1 of 3

০১।৫ প্রথম কাণ্ড : পঞ্চম অনুবাক

পঞ্চম অনুবাক
 প্রথম সূক্ত : হৃদ্রোগকামিলানাশনম্
[ঋষি : ব্রহ্মা দেবতা : সূর্য, হরিমা হৃদরোগ ছন্দ : অনুষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ অনু সূর্যমুদয়তাং হৃদ্দ্যোতো হরিমা চ তে। গো রহিতস্য বর্ণেন তেন ত্বা পরি দসি ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –হে জীব (আত্ম-সম্বোধন)! তোমার হৃদয়সম্বন্ধী রোগ (বন্ধনহেতুভূত অন্তৰ্বাধি) এবং কামিলাদি-রূপ শারীর-ব্যাধি (বন্ধনমূল বহিব্যাধি অর্থাৎ সৎপথ-অবরোধক কর্মপ্রভাব ইত্যাদি) সূর্যদেবের (শসন্তাপকারী শুদ্ধসত্ত্বের) উদ্দেশে প্রেরণ করো (অথবা অনুক্রম সহকারে একে একে প্রাপ্ত করাও); ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে বন্ধনমূল–অন্তর্ব্যাধি ও বহিব্যাধি–একে একে নাশ করো)। লোহিতবর্ণ (সৎ-ভাবজনক, সৎসমীপে নয়নসমর্থ) জ্ঞানকিরণের সেই প্রসিদ্ধ (ব্যাধিনাশ-সমর্থ অথবা বন্ধন-মোচন-সমর্থ) দীপ্তির দ্বারা (তুমি) তোমাকে আচ্ছাদিত (দীপ্তিমন্ত) করো ॥ ১

মন্ত্ৰাৰ্থ আলোচনা— নতুন অনুবাকে নতুন সূক্তের নতুন মন্ত্রে এক নতুন রকমের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। সূঞানুক্রমণিকায় প্রকাশ,অনু সূর্যং প্রভৃতি মন্ত্র হৃৎ-রোগ এবং কামিলাদি (বা কামলা ইত্যাদি) রোগ শান্তির জন্য বিনিযুক্ত হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে যে সকল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অবলম্বিত হয়, তার বিধিও ঐ সূঞানুক্রমণিকায় সক্ষেপে উল্লিখিত আছে। সেখানে দেখতে পাই, হৃৎ-রোগ ইত্যাদি প্রশমনের জন্য রোগীকে রক্তবর্ণ বৃষের রোমমিশ্রিত জল পান করাতে হয়। তারপর, রক্তবর্ণ গোচর্ম এবং অচ্ছিদ্র মণি গোক্ষীরে নিক্ষেপ করবার বিধি আছে। অনুক্রমণিকায় প্রকাশ,–সেই গোচর্ম পেতে, রোগীকে তার উপর উপবেশন করাবে এবং মন্ত্রপূত করে সেই মণি বেঁধে দেবে; পরে সেই গোক্ষীর তাকে পান করাবে। অতঃপর নবমবর্ষীয়া বালিকাকে হরিদ্রা-মিশ্রিত অন্ন ভোজন করিয়ে রোগীকে তার উচ্ছিষ্ট ভোজন করাবে এবং ভুক্তাবশিষ্ট রোগীর দুই পদে লিপ্ত করে রোগীকে খাটের উপর উপবেশন করাবে। তারপর, শুক, কাষ্ঠশুক এবং পীতনকশুক–এই তিন রকম পক্ষীর সব্যজঙ্ হরিৎবর্ণ সূত্রের দ্বারা সেই খাটের সাথে বেঁধে দেবে। মন্ত্রের অন্য যে সব প্রয়োগ-বিধি আছে, তা কর্মীর নিকট অবগত হওয়া কর্তব্য।–মন্ত্রটি বিশেষ জটিলতাপূর্ণ। ভাষ্যে মন্ত্রের যে অর্থ প্রকটিত, তা এই,-হে ব্যাধিত পুরুষ! তোমার হৃদয়-সন্তাপক হৃৎ-রোগ এবং কামিলা ইত্যাদি-জনিত শরীরের হরিৎ-বর্ণ রোগ–এই উভয়প্রকার ব্যাধি সূর্যকে লক্ষ্য করে প্রেরিত হোক; অর্থাৎ, পূর্বোক্ত সন্তাপজনক দুরকম রোগ তোমার শরীর পরিত্যাগ করে সন্তাপক সূর্যকে প্রাপ্ত হোক। তার পর লোহিতবর্ণ বিশিষ্ট গোজাতিসম্বন্ধীয় বর্ণে অর্থাৎ লোহিত বর্ণে তোমার শরীর আচ্ছাদিত হোক। স্থূলতঃ, অনভিমত রোগজনিত তোমার শরীর যে বিকৃতবর্ণ প্রাপ্ত হয়েছে, তা বিদূরিত হয়ে শরীর সুস্থ থোক এবং প্রকৃষ্ট (অর্থাৎ সুস্থতার লক্ষণযুক্ত) বর্ণ ধারণ করুক। সাদাসিধা-ভাবে মন্ত্রে এই রকম ব্যাধি মুক্তির প্রার্থনাই প্রকাশ পেয়েছে। আমরা মন্ত্রের পদসমূহের অন্বয়ে দূরকম ভাব গ্রহণ করেছি। এক অর্থ–সায়ণের অনুসারী; এবং অন্য অর্থ–আমাদের পরিগৃহীত পন্থারই অনুগামী হয়েছে।-মন্ত্রের সমস্যামূলক প্রথম পদ–হৃদ্যোতঃ। সায়ণ ঐ পদের অর্থ করেছেন,-হৃদয়ং দ্যোতয়তি সন্তাপয়তীতি হৃদ্যোতঃ হৃদ্রোগঃ–অর্থাৎ, যাতে হৃদয়ের সন্তাপ জন্মায়, হৃদয়ের সাথে যা ব্যাপ্য, অবস্থিত বা সম্বন্ধ-বিশিষ্ট এবং সন্তাপজনক, তা-ই হৃদ্দ্যোতঃ। এ থেকেই হৃদ্দ্যোতঃ পদে হৃদ্রোগ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। এ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, যা হৃদয়ের সন্তাপজনক–তা-ই হৃদয়ের ব্যাধি–তা-ই অন্তর্ব্যাধি। কামনা-বাসনায় এবং অসৎপ্রবৃত্তির সমাবেশ রূপ যে ব্যাধি অহরহ হৃদয়কে নিপীড়িত করে, আমাদের মতে, হৃদ্দ্যোতঃ পদে সেই ভাবই ব্যক্ত করে। হৃদয়ের ব্যাধি–অন্তৰ্বাধি-ভব-ব্যাধির মোচনই প্রধান মুক্তি। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা জ্ঞানকিরণের সাহায্যে তাকে দুগ্ধীভূত করতে পারলেই ইষ্টলাভের সম্ভাবনা। এই জন্যই আমরা হৃদ্দ্যোতঃ পদে, ভাষ্যকারের অর্থ-ব্যতিরিক্ত হৃদিসন্তাপকং ব্যাধিমূলং, বন্ধনহেতুভূতঃ অন্তঃশঃ অর্থ গ্রহণ করেছি।–মন্ত্রের দ্বিতীয় সমস্যাপূর্ণ পদ–হরিমা। সায়ণ ঐ পদের অর্থ গ্রহণ করেছেন,–কামিলাদিরোগজনিতঃ শারীরো হরিদ্বর্ণঃ; অর্থাৎ কামিলা ইত্যাদি রোগের আক্রমণে শরীর যে হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করে,-ভাষ্যকারের মতে হরিমা পদে তা-ই উপলব্ধ হয়। এ অর্থে সাধারণতঃ ব্যাধির বিষয়ই প্রখ্যাপিত হয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকারের নিষ্পন্ন অর্থ ব্যতীত, হরিমা পদে তার এক অতি উচ্চ ভাব ও সূচিত হতে পারে। ধাতু-অর্থের আলোচনায় প্রতিপন্ন হয়,-হৃ, ধাতু হতে হরিমা পদ নিষ্পন্ন। হৃ ধাতুর অর্থ হরণ বা ক্ষয় করা। যে রোগে শরীরের সামর্থ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তা-ই হরিমাপদবাচ্য। তা থেকে আমরা শরীরক্ষয়করঃ ব্যাধিঃ-যদ্বা, সৎপথাবরোধকঃ কর্মপ্রভাবঃ, বন্ধনমূলঃ বহির্বাধিঃ অর্থ আমনন করেছি। কামিলা ইত্যাদি রোগে যেমন শরীর ক্ষয় হয়ে আসে, রক্তহীনতা জন্মে, শরীরের সমস্ত সামর্থ্য নষ্ট হয়ে যায়; সেইরকম, ঐ সকল রোগের ন্যায়, আত্মধ্বংসকারী সত্ত্বভাবনাশক যে সকল অপকর্মের অনুষ্ঠান জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক আমরা নিত্য করে থাকি, তাতে আমাদের প্রাক্তন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, আর তাতে আমাদের সংসার-বন্ধন ক্রমে দৃঢ় হতে দৃঢ়তর দৃঢ়তম হয়ে আসে।–সেই অবস্থায় মানুষ হিতাহিত সৎ-অসৎ-বিচারশূন্য হয়ে পড়ে; ফলে, তার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। সেই অবস্থাই কামিলা ইত্যাদি রোগের অবস্থা বলা যেতে পারে। কামিলা ইত্যাদি রোগগ্রস্ত ব্যক্তির নিকট যেমন সংসারের যাবতীয় সামগ্রী হরিদ্রাবর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়, অর্থাৎ সবই যেমন তার নিকট বিকৃত বর্ণবিশিষ্ট বলে বোধ হয়, সে যেমন প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারে না; কামনা-বাসনায় নিমজ্জিত ব্যক্তিরও সেই অবস্থা ঘটে। প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়। এইভাবে, মন্ত্রের প্রথমাংশে যে বলা হয়েছে, তোমার হৃৎ-রোগ এবং কামিলা ইত্যাদি শারীরব্যাধি সূর্যদেবের উদ্দেশে প্রেরণ করো, তার তাৎপর্য এই যে, তোমার অন্তর্ব্যাধি ও বহির্ব্যাধি, শত্রুসন্তাপক শুদ্ধসত্ত্বপোষক সূর্যরূপী বা প্রজ্ঞান-স্বরূপ পরব্রহ্মের প্রভাবে বিনষ্ট করো। অর্থাৎ তুমি সঙ্কর্মের প্রভাবে হৃদয়ে সত্ত্বভাব সঞ্চয় করো; হৃদয়ে জ্ঞানের জ্যোতিঃ আহরণ করো; জ্ঞানসূর্যের উদয়ে শুদ্ধ-সত্ত্ব-পোষক ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সমর্থ হবে; ফলে, হৃদরোগ (অন্তৰ্বাধি)–কামক্রোধ ইত্যাদি জনিত চিত্তের বিক্ষোভ এবং কামিলা ইত্যাদি রোগ (শারীরব্যাধি) বহির্বাধি–অসৎ-প্রবৃত্তি বা অসৎকর্ম-সঞ্জাত আত্মধ্বংসকারী পাপকর্মের অনুষ্ঠান হতে মুক্ত হতে পারবে।–এখানে এক সংশয় বা প্রশ্ন উঠতে পারে। ব্যাধিসমূহকে সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করো বলা হলো কেন? এরও এক নিগূঢ় তাৎপর্য আছে। আলোক ভিন্ন সংসারে কিছুই তিষ্ঠিতে পারে না। আলোকই তেজই শক্তির জনয়িতা। সূর্যদেব সেই আলোকের–সেই শক্তির–সেই তেজের আধারভূত।-মন্ত্রের আর একটি সমস্যামূলক বাক্যগো রোহিতেস্য বর্ণেন। ভাষ্যকার ঐ বাক্যের অর্থ করেছেন,–লোহিতবর্ণস্য গোজাতীয়স্য বর্ণেন লৌহিত্যেন। অর্থাৎ, লোহিতবর্ণবিশিষ্ট গোজাতি সম্বন্ধীয় লৌহিত্য-বর্ণের দ্বারা। আমরা বলেছি–গো অর্থে জ্ঞানকিরণস্য; রোহিতস্য অর্থে লোহিতবর্ণস্য, সৎ-ভাবজনস্য, সৎসমীপনয়নসমর্থস্য–যদ্বা সৎসামীপ্য প্রদানসমর্থস্য; বর্ণেন অর্থে প্রভাবেন, দীপ্ত্যা ইত্যাদি। কেন? কারণ গো শব্দে কিরণ, রশ্মি প্রভৃতি বোঝায়। তা থেকেই জ্ঞানকিরণস্য অর্থ পরিগৃহীত হয়েছে। রোহিতস্য পদ রুহ ধাতু হতে নিষ্পন্ন। উৎপন্ন করা, আরোহণ করা–এই দুই অর্থেই রুহ ধাতুর প্রয়োগ দেখতে পাই। সুতরাং ঐ পদের অর্থ সৎসামীপ্যপ্রদানসমর্থস্য অযৌক্তিক নয়।–এখানে, এই মন্ত্রে ব্যাধির ও ব্যাধিশান্তির, উপমার মধ্য দিয়ে এক পরম-তত্ত্ব বিবৃত দেখি। কামনা-বাসনা ইত্যাদিই মানুষের পাপ-প্রবৃত্তির উত্তেজক। ব্যাধি যেমন অলক্ষিতে শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে, শরীরকে জর্জরিত করে ফেলে, কামনা-বাসনা ইত্যাদিও সেইরকম হৃদয়ের অসৎ-বৃত্তিসমূহকে উত্তেজিত করে মানুষকে অশেষ যন্ত্রণা প্রদান করে। ইত্যাদি। যাই হোক, মন্ত্রের অন্তর্গত বিভিন্ন পদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিষয়, বিবেচনা করে মন্ত্রে যে ভাব উপলব্ধ হয়, তা এই,–হে সংসার-তাপতপ্ত জীব! যদি বন্ধন-মোচনের অভিলাষ থাকে, তাহলে তোমার অন্তর ও বাহির ব্যাধি-নিমুক্ত করো; অর্থাৎ তোমার অসৎ-বৃত্তিসমূহ এবং কর্মক্ষেত্রের পাপ-সংশ্রব জ্ঞানের সাহায্যে দূর করে দাও। এমন কর্মী হও–এমন কর্ম সম্পাদন করো, যাতে হৃদয়ে জ্ঞানের দিব্য-জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হয়। তাহলেই অসৎ-বৃত্তির নিবারণে হৃদয়ে সৎ-বৃত্তির সঞ্চার হবে; শুদ্ধস্বভাবগুলি এসে হৃদয় অধিকার করবে। তিনি জ্ঞানময়; জ্ঞানের সাহায্যেই তুমি সৎ-স্বরূপ ভগবাকে জানতে পারবে। তাকে জানতে পেরে তার শরণ গ্রহণ করলেই তোমার সকল বন্ধন টুটে যাবে। দেখবে, তোমার অন্তর্ব্যাধি ও বহিব্যাধি কেউই আর তোমাকে তখন পীড়া দিতে সমর্থ হবে না। এইভাবেই এই মন্ত্র, মনকে জ্ঞানের অন্বেষণে ভগবানের অনুধ্যানে নিরত হতে আহ্বান জানাচ্ছে। ১৷

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ পরি জ্বা রোহিতৈর্ণৈদীর্ঘায়ুত্বয় দত্মসি। যথায়মরপা অসদথো অহরিততা ভুবৎ ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হে জীব (আত্মসম্বোধন)! দীর্ঘজীবন-লাভের জন্য (ভগবানের সমীপে চিরাবস্থানের নিমিত্ত) সৎসামীপ্যপ্রদানসমর্থ (জ্ঞানকিরণের) দীপ্তির দ্বারা (তুমি) তোমাকে আচ্ছাদিত (দীপ্তিমন্ত) করো। যে রকমে জীব (আমি) অপগতপাপ (নির্মলচিত্ত) হতে পারে (পারি) এবং পাপক্ষয়ের পরে সভাববিনাশকারী পাপসম্বন্ধরহিত হয় (হই), সেই ভাবে জ্ঞানজ্যোতিতে দীপ্তিমান হও ২

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা এ মন্ত্রও আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাষ্যকারের মতে, লোহিতবর্ণ পরিধানের ফল। প্রকটনের জন্য এই মন্ত্রের অবতারণা। ভাষ্যের ভাবে ব্যাধিত ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে–হে ব্যাধিত! দীর্ঘায়ু অর্থাৎ শতবর্ষপরিমিত আয়ু লাভের নিমিত্ত, তুমি পূর্বকথিত গো-সম্বন্ধী লোহিত বর্ণের দ্বারা তোমার দেহ আবৃত করো; যাতে তোমার পাপ অপগত হয় এবং পাপ অপগতের পরে যাতে তুমি কামিলা ইত্যাদি রোগ-জনিত হরিদ্বর্ণরহিত হয়ে দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারো, হে চিকিৎসিত ব্যাক্তি, তুমি সেইরকম হরিদ্বর্ণ প্রাপ্ত হও। বলা বাহুল্য, রোগ-উপশমের জন্য মন্ত্রের প্রয়োগ-ব্যবস্থায় মন্ত্রের যে অর্থ নিষ্পন্ন হতে পারে, ভাষ্যাভাষে তা-ই প্রকটিত হয়েছে। এই লৌকিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই বলার নেই। তবে আধ্যাত্মিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমাদের অর্থ অন্য পথ পরিগ্রহ করলো। আমরা মনে করি, হৃৎ-রোগে এবং কামিলা ইত্যাদি রোগে শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে, রোগী যেমন অন্তর্দশা প্রাপ্ত হয়; সেইরকম, অন্তর্ব্যাধি ও বহির্ব্যাধি প্রভৃতি মানুষের সৎপ্রবৃত্তিগুলির ক্ষয় করে তার গতি-মুক্তির পথ রোধ করে দেয়। উওম চিকিৎসায় রোগ-নির্ণয়ে প্রকৃত ঔষধের ব্যবস্থা হলে, যেমন রোগ উপশম হয়,শরীর সুস্থতা : অবলম্বন করে; সেইরকম জ্ঞানকিরণের সাহায্যে অন্তরের ব্যাধিমূল কামনা-বাসনা ইত্যাদি বিদূরিত করে মনের স্থৈর্য সাধনে সমর্থ হলে গতি-মুক্তির পথ আপনিই সুগম হয়ে আসে। আমাদের মনে হয়, মন্ত্রে সেই ভাবই প্রকটিত হয়েছে।-ব্যাধিপ্রশমনের দৃষ্টান্তে মন্ত্রে ভগবৎ-ভক্ত সাধক নিজের মনকে সম্বোধন করে বলছেন–যদি গতিমুক্তিলাভের অভিলাষ থাকে, যদি ভগবানের সাথে চিরাবস্থানের অভিলাষ করে থাকো, তাহলে জ্ঞানজ্যোতিঃ আহরণে প্রবৃত্ত হও। সেই জ্যোতিতে হৃদয় আলোকিত করতে পারলে, তুমি সকল পাপ-সম্বন্ধ হতে পরিত্রাণ লাভ করতে পারবে। জ্ঞানজ্যোতিঃ সৎপথের প্রদর্শক; তোমাকে সৎপথে পরিচালিত করে, তা-ই তোমাকে সৎস্বরূপের নিকট পৌঁছিয়ে দেবে। তাই বলি মন, তুমি জ্ঞানার্জনে নিরত হও। সৎপথে অগ্রসর হয়ে সৎকর্মসাধনে উদ্বুদ্ধ হও। তাহলেই তুমি অরপাঅর্থাৎ পাপসম্বন্ধবিহীন হতে সমর্থ হবে, তাহলেই তুমি দীর্ঘায়ু লাভ করতে সমর্থ হবে, আর তা হলেই তুমি তার সাথে চিরাবস্থিত হতে পারবে। তাহলেই তোমার জন্মগতি রোধ হয়ে যাবে।–মন্ত্রে এই ভাবই পরিব্যক্ত বলে আমরা মনে। করি। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ রোহিণীদের্বত্যাত গাবো যা উত রোহিণী। রূপংরূপং বয়োয়স্তাভিষ্টা পরি দসি ॥ ৩৷৷

বঙ্গানুবাদ –দেবভাবসম্ভুত যে ভগবৎ প্রাপ্তিসামর্থ্য, আর জ্ঞানকিরণোদ্ভূত যে ভগবৎ প্রাপ্তিসামর্থ্য (হৃদয়ে উপজিত হয়), তার দ্বারা অরূপ ভগবানের অনন্তরূপকে এবং বয়োহীন ভগবানের অনন্তযৌবনকে তোমার সাথে সংযোজিত করো। (ভাব এই যে, জ্ঞানের প্রভাবে সৎ-ভাবের সাহায্যে ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধ হয়)। ৩।

অথবা, সপ্রবৃত্তিপ্রভাবে এবং সৎকর্মসাহায্যে (হৃদয়ে) ভগবৎসামীপ্যপ্রদানে সামর্থ্য যে জ্ঞানজ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হয়, তার দ্বারা, হে জীব! সেই ভগবানের অনন্তরূপকে এবং তার অনন্তযৌবনকে আহরণ করে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করো। (অর্থাৎ-জ্ঞানের সাহায্যে সঙ্কর্মের দ্বারা সেই অনন্তরূপ অথবা অরূপ এবং অনন্তযৌবন অর্থাৎ চিরনবীন ভগবাকে হৃদয়ে ধারণ করো ॥ ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই সূক্তের সকল মন্ত্রই দুর্বোধ্য। ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রের যে অর্থ হয়, তা এই–লোহিতবর্ণবিশিষ্ট যে সকল কামধেনু আছে এবং লোহিত বর্ণবিশিষ্ট যে সকল সাধারণ গোজাতি পরিদৃষ্ট হয়, সেই উভয়বিধ গোজাতির লোহিতবর্ণ এবং সর্বব্যক্তিগত যৌবন আহরণ করে, হে রুগ্ন, তোমার শরীরে সংযোজিত করো। রোগ-প্রশমন-পক্ষে সাধারণভাবে মন্ত্রের যে অর্থ হয়, ভাষ্যাভাষে তা-ই প্রকটিত হয়েছে বলে মনে করি। আমরা মনে করি, একদিকে যেমন ব্যাধিশান্তি, অন্যদিকে তেমনই সংসারী জীবকে ভগবৎ-অনুসারী কধবার প্রয়াস, মন্ত্রের মধ্যে নিহিত রয়েছে। আমরা দুরকম দিক হতেই দুটি বঙ্গানুবাদে তা ব্যক্ত করেছি।-মন্ত্রের একটি সমস্যামূলক পদ–রোহিণীঃ। ভাষ্যে ঐ পদের প্রতিবাক্যে রোহিণ্যঃ লোহিতবর্ণাঃ পদ দৃষ্ট হয়। গাবঃ পদে ভাষ্যে গরুগণকে অর্থই গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে রোহিণ্যঃ গাবঃ পদ দুটিতে লোহিতবর্ণা গাভীগণ অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু বেদে গাবঃ পদে জ্ঞানরশ্মিসমূহ অর্থই প্রধানতঃ প্রত্যক্ষ করি। রোহিণীঃ পদ আরোহণের ভাবমূলক রুহ ধাতু হতে উৎপন্ন। তাতেই অর্থ আসে–ভগবৎ সমীপে উন্নীত করবার উপযোগী যে জ্ঞানরশ্মিসমূহ। এই অর্থেই সকল ভাব সঙ্গত হয়ে আসে। আমরা এই ভাবেরই অনুসরণ করেছি। মন্ত্রটি আত্মসম্বোধনমূলক। রূপংরূপং এবং বয়োবয়ঃ পদ দুটি বিশেষ দুর্বোধ্য। সাধারণতঃ ঐ দুই পদের যে অর্থ পরিগৃহীত হয়, ভাষ্যে তা প্রকটিত। আমাদের মতে, রূপংরূপং পদে রূপহীনের অনন্তরূপ এবং বয়োবয়ঃ পদে বয়োহীনের-ভগবানের–অনন্ত যৌবন অর্থ হওয়াই সঙ্গত বলে বোধ হয়। ভগবানের অনন্তরূপ হৃদয়ে ধারণ করতে পারলে, তার অনন্ত-যৌবনের–চিরনবীনত্বের বিষয় উপলব্ধি করতে সমর্থ হলে, পার্থিব রূপ-যৌবনের প্রতি আর আসক্তি থাকে কি? সে রূপের–সে নবীনত্বের ধারণা জন্মে কিভাবে? সে ধারণা জন্মে–সৎ-ভাবের সমাবেশে; সে ধারণা জন্মে–সৎপ্রবৃত্তির উন্মেষে। মন্ত্রে এক পক্ষে যেমন ব্যাধিনাশের কামনায় লোহিতবর্ণ ধারণের উপদেশ আছে; অন্যপক্ষে তেমনই জন্মগতিরোধের জন্য ভগবানের স্বরূপ জেনে তাতে আত্মসমর্পণে সংসারতাপতপ্ত জীবকে উদ্বোধিত করা হয়েছে ৷ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্র: সুকে তে হরিমাণং রোপণাকাসু দসি। অথো হারিদ্রবে্যু তে হরিমাণং নি দসি ॥৪॥

 বঙ্গানুবাদ –হে জীব (আত্মসম্বোধন)! তোমার সম্ভবনাশক পাপপ্রবৃত্তি সমূহকে দীপ্তিমান্ সৎ-ভাবজনক জ্ঞানকিরণ সমূহে সংন্যস্ত করো; আর, তোমার সৎ-ভাব-হরণশীল কর্মপ্রভাব সমূহকে পাপহারী দেবভাব সমূহে সংস্থাপিত করো। (ভাব এই যে, সৎ-অসৎ সকল কর্ম ভগবানে সমর্পণ করো এবং ফলাকাঙ্ক্ষা-বিবর্জিত হয়ে কর্ম করে যাও। তাতেই শ্রেয়ঃ সাধিত হবে)। ৪

মন্ত্ৰাৰ্থ আলোচনা –ভাষ্যের সূচনায় প্রকাশ, পূর্বোক্ত মন্ত্র তিনটিতে রুগ্নশরীরে গরু ইত্যাদি পশুসম্বন্ধি উজ্জ্বল লোহিতবর্ণ প্রবেশের পর, রোগজনিত হরিদ্বর্ণ কি গতি প্রাপ্ত হবে, তা পরিস্ফুট করবার জন্য, এই মন্ত্রের অবতারণা। মন্ত্রের অর্থ এই যে,-হে ব্যাধিত! তোমার শরীরগত রোগজনিত হরিদ্বর্ণ, শুক এবং কাষ্ঠশুক নামক হরিদ্বর্ণ পক্ষিসমূহে সংস্থাপিত করি। অনন্তর তোমার শরীরগত সেই হরিদ্বর্ণ পীতনক নামক হরিদ্বর্ণ পক্ষিবিশেষে স্থাপন করছি। মন্ত্রের এই অর্থে, চিকিৎসক যেন রুগ্ন ব্যক্তিকে সম্বোধন করে, এই সকল মন্ত্র উচ্চারণ করছেন,–এমন ভাব পাওয়া যায়।লৌকিক হিসাবে মন্ত্রের প্রয়োগপ্রণালী যা-ই হোক, মন্ত্রের অর্থ সাধারণ্যে যা-ই প্রচলিত থাকুক, মন্ত্রে যে এক উচ্চ আদর্শ পরিব্যক্ত হয়েছে, মন্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তা-ই উপলব্ধ হয়। আমাদের মতে, মন্ত্র নিষ্কাম-কর্মের শিক্ষা প্রদান করছেন। নিষ্কাম-কর্মের মূল-সূত্র গীতায় শ্রীভগবানের উক্তিতে সুন্দর পরিস্ফুট দেখতে পাই যৎকরোযি…মদর্পণম্। ফলাকাঙ্গা পরিশূন্য হয়ে, কর্মফল শ্রীভগবানে সমর্পণ করে কর্ম করতে পারলেই নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান হয়। এখানে এই মন্ত্রে সেই আকাঙ্ক্ষাই, ব্যাধি-প্রশমনের দৃষ্টান্তে, উপদেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত জটিলতাপূর্ণ দুর্বোধ্য পদগুলি–হরিমাণং হারিদ্রবেষু রোপণাকাসু সুকে। ভাষ্যের মতে ঐ সব পদের যে অর্থ নিষ্কাষিত হয়েছে উপরোক্ত মন্ত্রের অর্থেই তা প্রকটিত হয়েছে।আমরা হরিমাণং পদে সৎ-ভাব-নাশকং পাপপ্রবৃত্তিং স্থির করেছি। সুকেষু, রোপণাকাসু এবং হারিদ্রবে্যু পদ তিনটিতে যথাক্রমে দীপ্তিমৎসু, সৎ-ভাবজনকে দীপ্তিপ্রদেষু জ্ঞানকিরণেষু এবং পাপাপহারকে দেবে অর্থ নিষ্পন্ন করেছি। ধাতু-অর্থানুসারে আমাদের পরিগৃহীত অর্থেরই সার্থকতা বোঝা যায়। ইত্যাদি। এখন মন্ত্রের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশে যে ভাব সূচিত হয়, তা প্রদর্শিত হচ্ছে। মন্ত্রের প্রথমাংশে বলা হয়েছে তোমার সৎ-ভাব-নাশক পাপ-প্রবৃত্তিসমূহকে দীপ্তিমান্ সৎ-ভাব-জনক জ্ঞান-কিরণে নিবেশিত করো। ভাব এই যে–জ্ঞানকিরণের সাহায্যে সৎ-ভাব-নাশক পাপবৃত্তি-সমূহকে বিদূরিত করো; হৃদয়ে সৎ-ভাবের সঞ্চার হোক।-মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে,সৎ-ভাব-হরণশীল কর্মের প্রভাব ভগবানে সংন্যস্ত করো। অর্থাৎ ভগবৎ-অনুসারী হও। তাতে সকল কর্মফল অর্পণ করো; তাহলেই অসৎকর্মে, পাপের অনুষ্ঠানে আর তোমার প্রবৃত্তি আসবে না। তখন তোমার অনুষ্ঠিত কর্ম, তাঁর কর্ম জেনে তারই শরণ নিতে পারবে। ভাব এই যে,–ভগবৎকর্মের অনুষ্ঠান করো; যাতে তাঁর প্রীতি, তাতে তোমারও প্রীতি, এই মনে। করে, সৎকর্মের অনুষ্ঠানে নিরত হও। তাহলেই তুমি ব্যধি-নিমুক্ত হতে পারবে। ৪

.

দ্বিতীয় সূক্ত : শ্বেতকুষ্ঠনাশনম্

 [ঋষি : অথর্বা দেবতা : বনস্পতি (অসিকনি) ছন্দ : অনুষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ নক্তংজাতাস্যোষধে রামে কৃষ্ণে অসিকি চ। ইদং রজনি রজয় কিলাসং পলিতং চ যৎ ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –কর্মফলাবসানে বিমুক্তদেহ, চিরনবীনাবস্থাপ্রাপ্ত সৎ-বৃত্তি! যদিও তুমি মায়ামোহজ (এই ) দেহ হতে উৎপন্ন, তথাপি বিশ্বরমণশীল বিশ্বনাথের এবং আকর্ষণ-পরায়ণ ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুত হয়েছ। (ভাব এই যে,ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুত হওয়াতেই তুমি বিমুক্ত অবস্থা প্রাপ্ত হতে পেরেছ)। হে কালস্বরূপিণি আবরণকারিণি! তুমি এই দৃশ্যমান, কলুষলাঞ্ছিত, পতনোন্মুখ, মায়ামোহ হতে উদ্ভূত দেহকে চিরতরে বিনাশ করো। (ভাব এই যে, আমাদের দেহসম্বন্ধ হতে বিচু্যত করো। ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই পঞ্চমানুবাকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দুটি সূক্ত শ্বেতকুষ্ঠ ও পলিতকুষ্ঠ ব্যাধিনাশের পক্ষে অমোঘ ঔষধ বলে অভিহিত হয়। সূক্তের মন্ত্রগুলি আবৃত্তি করে হোমক্রিয়া সম্পাদনের বিধি আছে। তা ছাড়া, ব্যাধিত স্থানে নিম্নবিধিমতে প্রলেপ প্রদান করবার ব্যবস্থা দৃষ্ট হয়। ভৃঙ্গরাজ, হরিদ্রা, ইন্দ্ৰবারুণি ও নীলিকা–এই কয়েকটি দ্রব্য বিশেষভাবে পেষণ করে, প্রলেপ প্রস্তুত করতে হবে। সেই প্রলেপ ঐ দুইরকম কুষ্ঠাক্রান্ত স্থানে লেপন করণীয়। শ্বেতকুষ্ঠসম্বন্ধে নিয়ম এই যে,প্রলেপ দেবার পূর্বে শুষ্ক গোময়ের দ্বারা ব্যাধিযুক্ত স্থানে এমনভাবে ঘর্ষণ কর্তব্য, যেন সেই স্থানটি রক্তবর্ণ ধারণ করে। পলিতকুষ্ঠ-সম্বন্ধে নিয়ম,পলিতকুষ্ঠে প্রলেপটি এমনভাবে লাগাতে হবে–যেন ক্ষতস্থান সম্পূর্ণভাবে আবৃত হয়। ক্ষতস্থানে প্রলেপ দেওয়া এবং আজহোমে মন্ত্রোচ্চারণে শান্তিলাভ–এটাই ঐ দুইরকম কুষ্ঠনাশের ঔষধ। ঔষধ ব্যবহারের বিষয়ে এবং মন্ত্রের প্রয়োগ-সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা প্রচলিত আছে,–সে বিষয়ে আমাদের মতদ্বৈধের কারণ নেই। মন্ত্র যথাযথ প্রযুক্ত হলে এবং ঔষধ যথারীতি ব্যবহৃত হলে, দুরারোগ্য রোগ যে উপশম হয়, তা আমরা বিশ্বাস করি। তবে বর্তমানে মন্ত্রের যথাযথ প্রয়োগও হয় না, আবার ঔষধও যথারীতি প্রস্তুত হয় না; সুতরাং সুফলও সর্বথা প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এটাই ক্ষেভের বিষয়। তবে আমরা মনে করি,-মন্ত্রের প্রার্থনা কেবল এই দেহের ব্যধিনাশমূলক নয়; তাতে দেহব্যাধিনাশের দৃষ্টান্তে ভবব্যাধি বিনাশের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। ভাষ্যে মন্ত্রের যে অর্থ প্রকটিত, তার ভাব এই,-হে ওষধে অর্থাৎ হরিদ্রাখ্যে! তুমি রাত্রিতে উৎপন্ন হও। সেই হেতু তুমি শৈত্য (কুষ্ঠ) নাশে সম্পূর্ণরূপে সমর্থ হও। সেইরূপে, হে রামে অর্থাৎ ভৃঙ্গরাজাখ্য ওষধে! হে কৃষ্ণে অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণসম্পাদন-সমর্থ ইন্দ্রবারুণি নামক ওষধে, এবং হে অসিকি অর্থাৎ অসিতবর্ণোৎপাদিকে হে নীলিকা! তোমরাও রাত্রিতে উৎপন্ন বলে কুষ্ঠব্যাধিনাশে সম্পূর্ণ সমর্থ। হে রজনি! তুমিও এই কিলাস ও পলিত ব্যাধিগ্রস্তকে রঞ্জিত করে নাও অর্থাৎ ঢেকে নাও। এই অর্থে রামে পদে ভৃঙ্গরাজ, কৃষ্ণে পদে ইন্দ্ৰবারুণি এবং অসিকি পদে নীলিকা অর্থ অধ্যাহৃত হয়ে থাকে। আমাদের মনে হয়, আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের অন্তর্ভুক্ত বলে, ঐ সব পদার্থের সংশ্রব মন্ত্রে অধ্যাহার করা হয়েছে। আমাদের আরও মনে হয়, যখন মন্ত্রশক্তির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার হ্রাস হয়ে এলো; সেই সময়ই দ্রব্যবিশেষের দ্বারা রোগনাশের প্রস্তাব উপলব্ধি করে, এইরকম অর্থ পরিগৃহীত হয়েছে। এবার আমাদের পরিগৃহীত অর্থের কথা বলি। প্রথম–ওষধে পদ। ফল পরিপক্ক হলে যে বৃক্ষ নাশপ্রাপ্ত হয়, তাকেই ওষধি বলে। আমরা মনে করি, এই পদটি অন্তরস্থ সৎ-বৃত্তির সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে। সৎ-বৃত্তি যখন পরিপক্ক হয়, হৃদয় যখন সৎ-ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে আসে, তখন তার আধারভূত দেহ লোপপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। সেই লোপেরই নামান্তর–মোক্ষ বা মুক্তি।…দ্বিতীয় আলোচ্য পদ–অসিরু। ধাতু-অর্থের অনুসরণে ঐ পদে চিরনবীন অবস্থার ভাব প্রাপ্ত হই। সিত অর্থাৎ শ্বেতবর্ণ হয়নি যার কেশ, তাকেই অসিকি বলে। ফলতঃ বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়েও যে নবীনত্ব-সম্পন্ন, সেই অসিক্লী।…মন্ত্রের তৃতীয় আলোচ্য পদ-নক্তংজাত। এর প্রচলিত অর্থ রাত্রি হতে উৎপন্ন। এখানে পূর্ণ অজ্ঞানান্ধকারকে বা মায়ার প্রভাবকে লক্ষ্য করছে। মায়া হতেই–অজ্ঞানতা হতেই–এই মায়িক দেহের উৎপত্তি। কিন্তু এই দেহের মধ্যেই আবার সৎ-বৃত্তির স্ফুর্তি হয়; আর সেই সৎ-বৃত্তির সহায়তাতেই কর্মফল পরিপক্ক হয়ে আসে–মানুষ মুক্তির পথে অগ্রসর হয়। তাই বলা হলো,-হে ওষধে! হে অসিকি! যদিও তুমি এই মায়ার দেহ হতে উৎপন্ন হয়েছ; তথাপি তুমি যে এই অবস্থায় উপনীত হতে পেরেছ, তার কারণ–রামে ও কৃষ্ণে তোমরা সম্বন্ধযুত। মন্ত্রের অন্তর্গত রামে ও কৃষ্ণে পদ দুটি ভাষ্যকার বিভক্তি-ব্যত্যয়ে সম্বোধনের পদ বলে পরিগ্রহ করেছেন। কিন্তু আমরা ঐ দুই পদকে সপ্তমীর পদ বলে গ্রহণ করি। তাতে ঐ দুইয়ের সাথে সম্বন্ধহেতু–ঐ দুইয়ে অবস্থিতি হেতু–ওষধি ও অসিকী অবস্থা সঞ্জাত হয়েছে, সেটাই বোঝা যায়।

অতঃপর মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের মর্ম অনুধাবন করা যাক। ঐ অংশের সম্বোধ্য পদ–রজনি। ঐ পদে আবরণের–আচ্ছাদনের-বিনাশের ভাব বোঝায়। আলোক বিকাশমান ছিল; অন্ধকারের উদয়ে লোপ পেলো। সুতরাং যিনি বিলোপকারিণী, তাঁকে সম্বোধন করে এই পদ প্রযুক্ত হয়েছে, এটাই আমরা মনে করি। তাহলে, কি বিলোপের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে? বলা হচ্ছে,আমার এই যে দেহ–যে দেহ কলষ-লাঞ্ছিত যে দেহ পতনোন্মুখ; সেই দেহকে আপনি বিধ্বংস করুন। সে দেহের সাথে সম্বন্ধ যেন আমার আর না হয়। জন্ম-জরা-মরণই দুঃখের হেতুভূত; দেহের চিরনাশে জন্ম-জরা-মরণের কবল হতে আমি যেন মুক্ত হই। আপনি তারই ব্যবস্থা করে দিন। এ দেহ আবৃত থোক। এ দেহ চির অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকুক; এ দেহের প্রকাশের আর প্রয়োজন নেই। আপনি এমনই ভাবে আমার সাথে এ দেহের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে দিন। এ অংশের প্রার্থনার এটাই মর্ম। আমার সৎ-বৃত্তি ভগবৎ-অনুসারিণী হয়ে আমাকে দেহ-সম্বন্ধ বিমুও জন্মজরামরণরহিত অবস্থা প্রদান করুক; এটাই আমার আকাঙ্ক্ষা। আমরা মনে করি,-মন্ত্রের মধ্যে বন্ধনমোচনের এইরকম প্রার্থনাই নিহিত আছে ৷৷ ১৷৷

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ কিলাসং চ পলিতং চ নিরিতো নাশয়া পৃষৎ। আ ত্বা স্বা বিশতাং বর্ণঃ পরা শুক্লানি পাতয় ॥ ২॥

 বঙ্গানুবাদ –হে সৎ-বৃত্তি! মায়ামোহ হতে উৎপন্ন, কলুষক্লেদবিশিষ্ট ও জরামধ্যগত, সমুদ্রে বিন্দুবৎ, এই দেহকে সর্বপ্রকারে নিঃশেষে বিনাশ করো (এর লয় সাধন করো); হে সৎ-বৃত্তি! তোমাকে আমরা সর্বতোভাবে আহ্বান করছি; তুমি তোমার আত্মগত শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাব আমাদের মধ্যে প্রবিষ্ট (সঞ্চারিত) করো; তার দ্বারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সত্ত্বভাব প্রাপ্ত করিয়ে দাও। (ভাব এই যে,-সৎ-বৃত্তির প্রভাবে আমাদের জন্ম জরা মরণক্লেশহেতুভূত দেহধারণ নাশপ্রাপ্ত হোক; তার দ্বারা আমরা যেন সত্ত্বাবস্থায় সংবাহিত হই)। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রের অর্থ–পূর্ব মন্ত্রেরই অনুসারী। সেই অনুসারে প্রথম পাদের সম্বোধন–হে ওষধে এবং দ্বিতীয় পাদের সম্বোধন –হে রুগ্ন। অর্থাৎ, প্রথম পাদে হরিদ্রাকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে,–হে হরিদ্রা! তুমি আমার এই কিলাস আর পলিত অবস্থাকে আমাদের দেহ হতে দূরীভূত করে। তার পর, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে,-হে রুগ্ন! তোমার দেহে লোহিতাদি বর্ণ প্রবেশ করাও। তোমার শুক্লতা অপসৃত হোক। তোমার শরীরগত যে শুক্লবর্ণ, তাকে দূরে প্রেরণ করে। সে যেন তোমাকে আর স্পর্শ করতে না পারে। আমরা কিন্তু সূক্তের প্রথম মন্ত্রটিকে যেমন সৎ-বৃত্তির সম্বোধনমূলক (আত্ম-উদ্বোধনসূচক) বলে গ্রহণ করেছি, এই মন্ত্রটি এবং এর পরবর্তী মন্ত্রটিকেও সেই অনুসারী মনে করছি। এখানেও সম্বোধ্য-সৎ-বৃত্তি। আমরা প্রতিটি পদকে বিশ্লেষণ করে মন্ত্রের যে ভাব প্রাপ্ত হই, তা এই-সৎ-বৃত্তির প্রভাবে আমাদের এই জন্মজরামরণক্লেশহেতুভূত দেহধারণের বিনাশ, হোক; কেননা তার দ্বারাই আমরা সত্ত্বাবস্থায় সংবাহিত হয়ে থাকি ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ অসিতং তে প্রলয়নমাস্থানমসিতং তব। অসিস্যোষধে নিরিতো নাশয়া পৃষৎ ॥ ৩॥

 বঙ্গানুবাদ –হে সৎ-বৃত্তি! অজ্ঞানান্ধকার (মায়ামোহ-রূপ) তোমার উৎপত্তি-স্থান; আবার মায়ামোহ-রূপ অন্ধকারই : তোমার আশ্রয় (অবলম্বন); কর্মফলের অবসানে বিমুক্ত তুমি চিরনবীনতাসম্পন্ন হও; এক্ষণে, মায়ামোহ হতে উৎপন্ন সমুদ্রে বিন্দুবৎ এই দেহকে তুমি সর্বপ্রকারে নিঃশেষে বিনাশ (লয়) করে ফেল। ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যে প্রকাশ, এই মন্ত্রটি নীলি সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে। সেই অনুসারে মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ এই যে,-হে নীলি! তোমার প্রলয়নং অর্থাৎ উৎপত্তিস্থান অসিতং অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণ। সেখানেই তোমার আস্থানং অর্থাৎ সেখানে হতেই পুরুষগণ কর্তৃক তুমি আনীত হয়েছ এবং কৃষ্ণবর্ণ আছ। দ্বিতীয় অংশে ওষধে সম্বোধন আছে। ভাষ্যে প্রকাশ, এখানেও ঐ নীলির সম্বোধন। এখানকার ভাব এই যে,-হে ওষধে নীলি! তুমি অসিতবর্ণা হও। যেহেতু তোমার স্বভাব এরূপ, অতএব শ্বিত্ৰাদিরোগদূষিত অঙ্গে আলেপনাদির দ্বারা, তোমার সঙ্গ হেতু অঙ্গ হতে কিলাস ও পলিত পৃথকীকৃত করে নিঃশেষে বিনাশ করো। ফলতঃ, নীলি কুষ্ঠরোগ নাশ করুক–মন্ত্রে নীলির নিকট এমন প্রার্থনা করা হয়েছে। এটাই ভাষ্যের ভাবার্থ।–আমরা এই মন্ত্রের ভাবে যে অর্থ গ্রহণ করেছি, তা ভাষ্যকারের অর্থ হতে কিছুটা দূরত্বে অবস্থিত হলেও আধ্যাত্মিক ভাবপক্ষে পূর্বাপর সামঞ্জস্যপূর্ণ।–আমাদের যে সৎ-বৃত্তি, তার উৎপত্তি স্থান–আমাদের এই দেহ। জন্ম-জরা-মরণের অধীনতা পাশে আবদ্ধ, মায়ামোহ থেকে উৎপন্ন, এই দেহের অভ্যন্তরেই সৎ-বৃত্তির স্ফুর্তি হয়। সেই দেহের মধ্যে অবস্থিত থেকেই তা কার্য করে। অসিতং তে প্রলয়ং এবং অসিতং তব আস্থানং বাক্য দুটিতে সেই ভাব প্রকাশ করছে। ওষধে অসিকী অসি-এই বাক্যের ভাব প্রথম মন্ত্রেই প্রকাশ পেয়েছে। কর্মফলের অবসানে বিমুক্ত যে অবস্থা, তা চিরনবীন নিত্য–এই ভাব ঐ বাক্যে প্রকাশমান।–উপসংহারে এই মন্ত্রে কি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে, তা-ই লক্ষ্য করুন। আকাঙ্ক্ষা এই যে,জলবিন্দু যেমন সমুদ্রে বিলীন হয়, সৎ-বৃত্তির সাহায্যে আমি যেন সেইরকম সেই অনন্ত ব্রহ্ম-সমুদ্রে বিলীন হতে পারি। যদিও আমরা কর্মবশে এই জগতে পরিভ্রাম্যমান, তথাপি সৎ-বৃত্তির সাহায্যে যেন পরাগতি প্রাপ্ত হই।–আমরা মনে করি মন্ত্রের এটাই নিগূঢ় অর্থ ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্র: অস্থিজস্য কিলাসস্য তন্জস্য চ যৎ ত্বচি। দূষ্যা কৃতস্য ব্ৰহ্মণা লক্ষ্ম শ্বেতমনীনশং ॥ ৪

বঙ্গানুবাদ –হে সৎ-বৃত্তি! অস্থিজাত, দেহজাত, কর্মর্জাত, কলুষ-ক্লেদের যে কলঙ্ক দেহে লক্ষীভূত পাপচিহ্নরূপে প্রকাশমান, ব্রহ্মসম্বন্ধযুত হয়ে তুমি তার বয়সাধন করো। (ভাব এই যে, –দেহধারণ কর্মমূলক পাপচিহ্ন-জ্ঞাপক; সেই চিহ্ন লোপ প্রাপ্ত হোক) ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মন্ত্রের ভাব পরিগ্রহণের পক্ষে বিষম সমস্যায় পড়তে হয়। এই মন্ত্রের যে শ্বেতং পদ, তা হতে কুষ্ঠরোগ অর্থই সাধারণতঃ পরিগৃহীত হয়ে থাকে। অস্থির সাথে, ত্বকের সাথে, মাংসের সাথে ঐ ব্যাধির সম্বন্ধ। মন্ত্রের দ্বারা সেই ব্যাধির উপশম হোক–ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের অর্থে এই মাত্র ভাক প্রাপ্ত হওয়া যায়। আমরা যে ভাবে অর্থ পরিগ্রহণ করে আসছি, সেই পক্ষেই মন্ত্রের সঙ্গতি লক্ষ্য করি। যে কর্মের ফলে–অথবা যে পাপের প্রভাবে, আমাদের দেহধারণ করতে হয়; সে কর্ম বা সে পাপ, নানা রকমে সঞ্চিত হয়ে থাকে। ইহজীবনে আমরা আমাদের শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা পাপানুষ্ঠান করে থাকি। তার দ্বারা পুনরায় দেহ উৎপন্ন হয়। তাতে পাপের চিহ্নসমুদায়ও প্রকাশ পায়। সেই সকল পাপচিহ্নসমম্বিত দেহ যাতে চিরতরে লোপ পায়, সৎ-বৃত্তির সাহায্যে তার ব্যবস্থা হতে পারে। এখানে এই মন্ত্রে সেই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। আমার এ পাপ-সমুদ্ভূত দেহ লোপ-প্রাপ্ত হোক, আমি যেন ভগবানে আশ্রয় প্রাপ্ত হই,–এটাই মন্ত্রের মর্ম। ৪।

.

তৃতীয় সূক্ত : শ্বেতকুষ্ঠনাশনম্

[ঋষি : ব্রহ্ম দেবতা : আসুরী বনস্পতি ছন্দ : অনুষ্টুপ, পংক্তি ]

প্রথম মন্ত্রঃ সুপর্ণোজাতঃ প্রথমস্তস্য ত্বং পিত্তং আসিথ। ত আসুরী যুধা জিতা রূপং চক্রে বনস্পতী ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –হে জীব! প্রথমে তুমি ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুত (ঊর্ধ্বগতিপ্রাপ্তি-সামর্থ্য বিশিষ্ট) হয়ে জন্মগ্রহণ করো; কিন্তু আসুরী মায়া বিষম দ্বন্দ্বে তোমাকে জয় করে, তখন, তুমি ক্লেদবিশিষ্ট (পাপকলুষলাঞ্ছিত) দেহ প্রাপ্ত হও; তখন সেই মায়া তোমার হৃদয়-রূপ অরণ্যের অধিপতিগণকে (সত্ত্বভাব ইত্যাদিকে) মরণধর্মশীল দেহ প্রদান করে। (ভাব এই যে,–জন্মসহজাত সত্ত্বভাবসমূহ সংসারের কুটিল মায়ার প্রভাবে বিলুপ্ত হয়ে থাকে। তাতেই জীব নীচ গতি প্রাপ্ত হয়। তা হতে তুমি নিজেকে উদ্ধারের চেষ্টা করো) ॥ ১৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –প্রথমে ভাষ্যে এই মন্ত্রে কি ভাব পরিগৃহীত হয়েছে, তার একটু আভাষ প্রদান করি।–ভাষ্যে প্রকাশ, ঔষধের বীর্যাতিশয় প্রবচনের জন্য এখানে একটি উপাখ্যানের সমাবেশ হয়েছে। সেই অনুসারে সুপর্ণঃ পদে শোভনপক্ষদ্বয়বিশিষ্ট গরুড় পক্ষী অর্থ পরিগৃহীত। গরুড় পক্ষী প্রথমে দুটি পক্ষসহ জন্মগ্রহণ করে। তারপর মায়ার সাথে তার যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে আসুরী মায়া জয়যুক্ত হয়েছিল। এ বিষয়ে পুরাণেও নানা উপাখ্যান আছে। একটি উপাখ্যান এই যে,–গরুড়ের পক্ষে ইন্দ্রের বজ্র নিক্ষিপ্ত হয়; তাতে গরুড়ের যদিও কোনও অনিষ্ট হয় না; কিন্তু গরুড় বজ্রের বা ইন্দ্রের সম্মানার্থে একটি পক্ষ পরিত্যাগ করে। সে পক্ষটি সুবর্ণের ন্যায় মনোহর ছিল। ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ তাই গরুড়ের নাম সুপর্ণ রাখেন। ভাব এই যে, স্বর্ণপক্ষবিশিষ্ট ছিল বলে, গরুড় সুপর্ণ আখ্যা প্রাপ্ত হয়। যাই হোক, ঐ দুই রকম উপাখ্যানের সাথে এই মন্ত্রের যে কি সম্বন্ধ আছে, ভাষ্যে তা উপলব্ধ হয় না; যাই হোক ভাষ্যে টেনে-বনে মন্ত্রের একটা অর্থ করা হয়েছে। সে অর্থমন্ত্রটি নীলি প্রভৃতি ওষধিকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত; মন্ত্রে বলা হচ্ছে,–হে নীলি প্রভৃতি ওষধে! তুমি পূর্বে সেই গরুড়ের পিত্ত (পিত্তাখ্য দোষ) ছিলে। যুদ্ধে সেই পিত্তকে (তোমাকে) আসুরী মায়া জয় করে। জয় করে তোমাকে সে পিত্তরূপই প্রদান করেছিল। ঔষধাত্মক তোমাকে সেই দোষ-নিবারণে ব্যবহার করা কর্তব্য। তোমাদের রূপ এই যে, তোমরা বনস্পতি। এইভাবে নীলি প্রভৃতির সুপর্ণ-পিত্তত্ব প্রতিদানের দ্বারা, তাদের অমোঘবীর্যত্বের বিষয় কথিত হয়েছে। ভাষ্যের এটাই মর্ম। এ মর্মের মর্ম আমরা অবশ্য অনুধাবন করতে পারিনি।এখন, আমাদের বিশ্লেষণ সম্পর্কে কিছু বলি। আমরা মনে করি, মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। মন্ত্রের সম্বোধ্য–জীব অহং। মন্ত্রের অন্তর্গত তস্য পূর্বসম্বন্ধ খ্যাপন করছে। অর্থাৎ ভাষ্যকারের মতোই আমরাও মনে করি-পূর্বের দ্বিতীয় সূক্তের সাথে এই তৃতীয় সূক্তের সম্বন্ধ রয়েছে; অর্থাৎ উভয়ই লক্ষ্য সেই ভগবৎ-সম্বন্ধ প্রাপ্তি। মন্ত্রের তস্য পদ সেই সম্বন্ধের বিষয়ই জ্ঞাপন করছে। তারপর সুপর্ণঃ পদ। শব্দার্থ অনুসরণে শোভনপক্ষবিশিষ্ট অর্থ থেকে উধ্বগতিপ্রাপ্তিসামর্থযুত ভাব আমরা প্রাপ্ত হতে পারি। উদ্যমন–ভগবৎসামীপ্য-লাভ-মানুষের আকাঙ্ক্ষা। সুপর্ণঃ পদ সেইরকম. শক্তির বিষয় প্রকাশ করে। সত্ত্বভাবই সেই শক্তির নিদানভূত। সত্ত্বভাব থেকেই ঊর্ধ্বগতি লাভ হয়। প্রথমঃ জাতঃ পদদ্বয়ে জীবের জন্মসহচর হয়ে যে সত্ত্বভাব সংসারে প্রবেশ করে, তারই বিষয় প্রখ্যাত হয়েছে। এই অনুসারে মন্ত্রের প্রথম অংশের (ত্বং প্রথমঃ সুপর্ণঃ জাতঃ–এই বাক্যের) মর্ম হয় এই যে, হে জীব! তোমার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ভগবানের সাথে সম্বন্ধস্থাপনকারী ভগবাকে পাইয়ে দেবার পক্ষে উপযোগী সত্ত্বভাব তোমাতে সঞ্চিত থাকে। তারপর মন্ত্রের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অংশের ভাবসঙ্গতির বিষয় অনুধাবনীয়। সেই যে জন্মসহজাত সত্ত্বভাব–সে ভাব, সংসারের প্রলোভন ইত্যাদির মধ্যে পড়ে, মায়ামোহ ইত্যাদির সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়। আসুরী যুধা জিতা এই বাক্যাংশে সেই ভাব প্রাপ্ত হই। তখন যে কি অবস্থায় উপনীত হওয়া যায়, মন্ত্রের তৃতীয় অংশে সেই অবস্থার বর্ণনা দেখতে পাই। জীব তখন পাপকলুষলাঞ্ছিত (ক্লেদবিশিষ্ট) দেহ প্রাপ্ত হয়। পিত্তং পদে পাপ-কলুষলাঞ্ছিত দেহ বুঝিয়ে থাকে। পিত্তং আসিথ বাক্যে–সেই অবস্থা প্রাপ্তির বিষয় খ্যাপন করে। তা হতেই আমাদের এই জন্মজরামরণাধীন ও; দেহ-ধারণ। সত্ত্বভাব ইত্যাদিই আমাদের হৃদয়রাজ্যের অধিনায়কগণ। সত্ত্বভাব ইত্যাদি তখন সূক্ষ্ম অবস্থা পরিহার করে স্থূল অবস্থা ধারণে বাধ্য হয়। মায়া তখন আমাদের সৎ-বৃত্তিসমূহে অসৎ-ভাবের সংশ্রব ঘটিয়ে তাদের মরণধর্মশীল দেহ-উৎপত্তির কারণের মধ্যে পরিগণিত করে।–বনস্পতি পদে বেদে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকটিত করলেও আমরা দেখিয়েছি যে, ঐ পদে হৃদয়রূপারণ্য স্বামিনঃ, সত্ত্ববাদীন অর্থই সমীচীন ও সঙ্গত (বন অর্থে অরণ্য এবং পতি অর্থে স্বামী)। এ থেকেই হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব ইত্যাদি অর্থ সূচিত হয়। রূপং পদে বিনাশধর্মশীল দেহকে বুঝিয়ে থাকে।–এই সব বিবেচনা করলে মন্ত্রের শেষাংশের ভাব দাঁড়ায়,মায়ার দ্বারা আহত হয়ে আমরা যে দেহ প্রাপ্ত হই, সত্ত্বভাবের নাশে তার উৎপত্তি হয়ে থাকে। জীর! সেই দেহ-প্রাপ্তির পক্ষে তুমি সতর্ক হও। এই রকম আত্ম-উদ্বোধনায় সৎ-বৃত্তিকে উদ্বুদ্ধ করাই এই মন্ত্রের লক্ষ্য বলে মনে করি। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ আসুরী চক্রে প্রথমেদং কিলাসভেষজং ইদং কিলাসনাশনং। অনীনশৎ কিলাসং সরূপাং অকরৎ ত্বং ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –আসুরী মায়া প্রধান হয়ে (শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে) জন্মজরামরণ-কবলিত ধ্বংসশীল এই দেহ প্রদান করেন; আর, আমাদের হৃদয়স্থিত সেই শুদ্ধসত্ত্বভাব, আমাদের কলুষক্লেদ-নিবৃত্তিকারক ঔষধ-স্বরূপ হয়ে কলুষক্লেদ বিদূরণে সমর্থ হন; সেই শুদ্ধসত্ত্বই কলুষক্লেদকে দূর করেন এবং এই ত্বগাদি-ধাতুবিশিষ্ট কায়াকে প্রকৃত-রূপ-সম্পন্না (মোক্ষপথপ্রাপিকা) করেন। (ভাব এই যে,–মায়ার প্রভাবে আমরা মরদেহ প্রাপ্ত হই; শুদ্ধসত্ত্ব। আমাদের নিত্য অবিনশ্বর কায়া প্রদান করেন) ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যে এ মন্ত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব দেখি। তাতে ভাব আসে,–আসুরী মায়াই আমাদের কিলাস-নামক ভেষজ দান করে এবং সেই মায়াই কিলাস অপনোদন করে আমাদের স্বরূপ প্রদান করে থাকে। এ পক্ষে ভাষ্যের অভিমত এই যে,-পূর্ব মন্ত্রে উক্তা অসুরমায়ারূপা স্ত্রী শিতচিকিৎসার আদিভূতা হয়ে এই সুপর্ণপিত্তের দ্বারা নির্মিত নীলি প্রভৃতি কিলাস-ভেষজকে, কিলাসের (শ্বিত্রের-কুষ্ঠের) নিবর্তক ঔষধকে, প্রস্তুত করেছেন। সেই হেতু নীলি প্রভৃতি অধুনা লোকে কিলাসনামক অর্থাৎ শিরোগের নিবর্তক হয়েছে। তাতে নীলি প্রভৃতি ঔষধ প্রয়োগে শ্বিরোগ বিনাশপ্রাপ্ত হয়, এবং শ্বিদূষিত তৃগ্ধাতু সমানরূপ পায়, অর্থাৎ শিরহিত ত্ব সমানবর্ণ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এ থেকে নীলি প্রভৃতি যে কুষ্ঠরোগ নিবারণের ঔষধ, তা-ই বুঝতে পারা যায়। আমরা মন্ত্রটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছি। প্রথমতঃ আসুরী মায়ার যে কর্ম, তা-ই প্রখ্যাপিত হয়েছে। মায়া যখন প্রধান স্থান অধিকার করে, মায়া যখন প্রবলা হয়, তখনই ধ্বংসশীল দেহের উৎপত্তি হয়ে থাকে। মায়িক এই দেহ, মায়ার প্রভাবেই উৎপন্ন হয়। মন্ত্রের প্রথমাংশের (আসুরী প্রথমা ইদং চক্রে–বাক্যাংশের) এটাই মর্মার্থ। তারপর, শুদ্ধসত্ত্বই যে কলুষক্লেদ নিবৃত্তির ঔষধস্বরূপ, শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবেই যে আমরা আমাদের কলুষক্লেদকে অপসৃত করতে পারি, মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে (ইদং কিলাসভেষজং কিলাসনাশকং–এই মন্ত্রাংশে) এই ভাবই বর্তমান। মন্ত্রের এই দুটি অংশের মর্ম হৃদয়গত হলেই, শেষাংশের মর্ম উপলব্ধির পক্ষে আর কোনও সংশয় আসতে পারে না। শুদ্ধসত্ত্বভাবই যে কলুষ-ক্লেদ নাশ করতে সমর্থ হয়, শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারাই যে এই পঞ্চভূতাত্মক দেহ মোক্ষপথের। অধিকারী হতে পারে,–এখানে সেই ভাব পরিব্যক্ত। সেই লক্ষ্য রেখেই ত্বচং আর সরূপাং পদ দুটির প্রতিবাক্যে আমরা যথাক্রমে ত্বগাদিধাতুবিশিষ্টাং কায়াং এবং প্রকৃতরূপসম্পন্নাং মোক্ষপথ প্রাপিকাং প্রতিবাক্য পরিগ্রহণ করেছি। ফলতঃ, একপক্ষে নিত্যসত্যতত্ত্ব প্রকাশক, পক্ষান্তরে আত্ম-উদ্বোধনমূলক এই মন্ত্রের ভাব এই যে,মায়া এই মরদেহকে সৃষ্টি করছে, শুদ্ধসত্ত্বভাব তাকে অমরত্ব দিচ্ছে। আত্ম-উদ্বোধনার পক্ষে মন্ত্রের ভাব এই যে,জীব! মায়ার মোহ পরিত্যাগ করো। শুদ্ধসত্ত্বসঞ্চয়ে প্রবুদ্ধ হও। তাই তোমার শ্রেয়ঃসাধক।-এটাই আমাদের অভিমত ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ সরূপা নাম তে মাতা সরূপো নাম তে পিতা। সরূপকৃৎ ত্বমোষধে সা সরূপমিদং কৃধি ॥ ৩॥

বঙ্গানুবাদ –কর্মফলের অবসানে বিমুক্তদেহ হে সৎ-বৃত্তি! তোমার মাতা নামে সরূপা অর্থাৎ সমানরূপা, তোমার পিতা নামে সরূপ অর্থাৎ সমানরূপ; তুমিও সমানরূপপ্ৰদাত্রী হও; সেই তুমি (সমানরূপ-মাতাপিতা হতে উৎপন্ন) এই দেহকে সমানরূপসম্পন্ন করো। (ভাব এই যে-সৎ-বৃত্তি সত্ত্বভাব হতেই সমুৎপন্ন এবং সত্ত্বভাব-প্রদানে সমর্থ; সেই সৎ-বৃত্তি আমাদের সৎ-ভাবসম্পন্ন করুক) ৩

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা –ভাষ্যে প্রকাশ, এই মন্ত্রটিও নীলি প্রভৃতি ওষধিকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের ভাব এই যে,-হে ওষধে! তোমার জননী ভূমি, তিনি সরূপা অর্থাৎ তোমার সাথে সমান-কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্টা। এইরূপ, তোমার পিতা দ্যুলোক (আকাশ)। (অথবা, পিতৃ শব্দে বীজবিশেষকে বুঝিয়ে থাকে)। সেও সরূপ অর্থাৎ তোমার সাথে সমানবর্ণ। উভয় স্থলেই নাম শব্দ প্রসিদ্ধবাচক। মন্ত্রের প্রথম পাদে এইরকম অর্থ ভাষ্যে প্রকাশমান। মন্ত্রের দ্বিতীয় পদের অর্থ, ভাষ্যে প্রকাশ,–হে ওষধে (অর্থাৎ নীলি প্রভৃতি রূপসম্পন্ন)! তুমি স্বরূপকৃৎ অর্থাৎ সংসৃষ্ট পদার্থকে আত্মসমান বর্ণ প্রদান করো। সমানরূপ পিতামাতা হতে উৎপন্ন, সেই তুমি এই শিরোগদূষিত অঙ্গকে সমানবর্ণ দান করো। ভাষ্যানুসারে, মন্ত্রের এইরকম অর্থ প্রচলিত।–আমরা কিন্তু আধ্যাত্মিক ভাব-পক্ষে ওষধে পদে শুদ্ধসত্ত্ব অবস্থাপ্রাপ্ত সৎ-বৃত্তিকে বুঝেছি। এখানেও আমরা মন্ত্রটিকে তিন অংশে বিভক্ত করেছি। প্রথমাংশে সবৃত্তির একটু পরিচয় দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে–সৎ-বৃত্তি সত্ত্বভাব হতেই উৎপন্ন, সত্ত্বভাবই তার পোষক। পিতা ও মাতা যথাক্রমে সরূপ ও সরূপা। সতেই সতের অবস্থিতি। সতেই সতের উৎপত্তি। এখানে পিতামাতার পরিচয়েই বুঝতে পারি ওষধি সৎ-বৃত্তিই। দ্বিতীয় অংশে সবৃত্তির শক্তির বিষয় প্রখ্যাত হয়েছে। বলা হচ্ছে,-তুমি সমানরূপপ্ৰদাত্রী। বাস্তবিক, সৎ-ভাবেই সৎস্বরূপকে পাওয়া যায়। উপসংহারে-মন্ত্রের শেষাংশে (সা ইদং সরূপং কৃধি-বাক্যে) আত্ম-উদ্বোধনার ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে-হে আমার সৎ-বৃত্তি! তুমি আমাকে সত্ত্বভাবাপন্ন করো। আর তার ফলে, আমার এই জন্মজরামরণবন্ধন-হেতুভূত দেহ তোমার সমানরূপ সৎ-অবস্থা প্রাপ্ত হোক।–আমরা মনে করি, মন্ত্রে এই ভাবই, এই আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পেয়েছে ॥ ৩

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ শ্যামা সরূপংকরণী পৃথিব্যা অধ্যক্তৃতা। ইদমূ ষু প্র সাধয় পুনা রূপাণি কল্পয়॥ ৪।

বঙ্গানুবাদ –সমানরূপদাত্রী (অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্নকারিণী) অজ্ঞানান্ধকাররূপা অসৎ-বৃত্তি ইহসংসারের মধ্যেই নিত্য উৎপন্ন হচ্ছে; অতএব, হে সৎ-বৃত্তি! তুমি এই কলুষক্লেদযুক্ত দেহকে সুষ্ঠুভাবে প্রকৃষ্টরূপে সাধুভাবাপন্ন (সৎ-ভাবান্বিত) করো; আর, সর্বতোভাবে তাতে সত্ত্বভাবের সম্পাদন করো। (ভাব এই যে,–অজ্ঞানান্ধকারে পৃথিবী সদাকাল আচ্ছাদিত হচ্ছে; অতএব, হে সৎ-বৃত্তি, তোমার প্রভাবে আমরা যাতে জ্ঞানালোক প্রাপ্ত হই, অজ্ঞানতার দ্বারা আচ্ছন্ন না হই, তা-ই করো)। ৪।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রও নীলি প্রভৃতির সম্বোধনে প্রযুক্ত। নীলি প্রভৃতি ওষধি শ্যামা অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণা। কৃষ্ণবর্ণের মিশ্রণে অন্য দ্রব্য কৃষ্ণবর্ণ হয়, কৃষ্ণবর্ণ অন্য বর্ণকে কৃষ্ণবর্ণ প্রদান করে। তাদের সংস্পর্শে অন্য দ্রব্য কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্ত হয়। তাই তাকে (ঐ ওষধিকে) সরূপংকরণী বলা হয়েছে। সেই যে কৃষ্ণবর্ণপ্রদানকারিণী, তাকে বলা হচ্ছে,-তুমি ভূমির উপরে উদ্ভূত হও,–আসুরী মায়ার দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাক। এই কারণে, হে ওষধে! তুমি এই কিলাসাক্রান্ত অঙ্গকে সুষ্ঠুভাবে রোগনিমুক্ত করো; আর ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার পূর্বের যে রূপ, তাকে ফিরিয়ে দাও,ব্যাধিদূরীকরণের পর আমায় স্বাভাবিক রূপ প্রদান করো। ভাষ্যানুসারে মন্ত্রে এই ভাবই প্রাপ্ত হই। সে পক্ষে, ওষধি-সম্বোধনে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়–এটাই প্রখ্যাত।-কুষ্ঠরোগনাশে মন্ত্র এবং মন্ত্রকথিত ঔষধ ইত্যাদি যে সুফল প্রদান করে, সেই পক্ষে আমরা সংশয় রাখি না। তবে আমাদের মত এই যে, এই মন্ত্রে পক্ষান্তরে ভবব্যাধি নাশের আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, মন্ত্রান্তর্গত প্রথম পদ- শ্যামা। ঐ পদের কৃষ্ণবর্ণা প্রতিবাক্য থেকেই ভাব আসে–অজ্ঞানান্ধকাররূপা। এখন বুঝে দেখুন–কে সেই অজ্ঞানরূপা? সে সেই অসৎ-বৃত্তি নয় কি? অসৎ-বৃত্তিই অজ্ঞানরূপা। সে-ই আবার অন্যকে আচ্ছন্ন করে। তাই মন্ত্রের দ্বিতীয় পদ-সরূপংকরণী। ঐ পদে শ্যামা যে কেমন, শ্যামা যে কি শক্তিশালিনী, তারই পরিচয় প্রদত্ত হয়েছে। অসৎ-বৃত্তিই। অজ্ঞানতারূপা–অজ্ঞানতার জননী; আর অজ্ঞানতার ধর্মই আচ্ছন্ন করা। যে অজ্ঞানরূপা, তার কার্যই অজ্ঞানতার দ্বারা হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলা। তাই সরূপংকরণী পদের সার্থকতা। সেই অজ্ঞানতারূপা। অসৎ-বৃত্তির জন্মস্থান যে এই পৃথিবী, তাতে আর কি সংশয় আছে? পার্থিব মায়ামোহের মধ্যেই অসৎ-বৃত্তির উৎপত্তি হয়। পৃথিব্যা অধি উদ্ভূতা (উদ্ভূতা)-বাক্যাংশে–এই ভাবই ব্যক্ত হয়েছে। এর পর মন্ত্রের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশের অর্থ-সঙ্গতির বিষয় লক্ষ্য করা যাক। এই অংশ সৎ-বৃত্তির সম্বোধনমূলক। প্রথমে অসৎ-বৃত্তির কার্যের বিষয় প্রখ্যাত হয়েছে। তার পর, সৎ-বৃত্তিকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে,-তুমি আমায় সৎ-ভাবান্বিত করো; তুমি আমাকে সরূপ প্রদান করো। অসৎ-বৃত্তি অজ্ঞানান্ধকারে সংসারকে ঘিরে আছে। হে আমার সৎ-বৃত্তি! তুমি উদ্বুদ্ধ হও। আমাদের অসৎ-বৃত্তি অজ্ঞানান্ধকার দূর হোক।–আমরা মনে করি মন্ত্র এই ভাবই দ্যোতনা করছেন। ৪

.

চতুর্থ সূক্ত : জ্বরনাশনম্

 [ঋষি : ভৃগুঅঙ্গিরা দেবতা : যক্ষ্মনাশুনোহগ্নি ছন্দ : ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ]

প্রথম মন্ত্রঃ যদগ্নিরাপো অদহৎ প্রবিশ্য যত্রাকৃথন ধর্মপ্‌তো নমাংসি। তত্র ত আহুঃ পরমং জনিং স নঃ সংবিদ্বান পরি বৃদ্ধি তক্মন ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –যে কারণে দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত জ্ঞানদেবতা হৃদয়ে প্রাদুর্ভূত হয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রদীপ্ত (উন্মোষিত) করেন (অথবা, অজ্ঞানান্ধকার বা মায়ামোহ নাশ করেন); যে কারণে সেই জ্ঞানদেবতা আমাদের সম্যক্ জ্ঞানবান্ করেন; সেই কারণে, হে পাপ (পাপপ্রবৃত্তিপ্রবর্ধক)! তুমি আমাদের পরিত্যাগ করো। যে জ্ঞানাগ্নিতে ভগবগানুসারিগণ আহুতিস্বরূপ সত্ত্বভাব ইত্যাদি প্রদান করেন, হে জীব! সেই অগ্নিতেই তোমার শ্রেষ্ঠ-নিবাসস্থান নির্দিষ্ট (জেনো)। (ভাব এই যে–হে জীব! পাপ-সম্বন্ধ পরিহার করে জ্ঞানলাভে প্রবুদ্ধ হও। তাহলে সেই শ্রেষ্ঠ নিবাস-স্থান ভগবানকে পাবার নিমিত্ত তোমার সামর্থ্য জন্মাবে) ৷৷ ১. 

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— মন্ত্রটি বড় সমস্যামূলক। সূক্তানুক্রমণিকায় দেখতে পাই,জ্বর ইত্যাদি রোগ-নিবারণে এই মন্ত্র এবং এর পরবর্তী মন্ত্র-কয়েকটি প্রযুক্ত হয়। ঐকাহিক, দ্বি-আহিক (একদিন, দুদিন) প্রভৃতি জ্বর, কম্পজ্বর, সন্তত (জ্বালাযুক্ত বা সন্তাপক) জ্বর, বেলাজ্বর প্রভৃতি বিদূরিত করবার জন্য মন্ত্র-প্রয়োগের সার্থকতা। সেই অনুসারে যে প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অবলম্বিত হয়, সূক্তানুক্রমণিকায় তা নিম্নরূপে বিবৃত হয়েছে;যথা,–প্রথমতঃ একটি লৌহকুঠার অগ্নির তাপে উষ্ণ করণীয়। উষ্ণ জলের মধ্যে সেই কুঠার স্থাপন পূর্বক, সেই জলে রোগীর দেহ সিঞ্চিত করা কর্তব্য। এইরকম প্রক্রিয়া প্রয়োগের সময় মন্ত্র-জপের বিধিও অনুক্রমণিকায় পরিদৃষ্ট হয়।–ভাষ্যে মন্ত্রের যে অর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে, তার মর্মের মর্ম এই যে, অঙ্গনাদিগুণযুক্ত অগ্নিদেব তপ্তপরশু-সহযোগে জলের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে তাকে দগ্ধ (তা হতে কাথ আকর্ষণ) করেছেন। এই হেতু জলের মধ্যে ঔষ্ণগুণযুক্ত অগ্নি বিদ্যমান আছেন। অগ্নি-বিশিষ্ট উষ্ণোদকের দ্বারা রুগ্ন ব্যক্তিকে অভিষিঞ্চিত করা হচ্ছে, এই জন্য, হে শরীরের কষ্টদায়ক জ্বর, তুমি তোমার উৎপত্তিকারণবিৎ অগ্নির সাথে আমাদের শরীর পরিত্যাগ করে নির্গত হও। (অর্থাৎ শরীরে উষ্ণোদক সিঞ্চিত হচ্ছে; সেই উষ্ণ জলের উষ্ণতার সাথে জ্বরের উষ্ণতা প্রশমিত হোক–এই ভাব এখানে প্রকটিত)। [ আমাদের মনে হয়–অধুনা চিকিৎসকগণ দুরারোগ্য জ্বরে উষ্ণোদকে গামছা বা বস্ত্র সিক্ত করে রোগীর দেহ মুছিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। তাতে অনেক সময় জ্বর আরোগ্য হয় এবং রোগী সুস্থতা লাভ করে– মন্ত্রে সেইরকম ব্যবস্থা-প্রক্রিয়ারই মূল সূত্র প্রকটিত]। যাগ ইত্যাদি অনুষ্ঠানকারী যজমানগণ যে অগ্নিতে হবিলক্ষণ অন্ন ইত্যাদি প্রদান করেন, হে জ্বর! সেই অগ্নিতেই তোমার জন্ম বলে কথিত হয়। চিকিৎসকগণ বলেন,অগ্নি দুষ্ট হলেই জ্বর-বিকার প্রভৃতির উৎপত্তি হয়ে থাকে। অগ্নিসাধনভূত জলে অগ্নির বিদ্যমানতা। হেতু, সেই অগ্নি তোমাকে দগ্ধ করছে। অতএব তুমি (অর্থাৎ জ্বর) আমাদের শরীর পরিত্যাগ করে উষ্ণোদক-প্রবিষ্ট তোমার উৎপত্তিমূলীভূত অগ্নির সাথে নির্গত হও, অর্থাৎ আমাদের পরিত্যাগ করো। আমাদের অর্থ কিন্তু আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। বোধ-সৌকর্যার্থে মন্ত্রটিকে আমরা চার অংশে বিভক্ত করেছি। প্রজ্ঞানরূপী ভগবান হৃদয়ে জ্ঞানরূপে অধিষ্ঠিত হয়ে অজ্ঞানান্ধকার নাশ করেন; অজ্ঞানতা দূর হয়ে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের উন্মেষ হয়; ফলে মায়ামোহের আবরণ নষ্ট হয়ে যায়,-মন্ত্রের প্রথম অংশে (যৎ হতে অদহৎ পর্যন্ত অংশে) এই ভাবই পরিব্যক্ত বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি-মন্ত্রে জ্ঞানের উদয়ের, অজ্ঞানতা-নাশের, পাপকলুষ-বিধ্বংসের এবং মায়ামোহরূপ ভববন্ধন মোচনের সত্য-তত্ত্ব নিহিত রয়েছে।-মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশে (সঃ হতে সংবিদ্বান্ পর্যন্ত অংশে) জ্ঞানদেবের নিকট সম্যক জ্ঞান লাভের প্রার্থনা জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে-হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! আপনি আমাদের সম্যক জ্ঞান প্রদান করুন। প্রথমাংশে বলা হলো,-জ্ঞানদেবতা হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়ে অজ্ঞানতা নাশ করেন এবং শুদ্ধসত্ত্বভাবের উন্মেষ করে দেন। দ্বিতীয় অংশে তাই প্রার্থনা–(অতএব) তিনি আমাদের হৃদয়ে উদিত হয়ে, আমাদের বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রদান করুন। তৃতীয় অংশের ভাব, পূর্ববর্তী অংশ দুটির সাথে সামঞ্জস্য-বিধানে এই হয় যে,-হে সৎ-ভাব-ক্ষয়কারী পাপবৃত্তি! তোমরা আমাদের পরিত্যাগ করো। মন্ত্রের শেষাংশে (যত্র হতে আহু পর্যন্ত অংশে) ভগবানই যে পরম আশ্রয়স্থান, তাঁর হতেই যে উৎপত্তি আর তাতেই যে লয় হতে হবে,–সেই ভাব প্রকাশ পেয়েছে।–এইরকম বিশ্লেষণে মন্ত্রের যে ভাব হয়– আমরা বঙ্গানুবাদে তা ব্যক্ত করেছি; অর্থাৎ-পাপপ্রকৃতি নাশ করো, সৎ-ভাবের সমাবেশ হোক। তাহলে, উৎপত্তিমূল ধ্বংস হবে। তাহলে, সেই শ্রেষ্ঠনিবাসস্থান ভগবানে আশ্রয় লাভ করতে পারবে। আমাদের মনে হয়–মন্ত্রে, আধ্যাত্মিক পক্ষে, এই ভাবই পরিব্যক্ত ॥ ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ যদ্যৰ্চির্যদি বাসি শোচিঃ শকল্যেষি যদি বা তে জনিং। হ্রভুর্নামাসি হরিতস্য দেব স নঃ সংবিদ্বান পরি বৃদ্ধি তক্মন্ ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হে কৃচ্ছ্বজীবনকারী পাপ (অথবা পাপকারণভূত জ্বর)! যেহেতু তুমি দাহকর, যেহেতু তোমার উৎপত্তিস্থান জ্বলননিদানভূত অগ্নি, যেহেতু হরিৎ-বর্ণ রক্তশোষক (বলেই) তোমার পরিচয় প্রসিদ্ধ হয়; সেই ভীষণতাসম্পন্ন তুমি, আমাদের পরিত্যাগ করো। আর, দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত হে জ্ঞানদেব! আপনি আমাকে সম্যক জ্ঞানবান্ করুন। (ভাব এই যে,অজ্ঞানতাই পাপসন্তাপ মূলক। অতএব প্রার্থনা,পাপ! তুমি দূর হও। হে জ্ঞানদেব! আপনি জ্ঞানদানে আমাদের সর্বৰ্থা পরিত্রাণ করুন) ২

অথবা,

হে পাপ! যদিও তুমি স্বভাবতঃ জ্বালাকর, যদিও তুমি স্বভাবতঃ দাহকর, যদিও তোমার উৎপত্তি স্থান দাহ্য-পদার্থ, যদিও তোমার রক্তশোষক নাম সর্বত্র প্রসিদ্ধ আছে; তথাপি হে দেব! আমাদের মধ্যে তোমার উৎপত্তিকারণ অবগত হয়ে, সেই ভীষণতাসম্পন্ন তুমি, কৃপাপূর্বক আমাদের কে ত্যাগ করে যাও। ২

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রে দুরকম সম্বোধন আছে। এক সম্বোধন–তক্মন্ (পূর্ব মন্ত্রে আমরা এই পদটির অর্থ আমনন করেছিলাম–পাপ প্রবৃত্তি); অন্য সম্বোধন দেব। মন্ত্রার্থে দুই সম্বোধন একজনকে লক্ষ্য করে প্রযুক্ত হয়েছে বলেও মনে করা যায়;–আবার দুই সম্বোধনের লক্ষ্য যে দুরকম স্বতন্ত্র বস্তু, তা-ও মনে করতে পারি। পূর্বোক্ত দুরকম অর্থে আমরা এই দুই ভাবই ব্যক্ত করেছি। একরকম অর্থে তক্মন সম্বোধনে (পূর্বের মন্ত্রের ন্যায়) পাপকে সম্বোধন করে তাকে দূর হতে বলা হয়েছে; আর, সে পক্ষে দেব সম্বোধনে দেবতার অনুগ্রহের প্রার্থনা রয়েছে। দ্বিতীয় রকম অর্থে, পাপকেই যেন মিনতি করে বলা হচ্ছে,–হে পাপ! আর আমায় কষ্ট দিও না। যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছ। এখন তুমি আমায় ত্যাগ করো। আমি তোমার শরণাপন্ন। ইহসংসারে দেখতে পাই, শত্রুকে বিমর্দিত বা বশীভূত করতে হলে হয় আত্মশক্তির প্রয়োগ নয় অনুগ্রহ প্রার্থনার আবশ্যক হয়। এখানে দুই অর্থে সেই দুই ভাবই প্রকাশ পেয়েছে। বুঝতে হবে। ভাষ্যে কিন্তু প্রকাশ এই মন্ত্রটিও প্রথম মন্ত্রের মতোই জ্বর-ব্যধি-নাশের উদ্দেশে প্রযুক্ত হয়। এই সূক্তের চারটি মন্ত্র জ্বরের প্রকোপ নাশ উপলক্ষেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট ক্রিয়ার পর এই সকল মন্ত্রে শান্তিজল গ্রহণের বিধি আছে। জ্বর-নাশের পক্ষে যে ভাবই এই মন্ত্রের প্রয়োগ-বিধি থাকুক, সে বিষয়ে আমাদের বলবার কিছুই নেই। আমরা, আধ্যাত্মিক পক্ষে, মন্ত্রের নিগূঢ় ভাবার্থ নিয়েই আলোচনা করব। ভাষ্যের মত এই যে, এই মন্ত্রে জ্বরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে-কৃচ্ছ্বজীবনকারি হে জ্বর! যদিও তুমি উষ্ণগুণযুক্ত হও, যদিও তুমি শরীরসন্তাপক হও, যদিও তোমার জন্ম অগ্নি হতেই হয়েছে, তথাপি হে দেব (জ্বর)! তুমি পুরুষশরীরে পীতবর্ণের উৎপাদক রূঢু নামে প্রসিদ্ধ হও। যদিও তোমার অনেক নাম আছে, তথাপি ঐ নামে তোমার প্রসিদ্ধি। তুমি এখন আমাদের পরিত্যাগ করে, তোমার স্বকারণভূত অগ্নিকে জ্ঞাত হয়ে, সেই অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করো। মন্ত্রের এই ভাবের অর্থই সাধারণতঃ প্রচলিত আছে।–আমরা পূর্বেই বলেছি, এই মন্ত্রের তক্মন্ এবং দেব এই দুই পদে এক অর্থে পাপকে এবং অন্য অর্থে পাপনাশকারী দেবতাকে সম্বোধন করা হয়েছে। এক রকম অর্থে, তক্স–পদে পাপের এবং দেব পদে জ্ঞানাধার দেবতার সম্বোধন লক্ষ্য করা যায়। প্রথমতঃ পাপকে বলা হচ্ছে,হে সন্তাপকারক দারুণক্লেশপ্রদ পাপ! তুমি আমায় ত্যাগ করো, আমার সম্বন্ধ ত্যাগ করে দূরে চলে যাও। তোমার সংস্পর্শে আমায় যেন আর থাকতে না হয়। এইভাবে পাপের সংস্পর্শ-ত্যাগের উদ্বোধনার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানাধার দেবতার নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে-হে দেবতা! আপনি আমায় জ্ঞানদান করুন। অজ্ঞানতাই সকল পাপের মূল। অজ্ঞানতা দূরীভূত হলেই আমি যন্ত্রণা হতে নিষ্কৃতি পাই। এই মন্ত্র এই ভাবের প্রার্থনা নিয়েই প্রকাশ পেয়েছেন। পাপ দূর হোক–এটাই মন্ত্রের নিগূঢ় লক্ষ্য। দ্বিতীয় রকম অর্থে, ঐ একই ভাব প্রাপ্ত হই। তবে সে অর্থে দেব সম্বোধনও পাপ-পক্ষেই যুক্ত হয়। প্রসঙ্গতঃ, মন্ত্রান্তর্গত একটি পদ বড়ই সমস্যামূলক। সে পদটি হুড়ুঃ। ঐ পদটির নানারকম পাঠ দেখতে পাওয়া যায়। সায়ণ-ভাষ্যে এটির রূঢ়ঃ পাঠ পরিগৃহীত হয়েছে। কোথাও হ্রড়ঃ, কোথাও বা হ্রচুঃ পাঠ দেখা যায়। কখনও বা হ-কার হ্রস্ব-উকারান্ত, কখনও বা দীর্ঘ-উকারান্ত পরিদৃষ্ট হয়। ঐ পদটি যে কি অর্থ দ্যোতনা করে, তা বোঝবার উপায় নেই। সায়ণ ঐ পদের ব্যুৎপত্তি-মূল রুহ, ধাতু নির্দেশ করেছেন; তার অর্থ,বীজজন্মনি প্রাদুর্ভাবে। ঐ পদের সাথে রূঢ়-পদের সাদৃশ্য-সম্বন্ধ পরিলক্ষিত হয়। সেই অনুসারে, ঐ পদে প্রবৃদ্ধ প্রসিদ্ধ প্রভৃতি অর্থ গ্রহণ করতে পারি; আর, সেই অর্থেই ভাবের সঙ্গতি থাকে। ঐ পদকে পাপের প্রতিবাক্যস্বরূপ মনে করা যেতে পারে। পাপ যে রক্তশোষক বলে প্রসিদ্ধ, পাপ যে জীবনকে শোষণ করে, বিকৃত করে ফেলে, হরিতস্য নাম হূড়ুঃ অসি এই বাক্যে প্রখ্যাত হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত হরিতস্য পদ উপমার ভাবে শোষকতার পরিচয় দেয়। জ্বররোগে রক্তশূন্যতার অবস্থা উপস্থিত হলে দেহ হরিদ্বর্ণ প্রাপ্ত হয়। রক্তশূন্য ও হরিদ্বর্ণ-প্রাপ্ত দেহ যেমন মানুষকে মৃত্যুর পথে আকর্ষণ করে; পাপ সেইরকম জীবকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। অজ্ঞানতাই পাপের মূল বা পাপমূর্তিতে বিদ্যমান। সেই অজ্ঞানতাকে দূর করবার জন্যই এই মন্ত্রে জ্ঞানদেবতার স্মরণ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রের সম্বোধ্য যে জ্বর বলে কথিত হয়, তাতে কি সার্থকতা আছে–বুঝতে পারিনা। জ্বরকে সম্বোধন করলে, জ্বরের কি শক্তি আছে যে, সে অপসৃত হবে? ঔষধের দ্বারা জ্বরকে অপসারণ করতে হয়। এখানে অজ্ঞানতারূপ জ্বরকে বা পাপকে জ্ঞানের সাহায্যে বিতাড়িত করতে হবে। উপসংহারে মন্ত্রের সম্বোধ্য দেব পদের বিষয় একটু আভাষ দেওয়া যাক। পাপকে সম্বোধনে ঐ পদ প্রযুক্ত হলেও ঐ সম্বোধনে তার সন্তুষ্টি-সম্পাদনের ভাব আসে। আমাদের শাস্ত্রে দেবতার ও অপদেবতার উভয়েরই পূজার বিধি আছে। এ পক্ষে সেই ভাবই গ্রহণ করা যায়। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যদি শশাকো যদি বাভিশোকো যদি বা রাজ্ঞো বরুণস্যাসি পুত্রঃ। হ্রভুর্নামাসি হরিতস্য দেব স নঃ সংবিদ্বান পরি বৃদ্ধি তক্মন্ ॥ ৩

বঙ্গানুবাদ –হে কৃচ্ছ্বজীবনকারী পাপ! যেহেতু তুমি শোক (তাপক), যেহেতু তুমি সর্বশরীরে সন্তাপক, যেহেতু তুমি মিথ্যাসহজাত হও, যেহেতু রক্তশোষক (বলেই) তোমার পরিচয় প্রসিদ্ধ হয়; পূর্বোক্তরূপ ভীষণতাসম্পন্ন সেই তুমি, আমাদের পরিত্যাগ করো। আর, দীপ্তিদানাদিগুণযুত হে জ্ঞানদেব! আপনি আমাদের সম্যক জ্ঞানবান্ করুন। (এখানে, পাপ-সম্বন্ধ ত্যাগের কামনার সাথে জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে)। ৩।

অথবা, এই প্রসঙ্গে পূর্বৰ্মন্ত্রের ব্যাখ্যা (দেব সম্বোধন প্রভৃতি বিষয়ে) দ্রষ্টব্য ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের ভাবও পূর্বমন্ত্রেরই অনুরূপ। এমনকি, এই মন্ত্রের একটি চরণই পূর্বমন্ত্রের অনুবৃত্তি মাত্র-ডুর্নামাসি…তক্স। তবে এই মন্ত্রে তক্স পদে শীতজ্বরকে, কম্পজ্বরকে সম্বোধন করা হয়েছে,–এটাই ভাষ্যের অভিমত। এ ছাড়া এই মন্ত্রে তিনটি বিষয় নূতন আছে; প্রথম — শোকঃ, দ্বিতীয়–অভিশোকঃ, তৃতীয়–রাজ্ঞো বরুণস্য পুত্রঃ। এর মধ্যে শেষোক্ত পদটিই বিশেষ সমস্যামূলক। প্রথম দুটি পদের ভাব সহজেই অধিগত হতে পারে। এক পদে আত্মীয়স্বজন-সংক্রান্ত শোক বা তাপ, অন্য পদে আত্মসম্পর্কিত শোক বা তাপ বোঝাচ্ছে–মনে করতে পারি। কিন্তু রাজ্ঞো বরুণস্য পুত্রঃ বলতে কি ভাব প্রাপ্ত হই? সায়ণ রাঃ পদে রাজমানস্য, বরুণস্য পদে পাপকারিণাং শিক্ষকস্য প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাতেও কিছু বোধগম্য হয় না। তবে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের বচন হতে এবং পুরাণের মতে বরুণাত্মজা পদের অর্থ হতে, রাজ্ঞঃ বরুণস্য পুত্রঃ বাক্যের প্রতিবাক্যে আমরা মায়য়া উৎপন্নঃ মিথ্যাসহজাতঃ পদ দুটি গ্রহণ করেছি। পাপের যে কাৰ্য, যে কার্যে আমরা নিত্য অশেষ ক্লেশ ভোগ করি, তা মায়া বা মিথ্যা হতে উৎপন্ন হয়। এখানে ঐ বাক্যাংশে পাপের পরিচয় বা স্বরূপ পরিবর্ণিত হয়েছে। বরুণ পদে অভীষ্টবর্ষী কৃপাপর দেবতা অর্থই প্রায়শঃ আমরা গ্রহণ করে এসেছি। কিন্তু এখানে বরুণস্য পূর্বে রাজ্ঞ পদের ও পরে পুত্র পদের সমাবেশে ভাব পরিবর্তিত দেখছি। পাপ যেন এখানে নন্দদুলাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাই হোক, ভাবপক্ষে কোনই ব্যত্যয় দেখা যায় না। প্রার্থনা–অজ্ঞানতা দূরীকরণের। প্রার্থনা–জ্ঞানলাভের। মন্ত্রের এটাই অন্তরস্থ তাৎপর্য ॥ ৩!

.

চতুর্থ মন্ত্র: নমঃ শীতায় তক্মনে নমো রূরায় শশাচিষে কৃণোমি। যো অন্যেরুভয়রভ্যেতি তৃতীয়কায় নমো অস্তু তক্মনে ॥ ৪

বঙ্গানুবাদ –প্রাণশক্তির নাশক শৈত্যের সাধক পাপকে আমি নমস্কার করি; সেই হিংসক শোষককে আমি নমস্কার করি; যে পাপ প্রতিদিন সঞ্জাত হয়, ত্রিকালস্থিত সদাভূত পাপকে আমার নমস্কার (জ্ঞাপন করছি)। (ভাব এই যে, আমার নমস্কারে প্রীত হয়ে সকল রকম পাপ আমায় পরিত্যাগ করুক। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –শাস্ত্রে দেবতার পূজার বিধি আছে, আবার অপদেবতারও পূজা-প্রক্রিয়া দেখতে পাই। পূজায় পরিতুষ্ট হয়ে দেবতা এসে আমাতে সম্মিলিত হোন, দেবভাবে আমার হৃদয় পূর্ণ হোক, আর তার দ্বারা আমি দেবত্ব-লাভের অধিকারী হই,–দেবতার পূজার এটাই লক্ষ্য। অপদেবতার পূজার উদ্দেশ্য– অন্যরকম। অপদেবতা–পাপরূপী দেবতা–আমায় পরিত্যাগ করুন, তার সম্বন্ধ আমা হতে বিচ্ছিন্ন হোক, –সে পক্ষে প্রার্থনার এটাই উদ্দেশ্য। [এই সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে এই ভাব ব্যক্ত হয়েছে ]। তবে এই উপলক্ষে, (বিশেষতঃ পূর্বের তিনটি মন্ত্রের সম্বোধনে প্রযুক্ত দেব-শব্দ উপলক্ষে), একটা সংশয়-প্রশ্ন প্রায় মনে উদয় হতে পারে। সে প্রশ্ন-দেব সম্বোধনে তবে কি অপদেবতাকেও (পাপকেও) বোঝা? এই বিষয়ে আমাদের উত্তর এই যে, ঐ দেব শব্দ গুণবাচক–দাতৃত্ব ইত্যাদি গুণের প্রকাশক। সে পক্ষে, দেব সম্বোধনে, করুণাময় আপনি করুণা, প্রকাশ করুন-এখানে এইভাবই ব্যক্ত হচ্ছে। এই যুক্তির সমর্থক-স্বরূপ বেদে বিভিন্ন স্থানে অসুর পদ যে দেবগণের সম্বোধনে ব্যবহৃত হয়েছে, তা নির্দেশ করতে পারি। দেব-শব্দ যেখানে দেবভাবের বিপরীত বস্তু সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, সেখানে সেই বস্তুতে দেবত্বের আরোপ করে, সত্ত্বভাবের সমাবেশ করে ইষ্টবস্তু-প্রাপ্তির কামনাই প্রকাশ পেয়েছে। সেখানকার ভাব এই যে,-হে পাপ! হে অসৎ! তুমি দেবত্বসম্পন্ন সৎ-ভাবসমম্বিত হও। তার ফলে, আমা হতে তোমার সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ুক। এই অর্থ এই ভাব নিয়েই তক্স ও দেব সম্বোধন একই লক্ষ্যে সেখানে প্রযুক্ত হয়েছে–মনে করতে পারি। অন্য অর্থে, দুই পদে দুইয়ের সম্বোধন কল্পনা করা যায়। সেই অনুসারে প্রথমে পাপকে সম্বোধন করে তাকে দূরে যেতে বলা হয়েছে; তারপর দেবতাকে হৃদয়ে অধিষ্ঠান পক্ষে প্রচেষ্টা আছে। পাপ দূরীভুত হলেই দেবত্বে হৃদয় পূর্ণ হয়। সে পক্ষে এই ভাবই পরিব্যক্ত। তবে উভয় পক্ষেরই মর্ম অভিন্ন।যাই হোক, ভাষ্যে এই মন্ত্রের যে অর্থ প্রচলিত আছে, তা এইরকম, শীতজনক কৃচ্ছজীবনকারী রোগকে নমস্কার করি। আর শীতান্তরভাবী শোষক জ্বরকে নমস্কার করি। পরদিনে অর্থাৎ অদ্য যে শীতজ্বর আসে, দ্বিতীয় দিনে যে শীতজ্বর আসবে, তৃতীয় চতুর্থ ইত্যাদি দিনে যে শীতজ্বর হবে, ঐকাহিক দ্বি-আহিক, ত্রি-আহিক চাতুর্থিক ইত্যাদি (এক, দুই, তিন, চার ইত্যাদি দিবসে) সকল প্রকার শীতজ্বরকে আমার নমস্কার প্রাপ্ত হোক। এই রকম নমস্কারে প্রীত হয়ে জ্বর আমাদের পরিত্যাগ। করুক। ভাষ্যে এই অর্থই প্রকটিত।–আমরা মনে করি, সকল রকম ক্লেশপ্রদায়ক পাপকে দূরীভূত করার কামনাই এখানে বিদ্যমান। জ্বর ইত্যাদি পীড়া–সেও তো পাপেরই ফল। পাপ বিদূরিত হলেই সকল আপৎ শান্তি হয়। এটাই মন্ত্র কয়েকটির মর্মার্থ। ৪

.

পঞ্চম সূক্ত : শর্মপ্রাপ্তিঃ

[ঋষি : ব্রহ্মা দেবতা : ইন্দ্র, ভগ, সবিতা, মরুত ছন্দ : গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ আরেহসাবম্মদস্তু হেতিৰ্বোসো অসৎ। আরে অশ্ম যমস্যথ॥ ১.

বঙ্গানুবাদ –হে দেবগণ (হে আমার সত্ত্বভাবনিচয়)! দূরে পরিদৃশ্যমান (অথবা–অন্তরস্থিত) শত্রুর নিক্ষিপ্ত হননসাধক আয়ুধ (অথবা–রিপুশত্রুর প্রভাব) আমাদের নিকট হতে দূরে গমন করুক, অর্থাৎ তারা যেন আমাদের স্পর্শ করতে না পারে। আর, হে রিপুগণ! তোমরা যে হনোয়ুধ আমাদের হননের নিমিত্ত নিক্ষেপ করছ, সেই অস্ত্র আমাদের নিকট হতে দূরে গমন করুক। (মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে দেবগণ! আমাদের রক্ষা করুন, এবং রিপুশত্রুগণের প্রভাব খর্ব করুন; আর হে শত্রুগণ! তোমরা আমাদের সম্বন্ধ পরিত্যাগ করো) ॥ ১।

মন্ত্ৰার্থ-আলোচনা –পঞ্চম অনুবাকের পঞ্চম সূক্তে চারটি মন্ত্র আছে। ঐ মন্ত্র কয়েকটি শত্রুর আক্রমণ নিবারণের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়। সূক্তানুক্রমণিকায় এই সূক্তের মন্ত্র-কয়েকটির প্রয়োগ-বিষয়ে এইরকম লিখিত আছে,–আরেসৌ ইত্যাদি সূক্তের দ্বারা ভঙ্গ ইত্যাদি সকল শস্ত্রের নিবারণ-কর্মের জন্য উষাকালে হোম করতে হবে। শত্রু যখন আক্রমণ করতে আসছে, সেই সময় এই মন্ত্র জপ করলে শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে যাবে। কৌশিতকী ব্রাহ্মণে এ বিষয়ে আরেসাবিতাপনোদনানি ইত্যাদি সূক্ত আছে। কোনরকম দুর্লক্ষণের চিহ্ন দর্শন করলেও এই সূক্ত জপ করণীয়। তাতে দুর্লক্ষণ জনিত বিপদ দূরে যাবে। কোনও বিষয়ে জয়লাভ অভিলাষ করলে, এই সূক্তের দ্বারা হোম করণীয় এবং খঙ্গ ইত্যাদি শস্ত্রকে সেই হোম উপলক্ষে অভিমন্ত্রিত করে নেবে। শয়নকালে এবং সুপ্তোত্থিত হবার সময়ে, এই মন্ত্র অনুসারে নানা প্রক্রিয়ার বিধি আছে। ফলতঃ, এই সূক্তের সহযোগে হোম-কর্মে শত্রুকে অভিভূত করা যাবে এবং জয়শ্রী অধিগত হবে। এই সূক্তের মন্ত্র চারটির ফল সম্বন্ধে এইরকম অনুক্রমিত আছে। এই মন্ত্রে দেবগণকে এবং শত্রুগণকে সম্বোধনের বিষয় সূত্রিত হয়। ভাষ্যেও সেই ভাব গৃহীত হয়েছে। আমরাও সেই ভাব গ্রহণ করলাম। তবে, এই মন্ত্রে অন্তরস্থ শত্রুগণকে–রিপুশত্রুগণকে বিমর্দনের আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। মন্ত্র-জপে, সৎ-ভাবের অনুধ্যানে, মানুষ-শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারা যায়; এটা অসম্ভব নয়। কিন্তু মন্ত্রের অনুধ্যানে হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সমাবেশে, রিপুশত্রুগণের আক্রমণ যে বিধ্বস্ত করতে পারা যায়, তাতে কোনই সংশয় নেই। তাই মন্ত্রের সেই অর্থকেই আমরা প্রকৃষ্ট অর্থ বলে গ্রহণ করি। সেই অনুসারেই অসৌ পদে অন্তরস্থিতঃ, হেতিঃ পদে হননাস্ত্রঃ-কামক্রোধাদি প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি। ঐ সব প্রতিবাক্যের মর্ম অনুসরণ করলেই মন্ত্রের তাৎপর্যার্থ অধিগত হবে ॥ ১৷৷

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ সখাসাবস্মভ্যমস্তু রাতিঃ সখেন্দ্রো। ভগঃ সবিতা চিত্ররাধাঃ ॥ ২॥

 বঙ্গানুবাদ –প্রসিদ্ধ পরমহিতসাধক মিত্রদেবতা, আমাদের অভীষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত আমাদের মিত্রস্থানীয় সুহৃৎ হোন; আর, ভাগ্যপ্রদাতা পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন ইন্দ্রদেবতা, আমাদের মিত্রস্থানীয় সুহৃৎ হোন; আর, বৈচিত্র্য বিশিষ্ট পরমধনসম্পন্ন জ্ঞানপ্রেরক সবিতা দেবতা, আমাদের মিত্রস্থানীয় সুহৃৎ হোন। (ভাব এই যে, আমাদের কর্মের প্রভাবে দেবগণ আমাদের মিত্রস্থানীয় হোন) ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব সরল ও সহজবোধ্য। দেবগণ আমাদের সখাস্থানীয়। হয়ে আমাদের রক্ষা করুন,–এটাই প্রার্থনার তাৎপর্যার্থ। ভাষ্যে প্রকাশ, শত্রুর শস্ত্রসমূহ নিবারণের জন্যই এই প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। এই পক্ষে মানুষ-শত্রুর প্রযুক্ত শস্ত্রও মনে করা যেতে পারে; আবার হৃদয়স্থিত রিপুশত্রুর দমন-বিষয়ক প্রার্থনাও মনে আসতে পারে। মন্ত্র-উচ্চারণে, মন্ত্রের ভাবে ভাবুক হতে পারলে, দুরকম শত্রুর আক্রমণ হতেই নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভবপর। অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রু দুই রকম শত্রুই এই ভাবে দেবারাধনার ফলে পর্যদস্ত হতে পারে। মন্ত্রের অন্তর্গত কয়েকটি পদ লক্ষ্য করবার অছে। প্রথম রাতিঃ পদ। ঐ পদে সায়ণ সূর্য মিত্র প্রভৃতি অর্থ করেছেন। দানার্থক রা ধাতু হতে ঐ পদ নিস্পন্ন। সুতরাং স্বতঃকিরণদানশীল সূর্যদেবকে এবং স্বতঃ অনুগ্রহপ্রদানশীল মিত্রদেবতাকে ঐ রাতিঃ পদ লক্ষ্য করে। যে দেবতার করুণা স্বতঃবষণশীল, তিনিই ঐ পদের অভিধেয়। মিত্রদেব বলতে বা সূর্যদেব বলতে কি ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায় নানা প্রসঙ্গে তা আলোচনা করা হয়েছে। ফলতঃ, করুণার আধার দেবতাই ঐ রাতিঃ পদের লক্ষ্য। ইন্দ্রঃ ও সবিতা দেবতার বিষয়ও পূর্বে আলোচিত হয়েছে। জ্ঞানপ্রেরক দেবতাই সবিতা এবং পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন দেবই ইন্দ্র অভিধায়ে অভিহিত হন। যে দেবতার সাহায্যে মানুষ জ্ঞানের অধিকারী হয়, সে দেবতা যে বৈচিত্র্যসম্পন্ন পরমার্থযুত হবেন, তা আপনা-আপনিই মনে আসে। সেই জন্যই চিত্ররাধাঃ পদের সার্থকতা। যিনি ভাগ্যদাতা (ভগঃ), তিনিই যে পরমৈশ্বর্যশালী, তা স্বতঃসিদ্ধ। এইসব বিষয় বিবেচনা করলে, এই মন্ত্রে ঐ দেবতার উপাসনায় সবরকম কামনার পরিপূরণ-প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ ঘূয়ং নঃ প্রবতে নপান্মরুতঃ সূর্যচসঃ। শর্ম যচ্ছাথ সপ্রথাঃ ॥ ৩॥

 বঙ্গানুবাদ –বিপথগামীগণকে ভয়প্রদানকারী, জ্ঞানকিরণ সমন্বিত বিবেকরূপী হে মরুৎ-দেবগণ! আপনারা আমাদের সর্বতোভাবে সুখপ্রদান করুন। (ভাব এই যে,–বিবেকরূপী দেবগণের কৃপায় বিবেক উন্মেষের সাথে আমাদের শ্রেয়েলাভ হোক–এটাই কামনা ৷৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যে এই মন্ত্রের যে অর্থ প্রচলিত আছে, তা থেকে আমাদের অর্থ সম্পূর্ণরূপ বিভিন্নভাব পরিগ্রহ করলো। ভাষ্যের মতে, প্রবতো নপাৎ পদ দুটিতে পর্জনকে বোঝায়। তার মতে, –প্রবতস্য (অর্থাৎ ভূমি হতে প্রচণ্ড সূর্যকিরণের দ্বারা উর্ধ্বে উখিত উদকের) নপাৎ (অর্থাৎ, পতন না হওয়ায় অবস্থা) এই পদ দুটিতে, অকালে উদক অধোভাগে পতিত না হয়ে মেঘমণ্ডলে অবস্থিতি করে–এই অর্থে, পর্জন্যকে বুঝিয়ে থাকে। সূর্যত্বচসঃ পদে, ভাষ্যকার সূর্যসমানতেজস্কাঃ অর্থ গ্রহণ করেছেন। সূর্যের ত্বকের ন্যায় ত্বক যার–এই বাক্যে তিনি ঐ পদ নিষ্পন্ন করেছেন। মরুতঃ পদে, তার মতে, মরুৎসংজ্ঞক সপ্তগণাত্মক দেবগণকে বোঝায়। ইংরেজীতে বা অন্যান্য ভাষায় যাঁরা এই মন্ত্রের অনুবাদ করেছেন, তাদের সকলেরই মত এই যে, ঝড়ঝঞ্ঝাবাতকে লক্ষ্য করেই এই মন্ত্রের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। অসভ্য আদিম অবস্থার লোকে ঝড়ঝঞ্ঝাবাতকেও দেবতা বলে মনে করতো, এবং তাদের উদ্দেশে পূজা করতো। সে মতে, এখানে সেই ভাব প্রকাশমান। সে পক্ষে যে অর্থ সিদ্ধ হয় না, তা আমরা বলছি না। বরং তার পোষকতায় বলতে পারি, প্রবতো নপাৎ এবং সূর্যত্বচসঃ বিশেষণ দুটিতে ঝড়ঝঞ্জাবাতকে বেশ লক্ষ্য করা যায়। পর্জন্য হতে পর্জন্যসম্বন্ধভূত হয়েই, অনেক সময় ঝড়-ঝঞ্ঝাবাতের আবির্ভাব হয়। আবার, সেই ঝড়-ঝঞ্ঝাবাতের দ্বারাই মেঘ-সঞ্চালিত হয়ে সূর্যরশ্মিকে আবৃত করে,–সূর্যের ত্বকস্বরূপে (সূর্যত্বচসঃ) বিস্তৃত হয়ে পড়ে। সায়ণভাষ্যের অনুসরণে সাধারণতঃ এইরকম লৌকিক অর্থই আসতে পারে।–কিন্তু, সেই রকম অর্থের সঙ্গতিবিষয়ে নানারকম বাধা আছে। ঝড়-ঝঞ্ঝাবাত রূপ সেই মরুৎ-দেবগণ কিভাবে সুখ দান করতে পারেন? ভাষ্যকার যে শর্ম পদের প্রতিবাক্যে শরণং গৃহং সুখং বা পদ তিনটি গ্রহণ করে গেছেন; সেই শরণ, গৃহ বা সুখ কি রকমে ঝড়-ঝঞ্ঝাবাত হতে মানুষ লাভ করতে পারে? এ পক্ষে ভাবের সঙ্গতি রক্ষা করা বড়ই কঠিন হয়। সুতরাং এখানে রূপকে বা উপমায় এক আধ্যাত্মিক তত্ত্বই প্রকাশ পেয়েছে– বোঝা যায়। সে সম্পর্কে মন্ত্রের অন্তর্গত চারটি পদের অর্থ উপলব্ধ হলে, ভাবগ্রহণ সুস্পষ্ট হয়ে আসবে। প্রথম–প্রবতো নপাৎ পদ দুটি। এই অথর্ববেদেরই বিভিন্ন স্থানে এবং ঋগ্বেদে ও সামবেদে বিভিন্ন মন্ত্রে। এই পদের প্রয়োগ দেখেছি। তাতে, প্রবতো নপাৎ এই দুই পদে আমাদের পরিগৃহীত বিপথগামিনো ভয়প্রদাতরঃ অর্থই সঙ্গত বলে বুঝতে পারি। এই সায়ণভাষ্যেই অন্যত্র (১কা-৩অনু-২সূ-২ম) প্রবতো নপাৎ পদ দুটির যে ব্যাখ্যা আছে, তা থেকেই আমাদের অর্থের পোষক ভাব প্রাপ্ত হই। সেই স্থলে ভাষ্যে প্রকাশ–হে প্রবতো নপাৎ প্রবতঃ প্রগতস্য স্বস্মাৎ প্রচ্যুতস্য ত্বদ্বিষয়স্তুতিনমস্কারাদ্য কর্তৃঃ পুরুষস্য নপাৎ ন পাতঃ ন পালক। অসেবকস্য অশনিভয় প্রদারিত্যর্থঃ। বলা বাহুল্য, ঐ স্থলে দেবতার সম্বোধনে প্রবতো নপাৎ পদ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর সেই সূত্রেই ভাষ্যকার লিখে গিয়েছেন,–অসেবিকে অর্থাৎ ভগবৎসেবাবিহীন জনকে (অসৎ পথাবলম্বী জনকে) ভয়প্রদর্শক দেবতার সম্বোধনেই ঐ পদ প্রযুক্ত হয়েছে। সুতরাং আমাদের পরিগৃহীত অর্থের সার্থকতা প্রতিপাদনের জন্য অন্যের আশ্রয় গ্রহণ করবার আর কোনই আবশ্যক হচ্ছে না। সায়ণের ব্যাখ্যাতেই আমাদের পরিগৃহীত অর্থ আসছে। মন্ত্রের আলোচ্য অপর পদ–সূর্যত্বচসঃ। ঋগ্বেদ সংহিতায় (১ম-৪৭সূ-৯ঋ) সূর্যত্বচা পদ পেয়েছি। সেখানে রথের বিশেষণে ঐ পদ প্রযুক্ত দেখি; আর এখানে, মরুৎ-দেবগণ সম্বন্ধে ঐ পদ দৃষ্ট হয়। রথ বলতে যদি শকট বোঝায়, তাতেও ঐ বিশেষণের সার্থকতা থাকে না, আবার মরুৎ-গণ বলতে যদি ঝড়-ঝঞ্ঝাবাত বোঝায়, তাতেও ঐ বিশেষণের সার্থকতা থাকতে পারে না। ভাবে, উভয় ক্ষেত্রেই রথের বা ঝড়-ঝঞ্ঝাবাতের অতীত সামগ্রীর প্রতি লক্ষ্য আসে। তাই সেখানে রথ বলতে সকর্ম-রূপ-যান অর্থ সঙ্গত বলে সিদ্ধান্তিত হয়েছে; আর এখানে মরুৎ-দেবগণ বলতে বিবেকরূপী দেবতার প্রসঙ্গই প্রখ্যাপিত হচ্ছে। যে দেবতা বিবেকরূপে আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন, যে দেবতা নানা রকম বিতাড়ন ও ভর্ৎসনার দ্বারা আমাদের সৎপথাবলম্বী করতে প্রয়াস পান, মরুৎ-দেবগণ বলতে তাদের প্রতিই লক্ষ্য আসে।–সকল স্থানেই ব্যাখ্যার সামঞ্জস্য। { থাকে, যদি মরুৎ-দেবগণ বলতে বিবেক-উন্মেষণকারী বিবেক-রূপী দেবভাবনিচয়কে লক্ষ্য করা হয়।–এই সকল বিষয় বিবেচনা করলে, এই মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব দাঁড়ায়,-হে বিবেকোষেণকারী দেবগণ! হে সত্ত্বভাবের প্রস্ফুরণকারী দেবভাবনিবহ! আপনারা এসে আমাদের হৃদয়ে উদয় হয়ে, সর্বতোভাবে আমাদের মঙ্গলবিধান করুন। বিপথগামীরাই আপনাদের আগমনে সন্ত্রস্ত হয়। আপনারা জ্ঞান-বিতরণের দ্বারা মনুষ্যগণকে সুখ প্রদান করুন। মন্ত্র এমনই প্রার্থনার ভাবে পরিপূর্ণ। ৩।

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ সুসূদত মৃড়ত মৃড়য়া নস্তভ্যো। ময়স্তোকেভ্যস্কৃধি ॥৪॥

বঙ্গানুবাদ— হে দেবগণ! আপনারা আমাদের পাপসকলকে বিদূরিত করুন, এবং আমাদের সুখদান করুন। হে দেব! আমাদের সুখী করুন; এবং আমাদের অনিষ্ট দূর করে আমাদের দেহ-সকলকে ও বংশপরম্পরাকে সুখে রাখুন। ভাব এই যে, আমাদের অনুষ্ঠিত কর্মের দ্বারা অন্যকে সুখী করুন, এবং আমাদের সর্বপ্রকার সুখবৃদ্ধি করুন,এটাই আকাঙ্ক্ষা)। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের সম্বোধ্য বিষয়ে আপনা-আপনিই সংশয় আসে। কেননা, চারটি ক্রিয়াপদ এই মন্ত্রের অবলম্বন দেখি। অপিচ, সেই ক্রিয়াপদের দুটিতে একবচনের প্রয়োগ দেখি। অতএব, এখানে সম্বোধনে দুরকম পদ অধ্যাহৃত হয়ে থাকে। মন্ত্রের অন্তর্গত, সুসূদত এবং মৃড়ত এই দুই ক্রিয়াপদের সম্বন্ধে সম্বোধন-মূলক দেবাঃ সম্বোধন-পদ অধ্যাহৃত হয়; এবং পরবর্তী মৃড়য় ও কৃধি ক্রিয়াপদ দুটির সম্বন্ধে দেব এই সম্বোধন-পদ অধ্যাহার করা হয়ে থাকে। এ পক্ষে আমরা ভাষ্যেরই অনুবর্তন করলাম। তবে, এ সম্বন্ধে নিগূঢ় তাৎপর্য অনুসন্ধান করা যেতে পারে। বিভিন্ন দেবতার মধ্য দিয়ে, অসংখ্য অগণ্য দেবদেবীর বিকাশ-মূল হতেই, যে সেই একের সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায়, এখানে আমরা সেই ভাবেরই দ্যোতনা দেখতে পাই। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দেবতাকে আহ্বান করতে করতে, পরিশেষে সেই একেরই প্রতি লক্ষ্য পড়ে। ব্রহ্ম-সর্বদেবময়, তিনি এক হয়েও বহুরূপে বিকাশমান। এই মন্ত্রে যথাক্রমে দেবাঃ ও দেব সম্বোধনে সেই তত্ত্বই উদ্ভাসিত দেখি। ৪

.

ষষ্ঠ সূক্ত : স্বস্ত্যয়নম

 [ঋষি : অথর্বা (স্বস্ত্যয়নকাম) দেবতা : চন্দ্রমা ইন্দ্রাণী ছন্দ : অনুষ্টুপ পংক্তি ]

প্রথম মন্ত্রঃ অমূঃ পারে পৃদাক্কস্ত্রিপ্তা নির্জরায়বঃ। তাসাং জরায়ুভির্বয়মক্ষ্যাহবপি ব্যয়ামস্যঘায়োর পরিপন্থিনঃ ১।

বঙ্গানুবাদ –সেই হৃদয়স্থিতা অসত্যনাশিকা ত্রিগুণসাম্যসাধনভূতা মরণরহিতা দেবতাগণ সংসারের কুটিলতা হতে নিশ্চয়ই দূরে অবস্থিতি করছেন; তাঁদের হতে উৎপন্ন সত্ত্বভাব ইত্যাদির দ্বারা, সৎকর্মের বাধক হিংসাকারী শত্রুর চক্ষু দুটিকে (হিংসুদৃষ্টিশক্তিকে) ক্ষুদ্রশক্তিসম্পন্ন এই আমরাও আচ্ছন্ন করতে (আমাদের প্রতি সঞ্চালনে বাধা প্রদানে) সমর্থ হই। (ভাব এই যে, হৃদয়স্থ সত্ত্বভাবসমূহ এখন দূরে অবস্থিতি করছে; তাদের সহায়তা প্রাপ্ত হলে ক্ষুদ্রসামর্থ্য আমরাও প্রবল শক্তিশালী শত্রুদের অভিভব করতে সমর্থ হই)। ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই ষষ্ঠ সূক্তের মন্ত্র চারটির প্রয়োগ সম্বন্ধে অনুক্রমণিকায় লিখিত আছে যে, যুদ্ধজয়ের জন্য অস্ত্রগ্রহণ উপলক্ষে স্বস্ত্যয়ন-কর্মে এই মন্ত্রের প্রয়োগ-বিধি দৃষ্ট হয়। পূর্ব সূক্তের অনুসরণে এই সূক্তের অনুষ্ঠিত ক্রিয়া ইত্যাদি সম্পন্ন করতে হবে। প্রক্রিয়া-পদ্ধতি যেমনই বিহিত থাকুক, সে বিষয়ে আমাদের বক্তব্য কিছুই নেই। আমরা মাত্র এখানে মন্ত্রের ভাব সম্বন্ধেই আলোচনা করছি।–এই মন্ত্রের পদ কয়েকটি জটিল ভাবাপন্ন। ভাষ্যে এবং প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে তাদের আরও জটিলতা সম্পন্ন করে তুলেছে। যেমন,–মূলের পৃদাক্ক পদ। ভাষ্যে তার প্রতিবাক্য সর্পজাতয়। মূলের ত্রিষপ্তাঃ; ভাষ্যে তার প্রতিবাক্য ত্রিগুনিতসপ্তসংখ্যাকাঃ অর্থাৎ একুশ। মূলের নির্জরায়বঃ পদের ভাষ্যগৃহীত প্রতিবাক্য জরারহিতা দেবা ইব। মূলের পারে পদের ভাষ্যগৃহীত অর্থ ভূম্যাঃ পারদেশে নাগলোকে। মূলের তাসাং পদে পৃদাকূনাং পদকে লক্ষ্য করছে–এই অভিমত ভাষ্যে প্রকাশ পেয়েছে। মূলের জরায়ুভিঃ পদ থেকে ভাষ্যকার সর্পকঞ্চুকা দ্বারা ভাবার্থ গ্রহণ করেছেন। মূলে ব্যয়ামসি পদ আছে। ভাষ্যকার ঐ পদের বিভক্তিব্যত্যয় স্বীকার করে, তার অর্থে ভাবে আচ্ছাদয়ামঃ প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছেন।–এ পক্ষে মন্ত্রার্থে ভাষ্যের ভাব এই দাঁড়িয়েছে যে,-পরিদৃশ্যমান সর্পজাতির অন্তর্ভুক্ত একবিংশসংখ্যক জরারহিত দেবগণ নাগলোকে বাস করেন; সেই সর্পজাতীয় দেবতার শরীরের বেষ্টক ত্বকের অর্থাৎ সপকঞ্চুকের দ্বারা হিংসনেচ্ছুক যুদ্ধার্থী শত্রুগণের চক্ষু দুটি আমরা আচ্ছাদিত করি। অর্থাৎ, যুদ্ধ ইত্যাদির সময়ে শত্রুগণ যেন আমাদের দেখতেই না পায়–সেই ভাবে তাদের চক্ষু দুটি সাপের খোলস দিয়ে ঢেকে দিই। বলা বাহুল্য, এই রকম অর্থে মন্ত্রটিকে হেঁয়ালি-মাত্র বলেই মনে হয়, এর দ্বারা মন্ত্রোচিত কোনও সৎ-ভাবই পাওয়া যায় না।–এইবার আমাদের পরিগৃহীত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা যাক। মন্ত্রের প্রথম পদ অমূঃ। এই পদে আমরা। প্রসিদ্ধাঃ, হৃদিস্থিতা প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি। দেবতার স্থান যে হৃদয়ে, দেবতা যে অন্তরে অন্তর্যামী হয়ে বিদ্যমান থাকেন,–সেই ধারণা হতেই এই প্রতিবাক্য। দ্বিতীয়–পৃদাক্ক পদে আমরা অসত্যনাশিকাঃ প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি। হিংসাকরণেই সপজাতির পরিচয়। যারা হিংসাকারী, তাদের তাই সর্প প্রকৃতির লোক বলা হয়। কিন্তু এখানে দেবতা-সম্পর্কে ঐ পদ প্রযুক্ত হওয়ায়, ঐ অর্থই সৎ-ভাবের প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষতঃ এখানে, দেবতার সম্বন্ধে দুই পক্ষের দুই রকম বিশেষণ যথাপর্যায় লক্ষ্য করলে, সেই ভাবই অধিগত হতে পারে। এক বিশেষণ–পৃদাকঃ, অন্য বিশেষণ–ত্রিষপ্তাঃ। দেবতায় যে কঠোর কোমল দুই ভাব বিদ্যমান, এখানে ঐ দুটি পদে তা-ই ব্যক্ত করছে। তারা যে পৃদার্কঃ (হিংসাকারী), সে কাদের পক্ষে? না–পাপাচারীর পক্ষে–অসৎ-বৃত্তির পক্ষে। পাপাচারিগণকে তারা হিংসা করেন, হনন করেন; আর তারা পুণ্যকর্মানুষ্ঠাতৃগণের গুণসাম্যবিধান করেন, তাদের সত্ত্বভাব প্রদান করেন। এখানে ঐ দুই পদে দেবতাগণের সেই অভিনব মাহাত্ম্য-তত্ত্বই প্রখ্যাত হয়েছে। সেই অনুসারেই পৃদাঃ ও ত্রিষপ্তাঃ পদ দুটির প্রয়োগের সার্থকতা। নির্জরাঃ পদে, দেবতাগণের বা দেবভাবসমূহের অমরত্বের বিষয় প্রকাশ করছে। এ পদের অর্থ-বিষয়ে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের কোনই মতবিরোধ নেই। তার পর পারে পদ। আমরা বলি, এই পদের ভাব এই যে,সংসারের কুটিল ভাবের দূরে। দেবতাগণ সংসারের কুটিলতা হতে দূরে অবস্থিতি করেন। যে হৃদয় কুটিলতায় ভরা, দেবতার স্থান-সেখানে নয়। দেবতা বা দেবভাব এর হৃদয়েরই সামগ্রী বটে; কিন্তু সে হৃদয়ে তারা থাকেন না–যেখানে কুটিলতা স্থান পেয়েছে। আমরা মনে করি, অমু আর আরে এই পদ দুটিতে যুগপৎ এই ভাব ব্যক্ত হয়েছে।-মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে প্রথম সাং পদ। এই পদটিতে ব্যাখ্যাকারগণকে বড়ই সমস্যায় ফেলেছে। এই তাসাং পদ কার সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, তা নির্ধারণ পক্ষে ভাষ্যই গণ্ডগোলের সৃষ্টি করেছে। ভাষ্যের মত, ঐ পদ পৃদাকঃ (সর্পজাতয়ঃ) পদের সাথে সম্বন্ধ-বিশিষ্ট। এখানে কেন এ ভাব এলো, তার একটু কারণও দেখতে পাই। বহুবচনের স্ত্রীলিঙ্গান্ত জরারহিতাঃ দেবতাঃ না লিখে, ভাষ্যে জরারহিতা দেবা ইব–এইরকম পুংলিঙ্গের বহুবচনান্ত পদ ব্যবহৃত হয়েছে। গণ্ডগোল তাতেই বেধেছে। এ অবস্থায়, দেবাঃ পদ ব্যবহার করে, তাসাং পদের সম্বন্ধ-দ্যোতক পদকে সহসা সন্ধান করে পাওয়া যায় না। তাই বোধ হয়, পৃদাক্কঃ পদটিকে স্ত্রীলিঙ্গান্ত ধরে, পৃদাক পদের সাথে তাসাং পদের সম্বন্ধ সূচনা করা হয়েছে। কিন্তু, একটু অভিনিবেশ সহকারে দেখলেই দেখা যায়, এখানকার বিশেষণপদ কয়েকটিই স্ত্রীলিঙ্গের বহুবচন; এবং দেবতাঃ পদই ঐ সকল পদের দ্যোতক। অমূ পৃদাকঃ, ত্রিষপ্তাঃ, নির্জরাঃ, তাসাং–এই সব পদ পরস্পর সম্বন্ধ-বিশিষ্ট; এবং এদের সকলেই দেবঅর গুণবিশেষণ প্রকাশ করছে। তাই আমরা তাসাং পদের প্রতিবাক্যে দেবভাবানাং পদ গ্রহণ করেছি। এই অংশের দ্বিতীয় আলোচ্য পদ–জরায়ুভিঃ। ঐ পদে কেন সর্পের খোলস অর্থ টেনে আনি? কত দূরের কল্পনায় ঐ অর্থ আনতে হয়, তা সহজেই বোঝা যায়। জরায়ু থেকে প্রাণিজাত উৎপন্ন হয়। সে পক্ষে জরায়ুভিঃ (জরায়ুর দ্বারা) বলতে, তা হতে উৎপন্ন বস্তুর আকাঙ্ক্ষা আসে। সুতরাং তাসাং (দেবতানাং) জরায়ুভিঃ বলতে আমরা ভাবে সত্ত্বভাবের দ্বারা অর্থই পরিগ্রহণ করেছি। একমাত্র সত্ত্বভাবই যে পাপকে দূর করতে সমর্থ হয়, একমাত্র সত্ত্বভাবকেই যে পাপের আবরক বলতে পারা যায়, তাতে সংশয় আসতে পারে না। এ পক্ষে সেই ভাবই ব্যক্ত করছে। তার পর, মন্ত্রের আলোচ্য দুটি পদ–পরিপন্থিন অঘয়োঃ। এই দুই পদে সকর্মে বাধাপ্রদানকারী শত্রুকে বোঝায়। অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রু দুরকম শত্রুর পরিকল্পনাই এ পক্ষে সঙ্গত হতে পারে। তার পর অক্ষৌ পদ। ঐ পদে সাধারণতঃ চক্ষু-দুটিকে বোঝায়। তা থেকেই হিংস্র দৃষ্টিশক্তির ভাব আসে। উপসংহারে আর একটি সমস্যামূলক পদ–ব্যয়ামসি। আধুনিক ব্যকরণ অনুসারে এ পদ সিদ্ধ হয় না। অপিচ, এই পদের বিভক্তিতে, মধ্যম পুরুষের এক-বচনান্ত কর্তার আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু এখানে বয়ং এই কর্তৃপদ পরিদৃষ্ট হয়। সুতরাং ক্রিয়াপদটির ছান্দস-প্রয়োগ স্বীকার ছাড়া গত্যন্তর নেই। অতএব, ভাষ্যের অনুসরণেই আমরাও ঐ পদের অর্থ গ্রহণ করলাম। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মানুষের শত্ৰু মানুষের সাথে যুদ্ধের বিষয়ই মন্ত্রে প্রখ্যাপিও আছে, দেখতে পাই। অথচ, সে অর্থে, বিশেষতঃ সর্পের খোলসের দ্বারা বিপক্ষের চক্ষু আবৃত করার প্রসঙ্গে, কোনই ভাব প্রাপ্ত হতে পারি না। কিন্তু মন্ত্রে মনস্তত্ত্বের বিষয়-হৃদয়স্থ শত্রুর সাথে সংগ্রামের কাহিনী-বিবৃত আছে মনে করলেই, সুষ্ঠু ভাব ও অর্থ পাওয়া যায়। এ সব বিষয় বিবেচনার পর, মন্ত্রের যে ভাবার্থ হয়, আমরা আমাদের বঙ্গানুবাদে তা-ই প্রকাশ করেছি। মন্ত্রে বলা হয়েছে,-দেবতা বা দেবভাবসমূহ হৃদয়ের বস্তু। হৃদয়-রূপ গৃহেই তারা অধিষ্ঠিত থাকেন। কিন্তু আমাদের কর্ম-বৈগুণ্যে তাঁরা দূরে গিয়ে পড়েন,-কুটিল সংসারের পর-পারে তাদের আশ্রয় নির্দিষ্ট হয়। অথচ, সেই দেবতাগণের সহজাত যে সভাবসমূহ, তার সাহায্য যদি আমরা প্রাপ্ত হই, তাতে অতি বড় শত্রুর আক্রমণেও আমরা বাধা দিতে পারি। আমরা ক্ষুদ্র বটে, আমাদের শক্তিসামর্থ্য অল্প বটে; আর, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী শত্ৰু প্ৰবল ও পরাক্রান্ত সত্য; কিন্তু সত্ত্বভাবের সহায়তা পেলে, হৃদয়ে সৎ-ভাবের বিকাশ করতে সমর্থ হলে, আমরা নিশ্চয়ই শত্রুদের হিংস্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হতে পরিত্রাণ পেতে পারি; সেইরকম অবস্থায়, তারা আমাদের প্রতি দৃষ্টিসঞ্চালনেই সমর্থ হয় না। (প্রার্থনাপক্ষে এই মন্ত্রের ভাব এই যে,–হে দেবতা! আর দূরে থেকো না। হৃদয়ের নিধি, হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থেকে, আমাদের শত্রুর কবল হতে পরিত্রাণ করো) ॥ ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ বিচ্যে কৃতী পিনাকমিব বিভ্ৰতী। বিম্ব পুনর্ভুবা মনোহসমৃদ্ধা অঘায়ব ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ— পিনাকের ন্যায় ভীষণ আয়ুধধারী, আমাদের বিদারণকারী, অজ্ঞানতা-সম্বন্ধী, শত্রুসেনা বিমুখে গমন করুক (প্রতিহত বিত্ৰস্ত হোক); সেই হেন শত্রুসেনা যদি সঙ্গবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের সঙ্কৰ্মনাশের প্রবৃত্তি বিমুখ (অর্থাৎ বিনষ্ট) হোক; সৎকর্মের নাশক শত্রুগণ সর্বৰ্থা পরাজিত হোক। (ভাব এই যে,-সকল শত্রু বিচ্ছিন্ন ও বিনাশপ্রাপ্ত হোক,–এটাই আকাঙ্ক্ষা) ॥ ২॥  মন্ত্ৰার্থ-আলোচনা– ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রের ভাবার্থ এই যে,-ঈশ্বরের ধনু পিনাকের ন্যায় শহননক্ষম আয়ুধধারী, অতএব শত্রুবিদারণকারী–শত্রুসেনাসমূহ নানাদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গমন করুক। যদি সেই সকল শত্রুসৈন্য পুনরায় সদ্যবদ্ধ হয়ে আগমন করে, তাহলে তাদের চিত্ত অন্যদিকে প্রধাবিত হোক; তারা কার্যাকার্য বিচারশূন্য হয়ে থাকুক। আর, সেইরকম পরিভ্রাম্যমাণ সৈন্যসমূহের পরিচালক শসমূহ রাষ্ট্রকোষ ইত্যাদি ভ্রষ্ট হোক।–ভাষ্যের এই অর্থে মানুষ-শত্রুর বিষয়ই উপলব্ধ হয়। কিন্তু মন্ত্রে মানুষ-শত্রু অপেক্ষা প্রবলতর শত্রুর প্রসঙ্গই প্রখ্যাপিত হয়েছে, বুঝতে পারি। আমাদের অর্থ তাই একটু স্বতন্ত্র পথ পরিগ্রহ করেছে। ভাষ্যকার ঈদৃশী শাবী সেনা পদ অধ্যাহার করে বিভ্রতী এবং কৃতী পদ দুটি সেই সেনা-পদের বিশেষণ-রূপে পরিকল্পনা করেছেন। আমরাও তা-ই করেছি। তবে মানুষ-শত্রু বা মনুষ্য-সেনা ভাব গ্রহণ না করে, আমরা অন্তরস্থ শক্রর প্রসঙ্গই সমীচীন বলে বুঝেছি। বিসূচী পদের অর্থ, আমাদের মতে–বিমুখং; অর্থাৎ, আমাদের দিক হতে অন্য দিকে (বিপরীত দিকে)। এর নিগুঢ় তাৎপর্য এই যে, শত্রুর অস্ত্র শত্রুকেই আঘাত করুক; আপন বিষে আপনিই জর্জরিত হয়ে শত্রু নাশপ্রাপ্ত হোক; কণ্টকেনৈব কণ্টকং–শত্রুর দ্বারাই শত্রু যে উলিত হয়–এটাই আকাঙ্ক্ষা।-দেবতা বা দেবভাবসমূহ হৃদয়ের বস্তু। সংসারমোহপঙ্কে নিমজ্জমান নরহৃদয়ে তাদের স্থান কোথায়?…হৃদয় নির্মল হলে-হৃদয়ের পাপ-ক্লেদ ময়লামাটি দূর হলে, তবে সে হৃদয়ে দেবতার বা দেবভাবের অধিষ্ঠান হয়। তাই এই মন্ত্রে যেন বলা হয়েছে,সংসারের কুটিলতা দূরে অবস্থিতি করুক; দেবতা এসে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। এখানে শত্রু-শব্দে অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রু–উভয় রকম শত্রুকেই বোঝাচ্ছে।…সেই পক্ষে এখানকার নিগূঢ় তাৎপর্য এই যে,– আমাদের হৃদয়ে দেবভাব সঞ্জাত হোক; কুটিল শত্রুগণ পরস্পর বৈরী ভাব অবলম্বন করে আপনা আপনিই নিধন-প্রাপ্ত হোক। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের ভাব এই যে, দেবতা বা দেবভাব সংসারের কুটিলতা হতে দূরে অবস্থিতি করছেন। শত্রু যদি সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে হৃদয়কে আক্রমণ করে, তাহলে বিষম বিপদের আশঙ্কা। তাই আকাঙ্ক্ষা,-দেবতা হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন; তাদের অধিষ্ঠানে, শত্রুগণের সকর্ম-নাশের প্রবৃত্তি নষ্ট হোক; শত্রুগণ পরাজিত হয়ে দূরে পলায়ন করুক। এখানে, এই ভাবে, হৃদয় নির্মল করবার উপদেশই লক্ষিত হয়। মন্ত্র উপদেশ দিচ্ছেন,–জীব! সংসারের আবিলতা হতে দূরে সরে এসো। হৃদয় নির্মল করো। মনের কুটিলতা দূর হোক। তাহলেই, হৃদয় দেবতার ও দেবভাবের অধিষ্ঠানের যোগ্য হবে; দেবভাবের উন্মেষে শত্রুর আক্রমণে হৃদয় আর বিধ্বস্ত হবে না। শত্রু যদি সংহার-মূর্তিও ধারণ করে, শত্রু যদি শিবের ত্রিশূলের ন্যায় (পিনাকমিব) আয়ুধও প্রাপ্ত হয়, তাতেও ভয়ের কারণ নেই। যদি দেবতার সহায়তা লাভ করতে পারো, তবে তোমার ন্যায় অকিঞ্চনও শত্রুনাশে সমর্থ হতে পারে। এমন কি, তাতে শত্রুগণই পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করে আপনা-আপনিই নির্মূল হয়ে পড়বে। আমাদের মনে হয়, মন্ত্রে এই ভাবই প্রকটিত রয়েছে। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্র: ন বহবঃ সমশক নার্ভকা অভি দাপৃঃ। বেপোরা ইবাভিতোহসমৃদ্ধা অঘায়বঃ ॥ ৩॥

বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন্! বহুসংখ্যক অথবা বহুশক্তিসম্পন্ন শত্রুগণ যেন আমাদের অভিভূত করতে সমর্থ না হয়; অল্পসংখ্যক অথবা অল্পশক্তিসম্পন্ন শত্রুগণ যেন আমাদের অভিমুখে দৃষ্টি করতেও না পারে। (ভাব এই যে, শত্রুগণ আমাদের যেন সৎসম্বন্ধচ্যুত করতে সমর্থ না হয়)। পরিদৃশ্যমান সৎ-ভাবনাশক শত্রুসমূহ যেন ছিন্ন-বেণুশাখার ন্যায় সমৃদ্ধিরহিত হয়ে পরাজিত হয়। (ভাব এই যে, আমাদের সত্ত্বভাবের প্রভাবে আমাদের সকল রকম শত্রু বিনাশপ্রাপ্ত হোক) ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা এই সহজ ও সরলভাব সমন্বিত মন্ত্রে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সকল রকম শত্রুর বিনাশের বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। ছোটই হোক আর বড়ই হোক–শত্রুকে কখনই হীনবল বলে মনে করবে না– মন্ত্রের অভ্যন্তরে এই সত্য উপদিষ্ট হয়েছে। বহবঃ এবং অর্ভকাঃ পদ দুটিতে সেই ভাব পরিব্যক্ত বলে মনে করি। মন্ত্রের অর্থ-বিষয়ে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ কোনও মতদ্বৈধ নেই। বহবঃ পদে ভাষ্যকার হস্ত্যশ্বরথপদাতিযুক্তা বহুলাঃ শত্ৰবঃ অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরা সাধারণভাবে বহুশক্তিসম্পন্নাঃ) শত্ৰবঃ অর্থ গ্রহণ করেছি।…মন্ত্রের অন্তর্গত বোরা ইব বাক্যে শত্রুগণের অবস্থিতির বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। ভাব এই যে,–বেণুশাখা (কঞ্চি) যেমন অসংহত বিচ্ছিন্নভাবে হীনবল হয়ে অবস্থিতি করে, শত্রুগণও সেই রকম পরাজিত বিধ্বস্ত হয়ে অসহায়ে অবস্থিতি করুক; অর্থাৎ, পুনরাক্রমণে সমর্থ না হয়,–এইরকমভাবে তারা বিধ্বস্ত হোক। ফলতঃ, হৃদয়ের সৎ-ভাবের প্রভাবে সকল শক্রই বিনষ্ট হোক, মন্ত্রে সেই আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পেয়েছে। এইভাবে বোঝা যায়, এই মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব এই যে, –ভগবান্ যেন আমাদের হৃদয়ে এমন সৎ-ভাবসমূহ উপজিত করুন, যার প্রভাবে আমাদের সকলরকম শত্রু. নাশপ্রাপ্ত হয়। পাপপঙ্কে নিমজ্জিত আমরা; আমাদের হৃদয় কুটিলতাময়। তিনি সেই কুটিলতা দূর করুন; আমাদের হৃদয়ে দেবভাবের সমাবেশ হোক; শত্রুনাশে সামর্থ্য আসুক ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ প্রেতং পাদৌ প্র স্ফুরতং বহতং পৃণতে গৃহা। ইন্দ্রাণ্যে তু প্রথমাজীতামুষিতা পুরঃ ॥৪॥

বঙ্গানুবাদ –জ্ঞানভক্তি-রূপ (অথবা সকাম-নিষ্কাম কর্মরূপ) যানদ্বয়! তোমরা প্রকৃষ্ট-রূপে আমাদের কর্মে (অথবা জ্ঞানভক্তি সহ) মিলিত হও; (আকাঙ্ক্ষা এই যে, আমাদের কর্মের সাথে জ্ঞানভক্তির সম্মিলন হোক); তার দ্বারা আমাদের কর্মকে (অথবা জ্ঞানভক্তিকে) প্রকৃষ্টরূপে সৎপথে ঊর্ধ্বে নিয়ে যাও; ইষ্টফল-প্রদানে আমাদের তুষ্ট করো; এবং সেই শ্রেষ্ঠনিবাস ভগবানকে প্রাপ্ত করাও। তোমাদের কৃপায় পরমৈশ্বর্যশালিনী দেবী (শক্তি) আমাদের শ্রেষ্ঠা (সকলের বরণীয়া), অনির্জিত (অজেয়া), অনুমিতা (অনপহৃতা, চিরস্থায়িনী) হোন। (ভাব এই যে,-জ্ঞানভক্তির প্রভাবে আমাদের কর্মশক্তি চিরজয়শ্রীমণ্ডিতা হোন ॥ ৪৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এ মন্ত্রটি একটু জটিলতা-পূর্ণ। প্রথম সম্বোধন পাদৌ পদেই সেই জটিলতার সৃষ্টি করেছে। তাতে অর্থ দাঁড়িয়েছে,-হে জয়েছু জনের পদদ্বয়!-ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের যে ভাব হয়, তা এই,-হে জয়েন্টু জনের পদদ্বয়! তোমরা প্রকৃষ্ট-রূপে গমন করো; এবং পুনঃ পুনঃ শীঘ্র চলে গমন-কার্য সম্পন্ন করো। কি অবধি গমন করবে? ইষ্টফলদানে আমাদের পরিতুষ্ট করা পর্যন্ত এবং উদ্দিষ্ট পুরুষের গৃহপ্রাপ্তি পর্যন্ত। অথবা, শত্রুর পালনকারী সেই পররাষ্ট্রাধিপতির গৃহে আমাদের সৈন্যগণের পৌঁছানো পর্যন্ত। হে ইন্দ্রপত্নী! আগমন করুন। আপনি প্রথমা, সকলেরই অজেয়া, আপনি অনপহৃতা অর্থাৎ সকলেরই অনভিভাব্য। অতএব, আপনার অনুগ্রহে আমাদের সৈন্যগণ শত্রুগণকে পরাজিত করে তাদের গৃহ আক্রমণ করুক। মন্ত্রের এইরকম অর্থে কি উচ্চ ভাব প্রকাশ পায়–বুঝি না। বরং এ অর্থে জটিলতাই বৃদ্ধি পায়। আমরা কিন্তু পাদৌ পদের দুরকম অর্থ গ্রহণ করেছি। তাতে, জ্ঞানভক্তিরূপ যান-দ্বয়কে সম্বোধন করা হয়েছে বলেও বুঝতে পারি, অথবা সকাম ও নিষ্কাম দুই কর্মের সম্বোধনও ঐ পদের লক্ষ্য বলে নির্দেশ করতে পারি। দুই অর্থেই একই রকম ভাব প্রাপ্ত হই। দুই অর্থেই জ্ঞান ও ভক্তির সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। যখন সম্বোধন জ্ঞানভক্তিকে হবে, তখন কর্মকে তার সাথে মিলিত করবার প্রার্থনা প্রকাশ পাবে। যখন সকাম ও নিষ্কাম দুরকম কর্মকে আহ্বান করব, তখন জ্ঞানভক্তিকে তার সাথে সম্মিলিত করবার প্রার্থনা ব্যক্ত হবে।–প্রথমতঃ পাদৌপদে জ্ঞানভক্তিরূপৌ যানৌ প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি, এবং ভাষ্যের জিগমিষতঃ স্থলে মুক্তিমিষতঃ ভাব গ্রহণ করতে প্রবুদ্ধ হয়েছি। পদ দুটির পরিচালনরূপ কর্মের দ্বারা মানুষ যেমন ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হয়ে গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে পারে; সৎকর্ম-পরিচালিত জ্ঞান-ভক্তি-রূপ যান সেইরকম মুক্তিকামী জনকে ভগবানের দিকে ক্রমে অগ্রসর করিয়ে দেয়। যার দ্বারা বহন করে নেয়, তা-ই যান। মানুষের পদদ্বয়ও সে হিসেবে যানস্বরূপ। জ্ঞান-ভক্তি-সহযুত কর্ম মানুষকে ক্রমে ক্রমে ভগবানের দিকে নিয়ে যায়। তাই তাদের পাদৌ বা যান বলা যেতে পারে। এই ভাব উপলব্ধি করেই, এখানে রূপকে এই ভাব পরিব্যক্ত আছে বুঝেই, মন্ত্রের অন্তর্গত পাদৌ পদে আমরা জ্ঞানভক্তি-রূপৌ-যানৌ বা সকাম নিষ্কাম-কর্মরূপৌ যানৌ অর্থ আমনন করেছি। তাতে যে অর্থ হয় তা বঙ্গানুবাদে ব্যক্ত হয়েছে।-কর্ম যদি জ্ঞানভক্তি-সম্মিলিত সৎ-উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়, তাহলেই সে কর্ম ইষ্টফল প্রদান করতে পারে। তাই কর্ম, যাতে ভগবান্ পরিতুষ্ট হন। সেই কর্ম অর্থই জ্ঞানভক্তিসহযুত কর্ম-সৎকর্ম। সৎস্বরূপ ভগবান, সৎকর্ম ও সৎ-অনুষ্ঠানেই পরিতৃপ্ত হন। পক্ষান্তরে, মানুষের দুরকম কর্মও–সকাম ও নিষ্কাম–মানুষকে (ঐ দুই কর্মরূপ যানই) ভূলোক হতে স্বর্গলোকে নিয়ে যায়। সকাম ভাবেই সাধিত হোক, আর নিষ্কাম-ভাবেই সাধিত হোক,–সকমে শুভফল-লাভ অনিবার্য। সে পক্ষে সকাম ও নিষ্কাম কর্মদ্বয় জ্ঞানভক্তির সাথে মিলিত হোক, এইরকম আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। মর্ম উভয়ত্রই অভিন্ন। মন্ত্রের গৃহান পদের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ–উদ্দিষ্ট পুরুষস্য গৃহান অথবা পালকস্য পররাষ্ট্ৰাধীশস্য শত্রোঃ গৃহা। মন্ত্রে গৃহান্ পদ বহুবচনে, প্রযুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা এটির বচন-ব্যত্যয় স্বীকার করেছি; সেই অনুসারে আমাদের অর্থ– শ্রেষ্ঠনিবাসং ভগবন্তং। ভগবান্ এক; কিন্তু তিনি এক হয়েও বহু, আবার বহু হয়েও এক। এই ভাব ও উপলব্ধি করেই আমরা তাতে একবচন স্বীকার করেছি।-মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশে ইন্দ্রাণী পদ আছে। ইন্দ্রাণী –ভগবানের শক্তিরূপা, বিভূতি। কর্মেই শক্তি প্রকাশ পায়। ভগবানের শক্তিরূপা বিভূতিকে লক্ষ্য করবার তাৎপর্য এই যে, আমরা যেন শ্রেষ্ঠ শক্তিসমম্বিত হই।-মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব হয় এই যে,-সৎকর্মের প্রভাবে শক্তিসঞ্চয়ে, আমরা যেন আমাদের অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রু সকল শত্রুকেই বিনাশ করতে পারি। জ্ঞান-ভক্তি-কর্মের সহায়তায় অগ্রসর হয়ে আমরা যেন আমাদের ইষ্টফল মোক্ষ প্রাপ্ত হই এবং ভগবানে লীন হয়ে যাই। মোক্ষলাভাকাঙ্ক্ষী সাধক এমন প্রার্থনাই করে থাকেন। এটাই তার প্রাণের আকাঙ্ক্ষা। ৪

.

সপ্তম সূক্ত : রক্ষোঘ্নম

[ঋষি : চাতন দেবতা : অগ্নি, যাতুধানী ছন্দ : অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংক্তি]

প্রথম মন্ত্রঃ উপ প্রাগাদ্দেবো অগ্নী রক্ষোহামীবচাতনঃ। দহনুপ দ্বয়াবিনো যাতুনা কিমীদিনঃ ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –হিংসক শত্রুগণের (রিপুশত্রুসমূহের) নাশকারী, পাপপ্রবৃত্তিরূপ রোগসমূহের বিনাশক, দ্যোতমান জ্ঞানদেব, সেই মায়াবী রন্ধ্রান্বেষী (প্রচ্ছন্নচারী) সর্বশোষক শত্রুগণকে ভস্মসাৎ করে, জ্ঞানলাভে ব্যাকুলচিত্ত সাধককে অথবা শত্রুর আক্রমণে উদ্বিগ্নচিত্ত ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ তার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন। (মন্ত্রটি ভগবান্ জ্ঞানদেবের মাহাত্ম্যমূলক। জ্ঞানের উদয়ে জ্ঞানের প্রভাবে সকল শত্রুই বিনাশপ্রাপ্ত হয়। অতএব অজ্ঞান আমরা, জ্ঞান-সঞ্চয়ে প্রবুদ্ধ হই) ॥১॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটি সরল ভাব-প্রকাশক। ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ গ্রহণ করেছেন, আমাদের পরিগৃহীত অর্থের সাথে তার প্রায়ই মতান্তর ঘটেনি। আমাদের অর্থ উপরোক্ত বঙ্গানুবাদেই পরিব্যক্ত।—উদ্বিগ্নমানস ব্যক্তির উদ্বেগনিবৃত্তির জন্য এই মন্ত্রের প্রয়োগের বিষয় সূক্তানুক্রমণিকায় উল্লিখিত হয়েছে। সেই অর্থে শুক্লবীরিণোষিকার দ্বারা মনিবন্ধন এবং উলুকদ্বয় ঘর্ষণ প্রভৃতির বিধি আছে। সেই অনুসারে ভাষ্যের ভাব দাঁড়ায় এই যে,-দ্যোতমান দানাদিগুণযুক্ত এবং অঙ্গনাদিগুণবিশিষ্ট অগ্নিদেব উদ্বেগকারী রক্ষ প্রভৃতি শত্রুর বিনাশের জন্য উদ্বেগযুক্ত ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হন। কিন্তু সেই অগ্নির সেইরকম সামর্থ্য কোথায়? সে বিষয়ে কথিত হচ্ছে; যথা,–তিনি রক্ষোহা অর্থাৎ হিংসক পিশাচ ইত্যাদির হন্তা, তিনি অমীবচাতনঃ অর্থাৎ রোগসমূহের নাশয়িতা। দ্বিভাবসম্পন্ন মায়াময় রন্ধ্রান্বেষণবুদ্ধিযুক্ত রাক্ষসগণকে ভস্মসাৎ করে তিনি উদ্বিগ্নচিত্ত ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হন।–আমাদের ব্যাখ্যা অনেকাংশে ভাষ্যকারের মতের অনুবর্তী হলেও কোনও কোনও স্থলে বিশেষ পার্থক্য দেখা যায়। ভাষ্যানুসারী ব্যাখ্যা ছাড়াও মন্ত্রের মধ্যে যে আর এক ভাব নিহিত আছে, তাতে তা-ই প্রকাশ পেয়েছে। চিত্তের উদ্বেগ যে কেবল যজ্ঞনাশকারী রাক্ষসগণের দ্বারাই সাধিত হয়–তা নয়। সেও এক উদ্বেগের কারণ বটে; বহিঃশত্ৰু মানুষকে নানাভাবইে উদ্বিগ্ন করে থাকে সত্য; কিন্তু সে বহিঃশত্রু ছাড়াও, আন্তরশত্রুও যে আছে–তারাও যে নানারকমে উদ্বিগ্ন করতে পারে; মন্ত্রার্থে এমন ভাবও অধ্যাহৃত হয়না কি? বিশেষতঃ যে দেবতার করুণা প্রার্থনা করা হয়েছে, তাঁকে যখন রক্ষোহা ও অমীবচাতনঃ বিশেষণে পরিচিত হতে দেখছি; তখন মন্ত্রে বহিঃশত্রুর ও অন্তঃশত্রুর, দুরকম শত্রুর, উপদ্রবজনিত উদ্বেগ-নাশের কামনাই প্রকাশ পেয়েছে, বুঝতে পারি। ভাষ্যকার  সাধারণভাবেই মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশন করেছেন। কিন্তু তার মধ্য হতেও মন্ত্রে অন্যভাব নিষ্কাশিত হতে পারে।–ভাষ্যকার মন্ত্রের উপ প্রাগাৎ পদের অর্থ করেছেন,-উদ্বিজমানং পুরুষং উপগমৎ অর্থাৎ উদ্বেগপ্রাপ্ত ব্যক্তির নিকটে গমন করেন অথবা তাকে প্রাপ্ত হন। শান্তি-অপহরক শত্রু অথবা রাক্ষস চিরদিনই মানুষকে অহরহ আক্রমণ করছে–সদাকাল মানুষের শান্তি অপহরণ করে তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। সে শত্ৰু সকলের হৃদয়েই চিরবিদ্যমান–সে শত্ৰু অতি কপটচারী, সে শত্রু সর্বশোষক। এই শত্রুকে আমরা অজ্ঞানতা এবং তার সহচর কাম ইত্যাদি রিপুশত্রু প্রভৃতি বলেই মনে করি। অজ্ঞানতাই যে মানুষের পরম শত্রু, অজ্ঞানতাতেই যে মানুষের সকল সুখ-শান্তি নষ্ট হয়, অজ্ঞানতার প্রভাবেই যে আন্তর-বাহ্য সকল রকম উদ্বেগ অশান্তির উদয় হয়, তা আর বোঝাতে হবে না। ভগবান্ যখন সেই শত্রুকে মানুষের সম্বন্ধ হতে বিচ্ছিন্ন করেন, তখনই মানুষের সকল উদ্বেগ নষ্ট হয়। তখনই মানুষ প্রকৃত সুখ-শান্তির অধিকারী হতে পারে। তখনই জ্ঞানজ্যোতীরূপে ভগবান হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন।…জ্ঞানের প্রভাবে অজ্ঞানতা যেমন নাশ প্রাপ্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে তার সহচর রিপুগণের প্রভাবও তেমনই অন্তর্হিত হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের সে জ্ঞানলাভ হয় কখন? ভগবান্ কখন এসে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন? যখন মানুষ তাকে পাবার জন্য অকুলি-ব্যাকুলি করে, যখন জ্ঞানলাভের জন্য মানুষ একান্ত উৎসুক হয়, তখনই তাঁর আবির্ভাব সম্ভবপর। যতক্ষণ সংসারের ক্লেদ কালিমা মানুষকে ঘিরে থাকে, যতক্ষণ মানুষের আন্তর বাহ্য কপটতা বিদূরিত না হয়, ততক্ষণ তার জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষাও হয় না–ভাগবানকে পাবার জন্যও সে ব্যাকুল হতে পারে না। সেই জন্যই মন্ত্রের উপ প্রাগাৎ পদের সার্থকতা। যখনই মানুষের সে আকাঙ্ক্ষা জন্মে, তখনই সকল বাধা-বিঘ্ন অপসারিত করে, ভগবান্ তার অন্তরে দিব্যজ্ঞানজ্যেতিঃ বিকীরণ করে থাকেন। মন্ত্রের উপ-প্রাগাৎ পদের এটাই তাৎপর্য বলে মনে করি।-মন্ত্রে অমীবচাতনঃ পদেরও সেই হিসেবে সার্থক-প্রয়োগ উপলব্ধ হয়। ঐ পদের ভাষ্যানুসারী অর্থ–রোগাণাং চাতয়িতা নাশয়িতা; অর্থাৎ, তিনি রোগসমূহকে নাশ করেন। যেমন লৌকিক হিসেবে, তেমনি আধ্যাত্মিক হিসেবে–উভয় পক্ষেই এই বিশেষণের সার্থকতা আছে। যখন দেহে ব্রি-ধাতুর (বায়ু-পিত্ত-কফের) সমতা রক্ষিত হয়, তখনই দেহ সুস্থ থাকে। কিন্তু ঐ তিনটির কোনও একটির তারতম্য ঘটলে, শরীরে রোগের উৎপত্তি হয়। উপযুক্ত ঔষধের ও পথ্যের ব্যবহারে ত্রি-ধাতুর সাম্য-সাধন হলে, দেহ পুনরায় সুস্থতা প্রাপ্ত হয়। সে পক্ষেও ভগবানের অনুগ্রহ যেমন প্রয়োজন, আধ্যাত্মিক পক্ষেও তার অনুগ্রহ সেই রকম একান্ত আবশ্যক। পাপের সংশ্রব ভিন্ন রোগের উৎপত্তি হয় না। মানুষের অবৈধ আহারে-বিহারে যেমন ত্রি-ধাতুর বৈষম্য সাধিত হয়, সেইরকম অসৎ-আচরণে কুকর্ম-সাধনে মানুষের পাপোৎপত্তি ঘটে। মানুষে সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ ত্রিগুণের সাম্য সাধন হলে, সেই পাপপ্রবৃত্তি আর জন্মে না–পাপের উৎপত্তিও তখন আর সম্ভবপর হবে না। উপযুক্ত ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থায় যেমন রোগের শান্তি হয়, সেইরকম সৎকর্মের সাধনে জ্ঞানের উদয়ে পাপ-প্রবৃত্তি রূপ রোগ বিনষ্ট হয়ে থাকে। এস্থলে, রূপকে তাই অমীবচাতনঃ পদে ভগবানকে পাপ বা পাপ-প্রবৃত্তিরূপ রোগসমূহের নাশয়িতা বলা হয়েছে।এইভাবে মন্ত্রের রক্ষোহা ও দেব প্রভৃতি বিশেষণেরও সার্থকতা আছে। বহিঃশত্রুকেও রাক্ষস বলা যায়; অন্তঃ-শত্রুকেও রাক্ষস বলা যায়। অজ্ঞানতাই প্রধান অন্তঃশত্রু। বহিঃশত্রু যে, সেও অজ্ঞানতার প্রভাবেই সঞ্জাত হয়।-মন্ত্রে যে প্রার্থনার ভাব প্রচ্ছন্ন রয়েছে, তা এই, মানুষ! তুমি অহরহ শত্রুর আক্রমণে বিধ্বস্থ হচ্ছে। সে আক্রমণের ফলে, তোমার সকল সুখ-সকল শান্তি নষ্ট হচ্ছে; তুমি সর্বদা অশান্তির অনলে জ্বলে মরছে। যদি শত্রুর আক্রমণে পরিত্রাণ পেতে চাও, যদি প্রকৃত সুখ-শান্তি-লাভের আকাঙ্ক্ষা রাখো, জ্ঞানলাভে অজ্ঞানতানাশে প্রবুদ্ধ হও। অজ্ঞানতাই তোমার যত অনর্থের মূল। তোমার হৃদয়ে জ্ঞানের উদয় হলে, অজ্ঞানতা নাশপ্রাপ্ত হবে, অজ্ঞানতার সহচর কাম ইত্যাদি রিপুশত্রু দূরে পলায়ন করবে। পাপরূপ রোগসমূহের আক্রমণে আর তুমি জীর্ণ শীর্ণ হবে না। অতএব, জ্ঞানলাভে প্রযত্নপর হও। হৃদয়ে জ্ঞানের জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হলে, হৃদয় নির্মল হলে, জ্ঞানরূপী ভগবান আপনিই এসে সে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হবেন। তখনই তোমার সকল জ্বালার নিবৃত্তি হবে–তখনই তুমি প্রকৃত সুখ ও শান্তির অধিকারী হতে সমর্থ হবে। হৃদয়ে জ্ঞানের উদয় হলে, মনঃপ্রাণ ভগবানে ন্যস্ত করতে পারলে, কি অন্তর-শত্রু, কি বহিঃশত্রু, সকল শত্রুই নাশ-প্রাপ্ত হয়। মন্ত্রে এই উপদেশ প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ প্রতি দহ যাতুথানান্ প্রতি দেব কিমীদিনঃ। প্রতীচীঃ কৃষ্ণবর্তনে সং দহ যাতুধান্যঃ ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –দানাদিগুণযুক্ত দ্যোতমান হে ভগবন্! যাতনাবিধায়ক রাক্ষসগণকে (অথবা সৎ-ভাবের নাশক অন্তঃশত্রুগণকে) সর্বত্র নিঃশেষে ভস্মসাৎ করুন; রন্ধ্রান্বেষণী প্রচ্ছন্নাচারী রিপুশত্রুগণকে নিঃশেষে দগ্ধীভূত করুন; অপিচ, হে পবিত্রকারী দেব (অথবা দুষ্কৃতজনের সৎপথে নয়নকর্তা হে দেব)! জীবগণের প্রতিকুলাচারী শাত্রব উপদ্রব-সমূহকে সম্যকরূপে ভস্মসাৎ করুন অর্থাৎ নিঃশেষে বিদূরিত করুন। (এই মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এই মন্ত্রে বহিঃশত্রু ও অন্তঃশত্রুর নাশের পর জ্ঞানলাভের প্রার্থনা প্রজ্ঞাপিত হয়েছে)। ২।

মন্ত্ৰাৰ্থআলোচনা— এই সরল ও সহজবোধ্য মন্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ কোনও মতান্তর ঘটেনি। পুর্ব-মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রেও শত্রুনাশের প্রার্থনা জানানো হয়েছে। ভাষ্যপাঠে মন্ত্রে স্থূলভাবে রক্ষ-পিশাচ ইত্যাদি সাধারণ শত্রুর প্রতিই লক্ষ্য আছে। আমরা এই শত্রু বলতে কি বুঝি, তা উপরোক্ত বঙ্গানুবাদে উক্ত হয়েছে এবং পূর্বের মন্ত্রটিতে আলোচিত হয়েছে। ফলতঃ এখানে বহিরান্তর সকল দিকের শত্রু-নাশের আকাঙ্ক্ষা এবং ভগবানের প্রাপ্তি-কামনা প্রকাশ পেয়েছে।-মন্ত্রে অগ্নিকে কৃষ্ণবর্তনে বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অগ্নিশব্দ পর্যায়ে ঐ পদ পরিদৃষ্ট হয়। ভাষ্যকার ঐ পদের অর্থে মাত্র হে কৃষ্ণবর্ক্স লিখেই নিরস্ত হয়েছেন। অগ্নি কেন কৃষ্ণবর্ক্স অভিধায়ে বিভূষিত হন, সে বিষয়ের তিনি কোনই উল্লেখ করেননি এবং ঐ পদের কোনও সুষ্ঠু অর্থও প্রকাশ করেননি। আমরা ঐ সম্বোধন-পদে শত্রুনাশক দেব এবং কৃষ্ণানাং দুরাচারিনাং বর্তনি (বত্মনি) সৎপথি নয়নকত্রে অর্থ আমনন করেছি। এ-সম্বন্ধে আমাদের যুক্তি এই,–অভিধানে কৃষ্ণবর্তনি (কৃষ্ণবনি) পদের দুরাচার যার পথ অন্ধকারময় (কৃষ্ণো বনি মাগো যস্য) অর্থ দৃষ্ট হয়। যে দুরাচার, যে পাপী, তার পথই তো অন্ধকারময় কৃষ্ণবর্ণ। শাস্ত্রে পাপকে কৃষ্ণমূর্তি বলে উল্লিখিত আছে। কিন্তু, যাঁকে দেবতা বলে পূজা করি, যাঁর আশ্রয় গ্রহণ করে সংসার-বন্ধন হতে মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা করি, তাকে তো দুরাচার বা পাপ-সংসৃষ্ট বলতে পারি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি উচ্চ আদর্শেরই অনুসরণ করে; সৎ-জন সৎ-এরই আশ্রয় পেতে চায়। মোক্ষলাভে সৎ-স্বরূপ ভগবানই একমাত্র সহায়। অগ্নি-পাবক; অগ্নি-সংস্কারে সকলই পবিত্র-ভাব ধারণ করে। অতি পাপাচারী যে, সেও যদি অগ্নি-সংস্কারে সংস্কৃত হয়, সেও পবিত্র হয়ে থাকে। অজ্ঞানতাই–পাপের জনয়িতা। অজ্ঞানতার প্রভাবেই মানুষ সংসারে নানা পাপ-প্রবৃত্তির প্রলোভনে পড়ে নিরয়কূপে নিমজ্জিত হতে থাকে। পাপ–অপবিত্র। সেইজন্য পাপাচারীও অপবিত্র। কিন্তু সেই পাপী যদি একবার জ্ঞানরূপ অগ্নির সংস্কারে সুসংস্কৃত হয়, তার হৃদয়ে যদি একবার জ্ঞানের পবিত্র-জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হয়, তাহলে তার সকল অপবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়, জ্ঞানের প্রভাবে অজ্ঞানতা বিদূরিত হয়, পাপ-প্রবৃত্তির প্রলোভনে তখন আর তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না। তখন সে সৎপথে সৎ-এর দিকেই ক্রমশঃ আকৃষ্ট হতে থাকে। এই ভাব উপলব্ধি করেই আমরা ঐ কৃষ্ণবর্তনি পদে কৃষ্ণানাং দুরাচারিণাং বক্মনি সৎপথি নয়নকত্রে অর্থ অধ্যাহার করেছি। মন্ত্রের প্রতীচীঃ পদে এক বিশ্বজনীন ভাব অভিব্যক্ত হয়েছে। ঐ পদের ভাষ্যানুমোদিত অর্থই আমরা গ্রহণ করেছি। মন্ত্রের শেষাংশে বলা হয়েছে-প্রতীচীঃ যাতুধান্যঃ সংদহ। প্রাণিজাতের অর্থাৎ জীবগণের প্রতিকূলাচারী শাত্রব উপদ্রবসমূহকে সম্যকরূপে ভস্মসাৎ করুন (নিঃশেষে বিদূরিত করুন)। এখানে প্রার্থনাকারী কেবলমাত্র নিজ-শত্রু-নাশের–নিজের অজ্ঞানতা-বিনাশের প্রার্থনা জানিয়েই পরিতৃপ্ত নন। নিখিল বিশ্ব যাতে জ্ঞানলাভ করে, যাতে নিখিল বিশ্বের প্রাণিগণ পাপ হতে প্রতিনিবৃত্ত হয়; পরন্তু জগতের সকল প্রাণীই যাতে উদ্ধার লাভ করতে পারে, এ বিশ্বে যাতে পুণ্যের পূত প্রবাহ প্রবাহিত হয়,-মন্ত্রের শেষাংশে সেই বিশ্বজনীন উদার প্রার্থনাই প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রে এই ভাবই আমরা গ্রহণ করি। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্র যা শশাপ শপনেন যাঘং মূরমাদধে। যা রসস্য হরণায় জামারেভে তোকম সা॥ ৩॥

বঙ্গানুবাদ –যে প্রসিদ্ধ (বা পূর্বোক্ত) শত্রু, বিনাশহেতুভূত আয়ুধের (অথবা, সৎ-ভাব হরণের) দ্বারা, (আমাদের) আক্রমণ করে (অন্তর অধিকার করে); অথবা অপর যে সকল শত্রু, সকল দুষ্কৃতের অদিভূত (অথবা মোহজনক) অজ্ঞানতা-রূপ পাপের অনুষ্ঠান করে; অথবা অপর যে সকল শত্রুর অপত্য (তাদের হতে উৎপন্ন শত্রু) স্নেহরূপ সৎ-ভাবের (অথবা হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বের) অপহরণ (বিনাশ) করতে প্রবৃত্ত হয়; সেই সকল শত্রুর (অথবা আমাদের সেই সকল শত্রুসম্বন্ধি) অপত্যকে (অথবা শত্রু হতে জাত সর্বপ্রকার পাপকে) আমাদের হৃদয়স্থ সত্ত্বভাব ভক্ষণ (নাশ) করেন। (মন্ত্রে বিশেষভাবে শত্রুনাশের কামনা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রার্থনা,ভগবান্ সত্ত্বভাবের প্রভাবে জ্ঞানকিরণ-প্রদানে পাপমূল বিনাশ করুন এবং আমাদের সৎসম্বন্ধযুত করুন) ॥ ৩ ৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এ মন্ত্রটিও সরল প্রার্থনা-ব্যঞ্জক এবং বিশেষভাবে শত্রুনাশের কামনামূলক। পুর্বের মন্ত্র দুটিতে সাধারণভাবে শনাশের প্রার্থনা আছে। এই মন্ত্রে এবং এর পরবর্তী মন্ত্রে বিশেষভাবে শুক্রনাশের বিষয়ে প্রার্থনা জানানো হয়েছে।–এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ কোনই মতান্তর ঘটেনি। তবে আমাদের পরিগৃহীত পন্থার অনুসরণে কয়েকটি পদের প্রতিবাক্যে আমরা ভাষ্যাতিরিক্ত অপর অর্থও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। প্রথম শপনেন পদ। ঐ পদের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ–আক্রোশেন, নাশহেতুভূতেন পরুষবচনেন; আমরা এর অতিরিক্ত বিনাশহেতুভূতেন আয়ুধেন, যদ্বা-সম্ভাব-হরণেন অর্থ অধ্যাহার করেছি। মানুষের হৃদয়-সঞ্জাত সৎ-ভাবসমূহ নষ্ট হলেই মানুষ। জীবৎ-মৃত হয়ে পড়ে। পাপী যে, তার জীবনই তো বৃথা। মূরং পদে আমরা ভাষ্যানুমোদিত অর্থই অক্ষুণ্ণ রেখেছি। ভাষ্যের অর্থেই মন্ত্রের ভাব অতি সুন্দর পরিরক্ষিত হয়েছে। সকল দুষ্কৃতের মূল–সেই অজ্ঞানতা হতেই হিংসা-ক্রোধ লোভ মায়া মোহ কামনা বাসনা প্রভৃতির উদ্ভব হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে অঘং পদের অজ্ঞানতারূপং পাপং অর্থ বেশ সুষ্ঠুভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। রসস্য পদের আমরা স্নেহরূপস্য সদ্ভাবস্য, হৃতস্য শুদ্ধসত্তস্য অর্থ অধ্যাহার করেছি। হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদির প্রভাবে মনে নিত্য নূতন কামনার যে উদয়ে, মানুষের জন্মসহজাত সৎ-ভাবরাশি নষ্ট হয়ে যায়। কামনার অ-পরিপূরণে ক্রোধ ইত্যদির উৎপত্তি ঘটে, এবং তা হতে ক্রমশঃ হিতাহিত বিবেকাভাব ও পরে বুদ্ধিনাশ হয়ে মানুষ মৃতকল্প হয়। তখন হৃদয়ে আর সৎ-ভাবের লেশমাত্র থাকে না; তখন অজ্ঞান-সহচর রিপুগুলি হৃদয়ক্ষেত্র অধিকার করে বসে। সেই জন্য, অজ্ঞানতা হতে উৎপন্ন কামক্রোধ ইত্যাদিকে অজ্ঞানতার অপত্য বলা হয়েছে।–মন্ত্রের শেষ অংশে তোকম সা অংশে, পূর্বোক্ত অজ্ঞানোৎপন্ন সবরকম শত্রুনাশের কামনা প্রকাশ পেয়েছে। মূল যদি উচ্ছিন্ন হয়, শাখাপ্রশাখা কতক্ষণ জীবিত থাকে? যে শত্রু সকল দুষ্কৃতের মূল, যে শত্রু সংসারের সকল রকম বন্ধনের হেতুভূত সেই শত্রুকেই যদি বিনাশ করতে পারা যায়, তাহলে আর ভাবনা কিসের? তখন, সকল অন্ধকার টুটে যায়, তখন জ্ঞানের পূর্ণজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণে হৃদয়-ক্ষেত্র দেবতার আসনে পরিণত হয়। তখন আর সৎ-ভাব-হারক শত্রুর আক্রমণে বিধ্বস্ত হতে হয় না। তখন আর হৃদয়ে সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বভাবেরও অপচয় ঘটে না। তখন সৎ-ভাবে সৎ-স্বরূপকেই টেনে আনে; তখন হৃদয়ে সৎস্বরূপের অধিষ্ঠান হয়; তখন সংসারের সকল বন্ধন টুটে যায়; তখনই পরাগতি মুক্তি অধিগত হয়ে আসে। রূপকে রাক্ষস-নাশের প্রার্থনায় মন্ত্রের মধ্যে এই ভাবই নিহিত রয়েছে বলে আমরা মনে করি ॥ ৩

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ পুত্ৰমত্ত্ব যাতুধানীঃ স্বসারমুত নপ্ত্য। অধা মিথো বিকেশ্যো ই বি ঘুতাং যাতুধানন্যা ই বি তৃহন্তামরায্যঃ ॥৪॥

বঙ্গানুবাদ –হে ভগব। আপনার কৃপায় রাক্ষসীগণ অর্থাৎ অজ্ঞানতাসহচারিণী সকল অসৎ-বৃত্তি, তাদের আত্মজকে অর্থাৎ আমাদের শত্রু কাম ইত্যাদি রিপুকে ভক্ষণ করুক অর্থাৎ বিনাশ করুক; এবং তাদের ভগিনীকে অর্থাৎ তাদের সহজাত অপকর্মকে ভক্ষণ করুক অর্থাৎ বিনাশ করুক; আরও, তাদের পৌত্রকে অর্থাৎ কাম ইত্যাদি হতে উৎপন্ন নানা পাপসম্বন্ধকে ভক্ষণ করুক অর্থাৎ বিনাশ করুক; (ভাব এই যে,-কণ্টকের দ্বারা যেমন কণ্টক উৎপাটিত হয়, সেইরকম শত্রুর দ্বারাই শত্রুগণ নাশপ্রাপ্ত হোক); এই রকমে শত্রুর দ্বারা শত্রুবংশ নাশের পর সেই অসৎ-বৃত্তিসমূহ, পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহের দ্বারা বিচ্ছিন্ন-কেশা (ছিন্নভিন্ন হয়ে, পরস্পর তাড়নার দ্বারা নিহত হোক; এই রকমে সৎকর্মনিবরাধিকা পাপপ্রবৃত্তিসমূহ বিশেষভাবে পরস্পরকে হিংসা করুক। (ভাব এই যে, বিষধর সর্প যেমন পরস্পরকে দংশন করে উভয়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়, আমাদের অসৎ-প্রবৃত্তিসমূহ সেইরকম পরস্পরের শত্রুতা-আচরণে পরস্পর নিহত হোক)। ৪

 মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মন্ত্রটি একটু জটিলতাপূর্ণ।পুত্র শসা পৌত্র প্রভৃতি কয়েকটি পদ মন্ত্রের মধ্যে দৃষ্ট হয়, তাতেই সেই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ভাষ্যমতে, এই মন্ত্রে সপুত্রবান্ধব রাক্ষসগণের বিনাশের বিষয় উক্ত হয়েছে। রাক্ষসগণ যজ্ঞ নষ্ট করতো; সেই জন্য, যজ্ঞরক্ষার উদ্দেশ্যে রাক্ষসগণের বিনাশের নিমিত্ত অগ্নির নিকট প্রার্থনা জানানো হয়েছে।-মন্ত্রের মর্মার্থ-গ্রহণে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের মতপার্থক্য রয়েছে। ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ করেছেন, তার কিছুটা এই,-পুত্রবান্ধবের সাথে রাক্ষসনাশের বিষয় কথিত হচ্ছে। পূর্বোক্তলক্ষণযুক্তা রাক্ষসীরা তাদের পুত্রকে ভক্ষণ করুক; তাদের ভগিনীকে ভক্ষণ করুক, এবং তাদের পৌত্রকে ভক্ষণ করুক। পুত্র, ভগ্নী ও পৌত্র ইত্যাদি ভক্ষণের পর, তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন-কেশা হয়ে পরস্পরকে পরস্পর বিতাড়ন-পূর্বক সংহার করুক। দানপ্রতিবন্ধক পিশাচীগণ পরস্পরকে হিংসা করতে প্রবৃত্ত হোক।–আমাদের ব্যাখ্যাতেও এই ভাবই উপলব্ধ হবে। তবে পার্থক্য এই যে, প্রচলিত ব্যাখ্যা হতে, আমাদের ব্যাখ্যা ভাব-পক্ষে একটু স্বতন্ত্র পথ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের ব্যাখ্যানুসারে, অন্তর্যজ্ঞের বিপ্ন-উৎপাদনকারী অন্তঃশত্রুর প্রতিই লক্ষ্য পড়ছে। হৃদয়ে মানসযজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়েছে; ভক্ত সাধক সে যজ্ঞে আহুতি দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন; আর অমনি রজোরূপী অন্তঃশত্ৰু কাম-ক্রোধ ইত্যাদি এসে সে যজ্ঞ পণ্ড করে দিচ্ছে। সাধক তাই ব্যাকুল-চিত্তে, সেই সকল শত্রু-নাশের প্রার্থনা জানাচ্ছেন; বলছেন,-দেব! এমনই করুন, যাতে শত্রুরা আপনা-আপনিই বিনষ্ট হয়; যাতে তারা আপন-আপন সন্তান-সন্ততিকে ভক্ষণ করে, নিজেদের বংশের মূল নিজেরাই উম্মলিত করে। প্রার্থনার মর্ম এই,অজ্ঞানতাই প্রধান শত্রু; অসৎ-বৃত্তিসমূহ তার সহচর। কাম ইত্যাদি অজ্ঞানতা হতে উৎপন্ন। সুতরাং তার পুত্রস্থানীয়। জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞানতা বিদূরিত হলে, তার সহচর অসৎ-বৃত্তি এবং তা হতে উৎপন্ন কাম-ক্রোধ ইত্যাদি বিনাশ-প্রাপ্ত হয়। সুতরাং অজ্ঞানতাই তখন তাদের ভক্ষণ করে। এইরকম ক্ৰম-পর্যায়ে হৃদয়ের অসৎ-বৃত্তিসমূহের একটি নষ্ট হলে তাদের দ্বারা উৎপন্ন অপর বৃত্তিসমূহ নষ্ট হয়ে যায়। এ থেকেই পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণের ভাব আসে। কণ্টকের দ্বারা যেমন কণ্টক উৎপাটিত হয়, সেইরকম শত্রুর দ্বারাই শত্রুরা বিনাশপ্রাপ্ত হয়।–মন্ত্রের একটি পদযাতুধানী। স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহৃত ঐ পদের প্রতিবাক্যে ভাষ্যকার কাঁচন উদীরিতলক্ষণা রাক্ষসী অর্থ করেছেন। আমরাও সেই ভাবই অক্ষুণ্ণ রেখেছি। তবে আমাদের পরিদৃষ্ট রাক্ষসী-সাধারণ রাক্ষসী নয়। যে রাক্ষসী হৃদয়ে অবস্থিত থেকে মানুষকে অহরহ বিভ্ৰমগ্রস্ত ও বিপথে পরিচালিত করছে, আমরা যাতুধানী পদে সেই রাক্ষসীকেই লক্ষ্য করেছি।…লৌকিক জগতে সাধারণ রাক্ষসী যেমন যজ্ঞনাশ করে যজ্ঞকারীর অভীষ্ট-পূরণে বাধা জন্মায়, তেমনই হৃদয়-রাজ্যে অসৎ-বৃত্তিসমূহ হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে, হৃদয়ের সৎ-ভাব ও সৎ-বৃত্তিগুলি নষ্ট করে, সাধকের অভীষ্ট-পূরণে–ভববন্ধন-ছেদনে বিঘ্ন জন্মিয়ে থাকে।… যাতুধানীর পুত্র অর্থে, অসৎ-বৃত্তি হতে উৎপন্ন কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রুকে বোঝাচ্ছে। …এখন দেখা যাক, মন্ত্রের অন্তর্গত পুত্রং স্বসারং নপ্ত্যং প্রভৃতি যাতুধানীঃ পদের সাথে কিরকম সম্বন্ধ-সূত্রে গ্রথিত রয়েছে। যাতুধানী পদে অজ্ঞানতাসহচারিণী অসৎ-বৃত্তি; পুত্রং পদে অসৎ বৃত্তি হতে উৎপন্ন কাম-ক্রোধ ইত্যাদি; স্বসারং পদে অসৎ-বৃত্তি-সহজাত অপকর্মসমূহ; এবং নপ্ত্যং পদে কামক্রোধ ইত্যাদি হতে যে পাপসম্বন্ধের উদ্ভব হয়, তাকেই বোঝাচ্ছে। এ সকলই সংসার-বন্ধনের হেতুভূত;–এ সকলই মানুষের পরম শত্রু। ভগবৎ-ভক্ত সাধক, ভগবানে আত্মলীন হবার প্রয়াসী হয়ে, এই সকলের বিনাশের প্রার্থনাই করে থাকেন। অন্তঃশত্রু নাশ হলেই বহিঃশত্রু বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। উদারচরিতানান্তু বসুধৈব কুটুম্বক। মন নির্মল হলে, সকল ভূতে সমদর্শন-সামর্থ্য জন্মালে, তখন আর শত্ৰুমিত্র আত্মপর ভেদাভেদ জ্ঞান থাকে না; তখন সকলই এক সকলেই সমান স্নেহপ্রীতির সামগ্রী। সেই ভাব প্রকটনের জন্যই মন্ত্রে আন্তর বাহ্য সকল শত্রু-নাশের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। একের নাশে অপরের বিনাশের ভাব–সেই হতেই প্রকট হয়ে পড়েছে। মন্ত্রের অরায্য পদে ভাষ্যকার দানপ্রতিবন্ধকাঃ পিশাচ্যঃ অর্থ পরিগ্রহণ করেছেন। আমাদের অর্থও সেই অনুসারী হয়েছে। তবে ভাষ্যকারের অর্থে সাধারণ রাক্ষস-পিশাচ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য পড়ে। কিন্তু ঐ পদে আমাদের আন্তর শত্রুর বিষয়ই উপলব্ধ হয়। সেই ভাব উপলব্ধি করেই আমরা ঐ পদের সৎকর্ম-নিরাধিকা পাপপ্রবৃত্তয়ঃ অর্থ আমনন করেছি। দান ইত্যাদি কর্ম সৎ-কর্মের মধ্যে পরিগণিত। সৎবৃত্তির উন্মেষে হৃদয়ে সৎকর্মের সাধনে আকাঙ্ক্ষা জন্মে। অসৎপ্রবৃত্তিগুলি সে আকাঙ্ক্ষায় বিঘ্ন উৎপাদন করে। হৃদয়ে যদি সৎকর্ম-সাধনের আকাঙ্ক্ষাই না জন্মালো, তাহলে সকর্ম সম্পন্ন হবে কেমন করে? রক্ষঃ পিশাচ ইত্যাদি যেমন বহির্যাজ্ঞিকের যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদি সঙ্কর্মে বিঘ্ন উৎপাদন করে; সেইরকম অন্তরস্থরক্ষঃ-পিশাচ-সমূহ–অসৎপ্রবৃত্তিরাজি–অন্তর্যাজ্ঞিকের সকর্ম-সাধন-প্রবৃত্তি-উন্মেষের অন্তরায় হয়।… এইভাবে মন্ত্রে যে উচ্চ প্রার্থনার ভাব পরিব্যক্ত, তা এই,–কণ্টকের দ্বারা কণ্টক যেমন উৎপাটিত হয়,, সর্পদংশনে সর্প যেমন পঞ্চত্ব পেয়ে থাকে; হৃদয়ের অন্তঃশত্রু সমুদয়ও সেইরকম পরস্পর পরস্পরকে অস্ত্র তাড়না করে বিনাশপ্রাপ্ত হোক। অর্থাৎ,জ্ঞানের উদয়ে অজ্ঞানতা দূরে যাক এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সহচর, তার সহজাত ও তার হতে উৎপন্ন অসৎ-বৃত্তি, কাম ইত্যাদি রিপু, অপকর্ম সাধনের প্রবৃত্তি এবং সেই সমুদায় হতে সঞ্জাত নানা পাপ-সম্বন্ধ বিনাশপ্রাপ্ত হোক। আমরা মনে করি, মন্ত্রে এই ভাবই পরিস্ফুট।। ৪।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *