সিদ্ধ পাষাণ

সিদ্ধ পাষাণ

হরিসাধন লাহিড়ির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ট্রেনে।

পুরী-পাটনা এক্সপ্রেসে টিকিট পাইনি। আমার তো আগে থেকে কিছু ছকা থাকে না! ইচ্ছে বলুন, বাই বলুন, চাগলেই বেরিয়ে পড়ি। আসানসোল বৈদ্যনাথধাম-ঝাঁঝাঁ প্যাসেঞ্জার একটি অতি বিরক্তিকর ট্রেন। কিন্তু সোজা দেবগৃহ অর্থাৎ দেওঘর যেতে হলে আর উপায়ই বা কী! সঙ্গে তেমন বোঁচকাকুঁচকি নেই, একটা অ্যাটাচিতেই আমার সব কিছু ধরে যায়। উঠে জানলার ধারে গুছিয়ে বসি। বমপাস টাউনে আমার মামার বাড়ির দিকের এক কাজিন সুচরিতাদের একটি উৎকৃষ্ট বাংলো আছে। দেখাশোনার একটি মালিও আছে। সুযোগ পেলেই সুচরিতাকে একটি ফোন করে দেওঘর কেটে পড়ি। সুচরিতাই দূর পাল্লা থেকে খবরাখবর যা দেওয়ার দিয়ে দেয়।

বছর তিনেক হল স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে বসে আছি। ছেলেটা অল্প বয়সেই দাঁড়িয়ে গেছে। এক্ষুনি বিয়ে থা করতেও চাইছে না। তার মা এখন তাকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত। আমি সুতরাং নিঝঞ্ঝাট। একা একা ঘুরে বেড়ানোর আমার মস্ত মওকা। সহকর্মীরা বলেছিল, কেন শুধু শুধু যাচ্ছেন সোমেনদা, আপনাকে অন্তত এরা যেতে বাধ্য করতে পারে না। এখনও এগারোটা বছর…। আমি মুখে কিছু বলিনি। বলিনি সময় থাকতে কদর থাকতে থাকতেই কেটে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ। এ-ও বলিনি এই বিশ্রী একঘেয়েমির জীবন আমার আর ভালো লাগছে না। কোনোদিনই লাগেনি অবশ্য। ভাবিনি তো এভাবেই দিনগত পাপক্ষয়ে জীবন কেটে যাবে! কত রকম আশা-আকাঙ্ক্ষা, কত স্বপ্ন…সবই তো সংসারের চাপে জলাঞ্জলিই দিতে হয়। তবে এসব কথা বলেই বা লাভ কি! ভেবেই বা কি লাভ? তেমন কিছু হওয়ার হলে হয়তো তেমন ক্ষমতা নিয়েই জন্মায় মানুষ?

হরিসাধনবাবুকে আমার প্রথম থেকেই চোখে পড়েছিল। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি পরা মানুষ তো আজকাল তেমন একটা দেখা যায় না! তার ওপর এমন শান্ত সৌম্য ধরনের চেহারাটি। পুরুষমানুষ অথচ চাঁদের আলোর মত গায়ের রং। প্যাসেঞ্জার ট্রেন, অনবরত নামা-ওঠা, ধাক্কাধাক্কি ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে উত্তেজিত রাজনীতি, হাজারো ঢঙের হকারের চিৎকার। তারই মধ্যে যেন ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন, কিন্তু কিছু দেখছেন বলে বোধ হল না। চোখে ওটা সানগ্লাস বোধহয় নয়, ফটোক্রোম্যাটিক চশমাই। একটা আবছা আড়াল থেকে ওঁর চোখ দুটো খুবই মগ্ন, মায়াবী বলে মনে হল। আমার ছটফটে স্বভাব। মনে মনে যতই একাচোরা হই মুখে আমি খুব মিশুক। স্টেশনেই একখানা বাংলা কাগজ কিনেছিলাম, একটু পরেই পাশের ভদ্রলোকের সঙ্গে সেটা বদলাবদলি করি সেই সঙ্গে দিনকাল সম্পর্কে মতামতও। এই চা-এই চা করে বার দুই তিন লেবু-বিটনুন দেওয়া চা ও হয়ে গেল। ওঁর কিন্তু হেলদোল নেই। ট্রেনে উঠে চা-কফি খায় না এমন প্যাসেঞ্জার আমি আজও দেখিনি। এঁর কি চা টা চলে না? তাই হবে। তার কিছুক্ষণ পরেই মনে হয় ভদ্রলোক কোনো কারণে বিষণ্ণ, আত্মমগ্ন হয়ে আছেন। আপনজন কেউ মারা-টারা গেছেন হয় তো! কিংবা কারও দুরারোগ্য ব্যাধি! হয়তো ছেলের বউ কিংবা নিজের পত্নীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। এসব তো আজকাল ঘরে ঘরে। এভাবে ভাবছি দেখে নিজেই কিছুক্ষণ পরে লজ্জা পেয়ে যাই। আশ্চর্য পরচর্চার স্বভাব তো! মুখে করছি না, মনে মনে তো করছি! আপনমনে থাকা বড্ড শক্ত কাজ।

একটি হকার তখনও এক গোছা ছুরি-ছোরা দিয়ে কতরকম কাজ করা যায় তারস্বরে তার ব্যাখ্যান করছে। ওদিক থেকে ঝালমুড়ি তৃতীয়বার এসে গেল, যাদের হাতে ঠোঙা ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল এবার তাদের থেকে দাম সংগ্রহ করছে, পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে এক খদ্দেরের সঙ্গে মুড়িঅলার লাগধুমাধুম লেগে গেছে এমন সময়ে একটি অন্ধ ছেলেকে নিয়ে রোগা মুখ-চোখ-বসা এক মার্কামারা ভিখারি উঠল। উঠেই অসম্ভব চড়া সুরে পূর্ণদাসি স্টাইলে ফুকরে উঠল, ও-ও-ও-ও। ছেলেটার হাতে একটা কাঁসি, নিপুণ হাতে ব্যাটা বাজাচ্ছে সেটাকে।

এ লাইনে আসাযাওয়া করছি মন্দ দিন হল না। বাউল দেখিনি কখনও। এ-ও অবিশ্যি বাউল নয়। কিন্তু গাইছে নিখুঁত স্টাইলে। বাচ্চাটাও ধরছে মাঝে মাঝে। সরু মোটা গলার বুনুনিতে গাইছে বড্ড ভালো। টপাটপ পয়সা পড়ছে ওদের টিনের কৌটোয়, কুড়ি পয়সা, পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা, হঠাৎ দেখি লোকটার হাতে একটা আনকোরা পঞ্চাশ টাকার নোট। দিলেন আমার সামনের ভদ্রলোক। আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে একটু লজ্জা পেলেন, আশেপাশে সবাই-ই অবাক। বললেন, স্টেজে উঠতে পারলে ওর এর চেয়ে বিশগুণ তো রোজগার হতই। আমি নিজেও খুশি হয়ে দুটাকার একটা কয়েন দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকালকার দিনে ট্রেনে ভিখারিকে পঞ্চাশ টাকা! নাঃ, ভদ্রলোকের দিলের তারিফ করতেই হয়। তবে স্বভাবতই সবচেয়ে অভিভূত হয়ে গেছে ভিখারিটি। বললে, বাবু আর কী গান শুনবেন, ফরমায়েশ করুন আজ্ঞে?

উনি হাসিমুখে বললেন, কী শোনাবে বলো!

আজ্ঞে ফিলমের গান বাংলা হিন্দি…বলতে না বলতেই অন্ধ ছেলেটি গেয়ে উঠল যব ভি কোই লড়কি দেখুঁ মেরা দিল দিওয়ানা বোলে ওলে ওলে এ ওলে…তীক্ষ্ণ ধারালো গলায় পার্ফেক্ট একেবারে।

আই, এক ধমক খায় ছেলেটি। ভিখারি বলে, বলুন না বাবু রাগপ্রধান, কেসিকেল…যা বলবেন সব গেয়ে দেব।

ভদ্রলোক বললেন, থাকো কোথায়? এ লাইনে নতুন মনে হচ্ছে।

তা এক পকার নতুনই বলতে হবে, তবে আমাদের আর থাকা না থাকা, যখন সেখানে যেমন…কেসিকেল একখানা শুনুনই না বাবু। লিলুয়ার জাহাজবাড়িতে জলসা হল, তখনই তুলেছিলাম। —লোকটি অবলীলায় রেকর্ড চালাবার মতো একটা বৃন্দাবনি সারং ধরে ফেলল। উচ্চারণ এত এলানো যে কথা স্পষ্ট ধরা যায় না। বৃন্দাবন, মুরলী ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর ছেলেটিও দু-তিনখানা চালু ফিলমি গান গাইল। তারপর ওরা ভদ্রলোককে নমস্কার করে আমাদের বিদায় জানিয়ে পরের স্টেশনে নেমে গেল।

আমি বললাম, আপনাকে পঞ্চাশ টাকার গান শুনিয়ে গেল।

ভদ্রলোক একটু লজ্জা পেলেন, কৈফিয়ত দেবার সুরে বললেন, কী জানেন। গুণী মানুষ দাম চুকিয়ে দিতে না পারলে শান্তি পায় না। এই দেখুন না, একসময়ে রাজা-রাজড়া নবাব-বাদশারা দরবারে গুণীদের তনখা দিয়ে রাখতেন। ধনীদের খেয়াল মেটাতে তাঁরা তো নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। কার্পণ্য তো করেননি। সব রাজাই কিন্তু সমঝদার হতেন না।

আমি বললাম, আপনি নিজেও গুণী মানুষ, গানবাজনা করেন মনে হচ্ছে?

উনি হেসে বললেন, সে তো আমারও আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, ওই কেসটা কীসের? ভায়োলিনেরই তো?।

আমি লজ্জা পেয়ে বলি, দূর আপনিও যেমন! একটা শখ, অক্ষম লোকের একটা নেশা, যেমন এই চা সিগারেট…

তা যদি বলেন নেশা না হলে কি আর সংগীত হয়? নেশাটিই হওয়া চাই। না কি বলুন  সমর্থনের জন্যে আমার দিকে তাকান উনি।

নেশা হলেই কি আর হয়? ক্ষমতা চাই, একটু আধটু ন্যাক নয়, রীতিমতো ট্যালেন্ট। না হলে সব গুবলেট—আমি হাসি।

উনি কিন্তু কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।—কী রকম?

আমি বলি, দেখুন অল্প বয়সে অনেকেরই কোনো কোনো বিষয়ে একটু আধটু ক্ষমতা ধরা পড়ে। কেউ বাড়ির লোকেদের স্কেচ করে ফেলছে, কেউ হয়তো পাড়া ক্রিকেটে দশ রান দিয়ে তিনটে উইকেট তুলে নিয়েছে, কেউ বা আবার মান্না দে, মহম্মদ রফিকে নকল করে গাইতে পারে। এইগুলোকে সত্যিকারের প্রতিভা ভেবে তবে বাবা-মা কি সে নিজে যদি আশা করে সে একটা এরাপল্লী প্রসন্ন, কি মহম্মদ রফি, কি নন্দলাল বোস হবেই তবে খুব মুশকিল। দুরাশার খেসারত দিতে তখন সারা জীবনের সুখশান্তির দফা একেবারে গয়া।

ভদ্রলোক মুখটা নামালেন, হাতের নখগুলো যেন পরীক্ষা করছেন, তারপর মুখটা তুললেন, কোনো নির্দিষ্ট দিকে দৃষ্টি নেই, আস্তে আস্তে বললেন, ঠিকই, ঠিকই…। কিন্তু কী করে এই তফাতটা ধরা সম্ভব বলুন তো! অনেকেই দেখেছি, ছোটোতে আশ্চর্য ক্ষমতা দেখায়, সত্যিকারের খাটাখাটনি মানে যাকে বলে সাধনা সেটা ঠিকমতো করে গেলে…।

কথাটি উনি শেষ করলেন না।

প্রতিভা মানে যে নিরানব্বই ভাগ ঘাম ঝরানো, আর এক ভাগ মাত্র প্রেরণা কি ক্ষমতা…এ তো সত্যিই অনেকেই বলে থাকেন–আমারও মনে পড়ে।

ধরুন সংগীত-বাদ্যে বড়ো বড়ো ওস্তাদদের অনেকের পরিশ্রমের কথা তো আমরা শুনেইছি। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, আলি আকবর খাঁ সাহেব, বিলায়েৎ খাঁ সাহেব এঁদের পরিশ্রম তো অমানুষিক—উনি বললেন।

আমি যোগ করি, বিজয় মার্চেন্ট শুনেছি আয়না মোড়া ঘরে সারারাত শ্যাডো প্র্যাকটিস করতেন। তবে না পার্ফেকশন।

উনি বললেন, এঁরা সফল হয়েছেন তাই এঁদের নাম শুনি। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, কত মানুষ আছেন যাঁরা অতটাই পরিশ্রম করেছেন। ক্ষমতাও ছিল। কিন্তু কী যেন একটা ছিল না তাই…এখন কী সেই জিনিস যাতে প্রতিভা ও ন্যাক-এ তফাত করে? কী করে বোঝা যাবে?

আমি জবাব দেবার চেষ্টা করলাম না। কেন না জবাব তো আমার জানা নেই। উপরন্তু দুজনেই একই প্রশ্নের জবাব খুঁজছি! আমার নিজের ছেলের কথা মনে হল। মাত্র সাত বছর বয়সে ছেলেটা দিব্যি দাবা খেলত! অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন—ওকে তৈরি করো। খেলা শেখাও, ক্লাবে পাঠাও, প্রতিযোগিতার নাম দাও। আমি শুনিনি। রমু ঠিক আর পাঁচটা ছেলের মতো পড়েশুনে খেলে-ধুলে বড়ো হয়েছে। স্ত্রীকেও সাবধান করে দিয়েছিলাম, খবর্দার ওর মাথায় দাবার ভূত চাপিয়ো না। খেলছে খেলুক। কিন্তু মাথায় যেন পোকা না ঢোকে যে ভবিষ্যতে ওকে গ্র্যান্ডমাস্টার হতেই হবে।

ছেলের বেলায় সাবধান হতে পেরেছি। কেননা সুচরিতার গল্পটা আমার জানা ছিল। আমার সেই মামাতো বোন যার শ্বশুরের বমপাস টাউনের বাড়িতে আমি বেড়াতে যাচ্ছি। সুচরিতার নাচ-গান দুটোতেই স্বাভাবিক পটুতা ছিল। চলা ফেরায় চমৎকার একটা ছন্দ। এর ওর দেখে এমন সুন্দর নাচত, যে প্রথম সুযোগেই মামা-মামিমা ওর নাচ শেখার বন্দোবস্ত করলেন। এটা ওটা শিখে ভরতনাট্যম শুরু করেছিল। প্রচুর পরিশ্রম। ওরও, ওর মা মানে আমার মামিমারও–সেই কোন রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট থেকে টানতে টানতে ডোভার লেন। সপ্তাহে তিন দিন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। গুরু বদল করা হল। নতুনজন বললেন, এ কী! ও নাচবে কি মা! ওর পা যে ভেতর দিকে সামান্য বাঁকা। এ রকম শারীরিক ত্রুটি নিয়ে নাচের পেছনে সময় নষ্ট না করাই ভালো। ভরতনাট্যমও হল না, ওর স্বাভাবিক ছন্দটাও গেল। ওরা তখন ঠিক করলেন ওকে গান শেখাবেন। ভোরে দুঘন্টা, সন্ধের দুঘন্টা বাঁধা রেওয়াজ। নামকরা শিক্ষক। সুচরিতা এখনও ছোটোখাটো পারিবারিক অনুষ্ঠানে গান করে থাকে। বিয়ের বাসর, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন…। ও আমাদের পরিবারের লতা মঙ্গেশকর ধরুন। কিন্তু অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও ও এর চেয়ে বেশি কিছু আর করতে পারেনি। নাম-যশ-প্রতিষ্ঠার কথা বলছি না। স্রেফ গানের গুণাগুণের কথাই বলছি—জানো সোমেনদা— আমাকে একদিন দুঃখ করে বলেছিল, কত চেষ্টা করি ঠিক যেন মনে হয় সামনে একটা খাড়া পাঁচিল, সেটা আর কিছুতেই টপকাতে পারি না। এ যে কী কষ্ট। নিঃশব্দে কাঁদছিল ও। কী সান্ত্বনা দেব ওকে!

কপাল, বুঝলি, সুচি, কপাল!

বাজে কথা বোলো না। আমার এটুকুই ক্ষমতা ছিল তাই এটুকুই হয়েছে। বড়োরাই আমাকে মিসগাইড করলেন—এত ভালোগাস, তত ভালো গাস। তত ভাল গলা। আমার গাইতে ভালো লাগত। আমি তো আমার সীমার কথা জানতাম না। জানার কোনো দরকারও ছিল না। তা না এই রেওয়াজ, সেই ট্রেনিং। হুঁঃ।

বলছিস কী রে? ট্রেনিংগুলোর মধ্যে দিয়ে তুই কত শিখেছিস বল তো! এসব গুরুমুখী বিদ্যা। না শিখলে তাল, লয়, রাগ-রাগিণী, রাগের চলন এসব কিছুই জানতে পারতিস না।—এটা আমি ওকে ভোলাবার জন্যে বলিনি। সত্যি যা মনে করি তাই বলেছি। নিজে না-ই হতে পারলাম বড়ে গোলাম, ভীমসেন, হবার চেষ্টা করছি বলেই তো তাঁদের আরও ভালো বুঝতে পারি। তবে এ সবে সুচরিতা সান্ত্বনা পেত না। জলসা-কনফারেন্সে যাবার অভ্যেসটাও ওর আস্তে আস্তে চলে গেল। টিকিট কেটে আনলে বলত, দূর আমার ভালো লাগে না। যা আমি কিছুতেই গলায় তুলতে পারছি না, অন্য একজন অবলীলায় তা করে দিচ্ছে শুনলে আমার কেমন যন্ত্রণা হয়। হিংসুটে বলিস আর যাই বলিস।

একটু বেশি বয়সেই বিয়ে হয়েছে সুচরিতার। তিরিশ-টিরিশ। এতগুলো বছর। বেচারি খালি গান নিয়েই পড়ে ছিল। ব্যাঘাত হবে বলে বিয়েতে রাজিই হচ্ছিল না। কে জানে সুচরিতার এখনও সেই কষ্ট আছে কিনা! হয়তো ছেলে মেয়ে স্বামী সম্পদ এসব পেয়ে ভুলে গেছে। কিংবা হয়তো ভোলেনি। ভোলা যে শক্ত সেটুকু তো আমি বুঝিই।

যাক, এইভাবেই হরিসাধনবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। দুজনেই দেওঘরে নামি। আমি চলে যাই সাইকেল রিকশাতে বমপাস টাউন। উনি বাস ধরে চলে যান মধুপুর। যাবার সময়ে বললেন, বাড়ির ঠিকানাটা আপনাকে দিয়ে রাখলাম। যদি ঘুরতে ঘুরতে একবার গিয়ে পড়েন, আমার তো ভালো লাগবেই, একটু থেমে দৃঢ়ভাবে বললেন, আপনারও লাগবে।

ভদ্রলোককে আমার ভালো লেগেছিল বললে কম বলা হবে। যেন একটা টান। অনেক দিনের জমানো টান। আমার এই বাহান্ন-তেপ্পান্ন বছর বয়সের অবসরপ্রাপ্ত গেরস্থ জীবনে নতুন করে যে আর কিছু পাবার নেই তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে! যে নিস্পৃহ নিষ্ক্রিয় ধরনের মন উত্তরষাটে আসার কথা, তা গ্রহের ফেরে উত্তর পঞ্চাশেই আমার এসে গেছে। এদিকে বনং ব্রজেৎ জাতীয় কোনো তাগিদও মনের মধ্যে টের পাই না। চারদিকে যেসব উপকরণ, ঘটনা, সম্পর্ক ছড়িয়ে আছে তার থেকেই আমার ব্যস্ত থাকার, ভালোলাগার জিনিসগুলো খুঁজে নিতে হয় এখনও। একমাত্র এই বাজনা। বাজনাটুকুতেই আমার নিজস্ব কিছু বাড়তি আনন্দ যা আমি অন্য কিছুতেই আর পাই না। এক সময়ে খুব বাজাতাম। বাইশ-তেইশ বছর বয়স যখন, তখন পাড়া বেপাড়ায় জলসা হলে উদ্বোধনী সংগীতের আশেপাশে উদীয়মান ভায়োলিন শিল্পী সোমেন্দ্রনাথ সরকারের নামটা থাকত। তারপরে জায়গা হল সংগতিয়া হিসেবে। কোথায় বিরহ, বিচ্ছেদ, মৃত্যুর সময়ে করুণ এফেক্ট দিতে হবে। নৃত্যনাট্যে, নাটকে। কখনও কখনও ফিলম ওসব জায়গায় আমার ডাক পড়ত। কিন্তু একক স্বাধীন শিল্পী হিসেবে বাজাবার আর সুযোগ পাইনি। তা নিয়ে আমার অবশ্য কোনো নালিশ নেই। কিন্তু সেরকম বাজাতেই বা পারলাম কই? ওই সুচরিতার মতোই আমি আমার পরিবারের ভি.জি যোগ। আমার কথা সুচি কতটা কী বুঝতে পারে জানি না, কিন্তু ওর কথা তো আমি সেই জন্যেই অত ভালো বুঝতে পারি। তা ছাড়া, এখনও বাজনা নিয়ে কেউ কোনোরকম কটাক্ষ করলে আমার বড্ড লাগে। আমার স্ত্রী করে। ওঃ, ওই তোমার প্যাঁও প্যাঁও আরম্ভ হল—একদিনের জন্যে অন্তত রেহাই দাও না। ছেলে কিছু বলে না, বলেনি কোনো দিন। কিন্তু ওর বন্ধুরা হয়তো এক দঙ্গল বাড়িতে আড্ডা মারতে এসেছে—মেলোমশাই, আপনার সেই ভায়োলিনটা? আছে এখনও। যেন আমিও প্রাগৈতিহাসিক, আমার ভায়োলিনও প্রাগৈতিহাসিক। কিছু বলি না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ রাগ হয়, যে রাগ কষ্টেরই ওপিঠ। তাই এইরকম যখন বেরিয়ে পড়ি, বেশির ভাগ সময়েই যন্ত্রটা আমার সঙ্গী হয়।

দীর্ঘ দশ এগারো কি তার চেয়েও বেশি সময়ের মধ্যে এই প্রথম আমার কারও সম্পর্কে কৌতূহল হল। একটা আকর্ষণই বলব। ভদ্রলোক বলে গেলেন, আমার ভালো লাগবে আপনারও লাগবে—কী রকম একটা প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন কথাটা। আমি কি তাহলে এই উত্তর-পঞ্চাশে একজন সমমনস্ক বন্ধু পেতে চলেছি?

দেওঘরে বহুবার এসেছি। যখন তখন আসি বমপাস টাউনের ফুলে-ভরা মালঞ্চমালা নামের বাংলোটায়। দেশি কেয়ারটেকার বংশীধর ও তার পরিবার আমাকে আকণ্ঠ চেনে। কখন কী দরকার বলবার প্রয়োজন পর্যন্ত পড়ে না। ভোরবেলায় বাংলো থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে ক্লক-টাওয়ারের মোড় পর্যন্ত চলে আসি। তারপর আরেকটি সড়ক ধরে উইলিয়ামস টাউনের পথ ধরে চলে যাই রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের হাতা পর্যন্ত। এবার আস্তে আস্তে ফিরি। ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। বংশীধরের চা তৈরি। চা এবং আনুষঙ্গিক। খাওয়াদাওয়া সেরে একটা বই নিয়ে আসি। বাংলা আর ইংরেজি কিছু পেপারব্যাক এখানে থাকেই, দু একখানা সঙ্গে আনি কি না আনি। পড়তে পড়তে ক্যানভাসের ইজিচেয়ারে চোখ জড়িয়ে আসে, মধুফুলের গন্ধমাখা হাওয়া বয়। এই চটকাটুকু ভাঙলে তবে চান। সে-ও বেশ সময় নিয়ে। এসব অঞ্চলের জলে হাওয়ায় কেমন একটা অপাপবিদ্ধ, সোঁদা সোঁদা টাটকা গন্ধ থাকে। শুধু নিশ্বাস নিতেই একটা অগাধ আরাম। বংশীধরের বউয়ের বাঙালি রান্নাও ঠিক বাঙালি রান্নার মতো হয় না। এই তফাতটুকুও আমার মন্দ লাগে না। অচেনার সঙ্গে বসবাসের রোমাঞ্চের এটাও যেন একটা অঙ্গ। আমার গিন্নি বলেন, দূর! এটা কি বাঁধাকপি হয়েছে না গোরুর জাবনা হয়েছে? মিষ্টি পড়েনি। কষা হয়নি। পাতাগুলো ড্যাবড্যাব করছে,! ও পার্বতী, এ কেমন বেঁধেছ? আমার কিন্তু এইরকমই ভালো লাগে। এখানে দুপুরটায় খুব পাখি ডাকে। এদের ভিটেয় দেখি বারোমাসই ঘুঘু চরে। কিন্তু ভিটেমাটি চাটি হয়ে যাবার কোনো লক্ষণ এখনও পর্যন্ত তো দেখি না! সন্ধেবেলা একটু বেড়াই। কাছাকাছি। কিন্তু অন্ধকার একটু গাঢ় হতে না হতেই আমার যন্ত্র আমার টানতে থাকে। চিবুক দিয়ে পরম সোহাগে যন্ত্র চেপে ধরে ছড় চালাই, এখানে কেউ শোনার নেই। গাছগুলো ছাড়া। বংশীধরের ফ্যামিলি হয়তো শোনে কিন্তু তারা তো বিচার করে না। সুতরাং এইখানেই সোমেন্দ্রনাথ সরকার উদীয়মান বেহালা-শিল্পীর প্রকৃত মুক্তি। এই অস্তায়মান কালে।

দিন দশেকের কড়ারে এসেছি। দশদিনই যে পুরোপুরি থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।

আবার দশ দিন পেরিয়ে গেলেও কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু এবার দিন পাঁচেক কাটতে না কাটতেই ভেতরে একটা পালাই পালাই রব টের পাই। এমন নয় যে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু হেথা আর নয়। মন যখন ভীষণ অস্থির হয়ে থাকে তখনও এইরকম হয়। আমার আবার মন উচাটনের কারণ কী? নিজের মনের ব্যবহারে নিজেই অবাক হই। অন্ধকার বারান্দায় জোনাক জ্বলা দেখতে দেখতে ভাবি। তারপর আস্তে আস্তে বোধোদয় হয় যে একাকিত্ব আর ভালো লাগছে না। সঙ্গপিপাসা পাচ্ছে। যাচ্চলে! যে একাকিত্বর জন্য তিনশো উনত্রিশ কিলোমিটার উজিয়ে আসা সেই একাকিত্বই আউট? সঙ্গপিপাসা ইন? আরও ভাবি। বাজাতে বাজাতে, বেড়াতে বেড়াতে ভাবি। অবশেষে ঘুমোতে ঘুমোতে টের পাই সঙ্গপিপাসার দোষ নেই। আসলে পছন্দসই সঙ্গী পাবার একটা সম্ভাবনাতেই এমন আকুলিবিকুলি। হরিসাধন লাহিড়িমশাই আমাকে টেলিপ্যাথিক ডাক পাঠাচ্ছেন। সুতরাং আর দেরি করি না, সংকোচও নয়, ঝুলি কাঁধে, বেহালা বগলে ওল্ড মিনা বাজার স্ট্যান্ড থেকে মধুপুরের বাস ধরি।

জসিডি এসেছি, গিরিডি এসেছি, কিন্তু মধুপুরে আমি এই প্রথম। জায়গাটা দেখলাম স্টেশন রোড় বাদ দিলে তেমন ঘিঞ্জি নয়। প্রকৃতি তো একরকম হবেই। কিন্তু মধুপুর এখনও অনেক ফাঁকা, স্বাভাবিক। বিশেষ করে এই হল্লাটার এলাকাটি। হল্লাটারের মোড় পেরিয়ে বাহান্ন বিঘে শুরু। রাস্তার ধারে বাড়ি টাড়িগুলোর বেশিরভাগই ভগ্ন দশা। তবু তারই মধ্যে কোথাও একটা-দুটো পলাশ মেটে রঙের ফুলে আকাশ আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। দু-তিনটে য়ুক্যালিপ্টাস যেন ঠিক রুপোর থাম। ওই তো মাঝখানে বিরাট ইঁদারা আমার প্রথম ল্যান্ডমার্ক। কে টিলি সাহেবের বাংলোর নাম করি। অমনি কেটলি সাহেব? বলে শনশনিয়ে প্যাডল মেরে আমার পৌঁছে দেয় রিকশাওয়ালা। চমৎকার কাচটাকা বাংলোটি। ফুলে ফুলে ভরা বাগান। তবে আমার গন্তব্য তো কেটলি সাহেবের বাংলো নয়! তার পাশে মধুপুরের লালধুলো মাখা ঈষভগ্ন মুরারিকুঞ্জ। পড়ন্ত রোদে গায়ে পাঞ্জাবি চড়াতে চড়াতে বেরিয়ে আসছেন হরিসাধনবাবু। স্মিত হেসে বললেন, এলেন তাহলে?

এত্তেলা পাঠালেন। কী করি বলুন?

স্নানাহার হয়েছে?

ও সব হাঙ্গামা তো চুকিয়েই বেরিয়েছি। বাঃ বেশ জায়গাটি।

এই মুরারিকুঞ্জ কিন্তু মোটেই আমার বমপাস টাউনের মালঞ্চমালার থেকে কোনো অংশেই ভালো নয়। তেমন দেখাশোনা হয় না এটা স্পষ্ট। কিন্তু আমার কেমন মনে হল বাড়িটির একটা বিশেষ জলহাওয়া আছে যেটা আমার পক্ষে বেশ স্বাস্থ্যকর। যেন অনেকক্ষণ ধরে তার বাঁধতে বাঁধতে এইমাত্র সবগুলি সুরে বলে উঠল। হরিসাধনবাবুর ব্যক্তিত্বের জন্যই এটা হল কিনা বলতে পারি না। সন্দেহ নেই ভদ্রলোকের একটা প্রভাববলয় গোছের কিছু আছে। আমার মন আমার ভেতরের চাহিদাগুলোর সঙ্গে মানিয়েই যেন উনি তৈরি। ভালো। অনেক রকমের অভিজ্ঞতাই তো হল জীবনে! এবার এই আধবুড়ো বেলায় আর এক অপরিচিত আধবুড়োর জন্যে টান! জীবনে কখনও তেমন সত্যিকারের বন্ধু পাইনি। আমার মতো গুজগুঁজে লোকের নাকি বন্ধু হয়ও না, এ কথাও একাধিক প্রিয়জনের কাছ থেকে শুনেছি। তা এইবারে আমার সেই বন্ধুত্ব লাভের ফাঁকা কোটাটা বোধহয় পূর্ণ হতে চলল।

বুধুয়া…ভারী গম্ভীর স্নেহমাখানো গলায় উনি ডাকলেন।

একটা অল্পবয়সি সাঁওতাল ছেলে এসে দাঁড়াল। ঠিক একটি বাংলা লোককথার রাখাল ছেলে। গোরু তাড়াবার পাচনবাড়ি আর দুপুর যাপনের বাঁশের বাঁশিটি হাতে ধরিয়ে দিলেই হয়।

দ্যাখ, ইনি আমার বন্ধুলোক। মালপত্র ভেতরে নিয়ে রাখ। কলঘরটা দেখিয়ে দে আর ভালো করে চা কর।

আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, যান হাত মুখ ধুয়ে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।

দাওয়ার ওপর দুটি বেতের গোল চেয়ার। ইদারার চমৎকার জলে হাত মুখ ধুয়ে দাওয়ায় এসে দ্বিতীয় চেয়ারটা দেখাই, বলি, কী ব্যাপার! হাত গুনতে জানেন নাকি?

উনি বললেন, প্রতিবেশী দু-একজন এলে আসেন। আমরা অনেক দিনের বাসিন্দা তো? তবে—আমার দিকে চেয়ে বললেন—মাথার মধ্যে একটা অন্য প্রতীক্ষা ছিলই, বুঝলেন তো? …তা আর বুঝিনি, না বুঝলে আর এতটা পথ বাসের ঝাঁকুনি খেতে খেতে আর ধুলো মাখতে মাখতে চলে আসি?

দিনগুলো অতঃপর চমৎকার কাটতে থাকে। অভ্রের কুচি ছড়ানো কালো আকাশের তলায় কখনও বসে, কখনও হাঁটতে হাঁটতে কথা হয়। অনেক রাতে চাঁদ ওঠে। পুরো রাস্তাটা, রাস্তার মোড়ে যুগল শিরীষ, টিলি সাহেবের কাচের বাংলো কিছুই তখন আর এ জগতের থাকে না।

হরিসাধনবাবু মানুষটি অকৃতদার। ঠাকুরদাদার কয়লাখানি ছিল। সোনার চামচ মুখে জন্মেছিলেন অর্থাৎ। কিন্তু সে সব ওঁর বাবার আমলে চুকেবুকে যায় যা বুঝলাম। বাবা মানুষটি আলালের ঘরে দুলাল ছিলেন। অতি শৌখিন, বিলাসী, অলসও বটে। নিজের বাবার দোষ-ঘাটের কথা আর উনি স্পষ্ট করে কী বলবেন। কিন্তু বাবার রকমসকম দেখেই বোধহয় উনি বিয়ে থার মধ্যে যাননি। এটা অবশ্য আমার অনুমান। এক ভাই এক বোন। বোনের স্বভাবতই বিয়ে হয়ে গেছে। কলকাতা আসানসোলে খান দুই বাড়ি আর এই মুরারিকুঞ্জ, এটুকুই এঁর ভাগে পড়েছে। এভাবে খবরগুলো জানতে পারিনি অবশ্য, কোনো কৌতূহলও দেখাইনি। কথায় কথায় একটু একটু করে খবরগুলো প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ঠাকুরদাই ছিলেন মুরারিমোহন। ঠাকুরদার ওপর হরিসাধনবাবুর অগাধ শ্রদ্ধা। এই ঠাকুরদা এবং মা ওঁকে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে বড়ো করেছেন। তবে জীবনে কাজ বলতে উনি দুটি করেছেন। এক দেশবিদেশে ঘুরে ঘুরে গুণীদের গানবাজনা শোনা এবং সে নিয়ে লেখালেখি। আর দ্বিতীয় হল—সেতার বাজানো। সংগীত নিয়ে লেখাজোখা করেছেন। আমার খুব শখ এ ধরনের বই পড়ার। কই আমি…আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। হরিসাধন লাহিড়ির লেখা কোনো বইয়ের কথা আমি মনে করতে পারলাম না।

উনি কুণ্ঠিত গলায় বললেন, আমার আবার লেখা, তাও আবার আপনার চোখে পড়বে! অখ্যাত প্রকাশক, যেমন তেমন করে ছেপেছে। ভাষা-ভাব এসবের কী-ই বা আমি জানি। তবে কী জানেন? অনেক অখ্যাত কিন্তু খানদানি গুণীর কথা আছে বইগুলোতে ডায়েরির মতো করে। সেগুলো সংগীতপ্রিয় মানুষের কাছে…

আছে আপনার কাছে…

এখানে নেই। কলকাতার বাড়িতে আছে।

আমি ভাবছিলাম। ডায়েরির মতো করে লেখা দেশবিদেশের ভ্রমণকাহিণি তার মধ্যে গান, গুণী…কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে ব্যাপারটা! বলি, আচ্ছা, সেই মহারাষ্ট্রর গনেশপুরী নামে একটা গ্রামে নারায়ণ কেরকার বলে এক সরোদিয়া…

আপনি পড়েছেন?

আমি বলি, দাঁড়ান দাঁড়ান পণ্ডিত গম্ভীরনাথ সেতারের সিদ্ধশিল্পী যাঁকে শেষ বয়সে পা জখম হয়ে যাওয়ায় লোকে ল্যাংড়া পণ্ডিত বলত?

এইবার হরিসাধনবাবু জোড় হাত কপালে ঠেকালেন, বললেন, আপনি পড়েছেন তাহলে?

আমি বলি, হ্যাঁ, আমার মামাতো বোন সুচরিতার বাড়িতে হঠাৎ হাতে এসেছিল, কিন্তু সে তো আপনার লেখা বলে…

উনি হেসে বললেন, মাথা খারাপ? নিজের নামে লিখি কখনও! পর্যটক নাম নিয়ে লিখেছিলাম। যাক আপনি পড়েছেন… সমস্ত মুখে ওঁর খুশি ছড়িয়ে পড়ল, বললেন, আপনার সঙ্গে তাহলে শেয়ার করা যায়।

আপনার কাছে নিশ্চয়ই কপি আছে। এবার ফিরে গিয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। আর একবার ভালো করে পড়ব। খামচা খামচা পড়েছি তখন, ভালো লাগছিল খুব।

যাঁদের কথা লিখেছি তাঁরা সব অখ্যাত, কিংবা নিজেদের এলাকার মধ্যে একটা ছোট্ট মহলে পরিচিত। শেখান, বাজান বা গান, অত নাম ডাক পয়সাকড়ি কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। তাঁদের কথা জানতে পেরেছি এটাই লাভ। এটাই ও লেখার আসল মূল্য।

আমি বলি, না, না খুব ডিটেইলে আমার মনে নেই ঠিকই। কিন্তু এই কেরকার, ওই গম্ভীরনাথ, কতকগুলো সুন্দর টুকরার মতো গেঁথে আছে মনে। আচ্ছা সত্যি ওঁকে ল্যাংড়া বলত বলে উনি রাগে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন? আচ্ছা ছেলেমানুষ তো!

তাই বটে—হরিসাধনবাবু হাসলেন, গানের অগাধ পণ্ডিত হলে কী হবে, ছেলেমানুষের মতোই মান-অভিমান ছিল। আসলে দেখতে খুব সুপুরুষ ছিলেন তো! টকটকে রং, কাটা কাটা নাক মুখ, আকৰ্ণবিস্তৃত চোখ। রুপোলি চুল একটু ঢেউ খেলানো, দীর্ঘকায়। কপালে সিঁদুরের ফোঁটাটি পরে যখন আসরে বসতেন মনে হত একটি লম্বা প্রজ্বলিত মোমবাতি। রূপ নিয়ে ছিল খুব গর্ব। পাটনায় থাকতেন। গঙ্গায় চান করতে গিয়ে একবার ভীষণ পড়ে গেলেন। একটি পা হাঁটু থেকে কাটা গেল। আর যায় কোথা! একটা ঝোপড়পট্টির পাশে থাকতেন, সেখানকার বাচ্চারা ল্যাংড়া পণ্ডিত ল্যাংড়া পণ্ডিত বলে অস্থির করে দিতে লাগল। ক্রমে বড়োরাও ধরল। প্রথমটা ছেলেদের সঙ্গে রাগারাগি, চ্যাঁচামেচি। তারপর একদিন এক বস্ত্রে গৃহত্যাগ করে গেলেন। লিখে গেলেন ম্যায় যা রহা হুঁ। বাস।

আচ্ছা! একেবার নিরুদ্দেশ?

নিজের লোকেদের কাছে তাই। এসে উঠলেন আসানসোল এক রইস ভক্তর কাছে। তাঁর সঙ্গে কড়ার হল, কাউকে কোনোমতেই তাঁর খবর জানাতে পারবেন না। আসরে উনি ক্রাচ নিয়ে কিছুতেই উঠবেন না। সে নাকি বহোৎ শরম কি বাত! তবে ভদ্রলোকের নাতিকে উনি গড়ে পিটে নিজের মতো ওস্তাদ বানিয়ে দেবেন। এই অনর্থক ইগোর আবদার মেটাতেই তাঁর আশ্রয়দাতা গুণগ্রাহী ভদ্রলোক অগত্যা পণ্ডিতজিকে নিয়ে তুললেন নিজের এক নির্জন বাগানবাড়িতে। আর নাতিটিকে ভরতি করে দিলেন পণ্ডিতজির খিদমতগারি বলুন খিদমতগারিতে, শাগরেদি বলুন শাগরেদিতে।

এবং আপনিই সেই নাতি।

তবে? হাসিমুখে বললেন উনি, এবং সেই বাগানবাড়িটিই এই মুরারিকুঞ্জ।

বলেন কী—আমার শরীরের মধ্য দিয়ে কেমন একটা রোমাঞ্চের শিরশিরানি বয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি সংগীতের অজানা ইতিহাসের এক অজ্ঞাতবাসের পাতায়?

হরিসাধন বললেন, আমাদের কালী কুণ্ডু লেনের বাড়িতে, আসানসোলের বাড়িতে কত জলসা বসেছে। ওই পরিবেশ, তারপরে আরাম-বিলাস, এতে বাবার অল্প বয়সটায় খুব ক্ষতি হয়ে যায়। ঠাকুমা এ জন্য ঠাকুরদাকেই দোষ দিতেন। আমার ছোটোবেলায় এঁদের এমন ঝগড়া আমি বহু শুনেছি। ঠাকুরদা বলতেন, যা আমার অমৃত, তা যে আমার ছেলের গরল হয়ে দাঁড়াবে, কী করে বুঝব বলল। মূলত বাবার কাছ থেকে সরিয়ে রাখবার জন্যই উনি আমাকে এই মধুপুরের মুরারিকুঞ্জে পাঠিয়ে দেন। ইচ্ছে ছিল বাজনটাও ভালো করে শিখি। সেই বছর আষ্টেক বয়সেই আমি সেতার-টেতার ভালোই হ্যান্ডল করতাম নাকি! মা-ও আসতেন। কিছুদিন থেকে চলে যেতেন। এখানে আমার একজন গৃহশিক্ষকও থাকতেন। তাঁরই কাছে পড়াশোনা করতাম। আর…

বলুন। থামলেন কেন? অমন গুরুর একটিমাত্র শাগরেদ।

ও কথা বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না… বলে উনি বিষণ্ণ মুখে এমন করে চুপ করে গেলেন যে সে নীরবতার সম্মান না রেখে আমি পারলাম না।

এসব কথা অবশ্য এক দিনে হয়নি। হরিসাধনবাবু কথা বলেন খুব থেমে থেমে, প্রত্যেকটি কথা যেন অনিচ্ছুক স্বরযন্ত্রের মধ্যে থেকে টেনে বার করছেন। হা-হা করে উনি হাসতেও জানেন না। ওঁর সংস্পর্শে আমারও ফড়ি, অযথা কথা, চ্যাঁচামেচি এসব বন্ধ। ভোরবেলা আমি অভ্যাসমতো একটু বেড়িয়ে আসি। চমক্কার জায়গাটা। প্রাণভরে নিশ্বাস নিই। বুকে যেন নতুন করে জোর আসে। উনি কোনোদিনই আসেন না। অনেক ভোরে ওঠেন টের পাই। নিস্তব্ধ জায়গা একটু হাঁটাচলার শব্দ, কাশির আওয়াজ এসব স্পষ্টই বোঝা যায়। কিন্তু আমি যখন বেরোই, তখন ওঁর ঘরের দরজা দৃঢ়ভাবে বন্ধ থাকতেই দেখি। কী করেন কে জানে! সাধনভজন হতে পারে। কিন্তু উনি যখন বলেন না, আমি তখন জিজ্ঞেস করা সমীচীন মনে করি না। যখন ফিরি, তখন উনি স্নান সেরে ফিটফাট তৈরি। ভেতর দিকের দাওয়ায় দুটি ফোল্ডিং চেয়ার পড়ে, একটি ফোল্ডিং টেবিল। তার ওপরে চা এবং জলখাবারের ব্যবস্থা। তখন চা খেতে খেতে গল্প হয়। আগের দিনের কাগজটা হাতে পাই তখন। রাজনীতির খবর নিয়ে দু-একটা মন্তব্য, অন্য কোনো ভালো নিবন্ধ থাকলে দুজনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ি। উনি হয়তো বললেন, থার্ড লেটারটা পড়ুন দাদা, ঠিক বলেছে।

আমি হয়তো বললাম, অ্যাঙ্করটা দেখেছেন? ভালো লিখেছে আজ।

এডিটোরিয়ালের পাতায় দিল্লি স্কুল অব ইকনমিকস-এর অধ্যাপক লিখেছেন পোস্ট কোল্ড ওয়্যার ইকনমিকস নিয়ে, দেখুন পড়ে।

উনি এক সময়ে নিজের ঘরে ঢোকেন। আমি বই-টই পড়ি, ভায়োলিনটা কেস থেকে বার করে অযথাই মুছে মুছে চকচকে করি, ছড়টাতে রজন লাগাই। বাজাতে হাত ওঠে না। অতবড়ো উস্তাদের শাগরেদ! বাপরে! কিন্তু কোনোদিনই ওঁকে বাজাতে শুনি না।

সেদিন কথায় কথায় ধরেই পড়লাম, ঘরের কোণে যে যন্ত্রটি কাপড়মোড়া শুইয়ে রেখেছেন, ওকি পুজো করার জন্যে দাদা?

উনি চমকে উঠে বললেন, ঠিক, ঠিকই বলেছেন। পুজো ছাড়া আমার মতো অভাজন আর কী করতে পারে বলুন!

এ কথা কেন বলছেন?

আরে দাদা আমি কি পণ্ডিতজির যোগ্য শিষ্য? একটু আধটু স্বভাবপটুত্ব ছিল। কিন্তু তখন অল্পবয়স, খেলাধুলো, গল্পের বই, সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে হুটোপাটি এসবই ভালো লাগত। পণ্ডিতজি ঘন্টার পর ঘন্টা সরগম সাধতেন। একটা পালটা চলছে তো চলছেই। সারে রেগা গামা গামাগারেসা। আমার মতো মুকখুর তা পোষাবে কেন? অভিমানও হত খুব। কলকাতায় সবাই কত মজা করছে, সিনেমা থিয়েটার খেলা। ক্রিকেট-ফুটবলের পোকা ছিলাম তো। রাগেও অনেক সময় গোঁয়ারের মতো ঘাড় গুঁজে বসে থাকতাম। কিছুতেই সেতার ধরব না।

বকুনি খেতেন না? এঁরা তো খুব কড়া ধাতের মানুষ হন শুনেছি।

উনি তা ছিলেন না। ওঁর কাছে আমার সাতখুন মাফ। তা ছাড়া আমি কিন্তু ওঁর সেবা করতে খুব ভালোবাসতাম। পা দাবানো, মাথা টিপে দেওয়া। সুড়সুড়ি খেতে ভীষণ ভালোবাসতেন। বলতেন, আমি যেখানেই থাকি, তোকে আমি প্রাণভরে আশীর্বাদ করব বেটা। তুই যদি চাস তো সব পাবি।

তবে? কিছু তো শিখেছেন! অত ছোটো থেকে অমন একটা সঙ্গ! বাজনাও তো শুনেছেন প্রচুর!

তা শুনেছি। দিনে রাতে, দুপুরে বিকেলে। এই সেতার আর আমি এই দুটি ছিল ওঁর অবলম্বন। কখনও বাজাতেন ঝড়ের মতো, কখনও যেন ভারী জলস্রোত, পুরো ওজনটা নিয়ে বইছে। কখনও আবার ফোয়ারার মতো ঝরে পড়ছে। সেসব শুনে আমার মতো বালকও মন্ত্রপড়া সাপের মতো নিশ্ৰুপ হয়ে যেত। কিন্তু শিখতে হলে তো আমাকেই কসরতটা করতে হবে। তাতে আমি নারাজ। সেতার ধরেই বলব, তোমার মতো হচ্ছে না যে পণ্ডিত দাদু  আরে! একদিনে কি হয় বেটা! আমি তো পঁচাশ বরস সাধনা করে একটুকু পেয়েছি। ব্যাস আমার ধৈর্যচ্যুতি হয়ে যেত। উনি আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন, আমাদের ঘরের লড়কা হলে তোকে মেরে লাট করে দিতাম। কিন্তু তুই যে গানের ঘরের লড়কাই নয় রে বেটা।

এভাবে চলতে চলতে শেষে একদিন আমাদের মধ্যে চুক্তি হয়। দুজনেই দুজনকে বাজনা শোনাব। সত্যি বলতে কী এ কদিন না বাজিয়ে বাজিয়ে আমার হাত যেন নিশপিশ করছিল। ঠিক আছে ধরেই ফেলি।

তখন সন্ধে সবে গাঢ় হতে শুরু করেছে, আমি লাজলজ্জা ভুলে একখানা ইমন ধরি। ইমন বড়ো সুন্দর রাগ। কোনোক্রমেই ভালো হচ্ছে না, কিছুতেই মেজাজ আসছে না, নিজের ওপর বিশ্বাস নেই? একখানা ইমন ধরে ফেলুন। ইমন নিজেই আপনাকে গড়গড়িয়ে টেনে নিয়ে যাবে। খিচ নেই, খোঁচ নেই, বড়ো স্বচ্ছ অথচ মায়াময়। তাই আমি মনের সুখে ছড় চালাই। ইমনে ভরিয়ে তুলি মুররিকুঞ্জের দাওয়া। মিনিট পঁয়তাল্লিশ, আর কত আলাপ করব? খালি পুনরাবৃত্তিই হয়ে যায়। যন্ত্র কোলের ওপর নামিয়ে রাখি।

মগ্ন হয়ে শুনছিলেন হরিসাধনবাবু। এবার যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে বললেন, বাঃ!

আমি কিছু বলি না। চড়ার দিকে আমার তারের আওয়াজে কেমন কর্কশতা এসে যায়। অনেক চেষ্টা করেছি, দামি বিদেশি তার করিয়েছি, কিন্তু নিটোল মধুর আওয়াজ কিছুতেই বার করতে পারি না। সুরও মাঝে মধ্যে ফসকায়। কী করব? তুমি জানো মোর মনের বাসনা, যত সাধ ছিল সাধ্য ছিল না, তবু বহিয়াছি কঠিন

কামনা—দিবস নিশি।

মনে বড়ো দুঃখ, না দাদা।–খুব মৃদুস্বরে উনি বললেন, অদ্ভুত একটা দরদ গলায়।

গলায় আর্দ্রতা কোনোমতে সামলে হতাশ গলায় বলি, কী করি বলুন, সারাজীবন চাকরি বাকরি সংসারধর্ম করেছি বটে, কিন্তু আমার মন পড়ে থেকেছে। এই তারে ছড়ে। যে সুর হৃদয়ে শুনি হাতে তাকে আনতে পারি না কিছুতেই, আহা যদি একটিবারও পারতাম! আর পারব না!

অনেকক্ষণ চুপ আমরা! নিশ্বাসের শব্দসুদু শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ উনি বললেন, যদি পারেন?

যদি? যদি দিয়ে তো স্বর্গের সিঁড়িও বানানো যায়, বস্তুজগৎ কি আর তা দিয়ে চলে? সে যাক—এবার আপনার বাজনা শুনি।

উনি বললেন, এখন আপনার ইমন আর আপনার যন্ত্রের আওয়াজ শুনছে বাতাস। টের পাচ্ছেন না? সুরের ধ্যান ভাঙতে নেই। আর একটু রাত হোক, খাওয়াদাওয়ার পর…একটু বেশি রাতে বাজাব।

সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের খাওয়াদাওয়া চুকে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাওয়ার ওপর আরামচেয়ারে এলিয়ে বসে থাকি। ওঁর তো বাজানোর নাম নেই দেখছি। মনে একটা অভিমানের মেঘ জমছে। সেই মেঘ থেকে গুমোট। গুমোট থেকে বিস্মরণ। চোখের পাতা জুড়ে কী ভাবে কখন যে ঘুমের অন্ধকার নেমে এসেছে জানি না। কত রাত তখন?

ঘুমটা ভাঙল একটা মধুর অথচ বলিষ্ঠ আওয়াজেট–ঙ। মাথাটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে ওঠে। খরজ থেকে কোমলগান্ধার ছুঁয়ে শুদ্ধ মধ্যম পর্যন্ত একটি নিটোল গম্ভীর মিড়। যেন সুরের কলসটি সুরের পাথারে ডুবে গেল। তাকে ঘিরে সুরের বৃত্তগুলি ছড়িয়েই যাচ্ছে, ছড়িয়েই যাচ্ছে। মাঝরাতে মালকোশের সঙ্গে মন্দ্র আলাপে মেতেছেন কোনো সিদ্ধ বাদক। পায়ের রোম থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আমার খাড়া হয়ে উঠছে সুরের স্পন্দনে, শরীরের মধ্যে যেন সহস্র তন্ত্রীতে মালকোশ বাজছে। অনেকক্ষণ বসেই ছিলাম, তারপর আর থাকতে পারলাম না। হরিসাধনদার ঘরে ঢুকে পড়লাম। এ ঘরে উনি কোনোদিন আমাকে ডাকেননি, আমিও তাই আসিনি। পর্দা উড়তে চকিতে চোখে পড়েছে একটি পাথরের বেদি মতো, তার ওপরে একটি জাজিম বিছানো। সেখানে দুটি বিড়ের ওপর ঢোলা ঢাকনায় ঢাকা একটি সেতার। শোবার খাট অন্যদিকে। পেছনের খোলা জানলা দিয়ে এখন তারার আলো এসে পড়েছে ওঁর কাঁধে, মাথায়, চুলের জায়গায় জায়গায়, কনুইয়ের কাছটায়, আলোর কালোয় এক অদ্ভুত মহিমময় মূর্তি। এ যেন আমার চেনা হরিসাধনদা নয়, ওঁর খোলসের মধ্যে থেকে আরও সৌম্য আরও হাজারগুণ প্রাজ্ঞ এক দ্বিতীয় হরিসাধন যেন বেরিয়ে এসেছেন। হাতের যন্ত্রটারও জায়গায় জায়গায় আলো পড়েছে। স্টিলের তারগুলো মাঝে মাঝে ঝিকিয়ে উঠছে। সে যে কী আলোকসামান্য দৃশ্য আর আলোকসামান্য সুর আমি বলে বোঝাতে পারব না। হঠাৎ দেখি বেদির ওপর আমার ভায়োলিনটাও সযত্নে শোয়ানো আছে। সরস্বতী পুজোর দিনে আমরা যেমন বইপত্র সব ঠাকুরের বেদিতে রাখি। উনি ইঙ্গিতে আমাকে সেটা তুলে নিতে বললেন। আমি ঘোরের মধ্যে তুলে নিই, ছড় টানি। উনি যা করছেন তাকে অনুসরণ করে যাই প্রাণপণে, কোনো কথা কোনো সংকোচ মনে থাকে না, হঠাৎ খেয়াল হয় মাঝে মাঝে উনি থেমে যাচ্ছেন, শুধু সুরটুকু ধরে রাখছেন, তখন আমিই বাজাচ্ছি, একলা। অনুসরণ নয়, নিজে বাজাচ্ছি, মালকোশের গম্ভীর তরঙ্গপ্রবাহের পর্দায় পর্দায় অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছি, হাত চলছে বিদ্যুতের মতো, পরক্ষণেই আবার ঝংকৃত হয়ে উঠছে সেতার। কতক্ষণ যে এই যুগলবন্দি চলেছিল জানি না, গোটা ঘরটা, তার কড়ি বরগা, জানলা দরজা, তার ভেতরে পিছলে-পড়া রাতের আলো আর রাতের অন্ধকার পুরোটাই যখন সেই সুরের যুগলবন্দি ধরে নিল, পাথরে যেমন করে রং ধরে তখন কোনো একটা সময়ে আমাদের বাজনা আপনি থেমে গেল। এবং দুজনে সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়া সেই ভরাট সুরের মধ্যে মূর্তির মতো বসে রইলাম। তারপরে কখন সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে নেশার ঘোরের মতো ঘুম এসেছে, টলতে টলতে গিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছি জানি না।

ঘুম যখন ভাঙল তখন চারদিক আলোয় ফটফট করছে। একফালি পুবের রোদ ঠিক আমার ডান চোখের ওপর ধারালো ছুরির ফলার মতো পড়ে আছে। কোথাও কোনো একটা পাখি রোদের ঝলকে দমে না গিয়ে তীব্র মিষ্টি সুরে ডেকেই যাচ্ছে, ডেকেই যাচ্ছে।

মুখ হাত ধুয়ে এসে বসি। হরিসাধনদা রোজকার মতোই বসে আছেন নিজের চেয়ারে। বুধন আমার সাড়া পেয়ে চা আর চিড়েভাজার প্রাতরাশ এনে রাখল। আমি বললাম, দাদা একটু পায়ের ধুলো দিন। করেন কী! করেন কী ক—উনি আমার হাত ধরে ফেললেন।

আমি বলি, কাল যা হল, তা যদি স্বপ্ন না হয় তাহলে প্রণামটা না করতে দিয়ে আপনি আমাকে একটা মস্ত করণীয় থেকে বঞ্চিত করছেন।

উনি আস্তে আস্তে বললেন, প্রণাম? নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু সেটা এখানে নয়। উনি উঠে পড়লেন। ওঁর পেছন পেছন ঘরে ঢুকি। সেই জাজিম, সেই বেদি, তার ওপর সেতারটি শোয়ানো, পাশে আমার ভায়োলিন। উনি বললেন এই আসনে প্রণাম করুন। এ আসন পণ্ডিত গম্ভীরনাথজির। আপনি কাল যা শুনেছেন আর যা বাজিয়েছেন তা পণ্ডিতজির আশীর্বাদ। অমন ঘটে, খুব মাঝে মাঝে, আপনার অদৃষ্টে ঘটে গেল। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। সে সব কথা এখন স্বপ্নের মতোই মনে হয়। সত্যি কি শুনেছি? সত্যি বাজিয়েছিলাম? সত্যি এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, কেসের ডালাটা খুলে আমার তন্বী যন্ত্ৰিণীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করি, যা শুনেছিলাম সে কি সত্যি? আর একবার অমনি করে বাজো না যন্ত্র! যন্ত্র আমার দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকে। তার মেহগনি শরীরে বোবা কষ্ট। হরিসাধনদার সঙ্গে আমার কখনোই তো আর দেখা হয়নি কিনা! সপ্তাহ দুই পরে ওঁর কালীকুণ্ডু লেনের বাড়িতে গিয়ে শুনি হঠাৎ মারা গেছেন। মধুপুরেই ওঁর অন্ত্যেষ্টি হয়ে গেছে। জানাল ওঁর ভাগনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *