০২. “এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে”

আমি নিবিষ্ট হইয়া চণ্ডীদাসের পদাবলী পড়িতাম।–বটতলার পদকল্পতরু কিনিয়া লইলাম। ধীরে ধীরে এক গানটিতে আমার মনে একটা নূতন রাজ্যের দরজা খুলিয়া গেলঃ-
“এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে,
অবলা এমন তপঃ করিয়াছে কবে?
পুরুষ-পরশমণি নন্দের কুমার,
কি ধন লাগিয়া ধরে চরণে আমার।”

–তিনি স্পর্শ-মণি, যাহা ছুঁইয়া ফেলেন, তাহাই সোনা হইয়া যায়; এমন ধনী তিনি, কুবেরও তাঁহার কাছে ধন প্রার্থনা করেন, সেই কৃষ্ণ কি ধনের প্রত্যাশায় আমার পা ধরিয়া থাকেন, সখীগণ তোমরা বল, আমার মত তপস্যা কে করিয়াছে?–এরূপ অসাধনে সিদ্ধি আমি কি করিয়া লাভ করিলাম!
সাধকের চক্ষে বিশ্বের সকলই ভাগবত-মূর্ত্তি–তাঁহারই প্রকাশ। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, যাঁহারা নিবিড় স্নেহ দ্বারা আমাকে বাঁধিতেছেন, তাঁহারা ভাগবত শক্তি, তাঁহারা কি নিত্যই চরণ ধরিয়া আমার সেবার জন্য, আমায় সাধিতেছেন না? এমন তপস্যা আমি কি করিয়াছি, তিনি সেবা দিয়া নিরন্তর আমাকে আকর্ষণ করিতেছেন! যিনি বহুর মধ্যে কেবল এককে চিনিয়াছেন, এবং শত হন্তের সেবার মধ্যে সেই কর-কমল দুইটির পরশ পাইয়াছেন, তিনিই বলিতে পারেন–
পুরুষ-পরশমণি নন্দের কুমার,
কি ধন লাগিয়া ধরে চরণে আমার!”

এই পদের পরের পদগুলি এইরূপঃ-
“আমি যাই-যাই-যাই বলে’ তিন বোল।
কত না চুম্বন দেয়, কত দেহি কোল।
পদ আধ যায় পিয়া, চায় পালটিয়া,
বরান নিরথে কত কাতর হইয়া।” (চ)

কি অপার্থিব দৃশ্য! বিদায়কালে চিবুক ধরিয়া কৃষ্ণ “যাই” “যাই” বলিতেছেন; ‘যাই’ বলিলেই চলিয়া যাইতে পারেন না, রাধার মুখখানি তাঁহাকে ধরিয়া রাখে। পুনরায় ‘যাই’ বলিয়া বিদায় চান–প্রতিবারই ফিরিয়া আসিয়া সোগাগ করেন, আধ পা যাইয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চান এবং কাতর-দৃষ্টি মুখখানির প্রতি আবদ্ধ করিয়া থামিয়া দাঁড়ান, সে মুখ যে কোন কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ ফিরাইয়া আনে! এই অসাধনের ধন পাইয়া কি ফেলিয়া যাইতে ইচ্ছা হয়? কিন্তু যাইতে তো হইবেই; যদি সত্যই অঞ্চলের নিধি হারাইয়া যায়, যদি আবার না দেখিতে পান, তবে বাঁচিবেন কেমন করিয়া?

“করে কর ধরি পিয়া শপথি দেয় মোরে।
পুন দরশন লাগি কত চাটু বোলে।”

“রলয়োরভেদত্বাৎ”–‘মোরে’ ও ‘বোলে’র গরমিল পাঠক ধরিবে না। এগুলি গান, কাব্যের নিয়ম এখানে সর্ব্বদা চলে না।
তিনি হাত ধরিয়া শপথ চাহিতেছেন, “আমার হাত ছুঁইয়া বল, আবার দেখা পাব”–যে দর্শন সমস্ত সাধনার শেষ সিদ্ধি, সহস্র কষ্টের উপশম, ভবরোগের শ্রেষ্ঠ ভেষজ–সেই দর্শনের জন্য ভিক্ষা।
সেই সনাতন ভিক্ষারী জীবকে এমনই করিয়া চান। হে মানব! তোমার দেবতা তোমাকে এমন করিয়া চান, মাতার উৎকণ্ঠার মধ্যে, স্বামীর সোহাগে, শিশুর ব্যাকুলতার মধ্যে সেই চিরন্তন ভিখারী এমনই করিয়া বারম্বার তোমার কাছে হাত পাতিয়া আছেন–তোমার চোখের মায়ার ঢাকনিটা খুলিয়া দেখিতে চাহিলে সেই প্রেম ভিক্ষুকের এই চিত্রই দেখিতে পাইবে। কবে তোমাকে পাইব–এইজন্য তিনি কাকুবাদ করিয়া শপথ চাহিতেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *