০১. সাগর-সৈকত হোটেল

ঠিক সমুদ্রের উপকূল ঘেষে ‘সাগর-সৈকত’ হোটেলটি। বলতে গেলে ছোটখাটো শহরটি যেন গড়ে উঠেছে সাগরেরই কূল ঘেষে। শহরটিতে নানা শ্রেণীর স্বাস্থ্যান্বেষীদের ভিড় ও আনাগোনা যেন লেগেই আছে। এবং একমাত্র বর্ষাকাল ব্যতীত বৎসরের বাকি সময়টা নানা জাতীয় নানা শ্রেণীর যাত্রীদের আনাগোনা চলে। মাঝে মাঝে হোটেলে স্থান পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে। সাগর-সৈকত হোটেলটির মালিক একজন সিন্ধী। সময়টা মাঘের শেষ এবং শীত এখনো যেন বেশ আঁকড়েই বসে আছে এখানে। কিরীটীর ধারণা, শীতকালে কোনো সমুদ্র-সৈকতই নাকি রৌদ্রসেবনের প্রকৃষ্ট স্থান এবং এমন কোন স্থানে আসতে হলে নাকি মনের মত একজন সঙ্গী বা সাথী অপরিহার্য, অতএব আমাকেও সে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে, আমার কোন যুক্তিতেই সে কান দিতে চায়নি।

আমি অনেক করে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, রৌদ্রসেবনের আমার আদৌ প্রয়োজন নেই, যেহেতু আমার জন্মগত দৈহিক কৃষ্ণবর্ণের উপরে আর এক পোঁচ কৃষ্ণ রঙ সূৰ্যদেবতার নিকট হতে আমি গ্রহণে একান্তই অনিচ্ছুক, কিন্তু আমার যুক্তি সে মেনে নিতে রাজী হয়নি, বলেছে, গায়ের রঙটাই বড় কথা নয় সুব্রত। আমাদের মাথার মধ্যে যে স্নায়ুকোষের গ্রে সেলগুলো আছে, সূর্যরশ্মির মধ্যস্থিত বেগুনী-পারের আলোর প্রভাবে সেগুলো আরো সজীব ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তা ছাড়া সমুদ্রের মত মনের খোরাকও কেউ দিতে পারে না। তুই দেখবি, কী আশ্চর্যরকম সক্রিয় করে তোলে রৌদ্রসেবন তোর মনকে ও চিন্তাশক্তিকে!

কিন্তু রৌদ্রসেবন তো এখানে বসেও চলতে পারে?

উহুঁ। এখানে হলে চলবে না। রৌদ্রসেবনেরও অনুপান আছে—সমুদ্রসৈকত। কিরীটী মাথা নেড়ে জবাব দেয়।

কিরীটীর যুক্তিকে হয়তো, তর্কের ঝঞ্চা তুলে কিছুক্ষণ ক্ষতবিক্ষত করতে পারতাম কিন্তু তাতেও তাকে নিরস্ত্র করা যেত না; কারণ রৌদ্রসেবন ও সমুচ-সৈকত একটা অছিলা মাত্র। মোট কথা মনে মনে কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা সে স্থির করেছে এবং কিছুদিনের জন্য সে সেখানে গিয়ে নিরবচ্ছিন্ন খানিকটা নিষ্ক্রিয় আরাম উপভোগ করতে চায় এবং সাথী হতে হবে আমায়। তাই বৃথা আর যুক্তিতর্কের জাল না বুনে একান্তভাবেই ওর হাতে আত্মসমর্পণ করে দিনপাঁচেক হল আমরা এই জায়গাটিতে এসে সাগর-সৈকত হোটেলে অধিষ্ঠিত হয়েছি এবং হোটেলের সামনে খোলা জায়গাটিতে বসে রীতিমত রৌদ্রসেবনও চলেছে আমাদের।

সাগর-সৈকত হোটেলটি থেকে সমুদ্র হাত-কুড়ি-পচিশের বেশী দূরে হবে না। হোটেলের বারান্দা হতে সমুদ্র একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়—ঐ দিগন্তে আকাশ ও সমুদ্র যেন প্রীতির আনন্দে কোলাকুলি করছে। একটানা সমুদ্রের নোনা বাতাসে ভেসে আসছে যেন অবিশ্রাম নিষ্ঠুর চাপা হাসির একটা উল্লাস। সফেন তরঙ্গগুলি যেন আদি-অন্তহীন সমুদ্রের ঝকঝকে করাল দন্তপাতি। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল। বলতে গেলে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মাটি, যেটুকু সমুদ্রের বলয়গ্রাসের বেষ্টনীতে বন্দী হয়ে আছে সেটুকুও যেন গ্রাস করবার জন্য দুরন্ত নিষ্ঠুর ঐ জলধির চেষ্টার অন্ত নেই। ব্যাকুল নির্মম লক্ষ লক্ষ বাহু প্রসারিত করে মুহুর্মুহুঃ সে মাটির বুকে দুরন্ত উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ক্ষুরধার তৃষিত লোল জিহবা দিয়ে লেহন করে নিষ্ঠুর কলহাসিতে যেন পরক্ষণেই আবার ভেঙে শতধায় গড়িয়ে ভূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

বেলা প্রায় সাড়ে আটটা হবে। সূর্যের তাপ এখনো প্রখর হয়নি। হোটেলের সামনেই বালুবেলার উপরে নিত্যকারের মত আমি ও কিরীটী দুটো ক্যামবিসের ফোলডিং চেয়ার পেতে কিরীটীরই নির্দেশমত শোলার হ্যাট চাপিয়ে গেঞ্জি গায়ে পায়জামা পরিধান করে যথানিয়মে রৌদ্রসেবন করছি। রৌদ্রসেবনের ফলাফল যাই হোক, শীতের সকালে সমুদ্রোপকূলে বসে রৌদ্রের তাপটুকু বেশ উপভোগই করছিলাম।

অল্প দূরেই সমুদ্র-সৈকত এবং শীতকাল হলেও নানাজাতীয় যুবা-বৃদ্ধ-পুরুষ-রমণী ও কিশোর-কিশোরী স্নানার্থী ও দর্শকদের ভিড়ে সমুদ্র-সৈকতটি আলোড়িত হচ্ছে এবং মধ্যে মধ্যে তাদের উল্লাসের সুস্পষ্ট গুঞ্জনও কানে আসছে সাগর-বাতাসে ভেসে।

হোটেলের সামনে যে জায়গাটিতে আমরা বসে আছি তাকে ছোটখাটো একটা উদ্যান বলা চলে। নানাজাতীয় পাতাবাহারের গাছ ও মরসুমী ফলের বিচিত্র রঙিন সমারোহ স্থানটিকে সত্যিই মনোরম করে রেখেছে। হোটেল থেকে যে পায়ে-চলা-পথটা বরাবর সাগর-সৈকতে গিয়ে মিশেছে, তার দু পাশে ঝাউয়ের বীথি। সাগর-বাতাসে ঝাউ গাছের পাতায় একটা করুণ কান্না যেন নিরন্তর দীর্ঘশ্বাসের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে।

অল্পক্ষণ আগে কিরীটী তার মাথা থেকে শোলার টুপিটা খুলে একটা মোটা লাঠির মাথায় বসিয়ে পাশেই বালুর মধ্যে লাঠিটা পুতে দিয়ে আড় হয়ে আরামকেদারটার ওপরে বাম হাঁটুর উপরে ডান পা-টা তুলে দিয়ে মৃদু মৃদু নাচাচ্ছিল সামনের সাগর-সৈকতের দিকে তাকিয়ে। হাতের মুঠোয় ধরা একটা ইংরাজী উপন্যাস। হঠাৎ আমাকে সম্বোধন করে বললে, সু, ঐ সাদা ফ্লানেলের লংস ও গায়ে কালো গ্রেট কোট একটা চাপিয়ে যুবকটি এই দিকেই আসছে, স্রেফ ওর চলা দেখে এই মুহূর্তে ওর মনের চিন্তাধারার একটা study করে বলতে পারিস কিছু?

হাতের মধ্যে ধরা বাংলা বইটা বাজিয়ে কিরীটীর কথায় সামনের দিকে তাকালাম, শ্লথ মন্থর পায়ে যুবকটি এইদিকেই আসছে। একেবারে পথের ধারের ঝাউবীথি ঘেষে আসছে যুবক। মুখের রঙ শ্যামবর্ণই। মাথার একরাশ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। চুলের সঙ্গে তেলের বা চিরুনির যে সংস্পর্শ বড় একটা নেই বোঝা যায় বিস্রস্ত রুক্ষ চুলগুলো দেখে। যুবকের দুটি হাতই পরিহিত গ্রেট কোটের দু পাশের পকেটে প্রবিষ্ট। মুখটা নিচু করে হাঁটার দরুন ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় কোন কারণে যুবক যেন একটু চিন্তিতই।

ভদ্রলোকটি বোধ হয় কিছু ভাবছেন!

ভাবছেন? কী ভাবছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে, হিত না অহিত?

চলতে চলতে ঐ সময় যুবকটি একবার সামনের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাল।

তা কী করে বলি, থটরীডিং তো জানা নেই!

থট রীড করতে তো বলিনি তোকে, বলেছি ভদ্রলোকের গেইট, অর্থাৎ চলাটা দেখে বলতে,—অর্থাৎ পা থেকে মাথা।

কিরীটীর মুখের কথাটা শেষ হল না, হঠাৎ কেমন একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল। সেই সঙ্গে-সঙ্গেই প্রায় উপবিষ্ট কিরীটীর পাশেই লাঠির মাথায় বসানো তার শোলার টুপিটা ছিটকে গিয়ে মাটিতে পড়ল ও অস্ফুট একটা কাতর শব্দও কানে এল।

ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। জায়গাটায় হাওয়া ছিল কিন্তু হাওয়ার বেগ এত ছিল না, যাতে করে সহসা অমন করে লাঠির মাথায় বসানো কিরীটীর টুপিটা উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়তে পারে।

সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, মাত্র হাত ৮।১০ ব্যবধানে একটু পূর্বে যে যুবকটিকে কেন্দ্র করে আমাদের কথাবার্তা চলছিল, সে বাঁ হাতে তার নিজের ডান কাঁধটা চেপে মাটির উপরেই বসে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলাম যুবকটির দিকে। তার সামনে গিয়ে পৌঁছবার আগেই যুবক উঠে দাঁড়িয়েছে, চোখে-মুখে তার সুস্পষ্ট একটা যন্ত্রণার চিহ্ন। যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম, পড়ে গিয়ে হঠাৎ কাঁধে লাগল বুঝি? পড়ে গেলেন কি করে?

আমার প্রশ্নে যুবকটি মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। মৃদুকণ্ঠে বললে, ঠিক বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কাঁধে যেন একটা ধাক্কা লাগতে পড়ে গেলাম আচমকা। না, তেমন কিছু লাগেনি।

হঠাৎ ধাক্কা লাগল মানে? বিস্মিত আমি প্রশ্ন করলাম।

কিরীটী ইতিমধ্যে তার টুপিটা মাটি হতে কুড়িয়ে আমাদের কাছে এসে কখন দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। সহসা অতি নিকটে তার কণ্ঠস্বর শুনে যুগপৎ আমরা দুজনেই ফিরে তাকালাম।

মনে হচ্ছে একটা বুলেট সুব্রত!

বুলেট! সবিস্ময়ে কথাটা উচ্চারণ করে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে ঘুরে তাকালাম।

কিরীটী কিন্তু তখনও গভীর মনোযোগ সহকারে তার হস্তধৃত টুপিটা ঘুরিয়ে দেখছে এবং দেখতে দেখতেই মৃদু কণ্ঠে বললে, হ্যাঁ নিশ্চয়ই it was a bullet and that blessed bullet pierced through and through my poor hat!

এবং কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় হস্তধৃত টুপিটা আমার চোখের সামনে তুলে ধরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথাটা? Well see—এই দেখ!

তাকিয়ে দেখলাম কিরীটীর কথা মিথ্যা নয়, সত্যি। টুপিটার দুই দিকে দুটি গোলাকার ছিদ্র।

কিন্তু সর্বাগ্রে আপনাকে একবার দেখা দরকার। বলতে বলতে কিরীটী আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান যুবকটির দিকে অগ্রসর হয়। বুঝতে অবশ্য পারছি আঘাতটা নিশ্চয়ই তেমন মারাত্মক হয়নি, তা হলেও আপনার কাঁধের ক্ষতস্থানটা একটিবার পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। জামাটা খুলেন তো!

না না—বিশেষ কিছু হয়নি, যুবকটি কাঁধের উপর থেকে ততক্ষণে হাতটা সরিয়ে নিয়েছেন। স্মিতভাবে বললেন, ব্যস্ত হবেন না।

আপনি বলছেন কি—মানে—

আমার নাম শতদল বোস। না, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে জবাবটা দিলেন মিঃ বোস। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় গায়ের গরম ওভারকোটটা খুলে ফেলে দিলেন। কোটের নিচে সাদা টুইলের শার্ট ছিল। দেখা গেল মিঃ বোসের কথাই সত্য। গুলিটা তাঁর কাঁধ ছুঁয়ে গেলেও কোটের নীচে শার্ট পর্যন্তও পৌঁছয়নি। বোধ হয় সামান্য কাঁধের উপর দিয়ে ছুঁয়ে গেছে, যার ধাক্কাতেই বেমক্কা তিনি টলে পড়ে গেছেন।

যাক গে—না লেগে থাকলেই ভাল! But it was a bullet-এযাত্রা খুব বেঁচে গেছেন যা হোক। কিরীটী স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে।

মিঃ বোস আবার কথা বলেন, কিন্তু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না তো! আপনি বলছেন একটা বুলেট, কিন্তু কই, কোন ফায়ারিং-এর শব্দও শুনলাম না! তা ছাড়া এখানে আমাকে গুলিই বা করবে কে? এবং কেন

কে আর করবে! করেছেন অবশ্য তিনিই যিনি হয়তো এ পৃথিবীতে আপনার বেঁচে থাকাটা বাঞ্ছনীয় মনে করছেন না। তা ছাড়া ফায়ারিং-এর শব্দ বলছেন? সমুদ্রের হাওয়া ও সী-বীচের স্নানার্থীদের একটানা হৈ-হল্লার মধ্যে ফায়ারিং-এর শব্দটা না শুনতে পাওয়াটাও বিশেষ কিছু আশ্চর্য নয়। তা ছাড়া পিস্তলে সাইলেন্সারও তো লাগানো থাকতে পারে। তাতেও আপনি ফায়ারিংএর শব্দ শুনতে পাবেন না। কিন্তু কেউ না কেউ যে একটা গুলি ছুড়েছে সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। বলতে বলতে হঠাৎ কথাটার মোড় ঘুরিয়ে কিরীটী অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, আপনিও আমাদের মতো স্বাস্থ্যান্বেষী নাকি মিঃ বোস? না এইখানেই থাকেন?

আজ্ঞে দুটোর একটাও নয়। মাসখানেক হল বিশেষ একটা কাজে এখানে এসে আছি। ঐ দেখছেন যে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের ওপর বাড়িটা—ঐ বাড়িতেই আমি থাকি।

শতদলবাবুর কথা অনুসরণ করে দক্ষিণদিকে আমরা তাকালাম। সমুদ্রের কোল ঘেষে একটা ছোট পাহাড়, তারই উপরে যেন ঐতিহাসিক দুর্গের মতো বাড়িটা দূর থেকে মনে হয়। দুর্গের মতো পাহাড়ের উপরের ঐ বাড়িটার প্রতি এখানে এসে পৌঁছবার পরদিনই প্রত্যুষে কিরীটী আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দূর হতে মনে হয় একখানা ছবি। পাহাড়টা লোকালয় হতে আধ মাইলটাক দূর তো হবেই।

কিরীটী শতদলবাবুর কথায় দূর পাহাড়ের মাথায় দুর্গের মতো বাড়িটার দিকে তখনও তাকিয়ে ছিল অন্যমনে। একসময় ঐ দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, অদ্ভুত জায়গায় বাড়িটা তৈরী করা হয়েছে। বাড়িটা যিনি তৈরী করেছিলেন তাঁর সম্পর্কে দুটো কথা কেউ না বললেও, স্বতঃই মনে হয়—

কী বলুন তো? সকৌতুকে শতদল প্রশ্ন করে।

প্রথমতঃ, যিনিই বাড়িটা তৈরী করে থাকুন, বিশেষ খেয়ালী-প্রকৃতির ছিলেন তিনি। দ্বিতীয়তঃ, তাঁর অর্থের অভাব ছিল না—

আশ্চর্য! সত্যি তাই। বাড়িটা আমার দাদামশাইয়ের। এককালে পূর্ববঙ্গে ওঁদের সবিস্তীর্ণ জমিদারী ছিল। যার আয় ছিল শুনেছি প্রায় বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকা। আর দাদামশাই লোকটিও ছিলেন নিজে একজন নামকরা চিত্র ও মৃৎশিল্পী। শিল্পী রণধীর চৌধুরীর নাম শুনেছেন নিশ্চয়!

নিশ্চয়ই। শুনেছি বৈকি। অত বড় শিল্পপ্রতিভা নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম লোকই জন্মেছেন। আপনি তাঁরই দৌহিত্র?

হ্যাঁ। তাঁর একমাত্র মেয়ের একমাত্র পুত্র। তাঁর বিরাট সম্পত্তির শেষ ও একমাত্র অবশিষ্ট তাঁর ঐ নিরালা নামক পাহাড়ের ওপরে বাড়িখানার ওয়ারিশন। মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে শতদল বললে।

একজন শিল্পীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মূল্যের দিকে যাচাই করতে গেলে হয়তো আপনাকে হতাশই হতে হবে। কিন্তু সাগরের উপকূলে ঐ পাহাড়ের উপর নগরের কোলাহল হতে দূরে অমন একখানা বাড়ির মধ্যে যে মহামূল্যবান সৌন্দর্য-সৃষ্টির ইঙ্গিত ওর প্রতিটি গাঁথুনির মধ্যে ওতোপ্রোত হয়ে জড়িত আছে, তার মূল্য নিছক স্রেফ কাঞ্চনমুল্যে তো ধার্য করা যায় না শতদলবাবু। বিশেষ মূল্যেই যে ওর বিশেষত্ব।

শতদলবাবু কিরীটীকে বাধা দিয়ে কী বলতে উদ্যত হতে কিরীটী বলে ওঠে, না না শতদলবাবু এ সংসারে সব কিছুকেই নিছক টাকার নিক্তিতে ওজন করবেন না। এ শিল্পীর প্রতিভা আপনিও হয়তো আমার দাদার মতই শিল্প-পাগল, তাই ওই নির্জন সমুদ্রের উপকূলে জনমানবের বসতি ছাড়িয়ে পাহাড়ের উপর বাড়িখানা দূর থেকে দেখেই অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যের আভাস পাচ্ছেন। এবং বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করলে হয়তো আরও কিছু দেখতে পাবেন। কারণ বাড়ি-ভর্তি সব নর-নারীর স্ট্যাচু এবং অয়েল ও ওয়াটারকলার পেন্টিং, এ ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু আমি অত্যন্ত বস্তুতান্ত্রিক লোক, অতি সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ, আমার কাছে ওর কী-ই বা মূল্য বলুন! শতদল হাসতে হাসতে বলে।

মানুষের মন এমনিই বিচিত্র বটে মিঃ বোসু কিন্তু মন আপনার যতই বস্তুতান্ত্রিক হোক, আপাততঃ ক্ষমা করবেন, একটা কথা আপনাকে আমি কিন্তু না বলে পারছি না—আপনার প্রাণটি নেবার জন্য কেউ-না-কেউ অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন।

এবারই হাসালেন মশাই। আমার মত একজন অতি সাধারণ লোকের প্রাণের এমন কি মূল্য আছে বলুন তো যে সেটি নেবার জন্য কেউ উদগ্রীব হয়ে উঠবে! না আছে আমার অগাধ সম্পত্তি, না আছে এ দুনিয়ায় আমার কোন শত্রু।

হতে পারে, তবে আমার কথায় যদি বিশ্বাস করেন তাহলে জানবেন it was a pure and simple attempt on your life!

সত্যি নাকি? আমার কৌতূহলটা মাপ করবেন, আপনার নামটি জানতে পারি কি?

কিরীটী রায়। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।

নমস্কার। আপনিই কি বিখ্যাত সেই রহস্যভেদী কিরীটী রায়?

বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই কিরীটী রায়। মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়।

আর উনি?

সুব্রত।

কী সৌভাগ্য, আপনার মত লোকের এখানে পদার্পণ হয়েছে অথচ জানতেও পারিনি! তা আসুন না আজ আমার বাড়িতে। রাত্রির আহারূপর্বটা গরীবের ঘরেই সারবেন।

বিলক্ষণ, সে একদিন হবেখন। তবে আজ নয়, কাল সকালের দিকে যাব, আপনার ঐ বাড়িটা দেখতে। কিরীটী জবাব দেয়।

আসবেন, নিশ্চয় আসবেন কিন্তু। শতদলবাবু অনুরোধ জানান দরদ দিয়ে।

যাব। কিন্তু আমার কথাটা মনে থাক যেন।

কি বলুন তো? শতদল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল আবার।

একটু সাবধানে থাকবেন। আপনার আততায়ীটীর নিশানা একবার ব্যর্থ হলেও, বার বার ব্যর্থ নাও হতে পারে।

সত্যিই কি আপনার তাই সন্দেহ নাকি কিরীটীবাবু, আমার জীবনের উপরেই কেউ attempt নিয়েছিল!

কোন ভুল নেই তাতে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, একটু ভেবে বলুন তো—আজকের এই দুর্ঘটনার আগে আপনার অন্য কোন accident দুদশদিনের মধ্যে হয়েছে কিনা?

Accident!

হ্যাঁ, মানে কোনপ্রকার দুর্ঘটনা?

কই, এমন বিশেষ কোন ঘটনা তো আমার মনে পড়ছে না যাকে প্রাণহানিকর দুর্ঘটনার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে।

ভেবে দেখুন

না মশাই। তবে, কিন্তু তাকে দুর্ঘটনাই বা বলি কি করে এবং সেগুলো যে আমার জীবনের ওপরেই attempt নেওয়া হয়েছে তাই বা

কী ঘটেছিল বলুন তো?

এমন বিশেষ কিছুই নয়। এই তো পরশু রাত্রে যে ঘরে শুই—আমার ঠিক শিয়রের ধারে মাথার উপরে দেওয়ালের গায়ে মস্ত বড় একটা অয়েলপেন্টিং টাঙানো ছিল, হঠাৎ মাঝরাত্রে সেটা ছিড়ে আমার মাথার কাছেই পড়ে—অবশ্য অল্পের জন্যই আঘাত পাইনি

হুঁ। আর কোন ঘটনা ঘটেছে?

গতকাল সন্ধ্যার সময় পাহাড়ের গায়ের ঢালু পথ বেয়ে নিচে নেমে আসছি, হঠাৎ একটা বড় পাথরের চাঁই গড়াতে গড়াতে আর একটু হলে হয়তো আমার ঘাড়েই পড়ত এবং ঐ পাথরটা এসে গায়ে পড়লে একেবারে যে পিষে ফেলত তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে দুটো ব্যাপারই তো pure and simple accident! আমার জীবনের ওপরে attempt বলি কী করে! আপনি না বললে হয়তো মনেও পড়ত না, ভুলেই গিয়েছিলাম।

ভুলে যে যাননি তার প্রমাণ আপনার ঘটনা দুটির narration এবং আগের দুটি যেমন আপনার জীবনের উপরে attempt হয়েছিল, আজও ঠিক তেমনি চেষ্টা হয়েছিল। তিন-তিনবার নিষ্ফল হয়েছে যখন, চতুর্থবারের প্রচেষ্টা হয়তো খুব শীঘ্রই হবে। সাবধান হবেন।

কিরীটীর চরিত্রের সঙ্গে আমি যতখানি পরিচিত অনেকেই তা নয় এবং বিশেষ করে সে যখন কোন সাবধান বাণী উচ্চারণ করে, তার গুরুত্ব যে কতখানি সেও আমার চাইতে বেশী কেউ জানে না। কিন্তু শতদলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, তিনি যেন কিরীটীর কথায় কোন গুরুত্বই আরোপ করতে পারছেন না। সামান্য দু-চারটে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝেছিলাম, শতদলবাবু মানুষটি বেশ দিলখোলা ও সরল প্রকৃতির। সংসারের কূটনীতি যেন তাঁকে কোনরুপে স্পর্শই করতে পারে না।

শতদল হাসতে হাসতেই এবার প্রত্যুত্তর দিলেন, আপনি যখন অত করে বলছেন মিঃ রায়, চেষ্টা করব সাবধান হতে।

হ্যাঁ, করবেন। এবং শুধু বাইরেই নয়, বাড়ির মধ্যেও সাবধানে থাকবেন।

বাড়ির মধ্যেও সাবধানে থাকব? কী বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না!

এই ধরুন, যে ঘরে আপনি রাত্রে শয়ন করেন সে ঘরটা ভাল করে দেখেশুনে শোবেন।

কেন বলুন তো, রাত্রেও কেউ আমার শয়নঘরে চড়াও হয়ে আমার প্রাণহানি করবার চেষ্টা করবে নাকি?

ঘরের বাইরে ও ভিতরে যখন চেষ্টা হয়েছে, সেটা কিছু অসম্ভব নয়।

সহসা এমন সময় কুড়ি-বাইশ বৎসরের অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণী হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শতদলবাবুকই সম্বোধন করে বললে, বাবাঃ, এতক্ষণে তোমার আসবার সময় হল? দোতলার বারান্দা থেকে তোমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসছি। স্টেশনে আসনি কেন?

তরুণীর কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে আমরা তিনজনেই আগন্তুক তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।

এই তো, সবে সকালেই আজ তোমার চিঠি পেয়েছি রাণু—তুমি কবে এসে পৌচেছ?

কাল সকালের গাড়িতে, রাণু জবাব দেয়, কিন্তু সত্যি তুমি আজই আমার চিঠি পেয়েছ?

হ্যাঁ। কৌতুকোজ্জল দৃষ্টিতে তাকায় শতদল রাণুর মুখের দিকে। বিশ্বাস করি না। অভিমান-ক্ষরিত কণ্ঠে রাণু, জবাব দেয়।

সে হবেখন। এসো আগে এদের সঙ্গে তোমার আলাপটা করিয়ে দিই রাণু। আশ্চর্য ভাবেই এদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল এইমাত্র। একে চেনো? বিখ্যাত রহস্যভেদী কিরীটী রায় আর ইনি সুব্রত রায়।

শতদলের কথায় রাণু, আমাদের দিকে তাকাল। কিন্তু আমাদের পরিচয় পেয়ে যে সে বিশেষ কিছু আনন্দিত হয়েছে তেমন কোন কিছু তার মুখের চেহারায় বোঝা গেল না।

তথাপি সে হাত তুলে বোধ হয় একান্ত সৌজন্যের খাতিরেই আমাদের নমস্কার জানাল।

সহসা এমন সময়ে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চল, সুব্রত, সমুদ্রের ধারে একটু বেড়িয়ে আসা যাক।

বলে কাউকে কোনরুপ আর কোন কথার অবকাশ মাত্রও না দিয়ে সমুদ্রসৈকতের দিকে এগিয়ে চলল। অগত্যা কতকটা যেন বাধ্য হয়েই তাকে আমি অনুসরণ করলাম।

কিরীটীর হঠাৎ এভাবে চলে আসাটা কেমন যেন আকস্মিক ও বিসদৃশ বলেই আমার কাছে মনে হল।

কিন্তু কিরীটী বেশী দূর অগ্রসর না হয়েই সামনেই জলের একেবারে কোল ঘেষে বালুর উপরেই একটা জায়গায় হঠাৎ বসে পড়ল। আমিও পাশে বসলাম।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। বুঝলাম, কোন একটা বিশেষ চিন্তা আপাততঃ কিরীটীর মাথার মধ্যে ফেনিয়ে চলেছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, কি ভাবছিস কিরীটী?

কিরীটী আনমনে সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সেই দিকেই তাকিয়ে সে বলল, পর পর দুটি আবির্ভাব। বুলেট ও নারী সুন্দরী তরুণী!

কিরীটীর কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল যাতে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে আমি পারলাম না।