০১. শিক্ষার লক্ষ্য

শিক্ষার লক্ষ্য

শিক্ষা সম্বন্ধে এমন কতকগুলি তত্ত্বকথা প্রচলিত আছে, যাদের উদ্দেশ্য–কিছুই না বলিয়া, সমগ্ৰ বিষয়টার একটা সৰ্বজনসম্মত সুগভীর মীমাংসা করা। এই সকল তত্ত্ববাক্যের মধ্যে একটি এই যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য যথার্থ মানুষ তৈরি করা। মানব-শিশু যখন সচরাচর মানুষের শরীর ও মন লইয়াই ভূমিষ্ঠ হয়, এবং যেটি না-হয়, শিক্ষার দ্বারা তাহাকে যথার্থ মানুষ করার চেষ্টা স্বয়ং বৃহস্পতির পক্ষেও নিস্ফল, তখন যথার্থ মানুষ কাহাকে বলে জিজ্ঞাসা করিলে তত্ত্বজ্ঞেরা অবশ্য উত্তরে বলিবেন— আদর্শ-মানবকে, অর্থাৎ অসাধারণ মনুষ্যকে। আদর্শ-মানব যে কী প্রকার জীব, সে সম্বন্ধে কাহারও সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনও রূপ ধারণা না থাকাতে, জিনিসটা যে অতিশয় কাম্য এবং শিক্ষার দ্বারা অবশ্যালভা, এ বিষয়ে কাহারও কোনও দ্বিধা উপস্থিত হয় না; এবং একটা দুরূহ প্রশ্নের সহজ সমাধানে মনও প্ৰসন্ন হইয়া ওঠে। ইহার পরেও যদি কেহ জানিতে চায় আদর্শ-মনুষ্য কাহাকে বলে, তবে অধিকাংশ বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিশ্চয়ই তাহার সহিত বাক্যালাপ বন্ধ করিবেন। তবে কোনও কোনও তত্ত্বজ্ঞ হয়তো অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন যে, আদশ-মনুষ্য সেই, যাহার শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সকল শক্তি বা বৃত্তিই সম্যক অনুশীলিত হইয়াছে ও পূর্ণরূপে স্মৃর্তিলাভ করিয়াছে এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য এই শ্রেণির মানুষ গড়িয়া তোলা। এখন কথা এই যে, প্রথমত এহেন মানুষ চর্মচক্ষে দূরের কথা, কেহ কখনও মানস-নেত্রেও দেখেন নাই। পৃথিবীর কবি ও কল্পনাকুশল লোকেরা যে-সকল মহাপুরুষ ও অতিমানুষের আদর্শ-চিত্র আঁকিয়াছেন, সে সকলের কোনওটিই একাধারে সর্বশক্তিচোম্পন্ন অসম্ভব মানুষের চিত্র নয়। সেগুলির কোনওটিতে দেখিতে পাই বহু-শক্তির একত্র সমাবেশ, কোনওটিতে বা দু-একটি বৃত্তির অতিমাত্রায় বিকাশ; কিন্তু তাহার প্রতিটিই রক্তমাংসের মানুষেরই চিত্র। দ্বিতীয় কথা এই যে, সকল শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি দূরে থাক–দুই-চারিটি শক্তির একসঙ্গে একটু অসাধারণরকম স্মৃর্তির পরিচয় যাহার শরীরে আছে, এমন লোক হাজারে একজন মেলা কঠিন; অথচ শিক্ষা যে সকলের জন্যই প্রয়োজন, এ সম্বন্ধে কোনও মতভেদ নাই। তপস্বী বাল্মীকি যখন নারদকে বীৰ্যবান, ধৰ্মজ্ঞ, বিদ্বান প্রভৃতি অশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তির কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তখন ত্ৰিলোকজ্ঞ নারদ সেই ত্ৰেতাযুগেও ইক্ষ্বাকুবংশপ্রভব রামচন্দ্ৰ ব্যতীত আর কাহারও নাম করিতে পারেন নাই। এবং কোনও বিশেষ শিক্ষাপ্রণালীর ফলে রামচন্দ্ৰ যে এই সকল গুণের আধার হইয়াছিলেন, এমন কথা নাবাদও বাল্মীকিকে বলেন নাই, বাল্মীকিও আমাদিগকে বলিয়া যান নাই। তৃতীয় কথা, যদি প্রকৃতই আদর্শ-মানব বা অতিমানুষ গড়া শিক্ষার উদ্দেশ্য হইত এবং এই উদ্দেশ্য সফল হইবার কোনও সম্ভাবনা থাকিত, তাহা হইলে এইরূপ শিক্ষার ফলে পৃথিবীটা মানুষের পক্ষে বাসের উপযুক্ত থাকিত কি না, সন্দেহ করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। যে সমাজ-বন্ধনের ভিত্তির উপর মানুষের সভ্যতার ইমারত গঠিত হইয়াছে, তাহার মূল এই যে, মানুষে মানুষে শক্তির প্রভেদ আছে, এবং সে প্রভেদ কোনও শিক্ষার সাহায্যে সম্পূর্ণ লোপ করা যায় না। এই পার্থক্য ও তারতম্য আছে বলিয়াই সমাজে শ্রমবিভাগ ও কাৰ্যবিভাগ সম্ভবপর হইয়াছে, এবং এই বিভিন্নতার উপর মানুষের সভ্যতার প্রথম উন্মেষ হইতে অদ্যাবধি সমস্ত পরিণতি নির্ভর করিয়া রহিয়াছে। যদি শিক্ষার ফলে এই ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য লোপ করিয়া সকলকেই সর্বশক্তিসম্পন্ন আদর্শ-মানুষে পরিণত করা সম্ভবপর হইত, তাহা হইলে সমাজের সমস্ত কাজের কল-কারখানা তখনই বন্ধ হইয়া যাইত।

মানুষে মানুষে প্ৰভেদ আছে বলিয়াই মানুষের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয়। যদি শিক্ষার ফলে সকলেই আদর্শ-মানুষ, অর্থাৎ এক ছাঁচের মানুষ হইয়া উঠিত, তাহা হইলে আমাদের পরস্পরের সঙ্গ আমাদের নিকট এমনই অসহ্য বোধ হইত যে, মানুষ ঘর ছাড়িয়া বনে পালাইতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা করিত না। শেষ কথা, পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এক-একজন অতিমানুষের জন্ম হয়। তাহার ফলে কর্মের জগতে বা চিন্তার রাজ্যে যে বিপ্লব উপস্থিত হয়, তাহা স্মরণ রাখিলে সমাজ যদি কেবল অতিমানুষেরই সমাজ হইত। তাহা হইলে ব্যাপারটা কী ঘটিত মনে করিতেও শরীর শিহরিয়া ওঠে।

অতএব তত্ত্ববেত্তারা যাহাই বলুন না কেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য আদর্শ-মানুষ গড়াও নয়, অতিমানুষ তৈরিও নয়। কেননা এই উদ্দেশ্যটা সিদ্ধ হইবার সুদূর সম্ভাবনাও নাই, এবং যদি কোনও সম্ভাবনা থাকিত তাহা হইলে তাহার ফল অতি ভয়ংকর হইয়া উঠিত।

 

শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বিজ্ঞলোকদের আর একটি মত এই যে, শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত–ছাত্রের চরিত্রগঠন। চরিত্র জিনিসটা কী, তাহা লইয়া তর্ক না-ই তুলিলাম। ধরিয়া লওয়া যাক চরিত্র সেই সকল গুণের সমঞ্জসীকৃত সমষ্টি, যাহা মানুষের থাকা সমাজের পক্ষে কল্যাণকর। এই সকল গুণের তালিকা এবং সমষ্টির বিষয়, তাহদের রূপ ও মাত্রা সম্বন্ধে, বিভিন্ন কালে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা যে ছিল এবং আছে, তাহার প্রমাণ এই যে, শিক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধেও ভিন্ন দেশকালের প্রচলিত মত কিছু এক নয়। এই বিজ্ঞ বচনের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি এই যে, মুখে যিনি যাহাই বলুন না কেন, কি প্রাচীন কি আধুনিক কোনও শিক্ষাপ্রণালীই প্রকৃত কাজের বেলায় ছাত্রের চরিত্রগঠনকে তাহার প্রধান লক্ষ্যস্বরূপে গ্রাহ্য করে নাই। যিনি শিক্ষার দ্বারা চরিত্রগঠন বিষয়ে অতিমাত্ৰ উদ্যোগী, তিনিও সাহিত্যের একশো পাতার মধ্যে দশ পাতা হিতোপদেশ থাকিলে ভাল হয়, এই কথাই বলেন, এবং ইস্কুলের পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আধঘণ্টার জন্যেই নীতিশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ইহার কারণ এ নয় যে, মানুষের চরিত্র জিনিসটা সমাজের পক্ষে কিছু কম প্রয়োজনীয়; ইহার কারণ এই যে, চরিত্র জিনিসটা সেরূপ শিক্ষণীয় নয়। মানুষের চরিত্র প্রধানত নির্ভর করে বংশানুক্রম এবং পরিবার ও সমাজের বিশেষ অবস্থার উপর। কেবলমাত্র শিক্ষকের শিক্ষার দ্বারা চরিত্রে যে পরিবর্তন করা যায়, তাহার পরিমাণ অতি সামান্য; এবং তাহাও আবার শিক্ষার গৌণ ফল। সোজাসুজি নীতিশিক্ষার দ্বারা চরিত্র গড়িবার চেষ্টা করিলে, সে শিক্ষা অতি নীরস হইয়া ওঠে–এবং তাহার ফলও প্রায়ই বিপরীত হইতে দেখা যায়। প্রাচীন কালে গ্রিস দেশের পণ্ডিতগণ এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করিয়াছিলেন, এবং প্লেটো তাহার যে-সকল মত সক্রেটিসের নামে চালাইয়াছেন, তাহার মধ্যে একটা মত এই যে, চরিত্র বা virtues জ্যামিতি ও অলংকার-শাস্ত্রের ন্যায়ই একটা শিক্ষণীয় বস্তু। কিন্তু এই মতের মূলে আছে তাহার। আর একটি মত। প্লেটোর মতে ভালমন্দের জ্ঞান বুদ্ধির সাহায্যে লাভ করা যায়, এবং সেই জ্ঞান লাভ করিলেই মানুষ সচ্চরিত্র হয়। এই জ্ঞানবাদের–intellectualism-এর বিরুদ্ধে ইউরোপের অনেক মনীষী আজ লেখনী ধরিয়াছেন; এবং বেদাধ্যয়নেও যে দুরাত্মার চরিত্রের কোনও পরিবর্তন হয় না, তাহা আমাদের দেশের উদ্ভট কবিতার অজ্ঞাতি-নামা কবি অনেক পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছেন।

এ বিষয়ে একটা ভুল ধারণা থাকিয়া যাইবার সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালীর সহিত বিলাতের শিক্ষাপ্রণালীর তুলনা করিয়া আমাদের কর্তৃপক্ষেরা এবং তাহাদের বন্ধুবান্ধব সর্বদাই বলিয়া থাকেন, এবং আমরাও শুনিয়া শুনিয়া বলি যে, বিলাতে ইস্কুল-কলেজে ছাত্রদের চরিত্র গঠিত হয়, আর আমাদের ইস্কুল-কলেজ হইতে ছাত্রেরা কেবল কতকগুলি কথা মুখস্থ করিয়া চলিয়া আসে। কথাটা সত্য বলিয়াই ধরিয়া লওয়া যাক। কিন্তু ইহাতে এ প্রমাণ হয় না যে, বিলাতের ইস্কুল ও ইউনিভার্সিটিতে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহার ফলেই ছাত্রদের চরিত্র গঠিত হয়। বরং আমাদের কর্তৃপক্ষেরা উলটো কথাই বলেন। তাহারা বলেন যে, সেখানকার ইস্কুল-ইউনিভার্সিটির life বা আবহাওয়াতেই শিক্ষার্থীদের চরিত্র গড়িয়া ওঠে। অর্থাৎ সেখানকার ছাত্রদের চরিত্র সেখানকার বিদ্যালয়গুলির সামাজিক জীবনের ফল, শিক্ষার ফল নয। সুতরাং সামাজিক অবস্থার গুণে যেটা আপনা হইতেই জন্মলাভ করে, সেটাকে শিক্ষার ঘাড়ে চাপাইয়া আমাদের ছাত্ৰগণের কোনও হিতৈষী যেন তাহাদের পাঠ্য-পুস্তকের মধ্যে শেলির পরিবর্তে Smiles-এর আমদানি না করেন।

 

এখন শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি আদর্শ-মানুষ গড়াও না হয়, শিক্ষার্থীর চরিত্রগঠন করাও না হয়তবে তাহার উদ্দেশ্যটা কী? এ প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া খুব কঠিন নয়, এবং সে উত্তরও সকলেরই জানা আছে; কিন্তু সেটা প্রকাশ করিয়া বলিতে আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর লজ্জিত হই। কেননা উত্তরটা অতি সাধারণ রকমের, এবং বড় কথা বলিয়া ও শুনিয়া আমরা যে আত্মপ্রসাদ লাভ করি।—সোজা কথা বলায় ও শোনায় আমরা সে-সুখে বঞ্চিত হই।

কথাটা এই যে–শিক্ষার উদ্দেশ্য বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া; অর্থাৎ যার প্রথম সোপানকে সমস্ত বিষয়টার নামস্বরূপে ব্যবহার করিয়া আমরা বাংলা কথায় বলি-লেখাপড়া শিখানো। কি পুরাতন, কি বর্তমান সমস্ত শিক্ষাপ্রণালীর লক্ষ্যই যে এই বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া, তাহ টোল, পাঠশালা, ইস্কুল, কলেজগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করিলেই প্রত্যক্ষ করা যায়। নিতান্ত সূক্ষ্মদশী বিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া এই স্কুল বিষয়টা আর কাহারও চোখ এড়াইবার সম্ভাবনা নাই! শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যে-সকল তত্ত্বকথা আছে, তাহদের উদ্দেশ্যই এই নিতান্ত সোজা কথাটাকে চাপা দেওয়া, যাহাতে তাহা নিজগুণে প্ৰকাশ না হইয়া পড়ে।

তত্ত্বজ্ঞানীদের সমস্ত বচন উপেক্ষা করিয়া এবং বিজ্ঞব্যক্তিদের উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়া, পৃথিবীর শিক্ষালয়গুলি যগন বরাবর বিদ্যাশিক্ষা দেওয়াকেই তাঁহাদের প্রধান লক্ষ্য করিয়াছে, তখন ইহার মূলে যে নিছক বোকামি ছাড়া আরও কিছু আছে, তাহাতে অতি-বুদ্ধিমান ভিন্ন আর কেহ সন্দেহ করিবেন না। আমরা স্পষ্ট করিয়া বলিতে চাই যে, বিদ্যাশিক্ষাই যে কাৰ্যত শিক্ষার লক্ষ্য হইয়া আছে, কেবল তাঁহাই নহে, প্রকৃতপক্ষে উহাই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত। একটু ভাবিয়া দেখিলে বোঝা যাইবে যে, বিদ্যাশিক্ষা জিনিসটা মানবসমাজের যুগযুগান্তরসঞ্চিত সভ্যতার সহিত পৃথিবীতে নবাগত মানবসস্তানের পরিচয করানো। এই পরিচয় শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব, এবং শিক্ষা ভিন্ন আর কোনওরকমেই হইবার উপায় নাই। আদিম কাল হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত বহু-আয়াসলব্ধ সভ্যতার ফল নানা বিদ্যারূপে সঞ্চিত আছে ও হইতেছে। শিক্ষা এই বিদ্যাগুলির সঙ্গে মানুষের পরিচয় সাধন করে। অতি সভ্যসমাজের শিশুও অসভ্য হইয়া জন্মায়, এবং শিক্ষার মধ্য দিয়া এই বিদ্যাগুলির সহিত পরিচয় লাভ না করিলে অসভ্য অবস্থাতেই বাড়িয়া উঠিত। অসভ্য অর্থ বুদ্ধিহীনও নয়, হৃদয়হীনও নয়, অসভ্য অর্থ বিদ্যাহীন। অসভোর সমাজ সেই সমাজ, যাহার প্রতিপুরুষের লোকের জন্য পূর্বপুরুষের ও পূর্বকালের এমন কোনওই সঞ্চিত বিদ্যা নাই, যাহা বিশেষ শিক্ষা ভিন্ন আয়ত্ত হয় না। সভ্যসমাজের লোক ইস্কুল-কলেজে শিক্ষা না পাইলেও বংশানুক্রমের ফলে এবং সামাজিক অবস্থার প্রভাবে মোটামুটি সভ্য সমাজেচিত বুদ্ধি ও চরিত্র লাভ করে; কিন্তু রীতিমতো শিক্ষা না পাইলে অতি বড় পণ্ডিতবংশের প্রতিভাবান সন্তানও মুর্থই থাকিয়া যায়। কেননা বিদ্যার বংশানুক্রম নাই। সকলরকম বিদ্যাই প্রতি যুগের লোককে নূতন করিয়া আয়ত্ত করিতে হয়। এবং এই ক্ৰমাগত নুতন চেষ্টার ফলেই মনুষ্যসমাজের লব্ধ বিদ্যা প্রালব্ধ না হইয়াও রক্ষিত হয়। যদি পৃথিবীর একপুরুষের সমস্ত লোক একবার সমস্ত বিদ্যাশিক্ষা হইতে বিরত থাকে, তবে মানুষের আদিকাল হইতে একাল পর্যন্ত সঞ্চিত সমস্ত বিদ্যা ও সভ্যতা একপুরুষেই লোপ পায়, এবং মানুষকে আবার প্রাচীন বর্বরতায় কঁচিয়া বসিয়া সভ্যতার পুনর্গঠন আরম্ভ করিতে হয়। সুতরাং বিদ্যাশিক্ষা ব্যাপারটা একেবারে অকিঞ্চিৎকর জিনিস নয়। ইহার অর্ধ-মানুষের বহুযুগের চেষ্টার ফলে অর্জিত সভ্যতার সহিত পরিচিত হইয়া, অসভ্য অন্তত ন-সভ্য অবস্থা হইতে সভ্য হওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে এই কষ্টলব্ধ প্ৰাচীন সভ্যতাকে রক্ষা করা।

কথাটা আরও পরিষ্কার করিতে হইলে একবারে অনেকটা গোড়ার কথা ধরা ছাড়া উপায় নাই।

 

মানুষের সভ্যতা অতি প্রাচীন। সচরাচর কথাবার্তায় আমরা এই প্রাচীনতা সম্বন্ধে যে ধারণা প্রকাশ করি, ইহা তদপেক্ষা অনেক বেশি প্রাচীন। প্রাচীন সভ্যতার কথা উঠিলেই আমরা বৈদিক, ব্যবিলন, বা মিশরের সভ্যতার কথা তুলিয়া এমনভাবে কথা কই, যেন ওইগুলি মানবসভ্যতার আদিম অবস্থা। প্রকৃতপক্ষে ওই সকল সভ্যতা অতি সুপরিণত এবং মানুষের সভ্যতার প্রথম অবস্থা হইতে বহুদূরে অবস্থিত। অনেক বিষয়ে ওই সকল সভ্যতা যেস্থানে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল তাহার পর হইতে একাল পর্যন্ত মানুষের সভ্যতা সেদিকে আর বড় বেশি দূর অগ্রসর হয় নাই। এই কথা মনে না থাকায় আমরা যাহাকে আধুনিকতা বলি, প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে পদে পদে তাহার পরিচয় পাইয়া আশ্চৰ্য হই, এবং এই সকল সভ্যতা হইতেও বহু প্ৰাচীন অথচ পরিপুষ্ট সভ্যতার বিবরণ আবিষ্কার হইলে আমরা অতিমাত্রায় বিস্ময় প্রকাশ করি।

মানুষের এই সুপ্রাচীন সুপরিণত সভ্যতা মানুষ যে সম্পূর্ণ অসভ্যতার হাত হইতে ক্রমশ উদ্ধার করিয়াছে তাহাতে সংশয় নাই, এবং বর্তমানের অতি সুসভ্য মানুষ যে অতীতের নিতান্ত অসভ্য আদিম মানুষেরই বংশধর তাহাতেও সন্দেহ করিবাব কোনও কারণ দেখি না। মানুষ যে অসভ্যতা হইতে ক্রমশ সুসভ্যতায় উপনীত হইয়াছে, সে সম্বন্ধে বর্তমান যুগের শিক্ষিত জনসাধারণের মনে বড় একটা সংশয় নাই। তাহারা জানিয়া রাখিয়াছেন যে, ইহা ইভলিউশনের ফল। ইহার অর্থ কেবলমাত্র এই নয় যে, মানুষের সভ্যতা ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করিয়াছে; কেননা এই ক্ৰমবিকাশের কথা তো অল্প-বিস্তর ঘটনারই বিবৃতি, তাহার ব্যাখ্যা নয়। এই ইভলিউশন্যবাদের সম্পূর্ণ অর্থটা এই যে, যে নিয়মে অতি নিম্নশ্রেণির জীবদেহ হইতে পৃথিবীতে অতি উচ্চশ্রেণির জীবশরীর এমশ উদ্ভূত হইয়াছে বলিয়া প্রাণতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন, ঠিক সেই নিয়মেই মানুষের সভ্যতা অতি নীচ অবস্থা হইতে ক্রমশ উচ্চ অবস্থায় আসিযা পৌঁছিয়াছে। প্ৰসিদ্ধ ইংরাজ দার্শনিক হাৰ্বাট স্পেন্সার এই মতটা খুব জোরের সহিত প্রচার করিয়াছেন এবং সেই প্রচারের কাজটা এতই সাফল্য লাভ করিয়াছে যে, যাঁহাদের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে স্পেন্সারের লেখার সহিত কোনও পরিচয় নাই, তাহাদেরও এই মতের সত্যতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্ৰ সংশয় নাই। এবং বোধ হয় এই মতটা পোষণ করা আধুনিকতা ও বৈজ্ঞানিকবুদ্ধির লক্ষণ বলিয়াই শিক্ষিত-সমাজে গণ্য ও মান্য। কিন্তু মতটা আগাগোড়া মিথ্যা। পৃথিবীতে জীবশরীরের ক্রমবিকাশের নিয়মের সহিত মানুষের সভ্যতার ক্রমোন্নতির কোনও সম্পর্ক নাই। এই দুই ব্যাপারের নিয়ম ও প্রণালী সম্পূর্ণ পৃথক, এবং পৃথক বলিয়াই অসভ্য শিশুকে শিক্ষা দিয়া সুসভ্য মানুষ করা সম্ভব হয়, এবং পৃথক বলিয়াই সভ্য মানুষের সমাজে শিক্ষা এতটা স্থান জুড়িয়া আছে। যদি, সত্যই Organc Evolution-এর নিয়মে মানবসভ্যতার বিকাশ হইত। তাহা হইলে মানুষের জীবনে শিক্ষার কোনও স্থান থাকিত না; বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতালব্ধ সমস্ত বিদ্যা শিশুর মনে আপনিই স্ফরিত হইত এবং যে হতভাগ্যের হইত না স্বয়ং ফ্রোবেলও সারাজীবন শিক্ষা দিয়া তাহাকে বর্ণ পরিচয় করাইতে পারিতেন না।

Organic Evolution-এর মূলে আছে Heredity অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন, উদর সর্বস্ব জীবাণু হইতে যে পৃথিবীতে ক্ৰমে মানুষের জন্ম হইয়াছে ইহার গোড়ার কথা এই যে, জনক জননীর দেহের ও মনের ধর্ম সন্তানে সংক্রমিত হয়। ফলে যখন জনক জননীর শরীরে বা মনে নুতন কিছুর আবির্ভাব হয় তখন তাহাদের সন্তান, অন্বয়ানুসারে সেই নূতনত্ব লাভ করে। যদি জীবন-সংগ্রামে এই নূতন কিছুর দ্বারা কোনও সুবিধা হয় তবে যাহাদের সেটা আছে তাহার সাহায্যে সেই শ্রেণির প্রাণীর মধ্যে তাহারাই বাঁচিয়া থাকে এবং বংশ রাখিয়া যায়, বাকিগুলি নির্বংশ হইয়া মরে। এবং এইরূপে যুগের পর যুগ নানা বিভিন্ন অবস্থায় নূতনত্বের উপর নূতনত্ব পুঞ্জীভূত হইয়া সৰ্বেন্দ্রিয়হীন এক Cell-এর জীব হইতে পশুপক্ষী ও মানুষের উদ্ভব হইয়াছে। এই হইল Organic Evolution সম্বন্ধে পণ্ডিতদের আধুনিক মত।

কেমন করিয়া জীবশরীরে এই নূতনত্বের আবির্ভাব হয় এবং কোন জাতীয় নূতনত্ব Organic Evolution-এর প্রধান ভিত্তি, এ সম্বন্ধে ত্ৰিশ বছর পূর্বে পণ্ডিতেরা যতটা একমত ও নিঃসংশয় ছিলেন এখন আর তেমন নহেন। তখনও ডারউইনের প্রচারিত ব্যাখ্যাই সকলে মান্য করিতেন। ওই ব্যাখ্যা অনুসারে জনক জননীর সহিত সন্তানের যে-সব ছোটখাটো জন্মগত বিভিন্নতা প্ৰতিদিনই দেখা যায়, যাহার ফলে ছেলেটা বাপের মতো হইয়াও ঠিক তাহার মতো হয় না, সেই নিত্যসিদ্ধ নূতনত্বই ইভলিউশনের প্রধান সহায়। আর এক সহায, প্ৰত্যেক প্রাণীর জীবনকালের মধ্যে বাহিরের চাপে ও ভিতরের চেষ্টায় তাহার মধ্যে যে পরিবর্তন উপস্থিত হয়। কিন্তু ডারউইনের এই মতের আসন এখন টলিয়াছে। এখন পণ্ডিতেরা বলিতেছেন, যে নূতনত্বের উপর ভর করিয়া unicellular জীব মানুষে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহা প্রতিদিনকার আটপৌরে নূতনত্ব নয়। প্রাণীর শরীরে মাঝে মাঝে অতি দুৰ্জেয় কারণে হঠাৎ এক-একটা বড় রকমের পরিবর্তন উপস্থিত হয়। যদি তাহাতে জীবনযুদ্ধের কোনও সহায়তা হয় তবে তো কথাই নাই, অন্ততপক্ষে যদি নিতান্ত বিপত্তিকর না হয় তাহা হইলেই ওই পরিবর্তনটি স্থায়ী হইয়া বংশানুক্ৰমে চলিতে থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ প্ৰাণীতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরই মত যে এই সকল হঠাৎ-উপস্থিত বড় রকমের নূতনত্বই Organic Evolution-এর প্রধান কারণ। প্রতি প্রাণীর জীবদ্দশায় বাহিরের প্রকৃতির 5८° ७3 ভিতরের শক্তির প্রয়োগে তাহার মধ্যে যে পরিবর্তন হয়। সে সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা এখন বলিতেছেন যে, ওই-জাতীয় পরিবর্তন সন্তান-সন্ততিতে মোটেই সংক্ৰমিত হয় না। প্রাণীর শরীরে দুই রকমের মালমশলা আছে। এক শ্রেণির মালমশলায় তাহার শরীর গঠিত হয়, দ্বিতীয় রকমের মালমশলা বংশরক্ষার জন্য সঞ্চিত থাকে। বাহিরের চাপে বা ভিতরের চেষ্টায় যে পরিবর্তন তাহা ওই প্রথম শ্রেণির মালমশলাতেই আবদ্ধ থাকে, দ্বিতীয় শ্রেণির মালমশলা সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকিয়া যায়। ফলে ওই স্বেপার্জিত পরিবর্তন সন্তান-সন্ততির নিকট পৌছে না। যখন দ্বিতীয় শ্রেণির মালমশলায় পরিবর্তন উপস্থিত হয়, সেই পরিবর্তনই বংশানুক্ৰমে চলে। এই পরিবর্তনের কারণ এখন পর্যন্তও একেবারেই অজ্ঞাত। এবং জীবশরীরে যে-সকল হঠাৎ বড় বড় পরিবর্তন উপস্থিত হইয়া Organic Evolution-G ধাপে ধাপে টানিয়া তুলিয়াছে তাহার কারণ এই দ্বিতীয় রকমের মালমশলায় পরিবর্তন।

এই তো গেল। সংক্ষেপে Organic Evolution-এর নিয়ম-সম্বন্ধে পণ্ডিতদের বর্তমান মত। এখন ইহার সহিত মানুষের সভ্যতার ক্রমোন্নতির সম্পর্কটা কী? মানুষের কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, সংগীত কিছুই তো মানুষের শরীরে দাগ কাটে না, বিশেষত শরীরের সেই মালমশলাগুলিতে যাহার উপর বংশানুক্রম নির্ভর করে। এগুলি বাহিরের বস্তু। মানুষ এগুলিকে আবিষ্কার করিয়াছে, সৃষ্টি করিয়াছে। ইহারা এক পুরুষের শরীর হইতে আর এক পুরুষের শরীরে সঞ্চারিত হয় না। এক পুরুষের মানুষ পরের পুরুষের মানুষকে এগুলি সঞ্চিত ধনের মতো দান করিয়া যায়। ইহারা মানুষের heredity নয়, inheritance। এগুলির বংশানুক্রম নাই, আছে উত্তরাধিকার। এবং এ ধানের উত্তরাধিকারী একমাত্র অঙ্গজ নয়, সমগ্ৰ মানবসমাজ।

তারপর ডারউইনের Survival of the fittest নিয়মেরও এখানে কোনও প্রভাব নাই। সভ্যতার যাহা শ্রেষ্ঠ ফল তাহার দ্বারা জীবনসংগ্রামে কোনও কাজই হয় না। Binomial theorem আবিষ্কার করিয়া Newton-এর জীবনযাত্রার এবং বংশরক্ষার যে কোন সুবিধা হইয়াছিল, ইহা তাহার জীবনচরিত লেখকেরা বলেন না, এবং যাহারা ওই তত্ত্বটি আবিষ্কার করিতে পারেন নাই তাঁহারা যে নির্বংশ হন নাই। ইহাও নিশ্চিত। কাব্য রচনার ফলে ‘জীবনযুদ্ধে জয়লাভের কতটা সুবিধা হয় সে সম্বন্ধে দেশি বিদেশি ভুক্তিভোগী কবিদের আত্মোক্তির অভাব নাই, এবং অকবি লোকও যে সংসারে টিকিয়া থাকে এবং বংশরক্ষা করিয়া। তবে মরে তাহাও অস্বীকার করা চলে না।

এ কথা সত্য যে, মন ও ইন্দ্ৰিয়ের যে-সব শক্তির প্রয়োগে মানুষ সভ্যতা গড়িয়া তুলিয়াছে ও তুলিতেছে, ওই শক্তিগুলি Organic Evolution-এরই ফল। মানুষের বুদ্ধি, প্রতিভা, কল্পনা, ইন্দ্ৰিয়ের সূক্ষ্মানুভূতি এগুলি যে জন্মগত ইহা তো প্রতিদিন চোখেই দেখা যায়। এবং ওই শক্তিগুলিই যে জীবনযুদ্ধে মানুষের সহায় হইয়া তাহাকে পৃথিবীর রাজাসনে বসাইয়াছে তাহাও স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু ওই শক্তিগুলিকে যে-সব কাজে লাগাইয়া মানুষ সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে তাহা Organic Evolution-এর চোখে একবারে বাজে খরচ, সম্পূর্ণ অপব্যবহার। Organic Evolution-এর ফলে মানুষ লাভ করিল তীক্ষ শ্রবণশক্তি, যেন শিকারের ও শিকারির মৃদু পদশব্দটিও কানে না এড়ায়, মানুষ সেই সুযোগে গড়িল সংগীতবিদ্যা। ইভলিউশনে মানুষ পাইল দশ আঙুলের সূক্ষ্ম স্পর্শানুভূতি, যেন তাহার তিরের লক্ষ্যটা একেবারে অব্যৰ্থ হয়; সে বসিয়া গেল তাত পাতিয়া মলমল বুনিতে, আর তুলি ধরিয়া ছবি আঁকিতে। ইভলিউশন মানুষকে দিল তীক্ষ্ণবুদ্ধি আর কল্পনা যেন সেনানা ফিকিরে শরীরটাকে ভাল রকম বাঁচাইয়া বংশটা রাখিয়া যাইতে পারে, মানুষ গড়িয়া তুলিল কাব্য, বিজ্ঞান, দর্শন। ইভলিউশনে মানুষের কণ্ঠে আসিল ভাষা— যাহাতে তাহার পক্ষে দলবদ্ধ হওয়া সহজ হয়, মানুষ সৃষ্টি করিয়া বসিল— ব্যাকরণ আর অলংকার। মোট কথা মানুষ সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে প্ৰাণেব ঘরের চোরাই মাল মনের কাজে খরচ করিয়া। প্ৰাণের ঘরকন্নার জিনিস মনের বিলাসে ব্যয় করার নাম সভ্যতা।

মানুষের এই তহবিল তছরুপের একটা ফল এই যে, মানুষের ইন্দ্ৰিয়ের ও মনের শক্তি Organic Evolution-এ যেখানে আসিয়া পৌঁছিয়ছিল সেইখানেই থামিয়া আছে। ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে এই সকল শক্তির কিছু বৃদ্ধি হইয়াছে তাহা বোধ হয় না। প্রাচীন গ্রিক অপেক্ষা যে নবীন ফরাসির বুদ্ধি ও রূপজ্ঞান অধিক তাহার কোনও প্রমাণ নাই, এবং বৈদিক যুগের হিন্দুর অপেক্ষা আমাদের মানসিক শক্তি যে উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে এমন কথা কি সবুজপন্থী কি সনাতনপন্থী কেহই বলিবেন না। তবে প্রাচীন কালের তুলনায় বর্তমান সভ্যতার অনেক বিষয়ে আশ্চৰ্যজনক বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রাচীন পণ্ডিতের যাহা স্বপ্নেরও অতীত ছিল বর্তমানের শিশুরাও তাহা হাতেখড়ির পরেই শেখে। তাহার কারণ সভ্যতা বাড়ে টাকার সুদের মতো। এক যুগের মানুষ যাহা সৃষ্টি করে, পরের যুগের মানুষ শিক্ষার সাহায্যে তাহাকে আয়ত্ত করিয়া আবার তাহার উপর নূতন সৃষ্টির আমদানি করে, এইরকমে প্রাচীন সৃষ্টির উপর নবীন সৃষ্টি জমা হইয়া মানুষের সভ্যতা বাড়িয়া চলে। প্রাচীন যুগে যাহারা সভ্যতার গোড়াপত্তন করিয়াছিলেন তীহাদের মানসিক শক্তি যে আমাদের চেয়ে কিছু কম ছিল তাহা নয়, কিন্তু তাঁহাদের চেষ্টার ফল যে অনেক বিষয়ে আমাদের কাছে খুব সামান্য বোধ হয় তাহার কারণ আমরা পাইয়াছি তাহার পরের শত যুগের চেষ্টার পুঞ্জীভূত ফল। এবং আমরা যে নূতন সৃষ্টি করি তাহা এই বহুযুগের সৃষ্টিকে ভিত্তি করিয়া। এই জমানো সভ্যতার পুঁজি যে মাঝে মাঝে অল্প-বিস্তর খোয়া যায় না। তাহা নয়; তখন আবার মানুষকে কঁচিয়া আরম্ভ করিতে হয়। এবং বুনিয়াদি ঘরের জমানে টাকার মতোই ইচ্ছা করিলে কিছুমাত্র না বাড়াইয়া দুই-এক পুরুষেই ইহাকে ফুকিয়া নিঃশেষ করিয়াও দেওয়া যায়। ইহার দৃষ্টাস্তের জন্য আমাদের বেশি দূরে যাইতে হইবে না।

 

Organic Evolution-এর রাজ্যে বিদ্রোহী হইয়া তাহার রাজ্য লুটিয়া আনিয়া, মানুষ যে সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে তাহার ফল সঞ্চিত হইয়াছে সাহিত্যে, কলায় এবং বিবিধ বিদ্যায়। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য এইগুলির সহিত মানুষের পরিচয় করাইয়া দেওয়া। এই সকল বিদ্যা ও কলা অতীতের নিকট হইতে বর্তমানের উত্তরাধিকার। শিক্ষার লক্ষ্য এই উত্তরাধিকারে মানুষকে অধিকারী করা। কেননা এ তো কোম্পানির কাগজের দান নয় যে ঘরে বসিয়া সুদ পাওয়া যাইবে। এ হইল কষ্টে গড়া ব্যবসায়ের উত্তরাধিকার। কাজ শিখিয়া চলাইতে পারিলে তবেই লাভের সম্ভাবনা।

সভ্যতার এই ফলগুলি শিক্ষার দ্বারা মানুষকে আয়ত্ত করানো যায়, কেননা যে শক্তির প্রয়োগে ইহাদের সৃষ্টি সে শক্তি অল্প-বিস্তর মানুষ জন্ম হইতেই লাভ করে। সেই জন্য অসভ্য সমাজের শিশুও শিক্ষা পাইলে সভ্যসমাজের ছেলের মতোই সভ্যতার বিদ্যাগুলিকে আয়ত্ত করিতে পারে। ইহার পরীক্ষা অনেকবার হইয়া গিয়াছে। অন্যদিকে সভ্যসমাজের ছেলেকেও শিক্ষা পাইয়াই এই বিদ্যাগুলির সহিত পরিচিত হইতে হয়। কেননা বিদ্যা তো মানসিক শক্তি নয়, উহা মানসিক শক্তির সৃষ্টি এবং সহস্ৰ যুগের মানব-প্রতিভার সমবেত সৃষ্টি। প্রকৃতি যাহার কপালে প্রতিভার তিলক পরাইয়াছেন, যে কেবল সভ্যতার সৃষ্টিগুলিকে নিজস্ব করিতে পারে তাহা নয়, তাহার উপর নিজের সৃষ্টিও যোগ করিতে পারে, তাহাকেও এই শিক্ষার দ্বারা দিয়াই সভ্যতার রাজ্যে প্রবেশ করিতে হয়। কেননা এমন প্রতিভার কল্পনা করা যায় না, যাহা সভ্যতার কোনও সৃষ্টিকে আবার প্রথম হইতে একাই গড়িয়া তুলিতে পারে। প্রাচীন সৃষ্টির উপর দাড়াইয়াই তবে নূতন সৃষ্টি করা সম্ভব।

শিক্ষার লক্ষ্য সম্বন্ধে বর্তমান যুগে আর একটি মত প্রচলিত হইয়াছে যাহা বিজ্ঞলোকের পাণ্ডিত্যের ফল নয়। সংসারের চাকা বর্তমান যুগের মানুষ ও জাতির হৃদয় পিষিয়া এই মতটা নিংড়াইয়া বাহির করিয়াছে। মতটি হইল। এই যে, শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য মানুষকে জীবন-যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা। অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য–মানুষকে এমনভাবে গড়িয়া তোলা, যেন সে টিকিয়া থাকিয়া বংশরক্ষা করিয়া যাইতে পারে! এই মতটির আবির্ভাব মানবসভ্যতার একটা tragedy। ইহা মনের উপর প্রাণের প্রতিশোধ। প্ৰাণের ঘরে ডাকাতি করিয়া মানুষ মনের ভোগের জন্য সভ্যতা গড়িয়াছে। কিন্তু ইহার দু’-একটি সৃষ্টিকে আবাবা প্ৰাণের কাজে লাগাইতে গিয়া জীবনযাত্ৰাটা এমনই জটিল ও কঠিন হইয়া উঠিয়াছে যে, মানুষ প্রাণ রাখিতে যা কেবল প্ৰাণান্ত হইতেছে তাহা নয়, একেবারে মনান্ত হইতেছে। মনের যা কিছু শক্তি ও ক্ষমতা এক প্রাণ রাখার কাজেই ব্যয় করিতে হইতেছে। ইহার বিরুদ্ধে ওজস্বিনী বক্তৃতা করিয়া কোনও লাভ নাই। যাহা জীবন হইতে ঠেলিয়া উঠিতেছে কেবল মত দিয়া তাহাকে চাপা দেওয়া চলে না। এ হইল ভিড়ের ভিতর ঠেলাব মতো; ব্যাপারটা কেহ পছন্দ কবে না, কিন্তু পিছু হটবারও কাহারও সাধ্য নাই।

বর্তমান যুগের মানুষের পক্ষে হয়তো এই জটিলতার হাত এড়ানো অসাধ্য। এবং হয়তো বাধ হইয়াই বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীকে জীবন-যুদ্ধেব জন্য তৈরি করাটাই শিক্ষার একটা প্রধান লক্ষা করিতে হইবে। প্ৰাণের দাবির সুর যখন খুব চড়া হইয়া ওঠে তখন আর সব ফেলিয়া সেই দিকেই কান দেওয়া ছাড়া গতি নাই। কিন্তু আমরা যেন ভুলিয়াও না মনে করি যে এই বিসদৃশ ব্যাপারটাই হইল সভ্যতার উন্নতি। এ ভুলের আশঙ্কা আছে। কেননা মন আব ইন্দ্ৰিয়ের যে শক্তির প্রযোগে মানুষ সভ্যতা গড়িয়াছে, আজ জীবনযাত্রার জটিলতায় সেই সব শক্তির উপরেই প্ৰাণ তাহার একাধিপত্যের দাবি পেশ করিয়াছে। ফলে মানুষের বুদ্ধি, কল্পনা, প্রতিভা ব্যয় হইতেছে অনেক, কিন্তু সকলেরই লক্ষ্য কেবল প্ৰাণ বাঁচানো ও জাত বাঁচানো। ইহা সভ্যতা নয়, এ হইল সভ্যতা যে পথে চলে তাহার একবারে বিপরীত পথ। প্ৰাণের কাজে যাদের প্রথম প্ৰকাশ, মনের ভোগে তাদের শেষ পবিণতি হইল সভ্যতা। প্ৰাণের ব্যাগারে সমস্ত মনটাকেই নিঃশেষ করিয়া দেওয়া অসভ্যতা না হইতে পারে। কিন্তু সভ্যতা না।

ফাল্গুন ১৩২৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *