লিও টলস্টয় : জীবনবাদী লেখক

লিও টলস্টয় : জীবনবাদী লেখক

এবারে এক অবিশ্বাস্য জীবনকাহিনী শুনুন যা আরব্যউপন্যাসের মতো রোমহর্ষক। এটা হল এমন একজন প্রাতঃস্মরণীয় ও বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব যাকে এক পলক দেখার জন্য, যার গলার সুমিষ্ট স্বরটা একটিবার শোনার জন্য ও তার পোশাকের প্রান্তভাগ একবার ছুঁয়ে দেয়ার জন্য তাঁর অগণিত ভক্তরা তাঁর বাড়িতে অনবরত যাতায়াত করত–তিনি লিও টলস্টল।

তার জীবনকাহিনী যে-কোনো উপন্যাসের মতোই বর্ণাঢ্য। জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিয়াল্লিশ কামরাবিশিষ্ট ঐশ্বর্য পরিবেষ্টিত এক সুরম্য প্রাসাদে। আর লালিতপালিত হয়েছেন প্রাচীন রুশ আভিজাত্যের বিলাসিত পরিবেশে। যৌবনে তিনি ছিলেন একজন বিলাসী যুবক-সুন্দর ভঙ্গিমায় পদচালনা করতেন এবং কথা বলতেন, মস্কোর দর্জির দোকানে অনেক অর্থ খরচ করতেন। যৌবনে মদ খেতেন, মারামারি করতেন, অনেক জঘন্য পাপ কাজ এমনকি খুন-খারাপি করতেন। তাঁর নিজের কথায় একটা নোংরা পাপময় জীবন যাপন করতেন। কিন্তু যিশুর শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে পরবর্তীতে সমস্ত রাশিয়ার খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। যৌবনে তিনি কলেজে অকৃতকার্য হন। এবং তার গৃহশিক্ষকরা তার মাথায় বিদ্যে ঢোকাবার আশা ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনিই ত্রিশ বছর পর পৃথিবীর দুটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়ে গেলেন, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অমরগাথা হয়ে থাকবে। উপন্যাস দুটো হল–ওয়ার এন্ড পিস’, ও ‘এনা কারেনিনা। বন্ধুরা তাঁর বাড়িতে এসে একাধারে দীর্ঘদিন থেকে টলস্টয়ের সব কথা সাঁটলিপিতে লিখে নিত। তাঁর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা সুবিস্তারিতভাবে তারা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীতে এসব বিবরণী বড় বড় পুস্তকাকারে ছাপা হয়েছে।

লিও টলস্টয় এবং তার চিন্তাধারা সম্পর্কে ২৩,০০০ বই এবং সাময়িকী ও খবরের কাগজে ৫৬,০০০ প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তাঁর লেখা গ্রন্থাদির পরিমাণ ছিল একশত খণ্ড।

বিবাহিত জীবনে প্রথম কয়েকটি বছর তিনি ও তার স্ত্রী এত সুখী ছিলেন যে তারা সবসময় নতজানু হয়ে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে আনন্দময় জীবন সুখময় ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতেন। কিন্তু বেশ ক’বছর পরে তারা হয়ে গেলেন চরম অসুখী। তিনি পরে তার স্ত্রীর মুখ দর্শনেও ঘৃণাবোধ

করতেন এবং তার অস্তিম ইচ্ছে ছিল তার স্ত্রীকে যেন তাঁর সামনে আসার অনুমতি না দেয়া হয়।

টলস্টয়ের জীবনটা ছিল একটা ট্রাজেডি আর এই ট্রাজেডির কারণ হল তাঁর স্ত্রী। তাঁর স্ত্রী ধনসম্পদ, খ্যাতি ও বিলাসিতা পছন্দ করতেন কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে ধন-সম্পদ এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল একটা পাপস্বরূপ। তাঁর স্ত্রী বিশ্বাস করতেন শক্তির শাসনে আর তিনি বিশ্বাস করতেন ভালোবাসার শাসনে।

টলস্টয় সাহিত্যসাধনার ক্ষেত্রে প্রাচীন রাশিয়ার জার সম্রাটদের চেয়েও বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস দুটো রচনার জন্য লজ্জিত হয়েছিলেন এবং অবশিষ্ট জীবন শান্তি, ভালোবাসা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে বাণীপূর্ণ পুস্তিকা প্রণয়নের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। পুস্তিকাগুলো সুলভ সংস্করণে ছাপানো হয়েছিল এবং গরুর গাড়ি ও রেলগাড়িতে করে বয়ে নিয়ে ঘরে-ঘরে বিক্রি করা হয়েছিল। এ-সব পুস্তিকা চার বছরে ১,২০,০০,০০০ কপি বিক্রি ও বিতরণ করা হয়।

বয়সকালে টলস্টয় একজন সাধারণ কৃষকের মতোই সাদাসিধে কাপড় পড়তেন। নিজ হাতে নিজের জুতো তৈরি ও বিছানাপত্র সাজাতেন, ঘরদোর ঝাঁট দিতেন এবং একটা সাধারণ ও আবরণহীন টেবিলে কাঠের বাসন থেকে কাঠের চামচ দিয়ে খাবার তুলে খেতেন।

টলস্টয়ের বয়স যখন বিরাশি তখন ঘরের করুণ অশান্তি আর সহ্য করতে না পেরে এক বুক জ্বালা নিয়ে হতাশ মনে ১৯১০ সালের ২১শে অক্টোবর রাত্রিবেলায় স্ত্রীর কাছ থেকে অন্ধকার ও প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পালিয়ে এলেন। তার এগারোদিন পরে এক রেল স্টেশনের একটি ছোট কামরায় তিনি নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন কৃষক পরিবেষ্টিত হয়ে। মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর সব কিছুর ব্যবস্থা করবেন।‘ তাঁর শেষ বাক্য ছিল, ‘সবসময় কেবল খুঁজেছি।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *