০১. দত্তকগ্রহণ – প্রথম অধ্যায়

দত্তকগ্রহণ – প্রথম অধ্যায়

প্রাচীন হিন্দুসমাজে ১৪ প্রকার পুত্র জ্ঞাত ছিল। তন্মধ্যে কেবলমাত্র ঔরসপুত্ৰই স্বামী-স্ত্রীর প্রকৃত পুত্র। অপরগুলিরও মধ্যে কতকগুলি দত্তকপুত্রের ন্যায় গৃহীত, কতকগুলি স্ত্রীর বিবাহের পূৰ্ব্বে অপরের ঔরসে তাহার গর্ভে অবৈধপ্রণয়জাত, কেহ বা উপপত্নীর গর্ভজাত, ইত্যাদি। পরে সামাজিক আদর্শ উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে ক্রমে ঐ সকল পুত্র লোপ পাইতে লাগিল। এখন কেবলমাত্র ঔরস, দত্তক ও কৃত্রিম এই তিন প্রকার পুত্র প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে কৃত্রিম পুত্র কেবলমাত্র মিথিলা ভিন্ন আর কোথায়ও প্রচলিত নাই।

এই অধ্যায়ে আমরা দত্তক পুত্র সম্বন্ধে আলোচনা করিব।

দত্তক গ্রহণ করিতে হইলে, যে ব্যক্তি দত্তক গ্রহণ করিতেছেন, তাহার গ্রহণ করিবার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, যে ব্যক্তি দত্তক দান করিতেছেন, তাহার দান করিবার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, যাহাকে গ্রহণ করা হইতেছে সেই বালক দত্তকরূপে গৃহীত হইবার উপযুক্ত হইবে, এবং দত্তক গ্রহণের সময় হোম প্রভৃতি কাৰ্য্য সম্পন্ন হওয়া আবগুক। এই সমস্ত ব্যাপার সম্পন্ন হইলে তবে দত্তকগ্রহণ সিদ্ধ হইবে এবং এইরূপে গৃহীত হইলে দত্তকপুত্রের নানাপ্রকার অধিকার জন্মায়। আমরা এইগুলি একে একে আলোচনা করিব। কে দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন।

যে ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্ৰ বৰ্ত্তমান নাই তিনি দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন; উহাদের মধ্যে কেহ বৰ্ত্তমান থাকিতে দত্তক গ্রহণ করা চলে না। কিন্তু শিশুপ্রপৌত্র (প্রপৌত্রের পুত্র) বা দ্ৰৌহিত্র ব৷ ভ্রাতুপুত্র বা অন্য কোন জ্ঞাতিকুটুম্ব বর্তমানে দত্তক গ্রহণে বাধা নাই।

কেহ যদি তাহার নিজের একমাত্র পুত্রকে অপরের নিকট দত্তকরূপে দান করিয়া দিয়া থাকেন তাহা হইলে তিনি অপুত্রক স্বরূপ গণ্য হইবেন, এবং দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন। (শ্রবালুসু বঃ শ্ৰীবালুসু, ২২ মাদ্রাজ ৩৯৮, প্রিভিকৌন্সিল)।

কোন ব্যক্তির পুত্র উন্মাদগ্রস্ত, জন্মান্ধ, জন্মমূক, জন্মবধিব বা কুষ্টগ্রস্ত হইলে ঐ ব্যক্তি দত্তক গ্রহণ করতে পারেন (১০ মূর্‌স্ ইণ্ডিয়ান আপীলস্ ৪২৯), কারণ ঐরূপ পুত্র যখন পিণ্ডদানাদি ধৰ্ম্মকাৰ্য্য করিতে অক্ষম তখন সে থাকিয়াও না থাকা স্বরূপ গণ্য হইবে। সেইরূপ, কোন ব্যক্তির পুত্র সন্ন্যাসী হইয়া চলিয়া গেলে ঐ ব্যক্তি দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন। পুত্র বিধৰ্ম্মী হইলে পিতা দত্তক গ্রহণ করিতে সক্ষম, কারণ যদিও ঐ পুত্র ধৰ্ম্মান্তরগ্রহণ করা সত্ত্বেও ১৮৫০ সালের ২১ আইন অনুসারে পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হইবে বটে, তথাপি সে পিণ্ডদানাদি কাৰ্য্য করিতে অক্ষম, এবং ঐ কায্যের জন্য পিতা দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন। কিন্তু পুত্র নিরুদ্দিষ্ট হইয়া চলিয়া গেলে পিতা কি দত্তক গ্রহণ করতে পারেন? ইহা বড়ই কঠিন প্রশ্ন।

দত্তকগ্রহীতা যদি জম্মান্ধ, জন্মবধির, উন্মাদগ্ৰস্ত বা কুষ্ঠগ্রস্ত হন, তাহা হইলে তাহার দত্তকপুত্র ভরণপোষণ মাত্র পাইবে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইতে পারবে না। কারণ, দত্তকগ্রহীতা নিজেই যখন জন্মান্ধতা বা জন্মবধিরতা ইত্যাদি বশত: সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত, তখন তাঁহার দত্তকপুত্র কোথা হইতে সম্পত্তি পাইবে? তাহার দত্তকপুত্র কখনই তাঁহার অপেক্ষা অধিক স্বত্ব পাইতে পারে না। কিন্তু একথা কেবলমাত্র দত্তকগ্রহীতার পৈতৃক সম্পত্তি সম্বন্ধে খাটে; যদি দত্তকগ্রহীতা নিজের কিছু স্বোপার্জিত সম্পত্তি থাকে, আর তিনি যদি জন্মবধির (বা জন্মান্ধ) ইত্যাদি হন, তাহা হইলে ঐ সম্পত্তিতে তাঁহার দত্তকপুত্রের অবশ্যই উত্তরাধিকারস্বত্ব জন্মিবে।

স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় স্বামী দত্তক গ্রহণ করিলেও তাহা সিদ্ধ হইবে (১২ বোম্বাই ১০৫), কারণ, যতক্ষণ সন্তান ভূমিষ্ঠ না হইয়াছে, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত পিতা অপুত্ৰক বলিয়া গণ্য হইবে।

অবিবাহিত ব্যক্তি দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন (৪ মাদ্রাজ হাইকোর্ট রিপোর্ট ২৭০); যে ব্যক্তির স্ত্রী মৃত তিনিও পারেন (২ মাদ্রাজ ৩৬৭)।

হিন্দু আইন অনুসারে কোনও ব্যক্তির বয়স ১৫ বৎসর পূর্ণ হইলে সে দত্তক গ্রহণের পক্ষে সাবালক বলিয়া গণ্য হয়; ঐরূপ ব্যক্তি দত্তক গ্রহণ করিতে পারে (যমুনা বঃ বামামুন্দরী, ১ কলিকাতা ২৮৯, প্রিভিকৌন্সিল)। যাহার সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে থাকে তিনি রেভিনিউ বোর্ডের সম্মতি না লইয়া দত্তকগ্রহণ করিলে তাহা অসিদ্ধ হইবে।

এক সময়ে একটী মাত্র দত্তক গ্রহণ করা যাইতে পারে। একই সময়ে অর্থাৎ একদিনে একসঙ্গে একাধিক দত্তক গ্রহণ করিলে সকল গুলিই অসিদ্ধ হইবে।

যদি একটী দত্তক গ্রহণ করিয়া কিছুকাল পরে আর একটী দত্তক গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলে প্রথম দত্তকটা সিদ্ধ, এবং দ্বিতীয় দত্তক গ্রহণ অসিদ্ধ হইবে (মহেশ বঃ তারকনাথ, ২০ কলিকাতা ৪৮৭)। এমন কি, প্রথম দত্তকের মৃত্যু হইলেও ঐ দ্বিতীয় দত্তক সিদ্ধ হইবে না, কারণ যাহা অসিদ্ধ তাহা চিরকালই অসিদ্ধ এবং কোনও ঘটনা দ্বারা তাহা পরে সিদ্ধ হইতে পারে না।

স্ত্রীলোক কর্ত্তৃক দত্তক গ্রহণ-স্বামীর অনুমতি

পুরুষ যদি দত্তক গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তিনি স্ত্রীর সম্মতি লইতে বাধ্য নহেন; এমন কি, স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন।

কিন্তু কোন স্ত্রীলোক স্বামীর অনুমতি বা সম্মতি ব্যতীত দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন না। বশিষ্ঠ লিখিয়াছেন—“ন স্ত্রী পুত্ৰং দদ্যাং প্রতিগৃহীয়াং বা অন্যত্রাযুজ্ঞানাং ভৰ্ত্তঃ” অর্থাৎ স্বামীর অনুমতি ব্যতীত স্ত্রী কোন পুত্রকে দত্তকরূপে দান বা গ্রহণ করিতে পারেন না। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, কোন স্ত্রীলোক তাঁহার নিজের পারলৌকিক উপকারের জন্য দত্তকগ্রহণ করিতে পারে না—কেবলমাত্র তাই র স্বামীর মঙ্গলের জন্যই পারেন। এই কারণে কোনও অবিবাহিত। স্ত্রীলোক দত্তকগ্রহণ করিতে সক্ষম নহেন (৪ বোম্বাই ৫৪৩ : ১১ মাদ্রাজ ৪৯৩; ১২ মুরস ইণ্ডিয়ান আপীলস্ ৫৩৭)।

স্বামীর অনুমতি দেওয়া থাকিলে বিধবা দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন। অনুমতি বাচনিক হইতে পারে কিংবা দলিল দ্বারা দেওয়া যাইতে পারে। যদি ঐ অনুমতি উইলের দ্বারা দেওয়া হয়, অর্থাৎ উইলের মধ্যে উইলকৰ্ত্তা স্ত্রীকে দত্তক গ্রহণ করিবার ক্ষমতা লিখিয়া দেন, তাহা হইলে কোন ষ্ট্যাম্প কাগজের প্রয়োজন হয় না, এবং রেজেষ্টারী না করিলেও চলে, (কিন্তু রেজেষ্টার করা খুবই কৰ্ত্তব্য)। যদি উহা অনুমতিপত্রে লিখিত হয়, তাহা হইলে তাহা ২০ টাকার ষ্ট্যাম্প কাগজে লিখিতে হইবে, এবং রেজেষ্টারী করিতেই হইবে, নতুবা সিদ্ধ হইবে না।

স্বামীর অনুমতি থাকিলেই যে বিধবা দত্তকগ্রহণ করিতে বাধ্য হইবেন, এরূপ নহে; দত্তক গ্রহণ করা না করা তাঁহার সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। তিনি দত্তক গ্রহণ না করিলেও সম্পত্তিতে তাঁহার স্বত্বহানি হয় না। (২৮ এলাহাবাদ ৩৭৭; ৭ কলিকাতা ২৮৮)।

যে স্থলে বিধবা অনুমতি অনুসারে দত্তকগ্রহণ করেন, সেস্থলে অনুমতিপত্রে দত্তকগ্রহণ সম্বন্ধে যেরূপ আদেশ থাকিবে, বিধবা ঠিক সেইরূপ ভাবে আদেশ পালন করিতে বাধ্য হইবেন। তিনি ঐ আদেশের কোনরূপ পরিবর্তন করিতে বা তাহা লঙ্ঘন করিতে পারেন না। যদি কোনও একটী বিশেষ বালকের নাম করিয়া তাহাকে দত্তকস্বরূপ গ্রহণ করিবার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়, তাহা হইলে বিধবা ঐ বালকটী ভিন্ন অপর বালককে গ্রহণ করিতে পারেন না (সীতাবাই বঃ বাপু আন্ন, ৪৭ কলিকাতাঃ ১০১২)। কিন্তু যদি ঐ বালককে তিনি না পান, অর্থাৎ সেই বালকের পিতা যদি তাহাকে দিতে সম্মত না হন, কিম্বা ঐ বালককে গ্রহণ করিবার পূৰ্ব্বে যদি তাহার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে ঐ বিধবা অন্য দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন (২২ বোম্বাই ৯৯৬)। যদি একটিমাত্র দত্তক রাখিবার অনুমতি থাকে তাহা হইলে বিধবা একটিমাত্র দত্তক লইতে পারেন, এবং তাহার মৃত্যু হইলে আর দত্তক গ্রহণ করিবার ক্ষমতা তাঁহার থাকে না।

কিন্তু স্বামী যদি সাধারণ কথায় স্ত্রীকে দত্তক গ্রহণ করিবার ক্ষমতা দিয়া যান, তাহা হইলে এক দত্তক পুত্রের মৃত্যু হইলেও স্ত্রী পুনরায় দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন (২৯ মাদ্রাজ ৩৮২)। এক ব্যক্তি তাহার গর্ভবতী স্ত্রীকে এইরূপ ক্ষমতা দিয়া গিয়াছিলেন যে”প্রয়োজন হইলে তুমি দত্তক গ্রহণ করিতে পারিবে; যদি ঐ দত্তকের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে তুমি পুনরায় দত্তক গ্রহণ করিতে পারিবে।” ঐ স্ত্রীর গর্ভে এক পুত্র জন্মিল, ঐ পুত্র অল্প বয়সে মারা গেল; তখন বিধবা দত্তক গ্রহণ করিলেন, সেও মরিয়া গেল; বিধবা পুনরায় দত্তকগ্রহণ করিলেন, ঐ দত্তকেরও মৃত্যু হইল; বিধবা তৃতীয়বার দত্তকগ্রহণ করিলেন। তখন প্রশ্ন উঠিল যে বিধবার স্বামী দুইবার দত্তক গ্রহণ করিবার ক্ষমতা °দিয়াছেন, অতএব তৃতীয় দত্তক গ্রহণ সিদ্ধ কি না। প্রিভি কৌন্সিল স্থির করিলেন, যে স্বামী দত্তক গ্রহণের সাধারণ ক্ষমত দিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তৃতীয় দত্তক গ্রহণ অসিদ্ধ নহে (৩৪ এলাহাবাদ ৩৯৮)।

স্বামী সাধারণ কথায় স্ত্রীর প্রতি দত্তক গ্রহণের অনুমতি দিয়া গেলে, ঐ বিধবা যে কোন বালককে গ্রহণ করিতে পারেন। কিন্তু স্বামী জীবিতাবস্থায় যে বালককে গ্রহণ করিতে পারিতেন না, তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার বিধবা স্ত্রীও সেই বালককে দত্তকরূপে লইতে পারিবেন না।

অনুমতি পত্র অসিদ্ধ হইলে তাহার বলে বিধবা কোনও দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন না।

স্বামীর অনুমতি থাকিলে বিধবা স্ত্রী নাবালিকা (১৫ বৎসরের কম বয়স্কা) হইলেও দত্তক গ্রহণ করিতে পারেন (মন্দাকিনী বঃ আদিনাথ, ১৮ কলিকাতা ৬৯); কিন্তু অসতী বিধবা স্বামীর অনুমতি থাকিলেও দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন না (৫ বেঙ্গল ল রিপোট ৩৬২)।

স্বামীর অনুমতি থাকিলে বিধবা যখন ইচ্ছা (এমন কি, স্বামীর মৃত্যুর ১৫, ২৫ বা ৫০ বৎসর পরেও) দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন (৬ উইক্‌লি রিপোর্টার ২২১; ৯ বোম্বাই ৫৮)৷ তবে যদি স্বামী কোনও সময় নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া থাকেন যে এত বৎসরের মধ্যে দত্তকগ্রহণ করিতে হইবে, তাহা হইলে সেই সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর দত্তকগ্রহণ করা সিদ্ধ হইবে না (২৮ এলাহাবাদ ৩৭৭)।

আরও একটী নিয়ম জানিয়া রাখা উচিত। যদি স্বামীর দত্তকপুত্র বা ঔরসজাত পুত্রেব মৃত্যু হওয়ার পর পুত্রবধুতে বা পৌত্রে সম্পত্তি বৰ্ত্তে, তাহা হইলে ৰিধবা আর দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন না; এমন কি ঐ পুত্রবধু বা পৌত্রের মৃত্যুর পর ঐ বিধবাতে সম্পত্তি পুনরায় ফিরিয়া আসিলেও তখন তিনি দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন না (ভুবনময়ী ব: রামকিশোর, ১০ মুরস্ ইণ্ডিয়ান আপীলস্ ২৭৯; ১৯ বোম্বাই ৩১১; মাণিক্যমালা বঃ নন্দকুমার, ৩৩ কলিকাতা ১৩০৬; ২৬ বোম্বাই ৫২৬)

কিন্তু যদি পুত্রের মৃত্যুর পরই সম্পত্তি ঐ বিধবাতে ফিরিয়া আসে (অর্থাৎ মাঝে পুত্রবধুতে বা পৌত্রে সম্পত্তি না অশায়) তাহা হইলে ঐ বিধবা দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন (২২ উইক্‌লি রিপোর্টার ১২১; ২৫ বোম্বাই ৩০৬)।

কে দত্তক দান করিতে পারেন

কেবলমাত্র পিতা কিম্বা মাতা পুত্রকে দত্তক দিতে পারেন। মনু বলিয়াছেন—“মাতা পিতা বা দদ্যাৎ” অর্থাৎ কেবলমাত্র মাতা কিংবা পিতা দান করিতে পারেন; বশিষ্ঠ বলিয়াছেন—“তস্ত প্রদানবিক্রয়ত্যাগেষু মাতাপিতরে প্রভবতঃ” অর্থাৎ পুত্রকে দান, বিক্রয় বা ত্যাগ করিতে পিতামাতার অধিকার আছে। পিতামাতা ভিন্ন অন্য কেহ দত্তক দান করিতে পারে না। কোনও বালকের বিমাতা বা ভ্রাতা বা পিতামহ বা অপর কেহই তাহাকে দত্তকরূপে দান করিতে ক্ষমতাপন্ন নহেন। এইজন্য পিতৃমাতৃহীন বালককে দত্তকগ্রহণ করিতে পারা যায় না, কারণ তাহাকে দত্তকরূপে দিবার কেহ নাই।

কোনও ব্যক্তি তাঁহার স্ত্রীর সম্মতি না লইয়া, এমন কি স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও, পুত্রকে দত্তক দিতে পারেন; কিন্তু স্বামী বৰ্ত্তমানে তাঁহার সম্মতি না লইয়া স্ত্রী নিজ পুত্রকে দত্তক দিতে পারেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর, অথবা তিনি গৃহত্যাগী, নিরদিষ্ট বা উন্মাদগ্ৰস্ত হইলে, স্বামীর অনুমতি না থাকিলেও স্ত্রী নিজ পুত্রকে দত্তক দিতে পারেন; কিন্তু স্বামী যদি নিষেধ করিয়া গিয়া থাকেন, তাহা হইলে স্ত্রী পুত্রকে দত্তকরূপে দান করিতে পারেন না (৩৩ বোম্বাই ১০৭; যোগেশ বঃ নৃত্যকালী, ৩০ কলিকাতা ৯৬৫)।

পিতা বা মাতা পুত্রকে দত্তক দিবার জন্য অন্য কাহারও প্রতি ক্ষমতা দিতে পারেন না (১০ বোম্বাই হাইকোর্ট রিপোর্ট ২৬৮)।

পিতা হিন্দুধৰ্ম্ম ত্যাগ করিলেও পুত্রকে দত্তক দিতে পারেন; তবে যে সময়ে পুত্রকে দান করা হয় সে সময়ে তিনি বিধৰ্ম্মী হওয়ার জন্য স্বহস্তে পুত্রকে দান করিতে পারেন না; সেজন্য তাঁহার পক্ষে অন্ত কোনও হিন্দু ব্যক্তি উপস্থিত থাকিয়া দানকার্য্য সম্পন্ন করিবেন (২৫ বোম্বাই ৫৫১)।

অর্থ লইয়া পুত্রকে দান করা অতিশয় নিন্দনীয় কাৰ্য্য; তবে তজ্জন্য দত্তকগ্রহণ অসিদ্ধ হয় না বটে (২৯ মাদ্রাজ ১৬১)।

কাহাকে দত্তকগ্রহণ করা যাইতে পারে?

স্বধৰ্ম্মী বালককে দত্তক গ্রহণ করিতে হইবে; তবে ব্রাহ্ম বালককে দত্তক গ্রহণ করা অসিদ্ধ নহে, কারণ ব্রাহ্মগণ হিন্দু বলিয়া গণ্য। (কুসুমকুমারী বঃ সত্যরঞ্জন, ৩০ কলিকাতা ৯৯৯; জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়ের বিষয়, ৪৯ কলিকাতা ১০৬৯)।

স্বজাতীয় বালককে দত্তক গ্রহণ করিতে হইবে। ব্রাহ্মণ ব্যক্তি কায়স্থকে দত্তকগ্রহণ করিতে পারিবেন না। ভ্রাতুষ্পুত্র বা অন্য নিকটজ্ঞাতির পুত্ৰ থাকিলে তাহাকে দত্তক গ্রহণ করাই উচিত, কিন্তু তাহাকে গ্রহণ না করিয়া অপরকে গ্রহণ করিলেও তাহা সিদ্ধ হইবে।

শৌনকঋষি বলিয়াছেন যে দ্বিজ জাতির পক্ষে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, ও বৈশুগণের পক্ষে) এই নিয়ম যে দত্তকপুত্র”পুত্ৰচ্ছায়াবহ” হইবে, অর্থাৎ যে বালকের মাতাকে দত্তকগ্রহীতা বিবাহ করিতে পারিতেন, সেই বালককে তিনি দত্তক স্বরূপ গ্রহণ করিতে পারিবেন। সেই জন্য কন্যার বা ভগ্নীর বা মাসীর বা পিসীর পুত্রকে কোনও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য ব্যক্তি দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন না; এবং ভ্রাতা, কাক, বা মামাকেও কেহ দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন না। i ভ্রাতার পৌত্র, শ্যালক, শ্যালকপুত্র, শ্যালীর পুত্র ইত্যাদিকে সকলেই দত্তকরূপে গ্রহণ করিতে পারেন। কিন্তু বৈমাত্রেয় ভ্রাতাকে দত্তকরূপে গ্রহণ করা দ্বিজগণের পক্ষে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ হইয়াছে। (৩ মাদ্রাজ ১৫; ৯ পাটনা ল টাইম্‌স্‌, ১২৩)

উপরোক্ত শৌণকের সূত্র শূদ্রেরা প্রতি প্রযোজ্য নহে। (২১ এলাহাবাদ ৪১২)। অতএব শূদ্রেরা দৌহিত্র, ভাগিনেয়, বা মাসীর ও পিসীর পুত্রকে, এমন কি কাকা ও মামাকেও আইন মতে দত্তকগ্রহণ করিতে পারেন।

বঙ্গদেশীয় কায়স্থগণ ক্ষত্রিয়বর্ণ, ইহা বহু শাস্ত্রযুক্তি দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে, কিন্তু তাঁহারা উপবীতত্যাগ এবং নামান্ত দাসদাসী শব্দ ব্যবহার করা হেতু শূদ্ৰত্বে পতিত হইয়াছেন, এই বলিয়া কলিকাতা হাইকোর্ট স্থির করিয়াছেন যে বঙ্গদেশে কায়স্থগণ ভাগিনেয়কে দত্তকরূপে গ্রহণ করিতে পারেন (রাজকুমার বঃ বিশ্বেশ্বর, ১০ কলিকাতা ৬৮৮)। সম্প্রতি পাটনা হাইকোর্ট স্থির করিয়াছেন যে কায়স্থগণ শূদ্র নহেন; তাহারা মূলতঃ ক্ষত্রিয়, এবং যদিও তাহার কোন কোন বিষয়ে দ্বিজাচার (যথা উপবীতগ্রহণ) পালন করেন না বটে তথাপি তজ্জন্য তাঁহাদের ক্ষত্রিয়বর্ণতা বিলুপ্ত হইতে পারে না। অতএব কোন কায়স্থ তাহার বৈমাত্র ভ্রাতাকে দত্তকরূপে গ্রহণ করিতে পারেন না (রাজেন্দ্র প্রসাদ বস্তু বঃ গোলকপ্রসাদ বসু, ৯ পাটনা ল টাইম্‌স্, ১২৩)। এই মোকদ্দমায় পাটনা হাইকোর্ট কলিকাতার হাইকোটের ১০ কলিকাতা ৬৮৮ নামক নজীরটী ভ্রান্ত বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। পাটনা হাইকোটের উপরোক্ত নজীর দ্বারা বেহারবাসী বাঙ্গালী কায়স্থের শূদ্রত্ব অপবাদ দূরীভূত হইল। কিন্তু ঐ নজীরটী বাঙ্গালা দেশে খাটিবে না। এ দেশের কায়স্থগণ এখনও আইনের চক্ষে শূদ্র বলিয়া পরিগণিত হইতেছেন; এবং কলিকাতা হাইকোর্টের অপর একটী মোকদ্দমাতেও স্থির হইয়াছে যে কায়স্থগণ শূদ্র, সুতরাং তাহাদের দত্তকগ্রহণকালে কোন হোমক্রিয়ার প্রয়োজন নাই (অসিতমোহন ঘোষ মৌলিক বঃ নীরদ মোহন, ২০ কলিঃ উইক্‌লি নোট্‌স্‌, ৯০১)। কায়স্থগণ যতদিন উপবীত গ্রহণ, দাসদাসী শব্দ পরিত্যাগ করিয়া দেবদেবী শব্দ ব্যবহার এবং বিবাহ-শ্রাদ্ধাদি যাবতীয় কার্য্যে দ্বিজাচার পালন না করিবেন, ততদিন আইনের চক্ষে তাঁহাদের এই শূদ্রত্ব অপবাদ ঘুচিবেনা।

যে বালককে দত্তকগ্রহণ করিতে হইবে তাহার বয়ঃক্রমসম্বন্ধে কোন বিধান নাই; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যজাতির পক্ষে এই নিয়ম যে, ঐ বালকের উপনয়ন হইবার পূৰ্ব্বে উহাকে দত্তকগ্রহণ করিতে হইবে, পরে করিলে ঐ দত্তক অসিদ্ধ হইবে (৯ এলাহাবাদ ২৫৩)। শূদ্রগণের সম্বন্ধে এই নিয়ম যে, বালকের বিবাহের পূর্বে তাহাকে দত্তক লইতে হইবে।

দত্তকগ্রহিত্রী মাতা অপেক্ষা দত্তকের বয়স অধিক হইলেও তাহাতে দত্তকগ্রহণ অসিদ্ধ হয় না (২৩ বোম্বাই ২৫০)!

কোনও বালক তাহার পিতার একমাত্র পুত্র হইলে, তাহাকে দত্তকগ্রহণ করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ আছে। বশিষ্ঠ বলিয়াছেন—“ন ত্বেবৈকং পুত্ৰং দদ্যাং প্রতিগৃহ্নীয়াৎ বা স হি সন্তানায় পূৰ্ব্বেষাম্‌।” অর্থাৎ, একমাত্র পুত্রকে দান বা গ্রহণ করা কৰ্ত্তব্য নহে, কারণ সে তাহার পিতৃপুরুষের বংশরক্ষা করিবার জন্য থাকিবে। শৌনক বলিয়াছেন—”নৈকপুত্ৰেণ কৰ্ত্তব্যং পুত্রদানং কদাচন। বহুপুত্রেণ কর্ত্তব্যং পুত্রদানং প্রযত্মতঃ।” অর্থাৎ যাহার একটীমাত্র পুত্র, তাহার পুত্রদান করা কর্ত্তব্য নহে যাহার বহুপুত্র আছে, সেই ব্যক্তিরই দান করা উচিত। এই শান্ত্র বাক্য অনুসারে বঙ্গদেশে বহু মোকদ্দমায় স্থির হইয়াছিল যে একমাত্র পুত্রকে দত্তকগ্রহণ করা অসিদ্ধ (উপেন্দ্রলাল বঃ রাণী প্রসন্নময়ী, ১ বেঙ্গল ল রিপোর্ট ২২১)। কিন্তু ১৮৯৮ সালে প্রিভিকৌন্সিল দুইটী মোকদ্দমায় স্থির করিলেন যে, ঐ শাস্ত্রবাক্যগুলি সামান্য নিষেধসূচক উপদেশবাক্য, মাত্র, অবশ্য-প্রতিপাল্য আদেশবাক্য নহে; সুতরাং একমাত্র পুত্রকে দত্তকগ্রহণ করা সিদ্ধ (২২ মাদ্রাজ ৩৯৮; ২১ এলাহাবাদ ৪৬৯)।

কোনও ব্যক্তি তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে দত্তকরূপে দান করিতে পারেন। (জানকী ব: গোপাল, ২ কলিকাতা ৩৬৫)।

জন্মান্ধ, জন্মমূক, জন্মবধির, কুষ্ঠগ্রস্ত বা উন্মাদগ্ৰস্ত বালককে দত্তকগ্রহণ করা যায় না, কারণ যে উদ্দেশ্যে (পিণ্ডদান ও উত্তরাধিকার) দত্তকগ্রহণ করা যাইতেছে, তাহা এই বালক দ্বারা সাধিত হইতে পারে না।

দত্তকগ্রহণে কি কি ক্রিয়া অবশ্যক

যে বালককে দত্তকগ্রহণ করা হইবে তাহাকে প্রদান ও গ্রহণ করা আবশ্যক। বালকের পিতা ও মাতা স্বহস্তে দান করিবেন, এবং দত্তকগ্রহীতা স্বহস্তে তাহাকে গ্রহণ করিবেন। এই আদানপ্রদান ব্যাপারটা সাধিত হওয়া বিশেষ আবশ্যক, নচেৎ দত্তকগ্রহণ সিদ্ধ হইবে না। কাৰ্য্যতঃ আদান ও গ্রহণ করা চাই; শুধু মুখের কথায় বা লিখনক্রমে”আমি দান করিলাম” ও”আমি গ্রহণ করিলাম” বলিলে চলিবে না (মণ্ডিত বঃ ফুলচাদ, ২ কলিকাতা উইক্‌লি নোটুস ১৫৪; ঈশ্বরীপ্রসাদ বঃ হরিপ্রসাদ, ৬ পাটনা ৫০৬)। অথবা”আমি আমার পুত্রকে দান করিলাম, আপনি যখন ইচ্ছা তাহাকে শাস্ত্রাঙ্গুলারে গ্রহণ করিবেন? এইরূপ বলিয়া দত্তকদাতা একটী দলিল সম্পাদন করিয়া দিলেই দত্তকগ্রহণকার্ধ্য সম্পন্ন হয় না (শশিনাথ বঃ কৃষ্ণকুন্দরী, ৬ কলিকাতা ২৮১)।

শূদ্রগণের মধ্যে বালকের আদান-প্রদান ব্যতীত আর কোনও ক্রিয়া বা হোমের প্রয়োজন হয় না (৬ কলিকাতা ২৮১; ও কলিকাতা ৭৭০), কারণ শূদ্রগণ হোমকার্ঘ্যের অধিকারী নহেন। কিন্তু দ্বিজগণের মধ্যে (এবং বঙ্গদেশীয় কায়স্থগণও ইহাদিগের অন্তর্গত হওয়া উচিত) দত্তহোম করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য (১১ বেঙ্গল ল রিপোর্ট ১৭১); না করিলে দত্তক গ্রহণ অসিদ্ধ হইবে। হোমকাৰ্য্য আদান প্রদানের সময়ে করা যাইতে পারে, অথবা তাহার পরেও হইতে পারে। যদি কোনও দত্তকগ্রহীত আদান-প্রদানের পরে এবং হোমক্রিয়ার পূৰ্ব্বে পরলোক গমন করেন, তাহা হইলে পরে তাঁহার বিধবা পত্নী বা অপর কোনও ব্যক্তি উল সম্পন্ন করিলেও চলিবে (২১ মাদ্রাজ ৪৯৭; ৪৯ মাদ্রাজ ৯৬৯); এমন কি, এরূপ অবস্থায় হোমকাৰ্য্য না হইলেও কোন দোষ হইবে না। কিন্তু পক্ষগণ ইচ্ছাপূৰ্ব্বক হোমক্রিয়া পরিহার করিলে তাহাতে দত্তক গ্রহণ অসিদ্ধ হইবে।

সগোত্র বালককে দত্তকগ্রহণ করিলে দ্বিজগণের পক্ষে হোমক্রিয়া না হইলেও চলে (রেতকী বঃ লকপতি, ২০ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস ১৯; বালগঙ্গাধর তিলক বঃ শ্ৰীশ্ৰীনিবাস, ৩৯ বোম্বাই ৪৪১ প্রিভিকৌন্সিল)।

দত্তকগ্রহণ করিতে হইলে কোনও দলিল সম্পাদন করিবার প্রয়োজন হয় না; কিন্তু দলিল থাকিলে দত্তক গ্রহণ সম্বন্ধে উত্তম প্রমাণ হয়। অতএব দত্তকদাতা এবং দত্তকগ্রহীতার মধ্যে দলিল (দত্তকদানপত্র বা দত্তক গ্রহণ পত্র) সম্পাদিত হওয়া উচিত। এই দলিলে ২০ টাকা স্ট্যাম্প লাগে।

দত্তকের স্বত্বদত্তকগ্রহণের ফল

দত্তকগ্রহণ হইলেই দত্তক তাঁহার জন্মদাতা পিতার পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দুত্তকগ্রহীতা পিতার পরিবারে সম্পূর্ণরূপে আনীত হন।

তিনি তাঁহার জন্মদাতা পিতার পরিবারবর্গের শ্রাদ্ধ বা পিণ্ডদান কাৰ্য্য করিতে পারেন না এবং ঐ পরিবারস্থ কাহারও উত্তরাধিকারী হইয়া সম্পত্তি পাইতে পারেন না। কিন্তু দত্তকগ্রহণের পূৰ্ব্বেই তিনি যদি তাহার জন্মদাতার পরিবারে কোনও সম্পত্তি পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি দত্তকরূপে গৃহীত হইবার পরে ঐ সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইবেন না (বেহারীলাল বঃ কৈলাসচন্দ্র, ১ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস ১২১)। যথা, তিনি যদি তাঁহার পিতার মৃত্যুতে পিতৃপরিত্যক্ত সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হইয়া থাকেন, এবং তাহার পর তাঁহার মাতা যদি তাঁহাকে দত্তকরূপে দান করেন, তাহা হইলেও তিনি পৈতৃক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইবেন না।

কিন্তু দত্তকগ্রহণের পরেও জন্মদাতা পিতার পরিবারে তাঁহার রক্ত সম্বন্ধ নষ্ট হইবে না। সেজন্য দত্তকগ্রহণের পরে তিনি তাঁহার জন্মদাতা পিতার পরিবারে নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ করিতে পরিবেন না, অথবা নিষিদ্ধ ব্যক্তিগণকে দত্তকরূপে গ্রহণ করিতে ক্ষমতাপন্ন হইবেন না।

দত্তকপুত্রের স্বত্ব ঠিক ঔরস পুত্রের ন্যায়। সে দত্তকগ্রহীতা পিতা এবং তাঁহার পিতা ও পিতামহ আদি পূৰ্ব্বপুরুষগণের ওয়ারিস হইতে পারিবে; সে তাঁহার দত্তকগ্রহীতা পিতার ভ্রাতারও ওয়ারিস হইতে পারিবে; তাহার দত্তকগ্রহিত্রী মাতা যদি তাঁহাকে দত্তকরূপে গ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক হইয়াও থাকেন (অর্থাৎ যদি তাহার দত্তকগ্রহীতা পিতা নিজ স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে দত্তকগ্রহণ করিয়া থাকেন) তাহা হইলেও সে তাহার দত্তকগ্রহিত্রী মাতার স্ত্রীধন সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হইবে এবং ঐ মাতৃবংশের ব্যক্তিগণের ওয়ারিস হইতে পরিবে (কালীকমল বঃ উমাশঙ্কর, ১০ কলিকাতা ২৩২, প্রিভিকৌসিল)। দত্তকপুত্রে এবং ঔরসজাত পুত্রে উত্তরাধিকারিত্ব সম্বন্ধে কোন প্রভেদ নাই। ঔরসজাত পুত্র যে যে স্থলে যেরূপভাবে ওয়ারিস হইয়া থাকে, দত্তকপুত্রও সেই সেই স্থলে সেইরূপ ভাবে ওয়ারিস হইয়া সম্পত্তি পাইবে। ইহার আর একট প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেওয়া যাইতেছে। এক ব্যক্তির দুই কন্যা আছে, তন্মধ্যে এক কন্যার গর্ভজাত পুত্র আছে, এবং এক কন্যার দত্তকপুত্ৰ আছে; এরূপস্থলে উভয় দৌহিত্রই সমানভাবে ঐ ব্যক্তির সম্পত্তি পাইবে (সূৰ্য্যকান্ত বঃ মহেশচন্দ্র, না কলিকাতা ৭০)।

দত্তকগ্রহণের পর যদি দত্তকগ্রহীতার পুত্রসন্তান জন্মে, তাহা হইলে ঐ ঔরসজাত পুত্র যাহা পাইবেন তাহার অৰ্দ্ধেক অংশ দত্তকপুত্র পাইবেন। অৰ্থাৎ একজন ঔরসজাত পুত্র জন্মিলে সম্পত্তি তিন ভাগে বিভক্ত হইয়া ঔরস পুত্র ২/৩ অংশ ও দত্তকপুত্র এক তৃতীয়াংশ পাইবেন। দুইজন ঔরস পুত্র জন্মিলে দত্তক এক পঞ্চমাংশ (১/৫) এবং ঔরস পুত্রগণ প্রভ্যেকে ঐ অংশ করিয়া পাইবেন। তিন জন ঔরস পুত্র জন্মিলে দত্তক ১/৭ অংশ ও ঔরস পুত্ৰগণ প্রত্যেকে ২/৭ অংশ করিয়া পাইবেন। এইরূপ নিয়মে সম্পত্তির বিভাগ হইবে।

পিতা যেমন ঔরসপুত্রকে ত্যজ্যপুত্র করিতে পারেন, দত্তকগ্রহীতাও সেইরূপ দত্তকপুত্রকে বঞ্চিত করিয়া সম্পত্তি অপর কাহাকেও দান করিয়া বা উইল দ্বারা দিয়া যাইতে পারেন। কারণ, ঔরসপুত্র সম্বন্ধে পিতা যাহা করিতে পারেন, দত্তকপুত্র সম্বন্ধেও তাহাই করিতে তিনি ক্ষমতাপন্ন; ঔরসপুত্র অপেক্ষা দত্তকপুত্র অধিক ক্ষমতা পাইতে পারেন। (২২ মাদ্রাজ ৩৮৩)। কিন্তু যদি দত্তকগ্রহণ করিবার সময়ে দত্তকগ্রহীতা এইরূপ প্রতিশ্রুতি করিয়া চুক্তি করিয়া থাকেন যে, তিনি দত্তকপুত্রকে কোনও সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করবেন না, তাহা হইলে তিনি কোনও সম্পত্তি, অপর কাহাকেও হস্তান্তর করিয়া বা উইল করিয়া দিয়া, যাইতে পারেন না (সুরেন্দ বঃ দুর্গাসুন্দরী, ১৯ কলিকাতা ৫১৩)।

এ কথা সত্য বটে যে, ঔরসপুত্র অপেক্ষা দত্তকপুত্রের অধিক ক্ষমতা নাই, এবং ঔরসজাত পুত্রকে পিতা যখন ত্যাগ করিতে পারেন, তখন দত্তক পুত্রকেও পারেন। কিন্তু এস্থলে দুইটা বিষয় বিবেচনা কক্সিা দেখা কৰ্ত্তব্য। প্রথমতঃ, পিতা তাহার ঔরসজাত পুত্রকে সামাপ্ত কারণে প্রায় ত্যজ্যপুত্র করেন না, কারণ স্বাভাবিক পিতৃস্নেহ তাহাকে এরূপ কাৰ্য্য হইতে নিবৃত্ত করিবে; কিন্তু দত্তকপুত্রের প্রতি সেরূপ স্নেহ হওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং দত্তকগ্রহীতা-পিতা ইচ্ছা করিলে সামান্য কারণে দত্তকপুত্রকে ত্যজ্যপুত্র করিতে পারেন; অথবা হয়তো দত্তকপুত্রের প্রতি তাহার মোটেই স্নেহ হইল না, একারণেও তিনি দত্তককে বঞ্চিত করিয়া তাহা অপেক্ষা অধিকতর স্নেহের পাত্রকে সম্পত্তি দিয়া গেলেন। এই কারণ বশতঃ, দত্তকগ্রহীতা যাহাতে যথেচ্ছক্কপে দত্তকপুত্রকে ত্যজ্যপুত্র করিয়া না যাইতে পারেন এরূপভাবে তাহার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত, নহিলে দত্তকপুত্র অনেকস্থলে বিনাদোষে পরিত্যক্ত হইতে পারে। দ্বিতীয়তঃ, দত্তকপুত্রের জন্মদাতা-পিতা বালককে কোন উদ্দেশ্যে পরগৃহে দত্তকরূপে দান করিয়াছে? সে ভাল অবস্থায় থাকিবে, এই আশাতেই তো? সুতরাং যদি দত্তকপুত্র বিনাদোষে পরিত্যক্ত হয়, তাহা হইলে তাহার পিতামাতাও নিরাশ হইয়া যায়। এই সমস্ত ঘটনা আলোচনা করিয়া দেখিলে মনে হয় যে দত্তকপুত্রকে একান্তই ত্যজ্যপুত্র করিতে ইচ্ছা করিলে তাঁহাকে ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট সম্পত্তি দেওয়া উচিত।

যেস্থলে কোনও বিধবা স্ত্রীলোক দত্তকগ্রহণ করেন, সে, স্থলে যদি বালকের জন্মদাতা পিতার সহিত দত্তকগ্ৰহীত্রীর এইরূপ চুক্তি থাকে যে, দত্তকগ্রহণের পরেও দত্তকগ্রহীত্রী যতদিন জীবিত থাকিবেন ততদিন তিনি তাহার স্বামীত্যক্ত সম্পত্তি জীবনস্বত্বে ভোগ করিতে থাকিবেন, তাহা হইলে ঐন্ধপ চুক্তি ঐ বালক সাবালক হইয় অসিদ্ধ সাব্যস্থ করাইতে পারিবেন (ভায়া রবিদং বঃ মহারাণী ইন্দার, ১৬ কলিকাতা ৫৫৬ প্রিভি কৌন্সিল)।

বিধবা স্ত্রীলোক দত্তক গ্রহণ করিলেই স্বামীত্যক্ত সম্পত্তিতে তাঁহার জীবনস্বত্বের লোপ হয়, এবং উহাতে দত্তকপুত্রের নির্ব্যূঢ় স্বত্ব জন্মে (মন্দাকিনী বঃ আদিনাথ ১৮ কলিকাতা ৬৯)।

কোনও স্ত্রীলোক যদি তাঁহার পুত্রের মৃত্যুর পর তাহার সম্পত্তিতে জীবনস্বত্বে উত্তরাধিকারিণী হইয়া থাকেন, এবং তাহার পর তিনি দত্তকগ্রহণ করেন, তাহা হইলেও ঐ সম্পত্তিতে তাঁহার জীবনস্বত্ব লোপ হইবে, এবং দত্তকপুত্রের নির্ব্যূঢ় স্বত্ব জন্মিবে (১ মাদ্রাজ ১৭৪। কিন্তু পুত্রের স্বোপার্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হইয়া দত্তক গ্রহণ করিলে তিনি ঐ সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইবেন না। সেইরূপ, কোনও স্ত্রীলোক যদি তাহার পিতৃত্যক্ত সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারিণী হইয়া থাকেন, এবং তাহার পর তিনি দত্তকগ্রহণ করেন, তাহা হুইলেও তিনি ঐ সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইবেন না। তিনি যতকাল বাঁচিবেন, ততকাল পিতৃত্যক্ত সম্পত্তি ভোগ করবেন।

কোনও বিধবা যদি দত্তক গ্রহণের পূৰ্ব্বে স্বামীত্যক্ত কোনও সম্পত্তি আইনসঙ্গত আবশ্যকতা ব্যতীত হস্তান্তর করিয়া থাকেন তবে ঐ দত্তকপুত্র তাহা রহিত করিয়া সম্পত্তি দখল করিবার জন্য নালিশ করিতে পারেন। এরূপ নালিশ দত্তক গ্রহণের তারিখ হইতে ১২ বৎসরের মধ্যে করিতে হইবে (তামাদি আইন, ১৪৪ দফা)। কিন্তু বিধবা যদি হস্তান্তর করিবার সময়ে ভাবী উত্তরাধিকারীর সম্মতি লইয়া থাকেন, তাহা হইলে ঐ হস্তন্তর সিদ্ধ হইবে এবং দত্তকপুত্র তাহা রদ করিতে পারিবেন না (৩ উইক্‌লি রিপোর্টার ১৪)। যদি আইনসঙ্গত আবশ্যকতা.হেতু বিধবা সম্পত্তি হস্তান্তর করিয়া থাকেন, তাহা হইলে দত্তকপুত্র তাহা রদ করিতে ক্ষমতাপন্ন হইবে না।

দত্তকগ্রহণ যদি অসিদ্ধ হয়, তাহা হইলে দত্তকপুত্র দত্তকগ্রহীতার পরিবারে কেবলমাত্র ভরণপোষণ পাইবে; আবার কোন কোন শাস্ত্রকার বলেন যে, দত্তকগ্রহীতার গৃহে আসিয়া যদি তাহার বিবাহ বা উপনয়ন, সম্পন্ন না হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে আপন পিতৃগৃহে ফিরিয়া যাইবে কিন্তু যদি তাহা সম্পন্ন হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে সে আপন পিতৃগৃহে ফিরিয়া যাইতে পরিবে না, দত্তকগ্রহীতা তাহাকে ভরণপোষণ করিবেন।

দত্তকগ্রহণ একবার সিদ্ধরূপে সম্পন্ন হইলে আর কেহ তাহা রদ করিতে পারেন না। দত্তকপুত্রও ইচ্ছা করিলে আর স্বীয় পিতৃগৃহে ফিরিয়া যাইতে ও পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হইতে পারে না, তবে সে ইচ্ছা করিলে দত্তকগ্রহীতা-পিতার সম্পত্তি লইতে অস্বীকার করিতে পারে (১৯ বোম্বাই ২৩৯)।

অন্যান্য কথা

দত্তকগ্রহণ ব্যাপারে দাতা এবং গ্রহীতা এই উভয় পক্ষের স্বাধীন সম্মতি থাকা প্রয়োজন। কোনও পক্ষের প্রতি প্রবঞ্চনা, ভয়প্রদর্শন, বলপ্রকাশ, বা অবৈধ ক্ষমতাপ্রয়োগপূর্বক দত্তকগ্রহণ হইলে ঐ পক্ষ তাহা অসিদ্ধ করাইতে পারেন (চুক্তি আইন, ১৯ ধারা)।

যদি দত্তকগ্রহীতা দত্তকদাতাকে অর্থ দিবেন বলিয়া চুক্তি করিয়া দত্তকগ্রহণ করেন এবং পরে অর্থ না দেন, তাহা হইলে দত্তকগ্রহণ অসিদ্ধ হইবে না বটে; কিন্তু সেই টাকার জন্য দত্তকদাতা গ্রহীতার বিরুদ্ধে নালিশ করিতেও পারিবেন না, কারণ ঐ টাকা দিবার চুক্তি বে-আইনী ও অসিদ্ধ (চুক্তি আইন, ২৩ ধারা)।

কোনও দত্তকগ্রহণ অসিদ্ধ সাব্যস্থ করাইবার জন্য নালিস করাইতে হইলে, বাদী যে তারিখে দত্তকগ্রহণের কথা জানিতে পারেন সেই তারিখ হইতে ৬ বৎসরের মধ্যে নালিস করিতে হইবে (তামাদি আইন, ১১৮ দফা)। যদি ঐ নালিসে সম্পত্তি দখলেরও দাবী থাকে, তাহা হইলে ১২ বৎসর পর্য্যন্ত সময় পাওয়া যায় (তামাদি আইন, ১৪৪ দফা; মহম্মদ উমার বঃ মহম্মদ নিয়াজুদ্দিন, ৩৯ কলিঃ ৪১৮ প্রিভিকৌন্সিল; কল্যানদাপ্‌পা বঃ চেনবাসাপ্‌প, ৪৮ বোম্বাই ৪১১ প্রি: কৌঃ)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *