০১. সম্পাদকের কথা / স্মৃতিচারণ

বুক ওয়ার্ল্ড সংস্করণ : সম্পাদকের কথা

আমার স্বামী প্ৰয়াত কবি বিজনকৃষ্ণের দীর্ঘদিনের প্রয়াসে ও কঠোর শ্রমে ১৯৯৯ সালে ‘বাউলকবি রাধারমণ গীতি সংগ্রহ’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। আগরতলার সরস্বতী বুক ডিপো এর প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। গ্রন্থটির পাঁচশত কপি ছাপা হয়। এবং অচিরেই তা নিঃশেষ হয়ে যায়। সুখের কথা, গ্রন্থটির গুরুত্ব বিবেচনা করে তার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য অনেক সাহিত্যানুরাগী মরমী মানুষ উদ্যোগী হয়েছেন।

কবি বিজনকৃষ্ণ যে পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন সেখানে সঙ্গীত চর্চার একটি আবহাওয়া ছিল। কবির মাতৃকুলের অনেকেই বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। বাউল কবি রাধারমণের ‘গীত নানা উৎসবের অঙ্গরূপে তাদের গৃহে গীত হত। বিশেষত ধামাইল নৃত্যে রাধারমণের গীতির একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল কবির মাতৃদেবী রাধারমণের গীত’ -এ পারদর্শিনী ছিলেন। সুতরাং কবি বিজনকৃষ্ণ শৈশব থেকেই কবি রাধারমণের গীতি মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

এপার ও ওপার বাংলার গ্রামের কীর্তনের আসর থেকে হাটে মাঠে ঘাটে এবং নদীর বুর্কে এ গান আজও ধ্বনিত হয়। স্বভাবতই তাঁকে ছুটে যেতে হয়। গ্রামে। ১৯৮০ থেকে তিনি সাধক কবির এই সব অসামান্য গীতিমালা সংগ্ৰহ করতে শুরু করেন। তার এক সময়ের সহপাঠীদের অনেকেই তাকে একাজে সহায়তা করেন। এবং তঁকে সংগ্রহকর্মের বিভিন্ন স্তরে তার শ্ৰদ্ধেয় অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচাৰ্য মহোদয় যে কারণে গ্রন্থটির রচয়িতা হিসেবে বিজনকৃষ্ণ তাঁর নামের পূর্বে অধ্যাপক ভট্টাচার্যের নামটি যথার্থ মর্যাদায় শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেন। গ্রন্থটির প্রথম মুদ্রণে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক ভট্টাচার্য শুধু যে বিজন কৃষ্ণের প্রয়াসের প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ করেছেন তাই নয়, তাঁর সংগ্রহ থেকে কিছু সংখ্যক গীতি গ্রন্থটিতে মুদ্রণের অনুমতি দিয়েও বিজনকৃষ্ণকে বিশেষ ঋণী করেছিলেন। (বর্তমান সংস্করণে অধ্যাপক ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণের অংশ বিশেষ সংযোজিত হওয়ায় গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মর্যাদা রক্ষিত হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।)

বিজনকৃষ্ণ যখন বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে গীতিমালা সংগ্ৰহ করছেন, তখন তিনি শারীরিকভাবে অত্যুম্ভ অসুস্থ। হাঁটা চলা তাঁর পক্ষে কষ্টকর ছিল। দেহের পীড়াকে উপেক্ষা করে অনেক গ্রামে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সংগ্ৰহ কর্মচালিয়ে গেছেন। মানুষ তাকে সহায়তা করেছেন। কখনও গ্রামে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অচেনাময় ভগ্নীরা তাকে সেবা দিয়ে ভাল করে তুলেছেন। বহু পল্পীর মা এবং বোনেরা গান গেয়ে গেয়ে এই সঙ্গীত সংগ্রহের কাজে সহায়তা করেছেন। সংগ্ৰহকর্ম সম্পূর্ণ হবার পর যখন গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি প্ৰস্তুত করে সেটি প্রকাশের চেষ্টা হচ্ছিলো। ঠিক তখনই রাধারমণের নিকট আত্মীয় শ্ৰীদেবব্রত চৌধুরী মহাশয় বিনা অর্থমূল্যে তাঁর প্রেস থেকে সেটির প্রকাশ তরান্বিত করেছেন।

বর্তমানে ‘জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনীর শ্ৰীদেবানন্দ দাম গ্রন্থটির নতুন টজ্ঞান বিচিত্রা’ সংস্করণ প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করায় অনেক দিনের একটি প্রয়োজন সাধিত হল।

বর্তমানে সংস্করণটি পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মুরারিচাঁদে কলেজের অধ্যাপক এবং সুসাহিত্যিক শ্ৰীযুক্ত নন্দলাল শৰ্মা মহাশয়ের টরাধারমণের হাজার কবিতা’ সংকলন থেকে বেশ কিছু সংখ্যক গীত তাঁর সানুগ্রহ অনুমতিতে বর্তমান সংস্করণে সন্নিবেশিত হয়েছে। পূর্বে এগুলি গ্রন্থটিতে ছিল না। তাই এই সংযোজনে পুস্তকটির মান আরো বর্ধিত হবে। অধ্যাপক মহোদয়ের নিকট বিনম্র কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি।

প্রখ্যাত ছড়াকার ও কবি ও ত্রিপুরার মন্ত্রী শ্ৰীযুক্ত অনিল সরকার মহোদয় গ্রন্থটির নতুন একটি সংস্করণ প্রকাশের জন্য সবসময় উৎসাহিত করেছেন। তঁর এই আগ্রহ প্রকাশের জন্য তার প্রতি আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ।

আমাদের অতি নিকট আত্মীয়রা এবং রবীন্দ্র পরিষদের সদস্য এবং সদস্যদের অনেকেই বর্তমান সংস্করণটি প্রকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনো অবকাশ নেই বলেই সে চেষ্টা করছি না। পরিশেষে, যথার্থ সাহিত্য ও সঙ্গীতানুরাগী মানুষের কাছে যদি এই গ্রন্থটির হৃদয়স্পশী আবেদন পৌঁছায় তাহলেই বিজনকৃষ্ণের প্রয়াস সার্থক হবে। ইতি, ২ অক্টোবর, মহালয়া, ২০০৮

বিনীতা
রাজলক্ষ্মী চৌধুরী

সুহৃদয়’
রামনগর ৪-৫ (প্রথম গলি)
আগরতলা–২


স্মৃতিচারণ [ প্ৰথম মুদ্রণের অংশবিশেষ ]

শ্ৰীমান বিজনকৃষ্ণ ১৯৫৯ খৃ. হইতে প্রায় এক বৎসর কটন কলেজের বাংলা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি তখন প্রায় প্রত্যহ আমার বাড়ী আসিতেন। সেই সময় আমার সঙ্কলিত বাংলা পুঁথির তালিকাসমন্বয়ের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি প্ৰস্তুতির কাজ চলিতেছিল। একদিন কথা প্রসঙ্গে শ্ৰীমানকে আমাদের স্বজেলাবাসী পল্লীকবি রাধারমণের কথা বলি। রাধারমণের কয়েকশত গান আমার সংগ্রহেছিল।সংগৃহীত গানগুলি মোটামুটিবিষয়ানুসারে সাজানোও ছিল। আমার সংগৃহীত গানের বর্ণানুক্রমিক প্রথম পংক্তি সূচীও আংশিক করা ছিল। চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করিয়া বুঝিলাম তিনিও আমার মতো পল্লীকবি রাধারমণের গানের এক মুগ্ধ তথা নৈষ্ঠিক শ্রোতা। তিনি এই পল্লীকবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনুভব করিয়া আমি আনন্দিত হই।

শ্ৰীমান বিজনের রাধারমণ শ্ৰীতি লক্ষ্য করিয়া তাহাকে একদিন বলিলাম–আমার নানা কাজে এমনভাবে জড়াইয়া পড়িয়াছি যে, আমার পক্ষে রাধারমণের গান সংগ্রহ ও সম্পাদুনের জন্য উপযুক্ত সময় দেওয়া আর সম্ভব হইতেছে না। তিনি যদি এই সঙ্কলন সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সুযোগমত শ্ৰীহট্ট গিয়া রাধারমণের গান ও পাঠান্তর সংগ্ৰহ করিয়া আনেন এবং এই কাজ আমার নির্দেশমত সম্পূর্ণ করিতে উৎসােহবোধ করেন, তাহা হইলে তঁহার ও আমার যুগ্ম সম্পাদনায় ইহা প্ৰকাশ করিতে আমি সানন্দে রাজী হইব। আমার সংগৃহীত রাধারমণের গানের পাণ্ডুলিপি, মুদ্রিত গ্ৰন্থ ও প্রবন্ধাদি তাহার হাতে তুলিয়া দিয়া ভার মুক্ত হইতে আগ্রহী হইলাম। এ স্থলে উল্লেখ করা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না যে এ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত গ্রন্থাদির মধ্যে দুইখানি গ্রন্থের আমি যুগ সম্পাদক ছিলাম। গত ১৯৫০ খৃ, তদানীন্তন আসামের ডি. পি. আই, শ্ৰদ্ধেয় সতীশচন্দ্র রায়, এম. এ. (লন্ডন, আই.ই.এল) এবং আমার যুগ্ম সম্পাদনায় “স্বদেশ প্রেমিক রমাকান্ত রায়” গ্রন্থটি কলিকাতার চক্রবতীর্ণ চ্যাটাজী কোম্পানী প্ৰকাশ করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থের ভূমিকা লেখেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য শ্রদ্ধেয় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় গ্রন্থ রায়শেখরের পদাবলী,ইহা শ্ৰীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, আমার বয়ঃজ্যেষ্ঠ সুহৃৎ স্বৰ্গত দ্বারেশচন্দ্ৰ শৰ্মাচার্য এম.এ, এবং আমার যুগ্ম সম্পাদনায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১৯৫৫ খৃ: প্রকাশিত হইয়াছিল। একসময় আমি শ্ৰীমান বিজয়কৃষ্ণকে বলিয়াছিলাম যে রাধারমণের গানের সম্পূর্ণ প্রেসকপি, প্রস্তুত করিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “বাংলা গ্ৰন্থ প্রকাশন সমিতি’তে দাখিল করিতে চাই। এই উদ্দেশ্যে গত ২৬.৫.৮৪ খৃঃ তারিখের এক আবেদনপত্রে বিজনকৃষ্ণ ও আমার দস্তখত ছিল। সেই আবেদন পত্ৰখানি “রাধারমণের” গান সংক্রান্ত আমার ব্যক্তিগত ফাইলে রহিয়াছে। ইহা নানা কারণে কখনও দাখিল করা হয় নাই। আমার ধারণা ছিল, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা প্রকাশনা বিভাগ এই গ্ৰন্থ প্রকাশে রাজী হইতে পারেন। কিন্তু এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি কলিকতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসে গেলে আমার জীবৎকালে তাহা মুদ্রণের কোন সম্ভাবনা নাই। এ পর্যন্ত আমার ছয়খনি গ্ৰন্থ কলিকতাবিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করিয়াছিলেন। ষষ্ঠ গ্ৰন্থ ‘বাঙ্গালার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবির পদমঞ্জুষা’ ১৪ বৎসর কলিকতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করিয়া গত ১৯৮৪ খৃ, প্রকাশিত হইয়াছে। আমার সপ্তম গ্ৰন্থ ক্ষেমানন্দ কেতকাদাসের মনসামঙ্গলের তৃতীয় সংস্করণ। এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ ১৯৪৩ খৃ, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৪৯ খু, তৃতীয় সংস্করণের ৬০০ পৃষ্ঠা এ পর্যন্ত মুদ্রিত। অবশিষ্ট শাখানিক পৃষ্ঠা ছাপিলেই ইহা প্রকাশিত হইতে পারে। কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসে যাওয়া ও ধর্ণা দেওয়ার ক্ষমতা আর নাই। তাই মনে হইতেছে আমার জীবিতকালে এই সংস্করণের গ্রন্থকারে মুদ্রণের কোন সম্ভাবনা আর নাই। ১৫/১৬ বৎসর পূর্বে মুদ্রিত ফর্মগুলির গতি কি হইতেছে ভাবিয়া পাইতেছি না।

এই গ্রন্থ সম্পাদনের দায়িত্ব যেমন শ্ৰীমান বিজনকৃষ্ণের উপর ন্যস্ত হইয়াছিল। তদুপ গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্বও তাহার উপর বর্তিল। শ্ৰীমানের নিষ্ঠা ও একাগ্রতার ফলশ্রুতি এই গ্রন্থ প্রকাশ। এই গ্ৰন্থ সম্পাদন ও প্রকাশের কোন কৃতিত্ব থাকিলে তাহা শ্ৰীমানের প্রাপ্য। ইহার ক্রটি বিদ্যুতির সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার। বর্তমানে আমি এক অশীতিপর অকৰ্মণ্য বৃদ্ধ। দৃষ্টিশক্তি ক্ৰমশঃ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইতেছে। আমার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করিয়া শ্ৰীমান আমাকে একটি ফর্মার প্রুফও দেখিতে দেন নাই।

শ্ৰী যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচাৰ্য
১৫ জনতা রোড, সন্তোষপুর
কলিকাতা-৭৫
৪ আগষ্ট, ১৯৮৭ খৃ.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *