হযরত হূদ (আ)

হযরত হূদ (আ)

ভূমিকা

মহান আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার মানুষের হিদায়াতের জন্য অগণিত নবী-রাসূল প্রেরণ করিয়াছেন। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি হযরত হূদ (আ)-কে তাঁহার নিজের কাওম আদ-এর প্রতি নবী হিসাবে প্রেরণ করেন। পবিত্র কুরআনে এই সম্পর্কে বলা হইয়াছে : ১১৪ ১৫ ১, “আদ সম্প্রদায়ের নিকট উহাদিগের ভ্রাতা হূদকে পাঠাইয়াছিলাম” (১১ : ৫০)। হযরত হূদ (আ) হযরত নূহ (আ)-এর পর নবী হিসাবে আসিয়াছিলেন। হযরত আদম (আ) হইতে হযরত নূহ (আ)-এর পূর্ব পর্যন্ত প্রেরিত নবীগণের সময় শরীআতের বিস্তারিত নির্দেশাবলী নাযিল হয় নাই। ঐ পর্যায়ের নবীগণ মুখ্যত মানুষকে তাওহীদের শিক্ষা দিতেন। হযরত নূহ (আ) হইতে নবুওয়াত ও রিসালাতের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। হযরত নূহ (আ)-এর সময়ে শরীআতের নির্দেশাবলী অবতীর্ণ হইলেও জিহাদের নির্দেশ অবতীর্ণ হয় নাই। জিহাদের বিধান হযরত মূসা (আ)-এর সময় হইতে কার্যকর হয়। জিহাদের নির্দেশের পূর্বে কোন কাওমের নিকট প্রেরিত নবী-রাসূলের বিরোধিতাকারী ঐ কাওমের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট নবী অথবা তাঁহার অনুসারীগণের পক্ষে জিহাদের কোন অবকাশ ছিল না। আল্লাহ তাআলা ঐসব নাফরমান কাওমকে দুনিয়াবী আযাব ও গযব দিয়া ধ্বংস করিয়া দিতেন। আল্লাহ হযরত হূদ (আ)-এর কাওমকেও তাহাদের নাফরমানীর কারণে আযাব প্রেরণ করিয়া ধ্বংস করিয়া দেন।

হযরত হূদ (আ)-এর জন্ম

তাওরাতে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, এবর (হদ) যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁহার পিতা শেলহ-এর বয়স ছিল ৩০ বৎসর। হযরত হূদ (আ)-এর মোট বয়স ছিল ৪৬৪ বৎসর (বাইবেল, আদিপুস্তক ১১ ও ১৫; আম্বিয়ায়ে কুরআন, খ. ১, পৃ. ১২৩)।

বাইবেলের বর্ণনায় যাঁহাকে এবর বলা হইয়াছে তিনিই হযরত হূদ (আ)। উক্ত বর্ণনার আলোকে তাঁহার বয়সও নির্ধারণ করা যায়। যেমন এবর (হূদ) ৩৪ বৎসর বয়সে পেলগের জন্ম দেওয়ার পর আরও ৪৩০ বৎসর জীবিত ছিলেন। তাই তাঁহার মোট বয়স ছিল ৪৬৪ বৎসর।

হযরত হূদ (আ)-এর বংশ ও জন্ম সম্পর্কিত কিছু তথ্য ছাড়া বাইবেলের আদিপুস্তক হইতে আর কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। এই সম্পর্কে মুহাম্মাদ জামীল আহমাদ বলেন, “হযরত হূদ (আ)-এর নবুওয়াতের তথ্য ও তাঁহার ওয়াজ-নসীহত, দাওয়াত ও তাবলীগ, তাঁহার কাওমের নাফরমানী ও বিদ্রোহ এবং সর্বশেষ তাহাদের ধ্বংস সম্পর্কিত ঘটনা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হইয়াছে। তাওরাত এই সম্পর্কে নীরব” (আম্বিয়ায়ে কুরআন, খ.১, পৃ. ১২৪)।

হযরত হূদ (আ)-এর বংশপরিচয়

হৃদ ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইবন বিবাহ ইব্‌ন খাদ ইব্‌ন ‘আদ ইবন আওস ইব্‌ন ইরাম ইব্‌ন সাম ইব্‌ন নূহ (আ)। ৪র্থ পুরুষে তাঁহার পরদাদা ‘আদ ইবন আওস-এর নামযুক্ত যে পোত্র ছিল, সেই গোত্রের সঙ্গে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন। তাঁহার বংশলতিকা সাম ইবুন নূহ (আ) পর্যন্ত যাইয়া-হযরত ইবরাহীম (আ)-এর বংশের সহিত মিলিয়া যায়। হযরত হূদ (আ) ও সাম-এর মধ্যে ৬ পুরুষের ব্যবধান বিদ্যমান (গুলাম নবী, মুকান্মাল কাসাসুল কুরআন, ১খ, পৃ. ৭৫)। মুহাম্মাদ জামীল আহমাদ রচিত আম্বিয়ায়ে কুরআন নামক গ্রন্থে হযরত হূদ (আ)-এর বংশলতিকা নিম্নোক্তরূপে দেখানো হইয়াছে :

Noah

Shem

Arpachshad

Arphaxad

Salah

Eber

উপরিউক্ত বংশলতিকায় হযরত হূদ (আ)-কে ইবার (-) বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। তাওরাতের বর্ণনা অনুযায়ী হূদ (আ) হযরত আদম (আ)-এর ১৪তম অধস্তন এবং হযরত নূহ (আ)-এর ৫ম অধস্তন পুরুষ (আম্বিয়ায়ে কুরআন, খ. ১, পৃ. ১২৩; বাইবেল, আদিপুস্তক, পৃ. ১৩)।

ইব্‌ন কাছীর রচিত কাসাসুল আম্বিয়া গ্রন্থে হযরত হূদ (আ)-এর বংশলতিকা নিম্নেক্তরূপে উল্লেখ করা হইয়াছে : হূদ ইবন শালিখ ইব্‌ন আরফাখশায ইবন সাম ইবুন নূহ (আ)। কেহ বলেন, হযরত হূদ (আ) হইলেন আবির ইবন শালিক ইবন আরফাখশায ইবন সাম ইব্‌ন নূহ (আ) অথবা কেহ বলেন, হূদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন বিরাহ ইবন আল-জারূদ ইবন ‘আদ ইবন আওস ইবন ইরাম ইব্‌ন সাম ইবন নূহ (আ) (এই বংশলতিকাটি ইব্‌ন জারীর উল্লেখ করেন; ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, ১খ., পৃ. ৯৫, বৈরূত ১৯৮৫ খৃ.)। হযরত হূদ (আ) আদ জাতির সর্বাধিক অভিজাত শাখা খাদ বংশে জন্মগ্রহণ করেন (আয়নী, ৭ খ., কিতাবুল আম্বিয়া, উদ্ধৃতিসহ কাসাসুল কুরআন, ১খ., পৃ. ৮৯, বৈরূত ১৯৮৫ খৃ.)। হযরত হূদ (আ) আরব বংশীয় ছিলেন। এই মর্মে এক হাদীছে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায় । সহীহ ইবন হিব্বান-এ হযরত আবু যার (রা) কর্তৃক বর্ণিত আম্বিয়া-ই কিরামের বর্ণনা সম্বলিত দীর্ঘ হাদীছের এক স্থানে রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেন ।

“আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবী-রাসূলগণের মধ্যে ৪জন আরব ছিলেন : হযরত হূদ (আ), হযরত সালিহ্ (আ), হযরত আয়ব (আ) এবং তোমার নবী হে আবু যার অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (স)” (ইব্‌ন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, ১খ., পৃ. ৯৫)।

হযরত হূদ (আ)-এর বংশলতিকার একটি তুলনামূলক চিত্র বিখ্যাত মিসরীয় ঐতিহাসিক আবদুল ওয়াহহাব আন্-নাজ্জার তাঁহার রচিত কাসাসুল আম্বিয়া গ্রন্থে তুলিয়া ধরেন :

হযরত নূহ (আ)

  • (সাম)
    • (আরফাখশীয়)
      • (শালিহ)
      • (আবির)
      • (ফালিজ)
      • (রাউ)
      • (সারূয)
      • (নাহূর)
      • (তারিহ)
      • হযরত ইবরাহীম (আ)
    • (আরাম)
      • (আওস)
      • (আদ)
      • (আল-খালূদ)
      • (রিবাহ)
      • (আবদুল্লাহ্)
      • (হযরত হূদ (আ)

এই বংশলতিকার স্তম্ভে দৃষ্ট হয় যে, হযরত হূদ (আ) সাম-এর ৬ষ্ঠ অধস্তন পুরুষ, পক্ষান্তরে হযরত ইবরাহীম (আ) সাম-এর ৮ম অধস্তন পুরুষ (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫০)।

আরব বংশ বিশেষজ্ঞ আবুল বারাকাত জাওফী লিখেন, হূদ (আ)-এর পুত্র ইয়ারুব ইব্‌ন কাহতান পরবর্তী কালে য়ামানে পৌঁছিয়া বসতি স্থাপন করেন। য়ামানের সকল সম্প্রদায়ই তাহার বংশধর। আরবী ভাষার সূচনা তাঁহার নিকট হইতেই হইয়াছে এবং তাহার নাম অনুসারে ভাষার নাম আরবী ও এই ভাষাভাষীর নাম হইয়াছে আরব (বাহরে মুহীত; মুফতী মুহাম্মাদ শফী, মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত বাংলা সংস্করণ, পৃ. ৪৫৪)। কিন্তু আরেকটি তথ্য এই যে, আরবী ভাষা হযরত নূহ (আ)-এর আমল হইতে প্রচলিত ছিল। নূহ (আ)-এর কিশতীর একজন আরোহী জ্বরহুম নামক ব্যক্তি আরবী ভাষায় কথা বলিতেন। এই জ্বরহুম হইতেই মক্কা শহর আবাদ হইয়াছে। তবে ইহা সম্ভব যে, য়ামানে আরবী ভাষার সূচনা ইয়াকূব ইবন কাহ্তান হইতেই হইয়াছিল (মুফতী মুহাম্মাদ শফী, মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত বাংলা সংস্করণ, পৃ. ৪৫৪)।

ইবন আসাকির তাঁহার ইতিহাস গ্রন্থে এই মর্মে আনাস ইবন মালিক (রা) হইতে একটি মওকুফ হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, যখন আল্লাহ মানবজাতিকে বাবিল-এ একত্র করিলেন, তখন তাহাদের উপর দিয়া আল্লাহর হুকুমে জোরে হাওয়া প্রবাহিত হইল। তাহারা তাহাদের একত্র করার কারণ জানার জন্য এক স্থানে জড় হইল। তখন এক (অদৃশ্য) ঘোষণাকারী ঘোষণা করিলেন, “তোমাদের মধ্যে যাহারা পশ্চিমকে ডাইনে, পূর্বকে বামে রাখিবে এবং পবিত্র ঘরের দিকে মুখ করিবে তাহাদের ভাষা হইবে আকাশের বাসিন্দাদের ভাষা”। তখন কাহতানের পুত্র য়ারুব দাঁড়ান। তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলা হয়, “হে হ্রদের পুত্র আরুব ইব্‌ন কাহতান! তুমি কি সেই ব্যক্তি?” অতঃপর তিনি হইলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি “প্রাঞ্জল আরবীতে কথা বলেন। অতঃপর একের পর এক ঘোষণা হইতে লাগিল আর লোকেরা দাঁড়াইয়া নিজেদের সম্মতি জানাইতে থাকিল । এইভাবে মানবজাতির ভাষা বাহাত্তরটি ভাষায় বিভক্ত হইল, তখন ঘোষণা বন্ধ হইল। আর পরিণতিতে কাহারও ভাষা কেহই বুঝিতে সক্ষম না হওয়ায় তাহারা যাহার যাহার নির্ধারিত এলাকায় প্রস্থান করিল। সেই কারণেই এই দেশের নাম হয় বাবিল (আ.ত.ম. মুছলেহ উদ্দীন, আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ২৩২, ঢাকা ১৯৮২ খৃ.; নতুন সংস্করণ ১৯৯৫ খৃ.)।

হযরত হূদ (আ)-এর নবুওয়াত লাভ

হযরত হূদ (আ) তাঁহার নিজ কওম ‘আদ-এর প্রতি নবী হিসাবে প্রেরিত হন। আদ হযরত নূহ (আ)-এর ৫ম পুরুষের মধ্যে এবং তাঁহার পুত্র সাম-এর বংশধরের মধ্যে এক ব্যক্তির নাম। পরবর্তী পর্যায়ে আদ নামক ব্যক্তির বংশধর ও গোটা সম্প্রদায় আদ নামে খ্যাত হয়। বংশবৃদ্ধির ফলে আদ একটি জাতিতে পরিণত হয়। আদ জাতির লোকেরা ছিল সুঠামদেহী ও দীর্ঘ আকৃতিবিশিষ্ট। তাহারা প্রচণ্ড কায়িক শক্তির অধিকারী ছিল। তাহা ছাড়া আর্থিক দিক হইতেও তাহারা অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী ছিল। ‘আদ জাতি তাহাদের সুখ-সমৃদ্ধি ও শক্তিমত্তায় গর্বিত হইয়া আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয়। ফলে তাহাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ হযরত হূদ (আ)-কে নবীরূপে প্রেরণ করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ১৯৭৫ ১৬ ১, “আদ সম্প্রদায়ের নিকট উহাদিগের ভ্রাতা হূদকে পাঠাইয়াছিলাম”।

আল-কুরআনে হ্যরত হূদ (আ)

পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় হযরত হূদ (আ) ও তাহার রিসালাত সংক্রান্ত আলোচনা এবং তাঁহার কওম অর্থাৎ কওমে আদ-এর কথা বর্ণনা করা হইয়াছে। নিম্নে সূরাসমূহের নাম ও আয়াত নম্বর উল্লেখ করা হইল :

সূরা আল-আরাফ : আয়াত নম্বর ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২।

সূরা হূদ : আয়াত নম্বর ৫০, ৫১,৫২, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬০।

সূরা আল-মুমিনূন : ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২।

সূরা আস-শুআরা : আয়াত নম্বর : ১২৩, ১২৪, ১২৫, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১২৯, ১৩০, ১৩১, ১৩২, ১৩৩, ১৩৪, ১৩৫, ১৩৬, ১৩৭, ১৩৮, ১৩৯, ১৪০।

সূরা হা-মীম আস-সাজদা : আয়াত নম্বর ১৫, ১৬।

সূরা আয-যারিয়াত : ৪১-৪২।

সূরা আল-আহকাফ : আয়াত নম্বর ২১-২৬।

সূরা আল-কামার : আয়াত নম্বর ১৮, ১৯, ২০, ২১।

সূরা আল-হাক্কা : আয়াত নম্বর ৬, ৭, ৮।

সূরা আল-ফাজুর : আয়াত নম্বর ৬, ৭, ৮ (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৩-৫৬)। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“আদ জাতির নিকট আমি উহাদিগের ভ্রাতা হ্রদকে পাঠাইয়াছিলাম। সে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নাই। তোমরা কি সাবধান হইবে না? তাহার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ, যাহারা কুফরী করিয়াছিল, তাহারা বলিয়াছিল, আমরা তো দেখিতেছি তুমি নির্বোধ এবং তোমাকে আমরা তো মিথ্যাবাদী মনে করি। সে বলিল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি নিবোধ নহি, বরং আমি জগৎসমূহের প্রতিপালকের রাসূল। আমি আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদিগের নিকট পৌঁছাইতেছি এবং আমি তোমাদিগের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাঙখী। তোমরা কি বিস্মিত হইতেছ যে, তোমাদিগের নিকট তোমাদিগের একজনের মাধ্যমে তোমাদিগের প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমাদিগকে সতর্ক করিবার জন্য উপদেশ আসিয়াছে? এবং স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদিগকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাহাদিগের স্থলাভিষিক্ত করিয়াছেন এবং তোমাদিগের অবয়ব অন্য লোক অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর সমৃদ্ধ করিয়াছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়ত তোমরা সফলকাম হইবে। তাহারা বলিল, তুমি কি আমাদিগের নিকট এই উদ্দেশ্যে আসিয়াছ যে, আমরা যেন এক আল্লাহর ইবাদত করি এবং আমাদিগের পূর্বপুরুষগণ যাহার ইবাদত করিত তাহা বর্জন করি? সুতরাং তুমি সত্যবাদী হইলে আমাদিগকে যাহার ভয় দেখাইতেছ তাহা আনয়ন কর। সে বলিল, তোমাদিগের প্রতিপালকের শাস্তি ও ক্রোধ তো তোমাদিগের জন্য নির্ধারিত হইয়াই আছে; তবে কি তোমরা আমার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইতে চাহ এমন কতগুলি নাম সম্বন্ধে যাহা তোমরা ও তোমাদিগের পিতৃপুরুষগণ সৃষ্টি করিয়াছ এবং যে সম্বন্ধে আল্লাহ কোন সনদ পাঠান নাই? সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদিগের সহিত প্রতীক্ষা করিতেছি। অতঃপর তাহাকে ও তার সঙ্গীদিগকে আমার অনুগ্রহে উদ্ধার করিয়াছিলাম; আর আমার নিদর্শনকে যাহারা প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল এবং যাহারা মুমিন ছিল না তাহাদিগকে নির্মূল করিয়াছিলাম” (৭ : ৬৫-৭২)।

“আমি আদ জাতির নিকট উহাদিগের ভ্রাতা হ্রদকে পাঠাইয়াছিলাম। সে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য কোন ইলাহ নাই। তোমরা তো কেবল মিথ্যা রচনাকারী। হে আমার সম্প্রদায়! আমি ইহার পরিবর্তে তোমাদিগের নিকট পরিশ্রমিক যাজ্ঞা করি না। আমার পারিশ্রমিক আছে তাহারই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন। তোমরা কি তবুও অনুধাবন করিবে না? হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদিগের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাহার দিকেই ফিরিয়া আস। তিনি তোমাদিগের জন্য প্রচুর বারি বর্ষাইবেন। তিনি তোমাদিগকে আরও শক্তি দিয়া তোমাদিগের শক্তি বৃদ্ধি করিবেন এবং তোমরা অপরাধী হইয়া মুখ ফিরাইয়া লইও না। উহারা বলিল, হে হূদ! তুমি আমাদিগের নিকট কোন স্পষ্ট প্রমাণ আনয়ন কর নাই, তোমার কথায় আমরা আমাদিগের ইলাহূদিগকে পরিত্যাগ করিবার নহি এবং আমরা তোমাতে বিশ্বাসী নহি। আমরা তো ইহাই বলি, আমাদিগের ইলাদিগের মধ্যে কেহ তোমাকে অশুভ দ্বারা আবিষ্ট করিয়াছে। সে বলিল, আমি আল্লাহকে সাক্ষী করিতেছি এবং তোমরাও সাক্ষী হও যে, আমি তাহা হইতে নির্লিপ্ত যাহাকে তোমরা আল্লাহর শরীক কর, আল্লাহ ব্যতীত। তোমরা সকলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর, অতঃপর আমাকে অবকাশ দিও না। আমি নির্ভর করি আমার ও তোমাদিগের প্রতিপালক আল্লাহর উপর; এমন কোন জীব-জন্তু নাই, যে তাহার পূর্ণ আয়ত্তাধীন নহে; নিশ্চয় আমার প্রতিপালক আছেন সরল পথে। অতঃপর তোমরা মুখ ফিরাইয়া লইলেও আমি যাহাসহ তোমাদিগের নিকট প্রেরিত হইয়াছি, আমি তো তাহা তোমাদিগের নিকট পৌঁছাইয়া দিয়াছি এবং আমার প্রতিপালক তোমাদিগ হইতে ভিন্ন কোন সম্প্রদায়কে তোমাদিগের স্থলাভিষিক্ত করিবেন এবং তোমরা তাহার কোন ক্ষতি সাধন করিতে পারিবে না। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক সমস্ত কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এবং যখন আমার নির্দেশ আসিল তখন আমি হূদ ও তাহার সঙ্গে যাহারা ঈমান আনিয়াছিল তাহাদিগকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করিলাম এবং রক্ষা করিলাম তাহাদিগকে কঠিন শাস্তি হইতে। এই আদ জাতি তাহাদিগের প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করিয়াছিল এবং অমান্য করিয়াছিল তাহার রাসূলগণকে এবং উহারা প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারীর নির্দেশ অনুসরণ করিত। এই দুনিয়ায় উহাদিগকে করা হইয়াছিল লানতগ্রস্ত এবং লানতগ্রস্ত হইবে উহারা কিয়ামতের দিনেও। জানিয়া রাখ! আদ সম্প্রদায় তাহাদিগের প্রতিপালককে অস্বীকার করিয়াছিল। জানিয়া রাখ! ধ্বংসই হইল হৃদের সম্প্রদায় আদের পরিণাম” (১১ : ৫০-৬০)।

“অতঃপর আমি তাহাদিগের পর অন্য এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়াছিলাম এবং উহাদিগেরই . একজনকে উহাদিগের নিকট রাসূল করিয়া পাঠাইয়াছিলাম। সে বলিয়াছিল, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদিগের অন্য কোন ইলাহ নাই। তবুও কি তোমরা সাবধান হইবে না? তাহার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ, যাহারা কুফরী করিয়াছিল ও আখিরাতের সাক্ষাৎকারকে অস্বীকার করিয়াছিল এবং যাহাদিগকে আমি দিয়াছিলাম পার্থিব জীবনে প্রচুর ভোগসম্ভার, তাহারা বলিয়াছিল, সে তো তোমাদিগের মত একজন মানুষই; তোমরা যাহা আহার কর সে তো তাহাই আহার করে এবং তোমরা যাহা পান কর সেও তাহাই পান করে। যদি তোমরা তোমাদিগের মত একজন মানুষের আনুগত্য কর তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। সে কি তোমাদিগকে এই প্রতিশ্রুতিই দেয় যে, তোমাদিগের মৃত্যু হইলে এবং তোমরা মৃত্তিকা ও অস্থিতে পরিণত হইলেও তোমাদিগকে পুনরুত্থিত করা হইবে? অসম্ভব, তোমাদিগকে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে তাহা অসম্ভব। একমাত্র পার্থিব জীনই আমাদিগের জীবন, আমরা মরি-বাঁচি এইখানেই এবং আমরা পুনরুথিত হইব না। সে তো এমন এক ব্যক্তি যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করিয়াছে এবং আমরা তাহাকে বিশ্বাস করিবার নহি। সে বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর; কারণ উহারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে। আল্লাহ বলিলেন, অচিরে উহারা অনুতপ্ত হইবেই। অতঃপর সত্যসত্যই এক বিকট আওয়াজ উহাদিগকে আঘাত করিল এবং আমি উহাদিগকে তরঙ্গ-তাড়িত আবর্জনা সদৃশ করিয়া দিলাম। সুতরাং ধ্বংস হইয়া গেল জালিম সম্প্রদায়। অতঃপর তাহাদিগের পরে আমি বহু জাতি সৃষ্টি করিয়াছি” (২৩:৩১-৪২)।

“আদ সম্প্রদায় রাসূলগণকে অস্বীকার করিয়াছিল। যখন উহাদিগের ভ্রাতা হ্রদ উহাদিগকে বলিল, তোমরা কি সাবধান হইবে না? আমি তোমাদিগের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি তোমাদিগের নিকট ইহার জন্য কোন প্রতিদান চাহি না, আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আছে। তোমরা কি প্রতিটি উচ্চ স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করিতেছ নিরর্থক? আর তোমরা প্রাসাদ নির্মাণ করিতেছ এই মনে করিয়া যে, তোমরা চিরস্থায়ী হইবে। এবং যখন তোমরা আঘাত হান তখন আঘাত হানিয়া থাক কঠোরভাবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। ভয় কর তাহাকে যিনি তোমাদিগকে দিয়াছেন সেই সমুদয় যাহা তোমরা জান। তিনি তোমাদিগকে দিয়াছেন আনআম ও সন্তান-সন্তুতি, উদ্যান ও প্রস্রবণ। আমি তোমাদিগের জন্য আশংকা করি মহাদিবসের শাস্তির। উহারা বলিল, তুমি উপদেশ দাও অথবা না-ই দাও, উভয়ই আমাদিগের জন্য সমান। ইহা তো পূর্ববর্তীদিগেরই স্বভাব। আমরা শাস্তিপ্রাপ্তদিগের শামিল নহি। অতঃপর উহারা তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিল এবং আমি উহাদিগকে ধ্বংস করিলাম। ইহাতে অবশ্যই আছে নিদর্শন; কিন্তু উহাদিগের অধিকাংশই মুমিন নহে। এবং তোমার প্রতিপালক, তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু” (২৬ ১২৩-১৪০)।

“আর আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, উহারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করিত এবং বলিত, আমাদিগের অপেক্ষা শক্তিশালী কে আছে : উহারা কি তবে লক্ষ্য করে নাই যে, আল্লাহ যিনি উহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি উহাদিগের অপেক্ষা শক্তিশালী? অথচ উহারা আমার নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করিত। অতঃপর আমি উহাদিগকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাইবার জন্য উহাদিগের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলাম ঝঞ্ঝাবায়ু অশুভ দিনে। আখিরাতের শাস্তি তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং উহাদিগকে সাহায্য করা হইবে না” (৪১ : ১৫-১৬)।

“স্মরণ কর আদ সম্প্রদায়ের ভ্রাতার কথা, যাহার পূর্বে এবং পরেও সতর্ককারীরা আসিয়াছিল। সে তাহার আহকাফবাসী সম্প্রদায়কে সতর্ক করিয়াছিল এই বলিয়া, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত কাহারও ইবাদত করিও না। আমি তোমাদিগের জন্য মহাদিবসের শাস্তি আশংকা করিতেছি। উহারা বলিয়াছিল, তুমি আমাদিগকে আমাদিগের দেব-দেবীগুলির পূজা হইতে নিবৃত্ত করিতে আসিয়াছ? তুমি সত্যবাদী হইলে আমাদিগকে যাহার ভয় দেখাইতেছ তাহা আনয়ন কর। সে বলিল, ইহার জ্ঞান তো কেবল আল্লাহরই নিকট আছে। আমি যাহা লইয়া প্রেরিত হইয়াছি কেবল তাহাই তোমাদিগের নিকট প্রচার করি। কিন্তু আমি দেখিতেছি, তোমরা এক মূঢ় সম্প্রদায় । অতঃপর যখন তাহারা উহাদিগের উপত্যকার দিকে মেঘ আসিতে দেখিল তখন বলিতে লাগিল, উহা তো মেঘ, আমাদিগকে বৃষ্টি দান করিবে। হূদ বলিল, ইহাই তো তাহা, যাহা তোমরা ত্বরান্বিত করিতে চাহিয়াছ, এক ঝড়, মর্মন্তুদ শাস্তি বহনকারী। আল্লাহর নির্দেশে ইহা সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করিয়া দিবে। অতঃপর উহাদিগের পরিণাম এই হইল যে, উহাদিগের বসতিগুলি ছাড়া আর কিছুই রহিল না। এইভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়া থাকি। আমি উহাদিগকে যে প্রতিষ্ঠা দিয়াছিলাম তোমাদিগকে তাহা দেই নাই। আমি উহাদিগকে দিয়াছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও হূদয়; কিন্তু এইগুলি উহাদিগের কোন কাজে আসে নাই। কেননা উহারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করিয়াছিল। যাহা লইয়া উহারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিত উহাই উহাদিগকে পরিবেষ্টন করিল” (৪৬ ও ২১-২৬)।

“এবং নিদর্শন রহিয়াছে আদের ঘটনায়, যখন আমি তাহাদিগের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলাম অকল্যাণকর বায়ু। ইহা যাহা কিছুর উপর দিয়া প্রবাহিত হইয়া গিয়াছিল তাহাকেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিয়াছিল” (৫১ : ৪১-২)।

“আদ সম্প্রদায় সত্য প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল, ফলে কী কঠোর হইয়াছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী! উহাদিগের উপর আমি প্রেরণ করিয়াছিলাম ঝঞ্ঝাবায়ু নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভাগ্যের দিনে, মানুষকে উহা উৎখাত করিয়াছিল উম্মলিত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়। কী কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী” (৫৪ : ১৮-২১)।

“আর আদ সম্প্রদায়, উহাদিগকে ধ্বংস করা হইয়াছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা, যাহা তিনি উহাদিগের উপর প্রবাহিত করিয়াছিলেন সপ্ত রাত্রি ও অষ্ট দিবস বিরামহীনভাবে। তখন তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে দেখিত- উহারা সেথায় লুটাইয়া পড়িয়া আছে সারশূন্য বিক্ষিপ্ত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়। অতঃপর উহাদিগের কাহাকেও তুমি বিদ্যমান দেখিতে পাও কি” (৬৯ : ৬-৮)?

“তুমি কি দেখ নাই তোমার প্রতিপালক কি করিয়াছিলেন আদ বংশের ইরাম গোত্রের প্রতি, যাহারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের, যাহার সমতুল্য কোন দেশে নির্মিত হয় নাই” (৮৯ ও ৬-৮)?

হাদীছ শরীফে হযরত হূদ (আ)

হাদীছে হযরত হূদ (আ)-এর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে কতক হাদীছে হযরত হূদ (আ)-এর উল্লেখ পাওয়া যায় । হযরত আবূ বা সিদ্দীক (রা) এক দিন হযরত রাসূলুল্লাহ (স)-এর কিছু দাড়ি পাকা দেখিলেন এবং বিচলিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বার্ধক্যে উপনীত হইয়াছেন! রাসূলে পাক (স) বলেন, “হ” সূরা হূদ আমাকে বৃদ্ধ করিয়া দিয়াছে” (মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত বাংলা অনু., পৃ. ৬১৯)। এই হাদীছ হইতে বুঝা যায় যে, বিশেষত এই সূরায় হযরত নূহ (আ), হযরত হূদ (আ) ও হযরত সালিহ (আ)-এর দাওয়াতী কার্যক্রমের বর্ণনা এবং তাঁহাদের কওমের নাফরমানির কথা অবগত হইয়া মহানবী (স) বিচলিত হইয়াছিলেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হূদ (আ) সর্বপ্রথম আরবী ভাষায় কথা বলেন। ওয়াহ্ ইবন মুনাব্বিহ মনে করেন, হযরত হূদ (আ)-এর পিতা সর্বপ্রথম আরবী ভাষায় কথা বলেন (আবদুল ওয়াহহাব আন্-নাজ্জার, কাসাসুল কুরআন, পৃ. ৪৯; ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৯৫)।

সহীহ্ ইবন হিব্বানে হযরত আবু যার (রা) বর্ণিত দীর্ঘ হাদীছে নবী ও রাসূলগণের বর্ণনার এক স্থানে নবী করীম (স) বলেন :

“(আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত) নবী-রাসূলগণের মধ্যে ৪জন আরব ছিলেন। হযরত হূদ, হযরত সালিহ, হযরত শুআয়ক এবং তোমার নবী, হে আবু যার” (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৯৫)! হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীছে আদ জাতি ও হযরত হূদ (আ) সম্পর্কে বলা হইয়াছে :

“হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আদ জাতি ‘সামূদ ও ‘আল-হাতার নামক দুইটি মূর্তির পূজা করিতে শুরু করে। অতঃপর আল্লাহ তাহাদের নিকট হযরত হূদ (আ)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করেন। তিনি খালুদ গোত্রের সন্তান ছিলেন। তিনি বংশের দিক হইতে অভিজাত এবং সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট ছিলেন। তাঁহার শরীরের রং সাদা, চিবুক চুলপূর্ণ, দাড়ি লম্বা ছিল। তিনি তাহাদেরকে আল্লাহর ইবাদত করার ও তাহাকে একমাত্র স্রষ্টা হিসাবে মানার জন্য বলেন এবং মানুষের উপর অত্যাচার করা হইতে বিরত থাকিতে বলেন। কিন্তু তাহারা হযরত হূদ (আ)-কে মিথ্যুক বলে এবং গর্ব করিয়া বলে, আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে (তাফসীরুল মানার, খ. ৭, পৃ. ৪৯৮)!

কওমে হূদ বা আদ জাতির পরিচয়

হযরত হূদ (আ)-কে তাঁহার নিজস্ব কওম আদ-এর হিদায়াতের জন্য আল্লাহ প্রেরণ করেন। হযরত হূদ (আ)-এর জীবন ও কর্মতৎপরতা আদ জাতিকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হইয়াছিল । ফলে হযরত হূদ (আ)-এর জীবনী আলোচনা করিতে হইলে আদ জাতি সম্পর্কে সার্বিক আলোচনা আবশ্যক। হযরত আদম (আ)-এর পর অনেক অনেক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আরবে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সম্পদ ও প্রাচুর্যের অধিকারী এক জাতির আবাদ ছিল, যাহাদেরকে পবিত্র কুরআনে “আদ জাতি বলা হইয়াছে। হযরত নূহ (আ)-এর প্রাবনের পর তাহার পুত্রদের মধ্যে অন্যতম সাম-এর বংশ আরব ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। আদ জাতি ঐ বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, যাহাদের বিভিন্ন গোত্রকে url বা ‘সামী জাতিগোষ্ঠী বলা হইত। এই আদ জাতি ইরাম ইবন সাম ইব্‌ন নূহ (আ)–এর বংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় এই জাতিকে আদ-ই ইরাম বলা হইত। কুরআনে উল্লিখিত আদ ও ছামূদ জাতিদ্বয়ের বংশতালিকা উপরের দিকে ইরাম-এ গিয়া মিলিত হয়। ফলে ইরাম শব্দটি আদ ও ছামূদ উভয়ের বেলায় প্রযোজ্য।

সায়্যিদ সুলায়মান নদবী আসমানী কিতাব তাওরাত অনুযায়ী বর্ণিত [ ] বংশ পরিবর্তন ছক তাঁহার গ্রন্থে উপস্থাপন করিয়াছেন এবং ঐ ছকে তিনি [ ] জাতিকে [ ] বলিয়া উল্লেখ করেন। অর্থাৎ সেই আদ হযরত হূদ (আ)-এর যমানায় কওমে হ্রদ নামে অভিহিত ছিল এবং হযরত হূদ (আ)-এর পরবর্তী [ ] কে [ ] অর্থাৎ (ছামূদ), (জুরহুম), (মুঈন), (আসাম), (জাদীস) ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেন।

দ্বিতীয় সামী জাতিগোষ্ঠী দ্বিতীয় আদ : ছামূদ, জ্বরহুম, মঈন, তাসাম ও জাদীস, সালিহ

 (সায়্যিদ সুলায়মান নদবী, তারীখু আরদিল কুরআন, ১খ, পৃ. ৯৪, করাচী ১৯১৫ খৃ.)।

সায়্যিদ সুলায়মান নদবীর মতে … • আরবের সর্বপ্রথম ও প্রাথমিক বাসিন্দা ছিল এবং বিভিন্ন কারণে তাহারা আরবভূমি হইতে বাহির হইয়া বাবিল, মিসর, শাম (সিরিয়া) ইত্যাদি এলাকায় ছড়াইয়া পড়ে। আরব ঐতিহাসিকগণ তাহাদেরকে ১৬ • বা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি হিসাবে অভিহিত করেন। কেননা তাহারা তাহাদের দেশ আরব হইতে বাহির হইয়া অন্যত্র গিয়া আসমানী গযবে ধ্বংস হয়। কোন কোন ঐতিহাসিক তাহাদেরকে [ ] অর্থাৎ খাঁটি ও অবিমিশ্র আরব বলিয়া চিহ্নিত করেন। ইউরোপীয় বংশবিশারদ পণ্ডিতগণ আরবের বিভিন্ন প্রাচীন জাতি-গোষ্ঠীকে কেবল সামী বলিতেন, কিন্তু আরবগণ তাহাদের প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীকে পৃথক পৃথক নামে অভিহিত করেন। যেমন (আদ), (ছামূদ), (জুরহুম),  (লিয়ান), (তাসম), (জাদীস) ইত্যাদি। ঐসব গোত্রের মধ্যে আদ সবচাইতে বৃহৎ গোত্র ছিল এবং [ ] অর্থাৎ প্রাচীন আরবের ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল গোত্রের মধ্যে কেবল আদ গোত্রই রাজত্বের অধিকারী ছিল। আরবদের বর্ণনা অনুযায়ী আরব ও আরবের বাহিরে বাবিল ও মিসরে তাহারা বিশাল রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিল। আরব ঐতিহাসিকগণ উপরিউক্ত গোত্রসমূহের মূল ধারা, [ ]-এর দিকে নির্দেশ করেন। তাহাদের তথ্যসূত্র অনুযায়ী প্রাচীনতম উৎস ইব্‌ন কুতায়বার কিতাবুল মাআরিফ-এ ইব্‌ন কুতায়বা এবং পরবর্তী কালের লেখক কালকাশান্দী [ ]-এর মধ্যে নিম্নোক্তরূপে উপস্থাপন করেন :

ইবন কুতায়বা (কিতাবুল মাআরিফ)

আমালিক ইব্‌ন লাবি ইব্‌ন ইরাম ইবন সাম

জাদীস ইব্‌ন লাবিব ইবন ইরাম ইব্‌ন সাম

আদ ইব্‌ন আওদ ইবন ইরাম ইবন সাম

ছামূদ ইব্‌ন জাছার ইবন ইরাম ইব্‌ন সাম

.

কালকাশান্দী

আমালীক ইব্‌ন লাবিব ইবন সাম

জাদীস ইব্‌ন ইরাম ইবন সাম

আদ ইব্‌ন আওদ ইব্‌ন আবীল ইব্‌ন ইরাম ইব্‌ন সাম ইরাম ইবন সাম

ছামূদ ইব্‌ন জাছির ইব্‌ন ইরাম ইব্‌ন সাম তাসম ইবন লাবি ইব্‌ন সাম

(ইবন কুতায়বা, কিতাবুল মাআরিফ, পৃ. ১০, মিসর; আল্-কালকাশান্দী, সাবায়িকুল মাযহাব, পৃ. ১৩১৪, বোম্বাই)।

উপরে বর্ণিত বংশতালিকায় সকল গোত্রই সাম-এর বংশধর ছিল। তবে সাম-এর পরে সকলেই ‘ইরাম’-এর অধস্তন ছিল। ফলে আরবের সকল গোত্রের মধ্যে আরামী উপাদানের প্রাধান্য ছিল। যেমন আরবী ভাষায় আরামী শব্দ অধিক পরিমাণে পাওয়া যায় (প্রফেসর আরনল্ড, লাহোর)। এমনকি আরবের প্রাচীন শহর মক্কা নামটিও আরামী (জুরজী যায়দান, পৃ. ২৪০)। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবন খালদূন বলেন,

“প্রথমে ‘আদকে ইরাম বলা হইত। যখন তাহারা ধ্বংস হইয়া যায় তখন ছামূদ-ই ইরাম বলা হইত । যখন তাহারাও ধ্বংস হইয়া যায়, তখন নমরূদ-ই ইরাম বলা হইত” (ইবন খালদূন, ২ খ, পৃ. ৭)। পবিত্র কুরআনে বলা হইয়াছে :

“তুমি কি দেখ নাই তোমার প্রতিপালক কি করিয়াছিলেন আদ বংশের ইরাম গোত্রের প্রতি, যাহারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের, যাহার সমতুল্য কোন দেশে নির্মিত হয় নাই” (৮৯ : ৬-৮)!

উপরিউক্ত আয়াতে ইরাম শব্দ ব্যবহার করিয়া আদ গোত্রের পূর্ববর্তী বংশধর তথা প্রথম ‘আদকে নির্দেশ করা হইয়াছে। তাহারা দ্বিতীয় ‘আদ-এর তুলনায় আদ-এর পূর্বপুরুষ ইরাম-এর নিকটতম বিধায় তাহাদেরকে ‘আদ-ই ইরাম নামে অভিহিত করা হইয়াছে। অনুরূপভাবে সূরা আন্-নাজম-এ তাহাদিগকে ‘আদ-ই ঊলা বলা হইয়াছে :

“আরও এই যে, তিনিই প্রাচীন ‘আদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করিয়াছিলেন এবং ছামূদ সম্প্রদায়কেও, কাহাকেও তিনি বাকী রাখেন নাই, আর ইহাদিগের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কেও, উহারা ছিল অতিশয় জালিম ও অবাধ্য” (৫৩: ৫০-৫২)।

আদ শব্দটির অর্থ

সেমিটিক (সামী) ভাষাসমূহের মধ্যে সাহিত্যে অস্তিত্বের দিক হইতে হিব্রু প্রাচীনতম ভাষা। ইহার ফলে প্রাচীন শব্দসমূহের উৎপত্তি আরবী ভাষার তুলনায় ‘হিব্রু ভাষায় অধিক সংরক্ষিত। হিব্রু ভাষায় ‘আদ শব্দের অর্থ উচ্চ ও বিখ্যাত এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইরাম এবং ইসাম (সাম) শব্দদ্বয়ের অর্থও অনুরূপ। এই অর্থের প্রভাব আরবীতেও বিদ্যমান। ইরাম-এর অর্থ পার্বত্য পাহাড়ী ও দিকনির্দেশক পাথর। তাওরাতে ‘আদ পুংলিঙ্গের নামের জন্য এবং ০১৬ স্ত্রীবাচক নামের জন্য একাধিক স্থানে আসিয়াছে, যাহার ফলে ইহা স্পষ্ট যে, প্রাচীন কালে এই নাম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইত (সায়্যিদ সুলায়মান নদবী, তারীখু আরদিল কুরআন, খ, ১, পৃ. ৯৭-৯৮, করাচী ১৯১৫ খৃ.)।

আদ জাতির আবির্ভাবকাল

আদ জাতির আবির্ভাবের সময়কাল আনুমানিক ৩০০০ খৃস্টপূর্বাব্দ। কেননা আদকে [ ]- এর সন্তান বলা হইয়াছে। কিন্তু পবিত্র কুরআনের যে স্থানে ‘আদ-এর উল্লেখ করা হইয়াছে, সেই স্থানে তাহাদেরকে কওমে নূহ-এর প্রতিনিধি বলা হইয়াছে :

“এবং স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদিগকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাহাদিগের স্থলাভিষিক্ত করিয়াছেন এবং তোমাদিগের অবয়ব অন্য লোক অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর সমৃদ্ধ করিয়াছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ.স্মরণ কর, হয়ত তোমরা সফলকাম হইবে” (৭ : ৬৯)।

‘আদ-ই ইরাম অথবা ‘আদ-ই ঊলা তথা আমাদের আলোচ্য ‘আদ জাতির আবির্ভাবকাল ২২০০ খৃ. পূর্বাব্দ হইতে আরম্ভ হয় বলিয়া অনুমিত। আদ জাতির অন্তিমকাল নির্ধারণের পদ্ধতি এই যে, ১৫০০ খৃ. পূর্বাব্দে য়ামান-এ অপর একটি শক্তির উদ্ভব ঘটে এবং ঐ সময়ের কিছু পূর্বের যুগ ছিল হযরত মূসা (আ)-এর যুগ। হযরত মূসা (আ)-এর একজন অনুসারী মুমিন ব্যক্তি ফিরআনের দরবারে বলিয়াছিলেন :

“হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদিগের জন্য পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের শাস্তির দিনের অনুরূপ দুর্দিনের আশংকা করি, যেমন ঘটিয়াছিল নূহ, ‘আদ, ছামূদ এবং তাহাদিগের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে” (৪০ ও ৩০-৩১)।

সুতরাং উপরিউক্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে ‘আদ জাতির আবির্ভাবকাল ৩০০০ খৃ. পূর্বাব্দ হইলেও তাহাদের গৌরবময় যুগ খৃ. পূর্ব ২২০০ সাল হইতে খৃ. পূ. ১৭০০ সাল পর্যন্ত ছিল। অবশ্য ‘আদ জাতির নেককার লোকজন হযরত ঈসা (আ)-এর যুগ পর্যন্ত ছিলেন। গ্রীকগণ ‘আদ জাতিকে [ ] এবং  [ ] ইত্যাদি নামে উল্লেখ করে, যাহারা হাামাওত ও য়ামানের বাসিন্দা ছিল। পার্থক্য নির্ধারণের জন্য ১ম যুগকে আদ-ই ঊলা এবং ২য় যুগকে ‘আদ-ই ছানিয়া বলা হয় (তারীখু আরদিল কুরআন, ১খ., পৃ. ৯৮-৯৯)।

যে সকল ঐতিহাসিক আদ জাতি সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছেন তাঁহারা লিখেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ) যখন মক্কায় বায়তুল্লাহ্ নির্মাণ করেন এবং হযরত ইসমাঈল (আ) ও তাঁহার মাতা হযরত হাজেরা (রা)-কে ঐ স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করেন, তখন ‘আদ জাতি ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল।

আদ জাতির বাসস্থান

‘আদ জাতির কেন্দ্রীয় আবাসভূমি আরবের উস্কৃষ্ট বিস্তৃত অংশ অর্থাৎ য়ামান ও হারামাত তথা পারস্য উপসাগরের উপকূল হইতে ইরাক সীমান্ত পর্যন্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে তাহাদের রাজত্বের মূল কেন্দ্র ছিল য়ামান (তারীখু আরদিল কুরআন, ১খ., পৃ. ৯৯)।

কাসাসুল কুরআন গ্রন্থের গ্রন্থকারের মতে “আদ জাতি হযরত নূহ (আ)-এর পর পৃথিবীতে আবাদ হয়। “আহকাফ” নামক বালুকাময় মরুভূমিতে তাহাদের বসতি ছিল। ঐ এলাকা হামাওত ও য়ামানের উত্তরে আমান উপসাগরের (ভারত মহাসাগর সংলগ্ন) তীর ব্যাপী বিস্তৃত ছিল। এই অঞ্চল প্রাচীন কাল হইতেই বালুকাময় ছিল, না আদ জাতির ধ্বংসের পর বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়, তাহা জানা যায় না। তাওরাত ইত্যাদি আসমানী গ্রন্থ ‘আদ জাতি সম্পর্কে নীরব। ইতিহাসও এই প্রাচীনতম জাতি সম্পর্কে কিছু বলে না। তবে কুরআনুল কারীমই এই ‘আদ জাতির অবস্থা ও বাসস্থান সম্পর্কে জানার একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।

ইব্‌ন কাছীর রচিত কাসাসুল আম্বিয়ার মতে এই ‘আদ জাতি অর্থাৎ ‘আদ ইবন আওস ইবুন সাম ইব্‌ন নূহ ছিল একটি আরবী জাতিগোষ্ঠী। তাহারা আল-আহকাফে বসবাস করিত এবং আহকাফ হইল বালির পাহাড়। ইহা উমান ও হাদ্রামাতের মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থিত ছিল। এই স্থান সমুদ্র উপকূলে বিস্তৃত ছিল। উপকূল সংলগ্ন স্থানকে! (আশ-শিহর) বলা হইত এবং ঐ স্থানের উপত্যকার নাম a. (মুগীছ) (বিদায়া ওয়ান্-নিহায়া, ১খ., পৃ. ৯৫)। পবিত্র কুরআনে আদ জাতির বাসস্থান কোথায় তাহা নির্দিষ্ট করিয়া বলা না হইলেও সূরা আহকাফে বলা হইয়াছে :

“স্মরণ কর আদ সম্প্রদায়ের ভ্রাতার কথা, যাহার পূর্বে ও পরেও সতর্ককারীরা আসিয়াছিল। সে তাহার আহকাফবাসী সম্প্রদায়কে সতর্ক করিয়াছিল এই বলিয়া, আল্লাহ ব্যতীত কাহারও ইবাদত করিও না। আমি তো তোমাদিগের জন্য মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করিতেছি” (৪৬ ও ২১)।

জানা যায় যে, আদ জাতির নির্দিষ্ট বাসস্থান য়ামান হইতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত দক্ষিণ আরব এবং পারস্য উপসাগরের তীর ঘেঁষিয়া ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মনে হয় বর্তমান য়ামান, হামাওত, উমান, কাতার, আল-আহসা ইত্যাদি স্থানে ‘আদ জাতির বসতি বিস্তৃত ছিল। ইহাদের কেন্দ্রস্থল ছিল আহকাফ, যাহা হামাওতের উত্তরে, উমানের পশ্চিমে এবং রাবউল খালীর দক্ষিণে অবস্থিত। বর্তমানে আহকাফে বালির টিলা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু ঐ যুগে হয়ত আহকাফ অঞ্চল সবুজ-শ্যামল প্রান্তর ছিল। শায়খ আবদুল ওয়াহহাব আন্-নাজ্জার তাহার কাসাসুল আম্বিয়া গ্রন্থে হামাতের সায়্যিদ আবদুল্লাহ ইবন আহমাদের বর্ণনা উদ্ধৃত করেন যে, একবার তিনি একদল লোকের সঙ্গে প্রাচীন কালে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের খোঁজ করার জন্য হারামাতের উত্তর দিকের প্রান্তরে কর্মরত ছিলেন। তাঁহারা অনেক চেষ্টার পর বালির টিলা খোদাই করিয়া মর্মর পাথরের কতিপয় পাত্র উদ্ধার করেন। ঐ সকল পাত্রে কিক পদ্ধতির লেখা ছিল। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তাঁহারা খননকার্য সমাপ্ত করিতে পারেন নাই (হিফজুর রহমান, কাসাসুল কুরআন, খণ্ড ১, পৃ. ৮৯; আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫১)। এই খননকার্য দ্বারা অনুমান করা যায় যে, আদ জাতি বসবাস করার সময় ঐ স্থান হয়ত বর্তমান সময়ের মত মরুময় ছিল না, বরং সবুজ, সজীব ও শ্যামল অঞ্চল ছিল। পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় তাহা বুঝা যায়?

“ভয় কর তাঁহাকে যিনি তোমাদিগকে দিয়াছেন সেই সমুদয় যাহা তোমরা জ্ঞাত। তিনি তোমাদিগকে দিয়াছেন আনআম তথা উট, গরু, মেষ, ছাগল ও সন্তান-সন্তুতি, উদ্যান ও প্রস্রবণ । আমি তোমাদিগের জন্য আশংকা করি মহাদিবসের শাস্তি” (২৬ : ১৩২-১৩৫)।

‘আদ জাতির লোকেরা মাঠে তাঁবুর মধ্যে বসবাস করিত। ঐসব তাঁবু বিশাল উঁচু স্তম্ভের উপর স্থাপিত ছিল। অথবা তাহারা এমন উঁচু গৃহে বাস করিত, যেসব গৃহের ছাদ অত্যন্ত উঁচু স্তম্ভের উপর স্থাপিত ছিল।

সায়্যিদ সুলায়মান নদবী তাঁহার ‘তারীখু আরদিল কুরআন গ্রন্থে ja> ১স, শিরোনামে লিখেন, য়ামামা, উমান, বাহরাইব্‌ন, হাদরামাওত এবং পশ্চিম য়ামানের মধ্যবর্তী যে বিশাল প্রান্তর ‘আদ্-দুবনা” অথবা “রাবউলি-খালী” নামে পরিচিত, যদিও তাহা আবাদীর উপযুক্ত নহে, কিন্তু ইহার আশেপাশে কোথায়ও কোথায়ও আবাদীযোগ্য কিছু ভূমি বিদ্যমান, বিশেষ করিয়া ঐ অংশে, যে অংশ হারামাওত হইতে নাজরান পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে অবশ্য এই অংশটিও আবাদ নহে। তাহা সত্ত্বেও প্রাচীন কালে হারামাত ও নাজরানের মধ্যবর্তী অংশে “আদ-ই ইরাম”-এর বিখ্যাত জাতির বসবাস ছিল। এই জাতিকে আল্লাহ নাফরমানীর কারণে ধ্বংস করিয়া দেন (তারীখু আরদিল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৭৩)।

মুহাম্মাদ জামীল আহমাদ তাঁহার রচিত ‘আম্বিয়ায়ে কুরআন নামক গ্রন্থে ‘আদ জাতির আবাসভূমির পরিচয় দিতে গিয়া বলেন, “দক্ষিণ-পূর্ব আরবে পারস্য উপসাগরীয় উপকূল হইতে ইরাক সীমান্ত এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে (আরবে) হামাওত পর্যন্ত ‘আদ জাতির আবাসভূমি বিস্তৃত ছিল (অম্বিয়ায়ে কুরআন, ১খ., পৃ. ১২৪, লাহোর)। অত্র নিবন্ধের পরবর্তী পৃষ্ঠায় ‘আদ জাতির আবাসভূমির (বিলাদু আহকাফ) একটি মানচিত্র দেয়া হইল (পরের পৃষ্ঠায়)।

আদ জাতির পার্থিব সমৃদ্ধির বর্ণনা

পবিত্র কুরআনে ‘আদ জাতিকে হযরত নূহ (আ)-এর পরে পৃথিবীতে আগমনকারী এবং শারীরিক শক্তি, ধনসম্পদ ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। সর্বোপরি তাহাদেরকে কাওমে নূহের পরে দুনিয়ার খিলাফত দান করা হয় :

“স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদিগকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাহাদিগের স্থলাভিষিক্ত করিয়াছেন এবং তোমাদিগের অবয়ব অন্য লোক অপেক্ষা শক্তিতে অধিক সমৃদ্ধ করিয়াছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়ত তোমরা সফলকাম হইবে” (৭ : ৬৯)।

বলা বাহুল্য, আদ জাতির লোকেরা বিশালদেহী এবং প্রচণ্ড শারীরিক শক্তির অধিকারী ছিল। ইসরাঈলী রিওয়ায়াতসমূহে তাহাদের দেহের গঠন ও শক্তি সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথাবার্তা বর্ণিত আছে। তবে হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) ও হযরত মুকাতিল (র) হইতে তাহাদের উচ্চতা ১২ হাত তথা ১৮ ফুট বলিয়া বর্ণনা পাওয়া যায় (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ, পৃ. ১৪৫৪)। তাহাদের মত শক্তিশালী আর কোন জাতি তৎকালে পৃথিবীতে ছিল না। হাফেজ ইবন কাছীর লিখিয়াছেন যে, “আদ জাতির একেকজন লোক বিরাট পাথরের চাড় হাতে উঠাইয়া শক্র গোত্রের উপর নিক্ষেপ করিয়া ধ্বংস করিয়া দিতে পারিত। তাহারা তাহাদের সচ্ছলতা, ধন-সম্পদ ও শিল্প বিজ্ঞানের বিচারে সমসাময়িক সকল জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিল। তাহাদের শান-শওকত ও সার্বিক শক্তিমত্তা তাহাদেরকে অংহকারী, অত্যাচারী ও সীমালংঘনকারী বানাইয়া দেয়। তাহাদের অধিকৃত এলাকায় তাহারা সদম্ভে বিচরণ করিত। তাহারা ক্ষুদ্র ও দুর্বল জাতিসমূহের উপর অন্যায়ভাবে কঠোর আচরণ ও জুলম করিত। তাহাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় ছিল না। নিজেদের শক্তিমত্তার ক্ষেত্রে তাহারা কাহাকেও পরওয়া করিত না।

তাহারা অহংকারের সহিত বলিত, এই পৃথিবীতে আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে : তাহাদের এই অন্যায় দাবি পবিত্র কুরআনে বিবৃত হইয়াছে : “আর আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, উহারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করিত এবং বলিত, আমাদিগের অপেক্ষা শক্তিশালী কে আছে : উহারা কি তবে লক্ষ্য করে নাই যে, আল্লাহ যিনি উহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি উহাদিগের অপেক্ষা শক্তিশালী? অথচ উহারা আমার নির্দেশাবলীকে অস্বীকার করিত” (৪১ : ১৫)।

‘আদ জাতির ঔদ্ধত্য ও অবিমৃষ্যকারিতা এমন পর্যায়ে ছিল যে, তাহারা তাহাদের উপর আপতিত আযাবের কথা বা আখিরাতের আযাবের কথা হযরত হূদ (আ)-এর মুখ হইতে শ্রবণ করার পরও দম্ভভরে কথা বলে। পবিত্র কুরআনের সূরা আহকাফে বলা হইয়াছে।

“উহারা বলিয়াছিল, তুমি আমাদিগকে আমাদিগের দেব-দেবীগুলির পূজা হইতে নিবৃত্ত করিতে আসিয়াছ? তুমি সত্যবাদী হইলে আমাদিগকে যাহার ভয় দেখাইতেছ তাহা আনয়ন কর” (৪৬ ও ২২)।

আদ জাতির ধর্মমত

আদ জাতি মূর্তি নির্মাণে পটু ছিল। তাহাদের পূর্ববর্তী মূর্তিপূজকদের মত তাহারাও বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি নির্মাণ করিয়া ইহাদের পূজা করিত। তাহাদের মূর্তিসমূহের নাম ছিল : ওয়াদ্দ, সুআ, য়াগূছ, য়াউক ও নাসর। হযরত নূহ (আ)-এর কওমের পরে প্রথম মূর্তিপূজা আরম্ভকারী ছিল এই আদ জাতি বা আদ-ই ইরাম (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ১, পৃ. ১২১; নাজ্জারের কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫১)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “(আদ জাতি) এক মূর্তির পূজা করিত, উহাকে সামূদ বলা হইত এবং আর একটি মূর্তির পূজা করিত ঐ মূর্তিকে আল্-হাতার বলা হইত” (আবদুল ওয়াহহাব আন্-নাজজার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫১)।

ইবন কাহীর তাঁহার কাসাসুল আম্বিয়া গ্রন্থে বলেন : নিশ্চয় আদ জাতি এবং তাহারা হইল আদ-ই ঊলা বা ১ম আদ জাতি। হযরত নূহ (আ)-এর তুফানের পর তাহারা ছিল প্রথম মূর্তিপূজক। তাহাদের মূর্তি ছিল তিনটি, যথা সামাদ, সামূদ ও হারা।

মোটকথা আদ জাতি মূর্তি বা দেব-দেবীর পূজায় এতই বিমূঢ় ছিল যে, তাহারা কোনক্রমেই হযরত হূদ (আ)-এর দাওয়াত গ্রহণ করিয়া এক আল্লাহয় বিশ্বাস করে নাই এবং তাহার ইবাদত করে নাই। তবে তাহাদের উপর আল্লাহর গযব অবতীর্ণ হওয়ার সময় তাহাদের মধ্য হইতে মুষ্টিমেয় লোক ঈমানদার ছিলেন এবং গযব হইতে নবীর সঙ্গে রক্ষা পান।

হযরত হূদ (আ)-এর কর্মজীবন বা দাওয়াতী জীবন

আল্লাহ তাআলা হযরত হূদ (আ)-কে পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী, অহংকারী, জালেম, আল্লাহর নাফরমান মূর্তিপূজক আদ জাতির মধ্যে প্রেরণ করেন। আদ জাতি যখন তাহাদের শক্তিমত্তায় উন্মত্ত হইয়া আরব ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় লুটপাট, অসৎ কার্যকলাপ, ঝগড়া-ফাসাদ ও বিশৃঙখলায় লিপ্ত হইয়া পড়ে, তখন হূদ (আ) তাহাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহসমূহের বর্ণনা দানপূর্বক বলেন, হে আদ জাতি! আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তাঁহার নিয়ামতের দ্বারা ভরপুর করিয়া দিয়াছেন। তোমরা সবুজ ও সতেজ অঞ্চলের মালিক। ধন-সম্পদ, বাগান, ঝর্ণা, গবাদি পশু, মোটকথা সকল জীবনোপকরণ তোমাদের জন্য সহজলভ্য। কওমে নূহের পর আল্লাহ তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন। তাই বলিয়া ইহার অর্থ এই নহে যে, তোমরা আল্লাহর যমীনে অহংকার করিবে, দুর্বলের উপর জুলুম করিবে, মানুষের অধিকার ছিনাইয়া নিবে, নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করিবে, ভাল ও মন্দের মধ্যে কোন পার্থক্য করিবে না এবং তোমরা এইসব অন্যায় কেবল এই মনে করিয়া করিতেছ যে, আল্লাহর যমীনের উপর তোমাদের জওয়াবদিহি নেওয়ার মত আর কেহ নাই। তোমরা যদি উপরিউক্ত সকল কার্যকলাপ এবং পাপাচার পরিত্যাগপূর্বক তোমাদের চরিত্র সংশোধন কর, আল্লাহর নিকট পাপ মার্জনা চাহিয়া নিজেদেরকে তাঁহার মুখাপেক্ষী কর, তাহা হইলে তিনি (আল্লাহ) তোমাদের শক্তিমত্তা ও সচ্ছলতায় আরও উন্নতি দান করিবেন এবং তোমরা পরিত্রাণ লাভ করিবে। কিন্তু তোমরা যদি নিজেদেরকে সংশোধন না কর, তাহা হইলে স্মরণ রাখিও যে, আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করিয়াছেন এবং এইসব অনুগ্রহরাজি দ্বারা ভূষিত করিয়াছেন, তিনি তোমাদের বাদ দিয়া অন্য আর এক জাতিকে রাজত্ব দান করিবেন। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে হযরত হূদ (আ)-এর দাওয়াত ও তালীমের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে :

“এবং হে আমার কওম! তোমাদের পালনকর্তার নিকট তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁহার দিকেই ফিরিয়া আস। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিধারা প্রেরণ করিবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করিবেন, তোমরা অপরাধীর মত বিমুখ হইও না” (১১ : ৫২)।

আদ জাতি তাহাদের বসবাসের জন্য বিরাট বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করিত এবং তাহারা মনে করিত যে, তাহারা চিরকাল দুনিয়াতে থাকিতে পারিবে। তাহারা মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করিত এবং দুর্বলের উপর জুলুম করিত। তাহাদের এহেন কার্যকলাপের উল্লেখ করিয়া আল্লাহ বলেন :

“তোমরা প্রতিটি উচ্চ স্থানে নিরর্থক স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করিতেছ? এবং বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ করিয়াছ, যেন তোমরা চিরকাল এই অট্টালিকায় থাকিবে। যখন তোমরা আঘাত হান, তখন জালেম ও নিষ্ঠুরের মত আঘাত হান। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। ভয় কর তাঁহাকে, যিনি তোমাদেরকে সেইসব বস্তু দিয়াছেন, যাহা তোমরা জান। তিনি তোমাদেরকে দিয়াছেন চতুষ্পদ জন্তু ও সন্তান-সন্তুতি এবং উদ্যান ও ঝর্ণা” (২৬ : ১২৮-১৩৪)।

আদ জাতির মধ্যে অন্যায়-অপকর্ম এমনভাবে প্রোথিত ছিল এবং মূর্তিপূজা তাহাদের চিন্তা চেতনায় ও অস্থি-মজ্জায় এমনভাবে বাসা বাঁধিয়াছিল যে, তাহাদের উপর হযরত হূদ (আ)-এর ওয়াজ-নসীহত কোন প্রভাব ফেলিতে পারে নাই। তাহারা হযরত হূদ (আ)-এর পয়গাম শ্রবণে আগ্রহী হয় নাই, বরং গর্ব ও অহংকার বশত মিথ্যার অপবাদ দিয়া তাঁহার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। পবিত্র কুরআনে তাহাদের বক্তব্য নিম্নোক্তভাবে উক্ত হইয়াছে : “আর আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, তাহারা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করিত এবং বলিত, আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর কে আছে : তাহারা কি লক্ষ্য করে নাই যে, যে আল্লাহ তাহাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি তাহাদের অপেক্ষা শক্তিধর? বস্তুত তাহারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করিত” (৪১ : ১৫)।

হযরত হূদ (আ) তাঁহার কওমকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন, হে আমার সম্প্রদায়! ফেরেশতাদেরকে রাসূল হিসাবে পাঠানো উচিত ছিল, এই মর্মে তোমাদের বক্তব্য তোমাদের মূর্খতারই পরিচায়ক। তোমাদের কওমের কাহারও উপর আল্লাহর পয়গাম অবতীর্ণ হওয়ায় আশ্চর্য হওয়া উচিত নহে। কেননা প্রথম হইতেই আল্লাহর এই বিধান চলিয়া আসিতেছে। তিনি (আল্লাহ) মানবজাতির হিদায়াত ও সংশোধনের জন্য তাহাদের মধ্য হইতেই কোন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করিয়া তাঁহার রাসূল বানাইয়া প্রেরণ করেন এবং ঐ রাসূলের মাধ্যমে সকল বান্দার নিকট তাঁহার আহকাম পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। স্বভাবসিদ্ধ নিয়ম এই যে, কোন কওমের হিদায়াতের জন্য এমন ব্যক্তিকে নির্বাচন করা উচিত, যিনি সেই কওমেরই একজন হইবেন, তাহাদের ভাষায় কথা বলিবেন, তাহাদের চরিত্র-অভ্যাস এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে ভালভাবে জানেন, তাহাদের মতই জীবনযাপন করেন এবং কওমের সকলেই তাহাকে চিনে।

হযরত হূদ (আ)-এর উপদেশ সত্ত্বেও তাহারা তাহাদের বাপ-দাদার ধর্মে অটল থাকে। তাহরা এই কথা বলিয়া তাহাকে হাসি-ঠাট্টা করে যে, যেহেতু হযরত হূদ (আ) আমাদের দেবতাদের মন্দ বলেন, সেই হেতু দেবতারা তাঁহাকে কিছু করিয়াছে অর্থাৎ তাহার ক্ষতি করিয়াছে। এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হইয়াছে :“তাহারা (কওমে আদ) বলিল, হে হূদ! তুমি আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নিয়া আস নাই, আমরা তোমার কথায় আমাদের দেব-দেবীদের বর্জন করিতে পারি না, আর আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনয়নকারীও নহি। আমরা তো ইহাই বলি যে, আমাদের কোন দেবতা তোমার উপর শোচনীয় ভূত চাপাইয়া দিয়াছে। সে বলিল, আমি আল্লাহকে সাক্ষী করিতেছি এবং তোমরাও সাক্ষী থাক যে, আমার কোন সম্পর্ক নাই তাহাদের সঙ্গে, যাহাদেরকে তোমরা শরীক করিতেছ” (১১ : ৫৩-৫৪)।

সূরা আল-আরাফ-এ কওমে হূদ ও হযরত হূদ (আ)-এর কথোপকথনের বিষয় পরিষ্কারভাবে উক্ত হইয়াছে :“তাহার সম্প্রদায়ের (আদ) সর্দাররা যাহারা কুফরী করিয়াছিল, বলিল ও আমরা তোমাকে নির্বোধ দেখিতে পাইতেছি এবং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করি। সে বলিল : হে আমার সম্প্রদায়! আমি মোটেই নির্বোধ নহি, বরং আমি বিশ্বপ্রতিপালকের রাসূল। আমি তোমাদেরকে আমার প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছাই এবং আমি তোমাদের বিশ্বস্ত হিতাকাঙ্খী। তোমরা কি বিস্মিত হইতেছ যে, তোমাদের মধ্য হইতেই একজনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে উপদেশ আসিয়াছে, যাহাতে তিনি তোমাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেন। তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে কাওমে নূহের পর সর্দার করিয়াছেন এবং তোমাদের দেহের বিস্তৃতি বেশী করিয়াছেন। তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ স্মরণ কর যাহাতে তোমাদের মঙ্গল হয়। তাহারা বলিল, তুমি কি আমাদের কাছে এইজন্য আসিয়াছ যে, আমরা এক আল্লাহর ইবাদত করি এবং আমাদের বাপ-দাদা যাহাদের পূজা করিত, তাহাদেরকে ছাড়িয়া দেই? অতএব নিয়া আস আমাদের কাছে যাহার দ্বারা আমাদেরকে ভয় দেখাইতেছ, যদি তুমি সত্যবাদী হও” (৭ : ৬৬-৭০)।

হযরত হূদ (আ) তাঁহার কাওমের লোকদের সন্দেহ দূর করার জন্য পরিষ্কার ভাষায় বলেন, তোমরা এমন মনে করিও না যে, আমি কোন পদ-পদবী অথবা সম্পদ ও প্রাচুর্যের লোভ-লালসায় এইসব কথা শিক্ষা দিতেছি। এমন নহে, বরং আমি তো আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত, কেবল আল্লাহর পয়গাম তোমাদেরকে শুনাই এবং কোন লোভ-লালসা ছাড়াই আমার উপর অর্পিত এই অপরিহার্য দায়িত্ব পালন করিয়া যাইতেছি। তোমাদের নিকট হইতে কোন জিনিস প্রতিদান হিসাবে চাহি না। আমি তো কেবল আমার আল্লাহর নিকটই প্রতিদানের প্রত্যাশা করি।

হযরত হূদ (আ)-এর এই আহ্বানের পরেও আদ জাতি প্রচণ্ডভাবে তাহাদের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে এবং তাহারা হূদ (আ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে : “তাহারা বলিল, তুমি উপদেশ দাও অথবা উপদেশ নাই দাও, উভয়ই আমাদের জন্য সমান। এইসব কথাবার্তা পূর্ববর্তী লোকদের অভ্যাস বৈ কিছু নহে। আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হইব না” (২৬ : ১৩৬-৮)।

কাওমের অহংকারী লোকেরা বলিতে থাকে, আপনি আমাদের আযাবের যে ভয় দেখান সেই আযাব নিয়া আসুন। হূদ (আ) বলেন, আযাব নিয়া আসা তো কেবল আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আমি তো আল্লাহর দূতমাত্র। আমাকে যে পয়গাম পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছে, তাহা আমি শুধু পৌঁছাইয়া থাকি।

হযরত হূদ (আ)-এর এই আহ্বানের প্রত্যুত্তরে আদ-এর লোকেরা যাহা বলে, পবিত্র কুরআনে নিম্নেক্ত ভাষায় তাহা বর্ণনা করা হইয়াছে । “তাহারা বলিল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের দেব-দেবী হইতে নিবৃত্ত করিতে আগমন করিয়াছ? তুমি সত্যবাদী হইলে আমাদেরকে যাহার ভয় দেখাইতেছ তাহা নিয়া আস। সে বলিল, ইহার জ্ঞান তো আল্লাহর কাছেই রহিয়াছে। আমি যে বিষয়সহ প্রেরিত হইয়াছি, কেবল তাহাই তোমাদের কাছে পৌঁছাই। কিন্তু আমি দেখিতেছি, তোমরা এক মূর্খ সম্প্রদায়” (৪৬ : ২২-২৩)।

হযরত হূদ (আ)-এর জওয়াবের পরিপ্রেক্ষিতে তাহাদের বক্তব্য পবিত্র কুরআনে এইভাবে উক্ত হইয়াছে :“তাহারা বলিল, হে হূদ! তুমি আমাদের নিকট কোন প্রমাণ নিয়া আস নাই। আমরা তোমার কথায় আমাদের দেব-দেবীদের বর্জন করিতে পারি না এবং আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি না“ (১১ : ৫৩)।

হূদ (আ) আদ-এর লোকদের এই চরম কথার যে জওয়াব দেন তাহা পবিত্র কুরআনে এইভাবে বর্ণনা করা হইয়াছে :“সে বলিল, তোমাদের প্রতিপালকের শাস্তি ও ক্রোধ তো তোমাদের জন্য নির্ধারিত হইয়াই আছে; তবে কি তোমরা আমার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইতে চাহ এমন কতকগুলি নাম সম্বন্ধে যাহা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষগণ সৃষ্টি করিয়াছ এবং যে সম্বন্ধে আল্লাহ কোন সনদ পাঠান নাই? সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সহিত প্রতীক্ষা করিতেছি” (৭ : ৭১)।

আদ জাতির ধ্বংস

পরিশেষে অকৃতজ্ঞ, বিদ্রোহী, নাফরমান আদ সম্প্রদায়ের অন্তিম সময় উপস্থিত হয়। অন্যায় অপকর্মের শাস্তি শুরু হয়। দেখিতে দেখিতে আদ জাতির বিশাল শান-শওকতপূর্ণ ও বিরাট বিরাট স্তম্ভসমূহ এবং বিরাট উচ্চতাসম্পন্ন অট্টালিকাপূর্ণ বসতিগুলি ধ্বংস করিয়া দেওয়া হয়। প্রথমে এই জাতিকে অনাবৃষ্টি আক্রমণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের ফলে তাহারা মারা যাইতে থাকে। অতঃপর চূড়ান্ত পর্যায়ে নিকষ কাল অন্ধকারপূর্ণ প্রচণ্ড তুফান আরম্ভ হয়।, সেই তুফান সাত রাত্র ও আট দিন ধরিয়া চলিতে থাকে এবং কাওমে আদ-এর সবকিছু ধ্বংস করিয়া দেয়। সেইসব শক্তিধর ও মজবুত বাঁধনের মানুষগুলি, যাহারা নিজেদেরকে শক্তি ও সামর্থ্যের অহংকারে মূল্যায়ন করিয়া বলিত : (আমাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে?) এই গর্বিত ও অহংকারী জাতি নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। তাহাদের বাসগৃহসমূহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হইল। বর্তমানে ঐ স্থানে বালির পাহাড় বা টিলা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।

পবিত্র কুরআন মানবজাতির উপদেশ গ্রহণের জন্য কাওমে আদ-এর কথা বারবার উল্লেখ করিয়াছে? অতঃপর যখন উহারা উহাদের উপত্যকার দিকে মেঘ আসিতে দেখিল তখন বলিতে লাগিল, উহা তো মেঘ, আমাদিগকে বৃষ্টি দান করিবে। হূদ বলিল, ইহাই তো তাহা, যাহা তোমরা ত্বরান্বিত করিতে চাহিয়াছ, ইহাতে রহিয়াছে এক ঝড়-মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহর নির্দেশে ইহা সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করিয়া দিবে। অতঃপর উহাদের পরিণাম এই হইল যে, উহাদের বসতিগুলি ছাড়া আর কিছুই রহিল না। এইভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়া থাকি। আমি উহাদিগকে যে প্রতিষ্ঠা দিয়াছিলাম, তোমাদিগকে তাহা দেই নাই। আমি উহাদিগকে দিয়াছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও হূদয়; কিন্তু এইগুলি উহাদের কোন কাজে আসে নাই। কেননা উহারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করিয়াছিল । যাহা লইয়া উহারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিত উহাই উহাদিগকে পরিবেষ্টন করিল (দ্র. ৪৬ : ২৪-২৬)।

হযরত হূদ (আ) তাহার অনুসারী সঙ্গীগণসহ ঐ ভয়াবহ ধ্বংসলীলা হইতে আল্লাহর অনুগ্রহে রক্ষা পাইলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন : “এবং যখন আমার নির্দেশ আসিল তখন আমি হ্রদ ও তাঁহার সঙ্গে যাহারা ঈমান আনিয়াছিল তাহাদিগকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করিলাম এবং রক্ষা করিলাম তাহাদিগকে কঠিন শাস্তি হইতে” (দ্র. ১১ : ৫৮)। আদ সম্প্রদায়ের বিপর্যয় সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : “এবং নিদর্শন রহিয়াছে আদের ঘটনায়, যখন আমি তাহাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলাম অকল্যাণকর বায়ু। ইহা যাহা কিছুর উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছিল, তাহাকেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিয়াছিল” (৫১ : ৪১-৪২)।

আদ সম্প্রদায়ের উপর কত ভীষণ শাস্তি প্রেরিত হইয়াছিল তাহা আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আদ সম্প্রদায় সত্য অস্বীকার করিয়াছিল, ফলে কী কঠোর হইয়াছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী। উহাদের উপর আমি প্রেরণ করিয়াছিলাম ঝঞ্ঝা বায়ু নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভাগ্যের দিনে। মানুষকে উহা উৎখাত করিয়াছিল উনুলিত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়” (৫৪ : ১৮-২০)।

আখিরাতের আযাবের মত দুনিয়ায়ও আযাব দিয়া আল্লাহ মানুষের জন্য নিদর্শন রাখেন। এই সম্পর্কে সূরা হা-মীম-আস্-সাজদায় আল্লাহ বলেন : “অতঃপর আমি উহাদিগকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাইবার জন্য উহাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলাম ঝঞ্ঝাবায়ু অশুভ দিনে। আখিরাতের শাস্তি তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং উহাদিগকে সাহায্য করা হইবে na“ (৪১ : ১৬)।

সূরা আল-হাক্কায় কাওমে আদ-এর ধ্বংসের চিত্র নিম্নোক্তভাবে অংকন করা হইয়াছে : “আর আদ সম্প্রদায়, উহাদিগকে ধ্বংস করা হইয়াছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা বায়ু দ্বারা, যাহা তিনি উহাদের উপর প্রবাহিত করিয়াছিলেন সপ্ত রাত্রি ও অষ্ট দিবস বিরামহীনভাবে। তখন তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে দেখিতে উহারা সেথায় লুটাইয়া পড়িয়া আছে সারশূন্য খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়। অতঃপর উহাদের কাহাকেও তুমি বিদ্যমান দেখিতে পাও কি” (৬৯ ও ৬-৮)?

হযরত হূদ (আ) ও তাহার অনুসারীগণ আল্লাহর রহমতে রক্ষা পান। মূর্তিপূজকদের কেহই বাঁচে নাই। সূরা আল-আরাফে এই সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : “অতঃপর আমি তাহাকে ও তাহার সঙ্গীদিগকে আমার অনুগ্রহে উদ্ধার করিয়াছিলাম; আর আমার নিদর্শনকে যাহারা অস্বীকার করিয়াছিল এবং যাহারা মুমিন ছিল না তাহাদিগকে নির্মূল করিয়াছিলাম” (৭ :৭২)।

আদ জাতির উপর আযাব আসার মুহূর্তে সংঘটিত একটি অভিনব ঘটনার বিবরণ ইবন কাছীর উল্লেখ করেন। যখন কাওমে আদ তাহাদের কুফরীর উপর অটল থাকে এবং হযরত হূদ (আ)-এর কথা অমান্য করে, তখন আল্লাহ তাআলা তিন বৎসর পর্যন্ত তাহাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ রাখেন। ফলে আদ জাতি দুর্ভিক্ষ কবলিত হয় এবং তাহাদের মধ্যে হাহাকার শুরু হইয়া যায়। কাবা শরীফ ঐ যুগেও দুআ কবুলের জন্য বিখ্যাত ছিল। সুতরাং এই প্রত্যাশায় আদ সম্প্রদায়ের ৭০জন লোকের একটি প্রতিনিধি দল দুআ করার জন্য কাবা শরীফের দিকে রওয়ানা হয়। মক্কা মুআজ্জামায় ঐ সময়ে আমালিকা সম্প্রদায়ের একটি পরিবার অবস্থান করিতেছিল। তাহাদের সর্দার মুআবিয়া ইব্‌ন বা-এর মাতা ছিল আদ সম্প্রদায়ের মেয়ে। আদ-এর প্রতিনিধি দলের লোকেরা এই আত্মীয়তার সুবাদে আমালিকার সর্দারের মেহমান হয়। তিনি তাহাদের ভালভাবে মেহমানদারী করেন। মদের সঙ্গে সঙ্গে দুটি দাসীও মনোরঞ্জনের জন্য নিয়োজিত হয়। তাহারা যে উদ্দেশ্যে আসিয়াছিল তাহা ভুলিয়া যায় এবং আরাম-আয়েশ ও আনন্দ-স্ফূর্তিতে মগ্ন হয়। অনেক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর মেযবানের মনে পড়ে যে, কাওমে আদ-এর কারণে যেন আবার তাহার গোত্রকে আল্লাহর গযবের শিকার হইতে না হয়। কিন্তু তিনি মেহমানদেরকে ফিরিয়া যাওয়ার জন্য বলিতে পারিতেছিলেন না। পরিশেষে তিনি কতিপয় কবিতা রচনা করিয়া দাসীদেরকে গাহিবার জন্য নির্দেশ দেন। এই কবিতায় কাওমে আদ-এর মুসিবতের কথা উল্লেখ ছিল। এই কবিতা শুনিয়া আদ-এর প্রতিনিধি দলের সদস্যদের এই স্থানে আগমনের উদ্দেশ্যের কথা স্মরণ হয়। অবশেষে তাহারা কাবা শরীফে পৌঁছে এবং আল্লাহর নিকট কাওমে আদ-এর উপর আপতিত অনাবৃষ্টি দূর হওয়ার জন্য দুআ করে। এই দুআর ফলে আসমানে তিন রং-এর মেঘ প্রকাশিত হয়, যেমন কালো, সাদা ও লাল। অতঃপর আসমান হইতে একটি আওয়াজ আসে, তোমরা এই তিনটি মেঘের টুকরা হইতে যে কোন একটি নির্বাচন করিয়া লও। “আদ মুখপাত্র কালো মেঘ পছন্দ করিল। কেননা তাহাদের ধারণায় উহার মধ্যে পানি বেশী ছিল। ইহার পর আসমান হইতে পুনরায় আওয়াজ আসে, তোমরা ধ্বংসকারী মেঘ পছন্দ করিয়াছ, যাহা সব কিছু তছনছ করিয়া দিবে।

অবশেষে এই কালো মেঘ আদ জাতির বসতির উপর প্রেরণ করা হয়, যাহা আল্লাহর আযাব হিসাবে তাহাদের উপর আট দিন ও সাত রাত্রি ধরিয়া বৃষ্টি বর্ষণ করিতে থাকে এবং সমগ্র এলাকা ধ্বংস করিয়া দেয়। কেবল হযরত হূদ (আ) ও তাহার সাথিগণ রক্ষা পান। ঐ সময়ে তাহারা একটি ঘরে নিরাপদে বসিয়াছিলেন (তাফসীর ইবন কাছীর, ২খ, ২২৬)।

হযরত হূদ (আ)-এর শেষ জীবন ও ইনতিকাল

কাওমে ‘আদ-এর ধ্বংসের পর হযরত হূদ (আ) হাদরামাতের দিকে চলিয়া যান এবং অপর এক সূত্রমতে অবশিষ্ট জীবন তিনি ঐ স্থানেই অতিবাহিত করেন। ইনতিকালের পর ঐ স্থানেই তাঁহাকে দাফন করা হয়। হাফেজ ইব্‌ন কাছীরের তাফসীরে ইবন ইসহাকের রিওয়ায়াতকৃত হযরত আলী (রা)-র হাদীছে বলা হয় যে, তিনি হাদরামাতের এক ব্যক্তিকে বলেন, তুমি কি হাদরামাওতের অমুক স্থানে লাল মাটির একটি টিলা দেখিয়াছ, যাহার উপর কুল ও কাঁটাযুক্ত গাছ রহিয়াছে : হাদরামী বলেন, হাঁ, ঐ স্থানটি সম্পূর্ণ এমনই। হযরত আলী (রা) বলেন, ঐ স্থানে হযরত হূদ (আ)-এর কবর রহিয়াছে। কাহারও মতে তাহার কবর দামিশকের জামে মসজিদের কিবলার দিকস্থ দেওয়ালের পাশে অবস্থিত।

কাসাসুল আম্বিয়ার লেখক আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার লিখেন যে, হাদরামওতের বাসিন্দাদের বক্তব্য যুক্তিযুক্ত। কেননা আদ জাতির আবাসভূমি হারামাতের সঙ্গে মিলিত, ফিলিস্তীনের সঙ্গে নহে (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৩)।

হযরত হূদ (আ)-এর মাযার নামে হারামাওত অঞ্চলের নামক স্থানের পূর্বদিকে একটি যিয়ারতগাহ অদ্যাবধি বিদ্যমান (আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী, কুরআনুল হাকীম, পৃ. ৪৬৯)।

হযরত হূদ (আ)-এর সন্তান-সন্তুতি

হযরত হূদ (আ)-এর দুই পুত্রের নাম উল্লেখ করা হইয়াছে। একজনের নাম পেলগ (Peleg) এবং অপরজনের নাম 31, (যাকতান; Joktan)। যাকতানকে আরবরা কাহতান বলে। বনী কাহতান তাঁহারই বংশধর (আম্বিয়ায়ে কুরআন, ১খ., পৃ. ১৩৬; দ্র. বাইবেল, আদিপুস্তক, ১১ ১৪, পৃ. ১৩)।

গ্রন্থপঞ্জী : (১) আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, মিসর; (২) ইমাম আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, বৈরূত, লেবানন; (৩) মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী, তাফসীর মাআরেফুল কুরআন (বাংলা অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহীউদ্দীন খান); (৪) ইমাম আবুল ফিদা ইসমাঈল ইব্‌ন কাছীর, তাফসীর ইব্‌ন কাছীর, ২খ., বৈরূত, লেবানন ১৯৮৬ খৃ.; (৫) ইমাম কুরতুবী, আল-জামি লি-আহকামিল কুরআন (তাফসীর কুরতুবী), ৫., বৈরূত, লেবানন ১৯৯৩ খৃ; (৬) ইবন কাছীর আল্-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, তা, বি., দাৰু ইয়া আত্-তুরাছ আল-আরাবী; (৭) আল-কুরআনুল কারীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত; (৮) আবু তাহির মুহাম্মাদ মুছলেহ উদ্দীন, আরবী সাহিত্যের ইতিহাস (হিজরী ১৩২ /৭৫০ খৃ. পর্যন্ত), ইসালিমক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৮২ খৃ.; (৯) মুহাম্মাদ রশীদ রিদা, তাফসীরুল মানার, খ, ৮, ২য় সংস্করণ দারুল মারিফা, বৈরূত, লেবানন; (১০) হিফজুর রহমান সিওহারবী, কাসাসুল কুরআন, দিল্লী ১৯৭৮ খৃ.।

সিরাজ উদ্দিন আহমদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *