শতাব্দী এক্সপ্রেস

শতাব্দী এক্সপ্রেস

হ্যাঁরে বদ্যিনাথ, দাদা কি চলে গেছেন?

হ্যাঁ বউদি, এই তো মিনিট দশ হল।

মায়া রান্না করে খেতে দিয়েছে, বদ্যিনাথ চানের জল দিয়েছে। সে চলে গেছে। ফুরিয়ে গেল ল্যাঠা। তাকে এত কামড়ায় কেন? সে তো এমনটাই চেয়েছিল। ভালো তত্ত্বাবধায়ক সে, সবাই বলে, সে নিজেও জানে। গুছোনো পরিচ্ছন্ন সংসার। এদিকের জিনিস ওদিক হতে পায় না। আলমারির পাল্লা খুললেই হ্যাঙারে পরপর শার্ট প্যান্ট ঝুলছে, বার করে নিক যেটা ইচ্ছে। বাথরুমের আয়না খুললেই দাড়ি কাটার সরঞ্জাম পরপর। যাকে পাটভাঙা তোয়ালে। জুতোর যাকে চকচকে জুতো। খেতে বসার দু মিনিট আগে টেবিলে তিন পদ রান্না সাজানো, যা চাও তাই। ঘি খাবে না মাখন খাবে? বেশ তাই। রোজ নয়? মাঝে মাঝে? ঠিক আছে, সপ্তাহে একদিন কি দুদিন। নিমপাতা ভাজা আলু দিয়ে মেখে একদিন, বেগুন দিয়ে একদিন? একদিন নিমঝোল? ঠিক আছে। মাছ গরম গরম ভাজাটাই সকালে ভালো লাগে? সব দিন ভাত নয়? অর্ধেক দিন রুটি! তবু যদি মন না ওঠে? ঠিক এই সময়টাই যে আমার চানের সময় স্বরূপ, নইলে চুল শুকোবে না। চুল না ভিজোলে বড়ো মাথা ধরে। ভিজে চুল নিয়ে বেরোবার প্রশ্ন নেই। তবে কি চুলটাই কেটে ফেলব! ডান হাতে যেন নাচের মুদ্রা করে পেছনের চুলের গোছা সামনে আনল শাওনি। খানিকটা কেটে ফেলেছে। কিন্তু যা আছে তার সৌন্দর্য সম্পর্কে বেশ সচেতন সে। যতখানি সম্ভব যত্ন নেয়। এই চুল কেটে ন্যাড়া বোঁচা? আজকাল অর্ধেক মেয়েই এরকমই। সেই জন্যেই আরও জেদ তার। চলতি ফ্যাশনের পেছনে সে ছোটে না। তার হল স্টাইল—এমনই একটা ধারণা তার আছে। খুব অমূলক কি? ছোটো চুলেরাই তো উচ্ছসিত হয়, ইস শাওনিদি, কী সুন্দর তোমার চুল! দেখলে হিংসে হয়।

হিংসে হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিজেরাও রাখতে পারতে অনায়াসেই। ফ্যাশন করবার জন্যেই মাথা মুড়িয়েছ।

আজকাল সব দরকারের ফ্যাশন, সুবিধের—তা জানো তো শাওনিদি? চুল ছোটো হতে হতে আর আছেটা কী? সামনেটাই একটু ঝাঁপালো। পেছনটা তো টিকটিকির ল্যাজ। তা ছাড়া বিচ্ছিরি কোঁকড়া?

বিচ্ছিরি কোঁকড়া? কী যে বলো? কোঁকড়া চুল দেখতে তো পাগল হয়ে যেতাম আমরা। ন্যাচারাল কার্লস! তার তুলনা আছে?

ধ্যাৎ, একরকম, সব সময়ে মাথাটা একরকমের দেখাতে থাকবে। বোরিং টু দা পাওয়ার ইনফিনিটি। ভালো হল সোজা চুল, বা সামান্য ওয়েভি। তোমারটায় সেই সামান্য ওয়েভ আছে। চুলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই মুগ্ধ পুরুষের সময় কেটে যাবে। …..

এইবারে কঠিন হয়ে যায় শাওনির ঠোঁটের রেখা। চোখের পাতা। চোয়াল চিবুক। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। কী লাভ! পুরুষ! পুরুষ! পুরুষ! সবাই যে যেখানে আছে ঠারেঠোরে বলে যাচ্ছে পুরুষের মনোযোগই মেয়েদের সব, পুরুষ একবার তাকালে মেয়েরা কৃত-কৃতার্থ হয়ে যাবে। বিজ্ঞাপন বলছে, সিনেমা বলছে, লোভনীয় মোহনীয় চিত্রভাষ্যে বলে যাচ্ছে। পুরুষেরও নারীর মনোযোগই কাম্য, টেক্সটাইল কোম্পানি, মদ বিক্রেতা এরা সে কথাও বলছে। হোক সে নারী ডাক-মেয়ে, পার্টি-প্রজাপতির ছদ্মবেশে পণ্যস্ত্রী। কিন্তু এই মনোযোগটা স-ব এমন কথা বলতে চাইলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। কেউই গুরুত্ব দেবে না এমন ভাবনাকে। অথচ এই মেয়েগুলো! ত্রিশ-ছুঁই-ছুঁই কিংবা সবে-ত্রিশ-পার, যৌবন যাদের এখন কস্তুরী মৃগের মতো করে রেখে দেবার কথা! তারা কারণে অকারণে পুরুষের মনোযোগের কথা বলে। যদি না বলে তো ভাবে অন্ততপক্ষে। ডিসগাস্টিং।

কী হল শাওনিদি, রাগ করলে?

তোদের ওপর রাগ করে লাভ?

কেন, তুমি স্বরূপদার মনোযোগ চাও না?

স্বরূপদার মনোযোগ আর পুরুষের মনোযোগ এক হল?

আচ্ছা বেশ, তুমি পথ-চলতি পুরুষের প্রশংসার চাউনি চাও না? একটু অ্যাপ্রিসিয়েশন? একটু মুগ্ধতা? খুব খারাপ? সেটা? একটা সভা-সমিতি কি উৎসবে সাজগোজ করে গেছ, কেউ তোমার দিকে চাইল না, চোখ দিয়ে কেউ বলল না দাউ আর্ট বিউটিফুল, খুব খুশি হবে তুমি শাওনিদি? সত্যি কথা বলো তো?

তোরা মুড়ি-মুড়কির, রসবড়া-রসগোল্লার ডিফরেন্স করতে পারিস না, কী-ই বা বলব তোদের? তবু চেষ্টা করছি বোঝাতে, শুধু পুরুষ কেন, মেয়েরাও কি অ্যাপ্রিশিয়েট করতে জানে না? তারা করলেও আমার তৃপ্তি। আর যে পুরুষ আমাকে ছেড়ে আমার চেহারার দিকে চেয়ে থাকবে, তাকে তোরা মুগ্ধই বলিস আর হ্যাংলাই বলিস সে আমার চোখে ছোটো হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে আমি আয়নায় নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে দুদণ্ড ভাবব কী ছিল সেই সাজগোজে যা আমার নিজেকে আড়াল করে দিল?

ওঃ শাওনিদি প্লিজ, ফিলজফিক্যাল কথাবার্তা বলো না। তোমার রসবড়া রসগোল্লার তফাত কজন ধরতে পারে গুনে দেখো তো।

আর বেশি কথা বলে না শাওনি। কী দরকার বাবা? এরপর ওরা নিজেদের মধ্যে শাওনিকে নিয়ে হাসাহাসি ফাজলামি করবে হয়তো। কাউকে প্রভাবিত করবার নেত্রীসুলভ বা গুরুসুলভ ইচ্ছা বা ব্যক্তিত্ব কোনোটাই নেই তার। নিজের ধারণামতো নিজে চলতে পারলেই সে যথেষ্ট মনে করে। নিজে…আর…আর… সে যাকে জীবনসঙ্গী বলে পছন্দ করেছে, যে তাকে জীবনসঙ্গী বলে পছন্দ করেছে। পারস্পরিকতায় সে স্বীকৃত, সেই সে যদি তার ধারণাগুলোকে মান দেয় তাতেই সে খুশি থাকবে বর্তে যাবে। আর কী চাওয়ার আছে জীবনে? একখানা ফ্রস্টফ্রি রেফ্রিজারেটর, একটা চার চাকার যান, একটা কাপড়কাচা কল, একটি বিদেশি প্রযুক্তির টেলিভিশন সেট এগুলো তো ঠিক চাওয়ার জিনিস নয় জীবনে। এগুলো জীবনযাত্রার উপকরণ। যে মনে করে লাগবে, না হলেই চলবে না, তার কাছে উপকরণ হিসেবে এগুলোর দাম বেশি। যার মনে হয় না হলে চলে যায়, তার কাছে এগুলো অবান্তর। শেফালি সমাদ্দার বলে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে তার একবার মধ্যপ্রদেশ বেড়াতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল। তিনি জ্যোৎস্নারাতে নর্মদাবক্ষ থেকে মাৰ্বলরকের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বলে উঠেছিলেন, খুব সুন্দর, না মিসেস সরকার? কিন্তু জীবনের উচ্চাশার কতটা এর জন্যে স্যাক্রিফাইস করেছি, তা জানেন?

কতটা?—চোখ মাৰ্বলরকে গচ্ছিত রেখে শাওনি আলগা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।

বোনচায়নার একটা ডিনার সেট, কমপ্লিট উইথ কাটলারি। অবশ্যই রুপোর। সেটটা বিদেশি। উফফ ভাবলে ভেতরটা যেন কেমন হয়ে যায়। হল না। মেয়ে, আমার ওই হাইস্কুলে-পড়া মেয়ে জববলপুর আসবেই। আসতে হবেই। আরে, ধৈর্য ধরে স্টার টিভিটা দ্যাখনা, কত প্রোগ্রাম করছে আজকাল দেশ-বিদেশের ওপর। না, যাবই। লাইভ দেখব। তা দ্যাখ, জোছনাও প্রতি শুক্লপক্ষে ঝরছে, আর মাৰ্বলরকেরও পাখা নেই। যে কোনো সময়ে দেখা যাবে। চার বছর পরে বিয়ে লাগিয়ে দেব, হনিমুনে যাস না হয়। কিন্তু অমন ড্রেসডেন চায়না? আর কি পাব?

শাওনির মনে হল ভদ্রমহিলা যে ফোঁস করে নিশ্বাসটা ফেললেন সেটা গাড়ির একজস্ট দিয়ে বেরনো কালো কার্বন মনোক্সাইডের মতো। নর্মদার জোছনাকে কালো করে দিচ্ছে। সুজিত বলে এক বন্ধু আছে শাওনির। খুব ভগবানে বিশ্বাস করে। সে প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার সময়ে প্রার্থনা করে, হে ভগবান, আমার যেন একটা ফোর হুইলার হয়।

সুজিত-টুজিতের কথা বলে লাভ কী? খোদ শাওনির ঘরেই এই জাতীয় একজন মজুত আছে। প্রোমোশনের সঙ্গেই আসল গাঁটছড়াটা বেঁধেছে মনে হয়। বারো বছর আগে যখন ঘর বেঁধেছিল? মনে হয়েছিল…না, মনে হওয়ার কথা ভেবে কোনও লাভ নেই। মনে হওয়া জিনিসটা এত ব্যক্তিগত যে তার ওপর নির্ভর করে জীবনের কিছুই চলে না। কিন্তু…কত কোমল ছিল তখন স্বরূপের মুখ। কত ভাবুক ছিল তার চাউনি। কত আদর ছিল দু হাতে। সুবিচার ছিল ব্যবহারে। স্বরূপ তখন শাওনিকে তার প্রিয় বন্ধু ভাবত। এখন? এখন ভাবে না। শাওনির সম্পর্কে ভাববার তার সময় নেই। যদি বা ভাবে তাহলে শাওনি এখন তার স্ত্রী। ঘরনি গৃহিণী। খুব খারাপ লাগে খারাপ কথা বলতে, ভাবতে কিন্তু…কিন্তু শাওনি এখন স্বরূপের মেয়েমানুষও কি?

একটা সীমাহীন অন্ধকারে ভরে যেতে থাকে ভেতরটা। অন্ধকার, গ্লানি। শিক্ষা… বুদ্ধি… সতর্কতা… ভালোবাসা কিছুই শেষপর্যন্ত কাজে লাগে না জীবনে। তারা কি পরস্পরকে বোঝেনি? সে আর স্বরূপ? দুজন প্রাপ্তবয়স্ক, ডিগ্রিধারী, চাকুরিপ্রাপ্ত যুবক যুবতি? স্বরূপ বলেছিল, তোমাকে আমি সুখে রাখব, শাওনি।

তুমি আমাকে প্রেমে রেখো।

আর তুমি? তোমার বুঝি আমাকে প্রেম দিতে লাগবে না?—শাওনি হাসছিল। কত বিশ্বাস তখন জীবনে।

প্রেম প্রথম শাওনি, তারপর সুখ।

আমিও তোমাকে সুখে রাখব। দুধে-ভাতে। এই দেওয়া কথার অর্ধেকটা তারা রেখেছে। পরস্পরকে তারা সুখ দিয়েছে।

স্বরূপ প্রথম দিল টেলিভিশন সেট। দামি। রঙিন। তারপর দিল ফ্রিজ। প্রশস্ত, দু-কপাট, সুন্দর। তারপরে দিল ভি.সি.পি। তারপরে একটা চমত্তার সাততলার ফ্ল্যাট। তারপর তেজি স্কুটার। মিস্কি, মাইক্রোওয়েভ আভেন, ওয়াটার পিউরিফায়ার, ভ্যকুয়াম ক্লিনার, ওয়াশিং মেশিন… শাওনি? শাওনি দিয়েছে পুষ্টিকর, রুচিকর, নিত্য নতুন খাদ্য, ধবধবে জামাকাপড় হাতের কাছে, মুখের কাছে চা, কফি, মশলা, চকচকে জুতো, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের জন্য আপ্যায়ন, ইদানীং দিচ্ছে ড্রিংকস নরম এবং কড়া। দিচ্ছে না শুধু যান্ত্রিকভাবে নিজেকে। স্বরূপ বুঝতে চায় না প্রাণের টানে, প্রেমের টানে যে চাওয়া, সে চাওয়া চাইতে পারলেই শাওনি আছে। আছে নিবিড়, ভরাট অথই দিঘির জলের মতো, আছে উর্বরী মৃত্তিকার পেলব অভ্যন্তরের মতো, অনন্ত কুয়োর জলে পড়ে থাকা চাঁদের মতো।

সম্ভবত এসব আর চায় না স্বরূপ। তার বড্ড তাড়া। তা ছাড়া সে জানে দাম দিলাম কিনলাম এনে ফেললাম। ব্যাস। আবার কী? এক জিনিস যেমন বার বার কেনার পরিশ্রম সয় না, এক মানুষকেও তেমনি বার বার জয় করা লাভ করা এসব সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার অনেক পেছনে ফেলে এসেছে সে। ঠিক আছে। তাহলে বদ্যিনাথ চানের জল দিক, মায়া খেতে দিক, আলমারির পাল্লা খুললেই পরপর শার্ট, ট্রাউজার্স টাই, যাকে ব্রাউন, যাকে কালো জুতো পালিশে নিশপিশ করছে। তা ছাড়া এ তো কোনো প্রতিশোধ নয়। এটা একটা সুবিধের বন্দোবস্ত। এর মধ্যে শাওনির কোনো রাগ নেই। এমন নয়, সে লোকজনের হাতে স্বরূপকে একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। এ একটা আবশ্যিক ব্যবস্থা। সে-ও তো একটা চাকরি করে। প্রোমোশনে প্রোমোশনে ছয়লাপ না হলেও ভালোই চাকরি। সৃষ্টিসুন্দর, সন্তোষজনক। এ নিয়ে স্বরূপের সঙ্গে তার কোনো প্রতিযোগিতা নেই। স্বরূপ হয়তো বলতে পারে—তোমার বেরোবার সময় বরাবর একই ছিল। আমারও। তখন তুমি আমার সঙ্গে খেয়ে নিতে। মাঝে মাঝে যেমন বেণী তেমনি রবের অত্যাচার তোমার সইত। তুমি চুল ভিজোতে না। তা হলে? কিন্তু এ কথা বলার অধিকার কি স্বরূপের আছে আর? অধিকার তো আলাদা কথা, মানসিকতা? মানসিকতা আছে তার এ কথা বলার? যদি বলে তবে সেটা হবে না কি চূড়ান্ত হিপক্রিসি।

সে কি বলে না শনিবার ব্যান্ডেল লোকাল ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাওয়ার সেই আনন্দ একটা অপ্রয়োজনীয় রোমান্টিক ভাববিলাস! শনিবার তাকে হিতেশের বাড়ি ছুটতে হবে। হিতেশের একটা পি. সি. আছে বলে। বহু কাজ, বহু কাজ এখন দুজনে মিলে করবে। ডিগ্রিতে যা নেই, কাজের আগ্রহে, দক্ষতায় তা পুষিয়ে দিতে হবে তাকে। হবেই। নইলে নেক্সট প্রোমোশন ফসকে যাবে।

এদিকে সুসময় যে ফসকে যাচ্ছে। জীবন যে ফসকে যাচ্ছে সে চেতনা ওর আর নেই। সন্তান ও চায় না। একদম গোড়ার দিকেই বলে দিয়েছিল বাচ্চাকাচ্চা ও সব ভুলভাল ব্যাপার। সেটাতেই এখনও সেঁটে আছে ও।

শাওনি অবশ্য বাচ্চা না থাকাটা বা থাকাটাকে তাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা ইস্যু করে তুলতে চায়নি কখনও। পত্রিকাটা হোক ছোটো। তবু তার সহ সম্পাদিকার কাজটার মধ্যে তার মনে এমন একটা মুক্তি সে এখনও পায় যে নিজেকে সার্থক মনে করতে অসুবিধে হয় না। বাড়িতে দুজনেই চাকরি করলে বাচ্চা আনাটা বাচ্চার প্রতি অবিচার এই ধারণাটাও ছিল তার খুবই শক্তিশালী। নিজের ছোটোবেলার কথা স্মরণ করে। তবু তো তার মা কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন। দশটা পাঁচটা নয়! কিন্তু যতক্ষণ বাড়িতে একা, লোকের কাছে ততক্ষণ সে যে কী অসহায়বোধ। স্কুলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যদি বা সেটা কাটত, বাড়ি ফিরে মা-হীন বাবা-হীন বাড়িতে ঢোকবার কথা মনে হলেই গা ছমছম করত। শাওনি চায়নি আর কোনো বাচ্চা তার মতো কষ্ট পাক। তারপর স্বরূপ? স্বরূপের এই চব্বিশ ঘন্টার চাকরি তাকে বাবা হবার অধিকারচ্যুত করেছে। একেবারে নিশ্চিতভাবে। পাঁচ বছরের শাওনির ধুন্ধুমার জ্বর, ডাক্তার সন্দেহ করেছেন এনকেফেলাইটিস। বাবা টুরে। সাতদিনের আগে আসবেন না। বেশিও হতে পারে। দুপুর রাত। একটা লোক নেই। টেলিফোন ডেড। মা পাশে জলের গ্লাস রেখে বাড়ি চাবি দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ডাক্তারের বাড়ি ছুটে যাচ্ছে, সেই ঘটনার আর কি পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত তার জীবনে?

চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাচ্চার জন্যে প্রস্তুত হতে পারত সে। কিংবা বাচ্চা জন্মাবার পর অসুবিধে বুঝে চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারত। কিন্তু স্বরূপ-শাওনি সরকারের বাচ্চা না হলেও ভারতবর্ষের চলে যাবে—খাবার একটা মুখ, চাকরির একটা উমেদার কম থাকবে এটা যেমন শাওনি ভুলতে পারে না, তেমনই ভোলে না সন্তান তাকে পূর্ণতা দেবেই এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। তার অধ্যাপিকা মা, সেলসম্যান বাবা তো দৌড়োদৌড়ি করে তাকে মানুষ করেছেন, কুড়ি-বাইশ বছর বয়সে পঞ্চান্ন বছরের পরিশ্রমজীর্ণ মাকে কি তার বুড়ো মনে হত না? মনে হত না মা গত যুগের মানুষ, ক্রমেই রক্ষণশীল হয়ে যাচ্ছে, স্বরূপকে মায়ের তেমন পছন্দ হয়নি বলে সে কি মায়ের ওপর মর্মান্তিক ক্রুব্ধ হয়ে ওঠেনি? বাবা গত হয়েছেন, মা একলা এক বান্ধবীর সঙ্গে থাকতেন শেষটায়! যেত, মাঝে মাঝেই যেত, কিন্তু তাদের দুজনের সংসারে কি মাকে ঠাঁই দিতে কখনও ডেকেছে। স্বামী-স্ত্রীর সংসারে তৃতীয় ব্যক্তি থাকা ভালো না, স্বরূপের এই নীতিতে কি সে সায় দেয়নি? আর স্বরূপের ব্যাপার তো আরও খারাপ! স্বরূপের বাবা-মা দুজনেই জীবিত। এই শহরেরই প্রান্তে থাকেন, ভাইঝির বাড়ির একতলায়। স্বরূপ সেই খুড়তুতো দিদি জামাইবাবুর ওপর মা-বাবার দায়িত্ব সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে। টাকা-পয়সা পর্যন্ত দেয় না। বাবা-মার তো যা হোক কিছু সঞ্চয় আছে, পেনশন আছে, কী দরকার! যেন দরকারই সব। দরকারের ওপরে কিছু নেই। বিশেষ বিশেষ সময়ে মনে করে উপহার, স্বরূপের মনেও থাকে না। সে তো শাওনিই দেয়।

অবশ্য এসব কথা তার সম্প্রতি মনে হয়। বিবাহের বারো বছর পর। শ্বশুর শাশুড়ি এখন দূর গ্রহের মানুষ। নিজের মা মরে বেঁচেছেন। ছেলেমেয়েদের থেকে তাঁদের কিছু পাওয়া হয়নি এগুলো এখন, আজকাল মাঝে মাঝে জ্বলন্ত লোহার ছ্যাঁকার মতো বুকের মাঝখানে লাগে। জ্বলতে থাকে বুকটা। এসব ভুলের ক্ষমা নেই। শুধরে নেওয়ার উপায় নেই। সে শুধু বুঝতে পারে ছেলেমেয়ে তাকে পূর্ণ করবে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। নতুন কোনো ব্যথা-বেদনার উৎস তৈরি করে কী লাভ! উপরন্তু স্বরূপের সাধ্য, ইচ্ছে, স্বরূপের সঙ্গে সম্পর্কের চিরত্ব এগুলোর ওপর তার বিশ্বাস খুব পোক্ত নয়, এটা সে বুঝতে পারে। আর স্বরূপ বোধহয় এখনও তার নিজের মানসিকতার স্থির। বাচ্চাকাচ্চা ও সব ভুলভাল ব্যাপার।

অফিসে বেরোবার সময়ে বলে বেরোও না কেন? কথাটা বলেই শাওনির মনে হল সে ভুল করল। জিজ্ঞাসার ফ্রেমে না রেখে অন্যভাবে বলা যেত কথাটা। বলে বেরোলে পারো—এটা বললেই ভালো হত। সোজাসুজি জিজ্ঞাসাটা যেন একটা দ্বৈত সমরে আহ্বান।

বলেই তো বেরোই।–স্বরূপ টি.ভি-র পর্দায় চোখ রেখে বলল। সিগারেটটা মুখের একপাশে চালান দিয়ে।

কখন আবার বলো?

চান করলুম, জামাকাপড় পরলুম, খেলুম, জুতো পরলুম-বলা আবার কেমন হবে? … যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর, যেমন কর্ম তেমন ফল-শাওনি ভাবল।

পত্রিকাটার পাতায় তার চোখ, কিন্তু সে কিছুই পড়ছে না।

চুমু-টুমুও খেতে হবে না কি-পার্টিং কিস?

আপাদমস্তক রাগে লাল হয়ে গেল শাওনি। এত তিক্ততা? এতটা সিনিক এই লোকটা? বারান্দার দাঁড়াল। ঘরের ভেতরে এল। শীত শীত লাগল। পাখা বন্ধ করে দিল। খুবই স্পষ্ট যে সে আঘাত পেয়েছে। কিন্তু স্বরূপ সরকার একবারও ডাকল না, একবারও এল না, বারান্দায় বা ঘরে। নিজের ভঙ্গি বদল করল না। ঠিক যেমনভাবে সিগারেট হাতে-মুখে টিভি দেখছিল ঠিক তেমনভাবেই দেখতে লাগল। জঘন্য-জঘন্য বিজ্ঞাপন, তাদের অসম্ভব রূপকথাসদৃশ সুখের প্রলোভন। আদিখ্যেতা এবং মাঝে মাঝে যতিচিহ্নের মতো সিরিয়্যাল, নতুন বোতলে পুরনো মদ। একই, সেই একই একঘেয়ে আখ্যান, একই চরিত্র, একই চরিত্রহীনতা।

খেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু কোনোরকম দেখানেপনা তার অসহ্য। তাই সে উঠল। চোখে-মুখে জল দিল। অভ্যস্ত যত্নে খাবার পরিবেশন করল। তারপর রোজকার মতো দুখানা রুটিকে আট টুকরো করল দুহাতে ছিঁড়ে। চারটে টুকরো দুধের বাটিতে ফেলল। আর চারটে টুকরো আলুকপির হেঁচকি দিয়ে মুড়ে মুখে পুরতে লাগল একের পর এক, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু খাবারে তার কোনো স্বাদ লাগল না। ডাল নেবে কি না, মাছের কোন টুকরোটা তাকে দেওয়া হবে—এই সব টুকটাক প্রশ্নও সে রোজকার আলগা ভঙ্গিতে করল তার বরকে। কিন্তু তাতে ছিল না কোনো অন্তরঙ্গতা, না কোনো প্রাণ।

রাতে শুতে যাবার সময়ে সে ইচ্ছে করে অনেক দেরি করল। পড়ার ঘরে পত্রিকা স্তুপীকৃত হয়েছে। খাবারের কাগজগুলোর রবিবারের পাতা। একটার পর একটা খুলে সে পড়তে লাগল দাগিয়ে দাগিয়ে। এটা তার দরকার হয়। একটা ডায়েরির পাতায় সামান্য কিছু নোটও করল সে। ঘড়িতে একটা বাজতে তার খেয়াল হল। দুজনের একমাত্র শোবার ঘরে গিয়ে দেখল সবুজ আলোয় মাখামাখি হয়ে স্বরূপ ঘুমোচ্ছে। স্বল্প পরিসরের মধ্যেও এইভাবেই প্রথম বিচ্ছেদ সম্ভব করল শাওনি। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল কোটি-কোটি দম্পতি হয়তো এভাবেই থাকে, এভাবেই সম্ভব করে এসব। অন্তত এতকাল করেছে ভারতের মতো দেশে। সম্প্রতি আর করতে চাইছে না। উপায় বেরিয়েছে কিছু। একবিংশতিতে হয়তো আর কেউই এসব সহ্য করতে চাইবে না। বিশেষত সন্তানের দায় না থাকলে।

স্বরূপ বদলে গেছে। খুব বদলে গেছে। আগেকার প্রতিজ্ঞা সংকল্প এসব আর তাকে মনে করিয়ে কোনো লাভ নেই। সেভাবে আর ওর মনে পড়বেও না। কতকগুলো কথা মনে পড়াই তো আর মনে-পড়া নয়। তার পেছনে বা তার সঙ্গে যে আবেগ থাকে, অনুভূতির যে জটিল ঐশ্বর্য থাকে সেগুলোও মনে পড়তে হবে। নইলে নিতান্ত নিছক কতকগুলো কথার স্মৃতিতে বিশেষ কিছু নেই।

সে? সেও কি বদলেছে? বদলেছে বইকি? পঁচিশ বছর আটত্রিশ হয়েছে। সে স্থির হয়েছে। হৃদয়ের কথা বলবার সেই ব্যাকুলতা তাকে ছেড়ে গেছে। প্রেম? আগে না পেলেও দিতে পারত। উপছে পড়ত অতিরিক্তটুক। উপছে-পড়ার আনন্দে মাতোয়ালা থাকত। কড়ায়-গন্ডায় ফেরত পেলে কি না গ্রাহ্যই করত না। এখন করে। না পেলে আর দিতে ইচ্ছে করে না। এমন নয় যে তার হাতের অঞ্জলিতে প্রেম ভরা আছে, সে মুঠি বন্ধ করে রাখছে। আসল কথাটা হল, উসকে না দিলে প্রেম আর জন্মাচ্ছে না। ঠান্ডা জল জমা রয়েছে বুকে। তাকে তোমার উত্তাপে তাপিত করো তবে সে টগবগ করে ফুটবে, আর তখনই জন্ম হবে সেই রঙিন বাষ্পর। অধরা-মাধুর্যময়, বায়বীয় তবু বুকের মানিক, নয়নের নিধি সেই ভালোবাসা।

ভালোবাসা কী? ভাবে আজকাল শাওনি। কী সে জিনিসটা? ভাবটা? সত্যিই ভাব তো? বিশুদ্ধ, বিমূর্ত? পাত্র-ব্যতিরেকে সে থাকে? এই যে সে ভেবেছিল স্বরূপকে না হলে তার চলবে না, এটা তো ভুল। স্বরূপ কিংবা অরূপ কিংবা বিশ্বরূপ যে-ই হোক না কেন, তার রুচির পরিধির মধ্যে থাকলে বাকি ঘটনাগুলো পর পরই ঘটত। এখন তো স্বরূপের বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই তার জীবনে। স্বরূপের জীবনে শাওনিরই বা তাৎপর্য কী? কিছু না! কিছু না। ভালোবাসা কি যৌবনেরই ধর্ম, আরও পরিষ্কার গদ্য করে বলতে গেলে শরীর রসায়ন? হরমোন সম্ভব? স্বরূপের হরমোনেরা কি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে, মাত্র এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে? শাওনির হরমোনেরা কি বিরূপ? বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাবে না কি তারা? প্রেমের জন্যে? গেলেই ডাক্তার জিজ্ঞেস করবেন, নাল লাইফ লিড করছেন তো?

উত্তরে বলতে হবে, নামানে হ্যাঁ। অর্থাৎ আকাঙক্ষার কোনো অভাব নেই। স্বরূপের তো নয়ই। সে একটা রোবোই-মানুষের মতো কলকবজা নাড়ে। শাওনিরও নেই। কিন্তু আকাঙক্ষার হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে তার স্বরূপের আগেকার রূপ, আগেকার চেহারা মনে করতে হয়।

স্বরূপ, স্বরূপ তুমি অমন করে চেয়ো না।

তুমি অমন করে এলে কেন? নি! নি! তুমি কী পরেছ? কি করেছ আজ?

কই বিশেষ কিছু তো পরিনি, কিছুই করিনি।

তাহলে? তাহলে আমার ভেতর-অন্দর থেকেই যদি অমন চাউনি উঠে আসে…

কী দেখছ তুমি? কী দেখতে পাচ্ছ?

নি, আমার বলবার শক্তি নেই। এক প্রবল অনুভূতির তোড়ে সব হারিয়ে গেছে, সব ঘুরছে।

কালবৈশাখীর মতো?

অনেকটা। অনেকটা…হোল্ড ইয়োর ট্যাং ওহ ফর গডস সেক…

কতদিন স্বরূপ তাকে নি বলে ডাকে না। ডাকলেও বোধহয় ন্যাকা-ন্যাকা শোনাবে এখন। টাং হোল্ড করতে অবশ্য এখনও বলে। বলে কর্কশ, রূঢ় গলায়। আমি চলে যাব—ভেতর থেকে একটা স্বতঃস্ফূর্ত কান্নার মতো উচ্ছাসে বেরিয়ে এলো কথাগুলো। আমি চলে যাব। কাকে বলল শাওনি? স্বরূপ তো সামনে নেই! সে এখন দিল্লি গেছে। কিন্তু এই ঘরে, বাড়িতে স্বরূপ আছে। আছে দেয়ালে, জানলায়, কড়িকাঠে, আছে আলমারিতে, ছবিতে, শয্যায়, চেয়ারে, টেবিলে, সোফায়, মোড়ায়। আলমারির পাল্লা খুলে সারি-সারি ঝুলন্ত পোশাকগুলোকে শাওনি বলল, চলে যাব। টেবিলের ড্রয়ার খুলে তাড়াতাড়া কাগজপত্র নাড়তে চাড়তে বলে উঠল, যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি শিগগিরিই। চান করতে করতে শাওয়ার খুলে, ঊধ্বমুখে জলের তরল আঘাত নিতে নিতে। জোরালো গলায়, চারণ কবি মুকুন্দদাসের কিংবা নজরুলের দেশপ্রেমমূলক গানের প্রদীপ্ত সুরে বলে উঠল,

যাব, আমি চলে যাব। যাচ্ছি আমি যাচ্ছি চলে, সকল ফেলে সকল ভুলে, যাব যাব, সব হারাব, ফিরব না আর ফিরব না গো, যাবই যাব।

চান সেরে বেরিয়ে, শাড়ি পরতে পরতে, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে, শূন্য ঘরে ঘুরতে ঘুরতে, অন্যমনস্কভাবে ভাত খেতে খেতে শাওনি দেখল, বা বুঝল এই বাড়ির সর্বত্র যেমন স্বরূপ আছে, তেমনই সে-ও আছে। কোণে কোণে। ছবিতে, শয্যায়, চেয়ারে, টেবিলে, সোফায়, মোড়ায়, জানলায়, দরজায়, পর্দায়, পাপোশে…সর্বত্র। শাওনিকে চলে যাব বলতে তার গলা আটকে গেল। ফিসফিসানির বেশি উঠল না গলাটা।

কিন্তু এমনই ভেতরে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছিল সে চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা শাওনির মুখোমুখি হবার জন্য, যে মিনিবাসে অফিস যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে উঠল, যাব। একটু পরে আরও জোর গলায়। পাশের ভদ্রলোক চমকে ফিরে তাকালেন। একটু গুটিসুটি মেরে বসলেন। একটু সংযত সতর্ক হয়ে গেল সে। কিন্তু লজ্জা পেল না। মানুষ যখন তার জীবনের চূড়ান্ত মুহূর্তগুলোর মোকাবিলা করে তখন লজ্জা-সংকোচ এসব অতি তুচ্ছ মনে হয়। কী এসে যায় মিনিবাসের সহযাত্রী যদি তাকে ছিটগ্রস্ত ভাবেন? কিছু না।

কদিন ধরেই রাস্তা পার হচ্ছিল সে যান্ত্রিক অভ্যাসে। লাল আলো, হলুদ আলো, সবুজ আলো সমস্তই চেতনার ভেতরে জ্বলে, নেভে। ধাবমান, গর্জমান যান-মিছিল পার হয়ে, অফিসের দরজায় পৌঁছে চড়াৎ করে সে জ্ঞানে ফিরে আসে। সে কী? কখন সে রাস্তা পেরোল? বাস থেকে ঠিকঠাক স্টপে নামল কী করে? কখন কীভাবে সবটাই তার অজ্ঞাতে ঘটে গেছে। হঠাৎ শিউরে ওঠে সে। যদি কোনো গাড়ি ওস্তাদ খেলুড়ের মতো তাকে হেড মারত? শূন্যে লাফিয়ে উঠে ফুটপাথের শানে কিংবা অন্য খেলুড়ে গাড়ির সামনে পেছনে, নাকে মাথায় আছড়ে পড়ত! না, না অমন সমাপ্তি সে চায় না। না, সতর্ক হতে হবে। অমন হারিয়ে গেলে চলবে না।

এই মেজাজেই কাঠের পাটিশন-করা মাঝারি অফিসঘরে ঢুকে সে শুনল মালিক জয়ন্ত শেঠ বলছেন, না, না, মিসেস সরকারকে আমি এ প্রস্তাবটা দিতে পারি না। একে মহিলা, তার ম্যারেড। হতেপারে একটা কাগজ চালাচ্ছি। তার মানে হৃদয়টাও কাগজের মতো হতে যাবে? সুবীর তুমি একটু ভাববা…।

কী প্রস্তাব?–শাওনি সতর্ক চড়া স্বরে বলল এগোতে এগোতে।

কুপ্রস্তাব নয়, ঘাবড়াবেন না—সুবীর বলল হেঁকে!

আজ পনেরো বছর স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের সঙ্গে কাজ করছে, শাওনির এসব ইয়ার্কি গা-সওয়া হয়ে গে সুবীর ছেলেটা খুব ভালো, মজাদার। কিন্তু জয়ন্তবাবুর সামনে? এদের মাত্রাজ্ঞান আর কবে হবে?

জয়ন্তবাবু হাসলেনও না, কথাটা শুনেছেন বলেও জানতে দিলেন না। কেজো গলায় বললেন, আসলে উড়িষ্যাতে ছোট্ট করে একটা ব্রাঞ্চ খুলছি। লোক্যাল লোকই নেওয়া হবে, কিন্তু অভিজ্ঞ কারও যাওয়া দরকার। আপনার মতো। অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ, এক্সপার্ট যাকে বলে। এই সব চ্যাংড়াদের কাজ নয়।-সুবীর ইত্যাদির দিকে নজরটা ঝাঁটা বুলিয়ে নিলেন তিনি, কিন্তু আপনি ভাববেন না। আমরা ভাবছি। আরও ভাবছি।

যাব। আমি যাব।

বলছেন কী মিসেস সরকার? অফকোর্স ইটস আ প্রোমোশন! অ্যালাউয়েন্স বাবদও ভালোই দেওয়া হবে। বাসস্থানের ব্যাপারে মহিলা গেলে আমরা একস্ট্রা কেয়ারও নেব। কিন্তু…এটা…মানে চট করে ফেরত আসতে পারবেন না।

যাচ্ছি, আমিই যাচ্ছি। প্লিজ ডু দ্য নিডফুল।

নিজের ছোটো কিউবিকলে ঢুকে গেল শাওনি।

হোয়াট?—আপাদমস্তক নাড়া খেয়ে চমকে থমকে বলে উঠল স্বরূপ।

প্রোমোশন। পুরোনো লোক নইলে নতুন ব্রাঞ্চ কে সামলাবে?

তাই বলে…আর কেউ ছিল না?…তুমি রাজি হয়ে গেলে?

কী করব? চাকরি… তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। এরা ওয়েল-ট্রেনড। ঘাড়ে ধরে তাড়িয়ে না দিলে কাজ ছাড়বে না।

স্বরূপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। বলল না। একটু পরে বলল, কতদিন লাগবে ব্রাঞ্চটা চালু করতে?

শাওনি বুঝল ও ভেবেছে ব্যবস্থাটা সাময়িক। সে কিছু ভাঙল না। বলল, দেখা যাক।

চুপচাপ টিভি দেখা। এ. টি. এন। অবিশ্রান্ত উদরী নাচ, নিতম্ব নাচ, অবিশ্রান্ত তাল হ্যাঁচকা খিচুড়ি গান। স্বরূপ দেখছে। দেখুক। শাওনি প্যাকিং করবে। জামা কাপড়, প্রসাধনী, ওষুধ-বিষুধ, টিনের খাবার, বিস্কুট মশলা। যথাসম্ভব কেটেছেটে। সামান্য কিছু বই কাগজপত্র। একটা বাজল। ঘড়ি জানান দিচ্ছে। ভোর সাড়ে চারটের সময়ে উঠতে হবে। সন্তর্পণে একেবারে পা টিপে টিপে সবুজ আলোর ঘরে শয্যার ধার ঘেঁষে শুয়ে পড়ল শাওনি।

নি, নি তুমি কেন যাচ্ছ? কেন রাজি হলে? কেন? নি, তুমি হারিয়ে যাচ্ছ, তুমি যাবে না, যেয়ো না শাওনি, যেয়ো না…নাঃ স্বরূপ সরকার অঘোরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। বিয়ার-ঘুম কিংবা হুইস্কি-ঘুম। অনেকক্ষণ বিশুষ্ক চোখে জেগে জেগে কখন ঘুম এসে গেছে। পাঁচটা বাজার শব্দে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল শাওনি। পাশে স্বরূপ নেই। বাথরুমের দরজা খুলে যাচ্ছে। পরিষ্কার-দাড়ি কামানো, স্নাত স্বরূপ, পোশাক-পরিচ্ছদ পরা।

আমি চট করে একটু কফি খেয়ে ট্যাক্সি ডাকতে বেরোচ্ছি।

চান করার তেমন সময় আর নেই। চুল বাঁচিয়ে কাক-চান। সিনথেটিক কাপড়ের সালোয়ার কামিজ। চুলে বেণী বাঁধা। এই ভালো হল, যেমন বেণী তেমনি রইল, চুল ভিজল না। একটা, দুটো, তিনটে, চারটে হয়েছে লাগেজ। কপালে কালো টিপ আটকাতে আটকাতে আয়নার দিকে তাকাল শাওনি। আটত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে। আঠারো বছরেও মনে হত আঠারো? এখন মনে হয়, একদিন আটাশ ছিলুম। মনে হয় যখন আঠারো ছিলুম! কিন্তু আয়নায় কিছু বোঝা যায় না। না-পাওয়ার ভার, না-দেওয়ার ভার, কিচ্ছু না। যুবতী এক, নরম কপালে তারার মতো টিপ পরছে। শুধু চোখ দুটোয় ভালো করে চোখ ফেললে বোঝা যাবে সেখানে বাদামি কনীনিকার পেছনে ক্লান্ত সংকল্প ধূসর পর্দা মেলে রয়েছে। চুলের রঙে একটা খয়েরি ছোপ, খড়ের মতো শুষ্কতা যা যত্নের অপেক্ষায় আছে।

এতগুলো?—স্বরূপ।

আমি দুটো নিচ্ছি—শাওনি।

তুমি গাড়িতে গিয়ে বোসো—স্বরূপ।

বাস্কেটটা নিচ্ছি-শাওনি।

জল কই?-স্বরূপ। মিনার‍্যাল ওয়াটার নিয়ে নেব-শাওনি। স্বরূপ চুপ। শাওনি চুপ।

ভোরবেলা। ভোর। ময়লার গাড়ি। ময়লা। বাতি টিম টিম। সেলোফেনে সূর্য মোড়া। শুকতারা এখনও। ফিকে। ফালি চাঁদ। শুকিয়ে যাচ্ছে। টুপি মাথায় বৃদ্ধ। ভোরের হাওয়া। কাঁপ-ধরা ঠান্ডা। ভিখারি। বেরোচ্ছে। পা নেই। ঠ্যালাগাড়ি। চাকা অলা। ঠেলছে। ঠান্ডা স্ট্র্যান্ড রোড থরথরে। থরথর…থরথর। হাওড়া ব্রিজে টিনোসেরাসের পিঠ। কাঁপছে। ফেলে দেবে? গঙ্গা। ময়লা। গমগম গমগম। স্টেশন। জটলায় জটলায় পুঁটলি-পাঁটলার যাত্রীদল। গ্রুপে গ্রুপে নরম, শক্ত ল্যাগেজ নিয়ে ফিটফাট প্যাসেঞ্জার। সরসর সরসর। খবর্দার! খবর্দার! যাত্রী ভেদ করে ঠ্যালাগাড়ি। অমুক আপ উইল ডিপার্ট ফ্রম তমুক প্ল্যাটফর্ম অ্যাট অমুক আওয়ার। টু জিরো টু ওয়ান আপ…টু জিরো টু ওয়ান আপ…কোচ সেভেনটিন…সেভেনটিন। সিট ফর্টিওয়ান…থার্টিএইট নয়? বিয়াল্লিশ নয়? ফর্টিওয়ান?

এই যে, জলটা ধরো।

বেল দিচ্ছে।

কাচের বাইরে স্বরূপ। ভেতরে শাওনি। দেখা যায় না। কাচের গায়ে স্বরূপ নিজেকেই দেখতে পায়। শুকনো চুল। এলোমেলো। উঁচু কলার। কাটা দাগ ভুরুর ওপর। কাচের ভেতরে শাওনি। বাইরে দৃষ্টি। বোঝা যায়, দেখা যায় না। কাচের গায়ে শাওনি নিজেকেই দেখতে পায়। গেরুয়া কাঁধ। রুদ্রাক্ষের গলা, কপালের মাঝখানে কড়া কালো, দু-কানে বাসি রক্তের ফোঁটা। ছটা উনপঞ্চাশ। শতাব্দী এক্সপ্রেস ছাড়ছে। রাইট টাইম। স্বরূপ, স্বরূপ তুমি কি আমাকে ডাকছ? ডাকো স্বরূপ.একবার ডাকার মতো ডাকো…শাওনি, শাওনি তুমি কি ফিরে আসছ? ফেরো শাওনি…একবার ফেরার মতো ফেরো…শতাব্দী এক্সপ্রেস ছেড়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *