1 of 2

রাগ অনুরাগ – শক্তিপদ রাজগুরু

রাগ অনুরাগ
শক্তিপদ রাজগুরু

হরিমাধব বাবুর এমনিতে বেশ সাজানো সংসার। দুই ছেলেও কৃতি। একজন কোন কলেজের অধ্যাপক, ছোট ছেলে এলাকার নামী ডাক্তার, ভালো পোর।

হরিমাধব বাবু নিজে এখানের বারের নামকরা উকিল। নিজের চেম্বার এদিকে। মক্কেলের ভিড় লেগেই আছে।

ফৌজদারী কেসের বিশেষজ্ঞ। ফাঁসির আসামীকে তার সাওয়াল জবাব আর নিপুণভাবে সাক্ষীকে পড়ানোর জন্য তিনি খালাশ করে আনতে পারেন এটা বেশ কয়েকবারই দেখেছে অনেকে।

এজলাসে দাঁড়ালে তরুণ হাকিমরা হরিমাধবকে সমীহ করেন। ভরাটি কণ্ঠস্বর, ইয়া গোল মুখে একজোড়া পুষ্ট বিড়ালের ল্যাজের মত গোঁফ, তার কণ্ঠস্বর গম গম করে এজলাস।

আদালতে তিনি যেন রয়েল বেঙ্গল টাইগার। চেম্বারেও সেই মূর্তি।

মক্কেল এসেছে চারাভাঙ্গানীর মামলা করতে অন্য পক্ষের নামে। তার ভাইপো নাকি জোর করে কাকার জমি দখল করতে চায়। তার রোয়া ধানগাছগুলি তছনছ করে গেছে। তাই ভাইপোর নামে মামলা করতে এসেছে শশী মোড়ল, বলে, ভাইপোকে ফাটকে পুরতে হবে উকিল বাবু। এই দুশো টাকা আগাম রাখেন, ভাইপোকে ফাটকে পুরতে পারলে আরও পাঁচশো–

তারপরই হরিমাধব বলে–ভাইপোকে ফাটকে পুরতে হবে? তাহলে এদিকে আয়–আয়।

শশী মোড়ল উকিলবাবুর ডাকে এগিয়ে আসতেই এবার উকিলবাবু টেবিল থেকে জম্পেশ রুল কাঠটা তুলে নিয়ে শশীর কপালেই এক মোক্ষম ঘা মারতে শশী আর্তনাদ করে বসে পড়ে কপলে হাত দিয়ে, আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছে টোপ টোপ করে।

নিজের হাতের এহেন কাজ বেশ মনদিয়ে দেখছে হরিমাধব।

শশী বলে, মারলেন, কপাল ফাটিয়ে রক্তপাত ঘটালেন কেন? কি করেছি?

—চোপ! হরিমাধব গোঁফ নেড়ে ধমকালেন—চোপ।

তোর মামলা পাকা করার জন্যই এটা করেছি। ওহে মুহুরী।

নিবারণ মুন্ত্রী জানে এরপর তার ডাক পড়বে। সে জানে তারও কিঞ্চিৎ আমদানী হবে। সে জানে কি করতে হবে এরপর। কারণ ফৌজদারী মামলা সাজাবার জন্য উকিলবাবু এসব কাজ করেন। নিবারণ বলে একে থানায় নে গিয়ে ডাইরী করিয়ে আনবো?

—উকিলবাবু বলেন শশী, একটা মিথ্যা সাক্ষীও আমি যোগাড় করে দোব— খরচা দিয়ে যাও থানায় ডাইরী করিয়ে এসো।

রক্তপাত-হত্যার চেষ্টা একবার উল্লেখ থাকলে তোমার ভাইপোকে হাজতে পোরা যাবে না। এবার সব ঠিক করে দিয়েছি। ফাটকে পুরছি তোমার ভাইপোকে।

আর হরিমাধব উকিল তাই করেছে। তিনচারজন জুনিয়ার উকিল আদালত বাড়ির চেম্বারে নথিপত্র নিয়ে হরিমাধবের নোট নেয়। মামলা সাজায়। সাক্ষীদের তালিম দেয় কি কি বলে যেতে হবে দিনকে রাত করার জন্য।

বিপক্ষের উকিলদের আনা সাক্ষীদের জেরার মুখে ধমক দিয়ে হরিমাধব ওদের সবকথাকে তাল গোল পাকিয়ে দেয়।

মামলা উলটে দেয়, হুঙ্কার আর ধমকে হরিমাধব উকিল।

কিন্তু এহেন পুরুষ সিংহ বাড়িতে গিন্নী হরিপ্রিয়ার কাছে একেবারে কেঁচো। হরিপ্রিয়ার বাবা মুর্শিদাবাদের কোন গ্রামের জমিদার। বিশাল চকমেলানো বাড়ি দেউড়ি, ঠাকুর দালান, কাছারিমহল, বাড়িতে জুড়ি গাড়ি সবই ছিল।

বাবার আব্দারে মেয়ে ছোট ভাইএর চেয়ে তার আব্দারই বেশী। জমিদার বাবু দেখে শুনে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।

হরিমাধবের বাবাও ছিলেন জমিদার। তবে হরিমাধব কলেজে পড়ে এখন নামকরা উকিল।

জমিদারী চলে গেছে, হরিপ্রিয়ার ছোট ভাই এখন ধানকল করে ভালো ব্যবসা করছে তবে জমিদারী না থাকায়ও জমিদারী মেজাজটা রয়ে গেছে হরিমাধবের শালা বাবুর। রয়েছে দাপটও।

তার তুলনায় হরিমাধব বাড়িতে নিরীহ নিপাট একটি মানুষ, আর সেটা হয়েছে ওই স্ত্রী হরিপ্রিয়ার দাপটেই। জমিদারী মেজাজ তার।

দশাসই চেহারা, এককালে সুন্দরীই ছিল, ফর্সা গায়ের রং। সেই সুন্দরী মেয়েটি এখন যেন দারোগা। হাকিম সামলাতে জানে হরিমাধব কিন্তু দারোগা সামলাতে অক্ষম, বিশেষ করে বাড়ির এই দারোগাকে।

হরিমাধব বিকালে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি ঢুকছে। উঠোনে কলতলায় কাজের মেয়ে সাবিত্রী একরাশ বাসন নিয়ে মাজতে বসেছে। বাড়ি ঢুকে হরিমাধব নিচে দাঁড়িয়েছে উপর থেকে হরিপ্রিয়ার চড়া গলা শোনা যায়।

ওখানে দাঁড়িয়ে কি হচ্ছে? উঠে এসো! এসো!

হরিমাধব বাবুর মেজাজ চড়ে ওঠে। আদালতে আজকে হাকিমের এজলাসে বেশ তর্ক হয়েছে একটা ল’পয়েন্ট নিয়ে মন মেজাজ ভালো নেই।

গিন্নীর এই হাকডাকে বলে হরিমাধব— যাচ্ছি।

—উঠে এসো, এক্ষুনিই।

হরিমাধব বাবু জুতো খুলে উঠে গেলেন দোতালার ওদিকের ঘরে। গিন্নীর হাকডাকে ওদিকে বড় বৌ শেফালী আর বড় ছেলে চাইল। শেফালী স্বামীকে বলে—এত খোঁজ করে এই কাজের মেয়েটিকে আনলাম বাবার বাড়ি থেকে মা এবার একেও তাড়াবে। কি সন্দেহ বাতিক যে মায়ের।

হরিমাধবের বড় ছেলে অধ্যাপক মধুসূদন পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে বলে— তাই দেখছি। মায়ের কি যে রোগ।

ওদিকে ছোট বৌও দেখেছে ব্যাপারটা। তার ডাক্তার স্বামী চেম্বারে যাবার জন্য পোষাক বদলাচ্ছিল সে বলে–মায়ের এটা একটা মানসিক রোগ। ছোট বৌ আইভি স্বামীকে বলে মায়ের রোগ আবার তোমার মধ্যে সংক্রামিত হয়নি তো? দেখো বাপু?

ডাক্তার হরগোবিন্দ স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে বলে–সে ভয় তোমার নেই।

আইভি বলে একটা কিছু না করলে বাড়িতে কাজের মেয়েতো থাকবে না। মায়ের একি বিশ্রী রোগ। তুমি তো ডাক্তার, দ্যাখনা ওষুধপত্র দিয়ে।

হরগোবিন্দ বলে— এরোগ সারানোর ক্ষমতা বাবা মহাদেবেরও নাই। আমি তো তুচ্ছ।

ওদিকে হরিমাধব তখন গিন্নীর জেরায় জেরবার। হরিপ্রিয়া মুখে পানের উপর একছিটে খুসবুদার জরদা ছিটিয়ে জেরা করে।

উঠানে হা করে ওই সাবিত্রীর দিকে চেয়েছিলে কেন?

হরিমাধব দেখেছে, ছোটছেলের গাড়ি রয়েছে, বড় ছেলেও ফিরেছে কলেজ থেকে। বৌমারাও রয়েছে।

হরিমাধব বলে স্ত্রীকে আস্তে, কি যা তা বলছ। ছেলে-বৌমারা রয়েছে শুনতে পাবে।

হরিপ্রিয়া খাটে গদিয়ান হয়ে গলা আরও চড়িয়ে বলে–শুনুক। ওদের বাপের গুণের কথা শুনুক। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে–এখনও ছোঁক ছোঁক স্বভাব গেল না। স্বভাব যায় না মলে, ইন্নৎ যায় না ধুলে।

হরিমাধব চাপা স্বরে বলে কি হচ্ছে। জুতো খুলছিলাম নীচে ফিতে খুলতে দেরী হচ্ছিল।

থাক। আর সাফাই গাইতে হবে না। শেষ বারের মত বলে দিলাম এদিক ওদিক চাইবে না।

তারপর গলা তুলে হাক পাড়ে কাজের মেয়ের উদ্দেশ্যে—এই সাবিত্রী, বাসন মাজা হলে রান্নাঘরে গিয়ে আনাজ কোট গে।

অর্থাৎ হরিমাধব এবার চা খেয়ে চেম্বারে নামবে তার আগেই সাবিত্রীকে উঠান থেকে সরিয়ে দেবার কথাই বলা হলো।

হরিমাধবের বয়স এখন ষাট পার হয়েছে। ওর নামে শত্রুতেও কোনদিন কলঙ্ক, অপবাদ দিতে পারেনি। চরিত্রবান সৎ মানুষ।

ভোরে উঠে স্নান করে গুরুবন্দনা পূজা গীতাপাঠ করেন, সন্ধাতেও আধঘণ্টা গুরুপূজা ভজন করে চেম্বারে নামেন।

বাকী সময় কাটে মক্কেল, কেস কাবারি আর আদালত নিয়েই।

তবু গিন্নীর চোখে তার মত ভ্রষ্ট পুরুষ আর যেন কেউই নেই। ফিরতে দেরী হলে কৈফিয়ৎ চায় হরিপ্রিয়া কোথায় ছিলে এতক্ষণ।

হরিমাধব বলে এজলাসে দেরী হয়ে গেল।

—এজলাস? না অন্য কোন মহিলা মক্কেলের বাড়িতে? শুধচ্ছি নিবারণকে?

হরিমাধব বলে— দোহাই তোমার, এসব ছাড়োতো? কি যে ভাবো? ছিঃ ছিঃ এসব কথা বলতে বাধে না।

–বাধবে কেন? তোমাকে বিশ্বাস নাই।

.

এই নিয়ে বৌদের মধ্যেও হাসাহাসি হয়।

—কি কাণ্ড।

ছেলেরা বলে কাজের মেয়েটা আছে তো? মা যা শুরু করেছে আবার।

হরিমাধব বাবুর উপর গিন্নীর কড়া নজর। রাতে হরিমাধব বাবু কোনদিন বাথরুমে যাবেন। হরিপ্রিয়ার ঘুমও সজাগ, দেখে কর্তা ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে বের হয়ে যাচ্ছে।

হরিপ্রিয়ার মনে হয় নিশ্চয়ই ওর মতলব ভালো নয়। সেও পা টিপে টিপে কর্তার পিছু পিছু বের হয়ে আসে। এবার হাতেনাতে কর্তার কুকীর্তি ধরবে।

সেকেলে আমলের বিরাট বাড়ি। দোতালার বাথরুম বারান্দার ওদিকে। হরিমাধব বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে। দেখে থামের আড়ালে গিন্নী সজাগ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

—তুমি!

হরিপ্রিয়া বলে–বাথরুম যাবে, বলে যাবে তো। রাতদুপুরে কোথায় যাচ্ছো দেখব না? সেই ফাঁকে দেখে হরিপ্রিয়া একতলায় নামার গেটটা সঠিক তালাবন্ধই রয়েছে। ঝি চাকররা অবশ্য একতলাতে থাকে রাতে।

হরিমাধব বলে— এত ঠাকুর নাম করো মনের এই ময়লা বু মুছতে পারলেনা।

এই নিয়েই অশান্তি বাড়িতে। হরিমাধব যেন বাড়ির ছেলে বৌদের সামনে একটা ক্লাউনে পরিণত হয়েছে।

হরিমাধবের ব্যাপারটা ক্রমশঃ অসহ্য হয়ে ওঠে। হরিমাধবের নীচের তলায় নামার সময় হরিপ্রিয়াও নেমে আসে বাতের শরীর নিয়ে।

চেম্বারে ঢুকিয়ে তবে উপরে উঠে যায় হরিপ্রিয়া। খবরটা দুচারজন মক্কেলও জেনে ফেলে।

.

সেদিন হরিমাধবের শ্যালক জমিদার তনয় এসেছে হরিমাধবের বাড়িতে। হরিপ্রিয়াও ভাইকে পেয়ে খুশী।

হরিমাধবের অনেক দিনের বন্ধু ও শ্যালক। কমলবাবু রসিক ব্যক্তি। সন্ধার পর তার একটু পানদোষএর অভ্যাস আছে। জমিদারী চলে গেলেও সেই অভ্যাসটা বজায় রেখেছে কমলবাবু।

হরিমাধব নিজে ওসব খায় না। নিষ্ঠাবান ব্যক্তি সে, তবু শ্যালকের জন্য বিলাতী মদ কাজু বাদাম, কাটলেট এসব আনিয়েছে।

হরিমাধব কমলকেই পেয়ে আজ বলে হরিপ্রিয়ার ওই সন্দেহ বাতিকের কথাটা। বলে তোমার দিদি তো আমার মানসম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দেবে ঘরে বাইরে। যা সন্দেহ বাতিক ওর।

কমল তখন সবে গ্লাসে চুমুক দিয়েছে। সে কথাটা শুনে বলে–সেকি! তুমি তো একদম নিরিমিস্যি লোক, মদ মেয়েছেলে কোন বাতিকই নেই, তোমাকে সন্দেহ করে দিদি!

–সন্দেহ বলে সন্দেহ, ছেলে বৌদের সামনে যা তা বলে? লজ্জায় মাথা কাটা যায়। বাড়ির কাজের মেয়ে—

ওই বুড়িকে নিয়ে সন্দেহ। হেসে ওঠে কমল।

হরিমাধব বলে তুমি হাসছ! এদিকে আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে। এক এক সময় মনে হয় সংসার ছেড়েই কোথায় চলে যাই। যেদিকে দুচোখ যায়।

কমল বলে–জল অনেক দূর গড়িয়েছে দেখছি। এক কাজ করতে পারো? ফল হবে।

—কি! হরিমাধব আশান্বিত হয়ে শুধোয় সেই পরিত্রাণের পথের কথাটা। কমল গলায় এক ঢোক মদ ঢেলে বলে— একদিন আচ্ছাসে প্রহার করো। বেদম প্রহার দেখবে মারের চোটে ওই সন্দেহের ভূত কোনদিকে পালাবে।

আমি শুধু এদিক ওদিক করি হরিমদা, এই নিয়ে কথা বলতে দিলাম মুষ্টিযোগ প্রয়োগ করে একদিন। ব্যস তারপর থেকে ঠাণ্ডা। তাই বলছি— হরিদা, তুমিও একদিন মুষ্টিযোগ দিয়ে দাও দিদিকে বেশ কড়া ডোজেই দেবে।

হরিমাধব শ্যালকের এহেন পরামর্শে চমকে ওঠেন, বলছ কি হে নীলকমল। এ্যা নিজের স্ত্রীকে প্রহার মারধোর করতে হবে। ছেলেরা বড় হয়েছে বৌমা, নাতি-পুতি রয়েছে। কি ভাববে তারা? নানা এ হতে পারে না। পাঁচজন শুনলে কি বলবে? ছিঃ ছিঃ করবে যে।

কমল মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বিজ্ঞের মত রায় দেয় তাহলে তোমার বাঁচার পথ আর নাই। ওই সব পাঁচালী শুনে যাও। তোমাকে বাঁচার আর কোন পথই দেখি না।

কমল বেশ কৃতি পুরুষ। ব্যবসাতে ভালো করছে। নানা জনকে চরিয়ে খায়। সদরের নেতাদেরও সকলে কমলবাবুকে সম্মান করে। তার কাছে নানা পরামর্শ নিতে আসে আপদে বিপদে।

হরিমাধব বলে— কমল তোমার মাথায় অনেক রকম মতলব খেলে শুনেছি। আমাকে পরিত্রাণের এক পথ বাতলাও ভায়া। নাহলে শেষ মেষ সংসার ছেড়েই চলে যাবো কোথাও।

কমল তখন কয়েক পেগ চড়িয়েছে। নেশাটা গোলাবী রং ধরেছে। কমলের মাথায় এবার আইডিয়াটা আসে। বলে সেহরিদা, একটা পথ আছে।

মারধোর করতে হবে না তো? হরিমাধব ওইসব অপ্রিয় কাজ করতে পারবে না। তাই ওই কথা বলে।

না না, এ একেবারে অন্য পথ। ঠিকমত চাল দিতে পারলে দিদি একেবারে মাৎ হয়ে যাবে। তোমার পূজার ছুটেতে কোর্ট কতদিন বন্ধ থাকে।

—তা ধরো মাসখানেক। হরিমাধব জানায়।

-তাহলে ক’টা দিন মুখ বুজে দিদির থ্যাতলানি খাও। তারপরই ব্যস। কুমোরের ঠুকঠুক, কামারের এক ঘা। একেবারে মোক্ষম ঘা।

—তা কি করতে হবে বলবে তো। হরিমাধব শুধোয়।

কমল বলে, সময়েই বলবো।

.

হরিমাধবের জীবন যেন বিষিয়ে উঠেছে গিন্নীর ওই বাতিকে। সাবিত্রীর কাজ চলে গেছে ছেলেরা কদিন চেষ্টা করে ছোট বৌ-এর গ্রাম থেকে এক বয়স্কা বিধবাকে এনেছে কাজের জন্য। ছোট ছেলে মাকে বলে— সারা পাড়ার লোক, কাজের লোকেরা জেনে গেছে তোমার কথা। আর পাগলামী কোরো না।

হরিপ্রিয়া বলে— তোরা আমার দোষই দেখলি, তোদের বাপ! তার গুণের কথা জানিস? আদালতে এক মানুষ আর ঘরে পাড়ায় নজর দোষ গেল না।

ছেলে সরে পড়ে। বৌরা আড়ালে হাসাহাসি করে। হরিমাধববাবু সেদিন না খেয়েই আদালতে চলে যান। কাজে মন লাগে না। পূজার ছুটিও পড়ে গেল।

রাতের বেলায় উঠে বাথরুম যাবেন, দেখেন তার ধুতির সঙ্গে গিন্নী জম্পেশ করে শাড়ির আঁচল বেঁধে রেখেছে। অর্থাৎ হরিমাধব বাবুকে যেন বেঁধে রাখা হয়েছে। গিন্নীও জেগে গেছে। শুধোয় কোথায় যাওয়া হচ্ছে চুপে চুপে। এা নতুন মেয়েটার দিকে নজর পড়েছে এর মধ্যে।

—থামবে।

—কেন থামবো। হরিপ্রিয়াও গর্জে ওঠে।

ছেলে বৌমা জেগে গেছে। বড় ছেলে বলে মা কি পাগল হয়ে গেল। ছোট বউ বলে ডাক্তারকে কি ব্যাপার গো! রাত দুপুরেও বুড়োবুড়ির নাটক।

হরিমাধব বাবু চুপ করে যান। অবশ্য হরিপ্রিয়া তখনও গজগজ করছে, স্বভাব যায় না মলে, ইৎ যায় না ধুলে।

হরিমাধবের মনে পড়ে এবার কমলের কথাগুলো। এবার সেও তৈরী।

পুজো আসছে। বাড়িতে সমারোহ শুরু হয়েছে, হঠাৎ সকাল থেকে হরিমাধবকে পাওয়া যাচ্ছে না। আদালত বন্ধ। কিন্তু লোকটা গেল কোথায়?

হরিপ্রিয়াও ভাবনায় পড়ে। বলা নাই কওয়া নাই পুজার মুখেই লোকটা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

বড় ছেলে, বড় বৌমা, ছোট ছেলে, ছোট বৌমা এবার মাকেই দায়ী করে।

লোকটা শিবের মত সৎ, দিনরাত খেটেছে পয়সা এনেছে তাদের মানুষ করেছে, আর মা তুমি সেই সম্মানীয় লোকটাকে দিনরাত শুধু শাসন করেছে আর যা তা কথা বলেছো। ছোট ছেলে জানায়।

সারা শহরের মানী লোকটাকে তুমি পদে পদে অপমান করেছে। আর তাই অতিষ্ঠ হয়ে লোকটা ঘর ছেড়েই চলে গেল।

পুজো এসেছে, হরিপ্রিয়া এখন একেবারে নীরব। বাড়িতে যত ঝগড়া হোত তার স্বামীর সঙ্গেই। আজ সেই লোকটা নেই। উৎসব আনন্দের দিনে কোথায় রইল কে জানে।

অবশ্য ছেলেরা পরামর্শ করে অন্যদের জানিয়েছে বাবা কেদারবদরী গেছেন। তারা আসল খবরটা জানে না।

হরিপ্রিয়া নাওয়া খাওয়া ছেড়ে এবার চোখের জলই ফেলে, মানুষটাকে হারিয়ে আজ বুঝেছে যে সত্যিই স্বামীকে সে অকারণে লাঞ্ছনা অপমানই করেছে। এবার দেবতার চরণে মাথা ঠোকে মানুষটাকে ফিরিয়ে এনে দাও ঠাকুর।

কিন্তু পূজা কেটে গেল হরিমাধবের কোন খবর নাই। ছেলেরাও ভাবনায় পড়ে।

কোন বিপদ আপদ হল কিনা বাবার কে জানে।

হরিপ্রিয়া কদিনেই আধখানা হয়ে গেছে আর কথা বলে না সে। শুধু চোখের জল ফেলে ঠাকুর দেবতার পায়ে মাথা ঠোকে। কিন্তু হরিমাধবের দেখা নাই।

কমল এখবর পেয়ে আসে দিদির কাছে। দিদির সেই তেজ দাপট আর নাই। এখন সব ঠাণ্ডা। ভাইকে দেখে বলে আমার কি সর্বনাশ হলরে। লোকটা বিবাগী হয়ে গেল। কোথায় গেল।

কমল বলে, তোমারই সন্দেহ বাতিকের জন্যই সংসার ছেড়ে চলে গেছে। গুরুদেবের আশ্রমে খবর নিয়েছো?

—হ্যারে। সেখানেও যায়নি।

—তাহলে গেল কোথায়? কমল ভাবছে।

হরিপ্রিয়া বলে আমারই দোষ। যাতা বলেছি ওকে আর কোন দিন ওসব কথা বলব না। তুই লোকটাকে খোঁজ কমল।

কমল বলে–কাশীপুর শ্মশানে অনেক বড় সাধু আসে। তারা ভূত ভবিষ্যৎ সব জানে।

—সেখানেই নিয়ে চল। যদি তাঁরা ওর সন্ধান দিতে পারে। চল ভাই। হরিপ্রিয়া এখন অন্য মানুষ।

কমল বলে সেখানে গিয়ে কি পাবে তাকে। তা এতকরে বলছ, কাল সকালে গাড়ি পাঠাবো, যাবে।

কমল বাড়ি ফিরে দেখে হরিমাধব কাগজ পড়ছে তার বাগান বাড়িতে। হরিমাধব কমলকে দেখে বলে ও বাড়ির কি খবর হে, তোমার দিদি।

একেবারে নেতিয়ে পড়েছে ঠাকরুণ। মনে হয় ওষুধ ধরেছে।

হরিমাধব বলে, এভাবে আর তোমার বাগান বাড়িতে কদিন গাঢাকা দিয়ে থাকবো?

কমল বলে— ওই তোমার দোষ, বিয়ের পয়লারাতে বৌ-এর কাছে হম্বিতম্বি দেখাতে পারেনি আমার মত, তাই ভুগছ। এবার একটা দিন বেশ জমিয়ে অভিনয় করতে হবে ব্যস। তাহলেই কিস্তি মাৎ।

অভিনয় করতে হবে?

কমল বলে–বার লাইব্রেরির নাটকে বাল্মিকী, বিশ্বামিত্রের পার্ট তোমার একচেটিয়াকাল কাশীপুরের শ্মশানে সাধুর রোল করতে হবে। লাস্ট সিন। মেকআপ করার লোকও এনেছি। যা যা বলবো করে যাও। ব্যস তারপর দেখবে আমার দিদি ইয়োর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট।

হরিপ্রিয়া ব্যাকুল হয়ে এসেছে কমলের এখানে।

কমল বলে চলো মহাশ্মশানে। শ্মশানে এক নতুন সাধু এসেছেন। কে জানে হরিদা মনের দুঃখে সন্ন্যাসী হয়ে গেল কি না।

ওকথা বলিসনি কমল। তার কিসের দুঃখ যে সন্ন্যাসী হবে।

কমল বলে–মনের দুঃখে। দুঃখ তত তুমি তাকে কম দাওনি।

আর ও বলিস না। আমার রে শিক্ষা হয়েছে। চল যদি সন্ধান পাই তার।

.

কাশীপুর শ্মশানে একটা নদীর ধারে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে রয়েছে শিরিষ, শেওড়া, নিম, আকাশমণি আর নিচে ঘন লতার জঙ্গল। ওরই এখানে ওখানে দু’একজন সাধু ধ্যানস্থ হয়ে রয়েছে। হরিপ্রিয়ার দামী শাড়ি ধূলায় লুটোচ্ছে। কাটা ঝোঁপ আকন্দ বনের ভিতরে সে খুঁজছে একজনকে ব্যাকুল ভাবে।

।কমল অবশ্য স্টেজ রেডিকরে রেখেছিল। সকালে হরিমাধবকে মেকআপ দিয়ে এখানে একটা বড় শেওড়া গাছের নীচে চালা করে বসিয়ে দিয়ে গেছে।

ইয়া দাড়ি, পরণে রক্তাম্বর গলায় অনেক হাবি জাবি মালা গায়ে ছাইও মাখানো। হরিমাধবের দাড়ি কুটকুট করছে। হঠাৎ হরিপ্রিয়াকে দেখে চাইল।

হরিপ্রিয়া দেখেই চিনেছে। পিছনে কমল। হরিপ্রিয়া এসে পায়ে লুটিয়ে পড়ে কান্না ভিজে গলায় বলে একি হাল হয়েছে তোমার? এই শেওড়া গাস্ত্রে নীচে বসে আছো নিজের ঘর সংসার ছেড়ে। ওগো ঘাট হয়েছে বাড়ি চলো।

হরিমাধব এবার বাল্মিকীর সেই ডায়লগ বলে–সংসার! ওসব মায়া। অনিত্য। সেই মায়ার সংসার ছেড়ে মহামায়ার কৃপালাভের জন্যই এখানে এসেছি। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।

—ছেলেরা বৌমারা কত ভাবছে তোমার জন্যে দাদুভাই কত কাঁদছে।

—দুদিন কাঁদবে তারপর ভুলে যাবে। একবার যখন অনিত্যকে ছেড়ে এসেছি আর ওখানে যাবো না। ওঁ হরি ওম বলে হরিমাধব নীরব হয়ে যায়। যেন সমাধি লাভই করেছে।

হরিপ্রিয়া এবার পায়ে মাথা ঠোকে। আমার ঘাট হয়েছে, আর ওসব পাপ কথা কোনদিন মুখে আনবো না। তোমার পা ছুঁয়ে বলছি ওগো ঘরে চলল। তপস্যা সেখানেই করবে। কাজকর্ম করবে, এও করবে শান্তিতে আমি কোন কথা বলব না আর। পোড়া জিব আমার খসে যাবে।

কমল বলে হরিদা, দিদি এতকরে বলছে ঘরেই চলুন সংসারই তো স্বর্গ, ঘরই তো মন্দির।

হরিমাধব বলে–তুমি বলছ কমল? শেষে আবার সেই অশান্তি।

হরিপ্রিয়া বলে–তোমার পা ছুঁয়ে বলছি, আমার ভুল ভেঙ্গেছে। যে এককথায় ঘর সংসার ছাড়তে পারে তার মনে কোন পাপ নেই। তুমি ঘরে চলো।

হরিমাধব অস্ফুট স্বরে বলে–হরি ওম্ ঔৎ সৎ চলো।

তবে কথার খেলাপ হলে এবার হিমালয়ে চলে যাবো।

কমল বলে দিদি তুমি বাড়িতে যাও। আমি হরিদার দাড়িফাড়ি কাটিয়ে ধাপ দুরস্ত করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

যদি না যায়! হরিপ্রিয়া বলে।

কমল বলে আমি তো আছি, ওকে নিয়েই বাড়ি ফিরবো। ভয় নেই।

পাড়ার সকলে জানে হরিমাধব কেদারবদরী থেকে ফিরেছে। বাড়িতে আজ আনন্দের পরিবেশ। সন্ধ্যায় কমল আজ বেলাতী মদ নিয়ে এসেছে। হরিমাধব কাটলেট খাচ্ছে। কমল বলে— ক্যামন বুঝছে হরিদা।

হরিমাধব বলে— অল কোয়ায়েট ইন দি হোম ফ্রন্ট। তোমার দিদি এখন একেবারে অন্য মানুষ হে। আর কোন কথা নাই। বেশ শান্তিতে কাজটা হয়েছে ঘরেও শান্তি নেমেছে।

কমল বলে তাহলে আমার এলেম আছে বলল। হরিমাধব আজ কমলের কেরামতিকে অস্বীকার করতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *