স্বৈরিণী

স্বৈরিণী

থলে দুটো দাও, বাজার যাব।

একটু কুচো চিংড়ি এনো আর পেঁয়াজকলি। কলি কিন্তু, শাক নয়। সাদা পাঁপড় দেখো তো!

লিস্ট করো, লিস্ট করো, ফরমাশগুলো এলোমেলো ছুড়ে মারলে হবে না।

লিস্ট করার কি আমার সময় আছে এখন? জিনিসগুলো তো রিলেটেড। মনে রাখতে অসুবিধে কি?

তক্কো করো না, তক্কো ভালো লাগে না সাতসকালে, মেয়েমানুষ মানেই তক্কো।

কথা শুনলে মনে হয় কথা কইছে কোনো উপমন্যু নয়, নির্জলা এক উপীন। উপেন্দ্রনাথ, দেবশর্মা-টর্মা, এক্ষুনি শরৎচন্দ্রের চরিত্রদের গলায় বলে উঠবে, তোমার ছোঁয়া খাবার খেতে আজ আমার ঘৃণা বোধ হচ্ছে।

শরৎচন্দ্রের ডায়লগ মনে করতে রিনার হাসিই পেয়ে গেল। ডাল ধুতে ধুতে সে ফিক করে হেসে ফেলল। শরৎচন্দ্র পড়তে দেখলেই মা রাগ করত। বলত, অন্য কিচ্ছু না, গুছিয়ে ঝগড়া করতে শিখবি, আমার ওপরেই শিক্ষাটা ফলাবি সবার আগে, দাদা বলত, শুধু ঝগড়া নয়, প্রেমালাপ করতেও শিখবে মা, বেশ গুছিয়ে প্রেমালাপ, দেবদা, নদীতে কত জল। অত জলেও কি আমার কলঙ্ক চাপা পড়বে না?

তোরই তো কণ্ঠস্থ মুখস্থ দেখছি। রিনা ঠাট্টা করত।

কিন্তু না, শরৎচন্দ্রের প্রেমালাপ রসালাপ নয়, উপীন প্রমুখদের বুড়োটে সেকেলেমিতেই উপমন্যু সবাইকে টেক্কা দেবে মনে হয়। আর কী নীরস! কী নীরস! টাকা-আনা-পাই কিলোমিটার-লিটার ছাড়া কিছু বোঝে না কিছু না।

ধরো, বন্ধুর বিয়েতে ভালো করে সাজল রিনা। একটা নতুন তাঞ্চোই শাড়ি, গয়না, প্রসাধন, আয়নায় নিজেকে দেখতেও দারুণ লাগল।

কেমন লাগছে গো?—উপমন্যুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লজ্জা লজ্জা মুখ করে অতঃপর জিজ্ঞাসা।

উত্তর হল, ন্যাকামি রাখো। তাড়াতাড়ি নাও।

ন্যাকামি, ঢং এই কথাগুলো যেন শুধু রিনাকে নয়, রিনার আত্মাকেও অপমান করে। ভেতরটা কুঁকড়ে যায়। মনে হয়, সে নিজেকে যা ভাবছে তা সে নয়, সে যত দূর সম্ভব অকিঞ্চিৎকর, তুচ্ছ। আর উপমনুও তার জানাবোঝা মানুষ নয়। সে অন্য। একেবারে অন্য। ভয়-ভয় চোখে সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে। ওই তো খাটের ওপর জয়পুরি বেডকভার বিছানো। ভেবেছিল ওটা তারই, তাদেরই খাট কিন্তু তা বোধহয় নয়। ও আর কারও খাট, ওখানে অন্য কেউ শোয়, ওই আলমারি, বইয়ের যাক, পড়ার টেবিল, খাটের পাশে লম্বা এক ফালি কার্পেট চিনে লণ্ঠনের মতো ওই আলোর শেডটা অনেক শখ করে যেটা লাগিয়েছিল, মেমসাহেব-নাচা ঘড়ি যেটা তার রাঙাকাকু বেলজিয়াম থেকে এনে দিয়েছিলেন—এ সমস্তই চূড়ান্ত ন্যাকামি অর্থাৎ ভান, অর্থাৎ মিথ্যা।

কানে ন্যাকামি শব্দটার অপমান প্রত্যাখ্যান নিয়ে রিনা বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। রান্নাঘরের দিকে চোখ পড়ে। স্টিলের কয়েকটা বাসন দেখা যাচ্ছে। ঝকঝক করছে। ক্রিসমাস কার্ডের মতো একগুচ্ছ ফুল-আঁকা সাদা উনুনটা, ভীষণ প্রিয় রিনার। খুব যত্ন করে ব্যবহার করে। এগুলো? এগুলোও কি ন্যাকামি? ওই রান্নাঘরের তাক গোছানো, পেতল পালিশ করা, সোডা সাবান দিয়ে রান্নাঘরের মেঝে পরিষ্কার করা ঘষে ঘষে…? না, সম্ভবত এগুলো ন্যাকামি নয়। খুব কেজো গেছের ব্যাপার এসব। কাজ করো, খাও দাও ঘুমোও, কাগজ পড়ো। দু-চার খানা বই পড়ো, আর হ্যাঁ রাত্তিরবেলা ডাক পড়লে সাড়া দিয়ে। নিভাঁজ, নির্ভেজাল প্রকৃতির ডাক কিন্তু।

কেন? কেন এমন হল? বাচ্চারা এল না বলে? কিন্তু সে-ও তো তার অপরাধ নয়। ডাক্তারদিদি বলেই দিলেন, কোনো অসুবিধে নেই, কারওই কোনো ডিফেক্ট নেই। স্পার্মগুলো যে কেন কোনো ওভামকে ফার্টিলাইজ করতে পারছে না, তা ভগবানের বাবারও সাধ্য নেই বলার। মিস্টার দত্ত আপনি একটু টেনশন কমান তো! মিসেস দত্ত আপনি যেমন ভালো লাগে তেমন করে দিন কাটাবেন, যেমন খুশি থাকবেন, ধরুন ইচ্ছে হল মাথায় একটা ফুল গুঁজলেন, ইচ্ছে হল একদিন রান্না করলেন না, দোকান থেকে খাবার আনিয়ে চালিয়ে দিলেন। অনেক সময়ে বড্ড গতানুগতিকতার মধ্যে বাঁধা পড়ে যান আপনারা। প্লিজ…লেট ইয়োরসেল্ফ গো। ইট ক্যান মেক আ গ্রেট ডিফারেন্স। তা নয়তো…আমি ডাক্তার হয়েও শনাক্ত করতে পারছি না ভাই আপনাদের স্টেরিলিটির কারণটা।

ডাক্তারদিদি পারেননি, কিন্তু রিনা বোধহয় পারে। ওই যে উপমনুর স্পার্ম? ওরাও তো উপমনুরই মতো? একই ডি এন এ কোড মেনে তৈরি হয়েছে। সেই লক্ষ লক্ষ স্পার্ম রিনার গুটিকয় ডিম্ব বেচারির দিকে বাঁকা হেসে তেড়ে যায়, বলে, ইয়েস একটা বাচ্চার বডি তৈরি করতে রাজি আছি ঠিকই, কিন্তু খবর্দার নো ন্যাকামি। তার ভেতরে ওভামদের কুঁকড়ে যাওয়াটা আজকাল টের পেতে শুরু করেছে রিনা। তাই কেন তার ঘর শূন্য এ নিয়ে রিনার মনে খেদ থাকলেও কোনো প্রশ্ন নেই।

রুটিনমাফিক খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফুস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে সোফায় একটু কাত হল উপমুন্য। এটা ওর উত্তর-চল্লিশ সাবধানতা। ডাক্তারের পরামর্শ। অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সিগারেট আর মদ্যও বারণ, সে বারণটা অবশ্য সে শোনে না।

এইবারে চানে ঢুকবে রিনা। চুল খুলতে খুলতে আড়চোখে দেখল উপমুন্য উঠে পড়ছে। যাক এইবার বেরোবে, বেরিয়ে যাবে, আঃ বেরিয়ে যাচ্ছে। মস্ত বড়ো একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রিনা উপমন্যুর পরিত্যক্ত সোফাটায় বসে পড়ল। শুধু চুলের বিনুনইি খুলছে না। যেন সারা শরীরে তার অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গ, প্রত্যঙ্গের সঙ্গে প্রত্যঙ্গ বিমোনো ছিল, স্নায়ুতে স্নায়ুতে জড়িয়ে গিঁট পড়ে গিয়েছিল, সেইসব গিঁট খুলছে সে সযত্নে, জট ছড়াচ্ছে, বিলি কাটছে। কী আরাম! কী অসহ্য মুক্তির আরাম! অনাবশ্যক একটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রিনা। চুলের ভেতর দিয়ে চিরুনি চালাতে চালাতে আরামে চোখ বুজে আসে। কিন্তু সেই কুঁড়েমিকে এক ভ্রূকুটিতে তাড়িয়ে সে বাথরুমে ঢুকে যায়। লাল বালতিটাকে কলের তলায় বসায়। তারপর ম্যাচিং লাল মগটা গবগব করে ডুবিয়ে এনতার জল ঢেলে যায় গায়ে। সাবান লাগাতে লাগাতে যতক্ষণ না সাদা ফেনায় গোটা শরীর ভরে যায় ততক্ষণ সাবানটা ছাড়ে না। চন্দনের গন্ধে বাথরুমটা ভরে যায়। নিজের ঈষৎ নত বুক তুলে ধরে সাবান দিয়ে ধোয়ার নামে অনেকক্ষণ আদর করতে থাকে সে। অঞ্জলিটা ঝটপট মুঠো করে পদ্মকলির মতো আকার করে দেখে, নাঃ বেশ সুললিত সাবলীল আছে মুঠো, গিঁটপড়া শক্ত আড়ষ্ট হয়ে যায়নি। এখনও।

তেমন গরম এখনও পড়েনি, তাই চুলটাও তেমন করে ভেজায়নি সে। সরু একটা সিঁদুরের রেখা আর একটা কুমকুমের টিপ পড়লেই মুখখানা বেশ হেসে ওঠে। সামান্য একটু ক্রিম ঘষে নেয়। পাটভাঙা একটা হালকা কমলা রঙের ছাপা শাড়ি পরতে পরতে নিজেকে ভীষণ ভালো লাগতে থাকে তার। মনে হয় আদর করুক, কেউ তাকে একটু আদর সোহাগ করুক। নিজেই নিজের মুখটাকে চুমো খাবার জন্য অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ ফিরে বৃথা চেষ্টা করে সে। তারপর একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে এক কাপ দুধ খায় চকলেট দিয়ে। ঠান্ডা ঠান্ডা। ঢালা উপুড় করে করে ফেনা ওঠানো। গান চালিয়ে দিতে হবে এখন তাকে। মাস্ট। অখিলবন্ধু ঘোষের ক্যাসেটটা বাছে সে, তারপর একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে সোফাটায় পিঠ এলিয়ে বসে। নীচু একটা বেতের মোড়া টেনে আনে সামনে, পা দুটো তুলে দেয় তার ওপর। তারপর বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। এখন গানের দিকেই তার মন পুরোটা চলে যাবে, না গল্পের বিবরণে মন হারাবে সেটা নির্ভর করছে সম্পূর্ণ গায়ক আর লেখকের আপেক্ষিক কেরামতির ওপর। তবে সত্যি কথা বলতে কি, সুরও নয়, সাহিত্যও নয়, আসলে তার মন ডুবে যায় একটা মনোরম অনুভূতির সাগরে। সুর তাল আর সাহিত্যরস দিয়ে তৈরি তার জলরাশি। কী পড়ল, কী শুনল সেগুলো তার মনে থাকে আবছাভাবে, শুধু হৃদয়ের ভেতরটা কূলে কূলে ভরে যায়।

হৃদয়ের এইরকম টইটম্বুর অবস্থাতেই দরজার ঘন্টাটা সেদিন পাখির গলায় ডেকে উঠল, কুব কুব কুব কুব, কুব কুব কুব কুব। ম্যাজিক আইতে চোখ রেখে কাউকে দেখতে পেল না রিনা। অগত্যা ছিটকিনি খুলে একটু ফাঁক করতেই হল দরজাটা। প্রথমেই একটা সাদা ঝলক। বাইরের সকাল দশটার প্রখর আলো আর সাদা শার্ট, সাদা প্যান্টের সুহৃৎ ঝলক।

তুমি? তুমি এখানে? তুমি হঠাৎ? আশ্চর্য হয়ে, আনন্দের তুঙ্গে উঠে গিয়ে রিনা কোনোমতে বলল।

কোনো কথা না বলে, প্রাণখোলা হাসিতে মুখ ভাসিয়ে ও ভেতরে ঢুকে এল। হাতের ব্রিফকেসটা দেখিয়ে বলল, ভালো বিজনেস হয়েছে আজ। এখন আমি একটু বিশ্রাম এবং এক কাপ ভালো দেখে ধোঁয়া-ওঠা চা অর্জন করেছি। তোমার হাতের।

কী আশ্চর্য, বসো না, বসো আগে আহ্লাদে কিশোরীর মতো শরীর মুচড়ে রিনা বলল।

ও বসে আছে। আধা-অন্ধকার বসার ঘরটায় আলো জ্বলছে বলে মনে হয়। ওর হাত-পা নাড়াচাড়ার মধ্যে একটা হালকা অ্যাথলেটিক ভাব আছে। যে কোনো মুহূর্তে উঠে দাঁড়াবে। সরে এক সোফা থেকে আর এক সোফায় যাবে, কি এক লাফে পৌঁছে যাবে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। এই লঘুতা ও পেয়েছে যোগ থেকে। যোগ করত রোজ।

এখনও চালিয়ে যাচ্ছ?—গ্যাসে চায়ের জল বসিয়ে দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল রিনা।

কী?

যোগ।

বাঃ, ওটা তো আমার প্রকৃতির দ্বিতীয় অংশই হয়ে গেছে। সেকেন্ড নেচার। চালাব না! যোগ বাদ দিয়ে আমার দিন শুরুই হয় না।

খবরের কাগজের পাতা উলটোচ্ছে। খড়মড় খড়মড় শব্দ হচ্ছে একটা। ওর ছোঁয়াচেই যেন রিনার পদক্ষেপেও কেমন একটা হালকা ভাব এসে যায়। ভেতর থেকে কী একটা ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে উঠছে। তার মনে হয় না ন-বছর বিয়ে হয়ে গেছে। আগের চেয়ে ভারী আর আলগা হয়েছে শরীর। শাড়িটা অগোছালো। ভুলে যায়, সে পুরো মানুষটাই, যত চেষ্টাই করুক, আগের মতো লাবণ্যময় হতে পারে না কিছুতেই।

ধোঁয়া-ওঠা দু কাপ চা একটা সাদা ট্রেতে।

এই দ্যাখো কেমন তোমার সঙ্গে ম্যাচ করা ট্রে, ম্যাচ করা কাপগুলো…

আরে, তাই তো ক খুশি ছড়িয়ে যায় ওর সর্বাঙ্গে। বলে, আসল কথাটা বলছ কেন? একদম আসল কথাটা?

কী!

তুমি নিজেই যে আমার সঙ্গে ম্যাচ করা। তাই বাকিগুলো আপনিই ম্যাচ হয়ে যায়।

ধুত। দেয়ালে টাঙানো গোল আয়নার দিকে তাকাবার চেষ্টা করল রিনা। দেখতে পেল না। কিন্তু আয়নার দিকে তাকাবার দরকার কী? নিজের বোধ দিয়েই তো নিজেকে চিনে নেওয়া যায়। ভাঙাচোরা থ্যাঁতলানো ধামসানো দাবড়ানো এই রিনা কি ওর সঙ্গে মানানসই হতে পারে?

হঠাৎ কয়েকটা লাল গোলাপ ঝলসে ওঠে ওর হাতে।

দ্যাখো তো এগুলো ম্যাচ করে কি না!

গোলাপের আরক্ত সংরাগ ওর হাত থেকে তার হাতে, ক্রমে তার সর্বাঙ্গে চারিয়ে যাচ্ছে বুঝে রিনা কাছে, ওর আরও—আরও কাছে চলে যেতে থাকে। ঘন, আরও ঘন হয়ে যায় দুজনে।

ধরা গলায় রিনা বলে, ছাড়ো, এবার ছাড়ো৷

মনে আছে সেই সব দিন? রিনঠিন রিনরিন দিন? যখন কলেজের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে তুমি আর ডাক্তারদের চেম্বার পালিয়ে আমি…মনে আছে সেই রোদের গন্ধ, বাতাসের রং, ভিক্টোরিয়ার পুকুরের সেই যমুনা-যমুনা জল?

রিনা মন্ত্রমুগ্ধর মতো বলল, মনে আছে সেই অনন্ত চিনেবাদাম, আইসক্রিমের সেই ক্ষণ-মধুর, উট্রামের গোলঘরের সেই মহাকাশ? মনে আছে?

আর ঘাসের তবকে মোড়া মাঠের উষ্ণতা, মেঘের তবকে মোটা দুপুরের দুপুরালি! হিমের তবকে মোড়া…

রিনা দেখল, ওর চোখ চকচক করেছ। ওরা পুরুষ, কখনও কাঁদে না, ওদের। নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু সে তো মেয়ে, নেহাতই মেয়ে, তাই তার চোখ উপচোচ্ছে। উপচোতে দিল সে। আর তখনই এল সেই চুমো যা সকাল থেকে সে নিজেকে নিজে দিতে চাইছিল, ব্যর্থ হচ্ছিল বারবার। জলের ফোঁটাগুলো গাল বেয়ে নেমে এসে ঠিক যেখান থেকে গালের কিনার বেয়ে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই কিনারে, এ কিনার থেকে ও কিনারে চোখের পাতায়, কানের লতিতে, তারপর? তারপর ঠোঁটের কূল থেকে মুখের গভীরে ক্রমশ প্রবিষ্ট হয়ে যেতে থাকে…ক্রমশই।

শেষ বিকেলে সমস্ত প্রকৃতি আবির মাখে। ছাতে না উঠলে প্রকৃতি দেখা যায় না এখানে। কিন্তু কেমন করে যেন তার নজরে একটা টেলিস্কোপ, পেরিস্কোপ জাতীয় কিছু এসে যায়। সে দেখতে পায়। ওপরে এবং নীচে সব। গোটা পরিপার্শ্বই যদি হোলির রঙ্গভূমি হয়ে যায় তো না দেখে উপায়?

আসলে প্রেমই আমাদের দিয়ে যায় অন্য ধরনের সুস্বাস্থ্য, যাতে করে শরীরটা থাকে সতর্ক, সব সময়ে চনমনে, প্রেম আরও দেয় এক অদ্ভুত অভিনিবেশ। গোটা পৃথিবীর অন্তর্নিহিত খেলাটা পরিষ্কার বোঝা যায় যেন। হঠাৎ যেন একটা শক্ত পাটিগণিতের অঙ্ক সোজা হয়ে গেল। বেশ হেসে হেসে ভালোবেসে বেসে সেইসব প্রতিদিনের কর্তব্যকাজগুলো করতে থাকে রিনা যেগুলো ভূতুড়ে রকমের বিশ্রী লাগত আগে। যেমন বালিশের ওয়াড় পরানো, মশলাপাতির কৌটো পরিষ্কার করা, ন্যাতা ফুটিয়ে কাপ, অ্যাশট্রে পরিষ্কার করা…এবং এবং এবং।

হঠাৎ টিপ পরেছ যে? বাঁকা চোখে উপীন।

হঠাৎ এ সময়ে এত সাজ? ভুরু কুঁচকে উপীন।

আশ্চর্য! টিপ না পরাটা কোনোদিন চোখে পড়েনি। পরাটাই চোখ পড়ল। টিপ? কপালে হাত চলে যায়। তাই তো! টিপই তো! কালচে ম্যাজেন্টা রঙের একটা টিপ! ঠিক আছে, টিপ লাগিয়েছি। কিন্তু সাজ? সাজ কই? সেই একই কলকা ছাপের সুতির শাড়ি। সেই একই ব্লাউজও সামান্য একটু মাড় পড়েছে কী? ইস্ত্রি চলেছে।? হবেও বা। অন্য মনেই এসব করে গেছে রিনা। তবে এগুলো কিছু না। আসলে ভালোলাগার রং লেগেছে গায়ে হোলির সন্ধেবেলার আবিরের মতো। খুশির প্রসাধনীতে মুখ-হাতের চামড়া মসৃণ হয়ে উঠেছে। ওসব শাড়ি-টাড়ি টিপ-ফিপ কিছু নয়।

কেউ কি এসেছিল?—কেমন একটা সন্দেহের ছোঁয়া উপীনের গলায়।

কে এসেছিল আজ?—ক্রমশ আরও জোরালো আরও নিশ্চিত হতে থাকে প্রশ্ন।

কে আবার আসবে?

না। তাই জিজ্ঞেস করছি। ঠিক যেন মনে হল আমি ঢুকবার দু-মিনিট আগেও কেউ ছিল। কেউ এসেছিল।

অনেক কথা বলে ফেলেছে। চটপট সে মোজা ছাড়ায় পা থেকে। জুতোর মধ্যে ঢোকায় মোজাগুলো, বাড়ির চটিতে সন্তর্পণে পা গলায়, তারপর কুকুরের মতো হাওয়ায় নাক ঢুকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে শোবার ঘরে চলে যায়।

চা করতে করতে হেসে ফেলে রিনা। টের পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু যার জন্য নাক ফোঁস ফোঁস করা সেই কাটালিচাঁপা যে তার বুকের খাঁজে, কেমন করে তার সন্ধান পাবে ভদ্রলোক?

এসেছিল, সত্যিই তো এসেছিল। উপমন্যুর অনুপস্থিতির সময়টাই ওর প্রেজেন্ট প্লিজ করবার সময়। তবে, কবে, কখন, ঠিক কোন মুহূর্তে ও আসবে সেটা বলা থাকে না, জানা যায় না। সত্যি কথাই, ও-ও তো ইচ্ছেমতো আসতে পারে না, কাজের মাঝে সময় করে ওকে আসতে হয়। কবে সে সময় পাবে সে কথা কি ও ই জানে?

হয়তো কোনোদিন একটা শিরশিরে মতো হাওয়া বইল। চৈত্রের শেষের দিকে কী শরতের গোড়ায় যে রকম একটা মন-কেমন-করা হাওয়া দেয়। রিনরিন, রিনঠিন দিন। হয়তো সারা সকাল ধরে নিজেকে প্রস্তুত করল রিনা। প্রস্তুত মানে কী? সাজগোজ? দূর! ঘরদুয়ার গুছোনো, লেপা-পোঁছা? ধুর! ভালো-ভালো টি. ভি-তে শেখানো খাবারদাবার করা? ধুত্তোর! ওসব কিছুই লাগে না। চোখের কাজল ও দেখে না, দেখে চোখের ভেতর, বাড়ির সাজসজ্জার মধ্যেও কিছুই দেখে না, দেখে যেটা তার নাম ছটা। প্রভা, দ্যুতি। রিনার। রিনা নামক মানুষীর বিশেষ রিনাত্বের যে ছটা তার মধ্যে থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই, সেটাই ওর অনুভব করে আনন্দিত অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠার অবলম্বন। আর কিছু লাগে না। আর খাবারদাবার? পাছে রিনার কষ্ট হয় অসময়ে খাবার খুঁজতে তাই ও পেট ভরিয়ে আসে, আর তেমন ভালো-ভালো জিনিস খেলে নিয়ে আসে রিনার জন্যে।

ছি ছি ছি, এমন এক গোছা অর্কিডের পাশে তুমি তেলেভাজা নিয়ে এলে?

আ রে! তেলেভাজা বলে কি ফেলনা? কাচের কেসের মধ্যে রাখে আজ্ঞে। কড়া থেকে ঝুড়িতে পড়তে পায় না, এমন কাটতি।

তা হলে শো-কেসে কোনগুলো যায় শুনি?

শো-কেসেরগুলো বিককিরির না, ওগুলো বিজ্ঞাপন, তা তুমি যদি বলো তো ফিরিয়ে নিয়ে যাই। বেগনি অর্কিডের ফুল দেখেই তোমার খিদে মিটুক।

ইসস ঠোঙাটা দেখি একবার, গরম আছে কি না।

তেলেভাজার সঙ্গে চা-টাই জমে। কিন্তু তৈরি করতে একটু দেরি লাগবে, একটু হাঙ্গামা বলে-কফির জেদই ধরবে ও। এমন করবে যেন কফির জন্যে প্রাণটা কাতরাচ্ছে ওর। কফি ছাড়া অন্য কোনো পানীয় যেন ওর চলে না।

তুলনা করছে না রিনা, কিন্তু উপমন্যু? উপমন্যুকে কিছু তৈরি করে দিতেও ভেতরটা ভয়ে ঢিপঢিপ করে, কিংবা বিরক্তিতে গা-টা কিসকিস করতে থাকে।

চা-টা কে করেছে?

আমি, কেন?

চিনি নেই।

রুটিটা কে সেঁকেছে?

আমি। আবার কে?

চামড়া।

আলুর দমটা কে বেঁধেছে?

কেন?

নুন বেশি। আলু আর একটু সেদ্ধ হত।

কোনো হোটেলে ফুড-টেস্টারের চাকরি নিক না তার চেয়ে। প্রতিটি খুঁটিনাটিতে এত খুঁত ধরবার বাতিক যদি! এতই কি খারাপ রান্না করে রিনা? ধরে বেঁধে কোনোদিন রান্না শেখেনি হয়তো। কিন্তু দেখে দেখে শুনে শুনে শেখাও তো শেখা! ভয়ের চোটে না চেখে রান্না নামাতেই পারে না রিনা। চেখে মনে হয় এই রে নুনটা একটু বেশি হয়ে গেছে, ঝপ করে একটু চিনি দিয়ে দেয়, আবার চাখে, এই রে মিষ্টি একটু বেশি হয়ে গেল, দে একটু জল ঢেলে, যা পাতলা হয়ে গেল ঝোলটা, শেষে একটু ময়দাগোলা, একটু ঘি, একটু গরমমশলা দিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যে জিনিসটা নামায় সেটাকে যদি উপীন যাচ্ছেতাই একটা নামে ডাকে, তাকে দোষ দেওয়াও যায় না। ভয়, আসল কথা, স্নায়বিক ভয় একটা কাজ করে তার কাজকর্মের পেছনে। অথচ ভয় পাওয়ার তো কথা নয়, টানা তিন বছর পরিচয়ের পরেই তো বিয়ে হয়েছে তাদের। তখন তো মনে হয়নি এমনি ভয় হবে। তা ছাড়া এমনি এমনি যখন সে নিজের ভালো লাগায় শখে কিছু রান্না করে, ছোলার ঘুগনি, কি বাঁধাকপির কোফতা, দিব্যি তো হয় জিনিসগুলো।

তুমি করেছ? দারুণ! ও তো বলে।

আমি করেছি বলেই দারুণ নাকি?

আরে আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি করেছ।

আমার বাড়িতে আমি করব না তো কি বড়ো হোটেলের শেফ এসে করে যাবে?

তা কেন? ওই সব হারুর মা নাড়র মা থাকে না? ভাবলাম হয়তো তেমনই কেউ… তা সে যে-ই করুক, ফ্যান্টাস্টিক হয়েছে। আর একটা দেখি।

আর একটা আর একটা করতে করতে দুজনে মিলে সব সাবাড়। ফুড টেস্টার মশাইকে দিয়ে আর যাচিয়ে নেওয়া হয় না জিনিসটা সত্যি সত্যি উতরোলো কি না।

পয়লা এপ্রিল যে রিনার জন্মদিন সেটা ও ছাড়া পৃথিবীর আর সবাই ভুলে মেরে দিয়েছে। সেই কবে মা জন্মদিনে ঠাকুরবাড়ি পুজো পাঠাত আর পায়েস রাঁধত। একবার সাত-আটজন বন্ধুকে শখ করে নেমতন্ন করেছিল সে, মাকে কত সাধাসাধি করে। ভালো ভালো রান্না হল, দোকান থেকে কেক-টেকও এল, আইসক্রিম পিঙ্ক নতুন ফ্রক পরে রিনাও রেডি। হায় রাম। একটা বন্ধুও এল না। মা তো রেগে লাল। ভালো করে বলতে পারিসনি, আমাকে নাহক এত খাটালি, এত্ত খাবারদাবার, কী হবে এখন? তার যে অপমানে অনাদরে চোখ ফেটে জল এসে গেছে সে খোয়াল মায়ের নেই। পরদিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করতে গিয়ে আর এক ফ্যাসাদ।—সে কি রে? আমরা ভেবেছিলাম এপ্রিলফুল করছিস। সত্যি-সত্যি তোর জন্মদিন পয়লা এপ্রিল। সত্যি-সত্যি নেমতন্ন করেছিলি? এ মা! ভাগ্যিস।

ভাগ্যিস কেন? না আটজনে মিলে ঠিক করেছিল একটা টুপি পাঠাবে। ফুলস ক্যাপ আর কি। তা শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে ওঠেনি। এমন বিদঘুঁটে জন্মদিন কে মনে রাখে!

কিন্তু একজন, সেই একজন ঠিক সেই মভ রঙের চমৎকার সিল্কের শাড়ি নিয়ে এসেছে! জন্মদিন তো তবু একরকম। বিবাহবার্ষিকীতেও মনে করে এক গোছা লম্বা লম্বা ফুল, আর সেই চমক্কার জয়পুরি মিনের গয়না নিয়ে এসেছে। ঠিক ওই গয়না, ওই শাড়িই রিনার সাংঘাতিক পছন্দ ছিল। উপমন্যুর এক বন্ধুর বিয়েতে উপহার কিনতে গিয়ে দেখেছিল। এক এক সময়ে এমন হয় না, যে মনে হয় ওই জিনিসটা না পেলে মরে যাব, জীবন বিস্বাদ হয়ে যাবে? এ সেই রকম চাওয়া। কিন্তু মুখ ফুটে উপমন্যুকে বলতে ইচ্ছে হয়নি। ওর টাকা ওর রোজগার ওর হিসেব। আর ওর খেয়াল—ও-ই বুঝুক।

উপমন্যুকে বলা হয়নি, কিন্তু ওকে কি বলা হয়েছিল? রিনার মনে নেই। কত কথাই তো গলগল করে বলা যায়। হিসেব থাকে কি? কিন্তু বিবাহবার্ষিকীর উপহার নিয়ে রিনা খুবই রাগারাগি করেছিল। এমন করছ যেন বিয়েটা তোমার সঙ্গেই হয়েছে–মুখটা বেচারির একটু ম্লান হয়ে গেল, কিন্তু হারবার পাত্র তো নয়, অমনি ঝলমল করে বলে উঠল, আমার না হোক তোমার তো বটে! আর বিয়ে একটা আনন্দের, একটু বেশ শুভ ব্যাপার! উপহার দিতে ইচ্ছে হল, চোখ চকচক, ঠোঁট তুলতুল দেখতে ইচ্ছে হল।

বলল আর রিনা অমনি গলে জল হয়ে গেল।

হারুর মা, কেউ কি এসেছিল, আজ দুপুরে?—উপমুন্যর ভাবটা যেন এই হঠাৎ কথাটা মনে হয়েছে তাই এমনিই জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু ভেতরটা তার উৎকর্ণ উদগ্রীব হয়ে আছে।

হারুর মা-ও তেমন, হেঁকে বলল অ বউদি দুপুরে কেউ এয়েছিল নাকি? বাবুর দিকে ফিরে বলল, আমার তো পেটে ভাত পড়লেই ঘুম ধরে গো বাবু।

আচ্ছা, আচ্ছা, হয়েছে- বিরক্ত গলায় বাবু বলেন।

অবশেষে নিজেরই এক বন্ধুকে কাকুতি-মিনতি করে উপমন্যু। কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেলে। খুব ছোটো লাগে নিজেকে। কিন্তু কি করা যাবে, এ যে প্রাণের দায়।

বারীন, প্লিজ, তোর কলেজে সকাল সকাল ছুটিও তো হয়, একটু আমার বাড়িটা ঘুরে যাস।

সে আবার কী? দুপুরবেলা তুই কোথায়?

আমি না-ই থাকলাম, ও তো থাকে?

ও কে? তোর স্ত্রী? রিনা?

হ্যাঁ।

তা আমি হঠাৎ তোর অনুপস্থিতিতে তোর শ্রীমতীর কাছে যেতে যাব কেন? আচ্ছা পাগল তো!

না, মানে এই, অনেকক্ষণ একা থাকে তো! বুঝতেই পারছিস একেবারে যুবতি মেয়ে…একলা।

পাহারা দিতে পাঠাচ্ছিস?

বলতে পারিস।

ব্যাপারটা ঠিক কী বল তো?

না মানে, ওকে আজকাল কেমন কেমন লাগে, যেন মনে হয় ওর লাইফে অন্য কেউ, মানে অন্য কারও প্রবেশ ঘটেছে।

তাই বলো। টিকটিকি লাগাচ্ছ আমাকে। তারপরে আমাকেই সন্দেহ শুরু করবে। মাফ করতে হল ভাই, এসব গোলমেলে ব্যাপারে আমি নেই। তা ছাড়া, রিনাই বা কী মনে করবে তোর অ্যাবসেন্সে গেলে?

কথাটা সত্যি।

তবু বন্ধুর পীড়াপীড়িতে রাজি হয়ে যায় বারীন।

ভর দুপুরবেলা রিনায় বেল বেজে ওঠে কুব-কুব-কুব-কুব। খুলে আরে আপনি? কী ব্যাপার?—আলুথালু রিনা বলে ওঠে।

আর বলবেন না, সাংঘাতিক জ্যাম। এক ঘন্টা বাসে বসে বসে তিতিবিরক্ত হয়ে ঘেমে-নেয়ে নেমে পড়লাম, কোথায় একটু কাটিয়ে যাই ভাবতে ভাবতে উপমন্যুর কথা মনে পড়ল। প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে কিন্তু। এক গ্লাস ঠান্ডা জল খাওয়াবেন?

কী আশ্চর্য বসুন বসুন।-পাখা চালিয়ে দেয় রিনা।

ঠান্ডা জল আনে, চা করবে কি না জিজ্ঞেস করে, মিষ্টান্ন বার করে। তারপর বারীনের আপত্তিতে আবার ঢুকিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর বারীনও কথা খুঁজে পায় না, রিনাও না। বারীন বলে, দেখি, জ্যামটা ছাড়ল কি না।

না রে উপমন্যু, ঠিক দুম্বুরবেলা গেলাম, এক্কেবারে দি টাইম ফর দি অ্যারাইভ্যাল অফ পরকীয়, তো পৌনে দু ঘন্টা ছিলাম, কেউ এল না তো, তোর বউকে দেখেও মনে হল না কারও প্রতীক্ষা করছে। খুব সভ্য, ভদ্র বউ তোর, যাই বলিস।

বন্ধুর প্রশংসায় খুশিও হয় উপমুনু, আবার কোথায় যেন একটু আহতও হয়। বলে, এ উপকারটা কর প্লিজ, একটু লেগে থাক।

আর একবার গেলে কিন্তু ও আমার সম্পর্কে খুব খারাপ কিছু ভাববে।

রিনা কিন্তু কিছুই ভাবল না। কারণ বারীনের বেচারি-বেচারি অপ্রস্তুত-অপ্রস্তুত বিরস মুখখানা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে উপবোধে চেঁকি গিলছে। খুবই অস্বস্তিতে আছে।

আজকেও জ্যাম তো?—রিনা হাসিমুখে বলল, অর্থাৎ ছুতোটা ও-ই জুগিয়ে দিল।

অসুবিধেয় পড়লে চলে আসবেন বইকি ক–জল এল, শরবত এল। বিকেল গড়াতে চা এল, সঙ্গে ডালমুট, রসগোল্লা, সয়াবিনের ঘুগনি…

তৃতীয় দিন জল শরবত এসব সরবরাহ করে রিনা বলল, আপনার জন্যে কতকগুলো পত্রিকা এনেছি, যদি আমি ভেতরে একটু বিশ্রাম করি গিয়ে, কিছু মনে করবেন?—সে হাতের পাতা দিয়ে একটা হাই আড়াল করল।

চতুর্থ দিন হাজার কাকুতি-মিনতি করেও উপমনু বারীনকে আর পাঠাতে পারল। তবু তো সন্ধেবেলার বাড়ি ফিরে বারীন বিষয়ে রিনার মন্তব্যগুলি শোনায়নি। আজ দুপুরে হঠাৎ তোমার বন্ধু বারীনবাবু এসেছিলেন। নাকি ট্রাফিক জ্যামে আটকে হাঁফ ধরছিল।

একটু চুপ। তারপরে, তাই ভদ্রলোক আমাদের বসার ঘরটা জ্যাম করে দিয়ে গেলেন। হাঁফও ধরালেন ফাউ হিসেবে।

কেন? তোমার কি কেউ আসার ছিল? উপমন্যুর ধারালো প্রশ্ন।

আসবার আর কে থাকবে ভুবন ছাড়া? তা ভুবন তো আর বসবার ঘরে বসে, বসে কলতলায়। বাসনের পাঁজা নিয়ে।

আজ না তোমার বারীন-বন্ধু আবার এসেছিলেন। অনেকক্ষণ গল্প হল, জানো? তুমি ওঁর থেকে নাকি অঙ্ক টুকেছিলে স্কুলে পড়তে, এ মা! তুমি টুকলি?

উঃ আবার বারীন, বুঝলে? তোমার বন্ধুর কি আমাকে মনে ধরল না কি বলো তো! নিজে ঘরে বউ আনলেই তো পারেন, পরের বউয়ের কাছে ঘুরঘুর কেন?

ছি, ছি। বারীন আমার ছোট্টবেলার বন্ধু তা জানো?

ছোট্টবেলার বন্ধুরাই বন্ধুদের বউ নিয়ে বেশি হ্যাংলামি করে।

ইস, নিজেকে ভাবো কি?

কী আবার ভাবব, আমি যা তা-ই। স্রেফ একজন পরের বউ!

এ হেন প্রতিক্রিয়ার পর বাল্যবন্ধুকে টিকটিকিগিরি করতে পাঠানোটা ঠিক বন্ধুজনোচিত কাজ বলে মনে হয় না।

তখন উপমন্যু নিজেই হঠাৎ ভীষণ শরীর-খারাপের অজুহাতে দুপুর আড়াইটের সময় বাড়ি ফেরে। দরজা খুলে দেয় হারুর মা, বলে ভালোই হয়েছে বাবু আপনি এসে গেছেন, বউদি ভীষণ বমি করতেছে। খাচ্ছে উগরে দিচ্ছে, যা খাচ্ছে উগরে দিচ্ছে।

সে কী? কখন থেকে?

কখন মানে? কদিন থেকেই এমন করেতেছে। ধুন্ধুমার বমি।

কী খেয়েছিল? ফুচকা-টুচকা? আলু-কাবলি?

কই, আমি তো দেখিনি বাপু। দেখো এখন ঘরে যাও।

রিনার চোখের কোলে গভীর কালি। যেমন শীর্ণ দেখাচ্ছে। বুকের সামনের কাপড় ভিজে টুসটুস করছে।

কী ব্যাপার তুমি?

তোমারই বা কী ব্যাপার?

বিকেল হতে না-হতেই ডাক্তার মিসেস কারনানি। বললেন, ওহ, অ্যাট লং লং লাস্ট, মি. দত্ত আপনার একটা ছোট্ট অণু পরিমাণ স্পার্ম প্রচণ্ড ফাইট করে তার কাজটি করতে সফল হয়েছে। এখন সাবধান। বিয়ের অনেকদিন পরের কনসেপশন তো!

কালিপড়া চোখ, কিন্তু উদ্ভাসিত, যেন রাজ্যজয় করেছে। উপমন্যু আড়ে আড়ে দেখে। তার বুকের ভেতর পাথর। পাথরগুলোকে ডিনামাইট বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু সে পারছে না, কিছুতেই পারছে না।

অবশেষে যথাসময়ে একটি সুস্থ, সবল আট পাউন্ডের পুত্রসন্তান প্রসব করে রিনা। কোনো জটিলতা নেই। খুব সহজ নির্গমন। আজকাল চট করে এমনটা দেখাই যায় না। বিশেষ করে এত পরের জাতক। বাচ্চাটার কান্নাটাও অদ্ভুত! যেন কাঁদছে না। গমক দিয়ে দিয়ে হাসছে।

উপমন্যু যখন শোনে তার পত্নীর প্রসবক্লান্তি কেটে গেছে তখন সে কেবিনে যায়। অস্বস্তিতে নাড়াচাড়া করে উপহারের রজনিগন্ধা। তারপর নীচু হয়ে স্ত্রীর চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রাখে। কঠিন অনন্য স্বরে এতদিনের পুষে রাখা প্রশ্নটি করে, কে বাবা? বাচ্চাটার?

চমকে ওঠে রিনা, কিন্তু পরক্ষণেই সরিয়ে নেয় শিশুটির জাতবস্ত্রের ঘোমটা, আর সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর চোখে লাফিয়ে ওঠে নির্ভুল প্রতিবিম্ব, তার নিজের।

জিজ্ঞাসা-মুছে-যাওয়া বোকা-বনে-যাওয়া সেই মুখের দিকে ক্লান্ত চোখে তাকায় রিনা, ফুঁপিয়ে উঠে বলে, কে আর? এক মিথ্যে-মিথ্যে-মিথ্যে-উপমন্যু– এমন করে বলে যেন একই সঙ্গে তার পুত্রলাভ ও পতিবিয়োগ হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *