০১-১০. বন্ধুবান্ধবরা বলে, তোমার জীবনী লেখ

০১.

বন্ধুবান্ধবরা বলে, “তোমার জীবনী লেখ”। সহকর্মীরা বলে, “রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।“ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে জমাদার সাহেব চলে গেলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সাথে আমার পরিচয় হল। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।

হঠাৎ মনে হল লিখতে ভাল না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কি? সময় তো কিছু কাটবে। বই ও কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ দুইটাও ব্যথা হয়ে যায়। তাই খাতাটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম। আমার অনেক কিছুই মনে আছে। স্মরণশক্তিও কিছুটা আছে। দিন তারিখ সামান্য এদিক ওদিক হতে পারে, তবে ঘটনাগুলি ঠিক হবে বলে আশা করি। আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু—আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।

***

আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। আমার ইউনিয়ন হল ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের পাশেই মধুমতী নদী। মধুমতী খুলনা ও ফরিদপুর জেলাকে ভাগ করে রেখেছে।

টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের নাম কিছুটা এতদঞ্চলে পরিচিত। শেখ পরিবারকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বলা যেতে পারে। বাড়ির বৃদ্ধ ও দেশের গণ্যমান্য প্রবীণ লোকদের কাছ থেকে এই বংশের কিছু কিছু ঘটনা জানা যায়।

আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোটসময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের। কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত। একটা দালানে আমার এক দাদা থাকতেন। এক দালানে আমার এক মামা আজও কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। আর একটা দালান ভেঙে পড়েছে, যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নাই। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি।

শেখ বংশ কেমন করে বিরাট সম্পদের মালিক থেকে আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে গিয়েছিল তার কিছু কিছু ঘটনা বাড়ির মুরুব্বিদের কাছ থেকে এবং আমাদের দেশের চারণ কবিদের গান থেকে আমি জেনেছি। এর অধিকাংশ যে সত্য ঘটনা এ সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নাই। শেখ বংশের সব গেছে, শুধু আজও তারা পুরাতন স্মৃতি ও পুরানো ইতিহাস বলে গর্ব করে থাকে।

শেখ বোরহানউদ্দিন কোথা থেকে কিভাবে এই মধুমতীর তীরে এসে বসবাস করেছিলেন কেউই তা বলতে পারে না। আমাদের বাড়ির দালানগুলির বয়স দুইশত বৎসরেরও বেশি হবে। শেখ বোরহানউদ্দিনের পরে তিন চার পুরুষের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে শেখ বোরহানউদ্দিনের ছেলের ছেলে অথবা দু’এক পুরুষ পরে দুই ভাইয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। এদের সম্বন্ধে অনেক গল্প আজও শোনা যায়। এক ভাইয়ের নাম শেখ কুদরতউল্লাহ, আর এক ভাইয়ের নাম শেখ একরামউল্লাহ। আমরা এখন যারা আছি তারা এই দুই ভাইয়ের বংশধর। এই দুই ভাইয়ের সময়েও শেখ বংশ যথেষ্ট অর্থ ও সম্পদের অধিকারী ছিল। জমিদারির সাথে সাথে তাদের বিরাট ব্যবসাও ছিল।

শেখ কুদরতউল্লাহ ছিলেন সংসারী ও ব্যবসায়ী; আর শেখ একরামউল্লাহ ছিলেন দেশের সরদার, আচার-বিচার তিনিই করতেন।

শেখ কুদরতউল্লাহ ছিলেন বড় ভাই। এই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশ দখল করে এবং কলকাতা বন্দর গড়ে তোলে। ইংরেজ কুঠিয়াল সাহেবরা এই দেশে এসে নীল চাষ শুরু করে। শেখ কুদরতউল্লাহ সম্বন্ধে একটা গল্প আজও অনেকে বলাবলি করে থাকে এবং গল্পটা সত্য। খুলনা জেলার আলাইপুরে মি. রাইন নামে একজন ইংরেজ কুঠিয়াল সাহেব নীল চাষ শুরু করে এবং একটা কুঠি তৈরি করে। আজও সে কুঠিটা আছে। শেখদের নৌকার বহর ছিল। সেইসব নৌকা মাল নিয়ে কলকাতায় যেত। মি. রাইন নৌকা আটক করে মাঝিদের দিয়ে কাজ করাত এবং অনেক দিন পর্যন্ত আটক রাখত। শুধু শেখদের নৌকাই নয় অনেকের নৌকাই আটক রাখত। কেউ বাধা দিলে অকথ্য অত্যাচার করত। তখনকার দিনের ইংরেজের অত্যাচারের কাহিনী প্রায় সকলেরই জানা আছে। শেখরা তখনও দুর্বল হয়ে পড়ে নাই। রাইনের লোকদের সাথে কয়েক দফা দাঙ্গাহাঙ্গামা হল এবং কোর্টে মামলা দায়ের হল। মামলায় প্রমাণ হল রাইন অন্যায় করেছে। কোর্ট শেখ কুদরতউল্লাহকে বলল, যত টাকা ক্ষতি হয়েছে জরিমানা করুন, রাইন দিতে বাধ্য। ঐ যুগে এইভাবেই বিচার হত। শেখ কুদরতউল্লাহ রাইনকে অপমান করার জন্য আধা পয়সা জরিমানা করল। রাইন বলেছিল, “যত টাকা চান দিতে রাজি আছি, আমাকে অপমান করবেন না। তাহলে ইংরেজ সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না; কারণ, কালা আদমি’ আধা পয়সা জরিমানা করেছে।” কুদরতউল্লাহ শেখ উত্তর করেছিল বলে কথিত আছে, “টাকা আমি শুনি না, মেপে রাখি। টাকার আমার দরকার নাই। তুমি আমার লোকের উপর অত্যাচার করেছ; আমি প্রতিশোধ নিলাম।” কুদরতউল্লাহ শেখকে লোকে কদু শেখ’ বলে ডাকত। আজও খুলনা ও ফরিদপুরের বৃদ্ধ মানুষ বলে থাকে এই গল্পটা মুখে মুখে। কুদরতউল্লাহ শেখের আধা পয়সা জরিমানার, দু’একটা গানও আছে। আমি একবার মিটিং করতে যাই বাগেরহাটে, আমার সাথে জিল্লুর রহমান এডভোকেট ছিল। ট্রেনের মধ্যে আমার পরিচয় পেয়ে এক বৃদ্ধ এই গল্পটা আমাকে বলেছিলেন। খুলনা জেলায় গল্পটা বেশি পরিচিত।

শেখ কুদরতউল্লাহ ও একরামউল্লাহ শেখের মৃত্যুর দুই এক পুরুষ পর থেকেই শেখ বাড়ির পতন শুরু হয়। পর পর কয়েকটা ঘটনার পরেই শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেল।

ইংরেজরা মুসলমানদের ভাল চোখে দেখত না। প্রথম ঘটনা, রাণী রাসমণি হঠাৎ জমিদার হয়ে শেখদের সাথে লড়তে শুরু করলেন, ইংরেজও তাকে সাহায্য করল। কলকাতার একটা সম্পত্তি ও উল্টাডাঙ্গার আড়ত শেখদের সম্পত্তি ছিল। এই সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন শেথ অছিমুদ্দিন। আবার জমিদারি নিয়েও রাসমণির স্টেটের সাথে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগেই ছিল। শেখ বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে শ্রীরামকান্দি গ্রামে তমিজুদ্দিন নামে এক দুর্ধর্ষ লোক বাস করত। সে রাসমণি স্টেটের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। সে ভাল যোদ্ধা ছিল। একবার দুইপক্ষে খুব মারামারি হয়। এতে রাণী রাসমণির লোক পরাজিত হয়। শেখদের লোকেদের হাতে তমিজুদ্দিন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে এবং শোনা যায় যে, পরে মৃত্যুবরণ করে। মামলা শুরু হয়। শেখদের সকলেই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে বহু অর্থ খরচ করে হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পায়।

এরপরই আর একটা ঘটনা হয়। টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ির পাশেই আরেকটা পুরানা বংশ আছে, যারা কাজী বংশ নামে পরিচিত। এদের সাথে শেখদের আত্মীয়তাও আছে। আত্মীয়তা থাকলেও রেষারেষি কোনোদিন যায় নাই। কাজীরা অর্থ-সম্পদ ও শক্তিতে শেখদের সাথে টিকতে পারে নাই, কিন্তু লড়ে গেছে বহুকাল। যে কাজীদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল তারা শেখদের সমর্থন করত। কাজীদের আর একটা দল রাণী রাসমণির সাথে যোগদান করে। তারা কিছুতেই শেখদের আধিপত্য সহ্য করতে পারছিল না। তাই তারা এক জঘন্য কাজের আশ্রয় নিল শেষ পর্যন্ত। অধিকাংশ কাজী শেখদের সাথে মিশে গিয়েছিল। একটা দল কিছুতেই শেখদের শেষ না করে ছাড়বে না ঠিক করেছিল। বৃদ্ধ এক কাজী, নাম সেরাজতুল্লা কাজী। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। ছেলেরা এক। ষড়যন্ত্র করে এবং অর্থের লোভে বৃদ্ধ পিতাকে গলা টিপে হত্যা করে শেখ বাড়ির গরুর ঘরের চালের উপরে রেখে যায়। এই ঘটনা শুধু তিন ভাই এবং তাদের বোনটা জানত। বোনকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল। শেখ বাড়িতে লাশ রেখে রাতারাতিই থানায় যেয়ে খবর দেয় এবং পুলিশ সাথে নিয়ে এসে লাশ বের করে দেয় এবং বাড়ির সকলকে গ্রেফতার করিয়ে দেয়। এতে শেখদের ভীষণ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়।

আমার দাদার চাচা এবং রেণুর দাদার বাবা কলকাতা থেকে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে চলে আসেন বাড়িতে। কলকাতার সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। তারপর যখন সকলে গ্রেফতার হয়ে গেছে, কেউই দেখার নাই—বড় বড় ব্যবসায়ী, মাঝি ও ব্যাপারীরা নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে উধাও হতে শুরু করল। এর পূর্বে তমিজুদ্দিনের খুনে যথেষ্ট টাকা খরচ হয়ে গেছে। জমিদারিও নিলাম হয়ে প্রায় সবই চলে যেতে লাগল। বহুদিন পর্যন্ত মামলা চলল। নিচের কোর্টে সকলেরই জেল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টে মামলা শুরু হল। আমাদের এডভোকেট হাইকোর্টে দরখাস্ত করল সিআইডি দ্বারা মামলা আবার ইনকোয়ারি করাতে। কারণ, এ মামলা ষড়যন্ত্রমূলক। হাইকোর্ট মামলা দেখে সন্দেহ হলে আবার ইনকোয়ারি শুরু হল। একজন অফিসার পাগল সেজে আমাদের গ্রামে যায় আর খোঁজ খবর নেয়। একদিন রাতে সেরাজতুল্লাহ কাজীর তিন ছেলের মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয় এবং কথায় কথায় এক ভাই অন্য ভাইকে বলে, “বলেছিলাম না শেখদের কিছু হবে না, বাবাকে অমনভাবে মারা উচিত হবে না।” অন্য ভাই বলে, “তুই তো গলা টিপে ধরেছিলি তাই তো বাবা মারা গেল।” বোনটা বলল, “বাবা একটু পানি চেয়েছিল, তুই তো তাও দিতে দিলি না।” সিআইডি এই কথা শুনতে পেল ওদের বাড়ির পিছনে পালিয়ে থেকে। তার কয়েকদিন পরেই তিন ভাই ও বোন গ্রেফতার হল এবং স্বীকার করতে বাধ্য হল তারাই তাদের বাবাকে হত্যা করেছে।

শেখরা মুক্তি পেল আর ওদের যাবজ্জীবন জেল হল। শেখরা মামলা থেকে বাঁচল, কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়েই বাঁচল। ব্যবসা নাই, জমিদারি শেষ, সামান্য তালুক ও খাস জমি, শেখ বংশ বেঁচে রইল শুধু খাস জমির জন্য। এদের বেশ কিছু খাস জমি ছিল। আর বাড়ির আশপাশ দিয়ে কিছু জমি নিষ্কর ছিল। খেয়ে পরার কষ্ট ছিল না বলে বাড়িতে বসে আমার দাদার বাবা চাচারা পাশা খেলে দিন কাটাতেন। সকলেই দিনভর দাবা আর পাশা খেলতেন, খাওয়া ও শোয়া এই ছিল কাজ। এরা ফার্সি ভাষা জানতেন এবং বাংলা ভাষার উপরও দখল ছিল। রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাতো ভাই, তিনি তার জীবনী লিখে রেখে গিয়েছিলেন সুন্দর বাংলা ভাষায়। রেণুও তার কয়েকটা পাতা পেয়েছিল যখন তার দাদা সমস্ত সম্পত্তি রেণু ও তার বোনকে লিখে দিয়ে যান তখন। রেণুর বাবা মানে আমার শশুর ও চাচা তাঁর বাবার সামনেই মারা যান। মুসলিম আইন অনুযায়ী রেণু তার সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোনো চাচা না থাকার জন্য তার দাদা সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। আমাদের বংশের অনেক ইতিহাস পাওয়া যেত যদি তার জীবনীটা পেতাম। কিন্তু কে বা কারা সেটা গায়েব করেছে বলতে পারব না, কারণ অনেক কথা বের হয়ে যেতে পারে। রেণু অনেক খুঁজেছে, পায় নাই। এ রকম আরও অনেক ছোটখাটো গল্প আছে, কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা বলতে পারি না।

যাহোক, শেখদের দুর্দিন আসলেও তারা ইংরেজদের সহ্য করতে পারত না। ইংরেজকে গ্রহণ করতে না পারায় এবং ইংরেজি না পড়ায় তারা অনেক পেছনে পড়ে গেল। মুসলমানদের সম্পত্তি ভাগ হয় অনেক বেশি। বংশ বাড়তে লাগল, সম্পত্তি ভাগ হতে শুরু করল, দিন দিন আর্থিক অবস্থাও খারাপের দিকে চলল। তবে বংশের মধ্যে দুই একজনের অবস্থা ভালই ছিল।

আমার দাদাদের আমল থেকে শেখ পরিবার ইংরেজি লেখাপড়া শুরু করল। আমার দাদার অবস্থা খুব ভাল ছিল না। কারণ দাদারা তিন ভাই ছিলেন, পরে আলাদা আলাদা হয়ে যান। আমার দাদার বড় ভাই খুব বিচক্ষণ লোক ছিলেন; তিনি দেশের বিচার-আচার করতেন। আমার দাদা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। আমার বড় চাচা এন্ট্রান্স পাস করে মারা যান। আমার আব্বা তখন এন্ট্রান্স পড়েন। ছোট্ট ছোট্ট ভাইবোন নিয়ে আমার আব্বা মহাবিপদের সম্মুখীন হন। আমার দাদার বড় ভাইয়ের কোনো ছেলে ছিল না। চার মেয়ে ছিল। আমার বাবার সাথে তার ছোট মেয়ের বিবাহ দেন এবং সমস্ত সম্পত্তি আমার মাকে লিখে দেন।

আমার নানার নাম ছিল শেখ আবদুল মজিদ। আমার দাদার নাম শেখ আবদুল হামিদ। আর ছোট দাদার নাম শেখ আবদুর রশিদ। তিনি পরে ইংরেজের দেয়া খান সাহেব’ উপাধি পান। জনসাধারণ তাকে ‘খান সাহেব’ বলেই জানতেন। আমার আব্বার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও দুই চাচার লেখাপড়া, ফুফুদের বিবাহ সমস্ত কিছুই তার মাথার উপর এসে পড়ল। বাধ্য হয়ে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরির অন্বেষণে বের হলেন। মুসলমানদের তখনকার দিনে চাকরি পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল। শেষ পর্যন্ত দেওয়ানি আদালতে একটা চাকরি পান, পরে তিনি সেরেস্তাদার হয়েছিলেন। যেদিন আমি ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যাই আমার আব্বাও সেইদিন পেনশন নিয়ে বাড়ি চলে যান।

একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।” রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর, সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড়বোনেরও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার। শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।

 

০২.

আমার জন্ম হয় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে। আমার আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করে আমার আব্বার কাছে চলে যাই এবং চতুর্থ শ্রেণীতে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হই। আমার মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তিনি কোনোদিন আমার আব্বার সাথে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, “আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে তার বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।”

আমরা আমার নানার ঘরেই থাকতাম, দাদার ও নানার ঘর পাশাপাশি। আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তার গলা ধরে রাতে

ঘুমালে আমার ঘুম আসত না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল। আমার মেজো চাচারও কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। আমার ছোট দাদারও একমাত্র ছেলে আছে। তিনিও খান সাহেব’ খেতাব পান। এখন আইয়ুব সাহেবের আমলে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য আছেন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সভ্যও ছিলেন, নাম শেখ মোশাররফ হোসেন।

১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতাম। হঠাৎ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। আব্বা আমাকে নিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যান। কলকাতার বড় বড় ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য, এ কে রায় চৌধুরী আরও অনেককেই দেখান এবং চিকিৎসা করাতে থাকেন। প্রায় দুই বছর আমার এইভাবে চলল।

১৯৩৬ সালে আব্ব মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হয়ে বদলি হয়ে যান। আমার অসুস্থতার জন্য মাকেও সেখানে নিয়ে আসেন। ১৯৩৬ সালে আবার আমার চক্ষু খারাপ হয়ে পড়ে। গ্লুকোমা নামে একটা রোগ হয়। ডাক্তারদের পরামর্শে আব্বা আমাকে নিয়ে আবার কলকাতায় রওয়ানা হলেন চিকিৎসার জন্য। এই সময় আমি মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম লেখাপড়া করার জন্য। কলকাতা যেয়ে ডাক্তার টি. আহমেদ সাহেবকে দেখালাম। আমার বোন কলকাতায় থাকত, কারণ ভগ্নিপতি এজিবিতে চাকরি করতেন। তিনি আমার মেজোবোন শেখ ফজলুল হক মণির মা! মণির বাবা পূর্বে সম্পর্কে আমার দাদা হতেন। তিনিও শেখ বংশের লোক। বোনের কাছেই থাকতাম। কোন অসুবিধা হত না। ডাক্তার সাহেব আমার চক্ষু অপারেশন করতে বললেন। দেরি করলে আমি অন্ধ হয়ে যেতে পারি। আমাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। ভোর ন’টায় অপারেশন হবে। আমি ভয় পেয়ে পালাতে চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু পারলাম না। আমাকে অপারেশন ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। দশ দিনের মধ্যে দুইটা চক্ষুই অপারেশন করা হল। আমি ভাল হলাম। তবে কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে, চশমা পরতে হবে। তাই ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা পরছি।

চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ঘোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এসডিও, আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পরে শুনেছি।

১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরানো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠীরা আমাকে পিছনে ফেলে গেছে। আমার আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার আব্বাও আবার গোপালগঞ্জ ফিরে এলেন। এই সময় আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তাঁর জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন। গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা বলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হত তার সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক। যদি কোন মুসলমান চাউল না দিত আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হত। এজন্য আমার আব্বার কাছে অনেক সময় শাস্তি পেতে হত। আমার আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না।

আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভাল খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভাল অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।

আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম। স্কুলে ছেলেদের মধ্যে আমার বয়স একটু বেশি হয়েছে, কারণ প্রায় চার বৎসর আমি লেখাপড়া করতে পারি নাই। আমি ভীষণ একগুয়ে ছিলাম। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম। আমার দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমার আব্বা মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। কারণ ছোট শহর, নালিশ হত; আমার আব্বাকে আমি খুব ভয় করতাম। আর একজন ভদ্রলোককে ভয় করতাম, তিনি আবদুল হাকিম মিয়া। তিনি আমার আব্বার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে চাকরি করতেন, আমাকে কোথাও দেখলেই আব্বাকে বলে দিতেন, অথবা নিজেই ধমকিয়ে দিতেন। যদিও আব্বাকে ফাঁকি দিতে পারতাম, তাঁকে ফাঁকি দিতে পারতাম না। আব্বা থাকতেন শহরের একদিকে, আর তিনি থাকতেন অন্যদিকে। হাকিম সাহেব বেঁচে নাই, তার ছেলেরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বড় চাকরি করেন, আর একজন সিএসপি হয়েছে। তখন গোপালগঞ্জে এমএলএ ছিলেন খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেব। তিনি নামকরা উকিলও ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে খন্দকার মাহবুব উদ্দিন ওরফে ফিরোজ আমার বন্ধু ছিল। দুইজনের মধ্যে ভীষণ ভাব ছিল। ফিরোজ এখন হাইকোর্টের এডভোকেট। দুই বন্ধুর মধ্যে এত মিল ছিল, কেউ কাউকে না দেখলে ভাল লাগত না। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। অমায়িক ব্যবহার তার। জনসাধারণ তাঁকে শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। তিনি মরহুম শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য ছিলেন। যখন হক সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং মুসলিম লীগে যোগদান করলেন, খন্দকার সাহেবও তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেন। যদিও কোনো দলেরই কোনো সংগঠন ছিল না। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার উপরই সবাই নির্ভর করত। মুসলিম লীগ তো তখন শুধু কাগজে-পত্রে ছিল।

 

০৩.

১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তারা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। এগজিবিশন হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা একসাথে গোপালগঞ্জে আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হল। স্কুলের ছাত্র আমরা তখন। আগেই বলেছি আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সম্বর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। এগজিবিশনে যাতে দোকানপাট না বসে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা আশিটি দোকান হিন্দুদের ছিল। আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান—সবই চলত।

আমাদের নেতারা বললেন, হক সাহেব মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এতে আমার মনে বেশ একটা রেখাপাত করল। হক সাহেব ও শহীদ সাহেবকে সম্বর্ধনা দেয়া হবে। তার জন্য যা কিছু প্রয়োজন আমাদের করতে হবে। আমি মুসলমান ছেলেদের নিয়েই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম, তবে কিছু সংখ্যক নমশূদ্র শ্রেণীর হিন্দু যোগদান করল। কারণ, মুকুন্দবিহারী মল্লিক তখন মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনিও হক সাহেবের সাথে আসবেন। শহরে হিন্দুরা সংখ্যায় খুবই বেশি, গ্রাম থেকে যথেষ্ট লোক এল, বিশেষ করে নানা রকম অস্ত্র নিয়ে, যদি কেউ বাধা দেয়। যা কিছু হয়, হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হতে পারত।

হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হল। এগজিবিশন উদ্বোধন করলেন। শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল। হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাকে সম্বর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। একজন সরকারি কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, “তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই?” বললাম, “কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই।” তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তার চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।

এই সময় একটা ঘটনা হয়ে গেল। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি চলছিল। গোপালগঞ্জ শহরের আশপাশেও হিন্দু গ্রাম ছিল। দু’একজন মুসলমানের উপর অত্যাচারও হল। আবদুল মালেক নামে আমার এক সহপাঠী ছিল। সে খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেবের আত্মীয় হত। একদিন সন্ধ্যায়, আমার মনে হয় মার্চ বা এপ্রিল মাস হবে, আমি ফুটবল মাঠ থেকে খেলে বাড়িতে এসেছি; আমাকে খন্দকার শামসুল হক ওরফে বাসু মিয়া মোক্তার সাহেব (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন) ডেকে বললেন, “মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করছে। যদি পার একবার যাও। তোমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস।” আমি আর দেরি না করে কয়েকজন ছাত্র ডেকে নিয়ে ওদের ওখানে যাই এবং অনুরোধ করি ওকে ছেড়ে দিতে। রমাপদ দত্ত নামে এক ভদ্রলোক আমাকে দেখেই গাল দিয়ে বসল। আমিও তার কথার প্রতিবাদ করলাম এবং আমার দলের ছেলেদের খবর দিতে বললাম। এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে। তিনজন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, “ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে কেড়ে নেব। আমার মামা শেখ সিরাজুল হক (একই বংশের) তখন হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। তিনি আমার মা ও বাবার চাচাতো ভাই। নারায়ণগঞ্জে আমার এক মামা ব্যবসা করেন, তার নাম শেখ জাফর সাদেক। তার বড় ভাই ম্যাট্রিক পাস করেই মারা যান। আমি খবর দিয়েছি শুনে দলবল নিয়ে ছুটে এসেছেন। এর মধ্যেই আমাদের সাথে মারপিট শুরু হয়ে গেছে। দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে চলে আসি।

শহরে খুব উত্তেজনা। আমাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। সেদিন রবিবার। আব্বা বাড়ি গিয়েছিলেন। পরদিন ভোরবেলায় আব্বা আসবেন। বাড়ি গোপালগঞ্জ থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে। আব্বা শনিবার বাড়ি যেতেন আর সোমবার ফিরে আসতেন, নিজেরই নৌকা ছিল। হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে একটা মামলা দায়ের করল। হিন্দু নেতারা থানায় বসে এজাহার ঠিক করে দিলেন। তাতে খন্দকার শামসুল হক মোক্তার সাহেব হুকুমের আসামি। আমি খুন করার চেষ্টা করেছি, লুটপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছি। ভোরবেলায় আমার মামা, মোক্তার সাহেব, খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ এমএলএ সাহেবের মুহুরি জহুর শেখ, আমার বাড়ির কাছের বিশেষ বন্ধু শেখ নুরুল হক ওরফে মানিক মিয়া, সৈয়দ আলী খন্দকার, আমার সহপাঠী আবদুল মালেক এবং অনেক ছাত্রের নাম এজাহারে দেয়া হয়েছিল। কোনো গণ্যমান্য লোকের ছেলেদের বাকি রাখে নাই। সকাল নটায় খবর পেলাম আমার মামা ও আরও অনেককে গ্রেফতার করে ফেলেছে। আমাদের বাড়িতে কি করে আসবে—থানার দারোগা সাহেবদের একটু লজ্জা করছিল। প্রায় দশটার সময় টাউন হল মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে দারোগা আলাপ করছে, তার উদ্দেশ্য হল আমি যেন সরে যাই। টাউন হলের মাঠের পাশেই আমার বাড়ি। আমার ফুফাতো ভাই, মাদারীপুর বাড়ি। আব্বার কাছে থেকেই লেখাপড়া করত, সে আমাকে বলে, “মিয়াভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না।” বললাম, “যাব না, আমি পালাব না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।”

এই সময় আব্বা বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। দারোগা সাহেবও তাঁর পিছে পিছে বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। আব্বার কাছে বসে আস্তে আস্তে সকল কথা বললেন। আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখালেন। আব্বা বললেন, “নিয়ে যান। দারোগা বাবু বললেন, “ও খেয়েদেয়ে আসুক, আমি একজন সিপাহি রেখে যেতেছি, এগারটার মধ্যে যেন থানায় পৌঁছে যায়। কারণ, দেরি হলে জামিন পেতে অসুবিধা হবে।” আব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, “মারামারি করেছ?” আমি চুপ করে থাকলাম, যার অর্থ “করেছি”।

আমি খাওয়া-দাওয়া করে থানায় চলে এলাম। দেখি আমার মামা, মানিক, সৈয়দ আরও সাত-আটজন হবে, তাদেরকে পূর্বেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসেছে। আমার পৌঁছার সাথে সাথে কোর্টে পাঠিয়ে দিল। হাতকড়া দেয় নাই, তবে সামনেও পুলিশ পিছনেও পুলিশ। কোর্ট দারোগা হিন্দু ছিলেন, কোর্টে পৌঁছার সাথে সাথে আমাদের কোর্ট হাজতের ছোট কামরার মধ্যে বন্ধ করে রাখলেন। কোর্ট দারোগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। আমাকে দেখে বলেন, “মজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না। আমি বললাম, “বাজে কথা বলবেন না, ভাল হবে না।” যারা দারোগা সাহেবের সামনে বসেছিলেন, তাদের বললেন, “দেখ ছেলের সাহস!” আমাকে অন্য সকলে কথা বলতে নিষেধ করল। পরে শুনলাম, আমার নামে এজাহার দিয়েছে এই কথা বলে যে, আমি ছোরা দিয়ে রমাপদকে হত্যা করার জন্য আঘাত করেছি। তার অবস্থা ভয়ানক খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে রমাপদের সাথে আমার মারামারি হয় একটা লাঠি দিয়ে, ও আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করলে আমিও লাঠি দিয়ে প্রত্যাঘাত করি। যার জন্য ওর মাথা ফেটে যায়। মুসলমান উকিল মোক্তার সাহেবরা কোর্টে আমাদের জামিনের আবেদন পেশ করল। একমাত্র মোক্তার সাহেবকে টাউন জামিন দেয়া হল। আমাদের জেল হাজতে পাঠানোর হুকুম হল। এসডিও হিন্দু ছিল, জামিন দিল না। কোর্ট দারোগা আমাদের হাতকড়া পরাতে হুকুম দিল। আমি রুখে দাঁড়ালাম, সকলে আমাকে বাধা দিল, জেলে এলাম। সাবজেল, একটা মাত্র ঘর। একপাশে মেয়েদের থাকার জায়গা, কোনো মেয়ে আসামি না থাকার জন্য মেয়েদের ওয়ার্ডে রাখল। বাড়ি থেকে বিছানা, কাপড় এবং খাবার দেবার অনুমতি দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত সাত দিন পরে আমি প্রথম জামিন পেলাম। দশ দিনের মধ্যে আর সকলেই জামিন পেয়ে গেল।

হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে টেলিগ্রাম করা হল। লোকও চলে গেল কলকাতায়। গোপালগঞ্জে ভীষণ উত্তেজনা চলছিল। হিন্দু উকিলদের সাথে আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। সকলেই আমার আব্বাকে সম্মান করতেন। দুই পক্ষের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়ে ঠিক হল মামলা তারা চালাবে না। আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে পনের শত টাকা। সকলে মিলে সেই টাকা দিয়ে দেওয়া হল। আমার আব্বাকেই বেশি দিতে হয়েছিল। এই আমার জীবনে প্রথম জেল।

 

০৪.

১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করি। আবদুল ওয়াসেক সাহেব আমাদের ছাত্রদের নেতা ছিলেন। তার সাথেও আলাপ করে তাঁকে গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করি। শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। একজন মোক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হল। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হল। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে। লেখাপড়ায় আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ, কয়েক বৎসর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করেছি। স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। খেলাধুলার দিকে আমার খুব ঝোক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভাল ছিল। মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।

১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবই নামকরা খেলোয়াড়। বত্সরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র; এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত। আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন, ‘কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ।” আমি বললাম, “আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না, আমাদের পরীক্ষা।” গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে বললেন, “তোমাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না। আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেটও পড়াতেন। আব্বা হেডমাস্টার বাবুকে খবর দিয়ে আনলেন। আমি আমার দলবল নিয়ে এক গোলপোস্টে আর আব্বা তার দলবল নিয়ে অন্য গোলপোস্ট। হেডমাস্টার বাবু বললেন, “মুজিব, তোমার বাবার কাছে হার মান। আগামীকাল সকালে খেল, তাদের অসুবিধা হবে।” আমি বললাম “স্যার, আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারজনই সারা বছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যথা, দুই-চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাব।” এবছর তো একটা খেলায়ও আমরা হারি নাই, আর এ জেড খান শিন্ডের’ এই শেষ ফাইনাল খেলা। এ. জেড. খান এসডিও ছিলেন, গোপালগতেই মারা যান। তার ছেলেদের মধ্যে আমির ও আহমদ আমার বাল্যবন্ধু ও সাথী। আমির ও আমি খুব বন্ধু ছিলাম। আমিরুজ্জামান খান এখন রেডিও পাকিস্তানে চাকরি করেন। ওর বাবা মারা যাবার পরে যখন গোপালগঞ্জ থেকে চলে আসে তখন ওর জন্য আমি খুব আঘাত পেয়েছিলাম। হেডমাস্টার বাবুর কথা মানতে হল। পরের দিন সকালে খেলা হল। আমার টিম আব্বার টিমের কাছে এক গোলে পরাজিত হল।

১৯৪১ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। পরীক্ষায় পাস আমি নিশ্চয়ই করব, সন্দেহ ছিল না। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক, আমাকে অঙ্ক করাতেন। অঙ্ককে আমার ভয় ছিল। কারণ ভুল করে ফেলতাম। অঙ্কের জন্যই বোধহয় প্রথম বিভাগ পাব না। পরীক্ষার একদিন পূর্বে আমার ভীষণ জ্বর হল এবং মামস হয়ে গলা ফুলে গেল। একশ’ চার ডিগ্রি জ্বর উঠেছে। আব্বা রাতভর আমার কাছে বসে রইলেন। গোপালগঞ্জ টাউনের সকল ডাক্তারই আনালেন। জুর পড়ছে না। আব্বা আমাকে পরীক্ষা দিতে নিষেধ করলেন। আমি বললাম, যা পারি শুয়ে শুয়ে দেব। আমার জন্য বিছানা দিতে বলেন। প্রথম দিনে বাংলা পরীক্ষা। সকালের পরীক্ষায় মাথাই তুলতে পারলাম না, তবুও কিছু কিছু লিখলাম। বিকালে জ্বর কম হল। অন্য পরীক্ষা ভালই হল। কিন্তু দেখা গেল বাংলায় আমি কম মার্কস পেয়েছি। অন্যান্য বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগের মার্কস পেয়েছি। মন ভেঙে গেল।

তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। বেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। খবরের কাগজ ‘আজাদ’, যা লেখে তাই সত্য বলে মনে হয়।

পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা-সমাবেশে যোগদান করি। মাদারীপুর যেয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি। আবার পড়তে শুরু করলাম। পাস তো আমার করতে হবে। শহীদ সাহেবের কাছে এখন প্রায়ই যাই। তিনিও আমাকে স্নেহ করেন। মুসলিম লীগ বললেই গোপালগঞ্জে আমাকে বোঝাত। যুদ্ধের সময় দেশের অবস্থা ভয়াবহ। এই সময় ফজলুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহ সাহেবের মনোমালিন্য হয়। হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের হুকুম মানতে রাজি না হওয়ায় তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে। মুসলিম লীগ ও ছাত্রকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। আমিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এই বৎসর আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলে থাকতাম। নাটোর ও বালুরঘাটে হক সাহেবের দলের সাথে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীদের দুইটা উপনির্বাচন হয়। আমিও দলবল নিয়ে সেখানে হাজির হলাম এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করলাম, শহীদ সাহেবের হুকুম মত।

 

০৫.

একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তারা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে। ছাত্রদের মধ্যেও দুইটা দল হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে আমি ফরিদপুর যেয়ে ছাত্রদের দলাদলি শেষ করে ফেলতে সক্ষম হলাম এবং পাকিস্তানের জন্যই যে আমাদের সংগ্রাম করা দরকার একথা তাঁরা স্বীকার করলেন। তখন মোহন মিয়া সাহেব ও সালাম খান সাহেব জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন।

১৯৪২ সালে মিস্টার জিন্নাহ আসবেন বাংলাদেশে, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগদান করার জন্য। সম্মেলন হবে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায়। আমরা ফরিদপুর থেকে বিরাট এক কর্মী বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করলাম। ছাত্রলীগ কর্মীই বেশি ছিল। সৈয়দ আকবর আলী সাহেবের বাড়িতে অভ্যর্থনা কমিটির অফিস করা হয়েছিল। আমি প্রায় সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে কাছে থাকতে চেষ্টা করতাম। আনোয়ার হোসেন তখন ছাত্রদের অন্যতম নেতা ছিলেন। তার সাথে কলকাতায় আমার পরিচয় হয়। শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকে খুব ভালবাসতেন। ছাত্রদের মধ্যে দুইটা দল ছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীও তখন ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ওয়াসেক সাহেব ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে গোলমাল লেগেই ছিল। ওয়াসেক সাহেব ছাত্রদের রাজনৈতিক পিতা ছিলেন বললে অন্যায় হবে না। বহুদিন তিনি ‘অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করেছেন বোধহয় পনের বছর পূর্বে। তবুও তিনি পদ ছাড়বেন না। কেউ তার মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই তিনি বলতেন, “কে হে তুমি? তুমি তো ছাত্রলীগের সদস্য বা কাউন্সিলার নও; বের হয়ে যাও সভা থেকে।” প্রথমে কেউই কিছু বলত না তাকে সম্মান করে। প্রথম গোলমাল হয় বোধহয় ১৯৪১ বা ১৯৪২ সালে কুঁচুড়া সম্মেলনে। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আমরা ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলাম, শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের হস্তক্ষেপে গোলমাল হল না। আমি ও আমার সহকর্মীরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর দলকে সমর্থন করে বের হয়ে এলাম। তখন সাদেকুর রহমান (এখন সরকারের বড় চাকরি করেন) প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, পরে আনোয়ার হোসেন সম্পাদক হন। বগুড়া সম্মেলনে আমরা উপস্থিত হয়েও সভায় যোগদান করি না, কারণ অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব ওয়াদা করলেন শীঘ্রই তিনি এডহক কমিটি করে নির্বাচন দেবেন। এডহক কমিটি করলেন সত্য, তবে তা কাগজপত্রেই রইল।

এই সময় ইসলামিয়া কলেজে আমি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি। অফিসিয়াল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাদের পরাজিত করালাম। ইসলামিয়া কলেজই ছিল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। পরের বছরও ১৯৪৩ সালে ইলেকশনে আনোয়ার সাহেবের অফিসিয়াল ছাত্রলীগ পরাজিত হল। তারপর আর তিন বৎসর কেউই আমার মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ইলেকশন করে নাই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ইলেকশন হত। আমি ছাত্রনেতাদের নিয়ে আলোচনা করে যাদের ঠিক করে দিতাম তারাই নমিনেশন দাখিল করত, আর কেউ করত না। কারণ জানত, আমার মতের বিরুদ্ধে কারও জিতবার সম্ভাবনা ছিল না। জহিরুদ্দিন আমাকে সাহায্য করত। সে কলকাতার বাসিন্দা, ছাত্রদের উপর তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। নিঃস্বার্থ কর্মী বলে সকলে তাকে শ্রদ্ধাও করত। চমৎকার ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে বক্তৃতা করতে পারত। জহির পরে ইসলামিয়া কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তবুও আমার সাথে বন্ধুত্ব ছিল। কিছুদিনের জন্য সে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় রেডিওতে চাকরি নিয়ে চলে আসায় আমার খুবই অসুবিধা হয়েছিল।

১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাচ্ছে। এই সময় আমি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হই। জনাব আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সম্পাদক হন। তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মনোনীত ছিলেন। আর খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন খুলনার আবুল কাশেম সাহেব। হাশিম সাহেব তাকে পরাজিত করে সাধারণ সম্পাদক হন। এর পূর্বে সোহরাওয়ার্দী সাহেবই সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই সময় থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটা দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটা প্রগতিবাদী দল, আর একটা প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকেও লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলেরাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।

খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ঢাকার এক জা বংশের থেকেই এগারজন এমএলএ হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে, খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি তাঁর ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবকে শিল্পমন্ত্রী করলেন। আমরা বাধা দিলাম, তিনি শুনলেন না। শহীদ সাহেবের কাছে আমরা যেয়ে প্রতিবাদ করলাম, তিনিও কিছু বললেন না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হলেন। দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্বের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাউল চল্লিশপঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নাই রাস্তায় লোকে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। আমরা কয়েকজন ছাত্র শহীদ সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম, “কিছুতেই জনসাধারণকে বাঁচাতে পারবেন না, মিছামিছি বদনাম নেবেন।” তিনি বললেন, “দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কি না, কিছু লোক তো বাঁচাতে চেষ্টা করব।”

তিনি রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তুললেন। কন্ট্রোল’ দোকান খোলার বন্দোবস্ত করলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা করার হুকুম দিলেন। দিল্লিতে যেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন এবং সাহায্য দিতে বললেন। চাল, আটা ও গম বজরায় করে আনাতে শুরু করলেন। ইংরেজের কথা হল, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজি হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও।’ এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে। আমরা কি করব? হেস্টেলে যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেই, কিন্তু কি হবে এতে?

এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম। আমার আরও কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন। যেমন পিরোজপুরের নূরুদ্দিন আহমেদ—যিনি পরে পূর্ব বাংলার এমএলএ হন। নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন—যদিও তিনি আনোয়ার হোসেন সাহেবের দলে ছিলেন, আমার সাথে এদের গোলমাল ছিল, তবুও আমার ওকে ভাল লাগত। বেকার হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান সাহেব (বহু পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল হন) আমাকে অত্যন্ত মেহ করতেন। হোস্টেল রাজনীতি বা ইলেকশনে আমার যোগদান করার সময় ছিল না। তবে তিনি আমার সাথে পরামর্শ করতেন। প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. আই, এইচ, জুবেরী। তিনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। যে কোনো ব্যাপারে তাদের সঙ্গে সোজাসুজি আলাপ করতাম এবং সত্য কথা বলতাম। শিক্ষকরা আমাকে সকলেই স্নেহ করতেন। আমি দরকার হলে কলেজের এ্যাসেম্বলি হলের দরজা খুলে সভা শুরু করতাম। প্রিন্সিপাল সাহেব দেখেও দেখতেন না। মুসলমান প্রফেসররা পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। হিন্দু ও ইউরোপিয়ান টিচাররা চুপ করে থাকতেন, কারণ সমস্ত ছাত্ৰই মুসলমান। সামান্য কিছু সংখ্যক ছাত্র পাকিস্তানবিরোধী ছিল, কিন্তু সাহস করে কথা বলত না।

 

০৬.

এই সময় রিলিফের কাজ করার জন্য গোপালগঞ্জ ফিরে আসি। গোপালগঞ্জ মহকুমার একদিকে যশোর জেলা, একদিকে খুলনা জেলা, আর একদিকে বরিশাল জেলা। বাড়িতে এসে দেখি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সবই প্রায় না খেতে পেয়ে কঙ্কাল হতে চলেছে। গোপালগঞ্জের মুসলমানরা ব্যবসায়ী এবং যথেষ্ট ধান হয় এখানে। খেয়ে পরে মানুষ কোনোমতে চলতে পারত। অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিল, যদি একটা কনফারেন্স করা যায় আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতাদের আনা যায় তবে চোখে দেখলে এই তিন জেলার লোকে কিছু বেশি সাহায্য পেতে পারে এবং লোকদের বাঁচাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমাদের সহকর্মীদের নিয়ে বসলাম। আলোচনা হল, সকলে বলল, এই অঞ্চলে কোনোদিন পাকিস্তানের দাবির জন্য কোনো বড় কনফারেন্স হয় নাই। তাই কনফারেন্স হলে তিন জেলার মানুষের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি হবে। এতে দুইটা কাজ হবে, মুসলিম লীগের শক্তিও বাড়বে, আর জনগণও সাহায্য পাবে। সকল এলাকা থেকে কিছু সংখ্যক কর্মীকে আমন্ত্রণ করা হল। আলোচনা করে ঠিক হল, সম্মেলনের ‘দক্ষিণ বাংলা পাকিস্তান কনফারেন্স’ নাম দেয়া হবে এবং তিন জেলার লোকদের দাওয়াত করা হবে। সভা আহ্বান করা হল অভ্যর্থনা কমিটি করার জন্য। বয়স্ক নেতাদের থেকে একজনকে চেয়ারম্যান ও একজনকে সেক্রেটারি করা হবে। প্রধান যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ রাজি হন না, কারণ খরচ অনেক হবে। দেশে দুর্ভিক্ষ, টাকা পয়সা তুলতে পারা যাবে না। শেষ পর্যন্ত সকলে মিলে আমাকেই অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান এবং যশোর জেলার মৌলভী আফসারউদ্দিন মোল্লা নামে একজন বড় ব্যবসায়ী, তাঁকে সম্পাদক করা হল।

আমি কলকাতায় রওয়ানা হয়ে গেলাম, নেতৃবৃন্দকে নিমন্ত্রণ করার জন্য। যখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দাওয়াত করতে গেলাম, দেখি খাজা শাহাবুদ্দীন সেখানে উপস্থিত আছেন। শহীদ সাহেব বললেন, “আমি খুবই ব্যস্ত, তুমি বুঝতেই পারো, নিশ্চয়ই চেষ্টা করব যেতে। শাহাবুদ্দীন সাহেবকে নিমন্ত্রণ কর উনিও যাবেন।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহাবুদ্দীন সাহেবকে বলতে হল, তিনিও রাজি হলেন। তমিজুদ্দিন খান তখন শিক্ষামন্ত্রী, ফরিদপুর বাড়ি, তাঁকেও অনুরোধ করলাম, তিনিও রাজি হলেন। মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এবং হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী সাহেবকেও দাওয়াত দিলাম। জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (লাল মিয়া), তখন কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির সম্পাদক। আমি তার সাথেই রিলিফের কাজ করতাম, আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন। তিনি যথেষ্ট টাকা, ঔষধ ও কাপড় জোগাড় করেছিলেন। তার সাথে সাথেই আমাকে থাকতে হত। আর প্রত্যেক মহকুমায় কাপড় পাঠাতে হত। যুদ্ধের সময় মালপত্র বুক করা কঠিন ছিল, দশ দিন ঘোরাঘুরি করলে কিছু কিছু কাপড় পাঠাবার মত জায়গা পাওয়া যেত। অনেক সময় হিসাব-নিকাশও দেখতে হত। নিজের হাতে কাপড়ের গাঁটও বাঁধতে হত। আমি কোন কাজেই ‘না’ বলতাম না। যাহোক, তাকেও গোপালগঞ্জ যেতে অনুরোধ করলাম, তিনিও রাজি হলেন। দিন তারিখ ঠিক করে আমি বাড়ি রওয়ানা হয়ে এলাম। সামান্য কিছু টাকা তুললাম শহর থেকে। আমি গ্রামে বের হয়ে পড়লাম, কিছু কিছু অবস্থাশালী লোক ছিল মহকুমায়, তাদের বাড়িতে যেয়ে কিছু কিছু টাকা তুলে আনলাম। কাজ শুরু হয়ে গেছে। লোকজন চারিদিকে নামিয়ে দিয়েছি। অতিথিদের খাবারের ভার আব্বাই নিলেন। তবে পাক হবে এক সরকারি কর্মচারীর বাড়িতে। পরে দুই পক্ষ হয়ে গেল। গোলমাল শুরু হলে শেষ পর্যন্ত গোপালগঞ্জে আমাদের বাড়িতেই বন্দোবস্ত হল। প্যাভেল করলাম নৌকা বাদাম দিয়ে। যাদের বড় বড় নৌকা ছিল তাদের বাড়ি থেকে দুই দিনের জন্য বাদামগুলি ধার করে আনলাম। পাঁচ হাজার লোক বসতে পারে এত বড় প্যান্ডেল করলাম, খরচ খুব বেশি হল না।

এদিকে এই কনফারেন্স বন্ধ করার জন্য অনেকেই চেষ্টা করতে আরম্ভ করল। টেলিগ্রাম করল সকল আমন্ত্রিত নেতাদের কাছে। কনফারেন্সের মাত্র তিন দিন সময় আছে, আমার কাছে তমিজুদ্দিন সাহেব ও শাহাবুদ্দীন সাহেব টেলিগ্রাম করেছেন, কনফারেন্স বন্ধ করা যায় কি না? আমি টেলিগ্রাম করলাম, বন্ধ করা অসম্ভব। সোহরাওয়ার্দী সাহেব আসতে পারবেন না বলে টেলিগ্রাম করেছেন। তিনি বোধহয় ফুড কনফারেন্সে দিরি বা অন্য কোথাও যাবেন। সকলে আমাকে বলল, কলকাতায় রওয়ানা হতে, কারণ যদি কেউ না আসে তবে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। বহু দূর দূর থেকে লোক আসবে। কনফারেন্স দুই দিন চলার কথা ছিল, তা দুর্ভিক্ষের জন্য সম্ভব হবে না। সকালে কর্মী সম্মেলন, বিকালে জনসভা হবে বলে ঠিক হল। আমি আমার সহকর্মীদের ওপর ভর দিয়ে কলকাতা রওয়ানা করলাম। তমিজুদ্দিন সাহেব পূর্বেই খুলনায় রওয়ানা হয়ে গেছেন। শাহাবুদ্দীন সাহেব, মওলানা তর্কবাগীশ ও লাল মিয়া সাহেবকে নিয়ে খুলনায় এলাম। খুলনায় তমিজুদ্দিন সাহেব সরকারি লঞ্চে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আমরা লঞ্চে উঠলাম এবং জানতে চাইলাম, কেন তিন দিন পূর্বে কনফারেন্স বন্ধ করতে বললেন? জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, জনাব ওয়াহিদুজ্জামান কিছুদিন পূর্বেও হক সাহেবের সাথে ছিলেন, সদ্য মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন, তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না যে আমি চেয়ারম্যান হয়েছি আর গোপালগঞ্জে কনফারেন্স হবে। তাঁর কিছু করার নাই আর বলারও নাই। যদিও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তাঁরা আমাকে ও মুসলিম লীগকে বাধা দিয়েছেন। আবার সালাম খান সাহেব, জেলা লীগের সম্পাদক, বাড়ি গোপালগঞ্জ, তারও আপত্তি রয়েছে এত বড় কনফারেন্স হবে তাঁকে বলা হয় নাই বা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করা হয় নাই। তিনিও খবর দিয়েছেন, যাতে নেতারা না আসেন।

আমাকে সকল নেতাই জানতেন ভাল কর্মী হিসাবে, আমাকে সকলে স্নেহও করতেন। শহীদ সাহেবও বলে দিয়েছেন সকলকে কনফারেন্সে যোগদান করতে। আমাকে অপমান করলে, আবার একবার মত দিয়ে না গেলে কলকাতায় ছাত্রদের নিয়ে যে গোলমাল করব সে ভয়ও অনেকের ছিল। সকলকে নিয়ে আমি গোপালগঞ্জ উপস্থিত হলাম। নেতারা বিরাট সম্বর্ধনা পেলেন। পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে গোপালগঞ্জ শহর মুখরিত হয়ে উঠল। নেতারা জনসমাগম দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। সভা হবে, কিন্তু প্যান্ডেল গত রাতে ঝড়ে ভেঙে গিয়েছে। নৌকার বাদামগুলি ছিঁড়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। সেই ভাঙা প্যাভেলে সভা হল। রাতেই সকলে বিদায় নিলেন। আমার অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে গেল। এত টাকা আমি কোথায় পাব? বাদামগুলি ছিঁড়ে গেছে, এখন তো কেউই এক টাকাও দিবে না। নেতারাও কেউ জিজ্ঞাসা করলেন না। যাদের বাদাম এনেছিলাম, তারা অনেকেই আমাকে স্নেহ করত। তারা অনেকেই অর্থশালী, আর তাদের ছেলেরা প্রায়ই আমার দলে। অনেকে ছেড়া বাদাম নিয়ে চলে গেল, আর কিছু লোক উসকানি পেয়ে বাদাম নিতে আপত্তি করল। তারা টাকা চায়, ছেড়া বাদাম নেবে না, আমি কি করব? মুখ কালো করে বসে আছি। অতিথিদের খাবার বন্দোবস্ত করার জন্য আমার মা ও স্ত্রী গ্রামের বাড়ি থেকে গোপালগল্পের বাড়িতে এসেছে তিন দিন হল। আমার শরীর খারাপ হয়ে পড়েছে অত্যধিক পরিশ্রমে। বিকালে ভয়ানক জ্বর হল। আব্বা আমাকে বললেন, “তুমি ঘাবড়িয়ে গিয়েছ কেন?” আব্বা পূর্বেও বহু টাকা খরচ করেছেন এই কনফারেন্স উপলক্ষে। বড়লোক তো নই কি করে আব্বাকে বলি। আব্বা নিজেই সমাধান করে দিলেন। যাদের ব্যবসা ভাল না, তাদের কিছু কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। একজন ব্যবসায়ী যার আট, দশটা বাদাম নষ্ট হয়েছে তিনি পুরা টাকা দাবি করলেন, না দিলে মামলা করবেন। আব্বা বললেন, “কিছু টাকা আপনি নিয়ে এগুলি মেরামত করায়ে নেন। মামলার ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। যারা পরামর্শ আপনাকে দিয়েছে, তারা জানে না আপনার বাদাম যে এনেছি তা প্রমাণ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।“ আমার জ্বর ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক উকিলের নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সাহস করে আর মামলা করেন নাই।

রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাই না। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।” একথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।

আর একদিনের কথা, গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না। অনেক সময় আব্বা আমার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। আমাকে প্রশ্ন করতেন, কেন পাকিস্তান চাই? আমি আব্বার কথার উত্তর দিতাম।

একদিনের কথা মনে আছে, আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা’ও আমাকে বলছিলেন, “বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।” শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা হন নাই। বাংলার মাটিও তাকে ভালবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন-দাঁড়িয়ে বললেন, “যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।” এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে। কয়েকবার মার খাওয়ার পরে আমাদের বক্তৃতার মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। পূর্বে আমার দোষ ছিল, সোজাসুজি আক্রমণ করে বক্তৃতা করতাম। তার ফল বেশি ভাল হত না। উপকার করার চেয়ে অপকারই বেশি হত। জনসাধারণ দুঃখ পেতে পারে ভেবে দাবিটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করতাম।

পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা পশ্চিম পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে—পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান। ওখানেও হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু থাকবে তবে সমান নাগরিক অধিকার পাবে হিন্দুস্তানের মুসলমানরাও। আমার কাছে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ থাকত। আর হবীবুল্লাহ বাহার সাহেবের পাকিস্তান’ বইটা এবং মুজিবুর রহমান স্ব সাহেবও পাকিস্তান’ নামে একটা বিস্তৃত বই লিখেছিলেন সেটা; এই দুইটা বই আমার প্রায় মুখস্তের মত ছিল। আজাদের কাটিংও আমার ব্যাগে থাকত।

সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাসও আমার জানা ছিল। কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কি করে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, সিপাহির চাকরি থেকে কিভাবে বিতাড়িত হল—মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল ইংরেজরা কেন? মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বেও দেশ শাসন করেছে তাই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদরা? বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরিক হয়েছিল। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফারায়জি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমণ করতাম। এর কারণও যথেষ্ট ছিল। একসাথে লেখাপড়া করতাম, একসাথে বল খেলতাম, একসাথে বেড়াতাম, বন্ধুত্ব ছিল হিন্দুদের অনেকের সাথে। আমার বংশও খুব সম্মান পেত হিন্দু মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্তু আমি যখন কোনো হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, আমাকে অনেক সময় তাদের ঘরের মধ্যে নিতে সাহস করত না আমার সহপাঠীরা।

একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম “ননী কি হয়েছে?” ননী আমাকে বলল, “তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।” বললাম, “যাব না, তুই আসিস।” আরও অনেক হিন্দু। ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনোদিন একথা বলে নাই। অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন। এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে। শহরে এসেই এই ব্যবহার দেখেছি। কারণ আমাদের বাড়িতে হিন্দুরা যারা আসত প্রায় সকলেই আমাদের শ্রদ্ধা করত। হিন্দুদের কয়েকটা গ্রামও ছিল, যেগুলির বাসিন্দারা আমাদের বংশের কোনো না কোনো শরিকের প্রজা ছিল।

হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারেও বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। যখন আবার হিন্দুরা ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য। এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ও জুলু হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তাঁরা অনেক সময় হিন্দুদের হুশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন। একথাও সত্য, মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত হিন্দু হিসাবে নয়, প্রজা হিসাবে। এই সময় যখনই কোনো মুসলমান নেতা মুসলমানদের জন্য ন্যায্য অধিকার দাবি করত তখনই দেখা যেত হিন্দুদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত, এমনকি গুণী সম্প্রদায়ও চিৎকার করে বাধা দিতেন। মুসলমান নেতারাও পাকিস্তান সম্বন্ধে আলোচনা ও বক্তৃতা শুরু করার পূর্বে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গালি দিয়ে শুরু করতেন।

এই সময় আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একটা নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং নতুনভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু মুসলমানদের মিলানোর জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বাস করতে পারে তারই জন্য। তিনি আমাদের কিছু সংখ্যক কর্মীকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে রাতে আলোচনা সভা করতেন মুসলিম লীগ অফিসে। হাশিম সাহেব পূর্বে বর্ধমানে থাকতেন, সেখান থেকে মুসলিম লীগ অফিসে একটা রুমে এসে থাকতেন, কলকাতায় আসলে। মুসলিম লীগ অফিসটা শহীদ সাহেব ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁকেই ভাড়া দিতে হয়েছে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। হাশিম সাহেব আমাদের বললেন, একটা লাইব্রেরি করতে হবে, তোমাদের লেখাপড়া করতে হবে। শুধু হিন্দুদের গালাগালি করলে পাকিস্তান আসবে না। আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন বলে আমিও তাকে শ্রদ্ধা করতাম, তার হুকুম মানতাম। শিম সাহেবও শহীদ সাহেবের হুকুম ছাড়া কিছু করতেন না। মুসলিম লীগের ফান্ড ও অর্থ মানে শহীদ সাহেবের পকেট। টাকা পয়সা তাঁকেই জোগাড় করতে হত। সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করব। হাশিম সাহেব বলতেন, মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। গ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। উপরের তলার প্রতিষ্ঠান করলে চলবে না। জমিদারদের পকেট থেকে প্রতিষ্ঠানকে বের করতে হবে। তিনি শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে সমস্ত বাংলাদেশ ঘুরতে আরম্ভ করলেন। চমৎকার বক্তৃতা করতেন। ভাষার উপর দখল ছিল। ইংরেজি বাংলা দুই ভাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন সুন্দরভাবে।

 

০৭.

এই সময় ছাত্রদের মধ্যে বেশ শক্তিশালী দুইটা দল সৃষ্টি হল। আমি কলকাতায় এসেই খবর পেলাম, আমাদের দিল্লি যেতে হবে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে’ যোগদান করতে। তোড়জোড় পড়ে গেল। যারা যাবেন নিজের টাকায়ই যেতে হবে। আনোয়ার হোসেন সাহেব তার দলবল থেকে কয়েকজনকে নিলেন। টাকাও বোধহয় জোগাড় করলেন। আমি ও ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মীর আশরাফউদ্দিন ঠিক করলাম, আমরাও যাব আমাদের নিজেদের টাকায়। আমাদের পূর্বেই ডেলিগেট করা হয়েছিল। মীর আশরাফউদ্দিন ওরফে মাখন, বাড়ি ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার কাজী কসবা গ্রামে। আমার খালাতো বোনের ছেলে, ওর বাবা-মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। যথেষ্ট টাকা রেখে গেছেন। ওর বাবা তখনকার দিনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। শহীদ সাহেবকে বললাম, “আমরা দিল্লি কনফারেন্সে যোগদান করব।” তিনি বললেন, “খুব ভাল, দেখতে পারবে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমান নেতাদের।” আমরা দুইজন ও আনোয়ার সাহেবের দলের কয়েকজন একই ট্রেনে ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে রওয়ানা করলাম। তাদের সাথে আমাদের মিল নাই। দুই মামু-ভাগ্নের যা খরচ লাগবে দিল্লিতে তা কোনোমতে বন্দোবস্ত করে নিলাম। টাকার বেশি প্রয়োজন হলে আমি আমার বোনের কাছ থেকে আনতাম। বোন আব্বার কাছ থেকে নিত। আব্বা বলে দিয়েছিলেন তাকে, আমার দরকার হলে টাকা দিতে। আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।

হাওড়া থেকে আমরা দিল্লিতে রওয়ানা করলাম। এই প্রথমবার আমি বাংলাদেশের বাইরে রওয়ানা করলাম। দিল্লি দেখার একটা প্রবল আগ্রহ আমার ছিল। ইতিহাসে পড়েছি, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনেছি, তাই দিল্লির লালকেল্লা, জামে মসজিদ, কুতুব মিনার ও অন্যান্য ঐতিহাসিক জায়গাগুলি দেখতে হবে। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাব। আমরা দিল্লি পৌঁছালে মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবক দল আমাদের পৌঁছে দিল এ্যাংলো এ্যারাবিয়ান কলেজ প্রাঙ্গণে। সেখানে আমাদের জন্য তাবু করা হয়েছে। তাঁবুতে আমরা দুইজন ছাড়াও আলীগড়ের একজন ছাত্র এবং আরেকজন বোধহয় এলাহাবাদ বা অন্য কোথাকার হবে। আনোয়ার সাহেবের দলবল অন্য একটা তাবুতে রইলেন। বিরাট প্যান্ডেল করা হয়েছে। আমরা ডেলিগেট কার্ড নিয়ে সভায় উপস্থিত হলাম। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে। প্রথম দিন কনফারেন্স হয়ে যাওয়ার পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হাতির পিঠে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের হল। আমরাও সাথে সাথে রইলাম। লোকে লোকারণ্য, রাস্তায় রাস্তায় পানি খাওয়ার বন্দোবস্ত রেখেছে। বোধহয় এই সময় পানি না রাখলে বহু লোক মারা যেত। দিল্লির পুরানা শহর আমরা ঘুরে বিকালে ফিরে এলাম। রাতে আবার কনফারেন্স শুরু হল। এই সময়কার একজনের কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। উর্দুতে তিন ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। যেমন গলা, তেমনই বলার ভঙ্গি। উর্দু ভাল বুঝতাম না, কলকাতার উর্দু একটু বুঝলেও এ উর্দু বোঝা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর। বক্তৃতা করেছিলেন নবাব ইয়ার জং বাহাদুর। তিনি হায়দ্রাবাদের লোক ছিলেন। স্টেট মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা না বুঝলেও সভা ছেড়ে উঠে আসা কষ্টকর ছিল।

শরীর আমার খারাপ হয়ে পড়ে। দিনেরবেলায় ভীষণ গরম, রাতে ঠাণ্ডা। সকালে আর বিছানা থেকে উঠতে পারি নাই। বুকে, পেটে, আর সমস্ত শরীরে বেদনা! দুই তিন দিন পায়খানা হয় নাই। অসহ্য যন্ত্রণা আমার শরীরে। দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে শুয়েই রইলাম। মাখন আমার কাছেই বসে তাছে। ডাক্তার ডাকতে হবে, কাউকেই চিনি জানি না। একজন স্বেচ্ছাসেবককে বলা হল, তিনি বললেন, “আভি নেহি, ঘোড়া বাদ”। তাকে আর দেখা গেল না, ‘পোড়া বাদই হয়ে গেল। বিকালের দিকে মাখন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমারও ভয় হল। এই বিদেশে কি হবে? টাকা পয়সাও বেশি নাই। মাখন বলল, “মামা, আমি যাই ডাক্তার যেখানে পাই, নিয়ে আসতে চেষ্টা করি। এভাবে থাকলে তো বিপদ হবে।” শহীদ সাহেব কোথায় থাকেন জানি না, অন্যান্য নেতাদের বলেও কোন ফল হয় নাই। কে কার খবর রাখে? মাখন যখন বাইরে যাচ্ছিল ঠিক এই সময় দেখি হেকিম খলিলুর রহমান আমাকে দেখতে এসেছেন। তিনি জানেন না, আমি অসুস্থ। খলিলুর রহমানকে আমরা ‘খলিল ভাই বলতাম। ছাত্রলীগের বিখ্যাত কর্মী ছিলেন। আলীয়া মাদ্রাসায় পড়তেন এবং ইলিয়ট হোস্টেলে থাকতেন।

ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ইডিয়ট হোস্টেল’। খলিল ভাই আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করে দিল্লিতে এসেছেন এক বৎসর পূর্বে, হাকিম আজমল ধা সাহেবের হেকিমি বিদ্যালয়ে হেকিমি শিখবার জন্য। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, কি সর্বনাশ কাউকে খরও দাও নাই। তিনি মাখনকে বললেন, আপনার ডাক্তার ডাকতে হবে না, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। আধ ঘন্টার মধ্যে খলিল ভাই একজন হেকিম নিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে ভালভাবে পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিলেন। তাঁকে খলিল ভাই পূর্বেই আমার রোগের কথা বলেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ভয় নাই। ওষুধ খাওয়ার পরে তিন বার আপনার পায়খানা হবে, রাতে আর কিছুই খাবেন না। ভোরে এই ওষুধটা খাবেন। বিকালে আপনি ভাল হয়ে যাবেন। তিনি যা বললেন, তাই হল।

পরের দিন সুস্থ বোধ করতে লাগলাম। কনফারেন্সও শেষ হয়ে যাবে। খলিল ভাই আমাদের সাথেই দুই দিন থাকবেন। আমাদের দিল্লির সকল কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। এই সময় আর একটা ঘটনা ঘটল। বরিশালের নূরুদ্দিন আহমেদের সাথে আনোয়ার সাহেবের ঝগড়া হয়েছে। নূরুদ্দিন রাগ করে আমাদের কাছে চলে এসেছে। তার টাকা পয়সাও আনোয়ার সাহেবের কাছে। তাকে কিছুই দেয় নাই, একদম খালি হাতে আমার ও মাখনের কাছে এসে হাজির। বলল, “না খেয়ে মরে যাব, দরকার হয় হেঁটে কলকাতা যাব, তবু ওর কাছে আর যাব না।” এই নূরুদ্দিন সাহেবকেই মাখন ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশনে জেনারেল সেক্রেটারি পদে পরাজিত করেছিল। নূরুদ্দিনকে ছাত্ররা ভালবাসত কিন্তু সে আনোয়ার সাহেবের দলে ছিল বলে তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল। আইএ পড়লেও দলের নেতা আমিই ছিলাম। আমরা একই হোস্টেলে থাকতাম। বললাম, “ঠিক আছে তোমার ওর কাছে যাওয়া লাগবে না, যেভাবে হয় চলে যাবে।“ যদিও ওর জন্য টিকিট করার টাকা আমাদের কাছে নাই। তিন দিন থাকব ঠিক হল। খাবার খরচ বেশি, হোটেলে খেতে হয়। দুই দিনের মধ্যেই খলিল ভাইকে নিয়ে দিল্লির লালকেল্লা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, কুতুব মিনার, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ, নতুন দিল্লি দেখে ফেললাম। কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল। হিসাব করে দেখলাম, তিনজনের টিকিট করার টাকা আমাদের নাই। দুইখানা টিকিট করা যায়, কিন্তু না খেয়ে থাকতে হবে। খলিল ভাই একমাত্র বন্ধু, তবে তিনি তখনও ছাত্র তার কাছেও টাকা পয়সা নাই। যাহোক, আর দেরি না করে স্টেশনে এসে হাজির হলাম। তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, একখানা টিকিট করব এবং কোনো সার্ভেন্ট’ ক্লাসে উঠে পড়ব। ধরা যদি পড়ি, হাওড়ায় একটা বন্দোবস্ত করা যাবে।

প্রথম শ্রেণীর প্যাসেঞ্জারদের গাড়ির সাথেই চাকরদের জন্য একটা করে ছোট্ট গাড়ি থাকে। সাহেবদের কাজকর্ম করে এখানেই এসে থাকে চাকররা। দিল্লি যাওয়ার সময় আমরা ইন্টারক্লাসে যাই। এখন টাকা ফুরিয়ে গেছে, কি করি? একখানা তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনলাম হাওড়া পর্যন্ত। আর দুইখানা প্লাটফর্ম টিকিট কিনে স্টেশনের ভিতরে আসলাম। মাখনের চেহারা খুব সুন্দর। দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না চাকর’ হতে পারে। আমরা শুনলাম, খান বাহাদুর আবদুল মোমন সাহেব এই বগিতে যাবেন। নূরুদ্দিন খোঁজ এনেছে। ভাবলাম, বিপদে পড়লে একটা কিছু করা যাবে। নূরুদ্দিনকে খান বাহাদুর সাহেব চিনতেন। তিনি রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বারও ছিলেন। আমরা তার গাড়ির পাশের সার্ভেন্ট ক্লাসে উঠে পড়লাম। মাখনকে বললাম, তুমি উপরে উঠে শুয়ে থাক। তোমাকে দেখলে ধরা পড়ব। এই সকল গাড়িতে বোধহয় কোনো রেলওয়ে কর্মচারী আসবে না। নূরুদ্দিনকে সামনে দিব যদি কেউ আসে। একবার এক চেকার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কোন সাহেবের লোক”? নূরুদ্দিন ঝট করে উত্তর দিল, “মোমেন সাহেব কা”। ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিছু কিছু ফলফলাদি নূরুদ্দিন কিনত, আমরা তিনজন খেতাম। ভাত বা রুটি খাবার পয়সা নাই। তিনজনে ভাত খেতে হলে তো এক পয়সাও থাকবে না।

কোনোমতে হাওড়া পৌঁছালাম, এখন উপায় কি? পরামর্শ করে ঠিক হল, মাখন টিকিট নিয়ে সকলের মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যাবে। মালপত্র কোথাও রেখে তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে আবার ঢুকবে। আমরা একসাথে বের হয়ে যাব।

গাড়ি থামার সাথে সাথে মাখন নেমে গেল, আমরা দুইজন ময়লা জামা কাপড় পরে আছি। দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমরা দিল্লি থেকে আসতে পারি। চশমা খুলে লুকিয়ে রেখেছি। মাখন তিনখানা প্লাটফর্ম টিকিট নিয়ে ফিরে এসেছে। তখন প্যাসেঞ্জার প্রায়ই চলে গেছে। দুই চারজন আছে যাদের মালপত্র বেশি। তাদের পাশ দিয়ে আমরা দুইজন ঘুরছি। মাখন আমাদের প্লাটফর্ম টিকিট দিল, তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে গেলাম। তখন হিসাব করে দেখি, আমাদের কাছে এক টাকার মত আছে। আমরা বাসে উঠে হাওড়া থেকে বেকার হোস্টেলে ফিরে এলাম। না খেয়ে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে।

 

০৮.

সেই সময় হতে নূরুদ্দিনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। পরে ভ্ৰমাদের বন্ধুত্বে ‘খেসারত’ তাকে দিতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে কর্মীদের তাদের দুঃখ কষ্টের কথা অন্য কোনো নেতাদের কাছে বললে কানও দিত না। একমাত্র শহীদ সাহেবই দুঃখ কষ্ট সহানুভূতির সাথে শুনতেন এবং দরকার হলে সাহায্যও করতেন। নূরুদ্দিন পরে অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক হয়। এনোয়ার সাহেব যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে যাদবপুর হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর যাবতীয় খরচ শহীদ সাহেব বহন করতেন।

১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের এক বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা ছিল—বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। কলকাতায় সম্মেলন হলে কেউ আমাদের দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। যাহোক, শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকেও ভালবাসতেন। আনোয়ার সাহেব অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। ঢাকার ছাত্রলীগ ও আমাদের সাথের কেউ আনোয়ার সাহেবকে দেখতে পারত না। একমাত্র শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই ঢাকায় আনোয়ার সাহেবের দলে ছিলেন।

শাহ সাহেব চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন। বগুড়ায় তাকে আমি প্রথম দেখি। আনোয়ার সাহেব কলকাতা ও ঢাকায় কনফারেন্স করতে সাহস না পেয়ে কুষ্টিয়ায় শাহ আজিজুর রহমানের নিজের জেলায় বার্ষিক প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকলেন। এই সময় আনোয়ার সাহেব ও নূরুদ্দিনের দলের মধ্যে ভীষণ গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। আনোয়ার সাহেব আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং অনুরোধ করলেন, তার সাথে এক হয়ে কাজ করতে। তিনি আমাকে পদের লোভও দেখালেন। আমি বললাম, আমার পদের দরকার নাই, তবে সবার সাথে আলোচনা করা দরকার। নূরুদ্দিন সাহেবের দলও আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালায়। একপক্ষ আমাকে নিতেই হবে, কারণ আমার এমন শক্তি কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না যে ইলেকশনে কিছু করতে পারব। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেছেন। জহির সাহেব ছাত্র আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামান না, মুসলিম লীগেরই কাজ করেন।

কলকাতায় যে সকল ছাত্র-কর্মী ছিল তারা প্রায়ই হাশিম সাহেবের কাছে যাওয়াআসা করে। তার কাছে যেয়ে ক্লাস করে, এইভাবে তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। যে সমস্ত নিঃস্বার্থ কর্মী সে সময় কাজ করত তাদের মধ্যে নূরুদ্দিন, বর্ধমানের খন্দকার নূরুল আলম ও শরফুদ্দিন, সিলেটের মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, খুলনার একরামুল হক, চট্টগ্রামের মাহাবুব আলম, নূরুদ্দিনের চাচাতো ভাই এস. এ. সালেহ অন্যতম ছিল। শেষ পর্যন্ত এদের সাথেই আমার মিল হল, কারণ আমরা সকলেই শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের ভক্ত ছিলাম, আনোয়ার সাহেবের দল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। কিন্তু শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। শহীদ সাহেব অবস্থা বুঝে আমাদের দুই দলের নেতৃবৃন্দকে ডাকলেন একটা মিটমাট করাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত মিটমাট হয় নাই। এই সময় শহীদ সাহেবের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বলেন, আমি বললাম কখনোই হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভাল কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, “Who are you? You are nobody.” আমি বললাম “If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you Sir. I will never come to you again.” এ কথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম। আমার সাথে সাথে নূরুদ্দিন, একরাম, নূরুল আলমও উঠে দাঁড়াল এবং শহীদ সাহেবের কথার প্রতিবাদ করল। বর্তমান বুলবুল একাডেমির১৩ সেক্রেটারি মাহমুদ নূরুল হুদা সাহেব শহীদ সাহেবের খুব ভক্ত ছিলেন। সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে থাকতেন। আমরা তাকে হুদা ভাই’ বলে ডাকতাম। হুদা ভাইয়ের ব্যবহার ছিল চমৎকার। কারও কোনো বিপদ হলে, আর খবর পৌঁছে দিলে যত রাতই হোক না কেন হাজির হতেন। হুদা ভাই ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন। আমি যখন বিখ্যাত ৪০ নম্বর থিয়েটার রোড থেকে রাগ হয়ে বেরিয়ে আসছিলাম শহীদ সাহেব হুদা ভাইকে বললেন, “ওকে ধরে আনন।” রাগে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। হুদা ভাই দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। শহীদ সাহেবও দোতালা থেকে আমাকে ডাকছেন ফিরে আসতে। আমাকে হুদা ভাই ধরে আনলেন। বন্ধুবান্ধবরা বলল, শহীদ সাহেব ডাকছেন, বেয়াদবি কর না, ফিরে এস।” উপরে এলাম। শহীদ সাহেব বললেন, “যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ নিজেদের মধ্যে গোলমাল কর না।” আমাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, “তুমি বোকা, আমি তো আর কাউকেই একথা বলি নাই, তোমাকে বেশি আদর ও স্নেহ করি বলে তোমাকেই বলেছি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি যে সত্যিই আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। যখনই তার কথা এই কারাগারে বসে ভাবি, সেকথা আজও মনে পড়ে। দীর্ঘ বিশ বৎসর পরেও একটুও এদিক ওদিক হয় নাই। সেইদিন থেকে আমার জীবনে প্রত্যেকটা দিনই তার স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তার কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তাঁর স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।

শহীদ সাহেবের বাড়িতে দুই দল বসেও যখন আপোস হল না, তখন ইলেকশনে লড়তে হবে। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের সাহায্য নিয়ে দখল করতে সক্ষম হলেন। খান বাহাদুররা জেলা লীগ কনফারেন্সে পরাজিত হলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে চট্টগ্রামের এই কর্মীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, আজ পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অটুট আছে। চট্টগ্রামের এম. এ. আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আজিজুর রহমান, ডা. সুলতান আহমেদ (এখন কুমিল্লায় আছেন), আবুল খায়ের চৌধুরী এবং আরও অনেকে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অনেকেই ছিটকে পড়েছেন। আজিজ ও জহুর আজও সক্রিয় রাজনীতি করছেন। জহুর শ্রমিক আন্দোলন। করেন এবং সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি। এম. এ. আজিজ (এখন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক) পাকিস্তান হওয়ার পরে অনেকবার ও অনেক দিন জেলে কষ্ট ভোগ করেছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব তখন এদের নেতা ছিলেন। পরে তিনি মুসলিম লীগেই থেকে যান। আজিজ ও জহুর আওয়ামী লীগে চলে আসেন। চৌধুরী সাহেব খুবই স্বার্থপর হয়ে ওঠেন এবং একগুয়েমি করতেন, সেজন্য যারা তাঁকে চট্টগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, পরে তারা সকলেই তাঁকে ত্যাগ করেন।

চট্টগ্রামে টেলিগ্রাম করলাম কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগের প্রতিনিধি পাঠাতে। লোক পাঠালাম সমস্ত জেলায়। নূরুদ্দিন, একরাম, শরফুদ্দিন, খন্দকার নূরুল আলম, আমি ও আমার সহকর্মীরা রাতদিন কাজ করতে আরম্ভ করলাম। আমাদের অর্থের খুব অভাব, কারণ হাশিম সাহেবের টাকা পয়সা ছিল না। শহীদ সাহেব আমাদের সামান্য সাহায্য করেছিলেন। আমরা নিজেরা চাঁদা তুললাম এবং দলবল নিয়ে কুষ্টিয়া পৌঁছালাম। কিউ. জে. আজমিরী ও হামিদ আলী নামে দুইজন ভাল কর্মী ছিল। আজমিরী ভীষণ রাগী ছিল। কথায় কথায় মারপিট করে ফেলত, শক্তিও ছিল, সাহসও ছিল। আজমিরী হাশিম সাহেবের আত্মীয়। ফরিদপুর কুষ্টিয়ার কাছে। ফরিদপুরে ছাত্রদের দুই ভাগ ছিল। এক ভাগ আমার সাথে আর একভাগ মোহন মিয়া সাহেবের সমর্থক। মোহন মিয়া সাহেব আনোয়ার সাহেবকে সমর্থন করতেন। কুষ্টিয়ায় যখন আমরা পৌঁছালাম তখন দেখা গেল যত কাউন্সিলার এসেছে তার মধ্যে শতকরা সত্তরজন আমাদের সমর্থক। দুই দলের নেতৃবৃন্দের এক জায়গায় বসা হল, উদ্দেশ্য আপোস করা যায় কি না? বগুড়ার ফজলুল বারীকে (এখন পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনেম খান সাহেবের মন্ত্রী হয়েছেন) সভাপতি করে আলোচনা চলল। কথায় কথায় ঝগড়া, তারপর মারামারি হল, শাহ সাহেব অনেক গুণ্ডা জোগাড় করে এনেছিলেন। আমরা বলেছিলাম, যদি গুণ্ডামি করা হয়, তবে কলকাতায় তাকে থাকতে হবে না। শেষ পর্যন্ত আপোস হল না। কুমিল্লার ছাত্রলীগ নেতারা আমাদের সাথেই ছিলেন। সকালে শোনা গেল তারা আনোয়ার সাহেবের দলের সাথে মিশে গেছেন, কারণ তাদের তিনটা পদ দেয়া হয়েছে। রফিকুল হোসেনকে আমাদের দলই কলকাতা থেকে কাউন্সিলার করে। তিনি আমাদের সকল পরামর্শ সভায়ও যোগদান করতেন। শফিকুল ইসলামও বেকার হোস্টেলে থাকত। আমাদের সাথেই আনোয়ার সাহেবের দলের বিরুদ্ধে কাজ করত। আর আবদুল হাকিম সাহেব তো আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। তখন থেকেই একসাথে কাজ করেছি। সকালবেলা এরা দল ত্যাগ করল। তথাপি আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি। কোনো ভয় নাই, আনোয়ার সাহেবের দল পরাজিত হবেই।

সিনেমা হলে কাউন্সিল অধিবেশন হবে। জনাব হামুদুর রহমান সাহেব (এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি) সভাপতির আসন গ্রহণ করবেন। তিনি এডহক কমিটির সদস্য ছিলেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্রলীগ ফেডারেশনের পক্ষ হতে তিনি সভাপতিত্ব করবেন। এটা আমাদেরই দাবি ছিল। আমরা যখন হলে ঢুকলাম তখন দেখলাম অনেক বাইরের লোক হলে বসে আছে। আমরা সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। আমাদের পক্ষ থেকে একরামুল হক বৈধতার প্রশ্ন তুলল এবং দাবি করল, ‘সকল প্রতিনিধি, হল থেকে বের হয়ে যাবে, দুইটা গেট খোলা থাকবে, দুই পক্ষ থেকে দুইজন করে চারজন প্রতিনিধি প্রত্যেকের কার্ড পরীক্ষা করে হলে আসতে দিবে।’

এই সময় হলের উপর তলার বারান্দায় বাইরের ছাত্ররা অনেক এসেছে, তারা দর্শক। একজন ছাত্র, হাফপ্যান্ট পরা চিৎকার করে বলছে, “আমি জানি এরা অনেকেই ছাত্র না, বাইরের লোক। শাহ আজিজ দল বড় করবার জন্য এদের এনেছে।” পরে খবর নিয়ে জানলাম, ছেলেটির নাম কামারুজ্জামান (পরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলা পরিষদের সদস্য হয়েছিল)। জনাব হামুদুর রহমান সাহেব আমাদের কথা মানলেন না, তিনি সভার কাজ শুরু করে দিলেন। যেখানে বিশজন ছাত্রকে কো-অপ্ট করা হবে কনফারেন্স শুরু হবার সময়, সেখানে তিনি ভোটে দিয়ে দিলেন। আমরা বাইরের লোকদের বের করে দিতে অনুরোধ করতে থাকলাম। ভীষণ চিত্তার শুরু হল, আমরা দেখলাম মারপিট হবার সম্ভাবনা আছে। কয়েকজন বসে পরামর্শ করে আমাদের সমর্থকদের নিয়ে সভা ত্যাগ করলাম প্রতিবাদ করে। আমরা ইচ্ছা করলে আর একটা প্রতিষ্ঠান করতে পারতাম। প্রায় সমস্ত জেলায়ই আমাদের সমর্থক ছিল। তা করব না ঠিক করলাম, তবে কলকাতায় এদের কোন সভা করতে দেব না। কলকাতা মুসলিম ছাত্রলীগের নামেই আমরা কাজ করে যেতে লাগলাম। অল বেঙ্গল নেতাদের কোনো স্থান ছিল না।

১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আর কোন ইলেকশন এরা করে নাই। মুসলিম ছাত্রলীগ দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, একদল পরিচিত হত শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দল বলে, আরেক দল পরিচিত হত খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব এবং মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের দল বলে। আমরা মওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না।

এই সময় একটা আলোড়নের সৃষ্টি হল। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে মুসলিম লীগের একটা ড্রাফট ম্যানিফেস্টো বের করলেন। মুসলিম লীগ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং এর রাজনৈতিক দাবিও থাকবে, ভবিষ্যতে পাকিস্তান পেলে অর্থনৈতিক কাঠামো কি হবে তাও থাকতে হবে। জমিদারি প্রথা বিলোপসহ আরও অনেক কিছু এতে ছিল। ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। আমরা যুবক, ছাত্র ও প্রগতিবাদীরা এটা নিয়ে ভীষণভাবে প্রপাগান্ডা শুরু করলাম। পাকিস্তান আমাদের আদায় করতে হবে এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো কি হবে তার একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকা দরকার। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা ক্লাস করতেন। ঢাকায় এসে কয়েকদিন থাকতেন এবং কর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভা করতেন। কলকাতা লীগ অফিসে তিনি থাকতেন, ঢাকার লীগ অফিসেও তিনি থাকতেন! কর্মীদের সাথে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রাখতেন। আমি তাঁর সাথে কয়েক জায়গায় সভা করতে গিয়েছি।

এই সময়কার একজন ছাত্রনেতার নাম উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে; কারণ, তিনি কোনো গ্রুপে ছিলেন না এবং অন্যায় সহ্য করতেন না। সত্যবাদী বলে সকলে তাকে শ্রদ্ধা করতেন। নেতাদের সকলেই তাঁকে স্নেহ করতেন। তার নাম এখন সকলেই জানেন, জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বার এট ল’। এখন ঢাকা হাইকোর্টের জজ সাহেব। তিনি দুই গ্রুপের মধ্যে আপোস করতে চেষ্টা করতেন। শহীদ সাহেবও চৌধুরী সাহেবের কথার যথেষ্ট দাম দিতেন। জনাব আবদুল হাকিম এখন হাইকোর্টের জজ হয়েছেন। তিনি টেইলর হোস্টেলের সহ-সভাপতি ছিলেন, ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। জজ মকসুমুল হাকিম সাহেব ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন না। বেকার হোস্টেলের প্রিমিয়ার হয়েছিলেন, ভাল ছাত্র ছিলেন, লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।

এই সময় শহীদ নজীর আহমেদ নিহত হবার পরে ঢাকার ছাত্রদের নেতৃত্ব দিতেন জনাব শামসুল হক সাহেব, শামসুদ্দিন আহমেদ, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং আরও অনেকে। এরা সকলেই শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন। পরে হাশিম সাহেবেরও ভক্ত হন। এরা সকলেই ছাত্র আন্দোলনের সাথে সাথে মুসলিম লীগ সংগঠনকে কোটারির হাত থেকে বাঁচার জন্য মুসলিম লীগের কাজে যোগদান করেছিলেন। ঢাকায় প্রাদেশিক লীগের একটা আঞ্চলিক শাখা অফিস হাশিম সাহেব খোলেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। কমিউনিস্ট পার্টির মত হোলটাইম ওয়ার্কার হিসাবে এরা অনেকেই যোগদান করেন। শামসুল হক সাহেব এই অফিসের ভার নেন। আমরাও কলকাতা অফিসের হোলটাইম ওয়ার্কার হয়ে যাই। যদিও হোস্টেলে আমার রুম থাকত, তবু আমরা প্রায়ই লীগ অফিসে কাটাতাম। রাতে একটু লেখাপড়া করতাম। সময় সময় কলেজে পার্সেন্টেজ রাখতাম। পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব? আমাদের অনেকের মধ্যে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল।

কলকাতার আহমেদ আলী পার্কে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা হবে, তখন দুই পক্ষের মোকাবেলা হবে। আমরা হাশিম সাহেবকে জেনারেল সেক্রেটারি করব এবং ম্যানিফেস্টো পাস করাব। অন্য দল হাশিম সাহেবকে সেক্রেটারি হতে দেবে না। নেতাদের মধ্যে অনেকেই শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। তারা শহীদ সাহেবকে সমর্থন করতেন কিন্তু হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। শেষ পর্যন্ত মওলানা আকরম খাঁ সাহেব, শহীদ সাহেব ও খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব বসে একটা প্যানেল ঠিক করলেন। হাশিম সাহেবই সেক্রেটারি থাকবেন তবে ম্যানিফেস্টো এবার পাস হবে না। একটা সাব-কমিটি করা হবে, তাদের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করে ম্যানিফেস্টো ঠিক হবে। আমার মনে হয়, ম্যানিফেস্টো সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল। আর কি কি সিদ্ধান্ত হয়েছিল আমার ঠিক মনে নাই। যাহোক, শহীদ সাহেব বললেন, “এখন গোলমাল করার সময় নয়। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। নিজেদের মধ্যে গোলমাল হলে পাকিস্তান দাবির সংগ্রাম পিছিয়ে যাবে।”

 

০৯.

এই সময় বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের পতন হয়। গভর্নর শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেন। শহীদ সাহেব দেখলেন যুদ্ধের সময় অধিক লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা কালো বাজারে কাপড় বিক্রি করার জন্য গুদামজাত করতে শুরু করছে। একদিকে খাদ্য সমস্যা ভয়াবহ, শহীদ সাহেব রাতদিন পরিশ্রম করছেন, আর একদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছে : শহীদ সাহেব সমস্ত কর্মচারীদের হুকুম দিলেন, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের আড্ডাখানা বড়বাজার ঘেরাও করতে। সমস্ত বড়বাজার ঘেরাও করা হল। হাজার হাজার গজ কাপড় ধরা পড়ল, এমনকি দালানগুলির নিচেও এক একটা গুদাম করে রেখেছিল তাও বাদ গেল না। এমনি করে সমস্ত শহরে চাউল গুদামজাতকারীদের ধরবার জন্য একইভাবে তল্লাশি শুরু করলেন। মাড়োয়ারিরাও কম পাত্র ছিল না। কয়েক লক্ষ টাকা তুলে লীগ মন্ত্রিসভাকে খতম করার জন্য কয়েকজন এমএলএকে কিনে ফেলল। ফলে এক ভোটে লীগ মন্ত্রিত্বকে পরাজয়বরণ করতে হল। যদিও এটা অনাস্থা প্রস্তাব ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব চ্যালেঞ্জ দিলেন এই কথা বলে যে, আগামীকাল আমি আস্থা ভোট নেব, যদি আস্থা ভোট না পাই তবে পদত্যাগ করব। স্পিকার ছিলেন নওশের আলী সাহেব। পরের দিন তিনি এ ব্যাপারে কুলিং দিলেন, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে, আর আস্থা ভোটের দরকার নাই।

আমি কিছু সংখ্যক ছাত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খবর যখন রটে গেল লীগ মন্ত্রিত্ব নাই, তখন দেখি টুপি ও পাগড়ি পরা মাড়োয়ারিরা বাজি পোড়াতে শুরু করেছে এবং হৈচৈ করতে আরম্ভ করেছে। সহ্য করতে না পেরে, আরও অনেক কর্মী ছিল, মাড়োয়ারিদের খুব মারপিট করলাম, ওরা ভাগতে শুরু করল। জনাব মোহাম্মদ আলী বাইরে এসে আমাকে ধরে ফেললেন এবং সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। হিন্দু নেতারাও বাইরে এসে প্রতিবাদ করল। যাহোক, কিছু সময় পর সব শান্ত হয়ে গেল, আমরা ফিরে এলাম। এই সময় বোধহয় দেড় বছরের মত মুসলিম লীগ শাসন করে, যদিও গভর্নরই সর্বময় ক্ষমতার মালিক ছিলেন। আমি নিজে জানি, শহীদ সাহেব কলকাতা ক্লাবের সদস্য ছিলেন। রাতে একবার দুই এক ঘন্টার জন্য কলকাতায় থাকলে ক্লাবে যেতেন, কিন্তু যেদিন তিনি সিভিল সাপ্লাইয়ের মন্ত্রী হন, তারপর থেকে এক মুহূর্তও সময় পান নাই কলকাতা ক্লাবে যেতে। রাত বারটা পর্যন্ত তিনি অফিস করতেন। আমি ও নুরুদ্দিন রাত বারটার পরেই শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে এবং রাজনীতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে প্রায়ই তার বাড়িতে যেতাম। কারণ, দিনেরবেলায় তিনি সময় পেতেন না। তিনি আমাদের এই সময়ের কথা বলে দিয়েছিলেন।

এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি। আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেবার, যাতে তারা দল ত্যাগ করে অন্য দলে না যেতে পারে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হল। তিনি বার বার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না : কিছু সময় পরে বললেন, “আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।” আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোট দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের! এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে আমাদের ধরে আনতে হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন।

এই সময় ফজলুর রহমান সাহেব আমাকে ডাকলেন, তিনি চিফ হুইপ ছিলেন। আমাকে বললেন, “আপনাকে এই বারটার সময় আসাম-বেঙ্গল ট্রেনে রংপুর যেতে হবে। মুসলিম লীগের একজন এমএলএ, যিনি খান বাহাদুর’ও ছিলেন তাঁকে নিয়ে আসতে হবে। টেলিগ্রাম করেছি, লোকও পাঠিয়েছি, তবু আসছেন না, আপনি না গেলে অন্য কেউই আনতে পারবে না। শহীদ সাহেব আপনাকে যেতে বলেছেন। আপনার জন্য টিকিট করা আছে।” কয়েকখানা চিঠি দিলেন। আমি বেকার হোস্টেলে এসে একটা হাত ব্যাগে কয়েকটা কাপড় নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে আসলাম। খাওয়ার সময় পেলাম না। যুদ্ধের সময় কোথাও খাবার পাওয়াও কষ্টকর। ট্রেনে চেপে বসলাম। তখন ট্রেনের কোন সময়ও ঠিক ছিল না, মিলিটারিদের ইচ্ছামত চলত। রাত আটটায় রংপুর পৌঁছাব এটা ছিল ঠিক সময়, কিন্তু পৌঁছালাম রাত একটায়। পথে কিছু খেতেও পারি নাই, ভীষণ ভিড়। এর পূর্বে। রংপুরে আমি কোনোদিন যাই নাই। শুনলাম স্টেশন থেকে শহর তিন মাইল দূরে। অনেক কষ্ট করে একটা রিকশা জোগাড় করা গেল। রিকশাওয়ালা খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি চিনে, আমাকে ঠিকই পৌঁছে দিল। আমি অনেক ডাকাডাকি করে তাঁকে তুললাম, চিঠি দিলাম। তিনি আমাকে জানেন। বললেন, “আগামীকাল আমি যাব। আজ ভোর পাঁচটায় যে ট্রেন আছে সে ট্রেনে যেতে পারব না।” আমি বললাম, “তাহলে আপনি চিঠি দিয়ে দেন, আমি ভোর পাঁচটার ট্রেনেই ফিরে যেতে চাই।” তিনি বললেন, “সেই ভাল হয়।” আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু খাব কি না, পথে খেয়েছি কি না। বললেন, “এখন তো রাত তিনটা বাজে, বিছানার কি দরকার হবে?” বললাম, “দরকার নাই, যে সময়টা আছে বসেই কাটিয়ে দিব। ঘুমালে আর উঠতে পারব না খুবই ক্লান্ত। একদিকে পেট টনটন করছে, অন্যদিকে অচেনা রংপুরের মশা। গতরাতে কলকাতায় বেকার হোস্টেলে ভাত খেয়েছি। বললাম, এক গ্লাস পানি পাঠিয়ে দিলে ভাল হয়। তিনি তার বাড়ির পাশেই কোথাও রিকশাওয়ালারা থাকে, তার একজনকে ডেকে বললেন, আমাকে যেন পাঁচটার ট্রেনে দিয়ে আসে। আমি চলে এলাম সকালের ট্রেনে।

কলকাতায় পৌঁছালাম আরেক সন্ধ্যায়। রাস্তায় চা বিস্কুট কিছু খেয়ে নিয়েছিলাম। রাতে আবার হোস্টেলে এসে ভাত খাই। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি, ক্ষেপেও গিয়েছি। ফজলুর রহমান সাহেবকে বললাম, “আর কোনোদিন এই সমস্ত লোকদের কাছে যেতে বলবেন না।”

একদিন পরে তিনি এসেছিলেন। তাঁকে পাহারা দেয়ার জন্য লোক রাখা হয়েছিল। তবু পিছনের দরজা দিয়ে এক ফাঁকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। খোজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় নাই। আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম, এই সকল জঘন্য নীচতা এই প্রথম দেখলাম, পরে যদিও অনেক দেখেছি, কিন্তু এই প্রথমবার। এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে, ইংরেজকে তাড়ানোও যাবে, বিশ্বাস করতে কেন যেন কষ্ট হত! মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণীর লোকেরা। এদের দ্বারা কোনোদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হত না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল। কি কারণে এমন ঘটল তা পরবর্তী ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে।

 

১০.

শহীদ সাহেব মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের দিকে মন দিলেন। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে ইংরেজ যুদ্ধের গতির পরিবর্তন করে ফেলল। এই সময় কংগ্রেস ‘ভারত ত্যাগ কর আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনকেও শহীদ সাহেব এবং হাশিম সাহেব জনগণের আন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছিলেন। ইংরেজের সাথেও আমাদের লড়তে হবে, এই শিক্ষাও হাশিম সাহেব আমাদের দিচ্ছিলেন। আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাত ক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের দলে নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হত, ইংরেজের থেকে জাপানই বোধহয় আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনোদিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হত, সুভাষ বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরেজকে তাড়ান সহজ হবে। আবার মনে হত, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কি হবে? আবার মনে হত, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম।

অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে। এই সময় আমাদের বক্তৃতার ধারাও বদলে গেছে। অনেক সময় হিন্দু বন্ধুদের সাথে ঘন্টার পর ঘণ্টা এ নিয়ে আলোচনা হত। কিছুতেই তারা বুঝতে চাইত না। ১৯৪৪-৪৫ সালে ট্রেনে, স্টিমারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হত। সময় সময় এমন পর্যায়ে আসত যে, মুখ থেকে হাতের ব্যবহার হবার উপক্রম হয়ে উঠত। এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নাই। পাকিস্তান আনতে হবে এই একটাই শ্লোগান সকল জায়গায়।

একদিন হক সাহেব আমাদের ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। দাওয়াত নিব কি নিব না এই নিয়ে দুই দল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, “কেন যাব না, নিশ্চয়ই যাব। হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগে ফিরে আসতে। আমাদের আদর্শ যদি এত হালকা হয় যে, তাঁর কাছে গেলেই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাব, তাহলে সে পাকিস্তান আন্দোলন আমাদের না করাই উচিত।” আমি খুলনার একরামুল হককে সাথে নিলাম, যদিও সে ইসলামিয়ায় পড়ে না। তথাপি তার একটা প্রভাব আছে। আমাকে সে মিয়াভাই বলত। আমরা ছয়সাতজন গিয়েছিলাম। শেরে বাংলা আমাদের নিয়ে খেতে বসলেন এবং বললেন, “আমি কি লীগ ত্যাগ করেছি? না, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে? জিন্নাহ সাহেব আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেন না। আমি বাঙালি মুসলমানদের জন্য যা করেছি জিন্নাহ সাহেব সারা জীবনে তা করতে পারবেন না। বাঙালিদের স্থান কোথাও নাই, আমাকে বাদ দিয়ে নাজিমুদ্দীনকে নেতা করার ষড়যন্ত্র।” আমরাও আমাদের মতামত বললাম। একরামুল হক বলল “স্যার, আপনি মুসলিম লীগে থাকলে আর পাকিস্তান সমর্থন করলে আমরা বাংলার ছাত্ররা আপনার সাথে না থেকে অন্য কারও সাথে থাকতে পারি না। পাকিস্তান না হলে মুসলমানদের কি হবে?” শেরে বাংলা বলেছিলেন, “১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কে করেছিল, আমিই তো করেছিলাম! জিন্নাহকে চিনত কে?” আমরা তাকে আবার অনুরোধ করে সালাম করে চলে আসলাম। আরও অনেক আলাপ হয়েছিল, আমার ঠিক মনে নাই। তবে যেটুকু মনে আছে সেটুকু বললাম। তার সঙ্গে স্কুল জীবনে একবার ১৯৩৮ সালে দেখা হয়েছিল ও সামান্য কথা হয়েছিল গোপালগঞ্জে। আজ শেরে বাংলার সামনে বসে আলাপ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

এদিকে মুসলিম লীগ অফিসে ও শহীদ সাহেবের কানে পৌঁছে গিয়েছে আমরা শেরে বাংলার বাড়িতে যাওয়া-আসা করি। তার দলে চলে যেতে পারি। কয়েকদিন পরে যখন আমি শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “কি হে, আজকাল খুব হক সাহেবের বাড়িতে যাও, খানাপিনা কর?” বললাম, “একবার গিয়েছি জীবনে।” তাঁকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, “ভালই করছ, তিনি যখন ডেকেছেন কেন যাবে না?” আরও বললাম, “আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি মুসলিম লীগে আসতে।” শহীদ সাহেব বললেন, “ভালই তো হত যদি তিনি আসতেন। কিন্তু আসবেন না, আর আসতে দিবেও না। তাঁর সাথে কয়েকজন লোক আছে, তিনি আসলে সেই লোকগুলির জায়গা হবে না কোথাও। তাই তাঁকে মুসলিম লীগের বাইরে রাখতে চেষ্টা করছে।”

শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, কোন সংকীর্ণতার স্থান ছিল না তার কাছে। কিন্তু অন্য নেতারা কয়েকদিন খুব হাসি তামাশা করেছেন আমাদের সাথে। আমি খুব রাগী ও একগুয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হত আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেইজন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কি অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালবাসত। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতই। কারণ, সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম। একদিন বললাম, “স্যার, কোনো ছাত্র রোগগ্রস্ত হলে যে কামরায় থাকে, সেই কামরাটা আমাকে দিয়ে দেন। সেটা অনেক বড় কামরা দশ-পনেরজন লোক থাকতে পারে।” বড় কামরাটায় একটা বিজলি পাখাও ছিল। নিজের কামরাটা তো থাকলই। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, দখল করে নাও। কোনো ছাত্র যেন নালিশ না করে।” বললাম, “কেউই কিছু বলবে না। দু’একজন আমার বিরুদ্ধে থাকলেও সাহস পাবে না।”

বেকার হোস্টেলে কতগুলি ফ্রি রুম ছিল, গরিব ছাত্রদের জন্য। তখনকার দিনে সত্যিকার যার প্রয়োজন তাকেই তা দেওয়া হত। আজকালকার মত টেলিফোনে দলীয় ছাত্রদের রুম দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত না। ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশোনা করার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। আমি আর্টসের ছাত্র ছিলাম, তবু নারায়ণ বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি যদিও জানতেন, আমি প্রায় সকল সময়ই পাকিস্তান, পাকিস্তান করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলে এই কাজের ভার দিত কেন? কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে।

এই সময় আমি বাধ্য হয়ে কিছুদিনের জন্য ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই। অনেক চেষ্টা করেও দুই গ্রুপের মধ্যে আপোস করতে পারলাম না। দুই গ্রুপই অনুরোধ করল, আমাকে সাধারণ সম্পাদক হতে, নতুবা তাদের ইলেকশন করতে দেওয়া হোক। পূর্বের দুই বৎসর নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করেছি। ইলেকশন আবার শুরু হলে আর বন্ধ করা যাবে না। মিছামিছি গোলমাল, লেখাপড়া নষ্ট, টাকা খরচ হতে থাকবে। আমি বাধ্য হয়ে রাজি হলাম এবং বলে দিলাম তিন মাসের বেশি আমি থাকব না। কারণ, পাকিন্তুান ইস্যুর ওপর ইলেকশন আসছে, আমাকে বাইরে বাইরে কাজ করতে হবে। কলেজে আসতেও সময় পাব না। আমি তিন মাসের মধ্যেই পদত্যাগপত্র দিয়ে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদক করে দেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *