হিসেবের বাইরে

হিসেবের বাইরে

সকাল সাতটাও নয় তখন। বাইরের বাঁধানো দাওয়ায় গরম চাদর মুড়ি দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলাম। একটু আগে এখানে বসেই প্রাথমিক চায়ের পর্ব শেষ হয়েছে। শীতের সকাল কুয়াশায় ঢাকা। রোদের ছিটেফোঁটাও নেই এখন পর্যন্ত। তাছাড়া কলকাতা থেকে এখানকার এই খোলামেলা জায়গায় শীতও বেশি। নিউ ব্যারাকপুরের লোকালয় ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে বন্ধুর এই বাড়ি। না শহর না গ্রাম। বন্ধুর আমন্ত্রণে দুদিনের অবকাশ কাটাতে এখানে আসা। একই আপিসে পাশাপাশি চাকরি করি। তবে চাকরিতে বন্ধুটি আমার থেকে কিছুটা পদস্থ। তার ওপর অফিস ইউনিয়নের হোমরা-চোমরা একজন। সকলেই মান্যগণ্য করে। এমন কি মালিকরাও তাকে একটু-আধটু সমীহ করে। কলকাতা থেকে একটু দূরে থাকার বাসনায় এইখানে জমি কিনে বছরখানেক আগে এই ছিমছাম ছোট বাড়িটি করেছেন ভদ্রলোক। এখান থেকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন এখন। দিনের কাজকর্ম চুকিয়ে একবার বাড়ি এসে বসতে পারলেই কি-যে মহাশান্তি সেকথা অজস্রবার শুনিয়েছেন। আর, একবার এসে দেখে যাবার তাগিদও বহুবার দিয়েছেন। গত সন্ধ্যায় আপিস ফেরত দুজনে এক সঙ্গেই চলে এসেছি। আগামী কালটা দুজনেই ছুটি নিয়েছি। তার পরদিন রবিবার। অতএব প্রাণখোলা আড্ডার ঢালা অবকাশ।

শীতের সকালে কলকাতায় সাড়ে সাতটা-আটটার আগে লেপের তলা থেকে বেরুতে পারি না। কিন্তু এখানে ছটা না বাজতে কেউ যেন ঠেলে তুলে দিল। তার বেশ খানিক আগে থেকেই পাখির কিচির-মিচির কানে আসছিল। ভোরের আলোয় তারা যেন মিষ্টি আলাপের আসর বসিয়েছে। এখানে কুয়াশা মাখা সকাল কলকাতার মতো নয়। ধোঁয়ার গন্ধের লেশমাত্র নেই। লেপের মায়া ছেড়ে উঠে পড়েছিলাম। ঘরের পিছনের দিকের জানলার সামনে চুপচাপ খানিক দাঁড়িয়েছিলাম। অনেকটা জায়গা। জুড়ে ধানী জমি। কুয়াশায় ভালো চোখ চলে না, তবু মনে হল ওই জমিটার পাশ দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার শেষ কোথায় গিয়ে মিশেছে তা আর আদৌ ঠাওর হচ্ছিল না।

বাইরের দাওয়ায় বন্ধুর সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছি। তিনি রাত থাকতে ওঠেন, সন্ধ্যা আহ্নিক করেন। এরই মধ্যে তার সব কিছু সারা। মুখ হাত ধুয়ে তার পাশে এসে বসলাম। তিনি হেসে বললেন, এত ঘুমোও কি করে বাপু! তুমি উঠবে-উঠবে। করে গিন্নি সেই কখন চায়ের জল চড়িয়ে বসে আছে।

বললাম, আজ তো তবু ঢের আগে উঠেছি, সাড়ে ছটাও নয় এখন

দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল। সর্ব ব্যাপারে আমার এই বন্ধুটির হিসেবের বায়ু আছে। হিসেবের ভিতর দিয়ে সবকিছুরই একটা পাকা চিত্র ছকে ফেলার ঝোঁক। চা খেতে খেতে যখন শুনলেন কলকাতায় সাড়ে সাতটার আগে আমার ঘুমই ভাঙে না, ছুটির অবকাশে তক্ষুনি একটা হিসেব মাথায় ঢুকে গেছে তার। এগারোটায় শুয়ে সাড়ে সাতটায় ওঠা মানে কম করে আট-সাড়ে আট ঘন্টার ঘুম–আট ঘণ্টাই ধরা। যাক। তাহলে এক মাসে অর্থাৎ তিরিশ দিনে দুশ চল্লিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটে-বছরে হল গিয়ে দুশ চল্লিশ ইনট বারো–হল গিয়ে দু হাজার আটশ আশী ঘণ্টা। তাহলে ধরো মোট যদি পঁচাত্তর বছর বাঁচো তাহলে

আমি ভাবলাম এই হিসেবটা আর মুখে মুখে এগোচ্ছে না। কিন্তু তিনি বলে। উঠলেন, ধ্যেৎ ছাই আমি বোকার মতো এভাবে হিসেব করছি কেন–আট ঘণ্টা ঘুমানো মানে দিনের চব্বিশ ঘণ্টার তিন ভাগের এক ভাগ ঘুমনো–তাহলে পঁচাত্তর বছরের তিন ভাগের এক ভাগ হল গিয়ে পঁচিশ বছর–সোজা হিসেব! তাহলে দেখো পঁচাত্তর বছরের মধ্যে পঁচিশটা বছর তুমি স্রেফ মরার মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে।

হেসেই বললাম, থামো এখন, তোমার হিসেবের কলে পড়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে–এক্ষুনি না আবার ঘুম পেয়ে যায়।

হাসতে লাগলেন বন্ধুও। বললেন, না, এই হিসেবের ফল ঠিক উল্টো-সর্বব্যাপারে মিতাচারী হবার মহৌষধ। দেখো, আগে আমি সিগারেট খেতাম কম করে দিনে দশটা। পঁচাত্তর বছরের জীবনে হিসেব করে দেখলাম দু লক্ষ সত্তর হাজার সিগারেট খেতে হবে–ব্যস সিগারেটের নেশা খতম। পান খাওয়াও এই হিসেব করেই কমিয়ে ফেলেছি

শুনতে মজা লাগছিল বেশ। চোখ টিপে গলা খাটো করে বললাম, তোমার যৌবনকালের গার্হস্থ্য ধর্মেও এই হিসেব মাথায় ছিল না তো?

বন্ধুর ছেলে মাত্র একটি, মেয়ে নেই। হা-হা শব্দে হেসে উঠে হাঁক দিলেন, ওগো শুনছ!

সচকিত হয়ে বললাম, আমি কিন্তু উঠে পালাব তাহলে

কিন্তু হাঁক শুনে তার গৃহিণী এসেই গেছেন। অগত্যা হাসি সামলে বন্ধু বললেন, চায়ের পেয়ালাগুলো নিয়ে যেতে বলো–

এই সাত সকালে দাওয়ায় বসে কিছু রঙ্গরস চলছে, তার গৃহিণী সেটা আঁচ করে হালকা সন্দিগ্ধ চোখে আমাদের দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন।

হাসি গোপন করার চেষ্টায় আমি সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কুয়াশা অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। তার ওপর রোদ ঝিকমিক করছে। হঠাৎ অদূরে একটা দৃশ্য দেখে আমার দু চোখ সেদিকে আটকালো। সামনের ওই রাস্তাটা ধরে শ্লথ পায়ে একটি রমণী এগিয়ে আসছে। পা ফেলে ফেলে তার এগিয়ে আসার ধরনটা যেন কেমন! দূর থেকে চেহারাপত্র ভালো ঠাওর করা গেল না। তবে বেশ মজবুত স্বাস্থ্যের মেয়ে এটুকু বোঝা যাচ্ছে। পরনে খয়রী রংয়ের একটা খাটো ডুরে শাড়ি। কিন্তু মেয়েটা এভাবে পা ফেলে ফেলে আসছে কেন!

বন্ধুর উপস্থিতি ভুলে সেদিকেই চেয়ে ছিলাম। আরো কাছে আসতে পরিষ্কার দেখলাম। বেশবাস দেখে বোঝা যায় খেটে-খাওয়া দুঃস্থ গরিব ঘরের বৌ। কিন্তু সুন্দর সুঠাম স্বাস্থ্য। আধফর্সা মুখখানাও বেশ সুশ্রী। মাথায় খাটো ঘোমটা। বয়েস বত্রিশ তেত্রিশ হতে পারে। ঢিমে তালে এলোমেলো পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে। আর যেভাবে আসছে, মনে হল মাথা ঘুরে পড়েও যেতে পারে।

যে কোনো কারণে রমণীটি বেশি-রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভেবে উতলা চোখে আমি বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালাম। দেখি বন্ধু আমাকেই দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা দেখার রোগ না লেখকের রোগ?

বললাম, মেয়েটাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে, কিভাবে পা ফেলছে আর ঢুলতে ঢুলতে আসছে দেখছ না?

-ওটা রস-সিক্ত পদক্ষেপ আর রসের ঢুলুনি। মেয়েটার পিছনে যে আসছে তাকেও দেখো! ৬৬৮

বন্ধুর কথা শুনে যেমন অবাক আমি, ওই মেয়েটার পিছনে গজ বিশেক পিছনে পিছনে যে আসছে তাকে দেখেও তেমনি অবাক। বছর চৌদ্দর একটি ছেলে। পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে হেঁভা শার্ট। আদর-যত্ন পেলে ওই কচি মুখটাও সুশ্রী দেখাত হয়তো। আমি অবাক এই কারণে যে ওই ছেলেটাও সামনের রমণীটির মতোই টলতে টলতে। ঢুলতে ঢুলতে পথ ভেঙে এগিয়ে আসছে।

সবিস্ময়ে আবার বন্ধুর দিকেই ফিরলাম আমি।–এই সাত সকালে দুটোতেই মদ গিলে ঘরে ফিরছে নাকি? কে ওরা-মা আর ছেলে?

বন্ধু জবাব দিল, তাই। তুমি আর ড্যাব ড্যাব করে ওদিকে তাকিয়ে থেকো না। ওই বজ্জাতও নতুন মানুষ দেখে তোমার দিকে মন দিয়েছে দেখছি-রসিক জন। ভেবেছে বোধহয়।

রাস্তাটা বেঁকে বাড়িটার পাশ ঘেঁষেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মেয়েটা অপলক চোখে সত্যি আমাকে দেখতে দেখতেই, বাড়িটা পার হল। অস্বস্তি তার পরেও। বাড়ি ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতে যেতেও ঘাড় ফিরিয়ে আমাকেই দেখছে। তার পরের বিস্ময় অভাবনীয়। দাঁড়িয়েই গেল এবং ঘুরে এদিকেই চেয়ে রইল। এদিকে বলতে বন্ধুর দিকে নয়, শুধু আমার দিকে। মাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ছেলেটাও মায়ের কাছাকাছি গিয়ে ঘুরে তাকালো।

ব্যাপার কি না বুঝে আমি বন্ধুর দিকে তাকালাম। মেয়েটার এরকম দুঃসাহস দেখে বন্ধুও কিছুটা অবাক আর কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভ্রূকুটি করে ওদের দিকে চেয়ে আছেন।

পায়ে পায়ে মেয়েটা এবার আমাদের এই দাওয়ার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। মদের বেঁকে আবার কি কাণ্ড বাধায় আমার সেই অস্বস্তি। বন্ধুও হকচকিয়ে গিয়ে থাকবেন।

পায়ে পায়ে মেয়েটা এসে একেবারে দাওয়া ঘেঁষে দাঁড়াল। অপলক চাউনি আমারই মুখের ওপর। নেশার ঘোর কেটে গিয়ে তারও যেন কিছু বিস্ময়ের কারণ ঘটেছে। অভাবের ছায়া এটে বসা কমনীয় মুখ, উসকো-খুসকো ঈষৎ কোঁকড়া লালচে চুল। খাটো ডুরে শাড়ি পরা সুঠাম গড়ন, শরীরের সবটুকুর পক্ষে ওই ছোট শাড়ি আদৌ যথেষ্ট নয়। বছর তিরিশ-বত্রিশের বেশি বয়েস মনে হয় না। মাথার ছোট ঘোমটাটাও এর মধ্যে খসে গেছে। আমি কেমন বিমূঢ় হঠাৎ। এই গোছের একখানা মুখ আমি কি কোথাও কখনো দেখেছি? একেবারে অচেনা লাগছে না কেন?

পাশ থেকে বন্ধু প্রায় খেঁকিয়েই উঠলেন, কি চাই এখানে?

ধমক খেয়ে মেয়েটার বিস্ময়ের ঘোর কাটল যেন। এবার বন্ধুর দিকে তাকালো। তার ভয়লেশশূন্য সাদাসাপটা কথা শুনে আমি হতভম্ব।তাড়া দেন কেন বাবু, আমি কি চুরি করতে এয়েছি? পরক্ষণে আমার দিকে ফিরতে ঢুলু ঢুলু চোখে আগ্রহ যেন উপচে উঠল। জিজ্ঞাস করল, কলকাতার মুখুজ্জে বাড়ির সেজবাবু না?

আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। এবারে অবাক বোধ হয় বন্ধুটিও। নিজের অগোচরে। মাথা নেড়েছিলাম কিনা খেয়াল নেই। নিজের বাড়িতে আমি সেজবাবুই বটে।

চোখের পলকে মেয়েটা এবার দাওয়ায় উঠে এলো। তার পরেই উপুড় হয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম। আমি বাধা দেবারও সময় পেলাম না। প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির মালিকের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ঘাড় ফিরিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে হাঁক দিল, ভুলু, শীগগির আয়!

ছেলেটারও হয়তো নেশা ছুটে গেছে। সে হন্তদন্ত হয়ে কাছে আসতেই বলে উঠল, দেবতার দেখা পেয়ে গেলি আজ, গড় কর শীগগির, গড় কর।

ছেলেটাও কিছু না বঝেই তাড়াতাড়ি প্রণাম সেরে উঠল। আমি তখনও আঁতিপাতি করে খুঁজছি কে হতে পারে এরা।

মেয়েটার চোখে মুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে, আপনি এখানে সেজবাবু! বেড়াতে এয়েছেন?

-হ্যাঁ, আমার এই বন্ধুর বাড়ি এটা।

বাড়ির সকলে ভালো আছেন? সেজ-মা ভালো আছেন?

সেজ-মা বলতে আমার স্ত্রী। আমি বললাম, সব ভালো, কিন্তু তোমার নাম কি বলো তো?

সে বলে উঠল, ও-মা, এখনো এই পোড়ারমুখিকে চিনতেই পারলেন না সেজবাবু! আমি আপনাদের বাড়ির সেই কমলা দাসীর মেয়ে সরস্বতী!

শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে বিস্মৃতির পর্দাটা সরে গেল। এবার তাকাতেই মনে হল ষোল বছরের আধফর্সা কেঁকড়া কচি-কাঁচা মিষ্টি মুখের সঙ্গে আরো সতেরটা বছর জুড়লে এরকমই হতে পারে বটে। মগজে একরাশ স্মৃতি একসঙ্গে ভিড় করে আসছে। আবার একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়াও দেখা দিল সঙ্গে সঙ্গে। কিছুটা নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে বললাম, এবারে চিনেছি। কেষ্টর খবর কি?

–ঘরে আছে। অষ্ট পহর ঘরেই থাকতে হয়, ঘর থেকে বেরুনোর উপায় নেই। সাগ্রহে আঙুল তুলে মেঠো রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, ওই মাঠ ছাড়ালেই বস্তি এলাকায় আমাদের ঘর–মাঠ ভেঙে গেলে কাছেই–আপনি এখানে দিন কয়েক থাকবেন সেজবাবু?

মুখে বলতে সাহস করল না বটে, কিন্তু এমন করে বলল যে পারলে এক্ষুনি ও আমাকে ওদের ঘর দেখাতে টেনে নিয়ে যায়।

বন্ধুর বিরক্তি-ছাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আরো গম্ভীর। বললাম, না, পরশু ভোরে চলে যাব। তারপর প্রায় রূঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, তুই এভাবে হেঁটে আসছিলি কেন–সকালেই মদ গিলেছিস আর ছেলেটাকেও খাইয়েছিস?

সরস্বতী থতমত খেল একদফা। দেখতে দেখতে সমস্ত মুখটাই বিষাদে ছেয়ে গেল। বলল, আপনি নেদ্যয় হলে ভগবান আমাকে আরো কত মারবেন ঠিক নেই, আপনার কথা আমরা এখনো বলি, আপনি দয়া রাখবেন সেজবাবু! বিষ না খেয়ে আমাদের পেটে ভাত জোটে না যে, কি করব…

বলতে বলতে একটা উদগত কান্না ভিতরে ঠেলে দিয়ে ছেলের হাত ধরে তাড়াতাড়ি দাওয়া থেকে নেমে গেল। তারপর হনহন করে পথ চলল।

শেষের এই কথাগুলো শুনে কেন যেন আমার বুকের তলায় মোচড় দিয়ে উঠল। কি ব্যাপার আমি ভেবে পেলাম না। ওর স্বামী কেষ্ট ঘোষের ঘর ছেড়ে বেরুনোর উপায় নেই কেন? বিষ না খেলে পেটের ভাত জোটে না বলার মানে কি? মদ গিলে আগে বিবেকের গলা টিপে মেরে তারপর নিজের দেহ বেচে স্বামী পুত্রের ভাত জোটাতে হচ্ছে? তাহলে ছেলেটা সঙ্গে যাবে কেন? ছেলেটাও মদ গিলবে কেন?

বন্ধুর বিরস মুখের দিকে চেয়ে বললাম, মেয়েটা ভারী মিষ্টি আর ভালো ছিল এক সময়

বন্ধু বাধা দিয়ে উঠলেন, এক সময় বলতে সেই সতের বছর আগে তো? এর মাঝে আর দেখেছ?

মাথা নাড়লাম। দেখিনি।

তাহলে এখন আর ভালোটালো বিচার করতে বোসো না। তবে এখনো অনেক লোকে ওকে মিষ্টি দেখে। ওই মেয়ে এই দাওয়ায় উঠে কথা বলছিল দেখে কটা লোক অবাক হয়ে এদিকে চাইতে চাইতে চলে গেল তুমি খেয়াল করোনি। ওর সুনাম কেমন বুঝছ?

সরস্বতীর এ-বাড়ির দাওয়ায় উঠে কথা বলাটা বন্ধুর একটুকুও পছন্দ হয়নি বোঝা গেল। আবার বললেন, তোমার ওই ভালো মেয়ে এখন ছেলে নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় কলকাতা যায় চোলাই মদ বিক্রী করতে আর সকালে ফেরে। বুঝলে? কাপড়ের নীচে ওদের কোমরে চোলাই মদ পাচার করার ব্লাডার বাঁধা থাকে। যা বেচতে পারল বেচল, বাকিটা মা আর ছেলে মিলে যে সাবড়ে দেয় সে তো ওদের নিজের চোখে দেখেই বুঝতে পারলে। এই করে ঘরের পঙ্গু স্বামীর আর ছেলের ভাত জোটাস বুঝলাম, তা বলে নিজেরা খাস কেন! তাছাড়া তোমার ওই ভালো মেয়ের পিছনে অনেক লোক লেগে আছে, তার মধ্যে পয়সাওলা লোকেরও অভাব নেই শুনেছি। ওই বস্তি এলাকায় ওর কিছু পিয়ারের লোকও আছে-কারো সঙ্গে বনিবনা না হলে ওদের লেলিয়ে দেয়, দু-চারজন ভদ্রলোকের সঙ্গে মারপিটের খবরও আমার কানে এসেছে।

শুনে আমার কান মন দুই-ই বিষিয়ে গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে সতের বছর আগের একটা ঘটনাও বার বার মনে আসতে লাগল। ফলে ভিতরটা আরো বেশি ভারাক্রান্ত হয়েই থাকল।

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকতে বেলা একটা। ভারী খাওয়ার ফলে বন্ধু তার ঘরে একটু গড়াগড়ি করে নিতে গেলেন। আমাকেও তাই করতে বললেন।

গড়াগড়ি করতে গিয়ে হিসেব ভুলে বন্ধু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন নিশ্চয়। কারণ। তার আবার এ-ঘরে পদার্পণ ঘটল বেলা তখন চারটে। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই তিনি। হা একেবারে।

আমি আমার শয্যাতেই বসে আছি। আমার সামনে মেঝেতে বসে আছে সরস্বতী। এখন তার সঙ্গে ছেলেও নেই।

গৃহস্বামীর হতচকিত অবস্থা দেখে সরস্বতী বিব্রত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।

আমি ওকে উদ্দেশ্য করে হাল্কা সুরেই বললাম, বাড়ির মালিক ঘুমুচ্ছিলেন বলেই তুই এক ঘণ্টা ধরে এখানে বসে যেতে পারলি। যা পালা এখন, সাড়ে পাঁচটা নাগাত তোর ছেলেকে পাঠিয়ে দিস–কেষ্টকে দেখে আসতে যাবখন।

সরস্বতীর ঠাণ্ডা মুখে খুশির ছোঁয়া লাগল। কিন্তু সাহস করে সেটুকু প্রকাশ করতে পারল না। আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

বন্ধু আমার দিকে চেয়ে আছেন, আমাকেই দেখছেন। মাথার বিকৃতি কি আর কিছু তাই ভাবছেন। আমাকে হাসতে দেখে তার পিত্তি জ্বলে গেল বোধ হয়। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, আমার সকালের এত কথা তোমার কানে গেল না? তুমি ওর বাড়ি যাবে?

-শুনলেই তো। মাথা ঠাণ্ডা করে বোসো। ঘুরে এসে তোমার হিসেবের বাইরে তোমাকে যদি কিছু না শোনাতে পারি তো আজ রাতেই আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে নিশ্চিন্ত হয়ো।

বলার ধরনের ব্যতিক্রমটুকু কানে লেগেছে।-এখনি বলে শুনি, এক ঘণ্টা ধরে মেয়েটা তোমাকে কি এমন বলে গেল যে তুমি গলে জল হয়ে গেলে?

বললাম, এখন না, আগে ঘুরে আসি।

ঘুরে এলাম। এ-সব জায়গায় শীতকালের সাড়ে সাতটা মানে রাতই। ঘরে পা দিয়েই মনে হল বন্ধু আর বন্ধু-পত্নী দুজনেই আমার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। আমি যে ঘরে আছি সেই ঘরেই বসে ছিলেন তারা। বন্ধু-পত্নী উঠে দাঁড়িয়ে। বললেন, আগে এক পেয়ালা চা খাওয়াই আপনাকে।

বাধা দিলাম, কিছু দরকার নেই, বসুন, এর মধ্যে দু পেয়ালা হয়ে গেছে।

বন্ধু বলে উঠলেন, কোথায় হল, তোমার ওই সরস্বতীর ওখানেই?

-হ্যাঁ। শয্যায় বসে তার দিকে ফিরলাম।–যা বলব সে যদি তোমার হিসেবের বাইরে হয়, আমার একটা অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে, আর সে অনুরোধ রাখাটা। তোমার একটুও সাধ্যের বাইরে নয়–বউদি আপনি সাক্ষী।

বন্ধু বললেন, ভণিতা ভালই হয়েছে এখন ব্যাপারখানা কি শুনি!

এরপর যে চিত্রটা ওদের গোচরে এনেছিলাম, পাঠকের সামনেও সেটুকুই তুলে ধরছি।

সরস্বতীর মায়ের নাম কমলা দাসী।, আমাদের বাড়ির ঝি ছিল। বারো বছরের মেয়ে সরস্বতীকে নিয়ে সকালে আর বিকেলে আমাদের বাড়ি কাজ করতে আসত। কমলার বয়েস তখন বেশি হলে সাতাশ-আটাশ। স্বামী নেই, শুনেছি বছর দেড় দুই আগে বিধবা হয়েছে। আমাদের বাড়ির বউরা কাজে-কর্মে খুব একটা খুঁত ধরতে পারত না তার, তবু ওর ওপর তেমন খুশি ছিল না। বলত ওর স্বভাব চরিত্র সুবিধের নয়, কবে কার সঙ্গে কোন রাস্তায় নাকি ওকে দেখা গেছে একাধিক দিন। পরে বউরা তাকে জিজ্ঞাসা করতেও নাকি বলেছে আমার অমুক সম্পর্কের আত্মীয়। তাছাড়া চাল-চলনও ভালো নয়। বাড়ির ঠাকুরটার সঙ্গে নাকি ঠারেঠোরে কথা বলে, ফাঁক পেলে হাসাহাসি করে, যার দরুন ঠাকুরটা ওকে দু বেলাই বেশি-বেশি চা-রুটি দেয় ইত্যাদি।

মেয়েদের এ-সব কথায় আমি বড় একটা কান দিইনি। ভেবেছি, ওদের শ্রেণীর মেয়েদের তুলনায় কমলা দাসীর চেহারাপত্রের চটক বেশি, আর মোটামুটি সুশ্রী আর স্বাস্থ্যবতী বলেই মেয়েদের ওই গোছের সন্দেহ। তাছাড়া কান না দেবার আরো কারণ, ওর মেয়েটা সত্যিই স্নেহের পাত্রী হয়ে উঠেছিল আমার। সুন্দরী না হোক ভারী মিষ্টি দেখতে, না ফর্সা না কালো, মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল, বড় টানা-টানা দুটো চোখ। মুখ বুজে মায়ের কাজে সাহায্য করত, তারপর ফাঁক পেলেই দোতলায় চলে আসত। সকালে আমি নিজের মেয়ে আর ভাইঝিদের পড়াতাম, সন্ধ্যায় তাদের গল্প শোনাতাম। এই দু বেলার আসরে ওর উপস্থিত থাকা চাই-ই। ওর এত আগ্রহ দেখে ওকেও ছাত্রী করে নিলাম। বাড়িতে থাকতে বিনা বেতনের প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। আবার ভর্তি করে দিলাম। খুশিতে কৃতজ্ঞতায় মেয়েটা যেন আমার কেনা হয়ে গেল।

চার বছর বাদে সরস্বতীর মা কমলা মেয়ে ফেলে সত্যি কার সঙ্গে উধাও হয়ে। গেল। বাড়ির মেয়েরা তখন সরস্বতীকেও বিদায় দিল। ও তখন ষোল বছরের মেয়ে, বাড়ন্ত গড়ন। মেয়েদের বিশ্বাস ওরও স্বভাবচরিত্র মায়ের মতোই হবে। কারণ পাড়ার ভদ্র ঘরের একটা বখাটে ছেলের সঙ্গে ওর ভাবসাব দেখা যাচ্ছে। আর ওদের বস্তির কতগুলো ছোকরাও নাকি বাড়ির আশপাশে সর্বদা ঘুরঘুর করে। ভদ্রঘরের ওই ছেলেটা আস্কারা পায় বলে ওদের নাকি সরস্বতীর ওপর ভয়ানক রাগ। সেই ভদ্রঘরের ছোকরাকে আমি চিনি। নাম কৃষ্ণ ঘোষ, সকলে কেষ্ট বলে ডাকে। লেখাপড়ায় স্কুলের বেড়া পার হতে পারেনি। তখন শ্যামনগর না কোথায় একটা কাগজের কলে ঢুকেছে। হাতে কিছু পয়সা আসতেই বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে।

বিদায় দেবার তিন-চার দিনের মধ্যেই আলুথালু অবস্থায় এক সন্ধ্যায় সরস্বতী এসে আমার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল। কান্না আর থামেই না। শেষে যা বলল। তার মর্ম, বস্তির তিনটে জোয়ান ছেলে জোর করে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছে, যে পাতানো মাসির কাছে থাকে এখন তাকে টাকা দিয়ে বশ করেছে, আর সরস্বতীকে শাসিয়েছে এতটুকু অবাধ্য হলে তাকে একেবারে খুন করে ফেলা হবে। সে তিন-চারটে দিন মাত্র এ বাড়িতে আমার আশ্রয়ে থাকতে চায়, তারপর আর কোনো ভাবনা নেই। ভাবনা না থাকার কারণ শুনেও তাজ্জব আমি। কেষ্ট ঘোষ তার কাজের জায়গায় ঘর খুঁজছে, তিন-চার দিনের মধ্যেই পাওয়ার আশা। তারপরেই তাকে কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলবে।

মেয়েটার কান্না দেখে আর কথা শুনে মায়া হল। কিন্তু কেষ্ট ঘোষকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রাতে তাকে ডেকে পাঠালাম। আমি অবাক, ছেলেটাও কাঁদছে, সেই সঙ্গে কাকুতি-মিনতি, তিন-চারটে দিন ওকে আশ্রয় দিন দয়া করে, আমি এর মধ্যে ব্যবস্থা করছি। ভালো কায়েতের ছেলে, সরস্বতীকে বিয়ে করে নিজেদের ঘরে তোলা চলবে না–বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়াবে জানা কথা। তাই কটা দিন সময় দরকার।

আমি কঠিন গলায় ওকে বললাম, এরপর ওকে ফেলে আবার একদিন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবি তো?

কেষ্ট কালীর দিব্যি কাটল, মরা বাপের নামে শপথ করল।

 সরস্বতীকেও বললাম, আর তুই তোর মায়ের মতো হবি না তো?

ও আমার পায়ে মাথা রেখে বলল, ওকে কখনো ছেড়ে গেলে আমার যেন কৃষ্ঠ হয়–আমার ছেলে হলে আমি যেন তার মরা মুখ দেখি!

চার-পাঁচটা দিন সরস্বতীকে আগলে রাখার মধ্যে বিপদ ছিল। কটা গুণ্ডা ছেলে সর্বদা বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু আমি থানা-পুলিশের ভয় দেখাতে গণ্ডগোল পাকাতে সাহস করেনি।

পাঁচ দিনের মধ্যেই কেষ্ট বিয়ে করে সরস্বতীকে তার কাজের জায়গায় নিয়ে গেছে। আমি ওকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম।

দু বছরের মধ্যে সরস্বতীর কোলে ছেলে এসেছে। গরিব হলেও আনন্দের হাট বসে গেছে তখন। কেষ্টর মতিগতি অনেক ভালো হয়েছে, সে তখন প্রাণপণে বেশি উপার্জনের রাস্তা খুঁজছে।

ছেলেটার সাত বছর বয়সের সময় বজ্রাঘাত হয়ে গেল। কলে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে কেষ্টর একটা পা একেবারে ভেঁচে গেল, একটা হাতও ভয়ানক জখম হল। পা-টা কেটে বাদ দিতে হল, হাতেরও খানিকটা। কলের মালিক সব-কিছু কেষ্টর দোষে হয়েছে বলে প্রমাণ করতে চাইল। অনেক চেষ্টার পর ক্ষতিপূরণ যেটুকু পেল তাই দিয়ে এখানকার এই মাথা গোঁজার ঠাইটুক করা গেছে।

…তারপর সংসার অচল। মাসের পর মাস একবেলা আধ পেটা খেয়ে থেকেছে। সরস্বতী ভদ্রলোকের বাড়ি ঝিগিরি করতে চাইলে কাজ মেলে। কিন্তু সব বাড়িতেই দেখা গেছে ওকে নিয়ে কিছু না কিছু গণ্ডগোল বাধছে। ওর দিকে কারো না কারো চোখ পড়েছে। সে-রকম লোক বাড়িতে না থাকলেও পাড়ায় আছে। পঙ্গু কেষ্টরও সন্দেহ হত সরস্বতী বুঝি ওকে ছেড়ে চলে যাবে। সরস্বতী সেই আগের কথাই বলেছে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, তোমাকে ছেড়ে গেলে ছেলের মরা মুখ দেখতে হবে আমাকে।

অভাবে না খেয়ে মর-মর দশার সময় চোলাই মদ বিক্রির রাস্তা ধরেছে। মদ সেলাই যারা করে তাদের অনেক টাকা। সরস্বতী, তার ছেলে আর এমনি অনেকের মারফত সে-সব কলকাতায় বা অন্যত্র চালান হয়, বিক্রি হয়। ওরা তার অংশ পায়। পুলিসের হুজ্জোত হলে মালিক সামাল দেয়, তখন সংসার চালায়।

সরস্বতীর আর তার ছেলের কলকাতার খদ্দের কয়েকটি মাঝারি নামী বার। চোলাই মণ তাদের কাছে বিক্রি করে। তারা ভালো মদের সঙ্গে সেগুলো মিশেল দেয়। প্রথম ই-এক দফা খাঁটি মদ পেটে পড়ার পর খদ্দের আর ভেজাল ধরতে পারে না।

কিন্তু চোলাই মদ মেশানোর বিপদ আছে। যদি বিষাক্ত হয়? যদি খেয়ে লোক মরে যায়? সেই কারণেই মা আর ছেলেকে জিনিস যাচাই হিসেবে প্রত্যেক দফার মাল ওদের সামনে খেয়ে দেখাতে হয়। খাওয়ার পর রাত বারোটা একটা পর্যন্ত ভিতরের কোথাও পড়ে থাকতে হয়। মাল বিষাক্ত নয়, এ-ভাবে যাচাই হবার পর টাকা মেলে। সেই নিযুতি রাতে মা-ছেলে কোন রকমে হেঁটে শিয়ালদা আসে। সেখান থেকে ভোরের প্রথম ট্রেন ধরে ঘরে ফেরে। এত সবের পরেও অনেক ভদ্রঘরের নেকড়েরা ওর পিছনে লাগতে ছাড়ে না। ওর কোমরে সর্বদা একটা ধারালো ছোরা গোঁজা থাকে। আত্মরক্ষার জন্যেই বস্তি এলাকার একদল ছেলে জুটিয়েছে, যারা ওর থেকে সস্তায় চোলাই মদ পায়, খাবার-টাবারও পায়। তারা ওকে দিদি বলে ডাকে। কেউ পিছনে লাগলে বা বেশি জ্বালাতন করলে সরস্বতী ওদের লেলিয়ে দেয়।

আমাকে দেখে কেষ্ট ফুলে ফুলে কেঁদেছে। আর সরস্বতী পায়ের ওপর থেকে মাথা তোলেই না। কেবল বলে, ভগবান আপনাকে পাঠিয়েছেন সেজবাবু, আমার ছেলেটার যা-হোক একটা ভালো কাজের ব্যবস্থা করে দেন, সেই টাকায় আমরা একবেলা খেয়ে থাকব–তা না হলে ছেলেটা আমাদের লিভার পচেই মরে যাবে। এখনই মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা হয়।

আমি বন্ধুকে বললাম, এবার যদি সব কিছু তোমার হিসেবের বাইরে মনে হয় তো সরস্বতীর ছেলেটার জন্য তুমি কিছু করবে। ইউনিয়নের মস্ত মাতব্বর তুমি, ইচ্ছে করলেই কর্তাদের বলে তুমি ওকে একটা বেয়ারার কাজে ঢুকিয়ে দিতে পারো। ছেলেকে নিয়ে আমি ওকে কাল সকালে তোমার এখানে আসতে বলেছি।… আর, ঘরে বসেও সরস্বতী কি করে কিছু রোজগার করতে পারে সে-কথাও ভাবব বলে তাকে কথা দিয়ে এসেছি।

বন্ধু নির্বাক। স্তব্ধ। তার স্ত্রীর চোখে জল।

হিসেবের বাইরে

হিসেবের বাইরে

হিসেবের বাইরে

থলের মুখটা বড়ো করে ধরেছেন উমাপদ। মুলো, বেগুন, ঝিঙে, কুমড়ো সব। নেওয়া সারা। শাকটার জন্য ভেবেছিলেন চাষিদের কাছেই যাবেন। কিন্তু লখার কাছেই পেয়ে গেলেন।

দে বাবা, দেখেশুনে দে, উঁতের জলে ভিজিয়ে রাখিসনি তো? দেখিস, তোর বউদি এঁতের জিনিস ছুঁয়ে দেখে না।

এঁতের কারবার লখা করে না, লখা ঝাঁজিয়ে ওঠে, কোনোদিন আপনাকে খারাপ জিনিস দিয়েছি?

 বা, বা দিব্যি পাটশাক উঠেছে তো! এক আঁটি কিনেই ফেললেন উমাপদ। যতই লিস্ট মিলিয়ে খরিদ করুন, হিসেবের বাইরে হাত চলেই যায়।

তা যদি বলো, বাজারহাট খুব সোজা জিনিস না। সময় লাগে। বাড়িটা ভাগ্যক্রমে কাছাকাছির মধ্যেই। তাই নিয়ম করে আসেন। রোজ না হলেও একদিন বাদ-বাদ তো বটেই। ফ্রিজে সাতদিন জমিয়ে রেখে খাওয়া তাঁরও পছন্দ নয়, তপরও নয়। এইবার মৎস্যমখী হতে হবে। মাছটা তিনি বোজ আগেই কিনে থাকেন। তরিতরকারি সময়ের জিনিস মোটের উপর সবই পাওয়া যায় কিন্তু মাছের ব্যাপারটা তো আর তা নয়। পাবদা না ট্যাংরা, পারশে না ভেটকি–কী পাওয়া যাচ্ছে তার উপর মেনু প্রোগাম সব নির্ভর করছে। আজকে এই পুঁইয়ের অনারে ভালো চিংড়ি দেখতে হচ্ছে। পুহঁটাই আজকের অর্ডার ছিল। অর্ডার বলো অর্ডার, আবদার বলো আবদার। চিংড়ি নেহাত পাওয়া না গেলে কাতলার মুড়ো ভরসা। মুশকিল হল ব্যাটারা মুড়োগুলো এমন করে কাটে যে কাঠ ছাড়া আর কিছু থাকে না। একটু কণ্ঠা, কণ্ঠার শাঁস না হলে ছ্যাঁচড়া জমে?

পাটপাতা দিয়ে খাবার জন্য দুশো মতো মৌরলাও কিনে ফেললেন উমা। তপু একেবারে অবাক হয়ে যাবে আজ।

এইজন্যেই লোকে আড়ালে উমাপদকে তপতীপদ বলে উল্লেখ করে থাকে। তিনি এ অঞ্চলের একজন ডাকসাইটে স্ত্রৈণ।

ছোটোখাটো মানুষটি। চটপটে, তরতরে। এ মোড় থেকে ও মোড় পৌঁছে যাবেন লহমার মধ্যে। খুরে এমন ধার! পরেন ধুতি আর রঙিন খাদির পাঞ্জাবি। মুখটা রূপী বাঁদরের মতো রাঙা ধরনের। কুতকুতে চোখ, ঝুপড়ি ভুরু। এক মাথা চুল গন্ধ তেল দিয়ে ঠেলে আঁচড়ানো ব্যাকব্রাশ।

উমাপদর শৌখিনতায় কেউ খুঁত ধরতে পারবে না। বাজার যাবার সময়ে ধুতিটা একটু হেঁটো করে পরেন অবশ্য। বাজারের চটিও আলাদা, রবার বা প্লাস্টিক যা-ই হোক। ধুয়ে নিলেই কাদা চলে যাবে। কিন্তু বাজারের এই কাদা, নোংরা, দুর্গন্ধ, ঠাসাঠাসির মধ্যেও তাঁর সবুজ কিংবা কমলা পাঞ্জাবির বোতামপটিতে গলার কাছের ভি-তে চিড় ধরে না। পাশ-পকেটে পরিষ্কার ভোয়ালে রুমাল। চুলের ফের একটা এদিক-ওদিক হবার জো নেই। ব্যাপার-বাড়িই যান আর বাজারেই যান উমাপদর চুল সদাসর্বদা ঠাস। চুলগুলিতে বলা বাহুল্য কড়া কলপ। তাঁর রাঙা মুখের শিরে কুচকুচে কালো চুলের বাহারের দিকে পথচলতি লোক ফিরে তাকাবেই।

জামার বোতাম, চটিজুতোর পালিশ, ধুতিপাঞ্জাবির ইস্তিরি, মায় চুলের কলপটি পর্যন্ত তপতীর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে, তবু মানুষের নিজের স্বভাবের অভ্যেসের দিক তো একটা আছেই! ধরুন উমাপদ বর্ধমানের সুদূর গ্রামের ছেলে, পড়াশোনা করতে তাঁকে বোর্ডিংয়ে থাকতে হয়েছে বরাবর। চাকরিকালে আবার যে দু চারখানা মেস কলকাতায় এখনও বহাল আছে, তারই একটাতে বাস করেছেন। ফলে নিজের জামাকাপড়ের বন্দোবস্ত নিজে করাটা গড়পড়তা বাঙালির ছেলের চেয়ে তাঁকে বেশিই রপ্ত করতে হয়েছে। গিন্নিরা গোছানো হোন বা না হোন এসব মানুষ কড়া মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা ফিটবাবু থাকবেই। জামার বোতাম সেলাই বা জুতো পালিশের জন্য এদের বউয়ের কাছে ধরনা দিতে হয় না, দর্জি-মুচির কাছে দৌড়াদৌড়ি করবারও দরকার পড়ে না। ঠিক কথা। কিন্তু খাওয়াদাওয়া? বোর্ডিংয়ের কুমড়োর ঘ্যাঁট আর মেসের মচ্ছের কালিয়া নামধারী বস্তুটির সঙ্গে যাদের পরিচয় গাঢ় হয়, তাদের যা-ই হোক রসনাগত শৌখিনতা বজায় থাকতে পারে না। থাকলে তারা সারভাইভ করতেই পারতেন না। অসাড় জিহ্বাই এসব ক্ষেত্রে একমাত্র বর্ম। আর বোডিং মেসের বোর্ডারের ছুটি-ছাটার বাড়ি? কে না জানে বর্ধমানের লোকেরা বেঁচে থাকে পোস্ত খেয়ে। সকালের জলখাবারে মুড়ি পোস্ত, দুপুর-ভোজনে ভাত-পোস্ত, রাত-ভোজনে ভাত বা রুটি-পোস্ত। পোস্ত মুখরোচক সন্দেহ নেই। কিন্তু উঠতে বসতে যদি কেউ একই জিনিস খেতে থাকে, খেতে চায়, সেটাকে কি ঠিক শৌখিনতা বলে অভিহিত করা যায়?

অথচ সেই উমাপদ এখন পোস্তর ঘের থেকে দিব্যি বেরিয়ে এসেছেন। তিনি এমনকি মাছের তেলের বড়া, ইলিশের মুড়ো-ল্যাজার টক, মোচার পাতুরি ইত্যাদির মতো অচিরাচরিত পদাদির আস্বাদন পাবার জন্য মুখিয়ে থাকেন। বেশি কথা কি বঙ্গীয় বেগুনভর্তার সঙ্গে বিহারি বেগুনচোকার কী তফাত, বা কত চালে কত ডাল মেশালে খিচুড়ি উপাদেয় হয় এসব কুটকচালিও তিনি দিব্যি জেনে গেছেন। এ বাবদে তাঁর শৌখিনতা বা পরিপক্কতার কৃতিত্ব পত্নী তপতীকে দিতেই হয়।

তাই বলে কেউ যেন না ভাবে উমাপদর তপতী দিনরাত্তির রান্নাঘরের খিদমতগারি করছেন। হলুদ-লংকায় হাত-রাঙা, নখ ভেঙে গেছে, ভাজা খেয়ে খেয়ে চামড়া ঢ্যাপচ্যাপ, পান খেয়ে দাঁতে ছোপ। তপসী সেই জাতের মহিলা নন। যাঁরা গৌরবর্ণ চাঁদ হেন মুখটি জন্মসূত্রে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে। উমাপদও তপতীকে তা থাকতে দেবেন না। ডাঁই করা ফ্যাশন-পত্রিকা উমাপদর টেবিলে। পাঠিকা তপতী, পাঠক উমাপদ।

পত্রিকার টিপস দেখে উমাপদ তপতীকে হেনার প্যাকেট এনে দেন। এই দ্যাখো, ডিমের সাদা, কফি-পাউডার, পুরোটাই ডিটেলে বলে দিয়েছে। লাগাও, লাগাও। লাগিয়ে ফ্যালো।

কী ব্যাপার? না, তপতীর মাথায় উত্তর-চল্লিশের পাকা চুল ভেসে উঠতে শুরু করেছে।

শীতের হাওয়া শুরু হতে না হতেই দু-তিন খেপ ক্রিম এসে যায়। মাখো মাখো, মুখে হাতে, পায়ে, আঙুলের মধ্যে মধ্যে ভালো করে ঘষে,—কী ব্যাপার, না তপতীর গোড়ালি ফাটছে, হাত খসখস। গাল-গলা খসখস। এসব নিয়ে উমাপদর ভারি উদ্বেগ। তপতীর চেয়েও।

লোকে জানে রকমারি মনোহারির দোকানে উমাপদবাবুকে দেখা মানে তিনি কসমেটিকস কিনছেন। জুতোর দোকানে? তিনি স্কিন-কালারের মোজা কিনছেন। মিশন রো-এর মোড়ে?-হঠাৎ ভালো জাতের মুসাম্বি কি বেদানা দেখেছেন। জীবনদায়ী, যৌবনদায়ী এসব ফল।

ছেলে পড়ছে হায়দ্রাবাদে। বাড়ি শুনসান। কর্তা-গিন্নিতে রাঁধেন বাড়েন, থাকেন খান, বকবকম করেন আর টিভি দেখেন। পড়শিরা বলে কর্তার আপিসটাই মাঝখানে একটা বেরসিক ড্যাশ। ড্যাশটিকে হাইফেন করতে নাকি উমাপদবাবুর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু এদান্তে বড্ড কড়াকড়ি পড়েছে। ভাগ্যিস পাতাল রেল হয়েছিল তাই হুশ করে যেতে আসতে পারছেন। গিন্নির আঁচল ছেড়ে বেরোনো কি উমাপদর পক্ষে সহজ?

না, না দ্বিতীয় পক্ষ-টক্ষ নয়। সিলভার জুবিলি হয়ে গেল তপুকে ঘরে এনেছেন উমাপদ। সেই থেকেই মজে আছেন। যেমন রং, তেমনি চুলের বাহার। মুখ চোখের বিচার অত আলাদা করে কে-ই বা করতে যাচ্ছে। আসল হল টান। টানছে কিনা। তা তার পিছনে অন্য বস্তুও তো কিছু না কিছু আছেই। রসনেন্দ্রিয় হয়ে পাকস্থলির ট্রাডিশনাল পথেও তো তপতী উমার হৃদয়মন্দিরে প্রবেশ করেছেন কিনা! বাঙাল মামারবাড়ি আর ঘটি বাপেরবাড়ি হওয়ার সুবাদে দুই বাংলার পাকপ্রণালীর যা কিছু মোহিনীমায়া সবই যে তপতীর আয়ত্তে সে আভাস পূর্বেই পেয়েছি। ওদিকের কচুরশাক এদিকের লাউশাক দিয়ে পোস্ত, এদিকের মুলো ভেটকি ওদিকের কালোজিরে কাঁচালংকার বিখ্যাত ট্যালটেলে মাছের ঝোল সর্বত্রই তপতী-হস্তের অবাধ কৃতি। কাজেই, মুচকি হাসলে কী হবে! সবকিছুরই একটা কার্যকরণ থাকে।

হনহন করে চলেছেন উমাপদ খাস্তগির। হাতে ব্যাগ, ব্যাগে বাক্স, বাক্সে টিফিন, গায়ে জহর, তলায় খাদি, তলায় উলিকট। পায়ে মোজা, মোজার ওপর পাম্প, জিবে তপতী, বুকে তপতী—আপাদমস্তক তপতীতে ঠাসা হয়ে চলেছেন উমাপদ।

আস্তে দাদা, আস্তে,—পাতাল রেলের সিঁড়িতে রবিন।

কেন? ধাক্কা? পা মাড়িয়েছি?

আরে না, না আপনি মারবেন ধাক্কা? বলছি আপনার জন্যই। বয়স তো হচ্ছে।

উমাপদবাবু কাষ্ঠ হাসলেন।

প্রথমত, বয়স হচ্ছে, এ একটা ফালতু কথা। আপামর জনগণ হল গিয়ে জম্মবুড়ো। জন্মেই মরে আছে। এই বুঝি এল, এই বুঝি…। তিনি সে বান্দা নন। কত বয়স? পঞ্চাশ? পঁচানববুইয়ে অলিম্পিক করছে আজকাল, একশো পার করছে লিখতে লিখতে, লেকচার দিতে দিতে। দেশ চালাচ্ছে কারা? ছেলেছোকরারা? পাকা পাকা মাথা সব। হয় পরিপক্ক শুভ্র-সনাতন, নয়তো বেল, সব চুকেবুকে গেছে। তা এদের কাছে তো তাঁর পঞ্চাশ নস্যি? তুরতুর করে ওর এর পাশ দিয়ে গলে গলে ঠিক ন-টা পনেরোরটাতে উঠে পড়বেন তিনি। বাঁধা নিয়ম। হাতেই বাঁধা হিসেব।

ভিড় কাটিয়ে এগোতে এগোতেই এক দঙ্গল স্কুল-ছাত্রী। বাঙালি নয়। মাড়োয়ারি এরা। দুধ-ঘি-খাওয়া নধর চেহারা। স্বাস্থ্য ফেটে পড়ছে। হলুদ ব্লাউজ, নীল স্কার্ট, টানটান দু-বিনুনি একেবারে খুলির ওপর থেকে ঝুলিয়েছে কেউ কেউ, আবার ঝুঁটি বেঁধেছে ক্লিপ দিয়ে। মুঠো করে সহজেই ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। উমাপদবাবুর হাইটে কুলোবে না। কিন্তু এইভাবেই তিনি কচি লাউ, বোম্বাই বেগুনের বোঁটা ধরে ঝুলিতে পোরেন।

সুতরাং আর এগোলেন না তিনি। ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না এরা, কিচিরমিচির শালিক-ছাতারে-চড়ই-বাবুই। এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে, সামনে দিয়ে, পিছন দিয়ে মাখন-চকচক হাত ঘুরে যায়। গোল গোল হাত গাল ঝাপটা মেরে যায়। কিচ্ছুটি বলবেন না উমাপদ। করুক যা করছে, দিক না তাঁকে চেপটে, তাঁর আপত্তি নেই। ওই রবীন্দ্রসদন আসছে, হুড়মুড় করে নেমে যায় সব। চোখে-কানে দেখতে দেয় না এই মেট্রো রেল।

এইবার এগোতে থাকেন উমাপদ। একজন বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছেন। পাশে এক ছোকরা। সামনে সিটে একটি ফ্রক, আর আশ্চয্যি, একটি শাড়ি। ডাইনে বাঁয়ে যদ্দূর চোখ যায়, চোখ চালিয়ে-সালোয়ার-কামিজ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলেন না উমাপদ। আছে বুড়ি-থুড়ি। কিন্তু কাঁচা গায়ে শাড়ি এই একটি মাত্তরই। সালোয়ার-কামিজ ড্রেসটা দুচোখ পেড়ে দেখতে পারেন না উমাপদ! পোশাক না পাশবালিশের ওয়াড় বোঝা যায় না। ফ্রক তবু একরকম। কিছুটা খোলাখালা থাকে। তবে সব পোশাকের সেরা পোশাক হল গিয়ে শাড়ি। এই যে মেয়েটি সবুজ রঙের গোল-গলা ব্লাউজ পরেছে, উপরের দিকে ভাঁজটা কেমন চমৎকারভাবে ভেসে রয়েছে। যতই চেষ্টা করুক পুরোপুরি ঢাকাতে পারবে না। ব্লাউজের আর কোমরের মাঝখানে যে নরম, সাদা, রসালো পেটিটুকু ওর দাম লাখ টাকা। এমন পুরু অথচ ফোলা নয়, চিকন, সুস্বাদু জিনিস কুমারী মেরে ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। নাভিটি খোলা আছে কি না দেখা যাচ্ছে না। তবে অনুমান করা যায়, আছে। কোনো বিনোদিনী আজকাল নাভির ওপরে শাড়ি পরে না। উঠে দাঁড়ালে বোঝা যাবে।

সামনে দিয়ে শটাশট অন্ধকার পাতাল চলে যাচ্ছে। সুতল, তলাতল, রসাতল। সেইদিকেই ঠায় চেয়ে আছেন উমাপদ। ছোকরা ঝুঁকে পড়ে ফুটকি-ফোড়ন কাটছে। চেনাশোনা বোধহয়। কলেজ-টলেজ? প্রেম নাকি? আজকাল আবার এদের ফঞ্চুড়ি দেখে এসব বোঝা যায় না ফ্রকে-শাড়িতে-প্যান্টে দিব্যি জমেছে। উমাপদবাবুও হাত টান টান করে জমে গেছেন। শাড়ির পাশে ফাইল। এসপ্লানেড এলেই উঠে যাবে। বয়স্কা মহিলার তাক ওদিকেই। তিনি তা হতে দেবেন না। টুক করে বড়ি নামিয়ে দেবেন।

আ মলো! উঠে পড়ল যে! এটা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। ফ্রক বসে। শাড়ি উঠে যাচ্ছে। বয়স্ক মহিলা বসছেন। ছোকরা অমায়িক। মুহূর্তে এসপ্লানেডমুখী কিউয়ে শামিল হয়ে গেলেন উমাপদবাবু। কখন যে চলতে শুরু করেছেন, কখন যে নেমে পড়েছেন বুঝতেই পারেননি। সামনেই মেয়েটির ধড়। বেশ ধড়ফড়ে, জ্যান্ত-জিয়ল।

কখনো ঠিক পাশে, কখনো ঠিক পিছনে, কখনো দু মানুষ পিছনে, তুরতুর খুরখুর চলেছেন উমাপদ। সামনে লকলক করছে সবুজ লাউডগা আঁচল, বিনুনিটিরও বেশ গোছ আছে। এক গোছে এক কেজি, বেশি তো কম হবে না। খুলিটি বেশ ঢাকা তো! শাঁসে জলে মাখা। ফঙ্গবেনে জিনিস নয়।

বেরোবার ঘুরনচাকের কাছে এসে টনক নড়ল। কাজ সেরে নিলেন। ঝট করে রাগত মুখ ফেরাল শাড়ি। উমাপদ তখন দু মানুষ পিছনে, সামনে ঢ্যাঙার পিছনে একেবারে ঢাকা পড়ে গেছেন। কিছু না, একটা কৌতূহল ছিল, মিটে গেল। আধপর্ব মতো ডেপথ। উপর ভাসা জিনিস নয়। মানে নাভিটি। এইবার উমাপদ ফিরে আবার পর-ট্রেনে উঠবেন। উটকো কিছু না ঘটলে নিশ্চিন্তে আপিস যাবেন।

ওদিকে উমাপদকে খাইয়েদাইয়ে সাজিয়েগুজিয়ে দুগগা-দুগগা করে রওনা করিয়ে তপতী আস্তে সুস্থে চান করেন। তাঁর সর-ময়দায় সামান্য কাঁচা হলুদ মেশানো থাকে। একটা সোনার জেল্লা আসে চামড়ায়। নিখুঁত হিসেব। সর-ময়দা শুকোবে। তারপর ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে-দিয়ে স্পঞ্জ রগড়ে সব তুলবেন। রিঠে ভিজছে রাত থেকে। সেই জল মাথায় পড়বে, ফুরফুরে রেশমি হয়ে থাকবে চুল। এসব করতে সারতে টাইম লেগে যায়। তারপর চান-টান সেরে ধোয়া ছাপা শাড়ি আলগা করে পরে তপতী খেতে বসেন। একলার ঘরে একলার টেবিলে খাওয়া। সে যে কী তরিবত আর কী পরিতৃপ্তি তা একমাত্র তপতীই জানেন। সোনামুগের ডাল দিয়ে চামরমণি চালের ভাত মাখো, আধা নরম কড়া ঢ্যাঁড়স ভাজা দিয়ে খাও। ডাল মেখেও খাও, গন্ধ মেখেও খাও। চক্ষু বুজে কষের দাঁত দিয়ে কাঁকড়ার দাঁড়া ভাঙো। চুষে চুষে ভেতরের ঘি টানতে থাকো, টানতে টানতে কুঁদ হয়ে যাও, তারপর টকটক জিবের আওয়াজ করে চাটনি বা অম্বল। চেটেপুটে শব্দ করে, এক চেয়ারে গা আর এক চেয়ারে পা এলিয়ে বসে, আয়েশ করে খাও। খেয়ে-দেয়ে মুখ কুলকুচো করে একটি দাঁতখড়কে নাও, ঠিকঠাক জায়গা খুঁচিয়ে কাঁকড়ার খোলামকুচি ঢ্যাঁড়সের বিচি, খেজুরের খোসা এসব বের করে আনো। যত খুশি মুখ ভ্যাটকাও, দাঁত ছরকুটে করো, কেউ দেখতে আসবে না। বলতে কী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই সময়টায় তপতী ইচ্ছে করেই বেশ খানিকটা মুখ ভেংচিয়ে নেন। যেন সামনে কোনো বাঁদর-টাঁদর আছে। নিরাপদ দূরত্বে অবশ্য। মাঝে জাল। তা নয়তো তপতীর ভেংচি-ভিরকুট্টির বাহার দেখে বাঁদরটা নির্ঘাত বিপজ্জনকভাবে খিচিয়ে খিমচিয়ে দিত। সুন্দর সুসংস্কৃত মুখখানায় কত রকম কাটাকুটি খেলা যায় সেটা দেখা, এবং নিজেকে দেখানোই যেন তপতীর উদ্দেশ্য।

 বেল বাজে, সেলস গার্ল এসেছে। আবার বেল বাজে। কাজের লোক এসেছে।

পাখার তলায় বসে চুলটাকে একটু শুকিয়ে নেন এবার। ভিজে চুলে শুলে মাথা ধরা কেউ আটকাতে পারবে না। মাথা ধরলে চোখে কালি, চোখে কালি পড়লে উমা ব্যস্ত হবেন। পত্রিকার ডাঁই থেকে চোখে কালির নিদান খুঁজতে সন্ধে কাবার। সুতরাং চুল শুকোলে তবেই পছন্দসই কয়েকখানা পত্রপত্রিকা নিয়ে তপতী বিছানাসই হবেন। যত না পড়েন তারচেয়ে বেশি দেখেন তপতী। প্রথমে দেখেন। সাজ। তারপর দেখেন রূপ। তারপর দেখেন গল্প। তারপর ফিরে আসেন সাজসজ্জায়। কত লেহেঙ্গা চোলি, কত বীরবউলি, বডিসুট, বাউটি, শেরওয়ানি, জিনস, কত জিম-যন্ত্র, কত ব্রেসিয়ার, কত হোসিয়ারি। দেখতে দেখতে চোখ ফেরে না। শেষে যখন বিউটি-ঘুমে ঢলে ঢলে পড়তে থাকেন বুকের ওপর উপুড় হয়ে থাকে পাতজোড়া এক নবনায়ক। পত্রিকা আঁকড়ে পাশ ফেরেন তপতী। এইবার উটকো কিছু না ঘটলে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *