লান্ত নয়।

আমি ওদের ক্লান্ত বলিনি, মা।

তৃষ্ণার্ত বলতে চেয়েছ?

আমি জানি না, আমি কী বোঝাতে চেয়েছিলাম। আমি শুধু আমার দেখার কথা বলেছিলাম। ঠিক আছে, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি।

মায়ের কাছ থেকে একটি মোমবাতি উঠিয়ে নিয়ে মেরিনা নিজের ঘরে যায়। বাবা-মা দুজনের কেউই আর কথা বলেন না। শুধু মারুফের ঘর থেকে পাঁচজন যোদ্ধার নানা কথা ভেসে আসছে। তার অনেক কিছুই বোঝা যায় না। মেরিনা নিঃশব্দে নিজের ঘরের দরজা ভেজিয়ে দেয়। এই একলা ঘরে বাইরের পৃথিবী ওর কাছে নিবিড় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্রী ও। অনার্স শেষ করেছে। মাস্টার্স পরীক্ষা হয়নি। এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। গেরিলাবাহিনীর যুদ্ধ। পড়ার টেবিলের ওপর মোমবাতি রেখে চেয়ার টেনে বসে। খাতা-বই উল্টায়। এলোমেলো করে রেখে দেয়। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের একটি বাক্য সাদা কাগজে লিখতে থাকে—দ্য সান ইজ নিউ এভরি ডে। বাক্যটি বারবার লিখে, কাটে। ওই বাক্যের ওপর ফুলপাখি আঁকে। পতাকা আঁকে। বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকে। ছবি আঁকার সহজাত ব্যাপার আছে ওর ভেতর। পড়তে চেয়েছিল আর্ট কলেজে। পরে সিদ্ধান্ত বদলায়। ভাবে, এই বাক্যটিতে সুর দিলে গান হবে—সান ইজ নিউ এভরি ডে-ও গুনগুন করার চেষ্টা করে। ভালো লাগে না। খাতা বন্ধ করে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখে। ভাবে, সূর্য তো প্রতিদিন নতুন করে ওঠে। এই আমিও নতুন সূর্য দেখি। কারণ, আমি কখনো এক রকমভাবে সূর্য দেখি না। সূর্য ওঠার বৈচিত্র্য আছে। প্রতিদিন সূর্য ওঠে, আমরা সবাই এমন কথা বলেই থাকি, ভাবি না যে এই ওঠা দেখার মধ্যে মানুষের ভাবনার সূত্র থাকে। এই ভাবনার মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের দিন গোনে। এখন এই শহরের মানুষ দিন গুনছে। প্রতিদিন নতুন সূর্য দেখছে। একদিন এই দেশের মানুষের কাছে সূর্যটা আকাশ ভরে উঠবে। পূর্ব-পশ্চিমউত্তর-দক্ষিণ—আকাশের সবটুকু জুড়ে উঠবে। সে জন্যই তো এই বাড়িটা এখন একটা দুর্গ। এখান থেকে নতুন সূর্য দেখার যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। শহরের অনেক বাড়ি এমন দুর্গ হয়েছে।

মেরিনা দুহাতে মুখ ঢাকে।

দরজা ফাঁক করে ঢোকে মন্টুর মা।

আপা।

মেরিনা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।

কী বলবেন? মা ডাকছে।

হ্যাঁ। আসেন। তারপর দুপা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে বলে, ভাইজানরা কোথায় যুদ্ধ করবে?

ঢাকায়। এই শহরের একটি এলাকায় ওরা অপারেশন চালাবে।

এত ছোট জায়গায় যুদ্ধ হয়?

হয় খালা, হয়। আবার দেশের সীমান্তে বড় আকারের যুদ্ধ হয়।

কী যে দিন শুরু হলো। আমার এখন গেরামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য মন পোড়ে। আমি বেশি দিন থাকব না। অল্প কয়েক দিন থেকেই চলে আসব।

বাড়িতে তো আপনার কেউ নাই। যেতে হবে কেন?

আমি চাই, আমার মরণ দেশের বাড়িতে হোক। গ্রামের মাটি আমার আসল জায়গা। ওই মাটির নিচে শুয়ে থাকতে চাই। ঢাকা শহরে আমি কবর চাই না।

পাগল, এখনই এসব কথা ভাবতে হবে না। স্বাধীনতা দেখার আগে মরার কথা ভাববেন না। আপনি না বলেন, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে।

বলি তো। ছোটবেলা থেকে তো এমনই শিখেছি।

তাহলে ভাবাভাবির কিছু নেই। মৃত্যু যখন হওয়ার হবে। চলেন, ভাত খেতে যাই।

মন্টুর মা অকারণে হাসে। কাপড় টেনে মাথা ঢাকে। দুহাত গালে ঘষতে ঘষতে বলে, এশার নামাজ পড়ার সময় আল্লাহরে বলি, আল্লাহ মাবুদ, আজ রাত পোহালে এক দিনের আয়ু পাব। না পোহালে। কথা শেষ করে না মন্টুর মা। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।

 

ডাইনিং টেবিল সরগরম হয়ে উঠেছে। নিচুস্বরে কথা হলেও গমগম করে ঘর। তিনটে অতিরিক্ত চেয়ার দিয়ে সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। মারুফ আর মেরিনা নিজেদের প্লেট হাতে তুলে নিয়েছে। ঘরে আলো জ্বালানো হয়েছে। আলো জ্বলছে শুধু রান্নাঘর আর ডাইনিংরুমে।

খেতে খেতে কায়েস উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, আমাদের জন্য এতকিছু রান্না করেছেন, খালাম্মা?

আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, তোদের মন ভরলে আমি খুশি।

আকমল হোসেন এক গ্রাস ভাত মুখে পুরে বলেন, যুদ্ধের সময় সব খাবারই সমানভাবে খেতে হয়।

মিজারুল দ্রুতকণ্ঠে বলে, আমরা সেভাবেই খাই, খালুজান। মেলাঘরের ক্যাম্পে বুটের ডাল আর রুটি খেতে আমাদের একটুও খারাপ লাগে না। বাড়িতে এলে মায়েদের ভালোবাসার রান্না আমাদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। তবে না পেলে ক্ষতি নাই।

আকমল হোসেন শান্ত কণ্ঠে বলেন, বুঝেছি, তোমরা রিয়াল ফাইটার। তোমাদের মেলাঘরের খবর কী? শুনতে পাচ্ছি, শহরের শত শত ছেলে গিয়ে ওখানে জড়ো হয়েছে।

একদম ঠিক, খালুজান। আমাদের মতো ছেলেরা যুদ্ধ করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। ঢাকা থেকে ত্রিপুরা বর্ডার কাছে। তাই পার হওয়া সহজ। ওখানে আছেন দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ। তিনি রেগুলার আর্মির পাশাপাশি গেরিলাবাহিনী গড়ে তুলে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন।

সে আমি বুঝতে পেরেছি। নিশ্চয়ই তিনি একটি সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করেছেন।

হ্যাঁ, করেছেন। আমাদের ট্রেনিং দেওয়ার পরে ঠিক হয়েছে এই স্কোয়াডের ১৬ জনের একটি দলকে ঢাকায় পাঠানো হবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এসেছি। আমাদের প্রত্যেককে চারটি করে গ্রেনেড আর ২০ পাউন্ড বিস্ফোরক দেওয়া হয়েছে।

আরও লাগবে। অস্ত্র, গোলাবারুদ—

সব পাব, খালুজান। আস্তে আস্তে আসবে।

তোমাদের এখনকার কাজ শহরটাকে চাঙা করে তোলা। রেগুলার আর্মির পাশাপাশি গেরিলাবাহিনী। সঙ্গে সাধারণ মানুষ। গেরিলারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছায়ার মতো মিশে থাকবে।

ঠিক বলেছেন, খালুজান।

গেরিলাদের কণ্ঠে উৎসাহের ধ্বনি।

মেলাঘরে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন ক্যাপ্টেন হায়দার। ক্যাম্প ভিজিটে এসে তিনি তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে আমাদের চাঙা করে তুলেছিলেন। বলেছিলেন, কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না। চায় রক্তস্নাত শহীদ।

আয়শা খাতুন খানিকটা অস্বস্তির কণ্ঠে বলেন, এসব কথা থাক, বাবারা। তোমরা ভাত খাও।

আমরা পেট পুরে খাব, খালাম্মা। আপনি একটুও ভাববেন না। আপনারা আছেন বলেই তো আমরা যুদ্ধের মায়ায় নিজেদের ভরাতে পারি।

আমরা ঢাকা শহরে আতঙ্ক তৈরি করব। আমরা হলাম ক্র্যাক প্লাটুন।

আকমল হোসেন শব্দ করে হাসেন। হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিয়ে এক চুমুক পানি খেয়ে বলেন, আমি তো জানি তোমাদের কাজ হবে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। ওদের বুঝিয়ে দেওয়া যে ওরা যা করছে, সেটা সহজে মেনে নেবে না বাঙালিরা।

ঠিক, খালুজান। ওদের আমরা ব্যতিব্যস্ত করে রাখব। একদিকে গ্রেনেড ফাটা সামলাতে সামলাতে ওরা দেখবে ওদের পেছনে আরেকটি ফেটেছে। ওটা সামলে ওঠার আগেই আরেকটি ফাটবে। আমাদের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এমনই বলেন।

তিনি আরও বলেন, বিদেশি সাংবাদিক এবং ডোনারদের বোঝাতে হবে যে পাকিস্তান সরকার যে শান্ত পরিস্থিতির কথা প্রচার করছে, পূর্ব পাকিস্তানে সেই পরিস্থিতি নেই। বীর বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীর নাকের ডগায় গেরিলা অপারেশন চালাচ্ছে।

বুঝেছি, তোমরা কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়েছ। আমার বুকের ছাতি দশ হাত বেড়ে গেল, বাবারা।

এটুকু বলে আকমল হোসেন আবার পানি খান। বলেন, আমার বাড়িতে একটা দুর্গ গড়ে তোলা আজকে সার্থক মনে হচ্ছে। আমার ছেলে যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, সেদিন আমাকে আর ওর মাকে কিছু বলে যায়নি। শুধু মেরিনা জানত। দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই ও বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে এক টুকরো পাউরুটি আর সেদ্ধ ডিম খেয়েছে। মেরিনা চা দিলে বলেছিল, খাব না। যেতে হবে। অন্যরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তুই বাবা-মাকে দেখে রাখিস। মেরিনার কাছ থেকে এটুকু শুনে আমি ভেবেছিলাম, মেয়েটি আমাকে রূপকথার গল্প বলছে। সেদিন ওর মা খুব কেঁদেছিল। আমি বেকুব বনেছিলাম। কাঁদতে পারিনি। শুধু নিজেকে বুঝিয়েছি যে এটাই বাস্তব। এমনই তো হওয়া উচিত। আজ তোমাদের পেয়ে আমার মনে হচ্ছে, তোমরা সোনার কাঠি, রুপার কাঠি এনেছ। আর ঘুমানোর সময় নেই। আকমল হোসেন থামলে যোদ্ধারা তার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে। আয়শা খাতুন আবার বলেন, তোমরা খাও, বাবারা।

কিন্তু কেউই চোখ নামাতে পারে না। ভাতের গ্রাসও মুখে তোলে না। ওদের মনে হয়, আকমল হোসেন আরও কিছু বলবেন। তখন তিনি বলেন, যেদিন ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করল, সেদিন থেকেই আমরা যুদ্ধে ঢুকে পড়ি। এ নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। আমি ধরে নিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু আমাদের এ পথেই পরিচালনা করবেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর আমরা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরিতে যুক্ত হই। এখন আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। সীমান্তে হবে সরাসরি যুদ্ধ। আর গেরিলা অপারেশন হবে সরাসরি যুদ্ধের নেপথ্য ক্ষেত্র। শহীদ এবং স্বাধীনতা শব্দ দুটোকে আমরা এক সুতায় গেঁথে গলায় পরেছি।

তিনি থামলে ছেলেরা একসঙ্গে বলে, ঠিক। ঠিক, খালুজান। আপনি আমাদের দোয়া করবেন।

ওরা ভাতের থালার ওপর ঝুঁকে পড়ে। খেতে শুরু করে। অন্যদিকে তাকায় না। আয়শা খাতুন ওদের প্লেটে এটা-ওটা তুলে দেন। ওরা আপত্তি করে না। খাওয়া শেষে মেরিনা যখন কাউন চালের পায়েস নিয়ে আসে, তখন মিজারুল মৃদুস্বরে বলে, আমরা কি পারব?

মেরিনাও ফিসফিসিয়ে বলে, পারতে হবে। যুদ্ধের সময় পারব না কথা কেউ শুনতে চাইবে না।

আরে বাবা, ফিলসফারের মতো কথা বলছ।

চুপ করেন, মা শুনবে।

খালাম্মা রান্নাঘরে, খালুজান হাত ধুতে গেছেন। বাকি আমরা সবাই শুনেছি।

তখন আকমল হোসেনের চপ্পলের শব্দ পেয়ে ওরা সোজা হয়ে বসে। আকমল হোসেন ডাইনিং টেবিলের দিকে আসতে আসতে বলেন, তোমাদের সঙ্গে আরেকটু সময় কাটাতে চাই, বাবারা। তোমাদের এখনো পায়েস খাওয়া হয়নি দেখে আমি খুশি। পায়েস খেতে খেতে যেটুকু সময় তোমাদের কাছ থেকে পাব, এটাও আমার বড় পাওয়া।

মেরিনা বাবার সামনে পায়েসের বাটি রেখে বলে, মায়ের রান্নাটা তাহলে আপনারই বেশি কাজে লাগল। তাই না, আব্বা?

নাহ্, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পারা যায় না। সময়মতো দিল আমাকে ঘায়েল করে।

মেরিনা হাসতে শুরু করলে আকমল হোসেন নিজেও ওর পিঠ চাপড়ে হাসতে শুরু করেন। পায়েসের বাটি টেনে নিয়ে মুখে এক চামচ দিয়ে বলেন, এই বিষয়টি তোমাদের আমি পরে বলব।

ছেলেরা শোনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে না। যার যার সামনে রাখা পায়েসের বাটি থেকে খেতে শুরু করে। প্রত্যেকের মনে হয় আজ এক অন্য রকম পায়েস খাওয়া হচ্ছে। মেরিনার কাছে আরেকটু চাওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না।

আকমল হোসেন পায়েস শেষ করে বাটিটা সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলেন, দশ দিনের সফরসূচি নিয়ে বিশ্বব্যাংক এখন ঢাকায়। প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান ঢাকায়। তিনি জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর রিফিউজিজ। তারা ঢাকার পরিস্থিতি বুঝতে এসেছে। পাকিস্তান সরকার তাদের বোঝাতে পারছে না যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে, তা কেবল কিছুসংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ মাত্র।

ছেলেরা উদ্গ্রীব হয়ে শোনে। কারও মুখে কথা নেই। স্বপন বলে, আমরা এতকিছু জানি না।

তোমাদের জানার জন্য বলছি, বাবারা। পাকিস্তান সরকার এদের বোঝাতে চাইছে যে বিদ্রোহীদের দমন করার পর আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। সশস্ত্র সেনাবাহিনী রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজে প্রাদেশিক সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় অনবরত প্রচারের পরও পাকিস্তান সরকার তাদের চোখে ধুলো দিতে পারছে না।

কায়েস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করা তো কঠিন, খালুজান। সীমান্তের ওপারে থেকেও আমরা ছিটেফোঁটা খবর পাচ্ছিলাম।

আপনার কাছে আমরা আরও শুনতে চাই, খালুজান। এসব জানা থাকলে আমাদের অপারেশন পরিকল্পনা করতে সুবিধা হবে।

বাদল কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজিত কায়েসকে হাত টেনে চেয়ারে বসায়। অন্য ছেলেরা উসখুস করে। যড়যন্ত্রের সুতা ছিঁড়তে চায়। ওদের চেহারা কাঠিন্যে ঢেকে যায়। ওরা বুঝতে পারে, এই সময়কে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি। তখন আকমল হোসেন বলতে শুরু করেন আবার, এখনকার সংবাদপত্র আমাদের সবকিছু সরাসরি বলে না। খবরের ভেতর থেকে আমাদের না-বলা খবর বুঝে নিতে হয়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এইড-টু পাকিস্তান কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান পিটার কারগিল তার সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় কেন, জানো? ওরা এসেছে নানা কিছু যাচাই করতে। যেমন পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের যাচাই, মে-জুন মাসের কিস্তি তিন কোটি ডলার শোধ দেওয়া এখন সম্ভব নয় বলে ছয় মাস সময় চেয়ে পাকিস্তান সরকারের আবেদন, এমন কিছু বিষয়। আবার জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে সাহায্য দেওয়া হবে, তা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। পাকিস্তান সরকার এই সিদ্ধান্তে রাজি নয়। তারা বিবৃতি দিয়েছে যে এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে গোলযোগের কারণে যেসব পাকিস্তানি বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতিকারীদের হুমকির মুখে সীমান্তের অপর পারে চলে গেছে, তাদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করবে। এ জন্য ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার বিভিন্ন পথে অভ্যর্থনাকেন্দ্র খোলা হবে। এসব বিষয় দেখার জন্য এসেছেন প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান।

খালুজান, এরা সবাই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আছে। তাই আমাদের লক্ষ্য এদের নাকের ডগায় গ্রেনেড ফাটানো। ওরা যেন বুঝতে পারে, পরিস্থিতি মোটেই শান্ত নয়।

ঠিক। এভাবে রেগুলার আর্মির পাশাপাশি চাই গেরিলাবাহিনী। আমিও তোমাদের সঙ্গী একজন গেরিলা।

ওরা চেয়ার ছেড়ে উঠে আকমল হোসেনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।

আব্বা, আমি পারলে আপনাকে মেলাঘর ক্যাম্পে নিয়ে যেতাম।

তুমি যখন কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গেলে তখন ভাবিনি যে বুড়ো বাবাও যেতে পারত। তারও সাহস আছে, যুদ্ধ করার শক্তি আছে।

মিজারুল দুহাত নেড়ে বলে, আপনি গেলে ঢাকা শহরের এই দুর্গ আমরা কীভাবে পেতাম।

ওমর আকমল হোসেনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, খালুজান, আমাদের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বলেন, ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমার প্রচুর ছেলের দরকার। আমি যে কয়জন ছেলে পেয়েছি তা আমার জন্য যথেষ্ট নয়, তোমরা যে যত পারো ছেলেদের নিয়ে আসবে। আমি দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে গ্রহণ করব। প্রশিক্ষণ দেব। আপনি গেলে তিনি আপনাকেও ট্রেনিং দিতেন।

আকমল হোসেন হেসে বলেন, আপাতত আমি তোমাদের গাড়িচালক। তোমাদের প্রথম অপারেশনে আমি যে থাকতে পারছি, এটাই আমার ভাগ্য। আমরা অবশ্যই বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব।

ইনশা আল্লাহ। ছেলেরা চেঁচিয়ে বলে, স্বাধীনতার লাল সূর্য আমরা ছিনিয়ে আনব।

কাছে এসে দাঁড়ান আয়শা খাতুন আর মেরিনা।

হইচই বেশি হচ্ছে, বাবারা।

আমাদের কণ্ঠস্বর বাইরে যাবে না, খালাম্মা। পারলে তো আমরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতাম। এখন তো পারছি না। আপনি আমাদের কাছে বসেন, খালাম্মা।

মারুফ হাততালি দিয়ে বলে, বাবার মতো মা-ও আমাদের গেরিলাসহযোগী।

তোমরা কেউ বললে না, ভাইয়া, আমিও গেরিলা।

মিজারুল দুহাত তুলে বলে, তোমার কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা তো জানি, তুমি আমাদের সঙ্গে আছ।

মেরিনা মায়ের ঘাড়ে মুখ রাখে। রান্নাঘর ছাড়া বাড়ির কোথাও আর বাতি জ্বলে না। রান্নাঘরের আলোয় ডাইনিংরুমে আলো-আঁধারি তৈরি হয়েছে, যেন আজ জ্যোৎস্না রাত। সবাই গেছে বনে। আয়শা খাতুনের বুক ধড়ফড় করে। একসময় মন্টুর মা রান্নাঘরের বাতি বন্ধ করে দেয়। টিমটিম করে মোমবাতির শিখা। তখন গুনগুন করে আয়শা খাতুন

ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা…।

আস্তে আস্তে গুনগুন ধ্বনি বাড়তে থাকে। ছড়াতে থাকে ঘরে। ঘর থেকে বাইরে যায়। শহর নীরব। হঠাৎ দু-একটা আর্মির গাড়ি শাই করে চলে যায়। রাস্তায় কুকুর ডাকে না। শহরজুড়ে জেগে থাকে গেরিলাদের পায়ের শব্দ। ওরা চারদিক তোলপাড় করে আসছে। ঘিরে ধরছে শহর।

একসময় গান থামে।

আয়শা খাতুন আস্তে করে বলেন, ঘুমোত যাও, বাবারা। শরীর ঠিক রাখো। কাল তোমাদের অনেক কাজ।

ছেলেরা উঠে এসে আয়শা খাতুনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।

দোয়া করবেন, খালাম্মা। এই মুহূর্তে আমাদের মা কাছে নেই। আপনি আমাদের মা।

মায়ের দোয়া ছাড়া ছেলেরা যুদ্ধে যাবে কী করে?

আয়শা খাতুন ওদের মাথায় হাত রাখেন। কারও কারও মাথার ওপর ঝরে পড়ে মায়ের চোখের পানি। সবার বুকের মধ্যে ধ্বনিত হয় একটি তারিখ। কাল ৯ জুন। ঢাকা শহরে গেরিলাদের প্রথম অপারেশন শুরু হবে। আয়শা খাতুন সবার মাথা কাছাকাছি টেনে ওদের মাথার ওপর হাত রেখে বলেন, জয় বাংলা।

ঘরের ভেতর জয় বাংলা ধ্বনি গমগম করে। সবাই মিলে বলতে থাকে। মন্টুর মা-ও সবার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, জয় বাংলা।

কেউ ঘড়ি দেখেনি। রাতের কোন প্রহর সেটা, কেউ জানে না। জানতেও চায় না। সবাই জানে, এখন ঘুমাতে যেতে হবে। কেটে যাবে রাত। ওদের সবার জীবনে আরেকটি নতুন সূর্য উঠবে।

 

সবার আগে ঘুম ভাঙে আকমল হোসেনের। দিনের প্রথম আলো দেখা তাঁর প্রিয় অভ্যাস। আগে রমনা পার্কে হাঁটতে যেতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আর যান না। নিরাপদ বোধ করেন না একদিকে, অন্যদিকে ভাবেন, তাঁর জীবনে একাত্তর অন্য রকম সময়। এই সময়কে অন্যভাবে সাজাতে হবে। নিজের বাড়িকে দুর্গ বানাতে হবে। গেরিলাযুদ্ধ নয়তো সীমান্তের রণক্ষেত্র। একটা জায়গা তো বেছে নিতেই হবে। নিজেকে যুদ্ধের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে না-পারা দেশ ও জাতির সঙ্গে বেইমানি করা। এমন একটি ভাবনা তিনি নিজের মধ্যে সক্রিয় রাখেন।

সকাল দশটার দিকে ওমর, কায়েস, মারুফ, স্বপন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের চারপাশ রেকি করতে যায়। আকমল হোসেন দুজনকে শাহবাগে নামিয়ে দেন। অপর তিনজনকে মিন্টো রোডের দিকে বড় নাগলিঙ্গম ফুল গাছের কাছে নামিয়ে দেন। মিজারুল তার সঙ্গে থাকে। রমনা থানার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার কোনায় তারা অপেক্ষা করবেন। বিভিন্ন সময়ে ঘোরাঘুরি করে জায়গা বদল করে আবার আগের জায়গায় ফিরে এসে দাঁড়াবেন। বারোটার মধ্যে যে যার মতো ফিরে আসবে।

পরিকল্পনামাফিক কাজ হয়। ছেলেরা নেমে যায়। মিজারুল পেছনের সিটে বসে আছে। আকমল হোসেন ঘাড় না ঘুরিয়ে বলেন, তোমার কী মনে হলো, মিজারুল?

সন্ধ্যায় ওদের আমরা গেটের আশপাশে নামাতে পারব, খালুজান। হোটেলের গেটের পাহারা তেমন জোরদার নয়। তেমন কোনো অসুবিধা হবে বলে আমার মনে হয় না।

আমিও তা-ই মনে করছি। এবার তো তোমরা শুধু আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য গ্রেনেড ছুড়বে। ওরা হকচকিয়ে যাবে। তারপর পরিস্থিতি বুঝতে বুঝতে তোমরা সরে পড়বে।

মিজারুল আবার বলে, খালুজান, আপনি এখন কোথাও না দাঁড়িয়ে কাকরাইল হয়ে প্রেসক্লাবের দিকে চলে যান। তারপর শাহবাগ হয়ে আমরা আবার এদিকে আসব। ততক্ষণে ওরা ফিরে আসতে পারবে। আপনি কী বলেন?

হ্যাঁ, তুমি যা বলছ তা-ই করি।

গাড়ি ঘুরে রমনা থানা পার হয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই যে যেদিকে আড়ালে ছিল সেদিক থেকে বের হয়ে গাড়িতে এসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট অন করে রাখা গাড়ি ছেড়ে দেন আকমল হোসেন। গাড়িতে ওরা হইচই করে। খানিকটুকু উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, মনে হয় না কাজটা কঠিন হবে।

আমাদের সময়ও ঠিক আছে। উপযুক্ত সময় বলতেই হবে।

মারুফ বলে, ঠিক করেছি, গেটের পাশের দেয়াল টপকে আমি হোটেলের ভেতরে ঢুকে যাব।

তোমরা এখন থামো। চুপচাপ বসে থাকো। বাড়ি গিয়ে বাকি পরিকল্পনা হবে।

ছেলেরা কথা থামায়। পরস্পরের হাত চেপে ধরে। ওদের ভেতরে প্রবল উত্তেজনা টগবগ করে। ওরা বুঝতে পারে, স্বাধীনতার পক্ষে একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষে জীবনের ঝুঁকির সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত। আর সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হওয়া মানেই এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। ওদের গেরিলা অপারেশনের সবগুলো কার্যকর করা হলে সাধারণ মানুষ বুঝবে কেমন করে সবাই এক হচ্ছে লক্ষ্যের দিকে। প্রবাসী সরকার বুঝবে যে ওরা পারছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঢাকা শহরকে জাগিয়ে রাখতে। আমাদের গেরিলাযোদ্ধারা-গেরিলা হো-হো-হো…। সুরের মতো বাজে শব্দের বাঁশি। আকমল হোসেন ভাবেন, আয়শা খাতুন গুনগুন করছেন। সেই গানের শব্দ এখন এই গাড়ির ভেতরে। মেরিনা গ্রেনেডগুলো পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখছে। সন্ধ্যায় এগুলো নিয়ে বের হবে গেরিলারা।

আর কয়েক ঘণ্টা পর সূচিত হবে একটি মাহেন্দ্রক্ষণ।

গাড়ি এসে থামে বাড়ির সামনে। গাড়ির পাশাপাশি দৌড়ে এসে আলতাফ গ্যারেজ খুলে দেয়। গ্যারেজে ঢোকানোর আগে গাড়ি থামান আকমল হোসেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের বলেন, নামো।

ওরা এক লাফে নেমে দুই লাফে বারান্দায় ওঠে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মেরিনা। হেসে বলে, সবাইকে বেশ উফুল্ল দেখাচ্ছে। বলব কি, ব্রাভো, গেরিলা ফাইটার।

মিজারুল থমকে দাঁড়িয়ে বলে, বলতে পারো। আস্তে করে বলো। তোমার গলা যেন রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে না যায়।

এই সাহস হারালে চলবে কেন? চেঁচাব এখনই।

পেছনে বাবা আছে। অকারণে ধমক খেয়ো না।

আচ্ছা, ঠিক আছে। টেবিলে লেবুর শরবত বানানো আছে। যে যার মতো খেয়ে ফেলেন।

দুপুরে কী?

মা আপনাদের সারপ্রাইজ দেবেন।

তাহলে চেঁচিয়ে বলি, জয় বাংলা, মামণি।

ছেলেরা ঢুকতে ঢুকতে বলতে থাকে, জয় বাংলা। দুর্গবাড়ি অমর হোক। বারান্দায় উঠে আসেন আকমল হোসেন। প্রবল ঘামে মুখ ভিজে আছে। গ্যারেজে আলতাফ বলেছিল, স্যার পানি খাবেন, তিনি না করেছিলেন। অনেক ঘেমে গেছেন স্যার, আলতাফের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল। তিনি বলেছিলেন, কী রকম গরম পড়েছে দেখেছ? একদম কাঠফাটা রোদ আরকি। আলতাফ হোসেনের তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, আপনার অনেক ধকল গেছে কি, স্যার? তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, যুদ্ধে জড়ালে কোনো কাজকে ধকল বলতে হয় না, আলতাফ। কথাটা শুনে আলতাফ লজ্জা পেয়ে বলেছিল, আমি ভুল করেছি। আমার বলা উচিত ছিল জয় বাংলার সময় সব কাজই জয় বাংলা, স্যার।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।

এটুকু বলে আকমল হোসেন বারান্দায় উঠেছিলেন। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল মেরিনা। বাবার ঘর্মাক্ত মুখ দেখে দ্রুতকণ্ঠে বলে, শরবত দেব, আব্বা?

কথা বলিস না। তোর মা কই?

গোসল করছেন।

ভালো হয়েছে। এক গ্লাস শরবত খেয়ে আমি বাথরুমে ঢুকব।

আপনাকে কখনো এত ঘামতে দেখিনি, আব্বা।

তোর মা দেখেছে। সে জন্য তোর মাকে আমার ঘামঝরা মুখ দেখাতে চাই না।

যা গরম পড়েছে! আপনি তো ঘামতেই পারেন।

সে তো ঘামতেই পারি। যুদ্ধের সময় না হলে এই ঘামভরা মুখ দেখলে তোর মা আমাকে বাথরুমে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু এখন দেবে না। অন্য কথা বলবে।

কী কথা, আব্বা? আপনার কথা শুনে আমি খুব অবাক হচ্ছি।

এখন আমাকে দেখলে তোর মা বলবে, তোমার আর ওদের সঙ্গে যেতে হবে না। তুমি এই বাড়ির অস্ত্রগুলো পাহারা দাও। তোর মা তো বলে আমাকে দুর্গের পাহারাদারই বেশি মানায়। সব কথা তো আর তোদের সামনে হয় না। রাতে ঘুমানোর সময় অনেক কথা হয়।

বোধ হয় ঠিকই বলেন, আব্বা।

তুই তোর মায়ের পক্ষে গেলি!

পক্ষে-বিপক্ষে না, আব্বা, মায়ের কথাটা আমার ঠিক মনে হয়েছে।

আকমল হোসেন মেয়ের কথায় সায় দেন না। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে দুগ্লাস শরবত খান।

আব্বা, আপনি কি মন খারাপ করলেন?

মন খারাপ নয়। কথাটা ভেবে দেখার মতো। যাকে যেভাবে কাজে লাগানো যাবে, সেটাই হবে যুদ্ধের সময়ের স্ট্র্যাটেজি। দেখলি না, রোদে ঘোরাঘুরি করেও ছেলেরা কিন্তু ঘামেনি। ওরা ঠিকই আছে। ওরা তো কেউ শরবতও খায়নি দেখছি।

আমি ট্রে ভরে গ্লাসগুলো ভাইয়ার ঘরে দিয়ে আসব।

হ্যাঁ, তা-ই কর। সন্ধ্যার আগেই ওদের আবার বের হতে হবে।

আকমল হোসেন নিজের ঘরে যেতে যেতে দেখতে পান আয়শা খাতুন। গোসল করে বেরিয়েছেন। হাতে একগাদা ভেজা কাপড়। মন্টুর মাকে ডেকে কাপড়গুলো রোদে শুকানোর জন্য দেন। তারপর ঘরে ফিরে আসেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলেন, কেমন হলো তোমাদের?

ভালোই হয়েছে। এখন সন্ধ্যার অপেক্ষায় আছি।

গোসলটা সেরে নাও। তোমার গোসল হলে টেবিলে খাবার দেব।

আকমল হোসেন তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়েন। স্বস্তি পান এই ভেবে যে আয়শা খাতুন তার ঘর্মাক্ত মুখ খেয়াল করেননি। অবশ্য শরবত খাওয়ার সময় তিনি নিজেও হাত দিয়ে মুখ মুছেছেন। আলতাফ ও মেরিনা যতটুকু দেখেছে, অতটুকু দেখার সুযোগ আয়শা খাতুনের ছিল না। বাথরুমে ঢুকে আকমল হোসেন প্রবল স্বস্তিতে গায়ে পানি ঢালেন। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তার মনে হয়, পানি তাঁর শরীরে নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। তখন তাঁর পুরোনো কথা মনে হয়—স্মৃতির নদীতে পুরোনো কথা স্রোতের মতো বয়। নইলে যৌবনের সময়ের কথা এখনকার সময়ে বয়ে এল কী করে! পাঠশালার শিক্ষক প্রতিদিন নদীর ঘাটে স্নান করতে আসতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে কাছে দাঁড় করিয়ে বলতেন, মনে রাখিস, যে নদীতে তুই বারবার নামিস, সে নদী কখনো এক রকম থাকে না। নদীর জল নতুন স্রোত তৈরি করে। নদী নতুন হয়।

তাহলে তো, দাদু, আমিও এক রকম ছেলে থাকি না। আমিও নদীর মতো প্রতিদিন নতুন ছেলে হই। না দাদু?

ঠিক ধরেছিস। এ জন্যই তো তুই ক্লাসে ফার্স্ট হোস। ভগবান তোর মগজভরা মেধা দিয়েছেন। তোকে আশীর্বাদ করি রে, দাদু।

নতুন ছেলে, নতুন ছেলে বলতে বলতে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। এখন মনে হয়, সেদিন এক আশ্চর্য সময় ছিল তার জীবনে। সময়কে, জীবনকে বুঝে ওঠার সময়। বুঝেছেন সব চোখ খোলা রেখে, করোটিতে সাদা আলো জ্বালিয়ে রেখে। সেই বোঝা ফুরোয়নি তার জীবন থেকে। এখন আবার নতুন সময় এসেছে নতুনের হয়ে ওঠার সাদা আলোয় নিজেকে চেনার। ভাবতে ভাবতে হাত বাড়িয়ে শাওয়ারের ট্যাপ বন্ধ করেন। শুনতে পান, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আয়শা খাতুন বলছেন, কী হলো, আজ এত সময় লাগছে কেন তোমার? গায়ে এত পানি ঢাললে ঠান্ডা লাগবে।

তিনি সাড়া দেন না। নিজেকেই বলেন, প্রতিদিন নতুন হওয়া সহজ কথা নয়। আমি কঠিনের সাধনা করছি। একাত্তর কঠিনের সাধনার সময়। এ সত্য তোমার চেয়ে কে বেশি বুঝবে! আমি তো জানি, গুনগুন করে গান গেয়ে তুমি নিজে কঠিনের সাধনা করো।

তিনি তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে শুরু করলে আয়শা খাতুন আবার দরজায় শব্দ করেন। তিনি এবারও সাড়া দেন না। ভাবেন, ওই শব্দ করে আয়শা খাতুন তার জন্য অপেক্ষা করুক। এরকম ভাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ভালো লাগা তাকে আচ্ছন্ন করে। তিনি দ্রুত হাতে শরীর মুছে বেরিয়ে আসেন। দরজা খুললে দেখতে পান দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আয়শা খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন।

এখনো দাঁড়িয়ে আছ?

তোমার জন্য, দেরি করলে যে?

ভীষণ খিদে পেয়েছে। টেবিল রেডি?

না, টেবিলে খাবার আনিনি। ছেলেরা দরজা বন্ধ করে মিটিং করছে। বলেছে, ওরা নিজেরা দরজা খুলবে; ওদের যেন ডাকাডাকি না করা হয়। মেরিনাও ওদের সঙ্গে আছে।

মিটিং করছে ওরা? ভুরু কোঁচকান আকমল হোসেন।

শুনলাম কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। গুলশান থেকে কোনো অবাঙালির গাড়ি হাইজ্যাক করবে। সেটা নিয়ে ওরা সন্ধ্যায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাবে।

ও, আচ্ছা।

আকমল হোসেন ভেজা চুলে ঝাঁকি দেন।

তোমাকে খাবার দেব?

না, ওদের জন্য অপেক্ষা করি। একসঙ্গে খাব।

আকমল হোসেন শোবারঘরে ঢুকে মাথা আঁচড়ান। তারপর আলনা থেকে সাদা পাঞ্জাবি নিয়ে পরতে পরতে বলেন, আমি কি খুব বুড়ো হয়েছি, আশা?

এমন প্রশ্ন কেন করলে?

তোমার কথায় বুঝতে পেরেছি যে ওরা আমার গাড়িতে যাবে না।

তুমি নিজে নিজে ভেবো না। ওদের পরিকল্পনার কথা শোনো। ওদের হয়তো দুটো গাড়ি লাগতে পারে। কিংবা অপরিচিত কারও গাড়ি নিয়ে গেলে ওদের ধরা পড়ার ভয় কম থাকবে। পুলিশ সেই গাড়ি দেখে খুঁজতে শুরু করলে ওদের খুঁজে পাবে না।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, আশা। ওরা গাড়িটা যেখানে-সেখানে ফেলে নিজেদের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন পথে পালিয়ে যেতে পারবে। এটা ওদের যুদ্ধের কৌশল। ঠিকই ভাবছে ওরা।

তুমি বয়স নিয়ে মন খারাপ করলে।

আকমল হোসেন মৃদু হেসে বলেন, কী খাওয়াবে আমাদের?

এটা যুদ্ধের সময়। খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে না।

আয়শা খাতুন তর্জনী তুলে কথা বললে তিনি বুঝতে পারেন যে আয়শা তার কথা তাঁকেই ফেরত দিয়েছেন। তার পরও হেসে বলেন, যুদ্ধের সময় সব খাবারই অমৃত। রেডিওটা ছেড়ে দাও, আশা। দেখি, কোনো খবর আছে নাকি, যে খবর ছেলেদের কাজে লাগবে।

আয়শা খাতুন রেডিও ছেড়ে দেন। করাচি থেকে উর্দু ভাষায় পড়া খবর শোনা যায়। আকমল হোসেন ইজিচেয়ারে বসেন। আয়শা খাতুন ভেজা তোয়ালে নিয়ে বাইরে যান। বারান্দার রশিতে তোয়ালেটা ঝুলিয়ে দেওয়ার সময় টের পান ছেলেরা ঘরের দরজা খুলেছে। হুড়মুড় করে বের হচ্ছে ওরা।

মন্টুর মা কাছে এসে দাঁড়ায়।

লুচি ভাজা কি শুরু করব, খালাম্মা?

হ্যাঁ, করো। ওরা বের হয়েছে।

ছুটে আসে মেরিনা।

মা, টেবিলটা সাজাই।

হ্যাঁ, সাজাও, মা। দুপা এগিয়ে মেরিনা ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওরা আজকের অপারেশনের দারুণ পরিকল্পনা করেছে। আমি বলব না। ওদের কাছ থেকে শুনবে। আমি যাই।

আয়শা খাতুনের মনে হয়, এখনই একটা গান গাওয়ার সময়। কী গাইবেন? ধনধান্য পুষ্পভরা-

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি…

গানের ধ্বনি আর সুর ছড়ায় পুরো বাড়িতে। আকমল হোসেন কান খাড়া করেন। ছেলেরা যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে একমুহূর্তে গানের বাণী নিজেদের বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। বুঝতে পারে, তাদের জয় বাংলা মামণি তাদের কী মেসেজ দিচ্ছেন। মেরিনা গুনগুন ধ্বনি শুনে ভীষণ আপ্লুত হয়ে বলে, মায়েদের বুঝি এমনই হতে হয়। আয়শা খাতুন তখন রান্নাঘরে বিভিন্ন ডিশে খাবার সাজান। লুচি, আলুর দম, মুরগির রোস্ট, গরুর রেজালা। আর একটি বড় কেক। আজ ছেলেদের নতুন জন্মদিন। তাই সবাইকে দিয়ে কেক কাটাবেন তিনি। বলবেন, শুভ হোক তোমাদের যাত্রা। আমরা তোমাদের অপেক্ষায় থাকব।

 

খাবার টেবিল দেখে ছেলেদের চোখ ছানাবড়া।

মামণি, এত কিছু?

হ্যাঁ, এত কিছুই। বসে যাও। মন্টুর মা লুচি ভাজা শেষ করবে না। ওটা গরম গরম আসবে।

খাওয়া শুরুর মাঝামাঝি সময়ে আকমল হোসেন প্রশ্নটি ওঠান, তোমরা কখন বাড়ি থেকে বের হবে?

তিনটার দিকে।

প্রশ্নের উত্তর দেয় ওমর। একই সঙ্গে মিজারুল বলে, আমরা পরিকল্পনা বদলে ফেলেছি, খালুজান। আমরা ঠিক করেছি, আপনার গাড়ি আমাদের নেওয়া ঠিক হবে না। আমরা গাড়ি হাইজ্যাক করব।

এখান থেকে আমরা গুলশানে যাব। ওখানে রশীদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে গুলশান ১-এর শপিং সেন্টারের কাছে। হাইজ্যাক করবে রশীদ। তারপর গাড়িটি স্বপনকে দেওয়া হবে। ও চালিয়ে এই বাসায় আসবে। এখান থেকে গ্রেনেড নিয়ে আমরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাব।

মিজারুল থামলে আকমল হোসেন বলেন, বেশ। তোমাদের পরিকল্পনা ঠিক আছে।

কায়েস বলে, যদি আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল না হয়, যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, আমরা চাই না আর্মি আমাদের পিছু নিয়ে আমাদের এই দুর্গবাড়ি চিনে ফেলুক। তাহলে ভবিষ্যতের আরও নানা পরিকল্পনা আমাদের ভেস্তে যাবে।

ঠিক বলেছ। আমি তোমাদের সঙ্গে একমত। তবে আমার মনে হয়, তোমাদের সবার গুলশান যাওয়ার দরকার নেই। তোমরা তিনজন গুলশান যাও। বাকিরা এই বাড়িতে অপেক্ষা করো। গাড়ি নিয়ে এলে এরা উঠবে। এরা গ্রেনেড নিয়ে রেডি থাকবে।

ওরা একসঙ্গে আকমল হোসেনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাঁর কথা থামলে ওরা একটু পরে মাথা নেড়ে বলে, ঠিক বলেছেন, খালুজান। গাড়ি চালাবে মিজারুল। তাহলে মিজারুলের সঙ্গে কায়েস আর স্বপন যাক। মারুফ, ফয়েজ

আর আমি দুর্গবাড়িতে থাকি।

হ্যাঁ, তা-ই করো।

মেরিনা উৎসাহ নিয়ে বলে, গ্রেনেডগুলো আমি গুছিয়ে দেব। কয়টি গ্রেনেড দেব, আব্বা?

আটটি। আটটির বেশি দরকার হবে না।

আমরা ঠিক করেছি, ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড ছোড়া ঠিকঠাকমতো হলে আমরা কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মির্জা শফিকুলের বাড়িতে গ্রেনেড ছুড়ব। ওর মগবাজারের বাড়ি হোটেল থেকে বেশি দূরে নয়। এক সন্ধ্যাতেই কাজটি হয়ে যাবে। মানুষকে জানানোর দিকটি জোরদার হবে। আকমল হোসেন প্লেটের ভাতটুকু শেষ করে বলেন, আতঙ্ক সৃষ্টি করার কাজটি জোরেশোরে হওয়াই ভালো।

এক গ্লাস পানি খেয়ে তিনি উঠে পড়েন।

আয়শা খাতুন বলেন, হাত ধুয়ে আবার টেবিলে ফিরে এসো। আরেকটি আইটেম বাদ আছে।

তাই নাকি? আসছি। এই ছেলেরা, তোমরাও হাত ধুয়ে নাও। আরেকটি আইটেম খাওয়া শেষ হলে তোমাদের আক্রমণের পরিকল্পনাটাও আমাকে বুঝতে হবে।

হ্যাঁ, আমরা সেটাও আপনাকে বলব।

হাত ধোয়ার জন্য কেউ কেউ রান্নাঘরে ঢোকে, কেউ টেবিলের পাশের বেসিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

সবাই ফিরে এলে কেক কাটা হয়। সবার মুখে কেকের টুকরো তুলে দেন আয়শা খাতুন। মারুফ হাসতে হাসতে বলে, মা, জন্মদিনের মোমবাতি নেই। আপনি কি মোমবাতি কিনতে ভুলে গিয়েছিলেন?

মোটেই ভুলিনি, বাবা। আজকে গেরিলাদের জন্মদিনের মোমবাতি হলো জয় বাংলা। ওই ধ্বনি আমাদের সামনে আলোর শিখা। ওটাকে ফু দিয়ে নেভানো যাবে না। এটা আমাদের সামনে জ্বলবেই। যুদ্ধের সময় জ্বলবে। স্বাধীন দেশেও জ্বলবে।

ওহ্, মামণি, আপনি—আপনি—

ছেলেরা কথা বলতে পারে না। ওদের সবার চোখ জলে ভরে যায়। বাইরে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ স্তিমিত হতে থাকে। গাড়ির হর্ন শোনা যায়। মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সঙ্গে রিকশার টুনটুন শব্দ। মন্টুর মা টেবিল থেকে বাসন-কোসন সরাতে থাকে। ওরা সবাই এখন ড্রয়িংরুমে। মেরিনা সবার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। কথা শুরু করে মিজারুল।

আমরা ঠিক করেছি, মিন্টো রোড দিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে এগোতে থাকব। বড় নাগলিঙ্গমগাছটার নিচে প্রথমে গাড়ি থামবে। আমাদের দুজন সেখানে নামবে। ওরা ফুটপাত ধরে সামনে এগোবে। বাকিরা হোটেলের গেট থেকে একটু সামনে গিয়ে বড় গাছগুলো যেখানে আছে, সেখানে নামবে। তারপর ওরা দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকবে। সেখান থেকে মেইন গেটের কাছে গ্রেনেড ছুড়বে। হোটেলের পর্চে যদি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের গাড়ি থাকে, তবে সেই গাড়ির ওপরও গ্রেনেড ছোড়া হবে। যারা ফুটপাত ধরে এগোবে, তারা হোটেলের সামনের বারান্দার দুপাশে গ্রেনেড ছুড়বে। আমাদের গাড়ি থাকবে মিন্টো রোডে। কাজ শেষ করে আমরা গাড়িতে উঠব। গাড়ি মিন্টো রোড ছাড়িয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজারে ঢুকবে। সেখানে মুসলিম লীগের নেতার বাড়িতে গ্রেনেড ছুড়ে আমরা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের দিকে যাব। ওই দুই অফিসে গ্রেনেড ছুড়ে আমরা পুরানা পল্টনের গলিতে ঢুকে গাড়ি ছেড়ে দেব। তারপর যে যার মতো নিরাপদ জায়গায় চলে যাব।

রুদ্ধশ্বাসে কথা শুনছিলেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন। কথা শেষ হলে আয়শা খাতুন তার ডান এবং বাম হাত মুঠি করে ধরে বলেন, এ বাড়িতে আসবে না তোমরা?

না, মামণি। আমরা এ বাড়িতে আসব না। এটা আমাদের যুদ্ধের কৌশল।

মারুফও সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমিও আসব না, মা। আমরা কে কোথায় যাব, সে বাড়িগুলো ঠিক করা আছে। ঢাকা শহরে এখন এমন অনেক বাড়ি আছে। তারা গেরিলাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে।

মেরিনা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, তাহলে তুমি কখন বাড়িতে আসবে, ভাইয়া?

যুদ্ধের সময় এমন প্রশ্ন করতে নেই, মেরিনা।

আকমল হোসেন চুপ করেই ছিলেন। অনেকক্ষণ পর বলেন, তোমাদের জন্য দোয়া করি। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।

আমিও তোমাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন। তোমরা যেন সবকিছু ঠিকমতো করে মায়েদের কোলে ফিরে আসতে পারো।

ওরা সবাই দুজনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে দুজনে উঠে দাঁড়ান। শোবারঘরের দিকে যেতে যেতে আকমল হোসেন বলেন, তোমাদের সঙ্গে মেরিনা থাকবে। তোমাদের গ্রেনেড ও গুছিয়ে দেবে। এখন থেকে ও নিজেও তোমাদের গেরিলাবাহিনীর একজন। মনে রেখো, যুদ্ধ শুধু ছেলেদের নয়, যুদ্ধ মেয়েদেরও।

বাবার কথা শুনে মেরিনা উচ্ছ্বসিত স্বরে দুহাত ওপরে তুলে বলে, জয় বাংলা।

 

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সূর্য পশ্চিম আকাশজুড়ে লাল আলো ছড়িয়েছে। পুরো ড়ুবে যায়নি। দুর্গবাড়ির তিনজন মানুষ ড্রয়িংরুমে চুপচাপ বসে আছে। টেলিভিশন ছাড়া। ভলিউম দেওয়া নেই বলে শব্দ হচ্ছে না। পর্দাজুড়ে নানা ছবি ভেসে উঠছে। গান হচ্ছে কিংবা অন্য কিছু। খবরের সময় হয়নি বলে টেলিভিশনে খবর নেই। কিছুক্ষণ পর মন্টুর মা এসে ড্রয়িংরুমে মেরিনার পাশে মেঝেতে বসে। মেরিনা জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?

ভয় করছে।

ভয়? কেন?

জানি না। ভয়ের কিছু নাই, খালা।

আছে। ওদের যদি কিছু হয়।

আপনি রান্নাঘরে যান। নইলে আপনার ঘরে যান। অজু করে জায়নামাজে বসেন। ওদের জন্য দোয়া করেন।

মন্টুর মা মাথা নেড়ে চলে যায়।

একটু পর আলতাফ আসে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলে না। আকমল হোসেন হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বলেন, কিছু বলবে?

গেট বন্ধ করে দিয়েছি। রাস্তায় লোক চলাচল খুব নাই।

বেশ করেছ। তুমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারো।

আমি শুয়ে পড়লে চলবে কেন? ভাইয়ারা কখন আসবে তার তো কিছু ঠিক নাই।

ভাইয়াদের কথা তোমার ভাবতে হবে না।

আলতাফের শরীর সোজা হয়ে যায়। খানিকটা ক্ষুন্ন স্বরে বলে, আমাকে তো ভাবতেই হবে, স্যার। গেট তো আমি খুলব। আমি ঠিক করেছি, আজ নিজের ঘরে ঘুমাব না। বারান্দায় শুয়ে থাকব, যেন গেটে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিতে পারি।

 

আকমল হোসেন কথা না বাড়িয়ে বলেন, ঠিক আছে, তোমার যা ভালো মনে হয়, তা-ই করো।

আলতাফ আবারও ক্ষুন্ন কণ্ঠে বলে, বারান্দায় শোব কি না এ কথাটি জানতে এসেছিলাম।

আকমল হোসেন উত্তর দেন না। আলতাফ দরজা ছেড়ে চলে যেতে যেতে ভাবে, এ বাড়ির সবার হলো কী আজ। দুপুর পর্যন্ত উৎসবের মতো কত কিছু হলো। এখন, ধুৎ! ও আর ভাবতে চায় না। বাড়ির বাইরের সব বাতি অফ করে দিয়ে আলতাফ বারান্দার সিঁড়ির ওপর চুপচাপ বসে থাকে। ভাইয়ারা জয়ী হয়ে ফিরে আসবে এমন একটি আশায় তার মন-প্রাণ উত্তেজিত। কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। উঠে গেটের কাছে যায়। গেটের গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আবার ফিরে আসে বারান্দায়। মন্টুর মা তার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। এগিয়ে দিয়ে বলে, পানি খান, আলতাফ ভাই?

আমার তো পিয়াস লাগেনি।

পানি খেলে আপনার স্বস্তি লাগবে। বুকের ভেতর ঠান্ডা হবে।

তাহলে খাই। আলতাফ গ্লাস নিয়ে পানি খায়। মন্টুর মা যেতে যেতে বলে, এখন নামাজ পড়েন। শান্তি পাবেন। নামাজ পড়ে দোয়া করেন, আমাদের ছেলেরা যেন যুদ্ধে জেতে।

ঠিক। যতক্ষণ ঘুম আসবে না, ততক্ষণ দোয়া পড়ব। যাই, জায়নামাজ নিয়ে আসি।

মন্টুর মা রান্নাঘরে গ্লাস রেখে নিজের ঘরে যায়। তার ভাবতে ভালো লাগে যে, সে মানুষটির অস্থিরতা কাটিয়ে দিতে পেরেছে। যুদ্ধের সময় মানুষকে অনেক বেশি অস্থির করে। মন্টুর মা নিজেও ছেলেদের জন্য দোয়া করবে বলে নামাজের জন্য অজু করে। জায়নামাজ পেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে মন্টুর মায়ের বুক প্রশান্তিতে ভরে যায়। ভাবে, ছেলেরা যে যুদ্ধে গেছে, সেটায় জয়ী হয়েছে। ঠিকই জয়ী হয়েছে। দুদিন পর এ বাড়িতে আবার জড়ো হয়ে বলবে, আমরা এসেছি। আমাদের গ্রেনেড দেন। মন্টুর মা ওদের জন্য দোয়া করে।

ঘরের ভেতরে মেরিনার ভাবনার শেষ নেই। ও প্রতি মুহূর্তে সময়ের হিসাব কষছে। ওরা গাড়ি হাইজ্যাক করছে। বাড়িতে এসে গ্রেনেড নিয়েছে। ওরা এখন কোথায়? টিভিতে সন্ধ্যার খবর পাঠ করা হচ্ছে। কিন্তু গেরিলা অপারেশনের কোনো খবর নেই। নিশ্চয় কালকের পত্রিকায় ওদের খবর ছাপা হবে। আয়শা খাতুন বই পড়ছিলেন। এখন তিনি বই পড়ছেন। সন্ধ্যার আগে থেকেই তিনি চুপচাপ হয়ে আছেন। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলছেন না। মেরিনা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরও মা ওর দিকে তাকান না। ও বাবার দিকে তাকায়। দেখতে পায়, বাবা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছেন। শব্দহীন টেলিভিশনের স্ক্রিন তিনি দেখছেন, নাকি দেখার ভাণ করে আছেন, তা বুঝতে পারে না মেরিনা। ওর মাথার মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পুরো চত্বর যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যায়। সরাসরি যুদ্ধ-গোলাবারুদ, মেশিনগান, ট্যাংক ইত্যাদিসহ পুরো যুদ্ধের চিত্রটি নিজের মধ্যে জাগিয়ে রেগে মেরিনা বাথরুমে আসে। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখমুখে পানি দেয়। ভাবে, আজ তো আর ওদের কোনো খবর পাওয়া যাবে না। সময়কে এখানে থামিয়ে রাখা উচিত।

কারণ সন্ধ্যা শেষ হয়ে গেছে। এখন রাত আটটা বাজে। ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা সব কাজ শেষ করেছে। নিশ্চিত করেছে। সময় এখন থেমে থাকুক। কোনো একদিন পুরো ঘটনা ওদের কাছ থেকে শুনতে হবে। ওরা হোটেলের দেয়াল ঘেঁষে লাগানো বড় গাছগুলোর আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছে। মোটা গাছের কাণ্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে গ্রেনেড ছুড়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের গাড়ির ওপর গ্রেনেড ফেলেছে। ওরা সমস্ত মানুষের চিত্তার দুকান ভরে শুনেছে। ওদের ছোটোছুটি দেখেছে। প্রধান গেটের সামনে গ্রেনেড ছুড়ে সিকিউরিটি গার্ডদের হতবিহ্বল করেছে। তারপর ওরা ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠেছে। গাড়ি স্টার্ট করা ছিল। গাড়ি শাঁই করে মগবাজারের শান্তি কমিটির অ্যাডভোকেটের বাড়িতে গ্রেনেড ছুড়েছে।

তারপর ওরা মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার অফিসের সামনে গিয়ে দেখেছে, পাহারা দিচ্ছে পাঞ্জাবি দারোয়ান ও মিলিশিয়া জওয়ান। ওরা একটি গ্রেনেড ঠিকই ছুড়েছে। কিন্তু ওটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। জামার আস্তিন গাড়ির দরজার লকে আটকে যাওয়ার ফলে গ্রেনেড অন্য জায়গায় পড়ে। ওরা আর অপেক্ষা করেনি। শহর টেরোরাইজ করে, চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে ওরা যার যার পথে চলে গেছে।

মেরিনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। ভাবে, একজন গেরিলা হওয়ার সাহস নিয়ে ও এখন নিজের মুখোমুখি হয়েছে। একাত্তরের এই সময়ে সাহস দরকার—প্রতিজ্ঞা দরকার—ঘরের মধ্যে থেকে কিংবা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের মুঠোয় সময়ের সবটুকু নিতে হবে। কোনো অপচয় নয়—বৃথা সময় কাটানো নয়। ওর কপাল কুঁচকে থাকে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছে। ভাবে, সময়ের হিসাবে গেরিলারা অপারেশন শেষ করেছে। তবে ওর মায়ের কণ্ঠে গুনগুন ধ্বনি নেই কেন? মা কি ওদের স্বাগত জানাবে না? মেরিনা মন খারাপ করে। বুঝতে পারে না যে আয়শা খাতুন কী ভাবছেন। তাঁর মনে কোনো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কি? ভাবছেন, ছেলেরা কোনো অনিশ্চয়তায় আছে? যতক্ষণ না খবর আসবে যে সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়েছে, ততক্ষণ তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকবেন। হয়তো এটাই সত্যি। তার বুকের ভেতরে সংগীত স্তব্ধ হয়ে আছে।

মেরিনা বাথরুম থেকে ড্রয়িংরুমে এলে দেখতে পায়, আয়শা খাতুন বইটা বুকের ওপর রেখে সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। আকমল হোসেন সেন্ট্রাল টেবিলটা সামনে টেনে নিজের বানানো শহরের ম্যাপের ওপর ঝুঁকে আছেন। মেরিনা বেরিয়ে এসে মন্টুর মায়ের ঘরে যায়। দেখতে পায়, মন্টুর মা ঘরের মৃদু আলোয় মৃদুস্বরে দোয়া পড়ছে। ও বেরিয়ে বারান্দায় আসে। আলতাফ তখনো সিঁড়ির ওপর বসে আছে। মেরিনাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।

আপা, ভাইয়ারা কখন আসবে?

জানি না তো। আমাকে কিছু বলেনি।

এতক্ষণে তাদের তো কাজ শেষ হয়েছে, না?

সময় হিসাব করলে হয়ে যাওয়ার তো কথা।

তাহলে যেকোনো সময় আসবে। চুপিচুপি করে ডেকে বলবে, আলতাফ ভাই, দরজা খোলেন। তাই না, আপা? তাদের যে-ই আমাকে ডাকুক না কেন তার গলা আমি চিনি। তাদের নাম ধরেই আমি বলি, দাঁড়ান, দরজা খুলছি, মিজারুল ভাই। আজকে কে আমাকে ডাকবে, আপা, আপনি বলেন?

আপনিই বলেন?

আমার মনে হয়, আজকে সবাই একসঙ্গে আমাকে ডাকবে। আলতাফ ভাই, দরজা খোলেন। তাই না, আপা? ঠিক বলেছি?

হ্যাঁ, তাই তো। ঠিকই বলেছেন। ওদের নিয়ে আজ আমাদের নিজের মতো করে ভাবার সময়। সময় খুব সুন্দর।

আজ আমি বারান্দায় বসে নামাজ পড়ব। আমি কোথাও যাব না।

তাই বুঝি জায়নামাজ এনেছেন এখানে?

হ্যাঁ। আলতাফ হোসেন মাথা নেড়ে মৃদু হাসে।

সেই ভালো। আমিও দেখতে এসেছিলাম যে আপনি কী করছেন।

বাড়ির দারোয়ানের তো গেট খোলারই কাজ, আপা। কিন্তু আজকে যাদের অপেক্ষায় গেট খোলার জন্য বসে আছি, তারা সবাই ফেরেশতা। তারা যখন কাজ শেষ করেছে, তখন আমাদের ঢাকা শহরের ওপর সাদা আলো ছড়িয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই আলো আর নিভবে না।

আলতাফ ভাই! মেরিনা অস্ফুট ধ্বনিতে একজন সাধারণ মানুষের স্বপ্নের কথা শোনে। বিস্ফারিত হয় ওর চোখ। ভাবে, এভাবে যুদ্ধ। এভাবেই স্বাধীনতার স্বপ্ন। একজন মানুষও বেঁচে থাকলে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেবে। ওহ, এই শহরে এখন আর কোনো মানুষের ভয় নাই।

রাত বাড়ে।

এখন পর্যন্ত বাড়ির টেলিফোন বাজেনি। খবরের জন্য অপেক্ষারত মানুষেরা এখন ঘরে-বারান্দায় পায়চারি করছে। আয়শা খাতুন বুকের ওপর থেকে বই সরিয়ে উঠে পড়েছেন। আকমল হোসেন সোফায় নেই। বাড়ির পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মন্টুর মা নামাজ শেষ করে রান্নাঘরে এসেছে। আলতাফ মিয়া লোহার গেটের ওপর মুখ রেখে ভাবছে, ফিরছে না কেন ভাইয়ারা? তারা এই বাড়িতে এলে সে-ও চলে যাবে তাদের সঙ্গে। যুদ্ধের সময় মানুষ কীভাবে ঘরে বসে থাকতে পারে।

তখন বাড়ির টেলিফোন বেজে ওঠে।

ছুটে যায় মেরিনা। গিয়ে ফোন ধরে।

হ্যালো, ভাইয়া।

ছুটে আসেন আকমল হোসেন, আয়শা খাতুন।

আমরা সাকসেসফুলি সব কাজ শেষ করেছি। শুধু পত্রিকা অফিসের সামনে ছোড়া গ্রেনেডটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। আব্বাকে দে, মেরিনা।

ফোন চলে যায় আকমল হোসেনের হাতে।

বলো, বাবা–

আমরা পেরেছি, আব্বা। আমরা বিদেশিদের সামনে দেখাতে পেরেছি যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত না। পাকিস্তান সরকার যা কিছু প্রচার করছে তা মিথ্যা।

তোমাদের জন্য দোয়া করি, বাবা। সাবধানে থাকো। জয় বাংলা।

ফোনটা মাকে দেন, আব্বা।

হ্যালো, বাবা।

মাগো, সব ঠিকঠাকমতো হয়েছে। আমার জন্য একটুও ভাববেন না। আপনি তো বলেন, দেশের জন্য আমরা সবাই জীবন দিতে তৈরি হয়েছি।

তোমার জন্য দোয়া করি, বাবা। আমি জানি, তোমার বুকভরা সাহস আছে। তুমি পিছু হটবে না।

মাগো, আমাদের সময়কে তো আমাদেরই পূর্ণ করতে হবে। ফোন রাখছি, মা। কবে দেখা হবে জানি না।

ফোনের লাইন কেটে যায়। আয়শা খাতুন একটু সময় রিসিভার বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। যেন তিনি অগণিত গেরিলাযোদ্ধার বুকের ধুকধুক ধ্বনি শুনছেন। যেন তার চারপাশে এখন আর কোনো ধ্বনি নেই, তিনি দুপা বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের অপর প্রান্তে মারুফ।

মাগো, দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার… গানটি শোনান।

আয়শা খাতুনের গুনগুন ধ্বনি ছড়িয়ে যায় ফোনে এবং ঘরে—লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার ছড়াতে থাকে সুর :

কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।…

ফোনের রিসিভার ওঠায় মিজারুল। ওর মনে হয়, জয় বাংলা মামণি ওর বুকের ভেতর সাহসের ধ্বনি ছড়াচ্ছেন। ও টেলিফোন কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে :

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার…।

গুনগুন ধ্বনি উজ্জীবিত করে মিজারুলকে।

রিসিভার ওঠায় স্বপন। টেলিফোন টোনে গুনগুন ধ্বনি শুনে চমকে উঠেছিল সে। বুঝতে পারে না কোথা থেকে এমন শব্দ আসছে। ফোনের চারপাশে এ কিসের ধ্বনি! তারপর দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরে। শুনতে পায়, জয় বাংলা মামণির কণ্ঠস্বর—ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান—গুনগুন ধ্বনি ছড়াতে থাকে ঘরে। ছুটে আসে তপন। দাদা, কে গান গাইছে? তুমি টেলিফোনে কার গান শুনছ? আমাকে শুনতে দাও। ফোনের রিসিভার কেড়ে নেয় তপন। গুনগুন ধ্বনি বুকে নিয়ে স্বপন ঘরে পায়চারি করে। টেলিফোন ওঠায় ফয়েজ :

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়াছে তাঁরা
দিবে কোন বলিদান?

থরথর করে কাঁপে ফয়েজের শরীর। বুঝতে পারে, জয় বাংলা মামণি ওর শরীরের সবটুকু শক্তি কেড়ে নিচ্ছেন। ও দুহাতে টেলিফোন রিসিভার ধরে রাখে।

টেলিফোন ওঠায় কায়েস। টেলিফোনে কোনো রিংটোন ছিল না। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল, কোথাও কিছু ভুল হয়েছে বোধ হয়। টেলিফোনে মেসেজ আসার কথা। ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দেখতে পায় দিনের প্রথম আলো ফুটছে। মায়াবী আলো ওর দুচোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করে। কায়েস বাইরে ছুটে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। টেলিফোনের অদৃশ্য ধ্বনি ওর পথ রোধ করে। ও রিসিভার ওঠায়—আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?—জয় বাংলা মামণি ওদের পথে আলোর হাতছানি। ওরা তো তার কাছে পৌঁছেই যাবে। কায়েসের মা এসে ওর কাছে। দাঁড়ালেন। এত ভোরে উঠেছিস কেন রে? আগের মতো কি আমাকে কিছু না বলে পালিয়ে যাবি বাড়ি থেকে? না মা, এবার তোমাকে বলেই যাব। কার সঙ্গে কথা বলছিস? শোনো কার সঙ্গে-গুনগুন ধ্বনিতে ঝংকৃত হয় :

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ
ছিড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?

ব্যাপার কিরে? কে তোদের ডাকছে? সব মায়েরা। সব মায়েরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য ডাকছে। কায়েস দুহাত ওপরে তুলে মায়ের চারপাশে পাক খায়।

বাবার হাত থেকে টেলিফোন নেয় ওমর। তখন মধ্যদুপুর। ভাত খাওয়ার সময়। বাবা ওকে বলেন, তোর ফোন, ওমর। কেউ তোকে খুঁজছে। এবার যদি বাড়ি থেকে যাস তাহলে আমাদের বলে যাবি। লুকিয়ে পালাতে হবে না।

না, বাবা, লুকিয়ে পালাব না। রিসিভার কানে লাগায় ওমর :

কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার…

গুনগুন ধ্বনি ওকে আচ্ছন্ন করে। ওর মনে হয়, ঘরে সবাই এসে জড়ো হয়েছে। হাতে রাইফেল কিংবা লাইট মেশিনগান, নয়তো গ্রেনেড। সবাই মিলে গাইছে :

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!

গান শেষে সবাই স্যালুট করে বলে, আমরা তৈরি। জয় বাংলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *