০২. অন্নচিন্তা

অন্নচিন্তা

আমাদের বৈশেষিকেরা বলেছেন অভাব একটি পদার্থ। এমন সূক্ষ্মদৃষ্টি না থাকলে কি আর তাদের চোখে পরমাণু ধরা পড়ে! আজি এই ঘোরতর অন্নাভাবের দিনে, অভাব যে একটা অতি কঠিন পদার্থ তাতে কে সন্দেহ করে? অথচ এই তত্ত্বটি প্রাচীন আচার্যেরা জেনেছিলেন যোগবলে। কেননা সেকালের ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিতের ঘরে যে অন্নাভাব ছিল না। সে বিষয়ে একালের ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিতেরা একমত, আর বিলাতি সভ্যতাই যে দেশের সমস্ত রকম অভাবের মূল, অর্থাৎ ওই সভ্যতার আমদানির পূর্বে যে দেশে কোনও কিছুরই অভাব ছিল না, এ তো আমাদের সকলেরই জানা কথা। সুতরাং কি ঘরে কি বাইরে, কোনও স্থানেই বৈশেষিক আচার্যের অভাবকে প্রত্যক্ষ করেন নাই। কাজেই সে সম্বন্ধে আঁরা যে তত্ত্বটি প্রচার করেছেন সেটি পুরাণের ভবিষ্যৎরাজবংশাবলির মতো, আর সুশ্রুতের শারীর-স্থান-বিদ্যার মতো সম্পূর্ণ ধ্যানলব্ধ সামগ্ৰী।

কুতার্কিক লোকে হয়তো এইখানে তর্ক তুলবেন যে, বৈশেষিকেরা যে অভাবকে পদার্থ বলেছেন সে অভাবের অর্থ কেবল negation। আর পদার্থ মানে বস্তু নয়, বিলাতি দর্শনে যাকে বলে category তাই। এবং এই তত্ত্বটির অর্থ মাত্র এই যে অভাব বা negation মনন-ব্যাপারের অর্থাৎ thought-এর একটা necessary ক্যাটিগরি। কিন্তু এই তর্ক আর কিছুই নয়, এ হল হিন্দু-দর্শনের পবিত্র মন্দিরেও স্লেচ্ছ সংস্পৰ্শ ঘটিয়ে তার জাত মারবার চেষ্টা। নিশ্চয় জানি, কোনও খাঁটি হিন্দু এ-সব তর্কে কান দেবেন না। সুতরাং এ তর্কের উত্তর দেওয়া নিম্প্রয়োজন।

প্রাচীনকালে যে ভারতবর্ষে অন্নাভাব ছিল না তার একটি অতি নিঃসংশয় প্রমাণ আছে। মাধবাচাৰ্য তার সর্বদর্শন-সংগ্রহে ছোট-বড় সমস্ত রকম দর্শনের বিবরণ দিয়েছেন। একটি পাণিনিদর্শনের বর্ণনা আছে, যাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে ব্যাকরণশাস্ত্ৰই পরম পুরুষার্থের সাধন, ওই শাস্ত্রে পারদশী না হলে সংসার-সাগর পারের আশা দুরাশা এবং ওই শাস্ত্ৰই মোক্ষমার্গের অতি সরল রাজপথ। এমনকী একটি রসেশ্বর-দর্শন আছে, যাতে যুক্তি এবং শ্রুতি উভয় প্রমাণেই প্ৰতিপাদিত হয়েছে যে রস বা পারদই পরব্রহ্ম। রসার্ণব, রাসহাদয় প্রভৃতি প্রামাণিক দার্শনিক গ্ৰন্থ থেকে যুক্তি-প্রমাণ উদ্ধৃত হয়েছে; এবং রসজ্ঞেরা শুনে খুশি হবেন, যে শ্রুতি-প্রমাণটি আহত হয়েছে সেটি তাদের সুপরিচিত ‘রসো বৈ সঃ রসো হোবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি’ এই শ্রুতিবাক্য। এমন পুথিতেও অন্নদর্শন বলে কোনও দর্শনের বিবরণ দূরে থাক নাম পর্যন্ত নেই। এ থেকে কেবল এই অনুমানই সম্ভব যে, প্রাচীনকালে এদেশে আন্নাভাব না থাকায় অন্নচিন্তাও ছিল না, এবং বিষয়টা সম্বন্ধে একবারে চিন্তার অভাবেই এ বিষয়ে কোনও দর্শনের উদ্ভব হয়নি। কেননা ও-বিষয়ে কিছুমাত্র চিন্তা থাকলে যে তার একটা দর্শনও থাকত, তাতে বোধ হয় যে প্রমাণ দেখিয়েছি তারপর আব্ব কোনও বুদ্ধিমান লোকে সন্দেহ করবেন না। এবং আমার এই যুক্তিটি যে সম্পূর্ণরূপে ‘বিজ্ঞানানুমোদিত ঐতিহাসিক প্রণালী সম্মত তাও নিশ্চয়ই সকলেই স্বীকার করবেন।

কিন্তু যখন বৈজ্ঞানিক-ঐতিহাসিকের উচ্চাসন একবার গ্রহণ করেছি তখন কোনও সত্যই গোপন করলে চলবে না। অগ্ৰীতিকর হলেও সমস্ত কথাই প্রকাশ করে বলতে হবে! অপ্ৰাচীন দার্শনিক যুগে যে দেশে আন্নাভাব ও অন্নচিন্তা ছিল না। এ বিষয়ে সর্বদর্শন-সংগ্রহের প্রমাণ অকাট্য। কিন্তু ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে যে খুব প্রাচীন অর্থাৎ বৈদিক যুগে কিছু কিছু অন্নাভাব ছিল। কেননা শ্রুতিতে অন্ন সম্বন্ধে আলোচনা দেখা যায়। এর বিস্তৃত প্রমাণ দেওয়া অনাবশ্যক। একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ধরুন তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভৃগু-বরুণের উপাখ্যান। বরুণের পুত্ৰ ভৃগু যখন পিতার কাছে ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে উপদেশ জিজ্ঞাসা করলেন তখন বরুণ তাকে বলেন তপস্যার দ্বারাই ব্ৰহ্মকে জানা যায়, তুমি তপস্যা করো। তবে সুবিধার জন্য ব্রহ্মের সম্বন্ধে একটা ‘ফরমুলা’ বলে দিলেন, ‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে’ ইত্যাদি। তপস্যা করে ভৃগু জানলেন অন্নই ব্ৰহ্ম। অন্ন থেকেই সকলের জন্ম হয়, জন্মের পর অন্নের বলেই সকলে বেঁচে থাকে, অন্নের দিকেই সকলের গতি এবং শেষে অন্নেই সবাই লীন হয়, অতএব অন্নই ব্ৰহ্ম। ভৃগু এই জ্ঞানটুকু লাভ করে পিতার কাছে গেলে বরুণ তাকে আবার তপস্যা করতে বললেন। দ্বিতীয়বার তপস্যায়। ভৃগুর বোধ হল প্ৰাণই ব্ৰহ্ম। এইরকমে তৃতীয়বারে জানলেন মনই ব্ৰহ্ম। চতুর্থবারে বুঝলেন বিজ্ঞানই ব্ৰহ্ম। অবশেষে শেষবার তপস্যায় এই জ্ঞানে পৌছিলেন যে আনন্দই ব্ৰহ্ম। এই হল ভৃগু-বরুণের গল্প, যাকে বলে ‘ভার্গবী বারুণী বিদ্যা’। এই শ্রুতি সম্বন্ধে শঙ্কর ও অন্যান্য ভাষ্যকারেরা নানা তর্ক তুলেছেন, ‘পঞ্চকোষ বিবেক’ ও ওইরকম সব দুর্বোধ্য জটিলতার অবতারণা করেছেন। কিন্তু এর প্রকৃত অথচ সহজ ইঙ্গিতটি কেউ ধরতে পারেননি। এই উপাখ্যানের প্রকৃত তাৎপর্য কি এই নয় যে গোড়ায় অন্ন থাকলে তবেই শেষ পর্যন্ত আনন্দ পাওয়া যায়! ইহাই যে শ্রুতির প্রকৃত মর্ম ও শিক্ষা তাতে আমার বিন্দুমাত্ৰ সংশয় নেই এবং একটু বিচার করে দেখলে বোধ হয় পাঠকেরও কোনও সন্দেহ থাকবে না। কেননা উপাখ্যানটি শেষ করেই শ্রুতি চারটি পরিচ্ছেদে কেবল অন্নেরই প্ৰশংসা করেছেন। এবং তার মধ্যে এমন সব শ্রুতি আছে যাতে যে-কোনও ইকনমিস্টের’ প্ৰাণ আহ্বাদে নৃত্য করে উঠবে। প্রকৃত ব্যাপারটা এই যে উপাখ্যানটি পড়লেই বিংশ শতাব্দীর জ্ঞানের উজ্জ্বল আলোতে ওর প্রকৃত অর্থটা স্পষ্ট ধরা পড়ে; এবং শঙ্কর প্রভৃতি প্রাচীন দার্শনিকেরা কেন যে ওর যথার্থ মর্ম বুঝতে পারেননি তার কারণও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্বেই প্রমাণ করেছি যে ওই সব দার্শনিকদের সময়ে কোনও অন্নাভাব ও অন্নচিন্তা ছিল না। এবং তাদের যে-কোনও historical sense বা ‘ঐতিহাসিক অনুভূতি’ ছিল না তা যার ওই sense বিন্দুমাত্র আছে তিনিই জানেন। সেইজন্য বৈদিক সময় যে তাঁহাদের সময়ের চেয়ে কিছুমাত্র অন্যরকম ছিল এটা তাঁরা কল্পনাই করতে পারতেন না। ফলে বর্তমান কালে আমরা যে higher criticism বা ‘উচ্চতর অঙ্গের সমালোচনা’র বলে প্রাচীনকালের মনের কথাটা একেবারে ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারি, শঙ্কর প্রভৃতির সে সামর্থ্য ছিল না। অবশ্য ওই সমালোচনা-প্ৰণালীর নামের higher বিশেষণটা যাঁরা ও-প্রণালীটা প্রবর্তন করেছেন তাঁরাই দিয়েছেন, কিন্তু সত্যের খাতিরে বিনয়কে উপেক্ষা করবার মতো সৎ সাহস তাদের সকলেরই ছিল।

যাহোক পূৰ্ববতী আলোচনার ফলে এটা বেশ জানা গেল যে বৈদিক সময়ের পরে আর অন্নচিন্তায় আমাদের পূর্বপুরুষেরা বড় মাথা ঘামাননি। তাঁরা ব্ৰহ্মসূত্র রচনা করেছেন এবং কামসূত্রেরও অনাদর করেননি, কিন্তু মাঝখান থেকে অন্নসূত্রটা একেবারে বাদ দিয়েছেন। এর ফলভোগ করছি আমরা, তাদের এ যুগের বংশধরেরা। আমাদের অন্নের অভাব অত্যন্ত বেশি, এবং কীসে ও বস্তুটার কিছু সংস্থান হয় তার একটা মোটামুটিরকম মীমাংসারও বিশেষ প্রয়োজন; কিন্তু বহুযুগের বংশানুক্রমিক অনভ্যাসের ফলে ও-সম্বন্ধে চিন্তা বা আলোচনা করতে গেলেই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তখন আমরা কে যে কী বলি তার কিছু ঠিক থাকে না। সেইজন্য আমাদেব বাংলাদেশে দেখা যায়, যিনি আইনের বিদ্যা ও বক্তৃতা বেচে টাকা জমিয়েছেন, তিনি সভায় দাঁড়িয়ে বাঙালির ছেলেকে ইস্কুল-কলেজে বৃথা সময় নষ্ট না করে চটপট ব্যাবসা-বাণিজ্যে লেগে যেতে খুব জোরালো বক্তৃতা দেন। অবশ্য সেই ব্যাবসাবাণিজ্যের মূলধনের জন্য তাঁর জমানো টাকার কোনও অংশ পাওয়া যাবে না, কেননা তাঁর যে বংশধর ওকালতি করবে। কিন্তু উপার্জন করবে না তার জন্য সেটা সঞ্চিত থাকা নিতান্ত দরকার। এবং বলা বাহুল্য, যে ‘শিল্প-বাণিজ্যে না ঢুকে’ ‘লেখাপড়া শিখে চাকুরি খুঁজে বেড়ায় বলে’ বাংলার যুবকেরা লেখায় ও বক্তৃতায় হিতৈষীদের গঞ্জনা শুনছে, সেই শিল্প ও বাণিজ্য দেশের কোথায় যে তাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে সেটা তাদের দেখানো কেউ প্রয়োজন মনে করিনে। ভাবটা এই যে না-ই বা থাকল বাঙালির ছেলের মূলধন, না-ই বা থাকিল দেশে তাদের জন্য কোনও শিল্প-বাণিজ্য, তাঁরা কেন প্রত্যেকেই বিনা মূলধনে আরম্ভ করে নিজের চেষ্টায় এক একটা শিল্পের বড় বড় কারখানা গড়ে তোলে না, বড় রকম ব্যাবসার মালিক হয়ে বসে না। কেননা কোনও কোনও দেশে কোনও কোনও লোক যে কদাচিৎ ওইরকম ব্যাপার করেছে, তা তো পুথিতেই লেখা আছে। তারপর আমাদের এই অন্নসমস্যার সমাধানের জন্য ইস্কুল-কলেজ সব তুলে দিয়ে সে জায়গায় কৃষিপরীক্ষাশালা ও শিল্প-বিদ্যালয় খোলাই যে একমাত্র উপায় সে বিষয়ে কেউ যুক্তি-তৰ্ক দেখান; আর যাঁরা কাজের লোক তাঁরা যে-হয় কোনও ছেলেকে, যা-হোক কিছু একটা শিখে আসবার জন্য, যে একটা হোক বিদেশে যাওয়ার জাহাজ-৬াড়া সাহায্যের জন্য চান্দার খাতায় স্বাক্ষর করাতে আরম্ভ করেন। আর এ যুগের বাঙালির ছেলেও হয়েছে এক অদ্ভুত জীব। বর্তমানে ধনে-জনে যে জাতি পৃথিবীর মাথাব্য বসে আছেন শোনা যায়, বুকের মধ্যে র্তাদের হৃৎপিণ্ডে পৌছিতে হলে তাদের গায়ের জামার অংশবিশেষের ভিতর দিয়েই তার সোজা, এবং মন্দ লোকে বলে একমাত্র পথ। বাঙালির ছেলের অবস্থাটা ঠিক উলটো। নিজের পকেট সম্বন্ধেও খুব বেশি সজাগ ও উৎসাহান্বিত করতে হলে, এদের একেবারে বুকের মধ্যে ঘা না দিলে কোনওই ফল পাওয়া যায় না। দেশি শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া যে দেশের ধনবৃদ্ধির ও ধনরক্ষার জন্য একটা ‘টারিফের’ প্রাচীর মাত্র, ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’ নামক বিজ্ঞানশাস্ত্রের যুক্তি-তর্ক এবং মহাজনের খাতার হিসাব-নিকাশেরই বিষয়, তা এরা কিছুতেই বুঝতে চায় না, এবং বুঝলেও তাতে কোনও ফল হয় না। এরা চায় গান আর কবিতা, যার বিষয় হচ্ছে দেশের উত্তরের হিমালয়ের মাথার বরফের মুকুট, দক্ষিণের নীল সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গ, এবং যখন সমস্ত পৃথিবী মুক ছিল তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে সামগানে সিন্ধু সরস্বতীর তাঁর ধবনিত করেছিলেন, সেই কাহিনি। অথচ এরা যে হাতেকলমে কাজে লাগতে পারে না বা কাজ উদ্ধার করতে পারে না, এমন নয়। এরা অর্ধোদয়-যোগে দেশের দীনতমকেও নারায়ণের পূজায় সেবা করে এবং শৃঙ্খলার সঙ্গেই করে; বন্যার জলে চালের বস্তা পিঠে নিয়ে সাঁতার দেয়, এবং কোনও ডিপার্টমেন্টের বিনা চালনায় অনুষ্ঠানটি যেমন করে নির্বাহ করে, তাতে কাজের চেয়ে কাজের শৃঙ্খলাই যাদের গর্বের প্রধান বিষয়, সেই ‘ডিপার্টমেন্টের’ কর্তাদেরও কতক বিস্ময় কতক সন্দেহের উদ্রেক হয়; জাতির একটা দুর্নােম ঘোচাবার জন্য এরা তুর্কির গুলিতে টাইগ্রিসের তীরে প্রাণ দিতে রাজি হয়, এবং তার শিক্ষানবিশিতে পুব-পশ্চিমের কোনও জাতির চেয়ে কম পটুতা দেখায় না। কিন্তু এ তো অতি স্পষ্ট যে এ সকলই কেবল ভাবের খেলা, এর মধ্যে বস্তুতন্ত্রতা কিছুই নেই। প্রকৃত কাজের বেলায় এদের চরিত্রে কোনও গুণই দেখা যায় না। এরা কিছুতেই উপলব্ধি করে না যে খুব দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা ও একনিষ্ঠার সঙ্গে আরম্ভ করে, সংসারযুদ্ধে জয়ী হয়ে দশের এক হওয়াই সবচেয়ে বড় কাজ, চরিত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সেইজন্য যদিও বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষার পুথিতে এদের সেই সব মহাপুরুষদের জীবনী পড়ানো হয় যাঁরা খুব হীন অবস্থা থেকে পরিশ্রম, অধ্যবসায় প্রভৃতি বহু সদগুণের সদ্ব্যবহারে নিজেদের অবস্থা খুব বেশিরকম ভাল করেছিলেন; এবং ইংরেজি হাতের লেখা লিখতে আরম্ভ করেই সময় আর টাকা যে একই জিনিস কপিবুক’ থেকেই এরা সে অদ্বৈতজ্ঞান লাভ করে, তবুও কিছু বড় হলেই এই পুস্তকস্থা-বিদ্যার ফল এদের স্বভাবে কিছু দেখা যায় না। তখন বাল্যশিক্ষার পুথির মহাজনদের অনুরূপ যে সব কৃতকর্মী পুরুষ, সমাজে সশরীরেই বর্তমান এরা তাদের কোনও খবরই বাখে না, এমনকী তাঁরা দেশের রাজার কাছে খুব উঁচু সম্মান পেলেও নয়। যাঁরা কেবল কথার সঙ্গে কথা গাঁথতে পারে, বা লজ্জাবতীর পাতায় তামার তার জড়ায়, এরা তাদের নিয়েই অসঙ্গতারকম হইচই করে। অন্নচিস্তায় যে এরা কাতর নয়, কি অন্নচেষ্টা যে এদের উত্তেজিত করে না তা নয়। সে চিন্তায় এরা যথেষ্টই ক্লিষ্ট; সে চেষ্টায় এরা অনেক দুঃখ, অনেক অপমানই সহ্য করে। কিন্তু সে-সব সত্ত্বেও ওই চিন্তা আর ওই চেষ্টাকেই পরমোৎসাহে সমস্ত মন দিয়ে বরণ করে নিতে কিছুতেই এদের মন সরে না। এদের ভাব কতকটা এইরকম যে রোগ যখন হয় তখন ডাক্তারও ডাকতে হয়, ঔষধও গিলতে হয় এবং হাঙ্গামও কিছু কম হয় না। এবং যে চিররোগী, সমস্ত জীবনই বাধ্য হযে তাকে এই হাঙ্গাম সইতে হয়। কিন্তু তাই বলে রোগের চিকিৎসাকেই সবচেয়ে বড় উৎসাহের ব্যাপার করে তোলা সম্ভবপর নয়।

আমরা বাংলাদেশের ছেলে বুড়ো অন্নচিন্তার ব্যাপারে সবাই যে এই সব আশ্চর্য ও অস্বাভাবিক কাণ্ড করি, পূর্বেই বলেছি। এতে আমাদের দোষ কিছু নেই। দোষ পূৰ্বপুরুষদের যাবা ও-সম্বন্ধে সুচিস্তা ও মনের কোনও স্বাভাবিক ঝোক রক্ত-মাংসের সঙ্গে আমাদের দিয়ে যেতে পারেননি। এই দায়িত্বহীনতার সাহসেই এই প্ৰবন্ধও শুরু করেছি। কেননা জানি, বেফাঁস কথা যা কিছু বলব তাতে আমার নিজের দায়িত্ব কিছুই নেই। দায়ী সেই পিতৃপুরুষেরা যাঁরা পিণ্ডের আশা করেন। কিন্তু পিণ্ডের অন্ন সম্বন্ধে একনিষ্ঠ হয়ে চিন্তা করবার মতন মনের বা মগজের অবস্থা নিজেদের না থাকায় আমাদেরও দিয়ে যেতে পারেননি।

 

দেশের প্রাচীন আচার্যেরা যখন অন্ন সম্বন্ধে চিস্তাই করেননি, তখন সে চিস্তায় কিছু সাহায্য পেতে হলে পশ্চিমের আধুনিক যবনাচাৰ্যদের কাছেই যেতে হয়। এঁদের মধ্যে একদল আছেন যাঁরা অন্ন-জিজ্ঞাসারই একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্র গড়ে তুলেছেন। কিন্তু অন্ন সম্বন্ধে যিনি সবচেয়ে ব্যাপক অথচ গভীরভাবে চিস্তা করেছেন তিনি এই অন্নশাস্ত্রের শাস্ত্রী নন, তিনি একজন প্ৰাণতত্ত্ববিদ আচাৰ্য, নাম চার্লস ডারউইন। ভূগু-বরুণ প্রসঙ্গের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে অন্নতত্ত্বের এক ধাপ উপরে উঠলে পাই প্ৰাণতত্ত্ব। সুতরাং প্রাণতত্ত্বজ্ঞ ডারউইন যে তার উপরের ধাপ থেকে অন্নের লীলা ব্যাপকতর ও স্পষ্টতরভাবে প্ৰত্যক্ষ করবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

ডারউইন পূর্বাচার্যদের কাছ থেকেই অন্নপ্ৰাণ-বিদ্যার এই বীজমন্ত্রটি পেয়েছিলেন যে পৃথিবীতে যত প্ৰাণী জন্মে তাদের সকলের প্রাণরক্ষার উপযোগী পৰ্যাপ্ত অন্ন বসুমতী জোগাতে পারেন না। কিন্তু এই প্রাচীন মন্ত্রই বহু বৎসর ধরে একান্ত নিষ্ঠা ও কঠোর সংযমেব সঙ্গে জপ করতে করতে পূর্বে যা কারও ভাগ্যে ঘটেনি তার সেই সিদ্ধি লাভ হল। অন্ন তার অদৃষ্টপূর্ব বিশ্বরূপ ডারউইনকে দেখালেন। তিনি দেখলেন স্থলে, জলে, আকাশে—-অরণ্যের ছায়ায়, মরুভূমির প্রান্তে, গাছের শাখায়, পর্বতের গহ্বরে, সমুদ্রের তলে, হ্রদের বুকে–অন্নের জন্য প্ৰাণের এক অবিশ্রান্ত দ্বন্দ্ব চলেছে। অন্ন পরিমিত, তার আকাঙ্ক্ষী জীব সংখ্যাহীন। এই পরিমিত অন্নকে আয়ত্ত করার জন্য প্ৰাণীতে প্ৰাণীতে, উদ্ভিদে উদ্ভিদে, উদ্ভিদে প্ৰাণীতে যে দ্বন্দ্ব, তা যেমন বিরামহীন তেমনি মমতাহীন। এ দ্বন্দ্বে কেহ কারও সহায় নয়। এ হল সকলের সঙ্গে প্ৰত্যেকের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কখনও প্রকাশ হচ্ছে প্ৰকাশ্য যুদ্ধের রক্তোচ্ছাসে, কখনও নিঃশব্দে চলেছে। নীরব রক্তশোষী প্ৰতিযোগিতার আকারে। কোনটা বেশি ভয়ানক বলা কঠিন। অন্ন তার মোহিনী মূর্তিতে প্ৰাণকে আকর্ষণ করেছেন, আর আকৃষ্ট প্রাণীকে মহাকালের মূর্তিতে সংহার করছেন। শেষ পর্যন্তও যাদের উপর প্রসন্ন দৃষ্টি রাখছেন সেই ভাগ্যবানদের সংখ্যা অতি সামান্য। মৃত্যুর মরুভূমির উপর দিয়ে অন্ন তার সম্মোহন শঙ্খ বাজিয়ে চলেছেন। প্রতি মুহূর্তে প্ৰাণের জোয়ারে দুকুল ছাপিয়ে উঠছে, কিন্তু সে উচ্ছাস দু’পাশের তপ্ত বালুতেই শুষে নিচ্ছে। প্ৰাণের একটা অতি ক্ষীণ ধারা কোনওরকমে শেষ পর্যন্ত অন্নের পিছনে পিছনে চলেছে।

অন্নের এই মোহিনীমহাকালের যুগলমূর্তি দর্শন করে ডারউইন কাল জয় করে আমর হয়েছেন। কিন্তু প্ৰাণের সঙ্গে অন্নের লীলার এখানেই শেষ নয়। প্ৰাণের ধারা চলতে চলতে একদিন মানুষে এসে ঠেকল। পৃথিবীতে প্ৰাণের ক্রমবিকাশ হতে হতে একদিন তা মানুষের মূর্তি নিয়ে প্রকাশ হল। কেমন করে হল সে কথা পণ্ডিতদের তর্ক-কোলাহলে অপণ্ডিত সাধারণের কানে আসা দুঃসাধ্য; তাতে আমাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এবার যে বিগ্রহে প্ৰাণের প্রতিষ্ঠা হল, সে বিগ্ৰহ অতি মনোরম, অতি বিস্ময়কর। তার সুঠাম, সরল, উন্নত দেহ, তার বন্ধনহীন মুক্ত বাহু, তার সতেজ ইন্দ্ৰিয়, তার সবল, অনাড়ষ্ট মাংসপেশি সবই যেন স্পষ্ট করে বলে দিল যে এ বিগ্রহ অরণ্যে পড়ে থাকবার নয়, এর জন্য একদিন সোনার দেউল গড়া হবেই হবে। তবুও প্রাণের এই প্রকাশের সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার তার এই মূর্তি নয়। তার চেয়েও লক্ষগুণে আশ্চর্য এক ব্যাপার সংঘটিত হল। যেমন বোধ হয় পৃথিবীতে প্রাণের যাত্রারম্ভের সঙ্গেই তার সাথে ছিল, অতি ক্ষীণ অদৃশ্যপ্রায় অবস্থা থেকে নানা মূর্তির মধ্য দিয়ে অতি ধীরে ধীরে ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, মানুষের মূর্তিতে পৌঁছে সে একবারে দীপ্ত সূর্যের মতন জ্বলে উঠল। তার উজ্জল দীপ্তিতে মানুষ পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখল যে এ বিপুল ধরিত্রী তারই রাজত্ব।

অন্ন তাঁর নিজের শক্তি সেইদিন পূর্ণরূপে উপলব্ধি করলেন যেদিন এই মানুষও, রাজটীকা ললাটে নিয়ে, কঙালের মতো তাঁর পিছু পিছু পৃথিবীময় ছুটে বেড়াতে লাগল। একটা ফলের জন্য দশটা গাছের তলায়, একটা শিকারের খোঁজে এক অরণ্য হতে আর এক অরণ্যে ঘুরে ঘুরে, পরে অন্নকে কিছু সুলভ করে একটু সুস্থির হওযার চেষ্টায় গোটাকয়েক প্রাণীকে যদি পোষ মানােল, তবে সেই প্রাণীরূপ অন্নের অন্ন খুঁজতে এক দেশ হতে আর এক দেশে চলতে চলতে তার পায়ে ব্যথা ধরে উঠল। এই অজ্ঞাতবাসের দুঃসহ দৈন্যে মানুষের বহুযুগ কেটে গেল। শেষে এক দিন পরম শুভক্ষণে ক্লান্তদেহ, ক্ষুব্ধ চিত্ত মানুষ বলে উঠল। আর অন্নের আশায় তার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াব না, অন্নকে সৃষ্টি করব, স্বল্প অন্নকে বহু করব। সেদিন নিশ্চয়ই স্বর্গের তোরণে মঙ্গলশঙ্খ বেজে উঠেছিল; দিব্যাঙ্গনারা মর্ত্যচক্ষুর অদৃশ্য হেমঘটে অভিষেকবারি এনে মানুষের মাথায় ঢেলেছিলেন; ইন্দ্ৰদেব এসে সোনার রাজমুকুট তার মাথায় পরিয়েছিলেন; আর সমস্ত আকাশ ঘিরে দেবতারা প্ৰসন্ন নোত্রে দীর্ঘ বনবাসের পরে মানুষের নিজ রাজ্যে অভিষেক চেয়ে দেখেছিলেন।

কৃষি আরম্ভ হল। প্ৰাণের ধাপ থেকে মনের ধাপে উঠে মানুষ দেখল যে এখানে দাড়ালে অন্ন এসে আপনিই হাতে ধরা দেয়, তাকে পৃথিবীময় খুঁজে বেড়াতে হয় না। এখানে বসে তপস্যা করলে কালো মাটির বুক চিরে সোনার ফসল বাইরে এসে পৃথিবী ঢেকে ফেলে; দিনের অন্ন দিন খুঁজে প্ৰাণাস্ত হতে হয় না। মানুষ জানল, ‘পৃথিবী বা অন্নম, পৃথিবীই অন্ন। মাটির তলে জলের অফুরন্ত ধারার মতো মাটির মধ্যে অন্নেরও অফুরন্ত ভাণ্ডার লুকানো আছে, লাঙলের ফালে তাকে তুলে আনতে জানলে অন্নের দৈন্য দূর হয়; যে মন্ত্র ডারউইন জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে প্ৰত্যক্ষ করেছিলেন তার শক্তিকে ব্যর্থ করা যায়। মাটির সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সম্বন্ধ স্থাপন হল। মাটির টানে উদ্রান্ত বনাচারী গৃহী হল। সেইদিন মানুষের স্বদেশ, সমাজের প্রতিষ্ঠা হল, মানুষের গ্রাম নগর গড়ে উঠল, শিল্প বাণিজ্যের শুরু হল। পৃথিবীর আদিম অরণ্য কেটে সভ্যতার সোনার মন্দিরে মানুষের প্রতিষ্ঠা হল।

কিন্তু প্ৰাণের ভূমি থেকে আরম্ভ করে মানুষের এই যে যাত্রা, এখানেই তার শেষ হয় নাই। মন যখন সৃষ্টির ক্ষমতায় পরিমিত অন্নকে বহু করে অন্নের দাসত্বের লোহার বেড়ি মানুষের পা থেকে খুলে নিল, বিরামহীন অন্নচেষ্টা থেকে তাকে মুক্তি দিল, তখনই মানুষের স্বভাবের যেটি পরমাশ্চর্য অংশ, সেটির বিকাশ হল। মানুষ দেখল যে কেবল অন্নে তার তৃপ্তি নাই, তার পরিমাণ যতই অপৰ্যাপ্ত হোক, তার প্রকার যতই বিবিধ হোক। প্ৰাণের তাড়নায় অন্নের খোঁজে আকাশ, বাতাস, পৃথিবীকে জানতে আরম্ভ করে মানুষ বুঝল যে তার স্বভাবে একটা কী আছে যেটা কেবল জানার দিকে তাকে ঠেলে দেয়। অন্নের সৃষ্টি আরম্ভ করে সে জানল যে তার প্রকৃতির যেটা অন্তরতম অংশ, সেটা কেবল সৃষ্টির আনন্দেই সৃষ্টি করে যেতে চায়। মানুষ যেন প্রাণীরাজ্যের রাজা হলেও অপ্ৰাণ-লোকেরই অধিবাসী। সে যেন বিদেশি রাজপুত্ৰ পরদেশে এসে রাজত্ব পেয়েছে, কিন্তু তার অন্তরাত্মার নাড়ির টান স্বদেশের দিকেই। প্রাণের জগতে মানুষের এই যে উদ্দেশ্যহীন জানা আর অনাবশ্যক সৃষ্টি তাই হল তার বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, কাব্য, কলা, শিল্প। মানুষের প্রাণ বলে এদের মূল্য এক কানা কড়িও নয়; তার অন্তর জানে এরাই তার যথাসর্বস্ব, অন্নের চেয়েও কাম্য, প্ৰাণের চেয়েও প্রিয়।

এই হল মানুষের সভ্যতার অন্ন আর প্রাণের ভূমি থেকে মনের সিঁড়ি দিয়ে বিজ্ঞান আর আনন্দলোকে যাত্রার ভ্রমণ-কাহিনি। এই লোকে পৌছিলেই অন্নের দাসত্ব থেকে মানুষের যথার্থ মুক্তি। মানুষ যদি কেবল অন্নকে আয়ত্ত করেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারত তা হলে অন্নদাস হলেও মানুষের জীবনে তার সর্বব্যাপী প্রভুত্বের কোনও অপচয় হত না। সোনাব শিকলে অন্নকে বাধলেও শিকলের অন্য দিকটা মানুষের গলাতেই পরানো থাকত, অন্নের টানে পৃথিবীময় না ঘুরতে হলেও সারাক্ষণ অন্নকে টেনেই পৃথিবীতে চলতে হত। এই বিজ্ঞান আর আনন্দলোকে পৌছিতে জানলেই মানুষের গলা থেকে এই অন্নের শিকল খোলার উপায় হয়। আমাদের ঋষিরা সংসারচক্র থেকে জীবের মুক্তির কথা বলেছেন। এই হল মানুষের সভ্যতার অন্নচক্র থেকে মুক্তির পথ।

 

যদি কারু মনে হয় যে মনের বলে মানুষের আয়ত্ত হয়ে, তাকে বিজ্ঞান আর আনন্দোব পথেব যাত্রী দেখে, মানবজীবনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে, অন্ন চিবদিনের জন্য নিশ্চেষ্ট হয়ে গেছে, তবে তিনি অন্নের প্রভাব এবং মাহান্ত্র্যের কথা কিছুই জানেন না। মানুষেব সভ্যতার যে যে মুক্তির কথা বলেছি সে হল শাস্ত্রে যাকে বলে জীবন্মুক্তি, অর্থাৎ দেহও আছে, মুক্তিও হয়েছে। সুতরাং মানুষের দেহ আর প্রাণ যখন আছে তখন তার অন্নের উপর একান্ত নির্ভর আছেই আছে। এই ছিদ্র ধরে অন্ন অতি নিপুণ সেনাপতির মতো এক নূতন পথ দিয়ে তার বল চালনা করে মানুষকে বন্দি করবার চেষ্টা করেছে। প্রাচীন দ্বন্দ্বটা চলেছে, কেবল অবস্থার পরিবর্তনে ‘ষ্ট্র্যাটেজি’র প্রভেদ ঘটেছে মাত্র।

যতদিন মানুষ কেবল প্ৰাণী ছিল, তার মনের পূর্ণ বিকাশ হয়নি, বিজ্ঞান ও আনন্দলোকের বার্তা তার অজ্ঞাত ছিল, ততদিন অন্নের দৃষ্টি ছিল মানুষের প্রাণের উপর। যেমন ইত্যর প্রাণীকে তেমনি মানুষকেও নিজের রথের চাকায় বেঁধে, অন্ন তার জীবন-মৃত্যুর উপব কর্তৃত্ব করত। এই যুদ্ধে অন্ন জয়ী হয়েছিল নিজেকে বিরল করে, আপনাকে দুর্লভ করে। মানুষের মন যখন অন্নকে বহু ও সুলভ করে এই উপায়টা ব্যর্থ করল সেইদিন থেকে অন্নের দৃষ্টি পড়েছে মানুষের বিজ্ঞান ও আনন্দলোকের দিকে। অন্ন জানে যে ওরাই তার প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী মানুষের জীবনে যদি ওদের আবির্ভাব না হত, তা হলে নামে প্ৰভু হলেও রোমের শেষ সম্রাটদের মতো মানুষ দাস অন্নের দাসত্বই করত। কাজেই অন্নেরা এখন চেষ্টার বিষয় হয়েছে মানুষের সভ্যতার ওই বিজ্ঞান আর আনন্দের লোকটা ধ্বংস করা। আর প্রাণকে আয়ত্ত করার প্রাচীন চেষ্টার ব্যর্থতার মধ্যেই অন্ন এই নূতন যুদ্ধের অস্ত্ৰ খুঁজে পেয়েছে। দুর্লভ অন্নকে বহু করে মানুষ সভ্যতা গড়েছে। এই বহু অন্ন অসংখ্য মােহিনী মূর্তিতে মানুষকে ঘিরে তার বিজ্ঞান আর আনন্দলোকের পথরোধের চেষ্টা করছে। বিরলতার ক্ষয়রোগে মানুষের সভ্যতাকে ধবংস করতে না পেরে বাহুল্যের মেদরোগে তার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়াটা বন্ধ করবার চেষ্টা দেখছে। অন্ন এখন মহাকালের মূর্তি ছেড়ে কুবেরের মূর্তি ধরেছে। মানুষের কত সভ্যতা মহাকালের করােল দংষ্ট্রা হতে উদ্ধার পেয়ে স্কুলোদর ভোগপ্ৰসন্নমুখ কুবেরের মেদপুষ্ট বাহুর আলিঙ্গনের মধ্যে নিশ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরেছে!

মানুষের সভ্যতার সঙ্গে অন্নের এই দ্বন্দ্ব নূতন নয়, এ দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। সভ্যতার সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই এ দ্বন্দ্বেরও আরম্ভ হয়েছে এবং বোধ হয় শেষ পর্যন্তই চলবে। কখনও সভ্যতা জয়ী হয়েছে, কখনও বা অন্নেরই জয় হয়েছে। মানুষে মানুষে শেষ যুদ্ধের বর্তমান কল্পনার মতো এ যুদ্ধের শেষ কল্পনাও হয়তো কেবল স্বপ্ন। হয়তো মানুষের সভ্যতাকে চিরদিনই এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে উঠে পড়ে চলতে হবে।

এই চিরন্তন দ্বন্দ্বের মধ্যে মানুষের সভ্যতা রক্ষা পেয়েছে, কেননা যুগে যুগে এমন সব জাতি উঠেছে। যাঁরা অন্নের মায়াকে অতিক্রম করে আনন্দের পথে চলতে পেরেছে। ভুল হতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস আধুনিক বাঙালি সেই সব জাতির অন্যতম। সভ্যতার এই প্রাচীন যুদ্ধে নবীন সেনাপতি হবার যোগ্যতা এদের মধ্যে আছে। অন্নের মহাকাল-মূর্তিতে ভয় পেয়ে যাঁরা এই জাতিকে কুবেরের কোলে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান, তাদের মাথায় বুদ্ধি থাকতে পারে, কিন্তু চোখে দৃষ্টির অভাব। আনন্দলোকের সূর্যরশ্মি বিজয়মাল্যের মতো এদের মাথায় এসে পড়েছে; হিতৈষীদের শত চেষ্টাতেও সে বরণকে উপেক্ষা কবে কেবল অন্নকে বহু করার চেষ্টাতেই এ জাতি কখনও জীবন উৎসর্গ করতে পারবে না।

‘অন্নং ন নিন্দ্যাৎ’, অন্নেব নিন্দা করিনে। অন্নং বহুকুর্বীত’; অন্নকে বহু করার যে কত প্রয়োজন তাও জানি। সেই ভিত্তির উপরেই মানুষের সভাতা দাঁড়িয়ে আছে। সমস্যা এই, কেমন করে অন্নকেও বহু করা যায় আবার তার বাহুল্যকেও বর্জন করা যায়। মহাকালের দর্শনেও ছিন্ন হতে না হয়, কুবেরের গদাও চূর্ণ না করে।

এস নুতন যুগের নবীন বাদরায়ণ! ‘অথাতোহান্ন জিজ্ঞাসা’ বলে তোমার অন্নসূত্র আরম্ভ করে এই সংশয়ের সমাধান কর। কোন মধ্যযান পথের পথিক হলে মানুষের সভ্যতাকে আর আনন্দের ব্ৰহ্মলোক হতে ফিরে আসতে না হয় তার নির্ধারণ করা।

আশ্বিন ১৩২৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *