০২. আদিম আরব বেদুঈন

আদিম আরব বেদুঈন

এ-পুস্তকে আরবী ভাষাভাষী সমস্ত জাতিই আমাদের আলোচ্য বিষয় কেবল আরবের বাসিন্দা নয়–সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ট্রান্স জর্দান, ইরাক, ইরান, মিসর, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যযুগীয় সিসিলী ও স্পেন সহ বহু দেশের লোক। তথাপি আদিম আরব বেদুঈনের উপর আমাদের প্রথম আলোক সম্পাতের প্রয়োজন।

জিপসীরা কেবল বেড়ানোর জন্যই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। বেদুঈন সে ধরনের জিপসী নয়। মরুভূমির অবস্থার সঙ্গে মানুষের জীবনকে কি করে সব চেয়ে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে চলতে হয়, বেদুঈন তার প্রকৃষ্ট আদর্শ। যেখানে ঘাস জন্মে, বেদুঈন তার উট, ঘোড়া, দুম্বা, বকরীর খাদ্যের খোঁজে সেখানেই চলে যায়। ডেট্রয়েট অথবা ম্যানচেস্টারে শিল্প ব্যবসায়ের মত নফুয়ে যাযাবর বৃত্তি জীবনযাত্রার এক বিজ্ঞানসম্মত পথ। বেদুঈনকে তার প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে একটা সুসঙ্গত এবং কঠোর সামঞ্জস্য সাধন করে চলতে হয়। কারণ, আরবের প্রায় সর্বাংশেই মরুভূমি; বাস-উপযোগী কেবল একটি মরু-ভূখও তার চারদিকে ঘিরে আছে। আরবরা তাদের দেশকে দ্বীপ বলে। প্রকৃতপক্ষে আরব একটি দ্বীপ। তার তিন দিকে পানি আর চতুর্থ দিকে বালির দরিয়া।

আরব পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বড় উপদ্বীপ। এত বড় আয়তন সত্ত্বেও এর বাসিন্দা সংখ্যা সত্তর-আশী লাখের বেশি নয়। ভূতত্ত্ববিদরা বলেন যে, আরব দেশ এককালে সাহারা মরুভূমির এক স্বাভাবিক সংযুক্ত অংশ ছিল; এক্ষণে লোহিত সাগর একে আলাদা করে রেখেছে। কেবল তাই নয়; যে বালুকাময় ভূখণ্ড মধ্য-ইরান ও গোবী মরুভূমির ভিতর দিয়ে এশিয়ার এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে, আরব দেশ তার সঙ্গেও যুক্ত ছিল। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ দেশসমূহের মধ্যে আরব অন্যতম। যদিও এর পূর্ব ও পশ্চিমে সমুদ্র বর্তমান, কিন্তু সে সমুদ্রের পরিসর অত্যন্ত অল্প। এশিয়া-আফ্রিকার বিরাট বৃষ্টিহীন ভূখন্দ্রে আবহাওয়ার সঙ্গে এর আবহাওয়া অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পৃক্ত। পূর্ব পশ্চিমের ক্ষুদ্র পরিসর সমুদ্রের পানি সে আবহাওয়াকে মোলায়েম করতে পারে না। দক্ষিণের সন্দ্র হতে কিছু বৃষ্টি আসে, সন্দেহ নাই; কিন্তু মৌসুমী হাওয়া মাঝে মাঝে দেশের উপর প্রবাহিত হলেও দেশের ভিতরের অংশের জন্য তার বুকে বিশেষ কোন বাষ্প অবশিষ্ট থাকে না। স্বাস্থ্যপ্রদ স্নিগ্ধ পুবালী বাতাস বরাবরই কেন আরব কবিগণের রচনার বিষয় হয়েছে, তা বোঝা কঠিন নয়।

বেদুঈন তার পিতৃ-পিতামহের মত এখনো ছাগল ও উটের পশমের তাঁবুতে বাস করে এবং সেই প্রাচীন চারণভূমিতে তার ভেড়া ও বকরী চরায়। ভেড়া, উট ও ঘোড়া পালন, শিকার ও লুণ্ঠন-এই হল বেদুঈনের নিয়মিত পেশা; আর তার বিবেচনায় মরদের পক্ষে এই-ই ইস্যুতের পেশা। তার দৃঢ় বিশ্বাস, কৃষি এবং সর্বপ্রকার শিল্প ও ব্যবসায় তার মর্যাদার অনুপযোগী। আসলে আবাদযোগ্য জমিনের পরিমাণও নগণ্য। সামান্য গমের আবাদ হয়। বেদুঈনের পক্ষে রুটি বিলাসের খাদ্য। সামান্য কিছু গাছপালা আছে খেজুর গাছ। আর আছে সেই গুল্ম যা থেকে দক্ষিণ-আরবের বিখ্যাত কফী তৈরি হয়। (১৪শ শতাব্দীর আগে, এর চল হয় নাই) মরূদ্যানে জন্মে নানা রকম ফল, বাদাম, আখ ও তরমুজ। দক্ষিণ-আরবের সেকালের বাণিজ্য-জীবনে গুগ্গুলের মস্ত গুরুত্ব ছিল। সে গুগুল আজো প্রচুর জন্মে।

আরব শুষ্ক নিষ্করুণ দেশ : বাতাস শুকনা, জমি লবণাক্ত। বারো মাস প্রবাহিত হয় এবং সমুদ্র গিয়ে পড়েছে, এমন একটি নদীও নাই। ছোট ছোট নদী যা আছে, তার একটি জাহাজ কিংবা নৌকা চালাচলের উপযোগৗ নয়। নদী নালার জায়গায় আছে অনেকগুলি ওয়াদী। কখনো বান প্লাবন এলো এই ওয়াদী পথে তো চলে যায়। এসব ওয়াদীতে আরো একটি কাজ হয় : হজযাত্রীদের এবং সাধারণ কাফেলার পথ নির্ণয় এরাই করে। ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় হতে হজই আরবের সঙ্গে বাইরের জগতের যোগসূত্র স্থাপন করে এসেছে।

উর্বর হেলালে সাম্রাজ্যের উত্থান হয়েছে-পতন হয়েছে; কিন্তু উষর মরুভূমিতে বেদুঈন বরাবর একই রয়ে গেছে। বেদুঈন, উট আর খেজুর গাছ মরুভূমিতে এদেরই প্রকৃত প্রভুত্ব। বালুকার সঙ্গে একত্র হয়ে এরা চারজনই এ মঞ্চের অভিনেতা। যেখানে আর কিছুই টিকতে পারে না, সেখানে দৃঢ়তা ও সহনশক্তির জোরে বেদুঈন বেঁচে থাকে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র তার চিত্তে এমন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে আছে যে, তার মধ্যে কখনো সামাজিক সচেতনতা বিকাশ লাভ করে নাই। নিজের কওমের বাইরে সে পর হিতৈষণার কথা ভাবতে পারে না। নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা-রক্ষা ও কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য–এ সব তার আদর্শের অন্তর্গত নয়।

সেমিটিক ধর্মের অঙ্কুর প্রথম পাতা মেলে মধ্যানে-বালুময় ভূমিতে নয়। পাথর ও ফোয়ারাকে কেন্দ্র করে এ ধর্ম গড়ে উঠতে থাকে। এর থেকেই এসেছে ইসলামে ‘হাজরুল আসোয়াদ’ ও জজ এবং ওলটেষ্টামেন্টে বেথেল।

বেদুঈনের মরু-গৃহের বৈচিত্র্যহীনতা,ও অনুর্বরতা তার দৈহিক ও মানসিক প্রকৃতির উপর যথাযথ প্রতিফলিত হয়েছে। সে কতকগুলি হাড়ডি ও শিরা উপশিরার বোঝ। খেজুর ও দুধ তার খানার প্রধান দফা। খেজুর আর উটের গোশতই তার অতরল খাদ্য। খেজুর গাঁজিয়ে সে তার প্রিয় শরবত তৈরি করে। খেজুরের বিচি ভেঙ্গে সে রোজ তার উটকে খাওয়ায়। পানি আর খেজুর মরুভূমির এই দুটি মূল্যবান সম্পদের মালিক হওয়া বেদুঈনের দিনের ধ্যান, রাতের স্বপ্ন।

বেদুঈনের খাদ্যের মত তার কাপড়-চোপড়ও নিতান্ত অল্প। কটিবন্ধযুক্ত একটি লম্বা কামিজ এবং তার উপর একটি দোলায়মান দীর্ঘ জামা। মাথায় দড়িতে বাঁধা একটি চাদর। পাজামা তারা পরে না; পাদুকা দুষ্প্রাপ্য।

আরবের জীব-জানোয়ারের মধ্যে দুটি প্রধান–উট আর ঘোড়া। উট বাদ দিলে মরুভূমিতে বাস করা কল্পনার অতীত। উট বেদুঈনের খাদ্য, তার বাহন, তার মুদ্রা। কনের মোহর, রজের দাম, জুয়ার লাভ, শেখের ঐশ্বর্য সবেরই পরিমাণ উটের সংখ্যা দিয়ে ঠিক করা হয়। উট বেদুঈনের নিত্য সঙ্গী, পোষক পিতা, দ্বিতীয় সত্তা। সে পানির বদলে উটের দুধ খায় পানি রেখে দেয় সে উট, ভেড়া, বকরীর জন্য। সে উটের গোশত্ দিয়ে ভোজের আয়োজন করে, সে উটের চামড়া গায় দেয়–সে উটের পশম দিয়ে তাঁবু তৈরি করে। সে উটের বিষ্ঠা জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে, তার পেশাব দিয়ে চুলের টনিক ও দাওয়াই তৈরি করে। মাথা পরিষ্কারের জন্য ব্যবহার করলে এতে চুলে এক রকম খোশ পয়দা হয় এবং মুখমণ্ডলের উপর তেলের মত লেগে থাকে, যার ফলে মশা মাছি কামড়ায় না। বেদুঈনের কাছে উট কেবল জাহাজ নয়–উট আল্লার খাস নেয়ামত।

আজকের বেদুঈনরাও গর্ভের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় দেয়–’আমরা উটের দেশের মানুষ।’ মুসিল ওয়ালাহ্ বেদুঈনদের সম্পর্কে তার লিখিত গ্রন্থে বলেন : সে কওমে এমন একটি লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, সে কোন না কোন সময় উটের পেটের পানি না খেয়েছে। জরুরী অবস্থায় হয় কোন বুড়ো উটকে জবে করা হয়, না হয় ওকে দিয়ে পানি বমি করার জন্য ওর গলার ভিতর একটা লম্বা কাঠি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। উট দুই-একদিন আগে পানি খেয়ে থাকলে তা মোটামুটি পানের উপযোগী থাকে।

পৃথিবীত আরবই উট পালনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। কাজে কাজেই উট-শিল্প এখনে আয়ের একটি বড় উৎস। আরবের অর্থনৈতিক জীবনে উটের স্থান যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা এ থেকেই বোজা যায় যে, উটের বিভিন্ন জাত, বিভিন্ন রং, বিভিন্ন অবস্থা এবং বিভিন্ন বয়স সম্বন্ধে নাকি আরবী ভাষায় এক হাজার শব্দ আছে। এক তলোয়ার ছাড়া আর কোন কিছুর জন্য ও ভাষায় এত প্রতিশব্দ নাই।

অন্যপক্ষে, ঘোড়া বিলাসের সামগ্রী। ঘোড়ার খাদ্য জোটানো ও যত্ন নেওয়া মরুবাসীর পক্ষে এক সমস্যা। ঘোড়া থাকলেই বুঝতে হবে যে, তার মালিক ধনবান ব্যক্তি। মুসলিম-সাহিত্যে আরবের ঘোড়া অপরূপ খ্যাতি লাভ কলেও প্রাচীন আরবে ঘোড়ার আমদানী হয়েছিল অনেক পরে। খৃস্ট-জন্মের পূর্বে ঘোড়া আরবে আসে। কিন্তু এবার এখানে এসে যাওয়ার পর সে তার রক্তকে সম্পূর্ণ অবিমিশ্র রাখার পুরোপুরি সুযোগ পেয়ে গেল। দৈহিক সৌন্দর্য, সহনশীলতা, বুদ্ধি ও মনিবের প্রতি অগাধ ভালবাসার জন্য আরবের তাজী বিশ্ববিখ্যাত। এইরূপ সংজাত তাজী হতেই পাশ্চাত্য জাতিসমূহ উচ্চবংশীয় ঘোড়া পালনের আইডিয়া ও আদর্শ গ্রহণ করেছে। খৃস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবেরা স্পেনের মারফত ইউরোপে ঘোড়া সরবরাহ করে। বার্বারী ও আন্দালুসীয়ান ঘোড়ার মধ্যে সেই ঘোড়ারই নিদর্শন স্থায়ী হয়ে আছে। ক্রুসেডের আমলে বিলাতী ঘোড়া আরব ঘোড়ার সংশ্রব হতে নতুন রক্ত সঞ্চয় করে।

বেদুঈনের কাছে ঘোড়ার প্রধান মূল্য এই যে, অতর্কিত আক্রমণের সময় ঘোড়ার দ্রুত-গতি তারপক্ষে বিশেষ সহায়ক। খেলা-ধুলা, দৌড় এবং শিকারেও ঘোড়া ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আজকের কোন আরব তাবুতে পানির অভাব হলে শিশুরা পিয়াসে আর্তনাদ করতে পারে, কিন্তু তাবুর কর্তা সে আর্তনাদে বিচলিত হয়ে পানির শেষ ফোঁটাটি পর্যন্ত ঢেলে নিয়ে তার ঘোড়ার সামনে ধরবে।

অতর্কিত আক্রমণকে বেদুঈন ভাষায় গোজওয়া বলে। গোওয়ারে এক হিসেবে লুণ্ঠনাত্মক আক্রমণ বলা যেতে পারে। কিন্তু মরুভূমির আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা গোজওয়াকে এক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। বেদুঈনের এই যে পশু পালন-প্রধান সামাজিক জীবন এর থেকেই গোওয়ার উদ্ভব। মরু-জীবনে যুদ্ধের জোশ মানুষের মনে নিত্য-জাগ্রত। কাজেই গোজওয়া সে জীবনে একটি বীরোচিত পেশা। খৃস্টান কওমেরাও এ পেশা অবলম্বন করত। সেকালের একজন কবি এমন জীবনের নীতি সম্বন্ধে দুই লাইনে সুন্দর বলেছেন :দুশমনের উপর গোজওয়া করা আমাদের পেশা। দুশমন না পেলে আমরা প্রতিবেশীর উপর হামলা চালাই; প্রতিবেশীও না মিলে অগত্যা আমরা ভাইকে আক্রমণ করি।’

গোজওয়া একরকম জাতীয় ক্রীড়া। এই ক্রীড়ার বিধান অনুসারে একান্ত প্রয়োজন না হলে রক্তপাত নিষিদ্ধ। পরিবারে খানেওয়ালার সংখ্যা কমিয়ে রাখার কাজে গোজওয়া খানিকটা সাহায্য করে। তবে এতে খাদ্যবস্তুর মোট পরিমাণ বাড়ে না। দুর্বল কওম অথবা স্থায়ী-বসুয়া কওম অনেক সময় প্রবল প্রতিবেশী কওমকে খাজনা দিয়ে নিরাপত্তা খরিদ করে।

গোজওয়ার অপকারিতা খানিটা প্রশমিত হয় আতিথেয়তার নীতি দ্বারা। দুশমন হিসেবে বেদুঈন যত নির্মমই হোক না কেন, তার বন্ধুত্বের নিয়মের মধ্যে সে একান্ত বিশ্বস্ত ও পরম উদার। প্রাক-ইসলামী যুগে কবিরাই ছিল বড় সাংবাদিক। তারা মেহমানদারীর প্রশংসা কীর্তনে কখনো ক্লান্ত হয় নাই। তারা বলত : মেহমানদারী, ধৈর্য ও মরদামী–এই-ই তো জাতির শ্রেষ্ঠ গুণ। পানি ও ঘাসের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার ফলেই কওমেরা পরস্পর দুশমন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দুর্দমনীয় হিংস্র মরু-প্রকৃতির সামনে মানুষ যে কত অসহায়, এরই উপলব্ধি হতে উদ্ভূত হয় এক পবিত্র কর্তব্য-জ্ঞান-মেহমানদারীর মহান দায়িত্ব। মরুভূমিতে সরাইখানা নাই, হোটেল নাই। সেখানে কোন মুসাফিরকে আশ্রয়দানে অস্বীকার কেবল সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি ও ইজ্জতের হানিকর স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধ কাজ। কারণ, তিনি সকল আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয়দাতা।

কওমী সংগঠন হচ্ছে বেদুঈন সমাজের বুনিয়াদ। একটি তাঁবু মানে একটি পরিবার। একসঙ্গে যতগুলি তবু থাকে, তা নিয় হয় একটি কওম। কয়েকটি আত্মীয় কওম নিয়ে হয় একটি সম্প্রদায়। এক কওমের লোক প্রত্যেক প্রত্যেককে এক রক্তের ভাই বলে মনে করে, এক শেখের আনুগত্য স্বীকার করে এবং এক যুদ্ধ-ধ্বনি করে। কওমের বয়োজ্যষ্ঠ জনকেই সাধারণত কওমের শেখ বা সর্দার করা হয়। গোত্রীয় সংগঠনে রক্তের সম্বন্ধ পরস্পরকে একত্রে বেঁধে রাখে । কোন কওমের এক ব্যক্তির কয়েক ফোঁটা রক্ত চুষে খেলেই সে কমে দাখিল হওয়া চলে।

তাঁবু এবং তাঁবুর ভিতর গিরস্থালীর জিনিষ-পাতি যা থাকে, তা তাঁবুপতির নিজ সম্পত্তি। কিন্তু পানি, ঘাস ও আবাদযোগ্য ভূমি কওমের সাধারণ সম্পত্তি।

কোন কওমে লোক যদি নিজ কওমের কোন লোককে খুন করে, তবে কেউ তার পক্ষে দাঁড়াবে না। যদি সে কওম ছেড়ে চলে যায়, তবে সে আইন বা সমাজ বিরোধী হয়ে পড়ে। যদি কওমের বাইরের কোন লোককে খুন করা হয়, তবে খুনের বদলা দিতে হয়। কওমের যে কোন লোককে নিজ জান দিয়ে সে বদলা দিতে হতে পারে।

মরুভূমির আদিম আইন অনুসারে রক্তের বদলা দিতে রক্ত চাই। প্রতিহিংসা সাধন ছাড়া আর কোন শাস্তিই পর্যাপ্ত নয়। রক্তের কলহ চল্লিশ বছর পর্যন্ত স্থায়ীও হতে পারে। প্রাক-ইসলামী যুগে কওমে কওমে যত লড়াই হয়েছে, তল্কালীন ঐতিহাসিকেরা রক্তের ঋণকে তার আসল কারণরূপে বর্ণনা করেছেন, যদিও অর্থনৈতিক বিবেচনাও নিঃসন্দেহভাবে অনেক লড়াই’র কারণ ছিল।

নিজ কওমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার চেয়ে বড় বিপদ বেদুঈনের জীবনে আর নাই। কারণ, কওমহীন মানুষ কার্যতঃ অসহায় হয়ে পড়ে। তার অবস্থা আইনের আশ্রয়চ্যুত ব্যক্তির অবস্থার মতো–সে আশ্রয় ও নিরাপত্তার সীমার বাইরে চলে যায়।

কওমী জীবন চায় সহযোগী কওমী মানুষের প্রতি শর্তহীন অসীম বিশ্বস্ততা। সে আনুগত্য দানের সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নেয় যে, তার কওম এক স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ ইউনিট। সে বিশ্বাস করে, অন্য প্রত্যেক কওমকে তার লুণ্ঠন ও হত্যা করার সঙ্গত অধিকার আছে। সামরিক ব্যাপারে ইসলাম এ-সব কওমের শক্তি ও দলীয় ঐক্যবোধের সদ্ব্যবহার করেছিল। ইসলাম তার সৈন্যদলকে কওমে কওমে বিভক্ত করত বিজিত দেশে কওমী ভিত্তিতে উপনিবেশ স্থাপনের ব্যবস্থা করত এবং পরাজিত জাতিসমূহের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করত, তাদের আশ্রিত বলে গণ্য করত। ইসলামের অভ্যুদয়ের পর আরব-চরিত্রের ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশ সাধিত হয়েছিল। কিন্তু সে চরিত্র এই কওমী মেজাজ এবং আত্মকেন্দ্রিক জীবনের সমাজবিরোধী বৈশিষ্ট্যসমূহকে সম্পূর্ণরূপে জয় করতে পারে নাই এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের অবনতি ও পতনের এই-ই কারণ ছিল।

কওমের সর্দারকে বলা হয় শেখ। শেখই কওমের প্রতিনিধি। শেখ কওমের বয়োজ্যষ্ঠ ব্যক্তি। তার নেতৃত্ব নির্ভর করে সংযত বিচার-বুদ্ধি, উদারতা ও সাহসিকতার উপর। বিচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং জনসাধরণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে শেখ সর্বময় কর্তা নন-কওমের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন পরিবারের কর্তাদের নিয়ে গঠিত পরামর্শ-সভার সঙ্গে তাকে আলোচনা করতে হয়। শেখের পদের স্থায়িত্ব নির্ভর করে কওমের সদিচ্ছার উপর।

আরব–বিশেষ করে বেদুঈন, জন্ম-গণতন্ত্রী। সে সমান স্তরে দাঁড়িয়ে শেখের সঙ্গে কথা কয়। যে সমাজে তার বাস, সে সমাজ প্রত্যেককে সমান স্তরে নামিয়ে আনে। বর্তমান কালের আগে বিদেশী শাসকদের ছাড়া আর কাউকে আরবরা কখনো মালিক বলে সম্বোধন করে নাই। কিন্তু আরব যেমন গণতন্ত্রী তেমনি আবার আভিজাত্য-প্রিয়। সে নিজকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ গুণান্বিত জীব বলে মনে করে। তার কাছে আরব জাতির মত মহৎ জাতি এ দুনিয়ায় আর নাই। বেদুঈন পরম গর্বের সঙ্গে বিশ্বাস করে যে, সভ্য মানুষ কম সুখী ও অতি নিকৃষ্ট। তার রক্তের পরিবত্রতায়, বাগীতায় এবং কবিত্বে, তার ঘোড়া ও তলোয়ারে সর্বোপরি তার মহান বংশ-মর্যাদায় আরবের গর্বের অন্ত নাই। সে সুদীর্ঘ বংশ-তালিকার কথা আওড়াতে ভালোবাসে এবং অনেক সময়, তার পূর্বপুরুষদের আদম পর্যন্ত নিয়ে ঠেকায়।

ইসলামের আগের জামানা হতে এ-যাবত কাল পর্যন্ত বেদুঈন রমনী যে পরিমাণ স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে, তা তার স্থায়ী বসুয়া বোনের ভাগ্যে ঘটে নাই। সত্য বটে, সে বহু-বিবাহ প্রধান পরিবারে বাস করে আসছে; কিন্তু তবু সে স্বাধীনভাবে স্বামী গ্রহণ করতে পারে এবং সদ্ব্যবহার না পেলে স্বাধীনভাবে স্বামী বর্জন করতে পারে।

সুযোগ পেলে মরু সন্তানেরা অন্য তমদ্দুনও অনায়াসে আত্মস্থ করতে পারে। বহুকালের ঘুমন্ত বৃত্তি উপযুক্ত সাড়া পেয়ে সহসা জেগে ওঠে এদের মাঝে এবং বিপুল শক্তিতে পরিণতি লাভ করে সৃজনশীল অর্ধচন্দ্র এই সুযোগের ক্ষেত্র। এরই প্রভাবে কোন হাম্মুরাবী ব্যাবিলনে আবির্ভূত হয়, কোন মুসাকে (আঃ) পাওয়া যায় সিনাইয়ে, কোন জেনোবীয়ার উত্থান হয় পামীরায়, কোন আরব ফিলীপ দেখা দেয় রোমে, কোন হারুনর-রশীদ জেগে ওঠ বাগদাদে। আর স্ট্রোর মত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। আজো সে স্মৃতিস্তম্ভ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে আছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তার যে অভূতপূর্ব সাফল্য, তার এক মস্ত কারণ ছিল বেদুঈনদের এই ঘুমন্ত শক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *