2 of 2

শুধু সমুদ্রের চিত্রনাট্য – অরূপরতন ঘোষ

শুধু সমুদ্রের চিত্রনাট্য – অরূপরতন ঘোষ

মূল শহরটা যেন এতক্ষণ দম বন্ধ করেছিল, এইমাত্র হাঁপ ছাড়ল। তাই হঠাৎ দেখা গেল বেশ কিছুটা সবুজ মাঠ। খোলা হাওয়া। যদিও তার চারপাশ ঘিরেই হুমকি দিচ্ছে। একটু ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসা কংক্রিটের অরণ্য বা সারি সারি মানুষ বাস করার মেশিন। কিন্তু এই সবুজ মাঠটায় মাঝেমাঝেই টের পাওয়া যাচ্ছে কিছুটা বাতাসের

স্পর্শ আর সঙ্গে সঙ্গে নম্রতার শাড়ির আঁচলের কিছু ব্যর্থ ওড়াউড়ি। ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা কেউ কেউ দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ বাড়ি যাচ্ছে বা অন্য কোথাও এদিক ওদিক চলাফেরা করছে। আর কেউ লক্ষ না করলেও অনেক ওপরে আকাশে কয়েকটি মেঘের টুকরো কোথায় যেন ছুটে যাচ্ছিল সেই সময়।

—বল কি শুনবি বল?’ নম্রতা বলল।

—তুই যা বলবি। এম. এ ইংরেজির ছাত্র তরুণ যেন শিশুর মত বলে উঠল।

—”কিছু শুনেছিস আমার সম্পর্কে?

—হ্যাঁ, তোকে তোর হাজব্যান্ড মারত।

–হুঁ ঠিকই শুনেছিস।

-কিন্তু কেন?

–এমনি।

-হ্যাঁ, রে। সব সময় যে মারত তা নয়। মাঝেমাঝে বেড়াতে নিয়ে যেত। সন্ধ্যেবেলা আমরা সি-বিচে যেতাম। কিন্তু মাঝেমাঝেই বাড়িতে ফিরে এসে, শোবার সময় ড্রিংক করত, তারপর মারত।

একুশ বছরের তরুণ কিছু বুঝতে পারে না। এত সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটাকে মারতে কেন একটা লোক? আসলে বিয়ে, বিয়ে ব্যাপারটা সম্পর্কেই বিশেষ ধারণা নেই ওর। এত অল্প বয়েস, পড়াশুনো নিয়ে থাকে—এ সব কিছু বোঝে না। বাড়িতে কোনও বোনও নেই যে তাকে কেন্দ্র করে কোনও বিয়ের পরিস্থিতি বা আবহাওয়া তৈরি হবে। একটু আধটু ব্যাপারটা বুঝতে পারবে তরুণ।

—আবার কি জানিস তো, কখনও কখনও মারার পর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইত।

তরুণ তার চারপাশের একটু দেখা জীবন, ইংলিশ অনার্সের নাটক, উপন্যাস—এ সবের ভেতরের কাহিনীর সঙ্গে মনে মনে মেলানোর চেষ্টা করে নম্রতার এই ব্যাপারটাকে। কিন্তু কোথাও কোনও মিল নেই। না সেক্সপিয়রে, না ডিকেন্সে, না শেরিডনে। ইবসেনের সঙ্গে বোধহয় একটু মিল আছে। দি ডলস হাউস নাটকের নোরার সঙ্গে। সেই যে নোরা বেরিয়ে এল স্বামীকে ছেড়ে। বলল, কারুর স্ত্রী, কারুর মেয়ে, কারুর মা—এসবের চেয়েও আমার প্রথম এবং আসল পরিচয় আমি নারী। আমি বাবার ঘরেও একটা পুতুল ছিলাম আর তোমার কাছেও একটা পুতুল হয়েই আছি, তাই এই পুতুল-ঘর ভেঙে দিয়ে আমি চললাম। না, নম্রতা ঠিক নোরার মতো অতটা র‍্যাডিকাল নয়। ও বিয়ে করে সংসার করতেই চেয়েছিল। কিন্তু স্বামীর অত্যাচারে ওকে চলে আসতে হল। না ওর বিয়েটা আবার কাকিমা, পাড়ার মিনু বৌদি কারুর সঙ্গেই মিলছে না।

কিন্তু নম্রতার এই ঘটনাটা লিখব কি করে রে বাবা! গল্প হতে চাইছে নম্রতা। নিদারুণ ঝড়ে বিপর্যস্ত ওর বাইশ বছরের জীবনটাকে নিয়ে ও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। হাওয়ায় আঁচল উড়ে যাচ্ছে ওর। নম্রতা বলতে লাগল—

কোথা থেকে যেন বিটোফেনের সেভেনথ সিম্ফনির সুর শোনা যেতে লাগল। নম্রতার কথার সঙ্গে সঙ্গে অর্কেস্ট্রার সুর কখনও উঁচুতে উঠছে কখনও নামছে। তরুণের বা আমার কানে ভেসে আসে এই সুন্দর সুর। অন্ধ সঙ্গীতকারের এই সুরবদ্ধ সিম্ফনিতে মনে হয় কখনও যেন পাপীরা সমুদ্রে স্নান করছে। আমিই তরুণ নাম দিয়ে শুরু করেছিলাম এই গল্প বা চিত্রনাট্যটা। নম্রতার সঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে সেই যে বসেছিলাম তা প্রায় কুড়ি বছর আগের কোনও একদিন। যেন চোখের সামন ভাসছে সেদিনটা। যেন থমকে আছে সেদিনের বাতাস, সবুজ মাঠ আর তার প্রান্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি ও অন্যান্য নগর-দৃশ্য। সেই আশির দশকে দৃশ্য-দূষণের সচেতনার যুগ তখনও আসেনি।

সিম্ফনিটা বাজছে—পাপীদের জলস্নাত হয়ে পবিত্র হওয়া। নাবিক ও সমুদ্র রঙ্গের মাখামাখি।

শুধু সমুদ্রের চিত্রনাট্যে অবধারিত ভাবেই এরকম ভাবে বিটোফেনের আসার কথা ছিল।

নম্রতা আবারও বলল, এমনি মাঝে মাঝে বেশ ভালো ব্যবহার করত। সন্ধ্যেবেলা সি বিচে বেড়াতে নিয়ে যেত।

সমুদ্র উত্তাল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইন্ডিয়া গেট সংলগ্ন বাঁধান এলাকায়।

আমি মনের চোখে সি বিচ কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। আরব সাগরের বিস্তৃত জলরাশি আর বষের তীরভূমির মেলামেশা। সেই কুড়ি বছর বয়েসে আমি তখনও বম্বে দেখিনি। আরব সাগরও না। কোনও সমুদ্রই তখনও আমার দেখা হয়নি। এখন বম্বের সমুদ্র আমার দেখা। কুড়ি বছর আগের নম্রতার কথাগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুম্বাইয়ের সমুদ্র। ইন্ডিয়া গেটসংলগ্ন বাঁধান তটে তার দুরন্ত উচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়া কিংবা জুহু বিচের বালির বিস্তৃত বিছানায় নির্দ্বিধায় সমুদ্রের কিছুটা এগিয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়া। অন্যদিকে পর্যটকদের নিয়ে উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়া লঞ্চ। মুম্বাইয়ের সমুদ্র বলতে এসবই এখন একসঙ্গে মনে পড়ে।

বহু দিন থেকেই চলচ্চিত্র পরিচালক বা ফিল্মমেকার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। তাই চোখের সামনে স্ব কিছু সিনেমার মতো করে দেখার অভ্যাস হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লন-এ বসে নম্রতার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তারপর কত সময় পার হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। নম্রতা যখনই সি বিচে বেড়ানোর কথা বলে, তখনই যেন একটা আছড়ে পড়া সমুদ্রের দৃশ্য বসে গেল মনের মধ্যে। চিত্রনাট্য লিখলে বা চলচ্চিত্র পরিচালনা করলে এ রকমই একটা দৃশ্য বা সিকোয়েন্স আমি রাখতাম।

সমুদ্রের নিটোল জীবন্ত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ইন্ডিয়া গেটের বাঁধান ঘাটে। প্রতিহত হয়ে ফিরে যেতে গিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরবর্তী ঢেউ। ভিজে যাচ্ছে কংক্রিট। মানুষের বাঁধ দেওয়ায় বিরক্ত সমুদ্র।খুশি মানুষ। ঘাটের একটু নিচে নামলে সমুদ্রের জল ছিটকে আসছে। ভয়ঙ্কর আকর্ষণ সমুদ্রের। নিরলস প্রকৃতির নিয়মে মাঝ সমুদ্র থেকে কিছুটা কালো ও ঘোলা জলের ঢেউয়ের প্রবাহ প্রবল শক্তিতে ছুটে আসছে তীরের দিকে। সমুদ্রের মতোই মানুষের মনও বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে দেখার জন্য অনেক সময় বেশি কেউ থাকে না ধারে কাছে। কিন্তু নম্রতাকে দেখতে হতো তার মারমুখী স্বামীকে।

কিন্তু তোকে ও মারতো কেন?

এমনিই হঠাৎ করে।

এমনিই!

হ্যাঁ। আবার কখনও পায়ে ধরে ক্ষমাও চাইতো। কাঁদতো। আমি আমার বউদিকে জানিয়েছিলাম ব্যাপারটা। বৌদি আমাকে কিছু ট্যাবলেট পাঠিয়েছিলেন। রোজ একটা করে খেতাম। ও এসব জানতো না। ওর ধারণা ছিল আমি ওর বাচ্চা ক্যারি করছি।

আজ বুঝতে পারি নম্রতা সেদিন আমাকে অনেক কিছু বলেনি। আমিও জিগেস করিনি। আমার তখন একুশ বছর বয়স। নম্রতারও এই রকম। তার ওপর ওই রকম হেনস্থার পর নতুন জীবন শুরু করেছে ও। তাই তখন আর বিবাহিত জীবনের গোপন কথা জিগেস করার কথা মনে হয়নি। একটা নিষ্পাপ সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে স্বামীর হাতে প্রায় প্রতিদিন মার খাচ্ছে এটা ভাবতেই আমার রক্ত জল হয়ে যাচ্ছিল তখন।

আজ চিত্রনাট্য লিখতে বসে মুম্বাইয়ের সমুদ্র যেন ঢুকে পড়ছে নম্রতাদের ঘরে। বিছানার ওপর আছড়ে পড়ছে। উথাল-পাথাল ঢেউ উঠছে ঘরের হাল্কা অন্ধকারে।

পালিয়ে এলি কি করে?

এ ব্যাপারে আমাকে শাশুড়ি কিছুটা সাহায্য করেছিলেন। একদিন আমার দাদা এল কলকাতা থেকে। ও তো দাদার সামনেই চুলের মুঠি ধরে মারতে লাগল। দেখে তো দাদা রেগে আগুন। যাই হোক ও দোকানে বেরিয়ে গেল। দাদা সেই সময় আমায় নিয়ে চলে এল কলকাতায়। শাশুড়িও তাই চেয়েছিলেন। শাশুড়ি মানুষটা বেশ ভালো ছিলেন।

দোকানে মানে—ও কি করত?

ওর তো কাপড়ের দোকান ছিল। শোনা যায় ফিল্মস্টার অরুণা ইরানির সঙ্গে ওর একটু সম্পর্কও ছিল।

কাপড়ের দোকানদার। কাপড়ের দোকানদারকে তুই বিয়ে করলি! নিজে ফিলসফিতে অনার্স পড়ছিস। তুই কি রে? ওর পড়াশোনা কতদূর ছিল?

ক্লাস ফাইভ।

ওঃ–ক্ষোভ, অবাক হওয়া আর অসহায় ভাবটা জমাট বেঁধে বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে।

অনুরোধে মানুষ টেকি গেলে শুনেছিস? আমি অনুরোধে পেঁকি গিলেছিলাম? তবে আমার মনে হয়েছিল পড়াশোনা কম হলেই একজন মানুষ খারাপ হবে তার কোনও মানে নেই।

সাদা শাড়ি পরে আছে নম্রতা। কি অদ্ভুত সরলতা ঘিরে আছে ওকে। আজও যখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও কাজে যাই ওই লনটা দেখলে মনে পড়ে আজও যেন ওখানে আশির দশকের সময়কাল জমাট বেঁধে আছে। স্থির হয়ে আছে ওই দিনটা। নম্রতার সঙ্গে আমার কথা বলা মুহূর্তের সারিগুলি। বাতাসে উড়তে উড়তে স্থির হয়ে গেছে। নম্রতার সাদা শাড়ি আর সরলতা।

চিত্রনাট্যে কি এখানে একটা ফ্রিজশট বসিয়ে দেব?

নম্রতা বলতে লাগল, তারপর ডিভোর্সের জন্য চেষ্টা শুরু করলাম। ও-ও কলকাতায় চলে এল। আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। ওকে লোক দিয়ে ভয় দেখান হল যে বাড়ির সামনে তোমাকে দেখলে একেবারে ধুনে দেব। ও ফুঁসে উঠে বলছিল, ওর বাচ্চা আমার পেটে আছে। কিন্তু ও তো জানতো না যে তা সত্যি নয়। আমি রোজ একটা করে ট্যাবলেট খেতাম। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স হয়ে গেল। এখন কি করব জানি না।

বাইশ বছরের নম্রতা দিগন্ত রেখার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু দিগন্তরেখা তো নেই। রাস্তা বি.টি. রোড। কিছু বাড়ি আর ফ্ল্যাটের সারি। বিষ্ণুদের লেখা সে কবিতার লাইনটা কেন জানি না মনে হচ্ছে, দিগন্তে হায় মরীচিকাও যে নেই।

কেন তুই তো পড়াশোনা শুরু করেছিস আবার। পড়।

হ্যাঁ, কিন্তু আমায় কি কেউ আর বিয়ে করবে?

নিশ্চয়ই ডিভভার্সের পরে কত বিয়ে হচ্ছে।

তোর যে সব লেখা আছে ওগুলো আমাকে পড়তে দিবি?

দেব।

সেদিন তোর গল্পটা শুনে মনে হল। আমার কথা বললে হয়তো তুই লিখতে পারবি।

হ্যাঁ, ভালোই করেছিস বলে। আমারও খুব কৌতূহল ছিল ব্যাপারটা জানার।

তুই বেশ জেনে নিলি সব।

হ্যাঁ, অপ্রতিভভাবে আমি বললাম।

লোককে আমার ঘটনা বলতে বলতে আমি একেবারে জেরবার হয়ে গেলাম। বম্বে থেকে চলে আসার পর সকলে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে বল। আমার একদম আর ভালো লাগে না এইসব কথা বলতে।

ছেড়ে দে। আর সব কিছু তো মিটে গেছে।

গল্পটা লিখে দেখাস। তোর অন্য সব লেখাগুলো পড়তে দিস।

হ্যাঁ।

একটু থেমে বললাম।

বম্বে তো আমি কখনও যাই নি। বম্বে শহরটা ঠিক কি রকম?

অনেকটা কলকাতার মতোই। সমুদ্র আর সি বিচ আছে এই যা।

পরে আমি মুম্বই গেছি। জুহু বিচে গেছি। মেরিন ড্রাইভে গেছি। ইন্ডিয়া গেটের বাঁধানো সমুদ্র তটে জলরাশির আছড়ে পড়া দেখেছি। বসেওছি সেখানে কিছুক্ষণ। নম্রতার কথা মনে হয়েছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী সেখানে কখনও বসত। সমুদ্রে প্রবল বিস্তারে ও উন্মুক্ত আকাশের নিচে বসে বোঝাই যায় না এমনটা ঘটেছিল কখনও। তা ছাড়া ব্যাপক মানব জীবন চর্যার কাছে কি আর এমন এ ঘটনা। তুচ্ছ। আমাদের সারাজীবনটাই যেন তুচ্ছ মনে হয় এই সমুদ্র বিস্তারের সামনে ও উন্মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়ালে।

তুচ্ছতার কথায় সেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়র’ নাটকের লাইনটার কথা মনে পড়ে। রাখাল বালকেরা যেমন মাছি মারে—ভগবানের কাছেও আমরা তেমনই।

‘অ্যাজ ফ্লাইজ অর টু দি ওয়ানটন বয়েজ।
আর উই টু দা গডস’

তবু সমুদ্রের দৃশ্য বা সিকোয়েন্স এখানে রাখি। চিত্রনাট্যে মাঝেমাঝেই দেখা যাচ্ছে তীরে সমুদ্রের আছড়ে পড়া। ঢেউ-এর প্রত্যাবর্তন ও মাঝ দরিয়া থেকে অনবরত ঢেউ-এর ছুটে আসা। মনে পড়ে কারুর করা ওথেলো সিনেমার শুরুই হয়েছিল বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের দৃশ্য দিয়ে।

সমুদ্রের তরঙ্গ জীবনের অনেক অবস্থার মধ্যে মিলে যায়, মানিয়ে যায়। তাই সমুদ্রের এত প্রভাব মানুষের জীবনে। ইয়োরোপের মানুষদের জীবনে তো ভীষণভাবেই। ওদের শিল্প-সাহিত্য যেন অনেকখানি দখল করে আছে সমুদ্র। যাই হোক জীবনসমুদ্র এই ধারণাটার সঙ্গে মিলিয়ে আরব সাগরের এই দৃশ্যটা আমি চিত্রনাট্যের এখানে রাখলাম। সুটিং তোলার পর এডিটিং টেবিলে গিয়ে দেখতে হবে কি রকম মানাচ্ছে।

নম্রতাকে তখন বলেছিলাম, একজন নারীর দৃষ্টিতে জীবন ও পৃথিবী এভাবেই লিখব গল্পটা।

ও বলেছিল, তোর যা খুশি।

আসলে আমার উওম্যান কনসেপ্ট নিয়ে বেশ কয়েকটা গল্প লেখা আছে। নারীর নানা রূপ, মা, প্রেমিকা, মেয়ে ইত্যাদি নানাভাবে দেখানো হয়েছে সেখানে। কিন্তু একজন নারীর চোখে…সেভাবে তো কিছু লেখা হয়নি। নম্রতার দৃষ্টিতে এই গল্পটা লিখব। সবচেয়ে অসুবিধে হচ্ছে আমি বিবাহিত নই। সেই একুশ বছরেও নয় আর এখন এই বেয়াল্লিশ বছরেও নয়। নম্রতার তখনকার সমস্যা, মারধোরের বর্ণনা—এসব কিছুই ঠিক বুঝতে পারিনি। তখন। এখনও খুব পরিষ্কার নয়। কিছুটা ওপর থেকে জীবনের স্পন্দবিন্দু হিসেবে দেখতে হবে সমস্যাটাকে।

সে গল্প কোনদিন লেখা হয়নি। তাই আজ এতদিন পরে চিত্রনাট্যে তা রূপ দেবার চেষ্টা করছি। পরে ফিল্ম করব। তখন নম্রতাকে খবর দেব। একদিন, তা-ও অনেকদিন আগে, নম্রতার সঙ্গে হঠাৎ নিউ কয়লাঘাটে বুকিং অফিসের সামনে দেখা। বলল, বিয়ে করে দিল্লিতে আছে। নিশ্চয়ই ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালো আছে এখন। বহুদিন আমার সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ নেই।

ও আমাকে ওর জীবনের এই ঘটনা নিয়ে লিখতে বলেছিল আমি তা লিখতে পারিনি। এর জন্য একটা গ্লানি বা অপরাধবোধে ভুগতাম। ইচ্ছে করে যে লিখিনি তা নয়। আসলে আমি ঠিক রিয়ালাইজ করতে পারিনি ওর পরিস্থিতিটাকে। ওর অভিজ্ঞতা, ওর অনুভূতি নিয়ে নিটোল গল্প লেখার ক্ষমতা ছিল না আমার। তাই লেখা হয়নি। তাই ওকে নিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে বসে বোধহয় একটা কোলাজধর্মী গল্পই হয়ে গেল। টুকরো টুকরো কথা টুকরো টুকরো ছবি, তা থেকে কি ধরা পড়ল না গত শতাব্দীর শেষ দিকের মানুষের জীবন যাপনের এক রকম একটা অংশ। সেদিন ওর বলা টুকরো টুকরো কথা যেন আলাদা পৃথিবী তৈরি করেছিল। মানুষের আচরণে তা যেন ঘোরা বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমার কাছে নম্রতার সেই নারীর আলোকপাতে দেখা পৃথিবীটা বঙ্কাল থেমে আছে। প্রায় বিস্মৃত, পরিত্যক্ত স্কুলের গ্লোবের মতো আলমারির ওপরে এক ধারে পড়ে আছে। এর মধ্যে বাস্তব পৃথিবীতে নারীরা অনেক সচেতন হয়েছে। গায়ত্রী স্পিভাক তার একটা বইয়ের নাম দিলেন ‘ক্যান দি সাব অলটার্ন স্পিক?’ বললেন, এতকাল নারীমুক্তির প্রসঙ্গে সাদা চামড়ার বা ইয়োরোপ ও আমেরিকার নারীদেরই বিবেচনা করে হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের নারীরা কোথায় যাবে? তারা কি তাদের কথা বলতে পারবে নারী মুক্তির প্রসঙ্গে? সেই জন্যই কি শোভা দের লেখা সাহিত্যকর্ম বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়ান হয় বলে শোনা গেছে। সেখানে ভারতীয় মেয়েদের কথা আছে বলে? অরুন্ধতী রায়ের বিখ্যাত বই ‘গড অফ স্মল থিংস’এ ও তো কেরালার মহিলাদের জীবনকথা আঁকা হয়েছে। তাই কি পশ্চিম পৃথিবীতে ওই বইয়ের এত জয় জয়কার? ভারতীয় নারীদের কথা শুনতে কি বহিঃবিশ্ব খুবই আগ্রহী আজকাল? ঠিক বুঝতে পারি না। তসলিমা নাসরিনকে তো আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছে পশ্চিম পৃথিবী। বিংশ শতাব্দীর শেষে এই উপমহাদেশে তসলিমাই নারী মুক্তির জোরাল প্রবক্তা। কিন্তু এই তসলিমাই মারাত্মক জীবন সংশয় হয়েছিল এক সময়। ১৯৯৪ সালের ১৪ই মের পর থেকে বেশ কয়েক মাস বাংলাদেশে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল তাকে। সেই সময়ের মধ্যে কোন এক সময় ফরাসি নারী সংগঠনের কাছে তসলিমার পাঠান ফরাসি ভাষায় পাঠান ফ্যাক্স বার্তাটি আমি খাতায় লিখে নিয়েছিলাম। ফরাসি ভাষা শেখার সূত্রে কলকাতার আলিয়স ফ্রঁসেজ লাইব্রেরিতে গিয়ে মাঝে মাঝে বসতাম। সেখানে পেয়েছিলাম বার্তাটা এবং অন্য আরও অনেক কথা। ফরাসি এল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মেয়েদের পত্রিকা এল। তসলিমা সেখানে লিখেছিলেন, ‘সোভে মোয়া’ যার অর্থ——আমাকে বাঁচাও বা সেভ মি। সেই সময় ওই পত্রিকা তসলিমাকে নিয়ে অনেক কিছু লিখত। যেমন একবার ঘোষণা করল, আসুন আমরা সকলে তসলিমার মুক্তির দাবীতে রোজ প্যারিসের বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে সন্ধ্যায় একঘন্টা করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাই। এমনি আরও অনেক লেখা থাকত তসলিমাকে কেন্দ্র করে তসলিমার সমর্থনে। তখন আমাদের দেশেও তসলিমাকে নিয়ে কোন খবর প্রচারিত হলে তা শুনতে বিশেষ আগ্রহ দেখালে মহিলারা। হয়ত তারা ভাবতেন আমার যা বলতে পারিনি তসলিমা তা বলতে পেরেছেন।

আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যখন নম্রতার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল তখন এ সব ঘটনা ছিল না বা আমাদের জানা ছিল না। সরলতা ঝরে পড়েছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে, আর নম্রতার চাপা হাহাকারে এবং আমার অবাক হয়ে যাওয়ার পরম্পরায় বা সিকোয়েন্সে। সেই সিকোয়েন্সগুলিকে নিয়ে এখনকার সামাজিক-মানসিক পরিপ্রেক্ষিতে সাজিয়ে নিচ্ছি এই চিত্রনাট্য।

মনের মধ্যে পড়ে থাকা নম্রতার ঘোরা বন্ধ হয়ে যাওয়া পৃথিবীটাকে টোকা দিয়ে ঘুরিয়ে দিলাম। ওর পৃথিবীটা ঘুরতে লাগল গ্লোরে মতো। যেন সেটি সৌরজগরে কোন নিয়মই মানে না। তবে কি আমার আঙুলেই তার ঘোরা ফেরা। পুরুষের আঙুলের ছোঁয়ায় বা নির্দেশে বা ইচ্ছেয় নারী-জগৎ আজও ঘুরে চলেছে। সর্বনাশ! সমালোচকরা ফিল্মটির এ রকম মানে করলেই তো গেল। যা নারীবাদী হাওয়া চারপাশে! এখনও কি পুরুষের অঙ্গুলি হেলনে নারীর জীবন ওঠা নামা করে। এখন তো ভারতীয় আইনের ৪৯৮ (ক) ধারা আছে। যেখানে বধূ তার স্বামী ও তার পরিবারের প্রতি অভিযোগ আনতে পারে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচারের। গ্রেপ্তার হয়ে যাবে সকলে। জামিন পাওয়া যাবে না। বিচার হবে পরে। ততদিনে সমস্ত সামাজিক মান-সম্মান চুরমার।

যাই হোক সেদিন পর্যন্ত নম্রতার এ সব কিছু ছিল না। সেদিন ও সাদা শাড়ি আর থ্রি-কোয়ার্টার ব্লাউজ পরে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে বসেছিল। যা বলছিল তাই নিয়েই এই চিত্রনাট্য লিখছি। চিত্রনাট্যের শুরুটা হচ্ছে এইরকম—

বরানগরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের মরকত কুঞ্জের সবুজ লন। একটু ফাঁকা ফাঁকা। আশির দশকে যেমন ছিল। সেখানে বসে আছে একুশ বছরের এক যুবক ও বাইশ বছরের এক যুবতী। ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী। ছাত্রীটি সুন্দরী, তন্বী। একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে। তার শাদা শাড়ির আঁচল একটু উড়ছে। ছেলেটি উদাস, ভাবুক, সম্ভবত গ্রামের ছেলে শহরে পড়তে এসেছে। কবি কবি ভাব।

তরুণ।। আচ্ছা তুই সব সময় শাদা শাড়ি পরিস কেন?

নম্রতা।। আমি রঙিন শাড়িও পরি। তবে ইউনিভার্সিটিতে কেবল সাদা পরি। কারণ বাবা মনে করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রঙিন পোশাক না পরে যাওয়াই ভালো।

নম্রতার শাদা পোশাক সহ শরীরের ওপর ক্যামেরা প্যান করে এসে মুখের বিগ ক্লোজ আপে পরিণত হয়। পর্দা জুড়ে নম্রতার মুখ ফুটে ওঠে। আস্তে আস্তে জুম ইন করতে থাকে ক্যামেরা। নম্রতা ও তার পাশের ছেলেটি। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের আশপাশ ও অন্যান্য পরিকাঠামো ফুটে উঠাতে থাকে ফ্রেমের মধ্যে। ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। অফ ভয়েসে শোনা যাচ্ছে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী কবিতার অংশ।

সেদিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া…।

কবিতার সঙ্গে সঙ্গে আবার জুম আউট হতে থাকে ও শেষ পর্যন্ত নম্রতার মুখ পর্দা জুড়ে ফুটে ওঠে।

মিড শট।

নম্রতা।। আমাকে যখন মারতো তখন আমি ইচ্ছে করে জোরে জোরে চীৎকার করতাম যাতে আশপাশের বাড়ির সকলে শুনতে পায়।

ক্লোজ শট। তরুরে মুখ। বিস্ময়ে হতবাক ও সহানুভূতিতে থরো থরো।

কাট্‌।

মিড শট।

নম্রতা ও তরুণ লনে বসে আছে।

নম্রতা।। যাই বল ছেলেরা মেয়েদের সেক্স ছাড়া আর কোনও ভাবে ভাবতে পারে না।

তরুণ।। এটা তুই ঠিক বললি না।

নম্রতা।। না, এটা আমি ঠিকই বলছি। (হাসতে হাসতে)

তরুণ।। (হাসতে হাসতে) তা হলে তুই মনে রাখিস এই সঙ্গে তুই তোর বাবাকে, দাদাকে এবং তোর সমস্ত পুরুষ আত্মীয়দেরও রাখছি।

হেসে ফেলে নম্রতা।

ফ্রাঁসোয়া ভুফোর ‘জুল এ জিম’ ছবির একটা ক্লিপিংস দেখানো হচ্ছে। সাদা কালো আগেকার ছবি। সম্ভবত জিম একটি পার্টিতে গেছে। সেখানে আর এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হল। সঙ্গে এক অপরূপ সুন্দরী যুবতী। কিন্তু সে মূক ও বধির। জিম অবাক হলে তাকে সে এই বিয়ে করার কারণ বুঝিয়ে বলে, ওনলি ফর সেক্স।–

ইংরেজি সাবটাইটেলে এই কথাটিই ফুটে ওঠে।

কাট্‌।

কলকাতার কফি হাউসের একটি দৃশ্য। তিনজন যুবক গল্প করছে। তাদের মধ্যে তরুণও আছে।

এক বন্ধু।। বিয়ে ব্যাপারটা সেক্সেরই ব্যাপার।

আর এক বন্ধ… ভুল ধারণা। তুমি সেক্স নিয়ে দিনে কত ঘন্টা চিন্তা করবে, চারঘন্টা? বাকি কুড়ি ঘন্টা তুমি কি নিয়ে ভাববে? বিয়ে ব্যাপারটা অত্যন্ত মাঙ্গলিক।

কাট্‌।

কাট অবাক হয়ে দেখলাম নম্রতা কি পোশাক পরেছে আজ। সাদা রঙেরই শাড়ি ব্লাউজ যেমন পরে তেমনই, কিন্তু… কেমন যেন একটু বেশি স্বচ্ছ তার ব্লাউজ। কিন্তু এ রকম কেন? বাবার ইচ্ছেয় সাদা পোশাক পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা। কিন্তু আদর্শের সেই কারণকে ছাড়িয়ে একটু বেশি গভীরে যেতে চাইছে তার পোশাক।

জিগেস করলাম, কি রে।

এই পরীক্ষার জন্য স্যারের কাছে কিছু ইমপর্টেন্ট কোনে জানতে এলাম।

ধ্বক করে উঠল বুকের মধ্যে। বয়স্ক অধ্যাপক, ফিলসফির হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট। গয়ের রঙ কালো, সুপুরুষ চেহারা নয়। আর নম্রতা—ঠিক তার বিপরীত। যেন বিউটি অ্যান্ড দি…না থাক অতদূর যাব না। ওই অধ্যাপকের কথা ভেবে আতঙ্কিত হলাম। তার মনের মধ্যে কি রকম হবে? তিনি কতদূর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলে দেবেন? তার ওপর তিনিও নিশ্চয়ই শুনেছেন নম্রতার বিবাহিত জীবনে হেনস্থা হওয়ার কথা। কামনা, সহানুভূতি কতদুর সমান্তরাল ভাবে যাবে না হঠাৎ মিলে যাবে কে জানে? ঘটনাক্রমে নম্রতাও সেই বছরে রবীন্দ্রভারতীতে ফিলসফি

অনার্সের একমাত্র ছাত্রী। ছোট ইউনিভার্সিটিতে তখন ওরকম হতো। ফিলসফিতে একজন, সংস্কৃতে একজন, অর্থনীতিতে দুজন—এই রকম অল্প ছাত্র-ছাত্রী পড়ত।

তবে নম্রতার এ রকম নারীমূর্তি আগে কখনও দেখি নি বা ভাবিনি সে আমার অজ্ঞতার জন্যই। আর জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়ার পর থেকেই তো ইভের অজ্ঞতা মোচন হয়েছিল। সবকিছু জেনে ফেলেছিল ইভ। কিন্তু একই সঙ্গে অ্যাডামও তো খেয়েছিল…মনের মধ্যে কে যেন প্রতিবাদ করে উঠল…।

কাট্‌।

অফ ভয়েসে ভেসে আসে সেই কবিতার লাইনগুলি। এবার নারী কণ্ঠে।

সেদিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া…

তারপর শুরু হয় সমুদ্রের তীরে আছড়ে পড়ার দানবীয় দৃশ্য, তাণ্ডব ও উন্মত্ততা। কিছুক্ষণ চলতে থাকবে এই জীবন্ত প্রাকৃতিক উচ্ছ্বাস। আর মাঝেমাঝেই সারা ছবিটি জুড়ে আরব সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউ দেখা যাবে নানা রকম ফেরে। প্রয়োজনে ‘ওথেলো’ সিনেমাটির সমুদ্রের দৃশ্যকে দেখান যেতে পারে।

ফিল্মটিতে মাঝেমাঝেই এত সমুদ্র কেন? সমালোচকরা কি বলবেন জানি না তবে আদিগন্ত দুরন্ত সমুদ্রের বিস্তার ও তার বুকের ওপর বিশাল স্ফীত আকাশের দৃশ্য প্রতিস্থাপিত করে সংযোগ রক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনও চলচ্চিত্রের ইমেজ—আমাদের এই জীবনের টুকরো ইমেজকেও বোঝানোর মতো শক্তিশালী উপাদান আমার আর মনে আসছে না। তাই আমার চিত্রনাট্য জুড়ে শুধু সমুদ্রের দৃশ্য আর জলের প্রচণ্ড শব্দ। সে শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে নম্রতার সেই সব দিনের তীব্র চিৎকার—আর মানবজাতির হাহাকার, ব্যথা আর প্রতিবাদ যা ঘুরে ফিরে আসছে আমাদের জীবনে। তাই শুধু সমুদ্রের দৃশ্য চিত্রনাট্য ভরে বারবার এসছে। যেন ভাসিয়ে দেবার ভয় দেখাচ্ছে সবকিছুকে, সবাইকে।

স্বামীর হাতে মার খাওয়ার সময় নম্রতা যে তাণ্ডব ও ক্ষোভ অনুভব করত সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে তার বোধ হয় কিছু মিল আছে। নম্রতার শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্তের সেই অনুভূতি–সব মিলিয়ে জীবনের অদ্ভুত স্পন্দন যাতে আপনাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে তাই এই চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্র ভরে শুধু সমুদ্রের দৃশ্য রাখা হয়েছে।

কোথা থেকে যেন একটা সিম্ফনির সুর শোনা যাচ্ছে। বিটোফেনের সেভেনথ সিম্ফনি? থার্ড মুভমেন্ট— মার্চ অফ দি ওশেন? সেই কুড়ি বছর আগের মতো আবার। সমুদ্র নাবিকদের তরঙ্গচ্ছ্বাসে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে পড়া।

চিত্রনাট্যটির একেবারে শেষে তাই লিখলাম—

বিটোফেনের সেভেন সিম্ফনির সুর যেন শাশ্বত সময়ের গভীরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বাজতে লাগল। কোনওদিন চলচ্চিত্রে রূপায়িত না হওয়া শুধু সমুদ্রের এই চিত্রনাট্যে এই আবহসঙ্গীত বাজতে থাকল চিরকালের মতো। ইংরেজ রোম্যানটিক কবি কিটসের লেখা কবিতা ‘ওড অন ও গ্রিসিয়ান আর্ন’-এ যেমন বলা হয়েছে ঐতিহাসিক মৃৎপাত্রটির গায়ে খোদাই করা রাখাল বালকের বাঁশী যেন চিরকাল ধরে বেজেই চলেছে। কোনদিন থামবে না তার সুর। আর চুম্বনরত প্রেমিক

প্রেমিকারাও যেন চিরকালের। শাশ্বত হয়ে আছে সেই কবেকার সুর এবং ভালোবাসা। হার্ড মেলডিজ আর সুইট বাট দোজ অফ আনহার্ড আর সুইটার।

আসলে কোথাও বিটোফেনের সুর বাজছে না, সমুদ্র নেই, নম্রতা নেই, তরুণ। নেই। দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে কাটাতে বহুদিন পরে ছাত্র জীবনের সেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে এসে দাঁড়াতেই এসব মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন শব্দ সুর সব শোনা যাচ্ছে। বিশাল ঢেউ নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রকে। আসলে সেদিনের সেই তরুণ ও নম্রতার মতো আজকের দিনের ইউনিভার্সিটির দুটি ছেলেমেয়েকে দেখা যাচ্ছে দূর থেকে মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসতে। আমার। সমুদ্র তাদের ওপর ভয়ঙ্কর ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কেন জানি না মুহূর্তে থেমে গেল বিটোফেনের সিম্ফনির সুর।

নাঃ মুহূর্ক্সে জন্য বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। ওই তো সিডি প্লেয়ারে আবার বাজছে বিটোফেনের মূচ্ছনা। এবার নাইনথ সিম্ফনি। ১৯৮৯-এ বার্লিন ওয়াল ভেঙে ফেলার পর পাঁচলক্ষ বার্লিনবাপ্রি খুশিতে উত্তাল তরঙ্গের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে এটি বাজান হয়েছিল। তখন অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে ছিলেন লিওনার্ড বার্নস্টাইন। হঠাৎ জলের নয় মনের চোখে দেখতে লাগলাম জনসমুদ্র। প্রবল ও স্বতঃস্ফূর্ত রঙ্গের উচ্ছ্বাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *