০১. বাঙালনামা – প্রারম্ভিক

‘বাঙালনামা’
০১. প্রারম্ভিক

বেশ কয়েক বছর আগে ‘রোমন্থন’ নাম দিয়ে বাল্য ও প্রথম যৌবনের স্মৃতির ভিত্তিতে কয়েকটি নকশা জাতীয় রচনার একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলাম। লেখাটি জনপ্রিয় হয়েছিল। সত্যি বলতে শিক্ষিত বাঙালির কাছে আমার নাম যেটুকু পরিচিত তা ওই রোমন্থনের দৌলতে। যৌবনে দেখেছি, শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই স্যার যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সেন এবং নীহাররঞ্জন রায়ের নাম জানতেন। অনেকে তাদের লেখাও কিছু কিছু পড়তেন। অনুরূপ পাণ্ডিত্য বা খ্যাতি যে আমার ভাগ্যে জোটেনি, তা আমার বহুমুখী অসাফল্যরই অন্যতর দ্যোতক। পাঠক-পাঠিকা এই আত্মবিলাপ মার্জনা করবেন।

রোমন্থনের সময়সীমা ছিল ১৯৪৭-৪৮ : দেশবিভাগের নিদারুণ অভিজ্ঞতা। বন্ধুবান্ধব এবং গুণগ্রাহী পাঠকরা দেশবিভাগের পরবর্তী কাল, তথা সুদীর্ঘ প্রবাসজীবনের স্মৃতিকথা লিখতে বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কী লিখব, কী ভাবে লিখব তা ঠিক করতে করতে অনেক বছর কেটে গেল।

একটা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত প্রথমেই নিতে হল। ‘আত্মকথা’ লেখা আমার পক্ষে সম্ভব না। কারণ তার জন্য যে-সাহস দরকার তা আমার নেই। অনেক খ্যাতনামা মানুষের আত্মচরিত পড়েছি। তার অধিকাংশই যে অসত্য বা অর্ধসত্যে ভরা এ কথা আজ বহুবিদিত। অন্তহীন সাহস না থাকলে সত্যিকার আত্মকথা লেখা যায় না। রুসোরও অনেক আগে সন্ত অগাস্টিনের যুগ থেকে অনেক আত্মচরিতকারই নিজের যৌনতা সম্পর্কে নির্দ্বিধায় লিখেছেন। এ যুগে তো ও ধরনের স্বীকারোক্তি আর ফ্যাশন নেই, নিতান্তই জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যে-মানুষ আধুনিক সংবেদনশীল চেতনা সত্ত্বেও বাড়ির ঝি-র গায়ে হাত তুলেছেন অথবা দুঃখিনী মাকে ঘেন্না এবং অবহেলা করেছেন, এসব কথা লিখতে ইতস্তত করেননি, তাঁর সমতুল্য লোক বেশি নেই। আমি বা আমার মতো অনেক লোকই নিজকৃত বহু কাজ নিজের কাছে স্বীকার করতেও লজ্জিত। সেসব কথা লেখার সাহস কোথায় পাব? আর নিজের গভীরতর চেতনা, অবদমিত মনের নানা বিকৃতির কথা লিখলে তা মনস্তাত্ত্বিকের কাছে হয়তো মূল্যবান বিশ্লেষণযোগ্য উপাদান হত, পূতিগন্ধপ্রিয় পাঠকরা লুফে নিতেন। কিন্তু ও পথে অর্থোপার্জন করতেও বুকের পাটা লাগে। আমার মতো ভিতু ছাপোষা লোকের তা নাগালের বাইরে। সব অপ্রিয় সত্য, যাবতীয় লজ্জাকর তথ্য বাদ দিয়ে নিজের কীর্তিকাহিনির সত্যমিথ্যা মেশানো বিবরণ যেসব আত্মচরিতের মূল উপাদান, তাদের সাহিত্য হিসাবে মূল্য থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের সামগ্রিক আত্মপ্রকাশ যা আত্মচরিতের গোড়ার কথা, অনেক ক্ষেত্রেই এগুলি তা কোনও অর্থেই নয়। সুতরাং আত্মচরিত লেখার প্রচেষ্টা সাহসের অভাবেই ছাড়তে হল।

কিন্তু বয়স আশির দিকে এগুচ্ছে। মানুষের স্বল্পস্থায়ী জীবনের হিসাবে সময়টা লম্বা। এই দীর্ঘ সময় ধরে নানা ঘাটের জল খেতে হয়েছে। পিছনের দিনগুলি সত্যিই নানা রঙের, যদিও রঙগুলি প্রায়শই ঘনকৃষ্ণ অথবা অভাব আর নৈরাশ্যে ধূসর। তবু সেসব দিনের স্বাদ আজকের প্রজন্মের কাছে অচেনা। অপরিচয়ের দান যে-মাদকতা, তার সম্ভাবনায় ভরা। আর যে-পৃথিবী ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকেও চিনতাম, তার অনেকাংশই সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে বরিশাল গিয়ে এই সত্য প্রবলভাবে অনুভব করি। যে-শহরে এখন থাকি, সেই অক্সফোর্ডও আর পঞ্চাশের দশকের অক্সফোর্ড নেই, এই পশ্চিমি নালন্দার চিরন্তনী বলে আত্মশ্লাঘা সত্ত্বেও। বার্ধক্যের এই রচনা সেই বিস্মৃত বা বিলুপ্ত জগতের বিবরণ। লেখক সেখানে দর্শক, বড়জোর পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা। অর্থাৎ বর্তমান রচনাটি আত্মজীবনী নয়, স্মৃতিকথা। আর শুরু করছি ১৯২৬ সাল, অর্থাৎ জন্মের বছর থেকে, যদিও অবশ্যম্ভাবী কারণেই সে সময়ের কোনও স্মৃতি আমার নেই। বন্ধু ও শুভার্থীদের উপদেশ, দেশবিভাগের সময় থেকে শুরু করা, অনেক ভেবে গ্রহণ করলাম না। কারণ, রোমন্থনও স্মৃতিকথা না, স্কেচবুক মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *