সিনক্লেয়ার লুইস : তিনি নোবেল বিজয়ী হলেন

সিনক্লেয়ার লুইস : তিনি নোবেল বিজয়ী হলেন

সিনক্লেয়ার লুইসের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হল আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে। তিনি, আমি এবং আরো কয়েকজন লং আইল্যান্ডের ফ্রিপোর্টে মোটর বোট নিয়ে উইক-মাছ ধরার জন্য জলের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। ঐ সময় আমি টুপি খুলে রেড লুইসকে অভিবাদন জানিয়েছি কারণ তিনি কখনো সমুদ্র পীড়ায় ভুগতেন না। সমুদ্রের ঢেউ প্রবল বেগে নৌকাটাকে আন্দোলিত করত আর আমি টাল সামলাতে

পেরে পাটাতনে আছড়ে পড়তাম, কিন্তু দেখেছি, লুইস পটে আঁকা ছবির মতো স্থির বসে থেকে মাছ ধরতেন। আজো আমি সিনক্লেয়ার লুইসের উদ্দেশ্য টুপি খুলে সম্মান জানাই শুধু একজন মৎস্য শিকারী হিসেবে তার দক্ষতার জন্য নয়, অবিরাম ধারায় অনেকগুলি চমকপ্রদ ও অমর উপন্যাস লেখার জন্য। আর আপনি যদি ভাবেন এটা আবার একটা বাহাদুরী হল নাকি? তাহলে আপনিও একবার একটু চেষ্টা করে দেখুন।

সিনক্লেয়ার লুইস প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন ১৯২০ সালে। এর আগে তিনি ছয়টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন কিন্তু জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হননি। তাঁর সপ্তম উপন্যাস ‘মেইন স্ট্রিট’ সমগ্র জাতির ওপর দিয়ে একটা প্রবল টর্নেডোর মতো বয়ে গেল। মহিলা সংগঠনগুলি তাঁকে অকাট্য ভাষায় বকাবকি করল, ধর্মযাজকরা এটাকে নিন্দা করল এবং খবরের কাগজগুলো একযোগে এটাকে আমেরিকার জাতীয়জীবনের প্রতি চরম একটা অপমান বলে অভিহিত করল। এই উপন্যাসটি আমেরিকার সাহিত্য জগতে প্রচণ্ড যুদ্ধ বাধিয়ে দিল। আর এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ল তিনি হাজার মাইল দূরে সুদূর ইউরোপে। অবশেষে এই বইটাই তাকে একজন প্রথম সারির তারকায় পরিণত করে দিল। নিন্দুকেরা বলল, হয়েছে বটে চমৎকার, কিন্তু এই পুঁচকে ছোঁকরাটা আবার ওরকম করে লিখতে পারবে না মোটেও।

কিন্তু সেই লাল-মাথা ছেলেটা আবার লেখা শুরু করে দিলেন, আর তখন থেকেই আধডজন সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় ও মূল্যবান উপন্যাস চটপট লিখে ফেললেন এবং সবাইকে অবাক করে দিলেন। অবশ্য চটপট বললে ভুল হবে কারণ তিনি অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং ধৈর্য সহকারে তার পাণ্ডুলিপিগুলো সমাপ্ত করেন। তার মেইন স্ট্রিট’ প্রকাশের সতের বছর আগে তা লিখতে আরম্ভ করছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘উডসওয়ার্থ র‍্যাবিট’, ‘এ্যারোস্মিথ, এলমার গাট্রি’, এ্যান ভিকারস’, ‘ইট কান্ট হেপেন হিয়ার’ ইত্যাদি।

আমি একবার তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা বলতে বলেছিলাম। তিনি বলেছেন যে, যদি কোনো সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত না থাকেন তাহলে তখন হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক অথবা দর্শন শেখানোর কাজ নতুবা গভীর জঙ্গলে গিয়ে একদল করাতীর সাথে বসবাস করা তিনি পছন্দ করেন। বছরে ছয় মাস তিনি পার্ক অ্যাভিনিউতে কাটাতে ভালোবাসেন আর বাকি ছয় মাস ভারমন্ট পাহাড়ের একটা নির্জন স্থানে বসে কাটান। সেখানে তিনশত চল্লিশ একরের একটা আখচাষের খামার আছে তার। তিনি নিজের শাকসবজি সেখানে ফলান। শুধুমাত্র চুল কাটানোর প্রয়োজন হলে তিনি শহরে যান।

তাঁর মতে কারো বিখ্যাত হওয়াটা বড় বিরক্তিকর। তিনি আমাকে বললেন, যদি তিনি লোকদের সমস্ত চিঠির উত্তর দিতেন তা হলে তিনি আর কোনোদিনই আর একটা বইও লিখতে সক্ষম হতেন না। শুধু তাই নয়, তা হলে তার ঘুমোবার সময়টাও ভাগ্যে জুটত না। তাই তিনি অধিকাংশ চিঠি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে সেগুলোকে পুড়ে যেতে দেখতেন। তিনি অটোগ্রাফপ্রার্থীদেরকে এড়িয়ে চলতেন। কদাচিৎ ভোজসভায় যেতেন এবং সাহিত্যিকদের আলোচনায় চা চক্র বর্জন করতেন।

আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম কীভাবে তিনি অনেক বছর প্রাতরাশের দুই ঘণ্টা আগে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে উনুন জ্বালাতেন, কফির পানি ফুটানোর জন্য চুলোয় কেটলি চড়িয়ে দিয়ে অবিরাম লিখে যেতেন। তিনি নিজের খাবার নিজেই রাঁধতেন, কাপড় ধুতেন এবং ছয় মাস যাবত দিন-রাত কাজ করতেন। এই ছ’মাসে তিনি একটিমাত্র জিনিস বিক্রি করলেন, তা হল দুই ডলারের বিনিময়ে একটি মাত্র কৌতুক। তিনি বলেছেন, তার যখন পেশায় হাতেখড়ি হচ্ছিল তখন ওই বছর ক’টিতে তার সময় যেমন কেটেছিল তেমনটি আর কখনো কাটে নি।

তাঁর লিখিতবইগুলোর কতকপি বিক্রি হয়েছে তা তিনি জানতেন না এবং তিনি কত উপার্জন করেছেন তারও হিসেব রাখতেন না।

তিনি সবরকমের অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে সক্ষম হন! একবার তিনি গরু-ভেড়ার নৌকায় করে আটলান্টিক মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন। তিনি বধির বালকদের জন্য প্রকাশিত একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি ছোটদের জন্য কবিতা লিখতেন এবং জ্যাক লন্ডনের কাছে কবিতার ও গল্পের প্লট বিক্রি করতেন। তিনি খেলাধুলার প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ করতেন না। এমনকি বিখ্যাত খেলোয়াড়দের দু একজনের বেশি তার নাম জানা ছিল না। একসময় সিনক্লেয়ার লুইস যে পত্রিকাগুলোতে কাজ করতেন তার প্রথম চারটাই তাকে বরখাস্ত করেছিল। কোনো ব্যাপারে উপদেশ ও উৎসাহ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা তিনি বিশ্বাস করতেন না।

সাহিত্যে নেবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এইখবর টেলিফোনে যখন তিনি পেলেন, তিনি তা বিশ্বাস করলেন না এবং হেসে উড়িয়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন কেউ হয়তো তার সঙ্গে ঠাট্টা মসকরা করছে। অবশেষে তিনি যখন জানতে পারলেন তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন–তিনি সাহিত্য জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানলাভে সক্ষম হয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *