০১. জাতিভেদ ভারতে ও বাহিরে

জাতিভেদ ভারতে ও বাহিরে

অন্য সকলের অপেক্ষা নিজের মান ও গৌরব অধিক হউক এই আকাঙ্খা সকলেরই আছে। বংশগৌরব প্রভৃতি নানাভাবে এই উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে। বংশগৌরবও একটি প্রধান পথ হওয়ায় সকল দেশেই এই বংশগৌরব লাভ করা ও প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য অশেষবিধ প্রয়াস দেখা যায়। এইভাবেই নানা দেশে নানারকমের বংশগত কৌলীন্য বা জাতিভেদের উৎপত্তি।

মিশর দেশ অতি প্রাচীন সভ্যতার স্থান। এখানে পুরাকালে ভূম্যধিকারী, শ্রমিক ও ক্রীতদাস এই তিন শ্রেণী ছিল। ক্রমে সেখানে যোদ্ধা ও পুরোহিতের উচ্চ স্থান ও অধিপত্য হইল ও তার নিচে হইল শিল্পী ও ক্রীতদাসদের স্থান। যোদ্ধা ও পুরোহিতদিগের মধ্যেই কেহ কেহ লেখক হইলেন।

এই সব দেখিয়া ১৮২০ সালে কেরী সাহেব তাঁহার সংস্কৃত ব্যাকরণের ভূমিকায় অনুমান করিয়াছিলেন যে মিশরীয় সভ্যতা ভারত হইতে আনীত। Bigand taতাঁহার ‘Ancient and Modern History’-teতে এই চারি জাতি দেখিয়াও এই একই কথা বলেন (পৃ. ৬৭)। অন্য দেশে শ্রেণীভেদ থাকিলেও মিশরে ও ভারতে তাহা ধর্মসম্মত (পৃ. ৬৯), তাইএই দুই সভ্যতার মধ্যে সম্বন্ধ আছে(১)। নানা প্রমাণে অনেকে মনে করেন দ্রাবিড়জাতির ও দ্রবিড় সভ্যতার সঙ্গে মিশরের যোগ আছে। অন্তত মিশর আর্য নহে। তাই সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় তবে কি এই জাতিভেদ দ্রাবিড়জাতিরই বিশেষত্ব? অন্তত অন্য কোনো আর্যদেশে এইভাবে তো জাতিভেদ দেখা যায় না।

চীনদেশে, ভদ্রলোক কৃষক শিল্পী ও বণিক এই চারি শ্রেণী দেখা যাইত। বণিকদের স্থান ছিল সবার নিচে। জাপানেও এই চারি শ্রেণী; তাহা ছাড়া Eta ও Hinin-রা ছিল অন্ত্যজদের মত। তবে ইহাদের মধ্যে একেবারে মেলামেশা বা পরিবর্তন কি খাওয়াদাওয়া অথবা ছোঁয়াছুঁই অসম্ভব ছিল না।

সে-সব দেখা যায় পৃথিবীর নানা অসভ্য দেশে। যে-দেশের লোক যত আদিম অবস্থায় আছে ততই তাহাদের ছোঁয়াছুঁইর দারুণ বিচার। স্পর্শের দ্বারা নিজেদের শক্তিবিশেষ হারাইয়া যাইতে পারে, অন্যের কাছে হইতে নানা অমঙ্গল আসিতে পারে এই রকম সব ভাব। ইহাকেই প্রশান্ত মহাসাগরস্থ দ্বীপগুলিতে অসভ্য জাতির লোকেরা Mana বলিত। এখন সব দেশের পণ্ডিতেরা এই Mana (ম্যানা) কথাটিই ব্যবহার করেন(২)। রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় মহাশয় Mana সম্বন্ধে চমৎকার আলোচনা করিয়াছেন। তাহা প্রত্যেকের দেখা উচিত।

‘Encyclopedia of Religion and Ethics’-eeএর ‘Mana’ নামক কথাটির সূচী দেখিলে নানাদেশের এই স্পর্শাস্পর্শবিচারের খবর মেলে। আফ্রিকা, ফিজি, প্রশান্ত মহাসাগরের নানা দ্বীপ, বোর্নিও প্রভৃতি নানা স্থানেই এই বিচার আছে। বোর্নিওতে গুটিতিনেক শ্রেণীও আছে। মেক্সিকো দেশেও তিন জাতি। শুদ্ধ স্পেনীয়রা উত্তম, মিশ্রিতরা মধ্যম, আদিমজাতীয়রা অধম।

সেমেটিকরা যদিও গর্ব করেন তাঁহাদের মধ্যে জাতিভেদ ছিল না তবু ইহুদিদের মধ্যে নানারকমের আভিজাত্য দেখা যায়। তাহাতেই বুঝা যায় তাঁহাদের মধ্যেও শ্রেণীবিভাগ ছিল। আরবদেশের দক্ষিণভাগে শিল্পীরাই অন্ত্যজ। তাহাদের বাস গ্রাম বা নগরের বাহিরে। ফেদারম্যান সাহেব বলেন, তাহাদের অপেক্ষাও হতভাগা অন্ত্যজ সে-দেশে আছে, তাহারা নিষ্ঠাবান মুসলমান হইলেও মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে না।

আর্যরা প্রায় সব দেশেই এই সব বিষয়ে একোটু উদারচিত্ত। অর্থাৎ তাঁহারা নিজেদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ কম মানেন। রোমে যদিও অভিজাত ও প্রাকৃত (অনতিজাত) এই দুই শ্রেণী ছিল তবু তাহাদের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান ছিল না। পরাজিত শত্রুরা অবশ্য দাস ছিল। ইংলণ্ডে অ্যাংলো-স্যাকসন যুগেও ঠিক এই ব্যবস্থাই ছিল। গ্রীসে ও প্রাচীন জার্মানিতে অভিজাতগণের একটি বিশেষ শ্রেণী ছিল।

পারসী আচার্য ধল্লা বলেন ইরানদেশীয়দের মধ্যেও চতুর্বর্ণ ছিল, যদিও এক বর্ণের লোক গুণ ও কর্মের দ্বারা বর্ণান্তরভুক্ত হইতে পারিত। আবার কেহ কেহ বলেন, জেন্দাবস্তাতে তিন রকমের বর্ণ দেখা যায়। এক দল করেন মৃগয়া, আর এক দল করেন পশুপালন, তৃতীয় দল করেন কৃষিকর্ম(৩)। কিন্তু এই কথা অন্যান্য পারসিক আচার্যেরা স্বীকার করেন না। তাঁহারা বলেন পারসিকদের মধ্যে জাতিভেদ কখনই ছিল না। হয়তো ভারতীয় ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া ধল্লা মহাশয় নিজেদের সামান্য সামান্য ভেদকেই বর্ণভেদরূপে কল্পনা করিয়াছেন। পারসীরা যখন স্বদেশে নির্যাতনবশত ভারতে আসেন তখন গুজরাতে নামিবার সময় রানা যদুর নিকট নিজেদের পরিচয় দেন। এই দেশে আশ্রয় পাইবার জন্য এদেশের সঙ্গে তাঁহাদের ধর্মের যতটা সম্ভব মিল তাহা দেখাইবার চেষ্টাই তখন তাঁহারা করিয়াছেন। যদু রানার কাছে তাঁহাদের প্রদত্ত পরিচয়-শ্লোকগুলিই তাহার সাক্ষী। তাহার মধ্যেও জাতিভেদের কথা নাই। চাতুর্বর্ন্য যদি তখন তাঁহাদের মধ্যে থাকিত, তবে এমন একটা সময়ে বর্ণাশ্রমবাদী রাজার রাজ্যে প্রবেশ প্রার্থণার উদ্দেশ্যে তাহা গোপন করিবার হেতু থাকিতে পারে না।

ভারতের জাতিভেদের স্বরূপ একটু বিভিন্ন, ঠিক ভারতীয় ভিন্ন ইহা ঠিক মত বুঝিতে পারে না। এই জাতিভেদ এখন জাতিগত। গুণকর্মবশত বিভাগের কথা শাস্ত্রে শোনা গেলেও এখন তাহা আর নাই। ভারতের বাহিরেও তো বহু আর্যজাতি আছে। কিন্তু ভারতের মত ঠিক এইরকম জাতিভেদ নাই। একমাত্র ভারতবর্ষের আর্যদের মধ্যে এই জাতিভেদটা আসিল কুরূপে?

এই বিষয়েরই আলোচনা এখানে যথাসাধ্য করিবার চেষ্টা করা যাইবে। আমরা সাধারণত প্রাচীন শাস্ত্র অর্থাৎ বেদ পুরাণ স্মৃতি প্রভৃতির উপরই আমাদের আলোচনাকে প্রতিষ্ঠিত রাখিব। দেশপ্রচলিত প্রথা ও আচারের আলোচনাও বাধ্য হইয়া করিতে হইবে। এইরূপ আলোচনায় সব সিদ্ধন্তই যে পরম ও চরম সত্য হইবে তাহা না-ও হইতে পারে। ভুলভ্রান্তিও থাকিতে পারে। তবু এই বিষয়ে যদি কাহারও কাহারও বিচার ও বিতর্ক জাগ্রত হয় তবেই শ্রম সার্থক মনে করিব। ভারতীয় জাতিভেদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ ইতিপূর্বে অনেক অনেক কাজ করিয়াছেন। আমি ঠিক সেই পথে কাজ করি নাই। তবু যখন আমার পূর্ববর্তী কাঁহারও ক্ষেত্রের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি তখন তাঁহাদের নাম করিয়াছি। এইরূপে কেতকর, উইলসন, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রিজলী, ক্রূক প্রভৃতি সেন্সসরিপোর্ট, ক্যাম্পবেল, ঘুরে প্রভৃতির নাম করিয়াছি। ডাক্তার G. SSS. Ghurye প্রণীত ‘Caste and Race in India’ পুস্তকখানি খুব উপাদেয়। তাহার অন্তভাগে এই বিষয়ে বহু বিশেষজ্ঞের নাম ও তাঁহাদের গ্রন্থের উল্লেখ আছে। তাহা দেখিলে অনেকেই উপকৃত হইবেন।

——————————-
১. Capt. N. A. Williard, Music of Hindusthan, intro : p.18
২. Encylopedia of Religion and Ethics VIII p.375
৩. Tribes and Castes of the NN. W. P and Frontier Provinces, vol. I, XVIXVI

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *