শহরে সকল সুখ

শহরে সকল সুখ

দিনের পর দিন গ্রামগুলো সব যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। মানুষগুলোও আর আগের মতো নেই। গ্রামের ছেলে ধলু অবাক হয়ে দেখে। অনেক আগের কথা মনে পড়ে যায়। নদীতে যখন ভাটা নামতো বহু দূর অবধি নরম ভেজা বালি চিকচিক করতো। নদীর তীরে বসে সেই বালি দিয়ে ধলুরা ঘর বানাতো। তার পর যখন জোয়ার আসতো, নদীতে মাতাল পানির ঢল নামতো, ধলুদের বালির ঘরগুলো ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়তো। জোয়ারের ঘোলা পানিতে সব তলিয়ে যেতো।

নদীতে এখন আগের মতো জোয়ার আসে না। স্রোতটা মরে গেছে। কখনো সরু ধারায় একটুখানি পানি বয়ে যায়। নইলে এপার ওপার শুধু বালি ধু ধু করে। রোদে তামাটে হয়ে বাতাসে হু হু করে ওড়ে। ছোট ছোট ঘূর্ণি হয়ে আকশে হারিয়ে যায়।

ধলু বসে থাকে সেই ধু ধু বালির চরে। বসে বসে শুধু ভাবে। দূরে দাদি ডেকে ডেকে ফেরে। কাছে এসে বলে তরে লইয়া আর পারি না। কোন সুম খনে তরে ডাকতাছি। আর তুই বইয়া রইছস এইহানে? ল, ঘরে যাই।

শুকনো, কঠিন, ফেটে যাওয়া মাটির আলপথ ধরে ধলু দাদির সঙ্গে ঘরে ফেরে। যতদূর চোখ যায় ফসলের শুকনো মাঠ খা খা করে। মনে হয় না কোনোদিন এ মাঠ ফসলের ভারে সবুজ ছিলো। মনে হয় না কোনোদিন এ মাঠে সোনালি ফসল কাটার আনন্দ নেমে আসতো। মনে হয় এ মাঠ চিরদিনই এমন ছিলো। হা-করা মস্তো ফাটলগুলো কঙ্কালের খুলির মতো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলে ভয় লাগে। পুরো মাঠটাকে প্রকাণ্ড এক কঙ্কাল মনে হয়।

দাদি বিড়বিড় করে, আল্লা, এ কি গজব নাযেল করলা। মানুষগুলা এমন ওইয়া গ্যালো ক্যান? কোন সর্বনাশের টানে মানুষ গ্যারাম ছাড়তাছে?

ধলু চেয়ে দেখে, দূরে শহরে যাবার রাস্তায় পিঁপড়ের মতো মানুষ। জোয়ারে বালির ঘরের মতো গ্রামগুলো চুর চুর করে ভেঙে যাচ্ছে। ভাঙা গ্রামের মানুষ শহরে যাচ্ছে। নিজের মনে প্রশ্নগুলো গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে–কিসের জোয়ার? মানুষ ক্যান শহরে যাইতাছে?

দাদি বলে, সর্বনাশের জোয়ার। সর্বনাশের টানে মানুষ শহরে যাইতাছে।

গ্রামের মানুষদের ওপর ধলুর বাবার ভীষণ রাগ। যখন মানুষ প্রথম গ্রাম ছাড়তে শুরু করলো তখন থেকেই তার রাগ। দিন দিন এই রাগ শুধুই বেড়ে চলছিলো। কারণ গ্রাম ছাড়ার মানুষও দিন দিন বাড়ছিলো।

একদিন হাঁদাই মাতবর তার সবকিছু গুছিয়ে নিলো। পান চিবুতে চিবুতে এসে ধলুর বাবাকে বললো, বুঝলা ধলুর বাপ, চিন্তা কইরা দেখলাম গেরামে থাকনের কোন সুখ নাই। ঠিক করছি শহরেই যামু।

মাতবরের অনেক পয়সা। কেউ মাতবরের কথার ওপর কথা বলে না। তবু ধলুর বাবা না বলে পারলো না, আপনে ক্যান শহরে যাইবেন? গ্যারামে আপনের কিসের কষ্ট?

একদলা পানের পিক থুক করে ছুঁড়ে দিয়ে হাঁদাই মাতবর বললো, দূর দূর। গ্যারামে সুখ আছে? সকল সুখ ওইলো গিয়া শহরে।

ধলুর বাবা ধারালো গলায় বললো, এতোদিন তো সুখেই আছিলেন।

অন্য কোন সময় হলে হাদাই মাতবর চটে যেতো। শুধু চলে যাচ্ছে বলেই বললো, তোমারে কইতে আপত্তি নাই ধলুর বাপ। সুখ কই দ্যাখতাছ গ্যারামে! কারে লইয়া সুখ করুম? গ্যারামের মানুষগুলান সব শহরে চইলা যাইতাছে। ট্যাহা পয়সা, জমি জিরাত যা আছে এগুলান খাটামু কোনহানে? মানুষ থাকলেতো ট্যাহা পয়সা খাটাইয়া সুখ আছে! গ্যারামে মানুষই নাই।

কথাগুলো শুনে ধলুর বাপের এতো বেশি ঘেন্না লাগলো–সে আর কোনো কথাই বলতে পারলো না। হাঁদাই মাতবর আবার বললো, চিন্তা কইরা দেখলাম, ভালই ওইবো শহরে গিয়া। জুতমতন কারবার করন যাইবো। আমার পোলায় ঠিকাদারী আর পারমিটের কারবার কইরা চাইরতালা দ্যালান দিছে। কত মানুষ খাটতাছে পোলার কারখানায়। দেখলেও বুকে শান্তি আসে। দিন রাইত কাম করে।

ধলুর বাবার কোনো কথা বলার ইচ্ছে হলো না। তবু পান চিবুতে চিবুতে হাঁদাই মাতবর বললো, বুঝলা ধলুর বাপ, আমিও পোলারে কইয়া দিছি, আমাগো গ্যারামের মানুষগুলানরে য্যান হ্যাঁগো কলে কারখানায় কাম কাজ দিয়া দ্যায়। মাইনষের দুঃখ বুঝলা, আমি সইয্য করতে পারি না। গ্যারামের মাইনষেগোরেও কইয়া দিছি শহরে গিয়া য্যান পোলার কারখানায় কাম লয়। ভালোই ওইবো। কি কও ধলুর বাপ?

ধলুর বাবাকে এবার বলতেই হলো, ভালা আর ওইলো কই! এইহানে থাকতে আপনের জমিতে কাজ করতো। শহরে গিয়া আপনের পোলার কারখানায় কাজ করবো। ভালাটা কই আমিতো দ্যাখতাছি না। কারখানায় কাম কইরাতো আর রাজা উজির ওইবো না।

পানের পিকটাকে গলার ভেতর রেখে খ্যাক খ্যাক হাসতে লাগলো হাঁদাই মাতবর তুমি বুঝবা না, বুঝলা ধলুর বাপ! তুমি বুঝবা না। বুঝছে ধনাই মণ্ডল। আমাগো মতন মানুষ ছাড়া কেউ বুঝবো না। ধনাইরে আমি কওনের লগেই রাজী ওইয়া গ্যাছে। ধনাইর শহরেও কায়-কারবার কম না। তা তুমি যদি যাও তোমারেও কারখানায় ভালা চাকরী একখান দিবার পারুম।

না। ধলুর বাবা চাবুকের মতো গলায় হিস হিস করে বললো, আমি যামু না।

বিচ্ছিরি শব্দ করে গলায় জমে থাকা পানের পিকগুলো ফেলে হাঁদাই মাতবর বললো, তোমাগোরে ভালা কথা কওন ওইলো আহামুকি। গ্যারামে বইয়া না খাইয়া মর।

রেগেমেগে চলে গেলো মাতবর।

সেই থেকে ধলুর বাবার রাগ আরো বেড়ে গেছে। ধলুকে বলে, তোরে কইয়া রাখলাম ধলু। দেখিস, শহরে একটা মানুষও সুখে নাই। সুখ ওইলো হাঁদাই মাতবর আর ধনাই মণ্ডলগো লাইগা। হ্যাঁগো গ্যারামেও সুখ। শহরেও সুখ । আমাগো বাঁচতে ওইবো গ্যারামে থাইকা।

ধলু বলে, গ্যারামে থাইকা খাইবা কি বাবা? ফসল কই? চাষ করবো কে? হাল বলদ কই? খাল কাটবো কে? মানুষ কই?

ধলুর বাবার চোখ দুটো তখন ফসলের মাঠের মতো রুক্ষ আর কঠিন হয়ে ওঠে। বিড় বিড় করে বলে, ঝড় তুফান খালি গ্যারামেই অয়। শহরে যদি একখান তুফান উইঠা সব সমান

ওইয়া যাইতো তাহলে মানুষ গ্যারামে ফিরা আসতো, ফসল ফলাইতো, সুখে থাকতো।

দাদি শুধু একটা কথাই বলে, আল্লা তোমার এমুন অবিচার ক্যান? আমাগো সোনার মাইনষেগো ক্যান শহরে নিতাছ? তোমার কইলজায় এটু দয়া মায়াও নাই?

ধলুর বাবা শুনে রেগে যায়–মা তুমি কেমুন কথা কও? আল্লায় কি শহরে বইসা মাইনষেগো ডাকতাছে? ডাকতাছে শয়তানে। শয়তানের ডাকে মানুষ শহরে যাইতাছে।

দাদি বলে, আমি বুঝি না বাপ, শয়তানে এত জোর কই পায়। অখনো তো আকাশে চান সূরু ওডে।

ধলুদের পাশের বাড়ির ফুলিরাও একদিন শহরে চলে গেলো। ধলুর ভীষণ খারাপ লাগলো। ফুলি ধলুর বন্ধু। ফুলির বাবা, ধলুর বাবার বন্ধু। অনেক দিনের বন্ধু। তবু সেই বন্ধুকে ছেড়ে চলে গেলো।

খবর পেয়ে ধলুর বাবা ছুটে গিয়েছিলো ফুলির বাবার কাছে –ক্যান ফুলির বাপ? তোমরা ক্যান শহরে যাইবা? তোমাগোতো ধনাই মণ্ডল আর হাঁদাই মাতবরের মতন কারবার নাই। ক্যান যাইবা তোমরা?

অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে ওঠে ধলুর বাবা। ফুলির বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, আমার কি কম কষ্ট ওইতাছে ধলুর বাপ। অনেক দুঃখ বুকে লইয়া শহরে যাইতাছি। শহরে দুইডা খাইয়া বাঁচবার পারুম। গ্যারামে তো কিছুই নাই। বলতে বলতে ফুলির বাবা কেঁদে ফেলে, বাপ দাদার ভিটা-মাটি ছাইড়া যাইতাছি। বুঝতাছ না কত কষ্ট বুকের মইধ্যে!

বুঝি ফুলির বাপ। ধলুর বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, বুঝি সবই। এইডাও বুঝি এই গ্যারাম আর গ্যারামের মাইনষেগো রক্ত দিয়ে শহরের কল কারখানা আর কারবার চলতাছে। বুঝলা ফুলির বাপ। আমরা বড় বেশি সস্তা ওইয়া গেছি।

সমস্ত গ্রামটা, সমস্ত গ্রামগুলো খা খা করে। সকালে সূর্য ওঠে পাতাঝরা মরা গাছগুলোর ভেতরে। দুপুরে ধু ধু কঙ্কালের মাঠে আগুন ঝরায়। সন্ধ্যেবেলা শুকনো নদীর হু হু চরে একসময় জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়। রাত নামে। ভূতুড়ে অন্ধকারে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস গ্রাম থেকে গ্রামে ফেরে।

সব কিছু শূন্য মনে হয় ধলুর। হু হু চর, ফ্যাকাশে আকাশ, খরায় ধু ধু মাঠের কুৎসিৎ ফাটলগুলো–সব যেন অর্থহীন হয়ে গেছে ধলুর কাছে। ধলু ভাবে। ধলুর বাবা চুপচাপ বসে থাকে দু’চোখে দুপুর সূর্যের আগুন নিয়ে। ধলুর দাদির দীর্ঘশ্বাস আর হা হুতাশ বাতাসে হারিয়ে যায়। ধলুর মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটা ধীরে ধীরে জমে যাচ্ছে। স্থির হয়ে যাচ্ছে।

সেদিন রাতে ধলুর স্থবির পৃথিবীতে ঝড় উঠলো–ফুলিদের চলে যাবার অনেকদিন পর, যেদিন ফুলির মা গ্রামে ধলুদের উঠোনে আছাড় খেয়ে পড়লো। ফুলির বাবা আর বেঁচে নেই। কারখানা তাকে গিলে খেয়েছে। একটু অসাবধান হয়েছিলো বুঝি। পুরো শরীরটা থেতলে একাকার হয়ে গেছে। দয়া দেখিয়ে মালিক পুষবার জন্যে ফুলিকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।

সেই রাতে ঝড় এলো। সারা আকাশ অন্ধকার করে প্রকাণ্ড কালো কালো মেঘগুলো সব কিছু ওলোট পালট করে দেয়ার জন্যে দৈত্যের মতো ছুটে এলো। সারারাত ঝড়ো বাতাস দাপাদাপি করলো।

শেষ রাতে ধলুকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো ওর বাবা। বললো, চল যাই।

কোথায় বাবা? ধলু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।

শহরে। ধলুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলো ওর বাবা। তারপর গভীর বিশ্বাসের গলায় বললো, শহরে সুখের ঘরে আগুন লাগামু।