উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

০১. বৃহৎ ছাগলাদ্য ঘটনা

০১. বৃহৎ ছাগলাদ্য ঘটনা

বললে বিশ্বাস করবে? আমরা চার মূর্তি–পটলডাঙার সেই চারজন টেনিদা, হাবুল সেন, ক্যাবলা আর আমি স্বয়ং শ্রীপ্যালারাম, চারজনেই এবার স্কুল ফাইন্যাল পাশ করে ফেলেছি। টেনিদা আর আমি থার্ড ডিভিশন, হাবুল সেকেণ্ড ডিভিশন–আর হতচ্ছাড়া ক্যাবলাটা শুধু যে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে তা-ই নয়, আবার একটা স্টার পেয়ে বসে আছে। শুনছি ক্যাবলা নাকি স্কলারশিপও পাবে। ওর কথা বাদ দাও-ওটা চিরকাল বিশ্বাসঘাতক।

কলেজে ভর্তি হয়ে খুব ডাঁটের মাথায় চলাফেরা করছি আজকাল। কথায় কথায় বলি, আমরা কলেজ স্টুডেন্ট! আমাদের সঙ্গে চালাকি চলবে না।

সেদিন কেবল ছোট বোন আধুলিকে কায়দা করে বলেছি, কী যে ক্লাস নাইনে পড়িস ছা-ছা! জানিস লজিক কাকে বলে?

অমনি আধুলি ফ্যাঁচ করে বললে, যাও যাও ছোড়া–বেশি ওস্তাদি কোরো না। ভারি তো তিনবারের বার থার্ড ডিভিশনে পাশ করে

আস্পর্ধা দ্যাখো একবার। যেই আধুলির বিনুনি ধরে একটা টান দিয়েছি, অমনি চ্যা-ভ্যা বলে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে একাকার। ঘরে বড়দা দাড়ি কামাচ্ছিল, ক্ষুর হাতে বেরিয়ে এসে বললে, ইস্টুপিড় গাধা! যেমন ছাগলের মতো লম্বা লম্বা কান, তেমনি বুদ্ধি! ফের যদি বাঁদরামো করবি–দেব এই ক্ষুর দিয়ে কান দুটো কেটে!

দেখলে? ইস্টুপিড তো বললেই সেই সঙ্গে গাধা-ছাগল বাঁদর তিনটে জন্তুর নাম একসঙ্গে করে দিলে। আমি যে কলেজে পড়ছি–এখন আমার রীতিমতো একটা প্রেসটিজ হয়েছে সেটা গ্রাহ্যিই করলে না। আমার ভীষণ রাগ হল। মা বারান্দায় আমসত্ত্ব রোদে দিয়েছিল, এদিক-ওদিক তাকিয়ে তা থেকে খানিকটা ছিড়ে নিয়ে মনের দুঃখ বাইরে চলে এলুম।

আমাদের বাড়ির সামনে একটুখানি পাঁচিল-ঘেরা জায়গা। সেখানে বড়দার সিল্কের পাঞ্জাবি শুকুচ্ছে–নিজের হাতে কেচেছে বড়দা। আর একপাশে বাঁধা রয়েছে ছোড়দির আদরের ছাগল গঙ্গারাম। বেশ দাড়ি হয়েছে গঙ্গারামের। একমনে আমসত্ত্ব খেতে খেতে ভাবছি, এবার সরস্বতী পুজোয় থিয়েটারের সময় গঙ্গারামের দাড়িটা কেটে নিয়ে মোগল সেনাপতি সাজব–এমন সময় দেখি গঙ্গারাম গলার দড়ি খুলে ফেলেছে।

ছাগলের খালি দাড়ি হয় অথচ কান পর্যন্ত গোঁফ হয় না কেন, এই কথাটা খুব দরদ দিয়ে ভাবছিলুম। ঠিক তক্ষুনি চোখে পড়ল–গঙ্গারাম এগিয়ে এসে বড়দার সিল্কের পাঞ্জাবিতে মুখ দিয়েছে। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিলুম। একটু আগেই বড়দা আমাকে গাধা-ছাগল এইসব বলেছে। খেয়ে নিক সিল্কের পাঞ্জাবি বেশ জব্দ হয়ে যাবে।

দেখলুম, কুকুর করে দিব্যি খিয়ে নিচ্ছে গঙ্গারাম। দাড়িটা অল্প অল্প নড়ছে–চোখ বুজে এসেছে আরামে, কান দুটো লটর-পটর করছে। সিল্কের পাঞ্জাবি খেতে রে বেশ ভালোই লাগে দেখা যাচ্ছে। আমসত্ত্ব চিবোনো ভুলে গিয়ে আমি নিবিষ্ট চিত্তে লক্ষ করতে লাগলুম।

ইঞ্চি-দুয়েক খেয়েছে–এমন সময় গেটটা খুলে গেল। গলায় স্টেথিসকোপ ঝুলিয়ে হাসপাতালে নাইট ডিউটি সেরে ফিরছে মেজদা। সবে ডাক্তারি পাশ করেছে মেজদা আর

কী মেজাজ! আমাকে দেখলেই ইনজেকশন দিতে চায়।

ঢুকেই মেজদা চেঁচিয়ে উঠল : কী সর্বনাশ! ছাগল যে বড়দার জামাটা খেয়ে ফেললে! এই প্যালাইডিয়ট-হতভাগা বসে বসে মজা দেখছিস নাকি?

বুঝলুম, গতিক সুবিধের নয়! এবার বড়দা এসে সত্যিই আমার কান কেটে নেবে। কান বাঁচাতে হলে আমারই কেটে পড়া দরকার। ঘাড়-টাড় চুলকে বললুম, লজিক পড়ছিলুম–মানে দেখতে পাইনি–মানে আমি ভেবেছিলুম–বলতে বলতে মেজদার পাশ কাটিয়ে এক লাফে সোজা সদর রাস্তায়।

আমাদের সিটি কলেজ খুব ভাল খালি ছুটি দেয়। আজও চড়কষষ্ঠী না কোদালে অমাবস্যা কিসের একটা বন্ধ ছিল। আমি সোজা চলে এলুম চাটুজ্যেদের বোয়াকে। দেখি, টেনিদা হাত-পা নেড়ে কী যেন সব বোঝাচ্ছে ক্যাবলা আর হাবুল সেনকে।

সামনেই ক্রিসমাস! ব্যস–বাঁই বাঁই করে প্লেনে চেপে চলে যাব! কুট্টিমামা তোদেরও নিয়ে যেতে বলেছে। যাবি তো চল–দিনকতক বেশ খেয়ে-দেয়ে ফিরে আসা যাবে।

ক্যাবলা বললেন, কিন্তু প্লেনের ভাড়া দেবে কে?

—আরে মোটে কুড়ি টাকা। ড্যাম চিপ। আমি বললুম, কোথায় যাবে প্লেনে চেপে? গোবরডাঙা?

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, খেলে কচুপোড়া! এটার মাথাভর্তি কেবল গোবর–তাই জানে গোবরডাঙা আর ধ্যাধ্যেড়ে গোবিন্দুপুর! ড়ুয়ার্সে যাচ্ছি–ড়ুয়ার্সে। এন্তার হরিণ, দেদার বন-মুরগি, ঘুঘু, হরিয়াল বলতে বলতেই আমার হাতের দিকে চোখ পড়ল : কী খাচ্ছিস র‍্যা?

লুকোতে যাচ্ছিলুম, তার আগেই খপ করে আমসত্ত্বটা কেড়ে নিলে। একেবারে সবটা মুখে পুরে দিয়ে বললে, বেড়ে মিষ্টি তো! আর আছে?

ব্যাজার হয়ে বললুম, না–আর নেই। কিন্তু ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে যে যেতে চাইছ, শেষে বাঘের খপ্পরে নিয়ে ফেলবে না তো?

বাঘ মারতেই তো যাচ্ছি। আমসত্ত্ব চিবুতে চিবুতে টেনিদা একটু উঁচুদরের হাসি হাসল–যাকে বাংলায় বলে হাইক্লাস।

—অ্যাাঁ! আমি ধপাৎ করে বোয়াকের ওপর বসে পড়লুম : বাঘ নানাবাঘটাগের মধ্যে আমি নেই!

হাবুল বললে, হ, সত্য কইছস! এদিকে দন্তশূলে মরতে আছি বাঘের হাতে পইড়া পরান যাইব গিয়া।

ক্যাবলা বললে, ভালোই তো! দাঁতের ব্যাথার কষ্ট পাচ্ছিস যদি মারা যাস দেখবি একটুও আর দাঁতের ব্যথা নেই।

টেনিদা আমসত্ত্ব শেষ করে বললে, থাম—ইয়ার্কি করিসনি। আরে ড়ুয়ার্সের বাঘ-ভাল্লুক সবাই আমার কুট্টিমামাকে খাতির করে চলে। কুট্টিমামা ভাল্লুকের নাক পুড়িয়ে দিয়েছেবাঘের বত্রিশটা দাঁত কালীসিঙির মহাভারতের এক ঘায়ে উড়িয়ে দিয়েছে। শেষে সেই বাঘ কুট্টিমামার বাঁধানো দাঁত নিয়ে খেয়ে বাঁচে। সে বাঘটা আজকাল আর মাংস-টাংস খায় না–স্রেফ নিরিমিষি। লোকের বাগান থেকে লাউ-কুমড়ো চুরি করে খায় সেদিন আবার টুক করে কুট্টিমামার একডিশ আলুর দম খেয়ে গেছে।

ক্যাবলা বললে, গুল!

টেনিদা চোখ পাকিয়ে বললে, কী বললি?

ক্যাবলা বললে, না—মানে, বলছিলুম–গুল বাঘ আর ভোরাদার বাঘ–দুরকমের বাঘ হয়।

হাবুল বললে, আর-এক রকমের বাঘও হয়। বিছানায় থাকে আর কুটুস কইর‍্যা কামড়ে দেয়। তারে বাগ কয়।

আমিও ভেবে-চিন্তে বললুম, আর তাকে কিছুতেই বাগানো যায় না। কামড়েই সে হাওয়া হয়ে যায়।

টেনিদা রেগেমেগে বললে, দুত্তের খালি বাজে কথা! এদের কাছে কিছু বলতে যাওয়াই ঝকমারি! এই তিনটের নাকে তিনখানা মুগ্ধবোধ বসিয়ে নাকভাঙা বুদ্ধদেব বানিয়ে দিলে তবে ঠিক হয়। ফাজলামি নয়–সোজা জবাব দে–যাবি কি যাবি না? না যাস একাই যাচ্ছি প্লেনে চেপে তোরা এখানে ভ্যারেণ্ডা ভাজ বসে বসে।

আমি বললুম, বাঘে কামড়াবে না?

বললুম তো সে আজকাল ভেজিটেবিল খায়। আলুর দম আর মুলো হেঁচকি খেতে দারুণ ভালবাসে।

ক্যাবলা জিজ্ঞেস করলে, তার আত্মীয়স্বজন?

—তারা কুট্টিমামাকে দেখলেই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়বে। তখন আর শিকার করবারও দরকার নেই–স্রেফ গলায় দড়ি বেঁধে বাড়িতে নিয়ে এলেই হল।

আমি ভারি খুশি হয়ে বললুম, তা হলে তো যেতেই হয়! আমরা সবাই একটা করে বাঘ সঙ্গে করে বেঁধে আনব।

হাবুল বললে, সেই বাঘে দুধ দিব। ক্যাবলা বললে, আর সেই বাঘের দুধ বিক্রি করে আমরা বড়লোক হব। টেনিদা চেঁচিয়ে উঠে বললে ডি-লা-এ্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস–আমরা সবাই আরও জোরে চিৎকার করে বললুম ইয়াক-ইয়াক! বাবা অফিস যাওয়ার সময় বলে গেলেন, সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসবি একদিনও যেন কলেজ কামাই না হয়।

কোর্টে বেরুতে বেরুতে বড়দা মনে করিয়ে দিলে, দু-একখানা পড়ার বইও সঙ্গে নিয়ে যাস–খালি ইয়ার্কি দিয়ে বেড়াসনি।

ছুটির ভিতরে পড়ার বই নিয়ে বসতে বয়ে গেছে আমার। আমি সুটকেসের ভেতর হেমেন রায় আর শিবরামের নতুন বই ভরে নিয়েছি খানকয়েক।

মা এসে বললে, যা-তা খাসনি। তুই যেরকম পেটরোগা–বুঝেসুঝে খাবি।

কোত্থেকে আধুলি এসে জুড়ে দিলে, দুটো কাঁচকলা নিয়ে যা ছোড়দা–আর হাঁড়ির ভেতরে গোটাকয়েক শিঙিমাছ।

আমি আধুলির বিনুনিটা চেপে ধরতে যাচ্ছি সেই সময় মেজদা এসে হাজির। এসেই বলতে লাগল : প্লেনে চেপে যদি কানে ধাপা লাগে তা হলে হাই তুলতে থাকবি। যদি বমি আসে তা হলে অ্যাঁভোমিন ট্যাবলেট দিচ্ছি–গোটা কয়েক খাবি। যদি–

উঃ, উপদেশের চোটে প্রাণ বেরিয়ে গেল! এর মধ্যে আবার ছোড়দি এসে বলতে আরম্ভ করল; দার্জিলিঙের কাছাকাছি তো যাচ্ছিস। যদি সস্তায় পাস কয়েক ছড়া পাথরের মালা কিনে আনিস তো!

—দুত্তোর বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছি, ঠিক সেই সময়েই বাইরে মোটরের হর্ন বেজে উঠল। আর টেনিদার হাঁক শোনা গেল; কি রে প্যালা–রেডি?

—রেডি। আসছি—

তক্ষুনি সুটকেস নিয়ে লাফিয়ে উঠলুম। হাবুলদের মোটরে চেপে ওরা সবাই এসে পড়েছে। মোটরে করে সোজা দমদমে গিয়ে আমরা প্লেনে উঠব। তারপর দুঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে। তখন আর পায় কে! কুট্টিমামার ওখানে মজাসে খাওয়া-দাওয়া চা বাগান আর বনের মধ্যে বেড়ানো–দু-একদিন শিকারে বেরিয়ে গলায় দড়ি বেঁধে বাঘ-টাঘ নিয়ে আসা। ডি-লা-এ্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস!

সকলকে চটপট প্রণাম-ট্রনাম সেরে নিয়ে গেট খুলে বেরুতে যাচ্ছি, হঠাৎ

পেছনে বিটকেল ব-ব-ব আওয়াজ আর শাটের কোনা ধরে এক হ্যাঁচকা টান। চমকে লাফিয়ে উঠলুম। তাকিয়ে দেখি, হতচ্ছাড়া গঙ্গারাম। দাড়ি নেড়ে নেড়ে আমার জামাটা খাওয়ার চেষ্টা করছে।

–তবে রে অযাত্রা! পেছু টান।

ধাঁই করে একটা চাঁটি বসিয়ে দিলুম গঙ্গারামের গালে। গঙ্গারাম ম্যা-আ-আ করে উঠল। আর আমার হাতে যা লাগল সে আর কী বলব! গঙ্গারামটার গাল যে এমন ভয়ানক শক্ত, সেকথা সে জানত!

মোটর থেকে টেনিদা আবার হাঁক ছাড়ল;কী রে প্যালা, দেরি করছিস কেন?

—আসছি বলে এক ছুটে বেরিয়ে আমি গাড়িতে উঠে পড়লুম। তখনও গঙ্গারাম সমানে ডাকছে; ম্যা-অ্যাঁ-অ্যাঁভ্যা-অ্যাঁ-অ্যাঁ। ভাবটা এই : খামকা আমায় একটা রামচাঁটি লাগালে? আচ্ছা যাও ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে। এর ফল যদি হাতে-হাতে না পাও–তা হলে আমি ছাগলই নই।

হায় রে, তখন কি আর জানতুম–গঙ্গারামের ভাগনে যা দশগণ্ডা করে মারে, তারই পাল্লায় পড়ে আমার অদৃষ্টে অশেষ দুঃখ আছে এরপর!

গাড়ি দমদম এয়ারপোর্টের দিকে ছুটল।