০১. সকাল

সকাল

স্বপ্নে সুজাতা বাইশ বছর আগেকার এক সকালে ফিরে গিয়েছিলেন, প্রায়ই যান। নিজেই ব্যাগে গুছিয়ে রাখেন তোয়ালে, জামা, শাড়ি, টুথব্রাশ, সাবান। সুজাতার বয়স এখন তিপান্ন। স্বপ্নে তিনি দেখেন একত্রিশ বছরের সুজাতাকে, ব্যাগ গোছানোয় ব্যস্ত। গর্ভের ভারে মন্থর শরীর, তখনো যুবতী এক সুজাতা ব্রতীকে পৃথিবীতে আনবেন বলে একটি একটি করে জিনিস ব্যাগে তোলেন। সেই সুজাতার মুখে বার বার যন্ত্রণায় কুঁচকে যায়, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না সামলে নেন সুজাতা, স্বপ্নের সুজাতা, ব্রতী আসছে।

সেদিন রাত আটটা থেকেই যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল, হেম অভিজ্ঞর মত বলেছিল, পেট নাবুতে নেমেছে মা। আর দেরি নেই। হেমই ওঁর হাত ধরে বলেছিল, ভাল ভালতে দুজনেই দু’ ঠাঁই হয়ে ফিরে এস।

যন্ত্রণা হচ্ছিল, ভয়ানক যন্ত্রণা। যে কোন সময়ে সন্তান হতে পারে বলে সুজাতা আগের দিন থেকেই নার্সিংহোমে। জ্যোতির। বয়স তখন দশ, নীপার আট, তুলির ছয়। শাশুড়ি সুজাতার কাছেই ছিলেন, মনে আছে। জ্যোতির বাবা শাশুড়ির একমাত্র সন্তান। একটি সন্তান হতেই শাশুড়ি বিধবা। সুজাতার সন্তান হওয়া দেখতে পারতেন না তিনি, ভয়ংকর বিদ্বেষের চোখে তাকাতেন। ঠিক সন্তান হবার সম-সমকালে চলে যেতেন বোনের বাড়ী, সুজাতাকে অকূলে ভাসিয়ে।

স্বামী বলতেন মা অত্যন্ত নরম, বুঝলে? তিনি এসব দেখতে পারেন না, যন্ত্রণা-টন্ত্রণা—চেঁচামেচি।

অথচ সুজাতা চেঁচাতেন না, কাতরাতেন না কখনো। দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে ছেলেমেয়েদের বিলিব্যবস্থা করতেন। সেবার শাশুড়ি এখানে ছিলেন, কেননা বোন কলকাতায় ছিলেন না? জ্যোতিদের বাবা কানপুর গিয়েছিলেন কাজে, মনে আছে। দিব্যনাথ জানতেনও না মা থেকে যাবেন এবার। থাকেন না, এবার থাকবেন না এই জানতেন। তবু সুজাতার জন্য ব্যবস্থা করে যান নি দিব্যনাথ। কোনদিনই করেন নি। সুজাতা বাথরুমে গিয়ে যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠেন। ভয় পেয়ে যান রক্ত দেখে। নিজেই সব গুছিয়ে নেন, ঠাকুরকে বলেন ট্যাক্সি আনতে।

নার্সিংহোম চলে যান একা একা। ডাক্তার খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন খুব। সুজাতার চোখ যন্ত্রণায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, যেন চোখের ওপর কাচ ঢেকে দিচ্ছিল কে, অস্বচ্ছ কাচ। জোর করে চোখ খুলে ডাক্তারের দিকে চেয়ে সুজাতা বলেছিলেন, অ্যাম আই অলরাইট?

নিশ্চয়।

চাইলড?

আপনি ঘুমোন।

কি করবেন?

অপারেশন।

ডাক্তরবাবু, চাইলড?

আপনি ঘুমোন। আমি ত আছি। একা এলেন কেন?

উনি নেই।

সুজাতা অবাক হয়েছিলেন। তিনি ত’ আশাই করেন নি, কলকাতায় থাকলেও দিব্যনাথ সঙ্গে আসবেন, ডাক্তার কেন আশা করেন। দিব্যনাথ সঙ্গে আসেন না, সুজাতাকে নিয়ে যান না সময় হলে। নবজাতকের কান্না শুনতে হবে বলে তেতলায় ঘুমোন। সন্তানদের অসুখ হলেও রাতে খোঁজ নেন না। তবে দিব্যনাথ লক্ষ্য করেন, সুজাতাকে লক্ষ্য করে দেখেন, আবার মা হবার যোগ্য শরীর হচ্ছে কিনা সুজাতার।

টনিক খাচ্ছ ত?

গাঢ়, যেন কফবসা গলায় জিগ্যেস করেন দিব্যনাথ। কামনায় অস্থির হলে ওঁর গলায় যেন কফ জমে থকথকে হয়ে যায় স্বর। সুজাতা জানেন দিব্যনাথকে। দিব্যনাথ তাঁর শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেবার একটি অর্থই হতে পারে। ডাক্তার কি করে জানবেন দিব্যনাথকে?

সুজাতাকে ওষধে দেন। ওষুধে ব্যথা কমে নি। সেই সময়ে সহসা সুজাতার মনে ভীষণ ব্যাকুলতা এসেছিল সন্তানের জন্যে। তুলি হবার পর ছ’ বছর কেটে যায় প্রায়। অনেক কষ্টে সুজাতা নিজেকে রক্ষা করেছিলেন, শেষ রাখতে পারেন নি।

তাই অশ্লীল, অশুচি লেগেছিল নিজেকে ন’মাস ধরে। শরীরের ক্রমবর্ধমান ভারকে মনে হয়েছিল অভিশাপ। কিন্তু যখন বুঝলেন তাঁর আর সন্তানের জীবনসংশয় হতে পারে, তখনি বুক ভরে উঠেছিল ব্যাকুল মমতায়। সুজাতা ডাক্তারকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, অপারেশন করন ওকে বাঁচান।

তাই ত করছি।

ডাক্তারের কথায় নাস ইঞ্জেকশন দেয়। যন্ত্রণা সুজাতার তলপেট ফুড়ে ফুঁড়ে ঢুকছিল আর বেরোচ্ছিল। উনিশশো আটচল্লিশ সাল। যোলই জানুআরি। সুজাতা বিছানার সাদা চাদর খামচে ধরছিলেন বার বার। কপাল ঘেমে উঠছিল। চোখের নিচে কালো দাগটা ছড়িয়ে পড়ছিল, বড় হচ্ছিল। একটুও শীত করছিল না সুজাতার। অথচ সে জানআরিতে তীব্র শীত।

 

তলপেটে যন্ত্রণা ফুঁড়ে ফুঁড়ে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। বিছানার সাদা চাদর খামচে ঘামতে ঘামতে সুজাতা জেগে উঠলেন। পাশে জ্যোতির বাবাকে দেখে তাঁর সাদা কপালে লম্বা ভুর দুটো কুঁচকে গেল। জ্যোতির বাবা পাশের খাটে কেন? তারপর মাথা নাড়লেন। ব্রতী হবার দিন জ্যোতির বাবা কাছে ছিলেন না, তাই সুজাতার স্বপ্নেও দিব্যনাথ কখনো থাকেন না, কিন্তু এখন ত আর স্বপ্ন দেখছেন না সুজাতা।

তারপর কোনমতে হাত বাড়ালেন। ব্যারালগান ট্যাবলেট। জন্স। ট্যাবলেট খেলেন, জল খেলেন। আঁচল দিয়ে কপাল মুছলেন।

আবার শলেন। এখন খুব দরকার এক থেকে একশো গুণে ফেলা। ডাক্তারের নির্দেশ। গণলেই ব্যথা কমে যায়। গণিতে যা সময় লাগে, তার মধ্যেই ব্যারালগান কাজ করতে শুরু করে। ব্যথা কমে।

তারপর ব্যথা কমে। সুজাতাকে ক্লান্ত, অবসন্ন, পরাজিত করে ব্যথা কমে। ব্যথা এখনই কমেছে। এখন ব্যথা কমা দরকার। ঘড়ির দিকে চাইলেন। ছ’টা বেজেছে। দেওয়ালের দিকে চাইলেন। ক্যালেণ্ডার। সতেরই জানুআরি। ষোলই জানুআরী সারারাত যন্ত্রণা ছিল, জ্ঞানে-অজ্ঞানে, ইথারের গন্ধ, চড়া আলো, আচ্ছন্ন যন্ত্রণার ঘোলাটে পদার ওপারে ডাক্তারদের নড়াচড়া সারারাত, সারারাত, তারপর ভোরবেলা, সতেরই জানুআরি ভোরে ব্রতী এসে পৌঁছেছিল। আজ সেই সতেরই জানুআরি, সেই ভোর, দ’ বছর আগে সতেরই জানুআরি এই ঘরে, এমনি করে এই লোকটির পাশের খাটেই ঘুমোচ্ছিলেন সুজাতা। টেলিফোন বেজেছিল। পাশের টেবিলে। হঠাৎ।

টেলিফোন বাজছে। জ্যোতির ঘরে। দ’বছর আগে সেদিনের পরেই জ্যোতি টেলিফোনটা ওর নিজের ঘরে নিয়ে যায়, বিবেচক, বিবেচক জ্যোতি। তাঁর প্রথম সন্তান,তাঁর জ্যেষ্ঠ। দিব্যনাথের অনুগত ও বাধ্য ছেলে। বিনির সহৃদয় স্বামী, সমনের স্নেহময় পিতা।

বিবেচক জ্যোতি। সুজাতা দু’বছর আগে একান্ন পার করে ছিলেন, জ্যোতির বাবা ছাপান্ন। নিরাপদ বয়স, জীবন দ’জনের গুছানো সশস্থল। মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ছোট মেয়ে মন ও পাত্র স্থির করেছে, বড়ছেলে সুপ্রতিষ্ঠিত, ছোট ছেলেকে বাবা কলেজের পরই বিলাতে পাঠাবেন। সব গুছানো, সশখল, সুন্দর ছিল, বড় সুন্দর।

সেই সময়ে সেই বয়সে টেলিফোন বেজেছিল। মা ঘুমচোখে রিসিভার তুলেছিলেন। হঠাৎ একটা অচেনা নৈব্যক্তিক অফিসার কণ্ঠ জিগ্যেস করেছিল, ব্রতী চ্যাটার্জি আপনার কে হয়?

ছেলে? কাঁটাপুকুরে আসুন।

হ্যাঁ, সেই মুখ-অবয়ব-রক্তমাংসহীন কণ্ঠ বলেছিল, কাঁটাপুকুরে আসন। রিসিভার আছড়ে পড়েছিল। মা পড়ে গিয়েছিল দাঁতে দাঁত লেগে।

দু’বছর আগে সতেরই জানুআরির ভোরে ব্রতীর জন্মদিনে, ব্রতীর পৃথিবীতে পৌঁছবার সম-সমকালে এই সুন্দর ঝকঝকে বাড়িতে, এই শান্ত সুন্দর পরিবারে, এই টেলিফোনের খবরের মত একটা বিশৃঙ্খল, হিসেব ছাড়া ঘটনা ঘটেছিল।

সেই জন্যেই জ্যোতি টেলিফোনটা সরিয়ে নিয়ে যায়। সুজাতা তা জানতেন না। তিনমাস সুজাতা কিছুই জানতেন না। বিছানায় পড়ে থাকতেন চোখে হাতচাপা দিয়ে। কখনো কাঁদতেন না চেঁচিয়ে। হেম, একা হেম ওঁর কাছে থাকত, ঘুমের ওষুধ দিত, ওঁর হাত ধরে বসে থাকত।

তাই সুজাতা জানতেন না কবে টেলিফোনটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

তিনমাস বাদে সুজাতা আবার ব্যাঙ্কে যেতে শুরু করলেন। আবার জ্যোতি নীপা আর তুলির সঙ্গে সহজভাবে কথা বললেন। জ্যোতির ছেলে সুমনের পেন্সিল কেটে দিলেন। জ্যোতির শ্রী বিনিকে বললেন, আমার কালোপাড় শাড়ীটা কি কাচতে দিয়েছ?

জ্যোতির বাবা যখন বম্বে গেলেন, তখন তাঁর সুটকেসে ইসবগুলের ভুসি দিয়ে দিলেন—

এমনি করেই কখন স্বাভাবিক হয়ে গেল সব, সহজ হয়ে গেল, তখন সুজাতা লক্ষ্য করলেন টেলিফোনটা তাঁর ঘর থেকে জ্যোতির ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

দেখেই ওঁর ভুঁরু কুঁচকে গিয়েছিল। জ্যোতির বুদ্ধি এত কম! মাথা নেড়েছিলেন বার বার জ্যোতির নির্বোধিতা দেখে। এখন ত আর কোন টেলিফোন আসবে না। জ্যোতির বাবার নিজস্ব চাটার্ড অ্যাকাউনটেনসির আপিস। জ্যোতি ব্রিটিশ নামাঙ্কিত ফামে মেজসাহেব। নীপা, বড় মেয়ের বর কাস্টমসে বড় অফিসার। তুলি যাকে বিয়ে করেছে, সেই টোনি কাপাডিয়া নিজে এজেন-সি খুলে সুইডেনে ভারতীয় সিলক-বাটিক, কার্পেট, পেতলের নটরাজ ও বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া পাঠায়। জ্যোতির শবশর-শাশুড়ি বিলাতেই থাকেন।

এরা কেউ এমন কোন বেহিসেবী, বিপজ্জনক কাজ করবে না যেজন্যে হঠাৎ টেলিফোন আসতে পারে, হঠাৎ কাঁটাপুকুর মর্গে ছুটে যেতে হবে সুজাতাকে।

এরা কেউ এমন বিরোধিতা করবে না, যেজন্যে জ্যোতি আর তার বাবাকে ছুটোছুটি করতে হয় ওপর মহলে, কাঁটাপুকুরে যেতে হয় শুধু সুজাতা আর তুলিকে।

এরা কেউ এমন অপরাধ করবে না যেজন্যে কাঁটাপুকুরে পড়ে থাকতে হয় চিত হয়ে। একটা ভারি চাদর সরিয়ে ধরে ডোম। ও. সি. জিজ্ঞেস করে, ডু ইউ আইডেনটিফাই ইওর সান?

এরা সবাই বিবেচক, নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে, সৎ নাগরিক। এরা সুজাতাকে তেমন কোন অবস্থায় ফেলবে না, জ্যোতির বাবাকে বাধ্য করবে না ছটোছুটি করতে। সত্যি বলতে কি, তাঁর ছেলে এমন কলঙ্কিতভাবে মরেছে, এই খবরটা ঢাকবার জন্যে জ্যোতির বাবা দড়ি টানাটানি করে বেড়াচ্ছিলেন।

টেলিফোনে খবরটা জানবার পরই জ্যোতির বাবার প্রথমেই মনে হয়েছিল কেমন করে খবরটা চেপে যাবেন। মনে হয় নি কাঁটাপুকুরে তাঁর যাওয়াটা বেশি জরুরী। জ্যোতি তাঁরই ভাবাদর্শে গড়া, সেও বাবার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল।

সুজাতাকে বাড়ির গাড়ি অব্দি নিতে দেননি দিব্যনাথ। কাঁটাপুকুরে তাঁর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে, সে কি হয়? যদি কেউ দেখে ফেলে?

সেদিন ব্রতীর সঙ্গে সঙ্গে সুজাতার চেতনায় ব্রতীর বাবারও মত্যু ঘটে। ব্রতীর বাবার সেদিনের, সেই মুহূর্তের ব্যবহার সুজাতার চেতনায় প্রবল উল্কাপাত ঘটায়। বিরাট বিস্ফোরণ। আদিম পৃথিবীতে যেমন ঘটেছিল কোটি কোটি বছর আগে। যেমন বিস্ফোরণে মহাদেশগুলো ছিটকে ম্যাপের দুপাশে সরে গিয়েছিল। মাঝখানের দস্তর ব্যবধান ঢেকে ফেলেছিল মহাসমদ্র।

দিব্যনাথের সেদিনের ব্যবহারের ফলে, দিব্যনাথ জানেন না, সুজাতার চেতনায় তিনি মরে গেছেন, অবশেষে সরে গেলেন বহদরে। সুজাতার পাশেই শুয়ে থাকেন দিব্যনাথ, কিন্তু জানতে পারেন না, মত ব্ৰতীর চেয়ে জীবিত দিব্যনাথের মানসম্মানের কথা, নিরাপত্তার কথা বেশি ভেবেছিলেন সেদিন, তাই সুজাতার কাছে তিনি অনস্তিত্ব হয়ে গেছেন।

দিব্যনাথের ছোটাছটি দড়ি টানাটানি সফল হয়েছিল। পরদিন খবরের কাগজে চারটি ছেলের হত্যার খবর বেরোয়। নাম বেরোয়। ব্রতীর নাম কোন কাগজে ছিল না।

এইভাবে ব্রতীকে মুছে দিয়েছিলেন দিব্যনাথ। কিন্তু, সুজাতা। তা পারেন না।

সেরকম নিয়ম-ছাড়া, রটিন-ছাড়া ঘটনা এ বাড়িতে আর ঘটবে। তবু জ্যোতি টেলিফোন সরিয়ে নিয়ে গেছে দেখে সুজাতা। কৌতুকবোধ করেছিলেন।

বিনি ওঁর ঠোঁটে কৌতুকের হাসি দেখে মনে এত আঘাত পায় যে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। জ্যোতিকে বলে, শী হ্যাজ নো হার্ট।

কথাটা সুজাতাকে শুনিয়ে বলা। সুজাতা শুনেছিলেন, ক্ষুণ্ণ হন নি। ওঁর আগে মনে হয়েছে, আবার মনে হয়েছে, আবার মনে হয়েছিল। বিনি ব্রতীকে ভালবাসত।

তখন মনে হয়েছিল বিনি ব্রতীকে ভালবাসে। পরে সে কথা মনে হয় নি। কেননা বারান্দায় ব্রতীর ছবিটা খুঁজে পান নি সুজাতা, ব্রতীর জুতোগুলো দেখতে পান নি। ব্রতীর বর্ষাতিও ছিল না।

বিনি, ছবিটা কোথায় গেল?

তেতলার ঘরে।

তেতলার ঘরে?

বাবা বললেন…

বাবা বললেন!

ব্রতী চলে যাবার পরও ব্রতীকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রয়াস দিব্যনাথ ছাড়েন নি দেখে সুজাতা অবাক হন নি, দুঃখও পান নি নতুন করে। শুধু অবসন্ন মনে ভেবেছিলেন, দিব্যনাথই বলতে পারেন এমন কথা। কিন্তু বিনি কি, না! বলে বাধা দিতে পারত না?

কোন কথা না বলে সুজাতা ব্যাঙ্কে চলে যান। ব্যাঙ্কে চাকরি তাঁর বহুদিনের। ব্রতীর তিনবছর বয়সে তিনি কাজে ঢোকেন। ব্রতীর বাবার আপিসে তখন একটু টালমাটাল যাচ্ছিল। দুটো বড় বড় অ্যাকাউন্ট বেরিয়ে গিয়েছিল হাত থেকে।

সেই সময়ে কাজে ঢোকেন সুজাতা। পরিবারের সবাই তাঁকে খুব উৎসাহ দিয়েছিল। এমন কি শাশুড়িও বলেছিলেন, করাই ত উচিত। তুমি বলেই এতদিন বাড়িতে বসেছিলে। দিবুও ত তেমন নয়। তেমন হলে তোমাকে আগেই কাজ করতে পাঠাত।

সুজাতা কেন চাকরি করতে চাইছেন, কেন নিজে খোঁজ করে যোগাযোগ করছেন, সে-কথা কেউ জানতে চাইবার যোগ্য, যথেষ্ট গুরত্বপূর্ণ মনে করেন নি। সেটা ভালই হয়েছিল। এ বাড়িতে দিব্যনাথ আর তাঁর মা সকলের মনোযোগ সবসময়ে আকর্ষণ করে রাখতেন। সুজাতার অস্তিত্বটা হয়ে গিয়েছিল ছায়ার মত। অনগত, অনুগামী, নীরব, অস্তিত্বহীন।

চেনাশোনা লোক ছিলেন ব্যাঙ্কে। নইলে কাজটা হত না। সুজাতা চাকরি পেয়েছিলেন পরিবার, বংশপরিচয়,অভিজাত চেহারা, বিশুদ্ধ ইংরাজী উচ্চারণের জোরে। নইলে তাঁর মত লোরেটোর বি.এ. পাস মহিলা ত কতই আছেন, তা কি সুজাতা জানতেন না?

শুধ, ব্ৰতী কাঁদত।

বপ্নে, তাঁর স্বপ্নে, তিন বছরের ব্রতী তাঁর হাঁটু জড়িয়ে ধরে কতবার কেঁদে বলে, মা তুমি আজ, শুধু আজ আপিসে যেও না, আমার কাছে থাক।

ফর্সা, রোগা ব্রতী, রেশম রেশম চুল, চোখে মমতা।

সেই ব্রতী। মুক্তির দশকে একহাজার তিরাশিজনের মৃত্যুর পরে চুরাশি নম্বরে ওর নাম। কেউ যদি মুক্তির দশকের আড়াই বছরে নিহত ছেলেদের নাম সংগ্রহ করে থাকে, তবে সে কি ব্রতীর নাম খুঁজে পাবে? কাগজ দেখে যদি খোঁজ করে থাকে, সে ত জানবে না ব্ৰতীকে।

ব্রতীর বাবা ওর নাম কাগজে উঠতে দেন নি।

ব্রতী চ্যাটার্জি?

আপনি কে হন?

না, মুখ দেখতে হবে না।

আইডেন্টিফিকেশন মার্ক?

গলায় জড়ুল?

মুখ দেখতে হবে না?

কি বলেছিলেন তিনি? আমি দেখব? নীল শার্ট দেখে, আঙুল দেখে, চুল দেখে, কোথায় তব সংশয় ছিল মনে। কোথায় যুক্তি বুদ্ধি চোখের দেখা সব পরাস্ত করে সংশয় বলছিল, না মুখ দেখলে, জানা যাবে এ ব্রতী নয়? তাই কি সুজাতা বলেছিলেন…

 

ডোমটি ওঁর ওপর অসীম করুণায় বলেছিল, কি আর দেখবেন মাইজী? মুখ কি আর আছে কিছু?

তখন কি করেছিলেন সুজাতা? অন্য চারটি শব পড়ে আছে। কারা যেন আকুল হয়ে কাঁদছে। কে যেন মাথা ঠুকছে মাটিতে। কারো মখে মনে পড়ে না। সব ধোঁয়া ধোঁয়া। কিন্তু কোন কোন স্মৃতি হীরের ছরির মত উজ্জ্বল, কঠিন, স্বয়ংপ্রভ।

ওর বুকে, পেটে আর গলায় তিনটে গুলির দাগ ছিল। নীল গর্ত। শরীরে খুব কাছ থেকে ছোঁড়া গুলি। নীলচে চামড়া। কর্ডাইটের ঝলসানিতে পোড়া বাদামী রক্ত। গতের চারদিকে কর্ডাইটের ঝলসানিতে ঝলসানো হেলো, চক্রাকার ফাটাফাটা চামড়া। গলায়, পেটে আর বকে তিনটে গলির দাগ।

ব্রতীর মুখ, ব্রতীর মুখ, সুজাতা সবলে দুহাতে চাদর সরিয়ে দেন, ব্রতীর মুখে। শাণিত ও ভারি অস্ত্রের উলটো পিট দিয়ে ঘা মেরে থেঁতলানো, পিষ্ট, ব্রতীর মখ। পেছন থেকে তুলির অস্ফুট আর্তনাদ।

সেই মুখই দেখেন সুজাতা ঝুকে পড়ে। আঙুল বোলালেন। ব্রতী! ব্রতী! বলে আঙুল বোলালেন, আঙুল বোলাবার মত মণ চামড়া ছিল না এক ইঞ্চিও। সবই দলিত, থেতলানো মাংস। তারপর সুজাতাই মুখ ঢেকে দেন। পেছন ফেরেন। অন্ধের মত তুলিকে ছাপটে ধরেন।

ব্রতীর বাবা ছবিটা সরিয়ে দিতে বলেছেন, একথা ব্যাঙ্কে যাবার সময়ও মনে ছিল। প্রথম দিন ব্যাঙ্কে যাবার সময়ে।

ব্যাঙ্কে সবাই ওঁর দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ সকলের কথা আস্তে হয়ে গিয়েছিল, তারপর চুপচাপ।

এজেন্ট লুথরা এগিয়ে এসেছিল।

ম্যাডাম, সে সরি…

থ্যাংক য়ু। সুজাতা মুখ তোলেন নি।

মেমসাব।

একটা জলের গেলাস। ভিখন এগিয়ে ধরেছিল। সুজাতার পরনো অভ্যেস, আপিসে এসে জল খান এক গেলাস।

মেমসাব!

ভিখন আস্তে বলেছিল। সুজাতা ওর চোখে বেদনা দেখেছিলেন, মমতা। ভিখন চোখ দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। উনি ওঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন একদিন। যেদিন ব্যাঙ্কে তার এসেছিল ভিখনের ছেলে অসুখে মরে গেছে।

ভিখনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন সুজাতা। এখনি উনি ওর সহানুভূতি নিতে পারছেন না। ভিখন, আমায় ক্ষমা কর। ব্রতীর মৃত্যু তোর ছেলের মৃত্যুর মত নয় যে? তোর ছেলের মৃত্যু এমন মৃত্যু, তাতে তোকে দেখলেই তুই যে বেয়ারা তা ভুলে গিয়ে তোকে জড়িয়ে ধরা যায়।

ব্রতী তো তেমন করে মরে নি। ব্রতীর মত্যুর আগে অনেক প্রশ্ন পরে অনেক প্রশ্ন। প্রশ্নচিহ্ন। সরাসরি প্রশ্নচিহ্নের মিছিল। তারপর সব প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকতেই, একটি প্রশ্নেরও উত্তর না মিলতেই হঠাৎ ব্রতী চ্যাটার্জির ফাইল বন্ধ করে দেওয়া।

তুই আমাকে মাপ কর ভিখন।

সারাদিন যন্ত্রচালিতের মত কাজ করছিলেন। সন্ধ্যায় ব্রতীর বাবা বাড়ী ফিরতেই জিগ্যেস করেছিলেন,

তুমি ব্রতীর ছবি তেতলায় সরিয়ে দিতে বলেছ?

হ্যাঁ।

ব্রতীর জুতো?

হ্যাঁ।

কেন?

কেন!

দিব্যনাথ নেড়েছিলেন। কেন ব্রতীর জিনিসপত্র সরিয়ে দেওয়া দরকার, কেন ব্রতীর অস্তিত্ব, স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা দরকার তা যদি সুজাতা না বোঝেন, কে তাঁকে বোঝাবে? এ দিব্যনাথ কথা বলেন নি।

তেতলার ঘর কি চাবি বন্ধ?

হ্যাঁ।

চাবি কার কাছে?

আমার কাছে।

দাও।

চাবিটা হাতে নিয়ে উঠে গিয়েছিলেন সুজাতা। তেতলার ঘরে ব্রতী ঘুমতো। আট বছর থেকে ওই ব্যবস্থা। প্রথমটা একা শুতে চাইত না। একলা শতে ওর ভয় করত। সুজাতা বলেছিলেন, ঠিক আছে, হেম মেঝেতে শোবে।

দিব্যনাথ রেগে যান। জ্যোতির বেলা সুজাতার এই দুবলতা ছিল না, নীপা আর তুলির বেলাতেও নয়, এইসব কথা বলেন। সুজাতা বলেছিলেন, ওদের বেলাতে ওঁর আপত্তি ছিল। কেন না ওরাও ভয় পেত, কিন্তু তখন দিব্যনাথ যা বলেছেন তার অন্যথা হতে পারে এ সুজাতা জানতেন না।

ভয় পেত ব্রতী, খুব ভয় পেত। অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ শিশু যেমন ভয় পায়। রাতে হরিধ্বনি শুনে ভয় পেত, দিনে বহরপী ডাকাত সেজে এসে চেঁচালে ভয় পেত। তারপর একদিন ওর সব ভয় চলে যায়।

এখন তো ব্রতী সব ভয় আর অভয়ের বাইরে।

ছোটবেলা থেকে মত্যুর কবিতা বড় প্রিয় ব্রতীর। তাইত সুজাতার স্বপ্নে সাতবছরের ব্রতী পা ঝুলিয়ে জানলায় বসে বসে কবিতা পড়ে কত। স্বপ্নে সুজাতা যখন ব্রতীকে দেখেন, তখন তাঁর মনে দু’রকম চেতনা কাজ করতে থাকে। একটা মন বলে এত স্বপ্ন। ব্রতী নেই। এ শুধু স্বপ্ন।

আরেকটা মন বলে স্বপ্ন নয় সত্যি।

সুজাতার স্বপ্নে তাই ব্রতী জানলায় বসে পা ঝুলিয়ে কবিতা পড়ে। সুজাতা বিছানায় বসে শোনেন, ব্রতীর বিছানায়। শোনেন এ আর ব্রতীর চাদর টেনে দেন। বালিশ ঠিক করে দেন।

কখনো ব্লতী ঘুমিয়ে পড়ে,

“ভয়কাতরে ছিল সে সবচেয়ে।
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।”

কখনো বা স্বপ্নে দেখেন ব্রতী ‘শিশু’ বইটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে পড়ছে।

‘আধার রাতে চলে গেলি তুই।
আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়
কেউতো তোরে দেখতে পাবে না।
তারা শুধু তারার পানে চায়।’

ঘুমের মধ্যে ‘ব্রতী!’ বলে ডুকরে ডেকে ওঠেনা সুজাতা। তারপর ঘুম ভেঙে যায়। এত সত্যি যে স্বপ্নে, এত সত্যি যে, চমকে চমকে চেয়ে সুজাতা দেখেন ব্রতী কোথায়!

তেতলার ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন সুজাতা। ব্রতীর বিছানা গোটানো। জামা আলমারিতে তোলা। দেওয়ালে ছবি। শেলফে বই। শুধু স্যুটকেসটা নেই। ওটা পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল।

ব্রতীর খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে সুজাতা ভুর কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করছিলেন, ব্রতীর হত্যার পেছনে তাঁর কি পরোক্ষ অবদান ছিল? কিভাবে তিনি তৈরি করেছিলেন ব্রতীকে যেজন্যে এই দশকে, যে দশক মুক্তির দশকে পরিণত হতে চলেছে সেই দশকে, ব্রতী হাজার চুরাশি হয়ে গেল! অথবা কি করতেন তিনি, অথচ করেননি বলে ব্রতী হাজার চুরাশি হয়ে গেল? কোথায় সুজাতা ব্যর্থ হয়েছিলেন?

দিব্যনাথ ব্রতীকে সহ্য করতে পারতেন না। বলতেন,

মাদাস চাইলড! তুমি ওকেই শিকিয়েছ আমার শত্রু হতে।

সুজাতা অবাক হয়ে যেতেন। কেন তিনি ব্রতীকে বলতে যাবেন তোর বাবার শত্রু হ’? কেন বলবেন? দিব্যনাথ কি সুজাতার শত্রু দিব্যনাথ যাতে যাতে বিশ্বাস করেন, সেই সম্ভ্রান্ততায়, সচ্ছলতায়, নিরাপত্তায় ত সুজাতাও বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেন কিনা সুজাতা কখনো সে প্রশ্ন নিজেকে করেন নি। করেন নি যখন, তখন নিশ্চয় তাঁর কোন প্রশ্নই ছিল না।

সুজাতা বড়ঘরের মেয়ে। অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবার তাঁদের। লোরেটোয় পড়ানো বি, এ, পাস করানো সবই বিয়ের জন্যে। ছেলের অবস্থা খারাপ, জেনেশুনেই তাঁকে বড়ঘরের ছেলে দিব্যনাথের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। সুজাতার বাবা জানতেন দিব্যনাথ অনেক ওপরে যাবেন।

এই বাড়ি, সচ্ছলতা, নিরাপত্তা, এতে সুজাতাও বিশ্বাস করেন। অতএব দিব্যনাথের অভিযোগ মিথ্যে।

যদি দিব্যনাথের অভিযোগ মিথ্যে হয়, তাহলে শুধু এই প্রমাণ হয় যে, সুজাতা ব্রতীকে দিব্যনাথের শত্রু হতে বলেন নি। এ প্রমাণ হয় না যে ব্রতী ওর বাবাকে শত্রু ভাবে। ব্রতী যে দিব্যনাথকে সহ্য করতে পারে না সে ত সুজাতাও জানেন। ভাল করেই জানেন।

কেন, ব্রতী?

দিব্যনাথ চ্যাটার্জি একক ব্যক্তি হিসেবে আমার শত্রু নন।

তবে?

উনি যে সব বস্তু ও মুল্যে বিশ্বাস করেন, সেগুলোতেও অন্য বহুজনও বিশ্বাস করে। এই মূল্যবোধ যারা লালন করছে, সেই শ্রেণীটাই আমার শত্রু। উনি সেই শ্রেণীরই একজন।

কি বলিস তুই ব্রতী? বুঝি না।

বুঝতে চেষ্টা করছ কেন? বোতামটা লাগাও না।

ব্রতী, তুই খুব অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিস।

কি রকম?

বদলে যাচ্ছিস।

বদলাব না?

কোথায় ঘুরিস সারাদিন?

আড্ডা দিই।

কাদের সঙ্গে?

বন্ধুদের।

নে তোর জামা। বোতাম লাগাতে বললি তাই মার সঙ্গে দুটো কথা বলার সময় হল।

ব্রতী কথা বলে নি। চোখ কুঁচকে হেসেছিল। ওর হাসিতে কথা বলার ভঙ্গিতে কি যেন এসে যাচ্ছিল ক্রমাগত। সহিষ্ণুতা, ধৈর্য। যেন সুজাতা কথা বলার আগেভাগেই ও জানে ওর কথা সুজাতা বুঝবেন না। ওঁর সঙ্গে কথা বলত যেন ওর বাবা, সুজাতা ওর ছোট মেয়ে। ওঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ছেলে ভোলাচ্ছে ব্রতী। সুজাতা বুঝতে পারছিলেন ব্রতী ওঁর অজানা হয়ে যাচ্ছে ক্রমে, অচেনা। তখন মনে দুঃখ হয়েছে খুব। কেন মনে আশঙ্কা হয় নি? ভয় হয় নি?

কেন মনে হয় নি মার কাছে ছেলে ক্রমেই অচেনা হয়ে যায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এক বাড়িতে বাস করেও, এ থেকে ভীষণ বিপদ হতে পারে একদিন?

ব্রতীর ঘরে দাঁড়িয়ে সুজাতা ভুঁরু কুঁচকে ভেবেছিলেন, আর ভেবেছিলেন।

ব্রতী যদি সুজাতার দাদার মত দুরারোগ্য অসুখে মারা যেত, তাহলেও মৃত্যুর পর প্রশ্ন থাকতে পারত মনে। সে প্রশ্নগুলো এইরকম হত—ডাক্তারের কোন এটি হল, না বাড়ির লোকের? এ ডাক্তারকে না ডেকে ও ডাক্তারকে ডাকলে কি হত? ও ওষধ না দিয়ে অন্য ওষুধ দিলে কি হত? ব্যাধিজনিত মৃত্যুর পরবতী প্রশ্নগুলো এই রকমই হয়ে থাকে।

ব্রতী যদি দুঘটনায় মরত তাহলে আগে প্রশ্ন হত, যে ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল, তা ব্ৰতী সাবধান হলে, এড়ানো যেত কিনা! তারপর প্রশ্ন হত, যে পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনা ঘটল, তা কোন ভাবে এড়ানো যেত কিনা! সুজাতার যদি দিব্যনাথের মত কোষ্ঠীতে বিশ্বাস থাকত তবে প্রশ্ন হত কোষ্ঠীতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কোন ইঙ্গিত ছিল কিনা! ইঙ্গিত থাকলে তা প্রতিরোধের কোন নিদান ছিল কিনা!

ব্রতী যদি দণ্ডনীয় কোন দরপরাধ করতে গিয়ে নিহত হত, তাহলে প্রশ্ন হত—এ বাড়ির ছেলে হয়ে কার দোষে, কোন সঙ্গে পড়ে ব্রতী অপরাধী হল! কোন কোন প্রতিষোধক ব্যবস্থা করলে ব্রতীর এই পরিণতি এড়ানো যেত।

ব্রতী ত এর কোন কোঠাতেই পড়ে না। অপরাধের মধ্যে ব্রতী এই সমাজে, এই ব্যবস্থায় বিশ্বাস হারিয়েছিল। ব্রতীর মনে হয়েছিল যে পথ ধরে সমাজ ও রাষ্ট্র চলেছে সে পথে মক্তি আসবে না। অপরাধের মধ্যে ব্রতী শুধু স্লোগান লেখেনি, শ্লোগানে বিশ্বাসও করেছিল। ব্রতীর মখাগ্নি পর্যন্ত দিব্যনাথ ও জ্যোতি করেন নি। ব্রতী এমনই সমাজবিরোধী যে ব্রতীদের লাশ কাঁটা পরে পড়ে থাকে। রাত হলে পলিশী হেফাজতে গাদাই হয়ে শ্মশানে আসে। তারপর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

রাতে লাশ জ্বলে। যারা শ্রদ্ধশান্তিতে বিশ্বাসী, তারাও শাস্ত্রের নিয়মে সকালে শ্রাদ্ধ করতে পারে না। তাদের বসে থাকতে হয় লাল, স্ফীত চোখে সারাদিন। তারপর রাতে একটা ঘেটো-বামনের দোর ধরতে হয়।

বামনটা মাথা পিছু থোক টাকা নিয়ে রাতেভিতে শ্রাদ্ধ সেরে দেয় ঝটপট।

ব্রতী স্লোগান লিখেছিল। পুলিশ যখন ওর ঘর তল্লাশ করে তখন সুজাতা দেখেছিলেন স্লোগানের বয়ান সব। ব্রতীর হাতে লেখা।

কেননা জেলই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়।

বন্দুকের নল থেকেই……

এই দশক মক্তির দশকে পরিণত হতে চলেছে…

ঘৃণা করুন! চিহ্নিত করুন! চূর্ণ করুন মধ্যপন্থীকে।

…অজ ইয়েনানে পরিণত হতে চলেছে।

শুনেছিলেন ব্রতীরা বয়ান লেখে, তারপর দেওয়ালে লেখে। রাতেভিতে অন্ধকারে লেখে। আবার কালর মত মরিয়া হলে বেলা এগারোটায়, পুলিশ পাহারায় যখন পাড়া ঘেরাও, রাস্তায় যখন তপনের রক্ত শুকোয় নি, তখনই লালরঙের পোঁচড়া টেনে সম্ভ্রান্ত কোন বাড়ির পরিষ্কার দেওয়ালে লেখা, লাল বাংলার লাল কমরেড লাল তপনের লালরক্তে…বাজার পুড়িয়ে মা…

লিখতে লিখতে কালুও গুলি খায় বলে শেষ শব্দটা শেষ হয় না। ওই রকমই থেকে যায়।

ব্রতীরা এই এক নতুন জাতের ছেলে। স্লোগান লিখলে বলেট ছুটে আসে জেনেও ব্রতীরা স্লোগান লেখে। কাঁটাপুকুর যাবার জন্যে হোড়োহুড়ি লাগিয়ে দেয়।

সুজাতা ত ব্রতীকে কোন রকম অপরাধীর কোঠাতে ফেলতে পারেন নি?

ব্রতীর জন্যে, কাঁদতে কাঁদতেই জ্যোতি ও দিব্যনাথ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, এ সমাজে বড় বড় হত্যাকারী, যারা খাবারে-ওষুধ, শিশ-খাদ্যে ভেজাল মেলায় তারা বেচে থাকতে পারে। এ সমাজে নেতারা গ্রামের জনগণকে পুলিশের গলির মুখে ঠেলে দিয়ে বাড়ি গাড়ি পুলিশ পাহারায় নিরাপদ আশ্রয়ে বেচেথাকতে পারে। কিন্তু ব্রতী তাদের চেয়ে বড় অপরাধী। কেননা সে এই মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ও বাথান্ধ নেতাদের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিল। এই বিশ্বাসহীনতা যে বালক, কিশোর বা যুবকের মনে ঢুকে যায়, তার বয়স বার—ষোল-বাইশ যাই হক, তার শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যু।

তার এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যু। যারা মেরুদণ্ডহীন, সুবিধাবাদী–হাওয়া বদল বুঝে মত বদলানো শিল্পী-সাহিত্যিকবুদ্ধিজীবীর সমাজকে বর্জন করে।

তাদের শাস্তি মৃত্যু। সবাই তাদের হত্যা করতে পারে। সব দল ও মতের লোকেঁদের এই দলছাড়া তরণের হত্যা করার নিবধি ও গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। আইন, অনুমতি, বিচার লাগে না।

একা অথবা যূথবদ্ধভাবে এই বিশ্বাসহীন তরুণদের হত্যা করা চলে। বুলেট-ছুরি-দা-বর্শা-সড়কি যে কোন অত্রে যে কোন সময়ে শহরের যে কোন অঞ্চলে, যে কোন দশক বা দর্শকদের সামনে।

জ্যোতি আর দিব্যনাথ এসব কথা সুজাতাকে পাখিপড়া করে বোঝনি। কিন্তু সুজাতা মাথা নেড়েছিলেন।

না।

ব্রতীর মৃত্যুর আগের প্রশ্ন হল কেন ব্রতী বিশ্বাসহীনতার ব্রতকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করেছিল?

ওর মত্যুর পরের প্রশ্ন হল ব্রতী চ্যাটার্জীর ফাইল বন্ধ হল বটে কিন্তু ওকে হত্যা করে কি সেই বিশ্বাসহীনতার প্রজলন্ত বিশ্বাসকে শেষ করে দেওয়া গেল? ব্রতী নেই, ব্রতীরা নেই। তাতেই কি শেষ হয়ে গেল সব?

প্রশ্ন হল ব্রতীর মৃত্যু কি নিরর্থক? ওর মৃত্যুর মানে কি তবে একটা বিরাট ‘না’?

সব কী অলীক ছিল? অনস্তিত্ব? ওর বিশ্বাস? ওর ভয় হীনতা? ওর দুবার আবেগ? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সমু বিজিত, পাথ আর লালটুকে সাবধান করবার জন্যেই ষোলই জানকারী নীল শার্ট পরে সুজাতাকে ছেলে ভুলিয়ে বেরিয়ে যাওয়া? যাবার আগে হঠাৎ সুজাতার দিকে তাকানো? দেখে নেওয়া? সুজাতার সুন্দর অভিজাত, প্রৌঢ় মখের প্রতিটি বেদনার রেখা দেখে মনে একে নেওয়া?

সুজাতা মাথা নেড়েছিলেন। ঘর বন্ধ করে বেরিয়ে এসেছিলেন।

 

 

চাবিটা সেদিন থেকে ওঁর কাছেই থাকে। ওঁর ব্যাগে। আজ দুবছর ধরে রাতে উঠে আসেন সুজাতা। ব্রতীর ঘর ঝাঁট দেন, ধলে। ও ঝাড়েন। বিছান্য আবার পেতেছেন সুজাতা। জতো রেখেছেন আলনার নীচে। জামাকাপড় গুছিয়েছেন। তাঁর মত ক’ হাজার ছেলের মা সকলকে লুকিয়ে ছেলের জামায় হাত বোলায়, ছেলের ছবিতে আঙুল বেলায়?

ব্রতীর ঘরে বসে থাকেন সুজাতা। মনে মনে ব্রতীর সঙ্গে কথা বলেন। চোখ বুজে ভাবেন ব্রতী কাছে আছে। ভাবেন কত মা কত ছেলেকে এমনি করে লুকিয়ে কাছে ডাকে, কাছে পেতে চায়?

ব্রতীর সঙ্গে কথা বলেন সুজাতা। কখনো ব্ৰতী উত্তর দেয়, কখনো দেয় না।

জ্যোতির ঘরে টেলিফোন বাজছে। ওটা ধরতে গিয়েই এত কথা মনে পড়ল সুজাতার।

সমু আর লালটু, বিজিত আর পাথর বাড়িতে টেলিফোন নেই। টেলিফোন বাজিয়ে ওদের বাড়ির লোকের ঘম ভাঙাবে না। আজ সমু বিজিত আর পাথের মা কি ভাবছেন? আজ সকালে?

বিনি শ্লথ পায়ে নাইলনের নাইটি পরে দরজা খুলে দিল। ওর চোখে মুখে বিরক্তি। এত তাড়াতাড়ি বিনি ঘুম থেকে উঠতে চায় না। ওর ঘুম ভাঙে না।

নিয়মিত ঘুম আর বিশ্রাম জ্যোতি আর বিনির খুবই দরকার। অত্যন্ত প্রেমাসক্ত সুজাতার বড়ছেলে আর বউ। সমনের আটমাস বয়স থেকেই অবশ্য ওদের খাট ও বিছানা আলাদা, তবু ওরা অত্যন্ত প্রেমাসক্ত দম্পতি বলে নাম আছে। রক্তমাংসের সখেকে সুজাতা খুব দামী বলে জানতেন। বিনিরা রক্তমাংসের সখেকে প্রেম থেকে ব্যবচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

ওদের প্রেম অন্যরকম। ওদের বিবাহবার্ষিকীতে খুব উদ্দাম পার্টি হয়। একসঙ্গে ঘোরে দুজনে, বেড়াতে যায়। সুজাতা শুনেছেন বিনি ক্লাবে গেলে জ্যোতি ছাড়া কারো সঙ্গে নাচে না। ফলে সমাজে বিনির খুব সুনাম। সুজাতা ফোন তুললেন, কে?

আমি নন্দিনী।

নন্দিনী!

হ্যাঁ, আমি ফিরে এসেছি।

কবে?

পরশু।

ও।

আপনার সঙ্গে আমার একবার দেখা হওয়া দরকার। আপনার ওখানে আমি যাব না। আপনি কি ব্যাঙ্কে যাবেন আজ?

আজ আমি যাব না নন্দিনী। আজ আমার ছোটমেয়ে তুলির এনগেজমেন্ট।

তাহলে?

তুমি বল কোথায় গেলে দেখা হবে। ঠিক সন্ধ্যাটা বাদ দিয়ে আমি অন্যসময় যেতে পারি।

চারটের সময়?

যেতে পারি। কোথায় যাব বল?

একটা ঠিকানা দিচ্ছি। আপনার বাড়ি থেকে বেশি দর হবে না।

বল।

নন্দিনী ঠিকানা বলল। সুজাতা ফোন নামিয়ে রাখলেন। নন্দিনী! ব্রতী নন্দিনীকে ভালবাসত। কিন্তু নন্দিনীকে কখনো দেখেন নি সুজাতা।

জ্যোতির দিকে তাকালেন। ঘুমোলে, একমাত্র ঘুমোলেই জ্যোতির মুখে সুজাতা ব্রতীর মুখের আদল দেখতে পান।

বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। বারান্দায় বেরোতেই বেশ শীতশীত করল! নন্দিনী আর ব্রতী কি একটা কবিতার কাগজ বের করেছিল? ওরা একসঙ্গে নাটক করেছিল, সুজাতার জলবসন্ত হয়, তাই যাওয়া হয় নি। বাড়ি থেকে আর কেউই যায় নি। শুধু হেম বলেছিল, ছোটোখোকা অনেক হাততালি পেয়েছে, জানলে গো মা। সবাই খুব সখ্যেত করেছে।

হেমই গল্প করত ব্ৰতীর সঙ্গে। সুজাতার কাছে যখন ব্রতী অচেনা হয়ে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে ওর মুখ দেখে সুজাতা কথা বলতেও ভয় পেতেন, তখনো হেম বলতে পারত, রাজকাজজিতে যাচ্ছ তা জানি, এটুকু খেয়ে উদ্ধার করে যাও বাপ।

সেই সে দীঘা যাচ্ছি, বলে ব্রতী দীঘার পথে বাস থেকে নেমে অন্য জায়গায় যায়, হেমই তখন ওর সটকেস গোছগাছ করে দিয়েছিল।

হেম বলেছিল ছোটখোকার সঙ্গে এট্টা মেয়ের ভাব আছে গো মা! ঠাকুর দেখে এয়েছে। ছোটখোকা বেরলে মেয়েটা পথের ধারে দাঁইড়ে থাকে। তা বাদে দুজন একসঙ্গে চলে যায়। মেয়েটা কালোপানা।

সেই নন্দিনী! সুজাতার বুক ধড়ফড় করছে কেন? ব্যারালগান খেয়ে বেশি সময় শুয়ে থাকেন নি বলে। নন্দিনী ফোন করেছে বলে?

বাথরুম থেকে সেজেগুজে বেরিয়ে এল বিনি। ঘাড় অবধি ছাঁটা রুক্ষ চুল নীল শাড়ির ওপর নীল নাইলনের কার্ডিগান। রঙে রং মিলিয়ে পরতে কখনো ভুল হয় না বিনির। দীপার হয় না, তুলিরও হয় না। বিনিকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।

কে ফোন করেছিল মা?

নন্দিনী।

নন্দিনী!

ব্রতীর বন্ধু।

বিনির মুখ কৌতূহলে ভরে গেল।

নিচে যাচ্ছ কেন মা?

কি হবে না হবে দেখি! তুমি সুমনকে তোল। ওর ত ইস্কুল আছে। বাস আসবে।

নিচে তুলিই গেছে।

সুজাতা হাসলেন। আজ তুলির এনগেজমেন্ট। আজও বিশ্বাস। করতে পারে না ও গিয়ে তদারক না করলেও এ বাড়িতে সকালের চা ব্রেকফাস্ট, দুপুরের রান্না, বিকেলের ঘর সাজানো সব হবে। কাউকে বিশ্বাস করে না তুলি।

ষোল বৎসর বয়সে ক্রাফট শিখতে গেল তুলি লেখাপড়া ছেড়েই। সেই সময় থেকেই সংসারের ভার ও নিল। আসলে সি. এ. ফার্ম দাঁড়িয়ে যাবার পর দিব্যনাথ সুজাতাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। সুজাতা শোনেন নি। শাশুড়ি জীবিত ছিলেন ব্রতীর আটবছর অবধি। ততদিন পর্যন্ত সুজাতার একখানা কাপড় নিজের শখে কিনবার অধিকার ছিল না।

সেই জন্য, এই ব্যাঙ্কে যাওয়া আসা, নিজের মত নিজের একটা জীবন খুঁজে পাওয়া, সবকিছু অত্যন্ত দামী হয়ে ওঠে সুজাতার কাছে। তাই উনি কাজ ছাড়েন নি।

তুলি ওর ঠাকমার চেহারা ও স্বভাব পেয়েছে। সুজাতা যে কাজ ছাড়েন নি সে জন্যে ওর বাবা আর ঠাকমার খুব রাগ হয়। আসলে সুজাতা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চান, ঘর সংসার তাঁর ভাল লাগে না, ভাল লাগে না ছেলেমেয়ের বোঝা, এসব কথা মা ও ছেলে সব সময় বলতেন।

তুলিও বলত, এখনো বলে, যে বাড়ির গিন্নি দিনে দশঘণ্টা বাইরে থাকেন, সে বাড়ির মেয়েকে বাধ্য হয়েই করতে হয় সব। আমি না করলে কোন কাজ হয়?

সর্বদা অসন্তুষ্ট তুলি, অপ্রসন্ন। একটু চা ঢালা, কি রান্না হবে বলে দেওয়া এ-সব কাজ ও করে শহীদের মত মুখ করে। আশা করা যায় বিয়ে হলে ওর স্বভাব শুধরে যাবে।

ক্রাফট শেখবার পর বন্ধুর সঙ্গে শাড়ি ছাপাবার দোকান করতে গিয়েছিল তুলি। সেই সত্রে টোনি কাপাডিয়ার সঙ্গে আলাপ হয়। আজ ব্রতীর জন্মদিনে তুলির এনগেজমেন্ট ঘোষণা করবার সিদ্ধান্তটা টোনির মার। মিসেস কাপাডিয়ার গুরু সোয়ামীজি আমেরিকায় থাকেন। তিনি জানিয়েছেন এই দিনটিই প্রশস্ত। তাঁর ক্যালেন্ডারে। সোয়ামীর শিষ্যরা সোয়ামীর ক্যালেন্ডার মেনে চলেন। সে ক্যালেণ্ডারে কোন ছুটিছাটা নেই। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই হল কর্ম এবং ধ্যানের দিন। টোনির কথা ভাবতে গিয়ে দিব্যনাথ বা তুলি সুজাতার মত নিতে ভুলে যায়।

নিচে নামতেই সুজাতা বুঝলেন তুলি বহুক্ষণ ওঁর সঙ্গে মনে মনে ঝগড়া করছে। আজ, ওর জীবনের একটা বিশেষ দিন। কিন্তু সুজাতা যেন দিনটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তাই ওর রাগ।

তুমি কি খাবে মা?

একটু লেবুজল।

কেন? ব্যথা বেড়েছে?

না। এখন আর নেই।

জানি না তুমি এরকম চান্‌স নিচ্ছ কেন। অ্যাপেনডিকস অপারেশন আজকাল এখন ডালভাত।

সবসময় নয়। অ্যাপেনডিকস অপারেশন হওয়া উচিত ইলেকটিভ। আIপেনডিকসকে ফুলতে বা পেকে উঠতে না দিয়ে অল্পস্বল্প ব্যথা হলেই কেটে ফেলা উচিত। সুজাতার ক্ষেত্রে তা হয়নি। তাছাড়া ডাক্তার সন্দেহ করেন সুজাতার অ্যাপেনডিকস। হয়ত গ্যাংগ্রীনাস। সময়ে না কাটলে গ্যাংগ্রীন দাঁড়াতে পারে। ফেটে গেলেও বিপদ হতে পারে। অথচ সুজাতার হাট তেমন সবল নয়। শরীর রক্তশূন্য, তাই অপারেশন করা ঠিক এই মহতে সম্ভব নয়। কালই সুজাতা এসব কথা জেনে এসেছেন। তবে তুলিকে সে কথা বললেন না। বললেন,

করব অপারেশন।

কবে?

তোর বিয়েটা হয়ে যাক।

বিয়ে ত এপ্রিলে হবে।

হয়ত তার আগেই করব। হেম! হেম!

কেন মা?

আমায় একটু লেবজল দিও।

সুজাতা টেবিলে বসলেন।

এত ভোরে কে ফোন করেছিল?

নন্দিনী।

তুলির মুখ লাল হল। ভুরু কুঁচকে গেল অসন্তোষে। ও ঘটাং ঘটাং করে টি-পটের ভেতরে চামচ নেড়ে দেখল লিকার কতটা গাঢ় হল। তারপর বলল, একটা ঘণ্টা বাজাবার নিয়ম করলে পার। সবাই একসময়ে চা খেয়ে যাবে। যার যখন ইচ্ছে আসে এতে লোকজনের কষ্ট আমারও অসুবিধে।

সুজাতা কৌতূহলে দেখতে লাগলেন তুলিকে। ঠিক এইরকম গলায় কথা বলতেন শাশুড়ি। শাশুড়ি ছেলেমেয়েদের আরাম করা, ইচ্ছেমতন গল্প করে খাওয়া, এসব দেখতে পারতেন না। সর্বদা তাড়না করতেন অসন্তোষে, বিরক্তিতে। সবাই তাঁর অনুশাসন মেনে নিয়েছিল। একা ব্রতী সেই শৈশবেও তাঁর শাসন মানে নি। দেরি করে ঘুম থেকে উঠত। নিয়মমাফিক টেবিল থেকে খাবার তুলে ফেলা হত। ব্রতী রান্নাঘরে গিয়ে হেমের কাছে পিড়িতে বসে খাবার খেয়ে নিত।

আশ্চর্য বাড়ি! আশ্চর্য ডিসিপ্লিন!

তুলি চাপা অসন্তোষে বলল। এখনি এই আটাশ বছর বয়সেই এত অসন্তোষ তুলির! এখনো ত জীবনের কতখানি পড়ে আছে সামনে।

জ্যোতি রাত করে শোয়, ওকে তাড়াতাড়ি তুলে কি হবে? তোর বাবা চা খান না। ঘোল খাবেন…

সে আমি ওঁর ম্যাসাজিস্‌ট চলে গেলেই পাঠিয়ে দিয়েছি। বাবার কথা হচ্ছে না।

বিনি ঠাকুরঘরে ফুলজল দিয়ে আসছে।

যতসব ন্যাকামি।

ন্যাকামি কেন হবে? তোর ঠাকুরমা নিয়মিত পজোপাঠ করতেন। আমার ভাল লাগত না। নিয়মরক্ষে দুটো ফল ফেলে দিতাম। বিনির ভাল লাগে, পুজো করে। এতে ন্যাকামি কোথায় দেখলি?

জানি না বাবা। বিলেতে জন্ম, সেখানে ষোলবছর অব্দি কাটিয়ে এত ভক্তি কোথা থেকে আসে জানি না।

বিলেতে ওর বাবা বাড়ি করেছিল, সেখানে থাকত। বিলেতে বড় হওয়ার সঙ্গে ঠাকুরঘরে ফল-জল দেওয়ার কি বিরোধ আছে কোন? আমি ত দেখতে পাই না।

ভক্তি থাকলে বুঝতাম। ওর কাছে ঠাকুরঘরটা একটা ইনটেরিয়র ডেকরেশন।

তুই তো সোয়ামীর মন্দিরে যাস পাক স্ট্রীটে।

সেটা অন্য জিনিস মা।

আমার ত মনে হয় না। যার যাতে বিশ্বাস করতে ভাল লাগে সে তাই বিশ্বাস করছে। তা বলে অন্যের বিশ্বাসটা ন্যাকামি, নিজের বিশ্বাসটা খাঁটি, তা হবে কেন?

ব্রতীও বলত। অন্যদের বিশ্বাসকে ব্যঙ্গ করত।

তোর সোয়ামীতে বিশ্বাস, বিনির ঠাকুরঘরে বিশ্বাস, দুটো মোটামুটি এক ধরনের জিনিস। ব্রতী যা বিশ্বাস করত, তার সঙ্গে অন্যদের বিবাসে তফাত ছিল তুলি। ব্রতী ব্যঙ্গ করত বলেও আমার মনে পড়ছে না। তক করত বলতে পারিস। তকে হেরে গেলে তই রেগে যেতিস। রাগিয়ে দিয়ে ও মজা পেত।

বিশ্বাস করত বলছ কেন মা? বিশ্বাস ওর ছিল না।

তুলি! আমি ব্রতীর কথা তোর সঙ্গে আলোচনা করব না।

কেন?

লাভ কি? তই ব্রতীকে জানিস না।

এখনও তুমি…

তুলি! চুপ কর।

সুজাতার হাত কেঁপে গেল। গেলাসটা নামালেন। কয়েকটি অসহ মুহত। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে সুজাতা বললেন, বিনিকে চা খেতে আসতে বল হেম।

তুলি, তাঁর আত্মজা, তাঁর দিকে অপরিচিত, হিংস্র চোখে তাকাল। অচেনা গলায় বলল,

আজ ভট থেকে গয়না কি আমাকেই আনতে হবে?

আমি যাব।

বিকেলে কি তুমি বাড়ি থাকবে?

থাকব।

আশাকরি আজ তুমি টোনির বন্ধুদের সঙ্গে একটু সহজ ব্যবহার করবে।

তোমরা কি, তোমরা কি সরোজকেও ডাকছ?

ডেকেছি। আসবে কিনা জানি না।

সরোজকে!

‘সরোজ পাল। সরোজ পাল, তোমার ক্ষমা নেই। অক্ষম, অক্ষম আস্ফালন। দু’বছর ধরে সরোজ পাল এই ব্যাপক তদন্ত তল্লাসী ও শাস্তিবিধানের ভার লইয়াছেন। তাঁহার অসামান্য কর্মদক্ষতা ও নির্ভীকতার জন্য–।’

মুক্তির দশক, মুক্তির দশক! সরোজ পাল শান্ত্রীদের যূথবদ্ধ করছে। যূথপতির মত নিদেশ, শ্যামা মা একবার রক্ত চান। সরোজ পাল। সুন্দর চেহারা, সুন্দর হাসি, সুন্দর উচ্চারণ, ইয়েস মিস্টার চ্যাটার্জি আই কোয়াইট অ্যাসিওর ইউ। মিসেস চ্যাটার্জি, আমি জানি, আমারও মা আছেন। সরোজ পাল। ইয়েস, সাচ দ্য রুম। না মিসেস চ্যাটার্জী, আপনার ছেলে সন্তান হয়ে মার কাছে মিছে বলেছিল। দীঘায় ও যায় নি। ব্রোক হিজ জার্নি। মিসগাইডেড ইয়ূথ। ইয়েস ও ক্যানসারাস গ্রোথ অন দ্য বডি অফ ডেমোক্রেসি। না মিঃ চ্যাটার্জী, কোন কাগজে বেরোবে না। আপনি টোনির ভাবি শ্বশুর, টোনি আমার…সরোজ পাল।

তুমি সুজাতাকে দেখেছ!

এনাফ ইজ এনাফ মা! আজ দুবছর ধরে বাড়িটাকে তুমি কবর করে রেখেছ। বাবা তোমার সামনে মুখ খোলেন না। দাদা অপরাধীর মত…এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেলে সবাই সেটা চাপা দিতে চেষ্টা করে। সেটাই স্বাভাবিক। ব্রতী ইজ ডেড। ইউ মাসট থিংক অব দ্য লিভিং। তুমি…

অত তাড়াতাড়ি চাপা দিতে চেষ্টা করে? লাশ সনাক্ত করবারও আগে। টেলিফোনে খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে বাপের মনে হয় না ছুটে চলে যাই? আগে মনে হয় গাড়িটা কাঁটাপুকুরের সামনে দাঁড় করানো উচিত হবে?

নাকি টেলিফোন আসবার অনেক আগেই ব্রতী ওর বাবা ও দাদার কাছে মরে গিয়েছিল। তাই সুজাতা অবিশ্বাস করেছিলেন, ওরা অবিশ্বাস করে নি? তাই দুজনেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল খবরটা চেপে দেবার জন্য ধরাধরি করতে।

সহসা সুজাতার মনে হল এ একটা উদ্ভট নাটক। তাঁরা সবাই এ নাটকের পাত্র-পাত্রী।

যদিও ব্রতী এ বাড়ির ছেলে, তবু সে নৃশংস ও হিংস্রভাবে নিহত হলে তার বাপ, দাদা, দিদিরা আপন আপন সমাজের কাছে কিভাবে সে মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করবে, কি অসুবিধেয় পড়বে, সেকথা ব্রতী ভাবেনি বলে সশস্থল ও সাজানো জীবনে ব্যাঘাত ঘটেছে। ব্যাঘাত ঘটেছে যার জন্যে, সে এখন মত। এখন এরা সুজাতাকে মনে মনে ব্রতীর দলে ফেলেছে। নিজের একটা আলাদা দল করছে।

হাজার হলেও বাপ, দাদা, দিদিদের পক্ষে একথা বলা কষ্টকর—

দেখুন আমার ছেলে ছিল—

সি, মাই ব্রাদার ওয়াজ—

আমার ছোট ভাই একটা—

টোনি, ব্রতী–!

সুজাতাকে ওরা বিপক্ষ দলে ফেলেছে। কেননা সুজাতা কোন সময়েই তাঁর সশস্থল জীবন বিপর্যস্ত হল এজন্যে ব্রতীকে দোষ দেন নি। দোষ দেন নি, বক চাপড়ে কাঁদেন নি, এদের কারো বুকে মাথা রেখে আকুল হন নি। প্রথমেই তাঁর মনে হয়েছে যারা আগে নিজের কথা ভাবে, তাদের কাছে ব্রতীর কথা বলে তিনি সান্ত্বনা খুঁজবেন না। ব্রতীর বাবা, দিদিদের চেয়ে হেমকে তাঁর আপন মনে হয়েছে।

সুজাতার একথাও মনে হল, ব্রতী যেদিন থেকে বদলে যেতে শর; করে, সেদিন থেকেই এরা ব্রতীকে বিপক্ষ দলে ফেলে দেয় মনে মনে। এরা যা যা করে, ব্রতী তা করত না। বড় হলে উত্তরজীবনেও ব্রতী তা করত না, এরা তা জানে। অতএব ব্রতী অন্য শিবিরের বাসিন্দা।

ব্রতী যদি জ্যোতির মত প্রচুর মদ খেত, নীপার বরের মত মাতলামি করত, ব্রতীর বাবা যেমন সেদিনও এক টাইপিসট মেয়েকে নিয়ে ঢলাঢলি করেছেন, তাই করত, ঝান জোচ্চোর হত টোনি কাপাডিয়ার মত, দুশ্চরিত্র হত ওর দিদি নীপার মত, যে এক পিসতুত দেওরের সঙ্গে প্রায় বসবাস করে; তাহলে ওরা ব্রতীকে বিপক্ষ মনে করত না।

অন্ততঃ ওরা যদি ব্রতীকে দেখে এ ভরসা পেত, যে বড় হয়ে ব্রতী ওদের মতই হবে, তাহলেও ওরা ব্রতীকে বিপক্ষ মনে করত না।

ব্রতী এর কোনটা করার দিকে প্রবণতা দেখায় নি। স্বামী, সন্তান, জামাই সবাই এসব করছে বলে সুজাতাও কোনদিন মনে করেন নি, তিনি বিশেষ করে অসখী। প্রথমত, যা ঘটে তা মেনে নেন, ওই তাঁর শিক্ষা, জীবন থেকে পাওয়া। দ্বিতীয়ত, তাঁর কোনদিন মনে প্রশ্ন ওঠে না, প্রশ্ন করবার নৈতিক অধিকার যে তাঁরও আছে, তা সুজাতা জানেন না। দুঃখ পেয়েছেন, খুব দুঃখ পেয়েছেন। দিব্যনাথ চিরকাল বাইরে মেয়েদের নিয়ে নোংরামি করেছেন। শাশুড়ির তাতে সস্নেহ প্রশ্রয় ছিল। তাঁর ছেলে পুরুষ বাচ্চা, তাঁর ছেলে স্ত্রৈণ নয়। সুজাতা দুঃখ পেয়েছেন তারপর ভেবেছেন পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন সখী কে হয়?

কিন্তু ব্রতী অন্যরকম ছিল। খুব ছোটবেলাতেও ওকে মিথ্যে বলে ভোলানো যায় নি। যুক্তি দিয়ে বোঝালে ও কথা শুনত। শুনতে হবে বলে দাবড়ালে কথা শুনত না। ও যখন বড় হতে থাকল, তখন ওর মধ্যে সুজাতা স্বামী ও অন্য সন্তানদের চেয়ে সম্পণ পথক একটা মানবজগৎ দেখতে পেলেন।

ওর সঙ্গে বই পড়ে, ওকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়িয়ে, ওর বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে গল্পগুজব করে সুজাতা ক্লমেই ওর মধ্যে ডুবে যেতে লাগলেন। ব্রতীই যেন ওঁর বেচে থাকার একমার ন্যায়সঙ্গত ব্যাখ্যা হয়ে দাঁড়াল। সম্ভবত, সম্ভবত ব্রতীর বিষয়ে সুজাতা অত্যন্ত অধিকারপ্রবণ হয়ে পড়েন।

একা ব্রতীর জন্যে সুজাতা। স্বামীকে, শাশুড়িকে অমান্য করেছেন। অর্থহীন শাসন, আর স্বেচ্ছাচারী প্রশ্রয়, যা অন্য সন্তানেরা ভোগ করেছে তা ব্রতীকে ভোগ করতে দেন নি। অন্য সন্তানদের শাশুড়ি সম্পর্ণেরপে অধিকার করেছিলেন। ব্রতীর বেলা সুজাতা দখল ছাড়েন নি। বেশি জেদি, বেশি অনুভূতিপ্রবণ, বেশি কল্পনাপ্রবণ ব্রতীকে সুজাতা ছায়ায় মায়ায় বড় করেছিলেন। স্বামী ও শাশুড়ির আধিপত্যের উত্তাপ থেকে ব্রতীকে বাঁচিয়ে চলার জন্যে সুজাতাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল।

সেই জন্যেই কি এরা এখনও ক্ষমাহীন? না ব্রতীর বিষয়ে এদের মনে মনে কোন পাপবোধ আছে? সেটা ঢাকবার জন্যেই এত রক্ষ তুলি, এত অপরাধী ও সংকুচিত দিব্যনাথ, এমন নম্র জ্যোতি?

মুখে সুজাতা এর কোন কথাই বললেন না। বললেন, তুলি তুই খুব সখী হবি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *