সিয়ামিজ বেড়ালের লোম

সিয়ামিজ বেড়ালের লোম

ছোটবেলায় আমরা ছোট্ট এক পাহাড়ী শহরে থাকতাম। মনে করো তার নাম ছিলো র-নগর। সবাই বলে র-নগর ভারি চমৎকার জায়গা। এখান থেকে হিমালয় দেখা যায়। ঝাউ বনে শনশন বাতাস বয়। সুন্দর এক ফটিকজল ঝরনা আছে, যেখানে বেতো শরীরের বুড়োরা ঘন্টার পর ঘন্টা গা ডুবিয়ে বসে থাকে। র-নগরের চা আর কমলালেবুর নাকি বাইরে খুব নামডাক। এসব কথা লোকজন প্রায়ই বলাবলি করে। তবে আমরা কখনও সেসব নামডাক শোনার জন্যে বাইরে যাইনি।

আমরা মানে–আমি, রামু আর বিজু। জন্মের পর থেকে আমরা র-নগরের বাইরে পা রাখি নি। এখন আমরা সেভেন, এইটে পড়ি। আমাদের কাছে র-নগর ভারি বিচ্ছিরি জায়গা। এখানে ছবিঅলা বই পাওয়া যায় না। শিলং-এ রিঙ্কুদের ওখানে চমৎকার : বিলেতি মার্বেল পাওয়া যায়। রিঙ্কু এনেছিলো একবার। আমরা পাকড়াশীদের দোকানে খুঁজে পাই নি। অথচ এই পাকড়াশীদের লাল টালির ছাদঅলা কাঠের দোকানটাই হচ্ছে র-নগরের সবচেয়ে বড় ভ্যারাইটি স্টোর। রিঙ্কু পাকড়াশীদের দোকান দেখে ঠোঁট উল্টে কত কী বলে গেলো। কী লজ্জার কথা বলো তো? তারপর ধরো, সবসময় লাটুও পাওয়া যায় না। বুড়ো পাকড়াশী বলে, লাটু নাকি বাইরে থেকে আনতে হয়। আর কাঠপেন্সিলের যা ছিরি–সে আর কী বলবো! ছোটকাকে যদি এ নিয়ে কিছু বলেছি, অমনি এক ধমক-বাজারে যা আছে তাই তো আনবো! আমার কি পেন্সিলের কারখানা আছে?

এবার তোমরাই বলল, কী করে আমরা র-নগরকে ভালো বলি! বুড়োরা এতো বাজে কথাও বলতে পারে! সন্ধ্যেবেলা অকা সরকারদের পুরোনো দিঘির চাতালে বসে র-নগরের বুড়োরা সবাই গল্প করে–এর মতো ভালো জায়গা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাজা ফলমূল আর তরকারি, চমৎকার স্বাদের মাছ, জুই ফুলের মতো ভাত, পাহাড়ী গরুর ঘন দুধ, এমনি সব বিষয় নিয়ে ওরা কথা বলে। সারাক্ষণ শুধু খাই খাই। বুড়োদের কথাই আলাদা।

আসলে র-নগরটা বলতে গেলে এক রকম বুড়োদেরই আড্ডাখানা। র-নগরে একটা ছবিঘর নেই এ কথা ওরা বলে না। অথচ রিঙ্কুদের ওখানে তিন তিনটে ছবিঘর। দিব্যি ছবি দেখে সবাই। রিঙ্কু বলে, ওদের ছবি নাকি কথা বলে। ছবিকে ওরা বলে টকি। আর আমাদের এখানে যা দেখি, সেসব হল বায়স্কোপ। কথা বলে না, শুধু ঠোঁট নাড়ে; নিচে লেখা ওঠে। তাও দেখি বছরে একবার, সেই পৌষের মেলাতে। বাইরে থেকে তখন সার্কাস, যাত্রা আর পুতুল নাচের দলের সঙ্গে ছবিঅলারা এসে তাঁবু খাটায়। দু আনা টিকিটে চাটাইয়ে বসে ছবি দেখায়। তিন আনা দিলে স্কুল থেকে ভাড়া করে আনা বেঞ্চিতে। আমরা বুঝি আর বেঞ্চিতে বসেছি! বুড়োরাই তো সবার আগে এসে ওখানে হাত-পা ছড়িয়ে কম্বল পেতে বসে থাকে। ছোটদের কেউ সেখানে বসতে গেলে বলে, তোরা আবার এখানে কেন, আমরা বুড়োরা দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইবো।

আমাদের তাতে কোনো দুঃখ নেই। চাটাইয়ে বসে ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় আমরা বুঝি আর এ পৃথিবীতে নেই। সে যে কী উত্তেজনা, বলে শেষ করা যাবে না। মেলার জন্যে আমরা প্রত্যেকে চার আনা করে পেতাম। দু আনায় বায়স্কোপ দেখতাম আর বাকি দু আনা দিয়ে এটা সেটা কিনতাম। সার্কাস দেখা হতো না। একবার বায়স্কোপের বদলে সার্কাস দেখেছিলাম, ভালো লাগে নি। পৌষমেলার বায়স্কোপের দলটাই শুধু আমাদের মাতিয়ে রেখে যায়। তারপর স্কুল ছুটির বাকি একমাস ধরে তারই জের চলে। স্কুল খুললে আবার সেই একঘেয়েমি।

মেতে থাকার মতো আর কিছুই আমাদের জীবনে ঘটে না। বুড়োরা সকাল-সন্ধ্যা জটলা করে। আমরা রোজ কাঁধব্যাগে বই, খাতা, স্কেল, পেন্সিল আর টিফিনের বাক্স নিয়ে স্কুলে যাই। বিকেলের ঠাণ্ডা রোদে লাল সুরকি বিছানো পথ ধরে বাড়ি ফিরি। কোনোদিন রামু বিজু যায় মাছ ধরতে। আমি একখানা পুরোনো রহস্যলহরী কিংবা বিশ্বগোয়েন্দা সিরিজের বই নিয়ে পড়তে বসি।

সন্ধ্যের পর পচার মা যখন ঘরে হারিকেন জ্বালায়, তখন স্কুলের পড়া পড়তে হয়। পাশের ঘরে বসে তিনদিনের বাসী খবরের কাগজ পড়েন বড় জেঠুমণি। তাঁকে শুনিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মুখস্ত কবিতাটা কয়েকবার পড়ে দিদাকে ডেকে বলি, দিদা ভাত দাও।

জেঠু ওঘর থেকে বলেন, এত শিগগির কিসের ভাত? ইংরেজি পড়ো।

এরপর জেঠুকে শুনিয়ে কতক্ষণ বা বা ব্ল্যাকশিপ কিংবা মেরী হ্যাঁজ এ লিটল ল্যাম্ব পড়ি। তারপর আবার দিদা–।

ভাত খেয়ে আর পড়া নয়। সোজা লেপের তলায়। রাতে ভারি শীত! পড়বে না কেন বলো? হিমালয়ের একেবারে কাছেই যে! শীতে তো রীতিমতো ঘাসের ডগায় ভোরের শিশির বরফের কুচো হয়ে জমে থাকতো। পশমী ব্যাপার আর বানরটুপি পরেও ঠক্ ঠক্ করে দাঁতে দাঁতে শব্দ হতো।

র-নগরের বুড়োদের জীবনের মতোই যেন একঘেয়ে ছিল আমাদের দিনগুলো। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতাম। শুধু চাইতাম একটা কিছু হোক। হিমালয়ের চুড়োটা ভেঙে পড়ুক। কিংবা একটা বিরাট ভূমিকম্পে সব ওলটপালট হয়ে যাক। আমরা কজন শুধু প্রলয়ের পরে বইটার নায়কের মতো বেঁচে থাকি আর ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াই। স্কুলে মাস্টারদের চোখ রাঙানি কিংবা বাড়িতে জেঠুর বকুনি কিছুই দেখতে বা শুনতে হবে না। কখনও ভাবতাম, হিমালয়ের ভয়ঙ্কর-এর মতো একটা তুষার মানব নেমে আসুক র-নগরে। এসে সব তোলপাড় করে দিক। কখনও যদি দূরের আকাশে একটা উড়োজাহাজ দেখতাম, তখনই ভাবতাম, আহা! একবার যদি ডানা ভেঙে পড়তো! সে রকম কিছুই হতো না সেই বুড়োটে শহর র-নগরে। তবে একদিন একটা আজগুবি কাণ্ড ঘটলো আমাদের বাড়িতে।

রোজ সকালের মতো দিদা এসেছেন আমাদের বিছানা গোটাতে। হৈ হৈ করে ধমক লাগালেন আমাদের সবাইকে। বিজুর জুলপি টেনে, রামুর গায়ের লেপটা উঠিয়ে, আমার কানে পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছেতাই করতে লাগলেন।

দিদার ওই এক বদ অভ্যাস। বাড়িসুদ্ধ সবাইকে তিনি সাতসকালে ঘুম থেকে তুলে দেবেন। দারুণ বিচ্ছিরি ব্যাপার। মহা বিরক্তি নিয়ে আমরা তিনজন গায়ে র‍্যাপার জড়াচ্ছি, এমন সময় দিদা গলার শব্দটা ফাটা বাঁশের মতো করে বললেন–আঁ, এ কী রে!

কী হলো দিদা–বলে সবাই দিদার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি। দিদার হাতে কালো মতো কী যেন লাল সুতো দিয়ে বাঁধা। আমরা বললাম-ও কী দিদা?

দিদা ভুরু কপাল সব কুঁচকে একাকার করে বললেন–এ যেন কিসের লোম মনে হচ্ছে!

তাই তো! সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখি, চকচকে কয়েক গাছি কালো লোম।

দিদা চোখ দুটো গোল করে বললেন–এগুলো এখানে এলো কী করে? তিনটে বালিশের তলায় তিনগোছা লোম! বল, কে রেখেছিস?

দিদার কথা শুনে সবাই আকাশ থেকে পড়লাম। তিনজন কোরাসে বললাম, কখনো আমরা এসব রাখি নি।

অবাক চোখে তিনজন একে অপরকে দেখলাম। দিদা আমাদের দিকে খানিকক্ষণ পিটপিট করে তাকিয়ে বললেন, তোরা রাখিস নি তো বাসাতে উড়ে এসেছে নাকি রে হতভাগার দল! বল কেন রেখেছিস?

আমি তো প্রায় কাঁদো কাঁদো–তুমি শুধু শুধু বকছো কেন? আমি বললাম কোথায় পাবো?

দিদা একটু নরম হয়ে বললেন-তুই রাখিস নি তো রামু রেখেছে। বলে দে রামু তুই রেখেছিস। এসব যে ভাল কাজ নয় সে তো তোরা জানিস নে।

রামু ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললো–তুমি সবসময় আমকে সন্দ কর দিদা। মিছেমিছি আমাকে মার খাইয়ে যে তুমি মজা পাও, সে যেন আমি আর বুঝি না!

দিদা আরেক দফা চোখ পিটপিট করে আমাদের দেখলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, কলতলায় যা।

কলতলা থেকে ফিরে আরেক দফা জেরা শুরু হলো। এবার জেঠুমণি। জেরার প্রশ্নও অনেক কঠিন। মার খাওয়ার ভয়ে বিজু তো কেঁদেই ফেললো। ওর কান্নার জন্যেই সে যাত্রা রেহাই পাওয়া গেলো।

প্রশ্নটা কিন্তু আমাদেরও। শুধু আমাদের তিনজনেরই বালিশের তলায় তিনগোছা লোম কোত্থেকে এলো? সঙ্গে আবার লাল সুতো বাঁধা? তোমরাই বলো, অযথা বকুনি শোনার জন্যে আমরা কেনই-বা রাখতে যাবো এসব? কুকুরের হোক, বেড়ালের হোক কিংবা ছুঁচোরই হোক–এই লোম রেখে আমাদের কী লাভ?

আসল কথা হলো আমরা কেউ তা রাখি নি।

রামু গোল মুখটা আরও গোল করে বললো, সবই তো বুঝলাম, কিন্তু রাখলোটা কে?

আমি একটু ভেবে বললাম, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে।

তিনজন স্কুলের পথে কাশফুলের উঁটা চিবোতে চিবোতে ভাবলাম, কে রাখতে পারে! স্কুলের বেঞ্চিতে বসে ভাবলাম, বাড়ি ফেরার পথে ভাবলাম, তবু কোনো হদিস পেলাম না।

বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি, সবখানে থমথমে ভাব। সবার মুখ শুকনো। রামু, বিজু রোজকার মতো ছিপ হাতে বাইতে বেরোবে, তখনই দিদা যেন মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এলেন। বললেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

রামু বললো, মাছ ধরতে।

কোথাও যেতে হবে না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকো।

দিদার কথার ওপর বাড়ির কেউ কথা বলতে পারে না। রামু রেগেমেগে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো ভেতরে। বিজুও ওর সাথে মুখ কালো করে ঘরে ঢুকলো। আমার আর রহস্যলহরী সিরিজ পড়তে ভাল লাগলো না। এমনিতেই চারপাশে যা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম, সে আর বলার নয়।

ভেতরের ঘরে দেখি, মা আর জেঠিমা গুজ গুজ করে কী যেন বলছেন। কান পেতে শুনি বড় জেঠিমা বলছেন, আমিও তাই ভাবছিলাম সেজো বৌ। বললে তো তোমরা বিশ্বেস করবে না। আমার বাপের বাড়িতে সেবার নিধু গয়লার জলজ্যান্ত জোয়ান ছেলেটা একদিন বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে মরে গেলো। আমরা তো ভারি অবাক! রোগ নেই, বালাই নেই, বলো কী? শেষে এলো বৈদ্য ওঝা। সব দেখেশুনে বললো, নির্ঘাত কেউ বাণ মেরেছে। সে আর কী বলবো ভাই! ওঝার কথামতো খুঁজতে গিয়ে সবাই দেখলো, নিধুর ছেলের ঘরের জানালার সাথে বাঁধা একগাছি লাল সুতো। ওঝা বললো–এই সুতো দিয়েই নাকি মন্ত্র-বাণ মেরেছে। সুতোর ভেতর দুটো গেরো দেখালো আমাদের।

জেঠিমার কথা শেষ হলে মা বললেন, আমিও এরকম একবার শুনেছিলাম। সেবার–।

মা-র কথা ছাপিয়ে আমার কানের কাছে দিদার গলা কট কট করে উঠলো। এক হাতে আমার একটা কান ধরে অপর হাতে থুতনি নেড়ে দিদা বললেন, আড়ি পেতে বড়দের কথা শোনা হচ্ছে হতচ্ছাড়া! কান আর মাথার সঙ্গে থাকবে না। কথা বলতে বলতে আমার কান দুটো বেশ আয়েশ করে মুচড়ে দিলেন দিদা।

রাগে দুঃখে তখন আমার যা কান্না পাচ্ছিলো সে আর কী বলবো! শুধু রামু, বিজু দেখে ফেলবে বলেই কাঁদলাম না। চুপচাপ দিদার সামনে থেকে সরে গেলাম। পাশের ঘরে যেতে গিয়ে শুনি দিদাও জেঠিমাদের আসরে বসে পড়েছেন।

একটু পরে দিদা আমাকে ডেকে বললেন–যা তো, একদৌড়ে পাশের বাড়ি থেকে হারুর মাকে ডেকে আন। আমার কথা বলবি!

হারুকাকার মায়ের সাথে দিদার ভারি খাতির। বুঝলাম, তাকে না হলে দিদার আসর ঠিকমতো জমবে না। আমি মুখ টিপে হেসে র‍্যাপারটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

হারুকাকাদের বাড়ি গিয়ে দেখি দিদার বন্ধুটি হাঁটু ভাঁজ করে জোড় হাতে বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর সামনে বসা মাথায় বিশাল জটা আর মুখভর্তি লম্বা দাড়িঅলা এক সন্ন্যাসী। চুল-দাড়ি সব জট লেগে একাকার হয়ে গেছে। একটা চিমটে নেড়ে কী যেন বলছিলেন।

আমাকে দেখেই সন্ন্যাসীটি বিরক্ত হয়ে কটমট করে তাকালেন। ভারি এক তাকানেঅলা! আমি যেন তার পরোয়া করি! সটান গিয়ে হারুকাকার মাকে বললাম, দিদা যেতে বলছেন।

ঘরের ভেতর থেকে হারুকাকা ডাকলেন–আবু কথা শুনে যা।

হারুকাকার ঘরে ঢুকে দেখি, তিনি আয়নার সামনে বসে আয়েশ করে গোঁফে মোম মাখাচ্ছেন। আয়নায় মুখ রেখে বললেন–হ্যাঁ রে, অকাদের ঘেসেড়াটা বললো, তোদের বাড়িতে কী সব লোম নাকি পেয়েছিস তোরা!

আমি সব খুলে বললাম। লাল সুতোর কথা শুনে হারুকাকার হাত থেকে মোমের কৌটো খসে পড়লো। চোখ কপালে তুলে বললেন–আমাকে আগে খবর দিস নি কেন? এক্ষুণি চল, দেখে আসি।

হাত ধরে আমাকে একরকম টেনে-হেঁচড়ে হারুকাকা আমাদের বাড়িতে এলেন। দিদার কাছ থেকে তিনগোছা লোম আলোর সামনে ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন–এ তো বেড়ালের লোম মনে হচ্ছে!

দিদার চোখ দুটো তখন দেখার মতো হলো। বার কতক খাবি খেয়ে বললেন–বে-ডা-ল?

হারুকাকা মাথা নেড়ে সায় জানালেন–বেড়াল। তবে যে-সে বেড়াল নয়। এ হচ্ছে সিয়ামিজ বেড়ালের লেজের ডগার লোম। সাধারণ বেড়ালেরটা এতো কুচকুচে হয় না।

দিদা আরও কয়েক দফা খাবি খেয়ে বললেন, কী মিজ বললে বাবা?

হারুকাকা কাষ্ঠ হাসলেন–সিয়ামিজ। ভারি দুর্লভ জাতের বেড়াল। আমাদের দেশে দেখাই যায় না।

দিদা তেমনি অবাক হয়ে বললেন, কী হয় বাবা ওই সিয়ামিজ বেড়াল দিয়ে?

হারুকাকা এবার ঢোক গিললেন। আশপাশে চোখ বুলিয়ে চাপা গলায় বললেন, আমি তো জানি এ বেড়াল সাধারণ লোকে পোষে না। আগেকার দিনে ডাইনীদের কাজে লাগতো।

হারুকাকার কথা শুনে মা, দিদা আর জেঠিমাদের চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো। বড় জেঠিমা আর দিদা ভাঙা গলায় একসঙ্গে বললেন, ডাইনী?

হারুকাকা এবার শুধু মাথা নেড়ে সায় জানালেন। কেউ কোনো কথা বললো না। সবাই চুপচাপ শুকনো মুখে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর হারুকাকা—তোমরা সবাই সাবধানে থেকো, বলে চলে গেলেন।

ভয়ে সবার হাত-পা সেঁধিয়ে গেছে। একি অলুক্ষণে ব্যাপার? ডাইনীদের বেড়ালের লোম–যা তা কিছু নয়! কিন্তু ডাইনী এলো কোত্থেকে?

বেশ রাতে দিদাদের সভা ভাঙলো। দিদা আমাকে ডেকে বললেন–একটা হারিকেন আর লাঠি হাতে তুই আর রামু গিয়ে হারুর মাকে ওদের বাড়িতে রেখে আয়।

রামু ভূত-টুত মানে না। তবু দেখলাম, ও যেন একটু দমে গেছে। দুজনে হারুকাকাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে চুপচাপ হাঁটছিলাম। একসময় রামু বললো, আসলে ডাইনী–ফাইনী কিছু নয়। কোনো খারাপ লোক বাজে মতলব হাসিল করার জন্যে এসব করেছে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমারও তাই মনে হয়। তবে বানরের থাবা গল্পটা তো তুই পড়েছিস। সেখানে কিন্তু অন্যরকম ছিলো। এ ধরনের কিছু দেখা মানে নির্ঘাত কোনো মৃত্যুর খবর শোনার লক্ষণ।

রামু শুধু বললো, দেখা যাক কী হয়!

পরদিন অবাক কাণ্ড! হারুকাকার মা ভোর না হতেই ছুটতে ছুটতে আমাদের বাড়িতে এলেন। আমি তখন কলতলায় যাচ্ছি। বললেন, হ্যাঁরে ছোঁড়া, তোর দিদা কোথায় রে?

আমি ভেতরে দেখিয়ে দিলাম। রামু, বিজু এগিয়ে এলো–কী হয়েছে?

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, কী জানি!

আমরা তিনজন অবাক হয়ে দিদার ঘরে গেলাম। শুনলাম, আজ সকালে হারুকাকাদের বাড়ির সবার বালিশের তলায় নাকি লাল সুতোয় বাঁধা সিয়ামিজ বেড়ালের লোম পাওয়া গেছে।

বাড়িতে সবার মুখ শুকিয়ে আমসত্ত্ব। সকালে কোনো খাবার তৈরি হলো না। শুধু মুড়ি খেয়ে স্কুলে গেলাম। হারুকাকার ছেলে কথাটা সারা স্কুলে রটিয়ে দিলো। আমাদের তখন হাজারটা জেরা করা হলো।

বাড়ি ফিরে দেখি মেঘ কাটে নি। সবার মুখ থম থম করছে। দিদা সন্ধ্যে না হতেই আমাদের গম্ভীর মুখে বললেন, তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ো, ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে।

আমরা শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবলাম। কোনো কুল-কিনারা পেলাম না।

তার পরদিন যে কাণ্ড ঘটলো, র-নগরের ইতিহাসে কেউ অমনটি শুনেছে কিনা বলতে পারবে না। র-নগরের দামপাড়া, মধুবাড়িয়া, সেন্ট জন স্ট্রিট, শালতলা–সবখানে কম করে হলেও তিরিশটা বাড়িতে খবর পাওয়া গেল, লাল সুতোয় বাঁধা সিয়ামিজ বেড়ালের লোমের গোছা পাওয়া গেছে সবার বালিশের তলায়। র-নগররের জীবনে এমন আজগুবি ঘটনা কখনও ঘটে নি। পথে-ঘাটে সবখানে লোকজন শুকনো মুখে ফিসফিসে গলায় একে অপরকে প্রশ্ন করছে–এটা কিসের ইঙ্গিত? র-নগরের ওপর কি কোনো অশুভ শক্তির দৃষ্টি পড়েছে?

স্কুলে মহা হইচই। ক্লাশে কোনো পড়া হলো না। শুধু সিয়ামিজ বেড়ালের নোম নিয়েই কথা হলো। টিচাররা সবাইকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বললেন। আমাদের বাড়িতে প্রথম দেখা গিয়েছিলো। সেজন্যে বেশি চাপ পড়তে লাগলো আমাদের ওপর। বেশ কয়েকজন টিচার স্কুলে আসেন নি। সেদিন আমাদের হাফ-স্কুল হলো। স্কুল থেকে বেরোবার সময় দেখলাম, আমাদের বুড়ো দপ্তরি ডেসমন ছুটির জন্যে ব্রাদার হামফ্রেকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।

বাড়ি গিয়ে ভয়ানক এক খবর শুনলাম। অকা সরকারদের বড় গিন্নির মোল ভরির এক চন্দ্রহার আর আটভরির দুই মকরমুখো বালা চুরি গেছে। গত রাতে তাঁর বালিশের তলায়ও নাকি লাল সুতোয় বাঁধা সিয়ামিজ বেড়ালের লোম পাওয়া গিয়েছিলো। অকা সরকারদের বাড়ির পল্টা এসে আমসি মুখে খবরটা জানিয়ে গেলো আমাদের বাসার সবাইকে। দারোগা নাকি সবাইকে জেরা করে ওদের রাধুনিকে নিয়ে হাজতে পুরেছে।

বিকেলে সরকারদের বড় গিন্নি এলেন দিদার কাছে। আরও এলেন হারুকাকার মা, দামপাড়ার হালদার দাদু, সেন্ট জন স্ট্রিটের মিসেস দুবে–সব মিলিয়ে দশ বারোজন বুড়ো-বুড়ি। মা আর জেঠিমারা অনবরত পান সেজে দিচ্ছেন আর চা বানাচ্ছেন। দিদা আসর জাঁকিয়ে বসেছেন।

হালদার দাদু হচ্ছেন র-নগরের সবচেয়ে বুড়ো মানুষ। সবার অনেক কথার শেষে তিনি বললেন, আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন, এর পেছনে একটা অশুভ শক্তি কাজ করছে। কোনো অপদেবতা বা গ্রহ যদি কুপিত হন, তাহলে এমন ঘটতে পারে। আমার মনে হয় অবিলম্বে এর একটা বিধান হওয়া উচিত।

কয়েকজন কোরাসে জানতে চাইলেন–বিধানটা কী?

হালদার দাদু গম্ভীর হয়ে বললেন–বলছি, ধৈর্য ধরুন। আপনারা রামনাঙ্গা পাহাড়ে তো অনেকেই গেছেন। আমাদের দামপাড়া থেকে মাত্র তিন মাইল হবে। সেখানে থাকেন হারিয়াম্পা মায়ী। তার মতো সিদ্ধ তপস্বিনী খুব কমই আছেন। আমরা তার কাছেই এর বিধান চাইবো। তিনি ছাড়া আর কেউ এ বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারবেন না।

হারুকাকার মা বললেন, কিন্তু আমি যে আমাদের সন্ন্যাসী বাবার কাছে বিধান চেয়ে বসে আছি।

থাকুন গে বসে! বিরক্ত হয়ে হালদার দাদু বললেন, এর বিধান যার তার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ, এ বেড়াল যে-সে ডাইনীর নয়। আমি বুঝতে পারছি, এ হচ্ছে সেই তিব্বতী ডাইনীর কাজ, আমার ঠাকুরদা যার কথা বলেছিলেন। র-নগরের পত্তনের সময় থেকে সেই ডাইনী গোটা শহরটার ওপর চটে আছে।

হারুকাকার মা এরপর আর কোনো কথা বললেন না। হালদার দাদু আবার বললেন, আপনারা কে কে যাবেন হারিয়াম্পা মায়ীর কাছে?

অকা সরকারদের বড় গিন্নি অলঙ্কারের শোকে কাঁদো-কাঁদো মুখে বসেছিলেন এক কোণে। মাঝে মাঝে রুমালে ফোৎ ফোৎ করে নাক ঝাড়ছিলেন। তিনি ধরা গলায় বললেন, আমি যাবো।

তার সঙ্গে সঙ্গে দিদা আর মিসেস দুবেও সাড়া দিলেন। মিটিং-এ ঠিক হলো হালদার দাদুর সঙ্গে এই তিনজনই যাবেন হারিয়াম্পা মায়ীর কাছে।

দিদা আমাকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ওরে মেনি বাঁদর, তুই একটা ভালো জামা পরে আয়। আমার সাথে যাবি।

আমি জানতাম দিদা যা ভীতু–আমাদের একজনকে সঙ্গে নেবেনই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। দিদা শুধু গায়ে একটা আলোয়ান জড়িয়ে নিলেন। হালদার দাদুরা তো তৈরি হয়েই এসেছিলেন।

শেষ বিকেলে একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে আমরা হারিয়াম্পা মায়ীর রামনাঙ্গা পাহাড়ে গেলাম। দিদাদের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। আমারও রীতিমতো গা ছমছম করছিলো।

রামনাঙ্গা পাহাড়ের একটা মস্ত গুহার ভেতরে থাকেন হারিয়াম্পা মায়ী। গুহার ভেতর ঢুকতেই সুড়ুৎ করে পাশ দিয়ে সবুজ চোখঅলা একটা নীল শেয়াল বেরিয়ে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ে বাঁধা একটা লাল-নীল তোতা পাখি কে-কে-কে-কে বলে ডানা ঝটপট করে ডেকে উঠলো।

হালদার দাদু ইশারায় আমাদের থামতে বললেন। ভেতর থেকে কে যেন চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললো–কিয়ারে ডাকিনী? কৌন আয়ারে?

বলতে বলতে গুহার অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এলো হারিয়াম্পা মায়ী। চেহারা দেখে বলা যাবে না বয়স দেড়শো না দুশো। যে চুলগুলো এককালে শাদা ছিলো সেগুলো মরচে-পড়া পুরানো লোহার মতো দেখাচ্ছে। চামড়া ঝুলে পড়েছে। নাকটা রামদার মতো বাঁকানো। চোখের কোটরে যেন দুটো সবুজ পাথর বসানো–জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে দেখছিলো আমাদের। আমার মনে হল হারিয়াম্পা মায়ী নিশ্চয়ই তিব্বতী ডাইনীটার বোন-টোন হবে।

হালদার দাদু এগিয়ে গিয়ে তার কানে কানে কি যেন বললেন। শুনে হারিয়াম্পা মায়ী খিক খিক করে হেসে দাঁড়ে বাধা তোতা পাখিটার দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে তোতা পাখিটাও ক্কি-ক্কি-ক্কি করে বিকট স্বরে ডেকে উঠলো। তারপর হারিয়াম্পা মায়ী ইশারায় আমাদের ভেতরে যেতে বললো।

ভেতরে বেশ ভোলা খানিকটা জায়গা। চারপাশে হাজারো রকমের লতাপাতা ঝোলানো। থেকে থেকে অল্প বাতাসে কিলবিল নড়ছিলো সাপের মতো। হালদার দাদু পরে আমাদের বলেছেন, ওগুলো নাকি আসলেই ছিলো সবুজ সাপ। গুহার ভেতর উনুনের মতো একটু জায়গা দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিলো। সেই আগুনের উপর বসানো মস্ত এক কড়াইতে টগবগ করে কি যেন ফুটছিলো।

হারিয়াম্পা মায়ী সেই কড়াইতে শাদা মতো কিসের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলো। তারপর বিচিত্র সব শব্দের মন্ত্র পড়া আরম্ভ করলো। কড়াই থেকে শাদা ধুয়োর আড়ালে হারিয়াম্পা মায়ীকে তখন দেখা যাচ্ছিলো না। শুধু বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ার শব্দ হচ্ছিলো। হালদার দাদু একটু কেশে উঠতেই প্রচণ্ড ধমকে খেলেন–খামোশ!

আমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছো। শক্ত করে দিদা আমার হাত ধরেছিলেন, তারপরও ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছিলাম। আসলে হারিয়াম্পা মায়ীকে একটা ডাইনী ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না আমি।

কিছুক্ষণ পর মন্ত্র পড়া শেষ হলো। শাদা ধোঁয়া কেটে গেলো। হারিয়াম্পা মায়ী আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, কিসকা জেবর?

হালদার দাদু অকা সরকারদের বড় গিন্নিকে দেখিয়ে দিলেন। তখন হারিয়াম্পা মায়ী কাঠের বারকোশে করে সেই কড়াই থেকে থকথকে কালো মতো কী যেন তুললো। দেখে মনে হলো সেখানে ছুঁচো, চামচিকে, সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি সব কিছুই থাকতে পারে। বারকোশের ভেতর ছুঁচোর লেজের মতো কি যেন দেখাও যাচ্ছিলো।

বড় গিন্নির কাছে এসে হারিয়াম্পা মায়ী বারকোশটা এগিয়ে দিয়ে খনখনে গলায় বললো, পিয়ো।

বড় গিন্নি ভয়ে ভয়ে হালদার দাদুর দিকে তাকালেন। হালদার দাদু তাকে সাহস দিয়ে বললেন, ভয় কি, খেয়ে নিন, গয়না–।

হালদার দাদুর কথার মাঝখানে হারিয়াম্পা মায়ী তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বাজখাই গলায় ধমক দিলো–খামোশ! তারপর চোখ পাকিয়ে গিন্নিকে বললো, পিয়ো।

হালদার দাদুর শুকনো মুখের দিকে আরেকবার তাকিয়ে বড় গিন্নি মুখখানা কাঁদো : কাঁদো করে সেই থকথকে কালো সুপ ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন।

হারিয়াম্পা মায়ী খনখনে গলায় বড় গিন্নিকে বললো–জেবর মিল যায়গা।

হালদার দাদু তখন দাঁড়ে বাঁধা তোতার মুখে একখানা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম ডাইনীর গুহা থেকে।

ঘোড়ার গাড়ি আমাদের জন্যে দাঁড়িয়েছিলো। গাড়িতে ওঠেমিসেস দুবে বললেন, মিসেস সরকার কী করে যে খেলেন, মাই গুডনেস!

লজ্জায় বড় গিন্নির মুখ লাল। হালদার দাদু গম্ভীর হয়ে বললেন, উনি অলঙ্কার পেয়ে যাবেন।

চারদিকে অলঙ্কারের জন্যে র-নগরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। র-নগরে সবাই জানে কোনো চোর-ডাকাত নেই। দু একটা ঘটিবাটি কেউ ভুল করে নিয়ে যেতে পারে। তাই বলে চব্বিশ ভরি সোনার গয়না চুরি যাবে এতো সোজা কথা নয়!

র-নগরের জীবনে কিছু ঘটে না বলে আমার ভারি দুঃখ ছিলো! আমি চাইতাম একটা কিছু ঘটুক। তাই বলে এতো বড় অঘটন এটা আমি চাই নি।

র-নগরের সবখানে এই ঘটনাটি আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আমরা তিনজনও বড়দের মতো গম্ভীর মুখে এ নিয়ে আলোচনায় বসতাম। এখন আর সিয়ামিজ বেড়ালের লোম দেখা যায় না বটে, তবে মিসেস দুবের হিরের কানফুল চুরি গেছে এটা কানে এলো। সবাই জানে, এই অলঙ্কার চুরি কিংবা উধাও হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সিয়ামিজ বেড়ালের লোমের একটা সম্পর্ক আছে।

হালদার দাদু মিসেস দুবেকে হারিয়াম্পা মায়ীর কথা বলাতে তিনি আঁতকে উঠেছেন মাই গুডনেস বলে। মিসেস দুবের ভঙ্গি দেখে হালদার দাদুর সে কী রাগ। বার বার বললেন–অলঙ্কার পেলে সরকার গিন্নিই পাবেন।

রামু একদিন বললোহারে, রাতে পাহারা দিলে কেমন হয়? বিজু বললো, কিছু না জেনে কোথায় পাহারা দিবি শুনি। বাড়ি তো অনেক। রামু চুপসে গিয়ে বললো, তাও তো কথা!

গোয়েন্দা সিরিজ আমি কম পড়িনি! মাতব্বরিটা নিলাম–সোজা হিসেব! গয়না চুরি হচ্ছে তাদেরই যাদের বাড়িতে সিয়ামিজ বেড়ালের লোম পাওয়া গেছে। শালতলার সরকারদের বাড়ি চুরি হয়েছে। সেন্ট জন স্ট্রিটের মিসেস দুবের চুরি হয়েছে। এই দুই পাড়া বাদ দিলে বাকি থাকে মধুবাড়িয়া, দামপাড়া আর আমাদের পাড়া। মধুবাড়িয়ায় চুরি করার মতো সেরকম কোনো বাড়ি নেই। সুতরাং আমরা আমাদের পাড়া আর দামপাড়ায় পাহারার ব্যবস্থা করতে পারি। দামপাড়ার ভার হালদার দাদুর ওপর ছেড়ে দেয়া যায়। আমরা আপাতত আমাদের পাড়াই পাহারা দেবো।

চমৎকার বলেছিস। আমার মাথায় চাটি মেরে লাফিয়ে উঠলো রামু। যদিও চাটিটা আমার পছন্দ ছিলো না, তবু রামুর প্রশংসার বদলে ওটা মেনে নিতে হলো।

আমাদের দারোগা মশাই সারা র-নগরে একাই একশো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। যেখানেই যাই সেখানেই বিশ্বাস দারোগা। সবখানে তার এক কথা–আঁ, আমার র-নগরে চুরি বাটপারি! তুর্কি নাচন নাচাবো না!

সবখানে খবরাখবর নেয়া হচ্ছে এ কদিনে নতুন মানুষ কে কে এসেছে র-নগরে। সরকারদের নতুন কাজের লোক উড়ে বামুনটার সে যা দুরবস্থা! দিনে কম করে হলেও তাকে দশবার বিশ্বাস দারোগার জেরা সামলাতে হচ্ছে।

আমাদের বাড়িতে দিদা কোত্থেকে যেন একটা মুশকিল আসান ফকির ধরে এনেছেন। লাল ফেজের টুপি মাথায়, দাড়ি, জোব্বাঅলা একটা লোক গলায় হরেক রকম তবি ঝুলিয়ে দিদাকে জ্ঞান দিতে বসেছে। দিদা ভক্তিভরে তার সেবা করছেন আর বাসার সবাইকে ধমক দিচ্ছেন।

আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতো কাজে নামলাম। রাতে ঠিক করলাম, খান বাহাদুরদের আস্তাবলে বসেই পাহারা দেবো। আস্তাবলটা এমন এক জায়গায় যেখানে থেকে পাড়ার সব বাড়ি দেখা যায়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, হারুকাকা আর আমাদের বাড়ি। আমি অবশ্য হারুকাকার বাড়ির ওপর বেশি নজর দেয়ার পক্ষপাতী ছিলাম।

আমরা তিনজন তিনখানা কম্বল জড়িয়ে আস্তাবলের পাশে নিশিন্দে গাছের ঝোঁপের নিচে বসলাম। রাত বাড়তে লাগলো। চোখ দুটো টান টান করে জেগে রইলাম। হঠাৎ মাঝরাতে রামুর খোঁচা খেয়ে উঠে বসতে হলো। দেখি, হারুকাকাদের বাড়ি থেকে সেই সন্ন্যাসী ঠাকুর বেরিয়ে যাচ্ছেন। বিজু ফিসফিস করে বললো, এভাবে খোঁচাচ্ছিস কেন, ওটা তো সেই সন্ন্যাসীটা!

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, হারুকাকার মা-র এতো সন্ন্যাসী সেবার বাতিক অথচ ঠাকুর মশাইকে রাতে বাড়িতে না রেখে এই শীতের ভেতর এভাবে যেতে দিলেন! যাক, ওদের বাড়ির লোকজন তাহলে এতক্ষণ জেগেই ছিলো।

আবার একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পেলাম । যখন ঘুম ভাঙলো, তখন দেখি, আমার আর রামুর কান দুটো জেঠুর দু হাতের মুঠোয়।

বাছাধনেরা তাহলে সারারাত আস্তাবলে ছিলে? আমি ওদিকে সারা বাড়ি খুঁজে মরি। খানদের বেতো ঘোড়ার সঙ্গে এত কিসের খাতির! বাড়ি চল। আজ যদি বেতিয়ে তোদের পিঠের চামড়া না তুলি তাহলে–এই বলে জেঠু আমাদের কান ধরে হিড় হিড় করে টেনে বাড়ি নিয়ে এলেন।

আমাদের মুখ শুকিয়ে কাঠ। আজ নির্ঘাত পিঠের ওপর তিনটে বেত ভাঙবে। কেন যে মিছেমিছি রাত পাহারার শখ হলো তাই ভাবছিলাম। কোনো লাভই তো হলো না। মাঝখান থেকে বরং এই হেনস্তা।

জেঠু সপাং করে বেতখানা বাতাসে নাচালেন। ঠিক তক্ষুণি হারুকাকার মা ছুটে এসে হাউমাউ করে বললেন, বাবা হাবু! আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে। কাল রাতে আমার বৌমার গয়নার বাক্স চুরি হয়ে গেছে। আমার কী হবে গো। হাউ, হাউ, হাউ! হারুকাকার মায়ের সে কি কান্না!

আমার মাথায় বিদ্যুতের চমকের মতোই চিন্তাটা এলো। বললাম, কাল রাতে কি আপনাদের বাড়িতে সন্ন্যাসী ঠাকুর এসেছিলেন?

হারুকাকার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তিনি তো সেই যে গেলেন, তিন দিন হয়ে গেলো আর এলেন না। ভাবছিলাম তাকে পেলে কুপিত গ্রহ বশ করাবো। তার আগেই–হাউ হাউ হাউ।

আমি রামুকে তখন এক ঝটকা মেরে টেনে বললাম, এখনই থানায় চল। ডাকাতের খোঁজ পেয়ে গেছি।

একছুটে থানায় এসে রুদ্ধশ্বাসে বিশ্বাস দারোগাকে সব খুলে বললাম।

তাই নাকি! বলে ছিটকে বেরিয়ে এলেন দারোগা মশাই। বললেন, আমি জানি হারামজাদা কোথায় থাকে! রণধীর সিং! আকবর আলী! জলদী আও!

সন্ন্যাসীকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হলো না। সবই পাওয়া গেলো। শুধু মিসেস দুবের হিরের দুল জোড়া ছাড়া। জেরা করে জানা গেলো ওটা সন্ন্যাসীর এক চ্যালার কাছে রয়েছে।

হালদার দাদু বললেন, তখনই মিসেস দুবেকে বলেছিলাম হারিয়া মায়ীর কাছে যেতে।

মিসেস দুবে কী আর করেন! হালদার দাদুর সঙ্গে গিয়ে হারিয়াম্পা মায়ীর সেই বীভৎস সুপ খেয়ে এলেন। আর কি আশ্চর্য, ঠিক তার পরদিনই সন্ন্যাসীর সেই চ্যালাটি দুলসমেত ধরা পড়লো। তখন আমাদের বুড়ো হালদার দাদুর লাফানো দেখে কে!

র-নগরের ঘটনা এরপরও কিছু বাকি ছিলো। চোর ধরা পড়ার আনন্দে আমরা সবাই একদিন হিমঝোরায় বনভোজনে গেলাম। বনভোজনের অর্ধেক চাঁদাই দিয়েছিলেন সরকার গিন্নি। বিশাল বপু নিয়ে তিনি একাই এর আয়োজন করলেন। হিমঝোরার ঝাউবনে আমরা বাকি রহস্যটুকু জানতে পারলাম। সেটা হল সিয়ামিজ বেড়ালের নোমর রহস্য।

আমরা ছোটরা সবাই দূরে দল বেঁধে বসে এ নিয়ে আলাপ করছিলাম। ওরা কেউ হারিয়া মায়ীর কথা জানে না। সবাইকে হারিয়াম্পা মায়ীর গল্প শুনিয়ে বাহাদুরি দেখানোর জন্য বললাম, বুড়ি বলেছে এ লোম হচ্ছে তিব্বতের লুসাংপি নামে এক পাজি ডাইনীর পোষা বেড়ালের। এই লোম দেখা মানে একটা দুর্ঘটনা ঘটবেই। আমাদের তো অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। গয়না চুরির সঙ্গে ডাইনীর বেড়ালের লোমের একটা সম্পর্ক আছে।

অকা সরকারদের পল্টা বললো–বুড়ি জানে কচু আর ঘন্টা। আমাদের বাড়িতে সবার দেখাদেখি আমিই তো রামছাগলের লোম লাল সুতো দিয়ে বেঁধে জেঠিমার বালিশের তলায় রেখেছিলাম। জেঠিমা যা ভীরু, কী করেন তাই দেখার জন্যে মজা করছিলাম।

মিসেস দুবের ভাইপো ইভু সঙ্গে সঙ্গে বললো, আমাদের বাড়িতে পিসিমার বালিশের তলায় আমি রেখেছিলাম।

হারুকাকার ছেলে বললো, আমাদের বাড়িতে আমি রেখেছিলাম।

সবার তখন কী তুমুল হাসি। হাসতে হাসতে সবাই স্বীকার করলো–এসব ডাইনী-টাইনীর ব্যাপার যে কি রকম ফালতু এ থেকেই সেটা প্রমাণ হয়। আমাদের মজার ব্যাপারটা বুড়োদের কী রকম নাজেহাল করে ছেড়েছে। উচিত শিক্ষা হয়েছে। ডাইনী, মন্ত্র এসব বিশ্বাস করলে এমনই হয়।

আমি নিজেও এরকমই ভেবেছিলাম। বুড়োদের এই ভয় আর কুসংস্কারের সুযোগ নিয়েছিলো পাজি সন্ন্যাসীটা। রামুকে বললাম–শুধু আমি নই। আমরা সবাই চেয়েছিলাম র-নগরে একটা কিছু ঘটুক। নইলে সবার মাথায় কেন লোম রাখার বুদ্ধি আসবে?

পল্টা আর ইভুরা সেটা স্বীকার করলো। পল্টা বললো, তোদের বাড়িতেই তো পয়লা ঘটলো। তুই-ই তাহলে শুরু করেছিলি?

আমি হেসে বললাম, সেটা কোনো তিব্বতী ডাইনীর সিয়ামিজ বেড়ালের লোম নয়। বড় জেঠুর পুরোনো জুতোর বুরুশের লোম।

পল্টা বললো-আহা, রামছাগলও নয়!

সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলাম। তবে সবশেষে সবাই মিলে ঠিক করলাম, বুড়োদের কানে যেন এসব কথা না যায়। ওরা ভাবছে এসব সন্ন্যাসীর কাজ। ভয় দেখাবার জন্যে সন্ন্যাসী ঠাকুরই বুঝি এসব চালান দিয়েছে। তাই ভাবুক ওরা। আসল ঘটনা জানতে পারলে কারও কানই যে মাথার সঙ্গে থাকবে না, এ বিষয়ে সবাই একমত হলাম।