০১. ঘরের মধ্যে দুভাইবোন

ঘরের মধ্যে দুভাইবোন অন্য যোদ্ধাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে আরও দুজন বয়সী মানুষ।

আকমল হোসেন গেরিলারা কোন পথে ঢুকবে তার হিসাব করছেন। পথের হিসাব। কাগজে আঁকিবুঁকি করে নিজেই একটি ম্যাপ বানিয়েছেন, যেন পথটি সহজেই তাঁর মাথায় থাকে। যেন তিনি চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন গেরিলাদের অবস্থান কোথায়—পথ ও সময় একটি সূত্রে এক হয়ে মিশে থাকবে তার চিন্তায়। আর এই অনুষঙ্গে তিনি স্বস্তি বোধ করবেন।

আয়শা খাতুন রান্নাঘরে। প্রতিদিন তিনি রান্নাঘরে ঢোকেন না। বাইরে তাঁর কাজ থাকে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তিনি রান্নাঘরে প্রায়ই কাজ করেন। যেদিন গেরিলাদের আসার খবর থাকে, সেদিন তিনি নিজে রান্না করেন। নিজ হাতে রান্না করে নিজেকে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাবেন। তিনি মনে করেন, এটিও একটি বড় ধরনের কাজ। যুদ্ধে জেতার প্রক্রিয়ার সঙ্গে রান্নার একধরনের সরল উপস্থিতি আছে। কারণ, গেরিলাদের খেতে হবে। শক্তির জন্য। তাই প্রতিদিনের রান্নার পরও অনেক সময় তিনি অন্য সময়ের জন্যও রান্না করে ফ্রিজে রাখেন। অনেক সময় ওরা খবর না দিয়েও আসে। তাই ঘরে খাবার রেডি রাখা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে একটা কিছু করে দিলেন, এই মনোভাবে তিনি পরাস্ত হতে চান না। আজও তিনি বাড়তি রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত।

সন্ধ্যা নেমেছে।

শহরে সন্ধ্যা নামলে রাস্তার বাতি জ্বলে ওঠে। টিমটিমে বাতির আলোয় শহরের রাস্তায় ম্লান ছায়া পড়ে। মারুফ বন্ধ জানালা সামান্য ফাঁক করে রাস্তার দিকে তাকায়। জানালা বরাবর বাড়ির সীমানাপ্রাচীর আছে। জানালা দিয়ে সরাসরি রাস্তা দেখা যায় না। মারুফকে একটি টুলের ওপর দাঁড়াতে হয়। পর্দা সরিয়ে জানালার শিকে মাথা ঠেকায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মেরিনাকে নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে যেত। এখন সেটা বন্ধ। আর্মির গাড়ির টহল আছে চারদিকে। যুদ্ধ শুরুর আগে এই রাস্তার ম্লান আলোর একধরনের অর্থ ছিল ওর কাছে। ও মেরিনাকে বলত, এ সময় রাস্তা খুব বিষণ্ণ থাকে। আমার মনে হয়, এই স্লান ছায়া রাস্তার বিষণ্ণ সৌন্দর্য। যে এটা অনুভব করে, সে এই শহরের বন্ধু। আমি এই শহরের বন্ধু। এটা ভাবতে আমার দারুণ লাগে।

মেরিনা হেসে গড়িয়ে পড়ত। জোর হাসিতে ঘর ভরিয়ে দিয়ে বলত, মাকে বলি যে তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ? তোমার চিন্তার ব্যালান্স নষ্ট হচ্ছে।

তোর তা-ই মনে হচ্ছে? তুই এমন একটি কথা বলতে পারলি?

হ্যাঁ, তাই তো। বলতে তো পারলামই। আমার এমনই মনে হচ্ছে।

আমার এই আবিষ্কারে তুই কোনো সৌন্দর্যই দেখলি না।

মেরিনা আরও জোরে হাসতে হাসতে বলত, ভাইয়া, তোমার পিপাসা পেয়েছে। আমি তোমার জন্য পানি আনতে যাচ্ছি। তুমি এখানেই বসে থাকো। নড়বে না।

মেরিনা ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলত, এক চুমুকে শেষ করবে।

কেন, তোর মতলব কী, বল তো?

তাহলে তোমার পাগলামি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তুমি গুড বয় হবে।

তুই এনেছিস, সে জন্য পানি খাব। কিন্তু আমার কোনো পাগলামি নেই, মেরিনা।

মেরিনা এই কথা শুনে আর হাসতে পারত না। বলত, তাহলে তোমার কথা ঠিক। আমিও একদিন শহরের রাস্তা চিনতে শিখব।

এখন ওরা দুভাইবোন শহরের রাস্তা আরেকভাবে চিনতে শিখেছে। মেরিনাই প্রথমে বলে, এখন শহরের রাস্তা আর বিষণ্ণ নয়। শহরের রাস্তা প্রাণবন্ত। উজ্জ্বল।

মারুফ মেরিনার দুহাত ঝাঁকিয়ে ধরে বলে, এখন শহরের রাস্তায় গেরিলাযুদ্ধের সৌন্দর্য। এই রাস্তায় চলাচল করতে শত্রুপক্ষ ভয় পায়।

আর রাস্তা কাঁপিয়ে হেঁটে আসে গেরিলারা।

ওহ, মেরিনা, দারুণ বলেছিস! আয়, আমরা রাস্তা দেখি। টিমটিমে বাতির দীপ্ত সৌন্দর্য দেখি।

দুভাইবোন জানালার পাল্লা সামান্য ফাঁক করে বাইরে তাকায়। রাস্তায় যান চলাচল কম। হাঁটার লোক নেই বললেই চলে। খুব জরুরি হলে কাউকে রাস্তায় থাকতে হয়। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ি চললেও খুব জোরে হর্ন বাজায় না। জোরে হর্ন বাজলে ঘরের ভেতরের লোকেরা বোঝে যে ওটা শত্রুপক্ষের গাড়ি। ওই সব গাড়ি হয় পাকিস্তানি সেনাদের, নয়তো ওদের পক্ষের বেসামরিক লোকদের। শহরের মানুষ এখন দুভাগে বিভক্ত। মুখ ফিরিয়ে মারুফ বলে, যুদ্ধের সময় শহরের রাস্তা এমনই থাকা উচিত।

তুমি কি ভয়ের কথা বললে, ভাইয়া?

মোটেই না। এটা কৌশলের কথা।

হবে হয়তো। তুমিই ঠিক।

রাস্তা দেখে দুভাইবোন জানালা বন্ধ করে। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বারান্দায় আসে। বাড়িতে কোনো শব্দ নেই। দুভাইবোন পরস্পরের নিঃশ্বাস টের পায়। বারান্দায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মারুফ বলে, গেরিলাদের আসতে খুব ঝামেলা হবে না। ফাঁকা রাস্তায় শাই করে চলে আসবে গাড়ি। ঝটপট নেমে পড়বে। দৌড়ে কোথাও যেতে হলে সেটাও সুবিধা।

ভাইয়া, আমার মনে হয় রাস্তায় গাড়ি এবং লোক চলাচল বেশি হলেই ভালো। অনেক মানুষের ভিড়ে নিজেকে আড়াল করা যায়।

মারুফ চুপ করে থাকে। মনে হয় মেরিনা ঠিকই বলেছে। বেশি ফাঁকা রাস্তায় ওদের ভয় বেশি। ওত পেতে বসে থাকা আর্মির গাড়ি চট করে ছুটে আসবে। টেনে নামাবে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

মেরিনা আস্তে করে বলে, আজকের রাস্তা দেখে আমার গা ছমছম করছিল। হঠাৎ কণ্ঠস্বর পাল্টে ফেলে জোরালোভাবে বলে, আমাদের এসব না ভাবাই ভালো। আমার মায়ের দেবদূতের মতো ছেলেরা এলেই ভালো। বাড়িতে স্বস্তি থাকবে। বাবা-মায়ের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে যতক্ষণ ওরা এ বাড়িতে থাকবে।

ওরা এলে তোর ভয় করে না, মেরিনা? মনে হয় না একটা কিছু ঘটে যেতে পারে?

মোটেই না। ওরা কবে আসবে আমিও সেই অপেক্ষায় থাকি। জানো ভাইয়া, ওরা না এলে আমার দিনগুলো ভুতুড়ে হয়ে যায়। মনে হয়, এই শহরের গেরিলারা কোথায় হারাল।

মারুফের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললে প্রথমে মারুফের চোখ কুঁচকে যায়। তারপর দৃষ্টি প্রসারিত হয়। মৃদু হেসে বলে, আমি তো জানি, মা শুধু ওদের দেবদূত বলে না। তুইও বলিস। যুদ্ধ মানুষের চেহারা বদলে দেয় রে। তবে শুধু দেবদূত নয়, তাকে ইবলিসও দেখতে হবে, মেরিনা।

আমি তা-ও জানি। পাকিস্তানি আর্মির সৈনিকগুলো আমার সামনে ইবলিস। সময়টা এখন এমনই। তোমার কি মনে হয় না, ভাইয়া, যে একদিন এই সময়ের একটা নাম হবে।

হতে পারে। আমরা যে সময় দেখছি এবং যেসব দিন পাড়ি দিচ্ছি, তার নাম হতেই হবে।

কী নাম হবে বলে তোমার মনে হয়?

মারুফ একমুহূর্ত মাথা ঝাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে, হুররে, পেয়েছি!

বলো, কী নাম হতে পারে?

মারুফ বুক টান করে দাঁড়িয়ে বলে, একাত্তর।

বাহ, দারুণ! একটি শব্দে পুরো যুদ্ধের ইতিহাস।

আমরা, গেরিলারা ঢাকা শহরের চেহারাই বদলে দিলাম। শরীরের ভেতর মেশিনগানের শব্দ টের পাচ্ছি। না, শুধু মেশিনগান হবে কেন, সব অস্ত্রের শব্দ টের পাচ্ছি। একটি ট্যাংক বা বোমারু বিমানও আমার ভেতরে ভরেছি।

একজন গেরিলাযযাদ্ধার এত আনন্দ হয়, আমি তা ভাবতে পারি না। আমার নিজেরও এমন আনন্দ হচ্ছে।

ভুলে যাচ্ছিস কেন তুই নিজেও একজন যোদ্ধা।

ভুলিনি, একদম ভুলব না। নিজের বীরত্বকে কে অস্বীকার করতে চায়?

প্রাণখোলা হাসিতে নিজেকে ভরিয়ে দিয়ে আবার বলে, আজ তোমার কোনো বন্ধু আসবে, ভাইয়া?

ওরা পাঁচজন আসবে। ওদের মধ্যে তিনজন তোর চেনা। বাকি দুজন নতুন। কী রান্না হয়েছে রে?

মা জানেন। রান্নাঘরের ব্যবস্থা মায়ের। মা বলেন, এটাই তার যুদ্ধ। গেরিলাদের খাইয়েদাইয়ে তরতাজা রেখে বড় অপারেশনে পাঠানো। মারুফের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হয়, ওহ্! আমাদের মা। গ্রেট মা। কত শান্তভাবে, কত মমতায় গেরিলাদের যত্ন করেন।

শুধু কি তা-ই, মা-ও গেরিলাদের অপেক্ষায় থাকেন। বলেন, ওরা এলে আমাদের বাড়িটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়। আসল যুদ্ধক্ষেত্র দেখা না হলে কী হবে, এই যুদ্ধক্ষেত্রও দেখা আমার পুণ্য রে, মেয়ে।

মারুফও জানে এসব কথা। তার পরও মেরিনার কাছ থেকে আবার শুনতে ভালো লাগে। যেন নতুন করে শোনা হলো যুদ্ধকালীন কথা। এসব কথা বারবার শুনতে হয়। যেন কোথাও বসে কেউ একজন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করছেন। বলছেন, হে পুরবাসী, শোনো, এই ইতিহাস তোমাদের নতুন জন্মের ইতিহাস। এই ইতিহাস তোমাদের নতুন জীবন রচনা করবে। হে পুরবাসী, তোমরা জয়ের প্রার্থনায় নিমগ্ন হও। কঠিন সময়কে আপন করার প্রার্থনায় মগ্ন হও তোমরা। দেখো, চারদিকে বিউগলের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তোমাদের সামনে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ।

মারুফ চারদিকে তাকিয়ে বলে, আমার মনে হলো, কেউ যেন স্তোত্র পাঠ করছিলেন।

আমার মনে হচ্ছিল বুদ্ধের বাণী, কিংবা বাইবেল থেকে পাঠ।

অথবা কোরআনের কোনো আয়াত।

মেরিনা চমকে মারুফের দিকে তাকায়।

এই কণ্ঠস্বর কোথা থেকে ভেসে আসছিল, ভাইয়া?

আমি জানি না। শুধু মনে হয়েছিল, শোনাটা আমাদের জন্য খুব দরকার। তাই দুকান খাড়া করে রেখেছিলাম। খুব পবিত্র মনে হচ্ছিল নিজেকে। এবং নিজেকে খুব সাহসীও। জীবনকে তুচ্ছ করার সাহস।

আমরা মায়ের কথা বলছিলাম। আমার মনে হয়, আমার মায়ের পূর্বপুরুষের কেউ, ধরো তার নানা বা দাদার আগের কেউ মোগল সম্রাটের সেনাপতি ছিলেন।

মারুফ হা-হা করে হেসে বলে, মায়ের সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে?

মোটেই না। মায়ের সাহস দেখে মুগ্ধ হই। তার ধমনিতে যুদ্ধের গৌরবের রক্তস্রোত আছে।

তুই কি মায়ের মতো সাহসী না?

আমিও গেরিলাযোদ্ধা হতে চাই, ভাইয়া। মেলাঘরে যেতে চাই। ট্রেনিং নিতে চাই।

বাদল আসুক। ওকে তোর কথা বলব। ও তোকে মেলাঘরে নিয়ে যাবে। খালেদ মোশাররফের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, মেয়েদের একটি প্লাটুন করুন, স্যার। আমি অনেক মেয়ে এনে দেব। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও পারে।

মেরিনা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, মা অন্য কথা বলে।

কেমন, কী কথা রে? মা আর অন্য কথা কী বলবেন?

মেরিনা চুপ করে থাকে। খানিকটুকু দ্বিধা ওকে বাধাগ্রস্ত করে।

বলছিস না কেন? এখন চুপ করে থাকার সময় নয়। এই সময়টা কথা বলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের সময়।

মেরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরি মারুফের দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে রাখে। ঠোঁট কামড়ায়। বলে, মা বলে, আমি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়লে ওরা আমাকে বাংকারে নিয়ে যাবে। সে জন্য সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।

ঠিকই বলেন। যুদ্ধকালে এর জন্যও তৈরি থাকতে হবে।

আগেকার দিনের নারীরা যুদ্ধে পরাজিত হলে আত্মাহুতি দিত।

মারুফ বোনের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। মেরিনা শক্ত কণ্ঠে বলতে থাকে, তবে সময় এখন আগেকার দিনের মতো নেই। এখনকার সময়ের মেয়েরা নির্যাতিত হলেও যুদ্ধের পক্ষে কাজ করবে। বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দেবে মুক্তিযযাদ্ধাদের সঙ্গে। বলবে, জনযুদ্ধ প্রতিটি মানুষের সাহস চায়। তোমাদের প্রয়োজনের কথা আমাকে বলো। আমি কাজটি করব। নদীর ওপর যে সেতুটি আছে, তা আমি উড়িয়ে দিয়ে আসি? তাহলে পাকিস্তানি সেনারা আর এপারে আসতে পারবে না। আমাদের এলাকা মুক্তাঞ্চল থাকবে।

মারুফ বাতাসে উড়িয়ে দেয় কণ্ঠস্বর। বলে, এমনই হবে দেশজুড়ে। আর সবকিছুই যুদ্ধের সময়ের ঘটনা হবে। এখান থেকে কেউ কাউকে আলাদা করতে পারবে না।

একাত্তর এক অলৌকিক সময় হবে, না ভাইয়া?

হ্যাঁ, এক আশ্চর্য সময়ও বলতে পারবি। বলতে পারবি শ্রেষ্ঠ সময়ও।

উহ্, কী সাংঘাতিক, আমরা এই সময়ের মানুষ! এই জীবনে আমি আর কিছু চাই না।

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে মেরিনার চেহারা। ও দুহাতে মোটা-লম্বা বেণিটা খোলে আর গাঁথে। ওরা দুভাইবোন পাঁচজন গেরিলার জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা একসঙ্গে আসবে না। একেকজন একেক সময় আসবে। রাত দশটার মধ্যে ওদের আসা শেষ হবে। ওরা আজ রাতে এ বাড়িতে আসবে। থাকবে। পরদিন দিনের বেলায় এ বাড়িতে অপেক্ষা করবে। সন্ধ্যায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা ফেলার কর্মসূচি আছে ওদের।

ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয় মেরিনা। দ্রুত হাতে বেণিটা শেষ করে দুহাত কাজমুক্ত করে। ওরা এলে হাত দুটোকে কাজে লাগাতে হবে। সেই হাত দিয়ে বেণি বাধার কাজ করা যাবে না। কাজ করতে হবে যোদ্ধাদের জন্য। ওরা এলে প্রথমে চা-নাশতা দিতে হবে। যখন যে আসবে তখন তাকে। তারপর খাবারের টেবিলে খাবার সাজাতে হবে। ওদের ঘুমানোর জন্য বিছানা করতে হবে। মারুফের ঘরের মেঝেতে বড়সড় বিছানা পেতে সবাই একসঙ্গে ঘুমোবে বলে ঠিক করেছে। সেই অনুযায়ী তোশক-বালিশ তৈরি রাখা হয়েছে।

মারুফ কান খাড়া করে বলে, বাবা বোধ হয় আমাকে ডাকছেন। শুনে আসি কী বলবেন।

এক মিনিট দাঁড়াও, ভাইয়া। একটা কথা—

কী বলবি? মারুফের ভুরু কুঁচকে থাকে।

তাহলে আজ রাতে শুরু, ভাইয়া?

হ্যাঁ, আজ রাতেই প্রস্তুতি শেষ হবে। কাল আমরা নিজেদের চিন্তামুক্ত রাখব। তাস খেলব। ক্যারম খেলব। মাকে খিচুড়ি রাঁধতে বলব। আর বাবাকে ডেকে তার ছাত্রজীবনের গল্প শুনব। আমরা মনে করব, সময় আমাদের জীবনে পাখা মেলেছে। ওটা দম আটকে মুখ থুবড়ে পড়েনি।

ওরা কখন আসবে?

মেরিনার কণ্ঠ অস্থির শোনায়।

যখন তখন। এক্ষুনি বা তক্ষুনি।

মেরিনা মৃদু হেসে বলে, বেশ সুন্দর করে উত্তর দিলে। তুমি তো নির্দিষ্ট করে জানো না যে কখন আসবে।

আসার পথ খুব সহজ নয়তো, সে জন্য এভাবে বলা।

বুঝেছি। চলো, বাবার ঘরে যাই।

দুজনে উঠে দাঁড়ানোর আগেই আকমল হোসেন ড্রয়িংরুমের দরজায় এসে দাঁড়ান।

আব্বা, আমরাই তো যাচ্ছিলাম।

আমিই চলে এলাম। তোদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। তোরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না। কিসের যুক্তিতক্ক হচ্ছিল?

পাঁচজন গেরিলা আসবে, বাবা!

হ্যাঁ, তা তো জানি। আমি ওদের আসার পথের ম্যাপ করছিলাম।

কই, দেখি তোমার কাগজটা।

না, তোদের হাতে দেওয়া যাবে না। আমি তোদের বোঝাব। তোদের মাকে ডেকে নিয়ে আয়।

আমাকে ডাকতে হবে না। আমি এসে পড়েছি।

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আয়শা খাতুন ঘরে এসে ঢোকেন। আগুনের আভায় তাঁর ফরসা দুগাল চকচক করছে। কপালে ঘাম জমে আছে।

হ্যাঁ, এখানে বসেন। এই সোফায় আমি আর আপনি। পাশের সোফায় আব্বা আর মেরিনা।

আপনার রান্না শেষ হয়েছে, মা?

হয়েছে, বাবা। সব শেষ করেই রান্নাঘর থেকে বের হয়েছি রে।

কী বেঁধেছেন? খাওয়ার লোভ জিবে টিকিয়ে রাখার জন্য জিজ্ঞেস করছি, মা।

বেঁধেছি মুরগি আর ইলিশ মাছ। ডাল, ঢ্যাঁড়শ ভাজি। শুটকি মাছের ভর্তা। কাউন চালের পায়েস করেছি।

উহ্, এত কিছু! খাবার টেবিল আজ দারুণ জমবে।

ছেলেরা ভালো-মন্দ না খেলে যুদ্ধ করবে কী করে! ওদের যুদ্ধ আমাদেরও করতে হবে।

আকমল হোসেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, খাইয়েদাইয়ে ছেলেদের আয়েশি করা যাবে না। পরে ওরা বলবে ঘুমপাড়ানি গান গাও, মা। ঘুমিয়ে পড়ি।

পাগল, ওরা কখনো এমন কথা বলবে না।

না বললে ভালো।

যারা যুদ্ধ করার জন্য পথে নামে, তাদের সহজে ঘুম আসে না। ওরা ঘুমপাড়ানি গানের তোয়াক্কা করে না।

তুমি রেগে গেলে দেখছি।

তুমি বলতে চাও এখন আদর দেওয়ার সময় না?

হ্যাঁ, তা-ই। আকমল হোসেনের কণ্ঠস্বর গম্ভীর এবং কঠিনও। আমি ছেলেদের বাড়াবাড়ি প্রশ্রয় দিতে চাই না। সেটা কোনো ধরনের আচরণেই না। সেটা খাওয়াদাওয়াতেই হোক বা রাস্তায় হাঁটাতেই হোক।

আয়শা খাতুন নিরেট কণ্ঠে বলেন, ঠিক আছে, এরপর ওরা যখন আসবে, তখন আমি ওদের আটার রুটি আর এক বয়াম আচার দেব। ওই খেয়েই ওদের গায়ে বল হবে।

মেরিনা মায়ের হাত চেপে ধরে আতঙ্ক নিয়ে বলে, না মা, না। আপনি এমন করবেন না। আপনি যা খাওয়াতে চান, তা-ই খেতে দেবেন। অপারেশনে গিয়ে ওদের কেউ যদি ফিরে না আসে, তখন ওর অন্য বন্ধুরা বলবে, ও মৃত্যুর আগে মায়ের আদর পেয়েছিল। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। ও বীর শহীদ। ইতিহাস ওকে মনে রাখবে।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আয়শা খাতুন ড়ুকরে কেঁদে ওঠেন। কাঁদে মারুফ আর মেরিনাও। শুধু আকমল হোসেন নিজের হাতের কাগজটি টেবিলে বিছিয়ে রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখেন। যুদ্ধের নিরেট সত্যে তার মগজ থমথমে। ওখানে আবেগের জায়গা নেই। কঠিন স্বরে ডাকেন, মারুফ।

জি, আব্বা।

তুমি একজন গেরিলাযযাদ্ধা। মেলাঘরে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছ।

জি, আব্বা।

তাহলে এমন ভেঙে পড়েছ কেন? যুদ্ধে প্রশ্রয়ের বাড়াবাড়ি থাকে না। মায়ের চোখের পানিও তাকিয়ে দেখতে হবে না। তুমি এখন গ্রেনেড, স্টেনগান, প্রয়োজনে আরও বড় অস্ত্র। যুদ্ধের সময় তোমার শরীর তোমার নয়।

আব্বা! মেরিনার ভয়ার্ত কণ্ঠ ঘরের ভেতর ধ্বনিত হয়। ওর শরীর কার, আব্বা?

দেশের এবং স্বাধীনতার। আকমল হোসেনের কণ্ঠস্বর ভাবলেশহীন। চেহারায় ভাবান্তর নেই।

আয়শা খাতুন দুহাতে চোখের পানি মুছে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলেন, তুমি এভাবে বললে?

হ্যাঁ, বললাম। তারপর মেয়ের দিকে ঘুরে বলেন, মা মেরিনা, তোমার শরীরও তোমার না।

আয়শা খাতুন গলা উঁচিয়ে বলেন, এসব কী বলছ তুমি।

যা বলছি, ঠিকই বলছি। মেরিনার শরীরও দেশের এবং স্বাধীনতার। যুদ্ধের সময় কারও শরীরের দাবি তার নিজের থাকে না।

মেরিনা দুহাতে মুখ ঢাকে। এক নিষ্ঠুর অনুভব তার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে ঘর। কারও মুখে কথা নেই। একটু পর মারুফ নিজের মতো করে বলতে থাকে, এই বাড়ি আমাদের দুর্গ। এখানে অস্ত্র আছে, খাদ্য আছে। গেরিলা অপারেশন পরিকল্পনা করার সুযোগ আছে। বয়সীদের সহযোগিতা আছে। প্রস্তুতির জন্য সাহস সঞ্চয়ের নেপথ্য শক্তি আছে। দুর্গের সবাই যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকে। তাহলে দুর্গে আর কী থাকে? মারুফ বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আব্বা, একটি দুর্গে কী কী থাকে?

ঘরের তিনজন মানুষই একযোগে মারুফের দিকে তাকায়।

আব্বা, আপনি কি কোনো দুর্গ দেখেছেন?

ঢাকা শহরে লালবাগ দুর্গ আছে। তোমাদের তিন-চারবার নিয়ে গিয়েছি সেখানে।

এই দুর্গের কথা বলছি না।

আমি ধরে নিয়েছি তুমি ইতিহাসের দুর্গের কথা বলছ। বই পড়ে তেমন দুর্গের ধারণা আমি করি।

আপনার কি মনে হয় আমাদের বাড়িটি একটি দুর্গ?

আসল দুর্গ নয়, তবে দুর্গের ক্যারেক্টার তৈরি হয়েছে এ বাড়ির।

গেরিলারা এলে এ বাড়ির মাটি খুঁড়ে আমরা অস্ত্র বের করব। আপনি তার তত্ত্বাবধান করবেন। তারপর প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন।

এই বাড়িটা জনযুদ্ধের দুর্গ। এসো, আমরা এখন ম্যাপ দেখি।

আকমল হোসেন সোফায় বসে থাকেন। মাঝের টেবিলটা টেনে তার সামনে রাখা হয়েছে। তিনজনে টেবিলের চারপাশে জড়ো হয়। আয়শা খাতুনকে একটি মোড়া দেয় মেরিনা। মারুফ আর ও মাটিতে বসে।

এই দেখ, এখান দিয়ে আসবে ওরা। ওরা নদীপথে আসবে। চালের বস্তাভর্তি নৌকায় আসবে। ওদের অস্ত্রগুলো ওসব বস্তার আড়ালে লুকানো থাকবে। নদীর ওপার থেকে অস্ত্র এনে রায়েরবাজারের এই বাড়িতে ওঠানো হবে। একতলা টিনের বাড়ি। সামনে উঠোন আছে। উঠোনে আম-কাঁঠাললেবু-আতাগাছের আড়াল আছে। এই পথে আসার জন্য এই জায়গাটি গেরিলাদের এন্ট্রি পয়েন্ট। আমার মনে হচ্ছে, ওরা এতক্ষণে শহরে ঢুকে গেছে। আজ সকালেই আমি ওই বাড়ির সবকিছু দেখেশুনে এসেছি। মোয়াজ্জেমকে বলে এসেছি কী করতে হবে না-হবে। আশা করি, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললে ওরা অল্পক্ষণে পৌঁছে যাবে।

মারুফ আয়শা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলে, সেটাই হবে আমার মায়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দের সময়। অপেক্ষার সময় মাকে অস্থির করে রেখেছে।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস তুই। তা ছাড়া এই বাড়িটাকে যদি আমরা দুর্গ বলি, তবে তোর মা এই দুর্গের রক্ষক।

আয়শা খাতুন বিচলিত না হয়ে বলেন, বাড়িতে অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা তুমি নিজে করো। রক্ষক আমি একা নই। ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুমিই তুলে দাও।

একদিন আমি না থাকলে ওই কাজটিও তোমাকে করতে হবে।

মারুফ দ্রুতকণ্ঠে বলে, একদিন আমরা কেউই না থাকতে পারি, আব্বা। এই আমি কাল যে অপারেশনে যাব, সেখান থেকে জীবিত না-ও ফিরতে পারি। কিংবা আর্মি যদি এই বাড়িতে আসে এবং তোমার লুকানো জায়গা থেকে অস্ত্র খুঁজে বের করতে পারে, তাহলে তো আমাদের কারও রক্ষা থাকবে না।

মারুফের কথা শেষ হলে অকস্মাৎ ঘর নীরব হয়ে যায়। একটুক্ষণের নীরবতা মাত্র। পরক্ষণে চেঁচিয়ে ওঠে মেরিনা, আমাদের এভাবে ভাবা উচিত না, একদম না। আমাদের শুধু মনে রাখতে হবে যে আমরা যুদ্ধ করছি। আমরা স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতার জন্য যত দিন প্রয়োজন তত দিন যুদ্ধ করব। দেশটা ধ্বংসস্তৃপ হয়ে গেলে, পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আমরা সেই ছাইয়ের ওপর ফিনিক্স পাখি হয়ে জেগে উঠব। আমাদের কোনো ভয় নেই, আব্বা।

তোদের সাহস আছে বলে আমাদেরও কোনো ভয় নাই রে, ছেলেমেয়েরা–

আমারও কোনো ভয় নাই। ওদের জন্য আমার বাড়িতে গরম ভাত থাকবেই, যেন ওরা বলতে না পারে যে ক্ষুধার জ্বালায় আমরা অস্ত্র হাতে নিতে পারিনি।

আবার ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আকমল হোসেন নিজের হাতে আঁকা ম্যাপটি দেখেন। আয়শা খাতুন মেয়ের ডান হাত টেনে নিজের কোলের ওপর রাখেন। বাম হাত বাড়িয়ে মারুফের হাত ধরেন। মৃদুস্বরে বলেন, বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করতে বলেছেন। আমরা তৈরি করতে পেরেছি। প্রয়োজনে। রক্তও দেব।

স্ত্রীর কথার সূত্র ধরে আকমল হোসেন মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেই বলেন, তাঁর ডাকে দেশের মানুষ জেগেছে। একজন নেতা একলা থাকতে পারেন না। মানুষকে জাগানোই নেতার কাজ। দেখা যাক, কী হয়।

কী হয় বলবেন না, আব্বা। হবেই। স্বাধীনতা শব্দটিকে আমাদের বুকের ভেতর নিতে হবে। তারপর যাবে মাথার ওপরে। তারপর উড়বে আকাশে। পিছু হটার রাস্তা আমরা নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়েছি।

ঠিক। আকমল হোসেন চোখ বড় করে সবার দিকে তাকালেন। তার উচ্চারিত ঠিক শব্দ বদ্ধ ঘরের ভেতরে ধ্বনিত হয়। সে শব্দ নিজের ভেতরে নিয়ে আয়শা খাতুন গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করেন। বাড়ির সবাই জানে, গুনগুন করে গান গাওয়া আয়শা খাতুনের প্রিয় অভ্যাস। রান্নাঘরে কাজের সময় তিনি গান করেন। অবসরে তো করেনই। রাতে খাওয়ার পর ডাইনিং টেবিলে বসেই সবার অনুরোধে তাকে গাইতে হয়। মেজাজ ভালো থাকলে তিনি গান গাইতে না করেন না। রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত গেয়ে থাকেন। কিংবা হামদ-নাত বা কীর্তন। নিজে নিজে শেখা এসব গানের সুর নিয়ে তিনি ভাবেন না। শুনে শুনে শেখা হলেও সাধ্যমতো শুদ্ধ সুরে গাইতে চেষ্টা করেন। আকমল হোসেন বিবাহবার্ষিকীতে তাঁকে গানের বই উপহার দেন। তাঁর ভান্ডারে অনেকগুলো গানের বই আছে। আজও তার গুনগুন ধ্বনিতে গানের বাণী উচ্চারিত হয়—ওই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে

মারুফ জানে, এটি মায়ের প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত।

মেরিনার মনে হয়, বৈশাখ মাসে মা শ্রাবণের গান গাইছেন। বেশ লাগছে শুনতে।

আকমল হোসেন ভাবেন আয়শা একটি দারুণ গান গাইছে। এই গানটি এই সময়ে এই বাড়িতে খুব দরকার ছিল।

আয়শা খাতুনের গুনগুন ধ্বনি ঘরে আর আবদ্ধ থাকে না। জানালার দুই পাল্লার ফাঁক দিয়ে বাইরে ছড়াতে থাকে। এই সময় গেরিলাযযাদ্ধারা এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে বুঝতে পারবে গানের সুর ওদের জন্য আবাহন সংগীত। এখনই সময় একটি গেরিলা অপারেশনের প্রস্তুতি নেওয়ার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *